Show Posts

This section allows you to view all posts made by this member. Note that you can only see posts made in areas you currently have access to.


Messages - 710001113

Pages: 1 2 3 [4] 5 6 ... 23
46
By Mehedi Hasan Nirob

হলিউডের চলচ্চিত্র পরিচালকদের একটি তালিকা করা হলে একদম উপরের দিকে থাকা নামগুলোর মধ্যে জেমস ক্যামেরন যে থাকবেন এটা চোখ বন্ধ করে বলে দেওয়া যায়। তবে বেশীরভাগ মানুষ তাকে শুধু পরিচালক হিসেবে চিনলেও তিনি কিন্তু তার থেকেও অনেক বেশী কিছু। কানাডিয়ান এই চলচ্চিত্র নির্মাতা একাধারে একজন প্রযোজক, চিত্রনাট্যকার, বিজ্ঞানী এবং ইঞ্জিনিয়ার। গভীর সমুদ্র নিয়েও তার অনেক কৌতুহল। নিজের বানানো সাবমেরিন দিয়ে সাগরের সবচেয়ে গভীরতম স্থান মারিয়ানা ট্রেঞ্চে ডুব দিয়ে এসেছেন। তিনি তার চলচ্চিত্রে যেসব প্রযুক্তি ব্যবহার করেন সেগুলোকে একেকটা মাইলফলক হিসেবেও ধরা যায়। অসাধারণ উদ্ভাবনী শক্তি তার অ্যাকশনধর্মী ও বৈজ্ঞানিক কল্পকাহিনীমূলক চলচ্চিত্রগুলোকে দিয়েছে নতুন মাত্রা।

এখানেই কেটেছে জেমস ক্যামেরনের শৈশব

তার জীবনের গল্পটাও কিন্তু চিত্রনাট্যের মতোই অনেকটা।

জেমস ফ্রান্সিস ক্যামেরনের জন্ম ১৯৫৪ সালে কানাডার অন্টারিওতে। তার মা ছিলেন একজন আর্টিস্ট এবং বাবা ছিলেন ইলেকট্রিক্যাল ইঞ্জিনিয়ার। তার পরিবার যখন ১৯৭১ সালে যুক্তরাষ্ট্রের ক্যালিফোর্নিয়াতে চলে আসে তখন তার বয়স ১৭ বছর। সেখানে তিনি ফুলারটন কলেজে ভর্তি হন পদার্থবিজ্ঞান পড়ার জন্য। কিন্তু সেখানে বেশীদিন টিকতে পারলেন না। এক বছর যেতে না যেতেই ড্রপ আউট হয়ে গেলেন কলেজ থেকে।

স্কুলের ল্যাবে জেমস ক্যামেরন

এরপর ট্রাক ড্রাইভারের কাজ নিলেন তিনি এবং সময় পেলে মাঝে মাঝে লেখালেখিও করতেন একটু আধটু। পরে তিনি বলেছেন এই সময়টাই ছিল তার জীবনের সবচেয়ে গুরুত্বপূর্ণ। তিনি ইউএসসি লাইব্রেরীতে নিয়মিত যেতেন এবং ফিল্ম টেকনোলজির সাথে সংশ্লিষ্ট সব ধরনের বই কিংবা থিসিস পেপার পড়ে ফেলতেন বা খাতায় নোট করে রাখতেন। এই সময়টাতে তিনি অপটিক্যাল প্রিন্টিং, ফ্রন্ট স্ক্রীন প্রজেকশন কিংবা ডাই ট্রান্সফারের মতো বিষয় নিয়ে পড়াশুনা করেছেন যা তাকে পরবর্তীতে চলচ্চিত্র পরিচালনায় বিস্তর সাহায্য করেছে।

এরপর ১৯৭৭ সালে একটি ঘটনা তার জীবনকে পুরোপুরি পাল্টে দিল। ওই বছর মুক্তি পেল বিখ্যাত চলচ্চিত্র সিরিজ স্টার ওয়ার্স এর চতুর্থ কিস্তি এ নিউ হোপ (A New Hope)। ওই চলচ্চিত্র দেখে তিনি বুঝতে পারলেন শিল্প এবং বিজ্ঞান কতটা কাছাকাছি থাকতে পারে। এরপর ট্রাক ড্রাইভারের চাকরি ছেড়ে দিয়ে ক্যামেরন ঝুঁকে পড়লেন চলচ্চিত্রের দিকে।

তিনি তার দুই বন্ধুকে নিয়ে জেনোজেনেসিস (Xenogenesis) নামে একটি ১০ মিনিটের বৈজ্ঞানিক কল্পকাহিনী স্ক্রিপ্ট লিখে ফেললেন। কিন্তু শ্যুট করার মতো যথেষ্ট টাকা তাদের হাতে নেই। শেষ পর্যন্ত বন্ধু-বান্ধবদেরকে নিয়ে চাঁদা তুলে ৩৩ মিলিমিটার ক্যামেরা, লেন্স, ফিল্ম স্টক এবং স্টুডিও ভাড়া করে ফেললেন। তারা ক্যামেরাটি পুরোটা খুলে এর বিভিন্ন অংশ পরীক্ষা করে দেখলেন এটা বোঝার জন্য যে ফিল্ম ক্যামেরা কীভাবে কাজ করে।

বলা যায় জেমস ক্যামেরন ছিলেন জেনোজেনেসিস এর পরিচালক, লেখক, প্রযোজক এবং প্রোডাকশন ডিজাইনার। এরপর তিনি রক এন্ড রোল হাই স্কুল (Rock and Roll High School) নামে একটি চলচ্চিত্রে কাজ করেন প্রোডাকশন সহকারী হিসেবে। কিন্তু এই কাজের জন্য কোনো স্বীকৃতি তিনি পাননি। তারপরও থেমে না গিয়ে চলচ্চিত্র বানানোর কায়দা-কানুন নিয়ে পড়াশুনা চালিয়ে যেতে লাগলেন। রজার কোরম্যান স্টুডিওতে একটি ক্ষুদ্রাকৃতির মডেল বানানোর কাজ শুরু করেন এই সময়টাতে। এরপর ১৯৮১ এবং ১৯৮২ এই দুই বছরে চারটি চলচ্চিত্রে আর্ট ডিজাইনার, প্রোডাকশন ডিজাইনার হিসেবে কাজ করেন।

পিরানহা মুভির সিকুয়্যাল পিরানহা-২ তে কাজ করার জন্য ইটালির রোমে যান ক্যামেরন। সেখানে ফুড পয়জনিং এর কারণে একপর্যায়ে গুরুতর অসুস্থ হয়ে পড়েন। অসুস্থ অবস্থায় একদিন রাত্রে ভয়ানক দুঃস্বপ্ন দেখলেন। দেখলেন ভবিষ্যৎ থেকে একটি রোবট পাঠানো হয়েছে তাকে খুন করার জন্য। এই স্বপ্ন থেকেই তিনি তার দ্য টারমিনেটর (The Terminator) চলচ্চিত্রের আইডিয়া পান। বলা যায় এখান থেকেই তার উত্থান শুরু হয়।

এখন পর্যন্ত জেমস ক্যামেরনের পরিচালিত চলচ্চিত্রের সংখ্যা সাতটি। তার পরিচালিত কয়েকটি চলচ্চিত্র সম্পর্কে তাহলে একটু জেনে নেওয়া যাক।
১. দ্য টারমিনেটর (১৯৮৪)

ক্যামেরন দ্য টারমিনেটর (The Terminator) চলচ্চিত্রটির জন্য চিত্রনাট্য লিখে সেটি বিক্রি করতে চেয়েছিলেন যাতে ছবিটি পরিচালনা করতে পারেন। কিন্তু কোনো প্রোডাকশন কোম্পানী তার মতো একজন অনভিজ্ঞ লোককে এরকম একটি চলচ্চিত্র পরিচালনা করার দায়িত্ব দিতে রাজি হচ্ছিল না। শেষমেশ হেমডেল পিকচার্স (Hemdale Pictures) নামে একটি কোম্পানী তাকে পরিচালকের দায়িত্ব দিতে রাজি হলো। কিন্তু এই চলচ্চিত্রটি বানানোর জন্য বাজেট ছিল খুবই কম, মাত্র ৬.৫ মিলিয়ন ডলার। অবশ্য ক্যামেরন ততদিনে শিখে গেছেন কীভাবে কম বাজেটে দক্ষতার সাথে কাজ আদায় করে নিতে হয়।

টারমিনেটরের সেটে জেমস ক্যামেরন

এই সিনেমাটিতে টারমিনেটরের ভূমিকায় অভিনয় করেন আর্নল্ড শোয়ার্জনেগার। ২০২৯ সাল থেকে তাকে অতীতে (১৯৮৪) পাঠানো হয়েছিলো সারা কনর নামে একজনকে হত্যা করার জন্য। কারণ সারা কনরের ছেলে একদিন যন্ত্রশক্তিদের বিরুদ্ধে মানব সমাজকে মুক্ত করার ক্ষেত্রে অপরিহার্য ভূমিকা পালন করবে।

সবাই ভেবেছিল এটিও হবে আর আট-দশটা সাধারণ সায়েন্স ফিকশন মুভির মতো, যা হয়ত থিয়েটারে এক সপ্তাহের বেশী টিকে থাকতে পারবে না। কিন্তু তাদের সেই ধারণাকে ভুল প্রমাণ করে দিয়ে বক্স অফিস হিট হয় টার্মিনেটর। দুর্দান্ত অ্যাকশন দৃশ্য আর দ্রুতগতিতে এগিয়ে যাওয়া কাহিনী দর্শকরা দারুণভাবে গ্রহন করে। সেই সঙ্গে শোয়ার্জনেগারের অভিনয় ছিলো আক্ষরিক অর্থেই দেখার মতো। সারা বিশ্বে ৭৮ মিলিয়ন ডলারেরও বেশী আয় করে এই সিনেমাটি।
২. এলিয়েনস (১৯৮৬)

ক্যামেরন ১৯৭৯ সালে রিডলি স্কটের এলিয়েন (Alien) সিনেমাটির একটি সিকুয়্যাল বানানোর কাজ শুরু করেন এবং এর নাম রাখেন এলিয়েনস (Aliens)।

সিনেমার প্রধান চরিত্র হচ্ছে এলেন রিপ্লে। এলেন রিপ্লেকে যখন উদ্ধার করা হয়, তখন সে দাবি করে এলিয়েনরা তাদের স্পেসশিপ ধ্বংস করে দিয়েছিল এবং শিপের বাকি সবাইকে মেরে ফেলে। কিন্তুই কেউই তার কথা বিশ্বাস করে না। একটি কলোনীকে দায়িত্ব দেয়া হয় পুরো ব্যাপারটা তদন্ত করতে। কিন্তু কোনো এক কারণে তাদের সাথে সকল যোগাযোগ বন্ধ হয়ে যায়। এরপর এলেন রিপ্লেকে পাঠানো হয় উদ্ধার অভিযানে। কিন্তু সে তখনো জানে না কি ভয়াবহ দুঃস্বপ্ন অপেক্ষা করছে তার সামনে। এভাবে এগিয়ে চলে বৈজ্ঞানিক কল্পকাহিনীমূলক এই অ্যাকশন হরর সিনেমার কাহিনী।

শ্যুটিং চলাকালীন সময়ে এলিয়েন সিনেমার কর্মকর্তাদের সাথে তার বনিবনা হচ্ছিল না। তারা মনে করতো জেমস ক্যামেরন রিডলি স্কটের মতো ভালো পরিচালক নন। এত ঝামেলার পরও সিনেমাটি বক্স অফিসে সফলতা পায়। এছাড়া বেশ কয়েকটি ক্যাটাগরীতে একাডেমি অ্যাওয়ার্ডের জন্য মনোনীত হয় এলিয়েনস সিনেমাটি।
৩. দ্য অ্যাবিস (১৯৮৯)

জেমস ক্যামেরন এই সিনেমাটির আইডিয়া পান তার হাই স্কুলের একটি বায়োলজি ক্লাস থেকে। একটি আমেরিকান সাবমেরিন ক্যারিবিয়ানে ডুবে গেলে উদ্ধারকারী একটি দল তেল কারখানার কিছু শ্রমিককে সাথে নিয়ে গভীর সমুদ্রে মিশনে যায়। গভীর সমুদ্রে তারা অদ্ভুত কিছু প্রাণীর সন্ধান পায়। এভাবে এগিয়ে যায় এই সিনেমার কাহিনী।

শুরুর দিকে এই সিনেমার বাজেট ছিল ৪১ মিলিয়ন ডলার যা দ্য অ্যাবিস (The Abyss)-কে ওই সময়ের সবচেয়ে ব্যয়বহুল সিনেমাগুলোর একটিতে পরিণত করে। সিনেমাটির সেট তৈরী করার জন্য একটি অসমাপ্ত নিউক্লিয়ার পাওয়ার প্ল্যান্ট বিল্ডিং এবং দুইটি বিশাল সাইজের ট্যাংক ব্যবহার করা হয়েছিল। এছাড়া ওই সময়ে সিনেমাটিতে এমন কিছু প্রযুক্তি ব্যবহার করা হয়েছিল যেটি হয়ত সম্ভব হয়েছে কেবল জেমস ক্যামেরনের কারণেই। ক্যামেরনের অন্য সিনেমাগুলোর তুলনায় এই সিনেমাটি অবশ্য তেমন ব্যবসা করতে পারেনি।
৪. টাইটানিক (১৯৯৭)

টাইটানিক নিয়ে জেমস ক্যামেরনের ছোটবেলা থেকেই আগ্রহ ছিল। একটা সময়ে এসে সিদ্ধান্ত নিলেন টাইটানিক ট্র্যাজেডির উপর একটি চলচ্চিত্র নির্মাণ করবেন। শুরু করলেন স্ক্রিপ্ট লেখার কাজ। সিনেমাটি বানানোর আগে ক্যামেরন আটলান্টিকের তলদেশে সত্যিকারের টাইটানিকের ফুটেজ সংগ্রহ করেন যা পরবর্তীতে মূল সিনেমায় যোগ করা হয়।

টাইটানিক জাহাজে উচ্চবিত্ত সমাজের মেয়ে রোজের সাথে নিম্নবিত্ত সমাজের ছেলে জ্যাকের প্রেম এবং ১৯১২ সালে টাইটানিকের পরিণতির পটভূমিতে নির্মিত এই চলচ্চিত্রের কাহিনীকে সাদামাটা বলা যায়। কিন্তু এই সিনেমার ভিজুয়্যাল ইফেক্ট অসাধারণ বললেও হয়তো কম বলা হয়। বিশেষ করে টাইটানিকের ডুবে যাওয়ার দৃশ্যটি অত্যন্ত দক্ষতার সাথে ফুটিয়ে তুলতে সক্ষম হয়েছিলেন তিনি। এজন্য তাকে স্কেল মডেলিং ও কম্পিউটার এনিমেশনের সাহায্য নিতে হয়েছে। চলচ্চিত্রটির প্রেমের গল্প আর প্রধান চরিত্রগুলো কাল্পনিক হলেও অনেকগুলো পার্শ্ব চরিত্র ঐতিহাসিক সত্যের ভিত্তিতে তৈরি করা হয়েছে।

টাইটানিক সিনেমার সেটে কেট উইন্সলেট এবং লিওনার্দো ডিক্যাপ্রিওকে দৃশ্য বুঝিয়ে দিচ্ছেন জেমস ক্যামেরন

এই চলচ্চিত্র তৈরীতে মোট ব্যয় হয়েছিল প্রায় ২০০ মিলিয়ন মার্কিন ডলার। তৎকালীন সময়ে এটিই ছিল পৃথিবীর সবচেয়ে বড় বাজেটের ছবি। ক্যামেরনের প্রবল উচ্চাকাঙ্খার এটি একটি উদাহরণ। প্যারামাউন্ট পিকচার্স ও টুয়েন্টিয়েথ সেঞ্চুরি ফক্সকে যৌথভাবে এই অর্থের যোগান দিতে হয়েছে। বিশাল বাজেটের কারণে মুক্তির আগেই ক্যামেরন ও তার টাইটানিককে সমালোচনার শিকার হতে হয়। সমালোচকরা ধারণা করেছিলেন ফক্স এবং প্যারামাউন্ট বিশাল লোকসানের সম্মুখীন হবে।

অস্কারের মঞ্চে জেমস ক্যমেরন

কিন্তু টাইটানিক মুক্তি পাওয়ার সাথে সাথে তাদের ধারণা ভুল প্রমাণিত হলো। কয়েক মাসের জন্য এটি বক্স অফিসের তালিকায় ছিল এক নম্বরে। পুরো বিশ্বজুড়ে টাইটানিক আয় করলো মোট ১.৮ বিলিয়ন মার্কিন ডলার যা অতীতের সব রেকর্ড ভেঙে দিয়ে সিনেমাটিকে তখন পর্যন্ত সবচেয়ে বেশী উপার্জন করা সিনেমার তালিকায় স্থান দেয়। পরবর্তীতে অবশ্য জেমস ক্যামেরনেরই অ্যাভাটার সিনেমাটি টাইটানিকের আয়ের রেকর্ড ভেঙে দেয়। ১৪টির মধ্যে ১১টি ক্যাটাগরীতেই একাডেমি পুরস্কার বা অস্কার জিতে নেয় এই সিনেমাটি। জেমস ক্যামেরন পান সেরা পরিচালকের পুরস্কার। টাইটানিক সিনেমার জ্যাকের মতোই ক্যামেরন অস্কারের মঞ্চে উঠে বলেছিলেন, “I am the king of the world!”।
৫. অ্যাভাটার (২০০৯)

পৃথিবীর মতো একটি গ্রহ যার নাম প্যানডোরা। এই গ্রহের অধিবাসীদের বলা হয় নাভি, যারা দেখতে অনেকটা মানুষের মতোই। পৃথিবীর একদল লোভী মানুষ আর নিরীহ নাভীদের মধ্য এক অসম আর সাহসী যুদ্ধ নিয়েই গড়ে উঠেছে অ্যাভাটার (Avatar) সিনেমার কাহিনী।

সিনেমাটি বানানোর পরিকল্পনা ক্যামেরন করেছিলেন সেই ১৯৯৭ সালের টাইটানিক সিনেমার পর থেকেই। এরও আগে ১৯৯৫ সালে ৮০ পৃষ্ঠার একটি খসড়া স্ক্রিপ্টও লিখে ফেলেন সিনেমাটির জন্য। কিন্তু সিনেমাটি বানানোর জন্য যে প্রযুক্তি দরকার, তা ওই সময়ে ছিল না। প্যানডোরা গ্রহটির ডিজাইন থেকে শুরু করে সিনেমার প্রায় প্রতিটি অংশই কম্পিউটার এনিমেশনের সাহায্য নিয়ে করা। দ্য পোলার এক্সপ্রেস (The Polar Express) সিনেমাটিতে পরিচালক রবার্ট জেমেকিস পারফরম্যান্স ক্যাপচার টেকনিক ব্যবহার করেছিলেন। জেমস ক্যামেরন ব্যবহার করলেন এই টেকনিকেরই অনেক উন্নত একটি ভার্সন।

অ্যাভাটার সিনেমার পরিচালনার দায়িত্বে জেমস ক্যামেরন

অ্যাভাটার সিনেমার বাজেট ছিল প্রায় ৩০০ মিলিয়ন ডলার যা টাইটানিকের বাজেট থেকেও অনেক বেশী! আর এই সিনেমাটি আয় কত করেছিলেন জানেন? সারা বিশ্ব থেকে সিনেমাটি আয় করে ২.৭৪ বিলিয়ন ডলারেরও বেশী!

অ্যাভাটারের এই জনপ্রিয়তা কারণে ২০১০ সালে হলিউডের সবচেয়ে বেশী আয় করা পরিচালকদের মধ্যে এক নম্বরে চলে আসেন জেমস ক্যামেরন। তার মোট সম্পদ তখন ২৫৭ মিলিয়ন ডলার!

জেমস ক্যামেরন সম্পর্কে সমালোচকদের প্রধান যে অভিযোগ সেটা হল তার লেখা স্ক্রিপ্টগুলোর কাহিনীর গভীরতা কম। অভিযোগ অবশ্য মিথ্যা নয়। তবে যে ধরনের সিনেমা তিনি তৈরী করেন, সেখানে কাহিনীর গভীরতা থাকা হয়ত অত আবশ্যকও নয়। এই কারণে সব জায়গায় গভীরতা খুঁজতে যাওয়া লোকেরা হতাশ হতে পারেন তার সিনেমাগুলো দেখে।

কিন্তু পরিচালক হিসেবে ক্যামেরনের সমালোচক খুব বেশী নেই। আর্টিস্টদের কাছ থেকে ষোল আনা কাজ আদায় করার ক্ষেত্রে তার জুড়ি মেলা ভার। এই কারণে তার সাথে কাজ করা অনেকের কাছেই দুঃস্বপ্নের মতো। তিনি শ্যুটিং শুরু হওয়ার আগে সবার মোবাইল ফোন বন্ধ করে রাখতে বলেন যাতে তা কাজে বিঘ্ন ঘটাতে না পারে। কোনো একটা দৃশ্য পছন্দ না হলে বারবার শ্যুট করেন। সিনেমাকে বাস্তবসম্মত করার জন্য জীবন বাজি রাখতেও দ্বিধাবোধ করেন না তিনি। টাইটানিক চলচ্চিত্রের নায়িকা কেট উইন্সলেট তো ঘোষণাই দিয়েছিলেন যে তিনি আর জেমস ক্যামেরনের কোনো সিনেমায় কাজ করবেন না।

নিজের কাজে ডুবে থাকার কারণে পরিবারকেও সময় দিতে পারেননি বেশী একটা। এ কারণে সংসারও ভেঙে গেছে তার। তাও একবার নয়, পাঁচবার!

তবুও জেমস ক্যামেরন থেমে নেই। অ্যাভাটার ২ হয়তো শিগগিরই মুক্তি পাবে। অ্যাভাটার ৩ এবং ৪ ও যে আসবে এরকম ঘোষণাও দিয়ে রেখেছেন। ৬২ বছর বয়সেও যেভাবে এগিয়ে চলেছেন তিনি, তাতে মনে হচ্ছে এটা অসম্ভব কিছু নয়। হলিউডে আরও অনেকদিন চলবে জেমস ক্যামেরনের রাজত্ব এটা নির্দ্বিধায় বলে দেওয়া যায়।

    তথ্যসূত্র

    ১. en.wikipedia.org/wiki/James_Cameron

    ২. imdb.com

    ৩. jamescamerononline.com

47
By Tawfiqur Rahman

    “ছোট ছোট জিনিস একত্র হয়েই বড় কিছুর জন্ম দেয়” – ভিনসেন্ট ভ্যান গখ

লক্ষ্য করলে দেখা যাবে, বিশ্বের প্রায় প্রতিটি বড় জিনিসের শুরু হয়েছে কোনো না কোনো ক্ষুদ্র জিনিস থেকে। কোনো একটি ক্ষুদ্র আইডিয়া, সেই সাথে ক্ষুদ্র প্রচেষ্টা- এ দুয়ের মাধ্যমেই কিন্তু জন্ম হয় বড় কিছুর।

যেমন, ১৯৯০ সালে স্টানফোর্ডের দুই ছাত্র তাদের সমস্ত কিছু বিনিয়োগ করে একটি নতুন কোম্পানি প্রতিষ্ঠা করতে চাইলেন। তখন তাদের একমাত্র চিন্তা ছিল কিভাবে সবকিছু মিলিয়ে মোটামুটি ১,৭০০ ডলার নিজেদের পকেটে নিয়ে আসা যায়, যাতে করে তারা তাদের নতুন অফিসের এক মাসের ভাড়া পরিশোধ করতে পারেন। আর তাদের নতুন অফিসটি কোথায় ছিল জানেন? তাদেরই এক বন্ধুর ফাঁকা গ্যারেজে! এখানেই ল্যারি পেইজ আর সের্গেই ব্রিন গড়ে তোলেন বিশ্বের অন্যতম বৃহৎ ইন্টারনেট ও সফটওয়্যার কোম্পানি গুগল।

স্যামসাংয়ের প্রতিষ্ঠাতা লি বিয়ং চল; Source: Wikipedia Commons

আর ঠিক এমনভাবেই ১৯৩০ সালে যখন লি বিয়ং চল দক্ষিণ কোরিয়ার ডেইগ শহরে প্রথম স্যামসাং নামের ব্যবসায়ী প্রতিষ্ঠানটি শুরু করেন তখন তার উদ্দেশ্য ছিল স্থানীয় বাজারে ছোটখাট মুদি ব্যবসা করা আর সেই সাথে স্থানীয় নানা পণ্য বাইরে রপ্তানি করা। বিভিন্ন ফ্লাগশিপ পণ্য? না, বর্তমানে স্যামসাং যেসব পণ্য তৈরি করে অতীতে কিন্তু তার ধারে কাছেও ছিল না তারা। আপনি হয়তো জানেন না, সেসময় স্যামসাংয়ের শুরু হয় নুডলস তৈরির মাধ্যমে!

স্যামসাংয়ের লোগোর বিবর্তন; Source: news.samsung.com

স্যামসাংয়ের প্রতিষ্ঠাতা লির জন্ম হয় এক ধনী পরিবারে। তাকে যখন টোকিওর ওয়াসেডা বিশ্ববিদ্যালয়ে পাঠানো হয় তখন তিনি তার গ্রাজুয়েশন শেষ না করেই আবার বাসায় ফিরে আসেন। এরপর জড়িয়ে পড়েন নানা পারিবারিক ব্যবসার সাথে। সেসময় তিনি মাত্র ৪০ জন কর্মচারী, একটি ছোট গুদাম ঘর ও কয়েকটি ট্রাক নিয়ে গড়ে তোলেন একটি ব্যবসায়ী প্রতিষ্ঠান, যার নাম দেন ‘স্যামসাং’। স্যামসাং একটি কোরিয়ান হানজা শব্দ। এখানে ‘স্যাম’ অর্থ থ্রি বা তিন এবং ‘সাং’ অর্থ স্টার বা তারা। অর্থাৎ দুয়ে মিলে এর অর্থ দাঁড়ায় ‘থ্রি স্টার’ বা তিন তারা। কোরিয়ান ভাষার ‘স্যাম’ শব্দটি দিয়ে বিশাল ও শক্তিশালী বুঝানো হয়। স্যামসাং প্রতিষ্ঠার সময় লির হাতে ছিল মাত্র ৩০,০০০ ওন (প্রায় ২৭ ডলার) আর ব্যবসার মালের মধ্যে ছিল কেবল ময়দা ও শুকনা সীফুড।

এগুলো খুব সহজেই বহন করা যেত এবং অনেক দিন ভালো থাকতো। ফলে ব্যবসার জন্য এগুলো ছিল সুবিধাজনক। ধীরে ধীরে ব্যবসা এগোতে শুরু করলো। লি তখন তার সমস্ত সঞ্চয় একেবারে বিনিয়োগ করে বিশাল পরিমাণে পণ্য কিনলেন। আর সেই সাথে দিলেন আকর্ষণীয় ছাড়। ফলে মানুষ তার পণ্যের প্রতি ঝুকলো। কয়েক দিনের মধ্যেই দেখা গেলো অসংখ্য ট্রাক নানা রকম মুদিদ্রব্য নিয়ে চীনের উদ্দেশ্য যাতায়াত করছে। আর এভাবেই শুরু হলো স্যামসাংয়ের এগিয়ে চলা।

স্যামসাংয়ের প্রস্তুতকৃত নুডলসের প্যাকেট; Source: Wikipedia Commons

স্থানীয় নানা পণ্যের পাশাপাশি এসময় স্যামসাং তাদের নিজস্ব গৃহজাত নুডলস বিক্রি করা শুরু করলো। নুডলসগুলোর প্যাকেটের গায়ে থাকতো তিনটি তারাযুক্ত প্রতীক যা ছিল তৎকালীন কোম্পানির লোগো।

এরপর ১৯৪৫ সালের শুরু হওয়া যুদ্ধ ও রাজনৈতিক বিশৃঙ্খলার ফলে স্যামসাংকে নানা দুর্ভোগ পোহাতে হয়। দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধের পর কোরিয়ায় জাপানী ঔপনিবেশিক শাসনের পতন ঘটে। এসময় বিচক্ষণ ও দূরদর্শী লি তার কোম্পানির সদরদপ্তর সরিয়ে সিউলে নিয়ে আসেন। নানা পদের নানা দরকারি মানুষের সাথে লির ছিল ঘনিষ্ঠ সম্পর্ক। ফলে নানা বিপদ ও আসন্ন কোরিয়ান যুদ্ধের মধ্য দিয়েও তিনি স্যামসাংকে এগিয়ে নিয়ে যান। এসময় সিউলে আক্রমণ হলে তিনি আবার তার কোম্পানির সদরদপ্তর সিউল থেকে উত্তর কোরিয়াতে নিয়ে যান। সেইসাথে তিনি বুসান শহরে একটি চিনির কল স্থাপন করেন।

১৯৫৪ সালের দিকে লি চিমসাং ডং এ একটি উলের মিল স্থাপন করেন। সেসময় এটি ছিল দেশের মধ্যে সবচেয়ে বড় উলের মিল। ১৯৪৭ সালে হিওসাং গ্রুপের প্রতিষ্ঠাতা চো হং যাই এবং লি মিলে ‘স্যামসাং মুলসান গংসা’ নামের একটি যৌথ ব্যবসায়ী প্রতিষ্ঠান গঠন করেন। ধীরে ধীরে এটি বড় হতে থাকে এবং ১৯৫১ সালে তা ‘স্যামসাং সি এন্ড টি কর্পোরেশন’ নামকরণ করা হয়। পূর্বের নানা পণ্যের পাশাপাশি লি ১৯৫০ থেকে ১৯৬০ এর মধ্যে আবাসন, জীবনবীমা, টেক্সটাইল প্রভৃতি ব্যবসা শুরু করেন। এভাবে কয়েক বছরের মধ্যেই যুদ্ধ শেষ হতে না হতেই লি বিশাল অংকের ব্যাংক ব্যালেন্স জমিয়ে ফেলেন। তবে ব্যাংক ব্যালেন্সের পাশাপাশি তার নামে দুর্নীতির অভিযোগও জমা হতে থাকে।

১৯৩০ সালে ডেইগে অবস্থিত স্যামসাংয়ের সদরদপ্তর; Source: thevintagenews.com

১৯৬১ সালে লি টোকিও থেকে ফিরে এসে নতুন সরকারের সাথে এক লেনদেনের চুক্তি করেন। পুরনো দুর্নাম ও দুর্নীতি বাদ দিয়ে স্যামসাং এসময় নতুন করে আবার সবকিছু শুরু করার পরিকল্পনা করে। লি সরকারের সাথে পরিকল্পনা করে এ সময় কোরিয়ার পাশাপাশি বিশ্ববাজারে তার ব্যবসাকে নতুনভাবে গড়ে তোলার চেষ্টায় লেগে পড়েন। ১৯৬০ এর শেষের দিকে স্যামস্যাং পেট্রোকেমিক্যালের মতো নানা ভিন্ন ভিন্ন ব্যবসা শুরু করে। শুধু তা-ই নয়, তাদের ওয়েবসাইটে দেওয়া তথ্যানুসারে ১৯৬৯ এর দিকে তারা সামরিক পোশাক ও বস্ত্র ইথিওপিয়ায় রপ্তানি শুরু করে। আর এই বছরই প্রথমবারের মতো ‘স্যামসাং ইলেক্ট্রনিক’ নামের ইলেক্ট্রনিক সামগ্রী নির্মাতা প্রতিষ্ঠান যুক্ত হয় স্যামসাং কর্পোরেশনের সাথে। এই বছরই স্যামসাং সর্বপ্রথম তাদের নিজেদের তৈরি সাদা-কালো টেলিভিশন বাজারে ছাড়ে।

সাদা-কালো টিভি নির্মাণ করছে স্যামসাংয়ের কর্মীরা; Source: news.samsung.com

১৯৭০ সালে ইলেক্ট্রনিক পণ্যের ব্যাপক জনপ্রিয়তার আভাস পেয়ে স্যামসাং ইলেক্ট্রনিক পণ্য নির্মাণের দিকে মনোযোগ দেয়। তারা তাদের সমস্ত কিছু ইলেক্ট্রনিক পণ্য নির্মাণ ও তা নিয়ে গবেষণায় বিনিয়োগ করে। ফলে গড়ে ওঠে স্যামসাং ইলেক্ট্রনিক ডিভাইস, স্যামসাং কর্নিং, স্যামসাং ইলেক্ট্রো-মেকানিক্স, স্যামসাং সেমিকন্ডাক্টর এবং স্যামসাং টেলিকমিউনিকেশনের মতো নানা শাখা। আর এসব শাখার মাধ্যমেই ধীরে ধীরে স্যামসাং হয়ে ওঠে বিশ্বের সবচেয়ে শক্তিশালী ইলেক্ট্রনিক ব্রান্ডগুলোর মধ্যে অন্যতম।

স্যামসাংয়ের তৈরি প্রথম কম্পিউটার; Source: Wikipedia Commons

এভাবে নুডলস থেকে শুরু করে স্মার্টফোন নির্মাতা প্রতিষ্ঠানে রূপ নেয়া স্যামসাংয়ের ২০১৪ এর হিসাব অনুসারে গোটা পৃথিবীতে মোট ৮০টির বেশি দেশজুড়ে ৪,৮৯,০০০ এর বেশি কর্মচারী রয়েছে। ফোর্বসের রিপোর্ট অনুসারে গত বছর স্যামসাং প্রায় ১৭৪ বিলিয়ন ডলার মূল্যের পণ্য বিক্রয় করছে। এতে তাদের লাভ হয়েছে প্রায় ১৯ বিলিয়ন ডলার।

একজন কলেজ পালানো নুডলস প্রস্তুতকারক কি কখনো চিন্তা করতে পেরেছিলেন তার প্রতিষ্ঠিত কোম্পানি একদিন বিশ্বের সবচেয়ে মূল্যবান ও জনপ্রিয় ব্রান্ডগুলোর একটিতে পরিণত হয়ে উঠবে! লি হয়তো ভাবেননি, তবে তিনি স্বপ্ন দেখেছিলেন। আর সেই স্বপ্নকে কিভাবে বাস্তবে রূপ দিতে হবে তা জানা ছিলো লিয়ের। লি যদি সেদিন কলেজ না পালিয়ে নিজের স্বপ্নের পিছে না ছুটতেন তবে হয়তো আজ স্যামসাংয়ের যে রূপ আমরা দেখছি তা কোনো দিন দেখতে পেতাম না। তার অদম্য ইচ্ছাশক্তি আর তা বাস্তবায়নের ক্ষমতাই তার সেই নুডলসের প্যাকেটের গায়ের তিন তারাকে বাড়িয়ে লক্ষ লক্ষ তারা যুক্ত এক গ্যালাক্সির রূপ দিয়েছে, যা কিনা এখন স্যামসাং এর সবচেয়ে মূল্যবান সম্পদ।

48
By Sirajam Munir Shraban

অশুভ ও নেতিবাচক যেকোনো কিছুকেই আমরা খারাপ হিসেবে দেখি। রোগ বা অসুস্থতার মতো কোনো কিছুকেই আমরা ভালো হিসেবে দেখি না কখনো। কিন্তু মানবজাতির অস্তিত্ব থাকার পেছনে অসুস্থতার অবদান সীমাহীন। জীববিজ্ঞানের দৃষ্টিকোণ থেকে বিবেচনা করলে দেখা যাবে অসুস্থতা মানবজাতির জন্য অমূল্য আশীর্বাদ। কীভাবে? সেটা আলোচনা করতে হলে পটভূমির একটু গভীরে প্রবেশ করতে হবে।

অসুস্থতা আমাদের নিত্য দিনের সঙ্গী। ভয়ঙ্কর মাংসাশী প্রাণীরা যেমন আমাদের জন্য বিপজ্জনক, তেমনই ক্ষুদ্র পরজীবীরাও আমাদের জন্য বিপজ্জনক। চোখে দেখা যায় না এমন ক্ষুদ্র পরজীবীরাই রোগ শোকের সৃষ্টি করে। বেকায়দায় বাজে পরিস্থিতিতে পড়ে গেলে মাংসাশী প্রাণীরা হয়ে যায় জীবনের জন্য সাক্ষাৎ হুমকি। তবে পরজীবীরা এদের মতো ‘সাক্ষাৎ’ হুমকি হয় না, তারা মানুষের জন্য বিপজ্জনক, এই যা। ব্যাকটেরিয়া ভাইরাস সহ অন্যান্য পরজীবী আমাদের দেহে বসবাস করে এবং আমাদের দেহকে খেয়ে খেয়ে বেঁচে থাকে।

শিকারি প্রাণীরাও অন্য প্রাণীর দেহ খেয়ে বাঁচে, তবে তা পরজীবী থেকে ভিন্ন। শিকারিরা প্রথমে তাদের শিকারকে ধরে মেরে ফেলে, তারপর খায়। অন্যদিকে পরজীবীরা খায় সরাসরি জীবন্ত প্রাণের দেহ। পরজীবীরা তাদের পোষকের (Host) দেহের তুলনায় অনেক অনেক ক্ষুদ্র হয়। শিকারি প্রাণীরা তাদের শিকার থেকে কিছুটা বড় হয়ে থাকে। যেমন- শিকারি বিড়াল তার শিকার ইঁদুর থেকে বড়। আবার ক্ষেত্রবিশেষে শিকারিরা ছোটও হয়ে থাকে। যেমন- একটি সিংহ তার শিকার জেব্রা থেকে ছোট। তবে ছোট হবার এই পরিমাণ খুব সামান্য। সেই তুলনায় পরজীবী প্রাণী তাদের শিকার (পোষক)-এর চেয়ে অনেক অনেক বেশি ছোট।

পরজীবীরা পোষকের চেয়ে অনেক ছোট আকারের হয়; Source: Devine Art

শিকারিরা তাদের শিকারকে প্রকাশ্য দিবালোকে শিকার করে এবং খোলাখুলিভাবে খায়। অন্যদিকে পরজীবীরা তাদের পোষক দেহকে ধীরে ধীরে একটু একটু করে খায়। দেহকে জীবন্ত রাখে, ফলে তাদের খাদ্যের সরবরাহ অব্যাহত থাকে। এই প্রক্রিয়ায় পোষক হয়তো সরাসরি মরে যায় না, কিন্তু ভেতরে ভেতরে প্রচুর ক্ষতির শিকার হয়।

জীবাণুরা মাঝে মাঝে দলবদ্ধ হয়ে একসাথে আক্রমণ করে। এমন পরিস্থিতিতে দেহ তৎক্ষণাৎ অসুস্থ হয়ে পড়ে। এভাবে অসুস্থ হবার উদাহরণ হচ্ছে সর্দি বা ভাইরাসের জ্বর। পরজীবী এতোই ছোট যে খালি চোখে তাদের দেখাই যায় না। খালি চোখে দেখা যায় না এরকম পরজীবীকে জীবাণু বলা হয়। কিন্তু শুধুমাত্র ‘জীবাণু’ শব্দ দিয়ে খালি চোখে না দেখা পরজীবীর জগৎকে পুরোপুরি তুলে আনা যায় না। এই তালিকায় আছে ভাইরাস, যা ক্ষুদ্রের চেয়েও আরো ক্ষুদ্রতর, অতি অতি ক্ষুদ্র।

এরপর আছে ব্যাকটেরিয়া। এরাও ক্ষুদ্র, এদেরকেও খালি চোখে দেখা যায় না। তবে এরা ভাইরাসের চেয়ে বড়। অনেক ভাইরাস আছে যারা ব্যাকটেরিয়ার মতো ক্ষুদ্র প্রাণীর দেহকেও পোষক হিসেবে ব্যবহার করে বসবাস করে। এরপর আছে আরেকটু বড় পরজীবী, যেমন ম্যালেরিয়া। এরাও ক্ষুদ্র, এরাও ব্যাকটেরিয়ার মতো এককোষী। তবে এরা ব্যাকটেরিয়া থেকে কিছুটা বড়। ব্যাকটেরিয়া থেকে বড় হবার পরেও তারা ক্ষুদ্র। তাদেরকেও মাইক্রোস্কোপ ছাড়া দেখা যায় না।

ব্যাকটেরিয়ার আকৃতি অত্যন্ত ক্ষুদ্র। এই ক্ষুদ্র জীবের দেহে পরজীবী হিসেবে বাস করে তার চেয়েও আরো ক্ষুদ্র জিনিস ভাইরাস; Source: Public Health Image Library (PHIL)

ব্যাকটেরিয়া দ্বারা সৃষ্ট রোগের উদাহরণ হচ্ছে যক্ষ্মা, নিউমোনিয়া, হুপিং কাশি, কলেরা, ডিপথেরিয়া, কুষ্ঠ, বিষফোড়া ইত্যাদি। ভাইরাসের দ্বারা সৃষ্ট রোগের মধ্যে আছে হাম, চিকেনপক্স, পনসিকা (গলা ফুলে যায়, খুব ব্যাথা হয় এবং এটি ছোঁয়াচে), হার্পিস, জলাতঙ্ক, পোলিও, ইনফ্লুয়েঞ্জা, ঠাণ্ডা জ্বর ইত্যাদি। ম্যালেরিয়া জীবাণু ঘুম অসারতার জন্ম দেয় এবং ম্যালেরিয়া জ্বর তৈরি করে। আরো কিছু গুরুত্বপূর্ণ পরজীবী আছে। এরা মোটামুটি বড় আকারের। খালি চোখেই এদেরকে দেখা যায়। যেমন চোখের মাঝে মাঝে একধরনের কীট বসবাস করে যাদেরকে খালি চোখে দেখা যায়। এ ধরনের ক্ষতিকর পরজীবীর আক্রমণকে ঠেকিয়ে রাখার জন্য আমাদের দেহে অত্যন্ত চমৎকার ও অত্যন্ত বুদ্ধিদীপ্ত একটি প্রক্রিয়া আছে। প্রক্রিয়াটি হচ্ছে ‘রোগ প্রতিরোধ ব্যবস্থা’ বা Immune system।

আমাদের দেহের রোগ প্রতিরোধ ব্যবস্থাটি এতটাই জটিল ও ব্যাপকভাবে বিস্তৃত যে একে ভালোভাবে ব্যাখ্যা করতে গেলে স্বতন্ত্রভাবে আস্ত একটি বই লিখতে হবে। এখানে অত্যন্ত সংক্ষিপ্তভাবে এই প্রক্রিয়াটিকে ব্যাখ্যা করার চেষ্টা করবো।

দেহ যখন কোনো ক্ষতিকর পরজীবীর উপস্থিতি অনুভব করে, তখন দেহ বিশেষ ধরনের কিছু কোষ তৈরি করার কাজে লেগে যায়। উদ্দেশ্য এই কোষগুলোকে ব্যবহার করে পরজীবীর বিরুদ্ধে যুদ্ধে নামবে। রক্তের প্রবাহের মাধ্যমে এই কোষগুলো উপযুক্ত স্থানে চলে যায় এবং এরা সৈনিক হিসেবে পরজীবীর সাথে যুদ্ধে লিপ্ত হয়ে যায়। এই যুদ্ধে সাধারণত দেহের রোগ প্রতিরোধ ব্যবস্থাই জয় লাভ করে। পরজীবীরা হেরে ব্যর্থ হয়ে যায়। ফলে ব্যক্তি সুস্থ হয়ে উঠে।

(GIF) দেহে আক্রমণ হলে দেহের কিছু বিশেষ ধরনের কোষ পরজীবীর বিরুদ্ধে যুদ্ধে নামে। ছবিতে একটি পরজীবীকে ধরে শায়েস্তা করছে দেহের বিশেষ কোষ। কোনায় মরে পড়ে আছে আরেকটি বহিরাগত পরজীবী; Source: The Germ Guy/Imgur

এই ঘটনা ঘটে যাবার পর থেকে দেহ তার স্মৃতিতে ঘটনাটির কথা ‘মনে রাখে’। এই যুদ্ধে কোন ধরনের কোষ তৈরি করে সৈন্য নামানো হয়েছিল তা-ও মনে রাখে। পরবর্তীতে যখন এ ধরনের কোনো পরজীবী এসে মানুষকে আক্রমণ করে, তখন একদম অল্প সময়ের ভেতরেই দেহের রোগ প্রতিরোধ ব্যবস্থা তাদেরকে প্রতিহত করে ফেলে। কারণ দেহ আগে থেকেই জানে যে এদেরকে কীভাবে শায়েস্তা করতে হবে।

এরকম ঘটনা আমরা প্রত্যক্ষও করি। কারো যদি কখনো জল বসন্ত হয় তাহলে পরবর্তীতে কখনোই এই রোগ হয় না। কারণ শরীরের ভেতর জল বসন্তের প্রতিরোধ ব্যবস্থা তৈরি হয়ে আছে প্রথম বারেই। এখন নতুন কেউ আসলে শরীর তাকে সাথে সাথেই শনাক্ত করে ফেলবে এবং উপযুক্ত ব্যবস্থা গ্রহণ করে ঠেকিয়ে দেবে। পুরাতন পাগলেই ভাত পায়নি, নতুন পাগলের আনাগোনা!

এই আক্রমণ যখন প্রথম বার হয়েছিল, তখন শরীর তাকে চিনতে পারেনি। ব্যক্তিটি রোগে আক্রান্ত হয়েছে। শরীর ধীরে ধীরে প্রতিরোধ করেছে এবং তারপরে ব্যক্তি সুস্থ হয়েছে। প্রথমবার অচেনা ছিল বলে আক্রান্ত হয়েছে। কিন্তু পরেরবার তো আর অচেনা নয়, তাই এবারে রোগ প্রতিরোধ ব্যবস্থা আর ক্ষতি করার সুযোগ দেবে না। কেউ কেউ মনে করে ছোটবেলায় এ ধরনের রোগগুলো হয়ে যাওয়া ভালো। ছোটবেলাতেই যদি এই রোগগুলোর প্রতি শরীরের প্রতিরোধ গড়ে উঠে, তাহলে বড় হয়ে আর ভয় থাকে না। কারণ এ ধরনের রোগ বড় অবস্থায় হলে ক্ষতি ও অসুবিধার পরিমাণ হয় বেশি।

চিকেন পক্স একবার হয়ে গেলে পরে আর হয় না; Source: WikiSickness

ভ্যাকসিন নামে একটি চিকিৎসা পদ্ধতি আছে। এই পদ্ধতি উপরে উল্লেখ করা প্রতিরোধ ব্যবস্থার অনুরূপ কাজ করে। এটিও চমৎকার ও বুদ্ধিদীপ্ত একটি পদ্ধতি। ভ্যাকসিনে মূলত নির্দিষ্ট রোগের জীবাণু থাকে। তবে এই জীবাণুকে কিছুটা পরিবর্তিত আকারে দেহে প্রবেশ করানো হয়। জীবাণুর শরীরের অংশবিশেষ কিংবা জীবাণুর মৃতদেহ কিংবা দুর্বল জীবাণু থাকে এক্ষেত্রে। এগুলো নির্দিষ্ট রোগের জন্য দায়ী হলেও এদের এমন পরিবর্তিত অবস্থা দেহে গিয়ে রোগ তৈরি করতে পারে না, অক্ষম। তবে অক্ষম হলেও দেহের রোগ প্রতিরোধ ব্যবস্থাকে ঠিকই নাড়িয়ে দিতে পারে।

দেহের রোগ প্রতিরোধ ব্যবস্থা এদেরকে জীবিত বা কার্যক্ষম ভেবে তাদের জন্য প্রতিরোধ তৈরি করতে শুরু করে। একবার প্রতিরোধ হয়ে গেলে পরবর্তীতে এ ধরনের আক্রমণে দেহকে আর কাবু করে ফেলতে পারবে না এই প্রজাতির জীবাণুগুলো। এই প্রক্রিয়ায় নকল জিনিস প্রবেশ করিয়ে দেহে এমন একটি প্রক্রিয়াকে সচল করা হয় যা দিয়ে আসল ভয়ঙ্কর জিনিসকে প্রতিহত করা যাবে।

জীবাণুকে পরোক্ষভাবে জীবাণু দিয়েই প্রতিহত করা হয়; Source: The Odyssey Online

কিছু কিছু ব্যাপারে সিদ্ধান্ত নিতে রোগ প্রতিরোধ ব্যবস্থার বেশ সমস্যায় পড়তে হয়। বাইরের কোন জিনিসটি দেহের জন্য ক্ষতিকর এবং কোন জিনিসটি দেহের জন্য প্রয়োজনীয় তা ‘অনুধাবন’ করতে কষ্ট হয়। কোন জিনিসটিকে আক্রমণ করে দফারফা করে ফেলা উচিৎ আর কোন জিনিসটিকে আশ্রয় দিয়ে দেহের অংশ হিসেবে মেনে নেয়া উচিৎ তার সিদ্ধান্ত নিতে বেশ সমস্যা হয়।

উদাহরণ হিসেবে একজন গর্ভবতী মায়ের কথা বিবেচনা করি। মায়ের পেটে যে নবজাতক আছে সে বহিরাগত। কারণ সন্তানের জিনের অনেক কিছুই মায়ের দেহের সাথে অমিল। সন্তানের অর্ধেক জিন আসে বাবার কাছ থেকে। এই হিসেবে সন্তানের অর্ধেক পরিমাণই হচ্ছে বহিরাগত। কিন্তু তারপরেও তার সবটাই আছে মায়ের ভেতর। রোগ প্রতিরোধ ব্যবস্থাও সন্তানকে বহিরাগত বলেই ধরে নেবে। কিন্তু অন্যদিকে সন্তানকে সবকিছু থেকে রক্ষা করাও রোগ প্রতিরোধ ব্যবস্থার কাজ। সন্তানের সাথে যুদ্ধে লিপ্ত না হওয়াও দেহের রোগ প্রতিরোধ ব্যবস্থার গুরুত্বপূর্ণ একটি কাজ।

মায়ের পেটে নবজাতক একদিক থেকে অন্তর্গত আবার আরেক দিক থেকে বহিরাগত; Source: Stimit/YouTube

বহিরাগতকে প্রতিহত করা এবং অভ্যন্তরস্থ সন্তানকে রক্ষা করা এই দোটানার সমস্যা ছিল স্তন্যপায়ী প্রাণীর বিবর্তনের ইতিহাসের অন্যতম বড় একটি সমস্যা। প্রাণিজগতে যখন গর্ভধারণের উৎপত্তি হয়, তখন এটি ছিল খুবই চ্যালেঞ্জিং। তবে এই চ্যালেঞ্জিং সমস্যাটি মোটামুটি সমাধান হয়েছিল। ভূমিষ্ঠ হবার আগ পর্যন্ত যেন গর্ভে টিকে থাকতে পারে, তার জন্য উপযুক্ত ব্যবস্থা নবজাতক শিশুর মাঝে বিবর্তিত হয়েছে। নবজাতক শিশুর দেহে এমন কিছু প্রক্রিয়া বিদ্যমান আছে যার সাহায্যে মায়ের দেহের রোগ প্রতিরোধ ব্যবস্থার আক্রমণকে ঠেকিয়ে রাখতে পারে।

কিন্তু তারপরেও কিছু সমস্যা দেখা দেয়। কিছু কিছু নবজাতক নিজেদেরকে টিকিয়ে রাখতে পারে না। আজকের যুগের এমন কিছু নবজাতকের জন্ম হয় যারা ত্রুটি নিয়ে জন্মায়। জন্মের সাথে সাথে খুব দ্রুত তাদের দেহের সকল রক্ত পাল্টে নতুন করে রক্ত দিতে হয়। মায়ের দেহের রোগ প্রতিরোধ ব্যবস্থার কর্মকাণ্ডের কারণেই এমনটা হয়। কোনো কোনো শিশু গর্ভেই মৃত্যুঝুঁকিতে থাকে। তাদেরকে বাঁচিয়ে পৃথিবীতে আনা যায় শুধুমাত্র চিকিৎসক ও উন্নত চিকিৎসা প্রযুক্তি ব্যবহারের ফলে।

মাঝে মাঝে আমাদের রোগ প্রতিরোধ ব্যবস্থা ভুলভাবে ভুল জিনিসের সাথে যুদ্ধে লিপ্ত হয়ে পড়ে। অপ্রয়োজনীয় ও ক্ষতিকর নয় এমন কিছু জিনিসের সাথে যুদ্ধে লিপ্ত হয়ে খামোখা দেহেরই ক্ষতি করে। এলার্জি মূলত এ কারণেই হয়। যেমন বাতাসে ভেসে বেড়ানো ফুলের পোলেন কণা। এরা দেহের জন্য একদমই ক্ষতিকর নয়। কিন্তু দেহের রোগ প্রতিরোধ ব্যবস্থা মনে করবে এরা খুবই ক্ষতিকর এবং এদের বিরুদ্ধে এখনই প্রতিরোধ গড়ে তোলা উচিৎ। দেহ যখন প্রতিরক্ষার মহা-সমারোহে নেমে পড়ে, তখন এলার্জির প্রভাব দেখা দেয় এবং মাঝে মাঝে এটি অত্যন্ত ভয়ানক ক্ষতিও করতে পারে। উপকার তো হয়ই না উপরন্তু দেহের আরো ক্ষতি হয়।

কেউ কেউ ফুলের প্রতি এলার্জিক; Source: Devine Art/PD07

কোনো কোনো মানুষ আছে যারা কুকুর বা বিড়ালের প্রতি এলার্জিক। এসব প্রাণীর গায়ে যে লোম আছে তার উপরের বা ভেতরের অণুগুলো মানুষের জন্য ক্ষতিকর নয়। কিন্তু মানুষের রোগ প্রতিরোধ ব্যবস্থা মনে করে এগুলো ক্ষতিকর। তাই এরা কাছে আসলেই এদের প্রতি বিরূপ প্রতিক্রিয়া দেখায় আমাদের দেহের অভ্যন্তরীণ ব্যবস্থা। এলার্জি মানুষকে মাঝে মাঝে ভয়ানক বিপদে ফেলে দিতে পারে। কিছু কিছু মানুষ আছে বাদামের প্রতি এলার্জিক। কারো কারো ক্ষেত্রে একটা মাত্র বাদাম খেলে মৃত্যু পর্যন্ত ডেকে আনতে পারে।

মাঝে মাঝে দেহের রোগ প্রতিরোধ ব্যবস্থা এতটাই আক্রমণাত্মক হয়ে যায় যে নিজের দেহের প্রতিই এলার্জিক হয়ে পড়ে! একে বলা হয় আত্ম-প্রতিরোধী রোগ (Auto-immune diseases)। অটো একটি গ্রিক শব্দ। এর অর্থ হচ্ছে আত্ম বা নিজ বা Self। আত্ম-প্রতিরোধী রোগের একটি উদাহরণ হচ্ছে মাথায় টাক পড়া। এই রোগে মাথার চুল পড়ে যায়, কারণ এক্ষেত্রে প্রতিরোধ ব্যবস্থা নিজের দেহের চুলের ফলিকলের বিরুদ্ধে যুদ্ধ ঘোষণা করে। চুলের গোড়ার ফলিকল কেটে দিলে চুল পড়ে যায়। মাথা টাক হয়।

দেহের রোগ প্রতিরোধ ব্যবস্থা বিভ্রান্ত হয়ে মাঝে মাঝে নিজের প্রতিই এলার্জিক হয়ে পড়ে। মাথায় টাক পরা এর অন্যতম উদাহরণ। ছবি: The Independent

আমাদের রোগ প্রতিরোধ ব্যবস্থা যে মাঝে মাঝে এমন অদ্ভুত আচরণ করে তাতে আসলে খুব বেশি অবাক করার মতো বিষয় নয়। কাকে আক্রমণ করবে আর কাকে ছেড়ে দেবে এ নিয়ে দোটানায় থাকতে হয় প্রতিরোধ ব্যবস্থার। একটি হরিণ যখন সবুজ মাঠে ঘাস খায়, তখনো এরকম সমস্যায় পড়ে। বাতাস বইছে এমন সময় ঘাসের আড়ালে কিছু একটা নড়ে উঠলো। হরিণ দ্বন্দ্বে পড়ে যায় এটা কি কোনো ওৎ পেতে থাকা শিকারি নাকি মামুলী একটি খরগোশের নড়াচড়ার শব্দ? দৌড় দিয়ে কি জীবন বাঁচাবো নাকি একটু ঝুঁকি নিয়ে এখানে থেকে খাবার শেষ করবো? দেহের প্রতিরোধ ব্যবস্থা ভাবে এটা কি কোনো ক্ষতিকর ব্যাকটেরিয়া নাকি নিরাপদ কোনো পোলেন কণা?

ভারসাম্য আর সাম্যাবস্থার দোটানা। সন্দেহজনক সকল কিছুর বিরুদ্ধেই কি প্রতিরোধমূলক ব্যবস্থা নেবে, নাকি কিছু কিছু ক্ষেত্রে ছাড় দেবে? প্রতিরোধের অতিরিক্ত সক্রিয়তার ফলে জন্ম নিতে পারে এলার্জি কিংবা নিজেকে ধ্বংস করে দেবার মতো পরিস্থিতি। অন্যদিকে কিছু কিছু উপাদানকে ছাড় দিলেও ভয়, এদের কেউ কেউ দেহে মারাত্মক রোগ বাধিয়ে ফেলবে।

দেহের রোগ প্রতিরোধ ব্যবস্থা দোটানায় পড়ে কোনো কিছুর বিরুদ্ধে প্রতিরোধ গড়ে তুলবে নাকি তুলবে না তার একটি গুরুত্বপূর্ণ উদাহরণ হচ্ছে ক্যানসার। ক্যানসারের প্রক্রিয়াটি বেশ অদ্ভুত কিন্তু গুরুত্বপূর্ণ। ক্যানসার হচ্ছে এমন কিছু দলছুট কোষের পথভ্রষ্ট কার্যক্রম যারা নিজেদেরকে ভুলে গেছে। তারা ভুলে গেছে তাদের কী কাজ করা উচিৎ। নিজেদের করণীয় কাজ ভুলে নিজেদের সীমা অতিক্রম করে বিভাজন অব্যাহত রাখে যে কোষ সেগুলো হচ্ছে ক্যানসার।

এ ধরনের কোষগুলো নিজের দেহের মধ্যেই আক্রমণাত্মক পরজীবীর মতো হয়ে ওঠে। এ ধরনের কোষগুলো একত্রে মিলে টিউমার গঠন করে এবং দেহের ভালো কোষগুলোকে খেয়ে খেয়ে নিঃশেষ করে। অবস্থা আরো খারাপ হয়ে গেলে এটি সীমাবদ্ধ গণ্ডি পেরিয়ে সমস্ত দেহে ছড়িয়ে পড়ে এবং নিজের দেহকে মেরে ফেলে।

ভ্রষ্ট কোষ, নিজেই নিজের দেহকে মেরে ফেলে; Source: Imgur

ক্যানসার কেন এত ভয়ঙ্কর? ক্যানসার কেন এত অপ্রতিরোধ্য? কারণ হচ্ছে আমাদের ঐ রোগ প্রতিরোধ ব্যবস্থার সিদ্ধান্ত নেবার দোটানা। এই দলছুট কোষগুলো আমাদের নিজেদের দেহের অভ্যন্তরের কোষ। এরা স্বাভাবিক কোষের তুলনায় কিছুটা পরিবর্তিত, কিন্তু তারপরেও এরা দেহেরই কোষ। যার কারণে দেহের রোগ প্রতিরোধ ব্যবস্থা সিদ্ধান্ত নিতে পারে না এদেরকে বহিরাগত জীবাণুর মতো আক্রমণ করবে নাকি দেহের স্বাভাবিক কোষের মতো সুরক্ষা দান করবে। প্রত্যেকটা পদে পদেই দুর্ভাগ্য। প্রত্যেকটা পদে পদে নেতিবাচকতা।

আর সিদ্ধান্তের দোটানায় পড়ে যায়, এর মানে হচ্ছে এরকম হলে বিজ্ঞানী-গবেষকদের দ্বারা ক্যানসারের প্রতিষেধক তৈরি করা অনেক কষ্টকর হবে। কারণ যে প্রতিষেধক দিয়ে ক্যানসার কোষ মারা হবে, সেটি দেহের স্বাভাবিক কোষকেও মেরে ফেলবে। স্বাভাবিক কোষ আর ক্যানসারের কোষ প্রায় একই। ব্যাকটেরিয়া বা এ ধরনের বহিরাগত কোষকে মেরে ফেলা সহজ। কারণ ব্যাকটেরিয়ার কোষ আমাদের দেহের কোষ থেকে আলাদা।

যে প্রক্রিয়ায় প্রয়োগ করলে ব্যাকটেরিয়া মরবে, কিন্তু তাতে দেহের কোষের কোনো সমস্যা হবে না তা ব্যবহার করা যেতে পারে। যে বিষ নিজের কোষকে মারে না, কিন্তু ক্ষতিকর ব্যাকটেরিয়াকে মেরে ফেলে, তাকে বলে এন্টিবায়োটিক। ক্যানসার কোষকে মারবে, কিন্তু সুস্থ কোষকে মারবে না এ ধরনের চিকিৎসা এখনো মানুষের হাতের নাগালে আসেনি।

ক্যানসার কোষকে মারতে গেলে দেহের সাধারণ কোষও মরে যাবে; Source: Wikimedia Commons

ক্যানসার চিকিৎসায় কেমোথেরাপি ব্যবহার করা হয়। কেমোথেরাপির মাধ্যমে ক্যানসার কোষগুলোকে বিষ প্রদান করা হয়। এতে দেহের অন্যান্য কোষও ক্ষতিগ্রস্ত হয়ে পড়ে। এ কারণেই কেমোথেরাপিতে মানুষের চুল পড়ে যায়। দেহের ক্ষতি হয় বলে সীমিত মাত্রায় এবং খুব নিয়ন্ত্রিত পদ্ধতিতে এই থেরাপি প্রদান করা হয়। যদি স্বল্প সময়ের মাঝেই বেশি থেরাপি গ্রহণ করা হয়, তাহলে তা হয়তো ক্যানসার কোষকে মারবে, তবে বেচারা রোগীকে মেরে ফেলার আগে নয়।

এই বেলায় এলার্জি সম্পর্কে একটি অনুমান বা ধারণা প্রকাশ করা যায়। আত্ম-প্রতিরোধী রোগ বা Auto-immune disease এর উৎপত্তি কি আমাদের পূর্বপুরুষদের মাধ্যমে অনেক আগে থেকে চলে আসা দেহের যুদ্ধের ফল? এমনটা হবার প্রবল সম্ভাবনা আছে। ক্যানসার বা ক্যানসারের মতো দেহজ রোগগুলোকে প্রতিহত করার জন্য দেহ এমন একটি প্রক্রিয়া আয়ত্ব করতে চাইছে যা দিয়ে নিজের ক্ষতিকর কোষগুলোর বিরুদ্ধে লড়াই করা যাবে। প্রক্রিয়াটি হয়তো এখনো স্বয়ংসম্পূর্ণ হয়নি, তাই দেহ ভুল করছে এবং মানুষ তাতে আক্রান্ত হয়ে কষ্ট পাচ্ছে।

এমন কি হতে পারে না এই কষ্টের পেছনে ভালো কিছু হবার উদ্দেশ্য আছে? এমনটা হতে পারে। কারণ ক্যানসার যখন প্রাথমিক অবস্থায় থাকে, তখন ক্ষেত্রবিশেষে দেহ তা প্রতিহত করতে পারে। দেহের প্রতিরোধ এখনো তেমন উন্নত হয়নি যা দিয়ে পরিপক্ব ক্যানসারের বিরুদ্ধে লড়াই করা যাবে। ব্যাপারটা যদিও এখনো অমীমাংসিত, তারপরেও বলা যায়- পদে পদে দুর্ভাগ্য আর অশুভ ঘটনার পেছনেও থাকতে পারে কোনো শুভ উদ্দেশ্য।

49
By Abdullah Ibn Mahmud

মিসর আর সিরিয়ার প্রথম সুলতান সালাহউদ্দিনকে পশ্চিমা বিশ্ব চেনে সালাদিন (Saladin) নামে। আইয়ুবী রাজবংশের প্রতিষ্ঠাতা সালাহউদ্দিন ক্রুসেডারদের বিরুদ্ধে চালিয়েছিলেন নানা সেনা অভিযান। তার সালতানাতের অধীনে ছিল মিসর, সিরিয়া, উত্তর ইরাক, হেজাজ, ইয়েমেন ও উত্তর আফ্রিকার কিছু অংশ- এতই বিশাল ছিল তার প্রতিপত্তি। শুধু মুসলিম ইতিহাস নয়, শত্রুর কাছেও তিনি ছিলেন সম্মানিত এক বীর। যারা বীর সালাদিন সম্পর্কে নামটি কেবল শুনেছেন, কিংবা কিংডম অফ হেভেন দেখা পর্যন্তই যাদের জ্ঞানসীমা, তাদের জন্যই আজকের এ পোস্ট; চলুন জেনে নেয়া যাক সুলতান সালাহউদ্দিনের জীবনের নানা দিক।

১১৮৫ সালের দিকে আঁকা সালাহউদ্দিনের ছবি © Ismail al-Jazari

১১৩৭ সালে ইরাকের বর্তমান তিকরিত এলাকায় তার জন্ম, নাম ছিল আসলে ইউসুফ। তার সম্মানসূচক উপাধি ছিল সালাহ-আদ-দ্বীন যার মানে ‘ধর্মের ন্যায়তা/পুণ্য (Righteousness)’।  কুর্দি পরিবার থেকে তিনি এসেছিলেন, আদি নিবাস মধ্যযুগীয় আর্মেনিয়ার প্রাচীন দ্বীন (Dvin) শহরে। যে রাওয়াদিয়া (Rawadiya) গোত্র থেকে তিনি এসেছিলেন সেটা ততদিনে আরবিভাষীদের সাথে মিলেমিশে একাকার হয়ে গেছে।

প্রাচীন দ্বীন শহর; Source: Wikimedia Commons

তার জন্মের পাঁচ বছর আগে, মসুলের শাসক ইমাদুদ্দিন জাঙ্কি এক যুদ্ধে পালিয়ে যাবার সময় টাইগ্রিস নদীর দ্বারা বাঁধাপ্রাপ্ত হন, তখন নদীর উল্টো পাশে তিকরিত দুর্গের রক্ষক ছিলেন সালাহউদ্দিনের বাবা নাজমুদ্দিন আইয়ুব। আইয়ুব তখন ইমাদুদ্দিনের জন্য ফেরির ব্যবস্থা করেন ও তাকে তিকরিতে আশ্রয় দেন।

তাকে আশ্রয় দেবার অপরাধে ১১৩৭ সালে (যে বছর সালাদিনের জন্ম) আইয়ুব পরিবারকে উত্তর মেসোপটিমিয়ার মিলিটারি গ্রিক গভর্নর বহিষ্কার করেন। যে রাতে তারা তিকরিত ছেড়ে চলে যাচ্ছিলেন সে রাতেই জন্ম হয় আমাদের গল্পের নায়ক ইউসুফের, যাকে বিশ্ব পরে চিনবে সালাহউদ্দিন নামে।

তবে উপকারের প্রতিদান পেলেন আইয়ুব, ইমাদুদ্দিন জাঙ্কি তার পরিবারকে মসুলে জায়গা করে দিলেন, এবং তাকে বালবেক (Baalbek) দুর্গের কমান্ডার বানিয়ে দিলেন। তবে ইমাদুদ্দিন মারা যান ১১৪৬ সালে, তার ছেলে নুরুদ্দীন তার জায়গা নেন এরপর।

ততদিনে সালাহুদ্দিন বাস করতে শুরু করেছেন দামেস্কে। তার ছোটবেলার খুব একটা কথা জানা যায় না, তবে দামেস্ক শহরটাকে বেশ ভালোবাসতেন তিনি। সালাহউদ্দিন ইউক্লিড জ্যামিতি, গণিত থেকে শুরু করে আইনও শিখে ফেলেন। কুরআন শিক্ষাও সেরে ফেলেন তখন, আর সাথে সাথে ধর্মতত্ত্ব। সেনাবাহিনীতে যোগ দেয়ার চাইতে ধর্মকর্ম নিয়ে লেখাপড়া করার ইচ্ছা বেশি ছিল তার। কিন্তু ধর্ম ছাড়াও তিনি ইতিহাসের পণ্ডিতও হয়ে যাচ্ছিলেন। আরব ইতিহাস তো জানতেনই, এমনকি আরবি ঘোড়ার বংশ-ইতিহাসও তিনি বাদ দেননি পড়তে। তিনি কুর্দি ও আরবি ভাষায় পারদর্শী ছিলেন।

দামেস্ক শহরে সালাহউদ্দিনের ভাস্কর্য; Source: Wikimedia Commons

নুরুদ্দীনের অধীনের একজন মিলিটারি কমান্ডার ছিলেন আসাদ আল দীন। তিনিই সালাহউদ্দিনের সামরিক ক্যারিয়ার শুরু করিয়ে দেন। তার প্রথম সামরিক অভিযান ছিল ২৬ বছর বয়সে। নুরুদ্দীন আসাদকে পাঠান ফাতিমী খলিফা আল-আদিদ এর উজির শাওয়ারকে সাহায্য করবার জন্য যিনি ছিলেন মিসর থেকে বিতাড়িত। সে অভিযানে সঙ্গে করে নিয়ে যান আসাদ সালাহউদ্দিনকে। মিশনটি সার্থক হয়েছিল।

ঠিক এরপরই যুদ্ধ লেগে যায় ক্রুসেডার-মিসরীয় যুক্তবাহিনীর সাথে। যুদ্ধের জায়গাটা ছিল গিজার পশ্চিমে, নীল নদের পাড়ে। সে যুদ্ধে সালাহউদ্দিন নুরুদ্দীনের বাহিনীর ডান পাশের নেতৃত্ব দেন। বলা হয়, সালাহউদ্দিনের বুদ্ধিতে প্রথমে বাহিনী হেরে যাবার ভান করে প্রস্থান করে এবং এরপর অতর্কিতে আক্রমণ করে বিজয় ছিনিয়ে আনে। এ বিজয়কে ইবনে আল-আছিরের মতে ‘ইতিহাসের অন্যতম সেরা বিজয়’ বলা হয়। এরপর সালাহউদ্দিন তার বাহিনীর অংশ নিয়ে আলেক্সান্দ্রিয়া শহরে চলে যান, এবং সে শহরের পাহারা দিতে থাকেন।

১১৯০ সালের দিকের সালাদিনের মুদ্রা; Source: Wikimedia Commons

একটু আগে বলা ফাতিমী খলিফা আল-আদিদের উজির শাওয়ারের সাথে ক্ষমতা নিয়ে দ্বন্দ্ব চলছিল আসাদের, ওদিকে জেরুজালেম রাজ্যের অ্যামালরিক দ্য ফার্স্টের সাথেও। শাওয়ার সাহায্য চাইলেন অ্যামালরিকের। কিন্তু ১১৬৯ সালে শাওয়ার নিহত হন গুপ্তঘাতকের হাতে, বলা হয় সেটি সালাহউদ্দিনের কাজই ছিল। সে বছর আসাদও মারা যান। তখন নুরুদ্দীন আসাদের একজন স্থলাভিষিক্তকে বাছাই করলেও, উজির হিসেবে খলিফা আল-আদিদ সালাহউদ্দিনকেই নিয়োগ দিলেন ২৬ মার্চ। প্রসঙ্গত উল্লেখ্য, আল আদিদ একজন শিয়া খলিফা ছিলেন, তাই উজির হিসেবে সুন্নি সালাহউদ্দিনকে বাছাই করাটা অবাক করা ছিল।

তবে আনুগত্য খলিফা আল-আদিদের দিকে দেবেন বেশি নাকি নুরুদ্দীনের দিকে, সেটা নিয়ে মনঃদ্বন্দ্বে ছিলেন তিনি। সে বছর, একদল মিসরীয় সেনা আর আমিরের ষড়যন্ত্রে গুপ্তহত্যার মুখে পড়েন সালাহউদ্দিন, কিন্তু গোপন সূত্রে তিনি আগেই খবর পেয়ে গিয়েছিলেন। হোতা ছিল ফাতিমী প্রাসাদের সিভিলিয়ান কন্ট্রোলার। তাকে গ্রেফতার করে হত্যা করেন সালাহউদ্দিন। পরদিন ফাতিমী বাহিনীর পঞ্চাশ হাজার কৃষ্ণবর্ণী সেনা বিরোধিতা করে সালাহউদ্দিনের। এ বিদ্রোহ দমন করতে করতে ২৩ আগস্ট চলে আসে। এরপর থেকে আর কখনো কায়রোর বিরোধিতার সম্মুখীন হতে হয়নি সালাহউদ্দিনকে।

১১৬৯ সালে নুরুদ্দীনের সহায়তায় বিশাল এক ক্রুসেডার আর্মিকে পরাজিত করেন সালাহউদ্দিন। ততদিনে কিন্তু আব্বাসীয় সুন্নি খলিফা আল মুস্তানজিদের সাথে ফাতিমী শিয়া খলিফা আল-আদিদের দ্বৈরথ তুঙ্গে। সালাহউদ্দিন তখন মিসরে নিজের ঘাঁটি শক্ত করছেন। নিজের আত্মীয়দের উচ্চপদ দিলেন তিনি। মালিকি ও নিজের শাফিই মাজহাবের জন্য কলেজ প্রতিষ্ঠা করেন সালাহউদ্দিন তার শহরে।

উনবিংশ শতকে আঁকা সালাহউদ্দিন ©Gustave Doré

মিসরে পাকাপোক্ত হবার পর ১১৭০ সালে দারুম অধিকার করে নিয়ে ক্রুসেডারদের পরাজিত করেন সালাহউদ্দিন সেখানে। গাজা থেকে তখন জেরুজালেমের শাসক অ্যামালরিক নাইটস টেম্পলারদের গ্যারিসন বের করে আনেন ও দারুমের পতন রোধ করতে আসেন। কিন্তু সালাহউদ্দিন তাদের উপেক্ষা করে গাজায় গিয়ে শহরটি অধিকার করে নেন তখন।

১১৭১ সালে নুরুদ্দীনের চিঠি পেলেন সালাহউদ্দিন, তিনি যেন মিসরে আব্বাসীয় খেলাফত প্রতিষ্ঠা করেন। শহরের শাফিঈ মাজহাবের আলেম নাজমুদ্দিন আল খাবুশানি প্রচণ্ড শিয়া বিরোধী ছিলেন, তিনিও সায় দিলেন। মিসরের কয়েকজন আমিরকে হত্যা করা হলো, তবে শিয়া খলিফা আল-আদিদকে বলা হয়েছিল যে, তাদের হত্যা করবার কারণ আসলে খলিফার বিরোধিতা করা। এরপর আল-আদিদ অসুস্থ হয়ে পড়েন, তাকে বিষ দেয়া হয়েছিল, কিন্তু কে দিয়েছিল তা জানা যায় না। অসুস্থ আল-আদিদ সালাহউদ্দিনকে অনুরোধ করেন তার শিশুদের যেন দেখে রাখেন। কিন্তু সালাহউদ্দিন না করে দেন, পাছে আব্বাসীয়রা তাকে বিশ্বাসঘাতকতার জন্য দায়ী করে। কিন্তু পরে তিনি তার নিজের এ কথার জন্য অনুতপ্ত হয়েছিলেন। ১৩ সেপ্টেম্বর মারা যান আল-আদিদ, পাঁচ দিন পর আব্বাসীয় খুতবা ঘোষিত হলো কায়রোতে, খলিফা হলেন আল-মুস্তাদি (حسن المستضی بن یوسف المستنجد)। তিনি ছিলেন সুন্নি আব্বাসীয় খলিফা।

লোহিত সাগরের তীরে আকাবার মন্ট্রিল দুর্গ আর কারাক শহর আক্রমণের জন্য সামরিক অভিযানের উদ্দেশ্যে সে বছরের ২৫ সেপ্টেম্বর মিসর ত্যাগ করলেন; সিরিয়া থেকে যোগ দিলেন নুরুদ্দীন। কিন্তু ফাতিমী ও ক্রুসেডারদের ষড়যন্ত্র নিয়ে খবর শুনতেই সালাহউদ্দিন ফিরে এলেন কায়রোতে। নুরুদ্দীন একাই গেলেন।

সালাহউদ্দিনের সবগুলো অভিযান বর্ণনা করে শেষ করা সম্ভব না এ সংক্ষিপ্ত লেখায়, তাই মূল ঘটনাগুলোই উল্লেখ করা হবে। ১১৭৪ সালের গ্রীষ্মে, নুরুদ্দীন বিশাল এক বাহিনী যোগাড় করছিলেন। কোনো এক কারণে (হয়ত নুরুদ্দীনের ক্রমঃক্রমঃ অর্থ ও সাপ্লাই চাওয়ার প্রতিউত্তর না দেয়ায়), আইয়ুবীরা ভাবতে লাগলো এ বাহিনী কি তবে কায়রো আক্রমণের জন্য? সালাহউদ্দিনকে কি হুমকি ভাবছেন নুরুদ্দীন? কিন্তু ১৫ মে, নুরুদ্দীন অসুস্থ অবস্থায় মারা যান হঠাৎ। ক্ষমতা চলে যায় তার পুত্র সালিহ ইসমাইল (as-Salih Ismail al-Malik) এর কাছে, বয়স তার মাত্র ১১।

সালাহউদ্দিনের সামনে তখন কয়েকটি অপশন। তিনি নিজেই কি ক্রুসেডারদের আক্রমণ করে বসবেন? নাকি ১১ বছরের বালকের কথার আশায় বসে থাকবেন? আচ্ছা, তিনি কি নিজেই সিরিয়া অধিকার করে নিতে পারেন না, এ বালক তো কিছু করবে না, দুনিয়ার হালহাকিকত বুঝে উঠবার বয়সই হয়নি তার এখনো- না এটা করলে মানুষ তাকে মুনাফিক ভাববে, নিজের আগের প্রভুর রাজত্ব আক্রমণ কেউ ভালো চোখে দেখবে না। ক্রুসেডের নেতৃত্ব দেবার অধিকার তখন হারাবেন সালাহউদ্দিন।

আগস্টে সালিহ ইসমাইলের অভিভাবক হিসেবে দায়িত্ব নিলেন আলেপ্পোর আমির ও ক্যাপ্টেন গুমুশ্তিগিন। তিনি তখন প্রতিদ্বন্দ্বীদের সরানোর অঙ্গীকার নিলেন, শুরুটা হবে দামেস্ক (সিরিয়ার রাজধানী বর্তমানে) দিয়ে। দামেস্কের আমির তখন আলেপ্পোর বিরুদ্ধে সাহায্য চাইলেন মসুলের সাইফ আল-দীনের কাছে, যিনি কিনা গুমুশ্তিগিনের আত্মীয়। কিন্তু সাইফ না করে দিলেন। তখন সিরিয়ানরা সালাহউদ্দিনের সাহায্য চাইলো। ব্যাপক সাহায্য নিয়ে সালাহউদ্দিন হাজির হলেন প্রিয় শহর দামেস্কে। বাবার পুরনো বাড়িতে বিশ্রাম নিলেন। চার দিন বাদে দামেস্কের সিটাডেলের দরজা খুলে দেয়া হলো। সালাহউদ্দিন তখন সিটাডেল অধিকার করে নিলেন এবং বাসিন্দাদের কৃতজ্ঞতা গ্রহণ করলেন।

এরপর নিজের ভাইকে দামেস্কের শাসক করে আলেপ্পোর দিকে এগিয়ে গেলেন তিনি। সালিহ প্রাসাদ থেকে বেরিয়ে এসে মানুষকে বললেন যেন তাকে কেউ সালাহউদ্দিনের হাতে তুলে না দেয়, কেউ যেন আত্মসমর্পণ না করে। তার অভিভাবক গুমুশ্তিগিন তখন সাহায্য চাইলেন সালাহউদ্দিনের শত্রু অ্যাসাসিনদের গ্র্যান্ডমাস্টার মাসায়েফের রাশিদ আদ্দিন সিনানের। ১১৭৫ সালের ১১ মে, ১৩ জন গুপ্তঘাতক প্রেরণ করা হলো সালাহউদ্দিনকে মারতে। কিন্তু সকলেই নিহত হয়।

অ্যাসাসিনদের হেডকোয়ার্টার সেই মাসায়েফ দুর্গ; Source: Wikimedia Commons

আবার ত্রিপলির রেইমন্ডও মুসলিম এলাকায় আক্রমণ শুরু করেন। ক্রুসেডারদের বিরুদ্ধে যুদ্ধ করতে তখন সালাহউদ্দিন পশ্চিম সিরিয়ার হমসে চলে যান, এবং অধিকার করে নেন সে শহর যুদ্ধ শেষে। এভাবে করে ১১৭৭ সালে সালাহউদ্দিনের বাহিনী এত শক্তিশালী হয়ে গেল যে ক্রুসেডারদের ত্রাস হয়ে গেলেন তিনি। ১১৮৭ সাল পর্যন্ত  তিনি ক্রুসেডারদের পাশাপাশি নিজের সাম্রাজ্যও বিস্তার করতে থাকেন। তার পতাকার নিচে এলো আলেপ্পো, দামেস্ক, মসুল ও আরো নানা শহর। মিসর, সিরিয়া ও ইয়েমেন জুড়ে প্রতিষ্ঠা হলো আইয়ুবী সাম্রাজ্য। সাম্রাজ্য বিস্তার করার সময় তিনি ক্রুসেডারদের সাথে বিভিন্ন চুক্তিতে ছিলেন যেন তার বাহিনী অন্যত্র ব্যস্ত থাকতে পারে। কিন্তু শাতিলনের রেজিনাল্ড এ চুক্তি ভঙ্গ করে বসেন।

সালাহউদ্দিনের ভাস্কর্য © কায়রো যাদুঘর

ক্রুসেডাররা জেরুজালেম অধিকার করে ছিল বহু বছর। অন্যান্য ক্রুসেডার শহরগুলো অধিকার করার পর নজর দিলেন সালাহউদ্দিন জেরুজালেমের দিকে। তিনি চাইলেন বিনা রক্তপাতে শহরটি অধিকার করবার, কিন্তু ভেতরের বাসিন্দারা জানালো, দরকার হলে এ পবিত্র শহর ধ্বংস করে দেবে তবুও মুসলিমদের কাছে হস্তান্তর করবে না। জেরুজালেমের বালিয়ান অফ ইবেলিন হুমকি দিলেন, যদি জেরুজালেমের খ্রিস্টান অধিবাসীদের মুক্তিপণের বিনিময়ে মুক্তির শর্ত মেনে না নেয়া হয় তবে ভেতরের জিম্মি পাঁচ হাজার মুসলিমদের এক এক করে হত্যা করা হবে, এবং মুসলিমদের পবিত্র মসজিদুল আকসা ও ডোম অফ দ্য রক ধ্বংস করা হবে। সালাহউদ্দিন মেনে নিলেন। খ্রিস্টানদের যে মুক্তিপণ তিনি ধার্য করলেন সেটা আজকের হিসেবে চার হাজার টাকা।

জেরুজালেমের খ্রিস্টান যাজক হেরাক্লিয়াস দান করে দিলেন অর্থ যার দ্বারা আঠারো হাজার গরিব খ্রিস্টানের মুক্তিপণের টাকা উঠল। বাকি রইল পনেরো হাজার, তাদের দাসত্ব বরণ করতে হবে।

১১৮৭ সালের সেপ্টেম্বরের ২০ তারিখ শুরু হওয়া সালাহউদ্দিনের হাত্তিন যুদ্ধফেরত ২০,০০০ সেনা কর্তৃক করা জেরুজালেম অবরোধ শেষ হয় অক্টোবরের ২ তারিখ। সেদিন আত্মসমর্পণ করে জেরুজালেম। শেষ হয়ে গেল কিংডম অফ জেরুজালেম।

জেরুজালেম জয় করে নিলেন সালাহউদ্দিন; Source: iTravelJerusalem

এর আগে যখন মুসলিমদের হারিয়ে ক্রুসেডাররা জেরুজালেম দখল করেছিল সেদিন মুসলিমদের কচুকাটা করে হাঁটু পর্যন্ত রক্তের বন্যা বয়ে দিয়েছিল তারা। তাই তারা আশংকা করছিল সালাহউদ্দিন এমনটা করবেন কিনা চুক্তিভঙ্গ করে। না, তিনি করেননি। তিনি যারা ক্ষতিপূরণ দিয়েছিল তাদের তো যেতে দিলেনই, যারা দিতে পারেনি তাদেরও বিনা মুক্তিপণে চলে যেতে দিলেন।

জেরুজালেম বিজয়ের পর সালাহউদ্দিন প্রাক্তন ইহুদী বাসিন্দাদের বললেন, তারা শহরে ইচ্ছেমত  আবার বসবাস করতে পারে।

হয়ত ভাবছেন কাহিনী এখানেই শেষ। কিন্তু না, জেরুজালেম জয় করতে গিয়ে সালাহউদ্দিন একটা বিশাল ভুল করেছিলেন, সেটি হলো, তিনি খ্রিস্টানদের টায়ার (Tyre) শহর জয় না করেই এদিকে এসেছিলেন। ইসলামে বেশি গুরুত্বপূর্ণ জেরুজালেম জয়ের জন্য তার তর সইছিল না।

জেরুজালেমের পতনের পর ইংল্যান্ডের রাজা রিচার্ড দ্য লায়নহার্টের উদ্যোগে ও অর্থায়নে শুরু হয় থার্ড ক্রুসেড (১১৮৯-১১৯১)। টায়ার শহর থেকে খ্রিস্টানরা যোগ দিল তার সাথে। আক্রা (Acre) শহরে মুসলিম বাহিনীকে পরাজিত করে রিচার্ডের বাহিনী। নারী ও শিশুসহ প্রায় তিন হাজার বন্দী মুসলিমকে হত্যা করেন রিচার্ড। এরপর ১১৯১ সালের ৭ সেপ্টেম্বর আরসুফ যুদ্ধে সালাহউদ্দিনের বাহিনীর মুখোমুখি হন রিচার্ড। সে যুদ্ধে ব্যাপক ক্ষয়ক্ষতির সম্মুখীন হন সালাহউদ্দিন, যুদ্ধক্ষেত্র ত্যাগ করতে বাধ্য হন বাহিনীসহ। রিচার্ড জাফফা শহর দখল করে নেন।

সেই আক্রা দুর্গ; Source: Visions of Travel

ওদিকে সালাহউদ্দিন মিসর ও ফিলিস্তিনের মাঝের আস্কালন শহরের নিরাপত্তা বাড়িয়ে দেন, যেন ক্রুসেডারদের হাতে এর পতন না হয়। তারা দুজন শান্তিচুক্তির পথ খুঁজতে লাগলেন। রিচার্ড প্রস্তাব দিলেন, রিচার্ডের বোন সিসিলির রানী জোয়ানকে সালাহউদ্দিনের ভাই বিয়ে করুক, আর বিয়ের উপহার হিসেবে জেরুজালেম দিয়ে দেয়া হোক। সালাহউদ্দিন এ প্রস্তাব উড়িয়ে দিলে রিচার্ড বললেন সালাহউদ্দিনের ভাই যেন খ্রিস্টান হয়ে যান।

১১৯২ সালে রিচার্ড জেরুজালেম থেকে ১২ মাইল দূরে থেকেও জেরুজালেম আক্রমণ করলেন না, বরং আস্কালনের দিকে গেলেন। ওদিকে সালাহউদ্দিন গেলেন জাফফা পুনরুদ্ধার করতে, প্রায় করেই ফেলেছিলেন, কিন্তু আস্কালান থেকে ছুটে এলেন কিং রিচার্ড এবং সালাহউদ্দিনকে পরাজিত করলেন শহরের বাইরের এক যুদ্ধে। এটাই ছিল থার্ড ক্রুসেডের শেষ যুদ্ধ। সালাহউদ্দিনকে মেনে নিতে হলো রিচার্ডের শর্তগুলো, টায়ার থেকে জাফফা পর্যন্ত ক্রুসেডারদের অধীনেই থাকবে। মেনে নিলেন যে, খ্রিস্টান তীর্থযাত্রীরা বিনা অস্ত্রে জেরুজালেম ভ্রমণ করে আসতে পারবে। তিন বছর পর্যন্ত কেউ কাউকে আক্রমণ করবে না।

কিন্তু তিন বছর আর বাঁচেননি সালাহউদ্দিন। কিং রিচার্ড চলে যাবার পর এক জ্বরে আক্রান্ত হয়ে দামেস্কে মারা গেলেন তিনি, ১১৯৩ সালের ৪ মার্চ। মৃত্যুর আগে তিনি সম্পত্তি দান করে গিয়েছিলেন গরীব দুঃখীদের। মাত্র এক স্বর্ণমুদ্রা আর চল্লিশ রৌপ্যমুদ্রা ছাড়া আর কিছুই ছিল না তার বাকি। তার জানাজা-দাফন-কাফনের টাকাটাও হচ্ছিল না। দামেস্কের উমাইয়া মসজিদের বাহিরের বাগানে তাকে দাফন করা হয়। সাত শতাব্দী পর জার্মানির রাজা দ্বিতীয় উইলহেম সালাদিনের কবরের জন্য একটি মার্বেলের শবাধার দান করেন। এখন আপনি সেখানে জিয়ারত করতে গেলে দেখতে পাবেন কবরের ওপরে দুটো শবাধার, একটি পুরনো ও আসল কাঠের, আর আরেকটি এই মার্বেলের।

তিনি পাঁচ কিংবা বারোজন পুত্র রেখে গিয়েছিলেন। তার অসংখ্য প্রজা হজ্ব করবার সৌভাগ্য ও নিরাপত্তা সালাহউদ্দিনের কল্যাণে পেলেও, সালাহউদ্দিন হজ্ব করবার সৌভাগ্য পাননি, যদিও তার পরিকল্পনা ছিল।

সালাহউদ্দিনের কবর; Source: Wikimedia Commons

ইউরোপজুড়ে সালাহউদ্দিনের নানা ঘটনা প্রচলিত ছিল, এখনো আছে। চুক্তির পর রিচার্ড আর সালাদিন একে অন্যকে অনেক উপহার দিয়েছিলেন। একবার একটা ঘটনা ঘটেছিল, এক খ্রিস্টান মহিলার তিন মাসের বাচ্চা চুরি হয়ে যায়, এবং সেই বাচ্চাকে বাজারে বিক্রি করে দেয়া হয়। খ্রিস্টানরা তাকে বলল সুলতান সালাহউদ্দিনের কাছে যেতে। মহিলাটির কষ্ট জানবার পর সালাহউদ্দিন নিজের টাকায় বাচ্চাটি কিনে নেন আবার, এবং মহিলাটিকে ফিরিয়ে দেন। সালাহউদ্দিনের দরবারে অশ্রু গড়িয়ে পড়ে মহিলার চোখ থেকে। সালাহউদ্দিন একটি ঘোড়ায় করে তাকে নিজের ক্যাম্পে পাঠিয়ে দেন।

মাইকেল হ্যামিল্টনের লস্ট হিস্টোরি বইতে আমরা জানতে পারি, ১১৯২ সালে আক্রা আক্রমণের সময় রিচার্ড অসুস্থ হয়ে পড়েন। তখন সালাহউদ্দিন শত্রু রিচার্ডের চিকিৎসার জন্য নিজের ব্যক্তিগত ডাক্তারদের পাঠিয়ে দিয়েছিলেন। জ্বর নিয়ন্ত্রণে রাখবার জন্য পাঠান বরফ, তাছাড়া ফলফলাদিও পাঠান। আরেকটি ঘটনা আমরা জানতে পারি, যখন রিচার্ড নিজের ঘোড়া হারিয়ে বিশাল মুসলিম বাহিনীর সামনে একা দাঁড়িয়ে থাকেন ময়দানে, তখন মুসলিমরা তাকে আক্রমণ করেনি। বরং, সুলতান সালাহউদ্দিন তার জন্য দুটো ঘোড়া পাঠিয়ে দেন যেন সমানে সমানে যুদ্ধ হতে পারে।

ইতিহাসের পাতা আমাদের বলে না যে, রিচার্ড কোনোদিন সালাহউদ্দিনের সাথে সামনা সামনি দেখা করেছেন, সবই হয়েছিল দূতের মাধ্যমে। কিন্তু তিনি প্রচণ্ড রকমের সম্মান করতেন সালাহউদ্দিনকে, তার সাহস ও বীর্যের তিনি খুব প্রশংসা করতেন। সালাহউদ্দিনও সম্মান করতেন রিচার্ডকে। সে যুগে একজন মুসলিমের নাম ইউরোপে সম্মানের সাথে নেয়া হচ্ছে সেটাই ছিল অবাক ব্যাপার। সালাদিন নামখানা আজও উজ্জ্বল ইতিহাসের তাম্রলিপিতে।

50
By Musavvir Mahmud Seazon

ভারতীয় উপমহাদেশের ইতিহাসের অন্যতম বিতর্কিত ঘটনা বঙ্গভঙ্গের পটভূমি, বিভিন্ন কারণ, বঙ্গভঙ্গের পর দুই বাংলার প্রতিক্রিয়া নিয়ে বলা হয়েছে আগের দুই পর্বে (পড়ুন: বঙ্গভঙ্গ: পেছনের গল্প; বঙ্গভঙ্গ: প্রতিক্রিয়া)। এবার বঙ্গভঙ্গের শেষ পর্বে থাকছে বঙ্গভঙ্গ বাতিলের পেছনের বিভিন্ন কারণ আর এর ফলে বাংলায় যেসব প্রভাব পড়েছিল সেসব নিয়ে।
বঙ্গভঙ্গ রদ

আগের পর্বে বলা হয়েছিল ১৯১০ সালের শেষের দিকে ভারতের প্রশাসনের দুটি বড় পরিবর্তনের কথা। বড়লাট লর্ড হার্ডিঞ্জ ব্রিটিশ সম্রাট ও সম্রাজ্ঞীর ভারতে আসার ঘোষণা দেন। এ সময় যাতে ভারতীয়রা, বিশেষ করে কংগ্রেস নেতৃত্ব যেন কোনো ঝামেলা না করে সে কারণে তিনি তাদের সাথে এক প্রকার আপোসে যান। কংগ্রেসের সাথে বঙ্গভঙ্গ রদের ব্যাপারে আপোসে গেলেও অন্যদিকে লর্ড হার্ডিঞ্জের মাথায় ছিল ভিন্ন এক পরিকল্পনা। বঙ্গভঙ্গ রদ করলে মুসলমানরা ক্ষিপ্ত হবে এটি জানা ছিল তার। একইসাথে বাংলাকে কেন্দ্র করে ব্রিটিশবিরোধী মনোভাব জোরদার হচ্ছিল। দুই পক্ষকে শান্ত রাখার জন্য গোপনে আরেক চাল চালেন তিনি।

পঞ্চম জর্জ; Source: Wikimedia Commons

১৯১১ সালের ২৫ আগস্ট হার্ডিঞ্জ ভারত সচিবের কাছে সুপারিশ করেন ভারতের রাজধানী কলকাতা থেকে দিল্লিতে স্থানান্তরের। এর ফলে এক ঢিলে দুই পাখি মারা যাবে। প্রথমত, বাংলাকে কেন্দ্র করে গড়ে ওঠা ভারতীয় জাতীয়তাবাদকে দমন করা যাবে। অন্যদিকে দীর্ঘদিন ভারতে মুসলিম শাসনের কেন্দ্র দিল্লিকে রাজধানী করে মুসলিমদের খুশি রাখা যাবে। একই সাথে বিহার ও উড়িষ্যাকে বাংলা থেকে পৃথক করে দুই বাংলাকে এক করার পরিকল্পনা তো ছিলই। ১৯১১ সালের ১২ ডিসেম্বর সম্রাট পঞ্চম জর্জ দিল্লির মসনদে বঙ্গভঙ্গ বাতিলের ঘোষণা করেন। ১৯১২ সালের জানুয়ারি থেকে কার্যকর হয় বঙ্গভঙ্গ রদ। একইসাথে কলকাতা হারায় রাজধানীর মর্যাদা। দুই বাংলা এক হলেও রাজধানীর মর্যাদা আর থাকে না বাংলা প্রদেশের।

দিল্লির দরবারে রাজা পঞ্চম জর্জ ও তার রানী; Source: Wikimedia Commons
বঙ্গভঙ্গ রদের কারণ

বঙ্গভঙ্গ রদের মূল কারণ ছিল হিন্দুদের বিরোধীতা, স্পষ্ট করে বলতে গেলে পশ্চিম বাংলার উঁচু শ্রেণীর হিন্দুদের বিরোধীতা। রাজনৈতিক ও অর্থনৈতিক সুবিধার কথা ভেবে হিন্দু রাজনীতিবিদ, বুদ্ধিজীবী, সাংবাদিকসহ শিক্ষিত শ্রেণী বঙ্গভঙ্গের বিরোধীতা করে। অথচ পূর্বের হিন্দুরা ঠিকই বঙ্গভঙ্গের পক্ষেই ছিল। তবে পরবর্তীতে পশ্চিমের উগ্রবাদী আন্দোলনের প্রভাব পূর্বেও পড়ে। সবচেয়ে বাজে অবস্থা হয় যখন বাংলাকে ভাগ করাকে কেন্দ্র করে উগ্র হিন্দুত্ববাদের জন্ম হয় ও হিন্দু জাতীয়তাবাদের প্রসারের চেষ্টায় মুসলমানদের সমর্থন হারায় কংগ্রেসসহ হিন্দু নেতারা।

স্বদেশী আন্দোলনের শুরুতে ব্রিটিশ পণ্য বয়কটও ব্রিটিশদের অর্থনৈতিক অচলতার সৃষ্টি করে। ব্রিটিশ কারখানাগুলোতে অচলাবস্থার সৃষ্টি হলে ব্রিটিশ ব্যবসায়ীরাও বঙ্গভঙ্গ বাতিলের জন্য সরকারকে চাপ দিতে থাকে। একইসাথে বিভিন্ন সন্ত্রাসী কর্মকান্ড এবং সাম্প্রদায়িক দাঙ্গাও ব্রিটিশ সরকারকে ভাবিয়ে তোলে। পরবর্তীতে চাপে পড়লেও বিরুদ্ধ পরিস্থিতিকে নিজেদের পক্ষে কাজে লাগায় ব্রিটিশরা। পশ্চিম বাংলাকে শান্ত করতে বঙ্গভঙ্গ রদ করে, কিন্তু একইসাথে রাজধানীও বাংলা থেকে দূরে সরিয়ে নেয়।

কলকাতা থেকে দিল্লিতে রাজধানী স্থানান্তর, দিল্লির দরবারে রাজা পঞ্চম জর্জ; Source: Wikimedia Commons

বঙ্গভঙ্গ রদের আরেকটি গুরুত্বপূর্ণ কারণ ছিল মুসলিম লীগের দুর্বলতা। মুসলিম লীগ বঙ্গভঙ্গকে স্বাগত জানালেও সাংগঠনিক দিক দিয়ে কংগ্রেসের চেয়ে দুর্বল ছিল। ফলে কংগ্রেস কলকাতা ও পশ্চিম বাংলায় হিন্দুদের বঙ্গভঙ্গের জন্য যেমন ঐক্যবদ্ধ করেছিল, মুসলিম লীগ সেরকম কিছুই করতে পারেনি বঙ্গভঙ্গকে সমর্থনের ব্যাপারে। তাদের বেশিরভাগ কার্যক্রম সীমিত ছিল বক্তৃতার মাধ্যমে বঙ্গভঙ্গকে স্বাগত জানানো। মুসলিমদের ঐক্যবদ্ধ করে বঙ্গভঙ্গকে চালু রাখা কিংবা বিরোধী দলের বিরুদ্ধে আন্দোলন করার মতো কিছু করতে পারেনি মুসলিম লীগ। ফলে কংগ্রেসের কাছে একপর্যায়ে নতি স্বীকার করতেই হয় ব্রিটিশ সরকারকে। মুসলিম লীগ নিজেদের স্বার্থে সেরকম কোনো চাপও সৃষ্টি করতে পারেনি সরকারের উপর। ফলে বঙ্গভঙ্গ বাতিল হয় স্বাভাবিকভাবেই মাত্র ছয় বছরের মাথায়।
হিন্দুদের প্রতিক্রিয়া

বঙ্গভঙ্গের সময় হিন্দুদের যে প্রতিক্রিয়া ছিল বঙ্গভঙ্গ রদের পর তাদের প্রতিক্রিয়া হয় ঠিক উল্টো। কংগ্রেস সরকারের এই সিদ্ধান্তকে স্বাগত জানায়। উগ্রপন্থী হিন্দুরা একে হিন্দু জাতীয়তাবাদের বিজয় হিসেবে প্রচার করে। কংগ্রেস সভাপতি অম্বিকাচরণ মজুমদার ব্রিটিশ সরকারকে অভিনন্দন জানান বঙ্গভঙ্গ রদের কারণে। কংগ্রেসের ইতিহাস লেখক পট্টভি সীতারাময় লিখেছেন, “১৯১১ সালে কংগ্রেসের বঙ্গভঙ্গ বিরোধী আন্দোলন জয়যুক্ত হয়েছে। বঙ্গভঙ্গ রদ করে ব্রিটিশ সরকার ভারত শাসনে ন্যায়নীতির পরিচয় দিয়েছে”।
মুসলমানদের প্রতিক্রিয়া

স্বাভাবিকভাবেই মুসলমানরা বঙ্গভঙ্গ রদের ফলে হতাশ হয়। তারা সরকারের এ সিদ্ধান্ত প্রত্যাখ্যান করে। বাংলা ছাড়াও ভারতের অন্যান্য অঞ্চলের মুসলমানরা এ ঘটনায় উদ্বিগ্ন হয়। বঙ্গভঙ্গের ফলে পূর্ব বাংলায় যে উন্নয়নের জোয়ার শুরু হয়েছিল সেটি নিয়েও সন্দিহান হয়ে পড়ে পূর্ব বাংলার জনগণ। মুসলিম লীগের নেতারা সরকারের সমালোচনা শুরু করেন। বঙ্গভঙ্গ রদে সবচেয়ে ব্যথিত হন নবাব সলিমুল্লাহ। ব্রিটিশ সরকারের বিরুদ্ধে প্রতিশ্রুতি ভঙ্গের অভিযোগ তুলে বলেন, “বঙ্গভঙ্গ রদের ফলে আমরা যে সুযোগ-সুবিধা থেকে বঞ্চিত হলাম তা আমাদের বিরাট দুঃখের কারণ। কিন্তু আমাদের দুঃখ আরো বেশি তীব্র হয়ে ওঠে যখন দেখি সরকার আমাদের সঙ্গে কোনো পরামর্শ না করে বা কোনো পূর্বাভাষ না দিয়েই এই পরিবর্তন বাস্তবায়ন করলেন”।

শেরে বাংলা এ. কে. ফজলুল হক; Source: Greatest Bangalis

বঙ্গভঙ্গ রদ ঘোষণার পর ৩০ ডিসেম্বর নবাব সলিমুল্লাহর আহবানে উভয় বাংলার নেতৃত্বস্থানীয়দের নিয়ে এক সভা করেন। সেই সভায় বঙ্গভঙ্গ বিরোধী মুসলিম নেতারাও উপস্থিত ছিলেন এবং মুসলমানদের সাথে কোনো প্রকার পরামর্শ না করে হঠাৎ করে পরিকল্পনা বাস্তবায়ন করায় সরকারের সমালোচনা করেন। মুসলিম লীগ মুসলমানদের অধিকার আদায়ের মুখপাত্রে পরীনত হয়। মুসলিম লীগের নেতৃত্বের আসে পরিবর্তন। মুহম্মদ আলী জিন্নাহ, এ. কে. ফজলুল হকের মতো নেতারা হাল ধরেন মুসলিম লীগের। ফজলুল হক ব্রিটিশ সরকারের প্রতি হুঁশিয়ারী উচ্চারণ করে বলেন মুসলমানদের দাবির প্রতি উপেক্ষা করা হলে বিপদের সম্ভাবনা আছে।
ব্রিটিশ সরকারের প্রতিক্রিয়া

বঙ্গভঙ্গ রদ করে পশ্চিম বাংলার হিন্দুদের শান্ত করতে পারলেও পূর্ব বাংলার মুসলিমদের অসন্তোষ ব্রিটিশদের আরেক সমস্যায় ফেলে। বাংলা থেকে রাজধানী দিল্লিতে নিয়ে যাওয়া বাংলার মুসলমানদের কোনো প্রভাবই ফেলেনি। লর্ড হার্ডিঞ্জ ১৯১২ সালের জানুয়ারিতে ঢাকা সফর করেন এবং মুসলিম নেতার সাথে বৈঠক করেন। তিনি তাদের আশ্বাস দেন নতুন প্রশাসনে মুসলমানদের স্বার্থ রক্ষা করা হবে। একইসাথে ঢাকায় একটি বিশ্ববিদ্যালয় প্রতিষ্ঠার আশ্বাস দেন। ড. রাসবিহারী ঘোষসহ বেশ কজন হিন্দু নেতা ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের বিরোধীতা করলেও ১৯২১ সালে ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় ঠিকই প্রতিষ্ঠা হয়। ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় পরবর্তীতে দেশের রাজনৈতিক ও সামাজিক আন্দোলনের কেন্দ্র হয়ে ওঠে।

কার্জন হল, বঙ্গভঙ্গ রদের ‘ক্ষতিপূরণ’ হিসেবে ব্রিটিশ সরকারের প্রতিশ্রুত ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের ভবন; Source: Wikimedia Commons
হিন্দু-মুসলিম ঐক্যের প্রচেষ্টা

বঙ্গভঙ্গকে কেন্দ্র করে বাংলায় হিন্দু-মুসলিম বিদ্বেষ ভয়াবহ আকার ধারণ করে। তবে বঙ্গভঙ্গ রদের পর মুসলিম লীগের নেতৃত্বে আসা নেতারা হিন্দুদের বিরোধীতার বদলে ঐক্যের চেষ্টা চালান। ফলে কংগ্রেস ও হিন্দু নেতৃবৃন্দও তাদের মনোভাব পরিবর্তন করতে বাধ্য হয়। ১৯১৩ সালে লক্ষ্ণৌতে মুসলিম লীগের বার্ষিক অধিবেশনে ভারতের জন্য স্বরাজ দাবি কর্মসূচির অন্তর্ভুক্ত করা হয়। একইসাথে হিন্দু-মুসলিম ঐক্যের ডাক দেয়া হয়। ফজলুল হক মুসলিম লীগের নেতা হবার পরেও কংগ্রেসে যোগ দেন এবং ১৯১৪ সালে কংগ্রেসের প্রাদেশিক সম্মেলনে সভাপতিত্ব করেন। অন্যদিকে মুসলিম লীগের অধিবেশনে বক্তৃতা দেন কংগ্রেসের শ্রীমতি নাইডু। ১৯১৬ সালে কংগ্রেস ও মুসলিম লীগ ভারতে স্বায়ত্তশাসন প্রতিষ্ঠার জন্য একসাথে আন্দোলনের সিদ্ধান্ত নেয়, যা ‘লক্ষ্ণৌ প্যাক্ট’ নামে পরিচিত। এর ফলে হিন্দু-মুসলমানের হারানো ঐক্য আবারো ফিরে আসতে থাকে এবং অসাম্প্রদায়িক জাতীয়তাবাদ আন্দোলনের ক্ষেত্র প্রস্তুত হয় ভারতে। একইসাথে হিন্দু-মুসলিম ঐক্য প্রমাণ করে বঙ্গভঙ্গ বিরোধী আন্দোলনের সাম্প্রদায়িক রূপ ছিল উগ্রবাদী একটি শ্রেণীর নিজেদের মতবাদকে প্রতিষ্ঠা করার চেষ্টা।

লক্ষ্ণৌ প্যাক্টের উপস্থিত কংগ্রেস ও মুসলিম লীগ নেতাদের একাংশ; Source: Pinterest

শুরুতে বঙ্গভঙ্গের উদ্যোগ ব্রিটিশরা নিয়েছিল প্রশাসনিক সুবিধার কথা ভেবে। কিন্তু ধীরে ধীরে বাংলাকে ভাগ করার পেছনে রাজনৈতিক উদ্দেশ্যেও যুক্ত হয়। পশ্চিম বাংলার ব্যাপক বিরোধীতা সত্ত্বেও ১৯০৫ সালে বঙ্গভঙ্গ কার্যকর হয়। এরপর থেকেই শুরু হয় কংগ্রেস ও হিন্দু নেতাদের আন্দোলন। অন্যদিকে পূর্ব বাংলার পিছিয়ে পড়া হিন্দু-মুসলিম উভয়ই উপকৃত হয় এর ফলে। কিন্তু একপর্যায়ে ব্রিটিশ সরকারকে হার মানতে হয় বঙ্গভঙ্গ বিরোধী আন্দোলনের কাছে। অবশ্য হার মানলেও দিল্লিতে রাজধানী স্থানান্তর করে পরিস্থিতিকে নিজেদের পক্ষেই কাজে লাগায় তারা। কিন্তু বঙ্গভঙ্গের ফলে হিন্দু-মুসলিম ঐক্যে যে দাগ পড়েছিল সেটি আর কখনোই মুছে যায়নি। কংগ্রেস ও মুসলিম লীগের প্রচেষ্টায় কিছুদিন ঐক্য থাকলেও শেষ পর্যন্ত ঐক্য টেকেনি বেশিদিন। ফলে ১৯৪৭ এ দেশ ভাগের সময় আর দুই বাংলাকে এক রাখা সম্ভব হয়নি। অথচ বাংলাকে ভাগ করা নিয়েই ঘটে গেছে কত কিছু!
তথ্যসূত্র

১. ১৯০৫ সালে বঙ্গভঙ্গ ও পূর্ববঙ্গে প্রতিক্রিয়া, মুনতাসির মামুন

২. বাংলাদেশের ইতিহাস (১৯০৫-১৯৭১), ড. আবু মোঃ দেলোয়ার হোসেন

৩. Bengal Electoral Politics and Freedom Struggle 1832-1947, Gautum Chattopadhyay

৪. The New Province of Eastern Bengal and Assam, M. K. U. Molla

৫. The History of Bengal, Volume II, Sir Jadunath Sarkar

৬. From Plassey to Partition – A History of Modern India (2004), Sekhar Bandyopadhyay

51
By Rasel Ahmed
১.

গ্রেট ইনিংস কাকে বলে? এই সংজ্ঞাটি একেকজনের চোখে একেক রকম। কারো চোখে সেঞ্চুরি করাটা গ্রেট ইনিংস, আবার কারো চোখে প্রয়োজনের সময় ৪০ রানের ইনিংসও গ্রেট।

‘বড় উপলক্ষ, প্রতিপক্ষ বড় দল, উইকেট হারিয়ে দল খাদের কিনারে, জেতার সম্ভাবনা খুবই কম’- এমন অবস্থা থেকে কেউ যদি মোটামুটি একাই দলকে রক্ষা করেন, তাহলে ৪০ রানের ইনিংসও গ্রেটের মর্যাদা পাবে। বলাই বাহুল্য, এমন ইনিংস এক জীবনে খুব বেশি খেলা সম্ভব নয়। খুব ভালো ব্যাটসম্যান হলে হয়তো হাতে গোনা ৫/৬টি। তার চেয়ে বড় কথা, এই ধরনের ইনিংস কেউ একই টুর্নামেন্টে একবারের বেশি খেলতে পারবেন না, এটাই স্বাভাবিক।

কিন্তু কোনো খেলোয়াড় যদি এক টুর্নামেন্টেই এরকম একাধিক ইনিংস খেলেন, তাহলে ইতিহাসে তাকে একটু আলাদা জায়গা দিতেই হয়। আর সেই টুর্নামেন্টটা যদি বিশ্বকাপের মতো বড় হয়, তাহলে তো কোনো কথাই নেই।

ব্যাটিং এ বিধ্বংসী ক্লুজনার; source: ESPNcricinfo

এমনই পারফর্মেন্স করে ক্রিকেটপ্রেমীদের চোখে অমর হয়ে আছেন ল্যান্স ক্লুজনার। বিশ্বকাপের মতো টুর্নামেন্টে ১৪০.৫০ গড়ে আর ১২২ স্ট্রাইক রেটে তিনি রান করেছেন ২৮১। বোলিংয়ে ২০.৫৮ গড়ে নিয়েছেন ১৭ উইকেট। টুর্নামেন্টে পেয়েছেন ম্যান অব দ্য সিরিজের পুরস্কার। কিন্তু পরিসংখ্যানের সাধ্য কী সব কিছু বোঝানোর। যদিও ‘ব্যাটিংয়ে ৪১.১০ গড় আর ৮৯.৯১ স্ট্রাইক রেটে ৩,৫৭৬ রান এবং বোলিংয়ে ১৭১ ম্যাচে ১৯২ উইকেট’ পরিসংখ্যান বিবেচনাতেও একজন অলরাউন্ডারের জন্য যথেষ্ট ভালো পারফর্মেন্স।

ওয়ানডেতে একই ম্যাচে বোলিং এবং ব্যাটিং ওপেন করেছেন এমন গুটিকয়েক ক্রিকেটারের মাঝে ক্লুজনার একজন। দলের প্রয়োজনে ১ থেকে ১০ নম্বর পজিশন পর্যন্ত ব্যাট করেছেন। ওয়ানডের সেরা অলরাউন্ডারের খুব সংক্ষিপ্ত তালিকাতেও তার নাম আসবে।

বোলিংয়েও ছিলেন প্রতিপক্ষের ভয়ের কারণ; source: ICC Cricket

অথচ জাতীয় দলে তিনি সুযোগ পেয়েছিলেন বোলার হিসেবে। ১৯৯৬/৯৭ সালের কলকাতা টেস্টের শুরুটা তার জন্য সুখকর হয়নি। এক পর্যায়ে মোহাম্মদ আজহার উদ্দিন তার ১ ওভারেই ৫টি চার মারেন। শেষ পর্যন্ত সেই ইনিংসে কোনো উইকেট পাননি ক্লুজনার। পরের ইনিংসে অবশ্য দুঃখটা ভুলে যান তিনি, ৮টি উইকেট তুলে নেন মাত্র ৬১ রানের বিনিময়ে। অভিষেকেই ১ ইনিংসে ৮টির বেশি উইকেট এখন পর্যন্ত কেউ নিতে পারেননি।

পরবর্তীতে টেস্টে ১৭৪ রানের ইনিংসও আছে তার ক্যারিয়ারে, টেস্ট সেঞ্চুরি আছে ৪টি। কিন্তু ক্লুজনার স্মরণীয় হয়ে থাকবেন বিশ্বকাপের জন্যই। কী করেছিলেন ক্লুজনার সেই বিশ্বকাপে? একটু ঘুরে আসা যাক সেসময়ে।
২.

সময়টা ১৯৯৯ সাল, ইংল্যান্ডের মাঠে বিশ্বকাপ অনুষ্ঠিত হচ্ছে। দক্ষিণ আফ্রিকা টপ ফেভারিট হিসেবে টুর্নামেন্ট শুরু করেছে। টুর্নামেন্টের বাকি দুই ফেভারিট ছিল পাকিস্তান আর অস্ট্রেলিয়া। গ্রুপের প্রথম ম্যাচে ভারতের বিরুদ্ধে ম্যাচটা সহজেই জিতে নেয় দক্ষিণ আফ্রিকা। কিন্তু এর মাঝেও ক্লুজনার তার ফর্মের একটা ঝলক দেখান। ৪ বলের ইনিংসে পরপর ৩টি চার মেরে ম্যাচ শেষ করে ফিরেন।

টেস্টেও কার্যকরী ছিলেন ক্লুজনার; source: Devid Munden/Popperfoto/Getty Images

গ্রুপের পরবর্তী ম্যাচ ছিল শ্রীলঙ্কার সাথে। সেই ম্যাচে মুরালির ঘূর্ণিতে ১২২ রানে ৮ উইকেট হারিয়ে পথ হারিয়ে ফেলে আফ্রিকা। সেখান থেকে ক্লুজনার দলকে ম্যাচে ফেরান ৪৫ বলে ৫২ রানের ইনিংস খেলে। শেষ ব্যাটসম্যান ডোনাল্ডকে নিয়ে ৩৩ রানের একটি জুটি করেন, যার মাঝে ডোনাল্ডের অবদান ছিল মাত্র ৩ রান। লো স্কোরিং ম্যাচে বোলিংয়ে ৩ উইকেট নিয়ে আফ্রিকাকে জিতিয়ে ম্যান অব দ্য ম্যাচ হন ক্লুজনার।

পরের ম্যাচেও একই দৃশ্য। ইংল্যান্ডের সাথে ১৪৮ রানেই ৭ উইকেট হারিয়ে ২০০ রানের কমে অল আউট হওয়ার শঙ্কা দেখা দেয়। কিন্তু ৪০ বলে অপরাজিত ৪৮ রান করে পথ হারানো দক্ষিণ আফ্রিকাকে আবার পথ দেখান ক্লুজনার। দল পায় ২২৫ রানের মাঝারি একটি পুঁজি। পরে বোলিংয়ে ১ উইকেট নিয়ে ম্যান অব দ্য ম্যাচ হন ক্লুজনার।

কেনিয়ার সাথে পরের ম্যাচেও ম্যান অব দ্য ম্যাচ তিনি। এবার অবশ্য ব্যাটিং করতে হয়নি, বল হাতেই তুলে নেন ৫ উইকেট। জিম্বাবুয়ের সাথে পরের ম্যাচে বোলিংয়ে পান ১ উইকেট। ব্যাটিংয়ে ক্লুজনার ৫২ রান করে অপরাজিত থাকলেও দক্ষিণ আফ্রিকা ম্যাচ হারে।

তবে প্রথমবার দক্ষিণ আফ্রিকা সেই বিশ্বকাপের অন্যতম টপ ফেভারিট পাকিস্তানের মুখোমুখি হয় সুপার সিক্স পর্বে। সেই ম্যাচে ২২০ রান তাড়া করতে গিয়ে ৫৮ রানেই ৫ উইকেট হারিয়ে ফেলে দক্ষিণ আফ্রিকা। সেই বিশ্বকাপে পাকিস্তানের বোলিং লাইন আপ ছিল দুর্দান্ত, দুইশ’রও বেশি রান করে তারা হারবে, এটা ভাবাই যেত না। ওয়াসিম, সাকলাইন, শোয়েব এর সাথে আজহার মাহমুদ আর আবদুর রাজ্জাক। কিন্তু অমন বোলিংকেও ছিন্ন-ভিন্ন করে ম্যাচ বের করে নেন সেই একজন, ল্যান্স ক্লুজনার। ৪১ বলে ৪৬ রান করে অপরাজিত থাকার পথে ওয়াসিম আর শোয়েবকে দুটি বিশাল ছয় মারেন তিনি। সাথে বোলিংয়ে ১টি উইকেট পাওয়ায় ম্যান অব দ্য ম্যাচ আবারও ক্লুজনার।

নিজের বলেই ক্যাচ ধরছেন ক্লুজনার; source: pinsdaddy

পরের ম্যাচ ছিল নিউজিল্যান্ডের সাথে, সেটাতে দক্ষিণ আফ্রিকা সেভাবে বিপদে পড়েনি। অস্ট্রেলিয়ার সাথে সুপার সিক্সের ম্যাচেও ক্লুজনার ২১ বলে ৩৬ রান করেন। কিন্তু সেই ম্যাচে পরাজয়ের মুখ দেখতে হয় দক্ষিণ আফ্রিকার।

তবে মূল ম্যাচটা হয় অস্ট্রেলিয়ার সাথে সেমিফাইনালে। মাত্র ২১৪ রানের টার্গেটে নেমে ৬১ রানেই ৪ উইকেট হারিয়ে বিপদে পড়ে যায় দক্ষিণ আফ্রিকা। ক্লুজনার যখন মাঠে নামেন, তখন ১৭৫ রানে ৬ উইকেট নেই। সবচেয়ে বড় কথা, শেন ওয়ার্ন তখন তার জীবনের অন্যতম সেরা ফর্মে বোলিং করছেন। উইকেট নেই, আস্কিং রান রেট বাড়ছে- এমন অবস্থায় তাকে ছেড়ে চলে গেলেন পোলক, তখন রান ১৮৩। এরপর মার্ক বাউচার যখন আউট হলেন, তখন ক্লুজনার বুঝে গেলেন, যা করার তাকে একাই করতে হবে। ৪৯তম ওভারের ৪র্থ বলে ম্যাকগ্রাকে উড়িয়ে মারলেন। ক্যাচ হয়ে যেত, কিন্তু টানটান মুহূর্তের স্নায়ুচাপে পড়ে পল রেইফেল মিস করে সেটিকে ছয় বানিয়ে দিলেন। গোটা ম্যাচের অনেক চড়াই-উৎড়াইয়ের পরে শেষ ওভারে দরকার হয় ৯ রান, হাতে তখন উইকেট ১ টি।

স্ট্রাইকে ক্লুজনার থাকায় সেই পরিস্থিতি সামলানোর সম্ভাবনা তখনও বেশ ভালোভাবেই ছিল। ফ্লেমিংয়ের প্রথম বলেই একটা চার মারলেন তিনি, আর দরকার ৫ বলে ৫। দ্বিতীয় বলে আরেকটা চার মারলেন। মাঠে থাকা সব অস্ট্রেলিয়ানরা মুখে হাত দিয়ে নিশ্চুপ। আর মাত্র একটি রান, তাহলেই বিশ্বকাপ ফাইনালে দক্ষিণ আফ্রিকা। কিন্তু অবিশ্বাস্যভাবে ডোনাল্ড নিজের ভুলে রান আউট হয়ে গেলেন। ক্লুজনার ১৬ বলে ৩১ রানে অপরাজিত থাকার পরেও ম্যাচ টাই হলো। টুর্নামেন্টের বাইলজ অনুযায়ী, আগের মুখোমুখি লড়াইয়ে অস্ট্রেলিয়া জয়ী থাকার কারণে টাই হওয়ার পরেও দক্ষিণ আফ্রিকা বাদ পড়ে যায়। কিন্তু ট্রাজিক হিরো হিসেবে সমগ্র বিশ্ববাসীর হৃদয় জয় করে নেন ক্লুজনার।

ঠিক এই মুহূর্তটাই বদলে দিয়েছিল ম্যাচের ভাগ্য; © PA Photos
ম্যাচের হাইলাইটস

৩.

ব্যাটসম্যান হিসেবে ক্লুজনার সবসময়ই বিধংসী ছিলেন। ক্যারিয়ারের প্রথম ওয়ানডেতে শুন্য রান করে আউট হলেও ৩য় ম্যাচেই শক্তিশালী অস্ট্রেলিয়ার বিপক্ষে অপরাজিত ৮৮ রানের একটি ইনিংস খেলেন। তবে সবাই প্রথম ক্লুজনারের জাত চেনে ১৯৯৭ সালে পাকিস্তানে অনুষ্ঠিত চার জাতির একটা টুর্নামেন্টে। এই টুর্নামেন্টের বাকি তিনটি দল ছিল পাকিস্তান, ওয়েস্ট ইন্ডিজ আর শ্রীলঙ্কা। সেই টুর্নামেন্টে ফাইনাল ম্যাচে সেই সময়ের সর্বজয়ী শ্রীলঙ্কার বিপক্ষে তিন নম্বরে নেমে ৯৯ রানের ইনিংস খেলেন ক্লুজনার।

আধুনিক টি-টুয়েন্টি যুগে তিনি একজন অসাধারণ কার্যকরী খেলোয়াড় হতেন, সেটি না বললেও চলে। তার ঘরোয়া টি-টুয়েন্টি ক্যারিয়ার সেই সাক্ষ্যই দেয়। ২০০০ সালে উইজডেনের নির্বাচিত বছরের সেরা ৫ ক্রিকেটারের একজন হন এই অলরাউন্ডার।

অবসর পরবর্তীতে শচীনের দলের হয়ে প্রীতি ম্যাচ খেলার একটি মূহুর্ত; source: Bob Levey/Getty Images

ইনজুরির জন্য ক্যারিয়ারের শেষভাগটা মনের মতো হয়নি। ২০০৪ সালে শেষ আন্তর্জাতিক ম্যাচ খেললেও ঘরোয়া ক্রিকেটে খেলে গিয়েছেন ২০১০ সাল পর্যন্ত। তবে বিশ্বকাপ ক্রিকেট যতদিন থাকবে, ক্লুজনারের কীর্তির কথা মানুষ সবসময়ই স্মরণ করবেন।

52
By MS Islam

চিকিৎসাবিজ্ঞানের যে বিস্ময়কর অগ্রগতি তা মাইক্রোবায়োলজি বা অণুজীববিজ্ঞানের হাত ধরেই এসেছে। অথচ এই অণুজীববিজ্ঞান যার হাত ধরে এসেছে সেই লিউয়েনহুককে কয়জন স্মরণ করেন আজ? যিনি ব্যাকটেরিয়া, স্পার্মাটোজোয়া, এককোষী জীবসহ আরো অনেক মৌলিক আবিষ্কার করে গেছেন তাকে নিয়ে আলোচনার অবশ্যই প্রয়োজন আছে। এই মহান জীববিজ্ঞানীকেই আজ স্মরণ করা যাক তবে।

অ্যান্টনি ভন লিউয়েনহুক; image source: todayinsci.com
শৈশব

অ্যান্টনি ভন লিউয়েনহুক ১৬৩২ সালের ২৪ অক্টোবর নেদারল্যান্ডের ছোট্ট শহর ডেলফটের এক দরিদ্র পরিবারে জন্মগ্রহণ করেন। তার বাবা ফিলিপ অ্যান্টনিজ ভন লিউয়েনহুক ছিলেন একজন সামান্য ঝুড়ি প্রস্তুতকারক। এই ঝুড়ি তৈরিতে সাহায্য করতেন তার স্ত্রী মার্গারেটা ডেল ভন ডেন বার্খ। তবে এই ঝুড়ি তৈরিও বেশিদিন চললো না। শিশু লিউয়েনহুকের দুঃখ-দুর্দশা বাড়িয়ে দিতেই যেন পরকালে পাড়ি জমালেন তার বাবা।

পাঁচ বছর বয়সে বাবাকে হারানোয় শিশু লিউয়েনহুকের ভবিষ্যৎ এক ঘোর সংকটের মধ্যে পড়ে। ফিলিপের মৃত্যুর কিছুদিন পরই লিউয়েনহুকের মা দ্বিতীয় বিয়ে করেন। সৎবাবাকে শিশু হুক কখনোই বাবা হিসেবে সহজভাবে মেনে নিতে পারেননি। তাই তিনি চলে গেলেন তার চাচার কাছে, যিনি পেশায় একজন আইনজীবী ছিলেন। সেখানে তিনি অল্পবিস্তর প্রাথমিক শিক্ষা গ্রহণ করেন। তবে প্রাতিষ্ঠানিক শিক্ষার ভাগ্য তার নেহায়েত মন্দই বলা চলে। তিনি ডাচ ছাড়া আর কোনো ভাষা শিখতে পারেননি। আর তখনকার সময়ে উচ্চশিক্ষার জন্য একাধিক ভাষায় দক্ষতা থাকা অতীব জরুরি বিষয় ছিল। এর উপর তার যখন ১৬ বছর বয়স, তখন তার সৎবাবাও মারা গেলে মায়ের দেখাশোনার দায়িত্ব তার কাঁধে পড়ে। অগত্যা জীবিকার্জনে নেমে পড়তে হলো কিশোর হুককে।
আমস্টারডামে হুক

যে বছর সৎবাবা মারা গেলেন, সে বছরই জন্মস্থান ডেলফট ছেড়ে বিখ্যাত বাণিজ্যিক শহর আমস্টারডামে পাড়ি জমান লিউয়েনহুক। সেখানে তিনি একটি টেক্সটাইল বিপণিতে কাজ করা শুরু করেন। দ্রুতই তিনি বিশ্বস্ত হয়ে ওঠেন এবং এজন্য তাকে ক্যাশিয়ার পদে উন্নীত করা হয়। ১৬৫৪ সালে তিনি এই টেক্সটাইল বিপণিতে কাজ ছেড়ে দেন এবং ডেলফট ফিরে যান। আর এই ফিরে যাওয়াই তার প্রথম এবং শেষ ফিরে যাওয়া। কারণ বাকি জীবনটা তিনি ডেলফটেই কাটিয়ে দেন।

হুক ও তার দ্বিতীয় স্ত্রী কর্নেলিয়া; image source: brookstonbeerbulletin.com

আমস্টারডাম থেকে রপ্ত করা ব্যবসায়িক দক্ষতা কাজে লাগালেন লিউয়েনহুক। তিনি নিজ শহর ডেলফটে নিজের টেক্সটাইল বিপণি খুলে বসলেন। কাপড় ছাড়াও তিনি বোতাম, চেইন, ফিতাসহ আরো অনেক আনুষঙ্গিক জিনিস বিক্রয় শুরু করেন। একই বছর বারবারা ডি মে-কে বিয়ে করেন হুক। বারবারার সাথে ১২ বছরের দাম্পত্য জীবনে তিনি ৫ সন্তানের পিতা হন, যাদের মধ্যে কেবল এক মেয়ে মেরিই বেঁচে ছিল। বাকিরা শৈশবেই মারা যায়। ১৬৬৬ সালে যখন বারবারা মারা যান, তখন হুক কর্নেলিয়াকে বিয়ে করেন। দ্বিতীয় স্ত্রীর ঘরে তার আর কোনো সন্তান হয়নি। ১৬৯৩ সালে কর্নেলিয়া মারা গেলে বাকি জীবনটা একাই কাটিয়েছিলেন হুক।

এবার হুকের ভাগ্যের চাকা ঘুরতে শুরু করলো। তার টেক্সটাইল ব্যবসা সফল হলো। কালক্রমে তিনি ডেলফটের বেশ প্রভাবশালী এবং পরিচিত ব্যক্তিত্বে পরিণত হলেন। ডেলফট কাউন্সিলের ‘মিটিং হল’ পরিচালনার সম্মানজনক দায়িত্ব তাকে দেয়া হলো। এই চাকরি থেকে তিনি বেশ ভালো বেতন পেতেন। এর বাইরেও তিনি ডেলফটের ওয়াইন ব্যবসায়ী সমিতির সুপারভাইজার হিসেবে দায়িত্ব পালন করেন যার কাজ ছিল আমদানিকৃত ওয়াইনের উপর কর বসানো।

এভাবে ব্যবসায়িক কাজকর্ম আর শহরের বিভিন্ন গুরুত্বপূর্ণ পদে আসীন হয়েই লিউয়েনহুকের জীবনের ৪০ বছর কেটে যায় কোনোরকম  বৈজ্ঞানিক কাজ ছাড়াই। একটু খটকা লাগছে কি পাঠক? কোনো বিজ্ঞানীর জীবনী পড়তে গিয়ে ভুল করে কার জীবনী পড়ছেন? যে ব্যক্তি প্রাথমিক শিক্ষার পরই আর প্রাতিষ্ঠানিক শিক্ষার সুযোগ পাননি, ব্যবসা বাণিজ্য আর শহুরে বিভিন্ন প্রতিষ্ঠানের গুরুত্বপূর্ণ কাজ তদারকি করাই যার কাজ, তিনি ব্যক্তি আবার জীববিজ্ঞানী হন কী করে?
বিজ্ঞানী হবার পথে যাত্রা গ্লাস: পার্ল ও মাইক্রোগ্রাফিয়া

লিউয়েনহুকের বৈজ্ঞানিক সাফল্য অনেকাংশেই তার উচ্চ ক্ষমতার লেন্স তৈরির উপর ভিত্তি করে। তবে তার এই লেন্স তৈরির ব্যাপারটি বেশ মজাদার। কেননা তিনি আমৃত্যু তার লেন্স তৈরির প্রকৃত উপায়টি কাউকে বলে যাননি। বললে যদি তার প্রতিযোগীরা তার চেয়ে এগিয়ে যায়! আরো মজার ব্যাপার হলো তিনি লেন্স তৈরির প্রথম ধাপ হিসেবে একবার একটি পদ্ধতির কথা সবাইকে জানিয়েছিলেন। সেই প্রক্রিয়া অনুসরণ করে অনেকেই লেন্স তৈরি করতে গিয়ে ব্যর্থ হন। পরে জানা যায় হুকের বর্ণিত সেই পদ্ধতিটি একেবারেই বানোয়াট, যা হুক তার প্রতিদ্বন্দ্বীদের বোকা বানানোর জন্যই প্রকাশ করেছিলেন!

গ্লাস পার্ল; image source: cousindiy.com

তখনকার সময়ে পোশাক শিল্পে ‘গ্লাস পার্ল’ নামক একপ্রকার সাধারণ কাঁচের লেন্স ব্যবহার করা হতো যার সাহায্যে পোশাকের গুণগত মান সহজে নির্ধারণ করা যেতো। হুক সেসব গ্লাস পার্ল নিয়ে কিছুদিন গবেষণা করেন এবং কিছুটা উন্নতি করতে সক্ষম হন। ধারণা করা হয়, এই কাজের সময়ই হুক লেন্স তৈরির প্রতি আগ্রহী হন। অন্যদিকে ১৬৬৮ সালে লিউয়েনহুক ইংল্যান্ড ভ্রমণ করেন। তখন পুরো ইংল্যান্ড জুড়ে রবার্ট হুকের ‘মাইক্রোগ্রাফিয়া’ (১৬৬৫) বইটি বেশ সাড়া ফেলেছিল। মাইক্রোগ্রাফিয়াকে বিজ্ঞানের ইতিহাসে মোড় ঘুরিয়ে দেয়া কয়েকটি বইয়ের একটি ধরা হয়। লিউয়েনহুক এই বইয়ের এক কপি নিয়ে দেশে ফিরলেন। যেহেতু হুকের ইংরেজি ভাষায় দখল ছিল না বললেই চলে, তাই তিনি মাইক্রোগ্রাফিয়া আদতে কতটুকু পড়তে পেরেছিলেন তা ভাববার বিষয়। তবে এই বইটি তার উপকারে লেগেছিল এর মধ্যে রবার্ট হুকের আঁকা চিত্রগুলোর জন্য।
লেন্স তৈরি

লিউয়েনহুকের গোলক লেন্স; image source: coreknowledge.org.uk

যদিও লিউয়েনহুক আমৃত্যু নিজের লেন্স তৈরির পদ্ধতি গোপন রেখেছিলেন, তথাপি আজকের আধুনিক প্রযুক্তির যুগে উদ্ভাবকরা তার লেন্স তৈরির পদ্ধতি উন্মোচন করে ফেলেছেন। হুক আজীবন ছোট গোলকাকার লেন্স ব্যবহার করেছেন। এই লেন্স তৈরির জন্য তিনি প্রথমেই একটি কাঁচের দন্ডের ঠিক মধ্যভাগ উত্তপ্ত করতেন। যখন কাঁচ নরম হয়ে গলতে শুরু করতো তিনি ধীরে ধীরে দন্ডটির দুই প্রান্ত পরস্পর বিপরীত দিকে টেনে গলিত কাঁচের লম্বা চিকন সুতা তৈরি করতেন। তিনি ততক্ষণ দন্ডের দুই প্রান্ত প্রসারিত করতেন যতক্ষণ না চিকন হতে হতে কাঁচের দন্ডটি মাঝখান থেকে ভেঙে যেত বা (গলিত কাঁচের সুতা) ছিঁড়ে যেতো। এরপর সেই সুতার চিকন অগ্রভাগ আবার আগুনের শিখার উপর ধরলে ঐ সুতার অগ্রভাগে ক্ষুদ্র কাঁচের গোলক সৃষ্টি হয়। গোলকটি যত ছোট হতো, এর বিবর্ধন ক্ষমতা তত বেশি হতো। প্রাথমিকভাবে এই লেন্স তিনি তার টেক্সটাইল ব্যবসার উদ্দেশ্যে তৈরি করছিলেন। কিন্তু ধীরে ধীরে (সম্ভবত মাইক্রোগ্রাফিয়া থেকে অনুপ্রাণিত হয়ে) তিনি এই লেন্স দিয়ে প্রাণ প্রকৃতিকে আরো কাছে থেকে দেখার প্রতি আকৃষ্ট হন।
লিউয়েনহুকের মাইক্রোস্কোপ

লিউয়েনহুকের মাইক্রোস্কোপ; image: ScienceBlogs.com

ব্রিটিশ বিজ্ঞানী রবার্ট হুকের কম্পাউন্ড মাইক্রোস্কোপ যেখানে ৪০ থেকে ৫০ গুণ বিবর্ধনে সক্ষম ছিল, সেখানে লিউয়েনহুকের তৈরি ছোট গোলক লেন্স দিয়ে তৈরি মাইক্রোস্কোপ প্রায় ২০০ থেকে ৩০০ গুণ বিবর্ধনে সক্ষম ছিল! তৎকালীন পরিপ্রেক্ষিতে এই মাইক্রোস্কোপ ছিল অস্বাভাবিকভাবে অগ্রসর, যা দিয়ে ১.৩৫ মাইক্রোমিটার আকারের ক্ষুদ্র বস্তুও দেখা যেত স্পষ্ট, যেখানে মানুষের দেহের রক্তকণিকার আকৃতি ৬-৮ মাইক্রোমিটার! তার এই অণুবীক্ষণ যন্ত্রের আরো একটি বিশেষত্ব হচ্ছে, এটি সর্বদাই একক লেন্সের ছিল। একাধিক লেন্স ব্যবহারের কথা হুক কখনো ভাবতেই পারেননি।
হুকের অনুপম নমুনা বিশ্লেষণ

লিউয়েনহুক তার জীবনে ৫০০ এর অধিক অণুবীক্ষণ যন্ত্র তৈরি করেছিলেন। এগুলোর কোনোটিই আজকের মাইক্রোস্কোপের সাথে তুলনীয় নয়। তথাপি আমাদের জন্য আরেকটি বিস্ময় জাগানো ব্যাপার হচ্ছে তার অণুবীক্ষণ যন্ত্রে আলোক সৃষ্টির কোনো উৎস নেই। অথচ এই মাইক্রোস্কোপের দ্বারা তিনি মানবজগতের কাছে উন্মোচিত করেছেন অণুজীবদের এক অচেনা, অজানা, বিশাল জগত!

নমুনা পরীক্ষার ক্ষেত্রে লিউয়েনহুক এতটাই এগিয়ে গিয়েছিলেন যে তার মৃত্যুর প্রায় একশ বছর পর্যন্ত আর কোনো জীববিজ্ঞানী এর বাইরে কোনো কিছু নিয়ে পরীক্ষা নিরীক্ষা বা পর্যবেক্ষণ করেননি। এক ফোঁটা রক্ত কিংবা ডোবার জল, ক্ষুদ্র কীটপতঙ্গের নিখুঁতভাবে কাটা অঙ্গ-প্রত্যঙ্গ, পেশি আর গাছগাছালির ছাল। এসব নমুনা অণুবীক্ষণ যন্ত্রে স্থাপন করার আগে তিনি এগুলো এত সূক্ষ্মভাবে কাটতেন যে এগুলোর মধ্য দিয়ে আলো চলাচল করতে পারতো। ফলে এদের ভেতরের গঠনও স্পষ্টভাবে ভেসে উঠতো তার চোখে।

প্রাতিষ্ঠানিক শিক্ষা থেকে বঞ্চিত হুক তার জীবনে বিজ্ঞান বিষয়ক পড়ালেখাও খুব একটা করেননি। তথাপি তার অর্জন অভাবনীয়। তার পর্যবেক্ষণ এতটাই মানসম্মত ছিল যে তৎকালীন বিজ্ঞানী সমাজ সেগুলো নিয়ে কোনোরকম প্রশ্ন তোলার সুযোগ পায়নি। তিনি পত্র মারফত নিজের পর্যবেক্ষণের ব্যাখ্যা ও চিত্র লন্ডনের রয়্যাল সোসাইটিতে প্রেরণ করতেন এবং রয়্যাল সোসাইটির বিজ্ঞানীরা সেগুলো দেখে বিস্ময়ে বিস্ময়াভিভূত হতেন। রয়্যাল সোসাইটির জার্নাল ‘ফিলোসফিক্যাল ট্রানজেকশনস’-এ সেগুলো প্রকাশিত হতো।
এককোষী জীব

হুকের এককোষী জীব পর্যবেক্ষণ; image source: timetoast.com

জীববিজ্ঞানের একটি অতি গুরুত্বপূর্ণ বিষয় হচ্ছে শ্রেণিবিন্যাস। যারা শ্রেণিবিন্যাস পড়েছেন, তারা অবশ্যই প্রটিস্টা জগতের অন্তর্ভুক্ত এককোষী জীব নিয়ে পড়াশোনা করেছেন। এই এককোষী জীবের বিশাল জগত যার হাত ধরে উন্মোচিত হয়, তিনিই লিউয়েনহুক। ১৬৭৪ সালে হুকের এই আবিষ্কারকে তার জীবনের শ্রেষ্ঠ আবিষ্কার বলে গণ্য করা হয়। তবে প্রাথমিকভাবে জীববিজ্ঞানীদের অনেকেই তার এই আবিষ্কার অস্বীকার করেন। ৩ বছর পর ব্রিটিশ বিজ্ঞানী রবার্ট হুক সেগুলো যাচাই করার পরই লিউয়েনহুকের আবিষ্কার স্বীকৃত হয়।
লোহিত রক্তকণিকা

লোহিত রক্তকণিকার আবিষ্কারক হিসেবে লিউয়েনহুকের নাম স্মরণ করে থাকেন অধিকাংশ মানুষ। কিন্তু লোহিত রক্তকণিকা আসলে আবিষ্কার করেন জেন সোয়ামার্ডাম। ১৬৬৮ সালে সোয়ামার্ডামের লোহিত রক্তকণিকা আবিষ্কারের ছয় বছর পর ১৬৭৪ সালে লোহিত রক্তকণিকা পর্যবেক্ষণ করেন লিউয়েনহুক। কিন্তু সোয়ামার্ডামের চেয়ে হুকের পর্যবেক্ষণ ছিল অনেক বেশি স্পষ্ট এবং বর্ণনা অধিক তথ্যবহুল। তবে তিনিই প্রথম ব্যক্তি হিসেবে লোহিত রক্তকণিকার আকৃতি সঠিকভাবে বর্ণনা করেন।
ব্যাকটেরিয়া

ব্যাকটেরিয়া; image source: NetDoctor.com

১৬৭৬ সালে লিউয়েনহুক আরো একটি যুগান্তকারী আবিষ্কার করেন। তিনি ডোবার পানিতে ব্যাকটেরিয়ার উপস্থিতি লক্ষ্য করেন। ব্যাকটেরিয়া এতই ক্ষুদ্র যে তা খালি চোখে দেখা যায় না। তিনি অনুমান করলেন যে একটি বালুর কণার সমআয়তন জায়গা পূরণ করতে ১০ হাজারের অধিক ব্যাকটেরিয়ার প্রয়োজন হবে।
আরো কিছু আবিষ্কার

১৬৭৭ সালে লিউয়েনহুক আবিষ্কার করেন স্পার্মাটোজোয়া তথা শুক্রাণু। এই আবিষ্কারের ধারাবাহিকতায় পরবর্তীতে সিদ্ধান্ত নেন যে শুক্রাণু যখন ডিম্বাণুতে প্রবেশ করে, তখনই নিষেক ঘটে। ১৬৮৩ সালে লিউয়েনহুক আরো একটি গুরুত্বপূর্ণ আবিষ্কার করেন। তিনি একপ্রকার সাদা তরল বিশিষ্ট সূক্ষ্ম কৈশিক নালী আবিষ্কার করেন, যাকে আমরা এখন লসিকানালী বলে চিনি।

স্পার্ম বা শুক্রাণু; image source: austinvasectomycenter.com

এসবের বাইরেও তিনি শূককীট এবং মাছির জীবনচক্র পর্যবেক্ষণ করেন। পার্থেনোজেনেসিস পর্যবেক্ষণকারী প্রথম ব্যক্তিও লিউয়েনহুক। এমনকি উইলিয়াম হার্ভের আবিষ্কৃত রক্ত সঞ্চালন নিয়েও তিনি পর্যবেক্ষণ করেন। লসিকানালী দিয়ে লসিকার প্রবাহ লক্ষ্য করে তিনি হার্ভের পর্যবেক্ষণ সঠিক বলে সিদ্ধান্ত জানান।
মৃত্যু

অ্যান্টনি ভন লিউয়েনহুক ২৬ আগস্ট, ১৭২৩ সালে ৯০ বছর বয়সে মৃত্যুবরণ করেন। তাকে ডেলফটের ‘ওল্ড চার্চ’ কবরস্থানে সমাধিস্থ করা হয়।

লিউয়েনহুকের জীবন ছিল চক্রাকার। একটি বিজ্ঞানমনস্ক ঐতিহ্যের পরিবারে জন্মগ্রহণ করেও তিনি বিজ্ঞান নিয়ে কোনো পড়ালেখাই করতে পারেননি। অর্জন হয়নি প্রাতিষ্ঠানিক শিক্ষাও। অথচ মৃত্যুর সময় তিনি ছিলেন পৃথিবীর অন্যতম শ্রেষ্ঠ জীববিজ্ঞানী, যিনি অনেকগুলো মৌলিক আবিষ্কার করে গেছেন। রবার্ট হুকের কোষ আবিষ্কারের ধারাবাহিকতায় লিউয়েনহুকের বৈজ্ঞানিক কর্মকান্ড বিজ্ঞানের এক নতুন দুয়ার খুলে দিয়ে যায়, যার নাম ‘মাইক্রোবায়োলজি’ বা অণুজীববিজ্ঞান। তাই মাইক্রোবায়োলজির জনক হিসেবে তার অবদান ইতিহাসের পাতায় অম্লান হয়ে থাকবে।

53
By Shamsun Nahar

    “লোকে বলে বলেরে, ঘর বাড়ি ভালা নায় আমার
    কি ঘর বানাইমু আমি, শূন্যের-ই মাঝার
    ভালা করি ঘর বানাইয়া, কয় দিন থাকমু আর
    আয়না দিয়া চাইয়া দেখি, পাকনা চুল আমার”

এই গান শোনেনি, এমন মানুষের সংখ্যা অনেক কম। গানের রচয়িতা মরমী কবি এবং বাউল হাসন রাজা। দেশ, জাতি, ধর্ম এবং লিঙ্গ নির্বিশেষে সকল মানুষের একটি ধর্ম রয়েছে, যাকে মানবতা বলে। এই মানবতা সাধনার একটি রুপ হলো মরমী সাধনা। যে সাধনা হাসন রাজার গান এবং দর্শনে পাওয়া যায়। তিনি সর্বমানবিক ধর্মীয় চেতনার এক লোকায়ত ঐক্যসূত্র রচনা করেছেন। তাঁর রচিত গানগুলো শুনলে মনের মাঝে আধ্যাত্মবোধের জন্ম হয়। এক সময়কার প্রতাপশালী অত্যাচারী জমিদার হাসন কীভাবে একজন দরদী জমিদার এবং মরমিয়া কবি ও বাউল সাধক হলেন, চলুন শুনে নেই সেই কাহিনী।

সুনামগঞ্জের লক্ষণশ্রী পরগণার তেঘরিয়া  গ্রামে এই মরমিয়া কবির জন্ম। ৭ পৌষ ১২৬১ ও ২১ ডিসেম্বর ১৮৫৪ খ্রিষ্টাব্দে (ইংরেজী সাল অনুযায়ী) দেওয়ান আলী রাজা চৌধুরী এবং মোসাম্মৎ হুরমত জান বিবির ঘর আলোকিত করে জন্ম হয় হাসনের। হুরমত বিবি ছিলেন আলী রাজার খালাতো ভাই আমির বখ্‌শ চৌধুরীর নিঃসন্তান বিধবা। পরবর্তীতে হাসন রাজার পিতা আলী রাজা তাকে পরিণত বয়সে বিয়ে করেন। হাসন রাজা ছিলেন তাঁর দ্বিতীয় পুত্র।

হাসনের পূর্বপুরুষের অধিবাস ছিল ভারতের উত্তর প্রদেশের অয্যোধ্যায়। বংশ পরম্পরায় তাঁরা হিন্দু ছিলেন। অতঃপর তাঁরা দক্ষিণবঙ্গের  যশোর জেলা হয়ে সিলেতে এসে থিতু হন। তাঁর দাদা বীরেন্দ্রচন্দ্র সিংহদেব মতান্তরে বাবু রায় চৌধুরী সিলেটে এসে ইসলাম ধর্ম গ্রহণ করেন। উল্লেখ্য যে, হাসনের অনেক কবিতা ও গানে পরবর্তীতে হিন্দু-মুসলিম সাম্প্রদায়িকতার মিলবন্ধন পাওয়া যায়। হাসনের দাদার মৃত্যুর পর তাঁর বাবা মাতৃ এবং পিতৃবংশীয় সকল সম্পদের মালিক হন। ১৮৬৯ সালে তার পিতা আলি রেজার মৃত্যুর চল্লিশ দিন পর তার বড় ভাই ওবায়দুর রেজা মারা যান। ভাগ্যের এমন বিড়ম্বনার স্বীকার হয়ে মাত্র ১৫ বছর বয়সে হাসন জমিদারীতে অভিষিক্ত হন।

‘হাসন রাজা’ সিনেমায় বামে হেলাল খান (হাসন রাজা) এবং শমি কায়সার

হাসন বেশ সুপুরুষ দর্শন ছিলেন। শুধু তাই নয়, তিনি ছিলেন স্বশিক্ষিত। তিনি সহজ-সরল সুরে আঞ্চলিক ভাষায় প্রায় সহস্রাধিক গান এবং পংক্তি রচনা করেছেন। এছাড়াও আরবী ও ফার্সি ভাষায় ছিল বিশেষ দক্ষতা। তখন সিলেটে ঘরে ঘরে আরবী ও ফার্সির প্রবল চর্চা চলত।

হাসন যৌবনে ছিলেন ভোগবিলাসী এবং সৌখিন। বিভিন্ন সময় তিনি অনেক নারীর সাথে মেলামেশা করেছেন। প্রতি বছর, বিশেষ করে বর্ষাকালে, নৃত্য-গীতের ব্যবস্থাসহ নৌকাবিহারে চলে যেতেন এবং বেশ কিছুকাল ভোগ-বিলাসের মধ্যে নিজেকে নিমজ্জিত করে দিতেন। এই ভোগবিলাসের মাঝেও হাসন প্রচুর গান রচনা করেছেন। বাইজী দিয়ে নৃত্য এবং বাদ্যযন্ত্রসহ এসব গান গাওয়া হত। সেই গানের মাঝেও অন্তর্নিহিত রয়েছে নশ্বর জীবন, স্রষ্টা এবং নিজের কৃত কর্মের প্রতি অপরাধবোধের কথা। কে জানতো সেই অত্যাচারী, ভোগবিলাসী জমিদারই হবেন পরবর্তীকালের সবচেয়ে প্রজাদরদি এবং দরবেশ জমিদার!

হাসন রাজার ব্যবহৃত একটি বাংলো

হাছন রাজা পশু পাখি ভালোবাসতেন। ‘কুড়া’ ছিল তার প্রিয় পাখি। ঘোড়াও পুষতেন হাসন। তাঁর প্রিয় দুটি ঘোড়ার একটি হলো জং বাহাদুর, আরেকটি চান্দমুশকি। এরকম আরো ৭৭টি ঘোড়ার নাম পাওয়া গেছে। হাসন রাজার আর এক মজার শখ ছিল ছোট ছোট ছেলেমেয়েদের জড়ো করে রুপোর টাকা ছড়িয়ে দেওয়া। বাচ্চারা যখন হুটোপুটি করে কুড়িয়ে নিত, তা দেখে তিনি খুব মজা পেতেন।

হাসন রাজার ব্যবহৃত পোশাক

পশু পাখির যত্ন ও লালন পালনের পেছনে বিপুল অর্থ ব্যয় করেছেন। একটা উদাহরণ দিলেই বুঝবেন হাসনের পশু প্রেম কতটা তীব্র। ১৮৯৭ সালের ১২ই জুন আসাম এবং সিলেট এলাকায় ৮.৮ রিখটার স্কেলের এক ভয়াবহ ভুমিকম্পে মানুষসহ অনেক পশুপাখি প্রাণ হারায়। হাসনের নিজেরে কুড়ে ঘরটিও ভেঙ্গে যায়। পরে এলাকা পরিদর্শনে গিয়ে দেখলেন তাঁর অনেক নিকটাত্মীয়ের মৃত্যু হয়েছে। খাদ্যের অভাবে হাসনের প্রাণপ্রিয় অনেক পশু পাখির মৃত্যু তাঁর মনে জীবন সম্পর্কে কঠিন বৈরাগ্যের সূচনা করে।

হাসন রাজার ব্যবহৃত একটি ঢোল

হাসন রাজার এই কালো অধ্যায়ের ইতি ঘটে বেশ অলৌকিক ভাবেই। লোক মুখে শোনা যায়- একদিন তিনি একটি আধ্যাত্নিক স্বপ্ন দেখলেন এবং এরপরই তিনি নিজেকে পরিবর্তন করা শুরু করলেন। বৈরাগ্যের বেশ ধারণ করলেন। জীবনযাত্রায় আনলেন বিপুল পরিবর্তন। নিয়মিত প্রজাদের খোঁজ খবর রাখা থেকে শুরু করে এলাকায় বিদ্যালয়, মসজিদ এবং আখড়া স্থাপন করলেন। সেই সাথে চলতে লাগলো গান রচনা।

১৯০৭ খ্রিষ্টাব্দে তাঁর রচিত ২০৬টি নিয়ে গানের একটি সংকলন প্রকাশিত হয়। এই সংকলনটির নাম ছিল ‘হাসন উদাস’। এর বাইরে আর কিছু গান ‘হাসন রাজার তিনপুরুষ’ এবং ‘আল ইসলাহ্‌’ সহ বিভিন্ন পত্র পত্রিকায় প্রকাশিত হয়েছে। ধারণা করা হয়, তাঁর অনেক গান এখনো সিলেট-সুনামগঞ্জের লোকের মুখে মুখে আছে এবং বহু গান বিলুপ্ত হয়ে গেছে। পদ্যছন্দে রচিত হাসনের অপর গ্রন্থ ‘সৌখিন বাহার’-এর আলোচ্য বিষয ছিল- ‘স্ত্রীলোক, ঘোড়া ও কুড়া পাখির আকৃতি দেখে প্রকৃতি বিচার। এ পর্যন্ত পাওয়া গানের সংখ্যা ৫৫৩টি। অনেকে অনুমান করেন হাসন রাজার গানের সংখ্যা হাজারেরও বেশী।

হাসন রাজা জাদুঘরের একাংশ

‘হাসন বাহার’ নামে তাঁর আর একটি গ্রন্থ কিছুকাল পূর্বে আবিস্কৃত হয়েছে। হাসন রাজার আর কিছু হিন্দী গানেরও সন্ধান পাওয়া যায়। যা-ই হোক, আমরা হয়তো দূর্ভাগ্যবান। তা না হলে হাসন রাজার আরো কিছু অবিস্মরণীয় সৃষ্টির সাক্ষী হতে পারতাম। হাসন রাজা তার গানের মধ্যে গভীর জীবন দর্শন ও আত্মোপলব্ধি প্রকাশ পায়। যখন তিনি তার ভোগ বিলাস ছেড়ে দিলেন, তখনকার রচিত একটি গানের অংশবিশেষ,

“গুড্ডি উড়াইল মোরে,মৌলার হাতের ডুরি।
হাছন রাজারে যেমনে ফিরায়, তেমনে দিয়া ফিরি।।
মৌলার হাতে আছে ডুরি, আমি তাতে বান্ধা।
জযেমনে ফিরায়, তেমনি ফিরি, এমনি ডুরির ফান্ধা।”

আরেকটি কবিতায় দেখা যায়, হাসন গৌতম বুদ্ধের মতোই বলেন-

“স্ত্রী হইল পায়ের বেড়ি পুত্র হইল খিল।
কেমনে করিবে হাসন বন্ধের সনে মিল”

জাগতিক দুই চোখ দিয়ে বাস্তব জগত দেখা যায়। তৃতীয় নয়ন বা মানশ্চক্ষ দিয়ে মানুষ জীবন জগত এবং স্রষ্টার মহিমা উপলব্ধি করতে পারে। যেমনটা দেখা যায় হাসনের আরেকটি কবিতায়-

“আঁখি মুঞ্জিয়া দেখ রূপ রে, আঁখি মুঞ্জিয়া দেখ রূপ রে।
আরে দিলের চক্ষে চাহিয়া দেখ বন্ধুয়ার স্বরূপ রে।”

হাসন মুসলিম ছিলেন, কিন্তু তাঁর গানের পূর্বপুরুষের ধর্ম, হিন্দু ধর্মের প্রতি প্রেমও লক্ষণীয়। যেমন –

“আমি যাইমুরে যাইমু, আল্লার সঙ্গে,
হাসন রাজায় আল্লা বিনে কিছু নাহি মাঙ্গে”

আবার পাশাপাশি তার কন্ঠে ধ্বনিত হয় –

“আমার হৃদয়েতে শ্রীহরি,
আমি কি তোর যমকে ভয় করি।
শত যমকে তেড়ে দিব, সহায় শিবশঙ্করী।”

বাউলা কে বানাইলো রে হাসন রাজারে…… হাসন রাজার ব্যবহৃত একতারা

হাসন দর্শন সম্পর্কে বিশ্বকবি রবীন্দ্রনাথ ঠাকুর ১৯ ডিসেম্বর ১৯২৫ সালে Indian Philosophical Congress এ  বলেছিলেন, “পূর্ব বাংলার এই গ্রাম্য কবির মাঝে এমন একটি গভীর তত্ত্ব খুঁজে পাই, ব্যক্তি স্বরূপের সাথে সম্মন্ধ সূত্রে বিশ্ব সত্য।” এছাড়াও ১৯৩০ সালে অক্সফোর্ড বিশ্ববিদ্যালয়ে `হিবার্ট লেকচারে` রবীন্দ্রনাথ `The Religion of Man` নামে যে বক্তৃতা দেন তাতেও তিনি হাসন রাজার দর্শন ও সংগীতের উল্লেখ করেন।
হাসন রাজার স্মৃতি সংরক্ষণ

সিলেটের জিন্দাবাজারে হাসন রাজা জাদুঘর

হাসন রাজার স্মৃতি সংরক্ষণের জন্য সিলেট নগরীর প্রাণকেন্দ্র জিন্দাবাজারে গড়ে তোলা হয়েছে একটি জাদুঘর, যার নাম ‘মিউজিয়াম অব রাজাস’। এখানে দেশ বিদেশের দর্শনার্থীরা হাসন রাজা ও তার পরিবার সম্পর্কে নানা তথ্য জানতে প্রতিদিন ভিড় করেন। এছাড়াও, সুনামগঞ্জ শহরের তেঘরিয়ায় এলাকায় সুরমা নদীর কোল ঘেঁষে দাঁড়িয়ে আছে হাসন রাজার স্মৃতিবিজড়িত বাড়িটি। এ বাড়িটি একটি অন্যতম দর্শনীয় স্থান। কালোত্তীর্ণ এ সাধকের ব্যবহৃত কুর্তা, খড়ম, তরবারি, পাগড়ি, ঢাল, থালা, বই ও নিজের হাতের লেখা কবিতার ও গানের পাণ্ডুলিপি আজও বহু দর্শনার্থীদের আবেগাপ্লুত করে। ১৯২২ খ্রিষ্টাব্দের ৬ ডিসেম্বর তিনি মৃত্যুবরণ করেন।  সুনামগঞ্জের লক্ষণশ্রীতে তাঁর মায়ের কবরের পাশে কবর দেওয়া হয়। তার এই কবরখানা তিনি মৃত্যুর পূর্বেই নিজে প্রস্তুত করেছিলেন।

তথ্যসূত্র

১) হাসন রাজা

২) হাসন রাজা, দেওয়ান

৩) somewhereinblog.net/blog/mahalderblog/28900039

৪) poemhunter.com/hason-raja/biography/

54
By MS Islam

ইয়ট ব্যবহারের ইতিহাস বহু পুরনো। ১৭ শতক থেকেই ব্রিটিশ এবং ডাচরা ইয়ট ব্যবহার করতো। তবে ব্যবহারটা তখন ছিল ভিন্ন উদ্দেশ্যে। ডাচ শব্দ ‘ইয়াট’ থেকে আজকের ইয়ট শব্দটির উৎপত্তি, যার অর্থ শিকার করা। ডাচরাই প্রথম একধরনের ছোট কিন্তু দ্রুতগামী জাহাজের নাম দেয় ইয়াট, যা তারা সমুদ্রে দস্যুদের ধরতে ব্যবহার করতো। সময়ের বিবর্তনে আজকের বিশ্বে ইয়টের সেই মধ্যযুগীয় ব্যবহারের কথা কেউ কল্পনাও করতে পারে না। এখন ইয়ট শব্দটি কানে গেলেই সবার পূর্বে যে ছবিটি মাথায় ভেসে ওঠে, তা হচ্ছে একটি অত্যন্ত সুন্দর, রাজকীয় এবং বিলাসবহুল জাহাজ, যেখানে অবসর যাপন করছে কিছু বিত্তশালী মানুষ।

ইয়ট বলতে এখন আমরা যা বুঝি, তা হচ্ছে প্রমোদতরী। বর্তমানে বিশ্বের অধিকাংশ হাই-প্রোফাইল ধনাঢ্য ব্যক্তিগণ, বিশেষ করে ব্যবসায়ী শ্রেণী নিজেদের অবসর যাপনের জন্য একটি ব্যক্তিগত ইয়ট রাখতে পছন্দ করেন। ঠিক যেমনি ডিসি কমিক্সের কাল্পনিক গোথাম শহরের ধনকুবের ব্রুস ওয়েইনও একটি ইয়ট ব্যবহার করতেন (ডার্ক নাইট মুভিতে)! যা-ই হোক, সময়ের সাথে ইয়টের সৌন্দর্য এবং ব্যবহার দুই-ই বৃদ্ধি পেয়েছে, পাল্লা দিয়ে বেড়েছে এর ব্যয়। ধনী ব্যক্তিরা যেন একে অপরের সাথে এক অঘোষিত প্রতিযোগিতায় নেমেছেন, একে অপরের চেয়ে বড় এবং দামি ইয়ট নির্মাণে। সেই প্রতিযোগিতার ফসলই আজকের লেখার বিলাসবহুল ইয়টগুলো।
৫) আল সাইদ (৩০০ মিলিয়ন)

আল সাইদ ইয়ট; source: beautifullife.info

বিশ্বের সবচেয়ে ব্যয়বহুল ইয়টের তালিকায় ৫ম স্থান দখল করে নিয়েছে ওমানের সুলতান কাবুস বিন সাইদ আল সাইদের নিজ নামে নামকরণ করা ইয়ট ‘আল সাইদ’। ২০০৬ সালে ৩০০ মিলিয়ন ডলার সম্ভাব্য আয় ধরে এর নির্মাণ কাজ শুরু করে লারসেন শিপইয়ার্ড। প্রাক্কলিত ব্যয়েই ২০০৮ সালে এর নির্মাণ কাজ শেষ হয়। ৭০ জন অতিথি এবং ১৫০ জন ক্রু ধারণক্ষমতা সম্পন্ন এই ইয়টের দৈর্ঘ্য ১৫৫ মিটার, যা একে করেছে পঞ্চম বৃহত্তম ইয়ট। কঠোর গোপনীয়তা বজায় রাখবার কারণে এই ইয়ট সম্পর্কে এই খুচরো তথ্যগুলোর বাইরে আর কিছুই জানা যায় না।

source: charterworld.com
৪) মোটর ইয়ট-এ (৩২৩ মিলিয়ন)

মোটর ইয়ট-এ; source: beautifullife.info

২০১৮ সালে ফোর্বসের শীর্ষ ধনী তালিকায় ৮৮তম স্থানে থাকা রাশিয়ান শিল্পপতি এবং ইউরোকেমের প্রধান শেয়ারহোল্ডার আন্দ্রে মেলনিশেনকোর ব্যক্তিগত ইয়ট মোটর ইয়ট-এ এই তালিকায় ৪র্থ স্থানে আছে। ২০০৬ সালে এই ইয়টের নির্মাণ কাজ শুরু হয়, যা ২০০৮ সালের জানুয়ারিতে শেষ হয়। এর নির্মাণ ব্যয় ৩২৩ মিলিয়ন ডলার, বাংলাদেশি টাকায় সংখ্যাটা ‘মাত্র’ ২,৬০০ কোটি টাকা! স্বাভাবিকভাবেই বিলাসিতা এবং শৌখিনতায় কানায় কানায় পূর্ণ এই ৪০০ ফুট লম্বা ইয়টটি। একটি যুদ্ধজাহাজের স্মারকস্বরূপ তৈরী এই জাহাজের নকশা এবং নির্মাণ কাজ সম্পন্ন করে ‘ব্লম+ভস’ নামক একটি জার্মান জাহাজ নির্মাণকারী কোম্পানি।

মেলনিশেনকোর বেডরুম; source: beautifullife.info

source: beautifullife.info

মোটর-এ এর অভ্যন্তরে মোট ২৪ হাজার বর্গ ফুট জায়গা রয়েছে, যার মধ্যে ২,৫০০ বর্গ ফুট জায়গা জুড়ে আছে মেলনিশেনকোর প্রধান বেডরুমটি। সম্পূর্ণ মেঝেটাই বিলাসবহুল সুদৃশ্য কাঁচে তৈরি। মেলনিশেনকোর বেডরুম ছাড়াও ইয়টটিতে রয়েছে আরো ৬টি অতিথি স্যুট, যেগুলোতে ৩০ জন অতিথি থাকতে পারবেন। এর সবচেয়ে আকর্ষণীয় দিক হলো অতিথি কক্ষের চলনশীল দেয়ালগুলো! অর্থাৎ দেয়ালগুলো প্রয়োজনে চলাচল করতে পারে এবং সেগুলোর বিন্যাস পরিবর্তন করে ৬টি স্যুট থেকে তৈরি করা যাবে ৪টি বড়সড় সভাকক্ষ! জাহাজের প্রতিটি আসবাব, খাবার টেবিল এমনকি কাচের বাসনপত্রাদিও উন্নতমানের ফরাসি ক্রিস্টালে তৈরি। ডেকের একপাশে রয়েছে একটি ৩০ ফুট লম্বা স্পিডবোট, অপর পাশে একটি হেলিপ্যাড। অতিথিদের বিনোদনের জন্য রয়েছে একটি সুদৃশ্য ডিসকো এবং তিনটি সুইমিংপুল, যার একটির পৃষ্ঠতল সম্পূর্ণ কাচের তৈরী।
৩) দুবাই (৪০০ মিলিয়ন)

দুবাই ইয়ট; source: superyachts.com

ব্যয়বহুল প্রমোদতরীর তালিকা করা হচ্ছে, আর সে তালিকায় কোনো আরব আমিরাতের ধনকুবেরের তরীর নাম থাকবে না, তা কি হতে পারে? তালিকার তৃতীয় স্থানটি দখল করে আছে দুবাই নামক এই বিলাসবহুল ইয়ট, যার মালিক সংযুক্ত আরব আমিরাতের বর্তমান ভাইস প্রেসিডেন্ট শেইখ মোহাম্মদ বিন রশিদ আল মাখতুম। এই ইয়টটি প্রাথমিকভাবে ব্রুনাইয়ের যুবরাজ জেফরি বলকিয়াহর জন্য যৌথ অর্থায়নে নির্মাণ কাজ শুরু করেছিল ব্লম+ভস এবং লারসেন কোম্পানি। ১৬২ মিটার লম্বা এই প্রমোদতরীর মালিকানা পরে রশিদ আল মাখতুম কিনে নেন। এটি বর্তমানে বিশ্বের তৃতীয় বৃহত্তম ইয়ট।

দুবাইয়ের সর্পিলাকার সিঁড়ি; source: beautifullife.info

source: charterworld.com

দুবাই ইয়টটির বিশেষত্ব হচ্ছে এর নজরকাড়া সব জ্যাকুজি (বিশেষ ধরনের শৌখিন বাথটাব) এবং সুইমিং পুল। ভেতরের সর্পিলাকার সিঁড়িগুলো সম্পূর্ণ পরিবর্তনশীল রঙিন কাঁচে তৈরি, যা এই ইয়টকে করেছে অনন্য। মেঝে থেকে শুরু করে দেয়াল, বেডরুম আর সিলিং সবই সাজানো হয়েছে হস্তনির্মিত মোজাইক দ্বারা, যা মন ভালো করে দেয়ার মতোই সৌন্দর্য সৃষ্টি করে। সব মিলিয়ে ১১৫ জন অতিথি অনায়াসে থাকতে পারবেন এই ইয়টে, যাদের জন্য রয়েছে দুটি সুদৃশ্য বার। ডেকের উপর হেলিপ্যাডের কথা আর আলাদা করে না বললেও চলে। তবে যে ব্যাপারটি উল্লেখ করা প্রয়োজন, তা হচ্ছে এর ভেতরকার ডিজাইনারের কথা। দুবাই ইয়টটির ভেতরের ডিজাইন করেন স্বয়ং রশিদ আল মাখতুম।
২) আজম (৬৫০ মিলিয়ন)

আজম; source: charterworld.com

সংযুক্ত আরব আমিরাতের প্রেসিডেন্ট এবং আবু ধাবির আমির, খলিফা বিন জায়েদ আল নাহিয়ান হচ্ছেন তালিকার ২ নম্বর স্থানে জায়গা পাওয়া ইয়ট আজমের মালিক। ১৮০ মিটার লম্বা এই বিলাসবহুল ইয়টটি সমুদ্রে ভাসানো হয় ২০১৩ সালের এপ্রিল মাসে। এটি এখনো পর্যন্ত পৃথিবীর বৃহত্তম ইয়ট। প্রধান প্রকৌশলী মুবারক সাদ এর নেতৃত্বে এবং লারসেন শিপইয়ার্ডের আওতায় ৬৫০ মিলিয়ন ডলার খরচে এই ইয়টটি নির্মাণ করতে সময় লাগে ৩ বছর। অগভীর জলে চলাচলের জন্য এতে ব্যবহার করা হয়েছে বিশেষ প্রকৌশল, যা এই তালিকার অন্য ইয়টগুলো থেকে আজমকে করছে অনন্য।

আজমের একটি বেডরুম; source: canlisohbethattiniz.com

ফরাসি ডিজাইনার ক্রিস্টোফার লিওনির তৈরি নকশা এই ইয়টটিকে দিয়েছে ভিন্ন মাত্রা। ইয়টের ভেতরের কক্ষগুলো এবং করিডরগুলো এমনভাবে স্থাপন করা হয়েছে যে অনেকের মতে এটি পৃথিবীর সবচেয়ে জটিল ইয়ট! এর একটি অভিনব দিক হচ্ছে এর বৈঠকখানা এবং বারগুলো, যেগুলোর একটিতেও কোনো পিলার নেই! আর বিস্ময়ের ব্যাপার হলো এর গতি। ঘন্টায় ৫৬ কিলোমিটার গতিতে চলতে সক্ষম এই ইয়ট, যা শুনতে বেশ সাদামাটা মনে হয়। কিন্তু ভিরমি খেতে হবে, যখন জানবেন এই ইয়টের রয়েছে নিজস্ব মিসাইল প্রতিরক্ষা ব্যবস্থা এবং একটি সাবমেরিন! নিঃসন্দেহে একটি সাবমেরিনকে ৫৬ কিলোমিটার/ঘন্টা গতিতে বয়ে নেয়া কোনো ইয়টের জন্যই সহজ নয়।
১) ইকলিপ্স (৫০০ মিলিয়ন থেকে ১.৫ বিলিয়ন)

ইকলিপ্স; source: beautifullife.info

এই তালিকার ইয়টগুলোর মধ্যে সম্ভবত সবচেয়ে পরিচিত নামটি হচ্ছে ‘ইকলিপ্স’। এর কারণটাও খুব স্বাভাবিক। এই ইয়টের মালিক যে রাশিয়ান ধনকুবের রোমান আব্রামোভিচ। অন্য সকলের সাথে প্রতিযোগিতায় বেশ বড় ব্যবধানেই জিতেছেন এই ধনকুবের। তার ইয়টের নির্মাণ ব্যয়ের ধারেকাছেও নেই আর কেউ। ১৬৩ মিটার লম্বা এই ইয়টটি বিশ্বের তৃতীয় বৃহত্তম ইয়ট, যা মাত্র ১ মিটারের ব্যবধানে হারিয়েছে দুবাইকে। এই ইয়টটিও নির্মাণ করেছে নজরকাড়া সব ইয়ট নির্মাণে পারদর্শী জার্মান শিপইয়ার্ড ব্লম+ভস। এর নির্মাণ খরচ নিয়ে রয়েছে বিস্তর বিতর্ক। কোনো কোনো সূত্র ৫০০ মিলিয়ন ডলার দাবি করলেও, অধিকাংশ সূত্রের মতে ইকলিপ্সের নির্মাণ ব্যয় দেড় বিলিয়ন ডলার। খুব সম্ভবত, প্রাথমিক ব্যয় সংকলনের হিসাবটি ছিল ৫০০ মিলিয়ন ডলার, যা কিনা নির্মাণকালের ব্যয় বৃদ্ধি, নতুন ডিজাইন সংযোজন এবং মূল্যস্ফীতি মিলিয়ে ১.৫ বিলিয়নে ঠেকেছে।

ইকলিপ্সের একটি বার; source: beautifullife.info

যেকোনো বিলাসবহুল ইয়টে একটি হেলিপ্যাড থাকবে, এ আর এমন কী? কিন্তু ইকলিপ্সে রয়েছে দুটি হেলিপ্যাড, যেগুলোতে একসাথে মোট চারটি হেলিকপ্টার অবতরণ করতে পারে! তাছাড়া এতে রয়েছে দুটি সুদৃশ্য সুইমিং পুল এবং বিশাল একটি ডিস্কো হল। আজমের মতো এই ইয়টটিতেও সংযুক্ত আছে একটি ছোট সাবমেরিন। প্রতিরক্ষার জন্য রয়েছে মিসাইল ডিটেকশন পদ্ধতি এবং টর্পেডো। বেডরুমের জানালাগুলোও বুলেটপ্রুফ। সবচেয়ে আকর্ষণীয় ব্যাপারটি হচ্ছে, পুরো ইকলিপ্স সর্বদা একটি ‘অ্যান্টি-পাপারাজ্জি’ লেজার শিল্ডের আওতায় থাকে। পাপারাজ্জিদের গোপনে ছবি তোলার দিন বুঝি শেষ হয়ে এলো!

স্ট্রিটস অব মোনাকোর পরিকল্পিত নকশা; source: pixorange.com

ইন্টারনেটে ভাইরাল হিস্ট্রি সুপ্রিমের একটি ভুয়া ছবি; source: stuarthughes.com

বিশেষ দ্রষ্টব্য: এই তালিকা থেকে প্রসিদ্ধ দুটি নাম, ‘দ্য হিস্ট্রি সুপ্রিম’ এবং ‘স্ট্রিটস অব মোনাকো’কে বাদ রাখা হয়েছে। প্রথমত, স্ট্রিট অব মোনাকো ইয়টটি তৈরির পরিকল্পনা করা হয়েছিল ২০১৩ সালে। কিন্তু, অত্যন্ত উচ্চাভিলাষী এবং ব্যয়বহুল এই ইয়টের নির্মাণ কাজের কোনোরূপ অগ্রগতিই এখনো পর্যন্ত হয়নি। অন্যদিকে, ১ লক্ষ কেজি স্বর্ণ ব্যবহার করে, অবিশ্বাস্য ৪.৫ বিলিয়ন ডলার খরচ করে তৈরি করা হিস্ট্রি সুপ্রিম ইয়টটি আসলে কোনোদিন তৈরিই করা হয়নি! এটি ছিল একটি নিছক ধাঁধা, যদিও এখনো ইন্টারনেটে অনেক তালিকায় একে এক নম্বরে রাখা হয়!

55
Place / স্টেডিয়ামে ভূতের বাড়ি!
« on: April 15, 2018, 05:22:20 PM »
By Islam Shami

মেলবোর্ন ক্রিকেট গ্রাউন্ডের হসপিটালিটি বক্সে বসে অ্যাশেজ টেস্টের রূপ-রস উপভোগ করছেন। আপনি ছাড়াও  জনা পাঁচেক দর্শক আছে, সেটাও একেবারে পিছনের দিকে। অল্প আলোতে কেমন যেন ভৌতিক পরিবেশ দাঁড়িয়েছে। অন্যদিকে পঞ্চম দিনের শেষ বিকেলে মাঝ মাঠে টানটান উত্তেজনায় লড়ছে স্টিভেন স্মিথ বনাম অ্যালিস্টার কুকের দল। এমন সময় চোখের কোণ দিয়ে দেখলেন, আপনার ৮-৯ আসন বাদেই আবছা অন্ধকারে কেউ একজন বসে আছে। একটু খেয়াল করতেই মনে হলো, চেহারাটা স্যার ডোনাল্ড ব্র্যাডম্যানের মতো! অস্ট্রেলিয়ান কিংবদন্তীর ভূত ভেবে চমকে উঠবেন? ঠিক সেই সময়েই যদি আস্তে করে ঘাড় ঘুরিয়ে আপনার দিকে একবার তাকিয়ে পিলে চমকানো হাসি দেন ব্র্যাডম্যান, কেমন লাগবে?

বলা হয়, বিশ্বের সবচেয়ে অভিশপ্ত ও রহস্যজনক স্টেডিয়ামটি সান্ডারল্যান্ডের। দর্শকশূন্য অবস্থায় দেখলেই যেন গা ছমছম করে উঠবে; Source: The Offside Rule

ব্যাপারটি আজগুবি মনে করে ভুলে যাওয়া যেতে পারে। কিন্তু আল্লাহর দুনিয়ায় কতকিছুই না রহস্য রয়ে যায়। সেই রহস্য ছাড়েনি খেলার স্টেডিয়ামকেও। সারা দুনিয়া জুড়ে এমন সব স্টেডিয়ামের কমতি নেই যেখানে কোনো না কোনো ‘ভূতুড়ে’ অভিজ্ঞতা আছে। ফুটবলেই যেন এমনটা বেশি হয়। বিশ্বের এমন কিছু স্টেডিয়ামের ছোট কিন্তু আলোচিত ঘটনা নিয়েই এই আয়োজন।
স্টেডিয়াম অব লাইট (সান্ডারল্যান্ড, ইংল্যান্ড)

সাদারল্যান্ড ক্লাবের সেই অভিশপ্ত স্টেডিয়াম; Source: Sportskeeda

ইংলিশ প্রিমিয়ার লিগের সময় চলছে। স্কাই স্পোর্টস চ্যানেলে পরদিন সন্ধ্যার ম্যাচের প্রিভিউ বয়ান করছেন বিশ্লেষকরা।  সান্ডারল্যান্ডের ম্যাচ। পিছনের জায়ান্ট স্ক্রিনে সান্ডারল্যান্ডের দর্শকশূন্য গ্যালারি আর মাঠের একটি কোণা দেখা যাচ্ছে। মাঠকর্মীরা সেখানে কাজ করছে। হুট করে টেলিভিশন ক্যামেরায় ধরা পড়ল একজন মাঠকর্মী কাজ করতে করতে এগিয়ে যাচ্ছে, এর মধ্যে হুট করে হাওয়ায় মিলিয়ে গেল! জলজ্যান্ত মানুষ এভাবে মিলিয়ে যাওয়া নিয়ে তুমুল আলোচনা হয়েছিল ২০১৬ সালের ওই ঘটনায়। এরপরও একাধিকবার একইভাবে মাঠকর্মীর হাওয়ায় মিলিয়ে যাওয়ার ঘটনা ঘটেছে। কিন্তু সত্যি সত্যি নিখোঁজ হয়েছে বলে এমন কোনো খবর তদন্ত করে পাওয়া যায়নি।

তারও আগে ২০০৫ সালের ঘটনা। দুজন কর্মচারী হঠাৎ ক্লাব কতৃপক্ষকে অভিযোগ জানাল, করিডোরে তারা ভূত দেখেছে। শুরুতে তো হেসেই উড়িয়ে দিল সবাই। ক্লাব তাদের কর্মীদের বোঝাল, আরেকপাশ থেকে কেউ একজন হেঁটে যাচ্ছিল, সেটার ছায়া পড়েছে এ পাশে। ঐ দুজন নাকি সেই ছায়া দেখেই ভয় পেয়েছে।

কিন্তু তারা যে ভুল ছিল না তা প্রমাণ করলেন আইরিশ স্ট্রাইকার স্টিফেন এলিয়ট। তিনি অভিযোগ আনেন, তিনিও  ভূত দেখেছেন করিডরে। এরপর থেকে পুরো স্টেডিয়াম ভূতুড়ে বলে পরিচিত হয়ে যায়। অনেকে বিশ্বাস করেন, যাকে ভূত বলে দাবি করা হচ্ছে সে আসলে ১৮ শতকের এক অভিশপ্ত আত্মা। যে কিনা ধ্বংসপ্রাপ্ত জাহাজ লুট করে বেড়াত। সে-ই স্টেডিয়ামে এভাবে ঘুরে বেড়াচ্ছে।

কিন্তু জাহাজের ভূত কিভাবে ফুটবলপ্রেমী হয়ে সান্ডারল্যান্ড স্টেডিয়ামে ভর করল সে ব্যাখ্যা এখনও কেউ দিতে পারেনি।
গাজী স্টেডিয়াম (কাবুল, আফগানিস্তান)

এখনও গা ছমছমে অভিজ্ঞতা দেই কাবুলের গাজী স্টেডিয়ামটি; Source: Skyscrapercity.com

মধ্যযুগে খোলা মাঠে অপরাধীদের শাস্তি দেওয়া হত। কাউকে ফাঁসিতে ঝোলানো, শিরচ্ছেদ, এমনকি কেটে টুকরো টুকরো করা; লোমহর্ষক সব শাস্তিই আয়োজন করে, মাঠ ভর্তি দর্শকের সামনে দিত শাসক গোষ্ঠীরা। সেটা শত শত বছর আগে। পরবর্তীতে সেই সব জায়গাগুলোয় অদ্ভুত সব ঘটনা ঘটেছে, এমন প্রমাণ ইতিহাসের পাতায় লেখা আছে। কিন্তু আধুনিক যুগেও এমন জায়গা খুঁজে পাওয়া যায়, সেটাই যেন মনে করিয়ে দেয় যুদ্ধবিদ্ধস্ত আফগানিস্তানের গাজী স্টেডিয়াম। রাজধানী কাবুলের এই ফুটবল স্টেডিয়ামটির আশেপাশে এখনও সন্ধ্যার পর কেউ যেতে চায় না।

কারণ, তালিবানরা এই স্টেডিয়ামকে বানিয়েছিল একরকম ফাঁসি কিংবা শিরচ্ছেদের মঞ্চ। তালিবানদের জন্য প্রাণ বাঁচানোয় দায় ছিল সাধারণ আফগান নাগরিকদের। সেখানে ফুটবল খেলা তো স্বপেরও বাইরে। কিন্তু স্টেডিয়ামে আসতেই হত বাধ্য হয়ে। তালিবান জঙ্গী গোষ্ঠী ‘অপরাধী’ ধরে এনে এখানে শাস্তি দিত, সেটা দেখার জন্য হাজির হতে হত স্থানীয়দের। সবাই যেন ভয় পায় সে কারণেই জোর করে মাঠে উপস্থিত হতে বলত তালিবান সদস্যরা।

গাজী স্টেডিয়ামে তালিবানদের অত্যাচারের একটি দৃশ্য; Source: Sportskeeda

একবার এক আফগান সাংবাদিক ওই সময়ের অবস্থা বর্ণনা করতে গিয়ে বলেছিলেন,

    ‘এক চোর নিজের গ্রাম থেকে কিছু চুরি করেছিল। তাকে এই মাঠে এনে সবার সামনে ডান হাত কেটে দেওয়া হল। আরেকবার এক নারী ও পুরুষ অবৈধ সম্পর্কের কারণে দোষী সাব্যস্ত হয়। তাদেরকে ১০০ বার দোররা মারা হয় এবং একে অপরকে বিয়ে করতে বাধ্য করা হয়। এই মাঠে অনেক মানুষের শিরচ্ছেদ করা, গুলি করার প্রত্যক্ষদর্শী আমি। আফগান জাতি কখনই এই দুঃসহ স্মৃতি ভুলবে না।’

আরেক স্থানীয় জানান, গাজী স্টেডিয়ামে তিনি অনেক কথিত অপরাধীকে গুলি করে হত্যা হতে দেখেছেন। ওই মুহূর্তগুলো খুবই আতংকের হত। অনেকে এসব স্বপ্নেও দেখত। অনেকে এসবের কারণে মানসিকভাবে বিকারগ্রস্থ হয়ে গিয়েছে বলেও কথিত আছে।এসব কারণে একা স্টেডিয়ামে ঢোকারই সাহস পায় না কেউ। মেয়েরা তো আশেপাশেও ভিড়তে চায় না।
দ্য ঘোস্ট অব দ্য দ্রাগাও (পর্তুগাল)

রদ্রিগেজের হাতের ওপাশে গ্যালারিতে বসে উদযাপনে ব্যস্ত সেই ‘ভূত’! Source: Daily Miror

চ্যাম্পিয়নস লিগের ২০১২ আসরের এক ম্যাচে প্যারিস সেইন্ট জার্মেইকে (পিএসজি) ১-০ গোলে হারিয়ে দিল পোর্তো ফুটবল ক্লাব। সেবার জেমস রদ্রিগেজের  ওই একমাত্র গোল যেন উল্লাসের বন্যা বইয়ে দিয়েছিল এস্তাদিও দো দ্রাগাওয়ের গ্যালারিতে। কিন্তু তার  মধ্যে যে একজন ‘ভূত’ সমর্থক ছিল সেটা তখনও টের পায়নি কেউ। যার কারণে পরবর্তীতে পুরো স্টেডিয়ামকেই ‘হন্টেড’ তকমা সেঁটে দেওয়া হল।

ঘটনাটি ছিল এমন, রদ্রিগেজ যখন গোল করার পর উদযাপন করছিলেন তখন টিভি ক্যামেরায় দেখা যায় সবার সঙ্গে গ্যালারিতে বসে অদ্ভুত চেহারা ও বেশভূষার একজন উচ্ছ্বাস করছেন। পর্তুগীজ গণমাধ্যম সেই মানুষটিকে ভূত বলেই দাবি করে। তাকে উল্লেখ করে ‘দ্য ঘোস্ট অব দ্য দ্রাগাও’। কিম্ভূতাকার লোকটির মুখের দিকে তাকালে দীর্ঘদিন আগে মৃত্যুবরণ করা মানুষের মনে হবে। পরনে ১৯০০ সালের সময়কার পোশাক। ওই ঘটনার পর থেকেই গুজব রটে যায়, স্টেডিয়ামে ভূত আছে। পরবর্তীতে ব্যাপারটিকে ধামাচাপা দেওয়ার কম চেষ্টা করেনি ক্লাবটি। এমনকি যে আলোকচিত্রী ছবিটি তুলেছিলেন, তিনিই প্রমাণ করার চেষ্টা করেন লোকটি ভূত নয়, বরং একজন বৃদ্ধ মানুষ। কিন্তু তাতে  সমর্থকদের  ভূতের  ভয় কাটেনি!
লুমি ক্যাসলের ভূতের খপ্পরে (ডারহাম, ইংল্যান্ড)

লুমির ক্যাসল থেকে তোলা ডারহাম স্টেডিয়ামের ছবি। Source: Getty Image

স্টেডিয়াম থেকে বের হয়ে খেলোয়াড়রা কোথায় যায়? টিম হোটেলে। এবারের গল্পটা সেই হোটেলকে ঘিরেই। ফুটবল নয়, ক্রিকেটাররা কীভাবে আক্রান্ত হয়েছিল সেই গল্পটাই শোনা যাক।

অ্যাশেজ খেলতে ২০০৫ সালে ইংল্যান্ডে সফর করল অস্ট্রেলিয়া। মাঠের পারফরম্যান্সে তো পারদের উত্তজনা ছড়িয়ে পড়ছিল সবার মধ্যে। প্রতিপক্ষকে কতভাবে বল-ব্যাটের কেরামতিতে ঘায়েল করা যায় তা নিয়ে দুই দলের সমর্থকরা সেবারও দু’ভাগ হয়েছিল। কিন্তু স্টেডিয়াম থেকে হোটেলে ফিরে বিপত্তিটা বাঁধালেন স্বাগতিক দলের অলরাউন্ডার শেন ওয়াটসন। তিনি নাকি হোটেলে ভূত দেখেছেন! এমনকি তার সঙ্গে যোগ দিলেন অজি ক্রিকেট দলের মিডিয়া ম্যানেজার! তিনি শপথ করে বললেন, ‘আমি ভূত দেখেছি। বিশ্বাস করুন, আমি সত্যি বলছি।’

ওই সময়ে এই ঘটনা খুব আলোড়িত করেছিল সমর্থকদের। শেন ওয়াটসন ভয়ে নিজের ঘর বদলে ঘুমিয়েছিলেন ফাস্ট বোলার ব্রেট লির ঘরে। শুধু তা-ই নয়, দুই দলের ক্রিকেটারদের সঙ্গে থাকা তাদের স্ত্রী-বান্ধবীরাও নাকি নিজেদের ঘর বদলাতে চেয়েছিল। ভূতুড়ে কাণ্ডের বর্ণনা দিতে গিয়ে এক অজি ক্রিকেটার বলেছিল, ‘কথা নেই, বার্তা নেই একা একাই গভীর রাতে বাথরুমের ট্যাপ ছেড়ে দিত কেউ।’ কড়িডোরেও নাকি ছায়া দেখা যেত!

শুধু অস্ট্রেলিয়া কিংবা ইংল্যান্ডের ক্রিকেটারই নয়, আরও পাঁচ বছর আগে ২০০০ সালে ইংল্যান্ডে সফর করতে এই হোটেলেই উঠেছিল উইন্ডিজ জাতীয় ক্রিকেট দল। তারাও লুমি ক্যাসলেই উঠেছিল, কিন্তু টিকতে পারেনি। অনেকেই রহস্যজনক অস্বাভাবিক অনেক কিছু টের পেত। অধিনায়ক জিমি অ্যাডাম সহ কয়েকজন খুব ভয় পেয়েছিলেন। ফলাফল, একদিন বাদেই হোটেল বদলায় ক্যারিবিয়ানরা।

কিন্তু কাহিনীটা কি? আসলেই কি ভূত ছিল অনেক পুরাতন হোটেলটিতে! স্থানীয়দের মতে, ১৪ শতকে এক ধনী ব্যক্তিকে খুন করেছিল এক ক্যাথোলিক পুরোহিত। শুধু তা-ই নয়, যে লুমির নামে এই হোটেল, সেটি একসময় শুধুই দুর্গ ছিল। লুমির পুরো নাম ছিল লিলি লুমি। তাকেও কয়েকজন ক্যাথোলিক পুরোহিত মিলে খুন করে। তার অপরাধ, ক্যাথলিক চার্চে না যাওয়া এবং তাদেরকে অনুসরণ না করা।

56
By Sanjana S Payel

অনেকদিন ধরে চলতে থাকা ব্যস্ততা, হঠাৎ বেড়ে যাওয়া অফিসের চাপ, শারীরিক অসুস্থতা অথবা কাছের মানুষের সাথে মনোমালিন্য- এসব যদি চলতেই থাকে মাসজুড়ে, তখন মনকে একটু শান্তি দেওয়ার কোনো উপায় আছে? প্রথমের মাথায় আসবে, “কোথাও ঘুরে আসা যাক!” কিন্তু ঘুরতে যাওয়া মানে নিশ্চয়ই কোনো আত্মীয়ের বাসা হবে না। একা নিরিবিলি সময় চাইলে সেটা বন্ধু-বান্ধবের বাসাও হতে পারে না। তখন আমাদের শরণাপন্ন হতে হয় হোটেলের।

যখন তখন ভালো হোটেল খুঁজে বের করাও মুশকিল। আবার যদি বা ভাগ্য জোরে কেউ তথ্য দেয়ও তবুও দেখা যায় খুঁজতে খুঁজতে হোটেলের কামরাগুলো বুক হয়ে গিয়েছে। মন ভালো করতে গিয়ে উলটো মন খারাপের আরও একটি কারণ হয়ে দাঁড়ায়। তাই আজকের এই আয়োজনে চেষ্টা করা হবে যেন আপনাকে আর কষ্ট করে হোটেল খুঁজে বের না করতে হয়, বরং এখান থেকেই জেনে নিন বিভিন্ন সুন্দর সুন্দর এবং বিলাসবহুল কিছু হোটেল বা রিসোর্টের ঠিকানা এবং খরচসহ আরও কিছু তথ্য।
১. প্যান প্যাসিফিক সোনারগাঁও

ঢাকার কাজী নজরুল ইসলাম এভিনিউয়ে অবস্থিত হোটেলটি বাংলাদেশের পাঁচ তারা হোটেলগুলোর মাঝে অন্যতম। আভিজাত্য এবং জাঁকজমকের নিদর্শন এই হোটেলটিতে আপনি খুব বিলাসিতায় অবস্থান করা এবং চড়া দামে সুস্বাদু খাবারের পাশাপাশি আরো পাবেন মিটিং করার জন্য বিজনেস সেন্টার, হেলথ ক্লাব, সুইমিং পুল, বিউটি স্যালুন, শপিং আর্কেড, ঢাকা শহরে ঘোরাঘুরি করার জন্য ব্যবস্থা এবং উচ্চমানের নিরাপত্তা ব্যবস্থা। এখানে বিভিন্ন মানের রুম থেকে শুরু করে দেশীয় ও আন্তর্জাতিক মানের স্যুইট আছে যেখানে ২৪ ঘণ্টা খাবার পৌঁছে দেয়ার ব্যবস্থাও রয়েছে।

প্রতি রাত কাটানোর জন্য বিভিন্ন প্রকার রুমের ক্ষেত্রে আপনার গুনতে হবে ১৫৫ ডলার থেকে ২২০ ডলার, স্যুইটের জন্য ২৭০ ডলার থেকে ৬২০ ডলার। প্রতিটি রুমেই নিরাপত্তার জন্য সেফ, কাজের জন্য টেবিল, উচ্চগতির ইন্টারনেট, বিনোদনের জন্য টেলিভিশন, মিনিবার, দৈনিক খবরের কাগজ ইত্যাদি সকল ব্যবস্থা আছে।

প্যান প্যাসিফিক হোটেলের এক ঝলক; Source: Global Hotel Alliance
২. ফোর পয়েন্টস বাই শেরাটন

ঢাকার গুলশান ২ নং এ অবস্থিত এই হোটেলটির কথা না বললেই নয়। চার তারা এবং বহুতল বিশিষ্ট এই হোটেলে আপনি পাবেন ঢাকা শহরের এক মনোরম দৃশ্য অবলোকন করার সুযোগ। এখানে রয়েছে অভিজাত ১৪৯টি কামরা এবং ৩১টি স্যুইট। প্রতিটি রুমেই রয়েছে বিভিন্ন নিরাপত্তা ব্যবস্থা, সেফ ডিপোজিট বক্স, রুমেই খাবারের ব্যবস্থা এবং পার্কিং, এয়ারপোর্ট পিক-আপ ও ড্রপ-অফের সুযোগ। এই আবাসিক হোটেলে আপনি আরো পাবেন অসাধারণ স্বাদের সব খাবার, বিভিন্ন বিজনেস সার্ভিস, বিনোদনের জন্য রুফ-টপ পুল, স্বাস্থ্যের জন্য ব্যায়ামাগার, পার্সোনাল ট্রেইনার ইত্যাদি। উল্লেখ্য, এখানে প্রতি রাত কাটানোর জন্য আপনাকে নূন্যতম ১৩৭ ডলার গুণতে হবে, যা রুমের মানের সাথে সাথে বাড়তে পারে।

ফোর পয়েন্টস বাই শেরাটন এর লবি; Source: Dhaka Business Directory
৩. দ্য ওয়েস্টিন

অভিজাত এলাকা গুলশানে অবস্থিত এই পাঁচ তারা হোটেলটি বাহির থেকে দেখতে যেমন আলিশান, ভেতরে তেমনি হুলস্থূল অবস্থা! ২৩৫টি বিভিন্ন মানের কামরা ও ২৪টি স্যুইট বিশিষ্ট এই হোটেলে আপনি থাকার পাশাপাশি আরো পাবেন ঢাকা শহরের এবং গুলশান লেকের এক অদ্ভুত মনোরম দৃশ্য, যা কোনো বহুতল ভবন থেকে সচরাচর দেখতে পাবেন না। প্রতিটি কামরায় রয়েছে উচ্চগতির ইন্টারনেট, এলসিডি টেলিভিশন, নিরাপত্তা ব্যবস্থা, অভিজাত ডিজাইনের বাথরুম ইত্যাদি। এখানে থাকতে গেলে প্রতি রাতের জন্য আপনাকে গুনতে হবে কমপক্ষে ২৬৫ ডলার, যা রুমের মানের অনুপাতের সাথে বাড়বে। এখানে আরো আছে ৫টি রেস্তোরাঁ যার প্রতিটি খাবারের মেন্যুর দিক দিয়ে স্বতন্ত্র। আপনি এই হোটেলে আরো পাবেন পুল, স্পা, ফিটনেস সেন্টার, এয়ারপোর্ট পিক-আপ এবং ড্রপ-অফ, পার্কিং ইত্যাদি সুবিধা।

রাতের আলোয় ঝলমলে হোটেল দ্য ওয়েস্টিন; Source: Hotel Deals for Dhaka
৪. সিক্স সিজনস হোটেল

ঢাকায় অবস্থিত পাঁচ তারা একটি হোটেল হলো সিক্স সিজনস হোটেল। গুলশান ২ এ অবস্থিত এই হোটেলটি এককথায় আভিজাত্যে ভরপুর। সুইমিং পুল, ফিটনেস সেন্টার, স্পা, বুফে রেস্টুরেন্টসহ এখানে রাত্রি যাপনকারী মেহমানদের জন্য রয়েছে অনেক সুযোগ সুবিধা। বিলাসবহুল এবং বিনোদনপ্রেমী যে কেউ এই হোটেলে কয়েকটা দিন কাটিয়ে আসলে, দেখবেন মন একদম ফুরফুরে হয়ে গেছে। এখানে প্রতিটি রুমে রয়েছে এলইডি টিভি, ইন্টারনেট, ল্যাপটপ সেফ সহ আরও অন্যান্য নানান সুবিধা। এই বিলাসবহুল হোটেলে থাকার জন্য আপনাকে প্রতিদিন গুনতে হবে সর্বনিম্ন ৩৪০ ডলার থেকে সর্বোচ্চ ১৪০০ ডলার।

হোটেল সিক্স সিজনের আলোকিত পুল; Source: Dhaka Tribune
৫. লেকশোর হোটেল অ্যান্ড অ্যাপার্টমেন্টস

গুলশান ২ লেকের পাড়ে অবস্থিত এই বিলাসবহুল হোটেল বাহির থেকে দেখতে অনেক বেশি জমকালো। একদম গুলশান লেকের পাড়ে অবস্থিত হওয়ায় এই হোটেল আভিজাত্য একটি অনন্য মাত্রা পেয়েছে। এই হোটেলে রয়েছে গ্র্যান্ড সিটিং রুম, ৬০টি গেস্টরুম, রেস্তোরাঁ, বার, আউটডোর পুল, হেলথ ক্লাব, এয়ারপোর্ট পিক-আপ ড্রপ-অফ, পার্কিং, ফ্রি ইন্টারনেট, বুফে নাস্তা ইত্যাদি অনেক সুবিধা। প্রতিটি গেস্টরুমই সুসজ্জিত এবং পরিবারবান্ধব। এখানে থাকার জন্য প্রতি রাতে আপনার গুনতে হবে ১৫০ ডলারের মতো, যা রুমের মানের সাথে একই অনুপাতে বাড়তে পারে। এখানে খাবার খুবই উন্নত এবং সুস্বাদু যা আপনি ইচ্ছা করলে বিভিন্ন ফুড ডেলিভারি সার্ভিসের সাহায্যে চেখে দেখতে পারেন। কিন্তু এর জন্যও আপনাকে উচ্চমূল্য গুনতে হবে!

লেকের পাড়ে লেকশোর হোটেল; Source: Hotel & Motels is BD
৬. র‍্যাডিসন ব্লু ঢাকা ওয়াটার গার্ডেন

সর্বমোট ৭ একর জমির উপর দাঁড়িয়ে থাকা এই পাঁচ তারা হোটেলটিতে নির্বিঘ্নে থাকাটা শহরের যান্ত্রিকতা দূর করার খুব কার্যকর একটি উপায়। ঢাকা ক্যান্টনমেন্টের ভিতরে শাহজালাল আন্তর্জাতিক এয়ারপোর্ট রোডের পাশে অবস্থিত এই হোটেলটির বাহিরের আভিজাত্যময় গঠন যে কারো মন ছুঁয়ে দিতে সক্ষম!

কী নেই এই হোটেলে? সর্বমোট ২০০টি বিলাসী রুম ও স্যুইট, ৪টি রেস্তোরাঁর সুস্বাদু খাবার, বার, স্পা, হেলথ ক্লাব, একাধিক পুল, বিজনেস লাউঞ্জ ইত্যাদি এই হোটেলটিকে বিলাসিতার উচ্চপর্যায়ে নিয়ে গেছে। এখানে প্রতিরাত থাকার জন্য আপনাকে নিজের পকেট থেকে কমপক্ষে ২০৩ ডলার গুনতে হবে। আর উচ্চমানের রুমে থাকলে তো কথাই নেই!

অপরূপ সৌন্দর্যের র‍্যাডিসন ব্লু ওয়াটার হোটেল; Source: Dhaka Tribune
৭. লা মেরিডিয়ান

শাহজালাল আন্তর্জাতিক বিমানবন্দর রোডের উপরে খিলক্ষেত নিকুঞ্জ ২ এ অবস্থিত লা মেরিডিয়ান হোটেল ঢাকায় উচ্চমানের আরেকটি নিদর্শন। এখানে ৩০৪টি রুম এবং ২৫টি স্যুইট রয়েছে যা অত্যন্ত শৌখিন এবং বিলাসী। এখানে রাত কাটানোর জন্য আপনার কোনো কিছুর অভাববোধ হবে এমন পরিস্থিতি হোটেল কর্তৃপক্ষ রাখেনি। প্রতি রাত এখানে কাটানোর জন্য আপনাকে কমপক্ষে ২৪১ ডলার গুনে হোটেল কর্তৃপক্ষকে দিতে হবে। আরো উচ্চমানের রুম বা স্যুইটের জন্য আরো বেশি খরচ পড়বে। এখানে আরো রয়েছে রুফ-টপ সুইমিং পুল যা ব্যবহারের কোনো সময়সীমা নেই, ৬টি রেস্তোরাঁর রুচিশীল সুস্বাদু খাবার, ফিটনেস সেন্টার, বেঙ্গল আর্ট লাউঞ্জ, বাচ্চাদের জন্য সুব্যবস্থা, বিজনেস সেন্টার, স্পা, মেরিডিয়ান ক্লাব লাউঞ্জ ইত্যাদি। শুধু থাকার ব্যবস্থা নয়, বরং আপনি এখানে বিভিন্ন অনুষ্ঠানের আয়োজনও করতে পারেন।

হোটেল লা মেরিডিয়ান; Source: Best Holdings Limited

ঘুরে আসুন আপনার সাধ এবং সাধ্যের সমন্বয়ে দেশের বিভিন্ন বিলাসবহুল হোটেল থেকে। শুধু বিদেশেই নয়, বরং আমাদের দেশেও রয়েছে নজরকাড়া, জাঁকজমকপূর্ণ এমন অনেক হোটেল।

57
By Fuad Hasan Shishir

দিন দিন স্মার্টফোনগুলোর দাম বেড়েই চলেছে। আপনার পছন্দের ব্র্যান্ডের দিকে লক্ষ্য করলেই দেখবেন, তারা প্রতিবছর বিভিন্ন ফিচার এবং হার্ডওয়্যারের মানোন্নয়ন করে সবচেয়ে ভাল ফোনটি বের করে থাকে। আর প্রতিবছরই সেই শীর্ষ ফোনটির দাম বেড়ে যায় বহুগুণে। এমনকি দাম এতটাই বেড়ে যায় যে, আপনার কাছে মনে হতেই পারে এই দাম একেবারেই অন্যায্য।

কে জানতো যে, একটি স্মার্টফোনের দামই লাখ টাকার উপরে হবে? যেমন আইফোন ১০ (iPhone X)। ২০১৭ সালে বের হওয়া এই ফোনটির মূল্য ছিল ৯৯৯ মার্কিন ডলার যা বাংলাদেশে লক্ষ টাকার উপরে বিক্রি করা হচ্ছে। তবে উচ্চমূল্যের এই আইফোনটি সাধারণ মানুষের ক্রয়ক্ষমতার বাইরে বলে অ্যাপল এই মডেলটি আশানুরূপভাবে বিক্রি করতে পারছে না।

অ্যাপলের বিভিন্ন মডেলের আইফোনের দাম; Source: cnetfrance.fr

এই যে বিশ্ববিখ্যাত ব্র্যান্ড যেমন অ্যাপল, স্যামসাং, এলজি, এইচটিসি ইত্যাদি তারা বারবার নিজেদের স্মার্টফোনগুলোর দাম দিনের পর দিন বাড়িয়ে চলেছে। নতুন ফোনগুলোতে তারা কি যুগান্তকারী কোনো উদ্ভাবন দেখাতে পেরেছে? আমরা যা দেখেছি এই কয়েক বছরে তা হলো, ফোনের পেছনে একটি ক্যামেরা থেকে দুইটি (হুয়াওয়ে পি২০ প্রো তে তিনটি ক্যামেরা) ক্যামেরার প্রচলন এসেছে, ডিসপ্লের রেজ্যুলেশনে উন্নয়ন হয়েছে যদিও আমরা খালি চোখে সেই উন্নয়ন খুব একটা ধরতে পারি না, ফোনের বেজেল কমে গেছে এবং উপরে-নিচে অর্থাৎ কাঁচের ডিসপ্লের পরিমাণ বেড়েছে যা প্রকৃতপক্ষে ফোনটিকে করেছে আরো ভঙ্গুর।

এখন নামীদামী কোম্পানির ফোনগুলোর প্রায় এই সবধরনের উন্নয়ন বিভিন্ন চীনা স্মার্টফোন কোম্পানির ফোনগুলোতেও দেখা যাচ্ছে। বড় বড় কোম্পানিগুলো তাদের গ্রাহকদের যে ফিচার এবং হার্ডওয়্যার অফার করছে, চীনা স্মার্টফোনগুলোও প্রায় সেগুলোই দিচ্ছে। কিন্তু তফাৎ হলো দামে। এই নামীদামী স্মার্টফোন কোম্পানিগুলোর তুলনায় চীনা স্মার্টফোনগুলোর দাম অনেকাংশেই কম। ধরা যায় প্রায় অর্ধেক।

মি মিক্স; Source: techcrunch.cn

এখন অনেকেরই যে ধারণাটি রয়েছে তা হলো চীনা কোম্পানিগুলো সাধারণত সস্তা হার্ডওয়্যার দিয়ে থাকে এবং তাদের মাঝে কোনো উদ্ভাবনী গুণ নেই। তারা সাধারণত অন্য কোম্পানিকে নকল করে থাকে। কথাগুলো একদিক দিয়ে আংশিক সত্য আবার অনেকখানিই ভুল। যেমন শাওমি তাদের প্রথম ‘মি মিক্স’ ফোন মডেল দিয়ে দেখিয়ে দিয়েছে সত্যিকারের বেজললেস ফোন আসলে কেমন হওয়া উচিত। ভিভো তাদের ‘X20 Plus’ মডেলে প্রথম ‘অনস্ক্রিন ফিঙ্গারপ্রিন্ট‘ বা ডিসপ্লের ভেতরেই ফিঙ্গারপ্রিন্ট প্রযুক্তির ব্যবহার দেখিয়ে সবাইকে তাক লাগিয়ে দিয়েছে যেগুলো তথাকথিত নামীদামী স্মার্টফোন কোম্পানিগুলো তাদের বিশাল ‘রিসার্চ অ্যান্ড ডেভেলপমেন্ট’ বিভাগ থাকা সত্ত্বেও দেখাতে পারেনি।

ভিভো X20 প্লাস; Source: htcnexus.com

যা-ই হোক, আসা যাক মূল বিষয়ে। এই যে চীনা কোম্পানিগুলো যেমন শাওমি, ওয়ানপ্লাস, হুয়াওয়ের অনর, ভিভো, মেইজু ইত্যাদি তাদের স্মার্টফোনগুলোতে প্রায় একই রকমের হার্ডওয়্যার এবং ফিচার ব্যবহার করা সত্ত্বেও নামীদামী কোম্পানিগুলোর তুলনায় দাম কম রাখছে। কিভাবে সম্ভব হচ্ছে? আসুন আজকে এই বিষয়েই জানা যাক- কিভাবে তারা তাদের স্মার্টফোনগুলোর দাম তুলনামূলকভাবে কম রাখছে অন্যান্যদের তুলনায়।
সীমিত লাভ

চীনা স্মার্টফোন কোম্পানিগুলোর বর্তমানে মূল লক্ষ্য ব্র্যান্ড প্রতিষ্ঠা এবং প্রচারণা। তারা স্মার্টফোন হার্ডওয়্যার থেকে খুব সীমিত লাভ করে থাকে। এমনকি এমনটিও জানা গিয়েছে যে, চীনা স্মার্টফোন ব্র্যান্ড শাওমি তাদের স্মার্টফোন হার্ডওয়্যার থেকে কোনো মুনাফাই অর্জন করে না। তারা আশা করে তাদের ব্র্যান্ড বিশ্বের আনাচেকানাচে ছড়িয়ে যাবে এবং স্বল্প মূল্যে ভালো স্মার্টফোন প্রদান করে তারা চায় ভবিষ্যতেও যাতে গ্রাহকরা তাদের ফোনটি কেনে। তাহলে প্রশ্ন আসতে পারে, তারা স্মার্টফোন থেকে লাভ না করলে প্রতিযোগিতার এই বাজারে টিকে আছে কীভাবে?

তারা অবশ্যই লাভ করে, কিন্তু সেটি তাদের সফটওয়্যারের দিক থেকে। চীনা স্মার্টফোন কোম্পানিগুলো সাধারণত নিজেদের তৈরি কাস্টোমাইজড অ্যান্ড্রোয়েড স্কিন প্রদান করে থাকে। যেমন MIUI, EMUI, ColorOS, HydrogenOS ইত্যাদি। আর কোম্পানিগুলো এসব সফটওয়্যারগুলোতে বিভিন্ন থিম, অতিরিক্ত অ্যাপস (যেগুলোকে অনেকে ব্লটওয়্যার নামেও অভিহিত করে থাকে), গেমস এবং ইন্টারনেট সুবিধা বিক্রি করে মুনাফা পেয়ে থাকে। অর্থাৎ যতদিন ফোনগুলো গ্রাহকদের কাছে থাকবে ততদিন তারা সফটওয়্যারগুলো কিনতে থাকবে এবং কোম্পানিগুলো এভাবে আয় করতে থাকবে।

শাওমির ব্লটওয়্যার এবং ব্রাউজার অ্যাড; Source: gadgetlite.in

শাওমির কথাই ধরা যাক। তারা এসব অ্যাপস, গেমস, থিম বিক্রি করেই মাসে ৪.৯ মিলিয়ন মার্কিন ডলার মুনাফা উপার্জন করে থাকে। গ্রাহকরা তাদের ফোনের MIUI ব্রাউজার দিয়ে শাওমির কোনো অংশীদারী সাইট যেমন Flipkart, Amazon, Myntra, Jabong ইত্যাদিতে ভিজিট করে কোনো পণ্য ক্রয় করলে সেখান থেকে শাওমি একটি কমিশন পেয়ে থাকে। শাওমির ব্রাউজারে কিছু অ্যাপসের বিজ্ঞাপনও দেওয়া থাকে এবং গ্রাহকরা যদি সেই অ্যাপস নিজেদের ফোনে ডাউনলোড করে ইন্সটল করে সেখান থেকেও শাওমি CPA সিস্টেমে (Cost Per Action) আয় করে থাকে।

অর্থাৎ চীনা স্মার্টফোন কোম্পানিগুলো এভাবে তাদের স্মার্টফোন হার্ডওয়্যার থেকে খুব কম লাভ করলেও অন্য বিভিন্ন উপায়ে আয় করে থাকে। যার মাধ্যমে তারা তাদের ব্র্যান্ডের প্রচারণার লক্ষ্য ঠিক রেখে মানুষকে কম দামে স্মার্টফোন প্রদান করে যাচ্ছে।
কোনো ইনভেন্টরি না রাখা

ইনভেন্টরিকে সহজ ভাষায় বললে গুদামঘরের সাথে তুলনা করা যেতে পারে। ইনভেন্টরি হলো সেই স্থান যেখানে কোম্পানিগুলো তাদের তৈরিকৃত স্মার্টফোন মজুদ রাখে। আর ইনভেন্টরি রাখতে গেলে অবশ্যই খরচ হয়। প্রথমত স্মার্টফোন তৈরি করতে এগুলোর বিভিন্ন যন্ত্রাংশ এবং প্রক্রিয়াকরণে প্রচুর খরচ হয়। তারপর সেগুলো বিক্রি না হওয়া পর্যন্ত কোনো উপযুক্ত স্থানে মজুদ করে রাখতে এবং তা তত্ত্বাবধানেও খরচ হয়। এখন এই চীনা কোম্পানিগুলো যারা খুব সীমিত লাভ করে থাকে তাদের কি কোনো ইনভেন্টরি নেই? হ্যাঁ, আছে! কিন্তু তা অপেক্ষাকৃত ক্ষুদ্রাকৃতির।

একটি চীনা স্মার্টফোন ফ্যাক্টরি; Source: ciomagazine.ir

তাহলে এই ইনভেন্টরি সমস্যার সমাধান করতে বা উপযুক্ত কোনো ইনভেন্টরি বাদেই কোম্পানিগুলো কিভাবে তাদের ফোনগুলো বিক্রি করে? এর অন্যতম একটি সমাধান হলো ‘ফ্ল্যাশ সেল‘। ফ্ল্যাশ সেল হলো দ্রুত হাজার হাজার ফোন বিক্রি করে ফেলার একটি উপায়।

কোম্পানিগুলো কিছুটা ছাড় দিয়ে হাজার হাজার ইউনিট ফোন বিভিন্ন ওয়েবসাইটে বিক্রির জন্য দেয়। ক্রেতারা আগে থেকেই বুকিং দিয়ে ফ্ল্যাশ সেল শুরু হওয়া মাত্র সেগুলো দ্রুত কিনে নিতে পারে। এভাবে চীনা কোম্পানিগুলো বড় আকারের ইনভেন্টরি রাখা থেকে এবং নিজেদের ছোট ইনভেন্টরিতে পণ্য অভারস্টক বা বেশি মজুদ করে রাখার হাত থেকে বেঁচে যায়। কিছু কিছু কোম্পানি ‘ইনটাইম ম্যানুফ্যাকচার মেথড’ও ব্যবহার করে থাকে। অর্থাৎ তারা তাদের পণ্য তখনই তৈরি করা শুরু করে যখন কোনো অর্ডার প্লেস করা হয় বা পণ্যের চাহিদা দেখা দেয়। এভাবে তারা অতিরিক্ত কাঁচামাল ক্রয়ের হাত থেকেও বেঁচে যায়।
জিরো মার্কেটিং বাজেট

বড় বড় কোম্পানিগুলোর অধিকাংশ ব্যয়ই হয় মার্কেটিংয়ে। স্যামসাংয়ের মত কোম্পানি শুধু বিলিয়ন বিলিয়ন মার্কিন ডলার খরচ করে প্রতিবছর বিভিন্নভাবে শুধু তাদের স্মার্টফোনের প্রচারণার পেছনেই। যেমন ২০১৬ সালে স্যামসাং ১০ বিলিয়ন মার্কিন ডলার খরচ করেছে মার্কেটিংয়ে। এলজির মত কোম্পানি যারা খুব বেশি স্মার্টফোন তৈরি করে থাকে না তারাও এক বিলিয়ন খরচ করেছে সেই বছরই।

বিলবোর্ডে স্যামসাংয়ের বিজ্ঞাপন; Source: pinsdaddy.com

অন্যদিকে চীনা কোম্পানিগুলো মার্কেটিংয়ের পেছনে তেমন খরচই করে না। যেমন ওয়ানপ্লাস কোম্পানির প্রথম ফোন ওয়ানপ্লাস ওয়ানের কথা বলা যেতে পারে। ওয়ানপ্লাস ওয়ান প্রচারে কোম্পানিটির বাজেট কত ছিলো জানেন? মাত্র ৩০০ মার্কিন ডলার! তারা তাদের ফোন প্রচারে অদ্ভুত এবং বিতর্কিত কিছু উপায় অবলম্বন করেছিলো। যেমন সামাজিক মাধ্যমগুলোর পাশাপাশি লেডিস ফার্স্ট, ইনভাইট সিস্টেম, স্ম্যাশ দ্য পাস্ট (যেখানে ব্যবহারকারীদের বর্তমান ফোন ভেঙ্গে ফেলতেও দেখা গিয়েছে নতুন ওয়ান প্লাস ওয়ান মাত্র ১ ডলারে নেওয়ার জন্য) ইত্যাদি।

‘Smash the past’; Source: ownstartup.com

তাই চীনা কোম্পানিগুলো প্রচারের দিক থেকে মূলত নির্ভর করে থাকে তাদের ফ্যানবেজ এবং বিভিন্ন সামাজিক প্রচার মাধ্যমগুলোর উপর। তারা ফোনগুলো বিভিন্ন প্রযুক্তি রিভিউয়ার, ইউটিউবার এবং ডেভেলপারদেরও দিয়ে থাকে যারা তাদের ফোনগুলো বিভিন্নভাবে ক্রেতাদের নিকট প্রচার করে থাকে। আর ভালোমানের অথচ দামে স্বস্তা স্মার্টফোন সবসময়ই জনগণের একটি আগ্রহের বিষয়। এজন্য প্রচার মাধ্যমগুলোও নিজে থেকেই সেগুলো সংগ্রহ করে রিভিউ দিয়ে থাকে নিজেদের ভিউ এবং ক্লিক বাড়ানোর জন্য। এভাবে মার্কেটিংয়ের একটি বড় অর্থ বেঁচে যায় চীনা কোম্পানিগুলোর।
সীমিত ‘রিসার্চ অ্যান্ড ডেভেলপমেন্ট’ খরচ

চীনের প্রযুক্তি নগরী হলো শেনঝেন। শেনঝেনে ধরা চলে কোনোপ্রকার ‘প্যাটেন্ট ল’ বা স্বত্তাধীকার আইনই নেই। অর্থাৎ কেউ কোনো কিছু আবিষ্কার করলে সেটি অন্যরা ইচ্ছামত নকল করে ব্যবহার করতে পারবে এমনকি বাজারজাতও করতে পারবে কোনো বাধা ছাড়াই। এজন্য আপনারা হয়তো দেখে থাকবেন, চীনা অনেক স্মার্টফোন কোম্পানি তাদের ফোনে হুবহু আইফোন বা স্যামসাংয়ের বিভিন্ন ডিজাইন কপি করে বাজারজাত করছে নির্বিঘ্নে।

দুটি ফোনের ক্যামেরা ডিজাইনে রয়েছে মিল; Source: eworldmagz.com

এজন্য চীনে কেউ বিশেষ কোনো কিছু তৈরি করলেও ধরে নিতে হয় তা অন্যরা নকল করবেই। তাই সেখানে সবকিছুই ওপেন-সোর্সড বা উন্মুক্ত। একজন একটি জিনিস আবিষ্কার করলে অন্যরা তার বিভিন্নভাবে মানোন্নয়ন করে বাজারজাত করে। তবে এই মানোন্নয়নে খুব বেশি খরচ হয় না। বড়বড় কোম্পানিগুলো যেখানে লাখ লাখ মার্কিন ডলার খরচ করে তাদের গবেষণা এবং মানোন্নয়নে সেখানে এই চীনা কোম্পানিগুলো বড়বড় কোম্পানির আবিষ্কার করা যেকোনো ফিচার নির্দ্বিধায় একটু এদিক সেদিক করে নিজেদের স্মার্টফোনে ব্যবহার করতে পারে। এভাবে তারা যুগোপযোগী স্মার্টফোন বাজারজাত করতে পারে ধরা চলে কোনোপ্রকার গবেষণা এবং মানোন্নয়ন খরচ ব্যতিরেকেই।
সস্তা যন্ত্রাংশ এবং শ্রম খরচ

চীনা কোম্পানি তো বটেই অন্যান্য নামীদামী কোম্পানিগুলোও চীনে তাদের ফোন তৈরি করে থাকে। কারণ চীনে রয়েছে প্রচুর শ্রমিক এবং চীনের শ্রমবাজার খুবই সস্তা। এই শ্রমিকদের পেছনে মাথাপিছু মাত্র ৫ ডলার থেকে ১০ ডলার খরচ হয় প্রতিটি ফোন প্রস্তুত করতে। একমাত্র এইচটিসি ব্যতিত যারা তাইওয়ানে শুধু তাদের ফোন তৈরি করে থাকে, অন্যান্য সকল স্মার্টফোন কোম্পানি চীনে তাদের ফোন প্রস্তুত করে থাকে শুধুমাত্র খরচ কম পড়ে বিধায়। আর চীনা কোম্পানিদের নিজের দেশে নিজেদের ফোন প্রস্তুত করতে বিদেশী কোম্পানিদের তুলনায় আরো কম খরচ পড়ে।

সেই সাথে চীনা কোম্পানিগুলো তাদের ইঞ্জিনিয়ার, সহকর্মী, কাস্টোমার কেয়ার এজেন্ট, মার্কেটিং এবং ম্যানেজমেন্ট বিষয়ক স্টাফদেরও অন্যান্য কোম্পানিগুলোর তুলনায় কম বেতন দিতে হয়। যেমন চীনের একজন প্রোডাক্ট ইঞ্জিনিয়ারের বেতন বার্ষিক ৩০,৫০০ মার্কিন ডলার যেখানে যুক্তরাষ্ট্রে সেই পদধারী ব্যক্তির বেতন ৭৪,১৩৬ ডলার এবং জাপানে ৫৩,০০০।

এখন আসা যাক সস্তা যন্ত্রাংশের ব্যাপারে। অনেকে ভেবে থাকেন, চীনা স্মার্টফোন বা চীনা যেকোনো জিনিসই টিকে না কারণ এতে ব্যবহার করা হয় অনুন্নত এবং সস্তা যন্ত্রাংশ। এই ধারণা কি আসলেই সঠিক? আসুন এ ব্যাপারটি বিশ্লেষণ করা যাক স্মার্টফোনের একটি যন্ত্রাংশ র‍্যামের উদাহরণ দিয়ে।

র‍্যাম; Source: doctorandroid.gr

ধরুন, আপনার একটি র‍্যাম ফ্যাক্টরি রয়েছে যেখানে আপনি স্মার্টফোনের র‍্যাম তৈরি করে থাকেন। এখন আপনার ফ্যাক্টরিতে অ্যাপল আসবে ট্রিলিয়ন ডলার বাজেট নিয়ে এবং তারা দাবী করবে আপনার ফ্যাক্টরির সর্বোৎকৃষ্ট র‍্যাম তাদের আইফোনের জন্য দিতে। এক্ষেত্রে মনে প্রশ্ন জাগতে পারে সর্বোৎকৃষ্ট র‍্যাম কিভাবে নির্ধারণ করা হয়? র‍্যামের মত যন্ত্রাংশ সাধারণত তৈরি করা হয় ব্যাচ ভাবে।

ধরুন এক ব্যাচে ১,০০০ র‍্যাম আছে। অ্যাপল সেই ব্যাচের র‍্যামই নিবে যে ব্যাচে সর্বোচ্চ ১০টি র‍্যামের ফ্যাক্টরি কোয়ালিটি চেক ফেইলড বা অনুত্তীর্ণ হয়। ক্ষুদ্রক্ষুদ্র যন্ত্রাংশগুলোতে এমন কোয়ালিটি ফেইলার স্বাভাবিক। অর্থাৎ সর্বোচ্চ ১% কোয়ালিটি চেক ফেইল সম্বলিত র‍্যামই অ্যাপল সর্বোচ্চ দাম দিয়ে গ্রহণ করবে তার বেশি নয়।

এখন মনে করুন, স্যামসাং আসলো আপনার কোম্পানিতে এবং তাদের অ্যাপলের মত বাজেট নেই। তাই তারা সর্বোচ্চ ৩% কোয়ালিটি চেক ফেইলড সম্বলিত র‍্যাম কিনলো আপনার কাছ থেকে কিছুটা কম দাম দিয়ে। অর্থাৎ তারা অ্যাপলের থেকে একটু কম মানসম্পন্ন র‍্যাম কিনলো তাদের স্মার্টফোনের জন্য। এখন এই অনুত্তীর্ণ র‍্যামগুলো আসলে কি অকাজের? না! এগুলো শুধু ফ্যাক্টরি স্ট্যান্ডার্ড বা মানের সাথে যায় না।

এখন আপনি যা করলেন তা হলো কোনো কম বাজেট সম্পন্ন চীনা কোম্পানি যেমন UMIDIGI-কে বললেন যে আপনার কাছে ফ্যাক্টরির মাপকাঠিতে যায় না এমন কিছু র‍্যাম আছে যেগুলা একদমই পানির দামে দিয়ে দিতে রাজী। তারা সেগুলো সবচাইতে কমদামে কিনে তাদের স্মার্টফোনে ব্যবহার করলো। এখন কোনো ক্রেতা দেখলো অ্যাপল, স্যামসাং এবং UMIDIGI’র ফোনে একই পরিমাণ হার্ডওয়্যার স্পেসিফিকেশন রয়েছে অথচ শেষের কোম্পানিটির দাম সবচেয়ে কম। এর কারণ হলো কোম্পানিটি সবচেয়ে কম মানসম্পন্ন যন্ত্রাংশ ব্যবহার করেছে তাদের স্মার্টফোনে।

এটি শুধু একটি উদাহরণ। কিছু কোম্পানি রয়েছে যারা এভাবে কমদামী এবং অনুন্নত যন্ত্রাংশ সস্তা দামে কিনে নিজেদের ফোনে ব্যবহার করে তা কমদামে বিক্রিও করে থাকে। তাই সেসব ফোনে কয়েকদিন পর সমস্যাও বেশি হতে দেখা যায়। আসলে এভাবে ক্রেতারা বুঝতেও পারেন না যে, তারা আসলে কেমন মানের যন্ত্রাংশ সম্বলিত স্মার্টফোন কিনছেন। হয়তো বাইরের কেসিং দেখে এবং ধরে প্রিমিয়াম ফিলিংস আসতে পারে কিন্তু আসল রহস্যটি থাকে ফোনের ভেতরের যন্ত্রাংশগুলোতে।

58
By Muhaiminul Islam Antik

শারীরিক আঘাতের চেয়ে মানসিক আঘাতের মাধ্যমে প্রতিপক্ষকে শায়েস্তা করার ফলাফল সবসময়ই সুদুরপ্রসারী হয়ে থাকে। বিভিন্ন খেলাধুলার সময় একপক্ষ যে নিজের দল সম্পর্কে নানা ভীতিকর কথা বলে এবং অপরপক্ষকে হেয় প্রতিপন্ন করার চেষ্টা করে, সেটিও এক প্রকার মনস্তাত্ত্বিক কৌশল ছাড়া আর কিছুই না। একই কথা বলা যায় যুদ্ধ-বিগ্রহের বেলাতেও। যুদ্ধের সময়ও একটি বাহিনীর নেতারা এমন সব কৌশল প্রয়োগের চেষ্টা করেন যাতে যত তাড়াতাড়ি সম্ভব প্রতিপক্ষকে মানসিকভাবে দুর্বল করে দেয়া যায়। ফলে চেতনাশক্তিতে দুর্বল সেই প্রতিপক্ষকে তখন যুদ্ধের ময়দানে হারানোটা অনেকটাই সহজ হয়ে যায় তাদের জন্য। পৃথিবীর ইতিহাস থেকে এমনই কিছু মনস্তাত্ত্বিক যুদ্ধের কৌশল তুলে এনেই সাজানো হয়েছে আজকের লেখাটি।
পেলুসিয়ামের যুদ্ধ

৫২৫ খ্রিষ্টপূর্বাব্দে পার্সিয়ান সাম্রাজ্য এবং প্রাচীন মিশরের মাঝে পেলুসিয়ামের যুদ্ধ সংঘটিত হয়। এ যুদ্ধের ফলে শাসনক্ষমতা তৎকালীন ফারাওদের হস্তচ্যুত হয় এবং সিংহাসনে বসেন পার্সিয়ান রাজা দ্বিতীয় ক্যাম্বাইসেস। এ যুদ্ধের বিস্তারিত বর্ণনা দিতে এ লেখাটা লিখছি না। বরং কীভাবে সূক্ষ্ম এক চালের সাহায্যে পুরো মিশরীয় বাহিনীকে প্রথমে মানসিক ও পরে শারীরিকভাবে পর্যুদস্ত করেছিলো পার্সিয়ানরা, সেটা বলতেই এ লেখা।
শিল্পীর তুলিতে আঁকা পেলুসিয়ামের যুদ্ধ

শিল্পীর তুলিতে আঁকা পেলুসিয়ামের যুদ্ধ

প্রাচীন মিশরে বিড়াল ছিলো বেশ সমাদৃত এক প্রাণী। বর্তমানে আমাদের কাছে ‘কিউট’, ‘সো সুইট’, ‘এত্তগুলা সুন্দর’ বিড়ালের প্রতি শ্রদ্ধা ও ভয়ের এক মিশ্র অনুভূতি কাজ করতো মিশরীয়দের মাঝে। এটা জানতো আক্রমণকারী পার্সিয়ান বাহিনী। সত্যি কথা বলতে, এটা ছিলো মিশরীয়দের এক ধরনের দুর্বলতা। আর এ দুর্বলতার সুযোগ পুরোপুরিই কাজে লাগিয়েছিলো তারা।

বাস্টেট

পার্সিয়ান বাহিনী তাদের ঢালগুলোতে বিড়ালের ছবি এঁকে নিয়েছিলো। কোনো কোনো ঐতিহাসিকের মতে, পার্সিয়ান বাহিনী তাদের প্রতিরক্ষার জন্য একেবারে আসল বিড়ালই ব্যবহার করেছিলো। মিশরীয়রা তখন ‘বাস্টেট’ নামে এক দেবীর পূজা করতো যার দেহাবয়ব ছিলো বিড়ালের মতোই। তাকে তারা বিড়াল, নিরাপত্তা, আনন্দ, নৃত্য, সঙ্গীত, পরিবার ও ভালোবাসার দেবী মনে করতো। তাই বাস্টেটের প্রতীকে আক্রমণ করতে অস্বীকৃতি জানায় মিশরীয় সৈন্যরা। দ্বিতীয় শতাব্দীর মেসিডোনিয়ান লেখক পলীনাসের মতে, পার্সিয়ান বাহিনীর সম্মুখভাগ সাজানো হয়েছিলো কুকুর, বিড়াল, ভেড়া ও আইবিস পাখির মাধ্যমে। এদের সবগুলোই মিশরীয়দের কাছে বেশ পবিত্র ছিলো। ফলে সেসবে আক্রমণ করতে অনীহাই তাদের প্রাণনাশের কারণ হয়ে দাঁড়ায়। গ্রীক ঐতিহাসিক টেসিয়াসের মতে, এ যুদ্ধে মিশরীয়রা প্রায় ৫০,০০০ ও পার্সিয়ানরা প্রায় ৭,০০০ সেনা হারায়।

অবশ্য এ যুদ্ধের কারণটাও ছিলো বেশ অদ্ভুত, বলা যায় হৃদয়ের লেনদেন বিষয়ক। গ্রীক ঐতিহাসিক হেরোডোটাসের মতে, ক্যাম্বাইসেস তৎকালীন মিশরের ফারাও দ্বিতীয় অ্যামাসিসের মেয়েকে বিয়ে করতে চেয়েছিলেন। কিন্তু অ্যামাসিস ভেবেছিলেন যে, তার মেয়ে হয়তো প্রকৃত রাণীর মর্যাদা পাবে না। বরং তাকে রাখা হবে উপপত্নী হিসেবে। এটা ভেবে তিনি তার আগের ফারাওয়ের মেয়েকেই নিজের মেয়ে হিসেবে ছদ্মবেশে বিয়ে দিতে পাঠান ক্যাম্বাইসেসের কাছে। কিন্তু দুর্ভাগ্য অ্যামাসিসের, কারণ ক্যাম্বাইসেস এ কৌশলটি ধরে ফেলেন। এতেই মারাত্মক ক্ষেপে গিয়ে তিনি মিশর আক্রমণের সিদ্ধান্ত নেন। এরপর কী হলো তা তো শুরুতেই বলেছি।
মেসিডনের রাজা দ্বিতীয় ফিলিপ

৩৫৯ খ্রিষ্টপূর্বাব্দ থেকে শুরু করে গুপ্তঘাতকের হাতে খুন হওয়ার আগে ৩৩৬ খ্রিষ্টপূর্বাব্দ পর্যন্ত প্রাচীন গ্রীক রাজ্য মেসিডনের রাজা ছিলেন দ্বিতীয় ফিলিপ। তাকে যদি চিনতে কষ্ট হয়, তবে জেনে নিন তিনিই বিশ্বখ্যাত আলেকজান্ডার দ্য গ্রেটের বাবা।

দ্বিতীয় ফিলিপের ভাষ্কর্য

ফিলিপ যখন মেসিডনের শাসনভার নিজ হাতে তুলে নিলেন, তখন সেটি বলার মতো কিছুই ছিলো না। বরং বারবার বহিঃশক্তির আক্রমণে পঙ্গু অবস্থায় ছিলো রাজ্যটি। কিন্তু দায়িত্ব নেয়ার মাত্র বছরখানেকের মাঝেই তিনি সকল অন্তর্কলহ কঠোর হস্তে দমন করলেন এবং মেসিডনকে এক শক্তিশালী রাজ্য বানানোর দিকে এগিয়ে নিতে থাকলেন।

মনস্তাত্ত্বিক যুদ্ধকৌশলে বেশ নিপুণ এক খেলোয়াড় ছিলেন দ্বিতীয় ফিলিপ। চালসিডিয়ান লীগের সাথে যুদ্ধের সময় তিনি স্টাগিরাস শহরটি একেবারে ধুলোয় মিশিয়ে দেন। প্রাচীন ঐতিহাসিকদের মতে, ফিলিপ শহরটি এমনভাবেই ধ্বংস করেছিলেন যে, একজন আগন্তুক যদি কোনো কারণে সেখানে আসতো, তবে সেখানে যে এককালে জনবসতি ছিলো এ কথাটি তাকে বিশ্বাস করাতেও কষ্ট হতো। ফিলিপের এমন কর্মকান্ডে মারাত্মক ভয় পেয়ে অন্যান্য চালসিডিয়ান শহরগুলো বিনা প্রতিরোধে তার কাছে আত্মসমর্পণ করতে বাধ্য হয়।

শিল্পীর তুলিতে যুদ্ধরত দ্বিতীয় ফিলিপ

৩৩৮ খ্রিষ্টপূর্বাব্দে কীরোনিয়ার যুদ্ধের সময়ও তিনি চমৎকার কৌশল খাটান। এথেন্স ও থীবসের বিদ্রোহীদের রোদ্রের প্রখর তাপের মাঝে দাঁড় করিয়ে রেখে প্রথমে ক্লান্ত করে ছাড়েন তিনি। পরবর্তীতে তাদের তিনি একটি আক্রমণ করেন যা আসলে মূল আক্রমণ ছিলো না। এ আক্রমণের ফলে বিদ্রোহীরা তার বাহিনীকে ধাওয়া করে এগিয়ে আসতে থাকে। কিন্তু ওদিকে ফিলিপের সৈন্যরা আগে থেকেই এ পরিস্থিতির জন্য প্রস্তুত ছিলো। তাই তারা চারদিক থেকে তখন সেই বিদ্রোহীদের ঘিরে ফেললে তারাই ফাঁদের মাঝে পড়ে যায়। শুরুতে রোদে পুড়ে ক্লান্ত হওয়া সৈন্যরা যখন পরে এভাবে ফাঁদে পা রাখে, তখন তাদের মানসিক অবস্থা কেমন হতে পারে তা সহজেই অনুমেয়।
তুর্কী-মোঙ্গল সেনাধ্যক্ষ তৈমুর লং

তুর্কী-মোঙ্গল সেনাধ্যক্ষ তৈমুর লং ছিলেন তিমুরীয় সাম্রাজ্যের প্রতিষ্ঠাতা। ১৩৭০ থেকে ১৪০৫ সাল পর্যন্ত পঁয়ত্রিশ বছর ছিলো তার রাজত্ব। আজকের দিনের তুরষ্ক, সিরিয়া, ইরাক, কুয়েত, ইরান থেকে মধ্য এশিয়ার অধিকাংশ অংশ (কাজাখস্তান, আফগানিস্তান, রাশিয়া, তুর্কমেনিস্তান, উজবেকিস্তান, কিরগিজস্তান, পাকিস্তান, ভারত, এমনকি চীনের কাশগর পর্যন্ত) তার সাম্রাজ্যের অন্তর্ভুক্ত ছিলো। ১৪০৫ সালের ১৮ ফেব্রুয়ারি মারা যান সুপরিচিত এ বিজেতা।

তৈমুর লং-এর ভাষ্কর্য

ঐতিহাসিকদের মতে, তৈমুরের বাহিনীর হাতে প্রায় ১,৭০,০০,০০০ লোক নিহত হয়েছিলো, যা ছিলো তৎকালে বিশ্বের মোট জনসংখ্যার প্রায় ৫ ভাগ। তার হাতে পরাজিতদের ভাগ্য হতো বেশ করুণ। পরাজিতদের খুলি দিয়ে পিরামিড বানানোর কুখ্যাতি আছে তার নামে। আর শত্রুর নামে যদি এমন কিছু প্রচলিত থাকে, তাহলে যে তার প্রতিপক্ষের শিরদাঁড়া দিয়ে ভয়ের শীতল স্রোত বয়ে যাবে, তা তো না বললেও চলে।

শিল্পীর কল্পনায় খাঁচায় বন্দী সুলতান প্রথম বায়েজিদ

কোনো কোনো ঐতিহাসিকের মতে- ১৪০১ সালে তার বাহিনীর বাগদাদ আক্রমণে ৯০,০০০ এর মতো মানুষ মারা যায়। মৃতদের খুলি দিয়ে তখন ১২০টি পিরামিড বানানো হয়েছিলো। দিল্লী বিজয়ের পর তার গণহত্যা অনেকদিন ভারতের জনগণের কাছে দুঃস্বপ্নের নামান্তর হয়ে ছিলো। অটোম্যান সাম্রাজ্যের বিরুদ্ধে বিজয়ের পর তিনি বাইজান্টাইন গেট খুলে নিজের প্রাসাদে নিয়ে আসেন। সেই সাথে খাঁচায় বন্দী করে তিনি নিয়ে এসেছিলেন সুলতান প্রথম বায়েজিদকেও যাকে তিনি তার বৈঠকখানায় প্রদর্শনের জন্য রেখে দিয়েছিলেন। তবে এ ব্যাপারে অবশ্য দ্বিমত পোষণ করেন তৈমুরের পক্ষের ঐতিহাসিকেরা। তাদের মতে, তৈমুর তার সাথে ভালো ব্যবহার করতেন। এমনকি তার মৃত্যুর পর তিনি শোকও প্রকাশ করেছিলেন।
মোঙ্গল সাম্রাজ্যের প্রতিষ্ঠাতা ও সম্রাট চেঙ্গিস খান

চেঙ্গিস খান

বিশ্বখ্যাত মোঙ্গল সাম্রাজ্যের প্রতিষ্ঠাতা ও সম্রাট চেঙ্গিস খানের নাম শোনে নি এমন মানুষ খুঁজে পাওয়া দায়। সাম্রাজ্য প্রতিষ্ঠার পর তিনি রাজ্য বিস্তারে মনোযোগী হন। তার সময়কালে অধিকাংশ ইউরাশিয়া মোঙ্গল সাম্রাজ্যের অন্তর্ভুক্ত হয়। এছাড়া কারা খিতাই, ককেশাস ও খারেজমিয়ান সাম্রাজ্য এবং ওয়েস্টার্ন শিয়া ও জিন রাজপরিবারের বিরুদ্ধেও অস্ত্র হাতে নিয়েছিলো চেঙ্গিস খানের নেতৃত্বাধীন মোঙ্গল বাহিনী। ঐতিহাসিকদের মতে, চেঙ্গিস খানের গোটা জীবনকাল ধরে চলা বিভিন্ন অভিযানে প্রায় ৪,০০,০০,০০০ লোক প্রাণ হারিয়েছিলেন। মধ্যযুগের বিভিন্ন আদমশুমারি থেকে জানা যায় যে, তার জীবনকালে চীনের জনসংখ্যা প্রায় এক কোটির মতো হ্রাস পেয়েছিলো। ওদিকে ঐতিহাসিকদের মতে, খারেজমিয়ানদের সাথে তার যুদ্ধকালে আধুনিক ইরানের তিন-চতুর্থাংশ লোক প্রাণ হারায়! সব মিলিয়ে, মোঙ্গল বাহিনীর আক্রমণে তখন বিশ্বের প্রায় এগারো শতাংশ লোক প্রাণ হারিয়েছিলো।

যে চেঙ্গিস খানের মোঙ্গল বাহিনী এত ত্রাসের সঞ্চার করেছিলো গোটা বিশ্বজুড়ে, সেই বাহিনীর সর্বাধিনায়ক যে মনস্তাত্ত্বিক যুদ্ধকৌশলকে খুব গুরুত্ব সহকারে দেখবেন, সেটা তো না বললেও চলে।

চলছে যুদ্ধ

যুদ্ধের সময় তিনি ইচ্ছা করেই নিজের বাহিনীর সৈন্য সংখ্যা বাড়িয়ে বলতেন যাতে করে প্রতিপক্ষ সেটা জেনে শুরুতেই মানসিকভাবে দুর্বল হয়ে যায়। বাহিনীর সৈন্য সংখ্যা বেশি দেখাতে মাঝে মাঝেই তার বাহিনীর ঘোড়ার পিঠে ডামি চড়িয়ে দেয়া হতো। এছাড়া তার বিখ্যাত এক কৌশল ছিলো রাতের বেলায় ক্যাম্পফায়ার জ্বালানোর মাধ্যমে দৃষ্টিভ্রম তৈরি করা। চেঙ্গিসের বাহিনীর সৈন্যদের প্রতি নির্দেশ ছিলো যে, রাতের বেলায় তারা প্রত্যেকেই যাতে কিছুটা দূরে দূরে আগুন জ্বেলে রাখে। এভাবে যখন প্রতিটি সৈন্যই আগুন জ্বালাতো, তখন স্বাভাবিকভাবেই রাতটা হয়ে উঠতো অনেক বেশি আলোকিত। দূর থেকে শত্রুপক্ষ তাদের দেখতে পেয়ে প্রকৃত সৈন্য সংখ্যা সম্পর্কে অনুমানে যেমন ব্যর্থ হতো, তেমনি সংখ্যাধিক্যের কথা চিন্তা করে ভড়কেও যেত।

মাঝে মাঝে চেঙ্গিস খানের মেকি পশ্চাদপসরণে শত্রু ভুল বুঝে তার বাহিনীকে তাড়া করে শেষ পর্যন্ত তার তীরন্দাজ বাহিনীর কাছেই প্রাণ বিসর্জন দিয়েছে। প্রতিপক্ষ সম্পর্কে সবসময় বেশ ভালো জ্ঞান রাখতেন তিনি। পরবর্তীতে তাদের ছত্রভঙ্গ করতে এ জ্ঞানকেই কাজে লাগাতেন তিনি। তার আরো একটি কৌশল ছিলো উটের গায়ে নাকাড়া লাগিয়ে সেগুলোকেও অশ্বারোহী বাহিনীর সাথে যুদ্ধে পাঠানো। এতে বাদ্যযন্ত্রের শব্দও প্রতিপক্ষের বুকে কাঁপন তুলে দিত।
তথ্যসূত্র

(১) en.wikipedia.org/wiki/Battle_of_Pelusium_(525_BC)

(২) en.wikipedia.org/wiki/Bastet

(৩) en.wikipedia.org/wiki/Timur

(৪) en.wikipedia.org/wiki/Genghis_Khan

(৫) listverse.com/2016/12/11/10-ancient-psychological-warfare-tactics/

(৬) history.com/news/history-lists/10-things-you-may-not-know-about-genghis-khan

59
By Tawfiqur Rahman
পেঁয়াজ বর্তমান পৃথিবীতে রান্নায় ব্যবহৃত অন্যতম জনপ্রিয় একটি মসলা। নানা মজাদার রান্নায় ব্যবহারের পাশাপাশি পেঁয়াজের রয়েছে নানা ঔষধি গুণ। তাই পৃথিবীর প্রায় সব স্থানেই রয়েছে পেঁয়াজের আলাদা কদর। আমাদের দেশেও পেঁয়াজের ব্যাপক ব্যবহার লক্ষ্য করা যায়। এই তো ক’দিন আগেও আমাদের দেশে পেঁয়াজ ছিল উচ্চমূল্য। অনেকেই সেসময় পেঁয়াজের সাথে অর্থের তুলনা কিংবা উপহার হিসেবে পেঁয়াজ দেওয়া ইত্যাদি নিয়ে মজা করেছিলেন। কিন্তু একটা সময় ছিল যখন কিন্তু এই পেঁয়াজ সত্যই অর্থের বিকল্প ও লেনদেনের মাধ্যম হিসেবে ব্যবহৃত হতো। মানুষ নানা উপলক্ষে একে অন্যকে উপহার দিত পেঁয়াজ! কী? বিশ্বাস হচ্ছে না? চলুন আজকে জেনে নেই পেঁয়াজের এই অদ্ভুত ইতিহাস সম্পর্কে।

ভিনসেন্ট ভ্যান গখের আঁকানো পেঁয়াজের একটি চিত্রকর্ম; Source: pinterest.com
পেঁয়াজ ছিলতে গিয়ে অনেকের চোখের জল নাকের জল এক হলেও পেঁয়াজের উপকারী গুণ ও আরোগ্য ক্ষমতা কিন্তু অবিশ্বাস্য! আর মসলা হিসাবে পেঁয়াজের গুরুত্ব তো বলাই বাহুল্য। পেঁয়াজ প্রাচীন মসলা। সেই প্রাচীন রোমের এক বিখ্যাত খাদ্যরসিক এপিসিয়াসের লেখাতে সর্বপ্রথম পেঁয়াজের উল্লেখ দেখতে পাওয়া যায়। প্রাচীন মিশরের বিখ্যাত পিরামিডের নির্মাণকাজে নিযুক্ত শ্রমিকদের রান্নার মেনুতেও ছিল পেঁয়াজ। শুধু তাই নয়, পৃথিবীতে যখন কৃষি কাজের প্রচলন হয়নি সেই সময়েও খাদ্য হিসেবে পেঁয়াজের ব্যবহারের প্রমাণ পাওয়া যায়।

১৮৬৫ সালের একটি শস্যবীজের দোকানের বিজ্ঞাপন; Source: flicker.com
তবে ঠিক কবে থেকে এই পেঁয়াজের চাষাবাদ শুরু হয়েছিল কিংবা ঠিক কবে থেকে রান্নায় পেঁয়াজের ব্যবহারের প্রচলন ঘটে তা সঠিক জানা যায়নি। মধ্য ও দক্ষিণ-পশ্চিম এশিয়ার প্রায় সাত সহস্রাব্দ আগের ব্রোঞ্জ যুগের কিছু মানববসতিতে সবজি হিসাবে পেঁয়াজের ব্যবহারের কিছু নমুনা পাওয়া গিয়েছে। আরেক দল গবেষকের মতে, ইরান ও পশ্চিম পাকিস্তানে সর্বপ্রথম পেঁয়াজের চাষ করা হয়। ইতিহাসবিদদের মতে, প্রাচীন ইতিহাসের গোড়ার দিকে চাষ হওয়া কিছু ফসলের মধ্যে পেঁয়াজ অন্যতম। সহজেই নানা জলবায়ুর সাথে খাপ খাইয়ে নেয়া, ধীর পচনশীলতা ও সহজে বহনযোগ্য হওয়ায় প্রাচীন মানুষের কাছে পেঁয়াজ ছিল প্রয়োজনীয় একটি খাদ্য। আমেরিকান পেঁয়াজ সমিতির তথ্য অনুযায়ী, প্রাচীন মানুষের তৃষ্ণাও মেটাতো পেঁয়াজ। যখন সব পুষ্টিকর খাদ্য ফুরিয়ে যেত সেসময় খাওয়ার জন্য আগে মানুষ পেঁয়াজ সংরক্ষণ করতো।

১৮৯৭ সালের পেঁয়াজ বীজের একটি মূল্য তালিকা; Source: Henderson, Peter & Co.(New York, N.Y.)
এসব কারণে পেঁয়াজ যে খুবই জনপ্রিয় একটি খাদ্য ছিল তা কিন্তু বলাই যায়। সেই সুদূর পূর্ব থেকে প্রাচীন মিশর অব্দি, পৃথিবীর বহু দেশে বহু সংস্কৃতিতে পেঁয়াজের ব্যবহারের বহু দলিল ইতিহাস ঘাটলেই পাওয়া যায়। সেই সাথে মজার ব্যাপার হলো, পৃথিবীর বহু স্থানে এই পেঁয়াজকেই অনন্ত জীবনের প্রতীক হিসাবে দেখা হতো। পেঁয়াজের গোলাকার আকৃতি ও এর সমকেন্দ্রিক একটির উপর আরেকটি চক্রাকার রিং থেকে এই ধারণার জন্ম বলে মনে করা হয়।
শুধু তাই নয়, প্রাচীনকালে মানুষের কাছে পেঁয়াজের ছিল বিশেষ গুরুত্ব। প্রাচীন মিশরীয়দের কাছে পেঁয়াজ ছিল পূজনীয় বস্তু। তারা মনে করতো মৃত্যুর পরের জীবনের জন্য পেঁয়াজ অতি গুরুত্বপূর্ণ। ফলে তাদের সমাধির মধ্যে তারা পেঁয়াজ রাখতো। এই ঘটনার সবচেয়ে চমকপ্রদ প্রমাণ পাওয়া যায় রাজা চতুর্থ রামেসিসের সমাধিতে। এই সমাধি আবিষ্কৃত হওয়ার পর দেখা যায় রাজা চতুর্থ রামেসিসের মমির দুই চক্ষু কোটরে ভরে রাখা হয়েছে পেঁয়াজ! এছাড়াও মৃতদেহের শরীরের নানা অংশে পেঁয়াজ রাখা হতো। বুকে পেঁয়াজের ফুল দিয়ে ঢেকে দেওয়া হতো। মমির কান, পায়ের পাতা ইত্যাদি স্থানে পেঁয়াজ দিয়ে সাজানো হতো। বহু মিসরীয় পিরামিডের ভিতরের নানা চিত্রকর্মে পেঁয়াজের উপস্থিতি লক্ষ করা যায়। বহু মিশরীয় যাজকদেরকেও ছবিতে পেঁয়াজ হাতে দেখা গিয়েছে।

পেঁয়াজের মালা পরিহিত ব্যক্তির চিত্র; Source: gallica.bnf.fr
পেঁয়াজের ঝাঁঝালো গন্ধ কি আপনার অপছন্দ? তবে জেনে রাখুন, কিছু মিশরীয়দের ধারণা ছিল পেঁয়াজের এই ঝাঁঝালো গন্ধ ও তার জাদুকরী ক্ষমতায় মৃত মানুষ আবার নিঃশ্বাস নেওয়া শুরু করে। গবেষকদের মতে, এমন ধারণার পিছে কারণ হলো, পেঁয়াজের ঔষধি গুণ। পেঁয়াজের ঔষধি গুণের কারণে নানা অসুখ ভালো হতো। ফলে মিশরীয়রা পেঁয়াজকে জাদুকরী বস্তু মনে করতো।

পেঁয়াজ বয়ে নিয়ে যাচ্ছে ১৯৮৭ সালের একটি পরিবার; Source: Wikipedia Commons
তবে প্রাচীন মিশরীয়দের তুলনায় প্রাচীন গ্রিকরা পেঁয়াজের ব্যবহারে ছিল কয়েক ধাপ এগিয়ে। তারা পেঁয়াজের বহু স্বাস্থ্যগত উপকারিতা সম্পর্কে অবগত ছিল। ফলে প্রাচীন গ্রিসের ক্রীড়াবিদরা প্রচুর পরিমাণে পেঁয়াজ খেতো। এছাড়াও নিজেদের পেশী আরো মজবুত ও শক্তিশালী করতে রোমান গ্লাডিয়েটররা তাদের শরীরে পেঁয়াজ মালিশ করতো। রোমানরাও পেঁয়াজের নানা উপকারী দিক সম্পর্কে জানতো। তারা দাঁতের ব্যথা কিংবা অনিদ্রা দূর করতে পেঁয়াজ খেতো। প্রাচীন রোমে যে ব্যাপক আকারে পেঁয়াজের চাষ হতো তার প্রমাণ পাওয়া যায় অগ্নুৎপাতে চাপা পড়ে যাওয়া পম্পেই নগরীতে। সেখানেও প্রত্নতত্ত্ববিদরা খুঁজে পেয়েছেন পেঁয়াজ চাষের প্রমাণ। বাইবেলেও ইসরাইলীদের পেঁয়াজ খাওয়ার উল্লেখ পাওয়া যায়।

পেঁয়াজ হাতে মধ্যযুগীয় কৃষক; Source: flicker.com
মধ্যযুগে পেঁয়াজকে দেখে হতো ‘সুপার-ফুড’ হিসাবে। সেসময় মানুষ ঠিক মুদ্রার মতো পেঁয়াজ ব্যবহার করতো। নানা কাজের পারিশ্রমিক হিসাবে কিংবা ভাড়া পরিশোধ করার ক্ষেত্রেও পেঁয়াজের প্রচলন ছিল। এছাড়াও বিশেষ বিশেষ অনুষ্ঠান যেমন বিয়েতে মানুষ বর-কনেকে পেঁয়াজ উপহার দিতো। মধ্যযুগে ইউরোপীয় রান্নার প্রধান তিন উপাদান ছিল শিম, পেঁয়াজ ও বাঁধাকপি। ধনী গরীব নির্বিশেষে সবাই খাবারে পেঁয়াজ ব্যবহার করতো।

১৯৬৪ সালের এক পেঁয়াজ বিক্রেতা মহিলা; Source: Wikipedia Commons
ইতিহাসে ওষুধ হিসাবেও পেঁয়াজের ব্যবহার উল্লেখযোগ্য। বিশেষ করে ষোড়শ শতাব্দীতে ওষুধ হিসাবে পেঁয়াজের কিছু অদ্ভুত ব্যবহার দেখতে পাওয়া যায়। যেসব মহিলার সন্তান জন্ম দিতে সমস্যা দেখা যেত কিংবা যাদের কোনো ছেলেমেয়ে হতো না তাদেরকে বিশেষভাবে পেঁয়াজ খেতে দেওয়া হতো। মাথাব্যথা উপশমের জন্য পেঁয়াজের ব্যবহার ছিল বহু প্রচলিত। এছাড়া সাপের কামড় ও চুল পড়া রোধে পেঁয়াজ ব্যাপক ভাবে ব্যবহৃত হতো।
ষোড়শ শতাব্দীতে মানুষ যখন আটলান্টিকের অন্য পাশের উন্নত জীবন ও জীবিকার আশায় পৃথিবীর পশ্চিম গোলার্ধে পাড়ি জমালো, তখন তারা তাদের সাথে করে কিছু পেঁয়াজ নিয়ে আসতে ভোলেনি। তাদের ব্যক্তিগত ডায়েরি থেকে জানা যায়, আমেরিকায় সেই ঔপনিবেশিকদের মাধ্যমেই প্রথম পেঁয়াজের চাষ শুরু হয়। উত্তর আমেরিকায় পাড়ি জমানো প্রথম ঔপনিবেশিকদের প্রথম চাষ করা ফসল ছিল পেঁয়াজ। তবে, ইউরোপীয়দের আগমনের আগেই আমেরিকার আদিবাসীদের মধ্যে পেঁয়াজের ব্যবহার চালু ছিল। তারা নানা সিরাপ, রঙ ও ওষুধ প্রস্তুত করার জন্য পেঁয়াজ ব্যবহার করতো। কাঁচা কিংবা রান্না করে এবং বিভিন্ন রান্নার মশলা হিসাবেও তারা ব্যবহার করতো পেঁয়াজ।

হাঙ্গেরিতে অবস্থিত পেঁয়াজের একটি ভাস্কর্য; Source: Wikipedia Commons
ভারতে ষষ্ঠ শতাব্দীতে পেঁয়াজের ব্যবহারের প্রমাণ পাওয়া যায়। বিখ্যাত চিকিৎসাবিদ্যার গ্রন্থ চক্র সংহিতাতেও ওষুধ হিসাবে পেঁয়াজের উল্লেখ পাওয়া যায়। সেখানে পেঁয়াজকে মূত্রবর্ধক, হজমে সহায়ক, হৃদপিন্ড ও চোখের জন্য উপকারী হিসাবে বর্ণনা করা হয়েছে। আর প্রাচীনকালের এসব বর্ণনার সত্যতা মিলছে বর্তমানের আধুনিক নানা গবেষণায়। বর্তমানে পেঁয়াজের নানা ওষধি গুণ কিন্তু বৈজ্ঞানিকভাবে প্রমাণিত। পেঁয়াজ থেকে নানা ওষুধও তৈরি হয় এখন।
তাই পেঁয়াজ যদি আপনার অপছন্দের তালিকায় থেকে থাকে কিংবা পেঁয়াজকে যদি আপনার তুচ্ছ কোনো মশলা বলে মনে হয়, তবে আশা করা যায় আজকের এই লেখা পড়ার পর আপনার ধারনা হয়তো কিছুটা হলেও বদলাবে।

Pages: 1 2 3 [4] 5 6 ... 23