Show Posts

This section allows you to view all posts made by this member. Note that you can only see posts made in areas you currently have access to.


Messages - 710001113

Pages: [1] 2 3 ... 23
1
History / Re: History of Muslim'S
« on: August 03, 2021, 07:17:06 PM »
nice

2
Basic Maths / Re: Co-Ordinate Geometry
« on: November 28, 2020, 09:27:53 PM »
nice

3
Basic Maths / Re: Theory of sets
« on: November 28, 2020, 09:27:38 PM »
nice

5
nice

6
ডাইনোসরদের কি ফিরিয়ে আনা সম্ভব?

Uzzal Hossen
https://roar.media/bangla/main/plants-animals/is-it-possible-to-bring-dinosaur-back
ডাইনোসর নিয়ে নির্মিত সিনেমা অনেকেই দেখে থাকবে। সেসব দেখতে অনেকেরই ভালো লাগে। দেখতে দেখতে হয়তো ভাবনা আসে, এত প্রভাবশালী প্রাণীগুষ্ঠি, এদের প্রায় সকলেই এখন বিলুপ্ত। এককালে পৃথিবী দাপিয়ে বেড়িয়েছে কিন্তু এদের কাউকে আমরা দেখতে পাই না। কেমন হতো যদি নিজ চোখে সেসব ডাইনোসর দেখা যেত!

ডাইনোসর বিলুপ্ত হয়ে গেছে আজ থেকে প্রায় ৬৬ মিলিয়ন বছর আগে। তাহলে ডাইনোসরদের দেখা সম্ভব হবে না? কোনো উপায়ে কি ডাইনোসরদের আবার পৃথিবীতে ফিরিয়ে আনা যাবে না? বিজ্ঞান কী বলে?


বিলুপ্ত হয়ে যাওয়া কোনো প্রাণীকে ফিরিয়ে আনার পদ্ধতি হচ্ছে ক্লোনিং। এছাড়াও রিভার্স ইঞ্জিনিয়ারিংয়ের মাধ্যমেও ফিরিয়ে আনা যেতে পারে। ক্লোনিং করতে হলে অবশ্যই ডাইনোসরের ডিএনএ লাগবে। সম্পূর্ণ ডিএনএ পাওয়া গেলে বিজ্ঞানীরা সেই প্রাণীকে নতুন করে ফিরিয়ে আনতে পারবেন। কিন্তু ৬৬ মিলিয়ন বছর আগে বিলুপ্ত হওয়া ডাইনোসরেদের ডিএনএ কি আদৌ পাওয়া সম্ভব? হয়তো সম্ভব, নয়তো না। ডিএনএ পাওয়া গেলে আবারো হয়তো পৃথিবীর বুকে দেখা যাবে ডাইনোসরদের। না পাওয়া গেলে তো আর সম্ভব না।


জুরাসিক পার্ক সিনেমা অনেকেই দেখেছে। এ সিনেমায় দেখা যায়, অ্যাম্বার পাথরে কয়েক কোটি বছর আগে আটকে যাওয়া একটি মশা খুঁজে পান বিজ্ঞানীরা। মশাটি কোনো এক ডাইনোসরের রক্ত খেয়েছিল। আর সেই মশা থেকে বিজ্ঞানীরা ডাইনোসরের ডিএনএ সংগ্রহ করেন। এরপর সেই ডিএনএ থেকে জন্ম দেন নতুন ডাইনোসরের। সিনেমার মতো করে বাস্তবে কি এরকম মশা, মাছি বা অন্যান্য প্রাণী থেকে ডাইনোসরের রক্ত/ডিএনএ পাওয়া সম্ভব?


গাছ থেকে নিঃসৃত অ্যাম্বারে আটকে থাকতে পারে মশার মমি; Image Source: Dietmar Down Under/Flickr
অ্যাম্বার হচ্ছে বিশেষ গাছ নিঃসৃত আঠালো পদার্থ। এই আঠালো পদার্থে কোনো ছোট পতঙ্গ বা প্রাণী আটকে গেলে সময়ের বিবর্তনে সেটি মমিতে পরিণত হয়। ফলে তার দেহে যদি রক্ত অবশিষ্ট থাকে তাহলে সেই রক্তে ডাইনোসরের ডিএনএ ভালো থাকলেও থাকতে পারে। অর্থাৎ বিজ্ঞানীরা যদি এই সময়ে এসে প্রাচীন যুগের সেই অ্যাম্বার খুঁজে পান আর তাতে যদি কোনো ডাইনোসরের ডিএনএবাহী প্রাণী বা পতঙ্গ পাওয়া যায় তাহলে ডাইনোসর অধ্যায়ের এক নতুন দিক উন্মোচিত হতেও পারে।

শুধু অ্যাম্বারই শেষ ভরসা নয়। ডাইসোরদের ফসিল বা কোনো হাড়ের খোঁজ পেলেও তাতে মিলতে পারে ডিএনএ। বিজ্ঞানীরা বিভিন্ন প্রচীন প্রাণীর হাড় থেকে ডিএনএ সংগ্রহ করতে সক্ষম হয়েছেন। তবে ডাইনোসরদের বসবাস ছিলো আজ থেকে প্রায় ৬৬ মিলিয়ন বছর আগে। এত আগের প্রাণীর অক্ষত হাড় খুঁজে পাওয়া কষ্টকরই বটে।

তবে আশার কথা হলো বিভিন্ন সময় বিভিন্ন বিজ্ঞানীই দাবি করেছেন ডাইনোসরের হাড় পাওয়ার কথা। যদি হাড় পাওয়াও যায় তাতে কি ডিএনএ মিলবে? কোটি কোটি বছর আগের মৃত কোনো প্রাণীর হাড়ে ডিএনএ’র খোঁজ পাওয়া আকাশের চাঁদ হাতে পাওয়ার মতোই।


সম্পূর্ণ ডিএনএ পাওয়া গেলে ডাইনোসর যুগের এক নতুন অধ্যায় সূচিত হতে পারে; Image credit Creations Shutterstock.com
৬৬ মিলিয়ন আগেই পৃথিবী থেকে বিলুপ্ত হয়ে গেছে ডাইনোসররা। তাহলে এত বছর পর তাদের হাড় বা ফসিল পাওয়া গেলেও তাতে ডিএনএ অক্ষত থাকবে তো? বিজ্ঞানীরা বলছেন, কোনো প্রাণীর ডিএনএ সেই জীবের মৃত্যুর পর মুহূর্ত থেকেই ক্ষয় হতে শুরু করে। কারণ বিভিন্ন এনজাইম (যেমন: মাটির জীবাণু, দেহের কোষ, অন্ত্রের কোষ) ডিএনএ’র ক্ষয় করে। একই কাজ করে আল্ট্রাভায়োলেট বিকিরণ। ইউনিভার্সিটি অফ ক্যালিফোর্নিয়ার পরিবেশবিজ্ঞান এবং বিবর্তন জীববিজ্ঞান বিভাগের সহযোগী অধ্যাপক বেথ শাপিরো বলেন, অক্সিজেন এবং পানি রাসায়নিকভাবে ডিএনএ’র প্রান্তগুলো ভেঙে দিয়ে এর পরিবর্তন ঘটাতে পারে। অ্যানজাইমগুলো ডিএনএকে ছোট ছোট টুকরায় ভাঙতেই থাকে যতক্ষণ পর্যন্ত না কিছু অবশিষ্ট থাকে।


 
এখন পর্যন্ত সবচেয়ে প্রাচীন যে ডিএনএ উদ্ধার করা সম্ভব হয়েছে তার বয়স ৭ লক্ষ বছর। কানাডার যুকন শহরের একটি হিমায়িত সোনার ক্ষেত্রে পাওয়া ঘোড়ার ফসিল থেকে এই ডিএনএ পাওয়া গিয়েছিল। তবে সম্প্রতি বিজ্ঞানীরা দাবি করেছেন ৮ লক্ষ বছর আগের মানুষের দাঁত থেকে তারা জিনোম সিকোয়েন্স করতে পেরেছেন।

বিজ্ঞানীদের ধারণা, সাধারণত কোনো ডিএনএ ১ মিলিয়ন থেকে ৫/৬ মিলিয়ন বছর পর্যন্ত টিকে থাকতে পারে। তাহলে ৬৬ মিলিয়ন বছর আগে বিলুপ্ত হওয়া ডাইনোসরদের ডিএনএ কি আর টিকে নেই? নিশ্চিত করে এ প্রশ্নের উত্তর দিতে পারেননি কোনো বিজ্ঞানী। তারা এখনও সন্দিহান যে, ডিএনএ কতদিন পর্যন্ত টিকে থাকতে পারে। কারণ গরম আবহাওয়ায় ডিএনএ খুব তারাতারি নষ্ট হয়। আবার ঠান্ডা আবহাওয়ায় বহু বছর টিকে থাকতে পারে। তাহলে ডাইনোসরদের ডিএনএ যদি উপযুক্ত পরিবেশ এবং আবহাওয়া পায় তাহলে বর্তমান সময় পর্যন্ত টিকে থাকার সম্ভাবনা উড়িয়ে দেওয়া যায় না।

বিশেষজ্ঞরা বলছেন, বিজ্ঞানীরা যদি ডাইনোসরের হাড়ে থাকা ডিএনএ নিয়ে অধ্যয়ন করার সিদ্ধান্ত নেন তবুও এটা বলা সম্ভব হবে না যে সে প্রাণীটি স্বভাবের দিক থেকে ডাইনোসর ছিল কি না। ৭ লক্ষ বছর আগের ঘোড়ার হাড় থেকে ডিএনএ’র যে খন্ডাংশ পাওয়া গিয়েছিল তা ছিল খুবই সংক্ষিপ্ত। তবে আধুনিক ঘোড়ার জিনোমের সাথে সে জিনোমের মিল পাওয়ায় বুঝা যায় যে সে ডিএনএটি ঘোড়ার উৎস থেকেই এসেছে।

অন্যদিকে দেখতে গেলে, ডাইনোসরদের জীবিত আত্মীয়রা হচ্ছে পাখি। ডাইনোসরদের অনেক গ্রুপ রয়েছে। দ্বিপদ, মাংশাসী টাইরানোসরাস রেক্স এবং ভেলোসিরাপ্টর ডাইনোসরদের থেকে বিবর্তিত হয়ে পাখিগুলো বিকশিত হয়েছে। ডাইনোসরদের অন্যান্য গ্রুপ যেমন- হ্যাড্রোসরাস (ডাক-বিল্ড ডাইনোসর), সিরাটোপসিয়ান (ট্রাইরাসেরাটোপস), স্টিগোসোর এবং অ্যাঙ্কিলোসোরদের কোনো জীবিত আত্মীয় নেই। তারপরও যদি ডাইনোসরের কোনো ডিএনএ এই সময়ে পাওয়া যায় তা হবে খুব ভগ্ন এবং বাজেভাবে ক্ষতিগ্রস্ত।


Hypacrosaurus stebingeri ডাইনোসরের ফসিল; Image Source: auctionzip.com
সাম্প্রতিক সময়ে একদল বিজ্ঞানী দাবি করেছেন তারা ডাইনোসরের ফসিল পেয়েছেন যেটি খুব ভালোভাবে সংরক্ষিত ছিল। ন্যাশনাল সায়েন্স রিভিউতে প্রকাশিত তাদের নিবন্ধ থেকে জানা যায়, তারা মূলত ৭৫ মিলিয়ন বছর আগের তৃণভোজী Hypacrosaurus stebingeri ডাইনোসরের খুলির হাড় পেয়েছেন। তারা মনে করছেন এই ফসিলে হয়তো ডাইনোসরের ডিএনএ পাওয়া যাবে।

 
নর্থ ক্যারোলিনা স্টেট ইউনিভার্সিটির মলিকুলার জীবাশ্ববিদ মেরি সোয়াইটজার জানান, তিনি সম্ভবত ডাইনোসরের হাড়ে ডিএনএ’র সন্ধান পেয়েছেন। তবে এখনো তিনি সেটার জিনোম সিকোয়েন্স করেননি। ফলে সেটি ডাইনোসরের কিনা বা তার বৈশিষ্ট্যই বা কেমন তা এখনো জানা যায়নি। ৬৬ মিলিয়ন বছর পরে এসে ডাইনোসরের ডিএনএ’র সন্ধান মিললে তাতে আশ্চর্য হওয়ার কিছু নেই। কারণ এখনো ডাইনোসরের ডিএনএ পাওয়া সম্ভব।

ডাইনোসর ক্লোনিং
তর্কের খাতিরে ধরে নিলাম, গবেষকরা ডাইনোসরের ডিএনএ’র সম্পূর্ণ সিকোয়েন্স পেয়ে গেছেন। এর মানে হলো গবেষকদের কাছে সম্পূর্ণ জিনোমটাই (প্রাণীর ডিএনএ’র সম্পূর্ণ সেট) আছে। আর এতে জাঙ্ক ডিএনএ এবং ভাইরাল ডিএনএ দুটোই থাকবে। ভাইরাল ডিএনএ যদি উদ্ভিদ এবং প্রাণীর দেহে আক্রমণ করে বসে তাহলে সেটি একটি বড় সমস্যা তৈরি করবে।


দৈত্যাকার ডাইনোসরের পুণঃনির্মিত কাল্পনিক রূপ; Image Source: scitechdaily.com
আধুনিক যুগে অনেক প্রাণীকেই ক্লোন করে জন্ম দেওয়া সম্ভব হয়েছে। ডাইনোসরের সঠিক ডিএনএ পাওয়া গেলে সেটিকে জন্ম দিতে সক্ষম হতেও পারেন বিজ্ঞানীরা। জিনোম পেয়ে গেলে তা থেকে ডাইনোসর ক্লোন করতে হলে বিজ্ঞানীদের দরকার পড়বে একটি হোস্ট জীবের। এক্ষেত্রে সঠিক হোস্ট হতে পারে পাখি। কারণ সকল পাখিই ডাইনোসরদের থেকে বিবর্তিত হয়ে এসেছে। এছাড়া ব্যাঙ, পায়রা এবং কুমিরের মতো সরীসৃপের কথাও ভেবে রেখেছেন বিজ্ঞানীরা। তবে এগুলো এখন কেবলই চিন্তা। কারণ এখনো ডিএনএ পাওয়া যায়নি। তার মানে এই মুহুর্তে দাড়িয়ে ক্লোনিংয়ের কথা ভাবাও যাচ্ছে না যেহেতু ডিএনএ নেই। ডিএনএ পাওয়া গেলেই ক্লোনিংয়ের পরবর্তী ধাপগুলোতে যেতে পারবেন বিজ্ঞানীরা। সে পর্যন্ত অপেক্ষা করেতেই হবে।

রিভার্স ইঞ্জিনিয়ারিং
যদি কোনোভাবেই ডাইনোসরের ডিএনএ না পাওয়া যায় তাহলে কি ডাইনোসরদের ফিরিয়ে আনার পথ বন্ধ হয়ে যাবে? না, আরেকটি পথ অবশ্য আছে। সেটি রিভার্স ইঞ্জিনিয়ারিং। প্রাণীর ক্ষেত্রে রিভার্স ইঞ্জিনিয়ারিং হচ্ছে এমন একটি প্রক্রিয়া যার মাধ্যমে জীবিত কোনো প্রাণীর ডিএনএ ধরে অতীতের দিকে যেতে হবে। ৬৬ মিলিয়ন বছর অতীত পর্যন্ত যেতে পারলে সেই প্রাণীকে ডাইনোসরে রূপ দেওয়া সম্ভব হবে।

কিন্তু বাস্তবে তার কাজ কতটুকু এগিয়েছে? ২০১৫ সালে বিজ্ঞানী জ্যাক হর্নার এবং তার দল ঘোষণা দেন যে, তারা পাখির ঠোঁটকে ডাইনোসরের মুখের মতো রূপ দিতে সক্ষম হয়েছেন। এটি হচ্ছে অনেকগুলো মডিফিকেশনের মধ্যে মাত্র একটা মডিফিকেশন। এভাবে নানা পরিবর্তনের মাধ্যমে তারা মুরগিকে ডাইনোসরে রূপ দিতে পারবেন। এটিকে বলা হচ্ছে ‘চিকেনোসরাস’। আর এ পদ্ধতিতে যে চিকেন জন্ম নেবে তাকে বলা হবে ডাইনো-চিকেন।



রিভার্স ইঞ্জিনিয়ারিংয়ের মাধ্যমে চিকেন থেকে ডাইনোসর; Image Source: sciencevibe.com
মন্টানা স্টেট ইউনিভার্সিটির জীবাশ্মবিদ্যা বিভাগের অধ্যাপক জ্যক হর্নার জানান, তারা প্রায় ৫০ শতাংশ কাজ করে ফেলেছেন। তবে এ পদ্ধতিতে যে চিকেন জন্ম হবে সেটি শুধুমাত্র ডাইনোসরের মতো দেখতে হবে। ডাইনোসরের মতো বৈশিষ্ট্য নাও থাকতে পারে তাতে।

জীবিত কোনো প্রাণীকে মডিফিকেশন করতে করতে ডাইনোসরের চেহারা প্রদান করা গেলেও তা দেখতে হয়তো কিছুটা ডাইনোসরের মতো হবে। কিন্তু তার আচরণ, বৈশিষ্ট্য, খাদ্যাভ্যাস কিংবা হিংস্রতা কোনোটাই ডাইনোসরের মতো নাও হতে পারে।

লন্ডনের ন্যাচারাল হিস্ট্রি মিউজিয়ামের মেরুদণ্ডী প্রাণীর জীবাশ্মবিদ সুসি মেইডমেন্ট বলেন, অ্যাম্বারের মধ্যে আমরা ডাইনোসর যুগের মশা বা মাছি পেতেই পারি। কিন্তু যখন অ্যাম্বারের মধ্যে কোনো কিছু আটকে যায় তখন সেটি শুধু ওই পোকার খোসা সংরক্ষণ করতে পারে। তার নরম টিস্যু সংরক্ষণ করতে পারে না। ফলে অ্যাম্বারের মধ্যে কোনো মশা বা মাছি পাওয়া গেলেও তা থেকে রক্ত পাওয়া সম্ভব নয়। আর রক্ত না পেলে ডিএনএ ও পাওয়া যাবে না, ডাইনোসরদের ফিরিয়ে আনা যাবে না।


ডাইনোসর; Image Source: enriquelopezgarre/Pixabay
যুক্তরাজ্যের ইউনিভার্সিটি অফ নর্দাম্পটনের প্রজননবিদ্যা বিশেষজ্ঞ জামাল নাসির ডাইনোসরদের ফিরিয়ে আনার ধারণা এবং সম্ভাবনাকে ইতিবাচকভাবেই দেখেন। তার মতে বিবর্তন কখনো স্থির নয় এবং এটি পরিকল্পনা মাফিকও ঘটে না। যেকোনো সময় যেকোনো কিছু ঘটতে পারে। বিবর্তন অনির্ধারিত এবং এটি যে সবসময় সামনের দিকে এগুবে এমনটিও নয়। এর একাধিক দিক থাকতে পারে। বিবর্তনের পেছনের দিকে হেটে ডাইনোসর সদৃশ কোনো প্রাণীতে ফিরিয়ে আনা সম্ভব।

তবে তিনি মনে করেন, ডাইনোসরদের ফিরিয়ে আনা গেলেও তাদের বাঁচিয়ে রাখার জন্য উপযুক্ত পরিবেশ নিয়ে ভাবতে হবে। এমন কোনো ভাইরাল মহামারি যদি আসে যেটি আমাদের জিনোম, শরীরবিদ্যা, আচরণকে ব্যাহত করবে এবং আমাদের নিয়ন্ত্রণের বাইরে চলে যাবে। সেক্ষেত্রে হয়তো ডাইনোসরদের ফিরিয়ে আনা এবং বাঁচিয়ে রাখার মতো পরিবেশ তৈরি হলে হতেও পারে।

 
তবে সুসি দ্বিমত প্রকাশ করে বলেন, বিশেষ অর্থে বিবর্তনের বিভিন্ন দিক নাও থাকতে পারে। আমাদের জানা মতে, একেবারে বিলুপ্ত হয়ে যাওয়া কোনো প্রাণী নতুন করে আর সামনে আসেনি। উদাহরণস্বরূপ: ইকথিয়াসোরাস ছিল সামুদ্রিক প্রাণী যার লম্বা বিন্দুযুক্ত নাক-মুখ এবং ডলফিনের মতো দেহ ও লেজ ছিল। আজকের দিনে ডলফিনও ইকথিয়াসোরাসের মতো একই পরিবেশে থাকে। তাই বলে ডলফিনকে আমরা ইকথিয়াসোরাস বলতে পারি না। কারণ ডলফিন এবং ইকথিয়াসোরাসের শারীরিক বৈশিষ্ট্য এক নয়।


পাখিদের আদি বংশধর ডইনোসর; Image Source: Davide Bonadonna
তিনি আরো বলেন, ডাইনোসররা এখনো আমাদের সাথেই আছে। ডাইনোসর বিলুপ্ত হয়েছে তবে সেটি উড়তে না পারা ডাইনোসর। পাখিরা হচ্ছে বিলুপ্ত না হওয়া ডাইনোসর। মাংশাসী ডাইনোসরদের থেকে বিবর্তিত হয়ে পাখিরা আজকের অবস্থানে এসেছে। তারা এখনো টিকে আছে। এমনকি নতুন প্রজাতির পাখিদেরও দেখতে পাচ্ছি। এই নতুন পাখিরা হচ্ছে নতুন প্রজাতির ডাইনোসর।

ডিএনএ থেকে ডাইনোসর জন্ম দেওয়া গেলেও ওই প্রাণীর বৃদ্ধির জন্য অনেক কিছুই করতে হবে। ধরে নিলাম যেকোনো ডিএনএ’র মাধ্যমে হোস্ট জীব থেকে ডাইনোসরের জন্ম দেওয়া সম্ভব হয়েছে। সেই ডাইনোসরটি হতে পারে অর্ধেক পাখি, অর্ধেক ডাইনোসর। কিংবা পুরোটাই যদি ডাইনোসর হয় তাহলে তাকে বাঁচিয়ে রাখাও অনেক বড় চ্যালেঞ্জ।

কারণ ৬৬ মিলিয়ন বছর আগের আবহাওয়া, পরিবেশ আর এখনকার আবহাওয়ার মধ্যে আকাশ-পাতাল তফাৎ। তখন ডাইনোসররা যা খেতো এখন তা প্রদান করা বেশ চ্যালেঞ্জের ব্যাপার। ফলে ক্লোন করে ডাইনোসর জন্ম দেওয়া গেলে তাকে বাঁচিয়ে রাখা সম্ভব নাও হতে পারে। যেমন: ২০০৯ সালে ক্লোনিংয়ের মাধ্যমে ‘Pyrenean ibex’ নামক বিলুপ্ত প্রজাতির একটি প্রাণীর জন্ম দেয়া সম্ভব হয়েছিল। কিন্তু মাত্র ৭ মিনিটের মাথায় প্রাণীটি মৃত্যুবরণ করে।

৬৬ মিলিয়ন বছর আগে ডাইনোসরের জিন এবং প্রোটিন ভিন্ন পরিবেশে টিকে ছিল। তখন বায়ুমণ্ডলে কার্বন ডাই-অক্সাইড, অক্সিজেনের মাত্রা ভিন্ন রকম ছিল। তাপমাত্রা ভিন্ন রকম ছিল। তার উপর প্রাণীটির হজমের এনজাইমগুলো আধুনিক প্রাণী বা উদ্ভিদের উপর কাজ করতে নাও পারে।



দৈত্যাকার প্রাণীগুলো এখন শুধুই অতীত; Image Source: David Mark/Pixabay

ডাইনোসরের প্রতিকৃতি দেখছেন দর্শনার্থীরা; Image Source: wyrk.com
সোয়াইটজার বলেন, আমাদের বিনোদনের জন্য যদি আমরা একটি ডাইনোসরকে ফিরিয়ে আনি তবে সেটি নিষ্ঠুর সিদ্ধান্ত হবে। জেনেটিক বৈচিত্র্যসহ একটি টেকসই ডাইনোসর কলোনি বানাতে হলে অন্তত পাঁচ হাজার ডাইনোসরকে ক্লোন করে জন্ম দিতে হবে। কিন্তু পাঁচ হাজার ডাইনোসর ক্লোন করা বেশ কষ্টসাধ্য ব্যাপার। আবার পাঁচ হাজার ডাইনোসর জন্ম দেওয়া গেলেও তাদের কোথায় রাখা হবে, কেমন পরিবেশে রাখা হবে তাও কিন্তু ভাবতে হবে।

এতসব সমস্যার আগে সবচেয়ে বড় সমস্যাটি হলো ডাইনোসরের ডিএনএ পাওয়া যেটির সন্ধান এখনো মেলেনি।

7
সিংহ কেন বনের রাজা?

Tasin Nur Rahim

https://roar.media/bangla/main/plants-animals/why-lion-is-called-the-king-of-the-jungle
সিংহই কেন বনের রাজা এ প্রশ্নের উত্তর খোঁজার আগে শ্রেষ্ঠত্বের মাপকাঠি নিয়ে কিছু বলা উচিত। ঠিক কোন বৈশিষ্ট্যের কারণে কোনো প্রাণীকে শ্রেষ্ঠত্বের আসনে বসানো হয়? প্রকৃতপক্ষে শ্রেষ্ঠত্বের মাপকাঠি প্রসঙ্গভেদে এবং ব্যক্তিভেদে ভিন্ন। তাই এই প্রশ্নের প্রেক্ষিতে ভিন্ন ভিন্ন মতামত পাওয়া যাবে। তো এখানে সম্ভাব্য সবগুলো উত্তর নিয়েই আমরা অগ্রসর হবো। উদঘাটন করব সিংহের বনের রাজা হবার পেছনের কারণ নিয়েও।

শ্রেষ্ঠত্বের মাপকাঠিতে অনেকে এগিয়ে রাখবেন বুদ্ধিমত্তাকে। উন্নত বুদ্ধিমত্তা নিঃসন্দেহে যেকোনো প্রাণীকে শ্রেষ্ঠত্বের দৌড়ে এগিয়ে রাখবে। কিন্তু সিংহ বনের সবচেয়ে বুদ্ধিমান প্রাণী নয়। শিম্পাঞ্জি, বানর, টিয়া, শেয়ালসহ জঙ্গলের অনেক প্রাণীই সিংহের চেয়ে বুদ্ধিমান। তাই বুদ্ধিমত্তাই যদি শ্রেষ্ঠত্বের মাপকাঠি হতো তাহলে নিশ্চিতভাবেই সিংহ রাজা হবার দৌড়ে পিছিয়ে পড়ত। মস্তিষ্কের আকার বিবেচনা করলে জঙ্গলের প্রাণীদের মধ্যে সবচেয়ে বড় মস্তিষ্ক হাতির, সিংহের নয়।


দৈহিক আকার অবশ্যই জঙ্গলের প্রাণীদের প্রভাব বিস্তারের জন্য অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ। কিন্তু জঙ্গলে তো সিংহের চেয়েও বিশালাকার প্রাণীর বাস রয়েছে। বিশালাকারের হাতিকে ছাড়িয়ে জঙ্গলের রাজা হওয়ার জন্য সিংহের দৈহিক আকারের বিশেষ কোনো অবদান নেই। তাছাড়া পুরুষ সিংহের ওজন যেখানে গড়ে ১৯০ কেজি, সেখানে একটি এশিয়ান হাতির ওজন গড়ে ৪,০০০ কেজি। আফ্রিকান হাতির গড় ওজন আরো বেশি। প্রায় ৬,০০০ কেজি। তাই দৈহিক আকার কিংবা ওজন কোনোটাই সিংহের শ্রেষ্ঠত্বের পক্ষে যুক্তি দিতে ব্যর্থ।


আফ্রিকান হাতি; Image: National Geographic
এবার আসা যাক শক্তিমত্তায়। সিংহ কি বনের সবচেয়ে শক্তিশালী প্রাণী? গণ্ডার, হাতি, গরিলা কিংবা বাঘ- এসব প্রাণী অবশ্যই সিংহের চেয়ে শক্তিশালী। একটি সিংহ যেখানে প্রতি বর্গ ইঞ্চিতে ৬৫০ পাউন্ডের কামড় বসাতে পারে, সেখানে একটি বাঘ বসাতে পারে প্রতি বর্গ ইঞ্চিতে ১,০৫০ পাউন্ড। বাঘ তার নিজের চেয়ে প্রায় ৫ গুণ বেশি ওজনের শিকার ধরতে পারে। অন্যদিকে সিংহ নিজের দৈহিক ওজনের দ্বিগুণ পরিমাণ পর্যন্ত শিকার ধরতে পারে।

পৃথিবীর সবচেয়ে বড় মহিষের প্রজাতি হলো গোর, যেটা ভারতীয় উপমহাদেশে পাওয়া যায়। একেকটি গোরের ওজন প্রায় এক হাজার কেজির কাছাকাছি হয়ে থাকে। এসব মহিষ রয়েল বেঙ্গল টাইগারের বেশ পছন্দের শিকার। তাই শক্তিমত্তা বিবেচনায় সিংহের চেয়ে বাঘ বেশি শক্তিশালী। তাই বাঘ কিছুটা এগিয়েই থাকবে।

বাঘ আর সিংহের মধ্যে লড়াইয়ের আয়োজনও করা হয়েছিল। উনিশ শতকের শুরুর দিকে ভারতের বারোদার রাজা বাঘ আর সিংহের ভেতর যুদ্ধ বাধিয়েছিলেন। এমনকি এই যুদ্ধে বাজিও ধরেছিলেন সিংহের পক্ষে ৩৭ হাজার রূপি। কিন্তু যুদ্ধে সিংহ হেরে যায়। ফলে বিশাল অংকের টাকা গচ্চা যায় রাজার।

বাঘ আর সিংহের কিছু তুলনামূলক তথ্য দেওয়া যাক। বাঘের পা সিংহ থেকে ছোট, তাই কম সেন্টার অফ গ্র্যাভিটির কারণে বাঘ নিচু হয়ে আক্রমণ প্রতিরোধ করতে পারে এবং ভারসাম্য ভালোভাবে বজায় রাখতে পারে। এছাড়াও লাফিয়ে বাঘ অনেক উঁচুতে আক্রমণ করতে পারে। কিন্তু সিংহ বাঘের মতো দুই পায়ে দাঁড়িয়ে আক্রমণে ততটা সক্ষম নয়। বাঘের মস্তিষ্কের আকারও সিংহের চেয়ে বড়। সিংহ থেকে প্রায় ১৬ শতাংশ বড়।

এবার মজার একটি তথ্য দিয়ে রাখি। সিংহকে বনের রাজা বলা হলেও সিংহ কিন্তু মোটেই বনে বাস করে না। আফ্রিকার সাহারা মরুভূমির সাভানা অঞ্চলে এদের বসবাস। সিংহ বলতে মূলত আফ্রিকান সিংহকেই বোঝানো হয়। তবে আফ্রিকার বাইরেও কিছু সিংহ দেখা যায়।



বাঘ তার শিকারের শরীরে কামড় বসাতে পারে প্রতি বর্গ ইঞ্চিতে ১,০৫০ পাউন্ড; Image: The Guardian
রাজা হওয়ার জন্য যে বিষয়টা সিংহকে সবচেয়ে এগিয়ে রেখেছে সেটা হলো তার চেহারা। আগে দর্শনধারী তারপর গুণবিচারী কথাটা এক্ষেত্রে একদম ফলে যায়। সিংহের কোমর পর্যন্ত বিস্তৃত কেশর যেন বারবার তার রাজকীয়তার জানান দেয়। নিঃসন্দেহে কোমর পর্যন্ত বিস্তৃত কেশরের কারণে জঙ্গলের যেকোনো প্রাণীর থেকে সিংহের চেহারা বেশি রাজকীয়। সেই সাথে সিংহের চলাফেরাতেও একটা রাজকীয় হালচাল আছে। সিংহের ভয়ডরহীন চাহনী ও চলাফেরা নিঃসন্দেহে একটি রাজকীয় বৈশিষ্ট্য। এছাড়াও এদের গর্জন জঙ্গলের অন্য যেকোনো প্রাণী থেকে এদের আলাদা করেছে। একেকটি সিংহের গর্জন প্রায় ৮ কিলোমিটার দূর থেকেও শোনা যায়। গর্জনের মাধ্যমে সিংহরা অন্যদেরকে নিজেদের সীমানার জানান দিয়ে থাকে। তাই রাজকীয় গর্জন কিংবা হুংকার সিংহের পশুরাজ হওয়ার পেছনে বেশ গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা রেখেছে।

তবে এগুলো ছাড়াও সিংহের রাজা হয়ে ওঠার পেছনে সবচেয়ে বড় অবদান এদের পরিবারতন্ত্রের। এরা অতিশয় সামাজিক একটি প্রাণী। অন্যান্য বিড়ালের প্রজাতি থেকে এরা বেশ আলাদা। এরা দলবেধে বসবাস করে। সিংহের একেকটি দলকে বলা হয় প্রাইড। একটি প্রাইডে প্রায় ৩০টির মতো সিংহ থাকে। যার ৩-৪টি পুরুষ সিংহ, ১০-১৫টি স্ত্রী সিংহ এবং বাকিসব সিংহ শাবক। একেকটা প্রাইডের আকার নির্ভর করে খাদ্য, পানি ও শিকারের যোগানের উপর। শিকার ও পানি বেশি হলে দলের আকার বড় হয়, কম হলে দলের আকারও ছোট রাখতে হয়।

একজন রাজার যেমন নির্দিষ্ট রাজ্য থাকে, তেমনই একটি প্রাইডেরও একটি নির্দিষ্ট এলাকা বা টেরিটোরি থাকে। এই টেরিটোরি প্রায় ১০০ বর্গ মাইল পর্যন্ত বিস্তৃত থাকে। প্রাইডের পুরুষ সিংহেরা এই টেরিটোরি রক্ষার কাজ করে থাকে। অন্য কোনো সিংহের দল যাতে তাদের সীমানায় ঢুকতে না পারে সেই কাজ করে থেকে পুরুষ সিংহেরা। পুরুষ সিংহ শাবককে একটি নির্দিষ্ট সময় পর তার বাবার এলাকা ত্যাগ করে একটি নতুন টেরিটোরিতে আক্রমণ চালিয়ে নিজের নতুন সীমানা প্রতিষ্ঠা করতে হয়।

সিংহের একটি দল বা প্রাইড ( source: wikimedia commons)
source: wikimedia commons
রাজা বাদশাহদের সাথে ভোগ-বিলাস ওতপ্রোতভাবে জড়িত। সিংহের প্রাইডেও এই বিষয়টি স্পষ্ট। সাধারণত দলের স্ত্রী সদস্যরাই শিকার ধরার কাজ করে থাকে। তবে শিকার স্ত্রীরা করলেও প্রথম অধিকার প্রাইডের নেতা পুরুষ সিংহের। তাই শিকারের পর প্রথমে পুরুষ সিংহ তার আহার শেষ করে, তারপর বাকি অংশ স্ত্রী সিংহরা নিজেদের মধ্যে ভাগ করে নেয়।

বাঘেদের মধ্যে এমন অসম বণ্টন নীতি দেখা যায় না। সাধারণত বাঘেরা দলবেধে শিকার করে না, এমনকি করলেও খাবারের ক্ষেত্রে সমান সমান অধিকার থাকে। তাই সিংহের পরিবারের এই প্রথা নিশ্চিতভাবে রাজতন্ত্রের কথাই সমর্থন করে।



প্রাচীনকাল থেকেই রাজকীয় প্রতীক হিসেবে সিংহের উপস্থিতি লক্ষ্যণীয়; source: Wikimedia commons
এই রাজকীয় পরিবারতন্ত্র জঙ্গলের অন্য কোনো প্রাণীর মধ্যে দেখা যায় না। একজন রাজার বেশভূষা ও পরিবারতন্ত্র সিংহের মধ্যেই প্রবলভাবে ফুটে উঠেছে বলেই হয়তো প্রাচীনকাল থেকেই রাজা-বাদশাহরা তাদের রাজকীয় পতাকায় সিংহের অবয়বের আধিক্য রেখেছেন। ভারতীয় উপমহাদেশের মতো এলাকায়, যেখানে সিংহের চেয়ে বাঘ সহজপ্রাপ্য ও জনপ্রিয়, সেখানেও রাজাদের রাজকীয় পতাকায় বাঘের চেয়ে সিংহের উপস্থিতিই বেশি লক্ষ্যণীয়। সেজন্যেই হয়তো প্রাচীনকাল থেকেই মানুষের মুখে মুখে 'বনের রাজা' হিসেবে চলে এসেছে সিংহের নাম!

শেষ করার আগে একটি বিষয়, 'দ্য লায়ন কিং' এর মুফাসা কিংবা সিমবার মতো সিংহদের মধ্যে কিন্তু কোনো রাজা নেই। একটি প্রাইডের সকল পুরুষ সিংহই সমান অধিকার ভোগ করে। নিজেদের মধ্যে রাজা-প্রজা জাতীয় কোনো শ্রেণীবিভাগ নেই এদের!

8
যে গাছেরা ছোঁয় না একে অপরকে
Uzzal Hossen

https://roar.media/bangla/main/plants-animals/crown-shyness
বিশেষ প্রজাতির এই গাছগুলোর শীর্ষ প্রতিবেশী গাছের শীর্ষকে স্পর্শ করতে চায় না। ফলে এক গাছ থেকে আরেক গাছের মধ্যে ফাঁকা স্থান তৈরি হয়। এভাবে একাধিক গাছের মধ্যকার ফাঁক দেখতে যেন অনেকটা পাজলের মতো দেখায়। এই শূন্যস্থানগুলো যেন ফাঁকা জায়গারই একটা নেটওয়ার্ক গড়ে তুলেছে। গাছদের মধ্যে এ ধরনের দূরত্ব বজায় রাখার বিষয়টিকে বিজ্ঞানীরা নাম দিয়েছেন 'ক্রাউন শাইনেস'।


বলে রাখা ভালো, সব গাছের ক্ষেত্রে ক্রাউন শাইনেস ঘটে না। আবার সব বনে ক্রাউন শাইনেসের দেখা নাও পাওয়া যেতে পারে। ব্ল্যাক ম্যানগ্রোভ (Avicennia germinans), পাইন গাছ (Pinus contorta), জাপানিজ লার্চ (Larix kaempferi), ইউক্যালিপ্টাসের কিছু প্রজাতি ছাড়াও আরো কিছু প্রজাতির মধ্যে ক্রাউন শাইনেস দেখা যায়। সাধারণত একই প্রজাতির একাধিক গাছের মধ্যে ক্রাউন শাইনেস দেখা গেলেও কিছু ক্ষেত্রে ভিন্ন ভিন্ন প্রজাতির গাছের মাঝেও এটি দেখা যায়। আবার একই গাছের একাধিক ডালের মধ্যেও এটি দেখা যেতে পারে।

 
এক গাছের সাথে আরেক গাছের এ ধরনের দূরত্ব বজায় রাখার দৃশ্য বিশ্বের বিভিন্ন জায়গাতেই দেখা যায়। কোস্টারিকার ম্যানগ্রোভ থেকে শুরু করে মালয়েশিয়ার কর্পূর গাছেও এ ধরনের দূরত্ব চোখে পড়ে।

যেভাবে আলোচনায় এলো
১৯৮২ সালের কথা। জীববিজ্ঞানী ফ্রান্সিস জ্যাক পাটজ দুপুরের তীব্র গরম থেকে বাঁচতে কোস্টারিকার গুয়ানাকাস্টে ন্যাশনাল পার্কের ব্ল্যাক ম্যানগ্রোভ ফরেস্টে হাঁটছিলেন। কয়েক ঘণ্টার ফিল্ডওয়ার্ক আর দুপুরের খাবার শেষে ভাতঘুমের কারণে তিনি সিদ্ধান্ত নিলেন, গাছের নিচে একটু ঘুমিয়ে নেবেন।


Image Source: sciencehalimah.blogspot.lt
ঘুমানোর সময় তিনি যখন উপরের দিকে তাকালেন, তখন খেয়াল করলেন, বাতাসের কারণে এক গাছের ডাল আরেক গাছের দিকে হেলে পড়লেও গাছগুলোর পাতা আরেক গাছের পাতার সাথে দূরত্ব বজায় রাখছে। যেন এক গাছ আরেক গাছের পাতাকে ছুঁতে আগ্রহী নয়।

চল্লিশ বছর আগে পাটজ যখন এ দৃশ্য দেখেছিলেন, তখন তিনি যুক্তি দিয়েছিলেন, যে গাছেরও ব্যক্তিগত জায়গার প্রয়োজন আছে। বর্তমান সময়ে এসে তার এই পর্যবেক্ষণের বৈজ্ঞানিক ভিত্তি খোঁজার জন্য অনেক বিজ্ঞানী কাজ করছেন। তবে ১৯২০ সাল থেকে বৈজ্ঞানিক সাহিত্যে ক্রাউন শাইনেসের কথা উঠে এসেছে অনেকবার।

ক্রাউন শাইনেসের কারণ
গাছদের মধ্যে এ শূন্যস্থান সৃষ্টি হওয়ার আসল কারণ এখনো বিজ্ঞানীরা উদঘাটন করতে পারেননি। একেক বিজ্ঞানী একেক ধরনের তত্ত্ব দিয়েছেন। তবে তাদের বেশিরভাগই স্বীকার করেছেন, ক্রাউন শাইনেসের পেছনে একক কোনো কারণ না থাকার সম্ভাবনাই বেশি। এর পেছনে একাধিক কারণ থাকতে পারে।


গাছেদের ক্রাউন শাইনেস; Image Source: 500.px
কিছু বিজ্ঞানী প্রথমদিকে অনুমান করেছিলেন যে, সালোকসংশ্লেষণের অন্যতম গুরুত্বপূর্ণ উপাদান আলোর অভাবের কারণে গাছগুলো তাদের মধ্যকার এই শূন্যস্থানগুলো পূরণ করতে পারে না।


 
জীববিজ্ঞানী এবং ট্রি ফাউন্ডেশনের পরিচালক মেগ লোম্যানের মতে, এ ধরনের ক্রাউন শাইনেস স্যোশাল ডিসট্যান্সিংয়ের বৃক্ষ-সংক্রান্ত সংস্করণও হতে পারে। তিনি বলেন, যে মুহুর্ত থেকে আপনি গাছগুলোর মধ্যে দূরত্ব বাড়াতে পারবেন, তখন থেকে আপনি গাছগুলোর উৎপাদনশীলতা বাড়াতে পারবেন। আইসোলেশনের (বিচ্ছিন্নতা) এটাই সৌন্দর্য। গাছগুলো আসলে তাদের নিজেদের স্বাস্থ্যরক্ষা করে চলেছে।

১৯৫৫ সালে উত্তর-পূর্ব অস্ট্রেলিয়ায় ইউক্যালিপ্টাসের এক জাতের গাছের ওপর এক গবেষণা করা হয়। এতে বলা হয়, এখানে প্রচণ্ড বাতাসের কারণে এক গাছ আরেক গাছের সাথে ধাক্কা খায়। এতে গাছগুলোর শীর্ষের পাতা এবং ডাল ভেঙে যায় এবং এক গাছের সাথে আরেক গাছের মধ্যে জায়গা তৈরি হয়।


Image Source: flickr.com
১৯৮৪ সালে এসে পাটজ এবং তার দল তাদের প্রকাশিত গবেষণায় দেখান যে, কিছুক্ষেত্রে বায়ুর প্রভাবে গাছের মধ্যে যে দোলা লাগে, তার কারণে ক্রাউন শাইনেস তৈরি হতে পারে। তাদের গবেষণামতে, যত বেশি বাতাস ম্যানগ্রোভে প্রবাহিত হচ্ছিল, গাছগুলোর শীর্ষের মধ্যে দূরত্বও তত বাড়ছিলে।

পাটজের দুই দশক পরে এসে মিশিগান প্রযুক্তি বিশ্ববিদ্যালয়ের জীববিজ্ঞানী মার্ক রুদনিকির নেতৃত্বে একটি দল কানাডার আলবার্তায় বাতাসের প্রভাবে পাইন গাছের ধাক্কা দেওয়ার বল পরিমাপ করেন। তারা দেখতে পান, যেসব বনে বাতাস বেশি এবং সমান উচ্চতার লম্বা গাছ বেশি, সেসব বনে ক্রাউন শাইনেস বেশি ঘটে। কিন্তু প্রতিবেশী পাইন গাছের সাথে ধাক্কা এড়াতে রুদনিকি ও তার দল যখন নাইলনের দড়ি ব্যবহার করে দেখলেন, গাছগুলোর পাতা তাদের মধ্যকার শূন্যস্থান পূরণ করে ফেলছে। তখন আর ক্রাউন শাইনেস থাকছে না।

রুদনিকির মতে, কিছু গাছ শিখে নিয়েছে যে, আগায় গিয়ে আর নিজেদের শরীর (ডালপালা, পাতা) বৃদ্ধি করা যাবে না। এ বিষয়ে মিশিগান বিশ্ববিদ্যালয়ের বাস্তুবিদ্যা-বিশেষজ্ঞ ইনেস ইব্যানেজ বলেন, গাছগুলো তাদের বৃদ্ধি একটা পর্যায়ে গিয়ে থামিয়ে দেয়, যাতে গাছের ডাল ভেঙে না পড়ে। গাছেদের ক্ষেত্রে নতুন টিস্যু উৎপাদন করা বেশ কষ্টসাধ্য। এটা অনেকটা এরকম যে, গাছগুলো নিজেরাই বুঝে নেয়- আর বৃদ্ধি পাওয়ার দরকার নেই, বেশি বৃদ্ধি পেলে নিজেরই ক্ষতি হতে পারে।

 
ইয়েল বিশ্ববিদ্যালয়ের ফরেস্টার এবং উদ্যানতত্ত্ববিদ মারলিইজি ডুগেড বলেন, অনেক গাছই নিজেদের বৃদ্ধির বিষয়ে এ ধরনের বিচক্ষণতা আরো এক ধাপ এগিয়ে নিতে পারে। এজন্য গাছগুলো আশেপাশের গাছপালা হতে উদ্ভূত রাসায়নিক পদার্থ শনাক্ত করতে একটি বিশেষ সংবেদক সিস্টেম ব্যবহার করে। বৃক্ষের এ ধরনের রাসায়নিক যোগাযোগ বেশ জটিল এবং অল্প মাত্রায় ঘটে। কিন্তু এক গাছ যদি আরেক গাছকে বুঝতে পারে, তবে একে অন্যকে স্পর্শ করার পরিস্থিতি তৈরি হওয়ার আগেই তারা নিজেদের শীর্ষের ডাল এবং পাতার বৃদ্ধি বন্ধ করে দিতে পারে।


Image Source: demilked.com
ক্রাউন শাইনেসের পেছনে গাছের নিজস্ব সুবিধার বিষয়টি জড়িত বলে মনে করেন লোম্যান। তিনি বলেন, গাছের অন্যতম একটি অঙ্গ হচ্ছে তার পাতা। গাছ চায়, যেকোনো মূল্যে তার পাতাকে রক্ষা করতে। যদি বাতাসের কারণে এর কোনো একটি ডাল আঘাতপ্রাপ্ত হয়, তাহলে তা গাছটির জন্য মারাত্মক ক্ষতিকর। এজন্যও গাছেরা দূরত্ব বজায় রেখে বসবাসের চেষ্টা করে।

মিগেল ফ্র্যাংকোর একটি তত্ত্বে বলা হয়েছে, প্রতিটি গাছ তার প্রতিবেশীদের এমন একটি প্যাটার্নে বা ছাঁচে যেতে বাধ্য করে, যা সম্পদ সংগ্রহকে সর্বাধিক করে তোলে এবং ক্ষতিকারক প্রতিযোগিতা হ্রাস করে। বাস্তুসংস্থান সংক্রান্ত মিথস্ক্রিয়া বেশ জটিল বিষয়। ফলে ক্রাউন শাইনেসের পেছনে একাধিক কারণ থাকতে পারে।

সুবিধা
মেগ লোম্যান মনে করেন, নিজেদের সুবিধার জন্যই এই বিশেষ গাছগুলো নিজেদের মধ্যে দূরত্ব বজায় রাখে। বেঁচে থাকার উপাদান যেমন- পরিপোষক পদার্থ, পানি, জায়গা এবং আলো সংগ্রহের জন্য গাছকেও অন্যান্য গাছ এবং প্রাণীর সাথে প্রতিযোগিতা করতে হয়। ঘন বনাঞ্চলে আলোর জন্য উদ্ভিদের মধ্যে তীব্র প্রতিযোগিতা চলে। ক্রাউন শাইনেসের এই শূন্যস্থানগুলো গাছগুলোকে সঠিক আলো পেতে এবং সালোকসংশ্লেষণ প্রক্রিয়া নিজের অনুকূলে রাখতে সাহায্য করে।


সৃষ্ট শূন্যস্থানের কারণে সূর্যের আলো বনের মাটিতে পৌঁছাতে পারে। ফলে নিচে অবস্থানকারী ছোট উদ্ভিদ এবং প্রাণীর জীবনধারণ সহজ হয়, যা ঘুরেফিরে পরোক্ষভাবে ওই বড় গাছের জীবনধারণেই সাহায্য করে।

9
ইসলামের ইতিহাস: সংক্ষিপ্ত পরিসরে চৌদ্দশ বছরের গৌরবময় যাত্রাকাহিনী

Muhaiminul Islam Antik
ইতিহাস হলো জ্ঞানের এমনই এক শাখা যা মানুষকে তার শেকড় সম্পর্কে জানতে সাহায্য করে, শেকড়ের সাথে বন্ধন মজবুত করে তার মস্তিষ্করূপী বৃক্ষে দরকারি পুষ্টিদ্রব্যের সরবরাহ নিশ্চিত করে, এবং সবশেষে ইতিহাস থেকে অর্জিত শিক্ষা মানুষকে বলে দেয় তার কোন পথে যাওয়া উচিত, আর কোন পথ ভুলেও মাড়ানো উচিত নয়।

মাসখানেক আগে অনলাইন সার্ফিংয়ের সময় নজরে আসে আরবের বিখ্যাত আলেম ড. মুহাম্মাদ ইবরাহীম আশ-শারিকি রচিত ‘ইসলামের ইতিহাস – নববী যুগ থেকে বর্তমান’ বইটি। মূল বইয়ের নাম ‘আততারিখুল ইসলাম’ অর্থাৎ ইসলামের ইতিহাস। সেখান থেকেই বাংলা ভাষায় রূপান্তর করেছেন বিশিষ্ট অনুবাদক কাজী আবুল কালাম সিদ্দীক, সম্পাদনায় ছিলেন শাইখ মীযান হারুন।



'ইসলামের ইতিহাস – নববী যুগ থেকে বর্তমান' বইটির প্রচ্ছদ; Background: Wallpaper Cave; প্রচ্ছদের ছবি: মুহাইমিনুল ইসলাম অন্তিক
বইয়ের নামের নিচে সাবটাইটেল অংশটিই বলে দিচ্ছে এর আলোচনার পরিধি। মোট পৃষ্ঠা সংখ্যা (৩৫২) এটাও জানান দেয় যে, এখানে কোনো কিছু নিয়েই আলোচনার গভীরে যাওয়া হয়নি, তবে সংক্ষেপে সম্ভাব্য ও গুরুত্বপূর্ণ সবকিছুকেই স্পর্শ করা হয়েছে। পাশাপাশি আবুল ফাতাহ মুন্নাহর চমৎকার প্রচ্ছদ ডিজাইন, যেখানে গোল্ডেন এজ অভ ইসলাম তথা ইসলামের স্বর্ণালী যুগের আবহ ফুটিয়ে তুলতে তার চেষ্টার কোনো কমতি ছিল না, এই বইটি কেনার সিদ্ধান্ত ত্বরান্বিত করতে গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা রাখে।

 
বইটি খোলার পর ভিন্নভাবে সজ্জিত ১৭ পৃষ্ঠার সূচিপত্র পাঠককে অসাধারণ এক যাত্রার হাতছানিই দেবে, যার শুরুটা হয়েছে ‘ইতিহাসশাস্ত্রের ইতিকথা’ অধ্যায়ের মাধ্যমে। এই অংশে ইতিহাস বলতে কী বোঝায়, এর আলোচনার পরিধি, এই শাস্ত্র পাঠের উপকারিতা, লক্ষ্য ও উদ্দেশ্য যেমন আলোচিত হয়েছে, তেমনই গুরুত্বপূর্ণ নানা বিষয়ে জ্ঞানী ব্যক্তিদের মতামত ইতিহাস সম্পর্কে আগ্রহী যে কাউকে অধিকতর আগ্রহী করে তুলবে। উদাহরণ হিসেবে ‘তারিখুল ইয়ামান’ গ্রন্থের ভূমিকায় খাযরাজির বক্তব্যের একটি অংশ উল্লেখ করা যায় যেখানে তিনি লিখেছেন,

যে ব্যক্তি পূর্ববর্তীদের ইতিহাস সম্পর্কে জ্ঞান লাভ করে, সে যেন সুপ্রাচীনকাল থেকেই বেঁচে আছে। আর যে পরবর্তী প্রজন্মের জন্য প্রশংসনীয় কিছু রেখে যায়, সে যেন পৃথিবীর শেষ লগ্ন পর্যন্ত বেঁচে থাকার সুখানুভূতি লাভ করে।

একই অধ্যায়ে আলোচিত ইতিহাসশাস্ত্রের নীতিমালা, ইসলামী ইতিহাস বিষয়ক প্রসিদ্ধ বইগুলোর নামের তালিকা একজন পাঠককে জ্ঞানের এক মহাসাগরের দিকেই হাতছানি দিয়ে ডাকবে, যার চর্চার ক্ষেত্র আসলে তৈরি করে দিচ্ছে এই বই।

এরপর বইটিতে একে একে এসেছে:

ইসলাম-পূর্ব সময়ে আরব সমাজের অবস্থা;
হযরত মুহাম্মাদ (সা.) এর আগমনের মধ্য দিয়ে আরব-ভূমিতে ইসলামের অভ্যুদয়;
এই মহামানবের ওফাতের পর খোলাফায়ে রাশেদীনের দক্ষ নেতৃত্ব ও পরিচালনায় বিশ্বের বুকে মুসলিম সভ্যতার অবস্থান সুদৃঢ়করণ ও সম্প্রসারণ;
উমাইয়া ও আব্বাসী খেলাফতের উত্থান-পতনের প্রেক্ষাপট, সাম্রাজ্য বিস্তার সংক্রান্ত আলোচনাসহ তাদের উন্নয়নমূলক কর্মকাণ্ডের সংক্ষিপ্ত আলোচনা;
ফাতিমি, হামদানি, আইয়ুবি, ওসমানী, মোঘল সাম্রাজ্যসহ ইসলামের ইতিহাসের কথা বলতে গেলে যে সাম্রাজ্যগুলোর নাম অবধারিতভাবেই উঠে আসবে সেসব সম্পর্কে নাতিদীর্ঘ আলোচনা;
মঙ্গোলদের বর্বরতায় ছিন্নভিন্ন মুসলিম বিশ্ব এবং ধ্বংসস্তূপ থেকে আবার মাথা তুলে দাঁড়িয়ে সেই মুসলিমদের হাতে সেই মঙ্গোলদেরই গুঁড়িয়ে দেবার দুঃখ-গৌরবের মিশ্র ইতিহাস;
ক্রুসেড কেন শুরু হলো, কীভাবে ধীরে ধীরে বিস্তৃতি লাভ করল, সেই সময়কার মুসলিম ও খ্রিস্টান শাসকবর্গ এই সংঘাত সম্পর্কে কেমন দৃষ্টিভঙ্গি পোষণ করতেন, এবং প্রতিটি ক্রুসেডের ফলাফল সংক্ষেপে আলোচনা;
সর্বশেষে আরব দেশগুলোর বর্তমান অবস্থা, সৌদি আরবের সংক্ষিপ্ত ইতিহাস, মুসলিম বিশ্বের বর্তমান অবস্থা প্রভৃতি।
উপরে মোট আটটি পয়েন্ট ধরে সংক্ষেপে বইটির আলোচ্য বিষয়গুলোর কথা বলা হলেও একজন পাঠক, যিনি কিনা ইসলামের ইতিহাস সম্পর্কে পড়াশোনা শুরু করতে চাচ্ছেন কিংবা পড়াশোনা শুরু করলেও একেবারেই শৈশবকাল পার করছেন, তার জন্য বইটি নিঃসন্দেহে চমৎকার এক সূচনাপর্ব হতে পারে; হতে পারে এমন এক ভিত্তিপ্রস্তর, অধ্যবসায়ের বলে যার উপর গড়ে উঠতে পারে ইসলামী ইতিহাস বিষয়ক জ্ঞানের সুউচ্চ ভবন।


কাবা; Image Source: Adli Wahid/Wikimedia Commons
মূল বইটির কাজ ১৩৮৯ হিজরি মোতাবেক ১৯৬৯ সালেই সমাপ্ত হয়েছিল। ওদিকে বাংলায় অনূদিত বইটি পাঠকদের হাতে এসেছে ২০২০ সালের জানুয়ারি মাসে। বইটির ভাষা যেন পাঠকদের জন্য সর্বোচ্চ পর্যায়ের সহজবোধ্য হয়, এখানে সংক্ষিপ্ত পরিসরে উল্লেখিত ইতিহাসের অজস্র তথ্য যেন পাঠকের বিরক্তি ও একঘেয়েমির কারণ না হয়ে ওঠে, সেজন্য অনুবাদক ও সম্পাদকের চেষ্টার কোনো কমতি ছিল না। বইটির নানা জায়গায় তাদের দুজনের আলাদাভাবে সংযোজিত সুবিশাল টীকা, যা কখনও মূল লেখকের বক্তব্যকে বাংলা ভাষাভাষী পাঠকদের কাছে আরও স্পষ্ট করার জন্য, কখনও আবার তার আলোচনায় না আসা বিষয়কে তুলে আনার জন্য, তাদের এই কঠিন পরিশ্রমেরই স্বাক্ষর বহন করে।


 
পাশাপাশি বইটির পুনঃনিরীক্ষণে ছিলেন ইসলামী ইতিহাস বিষয়ক জনপ্রিয় লেখক ইমরান রাইহান, যিনি ইতোমধ্যেই মৌলিক গ্রন্থ সুলতান আলপ আরসালান ও আব্বাসি খিলাফাহ, এবং সংক্ষিপ্ত অনুবাদ-গ্রন্থ সুলতান জালালুদ্দিন খাওয়ারিজম শাহ-এর মতো তিনটি বই দিয়ে ইতিহাসপ্রেমী পাঠকদের মনে খুব চমৎকার এক আস্থার স্থান তৈরি করে নিয়েছেন।

বইটির পাঠ-পর্যালোচনা করতে গিয়ে এতক্ষণ ধরে এর ইতিবাচক দিকগুলো নিয়েই বলা হলো কেবল, এবার আসা যাক উন্নতির দিক সংক্রান্ত আলোচনায়। নেতিবাচক দিক বলছি না এ কারণেই যে মানুষ নিজে এবং তার হাত ধরে আসা কোনোকিছুই কখনও শতভাগ নিখুঁত থাকেনি, বরং সময়ে সময়ে নানাজনের ‘উন্নতির দিক’ সংক্রান্ত পরামর্শই তাকে এবং তার সৃষ্টিকে পারফেকশন তথা পরিপূর্ণতার দিকে নিয়ে যায়।

১) বইটিতে নামসংক্রান্ত বিভ্রান্তিতে পড়তে হয়েছে মাঝে মাঝেই। এর মূল কারণ আরবের অধিবাসীদের নামগুলোর বিশালাকৃতি। কখনও নামের এক অংশ, আরেক জায়গায় নামের অন্য অংশ- এমন করার ফলে মাঝে মাঝেই বুঝতে অসুবিধা হয়েছে যে আসলে কার কথা বলা হচ্ছে। ফলে বেশ কয়েকবারই পেছনে গিয়ে খুঁজে খুঁজে যোগসূত্র বের করে আবার সামনে এগোতে হয়েছে, যা ইসলামের ইতিহাস বিষয়ক নবীন পাঠকদের জন্য কষ্টসাধ্য কাজ। না, নাম খুঁজে আনাটা না, বরং একই ব্যক্তির নামের বিভিন্ন অংশের ব্যবহার। হয়তো মূল লেখকই এমনটা রেখেছেন, তবে অনুবাদক-সম্পাদকের প্রতি অনুরোধ থাকবে এই সহজীকরণের দিকে নজর দিতে, একই নাম ব্যবহার করতে।

২) একই ব্যক্তির একই নামের দু’রকম উল্লেখের বিষয়টিও নজরে এসেছে। যেমন- বাইজান্টাইন সম্রাট নিকিফোরাসের নাম একবার ‘নিকিফোরাস’ (পৃষ্ঠা: ১৮৪) ও পরের পৃষ্ঠাতেই ‘নাইসিফোরাস’ হিসেবে এসেছে। একই বিষয় দেখা গিয়েছে তুর্কি সেনাপতি আফশিন/আশফিনের বেলাতেও, যাকে ‘আফশিন’ (পৃষ্ঠা: ২০৮-০৯) ও ‘আশফিন’ (পৃষ্ঠা: ২০৯) উভয় নামেই সম্বোধন করা হয়েছে। এই ভুলগুলো কম্পিউটারে টাইপ করার সময়ের ভুল হবার সম্ভাবনাই বেশি। ফলে এগুলো খুব সহজেই সংশোধনযোগ্য।

৩) সাল অর্থাৎ কোনো একটি ঘটনা সংঘটনের সময় সংক্রান্ত কিছু জায়গাতেও খটকা লেগেছে। উদাহরণস্বরুপ দুটো দিকের কথাই বলা যাক।


 
ক) ‘উসমানি সাম্রাজ্য’ অধ্যায়ের ‘মাগরিবে আরবী নিয়ন্ত্রণ’ (পৃষ্ঠা: ৩১১) অংশে দুটো স্থানে ১৯০০ এর পরবর্তী সালের কথা উল্লেখ আছে, যা সম্ভবত ভুলক্রমে লেখা হয়েছে। যেমন- এই অংশে উল্লেখ করা সিনান পাশার জীবদ্দশা ১৫০৬ থেকে ১৫৯৬ সাল পর্যন্ত বিস্তৃত হলেও তার তিউনিশিয়া জয়ের সময় হিসেবে ১৯৭৪ এর কথা লেখা আছে। যদি আমি ইন্টারনেট থেকে ভুল সিনান পাশাকে বেছে না নিয়ে থাকি, তাহলে এখানে সাল সংক্রান্ত একটি ভুল হয়েছে।

খ) একই রকমের একটি বিচ্যুতি দেখা গিয়েছে ‘আরব দেশগুলোর পরিস্থিতি’ অধ্যায়ের ‘জামাল উদ্দিন আফগানি’কে নিয়ে আলোচনাতেও। তার জীবদ্দশা ১৮৩৯ থেকে ১৮৯৭ সাল পর্যন্ত বিস্তৃতি হলেও তাকে মিশর থেকে বিতাড়নের সাল হিসেবে ১৭৮৯ লেখা (পৃষ্ঠা: ৩২০) রয়েছে।

৪) হতাশ হয়েছি মূল লেখকের বইয়ে মোঘল সাম্রাজ্য নিয়ে মাত্র একটি পৃষ্ঠা বরাদ্দ থাকায়, যেখানে এই সাম্রাজ্যের তিন শতাধিক বছরের ঘটনাবলীও বইটির সংক্ষিপ্ত আলোচনার নীতিতে অন্তত কয়েক পৃষ্ঠা আলোচনার দাবিদার।

৫) যে লেখক এত চমৎকার একটি বই লিখতে পারেন, তার সম্পর্কে জানবার আগ্রহ হবে যেকোনো পাঠকেরই। দুর্ভাগ্যবশত, বইয়ের পেছনে ‘আরবের বিখ্যাত আলিম’ শব্দত্রয় ছাড়া ড. মুহাম্মাদ ইবরাহীম আশ-শারিকি সম্পর্কে পুরো বইয়ে জানবার আর কোনো উপায়ই নেই। তাই লেখক পরিচিত যুক্ত হওয়াটা নিঃসন্দেহে অনুসন্ধানী পাঠকদের মনকে শান্ত করবে; এই লেখক সম্পর্কে, তার কর্মপরিধি সম্পর্কে আরও জানার সুযোগ করে দেবে।

৬) পুরো বইয়ের হিসেবে বলতে গেলে বিভিন্ন অংশেই ছোটখাট বানান ভুল নজরে এসেছে। এই দিকটিও অবশ্যই উন্নতির দাবিদার।


 
উন্নতির দিক সংক্রান্ত এই পরামর্শগুলো প্রথম সংস্করণ (প্রকাশকাল: আগস্ট ২০২০) এর ভিত্তিতে দেয়া। বইটির সাথে যুক্ত দায়িত্ববান সকলের প্রতিই বিনীত অনুরোধ থাকবে এই দিকগুলো নিয়ে যত্নসহকারে কাজ করার, যা চমৎকার এই বইয়ের মানোন্নয়ন ও একে আরও আকর্ষণীয় করতে গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা রাখবে।

বইয়ের উন্নতির দিক নিয়ে যে পরামর্শগুলো দেয়া হলো, একজন পাঠক হিসেবে সেগুলোকে অতিরিক্ত আমল দিয়ে বইটি সংগ্রহের চিন্তা থেকে আবার সরে আসবেন না যেন! কারণ এগুলো বইয়ের মূল আবেদন, মূল বক্তব্যে তেমন একটা প্রভাব ফেলতে পারেনি বলেই আমার অভিমত। বরং এগুলো দেয়া হলো যেন এর ‘গুড’ থেকে ‘বেটার’ এর পথে যাত্রাটা আরও সহজ হয়।


অটোম্যান তথা ওসমানী সাম্রাজ্যের মানচিত্র (১৬৮৩ খ্রিস্টাব্দ); Image source: Wikimedia Commons
বইয়ের একেবারে শেষে সংযুক্ত চাররঙা মানচিত্রগুলোর কথা যদি না বলা হয়, তাহলে নিঃসন্দেহে বইটি ও এর পেছনে জড়িত ব্যক্তিবর্গের প্রতি অবিচার করা হবে। চমৎকারভাবে এখানে মানচিত্রের মাধ্যমে নিম্নোক্ত বিষয়গুলো ফুটিয়ে তোলা হয়েছে:

উমাইয়া খেলাফতের সময়কার খেলাফতের বিস্তার
আব্বাসী খেলাফতের বিস্তার
সেলজুক ও ফাতিমি সাম্রাজ্য
উসমানী সাম্রাজ্যের উত্থান
উসমানী সাম্রাজ্যের পতন
বিশেষত শেষ দুটো মানচিত্রে উসমানী সাম্রাজ্যের উত্থান ও পতনের রঙিন মানচিত্রটি একবুক দীর্ঘশ্বাসই কেবল নিয়ে আসে…

10
Heritage/Culture / Re: Bengali - History and Cultural Relations
« on: November 21, 2020, 12:38:34 PM »
nice

11
Heritage/Culture / ইলিশনামা
« on: November 21, 2020, 12:37:53 PM »
ইলিশনামা

Arafat Hossain
বাঙালির কাছে অতি পছন্দের মাছের কথা জিজ্ঞেস করলে ইলিশের কথা আসবেই। বিশ্বের ৮৬% ইলিশ এককভাবে বাংলাদেশে উৎপাদিত হয়। সেই হিসেব ইলিশের একচ্ছত্র অধিকার বাংলাদেশের দখলে। ধোঁয়া ওঠা ভাতের সাথে ইলিশ পছন্দ করে না, এমন বাঙালি সম্ভবত পাওয়া যাবে না।

শব্দে জব্দ ইলিশ
উৎপত্তিগতভাবে 'ইলিশ' শব্দটি সংস্কৃত ভাষা থেকে এসেছে। সংস্কৃতে বলা হয় 'ইলীশ'। ইল+ঈশ- এই হলো সন্ধি-বিচ্ছেদ। 'ইল' মানে জলের মধ্যে, আর 'ঈশ' মানে রাজা। তাহলে 'ইলীশ' মানে দাঁড়ায় 'জলের রাজা'। যদিও ইলিশ শব্দটি এখন ইলিশ হিসেবে লেখা হয়। ইলিশ যে জলের রাজা তা যেকোনো রসনাবিলাসী বাঙালি স্বীকার করবেই, তবে অবাঙালিদের কথা ভিন্ন!



ইলিশের বসতবাড়ি
বঙ্গোপসাগর ও আরব সাগর এবং তৎসংলগ্ন নদ-নদীতে ইলিশের দেখা পাওয়া যায়। সেই হিসেবে বাংলাদেশ, ভারত, মায়ানমার, পাকিস্তান, ইরান, থাইল্যান্ড এসব দেশে ইলিশের চারণভূমি। বাংলাদেশের পদ্মার ইলিশের খ্যাতি তো জগৎজোড়া। বিশ্বের সিংহভাগ ইলিশের যোগানদার বাংলাদেশ। সেই মোতাবেক বলা যায় ইলিশ বাংলাদেশেরই ভূমিপুত্র। আন্তর্জাতিক মেধাস্বত্ব কর্তৃপক্ষের দেয়া ইলিশের জিআই (Geographical Indication) স্বীকৃতিও বাংলাদেশের দখলে।

 
শ্রেষ্ঠ ইলিশ
বিনা তর্কে বলা যায়, পদ্মার ইলিশই শ্রেষ্ঠ, কিন্তু কীভাবে এই শ্রেষ্ঠত্ব এলো সেদিকে এখন চোখ ফেরানো যাক। ইলিশ মূলত সাগরের মাছ। নোনা জলে ডিম নষ্ট হয়ে যায় বিধায় ডিম ছাড়তে ইলিশকে নদীর মোহনায় আসতে হয়।

এ সময় ইলিশকে দীর্ঘ পথ পাড়ি দিতে হয়। ইলিশের বেগ ঘন্টায় প্রায় ৬০ কি.মি.। নদীমুখী ইলিশ স্রোতের বিপরীতে চলে। নদীতে জমে থাকা শ্যাওলা খেয়ে বাঁচে। ইলিশের খাদ্যের জন্য উৎকৃষ্ট শ্যাওলা পদ্মার মোহনাতে পাওয়া যায়। এই শ্যাওলা ইলিশের পেটে চর্বি হিসেবে জমা হয়, যা ইলিশের স্বাদ বাড়িয়ে দেয় কয়েকগুণ। ডিম ছাড়ার আগপর্যন্ত ইলিশের স্বাদ বেশি থাকে। পেটে ডিম হলে স্বাদ কিছুটা কমে যায়, আর ডিম ছাড়লে আরো কমে।

বিশেষজ্ঞদের মতে, সাগরের চেয়ে নদীর ইলিশ সুস্বাদু। তবে সাগরের ইলিশও ফেলনা নেয়। মূলত একেক রকম ইলিশ একেক স্বাদের। আর যেকোনো রসনাবিলাসীর কাছে পদ্মার ইলিশই যে শ্রেষ্ঠ, এতে কোনো সন্দেহ নেই।

বিলিশ কথা
ডিম ছাড়ার উদ্দেশ্যে ইলিশ যখন সাগর ছেড়ে নদীতে আসে, তখন কিছু ইলিশ পথ ভুলে বা বন্যায় খালে-বিলে ঢুকে পড়ে। খাল-বিলের পানিতে ইলিশের স্বাদ কয়েকগুণ কমে যায়। এসব ইলিশকে বলা হয় বিলিশ। তবে বিলিশ সচরাচর পাওয়া যায় না।

ইলিশের খাদ্যগুণ
প্রতি ১০০ গ্রাম ইলিশে ফ্যাট আছে ১৯.৪ গ্রাম, প্রোটিন ২১.৮ গ্রাম, শর্করা ২.৯ গ্রাম, মিনারেল ২.২ গ্রাম, ক্যালসিয়াম ১৮০ মিলিগ্রাম, পটাশিয়াম ২৮০ মিলিগ্রাম, আয়রন ২ মিলিগ্রাম, এবং ২৭৩ ক্যালরি এনার্জি আছে। ইলিশ মাছে আছে ওমেগা ৩ ফ্যাট, যা হার্টের রোগ ও ক্যান্সার নিরাময়ে ভূমিকা রাখে। তবে অতিরিক্ত কোনো কিছুই স্বাস্থ্যকর নয়, যা ইলিশের ক্ষেত্রেও প্রযোজ্য।



সাহিত্য সংস্কৃতির ইলিশ
বাংলাদেশে পয়লা বৈশাখ আর পান্তা ইলিশ একরকম সমার্থক হয়ে গেছে। সত্যিকারার্থে চৈত্র, বৈশাখ মাস ইলিশ ধরা বা খাওয়ার সময় নয়। ইলিশ ধরার সেরা সময় ভাদ্র মাসের অমাবস্যা ও পূর্ণিমা।

মধ্যযুগের শ্রেষ্ঠ কবি ভারতচন্দ্র রায়গুণাকারের অন্নদামঙ্গলকাব্যের একটি কবিতায় একত্রিশটি মাছের নাম আছে, তার মধ্যে সর্বশেষটি ইলিশ।

বিজয়গুপ্তের মনসামঙ্গল কাব্যে ইলিশ রান্নার উপায় বর্ণনা করা হয়েছে এভাবে...

আনিয়া ইলিশ মৎস
করিল ফালা ফালা
তাহা দিয়া রান্ধো ব্যঞ্জণ
দক্ষিণ সাগর কলা।

বুদ্ধদেব বসু তার 'ইলিশ' কবিতায় ইলিশকে 'জলের উজ্জ্বল শস্য' হিসেবে বর্ণনা করেছেন। ইলিশ নিয়ে আছে গোপাল ভাড়ের গল্প। রাজা কৃষ্ণচন্দ্র গোপালকে বাজার থেকে ইলিশ কিনে সবাইকে দেখিয়ে দরবারে আসতে বলেন, যদি কেউ দাম না জিজ্ঞেস করে তবে গোপাল পুরস্কৃত হবে। বুদ্ধিমান গোপাল ইলিশ মাছ হাতে ধরে, ধুতিটা উল্টো করে পরে দরবারে এলো। লোকজন দাম না জিজ্ঞেস করে বলতে লাগল, পাগলের আবার ইলিশ খাওয়ার শখ হলো!

সৈয়দ মুজতবা আলীর ইলিশপ্রীতির কথা না বললেই নয়। একবার এক পাঞ্জাবি অধ্যাপকের সাথে তার তর্ক বাঁধে কোন খাবার শ্রেষ্ঠ তা নিয়ে। আলী সাহেবের মতে শ্রেষ্ঠ খাবার হলো সরু চালের ভাতের সাথে পদ্মার ইলিশ। অন্যদিকে পাঞ্জাবি অধ্যপক বলেন, বিরিয়ানি। রাগ করে তিনি অধ্যাপকের সাথে সাতদিন কথা বলা বন্ধ করে দেন। একেই বলে সত্যিকারের ইলিশরসিক!

ইলিশ নিয়ে গ্রামবাংলায় ছড়িয়ে আছে অসংখ্য ছড়া, কবিতা, শ্লোক, প্রবাদ, কথকতা, উপকথা। ১৯৭০ সালের নির্বাচনে তৎকালীন পূর্ববাংলায় একটি ছড়া বেশ জনপ্রিয় হয়েছিল, "ইলিশ মাছের তিরিশ কাঁটা, বোয়াল মাছের দাড়ি/ ইয়াহিয়া খান ভিক্ষা করে/ শেখ মুজিবের বাড়ি।"

 
অর্থনীতিতে ইলিশ
দৈনিক বণিক বার্তা জানাচ্ছে, ২০০৭-০৮ অর্থবছরে বাংলাদেশে ইলিশ উৎপাদনের পরিমাণ ছিল ২.৯০ লাখ টন। এর এক দশক পর ২০১৮-১৯ অর্থবছরে জাতীয় মাছটির উৎপাদন বেড়ে ৫.৩৩ লাখ টনে উন্নীত হয়েছে। শিগগিরই উৎপাদন সাড়ে পাঁচ লাখ টন ছাড়িয়ে যাবে বলে আশা করছেন সংশ্লিষ্টরা। দেশে মোট উৎপাদিত মাছের ১২.১৫ শতাংশই আসে শুধু ইলিশ থেকে। আর মোট দেশজ উৎপাদনে (জিডিপি) ইলিশের অবদান ১ শতাংশেরও বেশি।

একসময় বিশ্বের মোট ইলিশের ৬০% বাংলাদেশে উৎপাদিত হত। ২০২০ সালে মোট ইলিশের ৮৬%-ই এদেশে উৎপাদন হয়,  জানাচ্ছে দৈনিক প্রথম আলো। বাংলাদেশ ২০১৭ সালে ইলিশের ভৌগলিক নির্দেশক স্বত্ব লাভ করে আন্তর্জাতিক মেধাসত্ব কর্তৃপক্ষ থেকে। ২০১৮ সালে বাংলাদেশ কৃষি বিশ্ববিদ্যালয়ের চার বিজ্ঞানী ইলিশের জীবন রহস্য উন্মোচন করেন। বাংলাদেশে ইলিশের ৬টি অভয়াশ্রম আছে, অক্টোবর থেকে নভেম্বর মাসের ২২ দিন ইলিশের প্রজনন মৌসুমে ইলিশ ধরা নিষেধ, এছাড়াও সারা বছর তো জাটকা ধরা নিষেধ থাকেই। নিষিদ্ধ সময়ে সরকার জেলেদের জন্য বিকল্প আয় ও সাহায্যের ব্যাবস্থা করেছে, যার ফলাফল মিলছে ইলিশ উৎপাদনে, ১০ বছরে দেশে ইলিশের উৎপাদন ৮৪% বেড়েছে।

ইলিশ শিকারীদের যাপিত জীবন
ইলিশ নিয়ে এত কথা, এত নাম-ডাক, কিন্তু কেমন আছে ইলিশের জেলেরা সেটাও তো খতিয়ে দেখা দরকার। ইলিশ মাছ সাধারণত দুভাবে ধরা হয়- নৌকা বা ট্রলারে করে। ট্রলারযাত্রায় নদীতে একটানা ১০-১৫ দিন থাকতে হয়, তাই মাঝনদীতে যাওয়া-আসা আর থাকার বন্দোবস্ত করা লাগে। অন্যদিকে নৌকায় ইলিশ ধরতে গেলে ৩-৪ ঘন্টা পর ফেরত আসা যায়।

মাছ বিক্রির টাকা থেকে নৌকা বা ট্রলারের মালিক পায় ৩৮-৪০ ভাগ, বাকিটা জেলেরা ভাগাভাগি করে নেয়। জেলেদের থেকে মাছগুলো নৌকা বা ট্রলারের মালিক কিনে নেয়। সেখান থেকে আবার কিছু মাছ ফাও দিতে হয়। জেলেদের অভিযোগ- যখন তারা বেশি মাছ ধরে, ব্যবসায়ীরা তখন ইচ্ছে করে মাছের দাম কমিয়ে দেয়। অবশ্য মালিকপক্ষ বলে, ট্রলারের মেরামত, নদীতে থাকা-খাওয়ার খরচ, জালের খরচ সবই তাকে বহন করতে হয়। তার ভাগে যে বেশি পড়ে এ অভিযোগ সত্য নয়। তাছাড়া ইলিশ ধরার জাল দুই বছরের বেশি টেকেও না।


মৎসজীবীদের ইলিশ ধরার নিজস্ব ধর্মীয় রীতির অচার অনুষ্ঠানও আছে। মুসলমান জেলেরা নতুন নৌকা বা ট্রলার নামানোর আগে কোরআন খতম দেয়, মিলাদ পড়ায়। আর হিন্দু জেলেরা নৌকায় জল ছিটিয়ে পূজার মতো আয়োজন করে। প্রথম ইলিশ ধরা পড়লে থালায় সিঁদুর দিয়ে সাজিয়ে বরণ করে নেয়। জেলেরা মহাজনদের কাছ থেকে সুদে টাকা ধার নিয়ে নৌকা বা ট্রলার নামায় নদীতে, এটাকে বলা হয় দাদন। অনেক সময় দাদনের সুদের ভার প্রজন্ম থেকে প্রজন্ম বহন করতে হয়।

12
মহামারীতে কেমন আছেন কৃষকেরা?

Fatima Nujhat Quaderi
দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধের পর বর্তমান করোনা পরিস্থিতিকে সবচেয়ে বড় বৈশ্বিক এবং মানবিক সংকট হিসেবে উল্লেখ করেছেন জাতিসংঘের মহাসচিব। করোনার ভয়াবহতার অন্যতম একটি কারণ হচ্ছে, এটি সমগ্র পৃথিবীতে ছড়িয়ে পড়েছে মাত্র কয়েক মাসের ব্যবধানে এবং এ পরিস্থিতি থেকে উত্তরণ কবে নাগাদ সম্ভব হবে, সেটি এখন পর্যন্ত জানা যায়নি। স্বাভাবিকভাবেই মনে হচ্ছে ভ্যাকসিন ছাড়া করোনার নির্মূল করা সম্ভব নয়। ভ্যাকসিন নিয়ে আশার আলো দেখা দিয়েছে বেশ কয়েকটি গবেষণাগার থেকে, যেগুলোর ক্লিনিক্যাল ট্রায়াল ইতোমধ্যে শুরু হয়ে গেছে। সেসব আলোর মুখ দেখতে এখনো দেরি। এই আশা নিরাশার মাঝে মাঝে কেমন আছেন আমাদের বাংলাদেশের কৃষকেরা?


সর্বত্রই হতাশার ছাপ; Image Source: Daily Inquilab
ইতোমধ্যে করোনাভাইরাসের স্বাস্থ্য সংকট থেকে বিশাল অর্থনৈতিক সংকটের কারণ হয়ে দাঁড়িয়েছে, যা থেকে দেখা দিতে পারে অর্থনৈতিক মন্দা, খাদ্য সংকট এবং দুর্ভিক্ষ। বাংলাদেশের মতো উন্নয়নশীল দেশের জন্য করোনা পরিস্থিতি আরও ভয়াবহ রূপ ধারণ করতে পারে খাদ্য সংকট দেখা দিলে।


আমাদের দেশ বিশ্বের সর্বোচ্চ চাল উৎপাদনকারী দেশের মাঝে চতুর্থ অবস্থানে অবস্থান করছে। অক্টোবর থেকে মার্চ মাস পর্যন্ত সময়টা ধানের জন্য অন্যতম অনুকূল আবহাওয়াতে থাকে। মার্চ থেকে মে মাসের মাঝে পাকা ধানে সোনালি হয়ে যায় পুরো হাওর অঞ্চল, এই সময়টা দক্ষিণাঞ্চল থেকে ধান কাটার জন্য লোক নিয়োগ করা হয়। এবার করোনা পরিস্থিতে লকডাউনের কারণে যাতায়াত ব্যবস্থা বন্ধ থাকাতে নিয়োগকৃত শ্রমিকরা কাজে যোগ দিতে পারেননি, তাতে ধান নষ্ট হয়ে যাবার একটা আশঙ্কা ছিল। পরে সরকারি ব্যবস্থাপনায় শ্রমিক প্রয়োজনের আবেদনের ভিত্তিতে শ্রমিক নিয়োগের ব্যবস্থা করা হয়েছে। বোরো ধান কাটতে চলনবিল অঞ্চলে কুষ্টিয়া, রাজশাহী, গাইবান্ধা সহ প্রায় ১৭টি জেলা থেকে প্রায় ১৪ হাজার শ্রমিক আনার ব্যবস্থা করা হয়েছে।

 
সামাজিক দূরত্ব এবং নির্দিষ্ট নিয়ম-কানুন মেনে এ সকল শ্রমিকদের দিয়ে ধান কাটার ব্যবস্থা করা হয়েছে। শ্রমিকদের চলাচল এবং স্বাস্থ্য নিরাপত্তা নিশ্চিত করার জন্য সরকারি ব্যবস্থা গ্রহণ করা হয়েছে। এই সকল শ্রমিকের নদীর ধারে অস্থায়ী বসবাসের জায়গা নির্ধারণ করে দেওয়া হয়েছে এবং নিজেদের রান্নাবান্না করে থাকা-খাওয়ার ব্যবস্থার নিশ্চয়তা দেওয়া হয়েছে। বোরো ধানের মৌসুমে এই ধান যেন নষ্ট না হয়, তার জন্য সরকারি সকল মহল থেকে প্রয়োজনীয় প্রণোদনার ব্যবস্থা করা হয়েছে।

গত এপ্রিল মাসের শুরুতে সরকারি এক সভায় বোরো এবং আমন ধানের মূল্য নির্ধারণ করে দেওয়া হয়, যেন কৃষকদের বঞ্চিত না হতে হয়। এছাড়া, সরকার লটারির ভিত্তিতে বিভিন্ন কৃষকের কাছ থেকে সরাসরি ১৮ লক্ষ মেট্রিক টন ধান গম সংগ্রহের সিদ্ধান্ত নিয়েছে। এতে প্রচুর কৃষক লাভবান হবেন। এছাড়া ধান-গম মজুদের ব্যবস্থা গ্রহণ করা প্রয়োজন। চলতি করোনা পরিস্থির সাথে বন্যা পরিস্থিতে খাদ্য সংকট যেন দেখা না দেয়, তার জন্য সরকার আগে থেকেই এ ধরনের ব্যবস্থা গ্রহণের উদ্যোগ নিয়েছে।


তবুও থেমে নেই কাজ; Image Source: Cimmyt
করোনাভাইরাসের কারণে বোরো পরবর্তী কৃষিকে ব্যাপক গুরুত্ব দিচ্ছে সরকার। এ জন্য আউশ ধান, হাইব্রিড ধান, পাট, শাক-সবজি, ডালজাতীয় শস্য ও ফলমূল আবাদে বেশ কিছু পদক্ষেপ নিয়েছে কৃষি মন্ত্রণালয়। বর্তমান পরিস্থিতি এবং বন্যা পরিস্থিতির অবনতি সবকিছু মিলিয়ে দেশে খাদ্য সংকট দেখা দেবার যে সম্ভাবনা রয়েছে, সে পরিস্থিতি থেকে উত্তরণের জন্য গত এপ্রিল-মে থেকে কৃষি উৎপাদন অব্যাহত রাখতে কৃষির যান্ত্রিকীকরণ, বাজারজাতকরণ ও বিপণনে গুরুত্ব দিয়ে ব্যাপক উদ্যোগ নেওয়া হয়েছে। করোনার কারণে যেন খাদ্য সংকট না হয়, দেশে যেন দুর্ভিক্ষের মতো কোনো অবস্থা সৃষ্টি না হয়, মানুষ যেন খাদ্যকষ্টে না ভোগে, সেজন্যই এসব ব্যবস্থা নেয়া হয়েছে বলে জানা গিয়েছে।

দেশের গ্রামীণ অর্থনীতি ও কৃষি উদ্যোগে সবচেয়ে বড় অর্থায়ন করে থাকে বাংলাদেশ পল্লী কর্ম–সহায়ক ফাউন্ডেশন (পিকেএসএফ)। সংস্থাটির পক্ষ থেকে সরকারের শীর্ষ পর্যায়ে দেশে কৃষিখাতে করোনা পরিস্থিতির সম্ভাব্য পরিস্থিতে নিয়ে একটি প্রতিবেদন জমা দেওয়া হয়। সেখানে করোনা সংক্রমণের ফলে মার্চ-এপ্রিল মাসের কৃষিখাতের সংকটের চিত্র তুলে ধরে বলা হয়,

"আগামী জুন থেকে আগস্ট, এ সময়ে কৃষির বিপদের প্রভাব আরও স্পষ্ট হবে। দেশের সামগ্রিক খাদ্য সরবরাহ ব্যবস্থার ওপর এর প্রভাব পড়তে শুরু করবে। ফলে, সম্ভাব্য ওই প্রভাব মোকাবিলায় সরকারকে এখনই করণীয় ঠিক করতে হবে।"

করোনা পরিস্থিতিতে শাকসবজির বাজারজাতকরণ ও কৃষকের ন্যায্য মূল্য নিশ্চিত করার বিষয়ে কৃষিমন্ত্রী বলেন, শাকসবজি ও পচনশীল কৃষিপণ্যের চলাচল নির্বিঘ্ন করার ব্যবস্থা নেয়া হয়েছে। দুর্যোগ ব্যবস্থাপনা মন্ত্রণালয়ের প্রদত্ত ত্রাণসামগ্রীতে আলু, সবজি, পেঁয়াজ ইত্যাদি নিত্য প্রয়োজনীয় কৃষিপণ্য অন্তর্ভুক্ত করা হয়েছে। জেলা প্রশাসনের সহযোগিতায় কৃষি বিপণন অধিদপ্তর কৃষিপণ্যের ভ্রাম্যমাণ বাজার পরিচালনা শুরু করেছে। পাশাপাশি, লকডাউন এলাকার উদ্বৃত্ত কৃষিপণ্য ঘাটতি এলাকায় প্রেরণের ক্ষেত্রে ট্রাক চলাচলের জন্য জেলা প্রশাসনকে ব্যবস্থা নিতে কৃষি বিপণন অধিদপ্তর থেকে পত্র প্রেরণ করা হয়েছে। ফলে, শাকসবজির বাজারজাতকরণ কিছুটা সহজতর হয়েছে।


কৃষিখাত আমাদের সবচাইতে গুরুত্বপূর্ণ ক্ষেত্র; Image source: heifer.org
তিনি আরও জানান, আলোচনা সভায় পাওয়া সুপারিশ অনুয়ায়ী বিআরটিসির ট্রাক ব্যবহার, বিদেশে রপ্তানির জন্য কার্গো ভাড়া, দেশের সুপারশপ খোলা রাখার সময়সীমা বাড়ানো এবং সমন্বয়ের জন্য আন্তঃমন্ত্রণালয় উচ্চপর্যায়ের কমিটি গঠনের বিষয়টি গুরুত্ব দিয়ে বিবেচনা করা হবে।

সভায় জানানো হয়, বাংলাদেশের জেলাগুলোর মধ্যে মুন্সিগঞ্জ, নরসিংদী, জামালপুর, শেরপুর, ময়মনসিংহ, কুমিল্লা, ঝিনাইদহ, যশোর, মাগুরা, চুয়াডাঙ্গা, মেহেরপুর, বগুড়া, পাবনা, রাজশাহী, গাইবান্ধা, রংপুর, দিনাজপুর, কুড়িগ্রাম, লালমনিরহাট, পঞ্চগড়, ভোলা ইত্যাদি হচ্ছে সবজির জন্য উদ্বৃত্ত জেলা। এসব জেলা থেকে ট্রাকযোগে শাকসবজি অন্য জেলায় প্রেরণ করা হচ্ছে।

এতসব ব্যবস্থাপনার মাঝেও ক্ষতির সম্মুখীন হচ্ছেন ক্ষুদ্র ব্যবসায়ীরা। করোনাকালীন পরিস্থির প্রভাব অনেকটা সময় ধরে ভোগাবে বলে ধারণা করছে বিশ্বস্বাস্থ্য সংস্থা। তাই দীর্ঘমেয়াদী পরিকল্পনার বিকল্প নেই।

13
ব্যাটল অফ কোরাল সি (পর্ব-১): ২য় বিশ্বযুদ্ধে যুক্তরাষ্ট্র-জাপানের প্রথম বড় নৌযুদ্ধ

Abdullah Al Masud
১৯৪১ সাল, দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধের দামামা তখন পুরোদমে বাজছে।

জাপান একের পর এক প্রশান্ত মহাসাগরীয় দ্বীপপুঞ্জগুলো দখল করে নিচ্ছে দেখে যুক্তরাষ্ট্র তাদের তেলের সরবরাহ বন্ধ করে দিল। যুক্তরাষ্ট্র তখন মিত্র ব্রিটেনকে সাহায্য করলেও যুদ্ধে সরাসরি অংশ নেয়নি। জাপান যুক্তরাষ্ট্রের সাথে শান্তি আলোচনা চালিয়ে নিলেও হঠাৎ করে ৭ ডিসেম্বর প্রশান্ত মহাসাগর অঞ্চলের অন্যতম নৌ-ঘাঁটি পার্ল হারবারে আক্রমণ করে ব্যাপক ক্ষয়ক্ষতি করে। একইসাথে মিডওয়ে, গুয়াম, ওয়েক আইল্যান্ড মালয়েশিয়া, হংকং, সিঙ্গাপুর, সাংহাইয়ে আক্রমণ করা হয়। ফলে পরদিনই যুক্তরাষ্ট্র আনুষ্ঠানিকভাবে জাপানের বিরুদ্ধে যুদ্ধ ঘোষণা করে। ১৯৪১ এর ১৫ ডিসেম্বর একটি জাপানী বাণিজ্যিক জাহাজ ও ২৭ জানুয়ারি, ১৯৪২ সালে জাপানের একটি সাবমেরিন ডুবিয়ে দেয় আমেরিকা।


এরপর ১ ফেব্রুয়ারি যুক্তরাষ্ট্রের এয়ারক্রাফট ক্যারিয়ার ইউএসএস এন্টারপ্রাইজ (CV-6) ও ইয়র্কটাউন (CV-5) থেকে উড্ডয়ন করা যুদ্ধবিমান প্রথমবারের মতো গিলবার্ট এবং মার্শাল দ্বীপে জাপানি সেনাদের উপর হামলা করে তিনটি জাহাজ ডুবিয়ে দেয়। সেই বছরের মে মাসের আগপর্যন্ত বিচ্ছিন্নভাবে দুই দেশের নৌ ও বিমানবাহিনীর যুদ্ধ হয়েছিল। তবে বড় ধরনের নৌ-যুদ্ধ শুরু হয়েছিল ব্যাটল অফ কোরাল সি এর মাধ্যমে। এরপর একে একে সংগঠিত হয় দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধের ইতিহাসের বাক বদলে দেয়া ব্যাটল অফ মিডওয়ে, আজ অবধি হওয়া সবচেয়ে বড় নৌ-যুদ্ধ ব্যাটল অফ লেইতে গালফ, দু'পক্ষের ২৪টি এয়ারক্রাফট নিয়ে হওয়া বিশ্বের সবচেয়ে বড় ক্যারিয়ার বনাম ক্যারিয়ার যুদ্ধ 'ব্যাটল অফ ফিলিপাইন সি', দেড় লক্ষ মানুষের মৃত্যুর মাধ্যমে সংগঠিত হওয়া প্যাসিফিক অঞ্চলের সবচেয়ে রক্তক্ষয়ী যুদ্ধ 'ব্যাটল অফ ওকিনওয়া'। সব মিলিয়ে ৫টি প্রধান নৌযুদ্ধসহ অসংখ্য ক্ষুদ্র ক্ষুদ্র নৌ-যুদ্ধে পরস্পরের বিরুদ্ধে লড়েছিল জাপান-যুক্তরাষ্ট্র।

আজকের লেখাটি ব্যাটল অফ কোরাল সি নিয়ে। বাকি যুদ্ধগুলো নিয়েও আর্টিকেল পেতে চোখ রাখুন রোর বাংলায়।


গিলবার্ট-মার্শাল দ্বীপে আক্রমণের জন্য প্রস্তুত হচ্ছে ইউএসএস এন্টারপ্রাইজের একটি ডাইভ বোম্বার; Image source : wikipedia.org

যুদ্ধের কারণ
আগেই বলা হয়েছে, জাপান দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধের শুরু থেকেই Greater East Asia Co-Prosperity Sphere (大東亜共栄圏, Dai-tō-a Kyōeiken) নীতির আলোকে শক্তিশালী নৌবাহিনীর জোরে একটু একটু করে পুরো প্যাসিফিক অঞ্চল দখল করে নিচ্ছিল। চীনে আক্রমণের পাশাপাশি ফিলিপাইন, ডাচ ইস্ট ইন্ডিয়া (বর্তমান ইন্দোনেশিয়া), ওয়েক আইল্যান্ড, গিলবার্ট আইল্যান্ড, গুয়াম আইল্যান্ড, নিউ ব্রিটেন (পাপুয়া নিউগিনির অন্তর্গত) দখল করে নেয়াসহ ব্রিটিশ ইস্ট ইন্ডিয়া (ভারতবর্ষ) করায়ত্বের পরিকল্পনা করেছিল!

দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধ শুরু হওয়ার পরপরই জাপানের নেভাল জেনারেল স্টাফ ব্রিটিশরা যেন তাদের মিত্রের সহায়তা না পায় সেই ব্যবস্থার অংশ হিসেবে অস্ট্রেলিয়ায় অভিযান চালানোর মত দিয়েছিলেন। কিন্তু এত দূরে গিয়ে একবারে সৈন্য পরিবহন করে যুদ্ধ করা সম্ভব না বিধায় তার বিরোধিতা করেন আর্মি জেনারেলগণ। একই সময়ে জাপানের প্যাসিফিক অঞ্চলের ফোর্থ ফ্লিটের কমান্ডার ভাইস এডমিরাল শিগিওসি ইনোয়ি বিকল্প প্রস্তাব দেন। তিনি সলোমন দ্বীপপুঞ্জের অন্তর্গত তুলাগি এবং নিউ গুয়েনার পোর্ট মোর্শবি দখল করার কৌশলগত সুবিধা নিয়ে আলোচনা করেন। অস্ট্রেলিয়া দখল না করে দেশটির সাথে মিত্রবাহিনীর সাপ্লাই লাইন (সামুদ্রিক জাহাজ চলাচল রুট) কেটে দিতে পারলে জাপানের জন্য 'সাপ মরবে কিন্তু লাঠি ভাঙবে না'।

তাই শেষ পর্যন্ত তুলাগি এবং পোর্ট মোর্শবি দখল করার সিদ্ধান্ত হয় এর নাম দেয়া হয় Operation Mo। ১০ মে এই অপারেশনের পরপরই ১৫ মে নাউরু ও ওসেন আইল্যান্ড দখল করার জন্য Operation RY এবং পরের মাসে ফিজি, সামোয়া ও নিউ ক্যালিডোনিয়া দখল করার জন্য Operation FS এর পরিকল্পনা করা হয়। এডমিরাল ইনোয়ি চাচ্ছিলেন এডমিরাল ইয়ামামোতোর আসন্ন মিডওয়ে আইল্যান্ড অপারেশনের আগেই যেন তার অপারেশনগুলো শেষ হয়।


ভাইস এডমিরাল শিগিওসি ইনোয়ি, কোরাল সি যুদ্ধের জাপানের কমান্ডার ইন চীফ; Image source : wikipedia.org

১৯৪২ এর এপ্রিলে সেনাদের ল্যান্ডিং করার স্থান নির্বাচন করতে গোপন মিশনে সাবমেরিন RO-33 ও RO-34 কে পাঠানো হয়। দ্বিতীয় সাবমেরিনের নাম কি পরিচিত মনে হচ্ছে? জ্বী, এই সাবমেরিনটিকে আলু মেরে ডুবিয়ে দিয়েছিল মার্কিন নাবিকরা।  যা-ই হোক, জাপান আক্রমণ করতে যাচ্ছে- এই মর্মে খবর পায় যুক্তরাষ্ট্রের নৌ গোয়েন্দারা। মার্কিন কোডব্রেকারগণ পার্ল হারবার আক্রমনের পর জাপানীদের রেডিও ডিক্রিপশন কোডবুকের ৮৫% কোডের অর্থ উদ্ধার করে ফেলেছিল!

দুটো দ্বীপই যুক্তরাষ্ট্র ও মিত্রবাহিনীর জন্য কৌশলগতভাবে গুরুত্বপূর্ণ। এখানে জাপান বিমানঘাঁটি করলে আশেপাশের কয়েকশো কিলোমিটারের মধ্যে থাকা মার্কিন নৌ ও বিমানঘাঁটিগুলো তাদের হামলার আওতাভুক্ত হয়ে যাবে। একইসঙ্গে অস্ট্রেলিয়াতেও দরকার হলে হামলা করা জাপানের লংরেঞ্জ বোম্বারের জন্য সহজ হয়ে যাবে। তাই যুক্তরাষ্ট্রের প্যাসিফিক ফ্লিট কমান্ডার চেস্টার নিমিটজ জাপানি এডমিরাল শিগিওসি ইনোয়ির পরিকল্পনা বানচাল করে দিতে পাল্টা নৌবহর প্রেরণের সিধান্ত নেন। যুক্তরাষ্ট্রের সঙ্গে যোগ দেয় অস্ট্রেলিয়ার নৌ ও বিমানবাহিনী। কিন্তু ৩-৪ মে, ১৯৪২ সালে জাপানের ইনভেশন ফোর্স সলোমন দ্বীপপুঞ্জের অন্তর্গত তুলাগি অঞ্চলে অবতরণ করে। যুক্তরাষ্ট্র তাতে বাধা দিয়েও ব্যর্থ হয়।


প্যাসিফিক অঞ্চলে জাপানি সাম্রাজ্যবাদের বিস্তৃতি; Image source : wikipedia.org

ব্যাটল ফর্মেশন
মূল যুদ্ধের ঘটনায় যাওয়ার আগে কার শক্তি কেমন ছিল সেটি নিয়ে আগেই বলে নেয়া উত্তম। পাঠক হিসেবে আপনি যেন এই যুদ্ধের গুরুত্ব ও ভয়াবহতা ও দুই পক্ষের শক্তির তারতম্য অনুধাবন করতে পারেন সেজন্য এই আয়োজন।

জাপান
দ্বীপরাষ্ট্র জাপান দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধের আগে থেকেই শক্তিশালী নৌবাহিনী গঠনের দিকে মনোযোগ দেয়। প্রথম বিশ্বযুদ্ধের পর জাপান নিজেদের নৌ-শক্তি আরো বৃদ্ধি করে। এই যুদ্ধে জাপানের 'শকাকু' এবং 'যুইকাকু' নামের দুটি ফ্লিট ক্যারিয়ারের নেতৃত্বে মূল স্ট্রাইক ফোর্স ও 'শহো' একটি লাইট ক্যারিয়ার ইনভেশন ফোর্সের জন্য এয়ার সাপোর্ট প্রদান করে। ফ্লিট ক্যারিয়ার, লাইট ক্যারিয়ার ইত্যাদি শ্রেণীর যুদ্ধজাহাজ নিয়ে বিস্তারিত আলোচনা করা হয়েছে 'এয়ারক্রাফট ক্যারিয়ার: আধুনিক নৌবাহিনীর তুরুপের তাস (পর্ব-১)' শিরোনামের লেখাটিতে।

পার্ল হারবারে আক্রমণের সময় এয়ারক্রাফট ক্যারিকার 'শকাকু' ফ্লাইট ডেকে উড্ডয়ন প্রস্তুতি নিচ্ছে একটি জাপানি যুদ্ধবিমান; Image source : wikipedia.org

জাপানিদের তিনটি ক্যারিয়ার মিলিয়ে মোট ১৩৯টি বিমান ছিল। ১২টি সৈন্য পরিবহনকারী জাহাজকে প্রটেকশন ও ভূমিতে হামলার জন্য ৯টি ক্রুজার ও ১৫টি ডেস্ট্রয়ার শ্রেণীর যুদ্ধজাহাজ বহরে যোগ দেয়। এছাড়া নেভাল মাইন অপসারণের জন্য ৫টি মাইন সুইপার, শত্রুর জন্য মাইনের ফাঁদ পাততে ২টি মাইন লেয়ার, শত্রুর সাবমেরিন ধাওয়া ও ধ্বংস করতে দুটি সাবমেরিন চেজার, মাঝসাগরে যুদ্ধজাহাজে প্রয়োজনীয় তেল সাপ্লাই দিতে একটি অয়েল ট্যাংকার ও শত্রু জাহাজের উপর গোয়েন্দাগিরি করতে একটি লংরেঞ্জ সি-প্লেন ক্যারিয়ার (এসব বিমান পানিতে ল্যান্ড করতে পারে) জাপানি বহরে যোগ দেয়। সুতরাং বুঝতেই পারছেন যে প্রশান্ত মহাসাগরের রাজা রাজার বেশেই হামলা করতে এসেছিল কোরাল সাগরে। তাদের কমান্ডার ছিল যথাক্রমে রিয়ার এডমিরাল তাকেও তাকাগি ও রিয়ার এডমিরাল চুইচি হারা।


রিয়ার এডমিরাল তাকেও তাকাগি (বামে) ও চুইচি হারা (ডানে) এই যুদ্ধে জাপানকে নেতৃত্ব দেন; Image source : wikipedia.org

যুক্তরাষ্ট্র
পার্ল হারবার আক্রমণে যুক্তরাষ্ট্র তাদের ৫টি ব্যাটলশিপসহ ১৮টি যুদ্ধজাহাজ হারিয়ে অনেকটাই দুর্বল হয়ে পড়েছিল। তাই তারা ১২৮টি যুদ্ধবিমান বহনকারী দুটি বিশাল আকারের ফ্লিট ক্যারিয়ারের প্রটেকশনের জন্য ৮টি ক্রুজার ও ১৪টি ডেস্ট্রয়ার শ্রেণীর যুদ্ধজাহাজ নিয়ে এসেছিল। এছাড়া জরুরি তেল সরবরাহের জন্য দুটি ট্যাংকার জাহাজ মার্কিন বহরে ছিল।

ঐ সময়ে প্রশান্ত মহাসাগরে মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রের ৫টি এয়ারক্রাফট ক্যারিয়ার ছিল। ভাইস এডমিরাল হ্যালসির অধীনে থাকা ইউএসএস এন্টারপ্রাইজ ও ইউএসএস হরনেট নামের এয়ারক্রাফট ক্যারিয়ার দুটো কেবলমাত্র জাপানের মেইনল্যান্ডে বোম্বিং মিশন শেষ করে ঘাঁটিতে ফিরেছে বিধায় তড়িঘড়ি করে আবার যুদ্ধে পাঠানো সম্ভব ছিল না। তাছাড়া সারাটোগা নামের আরেকটি ক্যারিয়ার কিছুদিন আগেই জাপানী সাবমেরিনের টর্পেডো হামলার শিকার হয়ে এখন যুক্তরাষ্ট্রে মেরামত করতে পাঠানো হয়েছে। তাই ইউএসএস ইয়র্কটাউন ও লেক্সিংটন নামের দুটো ফ্লিট ক্যারিয়ার পাঠায় যুক্তরাষ্ট্র। তাদের কমান্ডার ছিল যথাক্রমে রিয়ার এডমিরাল ফ্যাংক জে. ফ্লেচার ও রিয়ার এডমিরাল অব্রে ফিচ।
 
প্রিয় পাঠক, লেখার এই পর্যায়ে এয়ারক্রাফট ক্যারিয়ারগুলো ও তাদের কমান্ডারদের নামগুলোর দিকে আবার খেয়াল করার অনুরোধ করছি। কেননা পরবর্তীতে কাহিনী বর্ণনার সুবিধার্থে এই নামগুলো বারবার আপনার সামনে উপস্থাপন করা হবে।


রিয়ার এডমিরাল ফ্লেচার (বামে) ও অব্রে ফিচ (ডানে) মার্কিনীদের নেতৃত্ব দেন; Image source : wikipedia.org

রিকনসিস মিশন
আগেই যেন মার্কিন ক্যারিয়ারের উপস্থিতির কথা জানা যায় সেজন্য জাপান ৪টি বাড়তি সাবমেরিন I-22, I-24, I-28 ও I-29 কে মোতায়েন করে। এরা ৮৩০ কিলোমিটার এরিয়া স্কাউটিং করার কথা ছিল। কিন্তু মার্কিন ক্যারিয়ার টাস্কফোর্স যে আগেই ঐ এলাকা পাড়ি দিয়ে ফেলেছে তা কে জানতো! এমনকি ঐ অঞ্চলে আগে থেকেই থাকা I-21 সাবমেরিন (যে কিনা নতুন ৪টিকে নেতৃত্ব দেয়ার কথা ছিল ) ২ মে ইয়র্কটাউনের একটি বিমান থেকে হামলার শিকার হয়। কিন্তু সে নিজেও জানতো না যে হামলাটি এয়ারক্রাফট ক্যারিয়ার থেকে হয়েছে। তাই কোরাল সি এর যুদ্ধে সাবমেরিনের কোনো ভূমিকা ছিল না। অন্যথায় জাপানিরা আগেই যদি টের পেত জার্মান ইউবোটের ন্যায় সম্মিলিত হাঙ্গরের ন্যায় এয়ারক্রাফট ক্যারিয়ারের উপর ঝাঁপিয়ে পড়তো।


ইউএসএস ইয়র্কটাউন দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধের গতিপথ পাল্টে দিতে ভূমিকা রেখেছে; Image source : wikipedia.org

এরই মধ্যে ৩ মে টাস্কফোর্স ১১ (ইউএসএস লেক্সিংটন) ও টাস্কফোর্স ১৭ (ইউএসএস ইয়র্কটাউন) নিউ ক্যালিডোনিয়া দ্বীপের উত্তর-পশ্চিমে একত্রিত হয়। লেক্সিংটনের রিফুয়েলিং শেষ না হওয়ায় তাকে অস্ট্রেলিয়ান নেভির টাস্কফোর্স ৪৪ এর সাথে যোগ দেয়ার নির্দেশ দেন এডমিরাল ফ্লেচার। ইতিমধ্যে রয়্যাল অস্ট্রেলিয়ান এয়ারফোর্সের একদল কমান্ডো তুলাগিতে ল্যান্ড করে এবং জাপানি ইনভেশন ফোর্স আক্রমণ করা মাত্রই তারা পূর্বনির্দেশ মোতাবেক পিছু হটে। খবরটি প্যাসিফিক হেডকোয়ার্টারে এডমিরাল নিমিটজের কাছে পৌঁছে গেলেও তিনি রেডিও সাইলেন্স না ভাঙার কারণে ইয়র্কটাউনের রিয়ার এডমিরাল ফ্লেচারকে সেটি দিতে পারছিলেন না। অর্থাৎ নির্ধারিত সময়ের চেয়ে একদিন পিছিয়ে আছে মার্কিন বাহিনী!

 
ফলে তিনি টাস্কফোর্স ১১ তথা রিয়ার এডমিরাল অব্রে ফিচের ক্যারিয়ার লেক্সিংটনের এর আশায় বসে না থেকে কোর্স পরিবর্তন করে গুয়াডালক্যানেল দ্বীপ এলাকার উদ্দেশ্যে যাত্রা শুরু করেন যেন পরদিন সকালে তিনি একাই তুলাগি ইনভেশন ফোর্সের উপর হামলা করতে পারেন!


ইউএসএস লেক্সিংটন কিছুটা পুরনো হলেও এই যুদ্ধে দারুণ ভূমিকা পালন করে; Image source : wikipedia.org

মূল যুদ্ধ - প্রথম দিন
একটা সময় নৌযুদ্ধ বলতে কেবলমাত্র দুই দেশের শক্তিশালী জাহাজ পরস্পরকে নিজেদের ভারী ভারী কামানের রেঞ্জে এনে গোলাবর্ষণ করাকে বোঝাতো। কিন্তু 'ব্যাটল অফ কোরাল সি'-তে এসে নতুন যুগের নৌযুদ্ধের সূচনা হয়। ইতিহাসে প্রথমবারের মতো দুই দেশের এয়ারক্রাফট ক্যারিয়ারের মধ্যে যুদ্ধ হয়। দুই দেশের বিমানবাহী রণতরীগুলো পরস্পরের ১৩০ কিলোমিটারের মধ্যে এসে পড়ে। তখনকার দিনে আজকের মতো এত উন্নত রাডার ছিল না। তাই শত্রু জাহাজ না দেখেই নেভি শিপের কমান্ডার আক্রমণ করছেন- এমন যুদ্ধের প্রথাও ছিল নতুন।


মার্কিন আইওয়া ক্লাস ব্যাটলশিপের ১৬" ব্যাসের ৯টি কামানের একযোগে ফায়ারিং এর ভয়ংকর সৌন্দর্য; Image source : wikipedia.org

অপারেশন পরিকল্পনায় যুক্তরাষ্ট্র জাপানের চেয়ে একদিন পিছিয়ে ছিল। ১৯৪২ সালে ৩-৪ মে তারিখে জাপান সফলভাবে তুলাগিতে সৈন্য অবতরণ করে এবং যুক্তরাষ্ট্রের তরফ থেকে প্রথম হামলা করা হয়। ইউএসএস ইয়র্কটাউন থেকে ৪ মে সকালে লঞ্চ করা ৬০টি বিমানের সারপ্রাইজ এয়ার অ্যাটাকে তুলাগি ইনভেশন ফোর্সের ডেস্ট্রয়ার 'কিকিজুকি'সহ ৩টি মাইন সুইপার জাহাজ ডুবিয়ে দেয় এবং আরো ৪টি ক্ষতিগ্রস্ত করে। ব্যাপক হামলার মুখেও ইনভেশন ফোর্স তাদের অগ্রযাত্রা অব্যাহত রাখে এবং দ্রুতগতিতে তুলাগিতে সি-প্লেন বেজ নির্মাণের কাজ শুরু করে। ৬ মে এই ঘাঁটি থেকে প্রথম রিকনসিস বিমান উড্ডয়ন করে।


Kawanishi H6K দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধে জাপানের বহুল ব্যবহৃত সি-প্লেন; Image source : wikipedia.org

এদিকে ভাইস এডমিরাল তাকেও তাকাগির ক্যারিয়ার স্ট্রাইক ফোর্স অপারেশন এম-ও এর টাইমটেবিল গড়বড় হয়ে যাবে দেখে রাবাউল ঘাঁটিতে ৯টি বাড়তি জিরো ফাইটারের ডেলিভারি দেয়ার মিশন বাতিল করে এয়ারক্রাফট ক্যারিয়ার যুইকাকুর রিফুয়েলিং শুরু করেন। তিনি মূলত খারাপ আবহাওয়ার কারণে দুবার চেষ্টা করেও ফাইটারগুলোর ডেলিভারি দিতে পারেননি। এই কাজ করতে গিয়ে তিনি শিডিউল থেকে দেড় দিন পিছিয়ে পড়েন। তা না হলে মার্কিন হামলার সময় তিনি তুলাগির একদম কাছেই থাকতেন। ইয়র্কটাউনের হামলার কথা শুনে রিফুয়েলিং বাতিল করে তুলাগির ৬৫০ কিলোমিটার উত্তরে থাকা ক্যারিয়ার  স্ট্রাইক ফোর্স নিয়ে দক্ষিণ-পূর্ব দিকে যাত্রা শুরু করেন। কিন্তু এয়ারক্রাফট ক্যারিয়ার যুইকাকুর স্কাউট বিমানগুলো এডমিরাল ফ্লেচারের ইয়র্কটাউনকে খুঁজে পায়নি। আর পাবেই বা কীভাবে? তিনি তো টাস্কফোর্স ১১ ও ৪৪ এর সাথে মিলিত হতে গুয়াডালক্যানেলের দক্ষিণে আরো ৫৯০ কিলোমিটার দূরে সরে গেছেন।


৫ মে অর্থাৎ কোরাল সি যুদ্ধ চলাকালে জাপানি এয়ারক্রাফট ক্যারিয়ার যুইকাকুর ফ্লাইট ডেকে ডাইভ বোম্বার; Image source : wikipedia.org

তবে জাপানিরা তার অবস্থান অনুমান করে ফেলতে সক্ষম হয়। কারণ জাপান অধিকৃত শর্টল্যান্ড আইল্যান্ড থেকে আসা একটি রিকনসিস বিমান দুটো মার্কিন ক্যারিয়ার গ্রুপের সাথে অস্ট্রেলিয়ান টাস্কফোর্সকে দেখে ফেলে বিধায় একে শুটডাউন করা হয়। নির্দিষ্ট সময় পর এটি খবর না পাঠানোয় এবং বেজে ফেরত না আসায় ধরে নেয়া হয় এটি মার্কিন ক্যারিয়ারের কোনো বিমানের হাতে ভূপাতিত হয়েছে। এরই মধ্যে পার্ল হারবার থেকে খবর আসে যে পোর্ট মোর্শবিতে আক্রমণ করা হবে ১০ মে।

প্রত্যাশিত স্থানে জাপানি ক্যারিয়ারকে না পেয়ে পুনরায় রিফুয়েলিং শেষে বুগেনভাইল দ্বীপাঞ্চলে দিকে রওনা দেন ফ্লেচার। কেননা ইনভেশন ফোর্সের সাপোর্ট হিসেবে সেখানে অবশ্যই জাপানি ক্যারিয়ার থাকবে বলে আশা করা যায়। কিন্তু এডমিরালের ফ্লেচারের অনুমান ছিল ভুল। পরদিন মার্কিনীদের পাশাপাশি জাপানিরাও এমন সব ভুল করতে শুরু করে যা ইতিহাসে কোরাল সি যুদ্ধকে 'Most confused battle in world history'-তে পরিণত করেছে। 

14
বলপয়েন্ট কলমের কথা: মানুষের লেখালেখির ইতিহাস বদলে দেওয়া যন্ত্র

Shah MD. Minhajul Abedin
কলম ছাড়া আজকের একটি দিন কল্পনা করাও কঠিন, ইলেকট্রনিক সামগ্রীর প্রভাব যতই হোক কলম আমাদের হাতের কাছে খুঁজে পাওয়া যাবেই। তবে গত শতাব্দীতে দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধের আগেও পরিস্থিতি এমন ছিল না, কলম ছিল তখনো বিলাসদ্রব্যের তাকে। কলম বানাতে ব্যবহৃত উপাদান আর কালি দুইটারই দাম বেশি হওয়ার কারণে প্রভাবশালী না হলে কারো টেবিলে দুই চারটা কলম থাকবে তা ভাবা ছিল দুষ্কর।

বলপয়েন্ট কলম এই দৃশ্যপট বদলে দিয়েছে, মানুষের লেখার গতিশীলতা বেড়েছে, বেড়েছে কলমের গতিশীলতা, পকেটে করে মাইলের পর মাইল পাড়ি দিচ্ছে আজকের কলম। গত শতাব্দীর শুরুতে কালির দোয়াতের ব্যবহার কমে আসতে শুরু করার সাথে সাথে লেখার জন্য পেন্সিল বাদে ‘ফাউন্টেন পেন’ বা ‘ঝর্ণা কলম’ই হয়ে উঠে একমাত্র কলম। সময়ের সাথে সেই ফাউন্টেন পেন বলপয়েন্ট কলমের কাছে জায়গা হারিয়ে এখন আভিজাত্য এবং শৌখিনতার প্রতীক।



প্রতিদিনের কাজে ফাউন্টেন পেন ব্যবহার করে এমন মানুষ পৃথিবীতে খুঁজে পাওয়া দুর্লভ এখন; Image Source: Borja Buenafente/BBC
ফাউন্টেন পেনের অসুবিধা
ফাউন্টেন কলমে যেহেতু তরল কালি ব্যবহার করা হয় তা শুকাতে সময় লাগে, লেখার জন্য কাগজকে হতে হয় একটু পুরু। আবার লেখার পরে কোনোভাবে যদি এতে হাতের ঘষা লাগে তবে কালি ছড়িয়ে যায়, আরেকটি অসুবিধা হলো তরল কালি ব্যবহারের কারণে একে ধরতে হয় একটু কায়দা করে, এই কলম যারা ব্যবহার করে অভ্যস্ত তারা বলে থাকেন সমতলের সাথে ৪০-৫৫ ডিগ্রী কোণ করে ধরতে। অনেকেই একে ‘Sweet Spot of Fountain Pen’ বলে থাকেন।


ফাউন্টেন পেন দিয়ে লিখতে দরকার একটু কায়দা কানুন; Image Source: pentemple.com
কলম, কালি ও হাতের গঠন অনুযায়ী একটু আলাদা হতে পারে এই কোণ, তবে কালির অবিচ্ছিন্নতা বজায় রাখতে হলে একে ধরতে হবে একটু কায়দা করে। হাতে সময় থাকলে শখের বশে এই কলমে ক্যালিগ্রাফি বেশ ভালো করা যায়। তবে পৃথিবীর গতিশীলতা বাড়ার সাথে সাথে ফাউন্টেন পেন ছিটকে পড়তে থাকে কক্ষপথের বাইরে। দ্রুত লিখতে ফাউন্টেন কলম বাদ দিয়ে অনেকেই পেন্সিল ব্যবহার শুরু করেন। তবে পেন্সিলের লেখা দীর্ঘদিনে পরে ঝাপসা হয়ে যায়, তাই কাগজে দ্রুত এবং দীর্ঘস্থায়ীভাবে লেখতে ফাউনন্টেন কলমের বিকল্প কলম নিয়ে অনেকেই চিন্তা করেছেন।

বলপয়েন্ট দেখছে আলোর মুখ
১৮৮৮ সালে বলপয়েন্ট কলমের প্রথম প্যাটেন্ট দাখিল করেছিলেন জন লাউড। আমেরিকান এই আইনজীবী আইনচর্চার পাশাপাশি যন্ত্রাংশের খুঁটিনাটি নিয়ে কাজ করতে বেশ স্বাচ্ছন্দ্য অনুভব করতেন। যন্ত্র খুলে ভেঙে নাড়াচাড়া করতে তার পারদর্শিতা ছিল। আইনজীবী হওয়ার সুবাদে ফাউনন্টেন পেন দীর্ঘদিন ব্যবহার করেছেন, কালি চটকেছে কাগজে, বারবার কালির রিফিল খুলতে লাগাতে গিয়ে দেখলেন এর নকশায় আছে ঝামেলা। পাশাপাশি তিনি এমন একটি কলম তৈরি করতে চেয়েছিলেন যা দিয়ে কাঠ, কাগজ, চামড়ায় খুব সহজেই লেখা যাবে।

আমরা এখন যে বলপয়েন্ট কলম ব্যবহার করি, তার মাথায় একটি ছোট স্টিলের বল ঘুরতে থাকে। কাগজে লেখা চালিয়ে যাবার সাথে সাথে এই ঘুরতে থাকা বল কালির সংস্পর্শে এসে নিজেই বারবার কালি বের করে আনতে পারে। এই ডিজাইনটি মূলত জন লাউডের করা। তবে এই ডিজাইনের আরেকটি চমৎকার ব্যবহার আছে, আমরা যে 'রোল-অন ডিওডোরেন্ট' ব্যবহার করে থাকি সেটিও এই ডিজাইন থেকে অনুপ্রাণিত হয়ে, বলের পেছনে কালির বদলে থাকে তরল ডিওডোরেন্ট। কলমের ক্ষেত্রে ঘুরতে থাকা স্টিল বলের পেছনে থাকবে তরল পদার্থটি, তবে স্টিল বল এবং সকেট এমন মাপের হবে যাতে কালি কোনোভাবে আবার বাইরে ছড়িয়ে না যায়। এই ডিজাইনে কালি খরচাও কমবে।


লাউডের প্যাটেন্ট, একই মডেল ব্যবহার করা হয়ে থাকে রোল-অন ডিওডোরেন্ট-এ; Image Source: commons.wikimedia.org
লাউড প্যাটেন্টে তার কলমকে ফাউন্টেন পেনের একটু উন্নত সংস্করণ হিসেবেই দেখিয়েছিলেন, তার কলমে কালি ছিল ঐ ফাউন্টেন পেনের মতোই তরল। তাই এটি দিয়ে চামড়া কিংবা কাঠে লেখা গেলেও সাধারণ পাতলা কাগজে লেখা কঠিন ছিল। সাধারণ মানুষের নিত্যদিনের কাজে বা পাতলা কাগজে যেহেতু লেখা যাচ্ছে না, তাই ধীরে ধীরে এই প্যাটেন্ট তার অর্থনৈতিক গুরুত্ব হারায়। তবে এই নকশাকে আরেকটু উন্নত করতে কাজ করেছেন অনেকেই। ১৯৩০ সালে অস্ট্রিয়ান-আর্জেন্টাইন লাজলো বিরো নামের এক সাংবাদিক বলপয়েন্ট কলম নিয়ে অনুসন্ধান শুরু করেন। সাংবাদিকতার খাতিরে প্রতিনিয়ত ফাউনন্টেন কলম তিনিও ব্যবহার করে অভ্যস্ত, লাউডের মতো তিনিও চাইতেন এর সমস্যাগুলো সমাধান করতে।

বদলে গেল দৃশ্যপট
তিনি বুঝতে পারলেন, বল পয়েন্ট কলমে যদি ঐ একই তরল কালি ব্যবহার করা হয় তাহলে তার আলাদা কোনো গুরুত্ব থাকবে না। লেখার কাজ একটু সহজ হলেও ঐ একই মোটা কাগজ ব্যবহার করতে হবে এবং কালি ছড়িয়ে যাবে। অর্থাৎ কলমের সবচেয়ে গুরুত্বপূর্ণ উপাদান কালিকে একটু পরিবর্তন করতে হবে। ঘটনাক্রমে লাজলো বিরোর ভাই ছিলেন একজন দন্ত চিকিৎসক এবং রসায়নবিদ। ভাইয়ের সাথে আলাপ করে বুঝতে পারলেন কালিকে করতে হবে একটু ঘন। অর্থাৎ, রসায়ন মিলিয়ে বললে দাঁড়ায় কালির সান্দ্রতা বাড়াতে হবে।

 
সান্দ্রতার ব্যাপারটি সহজে বুঝা যাবে পানি আর মধুর উদাহরণ দিয়ে, কাঁচের থালার উপরে পানি সহজে ছড়িয়ে যায় কিন্তু মধু ছড়ায় না সহজে। মধু যে ধর্মের কারণে তরল হয়েও ছড়িয়ে যায়না তা হল তার সান্দ্রতার মাত্রা। সান্দ্রতার মাত্রা যত বেশি তার ছড়িয়ে যাওয়ার মাত্রা তত কম। লাজলো আর তার ভাই মিলে কলমের কালির সান্দ্রতা বাড়ানোর ব্যাপারে চিন্তা শুরু করলেন।

কালির সাথে বিভিন্ন ধরনের আঠা মিশিয়ে এর সান্দ্রতার মাত্রা পরীক্ষা করা হলো। বেশি আঠালো কালি আবার কলমের নিব দিয়ে বের না হয়ে জমাট বেঁধে যায়, আবার বেশিদিন রাখলে কালি শুঁকিয়ে যায়। তাই সান্দ্রতা নিয়ে লাজলো বিরো এবং তার ভাই যে কাজ যুগান্তকারী কাজ শুরু করেছিলেন তা পরবর্তীতে বলপয়েন্ট কলম শিল্পের বড় নিয়ামক হয়ে দাঁড়ায়।


অস্ট্রিয়ান-আর্জেন্টাইন উদ্ভাবক লাজলো বিরো বলপয়েন্ট কলমের গতিপথ বদলে দিলেন; Image Source: Borja Buenafente/BBC
বিরোর কলমে আঠালো কালিকে রাখা হবে একটি নলে, নল থেকে মধ্যাকর্ষণের টানে ধীরে ধীরে কলমের নিবের কাছে এসে জমা হবে। আর বাইরে থাকা চাকার মতো বল কাগজের উপর ঘুরতে থাকবে, ঘুরতে থাকার সময়ে সেই চাকা কালির সংস্পর্শে আসবে। যেহেতু একটু আঠালো ধরনের কালি তা পাতলা কাগজেও লিখে ফেলা মাত্রই শুকিয়ে যাবে, অর্থাৎ ঘষা লেগে ছড়িয়ে যাওয়ার সম্ভাবনা খুবই কম। লাজলো বিরো এবং তার দন্ত চিকিৎসক ভাইয়ের পুরো কলমের প্যাকেজটি ছিল লাউডের থেকে আলাদা। সুতরাং বিরো তার কাজের জন্য নতুন প্যাটেন্ট নিলেন ১৯৩৮ সালে।

ইউরোপে যুদ্ধের ঘনঘটা
১৯৩৮ সালে প্যাটেন্ট নিলেও এই কলমের বিশালাকার উৎপাদনের কাজ শুরু করা সম্ভব হয়নি দুই ভাইয়ের। ইহুদী হওয়ার কারণে লাজলো বিরো ও তার ভাই নিজ দেশে নিপীড়নের শিকার হয়ে ১৯৪১ সালে আর্জেন্টিনায় পালিয়ে যান। সেখানে তিনি চালু করেন ‘বিরোম’ নামের বলপয়েন্ট কলম। সেই কলম নজর কাড়ে ব্রিটেনের রয়্যাল এয়ার ফোর্সের, অধিক উচ্চতায় যেখানে ফাউন্টেন পেন কাজে আসে না সেখানে পেন্সিলের জায়গা নিতে শুরু করে ‘বিরোম’।


আর্জেন্টাইন পত্রিকায় 'বিরোম' কলমের বিজ্ঞাপন; Image Source: Revista Leoplán, Argentina, año 1945
রয়্যাল এয়ার ফোর্সের পক্ষ থেকে ত্রিশ হাজার কপির অর্ডার দেওয়া হয় এই কলমের জন্য। দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধ এবং এর পরে এই বলপয়েন্ট কলম হয়ে উঠে ব্যাপক জনপ্রিয়। লাজলো বিরোর প্যাটেন্টে এক আধটু পরিবর্তন শুরু হয়, কেউ কলমের আকারে, কেউ কালিতে পরিবর্তন আনতে শুরু করেন। সুতরাং এই প্যাটেন্ট নিয়ে মাথা ঘামাবার প্রয়োজনীয়তা কমে আসে, বরং সহজে কম দামে কীভাবে মানুষের কাছে কলম পৌঁছে দেওয়া যায় সেই চিন্তা শুরু হয়। ১৯৪৫ সালে আমেরিকান ব্যবসায়ী মিল্টন রেনল্ডস আমেরিকাতে এই বল পয়েন্ট কলম বিক্রির সিদ্ধান্ত নেন, পত্রিকায় পত্রিকায় ছাপা হয় কলমের বিজ্ঞাপন। সাড়ে বারো ডলার খরচ করে নতুন এক কলম কিনতে দোকানগুলোর সামনে দেখা যায় লম্বা লাইন। সেই আমলের সাড়ে বারো ডলারকে এখনের হিসাবে নিলে তা দাঁড়াবে একশো আশি ডলারে, অর্থাৎ এই টাকা খরচা করে এখনের দিনে হাজারখানেকের বেশি কলম কিনে ফেলা যাবে।

 
ফাউন্টেন পেনের ছায়া থেকে বেরিয়ে আসা
একদম প্রথম দিকের বলপয়েন্ট কলম আসলে ফাউন্টেন কলমের ছায়া থেকে খুব একটা বের হয়ে আসতে পারেনি। শুরুতে এটিকে বানানো হতো প্রতিদ্বন্দ্বী হিসাবেই, যেহেতু কলমের দামও বেশি তাই মানুষের কাছে কলমের অন্যতম উপযোগীতা ছিল এর স্থায়িত্ব। তাই টেকসই কলম তৈরিতে ধাতব পদার্থের ব্যবহার ছিল বেশি। রেনল্ডস কোম্পানি তাদের বিজ্ঞাপনেই বলতো, দুইবছর রিফিল করা ছাড়াই যেকোনো স্থানে লিখতে পারবে যে কেউ, ফাউন্টেন পেন বারবার রিফিল করার ঝামেলা তাই এটি এড়িয়ে যেতেও বলপয়েন্ট ভালো সমাধান। ধীরে ধীরে ‘পার্কার’ সহ আরো বিখ্যাত ফাউন্টেন কলম নির্মাতা কোম্পানিও বলপয়েন্ট কলমের বাজারে প্রবেশ করে। কলম যেহেতু দীর্ঘস্থায়ী, তাই একটি কলম কিনে দীর্ঘদিন যাবৎ তার রিফিল কিনে নিলেই হচ্ছে। তাই পঞ্চাশের দশকের মাঝেই দেখা গেলো মানুষ আর কলম না কিনে বরং রিফিল কিনছে, অর্থাৎ কলম কোম্পানির বাজারে দেখা দিল নতুন সংকট।


রেনল্ডস কোম্পানির কলমের বিজ্ঞাপন, ১৫ বছর রিফিল করা লাগবে না এমন দাবী বিজ্ঞাপনের; Image Source: imgur.com
ফ্রেঞ্চ-ইতালিয়ান ব্যবসায়ী মার্সেল বিক কলমের বাজারকে দীর্ঘদিন ধরে পর্যবেক্ষণ করেছেন, তিনি বুঝতে পেরেছিলেন এখনো কলম সাধারণ মানুষের প্রয়োজনীয় দ্রব্য হয় উঠলেও এর উচ্চদামের কারণে এটি সে বারবার পরিবর্তন করতে পারছে না। অনেকটা বর্তমান দিনের স্মার্টফোনের মতো, অনেক কাটখড় পুড়িয়ে কেনা একটি স্মার্টফোন যতদিন না বিকল হচ্ছে সে ব্যবহার করছে, কলমই তখন অনেকটা সেরকমই ছিল।

অনেকক্ষেত্রে কলম আভিজাত্যও প্রকাশ করছে। কলমকে যদি আরো সস্তা করা যায়, এবং এর ব্যবহারকাল সীমিতও হয় তাহলেই কলমের বাজারে আসবে পরিবর্তন,  এই ভাবনা থেকেই কাজ শুরু করেন মার্সেল বিক। পঞ্চাশ এবং ষাটের দশকে সুলভে প্লাস্টিক সামগ্রীর ব্যবহার কলমকে আরো সহজলভ্য করে, বাজার থেকে কাঁচ, ধাতু কিংবা কাঠের কলম হারিয়ে যেতে শুরু করে।


কলমের সস্তা হয়ে উঠার পেছনে অবদান আছে মার্সেল বিকের; Image Source: BIC Cristal Story
বিকের নির্মিত কলমের অনুসরণ করে দুনিয়াজুড়ে প্রায় সব কলম নির্মাতা কোম্পানি প্লাস্টিকের দিকে ঝুঁকে। বিকের ডিজাইন করা কাঁচের মতো দেখতে স্বচ্ছ প্লাস্টিকের কলম ‘Cristal’ কে ধরা হয়ে থাকে পৃথিবীর ইতিহাসে অন্যতম ব্যবসা সফল কলম। ২০০৬ সাল নাগাদ এই কলম বিশ্বজুড়ে বিক্রি হয়ে ১০০ বিলিয়ন কপিরও বেশি।


বিকের বেস্টসেলার কলম ‘Cristal’; Image Source: commons.wikimedia.org
মজার ব্যাপার হলো, স্বচ্ছ হওয়ার কারণে এই কলমের কালি শেষ হয়ে যাবার আগেই দেখা যায় এবং কালি যত নীচের দিকে নামে ততই মানসিকভাবে নতুন কলম কেনার জন্য আগ্রহী হয়ে পড়ে। কলমের রিফিল কিনে ব্যবহারের চেয়ে নতুন কলম কিংবা কলমের পুরো একটি প্যাকেট কিনে ফেলাই হয়ে উঠে সংস্কৃতির অংশ। সত্তরের দশকে এসে প্লাস্টিকের একটি বলপয়েন্ট কলমের দাম দাঁড়ায় পেন্সিলের চেয়ে কমে।

মোটাদাগে বলপয়েন্ট কলমের দাম এত কমে এসেছে যে বিভিন্ন দেশে নামীদামী ব্র্যান্ড তাদের আধিপত্ব হারিয়েছে। কলম নিত্য ব্যবহার্য হয়ে উঠে উঠার সাথে সাথে এর গায়ে কোন কোম্পানির নাম লেখা তা গুরুত্ব হারিয়েছে। বিশেষ করে উন্নয়নশীল দেশগুলোতে স্থানীয় কলম নির্মাতা কোম্পানিগুলোর কাছে বাজার হারিয়েছে নামীদামী কোম্পানিগুলো। তাই বর্তমানে কলমের বাজারে একক আধিপত্য বিস্তার হয়ে উঠেছে কঠিন, তাই নামীদামী কোম্পানিরা হাঁটছে পুরাতন পথে, কলমে এবার নতুন করে বিলাস দ্রব্য বানানোর চেষ্টা করে যাচ্ছে তারা।

ফাউন্টেন পেন থেকে বলপয়েন্ট
ফাউন্টেন কলম যখন ব্যবহার করা হতো তখন মানুষের লেখার ধরন ছিল আলাদা, লেখার ধারাটা বজায় রাখার জন্য একটি অক্ষরের সাথে আরেকটি অক্ষরের যুক্ত করে দেওয়ার ব্যপারটি ছিল খুবই সাধারণ। লেখার এই ধরনকে বলা হয়ে থাকে 'Palmer Method', এবং লেখালেখির কাজটি ছিল ধীরেসুস্থে করার কাজ। অভিজাত স্কুলগুলোতে বা বাড়িতে শিক্ষকও রেখে অনেকেই এ ধরনের লেখা শিখতেন।


'Palmer Method' এ লেখা চিঠির উদাহরণ, দেখতে খানিকটা অভিজাত দেখায় বলে আমেরিকার শিক্ষিত সমাজে ব্যাপক জনপ্রিয় ছিল এই স্টাইল, এই আভিজাত্য ভেঙে দিয়েছে বলপয়েন্ট কলম; Image Source: commons.wikimedia.org
ফাউন্টেন পেনের কালির কারণেই একে এমনভাবে কাগজের সাথে ধরতে হয় যাতে করে এই প্যাচানো লেখার ব্যাপারটি স্বাভাবিকভাবেই অনুপ্রাণিত হত। আর প্রতিষ্ঠানগুলো লেখালেখিতে এই বিশুদ্ধতাকেও একটি আভিজাত্যের কাতারে ফেলে দিত। তবে ইউরোপ আমেরিকায় বলপয়েন্ট কলম আসার সাথে সাথে বরং লেখালেখির স্রোত উল্টোদিকে বইতে শুরু করে। বলপয়েন্টের নিবকে খাতার পৃষ্ঠার সাথে কোণ করে রাখার একান্তই কোনো দরকার নেই, তবে চাইলে কেউ একে ফাউন্টেন পেনের মতোও ব্যবহার করতে পারবেন। কলম উঠিয়ে যেকোনো কোণ থেকে লেখা শুরু করা যায়, অর্থাৎ কলম ব্যবহারের স্বাধীনতা একটু বেড়ে যায়। ফলে লেখালেখিতে এক্ক কয়েকটি স্টাইলের আভিজাত্য উঠে গিয়ে বিচিত্র সব স্টাইলের সৃষ্টি হয়। কোনো চমৎকার উদ্ভাবন সাধারণ মানুষের কাছে সহজলভ্য হলে তারা পুরো সমাজকেই বদলে দিতে পারে এর একটি উদাহরণ হলো বলপয়েন্ট কলম।

ফেলে দেওয়া কলমে নতুন সমস্যা
পৃথিবীজুড়ে বিশাল কলমের বাজার, এর বিপুল ব্যবহার জন্ম দিয়েছে বেশ কিছু সমস্যার। কোটি কোটি সস্তা কলম যাদের রিফিল করা যায় না তারা জন্ম দিচ্ছে প্রচুর পরিমাণ বর্জ্যের। পৃথিবীজুড়ে প্রতিবছর প্রায় ১০০ বিলিয়ন বলপয়েন্ট কলমের শেষ ঠিকানা হয় বর্জ্যস্তুপে, আর প্লাস্টিক বর্জ্যের বড় অংশের শেষ ঠিকানা সমুদ্রে। সেখানে কলমের প্লাস্টিক অন্যদের মতোই তাপে চাপে ভেঙে ক্ষতিকর 'মাইক্রো প্লাস্টিক পার্টিকেল' জন্ম দিচ্ছে। মানুষ এবং সামুদ্রিক বাস্তুসংস্থানের জন্য মারাত্মক ক্ষতিকর এই মাইক্রো প্লাস্টিক পার্টিকেল। বিক তাদের কলম বানাতে ৭৪ শতাংশ পর্যন্ত রিসাইকেল করা প্লাস্টিক ব্যবহার করছে। নিজেদের ব্র্যান্ড মূল্য বাড়াতে অনেক বড় কোম্পানিই এই কাজ করছে, তবে বেশিরভাগ কোম্পানিই সমস্যার মূলে যেতে চায় না।


আমাদের ফেলে দেওয়া কলম জন্ম দিচ্ছে নতুন সমস্যার; Image Source: eastcoastdaily.in
অর্থাৎ, রিসাইকেল করা প্লাস্টিক ব্যবহার করে এমন কলম বানাচ্ছে যা এক সপ্তাহ পুরোদমে ব্যবহারের পর বর্জ্য হিসেবে আবার ছুঁড়ে ফেলতে হবে। তাই পরিবেশ সচেতন আর গবেষকরা বলছেন ভোক্তাদের সচেতন হওয়া জরুরী, দীর্ঘদিন ধরে আমরা ব্যবহারের পর কলম ফেলে দিতে অভ্যস্ত। কিংবা একসাথে ডজন ডজন কলম কিনতে অভ্যস্ত। সেই অভ্যাস বাদ দিয়ে রিফিল করে বারবার ব্যবহার করা যায় এমন কলম ব্যবহার করা জরুরী। বর্তমান কলমের বাজারে কলমের আয়ুষ্কাল কম, পাশাপাশি এর রিফিল খুঁজে পাওয়া কঠিন। তাই সাধারণ ভোক্তারা চাপ না দিলে সেই রিফিলও বাজারে যে সহসাই চলে আসবে তা ভাবা কঠিন। তাই বারবার ব্যবহার করা যায় এমন কলম হতে পারে বৈশ্বিক উষ্ণায়ন কমাতে একটি ছোট সচেতন পদক্ষেপ, বিশ্বজুড়ে লক্ষ কোটি মানুষ যদি নিজেদের কলম থেকেই এই পরিবর্তন শুরু করতে পারেন।

Pages: [1] 2 3 ... 23