Show Posts

This section allows you to view all posts made by this member. Note that you can only see posts made in areas you currently have access to.


Topics - Noor E Alam

Pages: 1 2 [3] 4 5
31

১৯৩৭ সাল—দ্বিতীয় বিশ্ববিযুদ্ধের অব্যবহিতপূর্ব পটভূমিক বছর। গৃহযুদ্ধ কবলিত স্পেন তখন হিটলারপন্থী স্বৈরতান্ত্রিক একনায়ক ফ্রাঙ্কের শাসনাধীনে। ফ্রাঙ্কোর উগ্র জাতীয়তাবাদী প্রতিরক্ষা বাহিনী কর্তৃক স্পেনের বাস্ক প্রদেশের গোয়ের্নিকায় নিক্ষপ্ত বোমায় তাৎক্ষণিকভাবে প্রায় দু হাজার মানুষ মারা গেলে, আহত হলো অরো বহু হাজার। এ হৃদয়বিদারক ঘটনার প্রতিচ্ছবি ও প্রতিবাদ হিসেবে পাবলো পিকাসো আঁকলেন বিশ্ইতিহাসের অন্যতম মহা চিত্রকর্ম গোয়ের্নিকা। সৈন্যরা পিকাসোকে ধরে নিয়ে গিয়ে এক নায়ক ফ্রাঙ্কোর সামনে  হাজির করলো। চরমতম কষ্টের বোধ থেকে অঙ্কিত মানবতার জয়গানে ভরা ওই পরমতম সুন্দর চিত্রকর্ম গোয়ের্নিকার দিকে অঙ্গুলি নির্দেম করে ফ্রাঙ্কো পিকাসোকে জিজ্ঞেস করলেন, ইউ ডিড ইট—এটি তুমি করেছ? পিকাসো বললেন, নো, ইউ ডিড ইট—না, তোমরা এটি করেছ। আসলেই তো, ফ্রাঙ্কোরা যা করেছিল, পিকাসো সেটিকেই যত্নসহকারে রঙতুলিতে এঁকেছিলেনমাত্র।

ফ্রাঙ্কোর সঙ্গে রহিমআফরোজ (বাংলাদেশ)লিমিটেডের গ্রুপ ডিরেক্টরের পার্থক্য হচ্ছে, ফ্রাঙ্কো ধ্বংস করেছিলেন, আর নিয়াজ রহিম তার মেধা ও পরিশ্রম দিয়ে এ দেশের ব্যবসা ও শিল্পখাত তথা অর্থনীতিকে তিল তিল করে গড়ে উঠতে সহায়তা করেছেন।

নিয়াজ রহিমের জন্ম ১৯৫৪ সালের ১৭ সেপ্টেম্বর। বাবা প্রয়াত আব্দুর রহিম, মা মিসেস আয়েশা রহিম, যিনি আল্লাহর অসীম কৃপায় তিন ভাই আফরোজ রহিম, ফিরোজ রহিম ও নিয়াজ রহিমের মাথার ওপর ছায়া হয়ে এই ৮৭ বছর বয়সেও বেঁচে আছেন।

সেন্ট প্লাসিড স্কুল, বিএএফ শাহীন স্কুল ও নটরডেম কলেজের ছাত্র নিয়াজ রহিম ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় থেকে ১৯৮০ সালে আইন শাস্ত্রে স্নাতক সম্মান ও ১৯৮২ সালে কানাডার কনকর্ডিয়া বিশ্ববিদ্যালয় থেকে মার্কেটিং ম্যানেজমেন্টে এমবিএ ডিগ্রি অর্জন করেন।

কানাডা অবস্থানকালেই ১৯৮২ সালে তাঁর বাবা মারা যান এবং সৃষ্ট পরিস্থিতিতে দেশে ফিরে এসে সে বছরই তিনি অন্য ভাইদের সাথে মিলে বাবার হাতে ১৯৫৪ সালে শুরু হওয়া ব্যবসায়ের হাল ধরেন। প্রথমেই তিনি দায়িত্ব নেন রিনিউঅ্যাবল সোলার এনার্জি বা নবায়নযোগ্য সৌরবিদ্যুৎ উৎপাদন প্ল্যান্ট স্থাপন সংক্রান্ত কার্যক্রমের। কাজটি ব্যবসায়িক বটে, যেখানে মুনাফা অবশ্যই অন্যতম পূর্বশর্ত। কিন্তু মুনাফার শর্তকে ছাড়িয়ে গিয়ে চোখে মুখে তাঁর স্বপ্ন বিদ্যুৎবিহীন আলোবিহীন গ্রাম বাংলার অযুত অন্ধকার গ্রামকে তিনি সৌর বিদ্যুতের আলোয় আলোকিত করে তুলবেন। পৃথিবীর আগামী দিনের জ্বালানী চাহিদা মিটাবার জন্য নবায়নযোগ্য সৌর বিদ্যুৎ উৎপাদনের লক্ষ্যে বর্তমান বিশ্ব যে প্রাণান্তকর প্রচেষ্টায় লিপ্ত, আজ থেকে প্রায় চার দশক আগেই তিনি সে যাত্রা শুরু করেন, যা তার দূরদর্শীতা ও নেতৃত্বসূলভ গুণাবরীর পরিচয়কেই তুলে ধরে।

বৃটিশ ও পাকিস্তান আমল থেকেই এ দেশে বৃটিশ কোম্পানি লুকাসের ব্যাটারির ছিল একচ্ছত্র ব্যবসা। বাবা আব্দুর রহিম ছিলেন এ দেশে লুকাস ব্যাটারির একমাত্র ডিলার। ১৯৮০ সালে লুকাস এ দেশ থেকে ব্যবসা গুটিয়ে চলে যাবার সিদ্ধান্ত নিলে রহিমআফরোজ তা অধিগ্রহণ করে। মজার ব্যাপার হচ্ছে, শুধু ব্র্যান্ড ইমেজ কিনে নেবার জন্য পৃথিবীজুড়ে যেখানে কোটি কোটি ডলার ব্যয়ের ব্যবসায়িক সংস্কৃতি চালু রয়েছে সেখানে সে প্রতিষ্ঠিত সংস্কৃতির বিপরীতে দাঁড়িয়ে লুকাসের মতো বিশ্বব্যাপী খ্যাতিমান ব্র্যান্ড ইমেজকে পরিত্যাগ করে তারা এ ব্যাটারির নামকরণ করলেন ‘রহিমআফরোজ’। কতটা আত্মবিশ্বাস, প্রত্যয় ও দেশাত্মবোধ থাকলে এটি সম্ভব তা যে কেউ অনুধাবন করতে পারেন। উল্লেখ্য, ব্যাটারি রফতানির ক্ষেত্রে রহিমআফরোজ রাংলাদেশের প্রেক্ষাপটে শুধু অগ্রণী নয়—বিশ্ব বাজারেও অন্যতম শরীক।

একই কথা ডানলপ টায়ারের ক্ষেত্রেও প্রযোজ্য। একই প্রক্রিয়ায়, একই আত্মবিশ্বাসে ব্রিটিশ ব্যাটারি লুকাসের মতো ব্রিটিশ টায়ার ডানলপও এখন ‘রহিমআফরোজ’।

ইংরেজ, পর্তুগীজ বা ফরাসীদের আগমনের সুবাদে এ দেশ থেকে ইউরোপে কমবেশি যাতাযাতের চল সেই ষোড়শ শতক থেকেই রয়েছে। আর সে যাতায়াতের সুবাদেই শীতপ্রধান ইউরোপে এক ঘরের ছায়ায় সব পণ্য বিক্রির ডিপার্টমেন্টাল স্টোর, মল বা সুপার মার্কেট বহুদিন পর্যন্ত তাজ্জব হয়ে দেখেছি এবং দেশে ফিরে গল্প করেছি। কিন্তু নিজেদের দেশেও তেমনটি দেখার কথা প্রায় কেউই ভাবিনি। রহিমআফরোজ এ দেশে প্রথম চালু করল আধুনিক সুপার স্টোর ‘আগোরা’। গ্রিক শব্দ আগোরার মানে হচ্ছে মার্কেট প্লেস বা বিপণী বিতান বা বিপণী।

ব্যবসা পরিচালনায় অতি উন্নত নৈতিকতা রক্ষা করে চলা এবং ক্রেতা ও ভোক্তার আস্থা ও সন্তুষ্টি অর্জনের ক্ষেত্রে রহিমআফরোজ এক অনন্য প্রতিষ্ঠান। রহিমআফরোজের সকল পণ্য ও সেবার ক্ষেত্রে রাজধানী কিংবা প্রত্যন্ত গ্রাম সর্বত্রই একই মান ও মূল্য প্রযোয্য যা বাংলাদেশের খুব বেশি প্রতিষ্ঠানের পণ্য ও সেবার ক্ষেত্রে ঘটতে দেখা যায় না।

পাঁচটি বৃহৎ খাতের আওতায় বহুসংখ্যক পণ্য ও সেবার সমন্বয়ে গড়া রহিমআফরোজ গ্রুপের কর্মীসংখ্যা এখন প্রায় ১৫ হাজার এবং এই প্রতিষ্ঠান সমূহের বার্ষিক টার্নওভারের পরিমাণ প্রায় ১৩ হাজার কোটি টাকা।

ব্যবসায়ের পাশাপাশি সামাজিক দায়িত্ব পালনের ক্ষেত্রেও রহিমআফরোজ পিছিয়ে নেই। দরিদ্র ছেলেমেয়ের জন্য শিক্ষাবৃত্তি, এতিম ও দুস্থদেরকে আর্থিক সহায়তা প্রদান এবং নানা সামাজিক কল্যাণে প্রতিবছরই উল্লেখযোগ্য পরিমাণ অর্থ ব্যয় করে যাচ্ছেন। আর এসব কাজকে একটি স্থায়ী ভিত্তি ও কাঠামো দানের জন্য গড়ে তুলেছেন অলাভজনক প্রতিষ্ঠান ‘রুরাল সার্ভিস ফাউন্ডেশন’, ‘সেন্টার ফর যাকাত ফান্ড’ ইত্যাদি।

নিয়াজ রহিম বর্তমানে কানাডা-বাংলাদেশ চেম্বারের সহ-সভাপতি, এফবিসিসিআই, ঢাকা চেম্বার ও মেট্রোপলিটন চেম্বারের পরিচালক, অস্ট্রেলেশিয়া-বাংলাদেশ চেম্বার, বাংলাদেশ-মালয়েশিয়া চেম্বার ও জাতীয় ভোক্তা অধিকার পরিষদের সদস্য। ইতিপূর্বে তিনি রাষ্ট্রায়ত্ত্ব অগ্রণী ব্যাংক ও বিডিবিএল-এর সরকার নিয়োজিত পরিচালক হিসেবে দায়িত্ব পালন কেরেছেন। বর্তমানে তিনি বাংলাদেশ সুপার মার্কেট মালিক সমিতির সভাপতি।

প্রচলিত পারিবারিক সংজ্ঞা অনুযায়ী স্ত্রী মিসেস সাইয়িদা ফারজানা রহিম এবং তিন পুত্র ফারাজ আব্দুর রহিম, নাওয়াজ আব্দুর রহিম ও ফায়েজ আব্দুর রহিমকে নিয়ে তাঁর পরিবার গঠিত হলেও বাস্তবে ভাই, মামা, খালু ও ছোট ভাইদের ছেলেমেয়েদেরকে নিয়ে বৃহত্তর পারিবারিক বন্ধনের মধ্যেই তাঁর বসবাস এবং ব্যবসা পরিচালনার ক্ষেত্রেও ভবিষ্যতে কে, কীভাবে উত্তরাধিকারী হবেন এবং কে কোন দায়ত্ব পালন করবেন, সে উত্তরাধিকার পরিকল্পনাও বার্ষিক পারিবারিক সম্মেলনে আলাপ আলোচনার মাধ্যমে ঠিক করা আছে। এবং এটিও ঠিক করা আছে যে সন্তান বলেই পুত্ররা সরাসরি বাবার আসনে বসতে পারবেন না—তাদেরকে পিতা ভিন্ন অন্য নির্বাহীদের অধীনে কাজ করে কাজ শিখে সে পর্যায়ে পৌঁছাতে হবে।

(ড্যাফোডিল ইন্টারন্যাশনাল ইউনিভার্সিটিতে অনুষ্ঠিত ইন্ড্রাস্ট্রি একাডেমিয়া লেকচার সিরিজ অনুষ্ঠানে পঠিত বক্তব্য)
লেখক: পরিচালক, ক্যারিয়ার ডেভলপমেন্ট সেন্টার (সিডিসি), ড্যাফোডিল ইন্টারন্যাশনাল ইউনিভার্সিটি

32

অনেকগুলো শিল্পপ্রতিষ্ঠানের মালিক এক ভদ্রলোক আমাকে ফোন করে প্রায় ভর্ৎসনার সুরে বললেন, ‘আপনারা কী সব নিয়ে লেখালেখি করেন? দেশের এক নম্বর সমস্যা নিয়ে তো কিছু লেখেনটেখেন না।’

আমি হেসে বললাম, ‘এক নম্বর সমস্যা কোনটা?’

‘শোনেন, মশিউল সাহেব, আমার প্রতিষ্ঠানে কিছু লোক দরকার। এক লাখ, দেড় লাখ টাকা বেতন দেব, দুই মাস ধরে পত্রিকায় বিজ্ঞাপন দিচ্ছি, কিন্তু লোক পাচ্ছি না।’

‘বলেন কী? দেশে লাখ লাখ উচ্চশিক্ষিত বেকার ছেলেমেয়ে ঘুরে বেড়াচ্ছে, আর আপনি এত টাকা বেতন দিতে চেয়েও লোক পাচ্ছেন না?’

‘না, সত্যিই পাচ্ছি না। ইন্টারভিউ দিতে আসে, অনার্স–মাস্টার্স পাস করা তরুণেরা ইন্টারভিউ দিতে আসে, কিন্তু কিচ্ছু জানে না। ঢাকা ভার্সিটি থেকে ইংলিশে মাস্টার্স করে আসছে, দুইটা সেনটেন্স শুদ্ধ করে ইংলিশ লিখতে পারে না। কথা বললে মনে হবে আইকিউ লেভেল এত কম! দুনিয়ার কোনো খোঁজখবরই রাখে না।’

অভিযোগ নতুন নয়। ফলে আমার বিশেষ কোনো প্রতিক্রিয়া হলো না। শিল্পপতি ভদ্রলোক অবিরাম বলে চললেন। প্রায় সবই অভিযোগ। দেশের চাকরিপ্রার্থীদের মধ্যে দক্ষ লোক পান না বলে ভারত, শ্রীলঙ্কা, মালয়েশিয়া ইত্যাদি দেশ থেকে উচ্চ বেতনে লোক নিয়ে আসেন। বাংলাদেশের তৈরি পোশাকশিল্পসহ শিল্প ও সেবা খাতের উচ্চ স্তরের পদগুলোতে প্রচুর বিদেশি লোক কাজ করে, তারা হাজার হাজার ডলার নিয়ে যাচ্ছে। এভাবে বিপুল পরিমাণ বৈদেশিক মুদ্রা বিদেশে চলে যাচ্ছে।

ভদ্রলোক খেদের সঙ্গে আরও বললেন, আমাদের দেশে সরকারি–বেসরকারি বিশ্ববিদ্যালয় খোলার হিড়িক লেগেছে, কিন্তু সেসব বিশ্ববিদ্যালয় থেকে সর্বোচ্চ ডিগ্রি নিয়ে যারা বেরোচ্ছে, তারা যে শুধু সার্টিফিকেট নিয়ে বেরোচ্ছে, সেদিকে কারও দৃষ্টি নেই: না শিক্ষকদের, না অভিভাবকদের, না শিক্ষার্থীদের নিজেদের। উচ্চশিক্ষিত তরুণ–তরুণীরা ডিগ্রি নিয়ে বেরিয়ে আসার পরেই দাবি জানায়, তাদের চাকরি দিতে হবে। কিন্তু চাকরি করার জন্য যে বিদ্যা, জ্ঞান ও দক্ষতা অর্জন করা দরকার, সেটা তারা পুরো ছাত্রজীবন ধরে ভুলে থাকে। তারা নিজেদেরকে ঠকায়, মা–বাবাকে ঠকায়, জাতিকে ঠকায়; কারণ মা–বাবা ও রাষ্ট্র তাদের পড়াশোনার পেছনে প্রচুর অর্থ ব্যয় করে।

বছর দুয়েক আগে আমি প্রথম আলোর সম্পাদকীয় পাতায় ‘উচ্চশিক্ষিত বেকারদের অপরাধ কী?’ শিরোনামে একটি নিবন্ধ লিখেছিলাম। সেটি পড়ার পরেও ওই শিল্পপতি আমাকে ফোন করেছিলেন। তিনি সে কথা আমাকে স্মরণ করিয়ে দিয়ে বললেন, ‘আপনারা তো শুধু পপুলার কথাবার্তা লেখেন। অপ্রীতিকর বাস্তব সমস্যাগুলো এড়িয়ে যেতে চান। তখনো আমি আপনাকে বলেছিলাম, উচ্চশিক্ষিত বেকারদের অপরাধ হলো, তারা ভালোভাবে লেখাপড়া করে শ্রমবাজারের জন্য দরকারি যোগ্যতা ও দক্ষতা অর্জনের চেষ্টা করে না, অথচ তারা দাবি করে, তাদেরকে চাকরি দিতে হবে।’

একপর্যায়ে আমি তাঁকে বললাম, ‘আপনার কথা তো শুনলাম। কিন্তু আমাদের দেশে মেধাবী তরুণ–তরুণী একেবারেই নেই, এটা কি হতে পারে?’

ভদ্রলোক বললেন, ‘মেধাবীরা সম্ভবত বিদেশে চলে যায়, নইলে আমরা পাই না কেন?’

‘একদমই পান না?’

‘পাই, খুবই কম। কিন্তু তাদেরও সমস্যা আছে।’

‘কী সমস্যা?’

‘সততার অভাব। বেশি চালাক, শর্টকাটে রাতারাতি অনেক টাকার মালিক হতে চায়। আমার প্রতিষ্ঠানে যতজন ব্রাইট ছেলেকে চাকরি দিয়েছি, তাদের কারও মধ্যে সততার লেশমাত্র দেখিনি। বারবার বিশ্বাস করেছি, বারবার প্রতারিত হয়েছি। প্রত্যেকর শুধু দুই নম্বরি ধান্দা; দুই নম্বর রাস্তা ছাড়া আর কোনো রাস্তা তাদের জানা নেই।’

ভদ্রলোকের কথায় বিরক্তি। সম্ভবত হতাশ হয়ে পড়েছেন। তাঁর হতাশা দূর করার জন্য কিছু সান্ত্বনামূলক বা আশাব্যঞ্জক কথা বলা যেত, কিন্তু সে পথে গেলাম না। তিনি আমাকে বললেন, ‘এসব বিষয় নিয়ে লেখেন; আওয়ামী লীগ–বিএনপি নিয়ে লিখে কোনো কাজ হবে না। পলিটিশিয়ানরা
যেভাবে চলছে, সেভাবেই চলবে, আপনারা লেখালেখি করে তাদের বদলাতে পারবেন না। তার চেয়ে যুবসমাজের জন্য লেখেন, কিছু কাজ হলেও হতে পারে। আলটিমেটলি যুবসমাজই তো আমাদের ভবিষ্যৎ, না কী বলেন?’

সায় না দিয়ে উপায় কী। কিন্তু যুবসমাজ নিয়ে কী লেখা যায়? তাদের উপদেশ–পরামর্শ দেওয়ার যোগ্যতা কি আমাদের আছে? তাদের যে অবস্থার কথা ওই শিল্পপতি ভদ্রলোক বললেন, তার জন্য কি শুধু তারাই দায়ী? না পুরো শিক্ষাব্যবস্থা, সমাজব্যবস্থা, রাজনীতি, রাষ্ট্রব্যবস্থা দায়ী?

সাবেক তত্ত্বাবধায়ক সরকারের উপদেষ্টা ও লেখক ড. আকবর আলি খান এক সাক্ষাৎকারের সময় প্রসঙ্গক্রমে আমাকে বলেছিলেন, বাংলাদেশের পুরো শিক্ষাব্যবস্থার ব্যাপক সংস্কার করা প্রয়োজন। কারণ, তিনি মনে করেন, এই শিক্ষাব্যবস্থা সনদসর্বস্ব হয়ে পড়েছে, শিক্ষার গুণগত মান ভীষণভাবে নেমে গেছে এবং আরও নেমে যাচ্ছে।

ঢাকায় ব্রিটিশ হাইকমিশনার ছিলেন আনোয়ার চৌধুরী। আমি একবার তাঁর সাক্ষাৎকার নিয়েছিলাম, তখন তিনি প্রসঙ্গক্রমে আমাকে বলেছিলেন, ‘আপনাদের দেশের উচ্চশিক্ষাব্যবস্থা দক্ষ জনশক্তি তৈরির প্রতি মনোযোগী নয়। শিক্ষার্থীরাও ডিগ্রি অর্জনের ওপর বেশি গুরুত্ব দেন। বাট ইউ নো, পিএইচডি হোল্ডারস আর নট নেসেস্যারিলি গুড ডেলিভারার্স?’ অর্থাৎ বিশ্ববিদ্যালয়ের সর্বোচ্চ ডিগ্রিধারীরা যে বাস্তব কাজের ক্ষেত্রে সবচেয়ে বেশি দক্ষ হবেন, এমন কোনো নিশ্চয়তা নেই। আনোয়ার চৌধুরী আমাকে আরও বলেছিলেন, বাংলাদেশে বিশ্ববিদ্যালয়ের সংখ্যা প্রয়োজনের তুলনায় অনেক বেশি। এত বেশিসংখ্যক ছেলেমেয়ের অনার্স ও মাস্টার্স পর্যায়ে পড়াশোনা করার প্রয়োজন নেই। তার চেয়ে বেশি প্রয়োজন বিভিন্ন কারিগরি ও ভোকেশনাল শিক্ষা ও প্রশিক্ষণের ব্যবস্থা বাড়ানো।

গত দু–তিন দশকে বাংলাদেশে সরকারি ও বেসরকারি উভয় খাতে অনেক বিশ্ববিদ্যালয় প্রতিষ্ঠা করা হয়েছে। কিন্তু প্রতিবছর এসব বিশ্ববিদ্যালয় থেকে অনার্স–মাস্টার্স ডিগ্রি নিয়ে যে বিপুলসংখ্যক তরুণ–তরুণী বেরিয়ে এসেছে ও আসছে, তাদের কর্মসংস্থান কোথায় কীভাবে হবে, তা নিয়ে জাতীয় পর্যায়ে কোনো চিন্তাভাবনা করা হয়েছে বলে মনে হয় না। তাই দেখা যাচ্ছে, বেকারদের মধ্যে উচ্চশিক্ষিত তরুণ–তরুণীরাই আছে সবার ওপরে। সেন্টার ফর ডেভেলপমেন্ট অ্যান্ড এমপ্লয়মেন্ট রিসার্চ (সিডার) নামের একটি বেসরকারি গবেষণা প্রতিষ্ঠান নিয়মিতভাবে বাংলাদেশের কর্মসংস্থান ও শ্রমবাজার পর্যালোচনা করে থাকে। ২০১৭ সালে প্রকাশিত তাদের এক সমীক্ষা প্রতিবেদনে দেখা যায়, বাংলাদেশে বেকারত্বের হার উচ্চশিক্ষিত জনগোষ্ঠীর মধ্যেই সবচেয়ে বেশি। অর্থাৎ যার ‘শিক্ষাগত যোগ্যতা’ যত বেশি, তার চাকরি পাওয়ার সুযোগ ও সম্ভাবনা তত কম। যারা দশম শ্রেণি পর্যন্ত পড়েছে, তাদের মধ্যে বেকারত্বের হার ৭ দশমিক ৫ শতাংশ। কিন্তু যারা অনার্স–মাস্টার্স পাস করেছে, তাদের মধ্যে বেকারত্বের হার ১৬ দশমিক ৪ শতাংশ। সুখের বিষয়, কম শিক্ষিতদের মধ্যে বেকারত্বের হার ধীরে ধীরে কমে যাচ্ছে। কিন্তু দুঃখের বিষয়, উচ্চশিক্ষিতদের মধ্যে বেকারত্বের হার দ্রুতগতিতে বেড়ে যাচ্ছে।

পরিসংখ্যানের এই সত্য অস্বীকার করার কোনো উপায় নেই। আমাদের অর্থনীতির প্রবৃদ্ধি প্রীতিকরভাবেই অব্যাহত আছে; কিন্তু কর্মসংস্থান, বিশেষত উচ্চশিক্ষিত জনগোষ্ঠীর কর্মসংস্থান বাড়ছে না বলে প্রবৃদ্ধির সুসংবাদ এ দেশের লাখ লাখ তরুণ–তরুণীর হতাশা দূর করতে পারছে না।

এর বিপরীতে এ কথাও মিথ্যা নয় যে আমাদের শ্রমবাজারে দক্ষ লোকের বেশ ঘাটতি আছে। সেই ঘাটতি পূরণ করতে শিল্পপ্রতিষ্ঠান ও ব্যবসা–উদ্যোগের মালিকেরা বিদেশ থেকে লোক আনতে বাধ্য হচ্ছেন। আন্তর্জাতিক শ্রম সংস্থার এক সমীক্ষা প্রতিবেদনে উল্লেখ করা হয়েছে, বাংলাদেশের ব্যবসায়ী–শিল্পপতি–উদ্যোক্তা সমাজের ৭৫ শতাংশই বলেছে, তারা তাদের প্রতিষ্ঠানে লোক নিয়োগ করতে চায়, কিন্তু প্রয়োজনীয়সংখ্যক দক্ষ লোক পায় না। শিল্পপতি মনজুর এলাহী একবার প্রথম আলোর এক অনুষ্ঠানে বলেছিলেন, বাংলাদেশের শ্রমবাজারে দক্ষ জনশক্তির অভাব প্রকট। ড. আকবর আলি খানের মতো তিনিও মনে করেন, এ দেশের উচ্চশিক্ষার গুণগত মান ভালো নয় এবং ক্রমেই তা আরও খারাপ হচ্ছে।

অর্থাৎ বাংলাদেশের উচ্চশিক্ষাব্যবস্থা ও দক্ষ শ্রমশক্তির বাজার এক অস্বাভাবিক উভয়সংকটের মধ্যে আছে। এই সংকট দূর করতে হলে উচ্চশিক্ষার গুণগত মান বাড়াতেই হবে, এর কোনো বিকল্প নেই। সনদের জোরে চাকরি পাওয়া যাচ্ছে না, যাবে না—এই কঠিন বাস্তবতার মধ্যেও যদি শিক্ষার্থীদের টনক না নড়ে, তাহলে এই দুর্দশা কোনো দিন ঘুচবে না। দুর্বল শিক্ষাব্যবস্থায়ও ভালো মানের শিক্ষা অর্জন করা একেবারে অসম্ভব নয়, যদি শিক্ষার্থীদের নিজেদের আন্তরিক চেষ্টা থাকে। কলেজ–বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষার্থীরা সনদের অপেক্ষায় না থেকে জ্ঞান ও দক্ষতা বাড়ানোর প্রতি মনোযোগী হলে একপর্যায়ে তারাই শিক্ষাব্যবস্থার ঘাটতিগুলো দূর করার জন্য প্রয়োজনীয় সংস্কারসাধনে চাপ সৃষ্টি করতে পারে।

মশিউল আলম প্রথম আলোর সহকারী সম্পাদক ও সাহিত্যিক

mashiul.alam@gmail.com


Source:- Daily Prothom Alo, 6 January 2019.
Link: https://www.prothomalo.com/opinion/article/1573423/%E0%A6%9A%E0%A6%BE%E0%A6%95%E0%A6%B0%E0%A6%BF-%E0%A6%A8%E0%A7%87%E0%A6%87-%E0%A6%A8%E0%A6%BE-%E0%A6%A6%E0%A6%95%E0%A7%8D%E0%A6%B7-%E0%A6%B2%E0%A7%8B%E0%A6%95%E0%A7%87%E0%A6%B0-%E0%A6%85%E0%A6%AD%E0%A6%BE%E0%A6%AC

33
চ্যালেঞ্জ নিতে তিনি পছন্দ করেন। সততা, ব্যবহার আর শ্রমের বিনিময়ে এ চ্যালেঞ্জকে তিনি জয়ও করেছেন। সফলতাকে এনেছেন হাতের মুঠোয়। আর তাই আজ দেশের গণ্ডি ছাড়িয়ে বিদেশেও এক আলোকিত নাম বিআরবি ক্যাবল। এর কর্ণধার মো. মজিবর রহমান। কুষ্টিয়ার এক সম্ভ্রান্ত ব্যবসায়ী পরিবারে বেড়ে ওঠা। ফলে ছোট থেকে হিসাবের হাত একেবারে পাক্কা। চল্লিশ বছর ধরে এ পাক্কা হিসাবি মজিবর রহমান ব্যবসাকেও নিয়ে গেছেন পাক্কা খুঁটিতে। অন্যতম বিশ্বে বাংলাদেশের শীর্ষে- এ স্লোগান নিয়ে এগিয়ে যাচ্ছেন তর তর করে।

বেশিদিন আগের কথা নয়, ১৯৭৮ সালে কুষ্টিয়ায় প্রতিষ্ঠা করেন বিআরবি (বজলার রহমান অ্যান্ড ব্রাদার্স) ক্যাবল ইন্ডাস্ট্রিজ লিমিটেড। আস্তে আস্তে দেশের বাজারে অবস্থান করে নেয় প্রতিষ্ঠানের পণ্য। তারপর দেশের বাইরে নজর দেন তিনি। এখন বিশ্বের নানা প্রান্তে বাংলাদেশের সুনাম ও মর্যাদাকে শীর্ষে তুলে ধরছেন বিআরবি গ্রুপ তাদের উৎপাদিত পণ্যের মাধ্যমে। আর দেশের বেকারত্ব মোচন, অর্থনীতির গতি সঞ্চার ও দেশের রপ্তানি খাতকে এগিয়ে নিচ্ছেন সমান তালে। মজিবর রহমান প্রতিষ্ঠানটির চেয়াম্যান। তার মতে, দেশে কোনো কিছু করা না গেলে, বাইরে গিয়েও কিছু করা যায় না। ভবিষ্যৎ নিয়ে বলেন,জাতীয় ও আন্তর্জাতিক পর্যায়ে আমাদের অর্জন আরও সূদুরপ্রসারী করতে চাই।

প্রতিষ্ঠানের শুরু সম্পর্কে মজিবর রহমান বলেন, নিজেদের মূলধন ও ব্যাংকের অর্থায়নে বাণিজ্যিকভাবে উৎপাদন শুরু হয় ১৯৮০ সালে। ১৯৯৪ সালে গোটা দেশে বিদ্যুতায়নের প্রসার ঘটলে ক্যাবল উৎপাদন বাড়নো হয়। ১৯৯৬ ও ২০০০ সালে উন্নত বিশ্বের উন্নত যন্ত্রপাতি স্থাপন করে কারখানার সমপ্রসারণ করা হয়। বর্তমানে উন্নত ও গুণগতমান সম্পন্ন পণ্য উৎপাদন করে দেশের চাহিদা মিটিয়ে বিশ্বের ক্যাবল বাজারের স্থান করে নিয়েছে বিআরবি গ্রুপ। এখন এ শিল্পের উৎপাদিত পণ্য ইউরোপ, আফ্রিকা ও দক্ষিণ এশিয়াসহ বিশ্বের অনেক দেশে রপ্তানি হচ্ছে।

১৯৭৮ সালে শুরু হওয়া এ গ্রুপে বর্তমানে ১২টি প্রতিষ্ঠান রয়েছে। ৬ হাজারের বেশি কর্মকর্তা-কর্মচারী কর্মরত রয়েছে এখানে। এর মধ্যে বিআরবি ক্যাবল ইন্ডাস্ট্রিজ, কিয়াম মেটাল ইন্ডাস্ট্রিজ, এমআরএস ইন্ডাস্ট্রিজ, বিআরবি পলিমার, বিআরবি সিকিউরিটিজ, টিপিটি ক্যাবলস, লাভলী হাউজিং, কিয়াম সিরাতুন্নেসা মেমোরিয়াল ট্রাস্ট, বিআরবি এনার্জি, বিআরবি এয়ার, বিআরবি ট্রাভেলস, গ্যাস্ট্র লিভার হসপিটাল অ্যান্ড রিসার্চ ইনস্টিটিউট লিমিটেড।

জাতীয় অর্থনীতিতে অবদানের পাশাপাশি দেশে শিল্পায়নে পিছিয়ে থাকা জনপদ কুষ্টিয়াকে সমৃদ্ধ জেলায় রূপান্তরেরও অন্যতম কারিগর এই বিআরবি গ্রুপ। স্থানীয় বিপুলসংখ্যক মানুষের কর্মসংস্থানের সুযোগ সৃষ্টির পাশাপাশি এ প্রতিষ্ঠানের হাত ধরেই কুষ্টিয়া অঞ্চলে নতুন করে শিল্পায়নের সূচনা হয়। দেশ স্বাধীন হওয়ার পর কুষ্টিয়ার খ্যাতনামা শিল্পপ্রতিষ্ঠান মোহিনী মিল বন্ধ হয়ে যায়। নাজুক হয়ে পড়ে কুষ্টিয়া টেক্সটাইল মিলের অবস্থাও। জেলার বৃহৎ কর্মস্থানের এ ক্ষেত্র দুটি ভঙ্গুর হয়ে পড়লে অর্থনৈতিকভাবে দুর্বল হয়ে পড়ে এ জেলা।
মন অবস্থায় নানা রকমের ঝুঁকি সত্ত্বেও নতুন করে শিল্পকারখানা দাঁড় করানোর চেষ্টা শুরু করেন মজিবর রহমান। এ প্রচেষ্টা বাস্তবরূপ লাভ করে ১৯৭৮ সালের ২৩শে অক্টোবর কুষ্টিয়া শহর থেকে ৫ কিলোমিটার দক্ষিণ বিসিক শিল্প নগরীতে বৈদ্যুতিক ওয়্যারস ক্যাবল প্রস্তুতকারী প্রতিষ্ঠান বিআরবি ক্যাবল ইন্ডাস্ট্রিজ প্রতিষ্ঠার মধ্য দিয়ে। দেশে ও বিশ্ব বাজারের বৈদ্যুতিক ক্যাবলের ক্রমবর্ধমান চাহিদার পরিপ্রেক্ষিতে ১৯৯৫ সালে কোম্পানির প্রসার ঘটিয়ে বিআরবি ক্যাবলস ইন্ডাস্ট্রিজ লিমিটেড ইউনিট-২ স্থাপন করেন প্রতিষ্ঠানটি।

মজিবর রহমান বলেন, বিআরবি উৎপাদনের ধারাবাহিকতায় শুধু বৈদ্যুতিক ক্যাবলই তৈরি করছে না তাদের উৎপাদনের সঙ্গে আরও সংযোজিত হয়েছে টেলিকম টিউব লাইন ব্যালস্টসহ ৯৯ হাইভোল্টেজ ক্যাবল, যা এদেশের মধ্যে শুধু বিআরবিই তৈরি করছে। অত্যাধুনিক ল্যাবরেটরিতে পরীক্ষা-নিরীক্ষা শেষে বাজারজাতকরণের মাধ্যমে বিআরবি ক্যাবল তার সাফল্যের আরও এক ধাপ এগিয়ে আইএসও ৯০০২ : ২০০০ সনদপ্রাপ্ত হয়ে উন্নয়নের ধারা অব্যাহত রেখেছে। শিল্প উৎপাদনে-রপ্তানি খাতে গুরুত্বপূর্ণ অবদান রাখায় তিনি সিআইপি নির্বাচিত হয়েছেন বেশ কয়েক বার।

যেভাবে সম্প্র্রসারণ হয় গ্রুপটির: উৎপাদনের ধারাবাহিকতা রক্ষায় গ্রাহক চাহিদা মেটানোসহ কর্মসংস্থানের জন্য ২০০৯ সালে নতুন প্লান্ট স্থাপন করে উৎপাদন করছেন বৈদ্যুতিক ফ্যান। যার নাম লাভলী ফ্যান, যা বাজারে বেশ সুনাম অর্জন করেছে। টেকসই ও মজবুত হওয়ায় লাভলী ফ্যান অল্প সময়ে মানুষ গ্রহণ করেছে। বর্তমানে এ ফ্যান বাংলাদেশের এক নম্বর ব্র্যান্ড হিসেবে খ্যাতি পেয়েছে বলে জানান চেয়াম্যান।২০১১ সালে বিআরবি গ্রুপে যুক্ত হয় আর একটি নতুন অধ্যায়। বিআরবি ক্যাবল ইন্ডাস্ট্রিজ লিমিটেড মেরিন ক্যাবল উৎপাদন করে ব্যবসায় নজির স্থাপন করায় কোম্পানি ব্যাপক সুনাম অর্জন করে।

আন্তর্জাতিক মানের অত্যাধুনিক ও আকর্ষণীয় মেটালিক পণ্যসামগ্রী রান্নাঘরে পৌঁছে দেয়ার জন্য মজিবর রহমান ১৯৯০ সালে কিয়াম মেটাল ইন্ডাস্ট্রিজ লিমিটেড নামে কুষ্টিয়া বিসিক শিল্প নগরীতে আরও একটি শিল্পপ্রতিষ্ঠান গড়ে তোলেন।

অনুষ্ঠানে উপস্থিত ছিলেন পিএচপি পরিবারের চেয়ারম্যান সুফি মিজানুর রহমান।
অনুষ্ঠানে উপস্থিত ছিলেন পিএইচপি পরিবারের চেয়ারম্যান সুফি মিজানুর রহমান।
কুষ্টিয়ায় ১৯৯২ সালে বিআরবি গ্রুপের অন্তর্ভুক্ত এমআরএস ইন্ডাস্ট্রিজ নামে আরও একটি প্রকৌশল, ঢালাই, প্লাইউড ও মেলামাইন বোর্ড কারখানা প্রতিষ্ঠিত করেন গ্রুপটি।

কৃষিপ্রধান দেশর কৃষি উৎপাদন বৃদ্ধিতে উন্নত সেচ ব্যবস্থা নিশ্চিত করতে বিআরবির স্বপ্নদ্রষ্টা আরেকটি যুগান্তকারী সিদ্ধান্ত নিয়ে ১৯৯৭ সালে বিসিক শিল্প নগরী কুষ্টিয়ায় প্রতিষ্ঠা করেন বিআরবি পলিমার লিমিটেড।

২০১১ সালে বিসিক শিল্প নগরীর মূল হাইওয়েতে এমআরএস ইন্ডাস্ট্রিজ লিমিটেড ফিলিং স্টেশন স্থাপন করেন।

নিরবচ্ছিন্ন বিদ্যুৎ সরবরাহ নিশ্চয়তায় বিদ্যুৎ উৎপাদনের লক্ষ্যে বিসিক শিল্প নগরীর বিআরবি চত্বরে ২০০৯ সালে স্থাপন করেন বিআরবি এনার্জি লিমিটেড। এই বিদ্যুৎ সরবরাহের ফলে বিআরবি গ্রুপের সব প্রতিষ্ঠানের পণ্য উৎপাদনে গতিশীলতা ফিরে এসেছে।
অন্যদিকে ভোক্তাদের চাহিদা মেটানোর জন্য কুষ্টিয়া শহরের প্রাণকেন্দ্রে নবাব সিরাজ-উদ-দৌলা সড়কে ২০০০ সালে ১০তলা বহুতল ভবন বাণিজ্যিক কমপ্লেক্স ‘লাভলী টাওয়ার’ স্থাপন করেন।

আকাশপথের মাধ্যমে সারা দেশে দ্রুত যোগাযোগ নিশ্চিত করতে বিআরবি গ্রুপে যুক্ত হয় বিআরবি এয়ার লিমিটেড। বর্তমানে বেল ৪০৭ জিএক্স নামের একটি হেলিকপ্টার ব্যবহার করা হচ্ছে। শাহজালাল বিমানবন্দরে আনুষ্ঠানিকভাবে বিআরবি এয়ারের যাত্রা শুরু হয়।
গ্রুপের কর্ণধার মো. মজিবুর রহমান কুষ্টিয়ায় কিয়াম সিরাতুননেছা মেমোরিয়াল ট্রাস্ট গঠন করে দরিদ্র ছাত্রদের বিনামূল্যে ধর্মীয় ও আধুনিক শিক্ষা গ্রহণের সুযোগ সৃষ্টি করেছেন। পবিত্র হজব্রত পালনের জন্য তিনি বেশ কয়েকবার হজ ও ওমরাহ পালন করেছেন। নিজ খরচে কুষ্টিয়ার বিভিন্ন এলাকায় একাধিক মসজিদ, মাদরাসা ও শিক্ষাপ্রতিষ্ঠান নির্মাণ করেছেন।

মজিবর রহমান বলেন, স্বনির্ভর বাংলাদেশ গড়তে ও স্বনির্ভর কুষ্টিয়া প্রতিষ্ঠায় কাজ করছে বিআরবি গ্রুপ। দেশের সমৃদ্ধি ও বেকারত্ব মোচনে আমাদের প্রচেষ্টা অব্যাহত থাকবে। তিনি বলেন, আর এটা সম্ভব হয়েছে কুষ্টিয়াবাসীসহ দেশের সবার সার্বিক সহযোগিতায়। বিআরবির পণ্যের মান উন্নত হওয়ার কারণে বিশ্ব দরবারে অন্যতম শ্রেষ্ঠ ক্যাবল তৈরি প্রতিষ্ঠান হিসেবে চিনে। গোবি ইন্টারন্যাশনালের জরিপে সারা বিশ্বের তালিকাভুক্ত ৩ হাজার ক্যাবল উৎপাদনকারী প্রতিষ্ঠানের মধ্যে বিআরবি ৩৩তম। মানের কারণে বিআরবি ৩ বার জাতীয় রপ্তানি ট্রফি অর্জন করেছে।

34
১৯৬৪ সালে ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় থেকে গ্র্যাজুয়েশন সম্পন্ন করে প্রথম জীবনে ব্রিটিশ আমেরিকান টোব্যাকো কম্পানিতে নির্বাহী কর্মকর্তা হিসেবে কর্মজীবন শুরু করি। নিজের ৩০তম জন্মদিনে সেই সিদ্ধান্ত পরিবর্তন করে চামড়াশিল্পের ব্যবসা শুরু করি। এরপর অ্যাপেক্স গ্রুপ প্রতিষ্ঠা করি’, অ্যাপেক্স গ্রুপের প্রতিষ্ঠাতা চেয়ারম্যান সৈয়দ মঞ্জুর এলাহী ড্যাফোডিল ইন্টারন্যাশনাল ইউনির্ভার্সিটিতে (ডিআইইউ) এক বক্তৃতায় এসব কথা বলেন।

বিশ্ববিদ্যালয়ের ইনোভেশন অ্যান্ড ইনকিউবেশন সেন্টার দেশের শিল্প খাতের মোট ১২ জন উদ্যোক্তাকে নিয়ে আয়োজন করেছে ‘উদ্যোক্তা উন্নয়নবিষয়ক ডিআইইউ ইন্ডাস্ট্রি একাডেমিয়া বক্তৃতামালা’। ১২ পর্বের লোকবক্তৃতামালার দ্বিতীয় পর্ব অনুষ্ঠিত হয় গত ১১ জুন। সেই অনুষ্ঠানে এসব কথা বলেন মঞ্জুর এলাহী।শিক্ষার্থীদের  উদ্দেশে মঞ্জুর এলাহী বলেন, একমাত্র কঠোর পরিশ্রম, সততা, নিষ্ঠা আর বিনম্রতার মতো গুণাবলিই পারে একজন সফল উদ্যোক্তা তৈরি করতে। তিনি শিক্ষার্থীদের নিজের ওপর অগাধ বিশ্বাস রাখতে এবং উদ্যোক্তা হওয়ার স্বপ্ন দেখতে এবং সেই স্বপ্ন বাস্তবায়নে নিরলস পরিশ্রম করার আহ্বান জানান। তিনি নতুন উদ্যোক্তাদের গুণগত মান বজায় রাখার সর্বোচ্চ চেষ্টার পাশাপাশি সুনাম ধরে রাখারও আহ্বান জানান।

অনুষ্ঠানে আরো বক্তব্য দেন ইউনির্ভার্সিটির ট্রাস্টি বোর্ডের চেয়ারম্যান মো. সবুর খান, উপাচার্য প্রফেসর ড. ইউসুফ মাহাবুবুল ইসলাম ও ইনোভেশন অ্যান্ড ইনকিউবেশন সেন্টারের পরিচালক মো. আবু তাহের।

আমন্ত্রিত এই ১২ জন সফল উদ্যোক্তার বক্তৃতাগুলো নিয়ে পরবর্তী সময়ে একটি বই প্রকাশিত হবে, যা বিশ্ববিদ্যালয় পর্যায়ের ব্যবসা, অথনীতি ও উদ্যোক্তা উন্নয়ন সংশ্লিষ্ট বিভাগগুলোর শিক্ষার্থীদের জন্য রেফারেন্স বই হিসেবে ব্যবহারের সুযোগ সৃষ্টি করবে। এই ১২ জন উদ্যোক্তার ওপর ডিআইইউ থেকে ১২টি প্রামাণ্যচিত্রও নির্মাণের উদ্যোগ নেওয়া হবে।

ডিআইইউ থেকে এক বিজ্ঞপ্তিতে বলা হয়, এই লোকবক্তৃতামালা নতুন প্রজন্মের সৎ, শিক্ষিত ও মেধাবী উদ্যোক্তাদের সাহস, নিষ্ঠা ও দক্ষতার সঙ্গে সামনে এগিয়ে যেতে সাহায্য ও অনুপ্রাণিত করবে। উদ্যোক্তা উন্নয়নের ক্ষেত্রে বাংলাদেশ তার সম্ভাবনার সঙ্গে সামঞ্জস্যপূর্ণ গতিতে এগোতে পারছে না বলে যে ধারণা চালু রয়েছে, এ লোকবক্তৃতামালা সেই সীমাবদ্ধতা কাটিয়ে উঠতে সাহায্য করবে।

35

আমরা যথেষ্ট অবস্থাপন্নই ছিলাম। আমার দাদার চা বাগানটি ছিল এই অঞ্চলে স্থানীয় কারও মালিকানায় প্রথম বাগান। বাবার বড় পাটের ব্যবসা ছিল। পাটকলও করেছিলেন। সেই ১৭ বছর বয়সে আমার নিজেরই একটা গাড়ি ছিল, ফিয়াট। তার পরও জীবনের আর একটি দিক আমার দেখা হয়েছে।

জীবনে একটা সময় এসেছিল, যখন আমাদের কাছে নগদ এক শ টাকাও ছিল না। সেই জীবন থেকে আবার ঘুরেও দাঁড়িয়েছি। তারপর কেবল সামনে এগিয়ে যাওয়া। বাংলাদেশের অগ্রগতি আর আমার ব্যবসা বাণিজ্যের প্রসার যেন হাত ধরাধরি করে এগিয়েছে। ১৯৭১-এর মুক্তিযুদ্ধের পর বাংলাদেশ যেমন প্রায় শূন্য থেকে শুরু করেছে, আমাকেও নতুন করে শুরু করতে হয়েছে তখন থেকেই।

যে ট্রান্সকম গ্রুপকে কেন্দ্র করে আমরা এগিয়ে চলেছি, তার ভিত কিন্তু গড়ে উঠেছিল সেই ১৮৮৫ সালে, আমার দাদার হাত ধরে। আমার দাদা খান বাহাদুর ওয়ালিউর রহমান। তাঁর জন্ম কুমিল্লার চৌদ্দগ্রামের চিওড়া গ্রামে। তবে দাদার শৈশব কেটেছে জলপাইগুড়িতে, মামার কাছে। সেখানেই আইন পাশ করে আইনি পেশা শুরু করেনছিলেন। ১৮৮৫ সালে তিনি সেখানে কিছু জমি কিনে চা বাগান শুরু করেন। তখন চা বাগানের মালিক ছিল মূলত ব্রিটিশরা। জলপাইগুড়িতে জন্ম হলেও আমার বাবা মুজিবুর রহমান লেখাপড়া করেন কলকাতায়। সেখান থেকে আসামের তেজপুরে ফিরে নিজেই জমি কিনে চা-বাগান তৈরি করেন। আমার খান বাহাদুর উপাধী পাওয়া বাবা দেশ ভাগের পর সবাইকে নিয়ে ঢাকায় চলে আসেন। সিলেটে নতুন করে চা-বাগান করার পাশাপাশি শুরু করেন পাটের ব্যবসা। আমার জন্ম ১৯৪৫ সালের ২৮ আগস্ট, জলপাইগুড়িতে। ঢাকায় আমাদের বাসা ছিল গেন্ডারিয়ায়। ১৯৫৬ সালে বাবা আমাকে পাঠিয়ে দেন শিলংয়ের সেন্ট এডমন্ডস স্কুলে। সেখান থেকে চলে যাই কলকাতার সেন্ট জেভিয়ার্স কলেজে। তবে ১৯৬৫ সালের ভারত-পাকিস্তান যুদ্ধ, সাম্প্রদায়িক দাঙ্গা-এসব কারণে ঢাকায় ফিরে এসে বাবার পাটের ব্যবসায় যুক্ত হই। তখন চাঁদপুরে ডব্লিউ রহমান জুট মিল নামে আমাদের একটি পাটকল ছিল। ১৯৬৬ সালে সেখানে কাজ শুরু করি। ১৯৭১ সাল পর্যন্ত এভাবে কাজ করার পর শুরু হয় জীবনের আরেক অধ্যায়।

মুক্তিযুদ্ধের পর স্বাধীন বাংলাদেশে চা-শিল্প ছাড়া সবকিছুই জাতীয়করণ করা হয়। মালিকানা ব্রিটিশদের হাতে বেশি ছিল বলেই জাতীয়করণের আওতায় চা-শিল্প পড়েনি। এর আগ পর্যন্ত চা পুরোটাই চলে যেত পশ্চিম পাকিস্তানে। সেই বাজার পুরোপুরি বন্ধ হয়ে গেল। ফলে চা বাগান থাকলেও খুব একটা লাভ হলো না। অন্য দেশে কীভাবে চা রপ্তানি করতে হয়, তাও জানতাম না।বিক্রি করতে না পারার কারণে চা গুদামে পড়ে ছিল। আমাদের অবস্থার রাতারাতি পরিবর্তন হয়ে গেল। কিছু আসবাব ভাড়া করলাম। এমনকি ঘর থেকে পাখা খুলে এনে লাগাতে হলো অফিসে। মনে আছে, ১৯৭২ সালের শেষ দিকে একজন সুইস ভদ্রলোকের সঙ্গে পরিচয় হয়। নাম রেনে বারনার। আমার সঙ্গে চা-বাগানে গিয়ে তিনি স্তুপাকারে পড়ে থাকা চা দেখলেন। এরপর দেশে ফিরে গিয়ে চা কেনার আগ্রহের কথা জানালেন। তখন পণ্যের বিনিময়ে পণ্য, অর্থাৎ বার্টার বা কাউন্টার ট্রেডের ব্যবস্থা ছিল। বাংলাদেশে তখন কীটনাশকের প্রচুর চাহিদা। রেনে বারনার চায়ের সঙ্গে কীটনাশকের প্রচুর চাহিদা। রেনে বারনার চায়ের সঙ্গে কীটনাশকের বার্টার ট্রেডের প্রস্তাব দিলেন। এ জন্য অনুমতি লাগত। দেখা করলাম তখনকার বাণজ্যমন্ত্রী এম আর সিদ্দিকীর সঙ্গে। সচিবালয় ঘুরে ঘুরে অনুমতি আনলাম। এভাবেই শুরু হলো চা রপ্তানি। এর জন্য টি হোল্ডিংস লিমিটেড গঠন করা হলো। এভাবে আবার নিজের পায়ে দাঁড়াতে শুর করলাম।



সময়টা ছিল ১৯৭৩। নগদ অর্থের সংকট কিন্তু তখনো কাটেনি। নেদারল্যান্ডসের রটারডাম-ভিত্তিক ভ্যান রিস সে সময়ে বিশ্বে অন্যতম চা সরবরাহকারী প্রতিষ্ঠান। আমরা তাদের কাছে চা সরবরাহ করতে চাইলাম। এ জন্য অর্থের প্রয়োজন ছিল। উত্তরা ব্যাংকের কাছে ৫০ লাখ টাকার ঋণের আবেদন করলাম। ব্যাংক এ জন্য ঋণের মার্জিন ২০ শতাংশ নির্ধারণ করে দিল। উত্তরা ব্যাংকের এমডি ছিলেন মুশফিকুস সালেহীন। আমি তার কাছে গেলাম। তিনি আমার বাবাকে চিনতেন। বললেন, ১০ শতাংশ মার্জিন দিতে। আমি বললাম, ‘আমার কাছে কোনো টাকা নেই। আমি এক টাকাও মার্জিন দিতে পারব না।’ তিনি তা মেনে নিয়েছিলেন।

সেই ৫০ লাখ টাকা ঋণ নিয়ে নতুন করে চা ব্যবসা সাজালাম। শুরু হলো আবার পথচলা। সেই পথচলা আর কখনো থেমে যায়নি। কখনো আর পেছন ফিরে তকাতেও হয়নি। আমার জীবনে সেটাই ছিল মোর ফেরানো ঘটনা। এই ঘটনা থেকে আরও একটি শিক্ষা নিলাম যে স্থায়ী সম্পদে বড় কোনো বিনিয়োগ করব না। কারণ, নগদ অর্থ যে কোনো সময়ে নেই হয়ে যেতে পারে। ফলে বড় কোনো ভবন আমি আর বানাইনি। জমি কিনেও বসে থাকিনি। আবার কেবল বাণিজ্যেও ব্যস্ত থাকিনি। বরং শিল্প প্রতিষ্ঠান গড়েছি। ব্যাংকে টাকা জমিয়ে রাখা আমার পছন্দ নয়। তাহলে তো টাকা কোনো কাজেই লাগল না। আমি টাকা বিনিয়োগ করতে পছন্দ করি। আমি আমার পছন্দের কাজটা করে চলেছি।

নিজের দেশর প্রতি আমার একটা অঙ্গিকার ও ভালোবাসা আছে। আমার কখনো মনেই হয়নি যে আমি অন্য দেশে থাকব। আমি ভাবিনি, আমার সন্তানেরাও নয়। এমনকি আমার নাতিরা, যারা অন্য দেশে পড়াশোনা করেছে, তারাও সেখানে থেকে যেতে বিন্দুমাত্র আগ্রহী নয়। আমারে সবার একটাই পাসপোর্ট, এই বাংলাদেশের। আমাদের এই বাংলাদেশ নিয়ে অনেকেই হতাশার কথা বলেন। আমি একেবারেই হতাশ নই। আমার চোখের সামনে এই দেশের অনেক অগ্রগতি হয়েছে। অনেক এগিয়েছে বাংলাদেশ। রাজনৈতিক বিভক্তি, অবকাঠামোর সমস্যা, দুর্নীতি-এসব না থাকলে হয়তো আরও উন্নতি হতো।তিষ্ঠান চালানোর ক্ষেত্রে আমরা কিছু বিষয় মেনে চলি। যেমন আমি সবাইকে স্বাধীনভাবে প্রতিষ্ঠান চালাবার ক্ষমতা দিয়েছি। সিদ্ধান্ত নেওয়ার ক্ষমা তাদেরই। আমি যেটা খুব ভালোভাবে করি, তা হলো আর্থিক নিয়ন্ত্রণ। আমি সেটা কঠোরভাবে অনুসরণ করি। গ্রুপের প্রতিটি কোম্পানির হিসাব ও আর্থিক বিবরণী পরের মাসের মাঝামাঝি সময়ের মধ্যে পাঠাতে হয়। সেগুলো নিয়ে আমরা আলোচনা করি। কোনো ব্যবস্থা নিতে হলে তা-ও নিই। এটি আমার সাফল্যের একটি বড় কারণ। আর দীর্ঘ মেয়াদে সফলতার জন্য প্রয়োজন হলো দেশের আইন-কানুন মেনে ও নৈতিকতার সঙ্গে ব্যবসা পরিচালনা করা।

আমার গ্রুপের আর একটি বড় সাফল্য হচ্ছে, আমাদের কোনো প্রতিষ্ঠানেই কোনো বিদেশি কাজ করে না। সবাই বাংলাদেশি। আমাদের ফ্র্যাঞ্চাইজি কেএফসি বা পিৎজা হাট এশিয়ার সেরা হয়েছে, আমাদের পেপসি সেরা বাটলারের স্বীকৃতি পেয়েছে। এগুলো বাংলাদেশিরাই চালাচ্ছেন। তাদের নিয়েই আমরা আন্তর্জাতিক পর্যায়ের সাফল্য পেয়েছি।

লতিফুর রহমান: শিল্পোদ্যোক্তা; ব্যবসায়িক গ্রুপ ট্রান্সকমের চেয়ারম্যান। ব্যবসা ক্ষেত্রে নৈতিকতা ও সামাজিক দায়বদ্ধতার স্বীকৃতি হিসেবে অসলো বিজনেস ফর পিস অ্যাওয়ার্ডে সম্মানিত।

উৎস: ড্যাফোডিল ইন্টারন্যাশনাল ইউনিভার্সিটির ইনোভেশন অ্যান্ড ইনকিউবেশন সেন্টার আয়োজিত ‘ডিআইইউ ইন্ড্রাস্ট্রি একাডেমিয়া লেকচার সিরিজ’ অনুষ্ঠানে প্রদত্ত বক্তৃতা। (ঈষৎ সংক্ষেপিত ও অনুলিখিত)।

36

নিজের স্বপ্ন নিজেকেই দেখতে হয়; অন্যের দেখানো স্বপ্নের পথে হেঁটে কখনো সফল হওয়া যায় না। এমনটাই বললেন সাবেক তত্ত্বাবধায়ক সরকারের উপদেষ্টা এবং বিজ্ঞাপনী সংস্থা অ্যাডকমের চেয়ারম্যান গীতিআরা সাফিয়া চৌধুরী। ড্যাফোডিল ইন্টারন্যাশনাল ইউনিভার্সিটির ইনোভেশন অ্যান্ড ইনকিউবেশন সেন্টার আয়োজিত ‘উদ্যোক্তা উন্নয়নবিষয়ক ডিআইইউ ইন্ডাস্ট্রি একাডেমিয়া বক্তৃতামালা’ অনুষ্ঠানে তিনি এ মন্তব্য করেন। আজ শনিবার (১৪ জানুয়ারি) বিশ্ববিদ্যালয়টির সিটি ক্যাম্পাস মিলনায়তনে ১২ পর্বের লোকবক্তৃতামালার ষষ্ঠ পর্ব অনুষ্ঠিত হয়।

একক বক্তৃতায় শিক্ষার্থীদের  উদ্দেশে গীতিআরা বলেন, ‘জীবনে সফল হতে হলে নিজের স্বপ্নের পথে নিরলস হাঁটতে হয় এবং কঠোর পরিশ্রম করতে হয়। অন্য কেউ এসে তোমার স্বপ্ন পূরণ করে দেবে না।’

নিজের সফলতার গল্প শোনাতে গিয়ে এ বিশিষ্ট ব্যবসায়ী বলেন, ‘কেজি টু-তে পড়ার সময় থেকেই লেখালেখি শুরু করি। এক্ষেত্রে সবচেয়ে বেশি অনুপ্রেরণা দিয়েছেন দাদু ড. মুহাম্মদ শহীদুল্লাহ। এছাড়া মা-বাবার অনুপ্রেরণা তো ছিলই। পরবর্তীতে আমার পেশাজীবন শুরু হয় সাংবাদিকতার মাধ্যমে। কয়েক বছর সাংবাদিকতা করার পর নিজের ইচ্ছায় প্রতিষ্ঠা করি বিজ্ঞাপনী সংস্থা অ্যাডকম।’

বক্তৃতা শেষে ছিল প্রশ্ন-উত্তর পর্ব। সেখানে আইন বিভাগের এক শিক্ষার্থীর করা প্রশ্নের উত্তরে গীতিআরা বলেন ‘শেখার কোনো শেষ নেই। জীবনের সব পর্যায়েই শিখতে হয়। আমি যখনই যে কনফারেন্সে অংশ নিই না কেন, আমার হাতে কাগজ-কলম থাকে; আমি বসে বসে নোট নিই।’অপর এক শিক্ষার্থী জানতে চান, নতুন উদ্যোক্তাদের জন্য কোনো না কোনো সিঁড়ির প্রয়োজন হয়। এক্ষেত্রে সিঁড়ি খুঁজে পাবো কীভাবে?

মৃদু হেসে গীতিআরা উত্তর দেন, ‘কেউ কারো জন্য সিঁড়ি গড়ে দেয় না। সফল হতে হলে নিজের পরিশ্রম, চেষ্টা আর যোগ্যতা লাগে। আমি নিজের চেষ্টা আর পরিশ্রম দিয়ে নিজের সিঁড়ি গড়েছি। তোমাদেরকেও তাই করতে হবে।’

উদ্যোক্তা বিভাগের এক শিক্ষার্থীর প্রশ্নের জবাবে গীতিআরা বলেন, ‘আমাদের দেশে যোগ্য ও দক্ষ লোকের বড়ই অভাব।দুঃখজনক হলেও সত্য, আমাদের উচ্চশিক্ষা প্রতিষ্ঠানগুলো দক্ষ মানব সম্পদ তৈরি করতে পারছে না। এ জন্য বিশ্ববিদ্যালয়ের সিলেবাস ঢেলে সাজানো প্রয়োজন।’

এ সময় তিনি কারিগরি ও ব্যবহারিক শিক্ষার প্রতি নজর দিতে সবার প্রতি আহ্বান জানান।

অনুষ্ঠানে আরো বক্তব্য দেন ইউনির্ভার্সিটির ট্রাস্টি বোর্ডের চেয়ারম্যান মো. সবুর খান, উপাচার্য প্রফেসর ড. ইউসুফ মাহাবুবুল ইসলাম ও ইনোভেশন ও ইনকিউবেশন সেন্টারের পরিচালক মো. আবু তাহের।

ডিআইইউ থেকে প্রকাশিত এক বিজ্ঞপ্তিতে বলা হয়,  আমন্ত্রিত এই ১২ জন সফল উদ্যোক্তার বক্তৃতাগুলো নিয়ে পরবর্তী সময়ে একটি বই প্রকাশিত হবে, যা বিশ্ববিদ্যালয় পর্যায়ের ব্যবসা, অর্থনীতি ও উদ্যোক্তা উন্নয়ন সংশ্লিষ্ট বিভাগগুলোর শিক্ষার্থীদের জন্য রেফারেন্স বই হিসেবে ব্যবহারের সুযোগ সৃষ্টি করবে। এই ১২ জন উদ্যোক্তার ওপর ডিআইইউ থেকে ১২টি প্রামাণ্যচিত্রও নির্মাণের উদ্যোগ নেওয়া হবে।


গীতিআরা সাফিয়া চৌধুরীর বক্তব্যের ভিডিও দেখতে এখানে ক্লিক করুন :

37

আমাদের অধিকাংশের কাছে বৃষ্টিতে ভেজা আঠালো কাঁদামাটি মানেই এর পিচ্ছিল গাত্রে হোঁচট খেয়ে পড়ে যাওয়া আর সেই পিচ্ছিল কাঁদামাটিই কুমারের হাতে পড়ে হয়ে ওঠে সুদৃ্শ্য মৃৎপাত্র। নদীর বুক ও পাড় ঘেঁসে আমাদের কতোজনেরইতো নিত্য আসা-যাওয়া। কিন্তু মানিক বন্দ্যোপাধ্যায়ের আগে সেখানে সে কবে খুঁজে পেয়েছিল কুবের মাঝির জীবন? গোমতী বা মেঘনা সেতু হওয়ার বহু আগে থেকেই কুমিল্লা থেকে এ পথে কতশত মানুষের যাতায়াত কিন্তু মোস্তফা কামালের আগে কে কবে ভেবেছিলেন যে, মেঘনার এ এবড়ো থেবড়ো পাড় ঘেঁষেই গড়ে তোলো যায় বাংলাদেশের অর্থনীতিতে সাড়া ফেলে দেয়ার মতো অজুত সম্ভাবনাময় নানা শিল্প-কারখানা? হ্যাঁ, ইতিহাসের সংগ্রামী মানুষ যেমন কঠিন পাথর ঘষে তার বুক চিরে খুঁজে পেয়েছে আগুনের সন্ধান, মোস্তফা কামালও তেমনি ব্যবসা বাণিজ্যের নানা অচেনা পাথুরে পথঘাটকে নিরন্তর পরিশ্রম ও দূরদর্শী চিন্তাভাবনা দিয়ে একেবারেই অনায়াস সাধ্য করে তুলেছেন। বিদ্যালয়গামী মোস্তফা কামাল গ্রামের বাজারে চাচার সুপারির দোকানে বসে ব্যবসায়ের যে প্রথম পাঠ নিয়েছিলেন, সেটিই আজ পত্রপল্লবে মেঘনা গ্রুপ অব ইন্ডাস্ট্রিজ—পনের হাজার কর্মীর কর্ম ও কলরবে মুখর চল্লিশটিরও বেশি কারখানায় উৎপাদিত ৩২টিরও বেশি পণ্যের নিত্য সমাহার, যেখানে বার্ষিক টার্নওভারের পরিমাণ ইতোমধ্যে ২ বিলিয়ন ডলারকেও ছাড়িয়ে গেছে।

কোনো পরিশ্রম ছাড়াই রাতারাতি বিত্তবৈভবের মালিক হওয়ার আকাঙ্ক্ষায় বুঁদ হয়ে থাকা নতুন প্রজন্মের তরুণদের জেনে রাখা ভালো, যাত্রাবাড়ির লজিংয়ে থেকে ৪ আনা দিয়ে বাসে করে গুলিস্তান এসে সেখান থেকে পায়ে হেঁটে মৌলভীবাজারে হাজী মোহাম্মদ হোসেনের দোকানে পৌঁছা এবং সারাদিনের কাজ শেষে একই পথে ফিরে যাওয়া। বিনিময়ে মাস শেষে সর্বসাকুল্যে ১৬৫ টাকা। এই ছিল মোস্তফা কামালের প্রথম আনুষ্ঠানিক কর্মজীবন। আমাদের অনেকের কাছেই তাঁর ওই বেতনের এ পরিমাণকে আপাতদৃষ্টে সামান্য মনে হতে পারে। কিন্তু বেতন সামান্য হলেও সেখানে কাজ করে দক্ষতা ও অভিজ্ঞতার যে পুঁজি তিনি সংগ্রহ করেন, আজকের ২ বিলিয়ন ডলারের টার্নওভার সে পুঁজিরই ক্রমপুঞ্জিত রূপান্তর নয় কি?

ব্যবসায়িক প্রস্তাব মূল্যায়নের এক অসাধারণ মেধাবী সামর্থ রাখেন মোস্তফা কামাল। এ ক্ষেত্রে প্রথমেই তিনি সম্ভাব্য পণ্যের অগ্র ও পশ্চাৎ সংযোগ পণ্যগুলোর কথা ভাবেন। ভাবেন প্রযুক্তি সংশ্লিষ্টতার স্তর নিয়েও এবং অবশ্যই পুঁজি সামর্থের বিষয়টি নিয়েও। এবং মেঘনা গ্রুপের অভিজ্ঞতা থেকে আমরা দেখতে পাই, অধিকাংশ ক্ষেত্রে প্রথমে তিনি নিম্ন প্রযুক্তির স্বল্পপুঁজিসম্পন্ন পণ্যের কথা ভেবেছেন। কিন্তু মাথায় রেখেছেন এটিকেই উচ্চ প্রযুক্তির বড় পুঁজির ব্যবসায়ে রূপান্তরের। বস্তুত ধীরে ধীরে বড় ও বিকশিত হয়ে ওঠার এ চিন্তা তিনি ব্যবসায়ের ক্ষেত্রে যেমনি করেছেন, তেমনি করেছেন জীবনের অন্যান্য ক্ষেত্রেও। অগ্র ও পশ্চাৎ সংযোগ শিল্পের নানা আদ্যোপান্ত নিয়ে বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষক-গবেষকরা যখন ঘর্মাক্ত হচ্ছেন, তারা মোস্তফা কামালের সঙ্গে এ বিষয়ে কথা বললে উপকৃত হবেন বলে আশা করা যায়। তাঁর অভিজ্ঞতার বিবরণ শোনার জন্য বিশ্বখ্যাত হার্ভার্ড বিশ্ববিদ্যালয় তাঁকে আমন্ত্রণ জানিয়েছিল।

আবু তাহের খান: পরিচালক, ক্যারিয়ার ডেভলপমেন্ট সেন্টার, ড্যাফোডিল ইন্টারন্যাশনাল ইউনিভার্সিটি

38
তোমার হলো শুরু, আমার হলো সারা’-রবীন্দ্রনাথের গানের এ উক্তি আর কারো জীবনের সঙ্গে মিলুক বা না মিলুক, রোকেয়া আফজাল রহমানের জীবনের সঙ্গে মিলে গিয়েছিল ঠিকই।রবীন্দ্রনাথ তাঁর জীবনকে সাঙ্গ করে যে বছর চলে যান, ঠিক সে বছরই জন্মগ্রহণ করেন রোকেয়া আফজাল রহমান, ১৯৪১ সালের ২৪ সেপ্টেম্বর কলকাতায়। তাঁর বাবা ব্যারিস্টার খোন্দকার আলী আফজাল ছিলেন বঙ্গীয় আইন পরিষদ বা বেঙ্গল লেজিসলেটিভ অ্যাসেমব্লির সচিব। আর মা সাদিয়া আফজাল কোনো আনুষ্ঠানিক পেশায় না থাকলেও ছিলেন গভীর শিক্ষানুরাগী।

মিসেস রোকেয়া আফজাল রহমানের শিক্ষাজীবন শুরু কলকাতার লরেটো কনভেন্ট স্কুলে। পরে করাচির সেন্ট জেভিয়ার্স কনভেন্ট কলেজ থেকে মাধ্যমিক, উচ্চমাধ্যমিক ও স্নাতক ডিগ্রি অর্জন করেন। স্নাতক ডিগ্রি অর্জনের পরপরই ১৯৬২ সালে তিনি করাচিতে মুসলিম কমার্শিয়াল ব্যাংকে যোগদান করেন। কর্মদক্ষতার স্বীকৃতি স্বরূপ ১৯৬৪ সালেই তিনি ব্যাংকের তৎকালীন পূর্ব পাকিস্তান শাখার ব্যবস্থাপক নিযুক্ত হন। লক্ষণীয় যে, ১৯৬২ সালে ব্যাংকিংয়ের মতো পেশায় মেয়েদের যোগদানই যেখানে ব্যাতিক্রমী ঘটনা, সেখানে তিনি দায়িত্ব পালন করেন ব্যাংকের ব্যবস্থাপক হিসেবে।



ব্যাংকিং জীবনের অভিজ্ঞতাকে পটভূমিতে রেখে ১৯৮০ সালে নিজস্ব উদ্যোগ ও মালিকানায় বাংলাদেশ শিল্প ব্যাংকের ঋণে মুন্সিগঞ্জে প্রতিষ্ঠা করেন ‘আর আর কোল্ড স্টোরেজ’। ১৯৯৭ সালে এ তালিকায় যুক্ত হয় অন্যের কাছ থেকে কিনে নেয়া আরো একটি কোল্ড স্টোরেজ। কোল্ড স্টোরেজ চালাবার ক্ষেত্রে তাঁর অভিজ্ঞতা একদিকে যেমন পরম আনন্দ ও পরিতৃপ্তির, অন্যদিকে তেমনি কিছু কিছু দুষ্টু সামাজিক ক্ষত দ্বারা তাড়িত পীড়নেরও। আনন্দ ও পরিতৃপ্তি এ কারণে যে এ কোল্ড স্টোরেজ দ্বারা প্রায় ১৫ হাজার চাষী সরাসরি উপকৃত হচ্ছেন এবং ব্যবসায়ের উন্নত নীতি নৈতিকতা মেনে এগুলো পরিচালিত হবার কারণে সংশ্লিষ্ট চাষীরা এর দালিলিক মালিকানার অংশীদার না হয়েও একে নিজেদের প্রতিষ্ঠান বলেই মনে করেন। আর তিনিও একে শুধু আলু সংরক্ষণ ও বেচাকেনার প্রতিষ্ঠান না ভেবে একে চাষীদের ভবিষ্যৎ চাষ পরিকল্পনা প্রণয়ন ও বাড়তি মুনাফা অর্জনের সহায়ক প্রতিষ্ঠান হিসেবে গড়ে তুলেছেন। আর সে কারণেই এ দু’ প্রতিষ্ঠানের ঢাকাস্থ অফিসে বসে কাজ করার চেয়ে নিয়মিত মুন্সিগঞ্জের কারখানায় গিয়ে কর্মী ও চাষীদের সাথে মিলে কাজ করতে অধিকতর আগ্রহ ও স্বাচ্ছন্দ বোধ করেন। আর কষ্ট ও পীড়নের বিষয় এই যে, এ কারখানা চালাতে গিয়ে তাকে অত্যন্ত শক্ত হাতে ও সাহসিকতার সাথে চরম ঝুঁকি নিয়ে স্থানীয় চাদাবাজ ও মাস্তানদেরকে মোকাবেলা করতে হয়েছে।

স্বনামধন্য বেসরকারি প্রতিষ্ঠান মাইডাসের একেবারে প্রতিষ্ঠালগ্ন থেকেই তিনি এর কর্মকাণ্ডের সাথে যুক্ত আছেন এবং সে যুক্ততার ধারাবাহিকতাতেই সংশ্লিষ্টদের সাথে মিলে পরবর্তীতে তিনি গড়ে তোলেন মাইডাস ফাইন্যান্সিং লিমিটেড। আর তিনিই বস্তুতঃ সেখানে মহিলা উদ্যোক্তাদের বিনা বন্ধকীতে ১০ লাখ টাকা পর্যন্ত ঋণদান, তাদের উৎপাদিত পণ্য বিক্রির জন্য ‘মিনি মার্ট’ নামক স্বতন্ত্র দোকান, উইমেন টু উইমেন সাপোর্ট পোগ্রাম ইত্যাদি চালু করেন।

১৯৭৪ সালে মহিলা উদ্যোক্তা সমিতি বা উইমেন এন্ট্রাপ্রেনার্স অ্যাসোসিয়েশন গড়ে তোলেন। ২০০৬ সালে তিনি প্রতিষ্ঠা করেন বাংলাদেশ মহিলা উদ্যোক্তা ফেডারেশন বা বিএফডব্লিউই; সারাদেশে যার সদস্য সংখ্যা প্রায় ৫ লাখ।

ব্যাংকিং ছেড়ে নিজেকে ব্যাসায় যুক্ত করলেও শুধু মুনাফা অর্জন কখনোই তাঁর জীবনের মূল লক্ষ্য ছিল না। বরং স্বপ্নের পরিধিতে সবচেয়ে বেশি জাজ্বল্যমান হয়ে আছে এ দেশের নারীদের মধ্যে একটি নতুন উদ্যোক্তা শ্রেণি গড়ে তোলা, প্রকারান্তরে যা তাদেরকে সচ্ছল, সাবলম্বী ও বর্ধিত সামাজিক ক্ষমতার অধিকারী হয়ে উঠতে সাহায্য করবে।আর এরূপ স্বপ্ন দেখেন বলেই তাঁর জিজ্ঞাসার জবাবে একজন দুস্থ নারী যখন জানান যে ঋণ নিয়ে কাজে লাগাবেন এমন কোনো কাজই তার জানা নেই-রোকেয়া আফজাল তখন মমতাপূর্ণ ধমকের সুরে তাকে বলেন যে, এটা হতেই পারে না। নিরুপায় নারী তখন জানান যে, তিনি শুধু রাধতে জানেন। পরে সাব্যাস্ত হলো যে, তাকে রান্নার জন্যই ঋণ দেয়া হবে এবং তাই হলো। তাকে ঋণ দেয়া হলো পিঠা তৈরির জন্য এবং সে পিঠা বেচে এখন তিনি স্বাবলম্বীই নন-একজন প্রতিশ্রুতিশীল নারী উদ্যোক্তাও বটে।

প্রসঙ্গত তাই বলা প্রয়োজন যে, সামর্থ বা সম্ভাবনার অভাব নয়-সামর্থ ও সম্ভাবনার ব্যাপারে আত্মবিশ্বাসের অভাবই বাংলাদেশে উদ্যোক্তা উন্নয়নের ক্ষেত্রে সবচেয় বড় বাধা; যে বাধা সামাজিক সংস্কার ও মূল্যবোধের কারণে আরো বেশি করে প্রযোজ্য।

বাংলাদেশের নারীদের সৃজনশীল চিন্তা ভাবনার ব্যাপারে রোকেয়া আফজাল রহমান শুধু আশাবাদীই নন-রীতিমতো মুগ্ধও। আর সে মুগ্ধতার বোধ থেকেই জানালেন কুড়িগ্রামের এক সৃজনশীল নারী উদ্যোক্তার কথা যিনি তার ঘরের জানালায় বাইরের দিকে মুখ করে একটি টেলিভিশন সেট বসিয়ে দিয়ে সূর্যাস্তের পর থেকে রাত ১২টা অব্দি পালা করে ভারতীয় চ্যানেলের জনপ্রিয় ধারাবাহিকগুলো দর্শককে বিনা পয়সায় দেখাচ্ছেন। আর প্রত্যন্ত গ্রামের খেটে খাওয়া দরিদ্র মানুষরা সারাদিনের খাটা খাটুনির পর বিনোদন লাভের এমন সুযোগ হাতছাড়া করবেন কেন? না, তারা তা করছেনও না। বরং সারি বেঁধে সেখানে জড়ো হচ্ছেন। আর সেই সুযোগে ওই নারী উদ্যোক্তা জড়ো হওয়া দর্শকদের কাছে প্রতিদিন চা-পুরি ইত্যাদি বিক্রি করে যা আয় করছেন তা রীতিমতো ঈর্ষণীয়।

রোকেয়া আফজাল রহমানের কর্মময় জীবন এমনই আরো নানা স্বপ্ন ও অভিজ্ঞতায় ভরা যেখানে ড্যাফোডিল বিশ্ববিদ্যালয়ের নারী শিক্ষার্থীরাও বাদ পড়েননি। তিনি প্রতিশ্রুত যে, তাঁর সুবিধামতো সময়ে তিনি এখানকার নারী শিক্ষার্থীদের নিয়ে কিছু কিছু নারী উদ্যোক্তার বাড়ি ও কারখানায় যাবেন।


রোকেয়া আফজাল রহমান খুবই শ্রদ্ধার সঙ্গে স্মরণ করেন যে, অ্যাঞ্জেলা গোমেজ ও স্যার ফজলে হাসান আবেদের মতো ব্যাক্তির সঙ্গে তিনি দীর্ঘ সময় কাজ করেছেন ও করছেন। মিয়ানমারের নেত্রী অংসাং সুচির সঙ্গে আন্তর্জাতিক কমিশনে একসঙ্গে কাজ করেছেন, যদিচ রোহিঙ্গা ইস্যুতে সুচির বর্তমান ভূমিকায় তিনি খুবই অসন্তুষ্ট।

নিজের কর্ম ও অভিজ্ঞতার স্বীকৃতিস্বরূপ রোকেয়া আফজাল রহমান দেশে-বিদেশে বহু পদক ও পুরস্কারে ভূষিত হয়েছেন যার মধ্যে লিডিং উইমেন এন্ট্রাপ্রেনার্স অব দ্য ওয়ার্ল্ড, মন্টে কার্লো ১৯৯৯, আমেরিকান চেম্বারের বিসনেস পার্সন অব দি ইয়ার ২০০৩ ইত্যাদি অন্যতম। তিনি প্রেসিডেন্সি ইউনিভার্সিটির প্রতিষ্ঠাতা সভাপতি, রিলায়েন্স ইন্স্যুরেন্সের উদ্যোক্তা পরিচালক, ডেইলি স্টার ও দৈনিক প্রথম আলোর পরিচালনা পর্ষদের সদস্য হিসেবেও গুরুত্বপূর্ণ অবদান রেখেছেন।

বাংলাদেশ সরকারের তত্ত্বাবধায়ক সরকারের উপদেষ্টা থাকাকালে একই সঙ্গে তিনি মহিলা ও শিশুবিষয়ক মন্ত্রণালয়, শ্রম ও কর্মসংস্থান মন্ত্রণালয়, সমাজকল্যাণ মন্ত্রণালয় এবং সংস্কৃতি মন্ত্রণালয়ের দায়িত্ব পালন করেন।

বাংলাদেশের ভবিষ্যৎ সম্পর্কে কী ভাবেন বা কতটা আশাবাদী-এ প্রশ্নের জবাবে তাঁর উত্তর-‘তিন সন্তানের সবাই উচ্চশিক্ষা গ্রহণের পর বিদেশে থেকে গিয়ে প্রতিষ্ঠা লাভের সব ধরনের সুযোগ ও সামর্থ থাকা সত্ত্বেও তাঁরা সবাই দেশে ফিরে যার যার ক্ষেত্রে অবদান রাখার চেষ্টা করছেন। আমি ব্যাপারে আমি তাদের উৎসাহিত করেছি। দেশের সম্পর্কে আশাবাদী না হলে আমি কি এটা করতাম?’

লেখক: প্রকল্প পরিচালক, ইনোভেশন অ্যান্ড ইনকিউবেশন সেন্টার (আইআইসি), ড্যাফোডিল ইন্টারন্যাশনাল ইউনিভার্সিটি।

39
এম আনিস উদ দৌলা এসিআই গ্রুপের চেয়ারম্যান। ১৯৮৭ সালে ব্রিটেনের বহুজাতিক কোম্পানি আইসিআই গ্রুপের বাংলাদেশের ব্যবস্থাপনা পরিচালক হন। এসিআই প্রতিষ্ঠা ছাড়াও বিভিন্ন সময়ে দায়িত্ব পালন করেছেন বেশ কয়েকটি ব্যবসায়ী ফোরামের। সফল এ উদ্যোক্তা তিন মেয়াদ মেট্রোপলিটন চেম্বার অব কমার্স অ্যান্ড ইন্ডাস্ট্রির প্রেসিডেন্ট ও চারবার বাংলাদেশ এমপ্লয়ার্স ফেডারেশনের সভাপতি নির্বাচিত হয়েছিলেন। বাংলাদেশ ক্রপ প্রটেকশন অ্যাসোসিয়েশনের সভাপতিও ছিলেন তিনি। এসিআইয়ের বেড়ে ওঠা, চ্যালেঞ্জ,ব্যবসায় নৈতিকতার চর্চা, পণ্যের মান, ভোক্তা আস্থা অর্জনসহ নানা বিষয়ে ৮ অক্টোবর ড্যাফোডিল ইন্টারন্যাশনাল ইউনিভার্সিটি আয়োজিত একাডেমিয়া লেকচার সিরিজে  তিনি কথা বলেন।



শুরুতই তিনি বলেন, আমার উদ্যোক্তা হওয়ার শুরুটা গল্পের মতো। আগে বহুজাতিক কোম্পানির একজন ঊর্ধ্বতন কর্মকর্তা হিসেবেই কর্মরত ছিলাম। এসিআই শুরুর আগে ব্রিটিশ অক্সিজেন গ্রুপে পাকিস্তান, কেনিয়া ও বাংলাদেশে দীর্ঘ ২৭ বছর বিভিন্ন পদে দায়িত্ব পালন করি। এর মধ্যে বাংলাদেশ অক্সিজেন লিমিটেডে ১২ বছর ব্যবস্থাপনা পরিচালক হিসেবেও দায়িত্ব পালন করেছি। এরপর ১৯৮৭ সালে বাংলাদেশে আইসিআইয়ের তিনটি কোম্পানির গ্রুপ ব্যবস্থাপনা পরিচালক হই, যে কোম্পানিটি ১৯২৫ সাল থেকে বিশ্বের বিভিন্ন দেশে রসায়ন শিল্পে গুরুত্বপূর্ণ অবদান রেখে আসছে। প্রতিষ্ঠানটি ১৯৬৮ সালে জীবন রক্ষাকারী ওষুধসামগ্রী উত্পাদনের লক্ষে নারায়ণগঞ্জে কারখানা নির্মাণ শুরু করে, বাংলাদেশে যার আনুষ্ঠানিকভাবে যাত্রা ১৯৭৩ সালে। তবে কোম্পানিটি এ দেশে লোকসান করছিল। প্রতিষ্ঠানটি পরিচালনার জন্য ব্যবস্থাপনা পরিচালকের দায়িত্ব দেয়া হলে অল্প সময়ের মধ্যে একে লাভজনক করে তুলি। এরপর প্রতিষ্ঠানটির মালিকানা আমার কাছে বিক্রির সিদ্ধান্ত নেয় আইসিআই বোর্ড। তারই ধারাবাহিকতায় ১৯৯২ সালে আইসিআই লিমিটেড স্থানীয় ব্যবস্থাপনার কাছে হস্তান্তরের মাধ্যমে অ্যাডভান্সড কেমিক্যাল ইন্ডাস্ট্রিজ (এসিআই) লিমিটেড নামকরণ নিয়ে যাত্রা করে।তবে আইসিআই বহুজাতিক কোম্পানি হলেও বাংলাদেশে এর কার্যক্রমে তেমন চমক ছিল না। কোম্পানিটিকে লাভজনক করতে আমাকে আনা হয়েছিল। এক্ষেত্রে আমি সফল হয়েছি। তবে সময় লেগেছিল চার বছর। পঞ্চম বছরে এসে কোম্পানিটি সিদ্ধান্ত নিল, ছোট দেশে তারা আর কার্যক্রম পরিচালনা করবে না। ১৯৯২ সালে তারা প্রস্তাব দিল— কোম্পানিটি আমি কিনে নেব কিনা। বললাম, আমার তো এত অর্থ নেই। তারা বলল, অর্থ লাগবে না। আপনি আয় অনুযায়ী অর্থ পরিশোধ করবেন। তবে আমাকে প্রতিষ্ঠানের কর্মীদের স্বার্থ রক্ষা করতে হবে এবং আইসিআইয়ের সুনাম অটুট রাখতে হবে। তাদের শর্তাবলি আমার ধারণার সঙ্গে মিলে গেল। কর্মীরা যদি সুখী না হন বা কোম্পানির সমৃদ্ধিতে অংশ নিতে না পারেন, তাহলে কাজের পরিবেশ সুন্দর হয় না। অন্যদিকে আমার প্যাশনও ছিল পণ্যের গুণগতমান নিশ্চিত করা। আইসিআই ছিল মানসম্পন্ন কোম্পানি। ব্যবসায় যদি সততা ও কাউকে বঞ্চিত করার প্রবণতা না থাকে, তাহলে আপনি অবশ্যই মানসম্পন্ন পণ্য উত্পাদনে সক্ষম হবেন এবং ব্যবসাটি লাভজনক হবে। কোম্পানিটি আমি পেয়েছি ঘটনাক্রমে। তারা বাংলাদেশে ব্যবসা বন্ধের সিদ্ধান্ত নেয়ার ফলে কর্মী থেকে আমি পরিণত হলাম এর স্বত্বাধিকারীতে। এমন সুযোগ আরো অনেকে পেতে পারতেন। তবে দেখার বিষয় হলো— এক. যে উদ্দেশ্যে আমি কোম্পানিটি নিয়েছিলাম, তা সমুন্নত রাখতে পেরেছি কিনা। দুই. সততার সঙ্গে ব্যবসা পরিচালনার মাধ্যমে টিকে থাকা। এসব বিষয়ে আমি সবসময় ছিলাম সচেতন।উদ্যোক্তা হিসেবে তার শুরুর দিকের কথা বলতে গিয়ে তিনি জানান, শুরুতে ঔষধ ও কৃষি প্রক্রিয়াজাত শিল্পের রাসায়নিক তৈরি নিয়ে যাত্রা করলেও এখন এসিআই একটি পরিপূর্ণ গ্রুপ হিসেবে পরিচালনা করা হচ্ছে। ওষুধ, ভোগ্যপণ্য, কৃষি প্রক্রিয়াজাত ও প্রযুক্তিসহ নানা ক্ষেত্রে ব্যবসা সম্প্রসারণ করেছি। ফার্মাসিউটিক্যালস কিংবা এগ্রোকেমিক্যালসে ব্যবসা সীমাবদ্ধ রাখিনি। কৃষকের প্রচুর চাহিদার কথা বিবেচনায় নিয়ে ফার্টিলাইজারে বিনিয়োগ করি। এছাড়া মাটির পুষ্টিরক্ষা, এগ্রোনোমিক প্র্যাকটিস ট্রেনিং, সময়মতো ফসল বাজারজাতকরণ নানামুখী চাহিদা রয়েছে। এরপর বাজার সম্ভাবনা বিবেচনায় নিয়ে ব্যবসাকে নানামুখী খাতে সম্প্রসারণ করি। সব সময়ই পণ্যের গুণগত মান বজায় রেখে ক্রেতা সন্তুষ্টিকে প্রাধান্য দিয়েছি। আমাদের মূল উদ্দেশ্য ছিল বাংলাদেশের মানুষের জীবনমান উন্নয়ন করা। সব সময়ই আমাদের ভাবনাচিন্তায় এটি ছিল এবং সেখান থেকে এসিআই সামান্যতম বিচ্যুত হয়নি।

 হিসেবে  নিজের প্রত্যাশা ও প্রাপ্তি সম্পর্কে এম আনিস উদ দৌলা বলেন, এসিআই শুরুর দিকে মূলত রাসায়নিক ও ওষুধনির্ভর ছিল। সেগুলো সফল ব্যবসা। এখন ব্যবসাকে নানামুখী খাতে সম্প্রসারণ করছি। আর তা করছি পাঁচটি মূলনীতির ওপর ভিত্তি করে। পণ্যের মান, গ্রাহককেন্দ্রিকতা, সততা, স্বচ্ছতা, ক্রমাগত উন্নতি ও উদ্ভাবন। বর্তমানে ওষুধ খাতে আমরা গুরুত্বপূর্ণ অবদান রাখতে সমর্থ হয়েছি। এ পর্যন্ত ৫০০টিরও বেশি ওষুধ বাজারজাত করেছে এসিআই ফার্মাসিউটিক্যালস। তাছাড়া বাংলাদেশে আইএসও ৯০০১ সনদপ্রাপ্ত প্রথম প্রতিষ্ঠান আমরা। দেশের ওষুধের চাহিদা মেটানোর পরও শ্রীলংকা, ইয়েমেন, মিয়ানমার, ভিয়েতনামসহ মোট ৩৫টি দেশে রফতানি করছি। পাশাপাশি এশিয়া, আফ্রিকা ও মধ্য আমেরিকার বিভিন্ন দেশে বাজার তৈরিরও চেষ্টা চালাচ্ছি। কনজিউমার ব্র্যান্ড হিসেবে এসিআইয়ের কয়েকটি পণ্য সুনাম কুড়িয়েছে। এছাড়া গৃহস্থালিতে প্রয়োজনীয় কিছু সামগ্রী জনপ্রিয় হচ্ছে। অন্যদিকে কৃষিপ্রধান দেশের কৃষকদের চাষাবাদ প্রক্রিয়া আরো সহজ করে তোলা প্রতিষ্ঠানটির এগ্রোবিজনেস গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা রাখছে। শস্য সুরক্ষায় কীটনাশক তৈরি, উন্নত মানের সার, বিভিন্ন কৃষি মেশিনারি সরবরাহ করে থাকে এ প্রতিষ্ঠান। পাশাপাশি পশুস্বাস্থ্যের জন্য বিভিন্ন ধরনের ভ্যাকসিন, ওষুধ ইত্যাদিও বাজারজাত করছে। উন্নত মানের বীজ সরবরাহের লক্ষ্য নিয়ে ২০০৮ সালে এসিআই পুরোপুরি এ ব্যবসায় নামে। অন্যদিকে ক্রেতাদের পূর্ণ সন্তুষ্টি রয়েছে আমাদের রিটেইল চেইন ‘স্বপ্ন’-এর ওপর। স্বপ্ন থেকে পণ্য বিক্রি বাড়ছে, যার অর্থ ক্রেতাদের কাছে এর গ্রহণযোগ্যতা বাড়ছে। সব মিলিয়ে উচ্চপ্রযুক্তি ও ক্রেতা সন্তুষ্টি রক্ষায় উদ্যোক্তা হিসেবে সব সময়ই চেষ্টা করেছি। সুনিয়ন্ত্রিত পরিকল্পনা এবং উন্নত মানের কারণে এসিআইয়ের তৈরিকৃত অধিকাংশ পণ্যই আজ দেশের বাজারে জনপ্রিয়। যেটি ধরে রাখতে আজীবন চেষ্টা করে যাব।




নিজের প্রতিষ্ঠানের ভবিষ্যত কাজ নিয়ে তিনি তার পরিকল্পনার কথাও জানান। এ ব্যাপারে তিনি বলেন, কৃষিতে কাজ শুরুর পর দেখলাম, একই কৃষকের কাছে যেতে হচ্ছে সার, বীজ ও এগ্রোকেমিক্যালসের জন্য। তখন ভাবলাম, আমরা তো কৃষির সবকিছুই বুঝি। আমরা কেন তিনটিই একসঙ্গে দিতে পারব না? আমরা কৃষির সমন্বিতকরণের ব্যবস্থা নিলাম। জমি চাষের জন্য ট্রাক্টর বিক্রি শুরু করলাম। এসিআই মোটরস সেসব বিক্রি করে। চীন ও ভারত থেকে আমদানি করে এগুলো বাজারজাত করছি আমরা। তাতে কৃষকের চাহিদা ভালোই পূরণ হচ্ছে। এগুলো কিনে গ্রামের কেউ কেউ স্বাবলম্বীও হচ্ছেন। বেকাররা কৃষি যন্ত্রপাতি কিনে ভাড়া দিচ্ছেন কৃষককে। তাতে লাভ হচ্ছে দুজনারই। বেকারের জীবিকা হচ্ছে, অন্যদিকে স্বল্প সময়ে জমি চাষ করতে পারছেন কৃষক। সারা দেশে আমাদের ১২টি সার্ভিস সেন্টার আছে। এর মাধ্যমে সার্ভিস অরিয়েন্টেড ব্যবসাও করতে পারছি আমরা। এসবই আমাদের অভিজ্ঞতা থেকে প্রাপ্ত। এগুলো আমরা কাজে লাগাতে পারব অন্যত্রও। এভাবে সমন্বিতকরণের কাজটি করলাম। এখন ধান ও সবজির হাইব্রিড বীজ উত্পাদন করছে এসিআই। সর্বশেষ ভোগ্যপণ্য বিপণনে গেলাম। আমাদের দেশে আগে লবণ ছিল কাদাযুক্ত। আমরা সেটিকে ফিল্টার করে তাতে সঠিক মাত্রায় আয়োডিন দিয়ে প্রথম পিওর সল্ট বাজারজাত করলাম। এটা আমাদের গৌরবও বটে। এরপর ভাবলাম গৃহিণীদের জন্য কিচেন বাস্কেটের সব প্রয়োজন মেটাব। আটা–ময়দা তৈরি শুরু করলাম। প্রতিদিন ৩০০ টন প্যাকেট জাত আটা উত্পাদন করছি। আমাদের কারখানা পরিপূর্ণ ক্যাপাসিটি অনুযায়ী চলে। এটা হয়েছে কেবল আমাদের ব্র্যান্ডের প্রতি মানুষের আস্থার কারণে। এরপর চিনি, সয়াবিন ও সরিষার তেল, গুঁড়া মসলা বিক্রি শুরু করে এসিআই। কীভাবে মানুষের কেনাকাটার মান উন্নয়ন করা যায়, তাও চিন্তায় ছিল আমাদের।মানুষ কাঁচাবাজারে যাবে নাকি শীতাতপ নিয়ন্ত্রিত পরিবেশে মানসম্পন্ন পণ্য কিনবে? আমরা মধ্যম আকারের আউটলেট বানালাম। এ কনসেপ্টে আমরা প্রায় ৪৫টি আউটলেট করেছি। এগুলোর সিংহভাগই মূলত ঢাকা, চট্টগ্রাম ও সিলেটে। এখন আমরা চেইন রিটেইলিংয়ের দক্ষতা বাড়াচ্ছি। বাংলাদেশের মধ্যবিত্তশ্রেণীর মাঝে যেসব পরিবারের সদস্য বিদেশে থাকেন, তারা আর্থিক দিক থেকে বেশ সচ্ছল। তারা সাধারণত বিদ্যমান কাঁচাবাজারে যেতে অনিচ্ছুক। তাদের জন্য স্বপ্নে বাজার করার সুযোগ করে দেয়া হলো। এটা ভালোই চলছে। ধীরে ধীরে পণ্যের সংখ্যা ও আউটলেট বাড়াচ্ছি। আমরা প্লাস্টিক প্যাকেজিং উৎপাদন ও মার্কেটিং করি। একটা প্লাস্টিক ফ্যাক্টরি আমাদের আছে। এ দেশের ছোট–বড় বহু কোম্পানিকে প্লাস্টিক মোড়ক সরবরাহ করি। খাবারের মধ্যে আচার, চকোলেট প্রভৃতি তৈরি করছি। এগুলোকে আমরা বলি ফান ব্র্যান্ড। এছাড়া পোলট্রি ব্যবসা আছে গোদরেজের সঙ্গে। এটি করা হয়েছে যৌথ উদ্যোগে। টেটলির সঙ্গে আমাদের চায়ের ব্যবসা রয়েছে। ডাবরের সঙ্গেও যৌথ উদ্যোগ রয়েছে আমাদের। আরো কিছু যৌথ উদ্যোগে ব্যবসা করার ইচ্ছা রয়েছে। বিশ্বের এক নম্বর পেইন্ট ব্র্যান্ড এক্সো নোবেলের সঙ্গেও আমরা চুক্তি সম্পাদন করেছি।

নিজের বক্তব্য শেষে তিনি উক্ত অনুষ্ঠানে উপস্থিত শিক্ষার্থীদের বিভিন্ন প্রশ্নের উত্তর দেন। ড্যাফোডিল বিশ্ববিদ্যালয়ের বিবিএর ছাত্র আব্দুল কাইয়ুম প্রশ্ন করেন, শুরুর সময় ও এখনকার ব্যবসায় প্রতিবন্ধকতার মধ্যে কী পার্থক্য লক্ষ করছেন? কাইয়ুমের প্রশ্নের উত্তরে তিনি জানান, একজন ব্যবসায়ী বা উদ্যোক্তা হিসেবে সব সময়ই অনেক চ্যালেঞ্জ মোকাবেলা করতে হয়। নানা ধরণের নিত্য–নতুন চ্যালেঞ্জ মোকাবেলা করেই ব্যবসা করতে হয়। চ্যালেঞ্জ কোনো সময়ই এক রকম থাকে না। সময়ের সঙ্গে সঙ্গে এর পরিবর্তন হয়। এখনকার প্রধান চ্যালেঞ্জ হলো— জ্বালানি জোগাড়, প্রতিযোগিতায় টিকে থাকা, উত্পাদন প্রক্রিয়া স্বাভাবিক রাখতে বাজারের সঙ্গে তালমিলিয়ে টেকসই ব্যবস্থা প্রবর্তন প্রভৃতি। এক্ষেত্রে উত্পাদন খরচ যেমন গুরুত্বপূর্ণ, তেমনি এর ধারাবাহিকতা রক্ষাও জরুরি। বিদ্যুত্–গ্যাস না থাকলে ডিজেল বা ফার্নেস অয়েল দিয়ে পণ্য উত্পাদন করতে হয়, এতে খরচ পড়ে বেশি। কিন্তু উত্পাদনের ধারাবাহিকতা রক্ষা করতে সে খরচ উদ্যোক্তা বা ব্যবসায়ীকে বহন করতে হয়। বাজারে পণ্য সরবরাহে বিঘ্ন না ঘটে, সেদিকেই লক্ষ থাকে তাদের। সুনাম ধরে রাখতে লাভ–লোকসানের বিষয়টি বিবেচনায় না নিয়ে অনেক সময় উত্পাদনের ধারাবাহিকতা রক্ষায় এটি করতে হয়। আগে রেগুলেটরি চ্যালেঞ্জ ছিল। এখন সেসব কমে গেছে। বর্তমানে গুরুত্বপূর্ণ চ্যালেঞ্জ হলো প্রতিযোগিতা। এখন আমাদের ব্যবসাটা ঠিক চ্যালেঞ্জের জায়গায় এসেছে। আগে লাইসেন্স পেয়েই বাজার যাচাই না করেই পণ্য আমদানি করা যেত। কারণ সবই বিক্রি হয়ে যেত। এখন সে অবস্থা নেই। এখন পণ্য আনতেও অনুমতি নিতে হয়। আমদানি করা পণ্য অবিক্রিতও থেকে যায় অনেক সময়, দাম কমে যাওয়া ও নষ্ট হওয়ার শঙ্কাও থাকে। বড় চ্যালেঞ্জ হলো, ব্যবসায় ঠিকে থাকতে হলে প্রতিনিয়ত ভ্যালু অ্যাড করে যেতে হবে। যে কোম্পানি যত বেশি ভ্যালু অ্যাড করতে পারবে, বাজারে সে তত এগিয়ে যাবে।ন্টারপ্রেনারশিপ বিভাগের ছাত্রী সানজিদা আফরিন প্রশ্ন করেন, ব্যবসায় নৈতিকতা ধরে রাখতে করণীয় কী হতে পারে? উক্ত প্রশ্নের জবাবে এম আনিস উদ দৌলা বলেন, নৈতিকতা বলে–কয়ে হয় না। নিজ থেকে তা অর্জন করতে হয়। বাংলাদেশে এটাই এক সমস্যা। অন্যকে উপদেশ দিতে ভালো লাগে, কিন্তু নিজে সেটি মানি না। প্রতিটি ক্ষেত্রেই এমন চিত্র। এক্ষেত্রে নেতৃত্বে দুর্বলতার কারণেও ব্যবসায় ইতিবাচক ভাবমূর্তি তৈরি সম্ভব হচ্ছে না। তাছাড়া সংগঠন দিয়েও নৈতিকতা প্রতিষ্ঠা করা যায় না। এটি আসে ব্যবসা ও দৃষ্টান্ত থেকে। বাজারে নৈতিকতা ধরে রেখে আমি সফল হলে দৃষ্টান্ত তৈরি হবে। কেবল ব্যবসার ক্ষেত্রে নয়, সমাজে অন্যান্য ক্ষেত্রে নৈতিকতার চর্চা প্রয়োজন। সবচেয়ে জরুরি রাজনীতির ক্ষেত্রে নৈতিকতার চর্চা। মনে রাখতে হবে— সুনাম অর্জনে অনেক ত্যাগ স্বীকার করতে হয়।

সবশেষে নতুন উদ্যোক্তাদের জন্য পরামর্শ দিয়ে তিনি বলেন, তরুণ নেতৃত্বকেই দায়িত্ব নিতে হবে। এখন তারা যদি ঠিকমতো তৈরি না হয়, সেটি আমাদের ব্যর্থতা। আমাদেরও নেতৃত্বে আর ফিরে যাওয়ার পথ নেই। আমরা যখন নেতৃত্বে ছিলাম, তখন চেষ্টা করেছি যাতে কোনো ব্যক্তিস্বার্থ চরিতার্থ না হয়। সেটিই দৃষ্টান্ত হতে পারে নতুন উদ্যোক্তাদের জন্য। তাছাড়া সমাজের সবখানেই নীতি–নৈতিকতার অবক্ষয় হচ্ছে। সেখানে ব্যবসায়ী সমাজও এর বাইরে নয়। তাই এদিক সম্পর্কে নতুনদেরও সজাগ থাকতে হবে।

কয়েকটি বিষয় সব সময়ই বিবেচনায় নিয়ে ব্যবসা শুরু করা উচিত। প্রথমত. কোনো পরিকল্পনাই স্বল্পমেয়াদে করা উচিত নয়। সব সময়ই ব্যবসার চিন্তা নিতে হবে দীর্ঘমেয়াদে। এছাড়া পণ্যের মানের ব্যাপারে কোনো আপস করা চলবে না। মনে রাখতে হবে স্বল্প মেয়াদে হয়তো ভেজাল মিশিয়ে কিছু মুনাফা করা যায়, কিন্তু ব্যবসা বেশি দিন পরিচালনা সম্ভব হবে না। তাছাড়া তীব্র প্রতিযোগিতার মধ্য দিয়ে ব্যবসা পরিচালনা করতে হবে এমন মানসিকতাও থাকতে হবে। ভোক্তারাই সবচেয়ে বড় বিচারক, তারা বিশুদ্ধতাই বেছে নেন।

40

লিডারশিপ ডেস্ক

কোনো উদ্যোগ সফল হওয়ার জন্য উদ্যোক্তার নেতৃত্ব ও আন্তরিকতাই সবচেয়ে গুরুত্বপূর্ণ। এর সঙ্গে চ্যালেঞ্জ নেওয়ার মানসিকতা থাকতে হবে। উদ্যোগের জন্য পুঁজির চেয়ে বড় বিষয় হলো উদ্যোক্তার আগ্রহ। দক্ষতাও সফল উদ্যোগের পূর্বশর্ত।

গতকাল শনিবার ড্যাফোডিল ইন্টারন্যাশনাল ইউনিভার্সিটি (ডিআইইউ) আয়োজিত গণবক্তৃতায় বিশিষ্ট শিল্পোদ্যোক্তা, ব্যবসায়ীদের শীর্ষ সংগঠন এফবিসিসিআইর সাবেক সভাপতি এ. কে. আজাদ এমন মতামত দেন। উদ্যোক্তা উন্নয়নের ওপর এ বক্তৃতার আয়োজন করে বিশ্ববিদ্যালয়ের ইনোভেশন ও ইনকিউবেশন সেন্টার।

এ. কে. আজাদ বলেন, শুধু সততা, কঠোর পরিশ্রম ও অধ্যবসায় থাকলেই সফল হওয়া যাবে তা নয়। এগুলোর পাশাপাশি যে উদ্যোগ নেওয়া হচ্ছে, তা সম্পর্কে উদ্যোক্তার সুস্পষ্ট ধারণা থাকতে হবে। বাজার ব্যবস্থা সম্পর্কে জানতে হবে। নিজের উদ্যোগকে এগিয়ে নিতে সব ধরনের চ্যালেঞ্জ মোকাবেলায় আন্তরিক হতে হবে। পণ্য ও সেবার সেরা মান নিশ্চিত করতে সর্বাত্মক চেষ্টা থাকতে হবে। লেনদেনে স্বচ্ছ থাকতে হবে। এসব থাকলে পুঁজির অভাব কাউকে আটকাতে পারে না।

হা-মীম গ্রুপের ব্যবস্থাপনা পরিচালক এ. কে. আজাদ মধ্যবিত্ত পরিবার থেকে কীভাবে নানা প্রতিবন্ধকতা অতিক্রম করে নিজেকে সফল উদ্যোক্তা হিসেবে দাঁড় করিয়েছেন- বক্তৃতার একটি অংশে তা তুলে ধরেন তিনি। পুঁজির অভাব, বাজার প্রতিযোগিতা, রাষ্ট্রীয় ও আন্তর্জাতিক প্রতিবন্ধকতাসহ নানা সমস্যা সমাধানের গল্প বলেন তিনি। প্রায় দেড় ঘণ্টার (প্রশ্নোত্তর পর্বসহ) বক্তৃতায় উঠে আসে তার ছাত্রজীবন, সমাজ দর্শন এবং সমাজ ও মানবকল্যাণে ভবিষ্যৎ ভাবনাও।

অনুষ্ঠানে ডিআইইউর ব্যবসায় প্রশাসন, ডিপার্টমেন্ট অব এন্টারপ্রেনারশিপ বিভাগসহ বিভিন্ন বিভাগের কয়েকশ’ শিক্ষার্থী, ডিআইইউর বোর্ড অব ট্রাস্টির চেয়ারম্যান মো. সবুর খান, সাবেক উপাচার্য লুৎফর রহমান এবং বিভিন্ন বিভাগের ডিন ও শিক্ষকরা উপস্থিত ছিলেন। অনুষ্ঠানের শুরুতে হা-মীম গ্রুপের ওপর নির্মিত একটি প্রামাণ্যচিত্র প্রদর্শন করা হয়। এ. কে. আজাদের সংক্ষিপ্ত জীবনী তুলে ধরেন ডিআইইউর ইনোভেশন ও ইনকিউবেশন সেন্টারের পরিচালক আবু তাহের।

এ. কে. আজাদ বলেন, বাংলাদেশের সম্ভাবনা ব্যাপক। এখানে বেসরকারি খাতের অনেক সুযোগ রয়েছে। সেজন্য বাস্তবভিত্তিক ও সময়োপযোগী উদ্যোক্তা দরকার। তিনি বলেন, একার পক্ষে সব কিছু সম্ভব হয় না। অনেক ক্ষেত্রে যৌথ উদ্যোগ নিতে হয়। কিন্তু যৌথ উদ্যোগে যিনি নেতৃত্ব দেন, তাকে ত্যাগী হতে হয়। ত্যাগ স্বীকার না করলে উদ্যোগ যেমন সফল হয় না, তেমনি নেতাও হওয়া যায় না। কোনো প্রতিষ্ঠান একার মাধ্যমে চলে না। বিভিন্ন পর্যায়ে বহু কর্মীর সন্তুষ্ট থাকাটা খুবই জরুরি। শুধু মুনাফা দেখলেই চলবে না, মুনাফা যাদের মাধ্যমে আসবে, তাদের সন্তুষ্টি অর্জন করতে হবে।

বক্তৃতার এক পর্যায়ে এ. কে. আজাদ দেশে শিক্ষার মান নিয়ে হতাশা প্রকাশ করেন। তিনি বলেন, ‘আমি শাহ্জালাল ইসলামী ব্যাংকের চেয়ারম্যান ছিলাম। সেখানকার নিয়োগ পরীক্ষার উত্তরপত্র ও মৌখিক পরীক্ষা দেখেছি। চ্যানেল টোয়েন্টিফোর এর জনবল নিয়োগে পরীক্ষা নিয়ে থাকে। এসব প্রতিষ্ঠানের নিয়োগ পরীক্ষায় যারা অংশ নেন, তাদের লেখার মান দেখে আমি বিস্মিত। রেজাল্ট ভালো। নামকরা শিক্ষা প্রতিষ্ঠান থেকে লেখাপড়া করেছে। অথচ নিয়োগ পরীক্ষার উত্তরপত্রে যা লিখছে তা কোনোভাবেই গ্রহণযোগ্য নয়।’ তিনি বলেন, অনেক ক্ষেত্রে জনবলের অভাব রয়েছে। যোগ্য লোক পাওয়া যাচ্ছে না। তিনি শিক্ষার্থীদের মানোন্নয়নের জন্য উপস্থিত শিক্ষকদের অনুরোধ করেন।

অনুষ্ঠানে একজন শিক্ষার্থী জানতে চান, কেউ যদি শূন্য থেকে উদ্যোক্তা হতে চান তার জন্য তার পরামর্শ কী? জবাবে এ. কে. আজাদ বলেন, পুঁজির চেয়ে বড় বিষয় উদ্যোক্তার আগ্রহ। যদি কেউ উদ্যোক্তা হতে চান, তাহলে তাকে অবশ্যই সংশ্লিষ্ট বিষয়ে জানতে হবে। বাজার, চাহিদা, পণ্যের মান ইত্যাদি বিষয়ে স্পষ্ট ধারণা থাকতে হবে। এরপর উদ্যোক্তার পুঁজির সামর্থ্য অনুযায়ী উদ্যোগ নেওয়া উচিত।

তৈরি পোশাকের পরেই বাংলাদেশের কৃষির সম্ভাবনা ব্যাপক বলে মনে করেন ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের অ্যালামনাই অ্যাসোসিয়েশনের সভাপতি এ. কে. আজাদ। তিনি বলেন, বিশ্বের বিভিন্ন দেশ প্রক্রিয়াজাত কৃষি পণ্যের মাধ্যমে প্রচুর আয় করছে। বাংলাদেশেও কৃষি পণ্যের প্রক্রিয়াজাত খাতে অনেক সম্ভাবনা রয়েছে।

যেভাবে উদ্যোক্তা: এ. কে. আজাদ নিজের জীবনের গল্প বলতে গিয়ে বলেন, ‘১৯৭০ সালে পঞ্চম শ্রেণিতে বৃত্তি পাওয়ার পরই পরিবার বিশেষ করে বাবার আশার কেন্দ্রবিন্দুতে চলে আসি। বাবা মাথায় ঢুকিয়ে দেন বড় কিছু করতে হবে। ১৯৭৬ সালে সফলভাবে মাধ্যমিক পাস করলাম। কলেজে ভর্তি হলাম। কিন্তু সমাজের বিভিন্ন ক্ষেত্রে বঞ্চনা দেখে মানুষের মৌলিক অধিকার আদায়ে ছাত্ররাজনীতিতে সক্রিয় হই। সমাজতান্ত্রিক রাজনীতিতে দীর্ঘ সময় ব্যয় করি। যার কারণে সময়মতো উচ্চ মাধ্যমিক পরীক্ষা দেওয়া হয়নি। দু’বছর পর উচ্চ মাধ্যমিক পরীক্ষা দিয়ে ১৯৮০-৮১ শিক্ষাবর্ষে ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ে ফলিত পদার্থবিজ্ঞান বিভাগে সম্মান শ্রেণিতে ভর্তি হই।’

তিনি বলেন, ‘একজন ব্যাংকারের কাছ থেকে স্বল্প বেতনে জীবনযাপনের জটিল হিসাব-নিকাশ শুনে চাকরির ইচ্ছা উবে যায়। এ ছাড়া বিশ্ববিদ্যালয়ের অনেককে পাস করে বেকার থাকতে বা টিউশনি করে চলতে দেখে কীভাবে ছাত্রাবস্থায় কিছু একটা করা যায় সেই চিন্তায় ছিলাম। সেই ভাবনা থেকেই প্রথমে নিজের রুমমেট ফার্মেসি বিষয়ে পাস করা এক ছাত্রের সঙ্গে একটি উদ্যোগ নিই। কিন্তু ওই অংশীদারের লিবিয়াতে চাকরি হয়ে যাওয়ায় ভেস্তে যায় সেই উদ্যোগ।’

এ কে. আজাদ বলেন, ১৯৮৩ সালে কয়েক বন্ধু মিলে গার্মেন্ট কারখানা স্থাপনের পরিকল্পনা করেন। ৭৮টি মেশিন নিয়ে ছোট পরিসরে কারখানা চালু করেন। কিন্তু সে উদ্যোগে বাধা হয়ে দাঁড়ায় তৎকালীন আমেরিকান সরকারের এক সিদ্ধান্ত। বাংলাদেশ থেকে তৈরি পোশাক নেওয়ার ক্ষেত্রে নানা বিধিনিষেধ আরোপ করে দেশটি। পাশাপাশি দেশের কিছু ব্যবসায়ী নতুন ব্যবসায়ীদের চাপে ফেলতে নানা ষড়যন্ত্র করেন। ব্যবসার পাশাপাশি সে সময়ের স্বৈরাচারবিরোধী আন্দোলনেও ছিলেন তিনি। ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের কলাভবন থেকে গ্রেফতার হয়ে ২৩ দিন জেল খাটেন। জেল থেকে ফিরে দেখেন বন্ধুদের নিয়ে গড়া উদ্যোগও ভেস্তে গেছে। ছাত্রদের আন্দোলনে নামিয়ে দিয়ে পেছনে নেতাদের সঙ্গে সরকারের আঁতাত দেখে রাজনীতির প্রতি আগ্রহ হারান। এরপর একাই ব্যবসার উদ্যোগ নেন। রাজধানীর কারওয়ান বাজারে ছোট একটি জায়গায় মাত্র ২১টি মেশিন নিয়ে চালু করেন আরেকটি গার্মেন্ট কারখানা। এরপর নানা চড়াই-উতরাই এলেও আর পেছনে ফিরে তাকাতে হয়নি।

অনুষ্ঠানে প্রদর্শিত প্রামাণ্যচিত্রে জানানো হয়, ১৯৮৩ সালে যাত্রা শুরু করা হা-মীম গ্রুপ বর্তমানে বছরে ৫২ কোটি ডলার রফতানি আয় করছে। তৈরি পোশাক খাতের প্রায় সব ক্ষেত্রেই হা-মীম গ্রুপের নিজস্ব প্রতিষ্ঠান রয়েছে। এর পাশাপাশি গণমাধ্যম খাতেও বিনিয়োগ রয়েছে এ গ্রুপের। আধুনিক যন্ত্রপাতি ব্যবহার করে নিরাপদ ও পরিবেশবান্ধব উৎপাদন ব্যবস্থায় হা-মীম গ্রুপ দেশের অন্যতম। কর্মীদের চিকিৎসা সুবিধা, কর্মীর সন্তানদের জন্য ডে কেয়ার সেন্টারসহ অন্যান্য সুযোগ-সুবিধা নিশ্চিত করেছে হা-মীম কর্তৃপক্ষ। এ. কে. আজাদ দেশের শীর্ষ করদাতাদের অন্যতম। হা-মীম গ্রুপ অর্জন করেছে দেশি-বিদেশি বিভিন্ন স্বীকৃতি। নিজের প্রতিষ্ঠান সম্পর্কে এ. কে. আজাদ বলেন, আগামী পাঁচ থেকে ছয় বছরের মধ্যে হা-মীম গ্রুপ এক বিলিয়ন ডলারের রফতানি আয় করবে।


এ. কে. আজাদের বক্তব্যের ভিডিও দেখুন:

41

ড্যাফোডিল ইন্টারন্যাশনাল ইউনিভার্সিটির প্রধান ফটকের সামনে ভীড়। এ দৃশ্য নতুন নয়। তবে কারণটা নতুন। আজ (শনিবার, ২৪ ফেব্রুয়ারি) এখানে এসেছেন দেশবরেণ্য শিল্পোদ্যোক্তা ও আনোয়ার গ্রুপ অব ইন্ডাস্ট্রিজের চেয়ারম্যান আলহাজ আনোয়ার হোসেন। তিনি যখন গাড়ি থেকে পা রাখলেন বিশ্ববিদ্যালয়ের সিঁড়িতে তখন তীব্র তেজ নিয়ে জ্বলতে থাকা ফাল্গুনের সূর্যটা হঠাৎ করেই যেন খানিকটা চুপসে গেল। কেনই বা যাবে না? যে আনোয়ার হোসেন মাত্র সাত বছর বয়সে বাবাকে হারিয়ে সংসারের হাল ধরেছেন, বাবার রেখে যাওয়া সামান্য বোতামের ব্যবসা থেকে তিল তিল করে গড়ে তুলেছেন আনোয়ার গ্রুপ অব ইন্ডাস্ট্রিজ নামের বিশাল শিল্প সাম্রাজ্য, তার উজ্জ্বল আলোর সামনে শ্রদ্ধায় মাথা নোয়াবে সূর্য—সেটাই তো স্বাভাবিক। এই বরেণ্য শিল্পোদ্যোক্তা আজ বয়সের ভারে ন্যূজ্ব। ভুগছেন স্মৃতিভ্রম বা ডিমেনসিয়া নামের বিরল রোগে। অনেক চেনা মানুষকেও চিনতে পারেন না, তবু যখন দেখলেন ঢাকা চেম্বারের সাবেক সভাপতি মাহবুবুর রহমান দাঁড়িয়ে আছেন ড্যাফোডিল বিশ্ববিদ্যালয়ের লাউঞ্জে, তাঁকে দেখামাত্র বুকের মধ্যে জড়িয়ে ধরলেন আনোয়ার হোসেন। এই সময় স্মৃতি তার সঙ্গে প্রতারণা করেনি, তিনি ঠিকই চিনতে পেরেছেন তার দীর্ঘ ব্যবসায়ী জীবনের সহচরকে, যার কাঁধে কাঁধ মিলিয়ে প্রতিষ্ঠা করেছিলেন ঢাকা চেম্বার অব কমার্স অ্যান্ড ইন্ডাস্ট্রিজ। একসঙ্গে কত কাজ করেছেন তাঁরা, একটু একটু করে গড়ে তুলেছেন ঢাকা চেম্বারকে; মাহবুবুর রহমানকে বুকে চেপে ধরে সেসব পুরনো দিনগুলোতে যেন ফিরে গেলেন তিনি। চোখ ভরে উঠল জলে। পরিবেশ ভারী হয়ে উঠল আবেগে। কী নিবিড় সম্পর্ক! কী দৃঢ় বন্ধন!







এমন হাজারো মানুষের সঙ্গে আনোয়ার হোসেনের ছিল নিবিড় সম্পর্ক। কী রিকশাওয়ালা, কি বাড়ির দারোয়ান, কি কারখানার শ্রমিক, ‍কি ব্যাংক ম্যানেজার, কি উচ্চপদস্থ সরকারি আমলা—সবার সঙ্গে ছিল তাঁর হৃার্দিক সম্পর্ক। এই সম্পর্কই তাকে ব্যবসায়ী হিসেবে করেছে সফল।তাঁর সাফল্যের গল্প শুনতেই সেদিন ড্যাফোডিল ইন্টারন্যাশনাল ইউনিভার্সিটি আয়োজন করেছিল ভিন্ন আমেজের এক অনুষ্ঠানের। ডিআইইউ ইন্ডাস্ট্রি একাডেমিয়া লেকচার সিরিজ নামের ওই অনুষ্ঠানটি মূলত তরুণ শিক্ষার্থীদেরকে উদ্যোক্তা হওয়ায় উৎসাহী করতে সফল উদ্যোক্তার একক বক্তৃতার। ড্যাফোডিল বিশ্ববিদ্যালয় দেশের ব্যবসাক্ষেত্রের প্রথিতযথা ব্যবসায়ীদের জীবন, উদ্যোক্তা হওয়ার গল্প ও সংগ্রামের ইতিহাস শিক্ষার্থীদের শোনাতে এ ধরনের আয়োজন গত দুই বছর ধরে করে আসছে। সেদিন গল্প শোনার ১২তম আসর বসেছিল বিশ্ববিদ্যালয়ের ৭১ মিলনায়তনে।


42
কিউবা বিপ্লবের ৬০ বছর: বাংলাদেশে এর প্রাসঙ্গিকতা
আবু তাহের খান


২০১৯ সালের ১ জানুয়ারি, কিউবা বিপ্লবের ৬০ বছর পূর্ণ হলো। বাংলাদেশের স্বাধীনতা লাভের এক যুগ আগে সাধিত এ বিপ্লবের (২৬ জুলাই-১ জানুয়ারি ১৯৫৯) সাফল্য শুধু কিউবার জনগণকেই নতুন জীবনের আস্বাদন জোগায়নি, বিশ্বের অন্যান্য বহু দেশের সাধারণ মানুষের জীবনের দাবি ও অধিকার প্রতিষ্ঠার সংগ্রামকেও এগিয়ে নিয়ে যেতে অনেকখানি সহায়তা করেছে। আর বাংলাদেশের অর্থনীতি, সমাজ, রাজনীতিতে এ বিপ্লবের প্রভাব ও প্রাসঙ্গিকতা এতটাই নিবিড় যে, এক্ষেত্রে বিষয়টি স্বতন্ত্র গবেষণার দাবি রাখে। তাই সীমিত পরিসরের এ আলোচনায় এখানে শুধু বিপ্লবের মূল চেতনা, বৈশিষ্ট্য ও অভিজ্ঞতাগুলোকে স্মরণ করার চেষ্টা করা হলো, যেগুলোকে কেন্দ্র করে সামনের দিনগুলোয় আরো নানামাত্রিক আলোচনা বহুদূর পর্যন্ত এগিয়ে যেতে পারে।

যোজন দূরত্বের ভৌগোলিক অবস্থান ও সমাজকাঠামোর মধ্যকার নানা বৈসাদৃশ্য থাকা সত্ত্বেও বাংলাদেশের স্বাধীনতা সংগ্রাম ও কিউবা বিপ্লবের পটভূমির মধ্যে ব্যাপক মিল ও সাদৃশ্য রয়েছে। বাংলাদেশের স্বাধীনতা সংগ্রামের পটভূমিক কারণগুলোর অন্যতম ছিল শোষণ, বৈষম্য ও সে ধারায় সম্পদের চরম মেরুকরণ। কিউবা বিপ্লবের পটভূমিতেও ছিল তাই। বাংলাদেশের ক্ষেত্রে ছিল পাকিস্তানি শাসকগোষ্ঠীর শোষণ ও নিপীড়ন, পশ্চিম পাকিস্তানি উঠতি পুঁজিপতিদের দ্বারা সম্পদের একচ্ছত্র কুক্ষিগতকরণ (বহুল আলোচিত ২২ পরিবারের নাম বিশেষভাবে উল্লেখযোগ্য) এবং পাকিস্তানি সামরিক শাসকদের ছত্রচ্ছায়ায় মার্কিন সাম্রাজ্যবাদী শক্তির আগ্রাসন। অন্যদিকে কিউবার ক্ষেত্রে ছিল মার্কিন সমর্থনপুষ্ট স্বৈরাচারী বাতিস্তুতার একনায়কতন্ত্র, আখ উৎপাদনসহ (কিউবার অন্যতম অর্থকরী ফসল হচ্ছে আখ ও তদজাত চিনি) কিউবান অর্থনীতির ওপর মার্কিন কোম্পানিগুলোর একচেটিয়া নিয়ন্ত্রণ (কিউবার ৭৫ শতাংশ কৃষিজমির মালিকানা ছিল মার্কিনিদের হাতে) এবং মার্কিন অঙ্গুলি হেলনে রাষ্ট্রনীতি পরিচালনা। এর বাইরে কিউবার ক্ষেত্রে একটি অতিরিক্ত উপসর্গ ছিল অর্থনীতির ওপর মাফিয়া চক্রের প্রবল নিয়ন্ত্রণ এবং মার্কিন কোম্পানিগুলোর পাশাপাশি দেশের সম্পদের ওপর তাদেরও বড় ধরনের ভাগীদারিত্ব।

উপরোল্লিখিত প্রেক্ষাপটকে পেছনে রেখে ১৯৫৯ সালের ১ জানুয়ারিতে যাত্রা শুরু করা কিউবাকেও একেবারে প্রথম দিন থেকেই প্রচণ্ড অভ্যন্তরীণ ও আন্তর্জাতিক বৈরিতা মোকাবেলা করে যাত্রা শুরু করতে হয়, যেমনটি শুরু করতে হয়েছিল বাংলাদেশকেও। বাংলাদেশের অভ্যন্তরীণ বৈরিতা ছিল পাকিস্তানি শাসকগোষ্ঠীর এ দেশীয় সমর্থক পরাজিত শক্তির দিক থেকে, যেটি কিউবার ক্ষেত্রে ছিল মাফিয়াচক্র ও সে দেশের ধনিক শ্রেণী। অন্যদিকে বাংলাদেশের ক্ষেত্রে আন্তর্জাতিক বৈরিতা ছিল পাকিস্তান, সৌদি আরবসহ রাজপরিবারশাসিত মধ্যপ্রাচ্যের কতিপয় দেশ ও মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রের দিক থেকে। এবং এ বৈরিতার পথ ধরেই ১৯৭২-৭৩ সালে বাংলাদেশকে যুক্তরাষ্ট্রের খাদ্য সহায়তা বন্ধ করে দেয়া এবং সিআইএর প্রত্যক্ষ মদদে ১৯৭৫ সালে বঙ্গবন্ধুকে হত্যা। আর কিউবার ক্ষেত্রেও প্রায় একই ঘটনা ঘটেছিল। তবে এর মাত্রা ও ফলাফল ছিল ভিন্নতর। অর্থনৈতিক বৈরিতার ক্ষেত্রে কিউবার অবস্থা ছিল বাংলাদেশের চেয়েও ভয়াবহ। বাংলাদেশকে মার্কিন যুক্তরাষ্ট্র শুধু খাদ্য সহায়তা বন্ধ রেখেছিল। কিন্তু ১৯৬০ সালে কিউবার ওপর তারা আরোপ করেছিল স্থায়ী অর্থনৈতিক নিষেধাজ্ঞা, যা এখনো পুরোপুরি উঠে যায়নি। তাছাড়া একই সময়ে তারা যুক্তরাষ্ট্রে অবস্থিত সব কিউবান সম্পদ বাজেয়াপ্ত করে, কিউবার সঙ্গে ফেরি চলাচল বন্ধ করে দেয় এবং কূটনৈতিক সম্পর্ক ছিন্ন করে। আর এর দেখাদেখি বেশ কয়েকটি মার্কিন মিত্র দেশও প্রায় একই পথ অনুসরণ করে চলে। এতসব বৈরিতা উপেক্ষা করেও কিউবা পরম ধৈর্য, সাহস ও বিচক্ষণতার সঙ্গে এগিয়ে যায়, যার ফলে সেখানে এখন সাক্ষরতার হার শতভাগ, জনগণের আয়ুষ্কাল ৮০ বছর ও শিশুমৃত্যুর হার হাজারে ৪ দশমিক ৭৬ জন। আর এ সবক’টি ক্ষেত্রেই কিউবা যুক্তরাষ্ট্রের চেয়ে এগিয়ে আছে। বাংলাদেশ এক্ষেত্রে কিউবার মতো অতটা সাহস দেখাতে না পারলেও এসব ক্ষেত্রে দক্ষিণ এশিয়ায় শ্রীলংকার পরেই দেশটির অবস্থান, যেখানে পাকিস্তানের অবস্থান আরো অনেক পরে।

অন্যদিকে মার্কিন রোষানল থেকে নিজেদের রাষ্ট্রনায়ককে বাঁচিয়ে রাখার ক্ষেত্রেও কিউবানরা অনেক বেশি সাহসের পরিচয় দিয়েছে। বঙ্গবন্ধুর পাশাপাশি কিউবান নেতা ফিদেল কাস্ত্রোকেও সিআইএ বারবার হত্যা করতে চেয়েছে। কিন্তু তারা তা পারেনি, যা বাঙালি নামের কতিপয় কুলাঙ্গারের কারণে বাংলাদেশের ক্ষেত্রে সিআইএ পেরেছে। বলা হয়ে থাকে, ফিদেল কাস্ত্রো ছাড়া পৃথিবীর আর কাউকে হত্যার জন্য সিআইএ এত বেশিবার উদ্যোগ নেয়নি। কিন্তু কাস্ত্রো ও তার জনগণের কৌশলের কাছে তারা প্রতিবারই হেরে গেছে; যে কৌশল কাস্ত্রো আয়ত্ত করেছিলেন, তার দীর্ঘকালীন গেরিলা যুদ্ধের অভিজ্ঞতার মধ্য দিয়ে। উল্লেখ্য, কিউবান বিপ্লবের যুদ্ধকালীন পর্বের পুরোটাই ছিল বস্তুত গেরিলা যুদ্ধের ইতিহাস, যেটি বাংলাদেশের মুক্তিযুদ্ধের ইতিহাসের সঙ্গে মিলে যায়।

কিউবান বিপ্লব ও বাংলাদেশের স্বাধীনতা সংগ্রাম এবং এ দুই দেশের গঠন প্রক্রিয়ার মধ্যে ব্যাপক সাদৃশ্য ও আদর্শিক মিল থাকা সত্ত্বেও উভয়ের মধ্যে বৈসাদৃশ্যও কিন্তু যথেষ্ট রয়েছে। বাংলাদেশের স্বাধীনতার ৫০ বছর পূর্ণ হতে যাওয়ার প্রাক্কালে বিষয়গুলোর প্রতি পর্যালোচনামূলক দৃষ্টি দেয়া উচিত বলে মনে করি। বিপ্লব-পরবর্তী প্রথম সিদ্ধান্তেই ফিদেল কাস্ত্রো কিউবায় যা যা করেছিলেন, বঙ্গবন্ধুও বাংলাদেশে অনেকটা সে ধরনের সিদ্ধান্তই নিয়েছিলেন। কিন্তু কিউবায় সেগুলো বাস্তবায়িত হলেও বঙ্গবন্ধুর অবর্তমানে বাংলাদেশে সেগুলো আর বাস্তবায়িত হয়নি। কাস্ত্রোর প্রথম সিদ্ধান্তগুলোর অন্যতম ছিল সমাজ থেকে বৈষম্য নিরসন ও সমতা প্রতিষ্ঠার লক্ষ্যে ব্যাপকভিত্তিক ভূমি সংস্কার, অবৈধ পন্থায় আহরিত সম্পদ রাষ্ট্রের অনুকূলে জব্দকরণ, বেসরকারি খাতে বিদ্যালয় স্থাপন সম্পূর্ণভাবে নিষিদ্ধকরণ ইত্যাদি। ভূমি সংস্কার উদ্যোগের আওতায় যাদের বেশি পরিমাণ জমি ছিল, সে জমি রাষ্ট্রের অনুকূলে অধিগ্রহণ করা হয়, যার আওতায় ফিদেল কাস্ত্রো তার পৈতৃক সম্পত্তিও ছেড়ে দিয়েছিলেন। আর সর্বোচ্চ অগ্রাধিকারভিত্তিক অন্যান্য কর্মসূচির মধ্যে ছিল যোগাযোগ অবকাঠামো, স্বাস্থ্য, বাসস্থান, শিক্ষা ও নারীর ক্ষমতায়ন। আর এসবেরই কারণে সর্বোচ্চ পর্যায়ের মাথাপিছু আয়ের দেশ না হয়েও অধিকাংশ মানব উন্নয়ন সূচকের নিরিখে কিউবা এখন বিশ্বের সর্বোচ্চ সারির দেশগুলোর একটি। আর মাথাপিছু আয়ও নেহায়েত কম নয়— ৭ হাজার ৩৯১ ডলার, বাংলাদেশের তুলনায় প্রায় সাড়ে ৪ গুণ।

কিউবার মতো প্রায় একই আঙ্গিকের আদর্শ ও কর্মসূচি নিয়ে বাংলাদেশ তার যাত্রা শুরু করলেও ১৯৭৫ সালে রক্তক্ষয়ী সামরিক অভ্যুত্থানের মধ্য দিয়ে ক্ষমতায় আরোহণকারী সাম্রাজ্যবাদী শক্তির ক্রীড়নকেরা তার সবই প্রায় ধ্বংস করে দেয়। কিন্তু এখন যেহেতু স্বাধীনতা সংগ্রামে নেতৃত্বদানকারী দল ক্ষমতায়, তাই ১৯৭২-এর সেই গণমুখী কর্মসূচিগুলোর দিকে আবার ফিরে তাকানো যায় কিনা? বিশেষত ক্রমবর্ধমান বৈষম্য যখন ক্ষণে ক্ষণে আমাদের স্বাধীনতা সংগ্রামের মৌল চেতনাকে অনেকটাই ফ্যাকাশে করে দিচ্ছে, তখন এ তাকানোর বিষয়টি আরো জরুরি হয়ে পড়েছে বৈকি! বিশেষ করে কিউবার অনুকরণে বাংলাদেশের প্রাথমিক শিক্ষাকে পুরোপুরি সরকারি বিদ্যালয়ের অধীন করা যায় কিনা, তা ভেবে দেখা যেতে পারে।

এ প্রসঙ্গে এখানে শুধু এটুকু বলতে চাই শিল্প, কৃষি, শিক্ষা, স্বাস্থ্য, গৃহায়ণ ইত্যাদি প্রতিটি রাষ্ট্রীয় নীতিমালার আওতাতেই এমন কিছু অনুষঙ্গ রয়েছে, যেগুলো সম্পদের বৈষম্য ও মেরুকরণকেই শুধু ত্বরান্বিত করছে না, নিম্ন ও মধ্যবিত্ত মানুষের আয় উপার্জন বৃদ্ধি সত্ত্বেও একই সঙ্গে তা তাদের মধ্যে ক্ষোভ ও অসন্তুষ্টির মাত্রা বাড়িয়ে দিচ্ছে। এক্ষেত্রে কিউবা বিপ্লব থেকে আমাদের অনেক কিছু শেখার আছে বলে মনে করি। একমাত্র বারাক ওবামা ছাড়া প্রত্যেক মার্কিন প্রেসিডেন্ট (এমনকি জন এফ. কেনেডিও: ১৯৬১-৬৩) ফিদেল কাস্ত্রো ও কিউবাকে এত বেশি যন্ত্রণা ও কষ্ট দিয়েছেন, আর কোনো দেশের প্রতিই মার্কিন নিগ্রহের মাত্রা এতটা উগ্ররূপ ধারণ করেছে বলে প্রমাণ পাওয়া যায় না। তার পরও কিউবা যেভাবে নিঃশ্বাস দূরত্বে অবস্থান করে মার্কিন প্রতিকূলতা মোকাবেলা করে শুধু টিকে থাকা নয় দাপটের সঙ্গে এগিয়ে গেছে, তা আমাদের জন্য অনুপ্রেরণার উৎস হতে পারে। এ প্রসঙ্গে নিজেদের একটি সাহসের প্রশংসা অবশ্যই উল্লেখ করতে হয়, সেটি হচ্ছে শেখ হাসিনা কর্তৃক পদ্মা সেতু নির্মাণে বিশ্বব্যাংকের আর্থিক সহযোগিতা প্রত্যাখ্যান করা।

কিউবান বিপ্লবের প্রথম প্রত্যক্ষ সুবিধাভোগী নিঃসন্দেহে সে দেশের জনগণ। কিন্তু বিশ্বের অন্যান্য বহু দেশের লক্ষ-কোটি মেহনতি মানুষও কি এর সুফল কম-বেশি ভোগ করেনি? নেলসন ম্যান্ডেলা ১৯৯০-এর দশকে দক্ষিণ আফ্রিকায় কৃষ্ণাঙ্গ ও শ্বেতাঙ্গদের মধ্যে যে মেলবন্ধন গড়ে তুলেছিলেন, তার প্রায় সাড়ে তিন দশক আগে ১৯৫৯ সালেই ফিদেল কাস্ত্রো ঘোষণা করেছিলেন। তা ছিল আফ্রিকান বংশোদ্ভূত কৃষ্ণাঙ্গ কিউবানদের সঙ্গে মিলে শ্বেতাঙ্গ কিউবানদের একসঙ্গে দেশ গড়ার প্রত্যয়। এখন থেকে ৬০ বছর আগে ঘোষিত সে প্রত্যয়ের ধারাতেই যে বর্ণবৈষম্যবিরোধী চেতনা আজ বিশ্ব মানবাধিকারের অন্যতম মানদণ্ড। অন্যদিকে লাতিন আমেরিকার অধিকাংশ দেশই যে আজ মার্কিন কর্তৃত্বের বাইরে গিয়ে তাদের জনগণের জীবনমানের উন্নয়ন ও প্রগতিশীল রাজনৈতিক আদর্শকে সীমিত পরিসরে হলেও ধরে রেখেছে, সেটি কিউবান বিপ্লবেরই ফসল। অতএব, ফিদেল কাস্ত্রোর নেতৃত্বাধীন কিউবার বিপ্লব সে দেশের জনগণের মুক্তি, আকাঙ্ক্ষা ও অংশগ্রহণের প্রতীক হলেও একই সঙ্গে তা পৃথিবীর সব মুক্তিকামী মানুষেরই বিপ্লব।

১৯৭৩ সালে আলজেরিয়ার রাজধানী আলজিয়ার্সে অনুষ্ঠিত জোট নিরপেক্ষ শীর্ষ সম্মেলনে যোগ দিতে গিয়েছিলেন ফিদেল কাস্ত্রো ও বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমান। সেখানে অনুষ্ঠিত পারস্পরিক সাক্ষাতে ফিদেল কাস্ত্রো সদ্য স্বাধীনতাপ্রাপ্ত বাংলাদেশ রাষ্ট্রের প্রতিষ্ঠাতা বঙ্গবন্ধুকে উদ্দেশ করে বলেছিলেন, ‘আমি হিমালয় দেখিনি, কিন্তু শেখ মুজিবকে দেখেছি।’ ইতিহাসের এ অমোঘ উক্তি শুধু শেখ মুজিবের মহত্ত্ব ও বিরাটত্বের মহিমাকেই তুলে ধরেনি, একই সঙ্গে তা পৃথিবীর দেশে দেশে প্রগতিশীল মানুষের সংগ্রাম ও আকাঙ্ক্ষার প্রতি ফিদেল কাস্ত্রোর অঙ্গীকার ও দায়বদ্ধতার উপলব্ধিকেও তুলে ধরেছিল। এবং বস্তুত সেটিই ছিল কিউবান বিপ্লবের মূল চেতনা এবং তা বাংলাদেশের মুক্তি সংগ্রামের চেতনাও বৈকি!

 

লেখক: পরিচালক (সিডিসি)

ড্যাফোডিল ইন্টারন্যাশনাল ইউনিভার্সিটি

atkhan56@gmail.com


Source: Daily Bonikbarta, 01 January 2019

43
নতুন সরকারের করণীয়
আবু তাহের খান

পর পর তিনবার নির্বাচনে জিতে রাষ্ট্র পরিচালনার দায়িত্ব পেলে ক্ষমতাসীন দলের মন্ত্রী, সংসদ সদস্য ও নেতাকর্মীদের মধ্যে অতি আস্থা ও  অহমিকা দ্বারা তাড়িত হয়ে স্বেচ্ছাচারী হয়ে ওঠার যে ঝুঁকি থাকে, আওয়ামী লীগ বস্তুত সে ঝুঁকি মাথায় নিয়েই নতুন করে যাত্রা শুরু করতে যাচ্ছে। তবে এ ঝুঁকির বিপরীতে তাদের সামনে নতুন ইতিহাস সৃষ্টির মধ্য দিয়ে দেশ ও জনগণের জন্য অভূতপূর্ব কিছু করার অসামান্য সুযোগও রয়েছে। তারা যদি আবেগপ্রবণ ও উন্নাসিক না হয়ে ধীরস্থিরভাবে সে সুযোগগুলোকে পরিপক্বতা ও দায়িত্বশীলতার সঙ্গে ব্যবহার করতে পারে, তাহলে তাদের পক্ষে বাংলাদেশকে শুধু দক্ষিণ এশিয়ার নয়—পুরো এশিয়ারই অন্যতম মর্যাদাবান রাষ্ট্রে উন্নীত করা সম্ভব। আর তা করার ক্ষেত্রে তাদের সবচেয়ে বড় সুবিধা এই যে বিগত দুই মেয়াদে ক্ষমতায় থাকার সুবাদে অধিকাংশ হোমওয়ার্ক তাদের করাই আছে, যা একটি সম্পূর্ণ নতুন সরকার হলে সম্পূর্ণ নতুনভাবে করতে হতো। এখন তাই তাদের দরকার শুধু আর এক মুহূর্তও বিলম্ব না করে প্রতিজ্ঞা ও প্রত্যয় নিয়ে কাজে নেমে পড়া। আর সে কাজের ক্ষেত্রে সহায়ক হলে হতেও পারে, এমন কিছু চিন্তাভাবনা এখানে তুলে ধরা হলো।

প্রথমেই শীর্ষ নেতৃত্বের পক্ষ থেকে এমন একটি বার্তা সরকারি দল, মন্ত্রিপরিষদ, সংসদ সদস্য, নির্বাহী বিভাগ ও জনগণের মধ্যে পৌঁছে দিতে পারলে ভালো হয় যে আগে যখন যা-ই কিছু ঘটে থাকুক না কেন, এখন থেকে রাষ্ট্রের সব পর্যায়ে যার যার অবস্থান নির্ধারিত হবে সংশ্লিষ্ট ব্যক্তির নিজস্ব দক্ষতা ও যোগ্যতা অনুযায়ী। মন্ত্রিপরিষদকে দক্ষ করে তোলার জন্য অবিলম্বে প্রশিক্ষণের ব্যবস্থা করতে হবে। মন্ত্রীদের প্রতি পূর্ণ সম্মান রেখে বলি, যাঁরা নতুন মন্ত্রী হবেন তাঁরা তো বটেই, এমনকি যাঁরা এর আগে মন্ত্রী ছিলেন তাঁরাও অনেকে দক্ষতার সঙ্গে মন্ত্রণালয় পরিচালনাসংক্রান্ত সমুদয় খুঁটিনাটি আইন-কানুন, বিধিবিধান, প্রক্রিয়া-পদ্ধতি ইত্যাদি সম্পর্কে বিস্তারিত অবহিত নন। এ ক্ষেত্রে তাই একটি পূর্ণাঙ্গ প্রশিক্ষণসূচি তৈরি করে জাতীয় সংসদ সচিবালয়ের তত্ত্বাবধানে অবিলম্বে এ প্রশিক্ষণ আয়োজনের ব্যবস্থা করা যেতে পারে। পরবর্তীকালে মন্ত্রিপরিষদবহির্ভূত অন্য সংসদ সদস্যদের জন্যও প্রযোজ্য বিষয়সূচি তৈরি করে অনুরূপ প্রশিক্ষণের ব্যবস্থা করা যেতে পারে।

অন্যদিকে নির্বাহী বিভাগের বিদ্যমান দক্ষতা উন্নয়ন ব্যবস্থা পর্যালোচনা করে এটিকে আরো আধুনিক ও বৈশ্বিক মানসম্পন্ন করে তুলতে হবে। বিশেষত দ্রুত পরিবর্তমান তথ্য ও যোগাযোগ প্রযুক্তি ব্যবস্থার আওতায় দক্ষতার সঙ্গে কাজ করার ব্যাপারে তাঁদের সামর্থ্যবান করে তুলতে হবে। আর দক্ষতা উন্নয়নসংক্রান্ত আলোচনা ও অনুচ্ছেদের আওতায় অন্য একটি প্রস্তাব এই যে দলকে সরকার থেকে আরো সুনির্দিষ্টভাবে আলাদা করতে হবে এবং মন্ত্রী, সংসদ বা নির্বাহী বিভাগের সদস্যদের মতোই দলীয় কর্মীদের জন্যও প্রশিক্ষণের ব্যবস্থা করতে হবে।

ব্যাঙের ছাতার মতো গড়ে ওঠা মানহীন নামসর্বস্ব বেসরকারি বিশ্ববিদ্যালয় (মানসম্পন্ন ১০-১২টি বাদে) থেকে প্রায় শিক্ষা লাভ ছাড়াই সনদ নিয়ে বেরোনো স্নাতকের সংখ্যা কমাতে না পারলে দেশ ও সরকার উভয়ের জন্যই তা এক বিব্রতকর পরিস্থিতি তৈরি করতে বাধ্য। এরই মধ্যে প্রচলিত অভিমত দাঁড়িয়ে গেছে যে হাজার হাজার শিক্ষিত তরুণ বেকারত্ব মাথায় নিয়ে ঘুরে বেড়াচ্ছে, সরকার তাদের জন্য কোনো কর্মসংস্থানের ব্যবস্থা করতে পারছে না। অথচ প্রকৃত ঘটনা হচ্ছে এই যে দেশে যত কর্মের সুযোগই তৈরি হোক না কেন, সেসব পদের চাহিদা পূরণের মতো দক্ষতা ও যোগ্যতা তথাকথিত এ শিক্ষিত তরুণদের নেই। আর সে কারণেই বহু বেসরকারি প্রতিষ্ঠানকে উচ্চ বেতন দিয়ে বিদেশি কর্মী নিয়োগ করতে হচ্ছে। অতএব শিক্ষার সঠিক মান রক্ষার স্বার্থে তো বটেই, অহেতুক বদনামের হাত থেকে বাঁচার জন্য হলেও সরকারের উচিত হবে বেসরকারি বিশ্ববিদ্যালয়ের মানহীন ব্যবস্থাকে নিয়ন্ত্রণ করা। আর নতুন সরকারের উচিত হবে কাজটি গোড়াতেই সেরে ফেলা।

মাননীয় প্রধানমন্ত্রী এরই মধ্যে নির্বাচনী ইশতেহার ঘোষণাকালে জানিয়েছেন, তাঁর সরকার নতুন মেয়াদে ক্ষমতায় এলে দুর্নীতির ব্যাপারে ‘শূন্য সহনীয়তা’ নীতি গ্রহণ করবে। এ ব্যাপারে উল্লেখ করাটা প্রাসঙ্গিক হবে যে বাংলাদেশ এ পর্যন্ত একটি অপরাধের ক্ষেত্রেই শুধু ‘শূন্য সহনীয়তা’ নীতি বাস্তবায়ন করে দেখাতে পেরেছে এবং সেটি হচ্ছে, বর্তমান সরকারের অধীনে জঙ্গিবাদের বিরুদ্ধে ব্যবস্থা গ্রহণ। আমরা আশা করব, এ ক্ষেত্রে দ্বিতীয় সার্থকতাটি আসবে নতুন সরকারের আওতায় দুর্নীতির ব্যাপারে ‘শূন্য সহনীয়তা’ নীতি গ্রহণের মধ্য দিয়ে। আশা করি আইন ও নির্বাহী বিভাগ উভয় ক্ষেত্রের সমুদয় দুর্নীতিই এ নীতির আওতায় স্থান পাবে। আর তা পেলে বেসরকারি খাতের দুর্নীতিও বহুলাংশে হ্রাস পাবে বলে আশা করা যায়।

অনুসন্ধানকৃত তেল-গ্যাসের পাশাপাশি বাংলাদেশের অর্থনীতির নিকট-ভবিষ্যতের একটি অত্যন্ত সম্ভাবনাময় ক্ষেত্র হচ্ছে বঙ্গোপসাগরসহ দেশের অন্যত্র তেল-গ্যাসের নতুন সম্ভাব্য ক্ষেত্রগুলো খুঁজে দেখা। এ কাজটি যথেষ্ট দক্ষতা ও উদ্যমের সঙ্গে পরিচালিত হচ্ছে কি না তা পর্যালোচনা করে দেখা প্রয়োজন বলে মনে করি। দ্বিতীয়ত, অতীতে এ ক্ষেত্রে উৎপাদন বণ্টন চুক্তি (প্রডাকশন শেয়ারিং কন্ট্রাক্ট-পিএসসি) নিয়ে সংঘটিত নানা দুর্নীতি ও অনিয়মের কথা সংশ্লিষ্টরা তো বটেই, দেশের সাধারণ মানুষেরও অনেকটা জানা হয়ে গেছে। ফলে ভবিষ্যতে যাতে আর এমনটি না ঘটে, সে ব্যাপারে সতর্ক থাকার জন্য নতুন সরকারের প্রতি এখনই আহ্বান রাখছি।

রোহিঙ্গাদের আশ্রয় দিয়ে মাননীয় প্রধানমন্ত্রী এরই মধ্যে আন্তর্জাতিক পরিসর থেকে ‘মানবতার মা’ নামে খ্যাত হয়েছেন, যা নিঃসন্দেহে দেশ ও জাতির জন্য গৌরবের। কিন্তু পাশাপাশি এটাও সত্য যে এ নিয়ে আন্তর্জাতিক কূটনৈতিক তৎপরতা পরিচালনার ক্ষেত্রে পররাষ্ট্র মন্ত্রণালয়ের আরো বেশি দক্ষতার পরিচয় দেওয়া উচিত ছিল বলে সরকার সমর্থক কূটনীতিকদের মধ্যেই অভিমত রয়েছে। ফলে এ অসম্পূর্ণতার জায়গাটি কিভাবে সমন্বয় ও সংশোধন করা হবে, সে বিষয়টির প্রতি নতুন সরকারের দৃষ্টি আকর্ষণ করছি।

ডাকসু একটিমাত্র বিশ্ববিদ্যালয়ের বিষয় হলেও ইতিহাসের পথপরিক্রমায় ডাকসু আজ বাঙালি তরুণের আদর্শ ও চেতনার এক মহত্তম তীর্থক্ষেত্র। ফলে যত তাড়াতাড়ি সম্ভব ডাকসু আয়োজনের ব্যবস্থা করতে পারলে সেটি নতুন সরকারের জন্য একটি চমৎকার নতুন যাত্রা হবে বলে মনে করি। ডাকসু নির্বাচন সুষ্ঠুভাবে আয়োজনের পর ক্রমান্বয়ে অন্য শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানগুলোয়ও অনুরূপ নির্বাচন আয়োজনের সুযোগ করে দেওয়া যেতে পারে।

ঢাকা শহরে নতুন বিদ্যুৎ লাইন স্থাপন, নিয়নবাতি জ্বালিয়ে সৌন্দর্যবৃদ্ধিকরণ ও নিরাপত্তার কথা বলে জেনারেল জিয়াউর রহমান অকাতরে রাজধানীর কয়েক হাজার বৃক্ষনিধনের উৎসব করেছিলেন। বর্তমানে নির্বাচনী ইশতেহারের উল্লিখিত ঘোষণাকে কাজে লাগিয়ে অন্য সুবিধাবাদী কেউও এটি করে বসতে পারে। অতএব সে ব্যাপারে সতর্ক থাকতে হবে।

পরিশেষে একাদশ জাতীয় সংসদ নির্বাচনে মুক্তিযুদ্ধের পক্ষশক্তির বিজয়কে স্বাগত জানিয়ে অত্যন্ত বিনীতভাবে এই মর্মে একটি প্রস্তাব করতে চাই যে নতুন সংসদের সদস্যদের চিন্তায় নিজেদের স্থানীয় সরকারের প্রতিনিধি ভাবার চেয়ে আইনপ্রণেতা ভাবার বোধটি যেন অধিকতর গুরুত্ব পায়, যা একদিকে তাঁদের সম্মানকে যেমন বৃদ্ধি করবে, অন্যদিকে তেমনি দেশের স্থানীয় সরকারব্যবস্থাটিও আরো শক্তিশালী ও স্বনির্ভর হয়ে ওঠার সুযোগ পাবে। দুর্নীতির ব্যাপারে শূন্য সহনীয়তার মতোই এটিও হয়ে উঠুক নতুন সরকারের একটি যুগান্তকারী দৃষ্টিভঙ্গি।

লেখক : পরিচালক (সিডিসি), ড্যাফোডিল ইন্টারন্যাশনাল ইউনিভার্সিটি

Source: Daily kaler Kantho, 02 January 2019

44

সাধারণ মানুষের অসাধারণ হয়ে ওঠার একটা গল্প থাকে। সেই গল্পের পাতায় পাতায় থাকে সংগ্রাম আর টিকে থাকার লড়াই। জীবনের নানা দোলাচলের মাঝে তাঁকে টপকে যেতে হয় একের পর এক বাধার সিঁড়ি। স্বপ্নকে ছুঁয়ে দেখার সুতীব্র বাসনা তাঁকে পথ দেখায় অবিরাম। সেই পথে হাঁটতে হাঁটতে কেউ কেউ পৌঁছে যান সাফল্যের সোনালী বন্দরে। তেমনই একজন সফল ব্যক্তিত্ব মোস্তফা কামাল। তিনি দেশের শীর্ষ শিল্প প্রতিষ্ঠান মেঘনা গ্রুপ অব ইন্ডাস্ট্রিজের ব্যবস্থাপনা পরিচালক ও চেয়ারম্যান। মেঘনা ঘাটের পূর্ব-পশ্চিম প্রান্তজুড়ে কয়েক কিলোমিটারব্যাপী গড়ে তুলেছেন এক বিশাল শিল্প সাম্রাজ্য। প্রতিদিন চল্লিশটিরও বেশি কারখানায় ৩২টিরও বেশি পণ্য উৎপাদিত হয় এখানে। কাজ করছেন প্রায় ২১ হাজার কর্মী। একটি বাইসাইকেল কেনার সামর্থ ছিল না যাঁর, তার প্রতিষ্ঠানে এখন আড়াই হাজারের বেশি গাড়ি শুধু পণ্য আনা-নেওয়া করে। রয়েছে এক ডজন আন্তর্জাতিক জাহাজসহ ১০০টি অভ্যন্তরীণ জাহাজ। যে মোস্তফা কামাল একসময় গুলিস্তান আর পুরান ঢাকার অলিগলিতে পণ্য ফেরি করেছেন, কোনো ডিলার পাননি, কোনো এজেন্ট পাননি; সেই মোস্তফা কামালের প্রতিষ্ঠানের ডিলারশিপ নেওয়ার জন্য এখন হাজার হাজার মানুষের কাছ থেকে অনুরোধ আসে। মাত্র ১৭৫ টাকা নিয়ে যে ব্যবসা শুরু করেছিলেন তার বার্ষিক টার্নওভার এখন দুই বিলিয়ন মাকিন ডলারেও বেশি।

45
বিশ্বাস করা হচ্ছে এবং করানো হচ্ছে, বাংলাদেশে বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষকদের ‘মানহানি’ হয়েছে; অর্থাৎ তাঁদের মানের অবনতি ঘটেছে। আমলা-কাজি-সিপাহসালার—রাষ্ট্রের আর কোনো পক্ষের মানহানি হয়নি, হয়েছে শুধু বিশ্ববিদ্যালয়–শিক্ষকদের। বিশ্ববিদ্যালয়–শিক্ষকদের মান নির্ধারণ এবং মানের অবনতি রোধ করার উদ্দেশ্যে সম্প্রতি বিশ্ববিদ্যালয়ে শিক্ষক নিয়োগের ক্ষেত্রে একটি খসড়া নীতিমালা প্রণয়ন করা হয়েছে। বিভিন্ন বিশ্ববিদ্যালয় এবং বিশ্ববিদ্যালয় মঞ্জুরি কমিশনের কর্তাব্যক্তিরা এই নীতিমালার ব্যাপারে তাঁদের মতামত ব্যক্ত করেছেন। সিদ্ধান্ত হয়েছে বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষক নিয়োগের তিনটি নিয়ামক থাকবে: ১. প্রাথমিক-উচ্চমাধ্যমিক-স্নাতক স্তরের চূড়ান্ত পরীক্ষার ফলাফল; ২. নিয়োগ-পরীক্ষা পাস এবং ৩. পাঠদানের ক্ষমতা।

শিক্ষার তৃতীয় স্তর কিংবা উচ্চশিক্ষার সঙ্গে প্রথম দুই স্তর, অর্থাৎ প্রাথমিক ও মাধ্যমিক (উচ্চমাধ্যমিকও যার অন্তর্ভুক্ত) শিক্ষার মূল পার্থক্য হচ্ছে, উচ্চশিক্ষা যাঁরা দেবেন এবং নেবেন, তাঁদের যথাক্রমে গবেষণা করতে হবে এবং গবেষণা করা শিখতে হবে। ঐতিহাসিকভাবে ‘বিশ্ববিদ্যালয়’ নামের প্রতিষ্ঠানটির ওপর গবেষণা করা ও গবেষণা শেখানোর দায়িত্ব বর্তায়। গবেষণা যদি আপনি না করেন, তবে অতিসাম্প্রতিক কালে জ্ঞানের জগতে কী পরিবর্তন হলো, সেটা আপনি জানতে পারবেন না, শিক্ষার্থীদের জানাতে পারবেন না এবং এর ফলে সমাজেও জ্ঞানের অগ্রগতির সর্বশেষ সংবাদ অজানা থেকে যাবে। সুতরাং বিশ্ববিদ্যালয়–শিক্ষকের তিনটি কাজ: ১. নিজে গবেষণা করা; ২. অন্যকে গবেষণায় সহায়তা করা এবং ৩. পাঠদান করা।

প্রাথমিক, মাধ্যমিক ও মহাবিদ্যালয়ের শিক্ষকদের শুধু পাঠদান করলেই চলে। একজন কলেজশিক্ষকের সঙ্গে একজন বিশ্ববিদ্যালয়–শিক্ষকের পার্থক্যটা এখানেই। আমি প্রথম দুই স্তরের শিক্ষকদের কোনোভাবেই ছোট করছি না। আমি শুধু বলতে চাই যে একজন বিশ্ববিদ্যালয়–শিক্ষকের দায়িত্ব শুধু পাঠদানে সীমাবদ্ধ থাকা উচিত নয়।

একটি বিশ্ববিদ্যালয় কী ধরনের প্রতিষ্ঠান হওয়া উচিত—সে সম্পর্কে বাংলাদেশের নীতিনির্ধারক কিংবা বিশ্ববিদ্যালয়–শিক্ষকদের স্পষ্ট ধারণা আছে বলে মনে হয় না। এর কারণ, এখন যাঁরা নীতিনির্ধারক কিংবা প্রবীণ বিশ্ববিদ্যালয়–শিক্ষক, তাঁদের শিক্ষকেরাও খুব বেশি গবেষণামুখী ছিলেন না এবং এর ফলে শিক্ষার্থীদেরও তাঁরা গবেষণামুখী করে তুলতে ব্যর্থ হয়েছেন। আমাদের আগের প্রজন্মের বিশ্ববিদ্যালয়–শিক্ষকদের সিংহভাগ আচরণে-মানসিকতায় নেহাতই একেকজন কলেজশিক্ষক ছিলেন এবং তাঁদের শিক্ষার্থীরাও ছাত্রজীবনে কলেজশিক্ষার্থী এবং কর্মজীবনে কলেজশিক্ষকে পরিণত হয়েছেন।

শিক্ষকতা, কারিকুলাম, পাঠ্যক্রম, পাঠদান থেকে শুরু করে আমাদের প্রজন্মের বিশ্ববিদ্যালয়–শিক্ষকদের যাবতীয় আচরণ ও কর্মকালে কলেজশিক্ষকের মানসিকতা প্রতিফলিত হয়। মাস্টার্স পর্যায়েও তাঁরা সেমিনারের কথা ভাবতে পারেন না, কোর্স দিতে চান। পরীক্ষা ছাড়াও যে অর্জিত জ্ঞান যাচাইয়ের অন্য পন্থা থাকতে পারে—হাজার চেষ্টা করেও এ ব্যাপারটা বাংলাদেশের বিশ্ববিদ্যালয়–শিক্ষকদের বোঝাতে পারবেন না। এর পেছনে অর্থনৈতিক কারণও আছে বৈকি। পরীক্ষা মানেই ইনভিজিলেশন, খাতা দেখা, নম্বর তোলা ইত্যাদি হাজার রকম আয়ের সুবর্ণ সুযোগ নাদান শিক্ষকেরা কেন হেলায় নষ্ট করতে যাবেন? বাংলাদেশের বিশ্ববিদ্যালয়গুলোতে এখনো ছাত্রদের নাম ডেকে উপস্থিতির হিসাব নেওয়া হয়, অনেকটা জেলখানার কয়েদিদের মতো। একেকটি ক্লাসে শ খানেক ছাত্রের নাম ডাকতেই তো কুড়ি মিনিট চলে যাওয়ার কথা। ক্লাসের সময়সীমা যদি পঞ্চাশ মিনিট হয়, তবে শিক্ষক মহোদয় পড়াবেন কখন?

কোনো ব্যক্তির গবেষণা করার ক্ষমতা তাঁর মাধ্যমিক, উচ্চমাধ্যমিক ও স্নাতক পর্যায়ে অর্জিত ভালো ফলের ওপর নির্ভর করে না। ভালো ছাত্রমাত্রই ভালো গবেষক নন। কে ভালো গবেষক হবেন আর কে হবেন না, সেটা শুধু সময়ই বলতে পারে। নিয়োগ পরীক্ষা নিয়ে ভালো আমলা নির্বাচন করা যেতে পারে, কিন্তু ভালো গবেষক তথা ভালো বিশ্ববিদ্যালয়–শিক্ষক নির্বাচন করা কার্যত অসম্ভব।

পাশ্চাত্যে বিশ্ববিদ্যালয়–শিক্ষকদের কোনো নিয়োগ পরীক্ষায় পাস করতে হয় না। প্রাথমিক থেকে শুরু করে স্নাতক পর্যায়ের পরীক্ষায় কার, কী ফলাফল ছিল, সেটাও বিবেচনায় নেওয়া হয় না। এসব ফলাফল কলেজ কিংবা প্রাথমিক বিদ্যালয়ের শিক্ষক নিয়োগের সময় বিবেচ্য হয়। বিশ্ববিদ্যালয়ে শিক্ষক নিয়োগের ক্ষেত্রে একমাত্র বিবেচ্য, মুখ্যত গবেষণার ক্ষমতা এবং গৌণত পাঠদানের ক্ষমতা। দীর্ঘদিন ধরে এই দুই ক্ষমতা প্রমাণ করার পর পাশ্চাত্যে একজন ব্যক্তি বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষক হতে পারেন।

পাশ্চাত্যে পিএইচডি করতে করতেই একজন ছাত্র নিজ বিষয়ের বিখ্যাত সব জার্নালে তাঁর গবেষণাকর্ম প্রকাশ করার চেষ্টা করেন। একই সঙ্গে তিনি স্নাতক পর্যায়ে খণ্ডকালীন ভিত্তিতে পড়াতেও শুরু করেন। পাঠ দিতে দিতে তিনি পড়াতে শেখেন এবং জেনে যান, পড়ানোর কাজটা আদৌ তিনি পারবেন কি না। শিক্ষার্থীরাও শিক্ষানবিশ শিক্ষককে মূল্যায়ন করেন এবং শিক্ষানবিশ যখন কোনো বিশ্ববিদ্যালয়ে শিক্ষক পদের জন্য আবেদন করেন, তখন শিক্ষার্থীদের এই মূল্যায়ন বিবেচনায় নেওয়া হয়। পিএইচডি অভিসন্দর্ভ কিংবা প্রকাশিত গবেষণাকর্মের মান এবং পাঠদানের ক্ষমতা—এই দুটি বিষয়ের ওপর নির্ভর করে বিজ্ঞ নির্বাচকেরা সিদ্ধান্ত নেন, কোনো বিশেষ ব্যক্তিকে শিক্ষক হিসেবে অস্থায়ী নিয়োগ দেওয়া যেতে পারে কি না। কয়েক বছর অস্থায়ী শিক্ষক হিসেবে কর্মরত থাকার পর বিশ্ববিদ্যালয়ে সংশ্লিষ্ট শিক্ষকের নিয়োগ স্থায়ী হয়। নিয়োগ স্থায়ী হওয়া এবং পদোন্নতি পাওয়া নির্ভর করে প্রধানত শিক্ষকের কয়টি প্রবন্ধ স্বীকৃত জার্নালে প্রকাশিত হলো, তার ওপর।

বিশ্ববিদ্যালয় কর্তৃপক্ষ, মঞ্জুরি কমিশনের কর্তাব্যক্তিদের বক্তব্য এবং সাম্প্রতিক খসড়া নীতিমালা থেকে পরিষ্কার বোঝা যায়, বিশ্ববিদ্যালয়ে শিক্ষক নিয়োগ ও কলেজেশিক্ষক নিয়োগের মধ্যে পার্থক্য করতে আমরা সক্ষম নই। নিয়োগ পরীক্ষা ও প্রথম দুই স্তরের ফলাফলের ওপর নির্ভর করে বিশ্ববিদ্যালয়ে যেসব শিক্ষক নিয়োগপ্রাপ্ত হবেন, তাঁদের যোগ্যতা কলেজ বা স্কুলশিক্ষকের চেয়ে বেশি হবে না। কলেজ ও বিশ্ববিদ্যালয়ে নিয়োগের ধরন যদি একই হয়, তবে বিশ্ববিদ্যালয়গুলোতে কলেজ-মানের শিক্ষক নিয়োগ হবে এবং বিশ্ববিদ্যালয়গুলো প্রকারান্তরে কলেজে পরিণত হবে।

কার্যত বাংলাদেশে কোনো বিশ্ববিদ্যালয় নেই—প্রাইভেট-পাবলিকনির্বিশেষে বাংলাদেশের বিশ্ববিদ্যালয়গুলো প্রকৃতপক্ষে এক একটি বড়সড় কলেজমাত্র। পরিতাপের বিষয় এই যে ভবিষ্যতেও যে বাংলাদেশে কোনো বিশ্ববিদ্যালয় গড়ে উঠবে, তারও কোনো আলামত দেখা যাচ্ছে না ওই নীতিমালায়। বিশ্ববিদ্যালয় নিয়ে যাঁরা ভাবেন, বিশ্ববিদ্যালয়ের কাঠামোর ব্যাপারে সিদ্ধান্ত যাঁরা নেন, তাঁরা হয়তো জানেনই না ‘বিশ্ববিদ্যালয়’ কাকে বলে। বিশ্ববিদ্যালয়ের ইতিহাস: আদিপর্ব শীর্ষক পুস্তকটি পড়ে তাঁরা নিঃসন্দেহে উপকৃত হতে পারেন। বিশ্ববিদ্যালয় মঞ্জুরি কমিশন অন্ততপক্ষে শিক্ষকদের মধ্যে এই বই বিতরণের ব্যবস্থা নিলে শিক্ষা তথা বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষা সম্পর্কে সমাজের অজ্ঞানতা অনেকটাই দূর হবে বলে আমি মনে করি।

শিশির ভট্টাচার্য্য ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের আধুনিক ভাষা ইনস্টিটিউটের পরিচালক

Source:- Prothom Alo, 8th November,2018

Pages: 1 2 [3] 4 5