8
« on: May 16, 2012, 05:15:07 PM »
[এই গল্পটি সচলায়তন গল্প সংখ্যা- পূর্ণমুঠিতে প্রকাশিত। পুলিশের জলকামানে একজন শিক্ষক মারা গেছেন। এই গল্প সেই ক্ষোভের মূলে না হয় আরেকটু ঘি ঢালুক, আগুন জ্বালুক আমাদের বুকে।]
নিখিলেশ বাবু। আমার মাষ্টারমশায়। সেই ছোটবেলায় যেদিন প্রথম বাবার হাত ধরে, গাঁয়ের মেঠো পথ বেয়ে, সবুজ ঘাসে পা মাড়িয়ে এক বুক ধুকপুকানি নিয়ে টিনের চালার পাঠশালায় পা রাখলাম, সেদিন দেখেছিলাম নিখেলেশ বাবুকে। দিব্যকান্তিঋজুমাষ্টারমশায় এসে বাবার সাথে হাত মেলালেন, সযত্নে আমার মাথায় হাত বুলিয়ে নাম জিজ্ঞেস করেছিলেন। সত্যি বলতে কি সেই প্রথম দিন থেকেই আমি মাষ্টারমশায়ের গুনমুগ্ধ শিষ্যে পরিণত হয়ে গিয়েছিলাম। তাঁর হাত ধরেই আমার জ্ঞানচক্ষুর পাপড়িগুলো উন্মেষিত হয়েছিল সত্যের নির্মল আলোকে। তিনি যখন আমাদের কবিতা পড়াতেন তখন এক অবিমিশ্র ভালো লাগায় মন কানায় কানায় পরিপূর্ণ হয়ে যেতো, তন্ময় হয়ে যেতাম সবাই অপূর্ব এক অব্যক্ত শিহরণে। তিনিই প্রথম শিখিয়েছিলেন, সদা সত্য কথা বলিব, মিথ্যে বলা মহাপাপ, অন্যায়কারী আর অন্যায় সহ্যকারী উভয়েই সমান অপরাধী এই রকম আরো কতো কি। তিনি চেয়েছিলেন আমাদের হৃদয় গোলাপকে শুদ্ধতায় পরিস্ফুট করতে। সময় কেটে গেলো পল, মিনিট, ঘন্টার কাঁটা পেরিয়ে, আমি ও প্রাথমিকের ল্যাঠা চুকিয়ে ঢুকলাম মাধ্যমিকে। তখনো নিখিলেশ বাবু আমার নিয়মিত খোঁজ নিতেন, উৎসাহ দিতেন।
সে যাই হোক। আমি ক্রমে মাধ্যমিক, উচ্চ মাধ্যমিক পেরিয়ে ভর্তি হলাম দেশের সেরা বিদ্যাপীঠের একটাতে। বিশ্ববিদ্যালয়ের সেই রঙিন ভুবনে আমিও সব রঙিন কাজে জড়িয়ে পড়লাম। তখন আমি নিখিলেশ বাবুর দেয়া ধ্যান-ধারণা থেকে যোজন যোজন দূরে। গ্রামের সোদাঁ মাটির গন্ধ আমি ভুলে গেছি নতুন টাকার কড়কড়ে গন্ধে, ঠুনকো মূল্যবোধের ধব্জা ওড়ানো যে নির্বোধের কাজ সে আমি বেশ ভালই বুঝতে শিখেছি ততদিনে। টেন্ডারবাজি, চাঁদাবাজি ওসব কোন ব্যাপারই নয়। আমি ক্ষমতার স্বাদ পেয়েছি, বাঘ যেমন প্রথম রক্তমাংসের স্বাদ পেলে পাগল হয়ে ওঠে ঠিক তেমনি আমি ও ক্ষমতার মোহে অন্ধ হয়ে গেলাম।
বিশ্ববিদ্যালয়ের পার্ট যখন শেষ করলাম তখন আমার দল ক্ষমতায়। আমার গুরু তখন সরকারের ক্ষমতাধর মন্ত্রী। তিনি আমায় তার পি. এস. করে নিলেন। এখন আমি ও অনেক ক্ষমতাধর। আমার এক ইশারায় অনেকে মুহুর্তে আকাশ থেকে মাটিতে নেমে আসে আবার অনেকেই আকাশে ভাসে। আমার মুখে গর্বের হাসি, অহংকারের ছায়া। হ্যাঁ তুমি পেরেছো। আরো অনেক কিছু পারবে।
আজ আমার খুব টাইট সিডিউল। সকালে গুরুর দুটো জনসভা, তারপর শিক্ষকদের অনশন ভাঙ্গা, আরো....। আমি বেরিয়ে পড়ি। দুপুরে মন্ত্রীর সাথে যাই সচিবালয়ের বাইরে আন্দোলনরত শিক্ষকদের অনশন ভাঙ্গাতে। শিক্ষকদের একাংশ অনশন ভাঙ্গলেন মন্ত্রীর শরবত খেয়ে, আরেক অংশ তখনো দূরে প্ল্যাকার্ড নিয়ে বিক্ষোভ করছিলেন। তারা দাবী আদায় না হওয়া পর্যন্ত অনশন করে যাবেন। মন্ত্রী এখন শিক্ষকদের উদ্দেশ্যে ভাষণ দিচ্ছেন। হঠাৎ দূরে একজনের উপর চোখ আটকে গেলো। আমার মাষ্টারমশায় নিখিলেশ বাবু না? সেই ঋজু শরীর আর নেই কিন্তু সেই গৌরবর্ণের নির্বিকার মুখ আজো এক দেখাতে চেনা যায়। তাঁর হাতে প্ল্যাকার্ড- অবিলম্বে 10% বেতন বৃদ্ধি চাই। আমি ভাবি, 10% বেতন বৃদ্ধির জন্য কতো নিখিলেশ বাবুকে আমরণ অনশন করতে হয় আর আমার গুরুর বেতন বাড়াতে লাগে কলমের একটি মাত্রখোঁচা!
আমার উপর গুরু দ্্বায়িত্ব পড়েছে। শিক্ষকদের যে একাংশ অনশন করে যাচ্ছেন তাদের সাথে সমঝোতা করতে হবে, মিথ্যে আশ্বাস দিয়ে তাদের আন্দোলন বানচাল করে দিতে হবে। সেই শিক্ষক সমাজের প্রতিনিধিদের একজন আমার মাষ্টারমশায়। আমি আজ তাঁর সাথে মিটিং-এ বসবো, মুখোমুখি হবো। তাঁকে আশ্বস্ত করবো সব দাবি মেনে নেয়া হবে বলে; যিনি আমাকে প্রথম শিখিয়েছিলেন 'মিথ্যে বলা মহাপাপ, সদা সত্য কথা বলিবে'। তিনি এক বুক শান্তি নিয়ে ঘরে ফিরে যাবেন।
আর- আরেকটি আন্দোলনকে ব্যর্থ করে দেওয়ার সাফল্যের পালক যুক্ত হবে আমার রাজনৈতিক ক্যারিয়ারে।
আমি একদিন মন্ত্রী হবো।