ফেসবুকের মেনলো পার্কের প্রধান কার্যালয় থেকে তিন হাজার মাইল দূরে ডাউনটাউন ম্যানহাটনে পুরোনো-ধূসর একটি অফিস। সেখানে কয়েকটি প্রকল্প নিয়ে একদল কর্মী কাজ করছেন। তাঁদের কাজ কোনো সামাজিক যোগাযোগের ওয়েবসাইটের চেয়ে বৈজ্ঞানিক কল্পকাহিনিতেই যেন বেশি জুতসই। দলটি হচ্ছে ফেসবুক আর্টিফিশিয়াল ইনটেলিজেন্স রিসার্চ (এফএআইআর), যা অভ্যন্তরীণভাবে ফেয়ার টিম হিসেবে পরিচিত। দলটি একটি নির্দিষ্ট লক্ষ্যে কাজ করছে। লক্ষ্যটি হচ্ছে কম্পিউটারকে মানুষের মতো বুদ্ধিদীপ্ত করে তোলা। যদিও এ লক্ষ্য অর্জনের অনেকটা পথ বাকি, তবু এর মধ্যে কিছুটা সফলতা এসেছে। ধারণা করা হচ্ছে, আগামী এক দশকের মধ্যে অনেক দূর যাওয়া সম্ভব। দলটির তৈরি কৃত্রিম বুদ্ধিমত্তাযুক্ত প্রোগ্রামগুলো শিল্পীদের মতো হুবহু ছবি আঁকতে ও বিভিন্ন প্রশ্নের উত্তর দিতে পারছে। ভবিষ্যতে কোনো একদিন ফেসবুকে মানুষের মতোই কথোপকথন চালানোর বা কৃত্রিম বুদ্ধিমান বন্ধু হয়ে দাঁড়াবে এ প্রোগ্রাম।
ফেয়ার টিমটি ফেসবুকের আর দশটা সাধারণ টিমের মতো নয়, তা কাজের ধরন দেখলেই বোঝার কথা। এ দলের কর্মীরা ফেসবুকের মালিকানাধীন ইনস্টাগ্রাম, হোয়াটসঅ্যাপ, মেসেঞ্জার বা ফেসবুকের অন্য কর্মীদের সঙ্গে সরাসরি যুক্ত নন। দলটির লক্ষ্য পরবর্তী এক দশেক কী কী সুবিধা আনা যায়, তা নিয়ে কাজ করা। যা আদৌ সম্ভব কি না, এরও নিশ্চয়তা নেই। এই দলের নেতৃত্ব দিচ্ছেন এমন একজন, যিনি যুক্তরাষ্ট্রের সিলিকন ভ্যালির সুপরিচিত আর দশজনের মতো নন।
৫৬ বছর বয়সী ইয়ান লিকান আড়ালেই কাজ করে যাচ্ছেন ভবিষ্যৎ প্রযুক্তির বড় একটি সম্ভাবনার দিক নিয়ে। লিকানের জীবনের অভিজ্ঞতা তাঁকে এ কাজে আরও উৎসাহী করেছে। জীবনে তিনি ব্যর্থ হয়েছেন বহুবার। তাঁর তত্ত্বগুলো একসময় অচল বলা হচ্ছিল। কিন্তু তিনি দমে যাননি। ফেসবুক তাঁকে কাজের সুযোগ করে দিয়েছে। বর্তমানে কৃত্রিম বুদ্ধিমত্তার দুনিয়ায় তাঁর তত্ত্বগুলোকে বিশ্বমানের বলে বিবেচনা করা হচ্ছে।
ফেয়ারের কর্মীদের নিয়ে লিকান কম্পিউটারের সক্ষমতা বাড়াতে কাজ করছেন। কম্পিউটার যাতে দেখতে পারে, শুনতে পারে ও নিজ থেকে যোগাযোগ করতে পারে, সে চেষ্টা করছেন তাঁরা। তাঁদের এ উদ্যোগ ফেসবুকের বিভিন্ন ফিচার বা পণ্যে কাজে লাগানো হচ্ছে। ফেসবুকের নিউজ ফিড র্যাঙ্কিং থেকে শুরু করে ক্যামেরা ও ছবি ফিল্টারের ক্ষেত্রটিকেও স্পর্শ করেছে তাদের কাজ। দলটির পেছনে ফেসবুক বিনিয়োগ বাড়ানোর পাশাপাশি সময়ও দিচ্ছে প্রচুর। কৃত্রিম বুদ্ধিমত্তা মজার বলেই নয়, একে জরুরি বলে মনে করছে ফেসবুক। প্রযুক্তি বিশ্বের সবখানেই এখন কৃত্রিম বুদ্ধিমত্তা নিয়ে লড়াই শুরু হয়েছে। আমাজন, গুগল, উবার, অ্যাপল, স্যামসাংসহ অনেক প্রতিষ্ঠান এখন এ ক্ষেত্রে কাজ শুরু করেছে। ফেসবুকের সবখানেই এখন কৃত্রিম বুদ্ধিমত্তার ব্যবহার দেখা যায়। ফটো ফিল্টার, নিউজ ফিড সাজানো, কনটেন্ট বাছাই করা, কনটেন্ট সরানোসহ নানা কাজে কৃত্রিম বুদ্ধিমত্তাকে কাজে লাগানো হচ্ছে।
ফেসবুকের অ্যাপ্লাইড মেশিন লার্নিং গ্রুপের (এএমএল) প্রধান জোয়াকিন ক্যানডেলা বলেন, মানুষ ফেসবুকে এখন যে অভিজ্ঞতাগুলো পাচ্ছে, তা কৃত্রিম বুদ্ধিমত্তার ওপর নির্ভরশীল। এটা ছাড়া ফেসবুকের অস্তিত্ব থাকত না। এ ক্ষেত্র যত উন্নত হচ্ছে, ফেসবুক তত বেশি লিকান ও তাঁর কর্মী দলটির ওপর নির্ভরশীল হয়ে উঠছে। প্রতিদ্বন্দ্বীদের সঙ্গে এগিয়ে থাকতে, নতুন প্রোগ্রাম তৈরিতে লিকান ও তাঁর দল এখন ফেসবুকের কাছে গুরুত্বপূর্ণ হয়ে উঠেছে। বেশ কয়েক বছর ধরে সমালোচনা সইলেও লিকানের অধীনে এখন ৮০ জন গবেষক কাজ করছেন। এখানে যত অর্থ লাগে, তা জোগাচ্ছে ফেসবুক। ফেসবুক লিকানের ওপর আস্থা রাখায় তাঁর দলের প্রতিদান দেওয়ার পালা।
১৯৬০ সালে প্যারিসে জন্মগ্রহণ করেন ইয়ান লিকান। কম্পিউটার বিজ্ঞানী ও নিউরোনেটোলজিস্ট হিসেবে পরিচিত তিনি। কম্পিউটার ভিশন ও অপটিক্যাল ক্যারেক্টার শনাক্ত করতে কাজ করেছেন তিনি। কম্পিউটার একদিন দেখতে পাবে—ছোটবেলা থেকে লিকান এ ধারণা নিয়ে বড় হয়েছেন। এখন ফেশিয়াল রিকগনিশন ও ছবি শনাক্তকরণ পদ্ধতি উন্নত হলেও আশির দশকে তা ছিল কল্পনাতীত। ১৯৮০ সালের দিকে প্যারিসে বিশ্ববিদ্যালয়ে পড়ার সময় থেকেই তা নিয়ে কাজ শুরু করেন লিকান। যন্ত্র যাতে ধারণা করতে বা কোনো কাজ শিখতে পারে, সে লক্ষ্যে বিভিন্ন পদ্ধতি নিয়ে কাজ শুরু করেন তিনি। এটাকে বলা হতো আর্টিফিশিয়াল নিউরাল নেটওয়ার্ক। তবে কৃত্রিম বুদ্ধিমত্তাসংক্রান্ত বিজ্ঞানের কোনো কাজ নেই বলে এক সময় এ খাতে আগ্রহ কমতে থাকে। দ্রুত প্রযুক্তি পরিবর্তনে এ খাতের জনপ্রিয়তা কমতে থাকে। নব্বইয়ের দশকে কৃত্রিম বুদ্ধিমত্তা গবেষণার জন্য বেল ল্যাবে কাজ নেন তিনি। লিকানের অ্যাকাডেমিক পদ্ধতি নিয়ে অন্যদের সঙ্গে বিতর্ক শুরু হয়। ২০০০ সালে কম্পিউটার ভিশন কমিউনিটি তাঁর প্রযুক্তি সেকেলে বলে তাঁকে বয়কট করে। লিকানের মতোই পরিস্থিতি ঘটে একই ক্ষেত্র নিয়ে কাজ করা মন্ট্রিল বিশ্ববিদ্যালয়ের অধ্যাপক ওশুয়া বেনজিওর। তিনি বলেন, নিউরাল নেট নিয়ে যাঁরা গবেষণা করেছিলেন তাঁদের অধীনে পিএইচডি করতে চাইত না কেউ। এতে কোনো চাকরি না পাওয়ার আশঙ্কা ছিল। ২০০৩ সালে গবেষক লিকান ঘুরে দাঁড়াতে নতুন উদ্যোগ নেন। নিউইয়র্ক বিশ্ববিদ্যালয়ে যোগ দেন এবং গবেষক হিনটন ও বেনজিওকে নিয়ে নিউরাল নেটের পুনর্জন্ম দেওয়ার কাজ শুরু করেন। লিকান বলেন, ‘আমরা কাজ শুরু করার পর এর নাম দিয়েছিলাম ডিপ লার্নিং কনসপাইরেসি।’
একক কোনো বস্তু শনাক্তের জন্য পৃথক নিউরাল নেট তৈরির পরিবর্তে একটি নিউরাল নেট যাতে বিভিন্ন বস্তু শনাক্ত ও পার্থক্য বের করতে পারে, সে কাজ শুরু করেন লিকান ও সহকর্মী গবেষকেরা। এ কাজে গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা রাখে ডিপ লার্নিং কনসপাইরেসি। লিকানসহ এ খাতের অন্য গবেষকেরা মিলে ২০১০ সালের দিকে কম্পিউটার ভিশন ব্যবস্থার উন্নতি করতে সক্ষম হন। কম্পিউটার ছবিতে বস্তু চিনতে শুরু করে। এরপর তা ভিডিও ও লাইভ ক্যামেরায় বস্তু শনাক্ত করতে সক্ষম হয়। এখন যেমন বাস্কেটবলের দিকে ক্যামেরা ঠিক করলে ক্যামেরা বলে দিতে পারে বস্তুটি কী। কৃত্রিম বুদ্ধিমত্তার উন্নতির সঙ্গে সঙ্গে লিকান সাধারণ একজন গবেষক থেকে এ ক্ষেত্রের নেতৃত্বস্থানীয় গবেষকেদের একজন হয়ে যান। আর যে খাতটিতে গবেষণা করে চাকরি পাওয়া যাবে না বলে অনেকে পিছু হটেছিলেন, এক বছরের মধ্যে সেটিই হয়ে যায় আকর্ষণীয় খাত।
২০১৩ সালে লিকান ফেসবুকে যোগ দেন। কৃত্রিম বুদ্ধিমত্তাকে যিনি ছবিতে কাজে লাগাতে চান তাঁর জন্য ফেসবুক আদর্শ প্ল্যাটফর্ম হিসেবে ধরা দিল। লিকান ও তাঁর গবেষক দল ফেসবুকের ছবিগুলোর ওপরে কাজ করার সুযোগ পেলেন। ফেয়ার টিমটি ফেসবুকের এএমএল টিমের সঙ্গে যৌথভাবে কাজ করছে। ফেয়ার টিমের গবেষণা ফল কাজে লাগিয়ে নিউজফিড পরিবর্তনে কাজ করে এএমএল টিম। অর্থাৎ, আমরা ফেসবুকের নিউজফিডে যে পরিবর্তন দেখতে পাই, ব্যবহারকারী তাঁর নিউজফিডে কোন পোস্টটি দেখবেন, তা এ গবেষক দলটির কাজের ফল।
কৃত্রিম বুদ্ধিমত্তা নিয়ে গবেষণা করছেন ইয়ান লিকান।
কৃত্রিম বুদ্ধিমত্তা নিয়ে গবেষণা করছেন ইয়ান লিকান।
ফেসবুকের মেনলো পার্কের প্রধান কার্যালয় থেকে তিন হাজার মাইল দূরে ডাউনটাউন ম্যানহাটনে পুরোনো-ধূসর একটি অফিস। সেখানে কয়েকটি প্রকল্প নিয়ে একদল কর্মী কাজ করছেন। তাঁদের কাজ কোনো সামাজিক যোগাযোগের ওয়েবসাইটের চেয়ে বৈজ্ঞানিক কল্পকাহিনিতেই যেন বেশি জুতসই। দলটি হচ্ছে ফেসবুক আর্টিফিশিয়াল ইনটেলিজেন্স রিসার্চ (এফএআইআর), যা অভ্যন্তরীণভাবে ফেয়ার টিম হিসেবে পরিচিত। দলটি একটি নির্দিষ্ট লক্ষ্যে কাজ করছে। লক্ষ্যটি হচ্ছে কম্পিউটারকে মানুষের মতো বুদ্ধিদীপ্ত করে তোলা। যদিও এ লক্ষ্য অর্জনের অনেকটা পথ বাকি, তবু এর মধ্যে কিছুটা সফলতা এসেছে। ধারণা করা হচ্ছে, আগামী এক দশকের মধ্যে অনেক দূর যাওয়া সম্ভব। দলটির তৈরি কৃত্রিম বুদ্ধিমত্তাযুক্ত প্রোগ্রামগুলো শিল্পীদের মতো হুবহু ছবি আঁকতে ও বিভিন্ন প্রশ্নের উত্তর দিতে পারছে। ভবিষ্যতে কোনো একদিন ফেসবুকে মানুষের মতোই কথোপকথন চালানোর বা কৃত্রিম বুদ্ধিমান বন্ধু হয়ে দাঁড়াবে এ প্রোগ্রাম।
ফেয়ার টিমটি ফেসবুকের আর দশটা সাধারণ টিমের মতো নয়, তা কাজের ধরন দেখলেই বোঝার কথা। এ দলের কর্মীরা ফেসবুকের মালিকানাধীন ইনস্টাগ্রাম, হোয়াটসঅ্যাপ, মেসেঞ্জার বা ফেসবুকের অন্য কর্মীদের সঙ্গে সরাসরি যুক্ত নন। দলটির লক্ষ্য পরবর্তী এক দশেক কী কী সুবিধা আনা যায়, তা নিয়ে কাজ করা। যা আদৌ সম্ভব কি না, এরও নিশ্চয়তা নেই। এই দলের নেতৃত্ব দিচ্ছেন এমন একজন, যিনি যুক্তরাষ্ট্রের সিলিকন ভ্যালির সুপরিচিত আর দশজনের মতো নন।
৫৬ বছর বয়সী ইয়ান লিকান আড়ালেই কাজ করে যাচ্ছেন ভবিষ্যৎ প্রযুক্তির বড় একটি সম্ভাবনার দিক নিয়ে। লিকানের জীবনের অভিজ্ঞতা তাঁকে এ কাজে আরও উৎসাহী করেছে। জীবনে তিনি ব্যর্থ হয়েছেন বহুবার। তাঁর তত্ত্বগুলো একসময় অচল বলা হচ্ছিল। কিন্তু তিনি দমে যাননি। ফেসবুক তাঁকে কাজের সুযোগ করে দিয়েছে। বর্তমানে কৃত্রিম বুদ্ধিমত্তার দুনিয়ায় তাঁর তত্ত্বগুলোকে বিশ্বমানের বলে বিবেচনা করা হচ্ছে।
লিকান বাজফিড নিউজকে একবার বলেছিলেন, ‘ডিজিটাল দুনিয়ায় আপনার যোগাযোগ, বিশেষ করে ফোন, কম্পিউটারের সঙ্গে যোগাযোগ ব্যবস্থা বদলাতে যাচ্ছে।’
ফেয়ারের কর্মীদের নিয়ে লিকান কম্পিউটারের সক্ষমতা বাড়াতে কাজ করছেন। কম্পিউটার যাতে দেখতে পারে, শুনতে পারে ও নিজ থেকে যোগাযোগ করতে পারে, সে চেষ্টা করছেন তাঁরা। তাঁদের এ উদ্যোগ ফেসবুকের বিভিন্ন ফিচার বা পণ্যে কাজে লাগানো হচ্ছে। ফেসবুকের নিউজ ফিড র্যাঙ্কিং থেকে শুরু করে ক্যামেরা ও ছবি ফিল্টারের ক্ষেত্রটিকেও স্পর্শ করেছে তাদের কাজ। দলটির পেছনে ফেসবুক বিনিয়োগ বাড়ানোর পাশাপাশি সময়ও দিচ্ছে প্রচুর। কৃত্রিম বুদ্ধিমত্তা মজার বলেই নয়, একে জরুরি বলে মনে করছে ফেসবুক। প্রযুক্তি বিশ্বের সবখানেই এখন কৃত্রিম বুদ্ধিমত্তা নিয়ে লড়াই শুরু হয়েছে। আমাজন, গুগল, উবার, অ্যাপল, স্যামসাংসহ অনেক প্রতিষ্ঠান এখন এ ক্ষেত্রে কাজ শুরু করেছে।
ফেসবুকের সবখানেই এখন কৃত্রিম বুদ্ধিমত্তার ব্যবহার দেখা যায়। ফটো ফিল্টার, নিউজ ফিড সাজানো, কনটেন্ট বাছাই করা, কনটেন্ট সরানোসহ নানা কাজে কৃত্রিম বুদ্ধিমত্তাকে কাজে লাগানো হচ্ছে।
ফেসবুকের অ্যাপ্লাইড মেশিন লার্নিং গ্রুপের (এএমএল) প্রধান জোয়াকিন ক্যানডেলা বলেন, মানুষ ফেসবুকে এখন যে অভিজ্ঞতাগুলো পাচ্ছে, তা কৃত্রিম বুদ্ধিমত্তার ওপর নির্ভরশীল। এটা ছাড়া ফেসবুকের অস্তিত্ব থাকত না।
এ ক্ষেত্র যত উন্নত হচ্ছে, ফেসবুক তত বেশি লিকান ও তাঁর কর্মী দলটির ওপর নির্ভরশীল হয়ে উঠছে। প্রতিদ্বন্দ্বীদের সঙ্গে এগিয়ে থাকতে, নতুন প্রোগ্রাম তৈরিতে লিকান ও তাঁর দল এখন ফেসবুকের কাছে গুরুত্বপূর্ণ হয়ে উঠেছে। বেশ কয়েক বছর ধরে সমালোচনা সইলেও লিকানের অধীনে এখন ৮০ জন গবেষক কাজ করছেন। এখানে যত অর্থ লাগে, তা জোগাচ্ছে ফেসবুক। ফেসবুক লিকানের ওপর আস্থা রাখায় তাঁর দলের প্রতিদান দেওয়ার পালা।
১৯৬০ সালে প্যারিসে জন্মগ্রহণ করেন ইয়ান লিকান। কম্পিউটার বিজ্ঞানী ও নিউরোনেটোলজিস্ট হিসেবে পরিচিত তিনি। কম্পিউটার ভিশন ও অপটিক্যাল ক্যারেক্টার শনাক্ত করতে কাজ করেছেন তিনি। কম্পিউটার একদিন দেখতে পাবে—ছোটবেলা থেকে লিকান এ ধারণা নিয়ে বড় হয়েছেন। এখন ফেশিয়াল রিকগনিশন ও ছবি শনাক্তকরণ পদ্ধতি উন্নত হলেও আশির দশকে তা ছিল কল্পনাতীত। ১৯৮০ সালের দিকে প্যারিসে বিশ্ববিদ্যালয়ে পড়ার সময় থেকেই তা নিয়ে কাজ শুরু করেন লিকান। যন্ত্র যাতে ধারণা করতে বা কোনো কাজ শিখতে পারে, সে লক্ষ্যে বিভিন্ন পদ্ধতি নিয়ে কাজ শুরু করেন তিনি। এটাকে বলা হতো আর্টিফিশিয়াল নিউরাল নেটওয়ার্ক। তবে কৃত্রিম বুদ্ধিমত্তাসংক্রান্ত বিজ্ঞানের কোনো কাজ নেই বলে এক সময় এ খাতে আগ্রহ কমতে থাকে। দ্রুত প্রযুক্তি পরিবর্তনে এ খাতের জনপ্রিয়তা কমতে থাকে। নব্বইয়ের দশকে কৃত্রিম বুদ্ধিমত্তা গবেষণার জন্য বেল ল্যাবে কাজ নেন তিনি। লিকানের অ্যাকাডেমিক পদ্ধতি নিয়ে অন্যদের সঙ্গে বিতর্ক শুরু হয়। ২০০০ সালে কম্পিউটার ভিশন কমিউনিটি তাঁর প্রযুক্তি সেকেলে বলে তাঁকে বয়কট করে। লিকানের মতোই পরিস্থিতি ঘটে একই ক্ষেত্র নিয়ে কাজ করা মন্ট্রিল বিশ্ববিদ্যালয়ের অধ্যাপক ওশুয়া বেনজিওর। তিনি বলেন, নিউরাল নেট নিয়ে যাঁরা গবেষণা করেছিলেন তাঁদের অধীনে পিএইচডি করতে চাইত না কেউ। এতে কোনো চাকরি না পাওয়ার আশঙ্কা ছিল। ২০০৩ সালে গবেষক লিকান ঘুরে দাঁড়াতে নতুন উদ্যোগ নেন। নিউইয়র্ক বিশ্ববিদ্যালয়ে যোগ দেন এবং গবেষক হিনটন ও বেনজিওকে নিয়ে নিউরাল নেটের পুনর্জন্ম দেওয়ার কাজ শুরু করেন। লিকান বলেন, ‘আমরা কাজ শুরু করার পর এর নাম দিয়েছিলাম ডিপ লার্নিং কনসপাইরেসি।’
একক কোনো বস্তু শনাক্তের জন্য পৃথক নিউরাল নেট তৈরির পরিবর্তে একটি নিউরাল নেট যাতে বিভিন্ন বস্তু শনাক্ত ও পার্থক্য বের করতে পারে, সে কাজ শুরু করেন লিকান ও সহকর্মী গবেষকেরা। এ কাজে গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা রাখে ডিপ লার্নিং কনসপাইরেসি। লিকানসহ এ খাতের অন্য গবেষকেরা মিলে ২০১০ সালের দিকে কম্পিউটার ভিশন ব্যবস্থার উন্নতি করতে সক্ষম হন। কম্পিউটার ছবিতে বস্তু চিনতে শুরু করে। এরপর তা ভিডিও ও লাইভ ক্যামেরায় বস্তু শনাক্ত করতে সক্ষম হয়। এখন যেমন বাস্কেটবলের দিকে ক্যামেরা ঠিক করলে ক্যামেরা বলে দিতে পারে বস্তুটি কী। কৃত্রিম বুদ্ধিমত্তার উন্নতির সঙ্গে সঙ্গে লিকান সাধারণ একজন গবেষক থেকে এ ক্ষেত্রের নেতৃত্বস্থানীয় গবেষকেদের একজন হয়ে যান। আর যে খাতটিতে গবেষণা করে চাকরি পাওয়া যাবে না বলে অনেকে পিছু হটেছিলেন, এক বছরের মধ্যে সেটিই হয়ে যায় আকর্ষণীয় খাত।
২০১৩ সালে লিকান ফেসবুকে যোগ দেন। কৃত্রিম বুদ্ধিমত্তাকে যিনি ছবিতে কাজে লাগাতে চান তাঁর জন্য ফেসবুক আদর্শ প্ল্যাটফর্ম হিসেবে ধরা দিল। লিকান ও তাঁর গবেষক দল ফেসবুকের ছবিগুলোর ওপরে কাজ করার সুযোগ পেলেন। ফেয়ার টিমটি ফেসবুকের এএমএল টিমের সঙ্গে যৌথভাবে কাজ করছে। ফেয়ার টিমের গবেষণা ফল কাজে লাগিয়ে নিউজফিড পরিবর্তনে কাজ করে এএমএল টিম। অর্থাৎ, আমরা ফেসবুকের নিউজফিডে যে পরিবর্তন দেখতে পাই, ব্যবহারকারী তাঁর নিউজফিডে কোন পোস্টটি দেখবেন, তা এ গবেষক দলটির কাজের ফল।
মার্ক জাকারবার্গ জার্ভিস নামের একটি ডিজিটাল সহকারী তৈরি করেছেন।
মার্ক জাকারবার্গ জার্ভিস নামের একটি ডিজিটাল সহকারী তৈরি করেছেন।
গত বছরের ডিসেম্বর মাসে ফেসবুকের প্রধান নির্বাহী মার্ক জাকারবার্গ ফেসবুকে একটি ভিডিও পোস্ট করেন। ভিডিওতে জাকারবার্গ তাঁর নিজের বাড়ি ও পরিবারের সদস্যদের জন্য জার্ভিস নামের একটি এআই সিস্টেমকে তুলে ধরেন। ভিডিওটিতে দেখা যায়, মার্ক ঘুম থেকে উঠেছেন। আর জার্ভিস জানালার পর্দা সরিয়ে শুভেচ্ছা জানাচ্ছে, সময় জানাচ্ছে; পাশাপাশি ঘরের তাপমাত্রা কত তাও জানিয়ে দিচ্ছে। মার্ক জার্ভিসের সঙ্গে কথা বলছেন এবং জার্ভিস তাঁর দিনের গুরুত্বপূর্ণ কাজের কথা মনে করিয়ে দিচ্ছে। মার্কের এই প্রকল্প তাঁর বাড়িকে করে তুলেছে প্রযুক্তিনির্ভর বাড়ি বা স্মার্ট হোম। কারণ, স্মার্টফোনের মাধ্যমে বার্তা পাঠিয়ে বা কণ্ঠস্বর নির্দেশনার মাধ্যমে ঘরের অনেক কাজ করা সম্ভব। শুধু তা-ই নয়, জার্ভিস এআই ব্যক্তিগত সহকারীর মতো কথা বলবে, সুবিধামতো বা প্রয়োজন অনুযায়ী কাজ করে দেবে; যা অনেকটা গুগল ও আমাজনের ব্যক্তিগত সহকারীর মতো। পরিবেশের সঙ্গে তাল মিলিয়ে যেকোনো কাজ করতে পারে জার্ভিস। সকালের নাশতা থেকে শুরু করে কোনো গান বাজানো, ঘরের তাপমাত্রা নিয়ন্ত্রণ করা, কন্যা ম্যাক্সের ওপর নজর রাখাসহ বিনোদনও দিতে পারে জার্ভিস। দরজায় যদি কেউ আসে, তাহলে তার পরিচয় সে যাচাই করতে পারে। জাকারবার্গের এই জার্ভিসকে খুব বেশি গুরুত্বপূর্ণ বলে মনে করেননি লিকান। তিনি বলেন, এটা ছিল স্ক্রিপ্টনির্ভর। সহজ ও অল্পস্বল্প কৃত্রিম বুদ্ধিমত্তার ব্যবহার হয়েছে এতে। তাঁর লক্ষ্য জার্ভিসের চেয়েও উন্নত কোনো প্রোগ্রাম তৈরি করা।
সম্প্রতি মেসেঞ্জারে ‘এম’ নামের ডিজিটাল সহকারী সেবা চালু করেছে ফেসবুক। মূলত, মেসেঞ্জারকে আরও কার্যকর করতেই এ সেবা চালু করা হয়েছে। কৃত্রিম বুদ্ধিমত্তা প্রযুক্তির এ সেবা বার্তা বিনিময়ের সময় ব্যবহারকারীদের বিভিন্ন তথ্য দিয়ে সহায়তা করে। বন্ধুদের পাঠানো বার্তার উত্তর কেমন হওয়া উচিত, সে বিষয়েও পরামর্শ দেবে এটি। ব্যবহারকারীরা অবস্থানের তথ্যসহ গাড়িভাড়া এমনকি তাদের বন্ধুদের অ্যাকাউন্টে অর্থও পাঠাতে পারে ‘এম’। এটি তৈরিতে লিকান ও তাঁর টিমের গবেষণা কাজে লাগানো হয়েছে। লিকান এমন সহকারী তৈরি করতে চান, যা কথা বুঝতে সক্ষম হবে। লিকান বলেন, যন্ত্র কথোপকথন চালিয়ে যেতে পারবে। আগে থেকে পরিকল্পনা করতে পারবে। বোকা যন্ত্র বলে বিরক্ত হতে হবে না। লিকান বলেন, এ ধরনের যন্ত্র তৈরির জন্য কোনো ব্লুপ্রিন্ট নেই। ফেয়ার টিম স্মার্ট সে যন্ত্রে বুদ্ধিমত্তা যুক্ত করতেই কাজ করে যাচ্ছে।
মাত্র দুই দশক আগে যে লিকানের ধারণা কেউ শুনতে চাইত না, আজ তিনি তাঁর কাজের জন্য আলোচিত। যদিও সাফল্য এখনো দূরের পথ তবু লিকান বলেন, যতটা করেছেন, সেটা তাঁর কাছে দারুণ এক অনুভূতি।
http://www.prothom-alo.com/technology/article/1165101/%E0%A6%AB%E0%A7%87%E0%A6%B8%E0%A6%AC%E0%A7%81%E0%A6%95%E0%A7%87%E0%A6%B0-%E0%A6%86%E0%A7%9C%E0%A6%BE%E0%A6%B2%E0%A7%87%E0%A6%B0-%E0%A6%8F%E0%A6%95%E0%A6%9C%E0%A6%A8-%E0%A6%95%E0%A6%B0%E0%A7%8D%E0%A6%AE%E0%A7%80