Recent Posts

Pages: [1] 2 3 ... 10
1
আলহামদু লিল্লাহ.
উসুলুল ফিকহ এর পরিভাষায় শর্ত হলো: “যার শূন্যতা শূন্যতাকে আবশ্যক করে; কিন্তু যার অস্তিত্ব অস্তিত্বকে আবশ্যক করে না।” তাই নামায শুদ্ধ হওয়ার শর্তগুলো হলো: যেগুলোর ওপর নামায শুদ্ধ হওয়া নির্ভর করে। অর্থাৎ যদি এই শর্তগুলোর কোন একটি বাদ পড়ে তাহলে নামায সহিহ নয়। সেগুলো হচ্ছে:

প্রথম শর্ত: নামাযের ওয়াক্ত বা সময় হওয়া। এটি সর্বাধিক গুরুত্বপূর্ণ শর্ত। আলেমদের ইজমার ভিত্তিতে ওয়াক্ত প্রবেশের পূর্বে নামায আদায় করা সহিহ নয়। যেহেতু আল্লাহ্‌ তাআলা বলেন: “নির্ধারিত সময়ে সালাত কায়েম করা মুমিনদের উপর অবশ্য কর্তব্য।” [সূরা নিসা, আয়াত: ১০৩]

কুরআনে কারীমে নামাযের সময়সূচী এজমালিভাবে আল্লাহ্‌ তাআলা উল্লেখ করেছেন। তিনি বলেন: “সূর্য হেলে পড়ার পর থেকে রাতের ঘন অন্ধকার পর্যন্ত সালাত কায়েম করুন এবং (কায়েম করুন) ফজরের কুরআন (সালাত)। নিশ্চয় ফজরের কুরআন (সালাত) উপস্থিতির সময়।” [সূরা বনী ইসরাইল, আয়াত: ৭৮]

আয়াতে কারীমাতে لِدُلُوكِ الشَّمْسِ দ্বারা উদ্দেশ্য হচ্ছে- সূর্য মধ্যাকাশ থেকে হেলে পড়া। আর إِلَى غَسَقِ اللَّيْلِ দ্বারা উদ্দেশ্য হচ্ছে- মধ্যরাত হওয়া। মধ্যাহ্ণ থেকে মধ্যরাত পর্যন্ত সময়টুকু যোহর, আসর, মাগরিব ও এশা-এ চার ওয়াক্ত নামাযের সময়কে অন্তর্ভুক্ত করে। নবী সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম তাঁর সুন্নাহতে বিস্তারিতভাবে এ সময়সূচী বর্ণনা করেছেন। পাঁচ ওয়াক্ত সালাতের সময়সূচী প্রশ্নোত্তরে সে ব্যাপারে আলোকপাত করা হয়েছে।

দ্বিতীয় শর্ত: সতর ঢাকা। যে ব্যক্তি নামায পড়লেন; অথচ তার সতর উন্মুক্ত তার নামায সহিহ নয়। যেহেতু আল্লাহ্‌ তাআলা বলেন: “হে বনী আদম! প্রত্যেক সালাতের সময় তোমরা সুন্দর পোশাক গ্রহণ কর।” [সূরা আরাফ, আয়াত: ৩১]

ইবনে আব্দুল বার্‌র (রহঃ) বলেন: যে ব্যক্তি নিজেকে আচ্ছাদিত করার মত পোশাক সংগ্রহের সাধ্য থাকা সত্ত্বেও পোশাক ত্যাগ করে উলঙ্গ হয়ে নামায পড়েছে; তার নামায বাতিল মর্মে আলেমদের ইজমা সংঘটিত হয়েছে।[সমাপ্ত]

নামাযীর সতরের স্তরভেদ রয়েছে:

১. লঘু সতর: এটি হচ্ছে সাত বছর থেকে দশ বছর বয়সী পুরুষের সতর। তার সতর হচ্ছে লজ্জাস্থানদ্বয়: সামনের লজ্ঞাস্থান ও পেছনের লজ্জাস্থান।

২. মধ্যম সতর: দশ বছর ও তদূর্ধ্ব বছর বয়সীর সতর: নাভী ও হাঁটুর মধ্যবর্তী স্থানটুকু।

৩. গুরু সতর: প্রাপ্ত বয়স্ক স্বাধীন নারীর নামাযের সতর: কেবল চেহারা ও হাতের কব্জিদ্বয় ছাড়া নারীর গোটা দেহ। আর পাদ্বয় প্রকাশ হওয়ার ব্যাপারে আলেমদের মতভেদ রয়েছে।

তৃতীয় ও চতুর্থ শর্ত: পবিত্রতা। পবিত্রতা দুই প্রকার: হাদাছ (নাপাক অবস্থা) থেকে পবিত্রতা এবং নাজাস (নাপাক বস্তু) থেকে পবিত্রতা।

১. গুরু হাদাছ ও লঘু হাদাছ থেকে পবিত্রতা। যে ব্যক্তি হাদাছগ্রস্ত (যে ব্যক্তির ওযু নেই) অবস্থায় নামায পড়ে আলেমদের ইজমার ভিত্তিতে তার নামায সঠিক নয়। আবু হুরায়রা (রাঃ) নবী সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম থেকে বর্ণনা করেন যে, তিনি বলেন: ‘তোমাদের কারো ওযু ভঙ্গ হলে; ওযু না-করা অবধি আল্লাহ্‌ তার নামায কবুল করেন না।‘ [সহহি বুখারী (৬৯৫৪)]

২. নাজাস থেকে পবিত্রতা। যে ব্যক্তি জেনেশুনে, স্মরণ থাকা অবস্থায় কোন নাপাকি নিয়ে নামায পড়ে তার নামায সহিহ নয়। নামাযীর জন্য তিনটি স্থানের নাপাকি দূর করা আবশ্যক:

প্রথম স্থান: নিজ দেহ। তাই নামাযীর দেহে কোন নাপাকি থাকতে পারবে না। এর সপক্ষে প্রমাণ রয়েছে ইবনে আব্বাস (রাঃ) এর হাদিসে তিনি বলেন: ‘নবী সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম দু’টি কবরের পাশ দিয়ে যাচ্ছিলেন। তখন তিনি বললেন নিশ্চয় এ দু’জনকে শাস্তি দেয়া হচ্ছে। তবে কোন কবিরা গুনাহর কারণে তাদেরকে শাস্তি দেয়া হচ্ছে না। তাদের একজন চোখলখুরী করে বেড়াত। অপরজন পেশাব থেকে নিজেকে পবিত্র রাখত না…।’ [সহিহ মুসলিম (২৯২)]

দ্বিতীয় স্থান: পোশাক। এর সপক্ষে প্রমাণ রয়েছে আসমা বিনতে আবু বকর (রাঃ) এর হাদিসে তিনি বলেন: “একবার এক নারী নবী সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লামের কাছে এসে বলল: ‘আমাদের কেউ যখন তার পোশাকে হায়েযগ্রস্ত হয় তখন সে কি করবে; সে ব্যাপারে অবহিত করুন। তিনি বললেন: খসে ফেলে দিবে। এরপর পানি দিয়ে ঘষে ধুয়ে ফেলবে এবং তাতে নামায পড়বে।’ [সহিহ বুখারী (২২৭)]

তৃতীয় স্থান: নামায পড়ার স্থান। এর সপক্ষে প্রমাণ রয়েছে আনাস বিন মালিক (রাঃ) এর হাদিসে তিনি বলেন: ‘একবার এক বেদুঈন এসে মসজিদের এক প্রান্তে পেশাব করে দিল। লোকেরা তাকে ধমকালো। নবী সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম তাদেরকে নিষেধ করলেন। যখন সে পেশাব শেষ করল তখন নবী সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম বড় এক বালতি পানি আনার ও পেশাবের উপর ঢেলে দেয়ার নির্দেশ দিলেন।‘ [সহিহ বুখারী]

পঞ্চম শর্ত: ক্বিবলা অভিমুখী হওয়া। তাই যে ব্যক্তি সক্ষমতা থাকা সত্ত্বেও কোন ফরয নামায ক্বিবলার দিক ব্যতীত অন্যদিকে ফিরে পড়বে তার নামায আলেমদের ইজমার ভিত্তিতে বাতিল। যেহেতু আল্লাহ্‌ তাআলা বলেন: “সুতরাং আপনি আপনার চেহারাকে মসজিদে হারামের দিকে ফেরান। তোমরা যেখানেই থাক না কেন তোমাদের চেহারাগুলোকে মসজিদে হারামের দিকে ফেরাও।” [সূরা বাক্বারা, আয়াত: ১৪৪]

এবং নামায অসঠিকভাবে আদায়কারী ব্যক্তিকে নবী সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম বলেছেন: ‘এরপর তুমি কিবলামুখী হবে এবং তাকবীর দিবে।‘ [সহিহ বুখারী (৬৬৬৭)]

আরও জানতে দেখুন: যে অবস্থাগুলোতে কিবলামুখী হওয়ার শর্ত মওকুফ হয় প্রশ্নোত্তর।

ষষ্ঠ শর্ত: নিয়ত করা। যে ব্যক্তি নিয়ত ছাড়া নামায পড়ল; তার নামায বাতিল। দলিল হচ্ছে উমর বিন খাত্তাব (রাঃ) এর বর্ণিত হাদিস: “সকল আমল নিয়ত দ্বারা মূল্যায়িত হয়। প্রত্যেক ব্যক্তি যা নিয়ত করে সেটাই তার পাপ্য।” আল্লাহ্‌ তাআলা নিয়তহীন কোন আমল কবুল করেন না।

উপরোল্লেখিত শর্তগুলো নামাযের সাথে খাস। এগুলোর সাথে প্রত্যেক ইবাদত শুদ্ধ হওয়ার জন্য সাধারণ শর্তগুলোও যোগ করতে হবে। সেগুলো হল: ইসলাম, বুদ্ধিমত্তা ও বুঝবান হওয়া।

সুতরাং পূর্বোক্ত আলোচনার প্রেক্ষিতে নামায শুদ্ধ হওয়ার জন্য শর্ত নয়টি। এজমালিভাবে সেগুলো হচ্ছে: ইসলাম, আকল, বুঝবান হওয়া, অপবিত্রতা দূর করা, নাপাকি দূর করা, সতর ঢাকা, ওয়াক্ত প্রবেশ করা, কিবলামুখী হওয়া এবং নিয়ত করা।

আল্লাহ্‌ই সর্বজ্ঞ।


Source:https://quraneralo.net/what-are-the-conditions-for-prayer-to-be-purified/
2
সালাতের অর্থ:
আরবি সালাত শব্দটি ‘সেলা’ ধাতুমূল থেকে উদ্গত- যার অর্থ বন্ধন। সালাতের মাধ্যমে যেহেতু বান্দা ও তার রবের মাঝে বন্ধন সৃষ্টি হয় তাই এর নাম দেয়া হয়েছে সালাত। আর ইসলামি পরিভাষায় সালাত হল, রাসূল সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম প্রদর্শিত ইবাদতের সেই নির্দিষ্ট পদ্ধতি- যা তিনি মুসলমানদের হাতে-কলমে শিক্ষা দিয়েছেন। এককথায় সালাত নিয়ত সহযোগে বিশেষ কিছু শর্ত সমন্বিত নির্দিষ্ট কথা ও কাজের নাম- যা তাকবিরের মাধ্যমে সূচিত হয়ে সালামের মাধ্যমে সমাপ্ত হয়
সালাতের গুরুত্ব:

ইসলাম আল্লাহর একমাত্র মনোনীত ধর্ম। এ ধর্মের দ্বিতীয় ভিত্তিমূল সালাত। রাসূল সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম বলেন, ‘পাঁচটি ভিত্তির ওপর ইসলামের বুনিয়াদ।’ [বুখারি ও মুসলিম] এ পাঁচটির মধ্যে দ্বিতীয়টি হল সালাত।সালাত মুমিনদের বৈশিষ্ট্য। আল্লাহ তাআলা মুমিনদের প্রশংসা করে বলেন, “তারা সালাত কায়েম করে।” [বাকারা : ০৩] যে ব্যক্তি সালাতের হিফাজত করল, সে তার দীনের হিফাজত করল। আর যে সালাত নষ্ট করল সে তো অন্যসব কিছু আরো অধিক পরিমাণে নষ্ট করবে।’‘যার কাছে সালাতের গুরুত্ব যতটুকু ইসলামের গুরুত্বও তার কাছে ততটুকুই।’ রাসূল সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম-এর সর্বশেষ অসিয়ত ছিল সালাত। দুনিয়া থেকে বিদায়ের প্রক্কালে তিনি নিজ উম্মতকে (আস-সালাত, আস-সালাত) সতর্ক করেছেন। ‘তোমরা সালাতের ব্যাপারে যত্নশীল থেকো’

এ পৃথিবী তাঁর সর্বশেষ হাসিও দেখেছিল এ সালাতকে উপলক্ষ্য করে। রাসূল সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম আপন হুজরা থেকে মসজিদের দিকে তাকিয়ে দেখেন আবুবকর ইমামতি করছেন। সবাই তাঁর পেছনে একাত্ম হয়ে সালাতে নিমগ্ন। নিজ হাতে রোপন করা দীনের এমন সুন্দর দৃশ্য দেখে সফল মালীর মতো হেসেছিলেন তিনি তৃপ্তির হাসি।ইসলামের যে অংশ সর্বশেষ বিদায় নেবে তা এই সালাত। সালাত যখন বিদায় নেবে তখন ইসলামের আর কোনো অংশই অবশিষ্ট থাকবে না। রাসূল সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম বলেন, ‘ইসলামের বন্ধন সব এক এক করে ছিঁড়ে যাবে। যখন একটি বন্ধন ছিঁড়ে যাবে মানুষ তার পরবর্তী বন্ধনটি আঁকড়ে ধরবে। সর্বপ্রথম ইসলামি শাসন বিলুপ্ত হবে আর সর্বশেষ উঠে যাবে সালাত।’ [ইবনে হিব্বান]

রাসূল সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম এক সময় চাঁদের দিকে তাকিয়ে বলেন, ‘তোমরা তোমাদের রবকে দেখতে পাবে; যেমন দেখতে পাচ্ছ এ চাঁদকে, তাঁকে দেখার জন্য তোমাদের হুড়োহুড়ি করতে হবে না।’ যদি তোমাদের সাধ্য থাকে তবে সূর্যোদয় ও সূর্যাস্তের পূর্বের সালাত ত্যাগ করবে না।’ [বুখারি ও মুসলিম]

যারা সালাতের ব্যাপারে অবহেলা প্রদর্শন করে তাদের নিন্দা করে আল্লাহ তাআলা বলেন, “তাদের পর আসল এমন এক অসৎ বংশধর যারা সালাত বিনষ্ট করল এবং কুপ্রবৃত্তির অনুসরণ করল। সুতরাং শীঘ্রই তারা জাহান্নামের শাস্তি প্রত্যক্ষ করবে।“[মারইয়াম : ৫৯] রাসূল সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম বলেছেন, ‘যে আসরের সালাত ত্যাগ করল তার আমল বরবাদ হয়ে গেল।’ [বুখারি]

সালাত একটি গুরুত্বপূর্ণ ইবাদত- যার জন্য নবী-রাসূলগণ আপ্রাণ চেষ্টা করেছেন এবং এ জন্য আল্লাহর বিশেষ হিদায়েত ও তাওফিক প্রার্থনা করেছেন। যেমন ইবরাহিম আ. বলেন, “হে আমার রব, আমাকে সালাত কায়েমকারী বানান এবং আমার বংশধরদের মধ্য থেকেও। হে আমাদের রব, আর আমার দুআ কবুল করুন।” [ইবরাহিম : ৪০] আল্লাহ তাআলা ইসমাঈল আ. এর প্রশংসা করেছেন এ জন্য যে তিনি সালাত কায়েম করতেন এবং অন্যদের সালাতের প্রতি উদ্বুদ্ধ করতেন। ইরশাদ হচ্ছে, “সে তার পরিবারকে সালাত ও জাকাতের নির্দেশ দিত আর সে ছিল তার রবের সন্তোষপ্রাপ্ত।” [মারইয়াম : ৫৫]
সালাতের হুকুম:

সজ্ঞান সাবালক প্রত্যেক মুসলমানের ওপর সালাত ফরজ। আল্লাহ তাআলা বলেন, “তোমরা সালাত কায়েম কর এবং জাকাত প্রদান কর।” [বাকারা : ১১০] আল্লাহ তাআলা ইরশাদ করেন, “অতএব তোমরা সালাত কায়েম কর, নিশ্চয় সালাত মুমিনদের ওপর নির্দিষ্ট সময়ে ফরজ।” [নিসা : ১০৩] অন্যত্র বলেন, “আর তাদেরকে কেবল এই নির্দেশ দেয়া হয়েছিল যে, তারা যেন আল্লাহর ইবাদত করে । তাঁরই জন্য দীনকে একনিষ্ঠ করে; সালাত কায়েম করে এবং জাকাত দেয়; আর এটিই হল সঠিক দীন।” [বাইয়িনা : ০৫]

রাসূল সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম বলেন, ‘তোমরা নিজ সন্তানদের সালাতের নির্দেশ দাও, যখন তারা সাত বছরে পর্দাপণ করে। আর যখন তাদের বয়স দশে উপনীত হয় তখন সালাতের জন্য প্রহার কর এবং তাদের বিছানা আলাদা করে দাও।’ [সহিহ আল-জামে : ৫৮৬৮] রাসূল সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম বলেন, ‘আল্লাহ তাআলা পাঁচ ওয়াক্ত সালাত ফরজ করেছেন, যে ব্যক্তি সুন্দর করে অজু করবে, অতঃপর সময় মত তা আদায় করবে এবং তার রুকু ও একাগ্রতা যথাযথ আদায় করবে, আল্লাহর দায়িত্ব হচ্ছে তাকে ক্ষমা করে দেয়া। আর যে এমনটি করবে না, তার ব্যাপারে আল্লাহর ইচ্ছা, হয় তাকে ক্ষমা করে দিবেন; নয় তাকে শাস্তি দেবেন।’
সালাতের মর্যাদা:

রাসূল সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম বলেন, ‘সব কিছুর মূল হচ্ছে ইসলাম, ইসলামের স্তম্ভ হচ্ছে সালাত আর তার শীর্ষ পীঠ হল জিহাদ।’ [তিরমিজি : ৩৫৪১] সালাত আল্লাহ্‌র নিকট সবচেয়ে প্রিয় ও সর্বোত্তম আমল। রাসূল সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম বলেন, ‘তোমরা অবিচল থাক, গণনা করো না। তোমরা কাজ করো। মনে রাখবে তোমাদের সর্বোত্তম আমল হল সালাত, আর মুমিন ব্যতীত অন্য কেউ ওজুর যত্ন নেয় না।’ [ইবনে মাজাহ : ২৭৩]

কিয়ামতের দিন বান্দার সর্ব প্রথম সালাতের হিসাব নেয়া হবে। নবী করিম সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম বলেন, ‘কিয়ামতের দিন সর্ব প্রথম বান্দার সালাতের হিসাব হবে। যদি তার সালাত ঠিক হয় তবে তার সব আমলই ঠিক হবে। আর তার সালাত বিনষ্ট হলে, সব আমলই বিনষ্ট হবে।‘ [তিরমিজি : ২৭৮]

কুরআনে কারিমের দিকে লক্ষ্য করলে দেখা যায়, আল্লাহ তাআলা বিভিন্নভাবে বিবিধ পদ্ধতিতে সালাতের নির্দেশ দিয়েছেন। কখনো সালাতের নির্দেশ দিয়েছেন জাকাতের সঙ্গে। যেমন ইরশাদ হয়েছে, “তোমরা সালাত কায়েম কর এবং জাকাত প্রদান কর।” [বাকারা: ১১০] কখনো জিকিরের সঙ্গে। যেমন ইরশাদ হয়েছে, “অবশ্যই সাফল্য লাভ করবে যে আত্মশুদ্ধি করবে আর তার রবের নাম স্মরণ করবে অতঃপর সালাত আদায় করবে।” [আলা : ১৪-১৫] অন্যত্র ইরশাদ হয়েছে: “এবং আমার স্মরণার্থে সালাত কায়েম কর।’ (ত্বহা : ১৪)কখনো সবরের সঙ্গে। যেমন ইরশাদ হয়েছে: “আর তোমরা ধৈর্য ও সালাতের মাধ্যমে সাহায্য চাও। নিশ্চয় তা বিনয়ী ছাড়া অন্যদের ওপর কঠিন।” [বাকারা : ৪৫]

কখনো কুরবানির সঙ্গে। যেমন ইরশাদ হয়েছে: “অতএব তোমার রবের উদ্দেশ্যে সালাত পড় ও কুরবানি কর।” [কাওসার : ০২] অন্যত্র ইরশাদ হয়েছে: “বল, ‘নিশ্চয় আমার সালাত, আমার কুরবানি, আমার জীবন ও আমার মৃত্যু আল্লাহর জন্য, যিনি সকল সৃষ্টির রব। তাঁর কোনো শরিক নেই এবং আমাকে এরই নির্দেশ প্রদান করা হয়েছে। আর আমি মুসলমানদের মধ্যে প্রথম।” [আনআম: ১৬৪-১৬৫]
সালাতের ফজিলত:

সালাত নুর। রাসূল সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম বলেন, ‘পবিত্রতা ইমানের অর্ধেক আর আলহামদুলিল−াহ পাল−াকে সম্পূর্ণ করে, সুবহানাল−হ ও আলহামদুলিল−াহ আসমান ও জমিনের মধ্যবর্তী স্থানকে পূর্ণ করে, সালাত নূর, সদকা দলিল ও ধৈর্য হচ্ছে দীপ্তি এবং কুরআন তোমার পক্ষের অথবা বিপক্ষে প্রমাণ।’ [মুসলিম: ৩২৭] সালাত কবিরা গুনাহ ব্যতীত সকল পাপ মোচন করে দেয়। রাসূল সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম বলেন, ‘পাঁচ ওয়াক্ত সালাত এবং এক জুমা থেকে অপর জুমা মধ্যবর্তী সময়ে কৃত গুনাসমূহের কাফ্‌ফারা। যাবৎ সে কবিরা গুনাহে লিপ্ত না হয়।’ [মুসলিম: ৩৪৪]

রাসূল সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম একটি দৃষ্টান্ত দিয়ে বলেন, ‘যদি তোমাদের কারো বাড়ির সামনে একটি নদী থাকে আর সে দৈনিক পাঁচবার তাতে গোসল করে, তবে কি তার শরীরে ময়লা থাকতে পারে? সাহাবিরা বললেন, না। রাসূল সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম বললেন, পাঁচ ওয়াক্ত সালাতের দৃষ্টান্তও তদ্রুপ। আল্লাহ তাআলা এর দ্বারা গুনাহ মোচন করে দেন।’ [মুসলিম : ৪৯৭] তিনি আরো একটি দৃষ্টান্ত দিয়ে বলেন, ‘মুসলিম বান্দা যখন আল্লাহর সন্তুষ্টির উদ্দেশ্যে সালাত আদায় করে তখন তার গুনাসমূহ এমনভাবে ঝরে পড়ে, যেমন পড়ে যাচ্ছে এ গাছের পাতাসমূহ।’ [আহমদ : ২০৫৭৬]

সালাতের গুণগত মানের ভিত্তিতেই পরকালের সফলতা ও জান্নাতের সম্মানিত স্থান নির্ধারিত হবে। আল্লাহ তাআলা বলেন: “অবশ্যই মুমিনগণ সফল হয়েছে, যারা নিজেদের সালাতে বিনয়াবনত।” [আল-মুমিন : ০১-০২] অতঃপর বলেন, “আর যারা নিজদের সালাত হিফাজত করে তারাই হবে ওয়ারিশ- যারা ফেরদাউসের অধিকারী হবে। তারা সেখানে স্থায়ী হবে।” [মুমিনুন: ০৯-১১] এ সালাতের মাধ্যমেই জনৈক সাহাবি তার অপর শহিদ ভাইয়ের আগে জান্নাতে প্রবেশ করার তাওফিক লাভ করেছেন। সালাতের মাধ্যমেই মুমিন ব্যক্তি কখনো কখনো সিদ্দিক ও শহিদদের স্থানে পৌঁছতে সক্ষম হয়।
সালাত আল্লাহর নৈকট্য অর্জনের মাধ্যম:

সালাত আল্লাহ এবং বান্দার মাঝে একটি সুদৃঢ় বন্ধন। ইসরা ও মেরাজের সফরে তথা আসমানে সালাত ফরজ করা হয়েছে, যাতে কিয়ামত পর্যন্ত সালাত আসমান ও জমিনের মাঝে সেতু বন্ধন হয়ে থাকে, দুনিয়ার পঙ্কিলতা ও পার্থিব নিচুতা থেকে রূহানি উর্ধ্ব জগতে আরোহণের দরজা বান্দার জন্য সর্বদা উম্মুক্ত থাকে। যদিও আসমান দুনিয়া থেকে বিচ্ছিন্ন কোনো জিনিস নয়। তবে অনেক দূরে।  সালাত এক মেরাজ, এতে রূহসমূহ বিনীত ও একনিষ্ঠভাবে আল্লাহর দরবারে ফিরে যায়। সালাতের মাধ্যমে মুমিনগণ আল্লাহর নৈকট্য অর্জন করে। যেমন রাসূল সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম নৈকট্য অর্জন করেছিলেন মেরাজের মাধ্যমে।

সালাত বোরাক ¯ এর মাধ্যমে বান্দা খুব দ্রুত তার ও আল্লাহর মাঝখানের দূরত্ব অতিক্রম করে। সেজদা আল্লাহর নৈকট্য লাভের সর্ব শেষ স্থান। আল্লাহ তাআলা বলেন, “সেজদা কর এবং নিকটবর্তী হও।” [আলাক : ১৯] রাসূল সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম আরো বলেন, ‘সেজদা অবস্থায় বান্দা আল্লাহর সবচেয়ে নৈকট্য অর্জন করে। সুতরাং সেজদায় তোমরা বেশি বেশি দুআ কর।’ [মুসলিম : ৭৪৪]

আনাস রা. বলেন, ‘মেরাজের রাতে রাসূল সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম-এর ওপর পঞ্চাশ ওয়াক্ত সালাত ফরজ করা হয়। অতঃপর তা কমিয়ে পাঁচ রাকাত করা হয়। পরে ডেকে বলা হয়, হে মুহাম্মদ, আমার সিদ্ধান্ত পরিবর্তন হয় না। তুমি এ পাঁচ ওয়াক্ত সালাতের বিনিময়ে পঞ্চাশ ওয়াক্ত সালাতের সওয়াব অর্জন করবে।’ [আহমদ, নাসায়ি ও তিরমিজি]
মুসলমানদের জীবনে সালাতের প্রভাব:

সালাত ব্যক্তিকে গুনাহ থেকে হিফাজত করে, ববং গুনাহ এবং ব্যক্তির মাঝখানে প্রতিবন্ধকের ন্যায় কাজ করে। কখনো গুনাহ বা অপরাধ সংঘটিত হয়ে গেলে সঙ্গে সঙ্গে তওবার প্রতি উদ্বুদ্ধ করে।

রাসূল সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম সালাতের ভূমিকা ও তার প্রভাব প্রসঙ্গে বলেন, ‘তোমাদের কেউ ঘুমালে শয়তান তার ঘাড়ের পশ্চাতে তিনটি গিরা দিয়ে দেয়। প্রতিটি গিরায় সে বলে, এখনও অনেক রাত বাকি, ঘুমাও। যদি সে জাগ্রত হয় ও আল্লাহর নাম স্মরণ করে, একটি গিরা খুলে যায়। যদি সে অজু করে দ্বিতীয় ঘিরাটি খুলে যায়, যদি সে সালাত আদায় করে, তবে তৃতীয় ঘিরাটিও খুলে যায়। ফলে সে সকাল করে কর্মোদ্যম ও প্রফুল্ল চিত্ত নিয়ে, অন্যথায় সে সকাল করে আলস্য, অকর্মা ও অপবিত্র মন নিয়ে।’ [বুখারি : ১০৭৪]

যেহেতু সালাত ইবাদতের প্রধান অংশ এবং মানুষের ¯ ওপর ব্যাপক প্রভাব বিস্তার করে বলে প্রমাণিত, তাই কাফেররা শুআইব আ. এর দাওয়াতকে তার সালাতের দিকে ইংগিত করে তার আহ্বানকে এ বলে প্রত্যাখ্যান করেছে, ‘তারা বলল হে শুআইব,  তোমার সালাত কি তোমাকে এই নির্দেশ প্রদান করে যে, আমাদের পিতৃপুরুষগণ যাদের ইবাদত করত, আমরা তাদের ত্যাগ করি? অথবা আমাদের সম্পদে আমরা ইচ্ছামত যা করি তাও ত্যাগ করি। তুমি বেশ সহনশীল সুবোধ।’

সালাত মুমিনের অন্তরে শক্তি সঞ্চার করে। কল্যাণের প্রতি উদ্বুদ্ধ করে। ফলে সে সক্ষম হয় প্রবৃত্তির চাহিদা ও আলস্যকে পরাজিত করতে। আল্লাহ বলেন: “নিশ্চয় মানুষকে সৃষ্টি করা হয়েছে অস্থির করে। যখন তাকে বিপদ স্পর্শ করে তখন সে হয়ে পড়ে অতিমাত্রায় উৎকণ্ঠিত। আর কল্যাণ যখন তাকে স্পর্শ করে তখন সে হয়ে পড়ে অতিশয় কৃপণ, সালাত আদায়কারীগণ ছাড়া। যারা তাদের সালাতের ক্ষেত্রে নিয়মিত।” [মাআরেজ : ১৯-২৩]

তবে ব্যক্তির মাঝে সালাতের প্রভাব বিস্তার করার জন্য কতগুলো শর্ত রয়েছে। যেমন:

১. সময় মত সালাত আদায় করা। আল্লাহ তাআলা বলেন, “নিশ্চয় সালাত মুমিনদের ওপর নির্দিষ্ট সময় ফরজ।” [নিসা : ১০৩] রাসূল সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লামকে একবার জিজ্ঞাসা করা হয়েছিল, ‘কোন আমল আল−াহর নিকট অধিক প্রিয়? তিনি বলেন, সময় মত সালাত আদায় করা।’ [বুখারি : ৪৯৬]

২. সালাত কায়েম করা। অর্থাৎ এর ফরজ, ওয়াজিব ও সুন্নত ঠিক ঠিক আদায় করা। আল্লাহ তাআলা বলেন, “তোমরা সালাত কায়েম কর এবং জাকাত আদায় কর ও রুকুকারীদের সঙ্গে রুকু কর।” [বাকারা : ৪৩] অন্যত্র বলেন, “সূর্য হেলে পড়ার সময় থেকে রাতের অন্ধকার পর্যন্ত সালাত কায়েম কর এবং ফজরের কুরআন। নিশ্চয় ফজরের কুরআন (ফেরেশতাদের) উপস্থিতির সময়।” [ইসরা : ৭৮]

৩. নিয়মিত সালাত আদায় করা। আল্লাহ তাআলা বলেন: “যারা তাদের সালাতের ক্ষেত্রে নিয়মিত।” [মাআরেজ: ২৩]

৪. সালাতের প্রতি যত্নশীল থাকা। আল্লাহ তাআলা বলেন: “আর যারা নিজদের সালাত হেফাজত করে। তারাই জান্নাতসমূহে সম্মানিত হবে।” [মাআরেজ: ৩৪]

৫. খুশু তথা বিনয়ের সঙ্গে সালাত আদায় করা। আল্লাহ তাআলা বলেন: “অবশ্যই মুমিনগণ সফল হয়েছে। যারা নিজদের সালাতে বিনয়াবনত।” [মুমিনুন: ১-২]

অতএব প্রতিটি মুসলমানের কর্র্তব্য প্রত্যেক সালাত যথাসময়ে যথাযথ গুরুত্বের সঙ্গে আদায় করা। তবেই আমরা দুনিয়া ও আখিরাতের কল্যাণ লাভ করতে পারব। বাঁচতে পারব উভয় জগতের অকল্যাণ থেকে। আল্লাহ আমাদের সহায় হোন।


Source:https://quraneralo.net/salaat-the-most-important-form-of-worship/
3
ইসলামের সর্বাধিক গুরুত্বপূর্ণ ইবাদত হ’ল সালাত। সর্বাবস্থায় আল্লাহর স্মরণকে হৃদয়ে সঞ্চারিত রাখার প্রক্রিয়া হিসাবে আল্লাহ তাঁর বান্দাদের জন্য প্রতিদিন ৫ ওয়াক্ত সালাত ফরয করেছেন। আল্লাহ বলেন: ‘আর তুমি সালাত কায়েম কর আমাকে স্মরণ করার জন্য’।  [ত্বোয়া-হা ২০/১৪]

আর প্রতিটি কাজে সফলতার জন্য মৌলিক শর্ত হ’ল একাগ্রতা ও একনিষ্ঠতা। আর এ বিষয়টি ছালাতের ক্ষেত্রে আরো গুরুত্বপূর্ণ। কারণ ইবাদতের প্রকৃত স্বাদ আস্বাদনের জন্য একাগ্রতার কোন বিকল্প নেই। কিন্তু দুঃখজনক হ’লেও সত্য যে, বর্তমানে এই ব্যস্ত যান্ত্রিক সভ্যতার যুগে একাগ্রচিত্তে সালাত আদায় করা বেশ কঠিন হয়ে পড়েছে। অথচ একাগ্রতাবিহীন সালাত  শুধুমাত্র দায়সারা ও শারীরিক ব্যায়ামের উপকারিতা ব্যতীত তেমন কিছুই বয়ে আনে না। হৃদয়ে সৃষ্টি করে না প্রভুর একান্ত সান্নিধ্যে কিছু সময় অতিবাহিত করার অনাবিল প্রশান্তি। সঞ্চারিত হয় না নেকী অর্জনের পথে অগ্রগামী হওয়ার এবং যাবতীয় অশ্লীলতা ও অন্যায় কাজ থেকে বিরত থাকার কোন অনুপ্রেরণা। সার্বিক অবস্থা এমনই দাঁড়িয়েছে যে রাসূল (সা:)-এর নিম্নোক্ত হাদীছটি একটি কঠিন বাস্তবে পরিণত হয়েছে। তিনি বলেন: ‘এই উম্মত হ’তে সর্বপ্রথম ছালাতের একাগ্রতাকে উঠিয়ে নেয়া হবে, এমনকি তুমি তাদের মধ্যে কোন একাগ্রচিত্ত মুছল্লী খুঁজে পাবে না’।  [1]

একই বক্তব্য প্রতিধ্বনিত হয়েছে হুযায়ফা (রাঃ)-এর নিম্নোক্ত বাণীতে। তিনি বলেন: ‘সর্বপ্রথম তোমরা ছালাতে একাগ্রতা হারাবে। অবশেষে হারাবে সালাত। অধিকাংশ সালাত  আদায়কারীর মধ্যে কোন কল্যাণ অবশিষ্ট থাকবে না। হয়তো মসজিদে প্রবেশ করে একজন বিনয়ী-একাগ্রতা সম্পন্ন সালাত  আদায়কারীকেও পাওয়া যাবে না’।  [2]

বস্ত্ততঃ খুশূবিহীন সালাত বান্দাকে অন্যায় ও অশ্লীলতা থেকে দূরে রাখে না। তাইতো আল্লাহ তা‘আলা একাগ্রচিত্তের অধিকারী মুছল্লীদেরকেই সফল মুমিন বলে আখ্যায়িত করেছেন। বক্ষমান প্রবন্ধে ছালাতে একাগ্রতার প্রয়োজনীয়তা, ফযীলত এবং একাগ্রতা সৃষ্টির কিছু উপায় সংক্ষেপে আলোচিত হ’ল।
খুশূ বা একাগ্রতার পরিচয়:

‘খুশূ’-এর আভিধানিক অর্থ হ’ল দীনতার সাথে অবনত হওয়া, ধীরস্থির হওয়া ইত্যাদি। ইবনু কাছীর বলেন: খুশূ অর্থ- স্থিরতা, ধীরতা, গাম্ভীর্য, বিনয় ও নম্রতা। [3]

ইবনুল ক্বাইয়িম বলেন: খুশূ হ’ল হৃদয়কে দীনতা ও বিনয়ের সাথে প্রতিপালকের সম্মুখে উপস্থাপন করা। [4]

প্রত্যেক ইবাদত কবুল হওয়া এবং তার প্রকৃত স্বাদ আস্বাদন করার আবশ্যিক শর্ত হ’ল খুশূ। আর শ্রেষ্ঠ ইবাদত ছালাতের ক্ষেত্রে এর আবশ্যিকতা যে কত বেশী তা বলার অপেক্ষা রাখে না। তাই আল্লাহ তা‘আলা তাঁর বান্দাদেরকে নির্দেশ দিয়েছেন: ‘তোমরা আল্লাহর সম্মুখে দন্ডায়মান হও বিনীতভাবে’ [বাক্বারাহ ২/২৩৮]

তিনি আরো বলেন: ‘ঐ সকল মুমিন সফলকাম, যারা ছালাতে বিনয়াবনত’ [মুমিনূন ২৩/১-২]

খুশূ বা একাগ্রতার স্থান হৃদয়ের গভীরতম প্রদেশে। কিন্তু এর প্রভাব বিকশিত হয় অঙ্গ-প্রত্যঙ্গে। অন্যমনস্ক হওয়ার দরুন আত্মিক জগতে বিঘ্ন সৃষ্টি হ’লে বাহ্যিক অঙ্গ-প্রত্যঙ্গেও তার কুপ্রভাব পড়ে। তাই হৃদয় জগতকে একাগ্রতা ও একনিষ্ঠতায় পরিপূর্ণ করতে সক্ষম হ’লেই ছালাতের প্রকৃত স্বাদ পাওয়া সম্ভব। ছালাতের মধ্যে খুশূ কেবল তারই অর্জিত হবে, যে সবকিছু ত্যাগ করে নিজেকে শুধুমাত্র ছালাতের জন্য নিবিষ্ট করে নিবে এবং সবকিছুর ঊর্ধ্বে সালাতকে স্থান দিবে। তখনই সালাত তার অন্তরকে প্রশান্তিতে ভরে দিবে। রাসূলুল্লাহ (সা:) বলতেন: ‘সালাতেই আমার চোখের প্রশান্তি রাখা হয়েছে’। [5]

আল্লাহ তা‘আলা পবিত্র কুরআনে মনোনীত বান্দাদের আলোচনায় ‘খুশূ-খুযু’র সাথে সালাত আদায়কারী নারী-পুরুষের কথা উল্লেখ করেছেন এবং তাদের জন্য নির্ধারিত ক্ষমা ও সুমহান প্রতিদানের ঘোষণা দিয়েছেন। আল্লাহ বলেন: “নিশ্চয় মুসলমান পুরুষ, মুসলমান নারী, ঈমানদার পুরুষ, ঈমানদার নারী, অনুগত পুরুষ, অনুগত নারী, সত্যবাদী পুরুষ, সত্যবাদী নারী, ধৈর্য্যশীল পুরুষ, ধৈর্য্যশীল নারী, বিনীত পুরুষ, বিনীত নারী, দানশীল পুরুষ, দানশীল নারী, রোযা পালণকারী পুরুষ, রোযা পালনকারী নারী, যৌনাঙ্গ হেফাযতকারী পুরুষ, , যৌনাঙ্গ হেফাযতকারী নারী, আল্লাহর অধিক যিকরকারী পুরুষ ও যিকরকারী নারী-তাদের জন্য আল্লাহ প্রস্তুত রেখেছেন ক্ষমা ও মহাপুরষ্কার“। [আহযাব ৩৩/৩৫]

‘খুশূ’ বান্দার উপর ছালাতের এই কঠিন দায়িত্বকে স্বাভাবিক ও প্রশান্তিময় করে তোলে। আল্লাহ তা‘আলা বলেন: ‘তোমরা ধৈর্য ও ছালাতের মাধ্যমে সাহায্য চাও। নিশ্চয়ই তা বিনয়ী-একনিষ্ঠ ব্যতীত অন্যদের উপর অতীব কষ্টকর’। [বাক্বারা ২/৪৫]

বস্ত্ততঃ যেকোন ইবাদতের ক্ষেত্রে যখন রাসূল (সা:)-এর নিম্নোক্ত বাণীর অনুসরণ করা হবে, তখনই তা এক সফল ইবাদতে পরিণত হবে। হৃদয়জগতকে অপার্থিব আলোয় উদ্ভাসিত করবে। তিনি বলেন: ‘আল্লাহর ইবাদত কর এমনভাবে, যেন তাঁকে তুমি দেখতে পাচ্ছ। আর যদি দেখতে না পাও, তবে তিনি যেন তোমাকে দেখছেন’।
একাগ্রতাপূর্ণ ছালাতের ফযীলত:

খুশূ-খুযূ পূর্ণ সালাত আদায়কারীর মর্যাদা সম্পর্কে রাসূলুল্লাহ (সা:) বলেন: ‘আল্লাহ তা‘আলা পাঁচ ওয়াক্ত সালাত ফরয করেছেন। অতএব যে ভাল করে ওযূ করবে, সময় মত সালাত  আদায় করবে এবং রুকূ-সিজদা সঠিকভাবে আদায় করবে, আল্লাহর দায়িত্ব তাকে ক্ষমা করে দেওয়া। আর যে এমনটি করবে না, তার প্রতি আল্লাহর কোন দায়িত্ব নেই। তিনি শাস্তিও দিতে পারেন, ক্ষমাও করতে পারেন’।  [7]

রাসূল (সা:) আরো বলেন: ‘যে সুন্দরভাবে ওযূ করে, অতঃপর মন ও শরীর একত্র করে (একাগ্রতার সাথে) দু’রাক‘আত সালাত আদায় করে, (অন্য বর্ণনায় এসেছে- যে ছালাতে ওয়াসওয়াসা স্থান পায় না) তার জন্য জান্নাত ওয়াজিব হয়ে যায়। (অন্য বর্ণনায় রয়েছে, তার সমস্ত গুনাহ মাফ করে দেয়া হয়)’।  [8]
খুশূ ও একাগ্রতা অর্জনের উপায়:

ছালাতে একাগ্রতা অর্জনের উপায়গুলি দু’ভাগে বিভক্ত-

(১) একাগ্রতা সৃষ্টি ও তা শক্তিশালীকরণের পদ্ধতি গ্রহণ করা।
(২) ‘খুশূ’তে প্রতিবন্ধকতা সৃষ্টিকারী বিষয়গুলো পরিহার করা।

শায়খুল ইসলাম ইবনে তাইমিয়া (রহঃ) বলেন, দু’টি বস্ত্ত ‘খুশূ’র জন্য সহায়ক। প্রথমটি হ’ল– মুছল্লী যা বলবে: ‘যা করবে; তা অনুধাবন করবে। স্বীয় তেলাওয়াত ও দো‘আসমূহ গভীরভাবে চিন্তা-ভাবনা করবে। সর্বদা হৃদয়ে জাগরূক রাখবে যে, সে আল্লাহর সম্মুখে প্রার্থনারত এবং তিনি তাকে দেখছেন। কেননা সালাতরত অবস্থায় মুছল্লী আল্লাহর সাথেই কথপোকথন করে। হাদীছে জিবরীলে ইহসানের সংজ্ঞায় এসেছে, ‘আল্লাহর ইবাদত কর এমনভাবে, যেন তাঁকে দেখতে পাচ্ছ। যদি তুমি দেখতে না পাও, তবে তিনি তোমাকে দেখছেন’।  [9]

এভাবে মুছল্লী যতই ছালাতের স্বাদ আস্বাদন করবে, ততই ছালাতের প্রতি তার আগ্রহ বৃদ্ধি পাবে। এটা নির্ভর করে তার ঈমানী শক্তির উপর। আর তা বৃদ্ধি করার অনেক উপকরণ রয়েছে। রাসূল (সা:) বলতেন: ‘আমার জন্য প্রিয়তর করা হয়েছে নারীও সুগন্ধি। আর সালাতকে করা হয়েছে আমার চোখের প্রশান্তি’  [10]

অন্য হাদীছে এসেছে রাসূল (সা:) বেলাল (রাঃ)-কে উদ্দেশ্য করে বলছেন: ‘হে বেলাল, ছালাতের এক্বামত দাও, আমাদেরকে প্রশান্তি দাও’।  [11]

দ্বিতীয়টি হ’ল– প্রতিবন্ধকতা দূর করা। অন্তরের একাগ্রতা বিনষ্টকারী বস্ত্ত ও অপ্রয়োজনীয় চিন্তা-ভাবনা পরিহার করা এবং ছালাতের মৌলিক উদ্দেশ্য ব্যাহতকারী সকল আকর্ষণীয় বস্ত্তকে পরিত্যাগ করা। [12]
একাগ্রতা সৃষ্টি ও শক্তিশালী করণের উপায়সমূহ:

(১) ছালাতের জন্য প্রস্ত্ততি গ্রহণ

ছালাতে একাগ্রতা সৃষ্টির জন্য প্রথমতঃ নিজেকে ছালাতের জন্য প্রস্ত্তত রাখতে হবে। যেমন মুওয়াযযিন আযান দিলে তার জওয়াব দেওয়া, আযান শেষে নির্দিষ্ট দো‘আ পড়া, অতঃপর বিসমিল্লাহ বলে সঠিকভাবে ওযূ করা, ওযূর পরে দো‘আ পড়া ইত্যাদি। মুখ পরিষ্কার-পরিচ্ছন্ন রাখার জন্য মিসওয়াকের প্রতি যত্নশীল হওয়া আবশ্যক। রাসূল (সা:) বলেছেন: ‘বান্দা যখন ছালাতের জন্য দন্ডায়মান হয় এবং তেলাওয়াত করে, ফেরেশতা তার পিছনে দাঁড়িয়ে তেলাওয়াত শুনতে থাকে এবং শুনতে শুনতে তার নিকটবর্তী হয়। অবশেষে সে তার মুখকে বান্দার মুখের সাথে লাগিয়ে দেয়। ফলে সে যা কিছু তেলাওয়াত করে, তা ফেরেশতার মুখগহবরেই পতিত হয়। অতএব, ‘তোমরা (ছালাতে) কুরআন তেলাওয়াতের জন্য মুখকে পরিচ্ছন্ন কর’।  [13]

অতঃপর পরিষ্কার-পরিচ্ছন্ন সুগন্ধিযুক্ত পোষাক পরিধান করে ছালাতের জন্য বের হবে। যা মুছল্লীর হৃদয়ে অনাবিল প্রশান্তি বয়ে আনে। আল্লাহ তা‘আলা বলেন: ‘তোমরা ছালাতের সময় সুন্দর পোষাক পরিধান কর’। [আ‘রাফ ৭/৩১]

এছাড়া ছালাতের স্থানকে পবিত্র করা, ধীর-স্থিরভাবে মসজিদে গমন, পায়ে পা, কাঁধে কাঁধ মিলিয়ে কাতার সোজা করে দাঁড়ানো প্রভৃতি বিষয়গুলিও ছালাতে একাগ্রতা সৃষ্টির জন্য কার্যকর।

(২) ধীর-স্থিরতা অবলম্বন করা

“ছালাতে একাগ্রতা আনার জন্য ধীর-স্থিরতা অবলম্বন করা আবশ্যক। রাসূল (সা:) প্রত্যেক অঙ্গ নিজ নিজ স্থানে ফিরে আসা পর্যন্ত অপেক্ষা করতেন।” [14]

“ছালাতে ভুলকারী ব্যক্তিকে তিনি ধীরে-সুস্থে সালাত আদায় করার শিক্ষা দিয়ে বলেন, ‘এভাবে আদায় না করলে তোমাদের কারো সালাত শুদ্ধ হবে না’।”  [15]

আবু ক্বাতাদা (রাঃ) হ’তে বর্ণিত, রাসূল (সা:) বলেছেন: ‘নিকৃষ্টতম চোর হ’ল সেই ব্যক্তি, যে ছালাতে চুরি করে। তিনি বললেন, হে আল্লাহর রাসূল! ছালাতে কিভাবে চুরি করে?  তিনি বললেন, ‘যে রুকূ-সিজদা পূর্ণভাবে আদায় করে না’। [16]

রাসূলুল্লাহ (সা:) বলেন: ‘যে ব্যক্তি পূর্ণভাবে রুকূ করে না এবং সিজদাতে শুধু ঠোকর দেয়, সে ঐ ক্ষুধার্ত ব্যক্তির ন্যায়, যে দু’তিনটি খেজুর খেল, কিন্তু পরিতৃপ্ত হ’ল না’। [17]

এছাড়া রাসূল (সা:) সংক্ষেপে সালাত আদায় করতে নিষেধ করেছেন। [18] সাথে সাথে তিনি দীর্ঘ সালাতকে সর্বোত্তম সালাত বলে আখ্যায়িত করেছেন। [19]

ধীর-স্থিরতা ব্যতীত একাগ্রতাপূর্ণ সফল সালাত আদায় করা অসম্ভব। কাকের ন্যায় ঠোকর দিয়ে আদায়কৃত ছালাতে একদিকে যেমন একাগ্রতা থাকে না, অন্যদিকে তেমনি নেকী অর্জনও সুদূর পরাহত হয়ে পড়ে।

(৩) ছালাতে মৃত্যুকে স্মরণ করা

রাসূলুল্লাহ (সা:) বলেছেন: ‘তুমি ছালাতে মৃত্যুকে স্মরণ কর। কারণ যে ব্যক্তি ছালাতে মৃত্যুকে স্মরণ করবে, তার সালাত যথার্থ সুন্দর হবে। আর তুমি সেই ব্যক্তির ন্যায় সালাত আদায় কর, যে জীবনে শেষবারের মত সালাত আদায় করে নিচ্ছে’। [20]

রাসূল (সা:)-এর নিকটে জনৈক ব্যক্তি সংক্ষিপ্ত উপদেশ কামনা করলে তিনি তাকে বললেন: ‘যখন তুমি ছালাতে দন্ডায়মান হবে, তখন এমনভাবে সালাত আদায় কর, যেন এটিই তোমার জীবনের শেষ সালাত’। [21]

মৃত্যু অবশ্যম্ভাবী। কিন্তু তার সময়-ক্ষণ অনিশ্চিত। তাই বান্দাকে তার প্রতিটি সালাতকেই ‘বিদায়ী সালাত’ হিসাবে আদায় করতে হবে। মনে করতে হবে যে, এটাই তার জীবনের শেষ সালাত; প্রভুর সাথে একান্ত আলাপের শেষ সুযোগ। সর্বদা এ চিন্তা অন্তরে জাগরূক রাখতে পারলে তার প্রতিটি সালাতই এক বিশেষ ছালাতে পরিণত হবে।

(৪) পঠিত আয়াত ও দো‘আ সমূহ গভীরভাবে অনুধাবন করা

ছালাতে পঠিত প্রতিটি আয়াত ও দো‘আ গভীর মনোযোগে অর্থ বুঝে পড়তে হবে এবং শুনতে হবে। বিশেষতঃ পঠিত দো‘আ সমূহের অর্থ একান্তভাবেই জানা আবশ্যক। কুরআনের আয়াত সমূহ শ্রবণে যেসব বান্দা প্রভাবিত হয়, তাদের প্রশংসা করে আল্লাহ তা‘আলা বলেন: ‘আর যারা তাদের রবের আয়াতসমূহ স্মরণ করিয়ে দিলে বধির ও অন্ধদের মত পড়ে থাকে না’ [ফুরক্বান ২৫/৭৩]

এতদ্ব্যতীত শিক্ষিত ব্যক্তিদের জন্য কুরআনের তাফসীর পাঠ করা উচিত। খ্যাতনামা মুফাসসির ইবনু জারীর ত্বাবারী বলেন: ‘আমি আশ্চর্যান্বিত হই সেই সব পাঠককে দেখে, যারা কুরআন পাঠ করে অথচ তার মর্ম জানে না। সে কিভাবে এর স্বাদ পাবে’? [22]

একটি আয়াত বার বার পাঠ করা এবং সে সম্পর্কে গভীরভাবে চিন্তা করাও ছালাতে একাগ্রতা সৃষ্টির জন্য সহায়ক ভূমিকা পালন করে। আবু যর গিফারী (রাঃ) হ’তে বর্ণিত: “রাসূল (সা:) একদিন তাহাজ্জুদ ছালাতে কেবলমাত্র ‘যদি আপনি তাদেরকে শাস্তি প্রদান করেন তবে তারাতো আপনারই বান্দা, আর তাদেরকে যদি ক্ষমা করেন, তবে নিশ্চয়ই আপনি পরাক্রমশালী, প্রজ্ঞাময়’’ (মায়েদাহ ৫/১১৮)। -এই আয়াতটি পড়তে পড়তেই রাত শেষ করেছিলেন। [23]

হুযায়ফা (রাঃ) হ’তে বর্ণিত তিনি বলেন: ‘আমি রাসূলুল্লাহ (সা:)-এর সাথে কোন এক রাতে সালাত পড়েছিলাম। লক্ষ্য করলাম, তিনি একটি একটি করে আয়াত পড়ছিলেন। যখন আল্লাহর প্রশংসামূলক কোন আয়াত আসত, আল্লাহর প্রশংসা করতেন। যখন প্রার্থনা করার আয়াত আসত, আল্লাহর কাছে প্রার্থনা করতেন। যখন আশ্রয় চাওয়ার আয়াত আসত, আল্লাহর নিকট আশ্রয় চাইতেন’।  [24]

ছালাতে  আয়াত  সমূহ  অনুধাবন  করা  ও তার ফলাফলের বাস্তবতা জানার জন্য নিম্নোক্ত হাদীছটিও প্রণিধানযোগ্য।

আত্বা (রাঃ) বলেন, একদা আমি ও উবাইদ ইবনে ওমায়ের (রাঃ) আয়েশা (রাঃ)-এর নিকটে গমন করি। উবাইদ আয়েশাকে অনুরোধ করলেন, আপনি আমাদেরকে রাসূল (সা:)-এর একটি অতি আশ্চর্যজনক ঘটনা শুনান। আয়েশা (রাঃ) এ কথা শুনে কেঁদে ফেললেন। অতঃপর বললেন, এক রাতে উঠে রাসূল (সা:) আমাকে বললেন, আয়েশা তুমি আমাকে ছাড়, আমি প্রভুর ইবাদতে লিপ্ত হই। আমি বললাম, আল্লাহর কসম, আমি আপনার নৈকট্য যেমন পসন্দ করি এবং আপনার পসন্দের জিনিসও তেমনি পসন্দ করি। আয়েশা (রাঃ) বলেন, রাসূল (সা:) উঠে ওযূ করলেন এবং ছালাতে দাঁড়ালেন। অতঃপর কাঁদতে আরম্ভ করলেন। কাঁদতে কাঁদতে তার বক্ষ ভিজে গেল। এমনকি এক পর্যায়ে (পায়ের নীচের) মাটি পর্যন্ত ভিজে গেল। বেলাল তাঁকে (ফজরের) ছালাতের সংবাদ দিতে এসে দেখেন তিনি কাঁদছেন। বেলাল বললেন, হে আল্লাহর রাসূল (সা:)! আপনি কাঁদছেন, অথচ আল্লাহ আপনার পূর্বের ও পরবর্তী সকল গুনাহ মাফ করে দিয়েছেন? রাসূল (সা:) বললেন, হে বেলাল! আমি কি আল্লাহর কৃতজ্ঞ বান্দা হব না? আজ রাতে আমার উপর কয়েকটি আয়াত …(আলে-ইমরান ১৯০-২০০) নাযিল হয়েছে। ‘যে ব্যক্তি এগুলো পড়বে, কিন্তু চিন্তা-ভাবনা করবে না, সে ক্ষতিগ্রস্তদের অন্তর্ভুক্ত হবে’। [25]

(৫) প্রতিটি আয়াত তেলাওয়াতের পর ওয়াকফ করা

এ পদ্ধতি একদিকে যেমন পঠিত আয়াত সম্পর্কে চিন্তা ও উপলব্ধি করতে সহায়ক হয়, অন্যদিকে তেমনি তা একাগ্রতা সৃষ্টির জন্য অত্যন্ত কার্যকর। রাসূল (ছাঃ)-এর কুরআন তেলাওয়াতের ধরন ছিল এরূপ। তিনি প্রতিটি আয়াতের শেষে ওয়াকফ করতেন।[26]

(৬) মধুর স্বরে স্থিরতার সাথে তেলাওয়াত করা

আল্লাহ তা‘আলা বলেন: ‘স্পষ্টভাবে ধীরে ধীরে কুরআন তেলাওয়াত কর’। [মুযযাম্মিল ৪]

রাসূলুল্লাহ (সা:) প্রতিটি সূরা তারতীল সহকারে তেলাওয়াত করতেন। [27]

মধুর স্বরে ধীরগতির পড়া খুশূ বা একাগ্রতা সৃষ্টিতে যেমন সহায়ক ভূমিকা পালন করে, তাড়াহুড়ার সাথে দ্রুতগতির পড়া তেমনি একাগ্রতায় প্রতিবন্ধকতা সৃষ্টি করে। রাসূল (সা:)-এর বলেন: ‘তোমরা সুমধুর স্বরে কুরআন তেলাওয়াত কর। কারণ সুন্দর আওয়াজ কুরআনের সৌন্দর্যকে বৃদ্ধি করে’। [28]

তবে এখানে সৌন্দর্যের অর্থ গভীর ভাবাবেগ এবং আল্লাহভীতি সহকারে সুন্দরভাবে তেলাওয়াত করা। যেমন রাসূল (সা:) অন্য হাদীছে বলেন: ‘সবচেয়ে সুন্দর আওয়াজে কুরআন তেলাওয়াতকারী ঐ ব্যক্তি, যার তেলাওয়াত শুনে তোমার মনে হবে যে, সে আল্লাহকে ভয় করছে’।  [29]

(৭) আল্লাহ বান্দার ডাকে সাড়া দিচ্ছেন একথা স্মরণ করা

ছালাতের শুরু থেকে শেষ পর্যন্ত সবটাই মূলতঃ মহান প্রতিপালকের কাছে বান্দার একান্ত প্রার্থনা। তাই মুছল্লীকে সর্বদা মনে করতে হবে যে, আল্লাহ তার প্রতিটি প্রার্থনায় সাড়া দিচ্ছেন। এ ব্যাপারে রাসূল (সা:)-এর নিম্নোক্ত হাদীছটি অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ। যেমন তিনি বলেছেন, ‘আল্লাহ তা‘আলা বলেন, আমি সালাত কে আমার এবং আমার বান্দার মাঝে দু’ভাগে ভাগ করেছি। বান্দা আমার কাছে যা কামনা করবে তাই পাবে।
যখন আমার বান্দা বলে, (সমস্ত প্রশংসা আল্লাহর যিনি সারা জাহানের মালিক)।
তখন আল্লাহ বলেন, (বান্দা আমার প্রশংসা করল)।
যখন বলে, (পরম করুণাময় অসীম দয়াবান) আল্লাহ বলেন, (বান্দা আমার গুণগান করল)।
যখন বলে, (বিচার দিবসের মালিক) আল্লাহ বলেন, (বান্দা আমার যথাযথ মর্যাদা দান করল)।
যখন বলে, (আমরা কেবলমাত্র আপনারই ইবাদত করি এবং কেবলমাত্র আপনারই সাহায্য প্রার্থনা করি)।
আল্লাহ বলেন, (এটি আমার ও আমার বান্দার মাঝে, আর আমার বান্দা যা চাইবে, তাই পাবে)।
যখন বলে, (আপনি আমাদেরকে সরল পথ প্রদর্শন করুন। এমন ব্যক্তিদের পথ, যাদেরকে আপনি পুরস্কৃত করেছেন। তাদের পথ নয়, যারা অভিশপ্ত ও পথভ্রষ্ট হয়েছে)।
আল্লাহ তা‘আলা বলেন, (এটা আমার বান্দার জন্য, আর আমার বান্দা যা প্রার্থনা করবে তাই পাবে)। [30]

রাসূল (সা:) অন্য হাদীছে বলেন: ‘তোমাদের কেউ ছালাতে দাঁড়ালে সে মূলতঃ তার প্রভুর সাথে কথোপকথন করে। তাই সে যেন দেখে, কিভাবে সে কথোপকথন করছে’। [31]

উপরোক্ত হাদীছ দু’টি স্মরণে থাকলে ছালাতে একাগ্রতা বজায় রাখা সহজ হয়ে যায়।

(৮) সিজদার স্থানেই দৃষ্টি নিবন্ধ রাখা

ছালাতে একাগ্রতা সৃষ্টির জন্য মুছল্লীকে দৃষ্টি অবনত রাখতে হবে এবং আশেপাশে দৃষ্টি দেওয়া যাবে না। রাসূল (সা:) ছালাতের সময় মস্তক অবনত রাখতেন এবং দৃষ্টি রাখতেন মাটির দিকে। [32]

আর যখন তাশাহহুদের জন্য বসবে, তখন শাহাদত আঙ্গুলের প্রতি দৃষ্টি রাখবে। রাসূল (সা:) যখন তাশাহহুদের জন্য বসতেন, শাহাদত আঙ্গুলের মাধ্যমে কিবলার দিকে ইশারা করতেন এবং সেদিকে দৃষ্টি নিবদ্ধ রাখতেন। [33]

(৯) ভিন্ন ভিন্ন সূরা ও দো‘আ সমূহ পাঠ করা

ছালাতে সবসময় একই সূরা ও একই দো‘আ না পড়ে, বিভিন্ন সূরা ও হাদীছে বর্ণিত বিভিন্ন দো‘আ পাঠ করলে, এর দ্বারা নতুন নতুন প্রার্থনা ও ভাবাবেগের সৃষ্টি হয়। এজন্য মুছল্লীকে অধিক সংখ্যক দো‘আ এবং কুরআনের আয়াত মুখস্থ করা যরূরী।

(১০) আয়াতে তেলাওয়াতের সিজদা থাকলে সিজদা করা

সিজদায়ে তেলাওয়াত ছালাতে একদিকে যেমন একাগ্রতা বৃদ্ধি করে, অন্যদিকে শয়তানকে দূরে সরিয়ে দেয়। আবু হুরায়রা (রাঃ) হ’তে বর্ণিত, রাসূল (সা:) বলেন: “বনূ আদম যখন তেলাওয়াত শেষে সিজদা করে, শয়তান তখন কাঁদতে কাঁদতে দূরে সরে যায়। আর বলে, আফসোস! আদম সন্তান সিজদার নির্দেশ পেয়ে সিজদা করেছে- তার জন্য জান্নাত। আর আমি সিজদার নির্দেশ পেয়ে অমান্য করেছি- আমার জন্য জাহান্নাম“। [34]

(১১) শয়তান হ’তে আল্লাহর নিকট পানাহ চাওয়া

শয়তান মানুষের চিরশত্রু। যার প্রধান কাজই হ’ল ইবাদতে বান্দার একাগ্রতা নষ্ট করা এবং এতে সন্দেহ সৃষ্টি করা। একদিন ওছমান বিন আবুল ‘আছ (রাঃ) রাসূল (সা:)-কে বললেন: ‘হে আল্লাহর রাসূল! ‘শয়তান আমার এবং আমার সালাত  ও ক্বিরাআতের মাঝে প্রতিবন্ধকতা এবং ছালাতে সন্দেহ সৃষ্টি করে। রাসূল (ছাঃ) বললেন,  ‘এ শয়তানটিকে ‘খিনযাব’ বলা হয়। যখন তুমি এর প্ররোচনা বুঝতে পারবে, আল্লাহর কাছে পানাহ চাইবে এবং বাম দিকে তিনবার থুক মারবে। তিনি বলেন, আমি এমনটি করেছি, আল্লাহ তা‘আলা আমার থেকে শয়তানের ওয়াসওয়াসা দূর করে দিয়েছেন’। [35]

রাসূল (সা:) বলেন: ‘তোমাদের কেউ ছালাতে দাঁড়ালে শয়তান ভুল-ভ্রান্তি ও সন্দেহ সৃষ্টির জন্য নিকটবর্তী হয়, ফলে এক পর্যায়ে সে রাক‘আত সংখ্যা ভুলে যায়। কারো এমন হ’লে বসা অবস্থায় দু’টি সিজদা করে নিবে’। [36]

(১২) একাগ্রতার গুরুত্ব ও ফযীলত সম্পর্কে জানা

রাসূল (সা:) বলেন: ‘যে ব্যক্তি ছালাতের সময় হ’লে সুন্দরভাবে ওযূ করে এবং একাগ্রতার সাথে সুন্দরভাবে রুকূ-সিজদা করে সালাত  আদায় করে, তার এ সালাত  পূর্বের সকল গুনাহের কাফফারা হয়ে যায়। যতক্ষণ পর্যন্ত না সে কোন কবীরা গুনাহে লিপ্ত হয়। আর এ সুযোগ তার সারা জীবনের জন্য’। [37]

জানা আবশ্যক যে, একাগ্রতা ও খুশূর পরিমাণ অনুপাতে ছালাতে ছওয়াব অর্জিত হয়। রাসূল (সা:) বলেন: ‘মুছল্লী সালাত  আদায় করে, কেউ পায় দশভাগ নেকী, কেউ নয়ভাগ, আটভাগ, সাতভাগ, ছয়ভাগ, পাঁচভাগ, চারভাগ, তিনভাগ আবার কেউ অর্ধেক নেকী অর্জন করে’। [38]

(১৩) ছালাতের পরে বর্ণিত দো‘আসমূহ ও নফল সালাত গুলি আদায় করা

সালাত  পরবর্তী মাসনূন দো‘আ সমূহ পাঠ এবং সুন্নাতে রাতেবা সমূহ আদায় করলে ছালাতের মধ্যে যে একাগ্রতা, বরকত ও খুশূ অর্জিত হয়, পরর্তীতে তা বিদ্যমান থাকে। সেকারণ সম্পাদিত ইবাদতের কার্যকারিতা বজায় রাখার জন্য পরবর্তী ইবাদতগুলি অতীব গুরুত্ববহ। তাই ছালাতের পরে মুছল্লী মাসনূন দো‘আগুলি পাঠ করবে। অতঃপর সারাদিনে মোট ১২ অথবা ১০ রাক‘আত সুন্নাতে মুওয়াক্কাদাহসহ বেশী বেশী নফল সালাত  আদায় করার চেষ্টা করবে।  কারণ নফল সালাত  দ্বারা ফরযের ত্রুটি-বিচ্যুতি মোচন করা হয়। [39]

(১৪) বেশী বেশী কুরআন তেলাওয়াত করা

অধিক কুরআন তেলাওয়াত হৃদয় জগতে সদাসর্বদা দ্বীনি চেতনা জাগরূক রাখে। সাথে সাথে মনের গভীরে এক ধরনের এলাহী প্রশান্তির আবহ সৃষ্টি করে। যা ছালাতের একাগ্রতার জন্য একান্ত প্রয়োজন। তাই মুছল্লীকে একাগ্রতা সৃষ্টির জন্য বেশী বেশী কুরআন তেলাওয়াতে অভ্যস্ত হ’তে হবে।

উপরোক্ত আলোচনায় একাগ্রতা সৃষ্টির উপায় সমূহ স্পষ্ট করা হয়েছে। এক্ষণে আমরা একাগ্রতা সৃষ্টিতে প্রতিবন্ধকতা সৃষ্টিকারী বিষয়গুলি নিয়ে আলোচনা করব।

(১) ছালাতের স্থান হ’তে একাগ্রতায় বিঘ্ন সৃষ্টিকারী বস্ত্তসমূহ দূর করা

আয়েশা (রাঃ) অর্থাৎ কারুকার্য খচিত কিংবা রঙ্গিন এক জাতীয় পর্দার কাপড় দ্বারা ঘরের পার্শ্ব ঢেকে রেখেছিলেন। তা দেখে রাসূলুল্লাহ (সা:) বললেন: ‘এগুলো আমার নিকট থেকে সরাও। কারণ এর কারুকার্যগুলি আমার ছালাতে প্রতিবন্ধকতা সৃষ্টি করছে’। [40]

অন্য বর্ণনায় এসেছে, একদিন রাসূল (সা:) কা‘বা গৃহে সালাত  আদায়ের জন্য প্রবেশ করলেন। অতঃপর সালাত  শেষে ওছমান বিন ত্বালহা (রাঃ)-কে বললেন: ‘আমি কা‘বা গৃহে প্রবেশ করার সময় দুম্বার দু’টি শিং দেখেছিলাম। কিন্তু তোমাকে শিং দু’টি ঢেকে দেওয়ার নির্দেশ দিতে ভুলে গিয়ে ছিলাম। অতএব তা ঢেকে দাও। কা‘বা গৃহে এমন বস্ত্ত থাকা উচিত নয়, যা মুছল্লীর একাগ্রতা বিনষ্ট করে’। [41]

তাই মুছল্লীর জন্য উচিত হবে, ছালাতের স্থান হ’তে একাগ্রতা বিনষ্টকারী সকল বস্ত্ত সরিয়ে ফেলা এবং মানুষের চলাচলের রাস্তা, গান-বাজনার স্থান ইত্যাদি পরিহার করা। সাথে সাথে সম্ভবপর প্রচন্ড গরম ও কনকনে শীতের স্থান এড়িয়ে সালাত  আদায় করা। কারণ গরম বা ঠান্ডার প্রচন্ডতা মুছল্লীর একাগ্রতাকে বিনষ্ট করতে পারে। প্রচন্ড গরমের কারণে রাসূল (ছাঃ) যোহর সালাত  একটু দেরী করে ঠান্ডায় পড়ার নির্দেশ দিয়েছিলেন। [42]

ইবনুল ক্বাইয়িম (রহঃ) বলেন: প্রচন্ড গরম মুছল্লীকে একাগ্রতা ও খুশূ থেকে দূরে রাখে। ফলে সে অপ্রসন্ন ও অনীহভাব নিয়ে ইবাদত করে। এজন্যই রাসূল (ছাঃ) সালাত  দেরীতে পড়ার নির্দেশ দিয়েছেন। যাতে গরম কমে যায় এবং মুছল্লী একাগ্রচিত্তে সালাত  আদায় করতে পারে। এতে মুছল্লীর জন্য ছালাতের প্রকৃত উদ্দেশ্য তথা খুশূ ও আল্লাহর সান্নিধ্য অর্জন করা সম্ভব হয়। [43]

এছাড়া দৃষ্টি আকর্ষণকারী পোষাক পরিধান করা উচিত নয়, যা নিজের বা অন্য মুছল্লীদের দৃষ্টি কেড়ে নেয়। [44]

সাথে সাথে অধিক সৌন্দর্যমন্ডিত মসজিদও একাগ্রতা বিনষ্ট করে। তাই রাসূল (সা:) মসজিদকে সৌন্দর্যমন্ডিত করার ব্যাপারে সাবধান করেছেন।[45] ওমর (রাঃ) মসজিদে নববী নতুনভাবে নির্মাণ করার সময় তা সৌন্দর্যমন্ডিত করা থেকে নিষেধ করে বলেন, ‘তোমরা লাল-হলুদ রং করা থেকে বিরত থাক। কারণ এতে মুছল্লীগণকে বিভ্রান্তিতে ফেলে দেবে’।

ইবনু আববাস বলেন: অচিরেই তোমরা তোমাদের মসজিদগুলোকে এমনভাবে সৌন্দর্যমন্ডিত করবে, যেমনভাবে ইহুদী-নাছারারা করে থাকে। [46]

(২) যাবতীয় ছগীরা ও কবীরা গুনাহ থেকে বিরত থাকা

ছালাতে একাগ্রতা আনার অন্যতম মাধ্যম ছগীরা ও কবীরা গুনাহ থেকে মুক্ত থাকা। পাপ মানুষের হৃদয়কে কলুষিত করে। এরূপ হৃদয়ে একাগ্রতা সৃষ্টি অলীক কল্পনা মাত্র। তাই একাগ্রতা অর্জনের জন্য ছোট-বড় সকল পাপ থেকে বিরত থাকা আবশ্যক। এভাবে ধীরে ধীরে একাগ্রতা অর্জন করতে সক্ষম হ’লে এক পর্যায়ে এই সালাত ই তাকে পাপ থেকে বিরত থাকতে সাহায্য করবে। সূরা আনকাবূতের ৪৫ নং আয়াতে আল্লাহ বলেছেন, ‘নিশ্চয়ই সালাত  যাবতীয় অশ্লীলতা ও অন্যায় থেকে বিরত রাখে’।

(৩) খাবারের চাহিদা নিয়ে সালাত  না পড়া

রাসূলুল্লাহ (সা:) বলেছেন: ‘খাদ্যের উপস্থিতিতে কোন সালাত  নেই’। [47]

সুতরাং যখন খাবার প্রস্ত্তত হয়ে যায় এবং সামনে উপস্থিত করা হয়, তখন উচিত হবে আগে খাদ্য গ্রহণ করা। কারণ এমতাবস্থায় ছালাতে একাগ্রতা আসে না। রাসূল (সা:) বলেন: ‘যখন তোমাদের কারো সামনে রাতের খাবার উপস্থিত হয়। আর ছালাতেরও সময় হয়ে যায়, তখন আগে খাদ্য গ্রহণ কর। খাবার শেষ না হওয়া পর্যন্ত তাড়াহুড়া করো না’। [48]

(৪) প্রাকৃতিক কর্মের বেগ চেপে রেখে সালাত  না পড়া

প্রাকৃতিক প্রয়োজন অর্থাৎ পেশাব-পায়খানার বেগ থাকলে ছালাতে কখনোই একাগ্রতা আসে না। এজন্যই রাসূল (সা:) এরূপ অবস্থায় সালাত আদায় করতে নিষেধ করেছেন। [49]

যদি ছালাতের কিছু অংশ ছুটেও যায়, তবুও প্রাকৃতিক প্রয়োজন সেরে নেওয়াই যরূরী। রাসূল (সা:) বলেন: ‘তোমাদের মধ্যে যদি কেউ টয়লেটে যেতে চায়, অথচ তখন ছালাতের সময় হয়ে গেছে, সে যেন আগে টয়লেট সেরে নেয়’। [50]

(৫) তন্দ্রাভাব নিয়ে সালাত  আদায় না করা

আনাস বিন মালেক (রাঃ) হ’তে বর্ণিত, রাসূলুল্লাহ (সা:) বলেন: ‘তোমাদের কারো ছালাতের মধ্যে তন্দ্রাভাব আসলে সে যেন ঘুমিয়ে নেয়। যাতে সে (ছালাতে) যা পাঠ করে তা বুঝতে পারে’। [51]

অন্য বর্ণনায় এসেছে, রাসূল (সা:) বলেন: ‘যখন তোমাদের কেউ সালাত রত অবস্থায় তন্দ্রাচ্ছন্ন হয়ে পড়ে, সে যেন ঘুমিয়ে নেয়। যতক্ষণ না তার ঘুম চলে যায়। কারণ ছালাতে তন্দ্রাচ্ছন্ন অবস্থায় হয়তো সে নিজের অজান্তে ক্ষমা প্রার্থনার সময় নিজেকে অভিসম্পাত করে বসবে’। [52]

এ অবস্থা সাধারণতঃ তাহাজ্জুদের ছালাতের ক্ষেত্রে হ’তে পারে। সেক্ষেত্রে অবশ্যই ঘুমিয়ে নিতে হবে। তবে ফরয ছালাতের ক্ষেত্রে ওয়াক্ত যেন অতিক্রান্ত না হয়ে যায়, সেদিকে খেয়াল রাখতে হবে।

(৬) আলাপরত বা ঘুমন্ত ব্যক্তির নিকটে সালাত  আদায় না করা

রাসূলুল্লাহ (সা:) বলেন: ‘তোমরা কেউ ঘুমন্ত ব্যক্তি কিংবা আলাপচারিতায় রত ব্যক্তির পিছনে সালাত  আদায় করবে না’। [53]

কারণ আলাপরত ব্যক্তির কথোপকথন মুছল্লীর ছালাতে বিঘ্ন সৃষ্টি করবে। আর ঘুমন্ত ব্যক্তি হ’তে এমন কিছু প্রকাশ পেতে পারে, যার দ্বারা ছালাতের একাগ্রতা বিনষ্ট হবে।

(৭) সিজদার জায়গা হ’তে ধূলা-বালি সরাতে ব্যস্ত না হওয়া

রাসূলুল্লাহ (সা:) বলেছেন: ‘সালাত রত অবস্থায় সিজদার জায়গা মুছবে না। যদি একান্তই করতে হয় তবে কংকর সরাতে একবারই করতে পার’। [54]

এর দ্বারা উদ্দেশ্য হ’ল ছালাতের মধ্যে এমন একাগ্রতা বজায় রাখা, যাতে এর ভেতর অন্য কোন কাজ প্রাধান্য না পায়। তাই উচিত হবে ছালাতের পূর্বেই সিজদার স্থান পরিষ্কার করে নেওয়া।

(৮) উচ্চৈঃস্বরে তেলাওয়াত করে অন্যের ছালাতে ব্যাঘাত ঘটানো থেকে বিরত থাকা

মুছল্লীর স্বীয় ছালাতের প্রতি যেমন যত্নবান থাকা যরূরী, তেমনি অন্যের ছালাতে বিঘ্ন সৃষ্টি হ’তে পারে এমন কাজ থেকে বিরত থাকাও যরূরী। রাসূল (সা:) বলেন: ‘স্মরণ রেখ! তোমরা সকলেই (সালাত রত অবস্থায়) আল্লাহর সাথে কথোপকথন কর। অতএব কেউ কাউকে কষ্ট দিবে না। কেউ অপরের চেয়ে উঁচু আওয়াজেও ছালাতে তেলাওয়াত করবে না। [55]

অপর এক বর্ণনায় এসেছে, ‘একে অপরের চেয়ে উঁচু কণ্ঠে তেলাওয়াত করবে না’। [56]

(৯) সালাত রত অবস্থায় আশেপাশে দৃষ্টিপাত না করা

আবু যর গিফারী (রাঃ) হ’তে বর্ণিত, রাসূল (সা:) বলেন: ‘বান্দা (সালাত রত অবস্থায়) যতক্ষণ পর্যন্ত আশেপাশে দৃষ্টিপাত না করে, আল্লাহ তার প্রতি মনোনিবেশ করে থাকেন। যখন আশেপাশে তাকায় তখন আল্লাহ দৃষ্টি ফিরিয়ে নেন’। [57]

তিনি আরো বলেন: ‘সালাত  আদায়ের সময় তোমরা আশেপাশে দৃষ্টিপাত কর না। নিশ্চয়ই আল্লাহ তা‘আলা ছালাতের সময় বান্দার মুখের দিকে স্বীয় দৃষ্টি নিবদ্ধ রাখেন, যতক্ষণ না সে আশেপাশে দৃষ্টিপাত করে’। [58]

সালাত রত অবস্থায় এদিক-ওদিকে তাকানো সম্পর্কে রাসূল (সা:)-কে জিজ্ঞেস করা হ’লে তিনি বলেন: ‘এটা শয়তানের এমন এক লুটতরাজি, যার মাধ্যমে সে বান্দার ছালাতের নেকী লুট করে নেয়’। [59]

পরিশেষে বলা যায়, সালাত  ইসলামের সর্বাধিক গুরুত্বপূর্ণ ইবাদত। ‘খুশূ-খুযূ’ ছালাতের প্রাণ। ‘খুশূ-খুযূ’ বিহীন সালাত  প্রাণহীন দেহের মত। আল্লাহর রহমতে আজকের সমাজে নিয়মিত সালাত  আদায়কারীর সংখ্যা খুব কম নয়, কিন্তু অত্যন্ত দুঃখজনক হ’লেও সত্য যে, ছালাতের প্রকৃত হক আদায় করে সালাত  আদায়কারীর সংখ্যা অতি অল্পই। সে কারণে ছালাতের মৌলিক উদ্দেশ্য যেমন আদায় হচ্ছে না, তেমনি ছালাতের বাস্তব ফলাফল আমাদের জীবনে সেভাবে প্রতিফলিত হচ্ছে না। সুতরাং সালাত কে অর্থবহ ও মহান আল্লাহর দরবারে গ্রহণযোগ্য করতে হ’লে এবং জীবনের প্রতিটি পদক্ষেপে ছালাতের বাস্তব প্রভাব লাভ করতে হ’লে ‘খুশূ-খুযূ’সহ সালাত  আদায়ের বিকল্প নেই। আর এজন্য প্রয়োজন নিয়তের খুলূছিয়াত, আল্লাহভীতি, কঠোর অধ্যবসায়, সর্বোপরি আল্লাহর সাহায্য। আল্লাহ আমাদেরকে এসব বৈশিষ্ট্য অর্জনের তাওফীক দান করুন।

আমীন!


Source:https://quraneralo.net/importance-of-khushu-in-salah/
4
আল্লাহ মানুষকে তার এবাদতের জন্যেই সৃষ্টি করেছেন। শুধু মানুষ নয় ; মানুষ ও জ্বীন-উভয় জাতিকে আল্লাহ তার এবাদত তথা তার দাসত্বের জন্য সৃষ্টি করেছেন। আল্লাহ বলেন- অর্থাৎ আমি মানব ও জ্বীন জাতিকে একমাত্র আমার এবাদতের জন্য সৃষ্টি করেছি। ফলে তিনি মানুষের জন্য কিছু দৈহিক, আত্মিক ও আর্থিক এবাদতের প্রচলন করেছেন। দৈহিক এবাদতের মাঝে বিশেষ গুরুত্বপূর্ণ ও মহান এবাদত হল সালাত। সালাত এমন একটি এবাদত যাকে আল্লাহ তার মাঝে এবং তার বান্দার মাঝে সম্পর্ক স্থাপনের মাধ্যম সাব্যস্ত করেছেন।

সালাতের মাধ্যমে একজন মানুষ আল্লাহর সাথে দেয়া প্রতিশ্রুতির বার বার প্রতিফলন ঘটায়। সে তার প্রভু বা স্রষ্টাকে বুঝাতে সক্ষম হয় যে, সে তার প্রতিশ্রুতি পালন করে যাচ্ছে। এ সালাতের মাধ্যমেই মানুষ আল্লাহর নৈকট্য লাভ করে। আল্লাহর সাথে মানুষের সম্পর্কের বন্ধন সুদৃঢ় ও মজবুত হয়। ইহকাল ও পরকালের মুক্তির পথ কংটকমুক্ত হয়। সালাত ব্যক্তি, পরিবার, সামাজিক ও রাষ্ট্রীয় জীবনে শান্তি, শৃঙ্খলা, ভ্রাতৃত্ব ও মমতাবোধ ফিরিয়ে আনে। গড়ে উঠে সামাজিক ঐক্য। সালাতের মাধ্যমে ছগীরা তথা ছোট ছোট গুনাহগুলো হতে পরিত্রাণ লাভ করে এবং দুনিয়া ও আখেরাতের কল্যাণ লাভ হয়।
সালাতের বৈশিষ্ট্য :

সালাত এমন এক এবাদত যা সারা বছর দৈনিক পাঁচ বার আদায় করতে হয়। মৃত্যু ছাড়া আর কোন অবস্থাতেই সালাত মাফ হয় না এমনকি মৃত্যুশয্যাতেও সালাত হতে বিরত থাকার কোন বিধান নেই। আল্লাহ তাআলা প্রথমে পঞ্চাশ ওয়াক্ত সালাত ফরজ করেন। তারপর আল্লাহ মানুষের প্রতি দয়া করে তা কমিয়ে পাঁচ ওয়াক্তে নিয়ে আসেন। তবে সওয়াব ও বিনিময় পঞ্চাশ ওয়াক্তেরই জারী রাখেন। সুতরাং যে ব্যক্তি দৈনিক পাঁচ ওয়াক্ত সালাত আদায় করবে আল্লাহ তাকে পঞ্চাশ ওয়াক্ত সালাত আদায়ের সওয়াব প্রদান করবে।

সালাত একমাত্র এবাদত যা আল্লাহ তাআলা সাত আসমানের উপরেই ফরজ করাকে শ্রেয় মনে করেছেন। তাই রাসূল সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম যখন মেরাজে গমন করেন তখন আল্লাহ তাআলা সরাসরি-কোন প্রকার মাধ্যম ছাড়াই রাসূল সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম -কে সালাতের দায়িত্ব দেন। এতে সালাতের মহত্ত্ব, মর্যাদা ও গুরুত্বের প্রতিফলন ঘটে। রব ও স্রষ্টার সাথে সম্পর্ক স্থাপনে অভিপ্রায়ী একজন মুসলমানের কর্তব্য হল, সে এ মহান এবাদতটির মর্যাদা ও গুরুত্ব অনুধাবন করবে। এবং তার যথার্থতা বজায় রাখতে সচেষ্ট হবে। এছাড়া ও সালাতের অনেক লাভ ও ফজিলত আছে। নিম্নে এর কয়েকটি ফজিলত আলোচনা করা হল।

(১) আল্লাহর একাত্ববাদ ও মুহাম্মদ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম এর রেসালাতের স্বাক্ষ্য দেয়ার পর সালাত হল ইসলামের গুরুত্বপূর্ণ একটি রুকন। রাসূল সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লামঈমাননের পরেই সালাতের কথা উল্লেখ করেন। অতঃপর তিনি বলেন – بني الإسلام على خمس، شهادة أن لا إله إلا الله، وأن محمداً رسول الله، وإقام الصلاة، وإيتاء الزكاة، و صوم رمضان، وحج البيت. (رواه البخاري:7 و مسلم:19)

ইসলামের ভিত্তি পাঁচটি:

(১) এ কথার সাক্ষ্য দেয়া যে, আল্লাহ ছাড়া আর কোন সত্যিকার ইলাহ নেই এবং মোহাম্মদ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লামআল্লা¬হর রাসূল।
(২) সালাত কায়েম করা।
(৩) জাকাত প্রদান করা।
(৪) রমজানের রোজা রাখা।
(৫) বাইতুল্লাহর হজ করা। [বোখারি: ৭ মুসলিম: ১৯]

তিনি আরো বলেন: “সবকিছুর মূল হল ইসলাম, আর ইসলামের খুঁটি সালাত, আর ইসলামের শীর্ষ পীঠ হল জিহাদ।” [তিরমিযি:৩৫৪১]

(২) সালাত আল্লাহর নিকট সবচেয়ে প্রিয় ও সর্বোত্তম আমল। রাসূল সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লামবলেন: “তোমরা অটুট ও অবিচল থাক, গণনা করো না, আর মনে রাখবে তোমাদের সর্বোত্তম আমল হল সালাত, একজন মোমিন অবশ্যই সর্বদা ওজুর সংরক্ষণ করতে থাকে।” ইবনে মাজাহ:২৭৩]

(৩) সালাত নূর- যেমন রাসূল সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম বলেন: “পবিত্রতা ইমানের অর্ধেক আর আলহামদুলিল্লাহ পাল্লাকে সম্পূর্ণ করে, সুবহানালহ ও আলহামদুলিল্লাহ আসমান ও জমিনের মধ্যবর্তী স্থানকে পূর্ণ করে। সালাত নূর-আলো। দান খয়রাত প্রমাণ স্বরূপ। ধৈর্য উজ্জলতা আর কোরআন তোমার পক্ষে প্রমাণ অথবা তোমার বিপক্ষে প্রমাণ।” [মুসলিম:৩২৭]

(৪) সালাত আল্লাহর নৈকট্য ও উচ্চ-মর্যাদা লাভের উপকরণ। সাওবান (রা:) নবী সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম -কে এমন আমল সম্পর্কে জিজ্ঞাসা করেন যা তাকে জান্নাতে প্রবেশ করাবে-রাসূল সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লামউত্তরে বললেন: “তুমি বেশি করে আল্লাহর জন্য সেজদা-সালাত আদায় করতে থাক, কারণ তোমার প্রতিটি সেজদার কারণে আল্লাহ তোমার মর্যাদা বৃদ্ধি করবেন এবং তোমার গুনাহ মাপ করবেন।” [মুসলিম:৭৩৫]

তিনি (সা:) আরো বলেন: ” বান্দা আল্লাহর সবচেয়ে নৈকট্য লাভ করে যখন সে সেজদারত থাকে। সুতরাং তোমরা সেজদার অবস্থায় বেশি বেশি প্রার্থনা কর।” [মুসলিম:৭৪৪]

(৫) সালাত পাপ মোচনকারী এবং ছোট ছোট গুনাহের প্রায়শ্চিত্ত স্বরূপ। রাসূল সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম বলেন: “পাঁচ ওয়াক্ত সালাত, এক জুমা হতে আরেক জুমা মধ্যবর্তী গুনাহ সমূহের প্রায়শ্চিত্ত করে, যতক্ষণ পর্যন্ত সে কবিরা গুনাহে লিপ্ত না হয়।” [মুসলিম:৩৪৪]

এবং রাসূল সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লামগুনাহ প্রায়শ্চিত্তের একটি দৃষ্টান্ত এভাবে বর্ণনা করেন, তিনি বলেন: “যদি তোমাদের কারো বাড়ির দরজায় একটি পুকুর থাকে আর তাতে দৈনিক পাঁচবার গোসল করে, তার শরীরে কোন ময়লা আবর্জনা অবশিষ্ট থাকে ? সাহাবিরা উত্তরে বললেন, না। রাসূল সা. বলেন-অনুরূপ ভাবে পাঁচ ওয়াক্ত নামাজ; আল্লাহ তাআলা দৈনিক পাঁচবার সালাত আদায় করা দ্বারা গুণাহ-পাপাচারগুলো ধুয়ে মুছে ফেলেন।” [মুসলিম:৪৯৭]। তিনি আরো একটি দৃষ্টান্ত বর্ণনা করে বলেন: “মুসলিম বান্দা যখন একমাত্র আল্লাহর সন্তুষ্টির উদ্দেশ্যে সালাত আদায় করে তখন তার গুনাহ এমনভাবে ঝরে পড়তে থাকে যেমন এই বৃক্ষের পাতা ঝরে পড়ে।” [আহমদ : ২০৫৭৬]

(৬) সর্ব প্রথম বান্দার সালাতের হিসাব নেয়া হবে। তাতে হয় সে মুক্তি পাবে অথবা ধ্বংস হবে। নবী করিম সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লামবলেন: কেয়ামতের দিন সর্বপ্রথম বান্দার সালাতের হিসাব হবে। যদি সালাত ঠিক হয় তবে তার সকল আমল সঠিক বিবেচিত হবে। আর যদি সালাত বিনষ্ট হয় তবে তার সকল আমলই বিনষ্ট বিবেচিত হবে। [তিরমিযি:২৭৮]

(৭) সফলতা ও সম্মানিত স্থান জান্নাতে প্রবেশকে আল্লাহ তাআলা সালাতের উপরই স্থাপন করেছেন। তিনি বলেন: “মোমিনগণ সফলকাম, যারা তাদের সালাতে নম্রতা ও ভীতির সাথে দণ্ডায়মান হয়।” [সূরা মোমিন: ১-২]। অতঃপর বলেন: “আর যারা তাদের সালাতে যত্নবান, তারাই জান্নাতের ওয়ারিশ-যারা ফিরদাউসের ওয়ারিশ হবে এবং তথায় তারা চিরকাল থাকবে।” [সুরা আল-মোমিন: ৯,১০,১১]
মনে রাখতে হবে সালাত যেহেতু আল্লাহর নিকট সবচেয়ে প্রিয় আমল আল্লাহর নৈকট্য লাভের ও মর্যাদা বৃদ্ধির কারণ, সালাতের হেফাজত করলে মুক্তি, অন্যথায় ধ্বংস ইত্যাদি-তাই নি:সন্দেহে বলা যায় যে সালাত একটি মহান কাজ যার গুরুত্ব দেয়া অতীব জরুরি। আর তা বাস্তবায়িত হয় সালাত, তার বিধানাবলী তথা রুকন ও ওয়াজিবসমূহ শিক্ষা, সালাতে একাগ্রতা ও পবিত্রতা অর্জনের মাধ্যমেই।
উল্লেখিত ফজিলত লাভের উপযোগী কে হবেন ?

যার সালাতে নিম্ন বর্ণিত বিষয় পাওয়া যাবে, সেই একমাত্র উক্ত ফজিলত লাভের উপযুক্ত বলে বিবেচিত হবে।

(১) শরয়ি পদ্ধতি-যে পদ্ধতিতে রাসূল সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লামসালাত আদায় করতেন। শর্ত পূর্ণ করা, সালাতের রুকন ও ওয়াজিব যথাযথ ভাবে আদায় করা এবং সুন্নতগুলো গুরুত্বের সাথে আদায় করতে চেষ্টা করা।

(২) সালাত খুশু ও একাগ্রতার সাথে আদায় করা। আল্লাহ বলেন: “মোমিনগণ সফলকাম, যারা তাদের সালাতে নম্রতা ও ভীতির সাথে দাঁড়ায়।” [সুরা আল-মোমিন:১,২]

রাসূল সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লামবলেন: “যে কোন মুসলমানের জন্য যখন ফরজ সালাতের সময় উপস্থিত হয়, অত:পর সে সুন্দরভাবে ওজু করে এবং সুন্দরভাবে রুকু সেজদা করে, এতে তার অতীতের সকল গুনাহ মাফ হয়ে যায়। যদি সে কোন কবিরা গুনাহ না করে, আর এভাবে সর্বদা চলতে থাকে।” [মুসলিম:৩৩৫]

(৩) সময় মত সালাত আদায় করা: “রাসূল সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম -কে জিজ্ঞাসা করা হল, আল্লাহর নিকট কোন আমল সবচেয়ে বেশি প্রিয় ? তিনি বলেন-সময় মত সালাত আদায় করা, আবার জিজ্ঞাসা করা হল তার পর কোনটি? উত্তরে তিনি বলেন-মাতা পিতার সাথে সদাচরন করা। আবার জিজ্ঞাসা করা হল তার পর কোনটি? উত্তরে বললেন আল্লাহর পথে জিহাদ করা।” [বোখারি:৪৯৬]

(৪) মসজিদে জামাতের সাথে সালাত আদায় করা। জামাতে সালাত আদায় ওয়াজিব। (জামাতের বিস্তারিত আলোচনা পরবর্তীতে করা হবে।)
সালাত ফরজ হওয়ার হিকমত ও উপকারিতা:

আল্লাহ সালাতকে তার ও বান্দার মাধ্যমে সম্পর্ক স্থাপনের মাধ্যম সাব্যস্ত করেছেন, আল্লাহ অবশ্যই তার বান্দাদের মুখাপেক্ষী নন। তিনি তার বান্দাদের অবস্থা ও স্বভাব সম্পর্কে পরিপূর্ণ জ্ঞান রাখেন। তিনি মহা মর্যাদাবান-পরাক্রমশীল তিনি বান্দার ডাকে সাড়া দেন এবং তাদের দোয়া কবুল করেন।

আল্লাহ মানুষের স্বভাব সম্পর্কে পরিপূর্ণ জ্ঞান রাখেন, কারণ তিনি তাদের স্রষ্টা। তিনি বলেন: “যিনি সৃষ্টি করেছেন তিনি কি জানেন না ? তিনি সূক্ষ্মদর্শী সম্যক অবগত।” [সুরা মুলক]

আল্লাহ মানুষের দুর্বলতা, অক্ষমতা, দরিদ্রতা ও অভাব-সবই জানেন। তিনি এও জানেন যে, তাদের এমন এক মহা শক্তি বিদ্যমান থাকা প্রয়োজন, যার নিকট তারা বিপদে আশ্রয় নিবে, তার কাছে সাহায্য প্রার্থনা করবে, অতপর আল্লাহ নিজেই তার বান্দাদের জন্য এর পথ ও প্রবেশদ্বার খুলে দেন-দৈনিক পাঁচ বার নির্দিষ্ট সময়ে বান্দা সে পথ ও প্রবেশদ্বারের ফটক খুলবে এবং এ ছাড়াও যখন ইচ্ছা প্রবেশ করতে পারবে। যেমন  বকর আল মুযানী রহ.বলেন: হে বনী আদম-আদম সন্তান ! তোমার মত আর কে হতে পারে ? তোমার মাঝে আর মিহরাবের ও পানির মাঝে কোন বাধা অবশিষ্ট রইল না। যখনই তুমি চাও আল্লাহর দরবারে প্রবেশ করতে পার তোমার ও প্রভুর মাঝে কোন মধ্যস্থতা কারী নেই।মুসলিম বিন ইয়াছার বলেন, এমন স্বাদ আর কোন স্বাদ গ্রহনকারীই উপভোগ করতে পারেনি, যেমনটি উপভোগ করেন ঐ ব্যক্তি যে আল্লাহর সাথে নির্জনে কথোপকথন করে।

আল্লাহর- স্বীয় বান্দার প্রতি -অপার অনুগ্রহ হল, তিনি পাঁচ ওয়াক্ত সালাত আদায়ের বিনিময়ে পঞ্চাশ ওয়াক্ত সালাত আদায়ের সওয়াব দান করবেন। এ মানুষের জন্য একটি মহান প্রতিদান, যাতে মানুষ এ সালাতকে স্বাচ্ছন্দ্যে গ্রহণ করে এবং একে অধিক মনে না করে এবং তা আদায়ে কোন প্রকার অলসতা না করে। উল্লেখিত বিষয়গুলো অনুধাবন করা ছাড়াও সালাত ফরজ হওয়ার হিকমত ও কিছু উপকারিতা জানা অতীব জরুরি। আর তা নিম্নরূপ :

(১) আল্লাহর জিকিরের প্রতিষ্ঠা করা। সালাত মানুষকে তার স্রষ্টার কথা স্মরণ করিয়ে দেয়। সুতরাং সালাতে অন্তরের উপস্থিতি প্রয়োজন। সালাত শুধু প্রাণহীন নড়াচড়ার নাম নয়। এই সালাত সম্পর্কে রাসূল (সা:) বলেন: “সালাতেই আমার চোখ জুড়ানো ও শীতলতা নিহিত।” [নাসাঈ:৩৮৭৮] এবং বেলাল রা: তিনি বলেন: “তুমি সালাতের ব্যবস্থা কর এবং তার মাধ্যমে আমাকে তৃপ্ত কর।” [আবু দাউদ:৪৩৩৩]

মূলত প্রকৃত মোমিনের জন্য সালাত এমন, মাছের জন্য পানি যেমন। মাছ পানি ছাড়া বাঁচতেই পারে না। অপর দিকে মুনাফেক দুর্বল ইমানদার সে সালাতে খাঁচায় আবদ্ধ পাখির মত, যে কোন উপায়ে সে তা হতে মুক্তি চায়।

(২) সালাত একজন মুসলমানের মনোবল চাঙ্গা করে এবং শক্তি বৃদ্ধি করে। ফলে সে তার জন্য ইহকালীন জীবনের কষ্ট ক্লেশ এবং জাগতিক সকল প্রকার বিপদ আপদ মোকাবিলা করা সহজ হয়। আল্লাহ বলেন: “এবং তোমরা ধৈর্য ও সালাতের মাধ্যমে সাহায্য প্রার্থনা কর। অবশ্যই তা কঠিন কিন্তু বিনীতগণের জন্যে নয়। যারা ধারণা করে যে নিশ্চয় তারা তাদের প্রতিপালকের সাথে মিলিত হবে এবং তারা তারই দিকে প্রতিগমন করবে।” [সুরা বাকারাহ : ৪৫,৪৬]

একারণেই যখন রাসূল সা: কোন বিষয়ে চিন্তিত হতেন তাড়াতাড়ি সালাতে মগ্ন হতেন। সালাতের মাধ্যমে একজন মোমিন সরাসরি তার প্রভুর সান্নিধ্য পৌঁছে। এবং আল্লাহর নিকট বিপদাপদ ও দু:শ্চিন্তার কারণ গুলো তুলে ধরেন। তার রহমতের ফটক উন্মুক্ত বা খুলে দেয়ার জন্য আকুতি পেশ করেন। একজন সত্যিকার মোমিন অবশ্যই সালাতে তৃপ্তি, প্রশান্তি ও সন্তুষ্টি অনুভব করে। সে আল্লাহু আকবর বলে সালাত আরম্ভ করার সময় অনুভব করে নিশ্চয় আল্লাহ তাআলা সব কিছু হতে বড়। এবং সুরা ফাতেহা পড়ার সময় যখন-(আলহামদু লিল্লাহ) বলে তখন আল্লাহর নেয়ামতের অনুভূতিতে তার মন ভরে যায়। আর যখন সে (الرحمن الرحيم) পড়ে তখন সে অনুভব করে যে আমি রহমানের প্রতি কতই না মুখাপেক্ষী। তখন তার মানস্পটে আশা আরো বিশাল আকার ধারণা করে। আর যখন পড়ে (مالك يوم الدين) তখন আল্লাহর বড়ত্ব ও ইনসাফের কথা তার অন্তরে ফুটে উঠে আর ভয়ভীতি অনুভূত হয়। অত:পর সে স্বীকার করতে বাধ্য হয় যে, এবাদত একমাত্র আল্লাহর জন্য, আর তা আদায় করতে হলে প্রয়োজন আল্লাহর সাহায্য। সে প্রার্থনা করে এ বলে (إياك نعبد وإياك نستعين) অতঃপর সে স্মরণ করে যে, সে সর্বদা সঠিক পথের সন্ধান পাওয়ার মুখাপেক্ষী। তাই সে আল্লাহর নিকট দোয়া করে- اهدنا الصراط المستقيم

রাসূল (সা:) জিকির পবিত্রতা ও সালাতের ভূমিকা ও প্রভাবের কথা স্পষ্টভাবে উল্লেখ করেন। তিনি বলেন: “শয়তান ঘুমন্ত মানুষের ঘাড়ের পশ্চাতে তিনটি গিরা দেয়। আর প্রতিটি গিরায় সে বলে-আরে এখনও অনেক রাত বাকি তুমি ঘুমাও। আর যখন লোকটি ঘুম থেকে উঠে আল্লাহর জিকির করে তখন একটি ঘিরা খুলে যায়। আর যখন ওজু করে তখন তার আর একটি গিরা খুলে যায় আর যখন সালাত পড়ে আর একটি গিরা খুলে যায়। ফলে সে সকাল করে উদ্যমতা ও প্রফুল্ল মন নিয়ে। অন্যথায় সকাল করে অকর্মা এবং অপবিত্র মন নিয়ে।” [বোখারি:১০৭৪]

এবং কাফেররাও সালাতের পর আত্মতৃপ্তি ও অধিক কর্মোদ্যমী হওয়ার কথা স্বীকার করে। তাদের সালাতের যদি এ অবস্থা হয়, তাহলে মুসলমানদের সালাতের অবস্থা কেমন হওয়া উচিত ?

(৩) সালাত মোমিনের অন্তর ও মনুষত্বকে শক্তিশালী করতে সহযোগিতা করে এবং তাকে কল্যাণকর কাজে উৎসাহ জোগায় ও খারাপ কাজ হতে বিরত থাকার জন্য শক্তি জোগায়। এছাড়া সালাত অন্তরে আল্লাহর ধ্যানকে বদ্ধমূল করে এবং ওয়াক্ত সংরক্ষণের প্রতিশ্রুতি পূরণে সমর্থন দেয় এবং প্রবৃত্তির চাহিদা ও আলস্যকে পরাজিত করে। আল্লাহ বলেন: “মানুষ তো সৃজিত হয়েছে অতিশয় অস্থির চিত্তরূপে। যখন বিপদ তাকে স্পর্শ করে তখন সে হয় হা-হুতাশকারী। আর যখন কল্যাণ তাকে স্পর্শ করে তখন হয় অতি কৃপণ। তবে নামাজিরা ব্যতীত, যারা তাদের সালাতে সদা নিষ্ঠাবান।” [সুরা মাআরিজ ১৯-২৩]। আল্লাহ আরো বলেন: “এবং সালাত কায়েম কর। নিশ্চয় সালাত অন্যায় ও অশ্লীল কাজ হতে বিরত রাখে।” [সুরা আনকাবুত -৪৫]
সালাত ত্যাগকারীর বিধান

সালাত ত্যাগ করার মত আর কোন বড় গুনাহ হতে পারে না। সালাত ত্যাগ করার মানে হচ্ছে ইসলামের স্তম্ভ-খুঁটি ভেঙে চূর্ণবিচুর্ণ করা। ইসলামের মাঝে সালাত সম্পর্কে স্পষ্ট ধারণা থাকা সত্ত্বেও সালাত পরিত্যাগ করা যে কত বড় গুনাহ তা বর্ণনা দেয়ার অবকাশ রাখে না। আমরা কোরানের আয়াতগুলোর প্রতি লক্ষ্য করলে দেখতে পাই যে আল্লাহ সালাত ত্যাগকারীদের নয়, বরং ভুলে সালাত আদায় করেনি এমন ব্যক্তিকে কঠিন হুমকি দিয়েছেন, আর যারা নামাজ ত্যাগকারী ও সালাত নষ্টকারী, তাদের কি পরিণতি হবে, তা বলাই বাহুল্য।, দেখুন আল্লাহ সালাত ভুলে যাওয়া ব্যক্তিদের সম্পর্কে বলেন: “আর পরিতাপ সেই নামাজিদের জন্য, যারা তাদের সালাতে অমনোযোগী।” [সুরা মাঊন:৪-৫]

সালাত বিনষ্টকারীদের সম্পর্কে আল্লাহ বলেন: “তাদের পর আসল অপদার্থ পরবর্তীগণ -তারা সালাত নষ্ট করল ও লালসা পরবশ হল ; সুতরাং তারা অচিরেই কুকর্মের শাস্তি প্রত্যক্ষ করবে।” [সুরা মারয়াম :৫৯]

অসংখ্য হাদিস দ্বারাও সালাত ত্যাগ কারীর ক্ষতি প্রমাণিত হয় এবং কোন কোন হাদিসে সালাত ত্যাগকারীকে কাফেরও বলা হয়। যেমন, রাসূল সা: এর বাণী, তিনি বলেন: “ব্যক্তি ও কুফর-শিরকের মাঝে ব্যবধান হল সালাত ত্যাগ করা।” [মুসলিম:১১৬] তিনি আরো বলেন: “আমাদের মাঝে আর অমুসলিমদের মাঝে চুক্তি হল সালাত, যে ব্যক্তি সালাত ছেড়ে দিল সে কাফের হয়ে যাবে।” [আহমদ:২১৮৫৯]

রাসূল সা: জামাতে সালাত পড়া হতে বিরত থাকে এমন লোকদের বাড়ি ঘর জ্বালিয়ে দেয়ার ইচ্ছা পোষণ করেন। সমগ্র ওলামায়ে কেরাম ঐক্যমত পোষণ করেন যে, যারা নামাজ ফরজ হওয়াকে অস্বীকার করে তারা কাফের, আর যারা সালাতের প্রতি উপহাস-বিদ্রূপ ও সালাতকে গুরুত্বহীন মনে করে ছেড়ে দেয় তারাও কাফের। ওলামাগণ বলেন -আর যে ব্যক্তি সালাত ওয়াজিব হওয়াকে স্বীকার করে কিন্তু অলসতা বা অমনোযোগী হওয়ার কারণে সালাত ত্যাগ করে, তখন কর্তৃপক্ষ তাকে তওবা করার জন্য আদেশ দেবে। যদি সে তাওবা করে তাকে ক্ষমা করা হবে আর যদি তওবা না করে এবং সালাত ত্যাগের উপর অটল থাকে -তাকে হত্যা করার ব্যাপারেও সকলে ঐক্যমত পোষণ করেন।

তার এ হত্যা করাটা কি হদ হিসেবে নাকি মুরতাদ বা কাফের হিসাবে ?-এ বিষয়ে ওলামাদের মাঝে মত পার্থক্য আছে। যারা বলেন হদ হিসাবে হত্যা করা হবে তাদের মতানুসারে তার জানাজা পড়া হবে, মুসলমানদের কবরে তাকে দাফন করা হবে, এবং মুসলমান উত্তর সুরীরা তার সম্পত্তিতে মীরাছ পাবে। আর যেসব ওলামা বলেন-তাকে কাফের হিসেবে হত্যা করা হবে, তাদের মতে তার উপর জানাজা পড়া হবে না, তাকে মুসলমানদের কবরে দাফন করা হবে না এবং তার সম্পত্তি মুসলমানদের বাইতুল মালে মালে ফাই বলে গণ্য হবে তার পরিবার পরিজন কেউ ওয়ারিশ হতে পারবে না।

সালাত ত্যাগের পরিণতির বিষয়ে বিশেষ ভাবে চিন্তা করে দেখুন। সালাত ত্যাগী অবশ্যই প্রদীপ্ত আগুন তথা জাহান্নামের সন্নিকটেই অবস্থান করছে। তাই আমাদের উচিত খুব তাড়াতাড়ি তওবা করা এবং দ্রুত সালাত প্রতিষ্ঠা করা এবং সালাতে যত্নবান হওয়া।
জামাতে সালাত আদায় ওয়াজিব হওয়া প্রসঙ্গে:

সালাত আল্লাহ তাআলার মহান আদেশ এবং ঈমানের পরই সালাতের গুরুত্ব। আর সালাত মহা মর্যাদার অধিকারী এবং সালাত ত্যাগকারীর উপর অনেক বিধানই কার্যকর হয়। এ কারণেই আল্লাহ তার বান্দাদেরকে জামাতের সাথে মসজিদে সালাত আদায় করার নির্দেশ প্রদান করেন। সুতরাং, আমরা নিশ্চিন্তে বলতে পারি যে সালাত জামাতের সাথে আদায় করা ওয়াজিব। জামাতে সালাত আদায় করা ওয়াজিব হওয়ার উপর একাধিক প্রমাণ বিদ্যমান আছে।
জামাত ওয়াজিব হওয়ার প্রমাণ :

(১) আল্লাহ রুকুকারীদের সাথে রুকু করার নির্দেশ দেন। তিনি বলেন: “তোমরা সালাত কায়েম কর, জাকাত প্রদান কর এবং রুকুকারীদের সাথে রুকু কর।” [সূরা বাকারাহ] অর্থাৎ- সালাত আদায়কারীর সাথে সালাত আদায় কর।

(২) আল্লা¬হ তাআলা ভীষণ ভয়ের সময় জামাতে সালাত পড়ার নির্দেশ দিয়েছেন। আল্লাহ তার নবীকে বলেন: “এবং যখন তুমি তাদের মাঝে থাক, তখন তাদের জন্য নামাজ প্রতিষ্ঠিত কর, যেন তাদের একদল তোমার সাথে দণ্ডায়মান হয় এবং স্ব-স্ব অস্ত্র গ্রহণ করে: অতঃপর যখন সেজদা সম্পন্ন করে তখন যেন তারা তোমার পশ্চাদ্‌বর্তী হয় এবং অন্যদল, যারা নামাজ পড়েনি, তারা যেন অগ্রসর হয়ে তোমার সাথে নামাজ পড়ে এবং স্ব – স্ব সতর্কতা এবং অস্ত্র গ্রহণ করে।” [সুরা নিসা:১০২]

উল্লেখিত আয়াতটি صلاة الخوف সম্পর্কে অবতীর্ণ হয়েছে। এ বিষয়ে ইজমা বিদ্যমান আছে। আর এ কথা নি:সন্দেহে বলা যায় যে, ভয়ের সময় যদি জামাত ওয়াজিব হয়, তবে নিরাপদ ও স্বাচ্ছন্দ্যের সময় ওয়াজিব হওয়া অধিক যুক্তিযুক্ত।

(৩) নবী করিম সা: জামাতে সালাত আদয়ের নির্দেশ দেন তিনি বলেন: “যখন তারা তিন জন হবে তখন তাদের একজন ইমামতি করবে আর তাদের মাঝে যিনি ভাল পড়তে পারবে সেই ইমাম হওয়ার জন্য অধিক বিবেচ্য।” [মুসলিম:১০৭৭]

(৪) অন্ধ সাহাবি আব্দুল¬হ ইবনে উম্মে মাকতুম রা. জামাতে উপস্থিত হওয়া থেকে বিরত থাকার অনুমতি চাইলে রাসূল সা: তাকে অনুমতি দেননি। তিনি রাসূলের দরবারে এসে বলেন: “ইয়া রাসুলুল্লাহ ! আমি একজন অন্ধ মানুষ, আমার বাড়িও অনেক দূরে এবং আমার একজন পথচালক আছে সে আমার পছন্দনীয় নয়। আমার জন্য ঘরে সালাত পড়ার অনুমতি আছে কি ? রাসূল সা: বললেন তুমি কি আজান শুন ? বললেন হ্যাঁ। তার পর রাসূল সা. বললেন, তাহলে আমি তোমার জন্য জামাতে অনুপস্থিত থাকার কোন অনুমতি দিচ্ছি না।” [আবুদাউদ:৪৬৫]

অন্যান্য বর্ণনায় বর্ণিত আছে তার বাড়ি ও মসজিদের মাঝে খেজুরের বাগান ও অন্যান্য গাছের বাগান বিদ্যমান। শহরটিতে অধিক হারে হিংস্র পশু, কীট, পতঙ্গ বসবাস করত। তিবরানীর বর্ণনায় এসেছে – তিনি বলেন আমি তোমার জন্য অনুমতি দিতে পারছি না। জামাতে সালাত পড়া হতে বিরত ব্যক্তি যদি বুঝতে পারতো জামাতে সালাত পড়ার কি গুরুত্ব, তাহলে সে নিতম্ব, দুই হাত ও দুই পায়ে চড়ে হলেও সালাতে উপস্থিত হত। (তিবরাণী)

(৫) কোন প্রকার অপারগতা ছাড়া জামাত হতে বিরত থাকলে তার সালাতই হয় না। রাসূল (সা:) বলেন: “যে ব্যক্তি আজান শ্রবণ করার পর সালাতে উপস্থিত হয় না তার সালাতই হয় না।” [ইবনে মাজাহ:৭৮৫]

(৬) জামাতে সালাত হতে বিরত থাকা মুনাফেকের নিদর্শন। রাসূল সা: বলেন: “মুনাফেকের জন্য ফজর আর এশার সালাত যত কষ্টকর অন্য আর কোন সালাত অনুরূপ কষ্টকর নয়, তারা যদি এ দুটি সালাতের সওয়াব সম্পর্কে জানতো, তাহলে নিতম্বে ভর করে হলেও এ দুই সালাতে উপস্থিত হত।” [বোখারি:৫৮০]

(৭) জামাত বাদ দেয়া বান্দার উপর শয়তানের কর্তৃত্ব প্রতিষ্ঠার কারণ। রাসূল সা: বলেন: “কোন গ্রাম বা উপত্যকায় তিন জন লোক বিদ্যমান, অথচ সেখানে জামাতে সালাত হয় না তাদের উপর শয়তান প্রাধান্য বিস্তার করবে। সুতরাং, তুমি জামাতকে জরুরি মনে কর। কারণ, বাঘ সাধারণত পাল হতে বিচ্ছিন্ন বকরিটাকেই আক্রমণ করে।” [আবু দাউদ:৮৩৮]

(৮) জামাত ত্যাগ করা আল্লাহর ক্রোধের কারণ হয়। রাসূল সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লামবলেন: “সম্প্রদায়ের লোকেরা হয় জামাত ত্যাগ করা হতে বিরত থাকবে, অন্যথায় আল্লাহ তাদের অন্তরে মোহর মেরে দেবেন অতঃপর তারা গাফেল লোকদের অন্তর্ভুক্ত হবে।” [ইবনে মাজাহ:৭৮৬]

(৭) রাসূল সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লামজামাতে উপস্থিত হওয়া থেকে বিরত লোকদের বাড়ি ঘর জ্বালিয়ে দেয়ার ইচ্ছা করেছেন। তিনি বলেন: “আমার ইচ্ছা হয় মুয়াজ্জিনকে নির্দেশ দিই সে সালাতের একামত বলে আর একজনকে আদেশ করি সে সালাত পড়াবে অতঃপর একটি অগ্নিকুণ্ড নিয়ে বের হই এবং যারা সালাতে উপস্থিত হয়নি তাদের বাড়ি ঘর পুড়িয়ে দিই।” [বোখারি:৬১৭]

হাদিসে রাসূল ঐ সকল লোকদের বাড়ি ঘর জ্বালিয়ে দেয়ার ইচ্ছা করেছেন, যারা মসজিদে আসেনি, তারা ঘরে সালাত পড়ুক, অথবা নাই পড়ুক। জামাতে সালাত ওয়াজিব হওয়ার জন্য এটাই সব চেয়ে বড় দলিল। আর যদি জামাত মোস্তাহাব হত তাহলে এ ধরনের পুড়িয়ে দেয়ার মত সংকল্প করা কোনভাবেই সম্ভব হত না। ছলফে ছালেহীন জামাতের সালাতকে সীমাহীন গুরুত্ব দেন। এমনকি জামাত তরক করাকে মুনাফেকের নিদর্শন হিসাবে গণ্য করেন।

আব্দুল্লাহ বিন মাসঊদ রা. বলেন: “যে ব্যক্তি পছন্দ করে যে সে আগামী দিন আল্লাহর সাথে একজন মুসলমান হিসাবে সাক্ষাৎ করবে, সে যেন সালাত সংরক্ষণ করে, যখন তার প্রতি আহ্বান করা হয়। কারণ, আল্লাহ তোমাদের নবীর জন্য হেদায়াতের পদ্ধতি চালু করেছেন, আর সালাত তার অন্যতম, যদি তোমরা পশ্চাৎগামী লোকটির ন্যায় ঘরে সালাত আদায় কর, তবে তোমরা তোমাদের নবীর আদর্শকে ত্যাগ করলে। আর যদি তোমরা তোমাদের নবীর আদর্শকে ছেড়ে দাও, তাহলে তোমরা পথভ্রষ্ট হবে। অতঃপর তিনি বলেন, আমরা রাসূল সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম -এর যুগে দেখেছি নামাজে উপস্থিত হওয়া থেকে একমাত্র পরিচিত মুনাফেক ছাড়া আর কেউ বিরত থাকতো না, এমনকি কোন কোন লোককে দেখা যেত দুই ব্যক্তির কাঁধে ভর করে তাকে নিয়ে আসা হত তারপর তাকে সালাতের কাতারে দাঁড় করানো হত।” [মুসলিম:১০৪৬] এবং ইবনে ওমর রা. বলেন: আমরা যখন দেখতাম কোন লোক ফজর ও এশার নামাজে অনুপস্থিত তখন তার প্রতি আমরা খারাপ ধারণা করতাম। (ইবনু আবী শাইবা)

ইব্রাহীম তাইমী (রা:) বলেন: যখন দেখবে কোন ব্যক্তি নামাজে প্রথম তাকবীরকে গুরুত্ব দেয় না তুমি তার থেকে হাত ধুয়ে নাও। অর্থাৎ তাকে এড়িয়ে যাও। সুফিয়ান ইবনে উয়াইনাহ বলেন : সালাতের সুন্নত হল সালাতে ইকামত দেয়ার পূর্বেই উপস্থিত হওয়া।

আদি বিন হাতিম (রা:) বলেন : ইসলাম গ্রহণ করার পর যখনই সালাতের ইকামত হত, আমি ওজু অবস্থায় থাকতাম। ইব্রাহীম বিন মাইমুন-তিনি রঙের কাজ করতেন-তার অভ্যাস ছিল, যদি তিনি তুলি উঠানো অবস্থায় আজান শুনতেন তুলিটি ফিরিয়ে নিতেন না বরং তা ঐ অবস্থায় নিক্ষেপ করে দিতেন এবং সালাতে দাঁড়াতেন।

বশার বিন হাসান, পঞ্চাশ বৎসর পর্যন্ত প্রথম কাতার ছাড়েননি এমন কি তার নামও ছফ্‌ফী (কাতারবন্দী) হয়ে যায়। সুলাইমান বিন মাহরান সত্তুর বৎসর জীবিত থাকেন কিন্তু একবার ও তার তাকবীরে উলা-প্রথম তাকবীর -ছুটেনি। অনুরূপ আমাশ রহ. সাইদ বিন আব্দুল আজীজ রহ. যখন জামাতে সালাত ছুটে যেত কান্নাকাটি করতেন। ইবনে ওমর রহ.-এর যখন এশার সালাতের জামাত ছুটে যেত, তিনি অবশিষ্ট রাত ঘুমাতেন না, সারা রাত এবাদত বন্দেগিতে কাটিয়ে দিতেন। সাহাবিরা যে কোন ধরনের প্রতিকুল অবস্থা-অসুস্থতা, ভয়-ইত্যাদি সত্ত্বেও জামাতে উপস্থিত হওয়ার জন্য আকাংখা করতেন।

আবু আব্দুর রহমান আসসুলামী মসজিদে রওয়ানা দিলে পথ মাঝে তার মৃত্যু উপস্থিত হলে লোকেরা তাকে বাড়ি নিয়ে আসতে চাইলে তিনি তা প্রত্যাখ্যান করেন, যাতে তার রূহ ক্ববজ করার সময় তাকে নামাজের প্রতীক্ষা অবস্থায় পাওয়া যায়। সাহাবিরা তাদের সন্তানদেরও নামাজের জামাতের জন্য উৎসাহ দিতেন, তাদের জিজ্ঞাসাবাদ করতেন এবং অলসতার দরুন তাদের শাস্তি দিতেন। খুলাফায়ে রাশেদীনও জামাতের বিশেষ গুরুত্ব দিতেন। যারা জামাতে উপস্থিত হতেন না তাদেরকে হুমকি দিতেন। তৎকালে অক্ষম প্রতিবন্দিদের জন্য একজন লোক নিয়োগ করা হত যিনি জামাতে উপস্থিত হতে তাদের সাহায্য করতেন। যেমন ওমর রা: হতে বর্ণিত, তিনি একজন অন্ধকে সালাতে নিয়ে আসার জন্য একজন গোলাম নিয়োগ করেন।
জামাতে সালাত পড়ার ফজিলত

জামাতে সালাত আদায় কারীদের জন্য মহান আল্লাহ যে সব ফজিলতের ঘোষণা দিয়েছেন, তা জানা অত্যন্ত জরুরি। কারণ, যখন কোন কাজের লাভ ও উপকারিতা জানা থাকে, তখন সে কাজ করার প্রতি আগ্রহ জাগে এবং কাজটি করতে উৎসাহ পাওয়া যায়। মনে রাখতে হবে, জামাতে সালাত আদায়ের অনেক ফজিলত ও লাভ রয়েছে, কিন্তু এসব লাভ শুধু জামাতে সালাত পড়ার মাঝেই সীমাবদ্ধ নয় বরং কোন ব্যক্তি যদি জামাতে সালাত আদায়ের প্রতিজ্ঞা করে, জামাতে সালাত আদায়ের উদ্দেশ্যে মসজিদে আগমন করে, (যদিও সে জামাত পায়নি) জামাতের উদ্দেশ্যে মসজিদে অপেক্ষা করতে থাকে, এমনকি সালাত আদায়কারী জামাতে নামাজ আদায় শেষে বাড়ি ফেরা পর্যন্ত সে ছাওয়াব পেতে থাকবে।

নিম্নে এর বিশদ আলোচনা করা হল:

এক. যে ব্যক্তি মসজিদে জামাতে সালাত আদায় করাকে বেশি বেশি ভালোবাসে আল্লাহ তাআলা কেয়ামত দিবসে আরশের নীচে তাকে ছায়াদান করবে, যেদিন আল্লাহর আশ্রয় ছাড়া আর কোন উপায় থাকবে না। রাসূল সা. বলেন: “সাত ব্যক্তিকে কেয়ামত দিবসে আল্লাহর আরশের নীচে ছায়া দেয়া হবে, যেদিন আল্লাহর ছায়া ছাড়া আর কোন ছায়া অবশিষ্ট থাকবে না –

১) ন্যায় পরায়ণ বাদশা।
২) ঐ যুবক যে তার যৌবন আল্লাহর এবাদতে কাটিয়েছেন।
৩) যে লোকের অন্তর সর্বদা মসজিদের সাথে সম্পৃক্ত থাকে।
৪) দুই ব্যক্তি একে অপরকে আল্লাহর জন্য ভালোবাসে, আল্লাহর জন্য পৃথক হয়।
৫) একজন ক্ষমতাবান সুন্দরী রমণী তাকে আহ্বান করলে, উত্তরে সে বলল নিশ্চয়ই আমি আল্লাহকে ভয় করি।
৬) এক ব্যক্তি এমন গোপনে দান খয়রাত করল, তার বাম হাত জানে না ডান হাতে কি দান করল।
৭) যে নির্জনে আল্লাহর স্মরণ করল, এবং তার চক্ষুদ্বয় হতে অশ্রু প্রবাহিত হতে লাগল।

দুই. -মসজিদে আগমনের ফজিলত: বর্ণিত সওয়াব একমাত্র ঐ ব্যক্তি পাবে যে জামাতে নামাজ আদায় করার জন্যই ঘর হতে বের হয়। এ বিষয় বর্ণিত হাদিস: “যে ব্যক্তি পবিত্র অবস্থায় ফরজ সালাত আদায়ের উদ্দেশ্যে ঘর হতে বের হয়, তার সওয়াব এহরাম বেঁধে হজের উদ্দেশ্যে রওনা হওয়ার সমপরিমাণ।” [আবুদাউদ:৪৭১]

রাসূল সা: বলেন: “গভীর অন্ধকারেও মসজিদে আগমনকারীদেরকে কেয়ামত দিবসে পরিপূর্ণ নুরের সুসংবাদ প্রদান করুন।“[আবুদাউদ:৪৭৪]। রাসূল (সা:) আরো বলেন: “যে ব্যক্তি সকাল ও বিকালে মসজিদে গমন করে আল্লাহ তাআলা প্রতিবারই তার জন্য জান্নাতে মেহমানদারীর ব্যবস্থা করেন।” [বোখারি:৬২২]

তিন. সালাতের অপেক্ষায় বসে থাকা ব্যক্তি সালাতের সওয়াব পাবে। রাসূল সা: বলেন : তোমাদের কেউ সালাতের অপেক্ষা করতে থাকলে, যতক্ষণ পর্যন্ত তার ওজু নষ্ট না হয়, সে সালাতের সওয়াব পেতে থাকবে। আর ফেরেশতারা তার জন্য এ বলে দোয়া করবে- হে আল্লাহ তাকে মাফ কর; তাকে রহম কর; ও দয়া কর ; (মুসলিম:১০৬৩)

চার. প্রথম কাতারের ফজিলত: এ ফজিলত বিশেষ করে ঐ ব্যক্তি পাবে যে জামাতে সর্বাগ্রে উপস্থিত হয় এবং প্রথম কাতারে অংশগ্রহণ করে। প্রথম কাতারের ফজিলত সম্পর্কে হাদিস: “লোকেরা প্রথম কাতার ও আজানের ফজিলত কি তা যদি জানতো, আর তা লটারি ছাড়া লাভ করা সম্ভব না হত তবে তারা লটারিতেও অংশ গ্রহণ করত।” [বোখারি:৫৮০]

পাচ. গুনাহ মাফ হয়: “যে ব্যক্তি পরিপূর্ণভাবে সালাতের ওজু করে তারপর ফরজ নামাজের উদ্দেশ্যে পথ চলে এবং মসজিদে জামাতে সালাত আদায় করে আল্লাহ তাআলা তার যাবতীয় গুনাহ ক্ষমা করে দেন।” [মুসলিম:৩৪১]

ছয়.– দোজখের আগুন হতে নিষ্কৃতি ও নিফাক হতে পরিত্রাণ। রাসূল (সা:) বলেন: “যে ব্যক্তি চল্লিশ দিন যাবৎ প্রথম তাকবীরের সাথে জামাতে সালাত আদায় করে আল্লাহ তাকে দুটি পুরস্কার প্রদান করেন-এক-দোযখের আগুন হতে মুক্তি। দুই-নেফাক হতে নিষ্কৃতি।” [তিরমিযি:২২৪]

সাত. জামাতে সালাত আদায় একা একা আদায় হতে সাতাশ গুন বেশি মর্যাদা রাখে। উল্লেখিত সকল ফজিলত ছাড়াও ইশা ও ফজরের নামাজ জামাতে আদায়কারীর জন্য বিশেষ ফজিলত হাদিসে বর্ণনা করা হয়। এর কারণ, এ দুই সালাতের সময় সাধারণত বিশ্রাম, গভীর অন্ধকার ও ভয়-ভীতির সম্ভাবনা থাকে। এ দুই সালাত মুনাফেকদের জন্য ঈমানের বিলুপ্তির কারণ হয় আর মোমিনদের জন্য কারণ হয় ঈমান বৃদ্ধি এবং অধিক সওয়াব লাভের। রাসূল (সা:) বলেন: “যদি এশা ও ফজরের সালাতের ফজিলত সম্পর্কে জানতে পারতো তাহলে তারা হাতে পায়ে ভর করে হলেও সালাতে অংশ গ্রহণ করতো।” [বোখারি:৫৮০] এবং রাসূল সা: বলেন : যে ব্যক্তি ফজরের সালাত জামাতে আদায় করে, সে আল্লাহর জিম্মায়-দায়িত্বেই থাকে, আর যে ব্যক্তি আল্লাহর জিম্মা-দায়িত্ব বিনষ্ট করে আল্লাহ তাকে উপুর করে জাহান্নামে নিক্ষেপ করবেন। (তিবরানী ) আল্লাহর জিম্মা বিনষ্টের মাঝে দুটি জিনিস অন্তর্ভুক্ত।

     জামাতে ফজরের সালাত আদায়ে অলসতা করা। ফলে আল্লাহর মাঝে যে চুক্তি তা ভঙ্গ হয়ে যায়।
    যে সব ব্যক্তি জামাতে সালাত আদায়ের ফলে আল্লাহর জিম্মার অন্তর্ভুক্ত হল, তাদের কোন ধরনের কষ্ট দেয়া।

এ ছাড়াও ফজর এবং এশার সালাত জামাতে আদায় সম্পর্কে যে সকল হাদিস বর্ণিত আছে তন্মধ্যে একটি হাদিসে বলা হয়, এশার সালাত জামাতে আদায় করা অর্ধেক রাত জাগ্রত থেকে এবাদত করার সমান, আর ফজরের সালাতও যদি জামাতে পড়া হয় তা হলে সারা রাত ক্বিয়ামুললাইল এর-সমতুল্য ছাওয়াব পাওয়া যাবে। এ ছাড়াও হাদিস দ্বারা প্রমাণিত, ফজর ও আছরের সালাতে ফেরেশতাদের উভয় দল দুনিয়াতে একত্রিত হয়।
জামাতে সালাত আদায়ের লাভ ও উপকারিতা:

কোরআন ও হাদিস জামাতে সালাত পড়ার জন্য বিশেষভাবে উৎসাহ প্রদান করে এবং জামাতে সালাত আদায়ের নির্দেশ দেয়, এছাড়া এও প্রমাণিত হয় যে, যারা জামাতে সালাত আদায় করবে না, তাদেরকে নিঃসন্দেহে আজাবের সম্মুখীন হতেই হবে।
জামাতে সালাত আদায়ের বিশেষ কিছু লাভ ও উপকারিত:

এক. জামাতে সালাত আদায়ের ফলে সালাতের পাবন্দী করা সহজ হয়। শয়তান মানুষকে সালাত আদায় হতে দুরে সরানোর হাজারো চেষ্টা সত্ত্বেও নির্দিষ্ট সময়ে সালাত আদায় সহজ হয়। কারণ, শয়তানের ষড়যন্ত্র হল, সে প্রথমে মানুষকে জামাতে সালাত আদায় হতে বিরত রাখে। তারপর সে যে কোন সুন্নত ও নির্ধারিত সুন্নত গুলি আদায়ে বিঘ্ন ঘটায়। তারপর নির্দিষ্ট সময়ে পার করায়, এমনকি অনেক সময় সালাতের ওয়াক্ত পার করে দেয়, ফলে সালাত আদায় করাই হয় না তারপর দেখা যায় সে একত্রে দুই ওয়াক্ত সালাত আদায় করে। এভাবে চলতে চলতে দেখা যাবে, এক সময় এরকম আসবে তখন সে একেবারেই সালাত আদায় করবে না। রাসূল সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম শয়তানের ষড়যন্ত্র ও তা হতে মুক্তির পদ্ধতি সম্পর্কে বলেন: “নিশ্চয় ছাগলের জন্য যেমন বাঘ রয়েছে, তেমনিভাবে মানুষের জন্যও বাঘ রয়েছে। আর মানুষের বাঘ হল শয়তান। বাঘ বকরির পাল হতে বিচ্যুত ও বিচ্ছিন্নটিকেই আক্রমণ করে। সাবধান ! তোমরা বিচ্ছিন্ন হওয়া থেকে বিরত থাক। তোমরা জামাতবদ্ব থাক, মুসলমানদের দলভুক্ত হও এবং মসজিদ মুখী হও।” [আহমদ:২১০২০]

দুই. জামাত কল্যাণ, খোদাভীতি, নেক কাজের প্রতি আগ্রহ এবং কল্যাণকর আমলের দিকে ছুটে যাওয়ার একটি উপযুক্ত ক্ষেত্র। এছাড়াও উত্তম আদর্শ অনুসরণের একটি অভিনব মিলন মেলা। কারণ, মসজিদে জ্ঞানীরাও আসে এবং মূর্খরাও আসে : শিক্ষক ও আসে আবার শিক্ষার্থীরাও আসে। সালাতের পর যে সব ওয়াজ নসিহত এবং শরিয়তের বিধান আলোচনা করা হয়, চরিত্র সংশোধন ও নৈতিকতা সস্পর্কিত সব বিষয় ভিত্তিক আলোচনা করা হয় অথবা বিষয় ভিত্তিক ভাষণ দেয়া হয়, বা দরস দেয়া হয়-যাবতীয় সব কিছুতেই রয়েছে কল্যাণ ও শিক্ষা। এ কারণেই বলা হয় জামাতে সালাত একটি দ্বীনি কেন্দ্র ও মাদরাসা। এছাড়াও একজন ভাই তার অপর ভাইকে ব্যক্তিগতভাবে উপদেশ দিতে পারে। এবং ইমাম সাহেব মোক্তাদির সহযোগিতা করে। মোক্তাদিরাও একে অপরের সহযোগী হিসাবে এমন সব কাজ আঞ্জাম দিতে পারেন যা একজন মানুষ একা একা করতে সক্ষম হয় না।

তিন. জামাত মুসলমানদের স্বকীয়তা এবং তাদের অস্তিত্ব রক্ষার কারণ। মুসলমানদের -বিশেষ করে, অমুসলিম সমাজে মুসলমানদের দুর্বল হয়ে থাকা, তাদের ব্যক্তিত্ব খর্ব করা এবং ঐতিহ্যকে বিনষ্ট করা হতে হেফাজত করে। এর বাস্তব নমুনা আমরা বিভিন্ন মুসলিম সংখ্যালঘু দেশে স্বচক্ষে দেখতে পাই।জামাতে নামাজ আদায়ের কারণে একজন মুসলমান তার দ্বীনি ভাই ও প্রতিবেশীর সাথে পরিচিত হয়, তাদের খোঁজ খবর নেয়, এবং তাদের বিভিন্ন ধরনের সমস্যা সমাধানে যথাসম্ভব ভূমিকা রাখতে পারে, তাদের নিজেদের অধিকার আদায়ে সচেষ্ট হয়। তাদের পরস্পরের মাঝে লেনদেন ও মত-বিনিময় হয়। ফলে মুসলমানদের পারস্পরিক সম্পর্কের ভীত মজবুত। তাদের মাঝে ঈমানী বন্ধন সুদৃঢ় হয়, আপোশে মিল মহব্বত বৃদ্ধি পায়। এতে নেক ও কল্যাণের কাজে সহযোগিতা হয় এবং আল্লাহর আনুগত্যে প্রত্যয়ী হতে সহযোগিতা করে। ফলে মুসলমানদের পারস্পরিক একটি মহা ঐক্য গড়ে উঠে, তারা সমাজে একটি শক্তিশালী অবস্থানে থাকতে সক্ষম হয়, এতে করে তাদের শক্ররা তাদের ভয়ে আতঙ্কিত থাকতে বাধ্য হয়। তারা মুসলমানদের বিরুদ্ধে কোন পদক্ষেপ নিতে তারা হাজারো হিসাব নিকাশ কষে থাকে।

চার. মুসলমানরা যখন জামাতে সালাত আদায়ের পরিপূর্ণ আনুগত্য করে তা মূলতঃ অমুসলিম ভাইদের প্রতি ইসলামের দাওয়াতেরই নামান্তর। কারণ, জামাতে সালাত আদায়ের কারণে মুসলমানদের যে সব বৈশিষ্ট্য ও গুনাবলী ফুটে উঠে তা একজন অমুসলিম ভাইয়ের হৃদয়ংগম করা মোটেই অস্বাভাবিক নয়। জামাতে উপস্থিত হওয়ার জন্য আজানের সুউচ্চ আওয়াজ, মুসলমানদের দলে দলে মসজিদে গমন, নামাজে সুশৃংখলভাবে কাতার বন্দি হওয়া, এক ইমামের পিছনে সকল মানুষ একই ধরনের কার্যাদি একই নিয়মে অত্যন্ত বিনয় ও একাগ্রতার সাথে সম্পাদন-ইত্যাদি ইসলামের দাওয়াত বৈ আর কিছুই নয়।আল্লাহ মোমিনদের নির্দেশ দেন তারা যেন সালাতে খুব সুন্দর অবস্থায় হাজির হয়। এ কারণেই আল্লাহ তাআলা মোমিনদের ওজু করার নির্দেশ দেন।


Source:https://quraneralo.net/importance-of-salah-in-islam/
5
কুরআন আল্লাহর বাণী। সৃষ্টিকুলের উপর যেমন স্রষ্টার সম্মান ও মর্যাদা অপরিসীম , তেমনি সকল বাণীর উপর কুরআনের মর্যাদা ও শ্রেষ্ঠত্ব অতুলনীয়। মানুষের মুখে থেকে যা উচ্চারিত হয়, তম্মধ্যে কুরআন পাঠ সর্বাধিক উত্তম। নিম্নে কুরআন পাঠের প্রতিদান সম্পর্কে কতিপয় হাদীস উপস্থাপন করা হল:

কুরআন শিখানোর প্রতিদান: নবী সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম বলেন: “তোমাদের মাঝে সেই ব্যক্তি উত্তম যে নিজে কুরআন শিক্ষাকরে ও অন্যকে তা শিক্ষা দেয়।” (বুখারী)

কুরআন পাঠের প্রতিদান: রাসূল সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম বলেন: “যে ব্যক্তি পবিত্র কুরআনের একটি অক্ষর পড়বে, সে একটি নেকী পাবে। আর একটি নেকী দশটি নেকীর সমপরিমাণ।” (তিরমিযী)

কুরআন পাঠে যত্ম নেয়ার প্রতিদান: রাসূল সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম বলেন: “যে ব্যক্তি কুরআন পাঠ করবে এবং তা মুখস্থ করবে (এবং বিধি-বিধানের) প্রতি যত্নবান হবে, সে উচ্চ সম্মানিত ফেরেশতাদের সাথে অবস্থান করবে। আর যে ব্যক্তি কষ্ট হওয়া স্বত্বেও কুরআন পাঠ করবে এবং তার সাথে নিজেকে সম্পৃক্ত রাখবে সে দ্বিগুণ ছাওয়াবের অধিকারী হবে।” (বুখারী ও মুসলিম)

রাসূল সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম বলেন: “কিয়ামত দিবসে কুরআন অধ্যয়নকারীকে বলা হবে, কুরআন পড় এবং উপরে উঠ। যেভাবে দুনিয়াতে তারতীলের সাথে কুরআন পড়তে সেভাবে পড়। যেখানে তোমার আয়াত পাঠ করা শেষ হবে, জান্নাতের সেই সুউচ্চ স্থানে তোমার বাসস্থান।” (তিরমিযী)

ইমাম খাত্তাবী (রহঃ) বলেন: হাদীসে এসেছে যে, জান্নাতের সিঁড়ির সংখ্যা হচ্ছে কুরআনের আয়াতের সংখ্যা পরিমাণ। কুরআনের পাঠককে বলা হবে, তুমি যতটুকু কুরআন পড়েছো ততটি সিঁড়ি বেয়ে উপরে উঠো। যে ব্যক্তি সম্পূর্ণ কুরআন পড়েছে সে আখেরাতে জান্নাতের সর্বশেষ সিঁড়ি বেয়ে উপরে উঠে যাবে। যে ব্যক্তি কুরআনের কিছু অংশ পড়েছে সে ততটুকু উপরে উঠবে। অর্থাৎ যেখানে তার পড়া শেষ হবে সেখানে তার ছওয়াবের শেষ সীমানা হবে।”

কুরআন শুপারিশকারী হবে: রাসূল সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম বলেন: “তোমরা কুরআন পাঠ কর। কেননা কিয়ামতের দিবসে কুরআন তার পাঠকের জন্য সুপারিশ কারী হবে।” (মুসলিম) তিনি আরও বলেন: ” কিয়ামত দিবসে সিয়াম ও কুরআন বান্দার জন্য আল্লাহর কাছে সুপারিশ করবে।” (আহমদ, হাকেম হাদীস সহীহ দ্রঃ সহীহ তারগীব তারহীব হা/৯৮৪)

কুরআন নিয়ে পরস্পরিক আলোচনা-পর্যালোচনা করার প্রতিদান: রাসূল (সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম) বলেন: “কোন সম্প্রদায় যদি আল্লাহর কোন ঘরে একত্রিত হয়ে কুরআন পাঠ করে এবং তা পরস্পরে শিক্ষা লাভ করে, তবে তাদের উপর প্রশান্তি নাযিল হয়, আল্লাহর রহমত তাদেরকে আচ্ছাদিত করে এবং ফেরেশতারা তাদেরকে ঘিরে রাখে। আর আল্লাহ তাঁর নিকটস্থ ফেরেশতাদের সামনে তাদের কথা আলোচনা করেন।” (মুসলিম)

কিভাবে কুরআন পাঠ করবে? আনাছ বিন মালেক (রা:) কে নবী সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম এর কুরআন পাঠের পদ্ধতি সম্পর্কে প্রশ্ন করা হলে তিনি বলেন: ”তিনি টেনে টেনে পড়তেন .” বিসমিল্লাহির রাহমানির রাহীম” পাঠ করার সময় ” বিসমিল্লাহ” টেনে পড়তেন. “আর রহমান” টেনে পড়তেন “আর রাহীম” টেনে পড়তেন।” (বুখারী)


Source:https://quraneralo.net/hadith-on-quran-recitation/
6
আবূ উমামাহ আল বাহিলী (রাদ্বিআল্লাহু আনহু) থেকে বর্ণিত। তিনি বলেনঃ “আমি আল্লাহ্‌র রসূল সল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লামকে বলতে শুনেছিঃ “তোমরা কুর’আন পড়, কারণ ক্বিয়ামাতের দিন সে তার পাঠকারীর জন্য শাফা’আতকারী হিসাবে আসবে” [মুসলিম ৮০৪]

এই হাদীসটিতে কুর’আন পড়ার গুরুত্ব এবং এটা আমাদের জন্য যে পুরস্কার বয়ে নিয়ে আনবে সে ব্যাপারে বলা হয়েছে। ক্বিয়ামাতের দিন কুর’আন তার পাঠকারীকে জান্নাত প্রদান করার জন্য আল্লাহ্‌র কাছে অনুরোধ করবে।

আল-নাওয়াস ইবনু সাম’আন (রাদ্বিআল্লাহু আনহু) থেকে বর্ণিত। তিনি বলেন, আমি নাবী সল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম কে বলতে শুনেছিঃ “ক্বিয়ামাতের দিন কুর’আন ও কুর’আন অনুযায়ী যারা ‘আমাল করত তাদেরকে আনা হবে। সূরাহ বাক্বরহ্‌ ও সূরাহ ‘আল ‘ইমরন্‌ অগ্রভাগে থাকবে। রসূলুল্লাহ সল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম সূরাহ দুটি সম্পর্কে তিনটি উদাহরণ দিয়েছিলেন যা আমি কখনো ভুলিনি। তিনি বলেছিলেনঃ “এই সূরাহ দু’টি দু’খণ্ড ছায়াদানকারী মেঘের আকারে অথবা দু’টি কালো চাদরের মত ছায়াদানকারী হিসাবে আসবে যার মধ্যখানে আলোর ঝলকানি অথবা সারিবদ্ধ দু’ঝাঁক পাখীর আকারে আসবে এবং পাঠকারীদের পক্ষ নিয়ে যুক্তি দিতে থাকবে।” [মুসলিম ৮০৫]

আবদ-আল্লাহ ইবনু ‘আম্‌র হতে বর্ণিত। আল্লাহ্‌র রসূল সল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম বলেছেনঃ “ক্বিয়ামাতের দিন সিয়াম এবং কুর’আন জনৈক ব্যক্তির জন্য আল্লাহ্‌র কাছে সুপারিশ করবে। সিয়াম বলবে, ‘হে প্রভু, আমি তাকে দিনের বেলা খাবার এবং অন্যান্য পার্থিব ইচ্ছা থেকে দূরে রেখেছিলাম, সুতরাং আপনি আমাকে তার হয়ে সুপারিশ করতে দিন।‘ কুর’আন বলবেঃ ‘আমি তাকে রাতে ঘুমানোর থেকে বিরত রেখেছিলাম, সুতরাং আপনি আমাকে তার জন্য সুপারিশ করতে দিন।’ এভাবে এদের দু’জনকেই ঐ ব্যক্তির পক্ষ থেকে মধ্যস্থতা করার অনুমতি দেয়া হবে।” [আহ্‌মাদ ৬৫৮৯]

সিয়াম পালনকারী ব্যক্তির উচিৎ রমজানের দিনে এবং রাত্রিতে বেশী বেশী করে কুর’আন তিলাওয়াত করা। কারণ অন্যান্য সময়ের চেয়ে এই দিনগুলোতে কুর’আন পড়ার গুরুত্ব অনেক বেশী। আল্লাহ্‌ তা’আলা যে মহিমান্বিত মাসে এই কুর’আন নাযিল করেছেন, সিয়াম পালনকারী ব্যক্তির উচিৎ সেই মাসটির সর্বোত্তম ব্যবহার করা এবং এর থেকে সাওয়াব হাসিল করা। রাতের বেলা যেহেতু সবধরণের ঝামেলা এবং পারিপার্শ্বিক কোলাহল মুক্ত থাকে, তাই রমজানের রাতে বেশী বেশী কুর’আন তিলাওয়াত করা ভাল। এতে করে যা পড়া হচ্ছে সে দিকে ভালভাবে মনোনিবেশ করা যায় এবং কুর’আনের অর্থ বুঝতে সুবিধা হয়।

জিব্রীল (আলাইহিস সালাম) প্রত্যেক রমজানের রাতে নাবী সল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম-এর সাথে দেখা করতেন এবং একসাথে কুর’আন পড়তেন। জিক্‌র করা যদি কুর’আন পড়ার সমতুল্য কিংবা এর চেয়েও বেশী মর্যাদার হত তাহলে উনারা এই দেখা সাক্ষাতের সময়গুলোতে কিছুসময় অথবা সারাক্ষণই জিক্‌র এ ব্যস্ত থাকতেন। রমজানের সময় কুর’আন পড়া, এ উদ্দেশ্যে একত্রিত হওয়া এবং যে এই ব্যাপারে অধিক জ্ঞানী তার সামনে পড়া মুস্তাহাব অর্থাৎ পছন্দনীয় কাজ। মুসলিম উম্মাহ-এর সকল ন্যায়পরায়ণ সালাফগন রমজানের সময়ে অধিক হারে কুর’আন পড়তেন। সিয়াম পালনরত অবস্থায় তাঁরা মাসজিদে বসতেন এবং বলতেন, আমরা যেন আমাদের সিয়ামকে রক্ষা করি এবং অন্যের ব্যাপারে পরনিন্দা করে সময় নষ্ট না করি। সালাত এবং অন্যান্য সবসময়ই তাঁরা কুর’আন পাঠে নিজেদের ব্যস্ত রাখতেন।

    উসমান (রাদ্বিআল্লাহু আনহু) একদিনের মধ্যে পুরো কুর’আন পড়ে ফেলতেন।
    সালাফগণদের কেউ কেউ প্রতি তিনরাতে তারাবীহ্‌ এর সালাতে কুর’আন পড়ে শেষ করতেন।
    কেউ কেউ সাতরাতের মধ্যে আবার কেউ কেউ দশরাতের মধ্যে পুরো কুর’আন একবার করে তিলাওয়াত করতেন।
    আল-শাফ’ই রমজানের সময় সালাতে তিলাওয়াত বাদেই ষাটবার করে সমস্ত কুর’আন পড়তেন।
    আল-আসওয়াদ রমজানের প্রত্যেক দুইরাত অন্তর অন্তর সম্পূর্ণ কুর’আন পড়তেন।
    ক্বুতাদাহ্‌ রমজান ছাড়া অন্যান্য সময়গুলোতে প্রত্যেক সাতদিনে একবার করে আর রমজানের সময় প্রত্যেক তিনরাতে এবং শেষ দশরাতের প্রত্যেক দিন একবার করে কুর’আন পাঠ করতেন।

আল-হাফিয ইবনু রজাব (রহমাতুল্লাহি আলাইহি) বলেছেনঃ এমন একটি হাদীস বর্ণিত আছে যে, তিন দিনের মধ্যে সম্পূর্ণ কুর’আন পড়া উচিৎ না। তবে, বিশেষ সময়গুলোতে, যেমন, রমজান মাসে- বিশেষ করে শেষ দশদিনে যখন লাইলাত আল-ক্বদ্‌র এর অনুসন্ধান করা হয়, অথবা বিশেষ জায়গাগুলোতে যেমন, যারা মাক্কার অধিবাসী নন, তার যখন মাক্কায় যান, তখন তাদের উচিৎ বেশী বেশী করে কুর’আন তিলাওয়াতের মাধ্যমে এই বিশেষ সময় এবং জায়গাগুলোর পরিপূর্ণ সদ্ব্যবহার করা ও সাওয়াব লাভ করা। কারণ রমজানের সময় এবং মাক্কার মত বিশেষ জায়গাগুলোতে কুর’আন পাঠের মাধ্যমে অধিক সাওয়াব লাভ করা যায়। ইমাম আহমাদ, ইমাম ইসহাক্ব এবং অন্যান্য আরো অনেক ইমামগণ অনুরূপ মত ব্যক্ত করেছেন। উপরে উল্লেখিত সালাফগণের কাজের মাধ্যমেও এর প্রমাণ পাওয়া যায়। যথাযথ শিষ্ঠাচার ও আল্লাহ্‌র প্রতি আন্তরিকতা বজায় রেখে কুর’আন তিলাওয়াত করা উচিৎ। যিনি কুর’আন পড়বেন তার উচিৎ তিনি যা পড়ছেন তা যেন বুঝে পড়েন। অনেকেই তাড়াহুড়ো করে পড়েন, এটা ঠিক না। বরং আমাদের উচিৎ ধীরে ধীরে কুর’আনের আয়াত ও শব্দের অর্থের প্রতি খেয়াল রেখে পড়া, যাতে করে আমরা যা পড়ছি তা যেন নিজেরা বুঝতে পারি। এতে করে প্রতিটি শব্দের উচ্চারণও সঠিক হবে এবং একাগ্রচিত্তে কুর’আন পড়া হবে।

আল্লাহ্‌ রাব্বুল ‘আলামীন বলেছেনঃ“এটি একটি অত্যন্ত বরকতপূর্ণ কিতাব, যা (হে মুহাম্মাদ!) আমি তোমার প্রতি নাযিল করেছি, যাতে এরা তার আয়াত সম্পর্কে চিন্তা-ভাবনা করে এবং জ্ঞানী ও চিন্তাশীলরা তা থেকে শিক্ষা নেয়।” [সূরা সোয়াদ; ৩৮:২৯]

আমাদের মধ্যে অনেকেই এমন আছেন যারা আশেপাশে লোকজন নিয়ে কুর’আন পড়তে বসেন, এবং মাঝে মাঝেই পড়া বাদ দিয়ে তাদের সাথে কথা বলতে শুরু করে দেন, যেটা কুর’আন পড়ার মূল উদ্দেশ্যকে ব্যহত করে এবং এতে করে কুর’আন এর আদবের বরখেলাফ হয়। যিনি কুর’আন পড়ছেন তার উচিৎ কুর’আন অনুযায়ী চলা অর্থাৎ কুর’আনে যেটার অনুমতি দেয়া হয়েছে সেটাকে হালাল মেনে নিয়ে সে অনুযায়ী কাজ করা এবং কুর’আনে যেটার অনুমতি নেই সেটাকে হারাম মেনে নিয়ে তা থেকে দূরে থাকা। এর ফলে ক্বিয়ামাতের দিন কুর’আন ঐ ব্যক্তির হয়ে সাক্ষ্য দিবে এবং তাকে জান্নাতে প্রবেশ করানোর জন্য আল্লাহ্‌র কাছে সুপারিশ করবে।

সমস্ত বিষয়েই আল্লাহ্‌ সর্বজ্ঞ।

সূত্রঃ আহকাম আল-সিয়াম
7
Quran / কোরআনের চ্যালেঞ্জ
« Last post by Mrs.Anjuara Khanom on Today at 01:47:14 PM »
বিষয়বস্তু উপস্থাপনের দিক থেকে কোরআন আল-কারীম এক অনন্য সাধারন বৈশিষ্ট্যের অধিকারী হলেও কোরআন নিজেই অলৌকিকতায় ভরপুর এক বিস্ময়কর গ্রন্থ। “অলৌকিক” বলতে সাধারণত আমরা যা বুঝি তা হল, অতিপ্রাকৃতিক কিংবা বিস্ময়কর কোন ঘটনা যা মানুষের পক্ষে কখনই উপলব্ধি করা সম্ভব নয়। নবী কারীম (সা:) তৎকালীন আরবদেরকে কোরআনের ভাষা, ছন্দ ও বিষয়বস্তুর অলংকারের সমতুল্য সাহিত্য রচনার জন্য চ্যালেঞ্জ জানিয়েছিলেন অথচ তারাই কাব্যসাহিত্যে ব্যাপক পারদর্শী ছিল। কিন্তু কাব্য রচনায় নিজেদের এতো সাফল্য আর উৎকর্ষতা থাকার পরেও তারা উক্ত চ্যালেঞ্জের জবাব দিতে ব্যর্থ হয়েছে। কোরআন এর অবিকল কিছু সৃষ্টির ঐ চ্যালেঞ্জ আরবসহ পুরো মানবজাতির উপর তিনটি পর্যায়ে দেয়া হয়েছেঃ
১. সম্পূর্ণ কোরআন:

কোরআন আল-কারীমে আল্লাহ্‌ রাব্বুল ‘আলামীন প্রিয় নবী (সা) কে প্রথমে এই বলে সকল মানুষকে চ্যালেঞ্জ ছুঁড়ে দিতে বলেছেন যে, পারলে তারা যেন কোরআনের সমমর্যাদার কোন গ্রন্থ বানিয়ে দেখায়ঃ “বলঃ যদি সকল মানুষ ও জিন মিলে কোরআনের অবিকল কিছু বানিয়ে আনার চেষ্টা করে, তবুও তারা পারবেনা, এমনকি যদি তারা একে অপরকে সাহায্যও করে।” [সূরা আল-ইস্‌রা: ১৭:৮৮]
২. দশটি সূরা:

যারা এর সত্যতাকে এরপরও অস্বীকার করে যাচ্ছিল তাদেরকে আল্লাহ্‌ রাব্বুল ‘আলামীন নিদেনপক্ষে কোরআনের মত করে দশটি সূরা রচনা করতে বললেনঃ “অথবা তারা কি এটা বলে নাকি যে সে (মুহাম্মাদ) নিজেই এটা রচনা করেছে? (তাদের) বল, ‘যদি তাই হয়, তাহলে তোমরাও এর অনুরূপ (মাত্র) দশটি সূরাহ নিয়ে আসো এবং আল্লাহ্‌ ছাড়া তোমারা আর যাদের উপাসনা কর তাদেরকেও সাহায্য করতে বল, যদি তোমরা সত্যবাদী হও।” [সূরা হূদ: ১১:১৩]

সর্বশেষ চ্যালেঞ্জ ছিল, অন্তত পক্ষে কোরআন-এর একটি সূরার অনুরূপ তারা যেন বানিয়ে আনে, আর কোরানের সবচাইতে ছোট সূরা হচ্ছে সূরা আল-কাউসার, যার আয়াত সংখ্যা মাত্র তিনটি। “এবং আমার বান্দার (মুহাম্মাদ) উপর আমি যা নাযিল করেছি, তার ব্যাপারে তোমাদের মনে যদি বিন্দুমাত্র সন্দেহ থাকে, তাহলে এর অনুরূপ একটি সূরা নিয়ে আসো, এবং আল্লাহ্‌ ছাড়া তোমাদের আর যেসব সাহায্যকারী আছে তাদের সাহায্যের জন্য ডাকো, যদি তোমরা সত্যবাদী হও।” [সূরা আল বাক্বারাহ্‌:  ২:২৩]

এই চ্যালেঞ্জগুলা কিন্তু নিছক কথার কথা ছিল না যে, কেউ এর জবাব দিতে চায়নি কিংবা কোরআনকে ভুল প্রমাণিত করতে চায়নি। প্রিয় নবী মুহাম্মাদ (সা:) মানুষদের আল্লাহ্‌র একত্ববাদ, সকল ধরণের মূর্তিপূজা বাতিল এবং দাস-দাসী ও মনিবের মধ্যে যে সাম্যবাদের ডাক দিচ্ছিলেন তা সাধারণভাবে মাক্কার আর্থসামাজিক প্রেক্ষাপট এবং বিশেষ করে শাসকগোষ্ঠী কুরাইশ গোত্রের জন্য তাদের কর্তৃত্ব বজায় রাখার ক্ষেত্রে হুমকি হয়ে দাঁড়াচ্ছিল। আরবের প্রধান বাণিজ্য ও ধর্মীয় কেন্দ্র মাক্কার অধিবাসীরা রাসূল (সা:) এর সেই সাম্যবাদের বিস্তার রোধ করার জন্য মরিয়া হয়ে ছিল। এর জন্য তাদের শুধু এটুকু করলেই চলত, যদি তারা কোরআনের অনুরূপ মাত্র একটি সূরা বানিয়ে আনতে পারত! বহু কুরাইশ কবি ও বাকপটু লোক উক্ত চ্যালেঞ্জের উত্তর দিয়ে গিয়ে চরমভাবে ব্যর্থ হয়েছে। চ্যালেঞ্জে ব্যর্থ হয়ে তারা বরঞ্চ তাঁকে অনেক সম্পদ, সর্বোচ্চ ক্ষমতার আসন এমনকি গোত্রের সবচাইতে অভিজাত এবং সুন্দরী মেয়েদেরকে উপঢৌকন হিসেবে দেওয়ার প্রস্তাব করেছিল। আর তা করেছিল শুধুমাত্র এই জন্যে যে, যাতে তিনি ইসলামের এই দা’ওয়াত বন্ধ করে দেন।

উল্টো তিনি তাদের সূরা ফুসসিলাত এর প্রথম তেরটি আয়াতের আবৃত্তির মাধ্যমে তাদের জবাব দেন। এতে তারা যারপরনাই বিরক্ত হয়ে তাঁকে থামতে বলেন [ আল হাকীম, আল-বাইহাক্বী, আবূ ইয়’লা ও ইবন্‌ হিশাম কর্তৃক সংগৃহীত, ইব্‌রহীম আল-‘আলী তাঁর সহীহ্‌ আস-সীরাহ্‌ আন-নাবাওয়ীয়্যাহ-তে এই বর্ণনাকে ‘হাসান’ বলেছেন, পৃঃ৬৪]। প্রিয় নবী (সা:) কে প্ররোচিত করতে ব্যর্থ হয়ে কুরাইশরা তাদের দাস-দাসী ও আত্মীয়দের মধ্যে যারা ধীরে ধীরে ইসলাম গ্রহণ করছিল, তাদেরকে পৌত্তলিক ধর্মে ফিরিয়ে আনার জন্য নির্যাতন করে যাচ্ছিল। যদিও তারা ইসলাম থেকে ফিরে আসেননি। এতো কিছুতে না পেরে পরবর্তীতে তারা প্রিয় নবী (সা:) এবং তাঁর অনুসারী ও তাঁর বংশ বানূ হাশীম গোত্রের উপর অর্থনৈতিক নিষেধাজ্ঞা জারি করে, যাতে করে তারা অনাহারের কষ্টে তাদের কাছে মাথা নত করে। বলাবাহুল্য, তাদের এই চেষ্টাও বিফলে গিয়েছে। শেষমেশ তারা তাঁকে মেরে ফেলার সিদ্ধান্ত নেয়। এই উদ্দেশ্যে তারা কুরাইশদের সকল বংশ থেকে একজন করে সশস্ত্র লোককে পাঠায়, যাতে করে পরবর্তীতে নবী কারীম (সা:) এর নিজস্ব বংশের লোকেরা আর তাদের উপর প্রতিশোধ নিতে না পারে।

যাইহোক, এই পরিপ্রেক্ষিতে আল্লাহ্‌ রাব্বুল ‘আলামীন রাসূল (সা:) সহ তাঁর সকল অনুসারীগণকে মক্কা থেকে উত্তরে ইয়াসরিব নামক শহরে চলে যাওয়ার নির্দেশ দেন যেখানে আগে থেকেই বেশ কিছু মানুষ ইসলাম গ্রহণ করছিল। ইয়াসরিব এর লোকজনদের মধ্যে ইসলাম খুব দ্রুত ছড়িয়ে পড়ছিল এবং বছর না ঘুরতেই মুসলিমরা সেখানে সংখ্যাগরিষ্ঠতা অর্জন করে ফেলে। প্রিয় নবী (সা:) কে সেখানকার শাসক বানানো হয় এবং ইয়াসরিব শহরটিকে মাদীনাহ্‌  আন-নবী [নবী (সা:)-এর শহর] এই নামে নতুন করে নামকরণ করা হয়। পরবর্তী আট বছরের বিভিন্ন সময়ে মক্কা এবং এর আশেপাশের বিভিন্ন গোত্র ও বংশের অধিবাসীরা ক্রমবর্ধমান মদীনাহ্‌-এর মুসলিম রাষ্ট্রের বিরুদ্ধে বেশ কয়েকটি ব্যর্থ যুদ্ধাভিযান চালায়। যার পরিসমাপ্তি ঘটে মুসলিমদের মক্কা বিজয়ের মধ্য দিয়ে। কুরাইশ এবং তাদের মিত্র বাহিনী কেউ যদি শুধুমাত্র কোরআনের সূরা এর অনুরূপ মাত্র তিনটি কবিতার লাইন কিংবা পুঁথি রচনা করতে পারত তাহলেই কিন্তু এতো রক্তারক্তির আর দরকার পড়ত না। সুতরাং, একথা নিঃসন্দেহে বলা যায় যে, কোরআনের ভাষাশৈলীর অনুপম মর্যাদা, শব্দের মাধুর্য এবং ছন্দের গতিশীলতার এই অলৌকিক বিস্ময় কোন মানুষের পক্ষে অনুকরণ করা সম্ভব নয়।

অনেকে এমনটা ধারণা করে যে, কোরআনের অসাদৃশ্যতা এমন কোন অনন্য বৈশিষ্ট্য নয়। যেমন, বিখ্যাত ইংরেজ কবি শেক্সপীয়ার, চসার অথবা যে কোন ভাষারই যে কোন বিখ্যাত কবির প্রত্যেকেরই নিজস্ব একটা রচনাশৈলী থাকে যা তাদের সমসাময়িক অন্যান্য লেখকদের থেকে পৃথক করে রাখে। কিন্তু যদি এমন হয়, আজকের দিনের শীর্ষস্থানীয় কোন কবি শেক্সপীয়ার এর সাহিত্যকর্মের উপর গভীর পড়াশুনা করে এবং পুরাতন কালি দিয়ে পুরাতন কোন কাগজে শেক্সপীয়ারের রচনাশৈলী নকল করে নিজে কোন ‘সনেট’ লিখে সেটা শেক্সপীয়ারের নামে দাবী করে, তাহলে তার সেই দাবীকৃত কবিতাটি ভালভাবে দেখার পর হয়তো সেটা শেক্সপীয়ারের বলেই মেনে নেয়া হবে।

একজন কবি যতই বড় হোকনা কেন, এভাবে ঠিকই তাঁর রচনাশৈলীর অনুকরণ করা যায়। অনেক বড় এবং বিখ্যাত চিত্রকরের চিত্রকর্ম ঠিক যেমন অনুকরণ করা সম্ভব হয়েছে। [প্রকৃত পক্ষে অনেক ইংরেজ সাহিত্যিকদের মতে শেক্সপীয়ার এর সাহিত্যকর্ম হিসেবে যেগুলা ধরা হয়, তার বেশকিছু আসলে তারই সমসাময়িক লেখক ক্রিস্টোফার মার্‌ল এর লেখা।] কোরআন এই ক্ষেত্রে অনেক বেশীই উপরে। কেননা, ১৪০০ বছর আগ থেকে এখন পর্যন্ত অনেকেই কোরআন এর অনুরূপ সূরা নকল করে লেখার অনেক চেষ্টা করেছে, কিন্তু ভাল করে পরীক্ষা করার পর দেখা গেছে ওগুলো নিরর্থক পণ্ডশ্রম; নান্দনিক বৈশিষ্ট্যের দিক থেকে কোরআনের সামান্য একটি আয়াতের ধারেকাছে যাওয়ারও ক্ষমতা এদের নেই। যেমনটি আগেই উল্লেখ করা হয়েছে, তখন কোরআন এর অনুকরণ করার চেষ্টা ছিল এখনকার যেকোনো সময়ের চেয়ে বড় সময়ের দাবি, যখন কোরআন নাযিল হচ্ছিল, যখন সাহিত্যের চর্চা ছিল সর্বোচ্চ শিখরে। অথচ তখনই কেউ এর অনুরূপ কিছু সৃষ্টি করতে পারেনি, আর এখনতো প্রশ্নই উঠে না!


Source:https://quraneralo.net/challenge-of-the-quran/
8
সমস্ত প্রশংসা আল্লাহ তাআলার জন্য নিবেদিত। দরূদ ও সালাম অবতীর্ণ হোক সেই মহান নবীর উপর যার পরে আর কোন নবী নেই। আরো নাযিল হোক তাঁর পরিবার বর্গ, সহচর বৃন্দ এবং তাঁর হেদায়াতের অনুসারীদের উপর।

অত:পর হে মুসলিম ভাই! এ কথা জেনে নিন যে, আল্লাহ সুবহানাহু ওয়া তাআলা সকল বান্দার উপর ইসলামে প্রবেশ করা, উহা আঁকড়ে ধরা এবং উহার পরিপন্থী বিষয় থেকে সতর্ক থাকা ফরজ করেছেন। আর নবী মুহাম্মাদ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লামকে সে দিকে আহবান করার জন্যই প্রেরণ করেছেন। আল্লাহ্‌ এই মর্মে ঘোষণা দিয়ে বলেন, যে ব্যক্তি নবী সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম-এর অনুসরণ করবে সে হেদায়াত প্রাপ্ত হবে পক্ষান্তরে যে তাঁর থেকে বিমুখ হবে সে পথভ্রষ্ট হবে। তিনি বহু আয়াতে মুরতাদ হওয়ার মাধ্যম, শির্ক ও কুফরীর সকল প্রকার হতে সতর্ক করেছেন।

বিদ্যানগণ মুরতাদের বিধি-বিধান অধ্যায়ে এই মর্মে উল্লেখ করেছেন যে, একজন মুসলমান ব্যক্তির রক্ত ও ধন-সম্পদ হালাল কারী বিভিন্ন ইসলাম বিধ্বংসী কার্য কলাপ সম্পদনের মাধ্যমে মুরতাদ ও ইসলাম হতে বহিস্কার হয়ে যায়। ইসলাম বিধ্বংসী কাজ হল সর্ব মোট ১০টি যা শাইখুল ইসলাম ইমাম মুহাম্মাদ বিন সুলায়মান আত তামীমী (রহিমাহু্মুল্লাহ) ও অন্যান্য বিদ্বানগণ উল্লেখ করেছেন। আমরা ঐ সকল ইসলাম বিধ্বংসী কাজ গুলো নিন্মে সংক্ষিপ্ত ভাবে কিঞ্চিত ব্যাখ্যা বিশ্লেষণ সহ আপনার জন্য উল্লেখ করছি। যাতে আপনি উক্ত বিষয়গুলো থেকে সতর্ক থেকে অপরকে সতর্ক করতে পারেন।
ইসলাম বিধ্বংশী কাজ গুলো নিন্মরূপঃ

প্রথমঃ আল্লাহর ইবাদতে শির্ক করা। আল্লাহ বলেনঃ “নিশ্চয় আল্লাহ তার সাথে শির্ক করাকে ক্ষমা করেন না। উহা ব্যতিরেকে উহার নিন্ম পর্যায়ের পাপ সবই তিনি যাকে ইচছা ক্ষমা করেন।” [নিসা: ১১৬]

আল্লাহ তাআলা আরও বলেনঃ “নিশ্চয়ই যে ব্যক্তি শির্ক করবে আল্লাহ তার উপর জান্নাত হারাম করে দিবেন এবং তার বাসস্থান হবে জাহান্নাম, আর এই সমস্ত যালিমদের জন্য কোন সাহায্যকারী থাকবে না।” [সূরা মায়েদাহ্‌: ৭২]

জ্ঞাতব্যঃ এই শির্কের অন্তর্ভূক্ত হল: মৃতকে আহবান করা, তাদের নিকট ফরিয়াদ করা, তাদের জন্য নযর-নেয়াজ মানা ও পশু যবেহ করা। যেমন কোন ব্যক্তি জ্বিনের জন্য বা কোন কবেরর জন্য যবেহ করল ইত্যাদি।

দ্বিতীয়ঃ নিজের ও আল্লাহর মধ্যে মধ্যস্থতা সাব্যস্ত করে তাদের উপরেই ভরসা রাখা। এই ধরণের ব্যক্তি সর্ব সম্মতিক্রমে কাফের বলে গণ্য।

তৃতীয়ঃ  মুশরিককে মুশরিক বা কাফেরকে কাফের না বলা বা তাদের কুফরীতে সন্দেহ পোষণ করা কিংবা তাদের ধর্মকে সঠিক ভাবা।

চতুর্থঃ এই বিশ্বাস করা যে অন্যের আদর্শ নবী সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লামের আদর্শের চাইতে অধিক পূর্ণাঙ্গ। কিংবা এই বিশ্বাস করা যে, অন্যের বিধান নবী সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লামের বিধান অপেক্ষা অধিক উত্তম। (যেমন কেউ কেউ তাগুতের বিধানকে নবীর বিধানের উপর শ্রেষ্ঠত্ব দিযে থাকে) সে ব্যক্তি কাফের বলে গণ্য হবে।

পঞ্চমঃ রাসূল সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম আনিত কোন বস্তুকে ঘৃণার চোখে দেখা। এমতাবস্থায় সে কাফের বলে গণ্য হবে যদিও সে ঐ বস্তুর উপর বাহ্যিক ভাবে আমল করে। আল্লাহ তাআলা বলেনঃ “ইহা এজন্যই যে, তারা আল্লাহর নাজিলকৃত বিষয়কে ঘৃণা করেছে সুতরাং আল্লাহ তাদের আমল গুলোকে পণ্ড করে দিয়েছেন।” [সূরা মুহাম্মাদ: ৯]

ষষ্ঠঃ দ্বীনের কোন বিষয় নিয়ে বা তার পুরস্কার কিংবা শাস্তিকে নিয়ে ঠাট্টা-বিদ্রুপ করা। আল্লাহ্‌ তাআলা বলেনঃ “আপনি বলুন (হে রাসূল) তোমরা কি আল্লাহর সাথে, স্বীয় আয়াত সমূহের সাথে এবং রসূলের সাথে ঠাট্টা করছিলে? কোন প্রকার ওজর-আপত্তির অবতারণা কর না। তোমরা ঈমান আনায়নের পর আবার কুফরী করেছ।” [সূরা তাওবাহ্‌: ৬৫-৬৬]

সপ্তমঃ যাদু-টোনা করা: যাদুর অন্যতম প্রকার হল তন্ত্র-মন্ত্রের সাহায্যে দুজন মানুষের বন্ধন তৈরী করা বা তাদের মাঝে সম্পর্ক ছিন্ন করা। সুতরাং যে ব্যক্তি যাদু করবে বা তাতে রাজি হবে সে কাফের বলে বিবেচিত হবে। আল্লাহ তাআলার বলেনঃ “ঐ দুজন (হারূত- মারুত ফেরেস্তা) কাউকে যাদু শিক্ষা দিতেন না যতক্ষণ পর্যন্ত এই ক্থা না বলতেন-নিশ্চয় আমরা (তোমাদের জন্য) পরীক্ষা স্বরূপ। সুতরাং (আমাদের নিকট যাদু শিখে) কাফের হয়ো না।” [সূরা বাকারা: ১০২]

অষ্টমঃ মুশরিকদেরকে মুসলমানদের বিরূদ্ধে সাহায্য সহযোগিতা করা। আল্লাহ তাআলার বাণী: “তোমাদের মধ্য হতে যে ওদের (অর্থাৎ বিধর্মীদের) সাথে বন্ধুত্ব করবে সে তাদেরই দলভূক্ত বলে গণ্য হবে। নিশ্চয় আল্লাহ যালেমদেরকে হেদায়াত দান করেন না।” [সূরা মায়েদা: ৫১]

নবমঃ এ বিশ্বাস করা যে, কারও জন্য মুহাম্মাদ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম এর শরীয়তের বাইরে থাকার অবকাশ রয়েছে। যেমন (এক শ্রেণীর ভণ্ড সূফীর ধারণা অনুপাতে) অবকাশ ছিল খিযির (আ:)এর জন্য মূসার (আ:) শরীয়ত হতে বাইরে থাকার। এ বিশ্বাসেও সে কাফের হয়ে যাবে। আল্লাহ তাআলা বলেন: “যে ব্যক্তি ইসলাম ব্যতীত অন্য ধর্ম অন্বেষণ করবে তার থেকে তা গ্রহন করা হবে না। এবং সে পরকালে ক্ষতি গ্রস্থদের দলভূক্ত হবে।” [সূরা আলে ইমরান: ৮৫]

দশমঃ সম্পূর্ণ রূপে আল্লাহর দ্বীন হতে বিমুখ থাকা। সে ব্যাপারে জ্ঞানার্জন না করা, তদানুযায়ী আমল না করা, এই ধরণের মন-মানষিকতার ব্যক্তিও কাফের বলে পরিগণিত হবে। আল্লাহ তাআলা বলেনঃ “ঐ ব্যক্তি অপেক্ষা কে বেশী যালিম (অত্যাচারী) হতে পারে, যাকে উপদেশ দেওযা হয়েছে স্বীয় প্রতিপালকের আয়াত সমূহ দ্বারা অত:পর সে উহা হতে বিমুখ হয়েছে? নিশ্চয় আমি অপরাধীদের থেকে প্রতিশোধ গ্রহণ কারী।” [সূরা সাজদাহ্‌: ২২]

কোন লোক এ সকল বিষয়ে লিপ্ত হলে সে কাফের বলে বিবেচিত হবে চাই সে মজা করার জন্য এ সকল কাজ করুক বা গুরুত্ব সহকারে করুক, সেচ্ছায় করুক বা ভয়ে করুক। অবশ্য কাউকে যদি  বাধ্য করা হয় তবে তার ব্যাপার আলাদ।  এ সমস্ত ইসলাম বিধ্বংশ বিষয় অত্যন্ত মারাত্মক। তার পরও তা ব্যাপকভাবে এসব সংগঠিত হয়ে থাকে। সুতরাং মুসলিম ব্যক্তির উপর অপরিহার্য কর্তব্য হল এ সকল বিষয় থেকে সতর্ক থাকা। আমরা আল্লাহর নিকট তার ক্রোধ অবধারিত কারী বিষয় হতে এবং তাঁর যন্ত্রনা দায়ক শাস্তি হতে আশ্রয় প্রার্থনা করছি। সৃষ্টির সেরা মুহাম্মাদ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লামের উপর, তাঁর পরিবারের উপর, সাহাবীগণের উপর আল্লাহ রহমত ও শান্তির ধারা অবতীর্ণ হোক। [এখান থেকেই শাইখুল ইসলাম মুহাম্মাদ বিন সুলায়মান আত তামীমী (রহ:) এর বক্তব্য শেষ]।

উল্লেখিত চতুর্থ প্রকার ইসলাম বিধ্বংশী বিষয়ের অন্তর্ভূক্ত হবে ঐ ব্যক্তি যে বিশ্বাস করে যে, মানুষ যে সমস্ত সংবিধান রচনা করেছে উহা ইসলামী সংবিধানের চেয়েও উত্তম, অথবা উহার সম পর্যায়ের অথবা এই বিশ্বাস করে যে, ঐ সমস্ত মানব রচিত বিধানের নিকট ফায়সালা তলব করা জায়েয, যদিও শরীয়তের বিধানকেই সে উত্তম মনে করে- এধরণের সকল বিশ্বাসই চতুর্থ প্রকার ইসলাম বিধ্বংশী বিষয়ের অন্তর্ভূক্ত।

অনুরূপভাবে যদি কেউ বিশ্বাস করে যে ইসলামের বিধি-বিধান এই বিংশ শতাব্দীতে বাস্তবায়ন যোগ্য নয়। অথবা এই বিশ্বাস করে যে, ইহাই মূলত: মুসলিমদের পশ্চাদ মুখী হওয়ার কারণ। অথবা উহাকে সে স্বীয় প্রতি পালকের সাথে সর্ম্পর্কত করার মধ্যেই সীমিত রাখে, জীবনের অন্যান্য বিষয়ের কোন কর্তৃত্ব নেই বলে ধারণা করে।অর্থাৎ বলে যে শরীয়ত ব্যক্তিগত জিনিস, সমাজ, রাষ্ট বা জীবনের অন্য ক্ষেত্রে শরীয়তের প্রয়োজন নাই তাহলে সেও চতুর্থ প্রকার ইসলাম বিধ্বংশকারী আমল সম্দপনকারী কাফেরদের দলভূক্ত হবে।

অনুরূপ ভাবে চতুর্থ প্রকারে শামিল হবে ঐ ব্যক্তির কথা যে এমনটি ধারণা করে যে, চোরের হাত কাটা, বিবাহিত ব্যাভিচারীকে পাথর মেরে হত্যা করা ইত্যাদী আল্লাহর বিধান বাস্তবায়ন করা আধুনিক যুগের জন্য উপযোগী নয়।

অনুরূপ ভাবে চতুর্থ প্রকারের অন্তর্ভূক্ত ঐ ব্যক্তির কথা, যে বিশ্বাস করে যে বৈষয়িক বিষয় সমূহ এবং দণ্ডবিধি ইত্যাদির ব্যাপারে শরিয়ত ব্যতীত অন্য বিধান দিয়ে ফায়সালা করা জায়েয। যদিও সে এই বিশ্বাস না রাখে যে উহা শরীয়তের বিধান অপেক্ষা উত্তম। (তবুও সে কাফের বলেই গণ্য হবে) কারণ সে এর মাধ্যমে এমন বিষয়কে হালাল করেছে যা আল্লাহ হারাম করেছেন। আর যে ব্যক্তি আল্লাহর হারাম কৃত বিধানকে হালাল করবে যার হারাম হওয়া দ্বীন ইসলামে সর্বজন বিদিত। যেমন: ব্যাভিচার করা, মদ্যপান করা, সূদী কারবার করা, আল্লাহর শরীয়ত ব্যতীত অন্য বিধান দ্বারা ফায়সালা করা ইত্যাদী বিষয়কে যে হালাল মনে করবে সে মুসলমানদের সর্ব সম্মতিক্রমে কাফের বলে গণ্য হবে।

আমরা আল্লাহর সমীপে এই কামনা করি, তিনি যেন সকলকে তাঁর সন্তুষ্টি মূলক কাজের তাওফীক দেন এবং আমাদেরকে এবং সমস্ত মুসলিমদেরকে সঠিক পথের হেদায়াত দান করেন। নিশ্চয় তিনি সর্ব শ্রোতা ও নিকটবর্তী। আল্লাহ্‌ তাআলা নবী মুহাম্মাদ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম, তাঁর পরিবার বর্গ ও সাহাবীদের উপর রহমত ও শান্তির ধারা অবতীর্ণ করূন।

আমীন!!


Source:https://quraneralo.net/10-nulifiers-of-islam/
9
‘লা-ইলাহা ইল্লাল্লাহ’ কালেমায় দু’টি অংশ রয়েছে: ইতিবাচক ও নেতিবাচক, উভয় অর্থের ইলম বা যথার্থ জ্ঞান হাসিল করা প্রথম শর্ত। আল্লাহ তা‘আলা বলেন,

“অতএব জেনে রেখো, নিঃসন্দেহে আল্লাহ ছাড়া কোনো (সত্য) ইলাহ নেই”। [সূরা মুহাম্মদ, আয়াত: ১৯]
অপর আয়াতে তিনি বলেন: “তবে তারা ছাড়া যারা জেনে-শুনে সত্য সাক্ষ্য দেয়”। [সূরা আয-যুখরূফ, আয়াত: ৮৬]

এখানে সত্য সাক্ষ্য দ্বারা উদ্দেশ্য ‘লা-ইলাহা ইল্লাল্লাহ’, আর জেনে-শুনে অর্থ: লা-ইলাহা ইল্লাল্লাহর সাক্ষ্য দেওয়ার সঙ্গে অন্তর দ্বারা তার অর্থের জ্ঞান হাসিল করা। সহীহ গ্রন্থে উসমান রাদিয়াল্লাহু ‘আনহু থেকে বর্ণিত, রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু ‘আলাইহি ওয়াসাল্লাম বলেছেন, “যে এমতাবস্থায় মারা গেল যে, সে জানে আল্লাহ ছাড়া সত্য কোনো ইলাহ নেই, সে জান্নাতে প্রবেশ করবে”।[1] অতএব, মুসলিম হওয়ার জন্য লা-ইলাহা ইল্লাল্লার অর্থ জানা জরুরি।
দ্বিতীয় শর্ত, ইয়াকীন:

অর্থাৎ লা-ইলাহা ইল্লাল্লাহর অর্থের প্রতি দৃঢ় বিশ্বাস স্থাপন করা, শুধু জ্ঞানই যথেষ্ট নয়, আর সন্দেহপূর্ণ জ্ঞানের তো কোনো মূল্যই নেই। আল্লাহ তা‘আলা বলেন: “মুমিন কেবল তারাই যারা আল্লাহ ও তার রাসূলের প্রতি ঈমান এনেছে, তারপর সন্দেহ পোষণ করে নি”। [সূরা আল-হুজুরাত, আয়াত: ১৫]

এ আয়াতে ঈমানের জন্য আল্লাহ সন্দেহ মুক্ত হওয়া শর্তারোপ করেছেন। কারণ, সন্দেহ পোষণকারী মুনাফিক, মুমিন নয়। আবু হুরায়রা রাদিয়াল্লাহ ‘আনহু থেকে সহীহ সূত্রে বর্ণিত, রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু ‘আলাইহি ওয়াসাল্লাম বলেছেন, “আমি সাক্ষ্য দিচ্ছি যে, আল্লাহ ছাড়া সত্য কোনো ইলাহ নেই এবং আমি আল্লাহর রাসূল, এ দু’টি বাক্যে সন্দেহ পোষণ ব্যতীত কোনো বান্দা আল্লাহর সাথে সাক্ষাত করবে না, তবে সে অবশ্যই জান্নাতে প্রবেশ করবে”।[2]
অপর বর্ণনায় এসেছে: “কোনো বান্দা এ দু’টি সাক্ষ্যসহ, সন্দেহমুক্ত অবস্থায় আল্লাহর সাক্ষাত করবে, আর তাকে জান্নাত থেকে দূরে রাখা হবে, এরূপ হবে না”।[3]

একটি দীর্ঘ হাদীসে এসেছে, নবী সাল্লাল্লাহু ‘আলাইহি ওয়াসাল্লাম আবু হুরায়রা রাদিয়াল্লাহ ‘আনহুকে নিজের দু’টি জুতাসহ প্রেরণ করে বলেন: “এই দেয়ালের পশ্চাতে যার সাথে তুমি সাক্ষাত করবে, যে অন্তরের অন্তস্থল থেকে সাক্ষ্য দেয় যে, আল্লাহ ছাড়া কোনো ইলাহ নেই, তাকে তুমি জান্নাতের সুসংবাদ প্রদান কর”।[4] অতএব, জান্নাতে লাভের জন্য সন্দেহ মুক্ত সাক্ষ্য হওয়া জরুরি, অন্যথায় তাতে প্রবেশ করা সম্ভব নয়।
তৃতীয় শর্ত, কবুল:

অর্থাৎ কালেমার অর্থ ও দাবিকে বিনা বাক্যে মেনে নেওয়া। আল্লাহ তা‘আলা আমাদের নিকট অতীত জাতির ঘটনা বর্ণনা করেছেন, যারা এ বাক্য গ্রহণ করেছে তাদের তিনি মুক্তি দিয়েছেন এবং যারা তা প্রত্যাখ্যান করেছে তাদের থেকে তিনি প্রতিশোধ গ্রহণ করেছেন। তিনি বলেন, “(ফিরিশতাদেরকে বলা হবে), ‘একত্র কর যালিম ও তাদের সঙ্গী-সাথীদেরকে এবং যাদের ইবাদাত তারা করত আল্লাহকে বাদ দিয়ে তাদেরকে, আর তাদেরকে আগুনের পথে নিয়ে যাও, আর তাদেরকে থামাও, অবশ্যই তারা জিজ্ঞাসিত হবে”। [সূরা আস-সাফফাত, আয়াত: ২২-২৪]
অতঃপর আল্লাহ তা‘আলা বলেন, “তাদেরকে যখন বলা হত, ‘আল্লাহ ছাড়া কোনো (সত্য) ইলাহ নেই’, তখন নিশ্চয় তারা অহঙ্কার করত। আর বলত, ‘আমরা কি এক পাগল কবির জন্য আমাদের উপাস্যদের ছেড়ে দেব”? [সূরা আস-সাফফাত, আয়াত: ৩৫-৩৬]

আল্লাহ তাদেরকে শাস্তি দিয়েছেন। কারণ, তারা লা-ইলাহা ইল্লাল্লাহকে অহঙ্কার ভরে ত্যাগ করেছে, আল্লাহর দা‘ঈর ওপর তারা মিথ্যারোপ করেছে, লা-ইলাহা ইল্লাল্লাহর দাবি মোতাবেক তারা (অন্য মাবুদদের) প্রত্যাখ্যান ও (একমাত্র আল্লাহকে) গ্রহণ করে নি; বরং তারা বিদ্বেষ ও অহঙ্কার থেকে বলেছে: “সে কি সকল উপাস্যকে এক ইলাহ বানিয়ে নিয়েছে? নিশ্চয় এ তো এক আশ্চর্য বিষয়! আর তাদের প্রধানরা চলে গেল একথা বলে যে, ‘যাও এবং তোমাদের উপাস্যগুলোর ওপর অবিচল থাক। নিশ্চয় এ বিষয়টি উদ্দেশ্য প্রণোদিত’। আমরা তো সর্বশেষ ধর্মে [5] এমন কথা শুনি নি। এটা তো বানোয়াট কথা ছাড়া আর কিছু নয়”। [সূরা সোয়াদ, আয়াত: ৫-৭]

আল্লাহ তাদের মিথ্যারোপ ও নবী সাল্লাল্লাহু ‘আলাইহি ওয়াসাল্লামের ভাষায় প্রতিবাদ করেছেন, তিনি বলেছেন,“বরং সে সত্য নিয়ে এসেছিল এবং সে রাসূলদেরকে সত্য বলে ঘোষণা দিয়েছিল”। [সূরা আস-সাফফাত, আয়াত: ৩৭]
অতঃপর যারা লা-ইলাহা ইল্লাল্লাহকে মেনে নিয়েছে, তাদের ব্যাপারে তিনি বলেছেন, “অবশ্য আল্লাহর মনোনীত বান্দারা ছাড়া; তাদের জন্য থাকবে নির্ধারিত রিযিক, নি‘আমত-ভরা জান্নাতে ফলমূল; আর তারা হবে সম্মানিত”। [সূরা আস-সাফফাত, আয়াত: ৪০-৪৩]

আবু মূসা রাদিয়াল্লাহ ‘আনহু থেকে সহীহ সূত্রে বর্ণিত, নবী সাল্লাল্লাহু ‘আলাইহি ওয়াসাল্লাম বলেছেন, “আল্লাহ আমাকে যে হিদায়াত ও ইলমসহ পাঠিয়েছেন তার উদাহরণ মুষলধারার বৃষ্টির ন্যায়, যা কোনো জমিনে বর্ষিত হয়েছে। তাতে কিছু উর্বর জমি ছিল, যা পানি গ্রহণ করেছে, ফলে তৃণলতা ও প্রচুর ঘাস জন্মিয়েছে। তাতে কিছু ছিল শক্ত জমি, যা পানি আটকে রেখেছে, আল্লাহ তার দ্বারা মানুষদের উপকৃত করেছেন, ফলে তারা পান করেছে, পশুদের পান করিয়েছে ও সেচ কার্য আঞ্জাম দিয়েছে। আর সে পানি জমির অপর অংশে পতিত হয়েছে, যা ছিল পাথরি জমি, যা না পানি আটকে রাখে এবং না কোনো তৃণলতা জন্মায়।
এটাই তার উদাহরণ যে দীনের ইলম অর্জন করল, আল্লাহ আমাকে যা দিয়ে প্রেরণ করেছেন তার দ্বারা তিনি তাকে উপকৃত করলেন, ফলে সে জ্ঞানার্জন করল ও অন্যকে শিখাল এবং তার উদাহরণ, যে তার প্রতি মাথা তুলে তাকায়নি ও আল্লাহর হিদায়াত গ্রহণ করে নি, যা দিয়ে আমাকে প্রেরণ করা হয়েছে”।[6]
চতুর্থ শর্ত, ইনকিয়াদ:

অর্থাৎ লা-ইলাহা ইল্লাল্লাহর দাবিকে বিনা বাক্যে মেনে নেওয়া। আল্লাহ তা‘আলা বলেন, “আর যে ব্যক্তি একনিষ্ঠ ও বিশুদ্ধচিত্তে আল্লাহর কাছে নিজকে সমর্পণ করে, সে তো শক্ত রশি আঁকড়ে ধরে। আর সকল বিষয়ের পরিণাম আল্লাহরই কাছে”। [সূরা লুকমান, আয়াত: ২২]
আল্লাহর নিকট নিজেকে সমর্পণ করার অর্থ তার তাওহীদকে বিনা বাক্যে মেনে নেওয়া, যে মেনে নিল না ও ইহসান প্রদর্শন করল না, সে মজবুত রশি আঁকড়ে ধরে নি। এ কথাই আল্লাহ পরবর্তী আয়াতে বলেছেন, “আর যে কুফরী করে, তার কুফরী যেন তোমাকে ব্যথিত না করে; আমার কাছেই তাদের প্রত্যাবর্তন। অতঃপর তারা যে আমল করত আমি তা তাদেরকে জানিয়ে দেব”। [সূরা লুকমান, আয়াত: ২২]
একটি সহীহ হাদীসে নবী সাল্লাল্লাহু ‘আলাইহি ওয়াসাল্লাম বলেছেন,“তোমাদের কেউ মুমিন হবে না, যতক্ষণ না তার প্রবৃত্তি আমার আনীত বিষয়ের অনুসারী না হবে”। এটাই পরিপূর্ণ আনুগত্য ও নিজেকে সমর্পণ করা।
পশ্চম শর্ত, সিদক তথা কালেমাতে সত্যারোপ করা:

অর্থাৎ অন্তরের দৃঢ় বিশ্বাসসহ মুখে লা-ইলাহা ইল্লাল্লাহ উচ্চারণ করা। আল্লাহ তা‘আলা বলেন, “আলিফ-লাম-মীম। মানুষ কি মনে করে যে, ‘আমরা ঈমান এনেছি’ বললেই তাদের ছেড়ে দেওয়া হবে, আর তাদের পরীক্ষা করা হবে না? আর আমরা তো তাদের পূর্ববর্তীদের পরীক্ষা করেছি, ফলে আল্লাহ অবশ্যই জেনে নেবেন, কারা সত্য বলে এবং অবশ্যই তিনি জেনে নেবেন, কারা মিথ্যাবাদী”। [সূরা আল-‘আনকাবুত, আয়াত: ১-৩]

আর মুনাফিকদের ব্যাপারে তিনি বলেন, “আর মানুষের মধ্যে কিছু এমন আছে, যারা বলে, ‘আমরা ঈমান এনেছি আল্লাহর প্রতি এবং শেষ দিনের প্রতি’, অথচ তারা মুমিন নয়। তারা আল্লাহকে এবং যারা ঈমান এনেছে তাদেরকে ধোকা দিচ্ছে। অথচ তারা নিজেদেরকেই ধোকা দিচ্ছে এবং তারা তা অনুধাবন করে না। তাদের অন্তরসমূহে রয়েছে ব্যাধি, সুতরাং আল্লাহ তাদের ব্যাধি বাড়িয়ে দিয়েছেন। আর তাদের জন্য রয়েছে যন্ত্রণাদায়ক আযাব। কারণ তারা মিথ্যা বলত”। [সূরা আল-বাকারাহ্‌, আয়াত: ৮-১০]
সহীহ বুখারী ও মুসলিমে বর্ণিত, মু‘আয ইবন জাবাল রাদিয়াল্লাহ ‘আল্লাহু বলেন, “এমন কেউ নেই যে, অন্তরের অন্তস্থল থেকে সত্য সাক্ষ্য দিবে যে, আল্লাহ ছাড়া কোনো ইলাহ নেই এবং মুহাম্মাদ তাঁর বান্দা ও রাসূল, তবে আল্লাহ অবশ্যই তার ওপর জাহান্নাম হারাম করে দিবেন”।[7]
ষষ্ট শর্ত, ইখলাস:

অর্থাৎ নিষ্ঠা থাকা বা সকল প্রকার শির্ক থেকে মুক্ত রাখা। আল্লাহ তা‘আলা বলেন, “জেনে রেখ, আল্লাহর জন্যই বিশুদ্ধ ইবাদাত-আনুগত্য”। [সূরা আয-যুমার, আয়াত: ৩]
অপর আয়াতে আল্লাহ তা‘আলা বলেন, “বল, ‘আমি আল্লাহরই ইবাদাত করি, তাঁরই জন্য আমার আনুগত্য একনিষ্ঠ করি”। [সূরা আয-যুমার, আয়াত: ১৪]
সহীহ গ্রন্থে আবু হুরায়রা রাদিয়াল্লাহু ‘আনহু থেকে বর্ণিত, নবী সাল্লাল্লাহু ‘আলাইহি ওয়াসাল্লাম বলেছেন, “কিয়ামতের দিন আমার সুপারিশ দ্বারা সবচেয়ে বেশি উপকৃত হবে সে ব্যক্তি, যে নিজের অন্তরের অন্তস্থল বা মন থেকে লা-ইলাহা ইল্লাল্লাহ বলেছে”।[8]
সপ্তম শর্ত, মহব্বত তথা ‘লা-ইলাহা ইল্লাল্লাহ’ এ কালেমাকে মহব্বত করা:

তার দাবি ও অর্থকে মহব্বত করা, তার ওপর আমলকারী ও তার শর্তসমূহ যাদের মধ্যে রয়েছে তাদেরকে মহব্বত করা এবং যারা তার ওপর আমল করে না তাদেরকে অপছন্দ করা। আল্লাহ তা‘আলা বলেন, “আর মানুষের মধ্যে এমনও আছে, যারা আল্লাহ ছাড়া অন্যকে আল্লাহর সমকক্ষরূপে গ্রহণ করে, তাদেরকে আল্লাহকে ভালোবাসার মতো ভালোবাসে। আর যারা ঈমান এনেছে, তারা আল্লাহর জন্য ভালোবাসায় দৃঢ়তর”। [সূরা আল-বাকারা, আয়াত: ১৬৫]
এ আয়াতে আল্লাহ সংবাদ দিচ্ছেন যে, ঈমানদাররা আল্লাহকে অধিক মহব্বত করে, কারণ তারা মহব্বতের ইবাদতে তার সাথে কাউকে শরীক করে নি, যেমন তার মহব্বতের দাবিদার মুশরিকরা তার সাথে শরীকদেরকেও তার ন্যায় মহব্বত করে। আনাস রাদিয়াল্লাহ ‘আনহু থেকে বর্ণিত, নবী সাল্লাল্লাহু ‘আলাইহি ওয়াসাল্লাম বলেছেন, “তোমাদের কেউ মুমিন হবে না, যতক্ষণ না আমি তার নিকট তার সন্তান, পিতা ও সকল মানুষ থেকে অধিক প্রিয় না হবে”। [9]
আল্লাহ তা‘আলা ভালো জানেন।


Source:https://quraneralo.net/conditions-of-shahada/
10
 আল্লাহ্‌ ছাড়া ইবাদতের যোগ্য অন্য কোন সত্য ইলাহ্‌ নেই। এই কথা যদি কেউ সত্যতার সাথে অন্তরের অন্তঃস্থল থেকে উচ্চারন করে, এ কথার অর্থ যা বলে সে অনুযায়ী জীবন পরিচালনা করে, বিশ্বাস এবং চালচলনে এই কথাকে বাস্তবিক রূপদান করে তাহলে ব্যক্তি ও সমাজ উভয় জীবনেই একথার প্রভাব আসলেই চমৎকার এবং প্রশংসনীয়।
“লা ইলাহা ইল্লাল্লাহ্‌” এর তিনটি উল্লেখযোগ্য ক্ষমতাঃ
[১] গোটা মুসলিম উম্মাহ্‌কে একত্রীকরণঃ

একথা গোটা মুসলিম উম্মাহ্‌কে ঈমানের শক্তিতে বলীয়ান করবে। ফলে তারা বাতিল শক্তি তথা তাদের শত্রুদের বিপক্ষে সংগ্রামে বিজয়ী হবে। আর এটা তখনই সম্ভব যখন আমরা সকলেই আল্লাহ্‌ রাব্বুল ‘আলামীন কর্তৃক মনোনীত একমাত্র সত্য ধর্ম ইসলামকে অনুসরণ করব, মেনে চলব। যখন আমাদের আকীদাহ্‌ তথা ধর্মীয় বিশ্বাস হবে এক ও অভিন্ন। মহান আল্লাহ্‌ রাব্বুল ‘আলামীন বলেনঃ “আর তোমরা একযোগে আল্লাহ্‌র রজ্জুকে সুদৃঢ়রূপে ধারন কর ও বিভক্ত হয়ে যেয়ো না।” [সূরা আল ইমরান; ৩:১০৩]

“আর তারা যদি তোমাকে প্রতারিত করার ইচ্ছা করে তবে তোমার জন্যে আল্লাহ্‌ই যথেষ্ট, তিনিই তোমাকে স্বীয় সাহায্য দ্বারা এবং মু’মিনগণ দ্বারা শক্তিশালী করেছেন। আর তিনি মু’মিনদের অন্তরে প্রীতি ও ঐক্য স্থাপন করেছেন, তুমি যদি পৃথিবীর সমুদয় সম্পদও ব্যয় করতে তবুও তাদের অন্তরে প্রীতি, সদ্ভাব ও ঐক্য স্থাপন করতে পারতে না; কিন্তু আল্লাহ্‌ই ওদের পরস্পরের মধ্যে প্রীতি ও সদ্ভাব স্থাপন করে দিয়েছেন, নিঃসন্দেহে তিনি মহাশক্তিমান, মহাকৌশলী।” [সূরা আনফাল; ৮:৬২-৬৩]

আকীদাহ্‌ তথা বিশ্বাসগত পার্থক্যের কারনেই মুসলিম উম্মাহ্‌র মধ্যে আজ এতো বিভেদ, অনৈক্য, বিভ্রান্তি আর বিশৃঙ্খলা। একমাত্র এই কারনেই মুসলিম উম্মাহ্‌র ভিতর আজ এতো দ্বন্দ্ব আর হানাহানির সৃষ্টি হয়েছে। মহান আল্লাহ্‌ রাব্বুল ‘আলামীন বলেনঃ

“নিশ্চয় যারা নিজেদের দ্বীনকে খণ্ড-বিখণ্ড করেছে এবং বিভিন্ন দলে উপদলে বিভক্ত হয়ে পড়েছে, তাদের সাথে তোমার কোন সম্পর্ক নেই, তাদের বিষয়টি নিশ্চয়ই আল্লাহ্‌র হাওলায় রয়েছে, পরিশেষে তিনি তাদেরকে তাদের কার্যকলাপ সম্পর্কে অবিহিত করবেন।” [সূরা আন’আম; ৬:১৫৯]

“কিন্তু তারা নিজেদের মধ্যে তাদের দ্বীনকে বহুভাগে বিভক্ত করেছে; প্রত্যেক দলই তাদের নিকট যা আছে তা নিয়েই আনন্দিত।” [সূরা মু’মিনূন; ২৩:৫৩]

আর তাই মানুষ ততক্ষণ পর্যন্ত প্রকৃতঅর্থে ঐক্যবদ্ধ হতে পারবেনা যতক্ষণ না তারা ঈমান এবং আকীদাহ্‌ সম্পর্কে যথার্থ এবং বিশুদ্ধ উপলব্ধি অর্জন করতে পেরেছে। এখানেই নিহিত “লা ইলাহা ইল্লাল্লাহ্‌” এর তাৎপর্য। একথার তাৎপর্য উপলব্ধি না করে কারোর পক্ষে ঈমান ও আকীদাহ্‌গত পরিশুদ্ধি অর্জন করা সম্ভব নয়। ইসলাম আবির্ভাবের পূর্বে এবং পরে আরবের অবস্থার দিকে দৃষ্টিপাত করলেই বোঝা যায় “লা ইলাহা ইল্লাল্লাহ” এর কী ক্ষমতা।
[২] শান্তি ও নিরাপত্তা অর্জন:

যে সমাজ “লা ইলাহা ইল্লাল্লাহ্‌” এর শিক্ষায় বিশ্বাসী এবং এর শিক্ষাকে বাস্তবে রূপ দেয় সেই সমাজে বিরাজ করে শুধুই শান্তি ও নিরাপত্তা। এমন সমাজের প্রতিটি মানুষই কেবলমাত্র সেই কাজের ব্যপারে যত্নশীল হবে যা আল্লাহ্‌ রাব্বুল ‘আলামীন তাদের জন্য হালাল বা বৈধ ঘোষণা করেছেন। পক্ষান্তরে, তারা সেই সমস্ত কাজ পরিহার করে চলবে যা তিনি হারাম বা অবৈধ ঘোষণা করেছেন। সমাজের প্রতিটি মানুষই তখন তাদের এক ও অভিন্ন আকীদাহ্‌ তথা ধর্মীয় বিশ্বাসকে অনুসরণ করে সকল কাজ-কর্ম সম্পাদন করবে। কারণ “লা ইলাহা ইল্লাল্লাহ্‌” এর দাবী হল, যে কেউ এই কথার মৌখিক স্বীকৃতি দেবে তাকে এর সত্যতা বাস্তবায়ন করতে হবে কর্মের মাধ্যমে। কর্মহীন মৌখিক ঐ স্বীকৃতি একটি অন্তঃসার শূন্য স্লোগান ছাড়া কিছুই নয়। কাজেই কালিমার শিক্ষায় বিশ্বাসী এবং সেই শিক্ষাকে মেনে চলে এমন সমাজের লোকদেরকে দ্বারা কখনও জুলুম-অত্যাচার, অন্যায়, পারস্পারিক হানাহানি ইত্যাদি সংঘটিত হতে পারেনা। এমন সমাজের লোকেরা গভীর ভ্রাতৃত্বের বন্ধনে আবদ্ধ হয়ে সৎকর্ম সম্পাদনের জন্যে পরস্পরকে সহযোগিতা করবে এবং ভালবাসবে। আর তাদের এই পারস্পারিক সহযোগিতা ও ভালবাসা হবে কেবলমাত্র আল্লাহ্‌ রাব্বুল ‘আলামীনের জন্যে, তাঁর সন্তুষ্টি অর্জনের লক্ষ্যে। আল্লাহ্‌ রাব্বুল ‘আলামীন বলেনঃ “মু’মিনরা তো পরস্পর ভাই-ভাই।” [সূরা হুজুরাত; ৪৯:১০]

বিষয়টি অত্যন্ত সুস্পষ্টভাবে প্রতিফলিত সে সব আরবদের জীবনে যারা একসময় ইসলাম মেনে চলত না। অথচ “লা ইলাহা ইল্লাল্লাহ্‌” এর পরশে তাদের জীবনে এসেছিল আমূল পরিবর্তন। ইসলাম পূর্ব সময়ে তাদের জীবন ছিল পারস্পারিক মারামারি, কাটাকাটি, হানাহানি, দ্বন্দ্ব-সংঘাত, খুনাখুনি, লুটতরাজ ইত্যাদিতে জর্জরিত। সেই মানুষগুলোই যখন গ্রহণ করল তখন সব কিছু বদলে গেল। যারা রক্তের বদলে রক্ত চাইত তারা ইসলামের কারনেই শান্তি সৌহার্দ আর সম্প্রীতির এক অমায়িক বন্ধনে আবদ্ধ হল। যারা ছিল চরম শত্রু তারাই হল পরম বন্ধু। এই হল ইসলাম তথা “লা ইলাহা ইল্লাল্লাহ্‌” এর ক্ষমতা। আল্লাহ্‌ রাব্বুল ‘আলামীন বলেনঃ “মুহাম্মাদ (সা) আল্লাহ্‌র রাসূল; আর যারা এর সাথে আছে তারা কাফিরদের বিরুদ্ধে কঠোর এবং নিজেদের মধ্যে পরস্পরে সহানুভূতিশীল।” [সূরা ফাত্‌হ; ৮৪:২৯]

“এবং তোমাদের প্রতি আল্লাহ্‌র যে নেয়ামত রয়েছে তা স্মরণ কর, যখন তোমরা পরস্পর শত্রু ছিলে তখন তিনিই তোমাদের অন্তঃকরণে প্রীতি স্থাপন করেছিলেন, তৎপরে তোমরা তাঁর অনুগ্রহে ভ্রাতৃত্বে আবদ্ধ হলে।” [সূরা আল-ইমরান; ৩:১০৩]
[৩] সুমহান লক্ষ্য অর্জন:

প্রকৃত সুখ-শান্তি অর্জন, পৃথিবীতে খেলাফাত (ইসলামিক কর্তৃত্ব ও শাসন ব্যবস্থা) প্রতিষ্ঠা, ইসলামের বিশুদ্ধ চর্চা এবং সমস্ত রকম বাতিল ও শয়তানি অপশক্তির আক্রমণের বিরুদ্ধে ধৈর্য এবং নিষ্ঠার সাথে সংগ্রাম চালিয়ে যাওয়া- এসবের একটিও সম্ভব নয় “লা ইলাহা ইল্লাল্লাহ্‌” এর বাস্তবিক প্রয়োগ ছাড়া। আল্লাহ্‌ রাব্বুল ‘আলামীন বলেনঃ “তোমাদের মধ্যে যারা ঈমান আনে ও সৎকর্ম করে আল্লাহ্‌ তাদেরকে প্রতিশ্রুতি দিয়েছেন যে, তিনি তাদেরকে পৃথিবীতে খেলাফাত (প্রতিনিধিত্ব) অবশ্যই দান করবেন, যেমন তিনি (প্রতিনিধিত্ব) দান করেছিলেন তাদের পূর্ববর্তীদেরকে এবং তিনি অবশ্যই সুদৃঢ় করবেন তাদের দ্বীনকে যা তিনি তাদের জন্যে মনোনীত করেছেন এবং তাদের ভয়-ভীতির পরিবর্তে তাদেরকে অবশ্যই নিরাপত্তা দান করবেন; তারা শুধু আমার ইবাদত করবে, আমার সাথে কাউকে শরীক করবেনা, অতঃপর যারা অকৃতজ্ঞ হবে তারা তো সত্যত্যাগী (ফাসিক) ।” [সূরা নূর; ২৪:৫৫]

কাজেই আল্লাহ্‌ রাব্বুল ‘আলামীন উল্লেখিত সুমহান লক্ষ্যসমূহের অর্জনকে আমাদের জন্য শর্তসাপেক্ষ করে দিয়েছেন। অর্থাৎ, আমরা এগুলো কেবল মাত্র তখনই অর্জন করতে সমর্থ হব যখন আমরা শুধু মাত্র এবং কেবলমাত্র তাঁরই ইবাদত এবং আনুগত্য করব, তাঁর দেয়া বিধানকে প্রশ্নাতীতভাবে মেনে চলব এবং তাঁর সাথে কোন শরীক স্থাপন করব না। আর এটাই হল “লা ইলাহা ইল্লাল্লাহ্‌” এর নিহিত মর্মার্থ।

আল-ইস্‌তিক্কামাহ্‌,


Source:https://quraneralo.net/power-of-kalema-tayyeba/
Pages: [1] 2 3 ... 10