Daffodil International University

Bangladesh => Heritage/Culture => Topic started by: 710001113 on November 21, 2020, 12:37:53 PM

Title: ইলিশনামা
Post by: 710001113 on November 21, 2020, 12:37:53 PM
ইলিশনামা

Arafat Hossain
বাঙালির কাছে অতি পছন্দের মাছের কথা জিজ্ঞেস করলে ইলিশের কথা আসবেই। বিশ্বের ৮৬% ইলিশ এককভাবে বাংলাদেশে উৎপাদিত হয়। সেই হিসেব ইলিশের একচ্ছত্র অধিকার বাংলাদেশের দখলে। ধোঁয়া ওঠা ভাতের সাথে ইলিশ পছন্দ করে না, এমন বাঙালি সম্ভবত পাওয়া যাবে না।

শব্দে জব্দ ইলিশ
উৎপত্তিগতভাবে 'ইলিশ' শব্দটি সংস্কৃত ভাষা থেকে এসেছে। সংস্কৃতে বলা হয় 'ইলীশ'। ইল+ঈশ- এই হলো সন্ধি-বিচ্ছেদ। 'ইল' মানে জলের মধ্যে, আর 'ঈশ' মানে রাজা। তাহলে 'ইলীশ' মানে দাঁড়ায় 'জলের রাজা'। যদিও ইলিশ শব্দটি এখন ইলিশ হিসেবে লেখা হয়। ইলিশ যে জলের রাজা তা যেকোনো রসনাবিলাসী বাঙালি স্বীকার করবেই, তবে অবাঙালিদের কথা ভিন্ন!



ইলিশের বসতবাড়ি
বঙ্গোপসাগর ও আরব সাগর এবং তৎসংলগ্ন নদ-নদীতে ইলিশের দেখা পাওয়া যায়। সেই হিসেবে বাংলাদেশ, ভারত, মায়ানমার, পাকিস্তান, ইরান, থাইল্যান্ড এসব দেশে ইলিশের চারণভূমি। বাংলাদেশের পদ্মার ইলিশের খ্যাতি তো জগৎজোড়া। বিশ্বের সিংহভাগ ইলিশের যোগানদার বাংলাদেশ। সেই মোতাবেক বলা যায় ইলিশ বাংলাদেশেরই ভূমিপুত্র। আন্তর্জাতিক মেধাস্বত্ব কর্তৃপক্ষের দেয়া ইলিশের জিআই (Geographical Indication) স্বীকৃতিও বাংলাদেশের দখলে।

 
শ্রেষ্ঠ ইলিশ
বিনা তর্কে বলা যায়, পদ্মার ইলিশই শ্রেষ্ঠ, কিন্তু কীভাবে এই শ্রেষ্ঠত্ব এলো সেদিকে এখন চোখ ফেরানো যাক। ইলিশ মূলত সাগরের মাছ। নোনা জলে ডিম নষ্ট হয়ে যায় বিধায় ডিম ছাড়তে ইলিশকে নদীর মোহনায় আসতে হয়।

এ সময় ইলিশকে দীর্ঘ পথ পাড়ি দিতে হয়। ইলিশের বেগ ঘন্টায় প্রায় ৬০ কি.মি.। নদীমুখী ইলিশ স্রোতের বিপরীতে চলে। নদীতে জমে থাকা শ্যাওলা খেয়ে বাঁচে। ইলিশের খাদ্যের জন্য উৎকৃষ্ট শ্যাওলা পদ্মার মোহনাতে পাওয়া যায়। এই শ্যাওলা ইলিশের পেটে চর্বি হিসেবে জমা হয়, যা ইলিশের স্বাদ বাড়িয়ে দেয় কয়েকগুণ। ডিম ছাড়ার আগপর্যন্ত ইলিশের স্বাদ বেশি থাকে। পেটে ডিম হলে স্বাদ কিছুটা কমে যায়, আর ডিম ছাড়লে আরো কমে।

বিশেষজ্ঞদের মতে, সাগরের চেয়ে নদীর ইলিশ সুস্বাদু। তবে সাগরের ইলিশও ফেলনা নেয়। মূলত একেক রকম ইলিশ একেক স্বাদের। আর যেকোনো রসনাবিলাসীর কাছে পদ্মার ইলিশই যে শ্রেষ্ঠ, এতে কোনো সন্দেহ নেই।

বিলিশ কথা
ডিম ছাড়ার উদ্দেশ্যে ইলিশ যখন সাগর ছেড়ে নদীতে আসে, তখন কিছু ইলিশ পথ ভুলে বা বন্যায় খালে-বিলে ঢুকে পড়ে। খাল-বিলের পানিতে ইলিশের স্বাদ কয়েকগুণ কমে যায়। এসব ইলিশকে বলা হয় বিলিশ। তবে বিলিশ সচরাচর পাওয়া যায় না।

ইলিশের খাদ্যগুণ
প্রতি ১০০ গ্রাম ইলিশে ফ্যাট আছে ১৯.৪ গ্রাম, প্রোটিন ২১.৮ গ্রাম, শর্করা ২.৯ গ্রাম, মিনারেল ২.২ গ্রাম, ক্যালসিয়াম ১৮০ মিলিগ্রাম, পটাশিয়াম ২৮০ মিলিগ্রাম, আয়রন ২ মিলিগ্রাম, এবং ২৭৩ ক্যালরি এনার্জি আছে। ইলিশ মাছে আছে ওমেগা ৩ ফ্যাট, যা হার্টের রোগ ও ক্যান্সার নিরাময়ে ভূমিকা রাখে। তবে অতিরিক্ত কোনো কিছুই স্বাস্থ্যকর নয়, যা ইলিশের ক্ষেত্রেও প্রযোজ্য।



সাহিত্য সংস্কৃতির ইলিশ
বাংলাদেশে পয়লা বৈশাখ আর পান্তা ইলিশ একরকম সমার্থক হয়ে গেছে। সত্যিকারার্থে চৈত্র, বৈশাখ মাস ইলিশ ধরা বা খাওয়ার সময় নয়। ইলিশ ধরার সেরা সময় ভাদ্র মাসের অমাবস্যা ও পূর্ণিমা।

মধ্যযুগের শ্রেষ্ঠ কবি ভারতচন্দ্র রায়গুণাকারের অন্নদামঙ্গলকাব্যের একটি কবিতায় একত্রিশটি মাছের নাম আছে, তার মধ্যে সর্বশেষটি ইলিশ।

বিজয়গুপ্তের মনসামঙ্গল কাব্যে ইলিশ রান্নার উপায় বর্ণনা করা হয়েছে এভাবে...

আনিয়া ইলিশ মৎস
করিল ফালা ফালা
তাহা দিয়া রান্ধো ব্যঞ্জণ
দক্ষিণ সাগর কলা।

বুদ্ধদেব বসু তার 'ইলিশ' কবিতায় ইলিশকে 'জলের উজ্জ্বল শস্য' হিসেবে বর্ণনা করেছেন। ইলিশ নিয়ে আছে গোপাল ভাড়ের গল্প। রাজা কৃষ্ণচন্দ্র গোপালকে বাজার থেকে ইলিশ কিনে সবাইকে দেখিয়ে দরবারে আসতে বলেন, যদি কেউ দাম না জিজ্ঞেস করে তবে গোপাল পুরস্কৃত হবে। বুদ্ধিমান গোপাল ইলিশ মাছ হাতে ধরে, ধুতিটা উল্টো করে পরে দরবারে এলো। লোকজন দাম না জিজ্ঞেস করে বলতে লাগল, পাগলের আবার ইলিশ খাওয়ার শখ হলো!

সৈয়দ মুজতবা আলীর ইলিশপ্রীতির কথা না বললেই নয়। একবার এক পাঞ্জাবি অধ্যাপকের সাথে তার তর্ক বাঁধে কোন খাবার শ্রেষ্ঠ তা নিয়ে। আলী সাহেবের মতে শ্রেষ্ঠ খাবার হলো সরু চালের ভাতের সাথে পদ্মার ইলিশ। অন্যদিকে পাঞ্জাবি অধ্যপক বলেন, বিরিয়ানি। রাগ করে তিনি অধ্যাপকের সাথে সাতদিন কথা বলা বন্ধ করে দেন। একেই বলে সত্যিকারের ইলিশরসিক!

ইলিশ নিয়ে গ্রামবাংলায় ছড়িয়ে আছে অসংখ্য ছড়া, কবিতা, শ্লোক, প্রবাদ, কথকতা, উপকথা। ১৯৭০ সালের নির্বাচনে তৎকালীন পূর্ববাংলায় একটি ছড়া বেশ জনপ্রিয় হয়েছিল, "ইলিশ মাছের তিরিশ কাঁটা, বোয়াল মাছের দাড়ি/ ইয়াহিয়া খান ভিক্ষা করে/ শেখ মুজিবের বাড়ি।"

 
অর্থনীতিতে ইলিশ
দৈনিক বণিক বার্তা জানাচ্ছে, ২০০৭-০৮ অর্থবছরে বাংলাদেশে ইলিশ উৎপাদনের পরিমাণ ছিল ২.৯০ লাখ টন। এর এক দশক পর ২০১৮-১৯ অর্থবছরে জাতীয় মাছটির উৎপাদন বেড়ে ৫.৩৩ লাখ টনে উন্নীত হয়েছে। শিগগিরই উৎপাদন সাড়ে পাঁচ লাখ টন ছাড়িয়ে যাবে বলে আশা করছেন সংশ্লিষ্টরা। দেশে মোট উৎপাদিত মাছের ১২.১৫ শতাংশই আসে শুধু ইলিশ থেকে। আর মোট দেশজ উৎপাদনে (জিডিপি) ইলিশের অবদান ১ শতাংশেরও বেশি।

একসময় বিশ্বের মোট ইলিশের ৬০% বাংলাদেশে উৎপাদিত হত। ২০২০ সালে মোট ইলিশের ৮৬%-ই এদেশে উৎপাদন হয়,  জানাচ্ছে দৈনিক প্রথম আলো। বাংলাদেশ ২০১৭ সালে ইলিশের ভৌগলিক নির্দেশক স্বত্ব লাভ করে আন্তর্জাতিক মেধাসত্ব কর্তৃপক্ষ থেকে। ২০১৮ সালে বাংলাদেশ কৃষি বিশ্ববিদ্যালয়ের চার বিজ্ঞানী ইলিশের জীবন রহস্য উন্মোচন করেন। বাংলাদেশে ইলিশের ৬টি অভয়াশ্রম আছে, অক্টোবর থেকে নভেম্বর মাসের ২২ দিন ইলিশের প্রজনন মৌসুমে ইলিশ ধরা নিষেধ, এছাড়াও সারা বছর তো জাটকা ধরা নিষেধ থাকেই। নিষিদ্ধ সময়ে সরকার জেলেদের জন্য বিকল্প আয় ও সাহায্যের ব্যাবস্থা করেছে, যার ফলাফল মিলছে ইলিশ উৎপাদনে, ১০ বছরে দেশে ইলিশের উৎপাদন ৮৪% বেড়েছে।

ইলিশ শিকারীদের যাপিত জীবন
ইলিশ নিয়ে এত কথা, এত নাম-ডাক, কিন্তু কেমন আছে ইলিশের জেলেরা সেটাও তো খতিয়ে দেখা দরকার। ইলিশ মাছ সাধারণত দুভাবে ধরা হয়- নৌকা বা ট্রলারে করে। ট্রলারযাত্রায় নদীতে একটানা ১০-১৫ দিন থাকতে হয়, তাই মাঝনদীতে যাওয়া-আসা আর থাকার বন্দোবস্ত করা লাগে। অন্যদিকে নৌকায় ইলিশ ধরতে গেলে ৩-৪ ঘন্টা পর ফেরত আসা যায়।

মাছ বিক্রির টাকা থেকে নৌকা বা ট্রলারের মালিক পায় ৩৮-৪০ ভাগ, বাকিটা জেলেরা ভাগাভাগি করে নেয়। জেলেদের থেকে মাছগুলো নৌকা বা ট্রলারের মালিক কিনে নেয়। সেখান থেকে আবার কিছু মাছ ফাও দিতে হয়। জেলেদের অভিযোগ- যখন তারা বেশি মাছ ধরে, ব্যবসায়ীরা তখন ইচ্ছে করে মাছের দাম কমিয়ে দেয়। অবশ্য মালিকপক্ষ বলে, ট্রলারের মেরামত, নদীতে থাকা-খাওয়ার খরচ, জালের খরচ সবই তাকে বহন করতে হয়। তার ভাগে যে বেশি পড়ে এ অভিযোগ সত্য নয়। তাছাড়া ইলিশ ধরার জাল দুই বছরের বেশি টেকেও না।


মৎসজীবীদের ইলিশ ধরার নিজস্ব ধর্মীয় রীতির অচার অনুষ্ঠানও আছে। মুসলমান জেলেরা নতুন নৌকা বা ট্রলার নামানোর আগে কোরআন খতম দেয়, মিলাদ পড়ায়। আর হিন্দু জেলেরা নৌকায় জল ছিটিয়ে পূজার মতো আয়োজন করে। প্রথম ইলিশ ধরা পড়লে থালায় সিঁদুর দিয়ে সাজিয়ে বরণ করে নেয়। জেলেরা মহাজনদের কাছ থেকে সুদে টাকা ধার নিয়ে নৌকা বা ট্রলার নামায় নদীতে, এটাকে বলা হয় দাদন। অনেক সময় দাদনের সুদের ভার প্রজন্ম থেকে প্রজন্ম বহন করতে হয়।