Daffodil International University

Religion & Belief (Alor Pothay) => Islam => Topic started by: 710001113 on April 22, 2018, 04:34:59 PM

Title: সুলতান সালাহউদ্দিন আইয়ুবী: ক্রুসেডারদের বিরুদ্ধে ইসলামের মহাবীর
Post by: 710001113 on April 22, 2018, 04:34:59 PM
By Abdullah Ibn Mahmud

মিসর আর সিরিয়ার প্রথম সুলতান সালাহউদ্দিনকে পশ্চিমা বিশ্ব চেনে সালাদিন (Saladin) নামে। আইয়ুবী রাজবংশের প্রতিষ্ঠাতা সালাহউদ্দিন ক্রুসেডারদের বিরুদ্ধে চালিয়েছিলেন নানা সেনা অভিযান। তার সালতানাতের অধীনে ছিল মিসর, সিরিয়া, উত্তর ইরাক, হেজাজ, ইয়েমেন ও উত্তর আফ্রিকার কিছু অংশ- এতই বিশাল ছিল তার প্রতিপত্তি। শুধু মুসলিম ইতিহাস নয়, শত্রুর কাছেও তিনি ছিলেন সম্মানিত এক বীর। যারা বীর সালাদিন সম্পর্কে নামটি কেবল শুনেছেন, কিংবা কিংডম অফ হেভেন দেখা পর্যন্তই যাদের জ্ঞানসীমা, তাদের জন্যই আজকের এ পোস্ট; চলুন জেনে নেয়া যাক সুলতান সালাহউদ্দিনের জীবনের নানা দিক।

১১৮৫ সালের দিকে আঁকা সালাহউদ্দিনের ছবি © Ismail al-Jazari

১১৩৭ সালে ইরাকের বর্তমান তিকরিত এলাকায় তার জন্ম, নাম ছিল আসলে ইউসুফ। তার সম্মানসূচক উপাধি ছিল সালাহ-আদ-দ্বীন যার মানে ‘ধর্মের ন্যায়তা/পুণ্য (Righteousness)’।  কুর্দি পরিবার থেকে তিনি এসেছিলেন, আদি নিবাস মধ্যযুগীয় আর্মেনিয়ার প্রাচীন দ্বীন (Dvin) শহরে। যে রাওয়াদিয়া (Rawadiya) গোত্র থেকে তিনি এসেছিলেন সেটা ততদিনে আরবিভাষীদের সাথে মিলেমিশে একাকার হয়ে গেছে।

প্রাচীন দ্বীন শহর; Source: Wikimedia Commons

তার জন্মের পাঁচ বছর আগে, মসুলের শাসক ইমাদুদ্দিন জাঙ্কি এক যুদ্ধে পালিয়ে যাবার সময় টাইগ্রিস নদীর দ্বারা বাঁধাপ্রাপ্ত হন, তখন নদীর উল্টো পাশে তিকরিত দুর্গের রক্ষক ছিলেন সালাহউদ্দিনের বাবা নাজমুদ্দিন আইয়ুব। আইয়ুব তখন ইমাদুদ্দিনের জন্য ফেরির ব্যবস্থা করেন ও তাকে তিকরিতে আশ্রয় দেন।

তাকে আশ্রয় দেবার অপরাধে ১১৩৭ সালে (যে বছর সালাদিনের জন্ম) আইয়ুব পরিবারকে উত্তর মেসোপটিমিয়ার মিলিটারি গ্রিক গভর্নর বহিষ্কার করেন। যে রাতে তারা তিকরিত ছেড়ে চলে যাচ্ছিলেন সে রাতেই জন্ম হয় আমাদের গল্পের নায়ক ইউসুফের, যাকে বিশ্ব পরে চিনবে সালাহউদ্দিন নামে।

তবে উপকারের প্রতিদান পেলেন আইয়ুব, ইমাদুদ্দিন জাঙ্কি তার পরিবারকে মসুলে জায়গা করে দিলেন, এবং তাকে বালবেক (Baalbek) দুর্গের কমান্ডার বানিয়ে দিলেন। তবে ইমাদুদ্দিন মারা যান ১১৪৬ সালে, তার ছেলে নুরুদ্দীন তার জায়গা নেন এরপর।

ততদিনে সালাহুদ্দিন বাস করতে শুরু করেছেন দামেস্কে। তার ছোটবেলার খুব একটা কথা জানা যায় না, তবে দামেস্ক শহরটাকে বেশ ভালোবাসতেন তিনি। সালাহউদ্দিন ইউক্লিড জ্যামিতি, গণিত থেকে শুরু করে আইনও শিখে ফেলেন। কুরআন শিক্ষাও সেরে ফেলেন তখন, আর সাথে সাথে ধর্মতত্ত্ব। সেনাবাহিনীতে যোগ দেয়ার চাইতে ধর্মকর্ম নিয়ে লেখাপড়া করার ইচ্ছা বেশি ছিল তার। কিন্তু ধর্ম ছাড়াও তিনি ইতিহাসের পণ্ডিতও হয়ে যাচ্ছিলেন। আরব ইতিহাস তো জানতেনই, এমনকি আরবি ঘোড়ার বংশ-ইতিহাসও তিনি বাদ দেননি পড়তে। তিনি কুর্দি ও আরবি ভাষায় পারদর্শী ছিলেন।

দামেস্ক শহরে সালাহউদ্দিনের ভাস্কর্য; Source: Wikimedia Commons

নুরুদ্দীনের অধীনের একজন মিলিটারি কমান্ডার ছিলেন আসাদ আল দীন। তিনিই সালাহউদ্দিনের সামরিক ক্যারিয়ার শুরু করিয়ে দেন। তার প্রথম সামরিক অভিযান ছিল ২৬ বছর বয়সে। নুরুদ্দীন আসাদকে পাঠান ফাতিমী খলিফা আল-আদিদ এর উজির শাওয়ারকে সাহায্য করবার জন্য যিনি ছিলেন মিসর থেকে বিতাড়িত। সে অভিযানে সঙ্গে করে নিয়ে যান আসাদ সালাহউদ্দিনকে। মিশনটি সার্থক হয়েছিল।

ঠিক এরপরই যুদ্ধ লেগে যায় ক্রুসেডার-মিসরীয় যুক্তবাহিনীর সাথে। যুদ্ধের জায়গাটা ছিল গিজার পশ্চিমে, নীল নদের পাড়ে। সে যুদ্ধে সালাহউদ্দিন নুরুদ্দীনের বাহিনীর ডান পাশের নেতৃত্ব দেন। বলা হয়, সালাহউদ্দিনের বুদ্ধিতে প্রথমে বাহিনী হেরে যাবার ভান করে প্রস্থান করে এবং এরপর অতর্কিতে আক্রমণ করে বিজয় ছিনিয়ে আনে। এ বিজয়কে ইবনে আল-আছিরের মতে ‘ইতিহাসের অন্যতম সেরা বিজয়’ বলা হয়। এরপর সালাহউদ্দিন তার বাহিনীর অংশ নিয়ে আলেক্সান্দ্রিয়া শহরে চলে যান, এবং সে শহরের পাহারা দিতে থাকেন।

১১৯০ সালের দিকের সালাদিনের মুদ্রা; Source: Wikimedia Commons

একটু আগে বলা ফাতিমী খলিফা আল-আদিদের উজির শাওয়ারের সাথে ক্ষমতা নিয়ে দ্বন্দ্ব চলছিল আসাদের, ওদিকে জেরুজালেম রাজ্যের অ্যামালরিক দ্য ফার্স্টের সাথেও। শাওয়ার সাহায্য চাইলেন অ্যামালরিকের। কিন্তু ১১৬৯ সালে শাওয়ার নিহত হন গুপ্তঘাতকের হাতে, বলা হয় সেটি সালাহউদ্দিনের কাজই ছিল। সে বছর আসাদও মারা যান। তখন নুরুদ্দীন আসাদের একজন স্থলাভিষিক্তকে বাছাই করলেও, উজির হিসেবে খলিফা আল-আদিদ সালাহউদ্দিনকেই নিয়োগ দিলেন ২৬ মার্চ। প্রসঙ্গত উল্লেখ্য, আল আদিদ একজন শিয়া খলিফা ছিলেন, তাই উজির হিসেবে সুন্নি সালাহউদ্দিনকে বাছাই করাটা অবাক করা ছিল।

তবে আনুগত্য খলিফা আল-আদিদের দিকে দেবেন বেশি নাকি নুরুদ্দীনের দিকে, সেটা নিয়ে মনঃদ্বন্দ্বে ছিলেন তিনি। সে বছর, একদল মিসরীয় সেনা আর আমিরের ষড়যন্ত্রে গুপ্তহত্যার মুখে পড়েন সালাহউদ্দিন, কিন্তু গোপন সূত্রে তিনি আগেই খবর পেয়ে গিয়েছিলেন। হোতা ছিল ফাতিমী প্রাসাদের সিভিলিয়ান কন্ট্রোলার। তাকে গ্রেফতার করে হত্যা করেন সালাহউদ্দিন। পরদিন ফাতিমী বাহিনীর পঞ্চাশ হাজার কৃষ্ণবর্ণী সেনা বিরোধিতা করে সালাহউদ্দিনের। এ বিদ্রোহ দমন করতে করতে ২৩ আগস্ট চলে আসে। এরপর থেকে আর কখনো কায়রোর বিরোধিতার সম্মুখীন হতে হয়নি সালাহউদ্দিনকে।

১১৬৯ সালে নুরুদ্দীনের সহায়তায় বিশাল এক ক্রুসেডার আর্মিকে পরাজিত করেন সালাহউদ্দিন। ততদিনে কিন্তু আব্বাসীয় সুন্নি খলিফা আল মুস্তানজিদের সাথে ফাতিমী শিয়া খলিফা আল-আদিদের দ্বৈরথ তুঙ্গে। সালাহউদ্দিন তখন মিসরে নিজের ঘাঁটি শক্ত করছেন। নিজের আত্মীয়দের উচ্চপদ দিলেন তিনি। মালিকি ও নিজের শাফিই মাজহাবের জন্য কলেজ প্রতিষ্ঠা করেন সালাহউদ্দিন তার শহরে।

উনবিংশ শতকে আঁকা সালাহউদ্দিন ©Gustave Doré

মিসরে পাকাপোক্ত হবার পর ১১৭০ সালে দারুম অধিকার করে নিয়ে ক্রুসেডারদের পরাজিত করেন সালাহউদ্দিন সেখানে। গাজা থেকে তখন জেরুজালেমের শাসক অ্যামালরিক নাইটস টেম্পলারদের গ্যারিসন বের করে আনেন ও দারুমের পতন রোধ করতে আসেন। কিন্তু সালাহউদ্দিন তাদের উপেক্ষা করে গাজায় গিয়ে শহরটি অধিকার করে নেন তখন।

১১৭১ সালে নুরুদ্দীনের চিঠি পেলেন সালাহউদ্দিন, তিনি যেন মিসরে আব্বাসীয় খেলাফত প্রতিষ্ঠা করেন। শহরের শাফিঈ মাজহাবের আলেম নাজমুদ্দিন আল খাবুশানি প্রচণ্ড শিয়া বিরোধী ছিলেন, তিনিও সায় দিলেন। মিসরের কয়েকজন আমিরকে হত্যা করা হলো, তবে শিয়া খলিফা আল-আদিদকে বলা হয়েছিল যে, তাদের হত্যা করবার কারণ আসলে খলিফার বিরোধিতা করা। এরপর আল-আদিদ অসুস্থ হয়ে পড়েন, তাকে বিষ দেয়া হয়েছিল, কিন্তু কে দিয়েছিল তা জানা যায় না। অসুস্থ আল-আদিদ সালাহউদ্দিনকে অনুরোধ করেন তার শিশুদের যেন দেখে রাখেন। কিন্তু সালাহউদ্দিন না করে দেন, পাছে আব্বাসীয়রা তাকে বিশ্বাসঘাতকতার জন্য দায়ী করে। কিন্তু পরে তিনি তার নিজের এ কথার জন্য অনুতপ্ত হয়েছিলেন। ১৩ সেপ্টেম্বর মারা যান আল-আদিদ, পাঁচ দিন পর আব্বাসীয় খুতবা ঘোষিত হলো কায়রোতে, খলিফা হলেন আল-মুস্তাদি (حسن المستضی بن یوسف المستنجد)। তিনি ছিলেন সুন্নি আব্বাসীয় খলিফা।

লোহিত সাগরের তীরে আকাবার মন্ট্রিল দুর্গ আর কারাক শহর আক্রমণের জন্য সামরিক অভিযানের উদ্দেশ্যে সে বছরের ২৫ সেপ্টেম্বর মিসর ত্যাগ করলেন; সিরিয়া থেকে যোগ দিলেন নুরুদ্দীন। কিন্তু ফাতিমী ও ক্রুসেডারদের ষড়যন্ত্র নিয়ে খবর শুনতেই সালাহউদ্দিন ফিরে এলেন কায়রোতে। নুরুদ্দীন একাই গেলেন।

সালাহউদ্দিনের সবগুলো অভিযান বর্ণনা করে শেষ করা সম্ভব না এ সংক্ষিপ্ত লেখায়, তাই মূল ঘটনাগুলোই উল্লেখ করা হবে। ১১৭৪ সালের গ্রীষ্মে, নুরুদ্দীন বিশাল এক বাহিনী যোগাড় করছিলেন। কোনো এক কারণে (হয়ত নুরুদ্দীনের ক্রমঃক্রমঃ অর্থ ও সাপ্লাই চাওয়ার প্রতিউত্তর না দেয়ায়), আইয়ুবীরা ভাবতে লাগলো এ বাহিনী কি তবে কায়রো আক্রমণের জন্য? সালাহউদ্দিনকে কি হুমকি ভাবছেন নুরুদ্দীন? কিন্তু ১৫ মে, নুরুদ্দীন অসুস্থ অবস্থায় মারা যান হঠাৎ। ক্ষমতা চলে যায় তার পুত্র সালিহ ইসমাইল (as-Salih Ismail al-Malik) এর কাছে, বয়স তার মাত্র ১১।

সালাহউদ্দিনের সামনে তখন কয়েকটি অপশন। তিনি নিজেই কি ক্রুসেডারদের আক্রমণ করে বসবেন? নাকি ১১ বছরের বালকের কথার আশায় বসে থাকবেন? আচ্ছা, তিনি কি নিজেই সিরিয়া অধিকার করে নিতে পারেন না, এ বালক তো কিছু করবে না, দুনিয়ার হালহাকিকত বুঝে উঠবার বয়সই হয়নি তার এখনো- না এটা করলে মানুষ তাকে মুনাফিক ভাববে, নিজের আগের প্রভুর রাজত্ব আক্রমণ কেউ ভালো চোখে দেখবে না। ক্রুসেডের নেতৃত্ব দেবার অধিকার তখন হারাবেন সালাহউদ্দিন।

আগস্টে সালিহ ইসমাইলের অভিভাবক হিসেবে দায়িত্ব নিলেন আলেপ্পোর আমির ও ক্যাপ্টেন গুমুশ্তিগিন। তিনি তখন প্রতিদ্বন্দ্বীদের সরানোর অঙ্গীকার নিলেন, শুরুটা হবে দামেস্ক (সিরিয়ার রাজধানী বর্তমানে) দিয়ে। দামেস্কের আমির তখন আলেপ্পোর বিরুদ্ধে সাহায্য চাইলেন মসুলের সাইফ আল-দীনের কাছে, যিনি কিনা গুমুশ্তিগিনের আত্মীয়। কিন্তু সাইফ না করে দিলেন। তখন সিরিয়ানরা সালাহউদ্দিনের সাহায্য চাইলো। ব্যাপক সাহায্য নিয়ে সালাহউদ্দিন হাজির হলেন প্রিয় শহর দামেস্কে। বাবার পুরনো বাড়িতে বিশ্রাম নিলেন। চার দিন বাদে দামেস্কের সিটাডেলের দরজা খুলে দেয়া হলো। সালাহউদ্দিন তখন সিটাডেল অধিকার করে নিলেন এবং বাসিন্দাদের কৃতজ্ঞতা গ্রহণ করলেন।

এরপর নিজের ভাইকে দামেস্কের শাসক করে আলেপ্পোর দিকে এগিয়ে গেলেন তিনি। সালিহ প্রাসাদ থেকে বেরিয়ে এসে মানুষকে বললেন যেন তাকে কেউ সালাহউদ্দিনের হাতে তুলে না দেয়, কেউ যেন আত্মসমর্পণ না করে। তার অভিভাবক গুমুশ্তিগিন তখন সাহায্য চাইলেন সালাহউদ্দিনের শত্রু অ্যাসাসিনদের গ্র্যান্ডমাস্টার মাসায়েফের রাশিদ আদ্দিন সিনানের। ১১৭৫ সালের ১১ মে, ১৩ জন গুপ্তঘাতক প্রেরণ করা হলো সালাহউদ্দিনকে মারতে। কিন্তু সকলেই নিহত হয়।

অ্যাসাসিনদের হেডকোয়ার্টার সেই মাসায়েফ দুর্গ; Source: Wikimedia Commons

আবার ত্রিপলির রেইমন্ডও মুসলিম এলাকায় আক্রমণ শুরু করেন। ক্রুসেডারদের বিরুদ্ধে যুদ্ধ করতে তখন সালাহউদ্দিন পশ্চিম সিরিয়ার হমসে চলে যান, এবং অধিকার করে নেন সে শহর যুদ্ধ শেষে। এভাবে করে ১১৭৭ সালে সালাহউদ্দিনের বাহিনী এত শক্তিশালী হয়ে গেল যে ক্রুসেডারদের ত্রাস হয়ে গেলেন তিনি। ১১৮৭ সাল পর্যন্ত  তিনি ক্রুসেডারদের পাশাপাশি নিজের সাম্রাজ্যও বিস্তার করতে থাকেন। তার পতাকার নিচে এলো আলেপ্পো, দামেস্ক, মসুল ও আরো নানা শহর। মিসর, সিরিয়া ও ইয়েমেন জুড়ে প্রতিষ্ঠা হলো আইয়ুবী সাম্রাজ্য। সাম্রাজ্য বিস্তার করার সময় তিনি ক্রুসেডারদের সাথে বিভিন্ন চুক্তিতে ছিলেন যেন তার বাহিনী অন্যত্র ব্যস্ত থাকতে পারে। কিন্তু শাতিলনের রেজিনাল্ড এ চুক্তি ভঙ্গ করে বসেন।

সালাহউদ্দিনের ভাস্কর্য © কায়রো যাদুঘর

ক্রুসেডাররা জেরুজালেম অধিকার করে ছিল বহু বছর। অন্যান্য ক্রুসেডার শহরগুলো অধিকার করার পর নজর দিলেন সালাহউদ্দিন জেরুজালেমের দিকে। তিনি চাইলেন বিনা রক্তপাতে শহরটি অধিকার করবার, কিন্তু ভেতরের বাসিন্দারা জানালো, দরকার হলে এ পবিত্র শহর ধ্বংস করে দেবে তবুও মুসলিমদের কাছে হস্তান্তর করবে না। জেরুজালেমের বালিয়ান অফ ইবেলিন হুমকি দিলেন, যদি জেরুজালেমের খ্রিস্টান অধিবাসীদের মুক্তিপণের বিনিময়ে মুক্তির শর্ত মেনে না নেয়া হয় তবে ভেতরের জিম্মি পাঁচ হাজার মুসলিমদের এক এক করে হত্যা করা হবে, এবং মুসলিমদের পবিত্র মসজিদুল আকসা ও ডোম অফ দ্য রক ধ্বংস করা হবে। সালাহউদ্দিন মেনে নিলেন। খ্রিস্টানদের যে মুক্তিপণ তিনি ধার্য করলেন সেটা আজকের হিসেবে চার হাজার টাকা।

জেরুজালেমের খ্রিস্টান যাজক হেরাক্লিয়াস দান করে দিলেন অর্থ যার দ্বারা আঠারো হাজার গরিব খ্রিস্টানের মুক্তিপণের টাকা উঠল। বাকি রইল পনেরো হাজার, তাদের দাসত্ব বরণ করতে হবে।

১১৮৭ সালের সেপ্টেম্বরের ২০ তারিখ শুরু হওয়া সালাহউদ্দিনের হাত্তিন যুদ্ধফেরত ২০,০০০ সেনা কর্তৃক করা জেরুজালেম অবরোধ শেষ হয় অক্টোবরের ২ তারিখ। সেদিন আত্মসমর্পণ করে জেরুজালেম। শেষ হয়ে গেল কিংডম অফ জেরুজালেম।

জেরুজালেম জয় করে নিলেন সালাহউদ্দিন; Source: iTravelJerusalem

এর আগে যখন মুসলিমদের হারিয়ে ক্রুসেডাররা জেরুজালেম দখল করেছিল সেদিন মুসলিমদের কচুকাটা করে হাঁটু পর্যন্ত রক্তের বন্যা বয়ে দিয়েছিল তারা। তাই তারা আশংকা করছিল সালাহউদ্দিন এমনটা করবেন কিনা চুক্তিভঙ্গ করে। না, তিনি করেননি। তিনি যারা ক্ষতিপূরণ দিয়েছিল তাদের তো যেতে দিলেনই, যারা দিতে পারেনি তাদেরও বিনা মুক্তিপণে চলে যেতে দিলেন।

জেরুজালেম বিজয়ের পর সালাহউদ্দিন প্রাক্তন ইহুদী বাসিন্দাদের বললেন, তারা শহরে ইচ্ছেমত  আবার বসবাস করতে পারে।

হয়ত ভাবছেন কাহিনী এখানেই শেষ। কিন্তু না, জেরুজালেম জয় করতে গিয়ে সালাহউদ্দিন একটা বিশাল ভুল করেছিলেন, সেটি হলো, তিনি খ্রিস্টানদের টায়ার (Tyre) শহর জয় না করেই এদিকে এসেছিলেন। ইসলামে বেশি গুরুত্বপূর্ণ জেরুজালেম জয়ের জন্য তার তর সইছিল না।

জেরুজালেমের পতনের পর ইংল্যান্ডের রাজা রিচার্ড দ্য লায়নহার্টের উদ্যোগে ও অর্থায়নে শুরু হয় থার্ড ক্রুসেড (১১৮৯-১১৯১)। টায়ার শহর থেকে খ্রিস্টানরা যোগ দিল তার সাথে। আক্রা (Acre) শহরে মুসলিম বাহিনীকে পরাজিত করে রিচার্ডের বাহিনী। নারী ও শিশুসহ প্রায় তিন হাজার বন্দী মুসলিমকে হত্যা করেন রিচার্ড। এরপর ১১৯১ সালের ৭ সেপ্টেম্বর আরসুফ যুদ্ধে সালাহউদ্দিনের বাহিনীর মুখোমুখি হন রিচার্ড। সে যুদ্ধে ব্যাপক ক্ষয়ক্ষতির সম্মুখীন হন সালাহউদ্দিন, যুদ্ধক্ষেত্র ত্যাগ করতে বাধ্য হন বাহিনীসহ। রিচার্ড জাফফা শহর দখল করে নেন।

সেই আক্রা দুর্গ; Source: Visions of Travel

ওদিকে সালাহউদ্দিন মিসর ও ফিলিস্তিনের মাঝের আস্কালন শহরের নিরাপত্তা বাড়িয়ে দেন, যেন ক্রুসেডারদের হাতে এর পতন না হয়। তারা দুজন শান্তিচুক্তির পথ খুঁজতে লাগলেন। রিচার্ড প্রস্তাব দিলেন, রিচার্ডের বোন সিসিলির রানী জোয়ানকে সালাহউদ্দিনের ভাই বিয়ে করুক, আর বিয়ের উপহার হিসেবে জেরুজালেম দিয়ে দেয়া হোক। সালাহউদ্দিন এ প্রস্তাব উড়িয়ে দিলে রিচার্ড বললেন সালাহউদ্দিনের ভাই যেন খ্রিস্টান হয়ে যান।

১১৯২ সালে রিচার্ড জেরুজালেম থেকে ১২ মাইল দূরে থেকেও জেরুজালেম আক্রমণ করলেন না, বরং আস্কালনের দিকে গেলেন। ওদিকে সালাহউদ্দিন গেলেন জাফফা পুনরুদ্ধার করতে, প্রায় করেই ফেলেছিলেন, কিন্তু আস্কালান থেকে ছুটে এলেন কিং রিচার্ড এবং সালাহউদ্দিনকে পরাজিত করলেন শহরের বাইরের এক যুদ্ধে। এটাই ছিল থার্ড ক্রুসেডের শেষ যুদ্ধ। সালাহউদ্দিনকে মেনে নিতে হলো রিচার্ডের শর্তগুলো, টায়ার থেকে জাফফা পর্যন্ত ক্রুসেডারদের অধীনেই থাকবে। মেনে নিলেন যে, খ্রিস্টান তীর্থযাত্রীরা বিনা অস্ত্রে জেরুজালেম ভ্রমণ করে আসতে পারবে। তিন বছর পর্যন্ত কেউ কাউকে আক্রমণ করবে না।

কিন্তু তিন বছর আর বাঁচেননি সালাহউদ্দিন। কিং রিচার্ড চলে যাবার পর এক জ্বরে আক্রান্ত হয়ে দামেস্কে মারা গেলেন তিনি, ১১৯৩ সালের ৪ মার্চ। মৃত্যুর আগে তিনি সম্পত্তি দান করে গিয়েছিলেন গরীব দুঃখীদের। মাত্র এক স্বর্ণমুদ্রা আর চল্লিশ রৌপ্যমুদ্রা ছাড়া আর কিছুই ছিল না তার বাকি। তার জানাজা-দাফন-কাফনের টাকাটাও হচ্ছিল না। দামেস্কের উমাইয়া মসজিদের বাহিরের বাগানে তাকে দাফন করা হয়। সাত শতাব্দী পর জার্মানির রাজা দ্বিতীয় উইলহেম সালাদিনের কবরের জন্য একটি মার্বেলের শবাধার দান করেন। এখন আপনি সেখানে জিয়ারত করতে গেলে দেখতে পাবেন কবরের ওপরে দুটো শবাধার, একটি পুরনো ও আসল কাঠের, আর আরেকটি এই মার্বেলের।

তিনি পাঁচ কিংবা বারোজন পুত্র রেখে গিয়েছিলেন। তার অসংখ্য প্রজা হজ্ব করবার সৌভাগ্য ও নিরাপত্তা সালাহউদ্দিনের কল্যাণে পেলেও, সালাহউদ্দিন হজ্ব করবার সৌভাগ্য পাননি, যদিও তার পরিকল্পনা ছিল।

সালাহউদ্দিনের কবর; Source: Wikimedia Commons

ইউরোপজুড়ে সালাহউদ্দিনের নানা ঘটনা প্রচলিত ছিল, এখনো আছে। চুক্তির পর রিচার্ড আর সালাদিন একে অন্যকে অনেক উপহার দিয়েছিলেন। একবার একটা ঘটনা ঘটেছিল, এক খ্রিস্টান মহিলার তিন মাসের বাচ্চা চুরি হয়ে যায়, এবং সেই বাচ্চাকে বাজারে বিক্রি করে দেয়া হয়। খ্রিস্টানরা তাকে বলল সুলতান সালাহউদ্দিনের কাছে যেতে। মহিলাটির কষ্ট জানবার পর সালাহউদ্দিন নিজের টাকায় বাচ্চাটি কিনে নেন আবার, এবং মহিলাটিকে ফিরিয়ে দেন। সালাহউদ্দিনের দরবারে অশ্রু গড়িয়ে পড়ে মহিলার চোখ থেকে। সালাহউদ্দিন একটি ঘোড়ায় করে তাকে নিজের ক্যাম্পে পাঠিয়ে দেন।

মাইকেল হ্যামিল্টনের লস্ট হিস্টোরি বইতে আমরা জানতে পারি, ১১৯২ সালে আক্রা আক্রমণের সময় রিচার্ড অসুস্থ হয়ে পড়েন। তখন সালাহউদ্দিন শত্রু রিচার্ডের চিকিৎসার জন্য নিজের ব্যক্তিগত ডাক্তারদের পাঠিয়ে দিয়েছিলেন। জ্বর নিয়ন্ত্রণে রাখবার জন্য পাঠান বরফ, তাছাড়া ফলফলাদিও পাঠান। আরেকটি ঘটনা আমরা জানতে পারি, যখন রিচার্ড নিজের ঘোড়া হারিয়ে বিশাল মুসলিম বাহিনীর সামনে একা দাঁড়িয়ে থাকেন ময়দানে, তখন মুসলিমরা তাকে আক্রমণ করেনি। বরং, সুলতান সালাহউদ্দিন তার জন্য দুটো ঘোড়া পাঠিয়ে দেন যেন সমানে সমানে যুদ্ধ হতে পারে।

ইতিহাসের পাতা আমাদের বলে না যে, রিচার্ড কোনোদিন সালাহউদ্দিনের সাথে সামনা সামনি দেখা করেছেন, সবই হয়েছিল দূতের মাধ্যমে। কিন্তু তিনি প্রচণ্ড রকমের সম্মান করতেন সালাহউদ্দিনকে, তার সাহস ও বীর্যের তিনি খুব প্রশংসা করতেন। সালাহউদ্দিনও সম্মান করতেন রিচার্ডকে। সে যুগে একজন মুসলিমের নাম ইউরোপে সম্মানের সাথে নেয়া হচ্ছে সেটাই ছিল অবাক ব্যাপার। সালাদিন নামখানা আজও উজ্জ্বল ইতিহাসের তাম্রলিপিতে।