39
« on: November 11, 2015, 10:28:25 AM »
ছোটবেলায় ম্যাপ পয়েন্টিঙের সময় ভারতের ম্যাপের নীচের দিকে ছোট ছোট কয়েকটা বিন্দু বিন্দু একে লিখে দিতাম আন্দামান-নিকোবর দ্বীপপুন্জ। তখন কি আর জানতাম কি অপরুপ রুপ নিয়ে সমুদ্রের মাঝে জেগে রয়েছে আন্দামান? আন্দামানের রাজধানী পোর্টব্লেয়ার। বঙ্গোপসাগরে ৫৭২টি দ্বীপ নিয়ে গড়ে উঠেছে আন্দামান ও নিকোবর দ্বীপপূঞ্জ। এর মধ্যে মাত্র ২২ টি তে জনবসতি গড়ে উঠেছে। এখানকার প্রধান ভাষা হল আন্দামানিজ, বাংলা, ইংরাজী, হিন্দী, নিকোবরিজ, তেলেগু, তামিল ইত্যাদি। পোর্ট ব্লেয়ার থেকে কলকাতার জলপথে দূরত্ব - ১২৫৫ কিলোমিটার। বছরে দুইবার বর্ষা হয় এখানে। আন্দামান যাবার দুটি প্রধান পথ - জলজাহাজ অথবা বিমানে। প্রতিদিন দমদম বিমানবন্দর থেকে পোর্টব্লেয়ারের দিকে বেশ কয়েকটি বিমান রওনা হচ্ছে। পোর্টব্লেয়ারে থাকার অনেক রকমের হোটেল রয়েছে। তাছাড়া শহর থেকে দূরে দক্ষিন দিকে ওয়ান্ডুরে বিচের আশে পাশে হোটেলে থাকলে সবুজের মাঝে থাকার আনন্দ পাওয়া যাবে। নির্মল বাতাস, কোনো রকমের দূষন নেই। পের্টব্লেয়ারে পৌছনোর দিন দেখে নেওয়া যায় কভলিন কোভ বিচ। বিচে হেটে জলে পা ভিজিয়ে বিচের ওপর ডক চেয়ারে আধশোয়া হয়ে হলুদ ডাবের জল খেতে খেতে সমুদ্রের ওঠা পড়া দেখতে ভালো লাগে। ৫টার পর দেখে নেওয়া যাবে সেলুলার জেলের লাইট ও সাউন্ড শো। কত মানুষের, কত উদার জীবনের জীবন দানের ফলে ভারতবাসী উপভোগ করছে স্বাধীনতা। সেলুলার জেলের বুড়ো অশ্বথ্ব গাছের গায়ে পরম মমতায় হাত বুলিয়ে আদর করে দিতে ইচ্ছা করবে। এই সেই প্রান যে আজও সাক্ষী আছে সেইসময়ের। চরম কষ্ট ভোগ করা জীবনের বিনিময়ে পাওয়া স্বাধীনতা। পর দিন সারাদিনের জন্য চলে যাওয়া যায় নর্থ বে বিচ। লন্চে করে যেতে হবে পোর্টব্লেয়ারের একটু উত্তরে নর্থ বে বিচ। গ্লাস লাগানো বোট করে দেখা যাবে বিভিন্ন রঙের কোরাল। কোরাল মনে হবে খুব কাছে চলে এসেছে। কোরালের ফাকে ফাকে রঙীন মাছের দল ঘুরে বেড়াচ্ছে। নর্থ বে বিচে ‘সি ওয়াকিং’ সমুদ্রের নীচে হাটানোর ব্যবস্হা, স্নোকেরিং, স্কুবা ডাইভিং ইত্যাদি নানা রকমের জলের খেলা আছে। খাবারের ব্যবস্হা আছে, কেনাকাটাও করা যায়। বিভিন্ন রকমের কোরালের গয়না, মুক্তোর কানের দুল, গলার হার পাওয়া যাচ্ছে অনেক কম দামে। নর্থ বে থেকে লন্চে করে চলে আসা যায় রস আইল্যান্ডে। রস আইল্যান্ড যা ব্রিটিশ সরকারের কর্মক্ষেত্র ছিল। কত যুগ আগে ওখানে জল পরিশোধনের ব্যবস্হা ছিল, বিস্কুট – কেক বানানোর জন্য বেকারি ছিল। এখন এখানে মানুষের বসবাস নেই, তবে অনেক হরিন, খরগোশ আছে।
পরের দিন চাইলে চলে যাওয়া যায় হ্যাভলক আইল্যান্ড। সরকারী ফেরির টিকিট আগের দিন কাটতে হবে লাইনে দাড়িয়ে। ফেরি হ্যাভলক পৌছতে ৪ – ৬ ঘন্টা নেয়। হাই স্পিড ফেরি ‘ম্যাকক্রজ’ ধরা যেতে পারে। হ্যাভলক পৌছতে সময় নেয় ৯০ মিনিট। দিনে দিনে ঘুরে আসা যায় হ্যাভলক থেকে। চাইলে থাকতে পারেন, আনেক হোটেলের ব্যবস্হা আছে। সময় থাকলে ঘুরে নেবেন পাশের নীল আইল্যান্ড। হ্যাভলকে আছে তিনটি বিচ, রাধানগর, কালাপাথ্থার আর এলিফ্যান্ট বিচ। এলিফ্যান্ড বিচে জলের খেলাধুলোর ব্যবস্হা আছে। হ্যাভলকের বিচগুলির জল নীল, আবার কোথাও সবুজ। জল এত স্বচ্ছ যে নীল আকাশের ছায়া, সবুজ গাছের ছায়া জলের মধ্যে প্রতিফলিত হয়। জলের রং বদলায়, নীল, ঘন নীল, সবুজ, সাদা অপরুপ মনে হয়। জলের রঙের সঙ্গে সঙ্গে মনের অনুভূতি স্নিগ্ধ হয়। ভালো লাগে। কালাপথ্থার বিচে কালো রঙের পাথর দেখা যায়। তবে বালির রঙ সোনালী। জলে বা বিচে কোথাও গলা মাটি নেই। হ্যাভলকে অতি অবশ্যই খাবেন রাধানগর বিচের ধারে বিক্রি করা গোটা পাকা পেঁপে, আনারস। কি যে অপূর্ব স্বাদ! পাশে ছোট ছোট ঝুঁপড়ি হোটেলে দূপুরের ভাত খাবেন সুরমাই, কোকারি মাছ আর সব্জি দিয়ে। আসল বাঙাল রান্নার স্বাদ পাবেন। নীল আইল্যন্ড ঘুরে আসতে পারেন। সমুদ্রের মাঝে যাওয়া আসার পথে একদিকে দেখা যায় উত্তর আন্দামানের জঙ্গল অন্চল আর অন্য দিকে দেখা যায় আদিগন্ত সমুদ্র, শান্ত সমুদ্র।
পরের একদিন দেখে নেওয়া যায় ওয়ান্ডুর বিচ, যা পোর্টব্লেয়ার থেকে আধঘন্টার গাড়ির পথে পৌছে যাওয়া যাবে। ওয়ান্ডুর থেকে ছেড়ে লন্চে করে চলে যাওয়া যায় জলি বয় আইল্যান্ড। জলি বয় আইল্যান্ড না খোলা থাকলে রেড স্কিন আইল্যান্ড যাওয়া যায়। সেখানে আনেক রকমের, নান রঙের প্রবালের দেখা মেলে। অবশ্যই একদিন পোর্টব্লেয়ার দেখে নিন। সেলুলার জেল, চাথ্থাম শ মিল, মিউজিয়াম ইত্যাদি। সেদিন ঘুরে নিতে পারেন ভাইপার আইল্যান্ড। আন্দামান গেলাম আর জারোয়া দেখলাম না তা কি কখনো হয়? পুরো একদিন রাখতে হবে জারোয়া জঙ্গল আর পাশের ম্যানগ্রুভ জঙ্গল দেখে নেওয়া যায়। সকাল সকাল বেড়িয়ে পড়তে হবে, জিরাকটাঙের দিকে, সেখানে সকাল ৮।৩০ ও সকাল ৯টার সময় পুলিসের কনভয় জারোয়া জঙ্গলে নিয়ে যায়। কনভয় ধরার সময় জারোয়া জঙ্গল শুরুর মুখে অতি অবশ্যই খাবেন সাউথ ইন্ডিয়ানের হাতের রান্না করা বড়া, ইডলি, ধোসা, সাম্বার আর চাঠনি। আমাদের চিরপরিচিত স্বাদের থেকে একদম আলাদা। দোকানের সাউথ ইন্ডিয়ান দিদি বললেন, জঙ্গলে ঢোকার এক কিমির মধ্যেই দেখা যেতে পারে। সত্যিই তাই, দেখা মিলল, তিন জন জারোয়া যুবক, লাল, নীল রঙের রঙ চঙে সাজ, হাতে কপালে রঙিন কাপড় জড়ানো। গল্প করছিল তিন জারোয়া যুবক, এক জনতো রীতিমতো জিন্স টি শার্ট গায়ে দিয়ে। ফেরার পথে দেখা মিলল তিন টি গ্রুপে আরও ১৩ – ১৪ জনের। বাচ্চারা, যাদের বয়স ১২-১৪ বছরের মধ্যে তারা একদম কিছু গায়ে নেই, আবার যাদের বয়স ৪০ এর ওপর তারাও কোনো মতে লাল, নীল কাপড় কোমরে জড়ানো। সেইভাবে সাজের প্রতি নজর কম। সবার মুখে শরীরে সাদা রঙের দাগ কাটা রয়েছে। পথের পাশে জলের ধারার পাশে দেখা গেল তাদের সাদামাটা পাতার ছাউনি দেওয়া ঝুপড়ি। পুরো জঙ্গলটার পথ অপূর্ব, রেন ফরেস্ট, সেজন্য গাছগুলি সব লম্বা লম্বা এবং ঘন সবুজ। জিরাকটাং থেকে শুরু করে বারাটাং পর্যন্ত জারোয়া বাস। বারাটাঙে ভেসেল করে অন্য পাড়ে গিয়ে ধরতে হল স্পিড বোট, যা নিয়ে গেল ম্যানগ্রুভ জঙ্গলের মধ্য দিয়ে। সমুদ্রের ব্যাক ওয়াটার, দু পাশে এক সাইজের ম্যানগ্রুভের জঙ্গল, নীল আকাশ আর পেঁজা তুলোর মতো মেঘ। জলের বুক চিরে স্পিড বোটে করে ৯ কিমি পথ চলে যাওয়া। সেখান থেকে এক কিমি পায়ে হেটে দেখা যায় প্রচীন গুহা। গুহার হাঁ করে থাকা মুখ আমাদের প্রাচীন সময়ের কথা মনে করিয়ে দেয়। হাতে আরও তিন চার দিন সময় থাকলে চলে যাবেন জাহাজ করে মায়া বন্দর। ঘুরে আসবেন ডিগ্লিপুর। আন্দামান থেকে ঘুরে আসার পর শহুরে জীবনে অনেক দিন তাড়া করবে সমুদ্রের নীল জল, সবুজ জল, স্বচ্ছ জলের রঙীন মাছ।