Show Posts

This section allows you to view all posts made by this member. Note that you can only see posts made in areas you currently have access to.


Topics - kekbabu

Pages: 1 2 [3] 4 5 6
31
সড়ক পরিবহন আইনের যথাযথ বাস্তবায়ন জরুরি
ড. কুদরাত-ই-খুদা বাবু
৮ নভেম্বর, ২০১৯

বহুল আলোচিত সড়ক পরিবহন আইন-২০১৮ গত ১ নভেম্বর থেকে কার্যকর হয়েছে। নতুন সড়ক পরিবহন আইন বাস্তবায়নে পূর্ণ সমর্থন দেওয়ার কথা জানিয়েছে সড়ক পরিবহন সমিতি। তবে আইনটিকে সাধুবাদ জানালেও এর কিছু অংশ কঠিন বলে মনে করছে মালিক সমিতি। এ জন্য আইনের কিছু অংশ সংশোধনের দাবি জানিয়েছে তারা। সড়ক পরিবহন সমিতির পক্ষ থেকে বলা হয়, নতুন এ আইনে ক্ষতিপূরণের পরিমাণ এত বিপুল যে তা দেওয়া সম্ভব নয়। যাহোক, নতুন এ আইনে মালিক, শ্রমিক, পথচারী সবারই জরিমানা বেড়েছে। তবে এটা জানানোর জন্য আরো বেশি প্রচারণা দরকার।

বেশির ভাগ মানুষ এখন পর্যন্ত এ আইনের কথা জানে না। ড্রাইভিং লাইসেন্স ছাড়া পেশাদার বা অপেশাদার চালক গাড়ি চালালে কারাদণ্ড ও জরিমানার বিধান রেখে ২০১৭ সালের ২৭ মার্চ মন্ত্রিসভা আইনটির খসড়ায় অনুমোদন দেওয়ার পর গত বছরের ৮ অক্টোবর ‘সড়ক পরিবহন আইন-২০১৮’-এর গেজেট জারি করা হলেও এর কার্যকারিতা এত দিন ঝুলে ছিল। এ আইনে ড্রাইভিং লাইসেন্স ছাড়া গাড়ি চালালে ছয় মাসের কারাদণ্ড বা ৫০ হাজার টাকা জরিমানা বা উভয় দণ্ডের বিধান রয়েছে। তা ছাড়া গাড়ি চালানোর সময় চালকদের মোবাইল ফোন ব্যবহারের জন্যও দণ্ডের বিধান রাখা হয়েছে। আইনে বলা হয়েছে, অষ্টম শ্রেণি পাস না করলে লাইসেন্স পাবে না চালকরা। পাশাপাশি গাড়ি চালানোর সময় মোবাইল ফোন ব্যবহার করা যাবে না। মোবাইল ফোন ব্যবহার করলে এক মাসের কারাদণ্ড ও পাঁচ হাজার টাকা জরিমানা করা হবে। আইনে সাধারণ চালকের বয়স কমপক্ষে ১৮ বছর এবং পেশাদার চালকদের বয়স হতে হবে কমপক্ষে ২১ বছর। জাল ড্রাইভিং লাইসেন্স ব্যবহারের জন্য দুই বছরের কারাদণ্ড ও জরিমানা তিন লাখ টাকা করা হয়। ফিটনেস চলে যাওয়ার পরও মোটরযান ব্যবহার করলে এক বছরের কারাদণ্ড বা সর্বোচ্চ এক লাখ টাকা জরিমানা করার বিধান রয়েছে। তা ছাড়া দুর্ঘটনার জন্য দণ্ডবিধি অনুযায়ী তিন রকমের বিধান রয়েছে। যেমন—অপরাধমূলক নরহত্যা হলে দণ্ডবিধির ৩০২ ধারা অনুযায়ী মৃত্যুদণ্ডের সাজা হবে। খুন না হলে ৩০৪ ধারা অনুযায়ী যাবজ্জীবন।

বেপরোয়াভাবে গাড়ি চালিয়ে মৃত্যু ঘটালে ৩০৪(বি) ধারা অনুযায়ী তিন বছরের কারাদণ্ড হবে। আর দুই গাড়ি পাল্লা দিয়ে দুর্ঘটনা ঘটালে তিন বছরের কারাদণ্ড বা ২৫ লাখ টাকা জরিমানা বা উভয় দণ্ড দেওয়া হবে। দুর্ঘটনায় না পড়লেও বেপরোয়াভাবে গাড়ি চালানোর জন্য সর্বোচ্চ দুই বছরের কারাদণ্ড অথবা দুই লাখ টাকা জরিমানার প্রস্তাব করা হয়েছে আইনে। তা ছাড়া নারী, শিশু, প্রতিবন্ধী ও বয়োজ্যেষ্ঠ যাত্রীর জন্য সংরক্ষিত আসনে অন্য কোনো যাত্রী বসলে এক মাসের কারাদণ্ড বা পাঁচ হাজার টাকা জরিমানা বা উভয় দণ্ড দেওয়া হবে। পাশাপাশি মদপান করে বা নেশাজাতীয় দ্রব্য খেয়ে গাড়ি চালালে, সহকারীকে দিয়ে গাড়ি চালালে, উল্টো দিকে গাড়ি চালালে, নির্ধারিত স্থান ছাড়া অন্য স্থানে গাড়ি থামিয়ে প্রতিবন্ধকতা সৃষ্টি, চালক ছাড়া মোটরসাইকেলে একজনের বেশি সহযাত্রী ওঠালে, মোটরসাইকেলের চালক ও সহযাত্রীর হেলমেট না থাকলে, ছাদে যাত্রী বা পণ্য বহন, সড়ক বা ফুটপাতে গাড়ি সারানোর নামে যানবাহন রেখে পথচারীদের চলাচলে বাধা সৃষ্টি, ফুটপাতের ওপর দিয়ে কোনো মোটরযান চলাচল করলে সর্বোচ্চ তিন মাস কারাদণ্ড বা ৩৫ হাজার টাকা জরিমানা বা উভয় দণ্ডের বিধান রয়েছে। তবে এখনো আইনটির বিধিমালা হয়নি। ফলে এটি কার্যকর করতে গেলে সমস্যায় পড়া লাগতে পারে। এ জন্য আইনটির দ্রুত বিধিমালা করা প্রয়োজন। তবে নতুন এ আইনটি সঠিকভাবে বাস্তবায়িত হলে এবং চালক, জনগণসহ সবাই তা মান্য করলে দেশের সড়ক-মহাসড়কে নিশ্চয় শৃঙ্খলা ফিরে আসবে।

প্রতিবছর এ দেশে প্রায় সাড়ে সাত হাজার সড়ক দুর্ঘটনা ঘটে। নৌ, সড়ক ও রেলপথ রক্ষা জাতীয় কমিটির এক পর্যবেক্ষণ প্রতিবেদনে বলা হয়, গত ঈদুল ফিতরের ছুটিতে সারা দেশে সড়ক দুর্ঘটনায় কমপক্ষে ১৪২ জন নিহত ও ৩২৪ জন আহত হয়েছেন। সড়ক পরিবহন ও সেতু মন্ত্রী ওবায়দুল কাদের গত ১২ জুন জাতীয় সংসদে জানিয়েছিলেন, গত ১০ বছরে (২০০৯-২০১৯) দেশে সড়ক দুর্ঘটনায় ২৫ হাজার ৫২৬ জন মানুষ নিহত হয়েছে। আহত হয়েছে ১৯ হাজার ৭৬৩ জন। আর বাংলাদেশ সড়ক পরিবহন কর্তৃপক্ষের হিসাব অনুযায়ী ১৯৯৪ সাল থেকে ২০১১ সাল পর্যন্ত দেশে ৭২ হাজার ৭৪৮ জন প্রাণ হারিয়েছে এবং ৫২ হাজার ৬৮৪ জন আহত হয়েছে। এ হিসাব অনুযায়ী দেশের বিভিন্ন স্থানে প্রতিদিন গড়ে ১০ জন সড়ক দুর্ঘটনায় প্রাণ হারায়। দেশে প্রতিনিয়ত যেভাবে সড়ক দুর্ঘটনা ঘটে চলেছে তাতে মনে হয়, এ দেশের সড়ক-মহাসড়কগুলো দিন দিন মৃত্যুফাঁদে পরিণত হচ্ছে।

এ দেশের সড়ক-মহাসড়কগুলোতে নিয়মিতভাবে ঘটে চলা দুর্ঘটনা জনগণের কপালের লিখন নয় কিংবা ভাগ্যদেবীর নির্মম পরিহাস নয়। এ ক্ষেত্রে যে বিষয়গুলো দায়ী তা হচ্ছে—সার্বিক যোগাযোগব্যবস্থার ধরন, চালকদের দক্ষতা, বেপরোয়া গতিতে গাড়ি চালানো, চালকদের ওভারটেকিং করার মানসিকতা প্রবল মাত্রায় বিদ্যমান থাকা, ড্রাইভিং লাইসেন্স প্রাপ্তিতে স্বচ্ছতা ও জবাবদিহির অভাব, জনগণের সচেতনতার অভাব, ট্রাফিক আইন কিংবা রাস্তা চলাচলের নিয়ম না মানা ইত্যাদি। এক হিসাবে দেখা গেছে, সড়ক দুর্ঘটনার দিক থেকে বাংলাদেশের অবস্থান সারা বিশ্বে দ্বিতীয়। দেশে প্রতিনিয়তই সড়ক দুর্ঘটনার শিকার হয়ে অনেক লোকের প্রাণহানি ঘটছে, অনেকে পঙ্গুত্ববরণ করছে, মোটা অঙ্কের আর্থিক ক্ষতি হচ্ছে; তা ছাড়া সড়ক দুর্ঘটনাকে কেন্দ্র করে অনেক সময় ভাঙচুর ও নৈরাজ্যের ঘটনা ঘটছে। ফলে সাধারণ মানুষ কঠিন ভোগান্তি আর হয়রানির শিকার হচ্ছে, যা অস্বীকার করার উপায় নেই। দেশের সড়ক-মহাসড়কগুলোয় যেভাবে দুর্ঘটনা ঘটছে এবং দুর্ঘটনার সংখ্যা দিন দিন যে হারে বাড়ছে, তা অতি দ্রুত রোধ করার ব্যাপারে বাস্তবমুখী ও যথাযথ পদক্ষেপ গ্রহণ এবং যথাযথ সতর্কতা অবলম্বন করতেই হবে।

সড়ক দুর্ঘটনা রোধে সর্বাগ্রে চালকদের হতে হবে বেশি দক্ষ, হতে হবে সতর্ক। পাশাপাশি জনগণকেও ট্রাফিক আইন ও রাস্তা চলাচলের আইন-কানুন যথারীতি মেনে চলতে হবে। এ ক্ষেত্রে যথেষ্ট কঠোরতার সঙ্গে ট্রাফিক আইনের প্রয়োগ অপরিহার্য। মাদক সেবন করে গাড়ি চালানো এবং গাড়ি চালানো অবস্থায় মোবাইল ফোনে কথা বলাসহ চালকদের ‘ওভারটেকিং’ করার মানসিকতাও পরিহার করা প্রয়োজন। তা ছাড়া সড়ক দুর্ঘটনা রোধে দেশের সার্বিক সড়কব্যবস্থার উন্নয়ন ঘটানোসহ চালকদের দক্ষতা বিচার করে ড্রাইভিং লাইসেন্স দেওয়ার বিষয়টিও নিশ্চিত করা জরুরি। এ ক্ষেত্রে যেন কোনো ধরনের দুর্নীতি না ঘটে, সে বিষয়টিও সরকারের পক্ষ থেকে নিশ্চিত করতে হবে। আর সড়ক দুর্ঘটনার জন্য দায়ী ব্যক্তিদের রাজনৈতিক পরিচয় বাদ দিয়ে কঠোর জবাবদিহির আওতায় এনে শাস্তি প্রদানের ব্যবস্থা থাকাও আবশ্যক। পাশাপাশি সড়ক দুর্ঘটনা রোধে বিভিন্ন গণমাধ্যম, সুধীসমাজ, সরকারসহ আপামর জনগণকে একযোগে আন্তরিকভাবে এগিয়ে আসতে হবে। সর্বোপরি সবাই সচেতন হলেই সড়ক দুর্ঘটনা কমিয়ে আনা সম্ভব।

লেখক : সহযোগী অধ্যাপক, আইন বিভাগ ড্যাফোডিল ইন্টারন্যাশনাল ইউনিভার্সিটি, অ্যামনেস্টি ইন্টারন্যাশনালের সদস্য।
kekbabu@yahoo.com

Link: https://www.kalerkantho.com/print-edition/muktadhara/2019/11/08/836491


32
শিক্ষকের মর্যাদা আর কতভাবে ভূলুণ্ঠিত হবে?
 ড. কুদরাত-ই-খুদা বাবু
 ০৭ নভেম্বর ২০১৯

রাজশাহী সরকারি পলিটেকনিক ইন্সটিটিউটের অধ্যক্ষকে লাঞ্ছিতের পর পানিতে ফেলে দিল ছাত্রলীগ নেতাকর্মীরা। (ইনসেটে) অধ্যক্ষ ফরিদ উদ্দিন। ছবি-সংগৃহীত
রাজশাহী সরকারি পলিটেকনিক ইন্সটিটিউটের অধ্যক্ষকে লাঞ্ছিতের পর পানিতে ফেলে দিল ছাত্রলীগ নেতাকর্মীরা। (ইনসেটে) অধ্যক্ষ ফরিদ উদ্দিন। ছবি-সংগৃহীত
রাজশাহী পলিটেকনিক ইন্সটিটিউটের অধ্যক্ষ ফরিদ উদ্দীন আহম্মেদকে টেনেহিঁচড়ে পুকুরে ফেলে দেয়ার ঘটনায় সচেতন শিক্ষক মহলের মনে প্রশ্ন দেখা দিয়েছে- আর কতভাবে শিক্ষকের মর্যাদা ভূলুণ্ঠিত করা হবে? ২ নভেম্বর দুপুরে অধ্যক্ষ ফরিদ উদ্দীন আহম্মেদকে টেনেহিঁচড়ে পুকুরে ফেলে দেয়ার মতো ন্যক্কারজনক ঘটনা ঘটে।


আর এ ধরনের ঘৃণ্য ঘটনার জন্য ওই ইন্সটিটিউটের ছাত্রলীগের কয়েকজন নেতাকর্মী দায়ী বলে অভিযোগ রয়েছে। ঘটনার শিকার অধ্যক্ষ গণমাধ্যমের কাছে অভিযোগ করেছেন, অন্যায় দাবি না মানায় ক্ষুব্ধ হয়ে ছাত্রলীগ নেতাকর্মীরা এ কাজ করেছে।

ক্লাসে উপস্থিতি কম থাকা দু’জন শিক্ষার্থী ফরম পূরণ করতে না পারায় ওইদিন প্রথমে ওই অধ্যক্ষের সঙ্গে বাকবিতণ্ডায় লিপ্ত হয়। ওইদিন দুপুরে অধ্যক্ষ ফরিদ উদ্দীন আহম্মেদ নামাজ শেষে মসজিদ থেকে কার্যালয়ে ফেরার সময় ১০-১২ জন তরুণ ওই অধ্যক্ষের হাত ধরে টেনে ও ধাক্কা দিয়ে রাস্তার পাশে পুকুরে ফেলে দেয়। পরে কয়েকজন কর্মকর্তা-কর্মচারী ও শিক্ষার্থী অধ্যক্ষকে পুকুর থেকে তোলেন।

শিক্ষকের মর্যাদা ভূলুণ্ঠিত করার ঘটনা দেশে এটিই প্রথম নয়। এর আগে নারায়ণগঞ্জে এক শিক্ষকের মর্যাদা প্রকাশ্য দিবালোকে ভূলুণ্ঠিত করা হয়, যা ছিল বহুল আলোচিত ও নিন্দিত ঘটনা। দুঃখজনক হলেও সত্য, আমাদের দেশে শিক্ষক হত্যাসহ হামলা, লাঞ্ছনার বেশিরভাগ ঘটনারই বিচার হয়নি।

যেমন- ২০১৪ সালের ১০ সেপ্টেম্বর চট্টগ্রাম বিশ্ববিদ্যালয়ে শিক্ষকদের বাসে ছাত্রশিবিরের সন্ত্রাসীরা ককটেল হামলা চালিয়ে ১২ শিক্ষককে আহত করার ঘটনা; ২০১৩ সালের ১০ জানুয়ারি বেগম রোকেয়া বিশ্ববিদ্যালয়ে বিভিন্ন সমস্যা সমাধানের দাবিতে আন্দোলনরত শিক্ষকদের ওপর ছাত্রলীগের ‘বহিরাগত’ কর্মীর হামলায় দুই শিক্ষক আহত হওয়ার ঘটনা; এর একদিন পর ১২ জানুয়ারি কুষ্টিয়ার ইসলামী বিশ্ববিদ্যালয়ে ছাত্রলীগ নামধারীরা বহিরাগতদের সঙ্গে নিয়ে ফিল্মি স্টাইলে শিক্ষক লাউঞ্জে ঢুকে ইটপাটকেল ছুঁড়ে ২০ শিক্ষককে আহত হওয়ার ঘটনা ইত্যাদি।

শুধু শিক্ষকদের লাঞ্ছনা করাই নয়, দেশে শিক্ষকদের হত্যা করতেও দ্বিধাবোধ করা হয় না। এর প্রকৃষ্ট উদাহরণ হচ্ছে রাজশাহী বিশ্ববিদ্যালয়। ওই বিশ্ববিদ্যালয়ে গত একযুগে চারজন শিক্ষককে নির্মমভাবে হত্যা করা হয়েছে; আর এসব হত্যাকাণ্ডে বিশ্ববিদ্যালয়েরই কতিপয় শিক্ষার্থীর যোগসাজশ ছিল; যা আদালতের মাধ্যমে প্রমাণিত হয়েছে।

কবি কাজী কাদের নেওয়াজ রচিত ‘শিক্ষকের মর্যাদা’ নামক কবিতার বিষয়বস্তু হল এরকম- দিল্লির এক মৌলভী (শিক্ষক) বাদশাহ আলমগীরের পুত্রকে পড়াতেন। একদিন প্রভাতে বাদশাহ লক্ষ করলেন, তার পুত্র ওই শিক্ষকের পায়ে পানি ঢালছেন আর শিক্ষক তার পা নিজেই পরিষ্কার করছেন।

এ ঘটনা প্রত্যক্ষ করার পর বাদশাহ দূত মারফত ওই শিক্ষককে ডেকে নিয়ে যান। তারপর বাদশাহ ওই শিক্ষককে বলেন, ‘আমার পুত্র আপনার নিকট থেকে তো সৌজন্য না শিখে বেয়াদবি আর গুরুজনের প্রতি অবহেলা করা শিখেছে। কারণ; সেদিন প্রভাতে দেখলাম, আমার পুত্র শুধু আপনার পায়ে পানি ঢেলে দিচ্ছে আর আপনি নিজেই আপনার পা পরিষ্কার করছিলেন। আমার পুত্র কেন পানি ঢালার পাশাপাশি আপনার পা ধুয়ে দিল না- এ কথা স্মরণ করলে মনে ব্যথা পাই।’

বাদশাহের মুখ থেকে এ কথা শোনার পর ওই শিক্ষক অত্যন্ত উচ্ছ্বাসের সঙ্গে বলে উঠলেন, ‘আজ হতে চির উন্নত হল শিক্ষাগুরুর শির; সত্যিই তুমি মহান, উদার, বাদশাহ্ আলমগীর।’

আগের যুগে সমাজে শিক্ষকের মর্যাদা যে কত উঁচুস্তরে ছিল, তা ওই কবিতার মাধ্যমে অত্যন্ত সুন্দরভাবে ফুটে উঠেছে। কিছুকাল আগেও আমাদের দেশে ‘শিক্ষকের মর্যাদা’ কবিতাটিকেই অভিভাবকরা ছাত্র-শিক্ষক সম্পর্কের আদর্শ রূপ বলে মনে করতেন।

আর এখনকার দিনে শিক্ষার্থী কর্তৃক শিক্ষকের ওপর হামলা চালানো, তাদের হুমকি দেয়া ও হত্যা করা এবং লাঞ্ছনা করার ঘটনা যেন নিত্যনৈমিত্তিক বিষয় হয়ে দাঁড়িয়েছে। এর পেছনে ক্ষমতা ও স্বার্থকেন্দ্রিক নোংরা রাজনীতিই যে দায়ী, তা আর বলার অপেক্ষা রাখে না।

অবশ্য আমাদের সমাজের সব শিক্ষকই ধোয়া তুলসী পাতা নয়। অনেক শিক্ষকের বিরুদ্ধেই অনিয়ম-দুর্নীতি, যৌন হয়রানি, শিক্ষার্থীদের ক্লাসে সঠিকভাবে না পড়িয়ে প্রাইভেট বাণিজ্য নিয়ে ব্যস্ত থাকা, নিয়মিতভাবে ক্লাস না নেয়া, সঠিক সময়ে খাতা না দেখা ও ফলাফল প্রকাশ না করে শিক্ষার্থীদের সেশনজটে ফেলা, মাদক গ্রহণ, শিক্ষার্থীকে শারীরিক ও মানসিকভাবে নির্যাতন করা, রাজনৈতিক বিবেচনায় শিক্ষার্থীদের মূল্যায়নপূর্বক অনেক শিক্ষার্থীর শিক্ষাজীবন নষ্ট করাসহ বিভিন্ন সময়ে নানা অভিযোগ পাওয়া যায়।

শিক্ষক-শিক্ষার্থীর পরস্পরের প্রতি এ ধরনের বিষয়গুলো নিঃসন্দেহে লজ্জার। আর এ লজ্জা যে গোটা জাতির লজ্জা, তা বলার অপেক্ষা রাখে না। ছাত্র-শিক্ষকের সম্পর্ক নিয়ে এডুকেশন ওয়াচ কর্তৃক প্রকাশিত এক প্রতিবেদনে বলা হয়েছে, ‘অর্ধেকের বেশি শিক্ষার্থী এখন আর শিক্ষকদের আদর্শ মনে করে না।’

প্রকাশিত ওই রিপোর্ট থেকে জানা যায়, এখানে মতামত শুধু শিক্ষার্থীরাই দেননি, মতামত প্রদানের ক্ষেত্রে যুক্ত ছিলেন শিক্ষার্থীদের অভিভাবক এবং অনেক শিক্ষকও। ছাত্র-শিক্ষক সম্পর্ক নিয়ে এ ধরনের গবেষণা এবং রিপোর্ট আমাদের দেশের শিক্ষাপদ্ধতি এবং শিক্ষাব্যবস্থা মূল্যায়নের ক্ষেত্রে গুরুত্বপূর্ণ।

কারণ, এ ধরনের গবেষণা এবং রিপোর্টের মাধ্যমে আমাদের দেশে ছাত্র-শিক্ষক সম্পর্কের বিষয়ে সম্যক ধারণা পাওয়া যায়। সত্যি বলতে কী, এখনকার অধিকাংশ শিক্ষার্থীই শিক্ষকদের আদেশ-উপদেশ পূর্ববর্তী সময়ের মতো মেনে চলে না, মেনে চলতে চায় না। যদিও এর পেছনে অনেক কারণ রয়েছে।

এখনকার অধিকাংশ শিক্ষার্থীই বেশি ক্লাস করতে বা বেশি পড়তে আগ্রহী নয়। কম ক্লাস নেয়া, কম পড়ানো আর বেশি নম্বর দেয়া শিক্ষকরাই যেন আজ অধিকাংশ শিক্ষার্থীর কাছে ‘জনপ্রিয়’ শিক্ষক হয়ে ওঠেন। যেসব শিক্ষক এ অবস্থার বিপরীতে চলেন, অধিকাংশ শিক্ষার্থীদের কাছে তারা হয়ে ওঠেন চরম যন্ত্রণাদায়ক এবং চরম অপছন্দের মানুষ।

একটা সময় যখন বেতন খুবই কম ছিল, তখন শিক্ষকতা পেশায় মেধাবীরা আসতেন না বললেই চলে। তখন একটি প্রবাদ প্রচলিত ছিল ‘যার নাই কোনো গতি, তিনি করেন পণ্ডিতি’। তবে শিক্ষকতা সম্মানিত পেশা হওয়ায় সেবার ব্রত নিয়ে অনেক সম্মানী লোক আগ্রহ করে আসতেন, যারা টাকা উপার্জনকে গুরুত্ব না দিয়ে সমাজের সম্মানী পেশা হিসেবে শিক্ষকতাকে বেছে নিয়েছিলেন।

একটা সময় মহৎ পেশা হিসেবে গর্ব করে বলা হতো- আমি শিক্ষকতা করি। এখনও সবচেয়ে সম্মানের পেশা শিক্ষকতা হলেও এ মহৎ পেশাটাকে তথাকথিত রাজনীতি আর কিছুসংখ্যক সুবিধাভোগী শিক্ষক নিজেদের স্বার্থে ব্যবহার করে এ মহৎ পেশার গায়ে কালিমা লেপন করছেন, যা মোটেই কাম্য নয়।

সদাচরণ, গুরুভক্তি, বড়দের সম্মান করা ইত্যাদি বিষয়গুলো একটা সময় আদর্শ ছাত্রের বৈশিষ্ট্য ছিল। কিন্তু আজ বাস্তবতা ভিন্ন। এজন্য অবশ্য অনেক শিক্ষকও প্রত্যক্ষ ও পরোক্ষভাবে দায়ী। যখন কোনো শিক্ষক পরীক্ষার হলে শিক্ষার্থীদের নকল সরবরাহ করেন তখন ছাত্রছাত্রীদের কাছে ওই শিক্ষকের মর্যাদা থাকে না।

আজকাল ইন্টারনেট, ফেসবুক, মাদক, ইভটিজিং ইত্যাদি বিষয়গুলো যেন শিক্ষার্থীসহ কিশোর ও যুব সমাজকে শেষ করে দিচ্ছে। এখন নীতি-নৈতিকতা যেন ছাত্রজীবন থেকে বিলীন হতে চলছে।

স্কুল, কলেজ, বিশ্ববিদ্যালয় পড়ুয়া ছেলেমেয়ের হাতে পিতামাতার নিগৃহীত ও নির্যাতনের শিকার হওয়া, এমনকি খুন পর্যন্ত হওয়া (যেমন ঐশী) সাধারণ বিষয় হয়ে দাঁড়িয়েছে। বর্তমানে সমাজ ব্যবস্থা পাল্টেছে; প্রায়ই শিক্ষকদের অপমান করে এক শ্রেণির শিক্ষার্থী (বিশেষ করে যারা রাজনীতির সঙ্গে যুক্ত) নিজেদের হিরো মনে করে।

শিক্ষাকে বলা হয়, জাতির মেরুদণ্ড আর শিক্ষকদের বলা হয়, জাতি গঠনের কারিগর। তাহলে উপরোক্ত ঘটনাগুলো নিশ্চয় জাতির মেরুদণ্ড এবং জাতির কারিগরের ওপর চরম আঘাত। একটি সভ্য ও গণতান্ত্রিক দেশ এভাবে চলতে পারে না।

বিষয়গুলো শিক্ষক-শিক্ষার্থী, অভিভাবক, শিক্ষা মন্ত্রণালয়, ইউজিসিসহ সংশ্লিষ্ট সবারই গুরুত্ব সহকারে ভেবে দেখা প্রয়োজন। মনে রাখতে হবে, পৃথিবীতে যারা বিখ্যাত হয়েছেন, প্রতিষ্ঠা পেয়েছেন; যাদের নাম স্বর্ণাক্ষরে লেখা আছে (যেমন- অ্যারিস্টটল, সক্রেটিস, প্লেটো প্রমুখ), তাদের প্রতিষ্ঠিত হওয়ার পেছনে কয়েকটি গুরুত্বপূর্ণ কারণ রয়েছে। এগুলোর মধ্যে রয়েছে মাতাপিতার প্রতি দায়িত্বশীলতা এবং শিক্ষাগুরুর (শিক্ষক) প্রতি শ্রদ্ধাশীল হওয়া।

এ কথা সত্য, এক প্রজন্ম থেকে আরেক প্রজন্মের মধ্যে ফারাক থাকবে এবং কথাবার্তা, চিন্তা-ভাবনা, চলনে-বলনে তার প্রকাশ ঘটবে এবং এটাই স্বাভাবিক। তবে আমাদের দেশে ছাত্র-শিক্ষক সম্পর্কের বর্তমান পরিস্থিতিতে দুই প্রজন্মেরই চলমান অবস্থা থেকে বেরিয়ে আসা প্রয়োজন।

শিক্ষক এবং শিক্ষার্থীদের নিজেদের সমালোচনার পরিবেশ-পরিস্থিতি তৈরি করতে হবে। কারণ, ছাত্র-শিক্ষকের মধ্যকার সুসম্পর্কই কেবল পারে আমাদের পুরো শিক্ষাব্যবস্থার অহসহনীয় এবং অস্বস্তিকর বিষয়গুলোকে উপড়ে ফেলতে।

ড. কুদরাত-ই-খুদা বাবু : সহযোগী অধ্যাপক, আইন বিভাগ, ড্যাফোডিল ইন্টারন্যাশনাল ইউনিভার্সিটি; অ্যামনেস্টি ইন্টারন্যাশনালের সদস্য
kekbabu@yahoo.com

Link: https://www.jugantor.com/todays-paper/sub-editorial/241363/%E0%A6%B6%E0%A6%BF%E0%A6%95%E0%A7%8D%E0%A6%B7%E0%A6%95%E0%A7%87%E0%A6%B0-%E0%A6%AE%E0%A6%B0%E0%A7%8D%E0%A6%AF%E0%A6%BE%E0%A6%A6%E0%A6%BE-%E0%A6%86%E0%A6%B0-%E0%A6%95%E0%A6%A4%E0%A6%AD%E0%A6%BE%E0%A6%AC%E0%A7%87-%E0%A6%AD%E0%A7%82%E0%A6%B2%E0%A7%81%E0%A6%A3%E0%A7%8D%E0%A6%A0%E0%A6%BF%E0%A6%A4-%E0%A6%B9%E0%A6%AC%E0%A7%87?fbclid=IwAR1Kfrx4dCBgnlL4NyQD4I9k58yGJauKNS8gPPGKEM6FVxtsUOaznfsaKok

33
শিক্ষাঙ্গনে খুনের রাজনীতি বন্ধ হবে কবে?
ড. কুদরাত-ই-খুদা বাবু
২১ অক্টোবর ২০১৯

বিশ্ববিদ্যালয় হচ্ছে জ্ঞানের আধার আর মুক্তবুদ্ধি ও মুক্তচর্চার জায়গা। ফলে স্বাভাবিকভাবেই বিশ্ববিদ্যালয়গুলোতে অধ্যয়নরত শিক্ষার্থীদের জ্ঞান-গবেষণা চর্চা নিয়ে ব্যস্ত থাকার কথা। পাশাপাশি মেধাভিত্তিক ছাত্ররাজনীতির মাধ্যমে দেশ, জাতি ও সমাজ গঠনে বলিষ্ঠ ভূমিকা রাখার কথা। অতীতের ছাত্ররাজনীতির দিকে তাকালে এমনটাই দেখা যেত। কিন্তু বর্তমান ছাত্ররাজনীতির দিকে তাকালে দেখা মেলে সম্পূর্ণ উল্টো চিত্রের। বিশ্ববিদ্যালয় মঞ্জুরি কমিশনের হিসাব অনুযায়ী, দেশে বর্তমানে ৪৫টি পাবলিক এবং ১০৩টি প্রাইভেট বিশ্ববিদ্যালয় রয়েছে। বিভিন্ন পাবলিক বিশ্ববিদ্যালয় প্রতিষ্ঠার পর থেকে এ পর্যন্ত রাজনৈতিক কারণসহ নানা কারণে এসব পাবলিক বিশ্ববিদ্যালয়ের অনেক শিক্ষার্থী হত্যাকাণ্ডের শিকার হয়েছেন। দেশের পাবলিক বিশ্ববিদ্যালয়ে ছাত্র হত্যার সর্বশেষ ঘটনা ঘটল বাংলাদেশ প্রকৌশল বিশ্ববিদ্যালয়ে (বুয়েট)। ৬ অক্টোবর বুয়েটের শিক্ষার্থী আবরার ফাহাদকে ‘ছাত্রলীগ’ নামধারী সন্ত্রাসীরা পিটিয়ে হত্যা করে। দুঃখজনক হলেও সত্য, দেশের বিভিন্ন পাবলিক বিশ্ববিদ্যালয়ে এ পর্যন্ত বিভিন্ন সময়ে অনেক হত্যাকাণ্ড সংঘটিত হলেও বেশিরভাগ হত্যাকাণ্ডেরই বিচার হয়নি। যেমন- বুয়েটের শিক্ষার্থী আবরার হত্যার বিচার দাবিতে দেশ যখন উত্তাল, ঠিক তখনই পত্রিকায় খবর বেরিয়েছে ‘চট্টগ্রাম মেডিকেল কলেজ হোস্টেলে পিটিয়ে আবিদ হত্যার মামলার রায়ে ছাত্রলীগের ১২ নেতাকর্মীর সবাই বেকসুর খালাস’।

উল্লেখ্য, ২০১১ সালের অক্টোবর মাসে দফায় দফায় পিটিয়ে হত্যা করা হয়েছিল চট্টগ্রাম মেডিকেল কলেজের ৫১তম ব্যাচের বিডিএস তৃতীয় বর্ষের ছাত্র আবিদুর রহমান আবিদকে। দেশের বিভিন্ন বিশ্ববিদ্যালয়ে ছাত্র হত্যার ঘটনা যেন নৈমিত্তিক বিষয় হয়ে দাঁড়িয়েছে।

গণমাধ্যমে প্রকাশিত খবর অনুযায়ী, দেশের দ্বিতীয় বৃহত্তম বিদ্যাপীঠখ্যাত রাজশাহী বিশ্ববিদ্যালয় ১৯৫৩ সালে প্রতিষ্ঠার পর থেকে এ পর্যন্ত হল দখল, পদ দখল, চাঁদাবাজি, টেন্ডারবাজি, আধিপত্য বিস্তার, অভ্যন্তরীণ কোন্দল, রাজনৈতিক প্রতিহিংসাসহ নানা কারণে ওই বিশ্ববিদ্যালয়ে সৃষ্ট সংঘর্ষে ৩৪ শিক্ষার্থীর প্রাণহানির ঘটনা ঘটেছে। অসংখ্য শিক্ষার্থী আহত হওয়াসহ পঙ্গুত্ববরণ করেছেন। বিভিন্ন সময়ে সৃষ্ট এসব সংঘর্ষের কারণে প্রায় ৬০০ দিন বিশ্ববিদ্যালয় ক্যাম্পাস বন্ধ থেকেছে, বিশ্ববিদ্যালয়ের অমূল্য সম্পদ বিনষ্ট হওয়াসহ আর্থিক ক্ষতি হয়েছে কমপক্ষে ৩০ কোটি টাকা।

রাজনৈতিক অস্থিরতায় সংঘটিত এসব হত্যাকাণ্ডের বেশিরভাগেরই বিচার আজ পর্যন্ত হয়নি। ছাত্র হত্যা ও ছাত্র হত্যার বিচার নিয়ে এ চিত্র শুধু রাজশাহী বিশ্ববিদ্যালয়েরই নয়। ছাত্র হত্যা নিয়ে ঠিক এ ধরনের চিত্র খুঁজে পাওয়া যাবে ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়, জাহাঙ্গীরনগর বিশ্ববিদ্যালয়, চট্টগ্রাম বিশ্ববিদ্যালয়, খুলনা বিশ্ববিদ্যালয়, কুষ্টিয়া ইসলামী বিশ্ববিদ্যালয়, বুয়েট, জাতীয় বিশ্ববিদ্যালয়সহ বিভিন্ন বিশ্ববিদ্যালয়ে।

রাজনৈতিক কারণসহ বিভিন্ন কারণে বিভিন্ন সংগঠনের অনেক নেতাকর্মী ও সাধারণ শিক্ষার্থী খুন হওয়া এবং শেষ পর্যন্ত রাজনৈতিক ডামাডোলে এসব মামলা হারিয়ে যাওয়া তথা এসব ঘটনার বিচার না হওয়া নিঃসন্দেহে দুঃখজনক। আর বিচার না হওয়ার পেছনে রাজনৈতিক ছত্রছায়া, হত্যাকাণ্ডের ঘটনায় করা মামলাগুলোকে রাজনৈতিক মামলা হিসেবে বিবেচনা করা, আদালতের ওপর রাজনৈতিক বা ক্ষমতাসীন দলের প্রভাব বিস্তার, মামলাসংশ্লিষ্ট পক্ষগুলোর আদালতে নিয়মিত হাজিরা না দেয়া, দীর্ঘদিনেও আদালতে প্রতিবেদন জমা না দেয়া, বাদীকে আদালতে হাজির হওয়া থেকে বিরত থাকার জন্য আসামিপক্ষ কর্তৃক নানাভাবে ভয়ভীতি দেখানো, দীর্ঘদিনেও বিচার না হওয়ায় বাদী কর্তৃক মামলা পরিচালনা না করার মনোভাব সৃষ্টি হওয়া ও শেষ পর্যন্ত হাল ছেড়ে দেয়া ইত্যাদি বিষয়গুলো কাজ করে। ছাত্র হত্যার শেষ পর্যন্ত বিচার না হওয়ার কারণে পরবর্তী সময়ে অনেকেই বিশ্ববিদ্যালয়ে এ ধরনের কর্মকাণ্ড ঘটাতে উৎসাহী হয়ে ওঠে- যা বিশ্ববিদ্যালয়গুলোর জন্য রীতিমতো অশনিসংকেতই বটে।

বিশ্ববিদ্যালয়গুলোতে বিভিন্ন সময়ে হত্যাকাণ্ড সংঘটিত হওয়ার পর সংশ্লিষ্ট বিশ্ববিদ্যালয় প্রশাসনের পক্ষ থেকে বলতে শোনা যায় ঘটনা তদন্তে কমিটি গঠন করা হয়েছে। ভালোভাবে খোঁজ নিলে দেখা যাবে বিশ্ববিদ্যালয়গুলোতে হত্যাকাণ্ড ও সংঘর্ষের ঘটনায় এ পর্যন্ত হাজারও তদন্ত কমিটি গঠন করা হয়েছে। প্র্রশ্ন থেকে যায়, এখন পর্যন্ত কয়টি তদন্ত কমিটির রিপোর্ট আলোর মুখ দেখেছে? এ কারণে অনেকেই তদন্ত কমিটিকে ‘ঘটনার ধামাচাপা কমিটি’ বা ‘ঘটনাকে ঠাণ্ডা করার কমিটি’ হিসেবে আখ্যায়িত করেন। বিশ্ববিদ্যালয় প্রশাসনের পাশাপাশি ছাত্র হত্যাকাণ্ড সংঘটিত হওয়ার পরে সংশ্লিষ্ট জায়গার আইনশৃঙ্খলা রক্ষাকারী বাহিনীর পক্ষ থেকেও বলতে শোনা যায়, অপরাধী যে-ই হোক না কেন তাদের বিরুদ্ধে আইনানুগ ব্যবস্থা নেয়া হবে। কিন্তু পরবর্তী সময়ে যে কী ধরনের ব্যবস্থা নেয়া হয় বা হয়েছে, তা সচেতন ব্যক্তিমাত্রই অনুধাবন করতে পারেন।

পত্রিকায় প্রকাশিত সংবাদ বিশ্লেষণে দেখা গেছে, মহাজোট সরকার ক্ষমতায় আসার আগে ছাত্রদল ও ছাত্রশিবির রাজশাহী বিশ্ববিদ্যালয়, কুষ্টিয়া ইসলামী বিশ্ববিদ্যালয়, ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়, জাহাঙ্গীরনগর বিশ্ববিদ্যালয়, চট্টগ্রাম বিশ্ববিদ্যালয়সহ বিভিন্ন বিশ্ববিদ্যালয়ের ক্যাম্পাসে একক আধিপত্য, দখলদারি, চাঁদাবাজি, ত্রাস ও সন্ত্রাসের রাজত্ব কায়েম করেছে। আর মহাজোট সরকার ক্ষমতায় আসার পরও যে সেই অবস্থার ইতিবাচক কোনো পরিবর্তন ঘটেছে, তা কিন্তু নয়। বরং ক্ষমতাসীন দলের নেতাকর্মীরাও বিশ্ববিদ্যালয়গুলোতে ঠিক একই ধরনের পরিস্থিতির সৃষ্টি করেছে। এ যেন মুদ্রার এপিঠ-ওপিঠ। এ দেশে প্রত্যেক রাজনৈতিক দল নির্বাচনের আগে নির্বাচনী ইশতেহারে শিক্ষাঙ্গনগুলোকে সন্ত্রাসমুক্ত রাখার ঘোষণা দিয়ে থাকে। কিন্তু শেষ পর্যন্ত তা ফাঁকাবুলি হয়েই থাকে।

স্বার্থকেন্দ্রিক রাজনীতি ও সুষ্ঠু রাজনৈতিক সংস্কৃতির অভাব-ই যে এসব অস্থিতরতার পেছনের মূল কারণ, তা সহজেই অনুমেয়। বাস্তবতা হচ্ছে, দেশের বিশ্ববিদ্যালয়গুলোয় এখন জ্ঞান-গবেষণা চর্চার চেয়ে রাজনীতিসহ আনুষঙ্গিক বিষয়গুলো প্রাধান্য পাচ্ছে। দেশের জনগণের কষ্টার্জিত টাকায় পরিচালিত উচ্চশিক্ষার এসব শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানে রাজনৈতিক সংগঠনের নেতাকর্মীদের রাজনৈতিক লেজুড়বৃত্তি ও ব্যক্তিস্বার্থের আন্দোলন দেশ-জাতির বৃহত্তর স্বার্থেই পরিহার করা উচিত। আর শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানে আন্দোলন যদি করতেই হয়, তবে তা একাডেমিক স্বার্থের জন্য করা উচিত। রাজনৈতিক লেজুড়বৃত্তি বা ব্যক্তিস্বার্থ উদ্ধারের জন্য নয়। মেধাভিত্তিক ছাত্ররাজনীতির মাধ্যমে যে ছাত্রদের দেশ, জাতি ও সমাজ গঠনে বলিষ্ঠ ভূমিকা পালন করার কথা, আজ তারাই টেন্ডারবাজি, চাঁদাবাজি, ছিনতাই, হানাহানি, খুনোখুনিসহ নানা ধরনের সন্ত্রাসী কর্মকাণ্ডে জড়িয়ে পড়ছে।

গণমাধ্যমে প্রকাশিত এক প্রতিবেদনে দেখা যায়, ২০০৯, ২০১০ এবং ২০১১- এই তিন বছরে দেশের বিভিন্ন শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানে অভ্যন্তরীণ কোন্দল ও প্রতিপক্ষের সঙ্গে সংঘর্ষে প্রাণ হারিয়েছেন ১৮ ছাত্র। অপর এক পরিসংখ্যানে দেখা যায়, গত ৪৫ বছরে শুধু ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়, রাজশাহী বিশ্ববিদ্যালয়, চট্টগ্রাম বিশ্ববিদ্যালয় এবং জাহাঙ্গীরনগর বিশ্ববিদ্যালয়ে ১৩২ শিক্ষার্থী হত্যাকাণ্ডের শিকার হয়েছেন; কিন্তু দুঃখের বিষয়, রাজনৈতিক কারণে এখন পর্যন্ত বেশিরভাগ হত্যাকাণ্ডের বিচার না হওয়ায় সন্ত্রাসী কর্মকাণ্ড করেও ‘ছাত্র’ নামধারী সন্ত্রাসীরা বারবার রেহাইও পেয়ে যাচ্ছে। দেশের উচ্চশিক্ষার শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানগুলোতে বারংবার ছাত্র হত্যা হলেও শেষ পর্যন্ত বেশিরভাগ ক্ষেত্রেই বিচার না হওয়া তথা সন্ত্রাসীরা ছাড় পেয়ে যাওয়া এবং বিশ্ববিদ্যালয়গুলোতে ধারাবাহিক অস্থিরতা কিসের আলামত বহন করে? পাশাপাশি দেশের উচ্চশিক্ষার প্রতিষ্ঠানগুলোতে অস্থিরতা বন্ধ করতে তথা ছাত্ররাজনীতির ব্যাপারে দেশের রাজনৈতিক সংগঠনগুলোকে তাদের স্বার্থেই সম্মিলিতভাবে সিদ্ধান্ত গ্রহণ করা উচিত।

কারণ, কোনো রাজনৈতিক দলের ছাত্র সংগঠন ক্যাম্পাসে বা কোথাও সন্ত্রাসী কর্মকাণ্ড ঘটালে সেই সংগঠনের ভাবমূর্তি ক্ষুণ্ণ হয় এবং পরবর্তী সময়ে সরকার গঠনে বা নির্বাচনে এসব সন্ত্রাসী কর্মকাণ্ডের সরাসরি নেতিবাচক প্রভাব পড়ে। দেশ-জাতির বৃহত্তর স্বার্থে এবং শিক্ষার সুষ্ঠু পরিবেশ নিশ্চিত করতে বিভিন্ন সময়ে বিশ্ববিদ্যালয়গুলোতে ছাত্র হত্যার সঙ্গে জড়িতদের যে কোনো মূল্যে খুঁজে বের করা এবং রাজনৈতিক পরিচয় বাদ দিয়ে তাদের বিরুদ্ধে দৃষ্টান্তমূলক শাস্তি প্রদান করা এখন জরুরি বিষয় হিসেবে দেখা দিয়েছে।

ড. কুদরাত-ই-খুদা বাবু : সহযোগী অধ্যাপক, আইন বিভাগ, ড্যাফোডিল ইন্টারন্যাশনাল ইউনিভার্সিটি; অ্যামনেস্টি ইন্টারন্যাশনালের সদস্য
kekbabu@yahoo.com


34
নিষ্পাপ-নিরপরাধ শিশুরা আজ নিরাপদ কোথায়?
ড. কুদরাত-ই-খুদা বাবু
১৮ অক্টোবর, ২০১৯ [The daily Kalerkantho, page no. 15]

জাতির ভবিষ্যৎ শিশুরা আজ যেন কোথাও নিরাপদ নয়। সংঘবদ্ধ অপহরণকারীচক্র, প্রতারক, দুর্বৃত্তের হাতে তো স্বাভাবিকভাবেই শিশুরা নিরাপদ নয়। নিজের পরিবারে, নিজের বাবার কাছে, এমনকি গর্ভধারিণী মায়ের কোলেও আজ নিষ্পাপ-নিরপরাধ শিশুরা আর নিরাপদ নয়। নিজ পরিবারের কাছেও যে শিশুরা নিরাপদ নয়, তার প্রমাণ পাওয়া যায় সুনামগঞ্জের দিরাই উপজেলার কেজাউড়া নামের এক গ্রামে তুহিন নামের এক শিশুকে বর্বরভাবে হত্যার ঘটনার মধ্য দিয়ে। গত ১৩ অক্টোবর রাতে শিশু তুহিনকে এমন বর্বর ও নৃশংসভাবে হত্যা করা হয়েছে, যা কল্পনাকেও হার মানায়। একই সঙ্গে ঘটনাটি মানবসভ্যতাকে প্রশ্নের মুখোমুখি করে তুলেছে। গণমাধ্যমে প্রকাশ, প্রতিপক্ষকে ফাঁসাতে তুহিন নামের পাঁচ-ছয় বছরের ওই শিশুকে ঘুম থেকে তার বাবা তুলে নিয়ে যায় এবং তার চাচা শিশুটিকে গলা কেটে হত্যা করে। পরে তাদের বাড়ির অদূরে একটি গাছের সঙ্গে ঝুলিয়ে রেখে শিশুটির পেটের মধ্যে হত্যাকাণ্ডে ব্যবহৃত দুটি ছুরি ঢুকিয়ে রাখা হয়। শুধু তা-ই নয়, শিশুটির পুরুষাঙ্গ ও কানও কেটে ফেলা হয়। এ ঘটনা জানার পর স্বাভাবিকভাবেই মনে প্রশ্ন জাগে, মানুষের বিবেকবোধ আজ কোন পর্যায়ে! কোথায় গিয়ে দাঁড়িয়েছে মানুষের মূল্যবোধ! বলা বাহুল্য, সারা দেশে আশঙ্কাজনক হারে বেড়ে চলছে শিশু ধর্ষণ, ধর্ষণ-পরবর্তী হত্যা ও নির্যাতন। দেশব্যাপী শিশু ধর্ষণ, হত্যা ও নির্যাতন ক্রমাগতভাবে বেড়ে যাওয়ার ঘটনায় দেশবাসী ও অভিভাবক মহল আজ রীতিমতো উদ্বিগ্ন। নিজ পরিবার-পরিজন, স্কুল, মাদরাসা, কলেজ, বিশ্ববিদ্যালয়, বাসে-লঞ্চে, পথে-ঘাটে, মাঠে—কোথাও আজ যেন শিশুরা নিরাপদ নয়। এ অবস্থা নিঃসন্দেহে এ জাতির জন্য এক অশনিসংকেত। আশঙ্কাজনক হারে শিশু ধর্ষণ, নির্যাতন ও হত্যার ঘটনাগুলো বিশ্বদরবারে বাংলাদেশের ভাবমূর্তি ক্ষুণ্ন করছে। বলার অপেক্ষা রাখে না যে কোনো সমাজে ধর্ষণ বিস্তৃত হলে এবং ধর্ষকদের কঠোর সাজার ব্যবস্থা করা না হলে সেই সমাজে নীতি-নৈতিকতা ও মূল্যবোধ বলে কিছুই থাকে না। এ ধরনের ঘটনা পুরো সমাজ, দেশ ও জাতিকে বিশৃঙ্খলা ও পাপাচারের দিকে ধাবিত করে, যা কখনোই ভালো ফল বয়ে আনে না। এমতাবস্থায় শিশু ধর্ষণ, নির্যাতন ও হত্যা বন্ধে দ্রুত কার্যকর পদক্ষেপ গ্রহণ না করা হলে ভবিষ্যতে এ অবস্থা ভয়ানক পর্যায়ে গিয়ে ঠেকবে।

পত্রিকায় প্রকাশিত এক প্রতিবেদনে জানা যায়, দেশে প্রতিবছর এক হাজারেরও বেশি নারী ও শিশু ধর্ষণের শিকার হচ্ছে। একটি বেসরকারি সংস্থার তথ্যানুযায়ী, চলতি বছরের এপ্রিল মাসের প্রথম ১৫ দিনে সারা দেশে ৪৭টি শিশু ধর্ষণ, ধর্ষণচেষ্টা ও যৌন হয়রানির শিকার হয়েছে। বিগত বছরগুলোতেও দেশে শিশু ধর্ষণ, হত্যা ও নির্যাতনের চিত্র ছিল ভয়াবহ। ওই বেসরকারি সংস্থা কর্তৃক সম্প্রতি প্রকাশিত প্রতিবেদনে জানা যায়, গত বছর ধর্ষণের শিকার হওয়ার মোট ৩৪৫টি সংবাদের মধ্যে শিশুর সংখ্যা ৩৫৬, যার মধ্যে মারা গেছে ২২ জন এবং আহত হয়েছে ৩৩৪ জন। প্রকাশিত ওই প্রতিবেদনে বলা হয়, শিশুরা প্রতিবেশী, উত্ত্যক্তকারী, বন্ধু, আত্মীয়-স্বজন, শিক্ষক বা অপরিচিত ব্যক্তির দ্বারা ধর্ষণের শিকার হয়েছে। আশ্চর্যের বিষয় হচ্ছে, দেশে প্রায় ৭০ শতাংশ শিশু তার প্রতিবেশী, আত্মীয়, বন্ধু ও তাদের শিক্ষক দ্বারা ধর্ষণ, হত্যা ও যৌন হয়রানির শিকার হচ্ছে। অন্য এক পরিসংখ্যানে দেখা গেছে, ২০১২ থেকে ২০১৬ সাল পর্যন্ত দেশে এক হাজার ৩০১ জন ধর্ষণের শিকার হয়েছে, যার মধ্যে শিশু, প্রতিবন্ধী, গৃহকর্মী ও স্কুলের ছাত্র-ছাত্রী রয়েছে। বাংলাদেশ শিশু অধিকার ফোরামের প্রদত্ত তথ্যানুযায়ী, ২০১২ সালের শুরু থেকে ২০১৫ সালের আগস্ট মাস পর্যন্ত দেশে সাড়ে ৯ শরও বেশি শিশু নির্যাতনের শিকার হয়ে প্রাণ হারিয়েছে।

চলতি বছর দেশে একের পর এক যেভাবে শিশু ধর্ষণ, হত্যা ও নির্যাতনের ঘটনা ঘটে চলেছে, তা বিগত বছরগুলোর পরিসংখ্যানকে ছাড়িয়ে যাবে বলে অনুমেয়। সমাজ থেকে দ্রুত এ অবস্থার ইতিবাচক পরিবর্তন না ঘটালে বিভিন্ন সভা-সেমিনার আর বক্তৃতায় ‘আজকের শিশুরাই আগামী দিনের ভবিষ্যৎ’, ‘আজকের শিশুরাই আগামীতে জাতির কর্ণধার’, ‘আজকের শিশুরাই আগামী দিনে দেশ-জাতির নেতৃত্ব দেবে’—এমন কথাবার্তা সত্যিকার অর্থে অপপ্রলাপে পরিণত হবে। শিশু ধর্ষণ, হত্যা ও নির্যাতন যেকোনো মূল্যে বন্ধ করা এখন জরুরি বিষয় হয়ে দাঁড়িয়েছে। শিশু ধর্ষণ ও হত্যার মতো জঘন্য ঘটনার সঙ্গে জড়িত অপরাধীরা অনেক সময় রাজনৈতিক ছত্রচ্ছায়ায় কিংবা পেশিশক্তির জোরে ছাড় পেয়ে যাচ্ছে এবং অনেক সময় অপরাধীরা ধরাছোঁয়ার বাইরেই থেকে যায়। এসব ঘটনার মধ্য দিয়ে একদিকে যেমন সামাজিক অবক্ষয়ের পরিচয় পাওয়া যায়, তেমনি অন্যদিকে তা সার্বিক সমাজব্যবস্থার ব্যর্থতার পরিচয় তুলে ধরে। শিশু হত্যা, শিশু নির্যাতন এবং শিশু অপহরণের সঙ্গে জড়িত ব্যক্তিদের বিরুদ্ধে উপযুক্ত ও দৃষ্টান্তমূলক ব্যবস্থা নিতে না পারলে ভবিষ্যতে পরিস্থিতি যে আরো ভয়াবহ হবে, তা আর বলার অপেক্ষা রাখে না।

নারী ও শিশু নির্যাতন দমন আইন ২০০০ (সংশোধিত ২০০৩)-এর ৯ ধারা মোতাবেক, ধর্ষণের ফলে কোনো নারী বা শিশুর মৃত্যু হলে ধর্ষণকারীর জন্য রয়েছে মৃত্যুদণ্ড বা যাবজ্জীবন সশ্রম কারাদণ্ড এবং এর অতিরিক্ত কমপক্ষে এক লাখ টাকা অর্থদণ্ড। একাধিক ব্যক্তি দলবদ্ধভাবে কোনো নারী বা শিশুকে ধর্ষণ করলে ধর্ষণকালে বা ধর্ষণের পর যদি তার মৃত্যু ঘটে, তবে ওই দলের সবার জন্যই এই শাস্তি প্রযোজ্য হবে। ধর্ষণের চেষ্টা করলে ধর্ষণচেষ্টাকারীর সর্বোচ্চ ১০ বছর ও সর্বনিম্ন পাঁচ বছরের সশ্রম কারাদণ্ড এবং এর অতিরিক্ত অর্থদণ্ডেরও বিধান রয়েছে। কোনো নারী বা শিশুকে ধর্ষণ করে মৃত্যু ঘটানো বা আহত করার চেষ্টা করলে ধর্ষণকারী যাবজ্জীবন সশ্রম কারাদণ্ডে দণ্ডিত হবে এবং এর অতিরিক্ত অর্থদণ্ডেও দণ্ডিত হবে। কিন্তু বাস্তবতা হচ্ছে, বর্তমান সমাজটা এখন এমন এক জায়গায় চলে গেছে, যেখানে শুধু বিচারব্যবস্থা কোনো কাজে আসবে না। পুরো বিষয়টি এক বড় গবেষণার বিষয়বস্তুতে পরিণত হয়েছে। শিশু ধর্ষণ, হত্যা ও নির্যাতন নিয়ে এখন দরকার সমাজতত্ত্ববিদ, মনোবিজ্ঞানীসহ বিশেষজ্ঞদের সুচিন্তিত গবেষণা, যা মানুষের অপরাধপ্রবণতার কারণগুলো উদ্ঘাটনপূর্বক প্রতিকারব্যবস্থার সুপারিশ করতে পারবে। পাশাপাশি আইন-শৃঙ্খলা রক্ষাকারী বাহিনীকে এ ধরনের অপরাধ রোধ করতে অবশ্যই সক্রিয় ভূমিকা পালন করতে হবে। সর্বোপরি যেহেতু এ ধরনের অপরাধ শুধু আইনের যথাযথ প্রয়োগ দ্বারা প্রতিরোধ করা সম্ভব হয় না, তাই সামাজিক ও পারিবারিকভাবেও এসব অপরাধ রোধকল্পে ব্যবস্থা গ্রহণ করা আবশ্যক। স্মরণ রাখা দরকার, শিশু ধর্ষণ বা নির্যাতন বা হত্যার বিষয়ে মামলা করে বিচার পাওয়ার চেয়ে সমাজে যেন এ ধরনের ঘটনা কোনোভাবেই না ঘটে সে ব্যবস্থা করা অধিকতর মঙ্গলজনক। কারণ Prevention is better than cure. আর এ অবস্থা থেকে চিরতরে মুক্তি পেতে হলে আমাদের দর্শন ও নৈতিকতার উন্নয়ন করতে হবে। মনের অশুভ চিন্তা বা দৃষ্টিভঙ্গির পরিবর্তন করতে হবে। বর্তমান বাস্তবতায় সমাজে ধর্ষণের বিরুদ্ধে সম্মিলিত কণ্ঠে প্রতিবাদ হওয়াটা খুবই জরুরি। ধর্ষকরা অনেক সময় শাস্তি পায় না বলেই পরবর্তীকালে তারা বীরদর্পে ধর্ষণ করে। আর তাদের দেখে অন্যরাও ধর্ষণ করতে উত্সাহিত হয়। এভাবে চলতে থাকলে দেশ, সমাজ ও জাতি কলুষিত হবে; দেশ পরিণত হবে মগের মুলুকে, যা কারো কাম্য নয়।
লেখক : সহযোগী অধ্যাপক, আইন বিভাগ ড্যাফোডিল ইন্টারন্যাশনাল ইউনিভার্সিটি
অ্যামনেস্টি ইন্টারন্যাশনালের আন্তর্জাতিক সদস্য
kekbabu@yahoo.com

Link: https://www.kalerkantho.com/print-edition/muktadhara/2019/10/18/828074

35
ভিন্নমত থাকলেই কি পিটিয়ে মারা যায়?
ড. কুদরাত-ই-খুদা বাবু
কালের কণ্ঠ, ১১ অক্টোবর, ২০১৯

বাংলাদেশ একটি গণতান্ত্রিক দেশ। ভিন্নমত প্রকাশ এবং বিরোধীদের অধিকার চর্চার পর্যাপ্ত ও নিরাপদ সুযোগ প্রদান এবং রাজনৈতিক সংলাপের মাধ্যমেই গণতন্ত্র পুরোপুরি বিকশিত হতে পারে। কিন্তু দুঃখজনক হলেও সত্য, এ দেশে কোনো সরকারের আমলেই জনগণ ভালোভাবে ভিন্নমত প্রকাশ করার সুযোগ পায়নি। পাশাপাশি বিরোধীদের অধিকার চর্চার পর্যাপ্ত ও নিরাপদ সুযোগও সুনিশ্চিত করা হয়নি, যা প্রকৃত গণতান্ত্রিক শাসন ব্যবস্থার বৈশিষ্ট্য নয়। এ দেশে ভিন্নমত প্রকাশকারীদের সব সরকারের আমলেই নানাভাবে নির্যাতিত-নিপীড়িত ও হয়রানির শিকার হতে হয়েছে এবং এখনো হতে হচ্ছে। শুধু তা-ই নয়, এ দেশে ভিন্নমত প্রকাশ করার কারণে অনেককে বিভিন্ন সরকারের আমলে হত্যারও শিকার হতে হয়েছে। আর এ ধরনের হত্যার সর্বশেষ ঘটনা ঘটল বাংলাদেশ প্রকৌশল বিশ্ববিদ্যালয়ের (বুয়েট) শিক্ষার্থী আবরার ফাহাদকে পিটিয়ে হত্যার ঘটনার মধ্য দিয়ে। গত ৬ অক্টোবর দিবাগত রাত ৩টার দিকে বুয়েটের শেরেবাংলা হলের একতলা থেকে দোতলায় ওঠার সিঁড়ির মধ্য থেকে আবরারের লাশ উদ্ধার করে পুলিশ। বিভিন্ন গণমাধ্যম মারফত জানা যায়, ওই রাতে বুয়েটের শেরেবাংলা হলের ২০১১ নম্বর কক্ষে আবরারকে পিটিয়ে মারা হয়। উদ্ধারকৃত ভিডিও ফুটেজ ও পারিপার্শ্বিক সব আলামতে এটি স্পষ্ট যে খুনটা করেছে বুয়েট ছাত্রলীগের কিছু নেতাকর্মী। এখন প্রশ্ন হচ্ছে, আবরারকে কেন নির্মমভাবে পিটিয়ে হত্যা করা হলো? তার ফেসবুক অ্যাকাউন্ট থেকে ভারত-বাংলাদেশের অসম সম্পর্ক নিয়ে কিছু প্রশ্ন তোলার কারণে? সরকারপন্থী দলের সমর্থক না হয়ে ভিন্ন দলের সমর্থক হওয়ার কারণে, নাকি ভিন্নমত প্রকাশ করার কারণে? এসব কারণে কি কাউকে হত্যা করার সুযোগ কোনো দেশের কোনো আইনে এবং কোনো দলের গঠনতন্ত্রে আছে? এসব কারণে ছাত্রলীগকে কি কাউকে পিটিয়ে মেরে ফেলার অধিকার দেওয়া হয়েছে ছাত্রলীগের গঠনতন্ত্রে?

প্রকাশিত সংবাদ বিশ্লেষণে দেখা গেছে, মহাজোটের সরকার ক্ষমতায় আসার আগে পর্যন্ত ছাত্রদল ও ছাত্রশিবির রাজশাহী বিশ্ববিদ্যালয়, কুষ্টিয়া ইসলামী বিশ্ববিদ্যালয়, ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়, বুয়েট, জাহাঙ্গীরনগর বিশ্ববিদ্যালয়, চট্টগ্রাম বিশ্ববিদ্যালয়সহ বিভিন্ন বিশ্ববিদ্যালয়ের ক্যাম্পাসে একক আধিপত্য, দখলদারি, চাঁদাবাজি, ত্রাস ও সন্ত্রাসের রাজত্ব কায়েম করেছে। আর মহাজোটের সরকার ক্ষমতায় আসার পরেও যে সেই অবস্থার পরিবর্তন ঘটেছে, তা নয়। বরং ক্ষমতাসীন দলের নেতাকর্মীরাও বিশ্ববিদ্যালয়গুলোতে আগের মতো ঠিক ওই একই ধরনের পরিস্থিতির সৃষ্টি করেছে। এ যেন মুদ্রার এপিঠ আর ওপিঠ। প্রতিটি রাজনৈতিক দলই নির্বাচনের আগে তাদের নির্বাচনী ইশতেহারে শিক্ষাঙ্গনগুলোকে সন্ত্রাসমুক্ত রাখার ঘোষণা দিলেও শেষ পর্যন্ত তা শূন্যের কোঠায় বিরাজ করে। স্বার্থকেন্দ্রিক রাজনীতি, ভিন্নমতকে সহ্য করতে না পারা আর রাজনৈতিক সংস্কৃতির অভাব—এসব অস্থিতরতার মূল কারণ। এক প্রতিবেদনে দেখা যায়, ২০০৯, ২০১০ ও ২০১১—এই তিন বছরে দেশের বিভিন্ন শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানে অভ্যন্তরীণ কোন্দল ও প্রতিপক্ষের সঙ্গে সংঘর্ষে প্রাণ হারিয়েছে ১৮ জন ছাত্র। অন্য এক পরিসংখ্যানে দেখা যায়, গত ৪৫ বছরে শুধু ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়, রাজশাহী বিশ্ববিদ্যালয়, চট্টগ্রাম বিশ্ববিদ্যালয় ও জাহাঙ্গীরনগর বিশ্ববিদ্যালয়ে ১৩২ জন শিক্ষার্থী হত্যাকাণ্ডের শিকার হয়েছে। কিন্তু দুঃখের বিষয়, রাজনৈতিক কারণে এখন পর্যন্ত বেশির ভাগ হত্যাকাণ্ডের বিচার হয়নি। রাজনৈতিক ক্ষমতার জোরে সন্ত্রাসী কর্মকাণ্ড করেও ‘ছাত্র’ নামধারী সন্ত্রাসীরা বারবার রেহাইও পেয়ে গেছে। দেশের উচ্চশিক্ষা প্রতিষ্ঠানগুলোতে ছাত্র হত্যা হলেও শেষ পর্যন্ত বেশির ভাগ ক্ষেত্রেই বিচার না হওয়া এবং বিশ্ববিদ্যালয়গুলোতে ধারাবাহিক এসব অস্থিরতা কিসের আলামত বহন করে? এসব অস্থিরতার মাধ্যমে দেশ-জাতিকে মেধা ও নেতৃত্বশূন্য করার সুদূরপ্রসারী পরিকল্পনার অংশ হিসেবে দেশি-বিদেশি কোনো অশুভ চক্র বা অশুভ কোনো শক্তির যোগসূত্রতা রয়েছে কি না, তা সরকারসহ সংশ্লিষ্ট সব মহলের ভালোভাবে খতিয়ে দেখা প্রয়োজন। বুয়েট শিক্ষার্থী আবরার ফাহাদকে পিটিয়ে হত্যার ব্যাপারে আওয়ামী লীগের সাধারণ সম্পাদক এবং সড়ক পরিবহন ও সেতু মন্ত্রী ওবায়দুল কাদের যথার্থই বলেছেন, ‘ভিন্নমত থাকলেই কাউকে পিটিয়ে মারা যায় না। যারাই অপরাধী, তাদের বিরুদ্ধে ব্যবস্থা নেওয়া হবে।’ আবরার ফাহাদের হত্যাকারীরা শেষ পর্যন্ত শাস্তি পাবে কি? অন্যান্য বিশ্ববিদ্যালয়ে ছাত্র হত্যার সঙ্গে জড়িত বেশির ভাগ যেভাবে ছাড় পেয়ে গেছে, ঠিক তেমনিভাবে আবরার ফাহাদের হত্যাকারীরাও শেষ পর্যন্ত ছাড় পেয়ে যায় কি না, সেটিই এখন দেখার বিষয়।

লেখক : সহযোগী অধ্যাপক, আইন বিভাগ, ড্যাফোডিল ইন্টারন্যাশনাল ইউনিভার্সিটি; অ্যামনেস্টি ইন্টারন্যাশনালের আন্তর্জাতিক সদস্য
kekbabu@yahoo.com

Link: https://www.kalerkantho.com/print-edition/muktadhara/2019/10/11/824990   

36
বন্যার্তদের পাশে দাঁড়ান
ড. কুদরাত-ই-খুদা বাবু
(দৈনিক যুগান্তর, ২১ জুলাই, ২০১৯; পৃ. ৫)

ইংরেজিতে একটি প্রবাদ আছে- ‘Prevention is better than cure’, অর্থাৎ প্রতিকারের চেয়ে প্রতিরোধ উত্তম। আমাদের দেশের জনগণকে প্রতিবছরই ‘ভাগ্যদেবীর আশীর্বাদস্বরূপ’ যেসব প্রাকৃতিক দুর্যোগের মুখোমুখি হয়ে নানা সমস্যায় জর্জরিত হতে হয়, বন্যা সেসবের অন্যতম। বিগত বছরগুলোর মতো চলতি বছরেও নাটোর, বগুড়া, নওগাঁ, ফরিদপুর, রাজবাড়ী, মানিকগঞ্জ, মুন্সীগঞ্জ, জামালপুর, কুড়িগ্রাম, গাইবান্ধা, নেত্রকোনা, সিলেট ও সুনামগঞ্জে বন্যা দেখা দিয়েছে। বৃষ্টিসহ বিভিন্ন নদ-নদীর পানি বৃদ্ধি পাওয়ায় এবারের বন্যা ব্যাপক রূপ নিয়েছে।

পানির ঢল, নদীভাঙন আর প্রবল বন্যায় গৃহহীন, সহায়-সম্বলহীন হয়ে পড়েছেন ওইসব এলাকার লাখ লাখ মানুষ। বন্যার কারণে মাথা গোঁজার ঠাঁই হারিয়ে রাস্তায়, স্কুল-কলেজে নির্ঘুম রাত পার করছেন অসহায় মানুষ। প্রতিমুহূর্তে তারা ভোগ করছেন অবর্ণনীয় কষ্ট। বিভিন্ন গণমাধ্যমে প্রকাশিত তথ্যানুযায়ী, বন্যাকবলিত এলাকাগুলোয় শত শত গ্রাম ও নিুাঞ্চল প্লাবিত হয়েছে। এর ফলে পানিবন্দি হয়ে পড়েছেন অসংখ্য মানুষ।

এসব এলাকার কাঁচা ঘরবাড়ি, রাস্তাঘাট, রোপা আমন ধানের বীজতলা, সবজি ক্ষেত, মৎস্য খামার ও পুকুরের মাছ বন্যার পানিতে ভেসে যাওয়ায় ব্যাপক ক্ষতির মুখে পড়েছেন ভুক্তভোগীরা। পাশাপাশি অনেক এলাকার স্কুল-কলেজ, হাটবাজার, রাস্তাঘাট বিনষ্ট হয়েছে, রেলপথসহ অনেক সড়কপথের যোগাযোগ বন্ধ হয়ে গেছে, বন্ধ ঘোষণা করা হয়েছে অনেক স্কুল-কলেজ। আমাদের সবারই উচিত, এসব বন্যার্ত মানুষের পাশে দাঁড়ানো।

দুর্যোগ ব্যবস্থাপনা ও ত্রাণ প্রতিমন্ত্রী ডা. মো. এনামুর রহমান অবশ্য বলেছেন, সরকারের ত্রাণভাণ্ডারে যথেষ্ট পরিমাণের ত্রাণসামগ্রী মজুদ রয়েছে, কোনো বন্যার্ত মানুষ সরকারি ত্রাণ পাওয়া থেকে বঞ্চিত হবে না, পর্যায়ক্রমে বন্যাকবলিত এলাকার সব মানুষই ত্রাণ পাবে। তবে বিদ্যমান পরিস্থিতিতে ক্ষতিগ্রস্ত বিপুলসংখ্যক মানুষকে প্রয়োজনীয় ত্রাণ, সাহায্য-সহযোগিতা ইত্যাদি সঠিকভাবে দেয়া হচ্ছে কি না, তা সরকারের পক্ষ থেকে সঠিকভাবে পর্যবেক্ষণ করা প্রয়োজন।

বিভিন্ন গণমাধ্যমে প্রকাশিত খবর অনুযায়ী, সরকারি-বেসরকারি পর্যায়ে বন্যার্ত মানুষকে সাহায্য-সহযোগিতা করার চেষ্টা করা হচ্ছে বটে; কিন্তু তা চাহিদার তুলনায় সামান্য। বন্যাকবলিত জেলাগুলোর যেসব শহর ও উপজেলা পর্যায়ে যাতায়াত করা সহজ সেসব এলাকায় কিছু ত্রাণ তৎপরতা থাকলেও অনেক স্থানে, বিশেষ করে যেসব জায়গায় দুর্গম চরাঞ্চল রয়েছে, সেখানে ত্রাণ নিয়ে তেমন কেউ যাচ্ছে না বলে গণমাধ্যমে খবর প্রকাশিত হয়েছে। উত্তরাঞ্চলে এমন অনেক চর রয়েছে, যেখানকার লোকজন স্বাভাবিক শুষ্ক মৌসুমেই অভাব-অনটনের মধ্য থাকে। তারা এখন কতটা ভয়াবহ অবস্থার মধ্যে পড়েছে, তা বলার অপেক্ষা রাখে না।

বন্যাকবলিত বিভিন্ন জেলার অনেক মানুষ এখন ডায়রিয়া, চর্মরোগসহ নানা রোগে আক্রান্ত। এবারের ভয়াবহ বন্যায় জনজীবন যেভাবে বিপর্যয়ের মুখে পড়েছে, যত টাকার সম্পদ বিনষ্ট হয়েছে, তা সাম্প্রতিক বছরগুলোতে ঘটেনি বলে জানা যায়। এ ক্ষেত্রে কয়েকটি উদাহরণ দিলে বিষয়গুলো পরিষ্কার হবে। যেমন- এবারের বন্যায় রংপুর বিভাগের ৮ জেলায় ৯০ হাজার মাছের পুকুর ও খামার পানিতে তলিয়ে যাওয়ায় শুধু মৎস্য খাতেই ৩০০ কোটি টাকার ক্ষতি হয়েছে বলে মৎস্য বিভাগ জানিয়েছে।

পানিতে তলিয়ে গেছে অনেক ফসলি জমি, রাস্তাঘাট। স্কুল-কলেজসহ ওইসব এলাকার অসংখ্য শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানে পাঠদান কার্যক্রম বন্ধ রাখতে বাধ্য হয়েছে সংশ্লিষ্ট কর্তৃপক্ষ। যোগাযোগ ব্যবস্থা বিছিন্ন হয়ে পড়েছে। বন্যাক্রান্ত জনগণকে সড়কে, নৌকায় ত্রাণের জন্য দীর্ঘ সময় অপেক্ষা করতে দেখা যাচ্ছে, যা চরম মানবিক বিপর্যয়েরই চিত্র বটে। বন্যার প্রভাবে কিছু কিছু এলাকার চিত্র এমন দাঁড়িয়েছে যে, কিছুদিন আগেও যেখানে লোকালয় ছিল, আজ সেখানে লোকালয় বলে কিছু নেই।

বন্যায় বসতবাড়ি ডুবে যাওয়ার কারণে অনেক মানুষ আশ্রয় নিয়েছেন বাঁধ বা উঁচু স্থানে। আবার অনেকেই বাধ্য হয়ে মাচা আর নৌকায় পেতেছেন সংসার। রাতে অনেকেই ঠিকমতো ঘুমাতে পারছেন না। এ পরিস্থিতিতে ঠিকমতো ঘুমানো সম্ভবও নয়। পানিবন্দি এসব মানুষের দিন কাটছে অনেকটাই অর্ধাহারে-অনাহারে। খাবার না থাকায় অনেকে গবাদি পশু বিক্রি করে দিয়েছেন। বন্যার কারণে গরু-ছাগলসহ অনেক গবাদি পশুর অবর্ণনীয় দুর্গতি, অনেক গবাদি পশুর করুণ মৃত্যুর পর পানির স্রোতে ভেসে যাওয়ার দৃশ্যগুলোও আমাদের বিবেককে নাড়া দিয়ে যাচ্ছে। তবে দুঃখের বিষয়, বন্যার্তরা ত্রাণ বা সহায়তা খুব একটা পাননি বলে এসব মানুষকে গণমাধ্যম কর্মীদের সামনে অভিযোগ করতে দেখা গেছে।

এবারের বন্যাকবলিত জেলাগুলোর অধিকাংশ স্থানের নলকূপ ডুবে যাওয়ায় খাবার পানিরও তীব্র সংকট দেখা দিয়েছে। পাশাপাশি চারদিকে ছড়িয়ে পড়ছে পানিবাহিত নানা রোগব্যাধি। বন্যাকবলিত এলাকাগুলোয় বন্যা ও বন্যা-পরবর্তী সময়ে নানা ধরনের রোগবালাই দেখা দেয়াই স্বাভাবিক। এর মধ্যে পানিবাহিত রোগের প্রভাবই বেশি দেখা যায়। বন্যার সময় ময়লা-আবর্জনা, মানুষ ও পশু-পাখির মলমূত্র এবং পয়ঃনিষ্কাশন ব্যবস্থা একত্রিত হয়ে এসব উৎস থেকে জীবাণু বন্যার পানিতে মিশে যায় এবং তা চারদিকে ছড়িয়ে পড়ে। এভাবে বন্যায় সংক্রামক ব্যাধির বিস্তার ঘটে।

বন্যা ও বন্যা-পরবর্তী সময়ে মানুষের ক্ষেত্রে জ্বর-সর্দি, ডায়রিয়া, কলেরা, রক্ত আমাশয়, টাইফয়েড, প্যারাটাইফয়েড, ভাইরাল হেপাটাইটিস, পেটের পীড়া, কৃমির সংক্রমণ, চর্মরোগ, চোখের অসুখ ইত্যাদি সমস্যা মহামারী আকার ধারণ করে। বন্যাক্রান্ত মানুষ যেন পানিবাহিত রোগ থেকে সহজেই রক্ষা পেতে পারেন সে জন্য বিভিন্ন সরকারি-বেসকারি ও ব্যক্তি উদ্যোগে সুপেয় পানির ব্যবস্থা করা জরুরি। আর এসব মানুষ যেন নিত্যপ্রয়োজনীয় সব কাজেই নিরাপদ পানি ব্যবহার করে, তা তাদের জানানো দরকার।

এর পাশাপাশি এটাও জানাতে হবে যে, বন্যার্তরা যেন বন্যার পানি বা বন্যায় তলিয়ে যাওয়া নলকূপ, কুয়া বা অন্য কোনো উৎসের পানি দিয়ে হাত-মুখ ধোয়া, কুলি করা ও পান করা থেকে বিরত থাকে। বন্যার পানিতে গোসল করা, কাপড় ধোয়া, থালাবাসন পরিষ্কার করা ইত্যাদি যতটা সম্ভব এড়িয়ে চলতে হবে। বন্যার পানি ফুটিয়ে পান করার ব্যাপারে বন্যাক্রান্তদের আগ্রহী করে তুলতে হবে। পানি ফোটানোর জন্য জ্বালানির সংকট থাকলে বা ফোটানো সম্ভব না হলে ক্লোরিনের মাধ্যমে পানি বিশুদ্ধ করার ব্যবস্থা করতে হবে।

প্রশ্ন হচ্ছে, প্রতিবছর দেশে বন্যা হলেও বন্যা মোকাবেলায় আমাদের প্রস্তুতি থাকে কতটুকু? যতটুকু প্রস্তুতি থাকে, তা কি বন্যা মোকাবেলার জন্য যথেষ্ট? কেন বন্যা প্রতিরোধে উপযুক্ত ও কার্যকর পদক্ষেপ গ্রহণ করা হয় না? এ ক্ষেত্রে সমস্যা কোথায়? সরকারের পক্ষ থেকে যদিও প্রতিবছরই বন্যার সময় বলা হয়, পর্যাপ্ত ত্রাণ মজুদ রয়েছে; বন্যাক্রান্ত এলাকায় ত্রাণের অভাব নেই ইত্যাদি; তবে এক হিসাবে দেখা গেছে, প্রতিবছর যে সংখ্যক মানুষ বন্যার শিকার হন তাদের জন্য পর্যাপ্ত আশ্রয় কেন্দ্র বন্যাকবলিত জেলাগুলোতে নেই।

ফলে অনেক বন্যার্ত মানুষ এক ধরনের বাধ্য হয়েই খোলা আকাশের নিচে বা মাচা পেতে দিনাতিপাত করেন। এসব মানুষকে শুধু খাদ্য দেয়াই যথেষ্ট নয়, বিশুদ্ধ খাওয়ার পানি, শিশুখাদ্য, ওরস্যালাইনসহ জরুরি ওষুধপথ্য দেয়ারও প্রয়োজন আছে। পাশাপাশি সরকারি ত্রাণসামগ্রী সুষ্ঠুভাবে বিতরণ করাও জরুরি। বেসরকারি উদ্যোগে বিভিন্ন রাজনৈতিক দল, সামাজিক-সাংস্কৃতিক ও স্বেচ্ছাসেবী বিভিন্ন সংগঠনের পক্ষ থেকে বন্যার্তদের পাশে দাঁড়ানোর যে সংস্কৃতি দেশে বিদ্যমান, তা আরও শক্তিশালী ও কার্যকর করা প্রয়োজন। বন্যাদুর্গত মানুষের প্রতি সাহায্য-সহযোগিতার হাত বাড়িয়ে দেয়া সবার নৈতিক দায়িত্ব। কারণ ‘মানুষ মানুষের জন্য, জীবন জীবনের জন্য’।

প্রাকৃতিক দুর্যোগ ঠেকানো সম্ভব নয়। তবে আগাম কিছু ব্যবস্থা নিয়ে দুর্যোগের ক্ষয়ক্ষতি ও দুর্ভোগ কমিয়ে আনা সম্ভব। আগামী দিনগুলোতে সরকারের পক্ষ থেকে বন্যাক্রান্ত স্থানগুলো চিহ্নিত করে সঠিক উপায়ে বাঁধ ও বেড়িবাঁধ নির্মাণ করা প্রয়োজন। নদীতীরবর্তী এলাকাগুলোয় জিওটিউব (বালির বড় বড় বস্তা) ফেলার ব্যবস্থা, নদীর নাব্যতা বৃদ্ধির ব্যবস্থাসহ এমন সব কার্যকর পদক্ষেপ গ্রহণ করা প্রয়োজন যেন সহজেই বন্যা মোকাবেলা করা যায়। এ সবকিছু সঠিকভাবে সম্পাদন করা হলে জনগণকে আর বন্যার কারণে চরম মানবিক বিপর্যয়ের মুখোমুখি হতে হবে না।
ড. কুদরাত-ই-খুদা বাবু : সহযোগী অধ্যাপক, আইন বিভাগ, ড্যাফোডিল ইন্টারন্যাশনাল ইউনিভার্সিটি; অ্যামনেস্টি, ইন্টারন্যাশনালের সদস্য
kekbabu@yahoo.com

37
ডেঙ্গু প্রতিরোধে আমাদের সচেতনতা ও প্রস্তুতি (কালের কণ্ঠ, তারিখ: ১৮ জুলাই, ২০১৯)
ড. কুদরাত-ই-খুদা বাবু

বিগত কয়েক বছরের তুলনায় এ বছর রাজধানী ঢাকাসহ সারা দেশে ডেঙ্গুতে আক্রান্তের সংখ্যা বেশি হিসাবে দেখা দিয়েছে। বর্তমানে ডেঙ্গু পরিস্থিতি উদ্বেগজনক। গণমাধ্যমে প্রকাশিত প্রতিবেদন অনুযায়ী এ বছরের এপ্রিল মাস থেকে চলতি জুলাইয়ের মাঝামাঝি সময় পর্যন্ত ডেঙ্গুতে আক্রান্ত হয়ে একজন চিকিৎসকসহ ১১ জনের মারা যাওয়ার খবর পাওয়া গেছে। গত বছর একই সময়ে দেশে ডেঙ্গুতে আক্রান্ত হয়ে মৃত্যু হয়েছিল সাতজনের।

শুধু ঢাকা শহর কিংবা বাংলাদেশ নয়, দক্ষিণ ও দক্ষিণ-পূর্ব এশিয়ায় ডেঙ্গুর প্রাদুর্ভাব আশঙ্কাজনক হারে বাড়ছে। গণমাধ্যমে প্রকাশ, বাংলাদেশের আশপাশের শ্রীলঙ্কা, ফিলিপাইন, সিঙ্গাপুর, মালয়েশিয়া ও ভারতে ডেঙ্গু পরিস্থিতি ভয়াবহ আকার ধারণ করেছে। ডেঙ্গুর ঘটনা ১৯৬০ সালের পর থেকে উল্লেখযোগ্যভাবে বৃদ্ধি পেয়েছে। এক পরিসংখ্যানে দেখা গেছে, প্রতিবছর বিশ্বে প্রায় ৫০ থেকে ১০০ মিলিয়ন লোক ডেঙ্গুতে আক্রান্ত হয়। বর্তমান বিশ্বে সবচেয়ে দ্রুত প্রসারমাণ রোগ ডেঙ্গু নিয়ে তাই আমাদের বিশেষ সতর্কতামূলক ও প্রতিরোধমূলক ব্যবস্থা গ্রহণের প্রয়োজন ছিল অনেক আগে থেকেই। কিন্তু বাস্তবতা হচ্ছে, তা সেভাবে হয়নি। বিশেষজ্ঞদের মতে, দীর্ঘমেয়াদি বর্ষা, তাপমাত্রা ও আর্দ্রতা বৃদ্ধি বিভিন্ন প্রজাতির এডিস মশার প্রজনন ও বিস্তারে সহায়ক। যে বছর বেশি বৃষ্টিপাত হয়, সেই বছর এডিস মশার ঘনত্ব বাড়ে। ফলে ডেঙ্গুর প্রকোপও স্বাভাবিকভাবে বাড়ে। বৃষ্টির স্থায়িত্ব যত বাড়বে ডেঙ্গুর বিস্তারও তত বাড়বে। যেহেতু এ বছর বাংলাদেশে মৌসুমি বায়ুর প্রভাবে বর্ষা দীর্ঘস্থায়ী হতে চলেছে, তাই সারা দেশে ডেঙ্গুর বিস্তারও আশঙ্কাজনক হারে বাড়ছে। ইংরেজিতে একটি প্রবাদ আছে, ‘Prevention is better than cure.’ প্রতিকারের চেয়ে প্রতিরোধ উত্তম। ডেঙ্গু প্রতিরোধকল্পেও সংশ্লিষ্ট কর্তৃপক্ষসহ আমাদের সবাইকে সচেতন হতে হবে। প্রতিবছর বর্ষার শুরুতেই আমাদের দেশে মশা তথা ডেঙ্গু প্রতিরোধে বিশেষ উদ্যোগ নেওয়া প্রয়োজন, যেন তা মহামারি আকারে ছড়িয়ে না পড়ে। যেহেতু এ রোগের জন্য নির্দিষ্ট কোনো ভ্যাকসিন নেই, তাই মশার সংখ্যা বৃদ্ধির অনুকূল পরিবেশ ও মশার সংখ্যা বৃদ্ধি হ্রাস করার ব্যবস্থা করা এবং মশার কামড়ের আশঙ্কা কমানোর মাধ্যমে এর প্রতিরোধ করা প্রয়োজন। বিশ্ব স্বাস্থ্য সংস্থা (WHO) এ বিষয়ে প্রচার, সামাজিক সক্রিয়তা এবং জনস্বাস্থ্য সংগঠন, স্বাস্থ্য ও অন্যান্য বিভাগের মধ্যে সহযোগিতা (সরকারি ও বেসরকারি) বাড়ানোসহ পাঁচটি মৌলিক দিকনির্দেশনা দিয়েছে।

এখন প্রশ্ন হচ্ছে, যেহেতু প্রতিবছরই বর্ষার সময় দেশে ডেঙ্গুর প্রাদুর্ভাব ঘটে থাকে এবং অনেক লোক মারা যায়, তাই ডেঙ্গু প্রতিরোধে আমাদের আগাম প্রস্তুতি, সচেতনতা ও কার্যকারিতা থাকে কতটুকু? সংবাদপত্রে প্রকাশিত প্রতিবেদন থেকে জানা যায়, মশা মারতে ঢাকার দুই সিটি করপোরেশন যে ওষুধ ব্যবহার করে, তা অকার্যকর হয়ে পড়েছে। আন্তর্জাতিক উদরাময় গবেষণা কেন্দ্র, বাংলাদেশ (আইসিডিডিআরবি) ও সরকারের স্বাস্থ্য অধিদপ্তরের রোগ নিয়ন্ত্রণ কেন্দ্র (সিডিসি) পৃথক দুটি গবেষণায় দেখেছে, এই ওষুধে মশা মরছে না। বর্ষা মৌসুমে ডেঙ্গু ও চিকুনগুনিয়ায় নিয়মিত জনস্বাস্থ্য ঝুঁকিপূর্ণ হয়ে উঠেছে। ঢাকা শহরের নাগরিকরা সাধারণত মশা নিধনের ওপর বিশেষ গুরুত্ব দেয়। জনগণ ও নগরবাসী চায়, সরকার নিয়মিতভাবে সব ধরনের মশা নিধনে কার্যকর ওষুধ ছিটাক। কিন্তু গবেষণার ফলাফলের মাধ্যমে জনগণ জানতে পেরেছে, মশা নিধনে সিটি করপোরেশন যে ওষুধ ছিটায়, তা অকার্যকর। আর এ বিষয়টি নাগরিকদের মধ্যে নতুন উদ্বেগ সৃষ্টি করেছে এবং অনেকেই এ বিষয়ে ক্ষুব্ধ প্রতিক্রিয়াও ব্যক্ত করেছে। ঢাকা দক্ষিণ সিটি করপোরেশনের মেয়র গণমাধ্যমকে বলেছেন, ডেঙ্গু মোকাবেলায় সিটি করপোরেশনের পক্ষ থেকে সর্বোচ্চ চেষ্টা করা হচ্ছে। মশক নিধন শুরু হয়েছে, পাশাপাশি ভ্রাম্যমাণ মেডিক্যাল টিমের কাজ শুরু হচ্ছে। নগরবাসীকে বিনা মূল্যে ওষুধ সরবরাহ করা হবে।

তবে সবচেয়ে বড়া কথা হচ্ছে, সিটি করপোরেশনের পাশাপাশি ডেঙ্গু প্রতিরোধে তথা মশা নিধনে প্রত্যেক মানুষ ও নগরবাসীর সচেতন হওয়ার কোনোই বিকল্প নেই। প্রত্যেকের বাড়ির আশপাশের ঝোপঝাড়, নালা-নর্দমা, ময়লা-আবর্জনা নিয়মিতভাবে পরিষ্কার-পরিচ্ছন্ন রাখা এবং এডিস মশার বংশবৃদ্ধির উপযুক্ত স্থান (যেমন—কোনো পাত্রে জমে থাকা পানি ইত্যদি) নিয়মিত পরিষ্কার রাখতে হবে। এসবের পাশাপাশি সিটি করপোরেশন ও সংশ্লিষ্ট কর্তৃপক্ষের পক্ষ থেকে সবখানে মশা নিধন ও পরিচ্ছন্নতা কার্যক্রম জোরদার করা প্রয়োজন। বিশেষ করে, ঢাকার দুই সিটি করপোরেশনের মেয়রদ্বয় এডিস মশা তথা সব ধরনের মশা নিধন এবং মশার বংশবিস্তার রোধে নিয়মিত জোরদার ও কার্যকর অভিযান পরিচালনা করবেন—এ প্রত্যাশা নগরবাসীর। সিটি করপোরেশন এলাকার বাইরেও স্থানীয় প্রশাসন ও দায়িত্বপ্রাপ্ত সরকারি প্রতিষ্ঠানগুলোকে এ কাজে দ্রুত তৎপর হওয়া দরকার। এ ছাড়া ডেঙ্গু প্রতিরোধে জনসচেতনতা তৈরি, ডেঙ্গুর প্রাথমিক লক্ষণগুলো সম্পর্কে মানুষকে অবগত করানো, ডেঙ্গুতে আক্রান্ত হলে করণীয় সম্পর্কে প্রচার-প্রচারণা ব্যাপকভাবে জোরদার করা প্রয়োজন। রাজধানী ও জেলা সদরের সরকারি হাসপাতালগুলোতে ডেঙ্গু শনাক্তকরণ ও চিকিৎসায় বিশেষ ব্যবস্থা রাখার কথাও বিবেচনা করা দরকার। দেশের জনগণের স্বার্থেই ডেঙ্গু প্রতিরোধ ও নিয়ন্ত্রণে দ্রুত কার্যকর পদক্ষেপ গ্রহণ ও তা বাস্তবায়নের কোনো বিকল্প নেই।

লেখক : সহযোগী অধ্যাপক, আইন বিভাগ, ড্যাফোডিল ইন্টারন্যাশনাল ইউনিভার্সিটি; আন্তর্জাতিক মানবাধিকার সংগঠন অ্যামনেস্টি ইন্টারন্যাশনালের আন্তর্জাতিক সদস্য
kekbabu@yahoo.com

38
শিশু ধর্ষণ, হত্যা ও নির্যাতনের শেষ কোথায়
ড. কুদরাত-ই-খুদা বাবু
১০ জুলাই, ২০১৯

সারা দেশে আশঙ্কাজনক হারে বেড়ে চলছে শিশু ধর্ষণ, ধর্ষণ পরবর্তী হত্যা ও নির্যাতন। দেশব্যাপী শিশু ধর্ষণ, হত্যা ও নির্যাতন বেড়ে যাওয়ার ঘটনায় সচেতন দেশবাসী ও অভিভাবক মহল আজ রীতিমতো উদ্বিগ্ন হয়ে পড়েছে। স্কুল, মাদরাসা, কলেজ, বিশ্ববিদ্যালয়, বাসে-লঞ্চে, পথে-ঘাটে, মাঠে কোথাও আজ যেন শিশুরা নিরাপদ নয়। এ অবস্থা নিঃসন্দেহে একটি জাতির জন্য অত্যন্ত লজ্জাজনক এবং তা ওই জাতির জন্য এক অশনি সংকেতই বটে। আশঙ্কাজনক হারে শিশু ধর্ষণ, নির্যাতন ও হত্যার ঘটনাগুলো বিশ্বদরবারে বাংলাদেশের ভাবমূর্তি ক্ষুণ্ন করছে। বলা বাহুল্য, কোনো সমাজে ধর্ষণ বিস্তৃত হলে এবং ধর্ষকদের কঠোর সাজার ব্যবস্থা করা না হলে সেই সমাজে নীতি-নৈতিকতা ও মূল্যবোধ বলে কিছুই থাকে না। এ ধরনের ঘটনা পুরো সমাজ, দেশ ও জাতিকে বিশৃঙ্খলা ও অপরাধের দিকে ধাবিত করে, যা কখনোই ভালো কোনো বিষয় হতে পারে না। এমতাবস্থায় শিশু ধর্ষণ, নির্যাতন ও হত্যা বন্ধে দ্রুত কার্যকর পদক্ষেপ গ্রহণ না করলে ভবিষ্যতে এ অবস্থা আরো ভয়ানক পর্যায়ে গিয়ে ঠেকবে।

আজকাল পত্রিকা পড়লে কিংবা টেলিভিশনের সংবাদের দিকে দৃষ্টিপাত করলেই চোখে পড়ে শিশু ধর্ষণ, ধর্ষণ-পরবর্তী হত্যা এবং শিশু নির্যাতনসংক্রান্ত খবর। এসংক্রান্ত খবর পড়তে পড়তে ও দেখতে দেখতে দেশের মানুষের মন বিষিয়ে উঠেছে। মানুষের জন্য ফাউন্ডেশন সংস্থার তথ্যানুযায়ী, চলতি বছরের (২০১৯) এপ্রিল মাসের প্রথম ১৫ দিনে সারা দেশে ৪৭টি শিশু ধর্ষণ, ধর্ষণচেষ্টা ও যৌন হয়রানির শিকার হয়েছে। পত্রিকায় প্রকাশিত এক প্রতিবেদনে জানা যায়, দেশে প্রতিবছর এক হাজারেরও বেশি নারী ও শিশু ধর্ষণের শিকার হচ্ছে। শুধু চলতি বছরেই নয়, বিগত বছরগুলোয়ও দেশে শিশু ধর্ষণ, হত্যা ও নির্যাতনের চিত্র ছিল ভয়াবহ। ‘মানুষের জন্য ফাউন্ডেশন’ নামের ওই বেসরকারি সংস্থা কর্তৃক সম্প্রতি প্রকাশিত রিপোর্টে জানা যায়, গত বছর (২০১৮) ধর্ষণের শিকার হওয়ার মোট ৩৪৫টি সংবাদের মধ্যে শিশুর সংখ্যা ৩৫৬, যার মধ্যে মারা গেছে ২২ জন এবং আহত হয়েছে ৩৩৪ জন। প্রকাশিত ওই রিপোর্টে বলা হয়, শিশুরা প্রতিবেশী, উত্ত্যক্তকারী, বন্ধু, আত্মীয়-স্বজন, শিক্ষক বা অপরিচিত ব্যক্তির দ্বারা ধর্ষণের শিকার হয়েছে। প্রকাশিত রিপোর্টে দেখা যায়, গত বছর ধর্ষণ ছাড়া আরো ৭৭টি শিশু যৌন নির্যাতনের শিকার হয়েছে এবং এর মধ্যে মারা গেছে একজন। ওই রিপোর্টে বলা হয়, ২০১৮ সালে বাংলাদেশে মোট ২৭৬টি শিশু হত্যা ও হত্যাচেষ্টার শিকার হয়েছে। এর মধ্যে মারা গেছে ২২৭ জন। এ পরিসংখ্যান থেকে এটা স্পষ্টতই দেখা যাচ্ছে যে আমরা যেন কোনোভাবেই শিশু ধর্ষণের লাগাম টেনে ধরতে পারছি না। আশ্চর্যের বিষয় হচ্ছে, দেশে প্রায় ৭০ শতাংশ শিশু তার প্রতিবেশী, আত্মীয়, বন্ধু বা তাদের শিক্ষক দ্বারা ধর্ষণ, হত্যা ও যৌন হয়রানির শিকার হচ্ছে। অন্য এক পরিসংখ্যানে দেখা গেছে, ২০১২ থেকে ২০১৬ পর্যন্ত দেশে এক হাজার ৩০১ শিশু ধর্ষণের শিকার হয়েছে; যার মধ্যে প্রতিবন্ধী, গৃহকর্মী ও স্কুলের ছাত্র-ছাত্রী রয়েছে। বাংলাদেশ শিশু অধিকার ফোরামের প্রদত্ত তথ্যানুযায়ী, ২০১২ সালের শুরু থেকে ২০১৫ সালের আগস্ট পর্যন্ত এ দেশে সাড়ে ৯ শরও বেশি শিশু নির্যাতনের শিকার হয়ে প্রাণ হারিয়েছে। প্রতিনিয়ত এই ঘৃণ্য অপরাধের মাত্রা বাড়ছে। দেশে প্রতিনিয়ত শিশু হত্যা, শিশু নির্যাতন এবং শিশু অপহরণের মতো বেদনাদায়ক ও জঘন্য ঘটনা ঘটলেও যেন কারো টনক নড়ছে না। পাশাপাশি এসব ঘটনার সঙ্গে জড়িত অপরাধীরা রাজনৈতিক ছত্রচ্ছায়া কিংবা পেশিশক্তির জোরে অনেক সময় পার পেয়ে যাচ্ছে। আবার অনেক সময় দেখা যায় যে অপরাধীরা ধরাছোঁয়ার বাইরেই থেকে যাচ্ছে। এসব ঘটনার মধ্য দিয়ে একদিকে যেমন সামাজিক অবক্ষয়ের পরিচয় পাওয়া যায়, অন্যদিকে তা সার্বিক সমাজব্যবস্থার ব্যর্থতার পরিচয়ই তুলে ধরে। শিশু হত্যা, শিশু নির্যাতন ও শিশু অপহরণের সঙ্গে জড়িত ব্যক্তিদের বিরুদ্ধে উপযুক্ত ও দৃষ্টান্তমূলক ব্যবস্থা নিতে না পারলে ভবিষ্যতে পরিস্থিতি যে আরো ভয়াবহ হবে তা আর বলার অপেক্ষা রাখে না।   

ধর্ষণের কারণগুলো বিশ্লেষণ করলে দেখা যায় : ১. ধর্ষণকারীদের মধ্যে বিন্দুমাত্র অপরাধবোধ না থাকার কারণে নির্দ্বিধায় ধর্ষণ করতে উদ্যোগী হচ্ছে। ২. যে সমাজে আইনের শাসন নেই কিংবা থাকলেও তা দুর্বল বা ভঙ্গুর, সেই সমাজের লোকরা ধর্ষণ উপযোগী পরিবেশ পায় এবং ধর্ষণ করে। সুতরাং সামাজিক প্রতিরোধ ও আইনের শাসনের অভাব ধর্ষণের জন্য দায়ী। ৩. পর্নোগ্রাফি, যা দেখে অনেক পুরুষ ধর্ষণে উৎসাহ বোধ করে। ৪. মেয়েদের ওপর আধিপত্য বিস্তার ও ভয়ভীতি দেখিয়ে নিয়ন্ত্রণ করার মানসিকতাও ধর্ষণের অন্যতম কারণ। ৫. ক্ষমতাশালী ব্যক্তি সুযোগ পেয়ে কোনো দুর্বল মেয়ে, শিশু বা ছেলের ওপর ক্ষমতার প্রয়োগ ঘটায় ধর্ষণের মাধ্যমে। ৬. অনেক সময় বন্ধুবান্ধব একসঙ্গে হয়ে আকস্মিকভাবে কোনো অসহায় মেয়েকে একা পেয়ে আনন্দ-ফুর্তি করার জন্যও ধর্ষণ করে। এ ছাড়া বর্তমানে ইন্টারনেটসহ নানা ধরনের তথ্য-প্রযুক্তির অবাধ ব্যবহার বৃদ্ধি পাওয়াসহ পারিপার্শ্বিক আরো অনেক কারণে ধর্ষণ হতে পারে। তবে যেভাবেই ধর্ষণ, হত্যা ও নির্যাতন হোক না কেন, তা গুরুতর ফৌজদারি অপরাধ। নারী ও শিশু নির্যাতন দমন আইন ২০০০ (সংশোধিত ২০০৩)-এর ৯ ধারা মোতাবেক ধর্ষণের অপরাধে যেসব শাস্তির বিধান রয়েছে তা হচ্ছে—ধর্ষণের ফলে কোনো নারী বা শিশুর মৃত্যু হলে ধর্ষণকারীর জন্য রয়েছে মৃত্যুদণ্ড বা যাবজ্জীবন সশ্রম কারাদণ্ড এবং এর অতিরিক্ত কমপক্ষে এক লাখ টাকা অর্থদণ্ড। একাধিক ব্যক্তি দলবদ্ধভাবে কোনো নারী বা শিশুকে ধর্ষণ করলে ধর্ষণকালে বা ধর্ষণের পর যদি তার মৃত্যু ঘটে, তবে ওই দলের সবার জন্যই এই শাস্তি প্রযোজ্য হবে। ধর্ষণের চেষ্টা করলে ধর্ষণকারীর সর্বোচ্চ ১০ বছর ও সর্বনিম্ন পাঁচ বছরের সশ্রম কারাদণ্ড এবং এর অতিরিক্ত অর্থদণ্ডেরও বিধান রয়েছে। কোনো নারী বা শিশুকে ধর্ষণ করে মৃত্যু ঘটানো বা আহত করার চেষ্টা করলে ধর্ষণকারী যাবজ্জীবন সশ্রম কারাদণ্ডে দণ্ডিত হবে এবং এর অতিরিক্ত অর্থদণ্ডেও দণ্ডিত হবে। তবে শিশু ধর্ষণ বা নির্যাতন বা হত্যা বিষয়ে মামলা করে বিচার পাওয়ার চেয়ে সমাজে যেন এ ধরনের ঘটনা কোনোভাবেই না ঘটে সে ব্যবস্থা নেওয়া অধিকতর মঙ্গলজনক। কারণ Prevention is better than cure। ধর্ষণের হাত থেকে পরিত্রাণ পেতে হলে আমাদের দর্শন ও নৈতিকতার উন্নয়ন করতে হবে, আমাদের মনের অশুভ চিন্তা বা দৃষ্টিভঙ্গির পরিবর্তন করতে হবে। বর্তমান বাস্তবতায় সমাজে ধর্ষণের বিরুদ্ধে সম্মিলিত কণ্ঠে প্রতিবাদ হওয়াটা খুবই জরুরি। ধর্ষকরা অনেক সময় শাস্তি পায় না বলেই পরবর্তী সময়ে তারা আবারও একই কাজ করে। আর তাদের দেখে অন্যরাও উৎসাহিত হয়। এভাবে চলতে থাকলে এ সমাজ, দেশ ও জাতি কলুষিত হবে। দেশ পরিণত হবে মগের মুলুকে। তাই ধর্ষণ রোধে প্রতিটি পরিবার থেকে প্রতিটি শিশুকে ছোটবেলা থেকেই নৈতিক শিক্ষা প্রদান করা প্রয়োজন, যেন বড় হয়ে সে কোনোভাবেই এ পথে পা না বাড়ায়। পরিবারই শিশুর আচরণ, মূল্যবোধ, নৈতিকতা ইত্যাদির ভিত্তি তৈরি করে দেয়। সর্বোপরি ধর্ষণ প্রতিরোধে সরকারসহ বিভিন্ন সরকারি-বেসরকারি প্রতিষ্ঠান, গণমাধ্যম, সুধীসমাজসহ সবার একযোগে এগিয়ে আসা প্রয়োজন। প্রয়োজন ধর্ষণকে যেকোনো মূল্যে প্রতিহত করা। এ দেশ ও জাতির উন্নয়ন, অগ্রগতি ঘটানোসহ সামাজিক শান্তি-শৃঙ্খলা বজায় রাখার স্বার্থে এবং একটি সুখী, সুন্দর ও সাফল্যময় দেশ গঠনে ধর্ষণকে কঠোর হস্তে দমন করা এখন অপরিহার্য বিষয় হয়ে পড়েছে।
লেখক : সহযোগী অধ্যাপক, আইন বিভাগ ড্যাফোডিল ইন্টারন্যাশনাল ইউনিভার্সিটি, অ্যামনেস্টি ইন্টারন্যাশনালের আন্তর্জাতিক সদস্য
kekbabu@yahoo.com

Link: https://www.kalerkantho.com/print-edition/muktadhara/2019/07/10/789396

39
এ দেশে এত বেশি সড়ক দুর্ঘটনা কেন
  ড. কুদরাত-ই-খুদা বাবু
 ০২ জুলাই ২০১৯, (যুগান্তর, ২জুলাই, পাতা ৫)

এ দেশে ঈদের সময়ও থামে না সড়ক দুর্ঘটনা, থেমে থাকে না মৃত্যু। সদ্য বিদায়ী ঈদুল ফিতরের ছুটিতে সারা দেশে সড়ক দুর্ঘটনায় কমপক্ষে ১৪২ জন নিহত ও ৩২৪ জন আহত হয়েছেন। গত ১০ জুন নৌ, সড়ক ও রেলপথ রক্ষা জাতীয় কমিটির এক পর্যবেক্ষণ প্রতিবেদনে এসব তথ্য দেয়া হয়েছে। বলা বাহুল্য, এ দেশে সড়ক দুর্ঘটনা নতুন কোনো বিষয় নয়। পত্রিকার পাতা খুললে কিংবা টিভি চ্যানেলের সংবাদের দিকে চোখ রাখলে প্রায় প্রতিদিনই চোখে পড়ে সড়ক দুর্ঘটনায় আহত ও নিহত হওয়ার খবরাখবর।

দেশে প্রতিনিয়ত মর্মান্তিক সড়ক দুর্ঘটনা ঘটে চললেও এখন পর্যন্ত সড়ক দুর্ঘটনা রোধে কার্যকর তেমন কোনো পদক্ষেপ গ্রহণ করা হয়নি বললেই চলে। ফলে প্রায় প্রতিনিয়তই ঘটে চলছে সড়ক দুর্ঘটনা; ঘটে চলছে হতাহতের ঘটনা।

এক হিসাবে দেখা গেছে, প্রতি বছর এ দেশে প্রায় সাড়ে সাত হাজার সড়ক দুর্ঘটনা ঘটে। আর এতে প্রায় সমানসংখ্যক মানুষ মারা যায়। বাংলাদেশ সড়ক পরিবহন কর্তৃপক্ষের (বিআরটিএ) হিসাব অনুযায়ী, ১৯৯৪ সাল থেকে ২০১১ সাল পর্যন্ত দেশে ৭২ হাজার ৭৪৮ জন প্রাণ হারিয়েছেন এবং ৫২ হাজার ৬৮৪ জন আহত হয়েছেন।

এ হিসাব অনুযায়ী, দেশের বিভিন্ন স্থানে প্রতিদিন গড়ে ১০ জন সড়ক দুর্ঘটনায় প্রাণ হারান। বাংলাদেশ যাত্রী কল্যাণ সমিতির প্রতিবেদন অনুযায়ী, ২০১৪ সালের প্রথম ছয় মাসে দেশের বিভিন্ন স্থানে ৩ হাজার ২৫৬টি সড়ক দুর্ঘটনায় নিহত হয়েছেন ৩ হাজার ৭৭০ জন। ২০১৫ সালে বাংলাদেশে সড়ক দুর্ঘটনায় ৮ হাজার ৬৪২ জন নিহত হয়েছেন, আহত হয়েছেন ২১ হাজার ৮৫৫ জন। মোট দুর্ঘটনা হয়েছে ৬ হাজার ৫৮১টি।

আর ২০১৬ সালে সড়ক দুর্ঘটনায় ৬ হাজার ৫৫ জন নিহত হয়েছেন অর্থাৎ দিনে অন্তত ১৬ জনের মৃত্যু হয়েছে; আহত হয়েছে ১৫ হাজার ৯১৪ জন।

দেশে যেভাবে সড়ক দুর্ঘটনা ঘটে চলেছে তাতে মনে হয়, দেশের সড়ক-মহাসড়কগুলো নিরাপদে চলার পথ না হয়ে তা দিনে দিনে মৃত্যুফাঁদে পরিণত হচ্ছে। সড়ক-মহাসড়কে এখন যাত্রা করা মানেই যেন নিজের জীবন বাজি রাখা।

এখন প্রশ্ন হচ্ছে, দেশের সড়ক-মহাসড়কগুলোতে নিয়মিতভাবে ঘটে চলা দুর্ঘটনাগুলো কি এ দেশের জনগণের কপালের লিখন? নিশ্চয় নয়। দেশের সড়ক-মহাসড়কে প্রতিনিয়ত সড়ক দুর্ঘটনাগুলোকে যদি এ দেশের পরিপ্রেক্ষিতে না দেখে উন্নত দেশের পরিপ্রেক্ষিতে দেখা যায়; তাহলে দেখা যাবে, উন্নত দেশে সড়ক দুর্ঘটনার হার এ দেশের তুলনায় অনেক কম।

সুতরাং এ দেশের সড়ক-মহাসড়গুলোতে নিয়মিতভাবে ঘটে চলা দুর্ঘটনা জনগণের কপালের লিখন নয় কিংবা ভাগ্যদেবীর নির্মম পরিহাসও নয়।

এ ক্ষেত্রে যে বিষয়গুলো এ পার্থক্যের সৃষ্টি করছে তা হচ্ছে; সার্বিক যোগাযোগ ব্যবস্থার ধরন, চালকদের দক্ষতা, বেপরোয়া গতিতে গাড়ি চালানো, চালকদের ওভারটেকিং করার মানসিকতা প্রবল মাত্রায় বিদ্যমান থাকা, ড্রাইভিং লাইসেন্স প্রাপ্তিতে স্বচ্ছতা ও জবাবদিহিতার অভাব, জনগণের সচেতনতার অভাব, ট্রাফিক আইন কিংবা রাস্তায় চলাচলের নিয়ম না মানা প্রভৃতি।

এক হিসাবে দেখা গেছে, সড়ক দুর্ঘটনার দিক থেকে বাংলাদেশের অবস্থান সমগ্র বিশ্বে দ্বিতীয়। বিভিন্ন গণমাধ্যমে প্রকাশিত সংবাদ থেকে জানা যায়, গড় দেড় বছরে শুধু ঢাকা-আরিচা মহাসড়কেই সড়ক দুর্ঘটনায় মারা গেছেন অন্তত ২০০ জন।

আহত হয়েছেন সহস্রাধিক। সরকারি হিসাবে গত ১০ বছরে সড়ক দুর্ঘটনায় প্রায় ৩৫ হাজার মানুষ মারা যাওয়ার কথা বলা হয়েছে। অবশ্য বেসরকারি হিসাবে এ সংখ্যা অনেক বেশি। বেসরকারি সূত্রগুলো বলছে, প্রতি বছর দেশের সড়কপথে অন্তত পাঁচ হাজার দুর্ঘটনা ঘটছে আর এক বছরেই দেশে মৃতের সংখ্যা ২০ হাজার ছাড়িয়ে যায় এবং পঙ্গুত্ব বরণ করছেন এর দ্বিগুণ।

এক্ষেত্রে সরকারি আর বেসরকারি হিসাবের সংখ্যাগত পার্থক্য থাকলেও দেশে যে প্রতিনিয়তই সড়ক দুর্ঘটনার শিকার হয়ে অনেক মানুষের প্রাণহানি হওয়াসহ পঙ্গুত্ব বরণের ঘটনা ঘটছে, মোটা অংকের আর্থিক ক্ষতি হচ্ছে; সড়ক দুর্ঘটনাকে কেন্দ্র করে অনেক সময় ভাংচুর ও নৈরাজ্যের ঘটনা ঘটছে এবং এর ফলে সাধারণ মানুষ যে কঠিন ভোগান্তি আর হয়রানির শিকার হচ্ছে; সেসব বিষয় অস্বীকার করার উপায় নেই।

দেশের সড়ক-মহাসড়কগুলোয় যেভাবে দুর্ঘটনা ঘটছে এবং দুর্ঘটনার সংখ্যা দিনে দিনে যে হারে বাড়ছে, তা যদি অতি দ্রুত রোধ করার ব্যাপারে বাস্তবমুখী ও যথাযথ পদক্ষেপ গ্রহণ এবং যথাযথ সতর্কতা অবলম্বন না করা হয়, তাহলে আগামীতেও ভয়াবহ ও মর্মান্তিক সড়ক দুর্ঘটনা ঘটার পাশাপাশি জনগণ আহত-নিহত হতেই থাকবে।

সুতরাং সড়ক দুর্ঘটনা রোধকল্পে মাননীয় প্রধানমন্ত্রী যে ছয় দফা নির্দেশনা দিয়েছেন, তা এখন অক্ষরে অক্ষরে বাস্তবায়ন করা প্রয়োজন। পাশাপাশি সড়ক দুর্ঘটনার অন্য কারণগুলোও নিবিড়ভাবে চিহ্নিত করা প্রয়োজন।

সড়ক দুর্ঘটনার অন্য কারণগুলোর মধ্যে রয়েছে পরিকল্পনাহীনভাবে দেশে অনেক সড়ক-মহাসড়ক নির্মাণ, নির্দিষ্ট লেন ধরে গাড়ি না চালিয়ে সড়কের মাঝখান দিয়ে চালকদের গাড়ি চালানো, রাস্তায় বিপজ্জনক বাঁক বিদ্যমান থাকা, রাস্তার ত্রুটিপূর্ণ নকশা, ফিটনেসবিহীন গাড়ি রাস্তায় চালানো, মাদক সেবন করে গাড়ি চালানো, চালকদের বেপরোয়া গতিসহ ভুলপথে গাড়ি চালানো, বেশি গতির বড় গাড়িগুলোর অপেক্ষাকৃত কম গতিসম্পন্ন ছোট গাড়িগুলোকে ওভারটেকিং করার মানসিকতা থাকা, রাস্তা দিয়ে চলাচলকারী যাত্রী বা পথচারীদের ট্রাফিক আইন না মানার প্রবণতা, ফুটপাত ব্যবহার না করে রাস্তার মাঝখান দিয়ে পথচারীদের চলাচল, রাস্তা পারাপারের জন্য অনেক সময় ওভার ব্রিজ থাকলেও তা ব্যবহার না করে ঝুঁকি নিয়ে জনগণ কর্তৃক রাস্তা পার হওয়া, রাস্তার ওপর এবং ফুটপাতে দোকানপাট সাজিয়ে ব্যবসা-বাণিজ্য করা, যত্রতত্র গাড়ি পার্কিং করা, দুর্বল ও দুর্নীতিগ্রস্ত ট্রাফিক ব্যবস্থা এবং সর্বোপরি রাস্তায় চলাচলের জন্য যেসব নিয়ম-কানুন রয়েছে, তা জনগণ কর্তৃক না মানা।

অস্বীকার করার উপায় নেই, আমাদের দেশে সড়ক ব্যবস্থাপনার চিত্র অত্যন্ত ভয়াবহ। একদিকে যাত্রীদের কাছ থেকে আদায় করা হচ্ছে গলাকাটা ভাড়া; অন্যদিকে অদক্ষ চালককে গাড়ি চালানোর দায়িত্ব দিয়ে, ট্রাফিক আইন না মেনে এবং ফিটনেসহীন গাড়ি চালানোর মধ্য দিয়ে অসংখ্য মানুষের মূল্যবান জীবন নিয়ে ছিনিমিনি খেলা হচ্ছে। বলা বাহুল্য, সড়ক দুর্ঘটনা অপ্রতিরোধ্য কোনো কঠিন বিষয় নয়।

এজন্য দরকার সরকার ও জনগণের ইতিবাচক চিন্তা এবং সমন্বিত পদক্ষেপ গ্রহণ ও তার উপযুক্ত বাস্তবায়ন।

রাস্তার ওপর ফুটপাতে দোকানপাট স্থাপনসহ ফুটপাতে নির্বিঘ্নে হকারদের ব্যবসা করার ‘সুযোগ’ করে দেয়া, অপরিকল্পিত ও দুর্বল ট্রাফিক ব্যবস্থা, ট্রাফিক পুলিশের চাঁদাবাজি, খেয়াল-খুশিমতো যেখানে-সেখানে গাড়ি পার্কিং করা, সড়ক-মহাসড়কের ওপর রিকশা, ভ্যান, ট্যাম্পু, ম্যাক্সি, ট্যাক্সিস্ট্যান্ড স্থাপন করা, রাস্তার মাঝখানে ডাস্টবিন স্থাপন করা, সড়ক-মহাসড়কের উন্নয়নের কাজ যথাযথভাবে সম্পন্ন না করা এবং অসৎ উদ্দেশ্যে একই রাস্তা বছরে বারংবার খনন করা, জনগণ কর্তৃক রাস্তা পারাপারের নিয়ম-কানুন সঠিকভাবে না মানার কারণে এ দেশের সড়ক-মহাসড়কগুলোতে প্রতিনিয়ত দুর্ঘটনা ঘটেই চলছে।

সংশ্লিষ্ট মন্ত্রণালয়কে স্মরণে রাখতে হবে, দেশের যোগাযোগ ব্যবস্থার উন্নতি মানে শুধু দেশকে গ্লোবাল ভিলেজের মতো করে ছোট করে আনা নয়; বরং সড়ক-মহাসড়কে চলাচলের ক্ষেত্রে মানুষের অমূল্য জীবন দুর্ঘটনামুক্ত রাখাটাও কিন্তু সংশ্লিষ্ট মন্ত্রণালয়ের দায়িত্বের মধ্যেই পড়ে।

সড়ক দুর্ঘটনা রোধে সর্বাগ্রে চালকদের হতে হবে বেশি দক্ষ, হতে হবে সতর্ক। পাশাপাশি জনগণকেও ট্রাফিক আইন ও রাস্তা চলাচলের আইন-কানুন যথারীতি মেনে চলতে হবে। এ ক্ষেত্রে যথেষ্ট কঠোরতার সঙ্গে ট্রাফিক আইনের প্রয়োগ অপরিহার্য।

মাদক সেবন করে গাড়ি চালানো এবং গাড়ি চালানো অবস্থায় মোবাইল ফোনে কথা বলাসহ চালকদের ‘ওভারটেকিং’ করার মানসিকতাও পরিহার করা প্রয়োজন।

তাছাড়া সড়ক দুর্ঘটনা রোধে দেশের সার্বিক সড়ক ব্যবস্থার উন্নয়নসহ চালকদের দক্ষতা বিচার করে ড্রাইভিং লাইসেন্স দেয়ার বিষয়টিও নিশ্চিত করা জরুরি। এ ক্ষেত্রে যেন কোনো ধরনের অনিয়ম বা দুর্নীতি না ঘটে, সে বিষয়টিও সরকারের পক্ষ থেকে নিশ্চিত করা অত্যাবশ্যক।

সড়ক দুর্ঘটনার জন্য দায়ী ব্যক্তিদের রাজনৈতিক পরিচয় বাদ দিয়ে কঠোর জবাবদিহিতার আওতায় আনা বা শাস্তি প্রদানের ব্যবস্থা থাকা জরুরি। সড়ক দুর্ঘটনা রোধে বিভিন্ন গণমাধ্যম, সুশীল সমাজ, সরকারসহ আপামর জনগণকে একযোগে আন্তরিকভাবে এগিয়ে আসতে হবে।

সেই সঙ্গে সড়ক দুর্ঘটনা রোধকল্পে মাননীয় প্রধানমন্ত্রী যে ছয় দফা নির্দেশনা দিয়েছেন, তা যথাযথভাবে বাস্তবায়ন করা দরকার। সর্বোপরি সড়ক দুর্ঘটনা রোধে আমাদের সবারই সচেতন দরকার। সবাই সচেতন হলে দুর্ঘটনা কমে আসবে।

এক্ষেত্রে দায়িত্ব পালনে সংশ্লিষ্ট সংস্থাগুলোর মধ্যে যে সমন্বয়হীনতা ও অবহেলা আছে, তা যে কোনো মূল্যে দূর করতে হবে। বলার অপেক্ষা রাখে না, উপরোক্ত পদক্ষেপগুলোর সঠিক বাস্তবায়ন হলে দেশের সড়ক-মহাসড়কগুলো মৃত্যুফাঁদ না হয়ে নিরাপদ হয়ে ওঠবে, যা সবার একান্ত কাম্য।

ড. কুদরাত-ই-খুদা বাবু : সহযোগী অধ্যাপক, আইন বিভাগ, ড্যাফোডিল ইন্টারন্যাশনাল ইউনিভার্সিটি; অ্যামনেস্টি ইন্টারন্যাশনালের সদস্য
kekbabu@yahoo.com

Link: https://www.jugantor.com/todays-paper/window/194323/%E0%A6%8F-%E0%A6%A6%E0%A7%87%E0%A6%B6%E0%A7%87-%E0%A6%8F%E0%A6%A4-%E0%A6%AC%E0%A7%87%E0%A6%B6%E0%A6%BF-%E0%A6%B8%E0%A7%9C%E0%A6%95-%E0%A6%A6%E0%A7%81%E0%A6%B0%E0%A7%8D%E0%A6%98%E0%A6%9F%E0%A6%A8%E0%A6%BE-%E0%A6%95%E0%A7%87%E0%A6%A8

40
পুকুরচুরি রুখবে কে?
ড. কুদরাত-ই-খুদা বাবু
১৪ জুন, ২০১৯

বাংলা ব্যাকরণের ‘পুকুরচুরি’ নামক বাগধারাটির সঙ্গে আমরা সবাই পরিচিত। আর এই পুকুরচুরি বলতে বড় রকমের চুরিমূলক কর্মকাণ্ডকে বোঝানো হয়। ফলে যারা পুকুরচুরির সঙ্গে জড়িত, তাদের পুকুরচোর বলা যায়। যেমন—যদি একটি আবাসিক ভবনের প্রতিটি বালিশের দাম দেখানো হয় পাঁচ হাজার ৯৫৭ টাকা; ৩০টি চাদর আনতে একটি ট্রাক ভাড়া করাপূর্বক যদি খরচ দেখানো হয় ৩০ হাজার টাকা; কম্বল বা লেপ আনার জন্য যদি দেখানো হয় আরো ট্রাকভাড়া আর তার খরচ বাবদ যদি দেখানো হয় আরো ৩০ হাজার টাকা এবং সর্বোপরি প্রতিটি চাদর নিচ থেকে খাটে তোলার জন্য খরচ দেখানো হয় ৯৩১ টাকা—তবে এ ধরনের চুরিগুলোকে পুকুরচুরি না বলে সাগরচুরি বলাই ভালো। ওপরের ওই দুর্নীতির ঘটনাগুলো কোনো বৈজ্ঞানিক কল্পজগতের বা সিনেমা, নাটক, সাহিত্যে উল্লিখিত কাল্পনিক কোনো জগতের ঘটনা নয়। বরং ওই ঘটনা হচ্ছে আমাদের বাংলাদেশের এবং এই দুর্নীতি সংঘটিত হয়েছে পাবনার রূপপুর পারমাণবিক বিদ্যুৎ কেন্দ্রে আবাসিক ভবনের বালিশ, চাদর ইত্যাদি ক্রয়ের ক্ষেত্রে। ওদিকে পত্রিকায় খবর বেরিয়েছে, ‘সাতক্ষীরায় হাসপাতালের ১৭ কোটি টাকার কেনাকাটায় ১২ কোটিই লোপাট। সাত কোটি টাকায় কেনা সফটওয়্যারের অস্তিত্ব নেই। সদর হাসপাতালে ১০ কোটি টাকার মধ্যে প্রায় পাঁচ কোটি টাকার মালামাল নেই।’ পত্রিকায় প্রকাশিত ওই প্রতিবেদন থেকে জানা যায়, সাতক্ষীরা মেডিক্যাল কলেজ হাসপাতাল এবং সদর হাসপাতালের জন্য ১৭ কোটি টাকার কেনাকাটায় প্রায় ১২ কোটিই লোপাট হয়েছে। আবার পণ্য সরবরাহ ছাড়াই জাল স্বাক্ষরে বিল তুলে নিয়েছে এর সঙ্গে জড়িত চক্রটি। আশ্চর্যজনক হলেও সত্য, জড়িতদের বিরুদ্ধে এখন পর্যন্ত কোনো ব্যবস্থা নেওয়া হয়নি। খবরে প্রকাশ, ২০১৮-১৯ অর্থবছরে প্রায় ১৭ কোটি টাকার যন্ত্রপাতি কেনা হয়। এর মধ্যে রয়েছে সাত কোটি টাকা দামের একটি সফটওয়্যার এবং প্রায় ১০ কোটি টাকার যন্ত্রপাতি। কাগজে-কলমে এসব কেনা হলেও বাস্তবে  বেশির ভাগ যন্ত্রপাতির কোনো হদিস নেই এবং সাত কোটি টাকার সফটওয়্যারের কোনো অস্তিত্বই পাওয়া যায়নি। এ ছাড়া ১০ কোটি টাকার পণ্যের মধ্যে সন্ধান মেলেনি প্রায় পাঁচ কোটি টাকার পণ্যের। সব মিলিয়ে ১২ কোটি টাকাই লোপাট। আরো আশ্চর্যের বিষয়, ঠিকাদারি প্রতিষ্ঠান এবং সংশ্লিষ্ট একটি অসাধুচক্র যন্ত্রপাতি সরবরাহ না করেই এই অর্থ আত্মসাৎ করেছে বলে স্বাস্থ্য মন্ত্রণালয়ের প্রাথমিক তদন্তে বেরিয়ে এসেছে।

বলা বাহুল্য, এ ধরনের ঘটনা এ দেশে এই প্রথম নয়। এর আগেও চট্টগ্রাম জেনারেল হাসপাতালে চিকিৎসা সরঞ্জাম কেনাকাটার ক্ষেত্রে এ ধরনের সাগরচুরির ঘটনা ঘটেছিল। ওখানে ঠাণ্ডা রক্তকে স্বাভাবিক তাপমাত্রায় আনার যন্ত্র ‘ব্লাড ওয়ারমার’-এর সর্বোচ্চ বাজারমূল্য যেখানে ১৫ হাজার টাকা, সেখানে ওই যন্ত্র যদি ৯ লাখ ৩২ হাজার টাকায় সরবরাহ করা হয় এবং কান পরীক্ষা করার অটোস্কোপ যন্ত্রের দাম যেখানে ১০ হাজার থেকে ৫০ হাজার টাকার মধ্যে, সেখানে ওই যন্ত্র যদি সরবরাহ করা হয় তিন লাখ ৭০ হাজার টাকায়, তাহলে কী দাঁড়ায়। শুধু উপরোক্ত দুই হাসপাতালে যন্ত্র ক্রয়ের ক্ষেত্রে বা পাবনার রূপপুর পারমাণবিক বিদ্যুৎ কেন্দ্রের আবাসিক ভবনের বালিশ আর চাদর ক্রয়ের ক্ষেত্রেই যে এ ধরনের বড় বড় অনিয়ম-দুর্নীতি হয়েছে তা নয়, ঠিক একইভাবে দেশের প্রায় সব সেক্টরেই অনিয়ম-দুর্নীতি হচ্ছে, যা পত্রিকার পাতায় ভালোভাবে চোখ রাখলেই দেখা যায়। এ ধরনের চুরি বা জোচ্চুরি যে নিঃসন্দেহে বড় ধরনের অপরাধ, তা বলা বাহুল্য। আমাদের দেশে এ ধরনের অপরাধকে গতানুগতিক অপরাধের পর্যায়ভুক্ত করে সাধারণ আইনে বিচার করা হয় (যদিও এজাতীয় অপরাধ গতানুগতিক অপরাধ অপেক্ষা অনেক বেশি মারাত্মক)। কিন্তু আইনের পরিভাষায় এজাতীয় অপরাধকে বলা হয় ‘হোয়াইট কলার ক্রাইম’ বা ‘ভদ্রলোকের অপরাধ’। আর এ ধরনের অপরাধের সঙ্গে জড়িতদের বলা হয় হোয়াইট কলার ক্রিমিনাল বা ভদ্রবেশী অপরাধী। হোয়াইট কলার ক্রাইম গতানুগতিক অপরাধ থেকে ভিন্নধর্মী এক অপরাধ হলেও বাংলাদেশ দণ্ডবিধিতে হোয়াইট কলার ক্রাইম নামক অপরাধের কথা স্পষ্টভাবে উল্লেখ নেই, যা দুঃখজনক।

সমাজের বিভিন্ন পেশার ক্ষেত্রে উচ্চপর্যায়ের অনেক লোক প্রতিনিয়তই এ ধরনের অপরাধ করে চলেছে, তা সহজেই অনুমেয়। এ ধরনের অপরাধ প্রতিনিয়ত সমাজে ঘটে চললেও এসব অপরাধীর হাত অনেক ‘লম্বা’ হওয়ায় তারা প্রায়ই ধরাছোঁয়ার বাইরে থেকে যায়। এ ধরনের অপরাধীরা ব্যক্তিগতভাবে লাভবান হলেও তাদের এহেন অপরাধের ফলে সমাজ ও দেশ ধ্বংসের মুখোমুখি হয়। সাধারণভাবে আইন দ্বারা স্বীকৃত আচরণ, নীতি বা কাজের পরিপন্থী কোনো কাজকে অপরাধ হিসেবে গণ্য করা হয়। আর এসব অপরাধ গতানুগতিক অপরাধের পর্যায়ভুক্ত। কিন্তু হোয়াইট কলার ক্রাইম গতানুগতিক অপরাধ থেকে ভিন্নধর্মী অপরাধ। এ ধরনের অপরাধের সঙ্গে সম্পর্কযুক্তরা আর্থ-সামাজিক এবং পেশাগত মর্যাদায় অনেক বেশি সুপ্রতিষ্ঠিত। সাধারণ অপরাধীরা নিতান্তই আবেগের বশে, প্রয়োজনের তাগিদে, অভাবের তাড়নায় বা জীবিকার তাগিদে অপরাধ করে থাকে। তাদের অপরাধ সমাজে তাৎক্ষণিকভাবে বিশৃঙ্খলা ডেকে আনলেও সরকারের পক্ষে তা দমন করা সম্ভব। কিন্তু হোয়াইট কলার ক্রাইমের সঙ্গে জড়িত অপরাধীরা লোভ ও লালসার বশবর্তী হয়ে সম্পূর্ণ সুস্থ মস্তিষ্কে এবং প্রয়োজন ছাড়াই লোকচক্ষুর অন্তরালে থেকে এ ধরনের অপরাধ করে থাকে বলে তাদের শাস্তি প্রদান করা তো দূরের কথা, অনেক সময় তাদের শনাক্ত করাই সম্ভব হয়ে ওঠে না। এ দেশে অর্থনৈতিক, রাজনৈতিক, সামাজিক, ভৌগোলিক ও মনস্তাত্ত্বিক কারণে নানা ধরনের হোয়াইট কলার ক্রাইম বৃদ্ধি পাচ্ছে দ্রুতগতিতে, যা বাস্তব সত্য। আর এসব অপরাধ যে জাতীয় উন্নয়ন ও অগ্রগতির ক্ষেত্রে বিরাট প্রতিবন্ধকতা সৃষ্টি করছে, তা বলার অপেক্ষা রাখে না। বিভিন্ন সরকারি-বেসরকারি অফিসে দ্রুত কাজ করে দেওয়ার নামে অবৈধভাবে অর্থ নেওয়া, উন্নয়ন খাতের অর্থ আত্মসাৎ করা, অধিক মুনাফার লোভে পণ্যে ভেজাল মেশানো, নকল ওষুধ তৈরি করা এবং তা বাজারে বিক্রি করা, পণ্য মজুদ রেখে কৃত্রিম সংকট তৈরি করা, জনপ্রিয় ট্রেডমার্ক ব্যবহার করে নকল দ্রব্য উৎপাদন করা, চিকিৎসক কর্তৃক ভুয়া সার্টিফিকেট প্রদান, বিনা প্রয়োজনে অস্ত্রোপচার, সরকারি হাসপাতালে সঠিকভাবে রোগী না দেখে চিকিৎসকদের প্রাইভেট ক্লিনিকে রোগী দেখার প্রবণতা, প্রকৌশলী কর্তৃক অর্থ আত্মসাত্পূর্বক নিম্নমানের সেতু ও রাস্তাঘাট তৈরি, পুলিশ কর্তৃক ঘুষ গ্রহণ প্রভৃতি বিষয় আমাদের এ সমাজে আর নতুন কোনো বিষয় নয়। তা ছাড়া কর ফাঁকি দেওয়া, প্রচারমূলক বিজ্ঞাপনে মিথ্যা তথ্য পরিবেশন, নিজের আয় সম্পর্কে মিথ্যা তথ্য প্রদান, অসৎ উপায়ে অর্থ বা সম্পত্তি অর্জন করা, অবৈধভাবে সুযোগ-সুবিধা গ্রহণ, বিভিন্ন ক্ষেত্রে রাজনৈতিক প্রভাব খাটানোর ঘটনা অহরহই ঘটে চলছে। পাশাপাশি ব্যাংক, বীমা, শিক্ষাপ্রতিষ্ঠান, আদালতপাড়া, রেলওয়ে, বিদ্যুৎ বিভাগসহ নানা প্রতিষ্ঠান ও পেশায় আজ হাজারো রকমের হোয়াইট কলার ক্রাইম সংঘটিত হচ্ছে।

বাংলাদেশ দণ্ডবিধিতে হোয়াইট কলার ক্রাইম সম্পর্কিত কোনো অপরাধ বা শাস্তির কথা স্পষ্টভাবে উল্লেখ না থাকলেও যারা হোয়াইট কলার ক্রাইম সংঘটন করে বা করছে তারা যে অপরাধী সে বিষয়ে কোনো সন্দেহ নেই। তাই সমাজ থেকে এ ধরনের অপরাধ দ্রুতগতিতে দূর করতে পৃথক আইন প্রণয়নের পাশাপাশি প্রয়োজন এসব অপরাধের সঙ্গে জড়িতদের রাজনৈতিক পরিচয় বাদ দিয়ে তাদের সম্পদ রাষ্ট্রায়ত্ত করা এবং বিশেষ ট্রাইব্যুনাল গঠনের মাধ্যমে তাদের বিরুদ্ধে কঠোর শাস্তি প্রদান করা। সরকার কর্তৃক এসব পদক্ষেপ যথাযথভাবে গ্রহণ ও তার যথাযথ বাস্তবায়ন সম্ভব হলেই শুধু সমাজ থেকে এ ধরনের অপরাধ দূর করা সম্ভব। আর তখনই শুধু সম্ভব হবে একটি সুখী, সুন্দর, শান্তিময় ও দুর্নীতিমুক্ত সমাজ প্রতিষ্ঠা করা, যে সমাজের স্বপ্ন আমরা সবাই দেখি।

লেখক : সহযোগী অধ্যাপক, আইন বিভাগ, ড্যাফোডিল ইন্টারন্যাশনাল ইউনিভার্সিটি; অ্যামনেস্টি ইন্টারন্যাশনালের আন্তর্জাতিক সদস্য
kekbabu@yahoo.com

Link:
https://www.kalerkantho.com/print-edition/muktadhara/2019/06/14/779405


41
আলকাপ গানকে বিলুপ্তির হাত থেকে রক্ষা করা প্রয়োজন
ড. কুদরাত-ই-খুদা বাবু
২০ মে, ২০১৯ 

গম্ভীরা গানের মতো বাংলাদেশের উত্তর-পশ্চিম সীমান্তবর্তী চাঁপাইনবাবগঞ্জ জেলার আরেকটি ঐতিহ্যবাহী ও নিজস্ব লোকসংগীত ‘আলকাপ’। নানা প্রতিকূলতার মধ্য দিয়ে গম্ভীরার চর্চা এখানে এখন পর্যন্ত কিছুটা থাকলেও আলকাপের চর্চা এখন একেবারে নেই বললেই চলে। এমনকি বর্তমান প্রজন্মসহ শহুরে অনেক শিক্ষিত ব্যক্তিও জানে না আলকাপ গান কী? অথচ নাচ-গান, বন্দনা-ছড়া, নাটকীয় পালাসহ নানা আয়োজনে এ রকম সমৃদ্ধ লোকসংগীত বাংলাদেশে খুব কমই চোখে পড়ে। ‘আলকাপ’ একটি আরবি শব্দ, যার বাংলা অর্থ হচ্ছে মসকরা, ঢং বা কৌতুক। এটি এক ধরনের পালাগান বা অন্য অর্থে লোকনাট্য। এই গান পালাগানেরই একটি অঙ্গ। অনেকটা কবিগানের মতোই বিভিন্ন আসরে এই গান গাওয়া হয়ে থাকে। এই ধরনের গানের প্রধান উপজীব্য হলো ছড়া ও গান। লৌকিক জীবনের প্রেম-ভালোবাসা, সুখ-দুঃখ, হাসি-কান্নাসহ নানা ধরনের বিষয় আলকাপ গানের মধ্যে লক্ষ করা যায়। তবে রাধাকৃষ্ণের কথা আলকাপ গানের অন্যতম গুরুত্বপূর্ণ দিক। লৌকিক জীবন নিয়ে যে ছড়া আলকাপের গানে স্থান পায়, তা সব সময় শ্লীল হয় না। গ্রাম্য জীবনের সহজ-সরলতা এই গানের সহজ বিশেষত্ব। মুসলমান সমাজের বিশাল অংশের মধ্যে একসময় এই গান আদৃত হলেও ধীরে ধীরে আধুনিক সভ্য সংস্কৃতির চাপে এর প্রচলন কমে আসছে। উনিশ শতকের প্রথম দিকে আলকাপ গানের চর্চা শুরু হলেও বিশ শতকের গোড়ার দিকে গৌড়ীয় অঞ্চলে আলকাপের একটি উল্লেখযোগ্য বিকাশ লক্ষ করা যায়। আর আলকাপ গান তখন উত্তরবঙ্গের বিভিন্ন স্থানে জনপ্রিয় ও পেশা হিসেবেও বেশ লাভজনক হয়ে উঠেছিল। আগের দিনে সাধারণত পূজা-পার্বণ, নবান্ন-অন্নপ্রাশন, বিয়েবাড়ি, বৈশাখী মেলা উপলক্ষে আলকাপ গানের আয়োজন করা হতো। বর্তমানে চাঁপাইনবাবগঞ্জসহ গৌড়ীয় অঞ্চলের বিভিন্ন জায়গায় আগের মতো পূজা-পার্বণ, নবান্ন-অন্নপ্রাশন, বিয়ে, বৈশাখী মেলাসহ অন্যান্য অনুষ্ঠান হলেও সেখানে আর আলকাপ গানের অনুষ্ঠান হতে দেখা যায় না। এক পরিসংখ্যান থেকে জানা যায়, দেশ বিভাগের আগ পর্যন্ত চাঁপাইনবাবগঞ্জ জেলায় আলকাপ শিল্পীর সংখ্যা ছিল দুই হাজার ৪১৯ জন। বর্তমানে যার সংখ্যা দাঁড়িয়েছে মাত্র ১৫২ জনে, যাদের মধ্যে বেশির ভাগ শিল্পীই অনিয়মিত।

আলকাপ গানের দল গঠনের দিকে তাকালে দেখা যায়, আলকাপ গান অন্যান্য গানের মতো নয়। একটু আলাদা। আলকাপ গানের দলের প্রধানকে সরকার বা মাস্টার বলা হয় আর তার সঙ্গে থাকে একজন ভাঁড়, যাকে আলকাপের ভাষায় ‘কাপ্যাল’ বলা হয়। আলকাপ গানে সরকার এবং কাপ্যালের চরিত্র সব সময় দুই ভাই হিসেবে দেখা যায়। এই দলে আরো থাকে দুজন পুরুষ মানুষ, যারা গানের সময় মেয়ে সেজে নাচ-গান আর অভিনয় করে। তাদের ‘ছোকরা’, ‘ছুকরি’ বা ‘ছুরকি’ নামে ডাকা হয়। গানের দলে থাকে কয়েকজন যন্ত্রবাদক। তারা বিশেষ করে ঢোলক, হারমোনিয়াম, ডুগি, তবলা, খঞ্জনি, বাঁশি ইত্যাদি বাদ্যযন্ত্র ব্যবহার করে। সম্পূর্ণ গানের দল গানের আসরেই বসে থাকে। যন্ত্রীরা বসে থেকেই বাদ্যযন্ত্র বাজায় আর সরকার, কাপ্যাল, ছোকরা এবং আরো দু-একজন, যারা অভিনয় করে, তারা অভিনয়ের সময় আসরের মাঝখানে নির্ধারিত জায়গায় অভিনয় করে। আলকাপ গানের আসরে দর্শক-শ্রোতারা মাঝখানে কিছু জায়গা ফাঁকা রাখে। আগের দিনে প্রত্যন্ত অঞ্চলে আলোর উৎস হিসেবে আলকাপ গানে ব্যবহার করা হতো হ্যাজাক লাইট। আলকাপ গানের আসর চলাকালে বাদ্যযন্ত্রী, দোহার, অংশগ্রহণকারী কলাকুশলী, সরকার (আলকাপ রচয়িতা), ছোকরা এবং লাবাড়া (জোকার) গোল হয়ে বসে। আর তাদের বসার পরে মাঝের ফাঁকা গোলাকার জায়গাটুকু হচ্ছে আলকাপের মঞ্চ। আর এ মঞ্চেই চলে নাচ, গান ও অভিনয়। চরিত্র অনুযায়ী অভিনয়ের সময় দাঁড়িয়ে অভিনেতারা অভিনয়ে নৈপুণ্য প্রদর্শন করে থাকে। আগমন-নির্গমন, পদচারণ, ছোকরার নাচ—সব কিছুই একই স্থানে হয়ে থাকে। উল্লেখ্য, আলকাপ গানে কোনো নারী অংশগ্রহণ করে না। পুরুষের মধ্য থেকে সুন্দর ও মিষ্টি চেহারার অল্প বয়সী কেউ মেয়েদের পোশাক পরে ছোকরা সেজে নারীর অভিনয় করে। অভিনেতা, ছোকরা ও সরকার ছাড়াও আলকাপ গানে একজন হারমোনিয়াম বাদক, তিন-চারজন জুড়ি বাদক, একজন তবলা বাদক, এক থেকে দুজন জোকারসহ আরো ছয়-সাতজন শিল্পী অংশগ্রহণ করে। আলকাপ গানের মূলে থাকে ছয়টি অংশ। এগুলো হলো—জয়, আসর বন্দনা, দেশ বন্দনা ও অন্যান্য ছড়া, খ্যামটা, ফার্স বা দ্বৈতসংগীত এবং আলকাপ পালা। আলকাপ গানের সূচনায়ই যন্ত্রসহযোগে মিউজিক বাজানো হয়। একে ‘গদ’ নামে অভিহিত করা হয়। এর পরপরই সমবেত কণ্ঠে দলের সরকার, দেবী সরস্বতী, গণেশ, কার্তিক প্রমুখের নামে ‘জয়’ দেওয়া হয়। যেমন—‘সরস্বতী দেবী কি জয়...’ ইত্যাদি। আর বন্দনা আলকাপ গানে তার জন্মলগ্ন থেকেই রয়েছে। এসব বন্দনা হচ্ছে শিব বন্দনা, গণেশ বন্দনা, কার্তিক বন্দনা ইত্যাদি। বন্দনার পর সরকার দাঁড়িয়ে দেশ বন্দনা ও ছড়া বন্দনা পরিবেশন করে থাকে। দেশ বন্দনার পর যন্ত্রে প্রথমে খ্যামটার সুর বাজানো হয়। খ্যামটার সুর অনুসরণ করে ছোকরা নৃত্য ও গান পরিবেশন করতে থাকে এবং এ নাচ-গান দর্শক-শ্রোতাকে অভিভূত করে তোলে। প্রশ্ন-উত্তরের মাধ্যমে দুজন শিল্পী ফার্স বা দ্বৈত গান পরিবেশন করে থাকে। ছোকরার নৃত্য শেষ হলে একজন গায়ক বন্দনা ছড়া পরিবেশন করে। আর এ ছড়া শেষ হলেই শুরু হয় অভিনয়সহ আলকাপ পালা। আলকাপ পালায় সাধারণত সমাজ ও পারিবারিক জীবনের চিত্র প্রতিফলিত হয়ে থাকে। আলকাপ গান বিভিন্ন বিষয় নিয়ে রচিত হয়ে থাকে। যেমন ঐতিহাসিক বিষয় সম্পর্কিত আলকাপ (যেমন—কৃষক আন্দোলন, সাঁওতাল বিদ্রোহ); সমাজ সমস্যামূলক আলকাপ (যেমন—যৌতুক, মাদক, দুর্নীতি); ধর্মীয় বিষয় সম্পর্কিত আলকাপ (যেমন—মহররমের বিয়োগান্তক ঘটনা, মনসা-চণ্ডীর কাহিনি); শিল্পসম্পর্কিত আলকাপ (যেমন—রেশমশিল্প, কুটিরশিল্পের বর্ণনা), ব্যক্তিপরিচিতিমূলক আলকাপ (যেমন—জাতির জনক বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমান, বিশ্বকবি রবীন্দ্রনাথ ঠাকুর, বিদ্রোহী কবি কাজী নজরুল ইসলাম ইত্যাদি)।

আলকাপ গানের অবলুপ্তির কারণ অনুসন্ধান করলে দেখা যায়, দ্বিজাতিতত্ত্বের ভিত্তিতে দেশ বিভাগের ফলে বহু হিন্দুর (যারা বিভিন্নভাবে আলকাপ গানের সঙ্গে সম্পৃক্ত ছিল) এ দেশ ত্যাগ করে ভারতে চলে যাওয়া, পেশা হিসেবে আলকাপ শিল্পীদের পারিশ্রমিক অতি নগণ্য এবং তা অলাভজনক হওয়া, বিভিন্ন দলে সরকারদের শিল্পী ও ছোকরা নিয়ে দ্বন্দ্ব ইত্যাদি। যারা এই পেশার সঙ্গে অনেক দিন ধরে যুক্ত ছিল, তারা দিন দিন হারিয়ে যাচ্ছে বয়সের কারণে। এখনই এই লোকসংগীত রক্ষা করতে না পারলে হয়তো একসময় কেউই থাকবে না আলকাপ গান করার জন্য। তখন আর হয়তো কোথাও বসবে না আলকাপ গানের আসর। বলা বাহুল্য, সময়ের সঙ্গে জনগণের রুচিবোধের পরিবর্তন, সরকারি ও বেসরকারিভাবে এ গানের রক্ষণাবেক্ষণ ও উৎকর্ষের ক্ষেত্রে পৃষ্ঠপোষকতার যথেষ্ট অভাব, দ্রুত নগরায়ণের বিকাশ ঘটাসহ তথ্য-প্রযুক্তির ব্যাপক প্রসার লাভের ঘটনা আলকাপ গানের অবলুপ্তির অন্যতম কারণ। বলার অপেক্ষা রাখে না, অবলুপ্তপ্রায় লোকসংগীত আলকাপ গানকে বিলুপ্তির হাত থেকে রক্ষা করে একে সংগ্রহ ও যথাযথভাবে সংরক্ষণের ব্যবস্থা করলে এ গান বাংলাদেশের লোকসাহিত্যের বৈচিত্র্যের ভাণ্ডারে এক অমূল্য সম্পদ হিসেবে বিবেচিত হবে। তা ছাড়া ‘মৈমনসিংহ গীতিকা’র মতো সারা পৃথিবীর লোকসংগীতপ্রিয় গবেষকদের দৃষ্টিনন্দিত হবে—এ বিষয়ে কোনো সন্দেহ নেই। দেশীয় ঐতিহ্যবাহী এ লোকসংগীতকে ধ্বংসের হাত থেকে রক্ষা করতে সরকারি-বেসরকারি পৃষ্ঠপোষকতাসহ প্রয়োজন সবার আন্তরিক প্রয়াস, কার্যকর পদক্ষেপ গ্রহণ ও তার বাস্তবায়ন।

লেখক : সহযোগী অধ্যাপক, আইন বিভাগ, ড্যাফোডিল ইন্টারন্যাশনাল ইউনিভার্সিটি;
অ্যামনেস্টি ইন্টারন্যাশনালের আন্তর্জাতিক সদস্য
kekbabu@yahoo.com

Link: https://www.kalerkantho.com/print-edition/muktadhara/2019/05/20/771217

42
ভেজাল থেকে রেহাই মিলবে কি?
ড. কুদরাত-ই-খুদা বাবু
২৫ মে ২০১৯ [যুগান্তর, ২৫ মে, ২০১৯ (পৃষ্ঠা নং ৪)]

ভেজালযুক্ত খাদ্য থেকে জনগণ মুক্তি চাইলেও যেন কিছুতেই মুক্তি পাচ্ছে না। তবে একদিনে এ অবস্থার সৃষ্টি হয়নি। দীর্ঘদিন ধরে সংশ্লিষ্ট কর্তৃপক্ষের গাফিলতির ফলে এ অবস্থার সৃষ্টি হয়েছে। ভেজালমুক্ত খাদ্য যেমন দেহের ক্ষয় পূরণ, বৃদ্ধি সাধন এবং রোগ-প্রতিরোধ করে, তেমনি ভেজালযুক্ত খাদ্য গ্রহণের ফলে নানা রোগ-ব্যাধিতে আক্রান্ত হয়ে জীবন বিপন্ন পর্যন্ত হতে পারে। তাই ‘সকল সুখের মূল’ নামক স্বাস্থ্যকে সুস্থ ও সুন্দর রাখতে ভেজালমুক্ত খাবার গ্রহণের কোনো বিকল্প নেই। কিন্তু আমাদের দেশে শাকসবজি, ফল-মূল, মাছ-মাংস, দুধ, গুড়, মসলা থেকে শুরু করে নিত্যপ্রয়োজনীয় প্রায় সব খাদ্যই ভেজালে পরিপূর্ণ।

এমনকি এদেশে শিশুখাদ্যসহ জীবনরক্ষাকারী ওষুধেও ভেজাল মেশানো হয়েছে এবং ভেজালযুক্ত ওষুধ খেয়ে অনেক শিশুর মৃত্যু পর্যন্ত হয়েছে। আবার এসব অপরাধের সঙ্গে জড়িত ব্যক্তিরা শেষ পর্যন্ত ছাড়ও পেয়েছেন, যা গোটা জাতির জন্য অত্যন্ত লজ্জার বিষয়।

বলাবাহুল্য, নিরাপদ খাদ্যের বিষয়টি জনস্বাস্থ্য সংক্রান্ত এমনই এক বিষয় যে, এক্ষেত্রে কাউকে ন্যূনতম ছাড় পর্যন্ত দেয়ার সুযোগ নেই। অথচ আমাদের দেশে বাস্তবে ঘটছে উল্টো ঘটনা। অনেক সময় দেখা যায়, ফল পাকানোর ক্ষেত্রে বিষাক্ত কেমিক্যাল ব্যবহার করা হচ্ছে।

ফল পাকানোয় ব্যবহৃত বিষাক্ত রাসায়নিকের কিছু অংশ ফলের খোসার সূক্ষ্ম ছিদ্র দিয়ে ভেতরে প্রবেশ করে। আর এ ধরনের ফল খাওয়ার ফলে ক্ষতিকর রাসায়নিক পদার্থের অংশবিশেষ শরীরে ঢুকে পড়ে লিভার, কিডনিসহ মানবদেহের বিভিন্ন অঙ্গ-প্রত্যঙ্গের ক্ষতি করে থাকে।

বিকল্প উপায় না থাকায় জনগণকে এক ধরনের বাধ্য হয়েই এসব ভেজাল খাদ্য খেতে হচ্ছে। ফলে প্রতি বছর অসংখ্য মানুষ নানা রোগে আক্রান্ত হয়ে অকালেই মারা যাচ্ছে।

খাদ্যদ্রব্যে ভেজাল (যেমন- ফরমালিন, ক্যালসিয়াম কার্বাইড, প্রোফাইল প্যারা টিটিনিয়াম পাউডার বা পিপিটি, ইথেফেন ইত্যাদি) মেশানোর বিষয়টি দেশে দীর্ঘদিন ধরেই আলোচিত ও নিন্দিত হয়ে এলেও জনগণ যেন এ থেকে পরিত্রাণ পাচ্ছেন না।

পত্রিকায় প্রকাশিত প্রতিবেদন থেকে জানা যায়, দেশে শিল্পখাতে ফরমালিনের প্রয়োজন ৪০-৫০ টন। কিন্তু গত অর্থবছরে ফরমালিন আমদানি করা হয়েছে ২০৫ টন। তার মানে বাড়তি ১৫০ টনের বেশি ফরমালিন বিভিন্ন খাদ্যদ্রব্যের সঙ্গে দেশবাসীর পেটে গেছে।

অনেক সময় ঢাকঢোল পিটিয়ে বিভিন্ন বাজারকে ফরমালিনমুক্ত ঘোষণা করতে দেখা যায়। অথচ খোঁজ নিলে দেখা যাবে, ফরমালিনমুক্ত ঘোষিত ওই বাজারে নিয়মিত কোনো পরীক্ষাই করা হয় না।

ভেজালযুক্ত খাবার গ্রহণের ফলে দেশের মানুষ স্বাভাবিকভাবেই দীর্ঘমেয়াদি স্বাস্থ্যঝুঁকিতে রয়েছেন। তবে সবচেয়ে বেশি স্বাস্থ্যঝুঁকিতে রয়েছে অগণিত শিশু, যাদের বলা হয় আগামীর ভবিষ্যৎ। এ ধরনের পরিস্থিতি নিঃসন্দেহে সবার জন্যই উদ্বেগজনক।

আমাদের পুরো খাদ্যচক্রের মধ্যে প্রতিনিয়ত যেভাবে বিষ ঢুকিয়ে দেয়া হচ্ছে, তাতে করে মনে হয় জাতি হিসেবে আমরা বেশ দ্রুতগতিতেই ধ্বংসের দিকে এগিয়ে যাচ্ছি। অথচ এসব বন্ধ করতে স্বাস্থ্য মন্ত্রণালয়সহ সংশ্লিষ্ট কর্তৃপক্ষের পক্ষ থেকে তেমন কোনো বাস্তবমুখী পদক্ষেপ গ্রহণ করা হয় না, এমনকি আমাদের দেশে এখন পর্যন্ত গড়ে তোলা হয়নি ‘ফুড অ্যান্ড ড্রাগ প্রশাসন’ ধরনের কোনো শক্তিশালী প্রতিষ্ঠান।

শুধু তাই নয়, উচ্চ আদালতের নির্দেশ জারির দীর্ঘদিনেও খাদ্যে ভেজাল রোধে সারা দেশে স্বতন্ত্রভাবে খাদ্য আদালত গঠন করা হয়নি।

অবস্থা এমন যে, জনস্বাস্থ্যের কথা চিন্তা করার কেউ নেই। খাদ্যে ভেজাল রোধে কয়েকটি ভ্রাম্যমাণ আদালত পরিচালনার মধ্যেই যেন কার্যক্রম সীমাবদ্ধ। অথচ এর মাধ্যমে দূরদর্শিতার কোনো প্রমাণ পাওয়া যায় না। প্রতি বছর ১৫ মার্চ এলে ঘটা করে ভোক্তা অধিকার দিবস পালন করা হয়।

সারা দেশ ভেজালযুক্ত খাদ্যে সয়লাব হওয়ার প্রেক্ষাপটে কনজ্যুমার রাইটস সোসাইটি এবং কনজ্যুমারস অ্যাসোসিয়েশন অব বাংলাদেশ (ক্যাব) একসঙ্গে আন্দোলন করার পর ২০১০ সালে ভোক্তা অধিকার সংরক্ষণ অধিদফতর গঠন করা হয়। কিন্তু এ প্রতিষ্ঠানটি বিশেষজ্ঞনির্ভর না হয়ে আমলানির্ভর হওয়ায় তা অনেকটা অচল হয়ে রয়েছে। ভোক্তা অধিকার সংরক্ষণ অধিদফতর নামক এ প্রতিষ্ঠানটির তেমন কোনো কার্যকর তৎপরতা নেই বললেই চলে।

কর্তৃপক্ষের অব্যাহত গাফিলতি এবং দীর্ঘদিন ধরে দায়িত্বহীনতার কারণে কোনোভাবেই খাদ্যে ভেজাল রোধ করা সম্ভব হচ্ছে না। আর এভাবেই চলছে মানুষের মূল্যবান জীবন নিয়ে ছিনিমিনি খেলা।

এক পরিসংখ্যানে দেখা গেছে, প্রতি বছর ভেজাল খাদ্য খেয়ে তিন লাখের বেশি মানুষ আক্রান্ত হচ্ছেন মরণব্যাধি ক্যান্সারে। আর প্রায় দেড় লাখ মানুষ ডায়াবেটিস ও প্রায় দুই লাখ মানুষ কিডনি রোগে আক্রান্ত হচ্ছে। তবে ভেজাল খাদ্য গ্রহণের ফলে শিশু ও গর্ভবতী মহিলারা সবচেয়ে বেশি আক্রান্ত হচ্ছেন। ভেজাল খাদ্যের ফলে গর্ভবতী মায়ের শারীরিক বিভিন্ন জটিলতা দেখা দেয় এবং গর্ভজাত অনেক শিশু বিকলাঙ্গ হয়ে পড়ে।

শিশুখাদ্যে ভেজাল মেশানো ও ভেজাল খাদ্যের কারণে শিশুর বিকলাঙ্গ হওয়া আগামী প্রজন্মের জন্য নিঃসন্দেহে একটি অশনিসংকেত। নিত্যপ্রয়োজনীয় খাদ্যসামগ্রীতে বিষাক্ত কেমিক্যাল ব্যবহারে সরকার কর্তৃক নিষেধাজ্ঞা থাকলেও একশ্রেণীর অসাধু ব্যবসায়ী জনস্বাস্থ্যের কথা চিন্তা না করে বেশি মুনাফার লোভে খাদ্যদ্রব্যে বিষাক্ত কেমিক্যাল মেশাচ্ছে।

অনেক সময় এদের কাউকে হাতেনাতে ধরা হলেও তারা ঘুষ, পেশিশক্তিসহ রাজনৈতিক ছত্রছায়ায় পার পেয়ে যায়। নিরাপদ খাদ্য আইন, ২০১৩ সঠিকভাবে বাস্তবায়িত না হওয়ার পাশাপাশি সংশ্লিষ্ট কর্তৃপক্ষের দায়িত্বহীনতা, উদাসীনতা এবং জনগণ সচেতন ও সোচ্চার না হওয়ায় খাদ্যে ভেজাল রোধ করা সম্ভব হচ্ছে না। এ অবস্থার পরিবর্তন না ঘটলে আগামীতে এর কুফল কী ভয়ানক ও বিপজ্জনক হবে, তা সময়মতোই টের পাওয়া যাবে।

খাদ্যে ভেজাল রোধ এবং খাদ্য উৎপাদন ও বিপণন নিয়ন্ত্রণে এদেশে একটি আইন রয়েছে- যার নাম ‘বিশুদ্ধ খাদ্য অধ্যাদেশ-১৯৫৯’। কিন্তু এ আইনটি প্রচলিত হওয়ার পর এর বেশিরভাগ বিধানই কার্যকর না হওয়ায় তা মূলত কাগজে-কলমেই রয়ে গেছে।

তাছাড়া পাশ্চাত্যের দেশগুলোয় যারা মুক্তবাজার অর্থনীতির প্রবক্তা, তারা মুক্তবাজার অর্থনীতির মাধ্যমে খাদ্যে ভেজালের রাস্তাটা খুলে দিয়েছে। শাকসবজি, ফল-মূল, গুড়, মুড়ি, মাছ-মাংস, দুধ, মসলা থেকে শুরু করে নিত্যপ্রয়োজনীয় সব ধরনের খাদ্যসামগ্রীতে বিভিন্ন বিষাক্ত কেমিক্যাল ব্যবহারে নিষেধাজ্ঞা থাকলেও একশ্রেণীর অসাধু ব্যবসায়ী জনস্বাস্থ্যের কথা চিন্তা না করে বেশি মুনাফার লোভে খাদ্যদ্রব্যে এসব বিষাক্ত কেমিক্যাল মেশাচ্ছেন।

অনেক সময় এদের কেউ হাতেনাতে ধরা পড়লেও টাকা ও পেশিশক্তির জোরে এবং সর্বোপরি রাজনৈতিক ছত্রছায়ায় পার পেয়ে যায়। এর পাশাপাশি স্বাস্থ্য মন্ত্রণালয় ও সরকারি বিভিন্ন প্রতিষ্ঠানের দায়িত্বহীনতা, উদাসীনতা, সর্বোপরি জনগণের অসচেতনতার কারণে খাদ্যে ভেজাল রোধ করা সম্ভব হচ্ছে না। এ অবস্থা চলতে থাকলে আগামীতে তা কী ভয়ানক বিপদ ডেকে আনবে, ভাবলে গা শিউরে ওঠে। তখন হয়তো করার মতো তেমন কিছুই থাকবে না।

আশার কথা, সরকার সম্প্রতি ফরমালিন আমদানির ওপর বিধিনিষেধ আরোপের উদ্যোগ নিয়েছে। এর পাশাপাশি ‘নিরাপদ খাদ্য আইন-২০১৩’ যেন বাস্তবায়িত হয় সেই লক্ষ্যে নিরলসভাবে সবার কাজ করে যাওয়া উচিত। এ আইনে খাদ্যে ভেজাল বা ক্ষতিকর রাসায়নিক পদার্থ মেশানোর অভিযোগে সর্বোচ্চ ১৪ বছরের কারাদণ্ড ও ১০ লাখ টাকা জরিমানার বিধান রাখা হয়েছে। এ ছাড়া খাদ্য নিয়ে মিথ্যা বিজ্ঞাপন, নিবন্ধন ছাড়া খাদ্য বিপণন, ছোঁয়াচে রোগে আক্রান্ত এমন কাউকে দিয়ে খাদ্য বিক্রি করার ক্ষেত্রে বিভিন্ন মেয়াদের কারাদণ্ডের বিধান রাখা হয়েছে।

তবে স্মরণ রাখতে হবে, কোনো বিষয়ে আইন প্রণয়ন করার চেয়ে বেশি গুরুত্বপূর্ণ হচ্ছে ওই আইনের যথাযথ বাস্তবায়ন। সরকার জনস্বাস্থ্যের কথা বিবেচনা করে দেশের সব জেলায় খাদ্য আদালত প্রতিষ্ঠা করতে আন্তরিক হবে বলে সবার প্রত্যাশা। খাদ্যদ্রব্যে ভেজাল ও ক্ষতিকর রাসায়নিক পদার্থের মিশ্রণ রোধে স্বাস্থ্য মন্ত্রণালয় তথা সরকার ও গণমাধ্যমসহ সংশ্লিষ্ট সবার সম্মিলিতভাবে এগিয়ে আসা প্রয়োজন; প্রয়োজন নাগরিক সচেতনতা বৃদ্ধি করা। তবে খাদ্যে ভেজাল রোধে সর্বাগ্রে প্রয়োজন প্রত্যেকের নৈতিকতাবোধ ও বিবেক জাগ্রত করা।

ড. কুদরাত-ই-খুদা বাবু : সহযোগী অধ্যাপক, আইন বিভাগ, ড্যাফোডিল ইন্টারন্যাশনাল ইউনিভার্সিটি; অ্যামনেস্টি ইন্টারন্যাশনালের সদস্য
kekbabu@yahoo.com

https://www.jugantor.com/todays-paper/sub-editorial/181191/%E0%A6%AD%E0%A7%87%E0%A6%9C%E0%A6%BE%E0%A6%B2-%E0%A6%A5%E0%A7%87%E0%A6%95%E0%A7%87-%E0%A6%B0%E0%A7%87%E0%A6%B9%E0%A6%BE%E0%A6%87-%E0%A6%AE%E0%A6%BF%E0%A6%B2%E0%A6%AC%E0%A7%87-%E0%A6%95%E0%A6%BF

43
ধর্ষণ প্রতিরোধে সামাজিক সক্রিয়তা জরুরি
ড. কুদরাত-ই-খুদা বাবু
রবিবার, ১২ মে ২০১৯ (কালের কণ্ঠ)

পত্রিকার পাতা খুললে কিংবা টিভির সংবাদের দিকে দৃষ্টিপাত করলে প্রায়ই চোখে পড়ে ধর্ষণ ও ধর্ষণ-পরবর্তী হত্যাবিষয়ক খবরাখবর। এসংক্রান্ত খবর পড়তে পড়তে মানুষের মন যেন আজ রীতিমতো বিষিয়ে উঠেছে।

ধর্ষণের হাত থেকে প্রাপ্তবয়স্ক মেয়ে, গৃহবধূ, স্কুল-কলেজ-মাদরাসা-বিশ্ববিদ্যালয় পড়ুয়া ছাত্রী থেকে শুরু করে চার-পাঁচ বছরের কোমলমতি শিশু পর্যন্ত রেহাই পাচ্ছে না। আর বিয়ের প্রলোভন দেখিয়েও ধর্ষণ করার ঘটনা তো সমাজে অহরহই ঘটে চলেছে। অনেক সময় দেখা যায়, কোনো মেয়ে ধর্ষণের শিকার হলে সমাজ ও মান-সম্মানের ভয়ে বিষয়টি কাউকে জানায় না। তখন বিষয়টি লোকচক্ষুর অন্তরালেই থেকে যায়।
আবার অনেক সময় এও দেখা যায়, ধর্ষণ করার ঘটনা ধর্ষক বা তার সহযোগী কর্তৃক ভিডিও করে ইন্টারনেটে ছেড়ে দেওয়া হচ্ছে কিংবা ইন্টারনেটে ছেড়ে দেওয়ার ভয়ভীতি দেখিয়ে ওই মেয়েকে প্রতিনিয়ত ধর্ষণ করা হচ্ছে কিংবা তার কাছ থেকে অবৈধ সুবিধা নেওয়া হচ্ছে। একজন মেয়ে যখন ধর্ষণের শিকার হয় তখন তার সারা জীবনের লালিত স্বপ্ন ভেঙে চুরমার হয়ে যায়। ধর্ষণের ওই ঘটনা তাকে সারাক্ষণ তাড়া করে বেড়ানোর ফলে তার মানসিক শান্তি থাকে না। থাকে না ভালোভাবে বাঁচার স্বপ্ন। শেষ পর্যন্ত তার আত্মবিশ্বাসটুকুও দিনে দিনে লোপ পেতে থাকে। সর্বোপরি, ধর্ষণের শিকার মেয়েটি মানসিকভাবে এমন অশান্তি ও যন্ত্রণাময় জীবন অতিবাহিত করে যে সে যেন জীবিত থেকেও মৃত। অনেক সময় ধর্ষণের শিকার হয়ে অপমান সইতে না পেরে অনেকে আত্মহত্যা পর্যন্ত করে থাকে। কিন্তু দুঃখজনক হলেও সত্য, অনেক ক্ষেত্রে ধর্ষণের মতো ফৌজদারি অপরাধ, ন্যক্কারজনক ও জঘন্য ঘটনা ঘটলেও ধর্ষিতা কিংবা তার পরিবার ন্যায়বিচারটুকু পর্যন্ত পায় না।
দেশে ধর্ষণের হার যে দিনে দিনে বেড়েই চলেছে, তার প্রমাণ পাওয়া যায় মানুষের জন্য ফাউন্ডেশন কর্তৃক প্রকাশিত এক তথ্যে। এ সংস্থার তথ্যানুযায়ী, চলতি বছরের এপ্রিল মাসের প্রথম ১৫ দিনে সারা দেশে ৪৭টি শিশু ধর্ষণ, ধর্ষণচেষ্টা ও যৌন হয়রানির শিকার হয়েছে। পত্রিকায় প্রকাশিত অন্য এক প্রতিবেদনে জানা যায়, দেশে প্রতিবছর এক হাজারেরও বেশি নারী ও শিশু ধর্ষণের শিকার হচ্ছে। আর ধর্ষণের এই সংখ্যা যে চলতি বছরে অনেক বেশি হবে, তা বলাই বাহুল্য। ধর্ষণের ধারাবাহিক ঘটনা নিঃসন্দেহে দেশের সবার জন্যই উদ্বেগজনক। ধর্ষণের ঘটনার ফলে বিশ্বদরবারেও বাংলাদেশের ভাবমূর্তি ক্ষুণ্ন হচ্ছে মারাত্মকভাবে। বলার অপেক্ষা রাখে না, যেকোনো সমাজে ধর্ষণ বিস্তৃত হলে এবং ধর্ষকদের সাজার ব্যবস্থা করা না হলে সেই সমাজে নীতি-নৈতিকতা ও মূল্যবোধ বলে কিছুই থাকে না। এ ধরনের ঘটনা পুরো সমাজ, দেশ ও জাতিকে বিশৃঙ্খলা ও পাপাচারের দিকে ধাবিত করে, যা কখনোই ভালো কোনো বিষয় হতে পারে না।

ধর্ষণের কারণগুলো বিশ্লেষণ করলে দেখা যায়—১. ধর্ষণকারীদের মধ্যে বিন্দুমাত্র অপরাধবোধ না থাকার কারণে নির্দ্বিধায় ধর্ষণ করতে উদ্যোগী হচ্ছে। ২. যে সমাজে আইনের শাসন নেই কিংবা থাকলেও তা দুর্বল বা ভঙ্গুর, সেই সমাজের লোকেরা ধর্ষণ উপযোগী পরিবেশ পায় এবং ধর্ষণ করে। সুতরাং সামাজিক প্রতিরোধ ও আইনের শাসনের অভাব ধর্ষণের জন্য দায়ী। ৩. পর্নোগ্রাফি, সেসব দেখে অনেক পুরুষ ধর্ষণে উৎসাহিত বোধ করে। ৪. মেয়েদের ওপর আধিপত্য বিস্তার ও ভয়ভীতি দেখিয়ে নিয়ন্ত্রণ করার মানসিকতাও ধর্ষণের অন্যতম কারণ। ৫. ক্ষমতাশালী ব্যক্তি সুযোগ পেয়ে কোনো দুর্বল মেয়ে, শিশু বা ছেলের ওপর ক্ষমতার প্রয়োগ ঘটায় ধর্ষণের মাধ্যমে। ৬. অনেক সময় বন্ধুবান্ধব একসঙ্গে হয়ে আকস্মিকভাবে কোনো অসহায় মেয়েকে একা পেয়ে আনন্দ-ফুর্তি করার জন্যও ধর্ষণ করে। এ ছাড়া বর্তমানে ইন্টারনেটসহ নানা ধরনের তথ্য-প্রযুক্তির অবাধ ব্যবহার বৃদ্ধি পাওয়াসহ পারিপার্শ্বিক আরো অনেক কারণে ধর্ষণ হতে পারে।

যেভাবেই ধর্ষণ হোক না কেন, তা এক প্রকার যৌন অত্যাচার এবং তা গুরুতর ফৌজদারি অপরাধ। বাংলাদেশ দণ্ডবিধির ৩৭৫ ধারা মোতাবেক যদি কোনো ব্যক্তি নিম্নোক্ত পাঁচ প্রকারের যেকোনো অবস্থায় কোনো নারীর সঙ্গে যৌন সহবাস করে, তবে ওই ব্যক্তি ধর্ষণ করেছে বলে গণ্য হবে। প্রথমত তার ইচ্ছার বিরুদ্ধে; দ্বিতীয়ত তার সম্মতি ব্যতিরেকে; তৃতীয়ত তার সম্মতিক্রমে, যে ক্ষেত্রে তাকে মৃত্যু বা আঘাতের ভয় প্রদর্শন করে তার সম্মতি আদায় করা হয়; চতুর্থত তাঁর সম্মতিক্রমে, যে ক্ষেত্রে লোকটি জানে যে সে তার স্বামী নয় এবং নারীটি এ বিশ্বাসে সম্মতিদান করে যে পুরুষটির সঙ্গে সে আইনানুগভাবে বিবাহিত অথবা সে নিজেকে আইনানুগভাবে বিবাহিত বলে বিশ্বাস করে এবং পঞ্চমত তার সম্মতিক্রমে বা ব্যতিরেকে, যে ক্ষেত্রে সে ১৪ বছরের কম বয়স্ক হয়। নারী ও শিশু নির্যাতন দমন আইন ২০০০ (সংশোধিত ২০০৩)-এর ৯ ধারা অনুযায়ী ধর্ষণের অপরাধের যেসব শাস্তির বিধান রয়েছে তা হচ্ছে, ধর্ষণের ফলে কোনো নারী বা শিশুর মৃত্যু হলে ধর্ষণকারীর জন্য রয়েছে মৃত্যুদণ্ড বা যাবজ্জীবন সশ্রম কারাদণ্ড এবং এর অতিরিক্ত কমপক্ষে এক লাখ টাকা অর্থদণ্ড। একাধিক ব্যক্তি দলবদ্ধভাবে কোনো নারী বা শিশুকে ধর্ষণ করলে ধর্ষণকালে বা ধর্ষণের পর যদি তার মৃত্যু ঘটে, তবে ওই দলের সবার জন্যই এই শাস্তি প্রযোজ্য হবে। ধর্ষণের চেষ্টা করলে ধর্ষণকারীর সর্বোচ্চ ১০ বছর ও সর্বনিম্ন পাঁচ বছরের সশ্রম কারাদণ্ড এবং এর অতিরিক্ত অর্থদণ্ডেরও বিধান রয়েছে। কোনো নারী বা শিশুকে ধর্ষণ করে মৃত্যু ঘটানো বা আহত করার চেষ্টা করলে ধর্ষণকারী যাবজ্জীবন সশ্রম কারাদণ্ডে দণ্ডিত হবে এবং এর অতিরিক্ত অর্থদণ্ডেও দণ্ডিত হবে।

ধর্ষণ বিষয়ে মামলা করে বিচার পাওয়ার চেয়ে সমাজে যেন ধর্ষণের ঘটনা না ঘটে সে ব্যবস্থা করা অধিকতর মঙ্গলজনক। কারণ Prevention is better than cure. ধর্ষণের হাত থেকে পরিত্রাণ পেতে হলে আমাদের দর্শন ও নৈতিকতার উন্নয়ন করতে হবে, আমাদের মনের অশুভ চিন্তা বা দৃষ্টিভঙ্গির পরিবর্তন করতে হবে। বর্তমান বাস্তবতায় সমাজে ধর্ষণের বিরুদ্ধে সম্মিলিত কণ্ঠে প্রতিবাদ হওয়াটা খুবই জরুরি। ধর্ষকরা অনেক সময় শাস্তি পায় না বলেই পরবর্তীকালে বীরদর্পে ধর্ষণ করে। আর তাকে দেখে অন্যরাও ধর্ষণ করতে উৎসাহিত হয়। এভাবে চলতে থাকলে সমাজ, দেশ ও জাতি কলুষিত হবে। দেশ পরিণত হবে মগের মুল্লুকে। ধর্ষণ রোধে প্রতিটি পরিবার থেকে প্রতিটি শিশুকে ছোটবেলা থেকেই নৈতিক শিক্ষা প্রদান করা প্রয়োজন। কারণ পরিবারই তার আচরণ, মূল্যবোধ, নৈতিকতা ইত্যাদির ভিত্তি তৈরি করে দেয়। সর্বোপরি, ধর্ষণ প্রতিরোধে বিভিন্ন সরকারি-বেসরকারি প্রতিষ্ঠান, গণমাধ্যম, সুধীসমাজসহ সবার একযোগে এগিয়ে আসা প্রয়োজন। প্রয়োজন ধর্ষণকে যেকোনো মূল্যে প্রতিহত করা। মনে রাখা প্রয়োজন, যে সমাজে নারীরা বেশি মাত্রায় ধর্ষণের শিকার হয়, সেই সমাজে নারীরা দেশ-জাতির উন্নয়নে স্বাভাবিকভাবেই গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা রাখতে পারে না। অথচ নারীদের পিছিয়ে রেখে বা তাদের ধর্ষণ করে কোনো সমাজের ঠিকমতো উন্নয়ন ও অগ্রগতি সাধিত হতে পারে না। তাই সমাজ, দেশ ও জাতির উন্নয়ন, অগ্রগতি ঘটানোসহ সামাজিক শান্তি-শৃঙ্খলা বজায় রাখার স্বার্থে এবং একটি সুখী, সুন্দর ও সাফল্যময় দেশ ও জাতি গঠনে ধর্ষণকে কঠোর হস্তে দমন করা অপরিহার্য, যেন ভবিষ্যতে এ পথে আর কেউ পা বাড়াতে না পারে।

লেখক : ড্যাফোডিল ইন্টারন্যাশনাল ইউনিভার্সিটির আইন বিভাগের সহযোগী অধ্যাপক
অ্যামনেস্টি ইন্টারন্যাশনালের আন্তর্জাতিক সদস্য
kekbabu@yahoo.com

Link: https://www.kalerkantho.com/print-edition/muktadhara/2019/05/12/768282




44
ড. জোহার আত্মত্যাগ এবং জাতির দায়বদ্ধতা

ড. কুদরাত-ই-খুদা বাবু
১৮ ফেব্রুয়ারি ২০১৯

আজ ড. জোহা দিবস। এ দিনটি রাজশাহী বিশ্ববিদ্যালয়সহ দেশের শিক্ষক সমাজের কাছে এক স্মরণীয় দিন। ১৯৬৯ সালের এই দিনে রাজশাহী বিশ্ববিদ্যালয়ের রসায়ন বিভাগের শিক্ষক ও প্রক্টর সর্বজনশ্রদ্ধেয় ড. শামসুজ্জোহা পাকবাহিনীর গুলিতে নির্মমভাবে নিহত হন। নিজের জীবন বিসর্জন দিয়ে সেদিন তিনি তার ছাত্রদের জীবন বাঁচিয়েছিলেন। ড. জোহা সেদিন শহীদ হয়ে ইতিহাসের পাতায় ছাত্রপ্রীতির এক মহান দৃষ্টান্ত স্থাপন করে গেছেন। রাজশাহী বিশ্ববিদ্যালয়ের প্রশাসন ভবনের সামনে অবস্থিত চত্বরে চিরনিদ্রায় শায়িত আছেন গণঅভ্যুত্থানের শহীদ ড. শামসুজ্জোহা। ড. জোহার আত্মদানের মধ্য দিয়েই তৎকালীন স্বৈরশাসক আইয়ুব খানের ক্ষমতার ভিত নড়ে উঠেছিল। প্রতিবাদে সোচ্চার হয়ে উঠেছিল বাঙালি, যা বেগবান করেছিল দেশমাতৃকার মহান স্বাধীনতা সংগ্রামের গতিকে।


ভারতের পশ্চিমবঙ্গের বাঁকুড়া জেলায় ১৯৩৪ সালের মে মাসে জন্মগ্রহণ করেন ড. শামসুজ্জোহা। ১৯৪৭ সালে দেশবিভাগের সময় পরিবারসহ চলে আসেন বাংলাদেশে। ১৯৫৩ সালে ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের রসায়ন বিভাগ থেকে অনার্স এবং ১৯৫৪ সালে একই বিষয়ে প্রথম শ্রেণীতে মাস্টার্স ডিগ্রি লাভ করেন তিনি। কর্মজীবনের শুরুত ড. জোহা পাকিস্তানের অর্ডিন্যান্স ফ্যাক্টরিতে সহকারী পরিচালক হিসেবে এবং পরে রাজশাহী বিশ্ববিদ্যালয়ের রসায়ন বিভাগে শিক্ষক হিসেবে যোগদান করেন। ইতিহাস থেকে জানা যায়, ১৯৬৯ সালের ১৫ ফেব্রুয়ারি ঢাকা ক্যান্টনমেন্টে বন্দি অবস্থায় আগরতলা ষড়যন্ত্র মামলার আসামি সার্জেন্ট জহুরুল হককে আইয়ুব খানের লোকেরা হত্যা করলে এর প্রতিবাদে তৎকালীন পূর্ব পাকিস্তানে প্রতিবাদের দাবানল ছড়িয়ে পড়ে। একই সালের ১৭ ফেব্রুয়ারি স্থানীয় জেলা প্রশাসন রাজশাহী শহরে ১৪৪ ধারা জারি করে সব ধরনের মিছিল-মিটিং নিষিদ্ধ করে। ওইদিন রাজশাহী বিশ্ববিদ্যালয়ের ছাত্র-শিক্ষক, কর্মকর্তা-কর্মচারীসহ মুক্তিকামী জনতা ১৪৪ ধারা ভঙ্গের উদ্দেশ্যে শোভাযাত্রা বের করেন। শোভাযাত্রাটি রাজশাহী মেডিকেল কলেজ অধ্যক্ষের বাসভবনের সামনে পৌঁছলে আইয়ুব খানের পেটোয়া পুলিশ বাহিনীর সঙ্গে ছাত্র-শিক্ষকসহ মুক্তিকামী জনতার সংঘর্ষ বাধে। এতে অনেকেই আহত হন, অনেকে হন কারাবন্দি। এ খবর শোনামাত্র ড. শামসুজ্জোহা দ্রুত ঘটনাস্থলে ছুটে যান এবং আহত মুক্তিকামী জনতাকে নিয়ে হাসপাতালে যান।

এ ঘটনার পরদিন ১৮ ফেব্রুয়ারি সকাল থেকেই রাজশাহী বিশ্ববিদ্যালয় ক্যাম্পাসে ছড়িয়ে পড়ে উত্তেজনা। বিক্ষুব্ধ ছাত্র-জনতা ১৪৪ ধারা ভঙ্গের প্রস্তুতি নেন। অপরদিকে সশস্ত্র বাহিনীকে বিশ্ববিদ্যালয়ের মেইনগেটে প্রস্তুত রাখাসহ গেট তালাবদ্ধ করে রাখা হয়- যেন ছাত্র-জনতা বের হতে না পারেন। এরপর আন্দোলনরত বিক্ষুব্ধ ছাত্র-জনতা সব প্রতিরোধ ও বাধা-বিপত্তি উপেক্ষা করে মেইনগেটের সীমানা প্রাচীর টপকে বের হওয়া শুরু করলে শিক্ষকরা মেইনগেটের দায়িত্বপ্রাপ্ত প্রহরীকে গেট খুলে দেয়ার নির্দেশ দেন। এহেন সংকটময় মুহূর্তে মুক্তিকামী ছাত্র-জনতাকে লক্ষ্য করে সামরিক জান্তার দোসররা রাইফেল উঁচিয়ে গুলি করার প্রস্তুতি নিতে থাকলে ছাত্ররা পাকবাহিনীর পার্ক করা একটি গাড়িতে কেরোসিন ঢেলে আগুন জ্বালিয়ে দেয়। উদ্ভূত পরিস্থিতিতে ড. জোহা পাকসেনা অফিসার ক্যাপ্টেন হাদির সঙ্গে কথা বলার জন্য এগিয়ে যান এবং তাকে অনুরোধ করেন যেন সেনাবাহিনীর তরফ থেকে কোনো ধরনের উসকানিমূলক পদক্ষেপ নেয়া না হয়। আস্তে আস্তে মেইনগেট সংলগ্ন ঢাকা-রাজশাহী মহাসড়কে ছাত্র-জনতার ঢল নামতে শুরু করলে সেনাবাহিনীর লোকজন তাদের ওপর গুলি করতে প্রস্তুত হয়। এ অবস্থায় ড. জোহা হাত উঁচু করে পাকসেনাদের উদ্দেশে অনুরোধের ভঙ্গিতে বলতে থাকেন, ‘প্লিজ, ডোন্ট ফায়ার; আমার ছাত্ররা এখান থেকে এখনই চলে যাবে...।’ কিন্তু পাক হায়েনারা সেদিন ড. জোহার সেই অনুরোধে কর্ণপাত করেনি। অল্প কিছুক্ষণ পরই খুব কাছ থেকে মার্ক ফোর রাইফেলের ছোড়া গুলি জোহার পেট দিয়ে ঢুকে পিঠ দিয়ে বের হয়ে যায়। তিনি মাটিতে লুটিয়ে পড়েন। পরে তাকে ভ্যানে করে দ্রুত শহরের হাসপাতালে নিয়ে যাওয়ার চেষ্টা করা হয়। কিন্তু দুর্ভাগ্যবশত সেদিন পথে পথে ব্যারিকেড থাকার কারণে তাকে হাসপাতালে নিতে বেলা গড়িয়ে যায়। হাসপাতালে নেয়ার পর অপারেশন টেবিলেই মৃত্যু হয় সর্বজনশ্রদ্ধেয় শিক্ষক ড. শামসুজ্জোহার।

তার মৃত্যুর খবর ছড়িয়ে পড়ার সঙ্গে সঙ্গে রাজধানী ঢাকাসহ সারা দেশের বিক্ষুব্ধ জনতা ১৪৪ ধারা ভঙ্গ করে পাকবাহিনীর বিরুদ্ধে তীব্র প্রতিরোধ গড়ে তোলেন। এ প্রতিরোধ প্রকট আকার ধারণ করলে পাকসেনারা ক্রমশ দুর্বল হয়ে পড়ে। শহীদ আসাদ, সার্জেন্ট জহুরুল হক এবং ড. শামসুজ্জোহার মৃত্যুতে উত্তাল হয়ে ওঠে গোটা পূর্ব বাংলা। দেশবাসী পাকবাহিনী ও আইয়ুবশাহীর বিরুদ্ধে গড়ে তোলে কঠোর আন্দোলন। ফলস্বরূপ দেশের রাজনৈতিক পরিস্থিতি জটিল আকার ধারণ করে। রাজশাহী বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষক-শিক্ষার্থী, কর্মকর্তা-কর্মচারীরাও হয়ে ওঠেন সোচ্চার। সারা দেশে পশ্চিমাদের শাসন, শোষণ ও নির্যাতনের বিরুদ্ধে প্রতিবাদের দাবানল জ্বলে ওঠে। স্বাধীনচেতা, গণতন্ত্রকামী মানুষ এক হয়ে তাদের ভোটের মাধ্যমে প্রমাণ করতে সক্ষম হন পূর্ব বাংলার জনগণ ঐক্যবদ্ধ।

ড. শামসুজ্জোহার শাহাদতবরণের ঘটনার মধ্য দিয়ে ছাত্রপ্রীতি ও কর্তব্যপরায়ণতার যে মহান দৃষ্টান্ত ইতিহাসের পাতায় স্থাপিত হয়েছে, তা এখন আর বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষকদের মাঝে খুঁজে পাওয়া যায় না। ড. শামসুজ্জোহা ইচ্ছে করলে সেদিন মোটামুটি নিরাপদ দূরত্বে থেকে পারতেন নিজের জীবন বাঁচাতে। কিন্তু তিনি তা করেননি। কারণ তার কাছে নিজের জীবনের চেয়ে তার ছাত্রছাত্রীদের জীবন বড় ছিল।

প্রশ্ন হচ্ছে, ড. জোহার এ মহান অবদানের কতটুকু স্বীকৃতি দিয়েছি আমরা? প্রতি বছর এ দিনটি রাজশাহী বিশ্ববিদ্যালয়ে ‘শিক্ষক দিবস’ হিসেবে পালন করা হলেও এখন পর্যন্ত দিবসটিকে সরকারিভাবে পালন করার কোনো কার্যকর উদ্যোগ গ্রহণ করা হয়নি। এ ব্যাপারে রাষ্ট্রের কিছু করার অবকাশ রয়েছে বলে মনে করি আমরা। ড. জোহাকে বাঙালি জাতির মণিকোঠায় ঠাঁই দিতে পারলে লাভ হবে আমাদের জাতিরই। কারণ এতে অনুপ্রেরণা পাবেন বুদ্ধিজীবী সমাজসহ দেশের জনগণ। পাশাপাশি যে কোনো স্বৈরাচারী শক্তি, অপশক্তি ও অকল্যাণের বিরুদ্ধে রুখে দাঁড়ানোর অনুপ্রেরণা পাবেন দেশের শিক্ষক-শিক্ষার্থী, তরুণ সমাজ, বুদ্ধিজীবীসহ সবাই।

ড. কুদরাত-ই-খুদা বাবু : সহযোগী অধ্যাপক, আইন বিভাগ, ড্যাফোডিল ইন্টারন্যাশনাল ইউনিভার্সিটি; আন্তর্জাতিক মানবাধিকার সংগঠন অ্যামনেস্টি ইন্টারন্যাশনালের সদস্য
kekbabu@yahoo.com


45
গ্যাস সিলিন্ডারজনিত দুর্ঘটনা রোধ
ড. কুদরাত-ই-খুদা বাবু
২১ জানুয়ারি, ২০১৯ ০০:০০

পত্রিকার পাতা খুললে কিংবা টিভির পর্দায় চোখ রাখলে প্রায়ই দেখা যায় গ্যাস সিলিন্ডার বিস্ফোরণে হতাহতের খবরাখবর। আমাদের দেশের অনেক মানুষ রান্নার কাজে এই গ্যাস সিলিন্ডার ব্যবহার করে থাকে। বেশির ভাগ ক্ষেত্রে যা এলপিজি বা এলপি গ্যাস হিসেবে পরিচিত। লিকুইফাইড পেট্রোলিয়াম গ্যাস বা লিকুইড পেট্রোলিয়াম গ্যাস (এলপিজি অথবা এলপি গ্যাস) অর্থাৎ চাপে শীতলীকৃত জ্বালানি গ্যাস। এসব নামে প্রোপেন বা বিউটেনকে বা এদের মিশ্রণকেও নির্দেশ করা হয়। এটি মূলত দাহ্য হাইড্রোকার্বন গ্যাসের মিশ্রণ এবং জ-ালানি হিসেবে রান্নার কাজে, গাড়িতে ও ভবনের তাপমাত্রা বৃদ্ধিতে ব্যবহার করা হয়। বিভিন্ন কাজে সিএফসি গ্যাসের বিকল্প হিসেবে এলপিজি ব্যবহৃত হচ্ছে। এতে বায়ুমণ্ডলের ওজোনস্তরের ক্ষয় রোধ করা যায়। এ ছাড়া যখন গাড়িতে এলপিজি ব্যবহার করা হয় তখন ‘অটো গ্যাস’ নামে পরিচিত হয়। ১৯১০ সালে আবিষ্কৃত হওয়ার পর ১৯১২ সালে এ গ্যাস বাণিজ্যিকরূপে উৎপাদন শুরু হয়। এটি জ-লে শেষ হলে কোনো অবশেষ থাকে না এবং সালফার নির্গত হয় না। এটি গ্যাসীয় হওয়ায় কোনো পানিদূষণ বা ভূমিদূষণ ঘটে না। এ গ্যাসের স্ফুটনাঙ্ক, কক্ষ তাপমাত্রার নিচে থাকে বিধায় দ্রুতই চাপমুক্ত হয়ে বাতাসে মিশে যায়। তাপ বেড়ে গিয়ে যাতে বিস্ফোরণ না হয় সে লক্ষ্যে স্টিল নির্মিত আধারে সর্বোচ্চ চাপ সহনের মাত্রা পূর্ণ করার বদলে ৮০ থেকে ৮৫ শতাংশ পূর্ণ করা যায়। এলপিজি প্রাকৃতিক গ্যাসের মতো নয়, বরং বাতাসের চেয়ে ভর বেশি হওয়ায় এটি নিচু স্থান ও বেইসমেন্টে জমে থাকতে পারে। এর বিপদগুলো হলো বাতাসের সঙ্গে ছড়িয়ে পড়ার পর আগুনের সংস্পর্শে জ-লে ওঠে এবং অক্সিজেনের স্থান দখল করে অক্সিজেনের অভাবে শ্বাস রোধ করতে পারে। অর্থনৈতিক সুবিধার জন্য বিশ্বের অনেক দেশে রান্নার কাজে এলপিজি ব্যবহার করা হয় এবং জ-ালানির উৎস হিসেবে কোনো কোনো দেশে এটি চাহিদার প্রথমে থাকে। বাংলাদেশেও বিশেষ করে শহরাঞ্চলে এর ব্যবহার বেশ উল্লেখযোগ্য। বলা বাহুল্য, দেশে প্রাকৃতিক গ্যাসের মজুদ কমে যাওয়ার কারণে সিলিন্ডারে বাজারজাত এলপি গ্যাসের চুলায় রান্নাবান্নার প্রচলন দিন দিন বেড়ে চলছে। শহরাঞ্চলের অনেক বাসাবাড়ি, হোটেল, রেস্তোরাঁসহ অনেক প্রতিষ্ঠানে গ্যাস সংযোগ না পাওয়ায় রান্নার কাজে সিলিন্ডারের গ্যাস ব্যবহার করা হয়। বর্তমান যুগে গ্রামাঞ্চলের মানুষের আয় বৃদ্ধি পাওয়ার ফলে অনেক পরিবারই এখন কাঠ, লতাপাতাসংবলিত জ-ালানি চুলার পরিবর্তে গ্যাসের চুলায় রান্না করছে, যা নিশ্চয় দেশের উন্নতি ও অগ্রগতির চি ডিগ্রি বহন করে। কিন্তু সিলিন্ডার গ্যাসের চুলা ব্যবহারে যে ঝুঁকি আছে এবং সেই ঝুঁকি এড়ানোর জন্য যে ধরনের সচেতনতার প্রয়োজন, তার ঘাটতি রয়েছে। ফলে আমাদের দেশে গ্যাস সিলিন্ডার বিস্ফোরণে প্রায়ই মানুষ মারা যাচ্ছে, গুরুতরভাবে দগ্ধ হয়ে অঙ্গ-প্রত্যঙ্গ হারাচ্ছে। যারা গ্যাস সিলিন্ডার ব্যবহার করে, তাদের অবহেলা ও উদাসীনতার কারণে অনেক সময় বিস্ফোরণের ঘটনা ঘটে। দুর্ঘটনা রোধে গ্যাস সিলিন্ডার ব্যবহারের কিছু নিয়ম-কানুন আছে, যা ব্যবহারকারীদের অবশ্যই মেনে চলা উচিত।

সিভিল ডিফেন্স ও ফায়ার সার্ভিসের এক সমীক্ষায় দেখা গেছে, সদ্য বিদায়ী ২০১৮ সালে দেশে গ্যাস দুর্ঘটনা ঘটেছে ১৭৮টি, যা ২০১৭ সালের চেয়ে অনেক বেশি। ২০১৬ সালে দেশে গ্যাস দুর্ঘটনা ঘটে ১৩১টি। আর ২০১৫ সালে ৮০টি গ্যাস দুর্ঘটনা ঘটেছিল। বলার অপেক্ষা রাখে না, কারিগরি ত্রুটি, অসচেতনতা ও অসতর্কতার ফলে দেশে এ ধরনের গ্যাস দুর্ঘটনা ঘটছে এবং দিন দিন তা বেড়েই চলেছে, যা রীতিমতো উদ্বেগের বিষয়। কিন্তু সংশ্লিষ্ট কর্তৃপক্ষ এ সমস্যা সমাধানের জন্য কার্যকর পদক্ষেপ নিচ্ছে বা নেবে বলে মনে হয় না। দেশে গ্যাস দুর্ঘটনা বা অগ্নিকাণ্ডের খবর পেলে ফায়ার সার্ভিসের কর্মীরা সেখানে ছুটে যান। কিন্তু একটি কথা সবারই জানা আছে, ‘Prevention is better than cure.’ অর্থাৎ প্রতিকারের চেয়ে প্রতিরোধ উত্তম। দেশে এ ধরনের দুর্ঘটনা যেন না ঘটে, সে বিষয়ে যথাযথ প্রয়োজনীয় পদক্ষেপ নেওয়া হচ্ছে না। এ বিষয়ে মহামান্য সুপ্রিম কোর্টে আইনজীবী অমিত দাশগুপ্ত জনস্বার্থে একটি রিটও করেছিলেন। সেই রিটের পরিপ্রেক্ষিতে হাইকোর্ট রুলও জারি করেন। প্রাকৃতিক গ্যাস বিতরণে দুর্ঘটনার ঝুঁকি এড়াতে বিবাদীদের ব্যর্থতাকে কেন ‘আইনগত কর্তৃত্ববহির্ভূত’ বলা হবে না এবং প্রয়োজনীয় নিরাপত্তাব্যবস্থা নেওয়ার নির্দেশ কেন দেওয়া হবে না, তা জানতে চাওয়া হয়েছিল ওই রুলে। জ-ালানি বিভাগ গ্যাস সিলিন্ডার বিস্ফোরণ ও দুর্ঘটনার কারণ বিশ্লেষণ করে একটি পরিপত্র জারি করেছে। ওই পরিপত্রে তিনটি ধাপে সতর্কতা অবলম্বনের উপায় বলে দেওয়া হয়েছে। সেগুলো হলো—১. সিলিন্ডার রাখার জন্য নিরাপদ জায়গা নির্ধারণ করা; ২. রান্না শুরুর আগে ও শেষ হওয়ার পর গৃহীত সতর্কতা এবং সিলিন্ডার রাখার সতর্কতামূলক ব্যবস্থা; ৩. রেগুলেটরসহ সিলিন্ডারের খুঁটিনাটি সব পরীক্ষা করে রান্নাঘরে যথাযথভাবে বাতাস আসা-যাওয়ার ব্যবস্থা নিশ্চিত করা। এটি একটি প্রাথমিক পদক্ষেপ। এর পাশাপাশি পরবর্তী সময় নিশ্চয়ই আরো বড় উদ্যোগ নেওয়া হবে; যেমন—সিলিন্ডার ব্যবসার লাইসেন্স দেওয়ার ক্ষেত্রে সর্বোচ্চ সতর্কতা অবলম্বন করা; সব সিলিন্ডার ব্যবসায়ীকে এ ধরনের আদেশ দেওয়া যে সিলিন্ডার বিক্রি বা সিলিন্ডারের সঙ্গে তা ব্যবহারের নিয়ম-কানুন ও প্রয়োজনীয় সতর্কতাসংবলিত লিফলেট বিতরণ করতে হবে ইত্যাদি।

গ্যাস সিলিন্ডার ব্যবহারকারীর সর্বদা স্মরণ রাখা উচিত যে গ্যাস সিলিন্ডার সর্বদা সোজা বা খাড়া করে রাখতে হবে, বাঁকা বা শুইয়ে রাখা যাবে না; টিউব, রেগুলেটর কিংবা অন্য কোনো অংশ লিকেজ হয়েছে কি না, তা চেক করতে ম্যাচের কাঠি বা লাইটার অথবা আগুন জ-ালানো যাবে না; সিলিন্ডার ও চুলার সংযোগ পাইপের সঙ্গে কোনো কিছু প্যাঁচানো যাবে না; একটি সিলিন্ডার থেকে একাধিক সংযোগ দেওয়া যাবে না; নিম্নমানের যন্ত্রাংশ ব্যবহার করা থেকে সর্বদা বিরত থাকতে হবে; গরম টিউব ব্যবহার না করা, টিউব গরম হলে তা দ্রুত পরিবর্তন করা; সিলিন্ডারের আশপাশে মোবাইল ফোন, ক্যামেরা ও অন্য কোনো ইলেকট্রনিক ডিভাইস ব্যবহার না করা, অনাকাঙ্ক্ষিত আগুনের সূত্রপাত হলে তা নিভিয়ে ফেলতে হবে। এ ক্ষেত্রে হাতের কাছে সর্বদা দু-এক বালতি পানি রাখা শ্রেয়। পরিস্থিতি বিবেচনা সাপেক্ষে দ্রুত বাসার বিদ্যুতের মেইন সুইচ বন্ধ করে দেওয়ার পাশাপাশি কাছের গ্যাস সরবরাহকারী প্রতিষ্ঠান অথবা ফায়ার সার্ভিসকে খবর দেওয়া প্রয়োজন। গ্যাস সিলিন্ডার ব্যবহারের ক্ষেত্রে ব্যবহারকারীরা ওপরের সতর্কতা ও নিয়ম-কানুন সঠিকভাবে মেনে চললে দেশে গ্যাস সিলিন্ডারজনিত দুর্ঘটনা রোধ করা বেশির ভাগ ক্ষেত্রেই সম্ভব হবে বলে আশা করা যায়।
লেখক : সহযোগী অধ্যাপক, আইন বিভাগ ড্যাফোডিল ইন্টারন্যাশনাল ইউনিভার্সিটি
অ্যামনেস্টি ইন্টারন্যাশনালের আন্তর্জাতিক সদস্য
kekbabu@yahoo.com

Link: http://www.kalerkantho.com/print-edition/muktadhara/2019/01/21/728208?fbclid=IwAR05MMpLOarSV1YSRSDcsERjQ1xLv9LYTW2LgRze0aI--vZoY8UCT0SYZRE

Pages: 1 2 [3] 4 5 6