চতুর্থ শিল্পবিপ্লবের জন্য কতটুকু প্রস্তুত উচ্চশিক্ষা
(https://images.prothomalo.com/prothomalo-bangla%2F2021-11%2F46577434-e326-4ce7-bb0b-cbe2f486fb3c%2Fprothomalo_shilpabiplob.jpg?auto=format%2Ccompress&format=webp&w=640&dpr=1.0)
চতুর্থ শিল্পবিপ্লবের চ্যালেঞ্জ মোকাবিলায় বিশ্ববিদ্যালয় সম্মুখসারির প্রতিষ্ঠান। সে লক্ষ্যেই বিশ্ববিদ্যালয়গুলোর কাজ করা উচিত। একটি উদাহরণ দিয়ে শুরু করা যাক। একদিন আমি ড্যাফোডিল ইউনিভার্সিটির ভর্তি কার্যালয়ের সামনে দিয়ে যাচ্ছি। দেখলাম, ভর্তি-ইচ্ছুক এক শিক্ষার্থী বিভিন্ন বিভাগ সম্পর্কে তথ্য পাওয়ার জন্য অপেক্ষা করছেন। কিছুক্ষণ পরে দেখতে পেলাম, ড্যাফোডিল ক্রুজার নামক একটি রোবট ভর্তি সহকারী হিসেবে তাঁকে সব প্রশ্নের উত্তর দিয়ে সাহায্য করছে। সেখানে প্রতিদিন ভর্তি-ইচ্ছুক অনেক শিক্ষার্থী উপস্থিত হন এবং অনুরূপ তথ্য পাওয়ার চেষ্টা করেন। রোবটটি ভর্তি কর্মকর্তাদের সহায়তা করে। এ কাজে রোবটটি অত্যন্ত দক্ষ। কৃত্রিম বুদ্ধিমত্তা এখন ব্যবহার করা হচ্ছে ব্যবসায়িক সাফল্য নিয়ে ধারণা তৈরির জন্য, রোবট ব্যবহার করা হচ্ছে পোশাকশিল্পে। চতুর্থ শিল্পবিপ্লব এখন একটি বাস্তবতা। আমাদের যা কিছু আছে, তা পুঁজি করে দ্রুত অগ্রসর হওয়া উচিত।
১৯৭২ সালের ১৬ ডিসেম্বর বাংলাদেশের প্রথম বিজয় দিবসে রাষ্ট্রপতির আদেশের মাধ্যমে ইউজিসি প্রতিষ্ঠার মাধ্যমে জ্ঞানভিত্তিক অর্থনীতি গড়ে তোলার সূচনা করেন। ১৯৭৩ সালে আনুষ্ঠানিকভাবে ইউজিসির কার্যক্রম শুরু হয়। বঙ্গবন্ধু স্বপ্ন দেখেছিলেন ক্ষুধা–দুর্নীতিমুক্ত ও সমৃদ্ধ ‘সোনার বাংলার’। একই দর্শন বহন করে দেশ ‘ডিজিটাল বাংলাদেশ’-এ রূপান্তরিত হয়েছে।একটি নিরাপদ, উন্নত ও উদ্ভাবনী দেশের মর্যাদায় পৌঁছাতে ভিশন ২০২১, ভিশন ২০৩০, ভিশন ২০৪১, ভিশন ২০৭১ এবং ডেলটা প্ল্যান ২১০০—এসব লক্ষ্যমাত্রা নেওয়া হয়েছে।
এ লক্ষ্যমাত্রা বাস্তবায়ন তখনই সম্ভব হবে, যখন আমরা উচ্চমানের শিক্ষা ও গবেষণার প্রসার এবং একটি উদ্ভাবনী শিক্ষা ইকোসিস্টেম তৈরি করতে পারব। এরই লক্ষ্যে বিশ্ববিদ্যালয় মঞ্জুরি কমিশন (ইউজিসি) আগামী ১০-১১ ডিসেম্বর থেকে ফোর্থ ইন্ডাস্ট্রিয়াল অ্যান্ড বিয়ন্ড বিষয়ে একটি আন্তর্জাতিক সম্মেলন আয়োজন করতে যাচ্ছে। জাতির জনকের জন্মশতবার্ষিকী এবং দেশের স্বাধীনতার সুবর্ণজয়ন্তীতে চতুর্থ শিল্পবিপ্লবের কৌশল ব্যবহার করে স্থানীয় সমস্যার সমাধান, জীবন ও পরিবেশের উন্নতি এবং টেকসই উন্নয়ন লক্ষ্যমাত্রা অর্জনে আমাদের সাহায্য করার জন্য গবেষক ও চর্চাকারীদের একত্র করে উচ্চপর্যায়ের একটি আন্তর্জাতিক ফোরাম তৈরি করা হবে। সম্মেলনে অন্তর্ভুক্ত থাকবে কৃত্রিম বুদ্ধিমত্তা, রোবোটিকস ও অটোমেশন, আইওটি ও স্মার্ট এগ্রিকালচার, ডেটা বিশ্লেষণ ও ক্লাউড কম্পিউটিং, যোগাযোগ ও নেটওয়ার্ক সিগনাল এবং ন্যাচারাল ল্যাঙ্গুয়েজ প্রসেসিং।
বিভিন্ন বৈশ্বিক সূচকে আমাদের বিশ্ববিদ্যালয়গুলোর র্যাঙ্কিং একেবারে গ্রহণযোগ্য নয়। সর্বশেষ টাইমস হায়ার এডুকেশন র্যাঙ্কিং ২০২২ অনুসারে, দেশের মাত্র তিনটি বিশ্ববিদ্যালয় বিশ্বব্যাপী র্যাঙ্কিংয়ে অন্তর্ভুক্ত হয়েছে। ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় (৮০১-১০০০), বাংলাদেশ কৃষি বিশ্ববিদ্যালয় (১০০১-১২০০) ও বুয়েট (১২০১+)। ২০২২ সালে এশিয়া র্যাঙ্কিংয়ে দেশের ১৩টি বিশ্ববিদ্যালয় অন্তর্ভুক্ত হয়েছে। ডিজিটাল বাংলাদেশে চতুর্থ শিল্পবিপ্লবের চ্যালেঞ্জ মোকাবিলায় উচ্চশিক্ষা রূপকল্পে আমাদের নিম্নলিখিত বিষয়গুলোয় জোর দেওয়া উচিত।
বাংলাদেশ ইতিমধ্যে ডিজিটাল শিক্ষার প্রথম পর্যায়, অর্থাৎ ফেস টু ফেস ডিজিটাল পার করেছে এবং এখন আমরা ডিজিটাল শিক্ষার দ্বিতীয় পর্যায়, অর্থাৎ ব্লেন্ডেড ডিজিটালে আছি। এর জন্য ইউজিসি সম্প্রতি ব্লেন্ডড লার্নিং পলিসি ২০২১ অনুমোদন দিয়েছে। পরবর্তী ধাপ হলো অনলাইন ডিজিটাল শিক্ষা। বাংলাদেশ এখনো বৈশ্বিক অনলাইন শিক্ষা ইন্ডাস্ট্রিতে নিজেদের উপস্থিতি বোঝাতে পারেনি। ২০২৬ সালের মধ্যে এর বাজারমূল্য ৩৭৫ বিলিয়ন ডলার। এটি সহজেই প্রবাসী আয় ও তৈরি পোশাকশিল্পের পরে আমাদের আয়ের তৃতীয় সর্বোচ্চ উৎস হতে পারে। এ ক্ষেত্রে চতুর্থ শিল্পবিপ্লবের প্রযুক্তিগুলো (যেমন কৃত্রিম বুদ্ধিমত্তাভিত্তিক এলএমএস, লার্নিং অ্যানালিটিকস) সিস্টেমের মধ্যে কার্যকরভাবে যোগ করতে হবে। এমনকি পার্শ্ববর্তী দেশ ভারতও অনলাইন ডিগ্রিকে স্বীকৃতি দেওয়া শুরু করেছে। উন্নত বিশ্বে অন্তত ১০ বছর আগে থেকে এটা করা হচ্ছে।
প্রতিটি বিশ্ববিদ্যালয়ের স্নাতকদের পাঠ্যক্রমের অংশ হিসেবে একটি বৃত্তিমূলক উপাদান থাকা উচিত, যাতে তাঁরা ভবিষ্যতের কাজের জগতের জন্য নিজেদের প্রস্তুত করতে পারেন। উদাহরণস্বরূপ অটোমোবাইল, ইলেকট্রিক ওয়্যারিং, গ্রাফিকস, ভিডিও সম্পাদনা, অ্যানিমেশন হতে পারে। দেশে অনেক স্নাতক বেকার আছে সত্যি, কিন্তু তাঁদের বৃত্তিমূলক দক্ষতা থাকলে চাকরির জন্য অপেক্ষা করতে হবে না; বরং তাঁরা অন্যদের জন্য চাকরির সুযোগ তৈরি করতে পারবেন। এমনকি অনলাইন ডিজিটাল শিক্ষাব্যবস্থায় টিচিং অ্যাসিস্ট্যান্ট, লার্নিং অ্যাডভাইজর, ইনস্ট্রাকশনাল ডিজাইনার, লার্নিং টেকনোলজিস্টের মতো হাজারো চাকরির পথ উন্মুক্ত হতে পারে। চতুর্থ শিল্পবিপ্লবের আবির্ভাবে অনেক চাকরি হারিয়ে যাবে। কিন্তু এর চেয়ে বেশি নতুন চাকরি তৈরি হবে।
আমাদের বিশ্ববিদ্যালয়গুলোর দুর্বল র্যাঙ্কিংয়ের একটি প্রধান কারণ আন্তর্জাতিক শিক্ষার্থীর সংখ্যা কম। দেশের দুটি শীর্ষ প্রতিষ্ঠানে এটি মাত্র ৩ ও ০ শতাংশ। পক্ষান্তরে, বেশির ভাগ অস্ট্রেলিয়ান বিশ্ববিদ্যালয়ে প্রায় ৪০ শতাংশ আন্তর্জাতিক শিক্ষার্থী রয়েছে। বিদেশি শিক্ষার্থী থাকলে প্রতিবছর বিলিয়ন ডলার আয় হয় এবং র্যাঙ্কিংয়ে গুরুত্বপূর্ণ অবদান রাখে।
আমাদের অনেক বিশ্ববিদ্যালয়ের পাঠ্যক্রম পুরোনো। প্রায়ই প্রয়োজনের ওপর ভিত্তি করে সেটা তৈরি বা হালনাগাদ হয় না। বিসিএসকেন্দ্রিক শিক্ষা আমাদের দীর্ঘ মেয়াদে সাহায্য করবে না। একাডেমিয়া ও ইন্ডাস্ট্রির মধ্যে একটি বড় ব্যবধান স্পষ্ট এবং আমাদের পাঠ্যক্রমে এটির সমাধান করতে হবে। একটি স্নাতক বা স্নাতকোত্তর প্রোগ্রামের শেষ বছরে শিক্ষার্থীদের ইন্ডাস্ট্রিতে অনুশীলনের সঙ্গে আরও বেশি যুক্ত হওয়া উচিত, সেখানে একটি ক্যাপস্টোন প্রোজেক্ট বা থিসিস অপশন থাকতে পারে। ওই সময়ে প্রয়োজনে বিশ্ববিদ্যালয়ের একটি বা দুটি কোর্স অনলাইনে অফার করা যেতে পারে। এ ধরনের উদ্যোগের পৃষ্ঠপোষকতায় সরকারি ও বেসরকারি খাতকে এগিয়ে আসতে হবে।
সফট স্কিল, যেমন যোগাযোগের ক্ষমতা, ভাষা দক্ষতা, জ্ঞানীয় বা মানসিক সহানুভূতি, সময় ব্যবস্থাপনা, দলগত কাজ, নেতৃত্বের বৈশিষ্ট্য কর্মসংস্থানের জন্য অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ। এটি মূলত চাকরির স্থান (স্থানীয় বা আন্তর্জাতিক), ফ্রিল্যান্সিং, কনসালট্যান্সি প্রোফাইল ডেভেলপমেন্ট, বিজনেস ডেভেলপমেন্ট গাইডেন্স এবং আইজিএ (ইনকাম জেনারেটিং অ্যাকটিভিটিস) নিশ্চিত করতে পারে। বাংলা ও ইংরেজির পাশাপাশি তৃতীয় ভাষার দক্ষতা চাকরির ক্ষেত্রে অনেক সময় অত্যন্ত কার্যকর প্রমাণিত হতে পারে।
উচ্চশিক্ষার বিভিন্ন স্কিম, যেমন সম্পূর্ণ বিনা মূল্যে, সরকারি-ভর্তুকিপ্রাপ্ত এবং সম্পূর্ণ ফি থাকতে পারে, যা করদাতার আয়ের ওপর ভিত্তি করে প্রদান করা যেতে পারে। স্থানীয় চাকরির বাজারে তাদের চাহিদার ওপর ভিত্তি করে সরকার চতুর্থ শিল্পবিপ্লব–সম্পর্কিত কোর্স ও প্রোগ্রামগুলোয় আরও ভর্তুকি প্রদান করতে পারে। স্নাতক শেষ করার পর শিক্ষার্থীরা যখন চাকরি পাবেন বা উদ্যোক্তা হবেন, তখন তাঁদের ধীরে ধীরে শিক্ষাঋণ পরিশোধ করতে হবে। সরকারি ঋণ বা ভর্তুকি পেতে ছাত্রদের মা–বাবা বা অভিভাবকদের আয়কর রিটার্ন দাখিল করতে হবে, এমনকি তা শূন্য হলেও।
আমাদের বিশ্ববিদ্যালয়গুলোর দুর্বল র্যাঙ্কিংয়ের একটি প্রধান কারণ আন্তর্জাতিক শিক্ষার্থীর সংখ্যা কম। দেশের দুটি শীর্ষ প্রতিষ্ঠানে এটি মাত্র ৩ ও ০ শতাংশ। পক্ষান্তরে, বেশির ভাগ অস্ট্রেলিয়ান বিশ্ববিদ্যালয়ে প্রায় ৪০ শতাংশ আন্তর্জাতিক শিক্ষার্থী রয়েছে। বিদেশি শিক্ষার্থী থাকলে প্রতিবছর বিলিয়ন ডলার আয় হয় এবং র্যাঙ্কিংয়ে গুরুত্বপূর্ণ অবদান রাখে। নিজস্ব অর্থায়নের ব্যবস্থা থাকলে বিশ্ববিদ্যালয়গুলো বিদেশ থেকে ভিজিটিং অধ্যাপক ও পণ্ডিতদের আনতে পারে, বিশেষ করে বাংলাদেশি বংশোদ্ভূত যাঁদের বিভিন্ন ক্ষেত্রে শিক্ষা ও গবেষণায় একাডেমিক উৎকর্ষ রয়েছে। ফলে, শিক্ষার গুণগত মানে পরিবর্তন আসবে।
টাইমস হায়ার এডুকেশন বা কিউএস র্যাঙ্কিং অনুসরণ করে বিশ্ববিদ্যালয়গুলোর একটি জাতীয় র্যাঙ্কিং সিস্টেম থাকা উচিত। এতে শিক্ষক ও বিশ্ববিদ্যালয়ের জন্য একটি প্রতিযোগিতামূলক কিন্তু অনুকূল একাডেমিক পরিবেশ সৃষ্টি হবে। প্রাতিষ্ঠানিক পদোন্নতি ও বার্ষিক ইনক্রিমেন্টের মানদণ্ড, যেমন একাডেমিক শ্রেষ্ঠত্ব, পেশাগত উন্নয়ন, মানসম্পন্ন প্রকাশনা ও গবেষণা অনুদানকে স্বচ্ছতার সঙ্গে একটি নিয়মতান্ত্রিক উপায়ে অনুসরণ এবং সেটি আরও শক্তিশালী করা প্রয়োজন।
ওয়ার্ল্ড ইকোনমিক ফোরামের (২০১৬) একটি প্রতিবেদনে ইঙ্গিত দেওয়া হয়েছে, ‘আজকে প্রাথমিক বিদ্যালয়ে প্রবেশকারী ৬৫ শতাংশ শিশু শেষ পর্যন্ত সম্পূর্ণ নতুন চাকরিতে কাজ করবে, যা এখনো বিদ্যমান নেই।’ সুতরাং শিক্ষা কোনো টিক নয়, বরং সারা জীবনের অর্জন। ভবিষ্যৎ কাজগুলো হবে এমন, যা মেশিন করতে পারে না। একই সঙ্গে সৃজনশীল প্রচেষ্টা, সামাজিক মিথস্ক্রিয়া, শারীরিক দক্ষতার মতো ক্ষেত্রগুলোর বিকাশ ঘটাতে হবে। মানুষ যাতে মেশিনকে হারাতে পারে। এখন আমাদের নীতিনির্ধারকদের উচিত চতুর্থ শিল্পবিপ্লব–সম্পর্কিত গবেষণা ও উদ্ভাবনকে অগ্রাধিকার দিয়ে শিক্ষানীতি পুনর্বিবেচনা করা, যাতে বৈশ্বিক শিক্ষার বাজারে বাংলাদেশ একটি ব্র্যান্ড হিসেবে আবির্ভূত হতে পারে।
লেখা:
অধ্যাপক ড. মো. আকতারুজ্জামান
ড্যাফোডিল ইউনিভার্সিটির ব্লেন্ডেড লার্নিং সেন্টারের পরিচালক এবং
বঙ্গবন্ধু ডিজিটাল বিশ্ববিদ্যালয়ের আইসিটি ও শিক্ষা বিভাগের প্রতিষ্ঠাতা প্রধান
Source: shorturl.at/arDF5