Show Posts

This section allows you to view all posts made by this member. Note that you can only see posts made in areas you currently have access to.


Messages - alsafayat

Pages: [1] 2
1
বাংলাদেশের ১৯৭১-এর মুক্তিযুদ্ধে সোভিয়েত ইউনিয়নের (ইউনিয়ন অব সোভিয়েত সোস্যালিস্ট রিপাবলিক  ইউএসএসআর) অসামান্য ঐতিহাসিক ভূমিকা থাকা সত্ত্বেও ১৯৭৫-এর সামরিক অভ্যুত্থানের পর বোধগম্য কারণেই ক্রেমলিনের সঙ্গে ঢাকার সম্পর্ক আর সেভাবে টিকে থাকেনি। অন্যদিকে ১৯৯১-এর ২৫ ডিসেম্বর সোভিয়েত ইউনিয়ন ভেঙে যাওয়ার পর সংশ্লিষ্ট দেশগুলোর সঙ্গে খুব স্বাভাবিকভাবেই অবশিষ্ট সম্পর্কটুকুও পরিবর্তনের চাপে পড়ে অনেকটাই গতি হারায়। তবে ১৯৯৯ সালে বর্তমান সরকার ক্ষমতায় আসার পর থেকে দেশগুলোর মধ্যে বিশেষভাবে রাশিয়ার সঙ্গে পুনরায় সম্পর্কের উন্নতি ঘটতে শুরু করে এবং ধীরে ধীরে তা অন্য কতিপয় ইউরেশীয় দেশের সঙ্গেও সম্প্রসারিত হতে থাকে (সোভিয়েত ইউনিয়ন ভেঙে সৃষ্ট এই ১৫টি ইউরেশীয় দেশ হচ্ছে আর্মেনিয়া, আজারবাইজান, বেলারুশ, এস্তোনিয়া, জর্জিয়া, কাজাখস্তান, কিরগিজস্তান, লাটভিয়া, লিথুয়ানিয়া, মলদোভা, তাজিকিস্তান, তুর্কমেনিস্তান, ইউক্রেন, উজবেকিস্তান ও রাশিয়া; যেগুলোকে একসঙ্গে বলা হয় কমনওয়েলথ অব ইনডিপেনডেন্টস স্টেটস—সিআইএস)। কিন্তু প্রায় তিন দশকের ব্যবধানে এ দেশগুলোর সঙ্গে বাংলাদেশের অর্থনৈতিক ও কূটনৈতিক সম্পর্ক যে হারে বিকশিত হতে পারত, বাস্তবে তা একেবারেই হয়নি।

প্রশ্ন হলো, এ সম্পর্ক জোরদার হওয়াটা জরুরি কিনা এবং জরুরি হলে সম্পর্কের সে ক্ষেত্রগুলো কী ও কেন? প্রথম কথা হচ্ছে, বাংলাদেশের অর্থনীতি এখন যে পর্যায়ে বিকশিত হচ্ছে, তাতে আন্তর্জাতিক বাণিজ্যে এর হিস্যা আরো দ্রুত হারে ও অধিক পরিমাণে নিশ্চিত হওয়া প্রয়োজন, বিশেষত রফতানির পরিমাণ উল্লেখযোগ্য পরিসরে বৃদ্ধি পাওয়া দরকার। আন্তর্জাতিক বাণিজ্যে বাংলাদেশের ঘাটতির পরিমাণ এখন বছরে প্রায় ১৪ হাজার ৩১৮ মিলিয়ন মার্কিন ডলার (৩৮,৭১৫ মিলিয়ন ডলার আমদানির বিপরীতে রফতানির পরিমাণ মাত্র ২৪,৩৯৭ মিলিয়ন ডলার: ২০১৭-১৮ অর্থবছরের হিসাব)। দেশের অর্থনীতিকে আরো চাঙ্গা করতে হলে বা এটিকে একটি দীর্ঘমেয়াদি টেকসই ভিত্তির ওপর দাঁড় করাতে চাইলে রফতানির পরিমাণ বৃদ্ধি করাটা যেমন জরুরি, তেমনি বা তার চেয়েও বেশি জরুরি হচ্ছে রফতানি পণ্যের ক্ষেত্রে বহুমুখীনতা আনা। অর্থাৎ শুধু তৈরি পোশাকের মতো একক পণ্যের ওপর বা মূলত ইউরোপ-আমেরিকার বাজারের ওপর নির্ভর না করে নতুন পণ্য নিয়ে নতুন বাজারে প্রবেশের চেষ্টা করতে হবে। কিন্তু সেক্ষেত্রে একটি প্রধান সমস্যা হচ্ছে, ইউরোপ ও মার্কিন বাজারের চাহিদানুরূপ মান সংরক্ষণে আমাদের অপারগতা এবং দ্বিতীয় অসুবিধাটি হলো, রফতানির নতুন বাজার খুঁজে না পাওয়া। আর এ দুটি সমস্যারই একটি উত্তম সমাধান হচ্ছে, ইউরেশীয় অঞ্চলের দেশগুলোর সঙ্গে নতুন বাণিজ্য সম্পর্ক গড়ে তোলা।

বিশ্ববাজারের প্রতিযোগিতায় টিকে থাকতে হলে নিজেদের উৎপাদিত পণ্যের গুণগত মানোন্নয়নের কোনো বিকল্প নেই। এমনকি স্থানীয় বাজারকে লক্ষ্য করে উৎপাদিত পণ্যেরও মানোন্নয়ন ঘটাতে হবে। কারণ এ বাজারেও আমদানীকৃত বিদেশী পণ্যের সঙ্গে প্রতিযোগিতা করেই স্থানীয় পণ্যকে টিকে থাকতে হচ্ছে। তবে রফতানি পণ্যের ক্ষেত্রে মানোন্নয়নের বিষয়টি আরো অধিক জরুরি। কিন্তু রাতারাতি যেহেতু সেটি সম্ভব নয়, সেহেতু এ পর্যন্ত উন্নীত মান নিয়েই আপাতভাবে আমরা যা করতে পারি, তা হচ্ছে ইউরেশীয় অঞ্চলের দেশগুলোয় রফতানি বৃদ্ধির চেষ্টা চালানো। কারণ সেসব দেশের বাজারে পণ্যমানের গুণগত চাহিদা এখনো ইউরোপ-আমেরিকার বাজারের মতো অতটা উচ্চপর্যায়ের নয়। বাংলাদেশ তার পণ্যের বিদ্যমান গুণগত মান নিয়েই অনায়াসে ইউরেশীয় বাজারে প্রবেশের সক্ষমতা রাখে। দ্বিতীয়ত. এসব দেশ বর্তমানে অন্য যেসব দেশ থেকে যে মূল্যে পণ্য আমদানি করে, বাংলাদেশের পক্ষে তার চেয়ে অনেক কম মূল্যে সেখানে পণ্য রফতানি করা সম্ভব। ফলে ইউরেশীয় বাজারই হয়ে উঠতে পারে বাংলাদেশী পণ্যের নতুন গন্তব্য। তদুপরি ইউরোপ-আমেরিকার বাজারে যেসব বাংলাদেশী পণ্যের তেমন একটা চাহিদা নেই, সেসব বহু পণ্যের চাহিদাও ইউরেশীয় দেশগুলোর বাজারে রয়েছে। ফলে ওই দেশগুলো শুধু বাংলাদেশী নতুন বাজার হিসেবে নয়, নতুন পণ্য বাজারজাতের সুযোগ হিসেবেও ব্যবহার হতে পারে।

সংবাদ মাধ্যমে প্রকাশিত খবর থেকে জানা যায়, বিলম্বে হলেও বাংলাদেশ সম্প্রতি ইউরেশীয় ইকোনমিক ইউনিয়নের (ইইইউ) নির্বাহী পরিষদ ইউরেশীয় অর্থনৈতিক কমিশনের (ইইসি) সঙ্গে একটি সহযোগিতা চুক্তি স্বাক্ষর করেছে, যা নিঃসন্দেহে দেশের রফতানি বাণিজ্য সম্প্রসারণের লক্ষ্যে একটি প্রশংসনীয় উদ্যোগ। তবে এখানে স্পষ্টীকরণের জন্য জানাই, সিআইএভুক্ত ১৫টি দেশের মধ্যকার সবগুলো দেশই কিন্তু এখনো ইইইউর সদস্য নয়। কেবল রাশিয়া, বেলারুশ, কাজাখস্তান, আর্মেনিয়া ও কিরগিজস্তান—এ পাঁচ দেশ নিয়েই বর্তমানের ইইইউ; যার যাত্রা ২০১৫ সালে। অর্থাৎ সিআইএভুক্ত ১৫টি দেশের মধ্যে ১০টি এখনো উল্লিখিত সহযোগিতা চুক্তির বাইরে থেকে গেছে। এখানে তাই প্রস্তাব রাখতে চাই, ইইসির সঙ্গে স্বাক্ষরিত চুক্তির যথাযথ বাস্তবায়নের পাশাপাশি আমাদের সিআইএভুক্ত অন্য ১০টি দেশের সঙ্গেও ক্রমান্বয়ে এবং যতটা সম্ভব দ্রুততার সঙ্গে অনুরূপ বাণিজ্য সহযোগিতার সম্পর্ক গড়ে তুলতে হবে। কেননা বিভিন্ন ভূরাজনৈতিক কারণে শেষোক্ত ১০টি দেশ এখনো ইইইউর সদস্য না হলেও দেশগুলোয় বাংলাদেশী পণ্যের রফতানি সম্ভাবনা খুবই উজ্জ্বল এবং কোনো কোনো ক্ষেত্রে তা কোনো কোনো ইইইউ সদস্য দেশের চেয়েও অধিক সম্ভাবনাময়।

বাংলাদেশের ব্যবসায়ীরা হয়তো বলবেন, দেশগুলোর সঙ্গে যোগাযোগ ব্যবস্থা এখনো যথেষ্ট ভালো নয়। দ্বিতীয়ত, সেখানকার বাণিজ্য সংগঠনগুলোও দ্বিপক্ষীয় বাণিজ্যিক সহযোগিতা কার্যক্রমকে এগিয়ে নিয়ে যাওয়ার ক্ষেত্রে ভূমিকা রাখার মতো যথেষ্ট শক্তিশালী নয়। তদুপরি তাদের পণ্য সংগ্রহ ও বিতরণ নেটওয়ার্কও এখন পর্যন্ত আধুনিক বিশ্ববাজারের কাঠামোর সঙ্গে সংগতিপূর্ণ হয়ে উঠতে পারেনি। তাছাড়া বাংলাদেশের ব্যবসায়ীদের কাছে এসব দেশের বাজারগুলো এখনো যথেষ্ট পরিচিত নয়। এসব দুর্বলতার কথা স্বীকার করে নিয়েও বলব, এ দেশগুলোর উল্লিখিত দুর্বলতার আড়ালেই কিন্তু লুকিয়ে আছে বাংলাদেশী পণ্যের বিপুল রফতানি সম্ভাবনা। উল্লিখিত দুর্বলতাগুলোর কারণে বাংলাদেশের মতো আরো অনেক দেশই এখন পর্যন্ত সেখানে তাদের পণ্যাদি নিয়ে প্রবেশের চেষ্টা করেনি। আর এ অকর্ষিত সম্ভাবনার কথা চিন্তা করে বাংলাদেশ যদি সেখানে বাণিজ্য সম্প্রসারণে এগিয়ে যেতে পারে, তাহলে দেখা যাবে সে দেশগুলোই অদূর ভবিষ্যতে বাংলাদেশী পণ্যের অন্যতম ও অধিকতর লাভজনক গন্তব্য হয়ে উঠেছে।

বাংলাদেশের জন্য ইউরোপীয় দেশগুলোয় পণ্য রফতানির আরেকটি সুবিধা হলো, সেখানকার কোনো কোনো দেশের সামাজিক রীতিনীতি ও অর্থনৈতিক স্তর আমাদেরই মতো। ফলে আমরা যে ধরনের পণ্য উৎপাদন করি, তাদের বাজারের চাহিদাও অনেকটাই অনুরূপ। অতএব, এ সুবিধাকে কাজে লাগিয়ে বাংলাদেশ থেকে অনেক মামুলি পণ্যও সেখানে রফতানি করা সম্ভব। এমনকি কিছু কৃষিপণ্যও সেখানে রফতানি করা যেতে পারে। প্রসঙ্গত বলি, সেখানে উচ্চদক্ষতাসম্পন্ন বিশেষজ্ঞ জনবল (বিশেষত আইটি বিশেষজ্ঞ ও বিশ্ববিদ্যালয় পর্যায়ের শিক্ষক) পাঠানোরও সুযোগ রয়েছে। তবে আর কোথায় কোথায় এসব সুবিধা রয়েছে, তা তথ্যানুসন্ধানের মাধ্যমে নিশ্চিত করা যেতে পারে।

পণ্যের গুণগত মান বিচারে বৈশ্বিক বিবেচনায় বাংলাদেশ বর্তমানে যে স্তরে অবস্থান করছে, তাতে শিল্পোন্নত দেশগুলোর উৎপাদিত পণ্যের সঙ্গে প্রতিযোগিতা করে বাজার দখল করা বা অধিকতর মুনাফা অর্জন—এর কোনোটিই হয়তো অত সহজ নয়। সেক্ষেত্রে বাংলাদেশ যদি সিআইএভুক্ত দেশগুলোর মতো মাঝারি মানের বিকল্প বাজার খুঁজে বের করে তার ওপর নিয়ন্ত্রণ প্রতিষ্ঠা করতে পারে, তাহলে সেটাই বাংলাদেশের জন্য অধিকতর নিরাপদ ও কৌশলী অবস্থান হবে বলে মনে করি। আর সে সম্ভাবনার সদ্ব্যবহারে বাংলাদেশী উৎপাদক ও রফতানিকারকদের উৎসাহ ও সহযোগিতাদানের লক্ষ্যে সরকার ওইসব দেশের সঙ্গে অর্থনৈতিক ও কূটনৈতিক সম্পর্ক জোরদার করার ব্যাপারে সহসাই ব্যাপকভিত্তিক উদ্যোগ গ্রহণ করতে পারে। তবে কূটনৈতিক সম্পর্ক জোরদার এবং তা থেকে অর্থনৈতিকভাবে লাভবান হওয়ার কাজটি কিছুটা সময়সাপেক্ষ। ফলে কূটনৈতিক তত্পরতা জোরদারের পাশাপাশি এরই মধ্যে এসব দেশের বাজার সম্ভাবনা সম্পর্কিত বিস্তারিত তথ্যাদি সংগ্রহ করে তা বাংলাদেশের শিল্পোদ্যোক্তা ও রফতানিকারকদের মধ্যে বিতরণের ব্যবস্থা করা যেতে পারে। তবে আসল কথা হচ্ছে, চরম প্রতিযোগিতা এড়িয়ে কম ঝুঁকিতে অধিকতর মুনাফার সুযোগ খুঁজে পেতে চাইলে শুধু সরকারের ওপর নির্ভর না করে ইইইউভুক্ত দেশগুলোর প্রকৃত বাজার পরিস্থিতি বাংলাদেশের সংশ্লিষ্ট ব্যবসায়ীদেরই খুঁজে বের করতে হবে এবং আশা করা যায়, সে প্রক্রিয়ায় কৌশল ও বুদ্ধিমত্তার সঙ্গে এগোতে পারলে তাতে সফল না হতে পারার কোনো কারণ নেই। সংশ্লিষ্ট সবার উদ্যোগ ও প্রচেষ্টায় ইউরেশিয়াই হয়ে উঠুক আন্তর্জাতিক বাণিজ্যে বাংলাদেশের নতুন অংশীদার, এটাই প্রত্যাশা।

লেখক : পরিচালক
আবু তাহের খান
ক্যারিয়ার ডেভেলপমেন্ট সেন্টার
ড্যাফোডিল ইন্টারন্যাশনাল ইউনিভার্সিটি
atkhan56@gmail.com

Source: http://bonikbarta.net/bangla/news/2019-07-05/202062/%E0%A6%AC%E0%A6%BE%E0%A6%82%E0%A6%B2%E0%A6%BE%E0%A6%A6%E0%A7%87%E0%A6%B6-%E0%A6%87%E0%A6%89%E0%A6%B0%E0%A7%87%E0%A6%B6%E0%A6%BF%E0%A7%9F%E0%A6%BE-%E0%A6%85%E0%A6%B0%E0%A7%8D%E0%A6%A5%E0%A6%A8%E0%A7%88%E0%A6%A4%E0%A6%BF%E0%A6%95-%E0%A6%B8%E0%A6%B9%E0%A6%AF%E0%A7%8B%E0%A6%97%E0%A6%BF%E0%A6%A4%E0%A6%BE--/

2
বর্তমান বিশ্বে টেলিভিশনই সম্ভবত সবচেয়ে জনপ্রিয় ও প্রভাবশালী গণমাধ্যম। ঘটনা ও বিষয়ের বিবরণ শোনার পাশাপাশি সেসবের পূর্ণাঙ্গ বা আংশিক চিত্র তাতে দেখা যায় বলে সহজেই তা মানুষকে অনেক বেশি আকর্ষণ করে। ঘটনার প্রত্যক্ষদর্শী না হয়েও সচক্ষে সেটি দেখতে পাওয়া অবশ্যই একটি চিত্তাকর্ষক ব্যাপার। একাত্তরের মুক্তিযুদ্ধে শহীদ হওয়া অসংখ্য মানুষের ও আগুনে পুড়ে যাওয়া অগণিত ঘরবাড়ির ছবি টেলিভিশনে দেখে মুক্তিযুদ্ধ না-দেখা বহু মানুষও ঘটনার বিভৎসতা উপলব্ধি করতে পারে। আবার সরাসরি মাঠে উপস্থিত না থেকেও বাংলাদেশসহ বিশ্বের বহু দেশের লাখ লাখ মানুষই-যে ৩০ মে থেকে যুক্তরাজ্যে শুরু হওয়া বিশ্বকাপ ক্রিকেট চরম উত্তেজনা নিয়ে উপভোগ করছে, তাও এই টেলিভিশন আছে বলেই। অনুর্ধ্ব ৫ বছর বয়সী শিশুদেরকে পোলিও টিকা খাওয়নোর ক্ষেত্রে বাংলাদেশ-যে বিশ্বে শীর্ষস্থান অধিকার করতে পারলো, সে ক্ষেত্রেও টেলিভিশনভিত্তিক প্রচারপ্রচারণার অসাধারণ ভূমিকা রয়েছে। তো, এই যে এত প্রভাবশালী গণমাধ্যম, সে মাধ্যমটি মানুষের মধ্যে এরূপ বহুমাত্রিক প্রভাব সৃষ্টির ক্ষেত্রে যে ভাষা ব্যবহার করছে, বাংলাদেশে তার হালহকিকতটি কেমন? জবাবটি বাঙালি টেলিভিশন দর্শকমাত্রেরই কমবেশি জানা আছে। তারপরও বিষয়টিতে উদ্বেগ প্রকাশের লক্ষ্যে এ সংক্রান্ত কিছু নমুনা সামনে রেখে এ নিয়ে এখানে খানিকটা আলোকপাত করার চেষ্টা করা হলো।

একমাত্র খবর বা সংবাদ ব্যতীত বাংলাদেশভিত্তিক টেলিভিশন চ্যানেলগুলোর অধিকাংশ অনুষ্ঠানেই শুদ্ধ বাক্য ও শব্দ সম্বলিত প্রমিত মানের ভাষা ব্যবহার একেবারেই লক্ষ্য করা যায় না। এমনকি প্রমিত মানের খবরের ভেতরেও যেসব মাঠ-প্রতিবেদন থাকে, সেগুলোর ভাষাও আবার প্রমিত পর্যায়ের নয়--উচ্চ মানসম্মততো নয়ই। নাটক বা চলচ্চিত্রের কথা যদি বাদও দিই (নাটক ও চলচ্চিত্রে পাত্রপাত্রী, স্থান ও সময়ভেদে অপ্রমিত ভাষার ব্যবহার থাকতেই পারে), তাহলেও এ বক্তব্য প্রায় সর্বাংশে সত্য বলে দাবি করা যায়। আর টেলিভিশনের স্ক্রল ও অন্যান্য লেখাজোখায় যেসব বাক্য ও বানান থাকে, সেগুলোর অবস্থাও প্রায় একই রকম করুণ। বিষয়গুলোকে স্পষ্ট করার জন্য এবার কিছু উদাহরণ টানার চেষ্টা করা যাক।

এই সেদিনও প্রশ্নপত্রের উপর লেখা থাকতো, ‘সাধু ও চলিত ভাষার মিশ্রণ দোষণীয়’। তো, এই সাধু ও চলিত রীতির উর্ধ্বে ওঠে সকল অনুষ্ঠানে (নাটক ও চলচ্চিত্রের কথা বাদ) যেকোনো একটি রীতিতে কথা বলার প্রমাণ বাংলাদেশের কোনো টেলিভিশন চ্যানেলে আছে কিনা, সে ব্যাপারে যথেষ্ট সন্দেহ রয়েছে। সাধু ও চলিতের মিশ্রণ থেকে এবার আসা যাক বাংলা ও ইংরেজির মিশ্রণ প্রসঙ্গে। টেলিভিশনের অধিকাংশ পাত্রপাত্রীই এ দোষে দুষ্ট। এবং সত্যি কথা বলতে কি, এ মিশ্রণ এড়িয়ে যেকোনো একটি ভাষায় কথা বলার মতো পর্যাপ্ত ভাষাজ্ঞান ঐ পাত্রপাত্রীদের বেশির ভাগেরই আছে কিনা, সে ব্যাপারে যথেষ্ট সন্দেহ রয়েছে। আর ‘অল্পবিদ্যা ভয়ংকর’-এর ছায়া পড়ে এদের অনেকে আবার বাংলার সাথে ইংরেজি মিলিয়ে কথা বলতে পারাটাকে বাড়তি সামর্থ বলেও মনে করেন। যদিও তিনি বুঝেন না বা বুঝতে পারেন না যে, এটি তার দুর্বল ভাষাজ্ঞানেরই বহিঃপ্রকাশ। এদের মধ্যে আবার কেউ কেউ আছেন, যাদের ন্যূনতম ব্যাকরণ জ্ঞানও নেই--না বাংলায়, না ইংরেজিতে। টেলিভিশনের পর্দায় বহু ‘শিক্ষিত’ লোকজনও বাংলা ও ইংরেজির মিশ্রণে কথা বলতে যেয়ে বহুবচনের বন্যা বইয়ে দিচ্ছেন। নাটক, চলচ্চিত্র, সংগীত ও অন্যান্য বিনোদনমূলক অনুষ্ঠানের পাত্রপাত্রীদের কাছে এ ধরনের অধঃমানের বহুবাচনিক কথাবার্তা যেন অনেকটাই ফ্যাশনের মতো। তারা বলেন: ‘‘আমার ফ্যানসদেরকে জানাই, আমি আমার সকল ভিউয়ারগণের  ওপিনিয়নসগুলোকে মূল্য দিই’’।

এখানে ফ্যান, ভিউয়ার ও ওপিনিয়ন--এই প্রতিটি শব্দের চমৎকার বাংলা প্রতিশব্দ থাকা সত্তে¡ও এখানে তারা সম্পূর্ণ অপ্রয়োজনীয় ইংরেজি শব্দ ব্যবহার করছেন। দ্বিতীয়তঃ এই তিনটি শব্দের ক্ষেত্রেই প্রতিবার তারা দু’বার করে বহুবচন ব্যবহার করছেন, যা ভাষাজ্ঞানের ব্যাপারে তাদের চরম অজ্ঞতারই বহিঃপ্রকাশ। কিন্তু টেলিভিশনের বাংলাভাষী দর্শকশ্রোতাকে অত্যন্ত নিম্মমানের এ অত্যাচার অনেকটা যেন অসহায়ের মতোই সয়ে যেতে হচ্ছে।

বিনোদনমূলক অনুষ্ঠানের কথা না হয় বাদই দিলাম। সংবাদের ভেতরও দেখি এই একই ধারার অত্যাচার। প্রায় সব টিভি চ্যানেলের অধিকাংশ মাঠ প্রতিবেদকের প্রতিবেদনেই শুনি অপ্রাসঙ্গিকভাবে ‘কিন্তু’ ব্যবহারের প্রবণতা, আর ভেতরে দোষণীয় মাত্রায় সাধু ও চলতি শব্দের মিশ্রণ এবং কখনো কখনো অতিনিম্মমানের শব্দচয়ন। টেলিভিশনের সংবাদকর্মীদের জন্য ন্যূনতম প্রশিক্ষণের ব্যবস্থা করাটা কি খুব ব্যয়বহুল কিংবা ন্যূনতম মানসম্পন্ন সংবাদকর্মীর কি বাংলাদেশে এতোটাই অভাব? নাকি ভালো মানের কর্মীর জন্য-যে কিছুটা ভালো বেতনভাতাও দরকার, সংশ্লিষ্ট মালিকপক্ষ সেটা ব্যয় করতে চান না বলেই ‘কিন্তু’মুক্ত ভালো মানের সংবাদকর্মীর দেখা মিলছে না? অবশ্য সংবাদের জন্য বাংলা-ইংরেজির মিশ্রণমুক্ত পান্ডূলিপি তৈরির ব্যাপারে সংবাদ-সম্পাদনা বিভাগের দায়িত্বই সর্বাধিক। কিন্তু দক্ষতা ও যোগ্যতার অভাব কিংবা মনোযোগের ঘাটতি, যে কারণেই হোক, এ ঘাটতি থেকেই যাচ্ছে, যা রুচিবান শিক্ষিত দর্শক-শ্রোতার জন্য সত্যি অস্বস্তিকর। অথচ, সামান্য কিছু বাড়তি অর্থ ব্যয় করলেই এ সমস্যার সমাধান হয়ে যায়। কিন্তু তা সত্তে¡ও এটি নিরন্তর ঘটে চলেছে যা দেখে মনে হচ্ছে যে, এ ক্ষেত্রে মূল সমস্যা অর্থ নয়--আসল ঘাটতি উদ্যমের এবং তারচেয়েও বড় সমস্যা হচ্ছে, ঘটনাটি যে মানহীন তা উপলব্ধি করতে পারার দৃষ্টিভঙ্গির অভাব।

টেলিভিশনের বিভিন্ন মাত্রিক পরিবেশনার মধ্যে সর্বাধিক দৃষ্টি আকর্ষক, প্রভাবশালী ও কার্যকর অনুষঙ্গ সম্ভবত এর স্ক্রলবার্তা। স্ক্রলে প্রচারিত তথ্য ও সংবাদ খুব সহজেই দর্শকের চোখে পড়ে এবং অনেক সংবাদ ও তথ্যের সারাংশ হিসেবে এটিকেই সে গ্রহণ করে। শিশু-কিশোর বয়সী যেসব দর্শকের কাছে সংবাদ ও তথ্য অনেকটা কম আবর্ষণীয়, স্ক্রলবার্তা তাদেরকেও কমবেশি আকর্ষণ করে বা আকর্ষণ না করলেও সহজ দৃষ্টিগ্রাহ্যতার কারণে এটি তাদের চোখ এড়িয়ে যায় না। অথচ স্ক্রলে প্রচারিত তথ্য ও সংবাদেই ভুল বানান ও ভাষার আধিক্য থাকে সর্বাধিক। এটি একদিকে শিক্ষিত-সচেতন দর্শকের জন্য পীড়াদায়ক ও অস্বস্তিকর, অন্যদিকে তেমনি তরুণ শিক্ষার্থী দর্শকদের জন্য অত্যন্ত ক্ষতিকর। কারণ এসব ভুল বানান ও ভাষা দেখে নিজেদের অজান্তেই তারা এসব শিখে ফেলছে, যার ক্ষতিকর প্রভাব দীর্ঘমেয়াদী হতে বাধ্য। স্ক্রলে সংবাদ ও বিজ্ঞাপন প্রচারের আগে সেগুলো যথাযথভাবে সম্পাদনার কোনো ব্যবস্থাই কি টিভি চ্যানেলগুলো করতে পারে না? বিজ্ঞাপনের ভাষা ও বানানের ব্যাপারে তারা হয়তো বলবেন যে, এটি বিজ্ঞাপনদাতাদের দায়িত্ব। কিন্তু নিজেদের পর্দায় প্রচারের আগে এগুলোর ভাষা ও বানান সম্পাদনার নৈতিক দায়িত্ব টিভি চ্যানেলগুলো কিছুতেই এড়াতে পারে না।

আমরা জানি যে, বাংলাদেশের বিভিন্ন টেলিভিশন চ্যানেলে প্রচারিত অধিকাংশ অনুষ্ঠানই এখন প্যাকেজভিত্তিতে বাইরে থেকে কিনে নেওয়া। বিজ্ঞাপনগুলোও অন্যদের তৈরি। ফলে টিভি চ্যানেল কর্তৃপক্ষ বলতেই পারেন যে, সেখানকার ভাষা ও বানানে যদি ত্রæটি থাকে, তাহলে চ্যানেলগুলো তা সংশোধন করবে কেমন করে? এটি করা মোটেও কোনো কঠিন বিষয় নয়। প্যাকেজ সরবরাহকারী প্রতিষ্ঠানের সাথে ক্রয়কারী প্রতিষ্ঠানের চুক্তির শর্তেই থাকতে পারে যে, ভুল ভাষা ও বানান সম্বলিত প্যাকেজ অনুষ্ঠান কিছুতেই গ্রহণযোগ্য হবে না (এখানে নাটক, চলচ্চিত্র বা এ জাতীয় বিনোদনমূলক অনুষ্ঠানের পাত্রপাত্রীদের মুখের ভাষার কথা বুঝানো হচ্ছে না)।
টিভি চ্যানেলগুলোতে এখন টকশোর ছড়াছড়ি। আর বাজারে একসাথে এতগুলো চ্যানেল থাকার কারণে এসব টকশো’তে বিষয়ের সাথে সামঞ্জস্যপূর্ণ মানসম্পন্ন প্রাজ্ঞ লোকজন খুঁজে পাওয়া অনেকটাই কঠিন হয়ে দাঁড়িয়েছে বৈকি! এ অবস্থায় বহুক্ষেত্রে অসামঞ্জস্যপূর্ণ ও মানহীন লোকজন দিয়েই অধিকাংশ চ্যানেল কোনোরকমে জোড়াতালি দিয়ে দায়সারাভাবে কাজ সম্পন্ন করছে (অবশ্য কোনো কোনো ক্ষেত্রে যথাযথ লোক খুঁজে পাওয়ার ব্যাপারে তাদের প্রচেষ্টায়ও ঘাটতি রয়েছে)। ফলে দেখা যাচ্ছে, এসব টকশো’তে অংশগ্রহণকারী লোকজনের মধ্যকার একটি বড় অংশেরই ন্যূনতম মানসম্পন্ন ভাষায় কথাবার্তা বলার যোগ্যতা থাকছে না। এঁরা শুদ্ধ বাক্য ও উচ্চারণে যেমন কথা বলতে পারছেন না, তেমনি পারছেন না বাংলা ও ইংরেজির মিশ্রণ ব্যতীত কথা বলতেও। ফলে এসব মানহীন লোকের কথা শুনে শুনে সাধারণ দর্শক যেমন বিরক্ত হচ্ছেন, তেমনি আমাদের সামাজিক-সংস্কৃতির একটি স্তর নির্মাণেও তা নিম্মমুখী মান ও প্রবণতা তৈরি করছে, যা জাতি হিসেবে আমাদের জন্য খুবই হতাশাব্যঞ্জক।

অর্থনৈতিকভাবে বাংলাদেশ এখন খুবই দ্রুতহারে এগুচ্ছে, যা আমাদের সকলের জন্যই অত্যন্ত গর্ব ও আনন্দের এবং তারচেয়েও বড় কথা হচ্ছে যে, সে অগ্রগতি দেশের জনগণকে আরো ভালোভাবে খেয়েপড়ে বাঁচতে সাহায্য করছে। কিন্তু দায়িত্ববোধসম্পন্ন সচেতন মানুষ কি শুধু খাওয়ার জন্যই বাঁচে? তার চিন্তা ও মনন, সংস্কৃতি ও সমাজবোধের স্তরটিও সেখানে যথেষ্ট গুরুত্বপূর্ণ নয় কি? যদি তাই হয়, তাহলে অর্থনৈতিক উন্নয়নের  পাশাপাশি আমাদের কর্ম ও আচরণের ক্ষেত্রেও অগ্রগতি সাধন ও সবক্ষেত্রে ন্যূনতম একটি মান রক্ষার চেষ্টা অব্যাহত রাখতে হবে বৈকি! আর সেটি টিভি চ্যানেলগুলোর ভাষা ও বানানের মতো স্পর্শকাতর বিষয়ের ক্ষেত্রে আরো অধিক প্রযোজ্য।

অবশ্যই মনে রাখছি যে, বেসরকারি টিভি চ্যানেলগুলোর প্রতিটিই এক-একটি বাণিজ্যিক প্রতিষ্ঠান। কিন্তু সে বাণিজ্যিক কার্যক্রম পরিচালনার জন্য রাষ্ট্রের কাছ থেকে গৃহীত অনুমোদন কোনোভাবেই শর্তমুক্ত নয়। এবং সে শর্ত অনুযায়ী এ বাণিজ্য কোনোভাবেই এমন ধারায় করার কথা নয়, যা সমাজ ও রাষ্ট্রের জন্য অকল্যাণকর। অতএব বাণিজ্যের দোহাই দিয়ে এ ক্ষেত্রে উল্লিখিত ভাষাগত মানদণ্ড এড়িয়ে যাওয়ার কোনো অবকাশ নেই। আর তর্কেও খাতিরে সে কথা যদি বাদও দিই, তাহলেও আশা করবো যে, নিজেদের পেশাগত সুনাম, মান ও ভাবমূর্তির স্বার্থে হলেও টিভি চ্যানেলগুলো তাদের পর্দায় প্রচারিত অনুষ্ঠানের ভাষা ও বানানের মানের ব্যাপারে আরো সচেতন হবে। বস্তুতঃ টেলিভিশন চ্যানেলগুলোর কাছে আমাদের প্রত্যাশা অনেক। কিন্তু সে প্রত্যাশাকে পুঁজি করে তারা যদি ভাষা ও বানানের মান রক্ষার দায়টি এড়িয়ে যান, তাহলে একটি জাতিগোষ্ঠীর বিকাশ ও গঠনের প্রক্রিয়ায় সেটিকে মানহীনতার দিকে ঠেলে দেবার দায়ও কিন্তু তাদের উপর অনেকখানিই বর্তাবে বৈকি! আশা করি, সে হীন দায়ভার থেকে তারা অবশ্যই মুক্ত থাকতে চাইবেন।

লেখক : পরিচালক
আবু তাহের খান
ক্যারিয়ার ডেভেলপমেন্ট সেন্টার
ড্যাফোডিল ইন্টারন্যাশনাল ইউনিভার্সিটি
atkhan56@gmail.com


Source: http://www.ekalerkantho.com/home/page/2019-06-19/15

3
দক্ষ ও প্রশিক্ষিত মানবসম্পদের চাহিদা পূরণে শিল্প বিশ্ববিদ্যালয় স্থাপন করা হবে। রাজধানীর মিরপুরে অবস্থিত মনিপুর উচ্চ বিদ্যালয় ও কলেজে ‘বিজ্ঞান-বই-পাখি-কারুমেলা আর ফুল-পিঠা আছে সাথে, জুড়ি মেলা ভার’ শীর্ষক মেলার উদ্বোধন অনুষ্ঠানে শিল্প প্রতিমন্ত্রী এ কথা বলেন। তিনি আরো বলেন, উন্নয়নের জন্য দক্ষ মানবসম্পদ অপরিহার্য। উন্নত ও সমৃদ্ধ বাংলাদেশ বিনির্মাণে সৃজনশীল ও দক্ষ মানবসম্পদ অপরিহার্য। উন্নত ও সমৃদ্ধ বাংলাদেশ বিনির্মাণে সৃজনশীল ও দক্ষ মানবসম্পদ তৈরিতে সরকার সর্বোচ্চ অগ্রাধিকার দিয়েছে। আগামীতে শিল্প মন্ত্রণালয়ের অধীনে শিল্প বিশ্ববিদ্যালয় স্থাপন করা হবে। সরকারের এ উদ্যোগ সাধুবাদযোগ্য। দেশ-বিদেশে দক্ষ ও প্রশিক্ষিত মানবসম্পদ সরবরাহ করতে বিদ্যমান বিশ্ববিদ্যালয়গুলোর ব্যর্থতায় সরকারকে বোধকরি এমন সিদ্ধান্ত গ্রহণ করতে হয়েছে। সরকার বিষয়ভিত্তিক বিশ্ববিদ্যালয় স্থাপনে প্রচণ্ড আগ্রহী। এতে দেশ ও জাতির কল্যাণের চেয়ে বিশেষ গোষ্ঠীর সন্তুষ্টি অর্জন করা যায়। সরকার দক্ষ ও প্রশিক্ষিত মানবসম্পদের চাহিদা পূরণের জন্য একটা বিশ্ববিদ্যালয় স্থাপন করবে, কিন্তু আমাদের তো কোনো মানবসম্পদ পরিকল্পনাই নেই! আমরা জানি না দেশ-বিদেশের জন্য কতজন চিকিৎসক, প্রকৌশলী, কৃষিবিদ, নার্স, টেকনিশিয়ান ইত্যাদি প্রয়োজন। আমাদের শিক্ষা ব্যবস্থায় মানবসম্পদ উন্নয়নের সুস্থ কোনো রূপরেখা দেখা যায় না। যে যার ইচ্ছামতো প্রাথমিক থেকে বিশ্ববিদ্যালয় পর্যন্ত শিক্ষাপ্রতিষ্ঠান সরকারের অনুমতি নিয়ে খুলে ফেলেছেন। পরিকল্পনাহীন ও নিয়ন্ত্রণহীন যাত্রাপথে দেশবাসীকে উন্নয়নের জোয়ার দেখানোর জন্য এমন বিশ্ববিদ্যালয়ের প্রয়োজনীয়তা অস্বীকার করা যাবে না।

আমাদের দেশে গরিবের হাতি পোষার শখে জাহাঙ্গীরনগর বিশ্ববিদ্যালয় প্রতিষ্ঠিত হয়। একজনের বিচিত্র শখ পূরণ হলে অন্যরা বসে থাকবেন কেন? তারাও তাদের গোষ্ঠীস্বার্থের চিন্তায় নিজেদের বিচিত্র খায়েশ পূরণের আবদার করেন। সরকারসংশ্লিষ্টরা গোষ্ঠীর সঙ্গে দেশ-কাল ভুলে খায়েশ বাস্তবায়নে উঠে-পড়ে লেগে যান। সরকার একসময় বাহবা পেতে জনকল্যাণের নতুন কনসেপ্ট দিয়ে একটা গোষ্ঠীকে সন্তুষ্ট করতে বিশ্বে বিরল এক অদ্ভুত জিনিস দেশ ও জাতিকে উপহার দেয়! ধারণা করলে একদম ভুল হবে না যে, দেশে এভাবেই একটার পর একটা বিষয়ভিত্তিক বিশ্ববিদ্যালয় জাতি উপহার পেয়েছে। একটা বিষয়ভিত্তিক বিশ্ববিদ্যালয় দেখে অন্য গোষ্ঠী উৎসাহিত হয়েছে এবং তারাও নিজেদের জন্য বিশ্ববিদ্যালয় পেয়েছে। এতে বিশ্বব্যাপী বিশ্ববিদ্যালয়ের কনসেপ্টটাই যে হারিয়ে যাচ্ছে, তা কেউ চিন্তা করছেন বলে মনে হয় না। বিচিত্র শখের অধিকারীরা নিজেদের প্রাপ্তিতে বিভোর থেকে দেশ ও জাতিকে ভুলে গেলেন।

গণপ্রজাতন্ত্রী বাংলাদেশের মালিকদের বিষয়ভিত্তিক বিশ্ববিদ্যালয় থেকে প্রাপ্তির হিসাব করতে গিয়ে মাথায় হাত। রাজধানীর রাস্তায় মিশুক আর জলাশয়ে আফ্রিকান মাগুর চাষ দেখতে দেখতে বিষয়ভিত্তিক বিশ্ববিদ্যালয়ের অবদান হিসাব করতে থাকেন। আজ শিল্প মন্ত্রণালয়ের মনে হয়েছে দক্ষ ও প্রশিক্ষিত মানবসম্পদের চাহিদা পূরণের জন্য শিল্প বিশ্ববিদ্যালয় চাই। এর ধারাবাহিকতায় পরিবহন বিশ্ববিদ্যালয়, রেল বিশ্ববিদ্যালয়, পর্যটন বিশ্ববিদ্যালয়, আইন বিশ্ববিদ্যালয়, খাদ্য বিশ্ববিদ্যালয়, জনপ্রশাসন বিশ্ববিদ্যালয়, সংস্কৃতি বিশ্ববিদ্যালয়—প্রতিটি মন্ত্রণালয় নিজেদের দক্ষ ও প্রশিক্ষিত মানবসম্পদের চাহিদা পূরণের জন্য বিশ্ববিদ্যালয় প্রতিষ্ঠায় উদ্যোগী হয়ে যাবে। কী মজা তাই না? বাংলাদেশে সরকারি অবকাঠামো নির্মাণের দায়িত্ব পালন করত গণপূর্ত অধিদপ্তর। সময়ের বিবর্তনে প্রতিটা মন্ত্রণালয় তাদের অবকাঠামো নির্মাণের জন্য প্রকৌশল শাখা খুলে নিয়েছে। সরকারি অবকাঠামো নির্মাণে গণপূর্ত অধিদপ্তরের শত বছরের দক্ষতা, অভিজ্ঞতাকে জলাঞ্জলি দিয়ে দিল। এতে ব্যক্তি বা গোষ্ঠীস্বার্থ রক্ষা হলো কিন্তু দেশ ও জাতির স্বার্থ ভূলুণ্ঠিত হলো। নির্মিত অবকাঠামোগুলো জীবত্কাল পেল না, নির্মাণ ব্যয় বেড়ে গেল, সৌন্দর্য হারাল। বিষয়ভিত্তিক বিশ্ববিদ্যালয়ের ক্ষেত্রেও সবাই নিজ নিজ প্রয়োজনমতো দক্ষ ও প্রশিক্ষিত মানবসম্পদ তৈরি করতে গিয়ে সংকীর্ণ মানসিকতার মানুষ তৈরি করবে।

বিষয়ভিত্তিক বিশ্ববিদ্যালয় বিকৃত মানসিকতার জন্ম দেয়। সাধারণ বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষার্থীরা অন্যান্য বিভাগের শিক্ষার্থীদের সঙ্গে মেশার সুযোগে তাদের দৃষ্টিভঙ্গির প্রসারতা পান। একজন অর্থনীতির শিক্ষার্থী সমাজবিজ্ঞান সম্পর্কে জানতে পারেন। আবার একজন রসায়নের শিক্ষার্থী ইতিহাস সম্পর্কে জানতে পারেন। পরস্পরের সঙ্গে ভাব বিনিময় করে শিক্ষার্থীরা নিজেদের সার্বিক অবস্থা সম্পর্কে ধারণা পান। এ ধারণা শিক্ষার্থীকে আগামী দিনে নিজের জীবনকে সুন্দর, সুষ্ঠুভাবে এগিয়ে যেতে সহায়ক ভূমিকা পালন করে। বিষয়ভিত্তিক বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষার্থীদের শুধু নয়, শিক্ষকদেরও এমন সুযোগ নেই। ফলে শিক্ষক-শিক্ষার্থী সবাই সংকীর্ণ দৃষ্টিভঙ্গির মানুষ হিসেবে নিজেদের ধ্যান-ধারণা প্রকাশ করেন। আমাদের মেডিকেল বিশ্ববিদ্যালয় দেশের কোনো মেডিকেল কলেজের শিক্ষাকে অনুমোদন দেয় না। প্রকৌশল বিশ্ববিদ্যালয় অনুরূপভাবে কোনো প্রকৌশলশিক্ষাকে অনুমোদন দেয়নি। কৃষি বিশ্ববিদ্যালয়ের ক্ষেত্রে একই কথা প্রযোজ্য। দেশে চিকিৎসা, প্রকৌশল, কৃষিশিক্ষা ইত্যাদির মতো যত শিক্ষা আছে, তা নিয়ন্ত্রণ করে সাধারণ বিশ্ববিদ্যালয়গুলো। কী অদ্ভুত না ব্যাপারটা? মেডিকেল বিশ্ববিদ্যালয় আছে কিন্তু মেডিকেল শিক্ষা নিয়ন্ত্রণ করে সাধারণ বিশ্ববিদ্যালয়। প্রতিটি বিষয়ভিত্তিক বিশ্ববিদ্যালয়ের ক্ষেত্রেই এমন দায়িত্বশীলতা!

সরকার গোষ্ঠীস্বার্থ রক্ষা করতে গিয়ে বিশ্ববিদ্যালয়ের কনসেপ্টটাই পরিবর্তন করে দিয়েছে। একটার পর একটা গোষ্ঠীকে সন্তুষ্ট করতে বিষয়ভিত্তিক বিশ্ববিদ্যালয় স্থাপন করে চলেছে। এরই ধারাবাহিকতায় শিল্প মন্ত্রণালয় শিল্প বিশ্ববিদ্যালয় প্রতিষ্ঠায় উদ্যোগী হয়েছে। আমরা আমাদের কৃতকর্ম থেকে শিক্ষা নিতে চাই না। প্রতিটি বিষয়ভিত্তিক বিশ্ববিদ্যালয় সম্পর্কে যেকোনো সভ্য দেশের যেকোনো শিক্ষাবিদ দ্বিমত পোষণ করলেও সরকারের সঙ্গে সঙ্গে সংশ্লিষ্টরাও লজ্জাবোধ করেন না। তারা নিজেদের গোষ্ঠীর স্বার্থে অন্ধ হয়ে এ কাজে নিবেদিত। শিল্প মন্ত্রণালয় নিজেদের দায়িত্ব-কর্তব্য ভুলে গিয়ে দেশে দক্ষ ও প্রশিক্ষিত মানবসম্পদ তৈরির কাজ করতে চায়। এখানেও তারা তাদের চাহিদার কথা শিক্ষা মন্ত্রণালয়কে জানাতে পারত কিন্তু তা না করে একটা বিশ্ববিদ্যালয়ের মালিক হতে চায়। দেশের সর্বত্র কেউ নিজের দায়িত্ব পালনের চেয়ে অন্যের দায়িত্ব কেড়ে নিতে অনেক বেশি আগ্রহী। আমাদের মন্ত্রীদের প্রতিদিনকার বাণীগুলোর দিকে নজর দিলে তা পরিষ্কার হয়ে যাবে।

আমরা আমাদের শিক্ষা ব্যবস্থায় গোষ্ঠীস্বার্থ রক্ষা করতে গিয়ে একটা হ-য-ব-র-ল অবস্থা সৃষ্টি করেছি। দিনে দিনে শিক্ষার মান নিয়ে প্রশ্ন লম্বা হচ্ছে। এর মধ্যে আমাদের প্রাথমিক শিক্ষা মানে বিশ্বের সঙ্গে প্রতিযোগিতায় সাড়ে চার বছর পিছিয়ে বলে মতামত প্রকাশ করেছে বিশ্বব্যাংক। বিশ্বব্যাংকের ভাষ্য, আমাদের মাধ্যমিকের শিক্ষার্থীদের মান অন্য অনেক দেশের প্রাথমিক শিক্ষার্থীদের সমমানের। বিশ্ব সাড়ে ছয় বছরে যা শিখছে, আমরা তা ১১ বছরে শিখছি। বিশ্বব্যাংকসহ আন্তর্জাতিক মহল যেকোনো বিষয়ে আমাদের সুখ্যাতি করলে তা প্রচার-প্রসারে বিশাল ভূমিকা রাখে সরকার। কিন্তু এমন মতামতকে গুরুত্ব দেয়া দূরে থাকুক, পারলে সমালোচনা করে তার অসারতা প্রমাণে ক্ষমতাসীনরা উঠে-পড়ে লেগে যান। সুখ্যাতি পেলে খুশিতে ডগমগ আর কুখ্যাতি পেলে রেগে আগুন। সমস্যার উৎসে যাওয়ার কোনো উদ্যোগ নেই। সমস্যার আশু সমাধান করতে এমন সব উদ্যোগ গ্রহণ করা হয়, যা সমস্যাকে আরো কঠিন করে তোলে। যে দেশে প্রাথমিক শিক্ষার মান নেই, সেই দেশের উচ্চশিক্ষার মান থাকে কীভাবে? অথচ শিল্প মন্ত্রণালয় দক্ষ ও প্রশিক্ষিত মানবসম্পদ সৃষ্টির জন্য শিল্প বিশ্ববিদ্যালয় প্রতিষ্ঠায় উদ্যোগী হয়েছে? অদ্ভুত বলে মনে হচ্ছে না?

দেশের বড় বড় শিল্প-কারখানার বর্তমান অবস্থা কী? শিল্প-কারখানাগুলো একের পর এক লোকসানের বোঝা মাথায় নিয়ে বন্ধ করে দিতে হয়েছে। আমাদের আদমজী বন্ধ হয়ে গেছে। ইস্পাত মিল বন্ধ হয়ে গেছে। নিউজপ্রিন্ট মিল বন্ধ হয়ে গেছে। রাসায়নিক, বস্ত্র মিল, পাটকল ইত্যাদি বন্ধ করে বিক্রি করে দেয়া হয়েছে অনেকগুলো। লোকসানের অজুহাতে বন্ধ করে দেয়া শিল্প-কারখানা বিক্রি করে দিয়ে দেশ ও জাতির কী উপকার করেছে জানি না, তবে কিছু ব্যক্তি ও গোষ্ঠীকে লাভবান করেছে। শুধু তা-ই নয়, নিজেদের দায়িত্ব শিল্প মন্ত্রণালয় কিছুটা লাঘব করেছে। এতে কিন্তু শিল্প মন্ত্রণালয় কোনোভাবেই তাদের দায় এড়িয়ে যেতে পারে না। সরকার যতই ছোট ছোট অর্থনৈতিক জোন সৃষ্টি করে বিনিয়োগ বৃদ্ধির প্রচার করুক, তাতে তাদের বড় শিল্প ধ্বংসের দায়মুক্তি ঘটে না। শিল্প মন্ত্রণালয় এখন বলতে পারে, দক্ষ ও প্রশিক্ষিত মানবসম্পদের অভাবে শিল্প-কারখানাগুলো লোকসান দেয়ায় বন্ধ করতে বাধ্য হয়েছে। এটা একটা কারণ হতে পারে। শিক্ষা সংকটের কারণে এ অবস্থা বিরাজমান কিন্তু শিল্প মন্ত্রণালয় কি দেশ ও জাতিকে নিশ্চিত করতে পারবে, যে লক্ষ্য ও উদ্দেশ্য নিয়ে শিল্প-কারখানাগুলো স্থাপন করা হয়েছিল, তা যথাযথভাবে পালন করা হয়েছে? তিন শিফটের কারখানা তিন শিফটে চালানো হয়েছে বা স্থাপনকালীন উৎপাদন লক্ষ্যমাত্রা অর্জন করতে সক্ষম হয়েছে? এসবের কোনো উত্তর শিল্প মন্ত্রণালয়ের কাছে আছে বলে বাংলাদেশের পরিসংখ্যান বলে না। যেখানে শিল্প মন্ত্রণালয় নিজেদের দায়িত্ব পালনে ব্যর্থতার পরিচয় রেখে চলেছে, সেখানে শিক্ষা মন্ত্রণালয়ের দায়িত্ব গ্রহণের ইচ্ছার কারণ জানতে পারলে জাতি খুশি হতো।

সাধারণ বিশ্ববিদ্যালয় হিসেবে ঢাকা কিংবা রাজশাহী বিশ্ববিদ্যালয়ে যত শিক্ষার্থী পড়াশোনা করার সুযোগ পেয়ে থাকেন, তার এক-দশমাংশ শিক্ষার্থী বিষয়ভিত্তিক বিশ্ববিদ্যালয়ে পড়াশোনা করার সুযোগ পান। একটা ফ্যাকাল্টি যেখানে যথেষ্ট, সেখানে একটা বিশ্ববিদ্যালয়—এটা কি জনকল্যাণে হতে পারে? তার ওপর এসব বিষয়ভিত্তিক বিশ্ববিদ্যালয় যে পেশার উন্নয়নে যথাযথ ভূমিকা রাখতে পারছে, তাও সাধারণ জনগণ মনে করতে পারছে না। এতে ক্ষমতার বলয়ের মানুষদের কিছু যায় আসে না। তাই সরকারের কাছে নিবেদন, সংকীর্ণ মানসিকতার দক্ষ ও প্রশিক্ষিত মানবসম্পদ তৈরি করার জন্য বিষয়ভিত্তিক আর কোনো বিশ্ববিদ্যালয় নয়; বরং বর্তমানের বিষয়ভিত্তিক বিশ্ববিদ্যালয়গুলোকে সাধারণ বিশ্ববিদ্যালয়ে রূপান্তর করা হোক।

 

লেখক: সাবেক সভাপতি, ইনস্টিটিউশন অব ডিপ্লোমা ইঞ্জিনিয়ার্স, বাংলাদেশ (আইডিইবি)

Source: http://bonikbarta.net/bangla/news/2019-06-25/200917/%E0%A6%8F%E0%A6%AC%E0%A6%BE%E0%A6%B0-%E0%A6%B6%E0%A6%BF%E0%A6%B2%E0%A7%8D%E0%A6%AA-%E0%A6%AC%E0%A6%BF%E0%A6%B6%E0%A7%8D%E0%A6%AC%E0%A6%AC%E0%A6%BF%E0%A6%A6%E0%A7%8D%E0%A6%AF%E0%A6%BE%E0%A6%B2%E0%A7%9F!--/

4
এমন একটি ধারণা প্রচলিত আছে যে বেকারত্বের চাপ প্রকট বলেই কিংবা কর্মসংস্থানের প্রতিযোগিতা দিন দিন আরো কঠিন হয়ে ওঠার কারণেই শিক্ষিত তরুণকে এখন পেশাচিন্তার ক্ষেত্রে ব্যাপকভিত্তিক পরিকল্পনার আশ্রয় নিতে হচ্ছে। ধারণাটি একেবারেই যথার্থ নয়। কর্মের সুযোগ কম বা বেশি যা-ই থাকুক না কেন, নিজের সামর্থ্য ও আকাঙ্ক্ষা অনুযায়ী পেশা বেছে নিতে চাইলে প্রাতিষ্ঠানিক শিক্ষাজীবন শেষ হওয়ার আগেই প্রত্যেক শিক্ষিত তরুণের উচিত তাঁর স্বপ্ন ও প্রত্যাশার সঙ্গে মিল রেখে নিজের সামর্থ্যের সঙ্গে সংগতিপূর্ণ একটি বাস্তবভিত্তিক পেশাপরিকল্পনা তৈরি করে সে অনুযায়ী নিজেকে প্রস্তুত করা। আর কর্মসংস্থানের প্রতিযোগিতা প্রবল না হয়ে উল্টোটা হলেও এ পরিকল্পনা অত্যাবশ্যক। কারণ কর্মের সুযোগ সহজলভ্য হলে সে ক্ষেত্রে পেশা নির্বাচন করতে গিয়ে দোদুল্যমানতায় পড়ার ঝুঁকিও যথেষ্টই থাকে বৈকি! মোট কথা কর্মবাজার কঠিন হোক বা সহজ হোক, সেখানে প্রতিযোগিতা কম থাকুক বা বেশি থাকুক—নিজেকে মানসম্পন্ন, মর্যাদাবান ও সন্তোষজনক পেশায় দেখতে চাইলে যেকোনো শিক্ষিত তরুণেরই উচিত যত আগেভাগে সম্ভব একটি দূরদর্শী ও চ্যালেঞ্জিং পেশাপরিকল্পনা তৈরি করে সে অনুযায়ী এগোনোর চেষ্টা করা।

এখন প্রশ্ন হচ্ছে, এ পেশাপরিকল্পনা প্রণয়নের কাজটি কি খুবই কঠিন বা জটিল? একজন শিক্ষিত তরুণ নিজে নিজেই কি এটি তৈরি করতে সক্ষম? জবাব হচ্ছে, কাজটি মোটেও কঠিন বা জটিল কিছু নয়। ধারণাগত স্পষ্টতা থাকলে একজন শিক্ষিত তরুণ নিজের পেশাপরিকল্পনা নিজেই তৈরি করতে পারেন এবং বস্তুত সেটিই করা উচিত। এ ব্যাপারে প্রয়োজনে শিক্ষক, অভিভাবক বা পেশাজীবী বিশেষজ্ঞের পরামর্শ বা সহায়তা গ্রহণ করা যেতে পারে। তবে তা যেভাবেই করা হোক না কেন, বাস্তবতা হচ্ছে—আজকের এই চরম প্রতিযোগিতামূলক বিশ্ববাজারে ও প্রযুক্তির দ্রুত অগ্রসরমাণতার এ যুগে পেশার ধরন ও যোগ্যতার শর্ত যেখানে নিয়তই পরিবর্তিত হচ্ছে, সেখানে সুষ্ঠুভিত্তিক পেশাপরিকল্পনা ছাড়া কোনো শিক্ষিত তরুণের পক্ষেই কাঙ্ক্ষিত মানের ও সন্তোষজনক পর্যায়ের পেশায় নিজেকে যুক্ত করা সম্ভব নয় বললেই চলে।

আনুষ্ঠানিক শিক্ষাক্রমের অধীনে ‘পেশাপরিকল্পনা’ নামে বাংলাদেশে এখনো কোনো স্বতন্ত্র বিষয় চালু হয়নি। ফলে এ ব্যাপারে অনেক শিক্ষার্থীর মধ্যে ধারণাগত ও প্রায়োগিক উভয়বিধ জ্ঞানার্জনের ইচ্ছা থাকলেও সুযোগের অভাবে তা সম্ভব হচ্ছে না। পাশাপাশি আবার এটাও ঠিক যে পেশাপরিকল্পনা বিষয়ে ন্যূনতম প্রাথমিক জ্ঞান থাকাটা যে প্রত্যেক শিক্ষিত তরুণের জন্যই জরুরি—এটাও আবার অনেকের ধারণায় নেই। আমাদের অনেক শিক্ষিত তরুণই পেশার কথা ভাবেন প্রাতিষ্ঠানিক শিক্ষা সমাপ্তির পর এবং তখন তা ভাবতে গিয়ে কর্মবাজারের চাহিদার সঙ্গে নিজের যোগ্যতার কোনো সংগতি খুঁজে পান না। কিন্তু এ ভাবনাটাই যদি তিনি কলেজ বা বিশ্ববিদ্যালয় শিক্ষার গোড়ার দিকে ভাবতেন, তাহলে বাজারের চাহিদা অনুযায়ী নিজেকে তিনি আগে থেকেই প্রস্তুত করে নিতে পারতেন।

বলা হয়ে থাকে যে বাংলাদেশের শিক্ষাব্যবস্থা যথেষ্ট কর্মমুখী নয় এবং এর অধীনে যেসব পাঠ্যক্রম অনুসরণ করা হয়ে থাকে তা আসলে কর্মে নিয়োজন উপযোগী জনবল তৈরি করতে সক্ষম নয়। এ ধারণা পুরোপুরি সত্য নয়। বিদ্যমান শিক্ষাব্যবস্থার অধীন পাঠ্যক্রমে অনেক ত্রুটিবিচ্যুতি ও অসম্পূর্ণতাই হয়তো রয়েছে। কিন্তু তার পরও সেটুকুও যদি উপযুক্ত শিক্ষকের মাধ্যমে ঠিকমতো অনুসরণ করা যেত, তাহলে শিক্ষিত তরুণের পেশা অনুসন্ধান হয়তো এতটা কঠিন হয়ে উঠত না।

শিক্ষিত তরুণের কর্মসংস্থান সৃষ্টির ক্ষেত্রে বর্তমানে বড় ধরনের একটি আধা-লুক্কায়িত সমস্যা হচ্ছে মানসম্পন্ন কর্মে (Quality employment) নিয়োজিত হতে না পারা। শেষ পর্যন্ত যেনতেন একটি কাজ তিনি পেয়ে যাচ্ছেন বটে, কিন্তু বেশির ভাগ ক্ষেত্রেই সেটি তাঁর শিক্ষাগত ও আনুষঙ্গিক যোগ্যতার সঙ্গে সংগতিপূর্ণ হয়ে উঠছে না। অন্যদিকে সনদীয় যোগ্যতায় যাঁরা কাজ পাচ্ছেন তাঁরা আবার ওই পদের চাহিদা পূরণ করতে পারছেন না। আসলে বাংলাদেশের কর্মবাজার এখন এরূপ এক জটিল পরিস্থিতির মধ্য দিয়ে যাচ্ছে যে শিক্ষার সামগ্রিক মানোন্নয়ন ছাড়া এ অবস্থা থেকে বেরোনো সত্যি এক দুরূহ ব্যাপার। তবে দূরদৃষ্টিসম্পন্ন পেশাপরিকল্পনা প্রণয়ন করে সে অনুযায়ী প্রস্তুতি গ্রহণকরত ধৈর্য ও পরিশ্রম সহকারে এগোতে পারলে এ ক্ষেত্রে কিছুটা হলেও পরিত্রাণ পাওয়া যেতে পারে।

একজন শিক্ষিত তরুণ বা শিক্ষার্থী তাঁর পেশাপরিকল্পনা কিভাবে তৈরি করবেন? পেশা অনুসন্ধানী তরুণকে প্রথমেই একটি সুনির্দিষ্ট পেশাগত লক্ষ্য ঠিক করতে হবে—তিনি কী চাকরি করবেন নাকি উদ্যোক্তা হবেন, চাকরি করলে সেটি কী সরকারি নাকি বেসরকারি, সেটি কী দেশে নাকি বিদেশে ইত্যাদি। অন্যদিকে উদ্যোক্তা হলে সেটি উৎপাদন খাতে হবে নাকি সেবাভিত্তিক ব্যাবসায়িক খাতে, এটি কি রাজধানীকেন্দ্রিক হবে নাকি গ্রামভিত্তিক ইত্যাদি প্রশ্নের জবাব সুনির্দিষ্ট তথ্য ও ধারণার ভিত্তিতে একেবারে গোড়াতেই তাঁকে নিষ্পত্তি করতে হবে। এ লক্ষ্য নির্ধারণের পর তাঁকে বসতে হবে আত্মবিশ্লেষণ ও আত্মমূল্যায়নে। তাঁকে অনুপুঙ্খভাবে যাচাই করে দেখতে হবে, উল্লিখিত লক্ষ্য অর্জনের ক্ষেত্রে কী কী যোগ্যতা ও সামর্থ্য তাঁর আছে এবং কী কী তাঁর নেই। যা যা আছে, সেগুলোকে যত্ন ও পরিচর্যার মাধ্যমে আরো শাণিত করতে হবে এবং সাহস প্রদর্শন, ঝুঁকি গ্রহণ ও ধৈর্য বজায় রাখার কাজে ব্যবহার করতে হবে। অন্যদিকে যেসব গুণাবলির ঘাটতি রয়েছে, দ্রুততার সঙ্গে সেগুলোকে অর্জনের চেষ্টা করতে হবে। তার পরও যদি লক্ষ্যে পৌঁছানোর কাজটি বিলম্বিত হয়, তাহলে সে ক্ষেত্রে হতাশ না হয়ে ধৈর্য ও আত্মবিশ্বাসের সঙ্গে চেষ্টা চালিয়ে যেতে হবে এবং তাতে সাফল্য একদিন না একদিন আসবেই।

পেশাচিন্তার পরিধিকে যতটা সম্ভব সম্প্রসারিত ও ব্যাপকভিত্তিক করতে হবে। যোগাযোগ ও তথ্য-প্রযুক্তির কল্যাণে সারা পৃথিবী বস্তুতই এখন হাতের মুঠোয়। চাকরি ও উদ্যোক্তাবৃত্তি উভয় কাজের জন্যই শুধু দেশের পরিধিকেই সীমানা ভাবলে চলবে না—সমগ্র পৃথিবীর যেখানে যা সুযোগ আছে, তার সব কিছুই ব্যবহারের ব্যাপারে উদ্যমী হতে হবে। আর পেশাসংক্রান্ত যেকোনো চিন্তাভাবনার ক্ষেত্রে অন্তত একযুগ এগিয়ে থেকে চিন্তা করতে হবে। কারণ বিজ্ঞান ও প্রযুক্তির কল্যাণে পৃথিবী এত দ্রুত বদলাচ্ছে যে সেই পরিবর্তনের সঙ্গে তাল মিলিয়ে নিজেকে গড়ে তুলতে এবং প্রয়োজন অনুযায়ী নিজের চিন্তাভাবনা ও দক্ষতা স্তরের ক্ষেত্রে সমন্বয় সাধন করতে না পারলে চতুর্থ শিল্পবিপ্লবের এ যুগে পেশাগত জীবনে সাফল্য অর্জন করা কোনোভাবেই সম্ভব নয়।

পেশাগত জীবনে সাফল্য অর্জন করতে হলে সুষ্ঠুভিত্তিক পেশাপরিকল্পনা প্রণয়ন যেমনি জরুরি, তেমনি সমান বা তার চেয়েও বেশি জরুরি হচ্ছে প্রণীত পরিকল্পনা অনুযায়ী দৈনন্দিন চর্চার মধ্য দিয়ে নিজেকে একটু একটু করে গড়ে তোলা। সে ক্ষেত্রে নিজের অধীত বিষয়ের পাশাপাশি সমকালীন অন্যান্য সব বিষয়েই তথ্যের দিক থেকে হালনাগাদ ও জ্ঞানের দিক থেকে গভীরতর মনোযোগের অধিকারী হতে হবে। আর অনিবার্যভাবেই পেশাপরিকল্পনার মূল উদ্দেশ্যই হবে এ ধারণা তুলে ধরা যে স্বনির্ধারিত যোগ্যতা দিয়ে চাকরি খুঁজলে কোনো দিনও চাকরি পাওয়া যাবে না; বরং চাকরিদাতার প্রয়োজন অনুযায়ী নিজের যোগ্যতা তৈরি করে প্রতিযোগিতায় অবতীর্ণ হতে হবে। বিষয়টি সমানভাবে সত্য উদ্যোক্তাবৃত্তির ক্ষেত্রেও। ক্রেতা বা ভোক্তার চাহিদার সঙ্গে সর্বোচ্চ সামঞ্জস্য বিধানে সক্ষম উদ্যোক্তার পক্ষেই শুধু সম্ভব এ ক্ষেত্রে সর্বোত্তম সফলতা অর্জন। বাংলাদেশের কর্মপ্রার্থী শিক্ষিত তরুণরা বিষয়টিকে আবেগ বা হতাশার জায়গা থেকে নয়—বাস্তবতার নিরিখে উপলব্ধি করে সে অনুযায়ী নিজেদের গড়ে তোলার ব্যাপারে উদ্যোগী হবেন বলেই আশা রাখি।

লেখক : পরিচালক
আবু তাহের খান
ক্যারিয়ার ডেভেলপমেন্ট সেন্টার
ড্যাফোডিল ইন্টারন্যাশনাল ইউনিভার্সিটি
atkhan56@gmail.com


Source: https://www.kalerkantho.com/print-edition/sub-editorial/2019/05/06/766189

5
Firstly, I like to express my sincere feelings with the words that I am really proud to be in Bangladesh-a country of potentials which economy is mostly lead by the entrepreneurs of young generation. I am also glad to see that the government of Bangladesh is performing very well in entrepreneurial sector. I have seen here a lot of Bangladeshi young people with high level of energy and enthusiasm apart capitalizing on entrepreneurship. So, I think it is good time for this country to exploring its entrepreneurial prospects and capacity. I learnt a lot about the depth and diversity of Bangladeshi culture which may be a great asset for global society as well. I saw here tremendous laugh, energy, joy, enthusiasm among the students as well as other people of the country.

I am really pleased to have a lot of conversations with young students who want to be entrepreneur in the near future. I visited a good number of innovative projects which were came from the young students. It seems that they have unbelievable talent. And I have no doubt that Daffodil International University (DIU) is playing a good role for spreading entrepreneurial mindset among the young generation of the country.

It’s a great time for young people throughout the glove. Because, technology has make it easy to keep them informed all about changes and development of all around the world. Bangladeshi students can learn from other Universities of the world because of free internet. We launched here Global Entrepreneurship Network (GEN) Bangladesh Chapter. So, those students can connect easily with GEN. Students can also work with GEN Bangladesh as voluntary basis. I invite the young people to join the Global Entrepreneurship Week (GEW) which is observed from 12-18 November every year. It’s a global network for entrepreneurs where more than 170 countries are connected. It’s a nice opportunity for Bangladeshi young people to sign up in genglobal.org. Then everybody can create his own profile in this site. And they will get access to it to use all data and information.

When I was a student of a University, I dreamed to change the world along with my friends. That’s why we wanted to be an entrepreneur. But at that time the problems were that if you want to be an entrepreneur, you had to work for a big company. 
But this is the time for young people of Bangladesh to be an entrepreneur. Here my question is that do you want to be successful in your life as an entrepreneur? If so, please try to know how to make sacrifice of doing well. Please try to be a social entrepreneur as well. I like to say that please value your system. Any entrepreneur in 2019 is highly different than any previous time. Now we are passing the incredible time for the young and it is also the time to see the rise of the rest. Who are the rests? The rests are all the nations inspiring entrepreneurial communities and the eco system throughout the world.  It is the rise of communities and countries who have tapped into the creative potential and it is the rise of a mass number of entrepreneurial experiments.

What happened in the last ten years? When I was an entrepreneur and started my first company, all the people who acted as the entrepreneurs got into entrepreneurship from the Business School. Now when we think of reforming our company, we create team and conduct experiments. In fact, starting a business is nothing but the testing of an idea and guessing what is happening. You can never fail. You can get unique result from the experiments.

Bangladesh is now a country of huge young population i.e. it has a strong work force. One-third of it’ population are you who are capable to work right now. And I feel the strength of this young people who can make any revolutionary change in the economy of this country. I have already known that many young Bangladeshi people are becoming successful as entrepreneur and many young people are interested to be an entrepreneur. So, there is no doubt that Bangladesh will be changed within a very few days based on the capabilities of these young people.

One day Bangladesh will be known as a country of entrepreneurs. We have commonly known that Silicon Valley or Israel is the best place for entrepreneurs. But the days is no far when Bangladesh will be the best place for entrepreneurs.

I would like to tell to the young generation of Bangladesh that you forget the future. Because, none can see the full-face of the future. So, utilize your present period. Please just think that people said Titanic would never be sunk, Trump would never be the President of America, Bob Dilan would never win Nobel prize. But all of those predictions have now proven as failed. So, give importance on your today’s work. Be creative, global, open minded, curious and network builders.

Now days we see that young people has been fallen in to depression about their career in the whole world. It’s happened because technology is changing the world rapidly. Young people cannot cop-up with this changes. Besides these, old people always show depression about career. All of those make them confused. They cannot realize their inner strength. Please don’t be upset. Be an entrepreneur.

The economy of Bangladesh is rising. No doubt that entrepreneurs have a lot of contribution to the process of this economic development. If we want to keep sustain this economy we need more and more entrepreneurs. Because entrepreneurs create a lot of employment.

To be an entrepreneur it is not necessary to be a graduate from Business School. Any student from any discipline can be an entrepreneur. Because, I strongly believe that all of young people are creative.
Lastly I want to say that unpredictability and uncertainty in the world is alarmingly increasing. So, I will repeat that we never ever imagine that Trump will be the President, but he is.  So young entrepreneurs should never disappoint about their future. They should just do their work.

[Summary of the Speech delivered by Dr. Jonathan Ortmans on 28 January 2019 in the 17th Foundation Day of Daffodil International University, Dhaka.]

Dr. Jonathan Ortmans
Founder & President
Global Entrepreneurship Network (GEN)

Source: https://www.eindependentbd.com/home/page/2019-04-06/7

6
ইউরোপ ও উত্তর আমেরিকার ধনী দেশগুলোর আগ্রাসী শিল্পোন্নয়ন নীতির কারণে শিল্পায়নের ক্ষেত্রে বাংলাদেশের মতো পশ্চাত্পদ দেশগুলোর নির্দোষ পরিবেশ আজ চরম বিপর্যয়ের মুখে নিপতিত। শিল্পোন্নত দেশগুলোর কলকারখানা ও অন্যান্য বিলাসী স্থাপনা থেকে নিঃসৃত কার্বন ও অন্যান্য তেজস্ক্রিয় রাসায়নিকের বিরূপ প্রতিক্রিয়ায় অনুন্নত দেশগুলোর পরিবেশ ও নিসর্গই শুধু নয়, মানুষ ও অন্যান্য প্রাণীর জীবনও আজ নানাভাবে অস্তিত্বের সংকট মোকাবেলা করে চলেছে। এক্ষেত্রে অত্যন্ত পরিতাপের বিষয় হলো, সংকটের এ মাত্রা এবং এর সুদূরপ্রসারী ক্ষতিকর প্রভাব সম্পর্কে সংশ্লিষ্ট সব পক্ষের মোটামুটি একটি ধারণা থাকা সত্ত্বেও পরিস্থিতির উন্নতি হওয়া তো দূরের কথা, একটি নিয়ন্ত্রিত স্থিতিশীল অবস্থাও বজায় থাকছে না। বরং দিনে দিনে পরিস্থিতির আরো অবনতিই ঘটে চলেছে এবং তা ঘটছে অনেকটাই জ্যামিতিক হারে।

পরিবেশের ক্ষেত্রে বাংলাদেশ এরই মধ্যে একটি বিপর্যয়কর অবস্থার মধ্যে নিপতিত হয়ে আছে এবং বর্তমান অধোগতির ধারা অব্যাহত থাকলে নিকট ভবিষ্যতে কত সময়ের মধ্যে পরিস্থিতি কোথায় গিয়ে দাঁড়াতে পারে, সে বিষয়ে এরই মধ্যে বিভিন্ন গবেষণা জার্নাল ও পত্রপত্রিকায় নানা ধরনের মতামত ও পূর্বাভাস প্রকাশিত হয়েছে এবং হচ্ছে। এসব মতামত ও পূর্বাভাসের সারকথা হচ্ছে, পরিবেশ বিপর্যয়ের ক্ষেত্রে বাংলাদেশ বর্তমানে খুবই বড় ধরনের ঝুঁকির মধ্যে রয়েছে। এ অবস্থায় বাংলাদেশ যদি পরিবেশ রক্ষায় তার নিয়ন্ত্রণমূলক ভূমিকা ব্যাপকভাবে জোরদার করতে না পারে, তাহলে পরিস্থিতির আরো দ্রুত অবনতি ঘটার সমূহ আশঙ্কা রয়েছে। বিষয়টি উপলব্ধি করার পাশাপাশি এটাও মনে রাখা দরকার, এ নিয়ন্ত্রণ আরোপের কাজটি করা প্রয়োজন দ্রুততম সময়ের মধ্যে। কারণ পরিস্থিতি নিয়ন্ত্রণের বাইরে চলে গেলে সেটিকে পুনরুদ্ধারের জন্য যে বিপুল অর্থের প্রয়োজন হবে, তা বিনিয়োগের সামর্থ্য বাংলাদেশের নেই। ফলে সে রকম বড় ধরনের কোনো পরিবেশ বিপর্যয় যাতে না ঘটে, সেজন্য আরো ব্যাপকভিত্তিক সতর্কতামূলক ও নিয়ন্ত্রণধর্মী ব্যবস্থা গ্রহণ করা আবশ্যক।

দ্বিতীয়ত, সামগ্রিক বিশ্ব অর্থনীতির গতিধারার তুলনায় বাংলাদেশের অর্থনীতি এখন নানা প্রতিকূলতা সত্ত্বেও যথেষ্ট উচ্চহারে বিকশিত হচ্ছে। এর সুনির্দিষ্ট বস্তুগত অর্থ হচ্ছে, এ অর্থনীতির বিভিন্ন বিকাশমান খাতের মধ্যে ক্রমেই বড় হয়ে উঠছে শিল্প তথা ম্যানুফ্যাকচারিং খাত, যার পদে পদে রয়েছে পরিবেশ ঝুঁকির আশঙ্কা। এ অবস্থায় অর্থনৈতিক প্রবৃদ্ধির হারকে দ্রুত ও উচ্চতর করতে ম্যানুফ্যাকচারিং খাতকে বিকশিত করার বিপরীতে দেশের পরিবেশের ক্ষেত্রে যাতে বড় ধরনের কোনো ক্ষতি বা বিপর্যয় নেমে না আসে, সংশ্লিষ্ট সবাইকে এখনই সেদিকটির প্রতি যথেষ্ট দৃষ্টি ও মনোযোগ দিতে হবে। বিশেষ করে রাষ্ট্রের পক্ষ থেকে এ ব্যাপারে কঠোর ও কার্যকর নিয়ন্ত্রণমূলক ব্যবস্থা ও উদ্যোগ নিয়ে এগোতে হবে। নইলে উচ্চতর প্রবৃদ্ধির ধারায় দেশের অর্থনীতি যতটুকু সমৃদ্ধি পাবে, পরিবেশের ক্ষতির মধ্য দিয়ে তার চেয়ে অনেক বেশি ক্ষতি হয়ে যাবে, যা লাভের বড় অংশ দিয়েও পরে আর পুনরুদ্ধার করা সম্ভব হবে না।

বিষয়টি বিবেচনায় নিয়ে বাংলাদেশ ব্যাংক সবুজ ব্যাংকিংয়ের আহ্বান জানিয়েছিল এবং এ ব্যাপারে বেশকিছু কার্যকর উদ্যোগও নেয়া হয়েছিল। বাংলাদেশ ব্যাংকে ওই সবুজ ব্যাংকিংয়ের সূত্র ধরেই দেশে সবুজ শিল্পায়ন কর্মসূচি গ্রহণের প্রস্তাব করছি, যার মূল লক্ষ্য হবে পরিবেশ বাঁচিয়ে শিল্পায়নকে এগিয়ে নেয়া। সবুজ শিল্পায়নের ক্ষেত্রে অনুসরণীয় বৈশিষ্ট্যগুলোর মধ্যে থাকবে: এক. এটি কোনোভাবেই মৃত্তিকা, প্রাণী, বৃক্ষ, বায়ু, পানি ও সর্বোপরি কোনোরূপ ক্ষতিসাধন করবে না। আর সর্বোচ্চ সতর্কতামূলক ব্যবস্থা নেয়ার পরও যদি একান্তই কোনো ক্ষতি হয়ে যায়, তাহলে শিল্পসংক্রান্ত কার্যক্রম চলার পাশাপাশি সংশ্লিষ্ট ক্ষতির জন্য প্রতিকারমূলক ব্যবস্থাও একই কার্যক্রমের আওতায় অন্তর্ভুক্ত থাকবে।

দুই: সবুজ শিল্পায়নের আওতায় যেকোনো শিল্প স্থাপনের ক্ষেত্রে কাঁচামাল হিসেবে বৃক্ষ ও কাঠের ব্যবহারকে নিরুৎসাহিত করা হবে। প্রয়োজনে বৃক্ষ বা কাঠভিত্তিক প্রচলিত ধারার শিল্পের পরিবর্তে এসবের বিকল্প উপায় অনুসন্ধান করতে হবে। উদাহরণস্বরূপ: কাগজ তৈরির কাঁচামাল হিসেবে মণ্ড প্রস্তুতের জন্য যেহেতু বিভিন্ন বৃক্ষ বা গাছ ব্যবহার করতে হয়, সেহেতু বৃক্ষভিত্তিক কাগজ শিল্পের বিকল্প হিসেবে কাগজের পরিবর্তে অনলাইনভিত্তিক লিখন ব্যবস্থাকে জোরদার করতে হবে। এতে একদিকে যেমন বৃক্ষ নিধন হ্রাস পাবে, অন্যদিকে তেমনি এ যোগাযোগ ব্যবস্থায় আর্থিক ব্যয়ও অনেকখানি কমে আসবে এবং এতে সময়েরও ব্যাপক সাশ্রয় হবে।

কাঠভিত্তিক শিল্পকে নিরুৎসাহিত করার আরো একটি উদাহরণ দেয়া যেতে পারে। প্রচলিত ধাঁচের ইটভাটা, ধানের চাতাল, আখ মাড়াই কল—যেসব শিল্পে জ্বালানি হিসেবে কাঠ ব্যবহার হয়, সেসব শিল্পকে কঠোরভাবে নিয়ন্ত্রণ করতে হবে এবং এসব শিল্পের উদ্যোক্তাদের কাঠের পরিবর্তে বিকল্প জ্বালনি ব্যবহারের জন্য উৎসাহিত করতে হবে। বন বা গাছগাছালি রয়েছে এরূপ স্থান থেকে গাছ কেটে শিল্প স্থাপনের প্রস্তাবও একইভাবে কঠোরতার সঙ্গে নিয়ন্ত্রণ করতে হবে। এক্ষেত্রে মনে রাখতে হবে যে একটি দেশের মোট আয়তনের ন্যূনতম ২৫ শতাংশ যেখানে বনাঞ্চল থাকা উচিত, সেখানে বাংলাদেশে তা রয়েছে মাত্র ১৭ শতাংশ।

তিন: জনস্বাস্থ্য ও পুষ্টি সহায়তাদান কার্যক্রমেও সবুজ শিল্পায়নের গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা থাকবে। এটি খুবই জানা তথ্য যে চালের গায়ে ‘কুড়া’ নামে যে লালচে আভরণ থাকে, বিদ্যুত্চালিত চালকলে ধান মাড়াই করতে গিয়ে সেটি আর অক্ষত থাকে না। অথচ এ কুড়া শরীরের জন্য খুবই প্রয়োজনীয় ও গুরুত্বপূর্ণ পুষ্টি উপাদান, যার অভাবে বেরিবেরি ও অন্যান্য রোগব্যাধি সৃষ্টি হতে পারে। অতএব বোঝাই যাচ্ছে বাজার থেকে আমরা কলভাঙা যে ঝলমলে রঙের চাল কিনে খাই, প্রতিনিয়ত তার পরিবর্তে যদি ঢেঁকিছাঁটা চাল খাওয়ার সুযোগ থাকত, তাহলে সেটি আমাদের মতো ব্যাপক পুষ্টি ঘাটতির দেশে সাধারণ মানুষের পুষ্টি চাহিদা পূরণে অনেকখানি সহায়ক হতে পারত।

এ অবস্থায় পল্লী অঞ্চলে ধান মাড়াইয়ের ক্ষেত্রে ঢেঁকিছাঁটা চালের প্রচলন ফিরিয়ে আনা যায় কিনা, সেটি বিবেচনা করে দেখা যেতে পারে। এক্ষেত্রে স্বভাবতই প্রশ্ন উঠতে পারে যে ঢেঁকিতে ধান ভানতে যে কায়িক শ্রম প্রয়োজন, সেটি যথেষ্ট মানবিক কিনা। বিষয়টি নিয়ে চিন্তাভাবনা করে দেখা গেছে যে প্রচলিত ধাঁচের ঢেঁকিকে কিছুটা উন্নত করে সেটির ওঠানামার জন্য কায়িক শ্রমের পরিবর্তে বিদ্যুৎ ব্যবহারের সুযোগ রয়েছে। আর তা করা গেলে এক্ষেত্রে ঢেঁকির উৎপাদনশীলতা যেমন বহুলাংশে বেড়ে যাবে, তেমনি এ ক্ষেত্র থেকে কায়িক শ্রমের বিষয়টিও অনেকাংশ হ্রাস করা সম্ভব হবে।

চার: সবুজ শিল্পায়নের আওতায় উচ্চদূষণযুক্ত শিল্প স্থাপনকে কঠোরভাবে নিরুৎসাহিত করতে হবে। সেক্ষেত্রে ওইসব দূষণযুক্ত শিল্পের পণ্য নিজেরা উৎপাদন না করে বিদেশ থেকে আমদানির ব্যবস্থা করতে হবে। ব্রিটেন যেমন উচ্চতর শ্রমব্যয় সাশ্রয়ের জন্য সুযোগ থাকা সত্ত্বেও নিজেরা পর্যাপ্ত চিনি উৎপাদন না করে বিশেষ সহযোগিতা দানের বিনিময়ে তা কেনিয়া ও ব্রাজিল থেকে আমদানি করে থাকে, নিজেদের পরিবেশের স্বার্থে বাংলাদেশকেও তেমনি শিল্প বাছাইয়ের ক্ষেত্রে অনুরূপ কৌশলী হতে হবে।

পাঁচ: পাট ও এ-জাতীয় প্রাকৃতিক তন্তুভিত্তিক শিল্প স্থাপনকে উৎসাহ দিতে হবে। এটি যে শুধু পলিথিন ও অন্যান্য ক্ষতিকর রাসায়নিকের মাধ্যমে সৃষ্ট দূষণের হাত থেকে বাংলাদেশের মৃত্তিকা, পানি ও বায়ুকে রক্ষা করবে তা নয়। একই সঙ্গে তা পাটের পুনরুজ্জীবন ও রফতানি সম্ভাবনাকেও বাড়িয়ে তুলবে। উল্লেখ্য, সারা পৃথিবীতেই এখন পাটের মতো প্রাকৃতিক আঁশজাত পণ্যের চাহিদা বাড়ছে। কিন্তু তা সত্ত্বেও বাংলাদেশ এক্ষেত্রে এখন সে সুযোগ কাজে লাগিয়ে উল্লেখযোগ্য অগ্রগতি সাধন করতে পারেনি। বিষয়টি আরো গভীরভাবে ভেবে ও তলিয়ে দেখা প্রয়োজন। বিশেষত পাটজাত পণ্যের আর কী কী ধরনের কার্যকর বহুমুখীকরণ হতে পারে, সংশ্লিষ্ট গবেষণা ও উন্নয়ন প্রতিষ্ঠানগুলো সে বিষয়ে আরো মনোযোগের সঙ্গে তাদের চিন্তাভাবনা প্রয়োগ করে দেখতে পারে।

ছয়: নৌপথে কাঁচামাল ও পণ্য সরবরাহকরণ এবং পানি সংগ্রহ ব্যবস্থার সুবিধার্থে একসময় নদ-নদী ও প্রবহমান জলাধারের তীরবর্তী স্থানে শিল্প স্থাপনের ধারণাকে উৎসাহিত করা হতো। বাংলাদেশের রাষ্ট্রীয় ও বেসরকারি খাতের অধিকাংশ পাট ও বস্ত্রকল, সার কারখানা এবং অন্যান্য ভারী শিল্পই নদী-তীরবর্তী স্থানে গড়ে উঠেছে। আর নদীদূষণের জন্য এ শিল্প-কারখানাগুলোই এখন সবচেয়ে বেশি দায়ী। অতএব সবুজ শিল্পায়নের আওতায় নদী ও প্রবহমান প্রাকৃতিক জলাধারের পাশে শিল্প স্থাপনকে কঠোরভাবে নিয়ন্ত্রণ করতে হবে। এক্ষেত্রে শিল্প-কারখানার অনুমোদন দানকারী রাষ্ট্রীয় সংস্থাকে (যথা বাংলাদেশ বিনিয়োগ উন্নয়ন কর্তৃপক্ষ—বিডা এবং বাংলাদেশ ক্ষুদ্র ও কুটির শিল্প করপোরেশন—বিসিক) আরো যত্নবান ও সতর্ক হতে হবে। বেপজা কর্তৃক নতুন ইপিজেড স্থাপন, বেজা কর্তৃক নতুন এসইজেড স্থাপন কিংবা বিসিক কর্তৃক নতুন শিল্প নগরী বা শিল্প পার্ক স্থাপনের ক্ষেত্রেও এ নীতিমালা কঠোরভাবে মেনে চলা প্রয়োজন।

সাত: জীবজন্তু, পাখি ও অন্যান্য প্রাণীর আবাসস্থল উচ্ছেদ করে বা তাদের আবাসস্থল ক্ষতিগ্রস্ত হয় এরূপ কোনো শিল্পের ধারণাকে সবুজ শিল্পায়নের আওতায় সমর্থন করা যাবে না। এমনকি শিল্প স্থাপনের পর ওইসব প্রাণীর বসবাস ঝুঁকির মুখে পড়ার আশঙ্কা থাকলে সেটিকেও নিরুৎসাহিত করতে হবে। সুন্দরবন, ভাওয়ালের গড়, মধুপুরের গড় প্রভৃতি বৃহৎ বনাঞ্চল আজ যেসব কারণে সবচেয়ে বেশি হুমকির মুখে পড়েছে, তার মধ্যে ওইসব এলাকায় অপরিকল্পিত শিল্পায়ন অন্যতম।

এখন কথা হলো, সবুজ শিল্পায়নকে কীভাবে উৎসাহিত ও জোরদার করা যাবে? এক্ষেত্রে প্রথম কথা হলো, বিষয়টিকে শুধু আহ্বানের মধ্যে সীমাবদ্ধ রাখলেই চলবে না। দ্বিতীয়ত, শিল্প-কারখানাটি স্থাপিত হয়ে যাওয়ার পর পরিবেশ সংরক্ষণমূলক পরিধারণ ও পরিদর্শনমূলক কার্যক্রম জোরদার করার প্রচলিত রেওয়াজ থেকে বেরিয়ে আসতে হবে। পরিবেশকে দূষণযুক্ত শিল্পের হাত থেকে রক্ষা করতে চাইলে শিল্প স্থাপনের আগেই তা নিয়ন্ত্রণ করতে হবে।

কোন কোন শিল্প স্থাপন করলে তা পরিবেশের জন্য ক্ষতিকর হবে না বা তা দূষণরোধে সহায়ক হবে, সে-সংক্রান্ত আনুষঙ্গিক তথ্যাদি ভালোভাবে যাচাই-বাছাই করে বিসিক, বিডা, পরিবেশ অধিদপ্তর ও সংশ্লিষ্ট অন্যান্য প্রতিষ্ঠান মিলে পরিবেশবান্ধব শিল্পের একটি তালিকা প্রণয়ন করা যেতে পারে। অতঃপর সে তালিকার ভিত্তিতে অগ্রাধিকার ভিত্তিতে ঋণ সহায়তাদানের জন্য তা বাংলাদেশ ব্যাংকের মাধ্যমে বাণিজ্যিক ব্যাংক ও অন্যান্য অর্থলগ্নি প্রতিষ্ঠানগুলোর কাছে পাঠানো যেতে পারে। অন্যদিকে একই উদ্যোগের আওতায় পরিবেশ দূষণের আশঙ্কা রয়েছে বা পরিবেশ দূষণ করছে—এরূপ শিল্প প্রতিষ্ঠানের ওপর উচ্চহারে করারোপের জন্য অন্য একটি তালিকা তৈরি করে তা জাতীয় রাজস্ব বোর্ডের (এনআরবি) কাছে পাঠানো যেতে পারে।

ব্যাংক ও আর্থিক প্রতিষ্ঠান কর্তৃক উদ্যোক্তার শিল্পঋণসংক্রান্ত প্রস্তাব মূল্যায়নকালে পরিবেশ রক্ষা পাওয়া বা না পাওয়ার বিষয়টিকে বিশেষ গুরুত্বের সঙ্গে বিবেচনা করতে হবে। এমনকি সম্ভব হলে ব্যাংকের সুদের হার ও অন্যান্য প্রযোজ্যতা নির্ধারণকালে পরিবেশ দূষণের বিষয়টি স্বতন্ত্র গুরুত্বের সঙ্গে বিবেচনা করা যেতে পারে।

সবুজ শিল্পায়ন কার্যক্রমকে জোরদার করে বাংলাদেশের এ উদ্যোগের কথা আন্তর্জাতিক পরিমণ্ডলে ব্যাপকভাবে প্রচার করতে হবে, যাতে বিদেশী ক্রেতারা বাংলাদেশের পরিবেশবান্ধব ‘সবুজ শিল্প’ থেকে পণ্য আমদানির ব্যাপারে বিশেষ উৎসাহ ও আগ্রহ বোধ করেন।

প্রধানমন্ত্রীর সভাপতিত্বে দেশে একটি জাতীয় শিল্প উন্নয়ন পরিষদ (এনসিআইডি) এবং এর পক্ষে কাজ করার জন্য শিল্পমন্ত্রীর সভাপতিত্বে এনসিআইডির একটি নির্বাহী কমিটি রয়েছে। উল্লিখিত পরিষদ ও কমিটি এ বিষয়গুলো বিস্তারিত পর্যালোচনা করে এ ব্যাপারে নীতিনির্দেশনামূলক পরামর্শ প্রদান করতে পারে। তবে এ পরিষদ ও কমিটির সভা সংখ্যা যেহেতু কিছুটা কম, সেহেতু এ ব্যাপারে বাস্তবায়নকারী সংস্থাগুলোর নির্বাহী পর্যায়েও এ বিষয়গুলো চূড়ান্ত করা যেতে পারে, যেমনটি আগে উল্লেখ করা হয়েছে।

‘সবুজ শিল্পায়ন’ এখন আর শুধু একটি স্লোগান বা আহ্বান নয়, এটি এখন আমাদের অস্তিত্বের সঙ্গে নিয়ত জড়ানো একটি অনিবার্য অনুষঙ্গও। ফলে শুধু অর্থনৈতিক উন্নয়ন ভাবনার দৃষ্টিকোণ থেকে নয়, নিকট ভবিষ্যতের জীববৈচিত্র্য ও জলবায়ু সংকটের সম্ভাব্য ঝুঁকি মোকাবেলার প্রয়োজন থেকেও তা বিশেষভাবে গুরুত্বপূর্ণ। আর সে গুরুত্বের বিষয়টি আমাদের বর্তমান ও আগামী দিনের শিল্পোদ্যোক্তারা যত দ্রুত ও সহজে অনুধাবন করবেন, বাংলাদেশের মানুষ, জীবন ও পরিবেশকে ততটাই সহনীয় পর্যায়ে রাখা যাবে বলে আশা করা যায়।

লেখক : পরিচালক
আবু তাহের খান
ক্যারিয়ার ডেভেলপমেন্ট সেন্টার
ড্যাফোডিল ইন্টারন্যাশনাল ইউনিভার্সিটি
atkhan56@gmail.com


Source: http://bonikbarta.net/bangla/news/2019-04-04/192752/%E0%A6%9F%E0%A7%87%E0%A6%95%E0%A6%B8%E0%A6%87-%E0%A6%AA%E0%A7%8D%E0%A6%B0%E0%A6%AC%E0%A7%83%E0%A6%A6%E0%A7%8D%E0%A6%A7%E0%A6%BF%E0%A6%B0-%E0%A6%B2%E0%A6%95%E0%A7%8D%E0%A6%B7%E0%A7%8D%E0%A6%AF%E0%A7%87-%E0%A6%B8%E0%A6%AC%E0%A7%81%E0%A6%9C-%E0%A6%B6%E0%A6%BF%E0%A6%B2%E0%A7%8D%E0%A6%AA%E0%A6%BE%E0%A7%9F%E0%A6%A8/

7
Articles and Write up / Internship Survival Guide
« on: March 24, 2019, 10:49:43 AM »
An internship gives you the opportunity to get a glimpse of what it will be like in your future chosen field of work. It is more than just a job, rather an experience that moulds you and betters you to possess all kinds of skills necessary to prosper in your career. However, choosing the right time for an internship in the right place is of utmost importance and is a decision that shouldn't be made lightly.
~Veronica Gomes

When to start looking?

Most students are seen taking up internship opportunities during  the third and fourth years of their undergraduate university lives. When asked why, Ritu Progga Saha, a third year student at BUET, said "Core major-related courses were taught third year onwards and that resulted in more experienced number of students ready to take on internships in the real world." However, first and second year students could just as easily get a head-start at launching their career with a part-time internship and brush up on communication and time management skills in the process. One downside however, is that they may not have as much of a clear career plan mapped out and interests may not be defined yet.

Another decision making criteria would be between summer (full-time or part-time) and academic (part-time) internships. Here, the obvious advantage for summer internships is that a full-time experience gets you to live the 9-5 schedule and adapt to its ways at an early stage. Part-time internships are often more stressful, as juggling work and academics could pose as quite an ordeal, however you might learn precious time management skills out of this type of job.


Where to look?

The benefit of working at big firms is the obvious brand recognition points that you gain through the presence of the internship experience in your CV. However, mid to small sized firms offer a more hands-on experience, giving you more opportunities to learn by performing various work duties and building stronger interpersonal relationships with your peers and supervisors. “Working at Career Solutions helped me network with a wide array of people and enabled me to communicate one-on-one with my supervisors and peers,” said Fariha Amber from NSU. Moreover, interning at big firms could often mean less relevant work and more coffee fetching, low number of assigned work due to confidentiality issues, and an overall impersonal environment which is exactly what Wasiq Ahmed, a student of IBA, DU, had to face during his internship at Deloitte. “However, if you have the intention to learn, work-shadowing your supervisors can help you gain some useful skills.” he added. The third option, startups, could be more suitable for students looking to play a more integral role during the course of their internship. “The workload was a bit overwhelming at first but after some time spent getting used to it, it was worth it simply because of the scale at which I got exposed to the practical world,” said Nafis Khandakar from NSU when asked about his time at AlterYouth, a startup of Grameenphone.

Even though there is usually an absence of a well-defined internship structure at companies in Bangladesh, some have structured internship opportunities, including Grameenphone, with its paid internship program for graduates while unstructured internships at Deloitte, Nestle and Unilever are popular among third and fourth year students. There is also an increasing number of consultancy firms like LightCastle Partners and startups including AlterYouth which provide such opportunities. Lastly, various others including 10 Minute School, Youth Opportunities, etc. have become a prominent platform for students to engage in part-time.


How to Apply?

Some firms often post internship offers on their website or social media page. These come with clear guidelines as to how and when to apply for the job and provide relevant details and requirements of the post itself. Another way could be to use the Youth Opportunities website to find opportunities and follow application procedures which are mentioned along with a link to the original website of the firm in question. When asked about the hiring process, Maliha Iqbal, from the hiring team at Youth Opportunities, replied, “My colleagues and I sit with different departments of the organisation and make a list of what we want from the interns. Once the requirements are set based on the needs, we set out a notice and interview applicants. The key judgement areas include their work interests, knowledge about YO, and alignment of the interviewee with our team values.” She also added that they accept open applications too for certain hires. LinkedIn also poses as an efficient way of finding connections to a company of your interest and finding information you need by reaching out to the Human Resource personnel or directly people from your field of interest. Make sure to send in a formal email with an updated resume clearly stating the purpose of your inquiry to the recipient. Lastly, peer and family connections and referrals often help land internship jobs especially in firms with no established internship structure.


What skills do you need?

Even though internships are learning experiences, a set of common minimal skills are recommended which boost the likeliness of getting accepted as an intern. Almost every firm looks for applicants who meet the basic Microsoft Office skills requirements, mostly focusing on Word, PowerPoint, and Excel at variegated degrees. Some jobs may require prior knowledge from courses such as Human Resource Management, Marketing, or Accounting depending on the line of work you choose. However, soft skills are often given more priority by employers as hard skills are easier to train interns through work. When asked what criteria applicants are judged on, Marcus Cornelius Gomes, Executive Vice President and Head of HR at Mutual Trust Bank, replied, “After the initial academic qualifications and hard skills are met, companies mostly focus on soft skills including creativity, mental alertness, and likelihood of taking initiative. Presentation and verbal communication skills are key judgement criteria to be fulfilled as well.” Other soft skills may include- interpersonal skills, patience, time management, public speaking, leadership, and the ability to work in a team. With the ever changing work environment, it is important to consider providing the employers with a diverse skillset with the right mix of soft and hard skills incorporated into your resume.

 
What are some common obstacles you may face?

The obvious one would be work-life balance as making a fool proof schedule- fitting classes, work, and social life is not that easy to carry out in real life. Moreover, the busy Dhaka streets contribute to increased commute time and this can be particularly troublesome if your workplace is far away from your home. “Time and distance were an issue while working 9-5, however I just got used to it” said Naomi Musleh, a third year student at IBA, DU about her time interning at Mashreq Bank. The workload could also seem overwhelming at first, especially while having to juggle with studies. The wide range of people you meet and have to deal with in the job also poses as an obstacle for many. “Coping with an environment consisting of a bunch of 30 year olds to whom it's a regular day at work was cumbersome for a newbie like me. Moreover, meaningful interactions with individuals were hard to engage in as my job wasn't a long-term one,” said Shadman Karim from NSU about his experience at BATB. However, overcoming this helps you obtain a sense of tolerance and ability to work better in teams. Lack of experience at your first internship or at a new field of work may seem pretty daunting. This is exactly what Aaqib Hasib, currently a student at BRAC University, faced while interning at GIZ Bangladesh. He added, “Hired as an English Trainer, I had to train lower level employees in their 30s-40s who were reluctant to respect me as an instructor as I was merely an inexperienced A level kid in their eyes.“ An important point to note is that a large part of overcoming work related obstacles depend on the supervisors and colleagues you end up working with. “Even though I didn't have prior work knowledge, the team I worked with was very patient with me and gave relevant detailed feedback which enabled me to improve and learn from my mistakes” said Ishraq R Rahman, a third year student at BUET who worked at Backpack BD.


What do internships teach you?

The takeaways from an internship are often a mixture of specific skills relating to the line of work you did and some common soft/hard skills. It could pose as an eye-opening experience, where you learn new things about your department and often clear out misconceptions you had about it from before. For instance, bank jobs may seem boring to you until you work in one and realise how different the various departments can be. At the same time, it could act as a reaffirming system, establishing your beliefs of a job to be true. Internship experience proved to be very helpful for Rageeb Kibria Gohin, currently a Senior Business Consultant at LightCastle Partners, whose internship at said firm made him shift industries from BAT to consultancy just because he liked it better there. “My time working at LCP as a junior associate gave me the luxury to be able to compare and realise how I would much rather work in an impact driven work environment which forces me to think, study, write, and implement and I preferred that over BATB's work culture despite of how great it is. Thus, I shifted.” Alongside soft skills including collaborative and communicative skills, it teaches you the importance of networking and enables you to set up one of your own. Moreover, it teaches you how to act in a formal setting and trains you to tackle real life issues, handle work pressures effectively, and the art of multitasking.

 
Advice to internship seekers

While big firms provide better-known credentials, working for small firms and startups is recommended if effective learning experience and being productive are the two important criteria to fulfill for you. It goes without saying, you should apply for internships in fields that genuinely interest you even if it means work-shadowing your employer for a larger part of the time; you can learn a lot about their day-to-day activities and work mechanisms through this. If it's your first time working, make sure to stay confident and bold, no matter how terrified you are inside. Remind yourself to be grateful for the learning opportunity you have been given and challenge yourself every day. The rest will fall into place.


Source: https://www.thedailystar.net/shout/cover-story/news/internship-survival-guide-1718212

8
সাম্প্রতিক সময়ের বহুল আলোচিত ও সর্বাধিক গুরুত্বপূর্ণ কিছু প্রসঙ্গের মধ্যে শিক্ষিত তরুণের চাকরি না পাওয়ার বিষয়টি নিঃসন্দেহে অন্যতম। বলা হচ্ছে, শিক্ষিত তরুণদের মধ্যে বিরাজমান ব্যাপকভিত্তিক এ বেকারত্ব তাদের মধ্যে ক্ষোভ ও হতাশা বাড়াচ্ছে, যা প্রকারান্তরে বড় মাত্রার জাতীয় ক্ষতিরই নামান্তর। বস্তুত দেশের সমাজ, রাজনীতি, অর্থনীতি সবকিছুর ওপরই এটি একটি বিরূপ প্রতিক্রিয়া সৃষ্টি করছে। আর সে দৃষ্টিকোণ থেকে বিবেচনা করলে সর্বসম্প্রতি দায়িত্ব নেয়া নতুন সরকারের সামনে দেশের সব শিক্ষিত তরুণের জন্য কর্মসংস্থানের সুযোগ সৃষ্টি করতে পারাটাও একটি গুরুত্বপূর্ণ চ্যালেঞ্জ বৈকি! আর সে চ্যালেঞ্জ মোকাবেলায় সরকার ও দেশের বেসরকারি খাত কী করতে পারে, সে বিষয় নিয়েই এখানে সংক্ষেপে খানিকটা আলোকপাত করা হলো।

প্রথম সরল হিসাব হচ্ছে, কর্মসংস্থান বাড়াতে হলে সর্বাগ্রে বিনিয়োগ বাড়াতে হবে, সেটি স্থানীয় বা বৈদেশিক বিনিয়োগ যা-ই হোক না কেন। দ্বিতীয়ত, এ বিনিয়োগের ক্ষেত্রে সেবা খাতের তুলনায় উৎপাদন খাতকে (ম্যানুফ্যাকচারিং) বিশেষ অগ্রাধিকার দিতে হবে। অবশ্য তার মানে এই নয়, সেবা খাতে বিনিয়োগ হবে না। বিনিয়োগ সেবা খাতেও হবে। তবে খেয়াল রাখতে হবে সেবা খাতের বিনিয়োগ যেন সেসব ক্ষেত্রে হয়, যেসব ক্ষেত্রে হলে পরে তা উৎপাদন খাতের বিনিয়োগকে সহায়তা ও সম্পূরকতা দান করতে পারে। আর বৈদেশিক বিনিয়োগ শুধু সেলফোনের মতো মুনাফা স্থানান্তরকারী খাতে নয়, স্থানীয় অর্থনীতির ভিত্তি নির্মাণে সহায়ক অন্যান্য খাতেও নিশ্চিত করতে হবে। যাহোক, বিনিয়োগের এ ধারণাগত বিষয়গুলোকে মূল বিবেচনায় রেখে বর্ধিত কর্মসংস্থান সৃষ্টির উপায় ও কৌশল নিয়ে এখন খানিকটা আলোচনা করা যেতে পারে।

এটি এখন জনপ্রিয় আলোচনায় পরিণত হয়েছে যে কৃষিতে নতুন করে কর্মসংস্থান সৃষ্টির আর কোনো সুযোগ নেই, বরং এ খাত এখন ছদ্ম বেকারত্বের ভারে জর্জরিত। ধারণাটি সর্বাংশে সত্য নয়, বরং তা একপেশে ও অসম্পূর্ণ। সত্য এই যে, এখানে ছদ্ম বেকারত্ব রয়েছে বটে, পাশাপাশি নতুন বিনিয়োগ ও কর্মসংস্থান সৃষ্টির সুযোগও যথেষ্টই রয়েছে। স্পষ্ট করলে বিষয়টি দাঁড়ায়, প্রচলিত ধাঁচের কৃষিকাজে নতুন বিনিয়োগ ও কর্মসংস্থানের সুযোগ তেমন একটা না থাকলেও প্রযুক্তিভিত্তিক আধুনিক কৃষিতে নতুন বিনিয়োগ ও এর বহুমুখীকরণের সুযোগ এতটাই রয়েছে, এ খাতই হয়ে উঠতে পারে শিক্ষিত তরুণের কাছে ভবিষ্যতে বেকারত্ব লাঘবের অন্যতম নির্ভরযোগ্য ক্ষেত্র। তবে সে আলোচনায় যাওয়ার আগে শিক্ষিত তরুণ চাকরি না খুঁজে কেন ও কীভাবে উদ্যোক্তা হবেন, তা নিয়ে মূল আলোচনাটি সেরে নেয়া যেতে পারে।

মধ্যযুগের গোড়ায় পশুপালন ছিল অন্যতম মর্যাদাসম্পন্ন পেশা। কিন্তু পেশার অগ্রাধিকার তালিকায় পশুপালন নিশ্চয় এখন আর টিকে নেই। সময়ের পরিবর্তনের সঙ্গে সঙ্গে পেশা পছন্দের ক্রমও পাল্টে গেছে। পরিবর্তনের ধারায় আজকের এ যুগে এসে মানুষ চাকরিকেই সর্বাধিক ঝুঁকিবিহীন ও নিরাপদ পেশা হিসেবে বেছে নিয়েছে, যদিও প্রগতিশীলদের অনেকেই এর সঙ্গে মুত্সুদ্দি মানসিকতার ছায়া রয়েছে মনে করেন। তবে সব দৃষ্টিকোণ থেকেই এটা ঠিক, চাকরির মতো পেশায় মানুষের ভেতরকার উদ্ভাবনী ও সৃজনশীলতার মতো বৈশিষ্ট্যগুলো অনেকটাই সংকুচিত হয়ে পড়ে। কিন্তু তার পরও অনুদ্যমী মানুষ, সংখ্যায় যারা সমাজের সিংহভাগ, চাকরিকেই জীবনের পরম আরাধ্য বলে গণ্য করে। তবে আজকের এ চতুর্থ শিল্প বিপ্লবের যুগে এসে শিক্ষিত তরুণদের জন্য উপলব্ধি করার সময় হয়েছে যে নিজেদের মেধা ও সৃজনশীল চিন্তাভাবনার যথার্থ প্রয়োগ ঘটাতে চাইলে গবেষক ও বিজ্ঞানীর কর্মকাণ্ডের এখন প্রথম ক্ষেত্রটিই হচ্ছে উদ্যোক্তা বৃত্তি এবং কোনোভাবেই তা চাকরি নয়।

অবশ্য এটি শুধু পরামর্শের আদলে মুখে বললেই তরুণরা সেদিকে ধাবিত হবে—এমনটি মনে করার কোনো কারণ নেই। এ ধারণার বাস্তবায়ন দেখতে চাইলে সর্বাগ্রে প্রয়োজন হবে উদ্যোক্তা-অনুকূল একটি বাস্তব পরিস্থিতি তৈরি করা, যেটি একজন শিক্ষিত তরুণকে চাকরি না খুঁজে উদ্যোক্তা বৃত্তিকে পেশা হিসেবে গ্রহণ করতে উৎসাহিত করবে। কিন্তু অপ্রিয় হলেও সত্য, বিশ্ব উদ্যোক্তা উন্নয়ন সূচক ২০১৮ অনুযায়ী বিশ্বের ১৩৭টি দেশের মধ্যে বাংলাদেশের অবস্থান এখন ১৩৪তম, যেখানে সার্কভুক্ত ভারত, শ্রীলংকা ও পাকিস্তানের অবস্থান হচ্ছে যথাক্রমে ৬৮, ৯০ ও ১২০তম। এ অবস্থার আশু পরিবর্তন করতে না পারলে আমরা মুখে তাদের যতই উদ্যোক্তা হওয়ার পরামর্শ দিই না কেন, বাস্তব পরিস্থিতি তাকে মোটেও সেদিকে ধাবিত হতে সহায়তা করবে না।

এ অবস্থার পরিবর্তনে তাহলে কী করা যায়? এক্ষেত্রে অগ্রাধিকার সারির কাজগুলোর মধ্যে একেবারে প্রথমেই রয়েছে উদ্যোক্তা হিসেবে যাত্রা শুরুর জন্য কী ধরনের প্রস্তুতি প্রয়োজন, সে-বিষয়ক ধারণা এবং তথ্যাদি সংশ্লিষ্টদের নাগালের মধ্যে সহজলভ্য করে তোলা। অর্থাৎ সরকার কর্তৃক উদ্যোক্তা উন্নয়নসংক্রান্ত নানা ধরনের ব্যবস্থাপনা ও দক্ষতা উন্নয়নমূলক কারিগরি প্রশিক্ষণ কার্যক্রম সারা দেশে ছড়িয়ে দেয়া। তবে বাজার ও প্রযুক্তির দ্রুত পরিবর্তনশীলতার এ যুগে এজন্য কোনো অবস্থাতেই ব্যয়বহুল স্থায়ী অবকাঠামো নির্মাণ ও স্থায়ী লোকবল নিয়োগ করাটা সমীচীন হবে না, যেমনটি এতদিন পর্যন্ত হয়ে আসছিল। কারণ আজ যে পণ্য ও প্রযুক্তির চাহিদা রয়েছে, অবধারিতভাবেই ১০ বছর পর সে চাহিদা আর অক্ষুণ্ন থাকবে না। অতএব কাজগুলো করতে হবে অন্যান্য শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানের বিদ্যমান অবকাঠামো ব্যবহার করে এবং চুক্তিভিত্তিক লোকবল নিয়োগের মাধ্যমে। এক্ষেত্রে স্মরণ করিয়ে দিতে চাই, সারা দেশে বর্তমানে যেসব কারিগরি ও উদ্যোক্তা উন্নয়ন কার্যক্রমের সঙ্গে সম্পর্কিত প্রতিষ্ঠান রয়েছে, আজকের পরিবর্তিত বৈশ্বিক প্রেক্ষাপটে সেগুলোর ভৌত অবকাঠামো ব্যতীত বাদবাকি দক্ষতা ও সামর্থ্যের ওপর খুব বেশি নির্ভর না করাটাই শ্রেয়তর হবে বলে মনে করি। কারণ এসব দক্ষতা ও সামর্থ্যের স্তর অধিকাংশ ক্ষেত্রেই সর্বশেষ বাজার চাহিদার সঙ্গে অসংগতিপূর্ণ, সমন্বয় অনুপযোগী ও পশ্চাত্পদ। এ অবস্থায় এসবের সমন্বয় ও আধুনিকায়নের জন্য অহেতুক সময়, শ্রম ও আর্থিক সম্পদ ব্যয় না করে সরকারের উচিত হবে সর্বশেষ বাজার প্রবণতার (শুধু স্থানীয় বাজার নয়, বিশ্ববাজারও) প্রতি লক্ষ রেখে ‘যেখানে যেরূপ প্রয়োজন’ নীতিমালার আলোকে এসব প্রশিক্ষণ কার্যক্রমকে এগিয়ে নিয়ে যাওয়া। এক্ষেত্রে বেসরকারি খাতকেও সমভাবে ও ব্যাপক পরিসরে যুক্ত করা যেতে পারে এবং তা করার একটি অন্যতম উপায় হচ্ছে ব্যাংক ও আর্থিক প্রতিষ্ঠান কর্তৃক ক্ষুদ্র ও মাঝারি উদ্যোগে (এসএমই) অগ্রাধিকার ভিত্তিতে ঋণদানের যে নীতিমালা রয়েছে, তার ভেতরে উদ্যোক্তা উন্নয়ন প্রশিক্ষণ কার্যক্রমে ঋণদানের জন্য একটি অধিকতর অগ্রাধিকারক্রম নির্ধারণ করা। পাশাপাশি থাকতে পারে মাধ্যমিক বিদ্যালয় থেকে শুরু করে বিশ্ববিদ্যালয় পর্যন্ত সব শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানে উদ্যোক্তা উন্নয়নসংক্রান্ত শিক্ষাদান কার্যক্রমকে উৎসাহিত করা।

অগ্রাধিকার সারির দ্বিতীয় কাজটি হতে পারে বাজার চাহিদা ও সম্ভাব্য উদ্যোক্তার নিজস্ব যোগ্যতা ও সামর্থ্যের আলোকে কোথায় বিনিয়োগ করাটা অধিকতর নিরাপদ ও লাভজনক হতে পারে, সে বিষয়ে প্রয়োজনীয় পরামর্শ ও তথ্যনির্দেশনা লাভের সুযোগ আগ্রহী সম্ভাব্য উদ্যোক্তার জন্য নিশ্চিত করা। এক্ষেত্রে সংশ্লিষ্ট সব প্রতিষ্ঠানের প্রচেষ্টার প্রতি পূর্ণ সম্মান রেখে বলি, উদ্যোক্তা উন্নয়নসংক্রান্ত সেবা সহায়তাদানের সঙ্গে জড়িত অধিকাংশ প্রতিষ্ঠানেরই এক্ষেত্রে দক্ষতা ও সামর্থ্যের ঘাটতি রয়েছে। ব্যাংক ও আর্থিক প্রতিষ্ঠান কর্তৃক অনিয়মতান্ত্রিক ঋণদানের বাইরে পেশাগত স্বচ্ছতা রক্ষা করে যে বিপুল পরিমাণ ঋণ দেয়া হয়, সেখানেও যে বহু বিনিয়োগ প্রকল্প অসফল হচ্ছে, তার একটি বড় কারণ হচ্ছে লাভজনক ও নিরাপদ বিনিয়োগ ক্ষেত্র যাচাইয়ে যথার্থ দূরদৃষ্টির অভাব ও পেশাগত দক্ষতার ঘাটতি। ফলে যে শিক্ষিত তরুণদের এখানে উদ্যোক্তা হিসেবে এগিয়ে আসার জন্য আহ্বান জানানো হচ্ছে, তাদের যদি উপযুক্ত বিনিয়োগ ক্ষেত্র নির্ধারণে নির্দেশনামূলক তথ্য দিয়ে সহায়তা করা না যায়, তাহলে ব্যাংকের অনিচ্ছাকৃত খেলাপি উদ্যোক্তার মতো এদেরও কারো কারোর মাঝপথে হতাশ হয়ে পড়ার আশঙ্কা রয়েছে। এখানে স্পষ্টীকরণের জন্য বলি, বিনিয়োগ ক্ষেত্র নির্ধারণের চূড়ান্ত সিদ্ধান্ত সংশ্লিষ্ট উদ্যোক্তাকেই নিতে হবে। কিন্তু সেক্ষেত্রে সঠিক সিদ্ধান্ত নেয়ার জন্য যে ধরনের তথ্য ও পরামর্শ প্রয়োজন, তা যাতে রাষ্ট্রের উদ্যোক্তা উন্নয়নসংক্রান্ত কর্মকাঠামোয় যথাযথভাবে সন্নিবেশিত থাকে, সেটি অবশ্যই নিশ্চিত করতে হবে।

এবার প্রবন্ধের গোড়ায় উত্থাপিত কৃষিতে নতুন করে বিনিয়োগ ও কর্মসংস্থানের সুযোগ আছে কিনা, সে আলোচনায় ফিরে যাই। তথ্যভিত্তিক দৃঢ় অভিমত হচ্ছে, শিক্ষিত তরুণদের একটি বড় অংশের জন্যই এ মুহূর্তের সবচেয়ে নিরাপদ ও লাভজনক বিনিয়োগ অনুসন্ধানের একেবারে প্রথম ক্ষেত্রটি হচ্ছে কৃষি, যে খাত সম্পর্কে সামাজিক ও উত্তরাধিকার সূত্রে তাদের প্রায় সবারই কমবেশি কিছুটা ধারণা রয়েছে। তবে এ বিনিয়োগ হতে হবে আধুনিক প্রযুক্তিভিত্তিক কৃষিতে, যেখানে ফসল উৎপাদনের ক্ষেত্রে যেমন বহুমুখীকরণ থাকবে, তেমনি বহুমুখীকরণ থাকবে কৃষি প্রক্রিয়াকরণেও এবং সে প্রক্রিয়াকরণ শুধু বহুমুখীকরণের উদ্দেশ্যের মধ্যেই সীমাবদ্ধ থাকবে না, একই সঙ্গে তার লক্ষ্যের পরিধিতে যুক্ত হবে বিশ্ববাজারও। আর তেমনটি ঘটলে বাংলাদেশ শুধু শাকসবজি, ফলমূল, মিঠা পানির মাছ ইত্যাদির উৎপাদনেই বিশ্বের অন্যতম শীর্ষস্থানীয় দেশ হয়ে থাকবে না, এসবের প্রক্রিয়াকরণেও শীর্ষ কাতারের রফতানিকারক দেশ হয়ে উঠবে বলে আশা করা যায়। আর যেসব উৎপাদন সূচকের ওপর ভিত্তি করে বিভিন্ন আন্তর্জাতিক মূল্যায়ন ও ভবিষ্যদ্বাণীতে বাংলাদেশের কাছে ভবিষ্যতের অর্থনীতিকে বড় অর্থনীতির কাতারে ফেলা হচ্ছে, তার মধ্যে কৃষি খাতে (মত্স্য ও পশুপালনসহ) প্রযুক্তি-সংশ্লিষ্টতা বৃদ্ধি ও ফসলের বহুমুখীকরণের পাশাপাশি এ প্রক্রিয়াকরণের বিষয়টিও রয়েছে। আশা করব বাংলাদেশের নতুন প্রজন্মের শিক্ষিত তরুণরা সে ভবিষ্যদ্বাণীকে বাস্তবে রূপদানের অন্যতম চালিকাশক্তি হিসেবে গড়ে তুলতে সক্ষম হবে।

নতুন সরকার প্রতিটি গ্রামে সব নাগরিক সুবিধা সৃষ্টির অঙ্গীকার করেছে। সে অঙ্গীকারের পুরোটা না হোক, ৮০ শতাংশও যদি বাস্তবায়ন হয়, তাহলে পল্লী অবকাঠামো খাতে যে যুগান্তকারী পরিবর্তন আসবে, শিক্ষিত তরুণরা সেটিকে ব্যবহার করে চৌকস উদ্যোক্তা হয়ে ওঠার সুযোগ পাবেন বলে আশা করা যায়। আর কর্মসংস্থান সৃষ্টির জন্য সরকারও সেটাকেই অন্যতম কৌশল হিসেবে গ্রহণ করে বেকারত্ব মোকাবেলার চ্যালেঞ্জকে সফলভাবে মোকাবেলা করতে পারে বৈকি! তবে এক্ষেত্রে একটাই বিনীত প্রস্তাব: স্থানীয় সরকার প্রতিষ্ঠানগুলোকে আরো শক্তিশালী করে তুলতে হবে এবং এরাই পল্লী অঞ্চলে শিক্ষিত, স্বল্পশিক্ষিত নির্বিশেষে সব তরুণের জন্য কর্মসংস্থান সৃষ্টিতে নেতৃত্বদানে সক্ষম হবে। আর তা করতে হলে মাননীয় সংসদ সদস্যদেরও স্থানীয় সরকার প্রতিষ্ঠানগুলোর কাছে তাদের স্থানীয় ক্ষমতা ছেড়ে দিয়ে জাতীয় সংসদের প্রকৃত কার্যক্রমের প্রতি আরো মনোযোগী হতে হবে, যেখানে বসে তারা আরো আধুনিক ও গতিশীল এমনসব আইন ও আইনি সহায়ক নীতিমালা প্রণয়ন করবেন, যা দেশের উদ্যোক্তা উন্নয়ন কার্যক্রমকে বর্ধিত গতিশীলতাদানে সক্ষম হবে।

নতুন কর্মসংস্থান সৃষ্টি নিঃসন্দেহে একটি বড় চ্যালেঞ্জ। আধুনিক প্রযুক্তির সন্নিবেশতার কারণে শ্রমঘন অধিকাংশ অর্থনৈতিক কর্মকাণ্ডই যখন ক্রমান্বয়ে প্রযুক্তিঘন ও শ্রম লাঘবকারী কর্মকাণ্ডে রূপান্তর হবে, তখন কর্মসংস্থান সৃষ্টির সে চ্যালেঞ্জ আরো বেশি কঠিন হয়ে পড়েছে বৈকি! তদুপরি দেশ ও পৃথিবী থেকে বহু পেশা ক্রমান্বয়ে বিলুপ্তমানতার দিকে ধাবিত হওয়ার ফলে কর্মসংস্থান হ্রাসের ঝুঁকি তো রয়েছেই। তার পরও আশার কথা, মানুষের দৈনন্দিন জীবনযাপন ও ভোগবিলাসের ক্ষেত্রে ক্রমবর্ধমান বৈচিত্র্যের কারণে পৃথিবীতে প্রযুক্তিভিত্তিক নতুন নতুন কর্মকাণ্ড সৃষ্টি হচ্ছে এবং হবে, যে সুবিধা গ্রহণের সুযোগ পৃথিবীর অধিকাংশ দেশের তুলনায় বাংলাদেশের তরুণদেরই বেশি রয়েছে। অতএব সরকারের উদ্যোক্তা উন্নয়ন কার্যক্রমের আওতায় বর্ধিত তত্পরতা (যা নেয়া হবে বলে আমরা আশাবাদী), গ্রামে নাগরিক অবকাঠামো সৃষ্টি ও বিশ্ববাজারে আধুনিক প্রযুক্তিভিত্তিক নতুন কর্মসৃষ্টির সম্ভাবনাকে সামনে রেখে এ কথা দায়িত্ব নিয়েই বলা যায়, কর্মসংস্থান সৃষ্টির চ্যালেঞ্জ মোকাবেলায় উদ্যোক্তা উন্নয়নই হয়ে উঠতে পারে বাংলাদেশের কাছে ভবিষ্যতের অন্যতম অর্থনৈতিক কৌশল, সার্বিক সামাজিক উন্নয়ন কৌশলের বিবেচনায়ও যা অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ।


লেখক : পরিচালক
আবু তাহের খান
ক্যারিয়ার ডেভেলপমেন্ট সেন্টার
ড্যাফোডিল ইন্টারন্যাশনাল ইউনিভার্সিটি
atkhan56@gmail.com


Source: http://bonikbarta.net/bangla/news/2019-02-13/187262/%E0%A6%95%E0%A6%B0%E0%A7%8D%E0%A6%AE%E0%A6%B8%E0%A6%82%E0%A6%B8%E0%A7%8D%E0%A6%A5%E0%A6%BE%E0%A6%A8-%E0%A6%B8%E0%A7%83%E0%A6%B7%E0%A7%8D%E0%A6%9F%E0%A6%BF%E0%A6%B0-%E0%A6%9A%E0%A7%8D%E0%A6%AF%E0%A6%BE%E0%A6%B2%E0%A7%87%E0%A6%9E%E0%A7%8D%E0%A6%9C-%E0%A6%AE%E0%A7%8B%E0%A6%95%E0%A6%BE%E0%A6%AC%E0%A7%87%E0%A6%B2%E0%A6%BE%E0%A7%9F-%E0%A6%89%E0%A6%A6%E0%A7%8D%E0%A6%AF%E0%A7%8B%E0%A6%95%E0%A7%8D%E0%A6%A4%E0%A6%BE-%E0%A6%89%E0%A6%A8%E0%A7%8D%E0%A6%A8%E0%A7%9F%E0%A6%A8/

9
ড্যাফোডিল ইন্টারন্যাশনাল ইউনিভার্সিটির চেয়ারম্যান মো. সবুর খান। নিজে একজন সফল উদ্যোক্তা, নতুন উদ্যোক্তা তৈরি করতেও সব সময় আগ্রহী। ব্যবসায়ী হয়ে ওঠার গল্প, বিশ্ববিদ্যালয় নিয়ে ভাবনা, উদ্যোক্তাদের জন্য পরামর্শ—এমন নানা কিছু নিয়ে কথা বলেছেন তিনি। সাক্ষাৎকার নিয়েছেন মো. সাইফুল্লাহ

যত দূর জানি, আপনি পাইলট হতে চেয়েছিলেন। জাহাঙ্গীরনগর বিশ্ববিদ্যালয়ে পরিসংখ্যান বিভাগে পড়েছেন। জীবনে নিশ্চয়ই এমন একটা মুহূর্ত এসেছে, যেটা আপনার ক্যারিয়ারের গতিপথ ঠিক করে দিয়েছে।

এটা ঠিক যে স্কুল-কলেজে আমার পাইলট হওয়ার ইচ্ছা ছিল। জাহাঙ্গীরনগর বিশ্ববিদ্যালয়ে পড়ার সময় সেনাবাহিনীর লং কোর্সে টিকেও গিয়েছিলাম। আমি ও আমার এক বন্ধুর সকাল ১০টায় রিপোর্টিং করার কথা। অর্থাৎ সকাল ৮টায় জাহাঙ্গীরনগর থেকে রওনা হতে হবে। সকালে বন্ধু যখন আমার রুমের দরজায় টোকা দিল, কেন যেন বলে বসলাম, আমি যাব না। মনে হচ্ছিল, আর্মিতে চলে গেলে বিশ্ববিদ্যালয়–জীবনটা মিস করব। সবাই খুব অবাক হয়েছিল। মা-বাবা অখুশি হয়েছিলেন। সেদিন যদি আর্মিতে যেতাম, হয়তো জীবনটা অন্য রকম হতো। কিন্তু এই সুযোগটা হারানোর কারণে আমার জেদ চেপে গিয়েছিল। এরপর আরও নানা কিছু করেছি। বিদেশে যাব ভেবে টোয়েফল দিয়েছি। স্নাতক শেষ হওয়ার পর দেখি বন্ধুরা সবাই বিসিএস দেয়, আমিও দিলাম। টিকে গেলাম। আমার পোস্টিং হয়েছিল ডাক বিভাগে। পররাষ্ট্র ক্যাডার পেলে হয়তো সরকারি চাকরিতেই যেতাম। আবার ব্যাংকে চাকরি পেয়েছি। কিন্তু ব্যবসা করার ইচ্ছে সব সময় ছিল, তাই মাস্টার্সের রেজাল্ট হওয়ার আগেই আমি ব্যবসা শুরু করেছিলাম। আমি মনে করি প্রতিটা ব্যর্থতাই একেকটা শিক্ষা। এই যে পররাষ্ট্র ক্যাডারে হলো না, এই ব্যর্থতা আমাকে আরও ভালো কিছু করার অনুপ্রেরণা দিয়েছে।

এখন যেমন সবকিছুই কম্পিউটারনির্ভর, প্রযুক্তিনির্ভর। নব্বইয়ের দশকে তো এমনটা ছিল না। কম্পিউটারের ব্যবসা কেন শুরু করলেন?
আমার সব সময় একটা মনোভাব ছিল, আমি সেই ব্যবসাই করব, যেটা সম্পর্কে আমি ভালো জানি। সে সময় কম্পিউটার হয়তো এত পরিচিত ছিল না, কিন্তু যে অল্প কয়েকটা প্রোগ্রাম ছিল, সেগুলোই খুব ভালো জানতাম। কম্পিউটার নিয়ে যেহেতু আমার আত্মবিশ্বাস ছিল, ভাবলাম এই খাতেই ব্যবসা করি। সে সময় কম্পিউটার সায়েন্স নামে কোনো বিষয় ছিল না। কিন্তু আমাদের সময়ই প্রথম কম্পিউটার সায়েন্স নামে ১০০ নম্বরের একটা কোর্স চালু হলো। আমি সর্বোচ্চ নম্বর পেয়েছিলাম। কারণ পরিসংখ্যানের কিছু বিষয় মজা লাগত না, কিন্তু কম্পিউটার সায়েন্স খুব ভালো লাগত।

ছাত্রজীবন থেকেই বোধ হয় ঝুঁকি নেওয়ার প্রবণতা আপনার মধ্যে ছিল। একজন উদ্যোক্তা হতে হলে যেই বৈশিষ্ট্যটা খুব প্রয়োজন।
হ্যাঁ। আমি কখনোই বেকার থাকতে পছন্দ করতাম না। তখনকার রাজনৈতিক পরিস্থিতিতে দীর্ঘ দিন বিশ্ববিদ্যালয় বন্ধ থাকত। এলাকায় গিয়ে তরুণদের ডেকে তখন উন্নয়নের অগ্রদূত নামে একটা সামাজিক সংগঠনের কাজ করতাম। স্কুলে পড়ার সময় খেলাঘর আসর করেছি, স্কাউটিং করেছি। বিশ্ববিদ্যালয়ে রোটার​্যাক্ট ক্লাবে খুব সক্রিয় ছিলাম। সব সময় আগ্রহ ছিল নতুন কিছু করার। পারি বা না পারি, কবিতা আবৃত্তি, বিতর্ক, গান, সবকিছুতে নাম লেখাতাম। কখনো কখনো পুরস্কারও পেতাম। এখন বুঝি, এই আগ্রহই পরে কর্মজীবনে কাজে এসেছে।

২৪ জানুয়ারি ড্যাফোডিল ইন্টারন্যাশনাল ইউনিভার্সিটির ১৭ বছর পূর্ণ হলো। ২০০২ সালে যখন শুরু করেছিলেন, তখন বিশ্ববিদ্যালয় নিয়ে আপনার ভাবনা কী ছিল?
আমাদের খুব সৌভাগ্য, শুরুতেই উপাচার্য হিসেবে অধ্যাপক আমিনুল ইসলামের মতো একজন মানুষকে পেয়েছিলাম। তিনি এত দৃঢ়তার সঙ্গে দায়িত্ব নিয়েছিলেন যে সত্যি বলতে, ২০০৭ সাল পর্যন্ত আমি বিশ্ববিদ্যালয় নিয়ে খুব একটা ভাবিনি। ২০০৬ সালে বিশ্ববিদ্যালয় মঞ্জুরি কমিশন বেসরকারি বিশ্ববিদ্যালয়গুলোর একটা মূল্যায়ন করল। দেখলাম সেরা ৯ বিশ্ববিদ্যালয়ের মধ্যে আমাদের অবস্থান ৬ নম্বরে। বিশ্ববিদ্যালয়ের বয়স তখন মাত্র ৪-৫ বছর, অনেক সময় শিক্ষকদের বেতন ঠিকমতো দিতে পারি না, নানা সমস্যা। আমি খুব অবাক হলাম, এত সীমাবদ্ধতার মধ্যেও কীভাবে আমরা এত ভালো করলাম। তখন বুঝলাম, এটা আসলে অধ্যাপক আমিনুল ইসলামের কঠিন নিয়মকানুন ও স্বচ্ছতার ফল। এই ঘটনাটা আমাকে খুব অনুপ্রাণিত করল। তখন মনে হলো, আমিনুল ইসলাম স্যার যদি বিশ্ববিদ্যালয়টাকে এত দূর নিয়ে আসতে পারেন, তাহলে আমি কেন আমার অভিজ্ঞতাটাও তাঁর সঙ্গে যোগ করি না? বিশ্ববিদ্যালয়ে সময় দিতে শুরু করলাম। ঠিক করলাম, প্রত্যেক শিক্ষার্থীকে আমরা একটা করে ল্যাপটপ দেব, বিনা মূল্যে। তখন থেকে শুরু করে আজ পর্যন্ত আমরা প্রায় ৩৪ হাজার ছাত্রছাত্রীকে ল্যাপটপ দিয়েছি।

 ল্যাপটপ দেওয়ার কথা ভাবলেন কেন?
আমার ভাবনা ছিল, শিক্ষার্থীরা যদি ল্যাপটপ পায়, তারা কর্মজীবনে ভালো করবে। তাদের একটা বিরাট অংশ এটাকে কাজে লাগাবে। হয়েছেও তাই। আউটসোর্সিং, ফ্রিল্যান্সিংসহ তথ্যপ্রযুক্তির সব খাতে দেখবেন আমাদের ছেলেমেয়েরা ভালো করছে। কয়েক দিন আগে একটা ছেলে এসে বলল, স্যার, আমি নারায়ণগঞ্জে একটা ব্যবসা করছি। আপনাকে একটা প্রেজেন্টেশন দেখাতে চাই। সে যখন প্রেজেন্টেশন দিতে শুরু করল, দেখলাম সে ড্যাফোডিলের দেওয়া ল্যাপটপ নিয়ে এসেছে। সে যখন বলল, স্যার, এই ল্যাপটপ দিয়েই তো আমি জ্যামে বসে পরিকল্পনা করেছি, ছোটখাটো ব্যবসা শুরু করেছি; আমার মন ভরে গেল।

উদ্যোক্তা তৈরির জন্য আপনি অনেক দিন ধরেই কাজ করছেন। বিশ্ববিদ্যালয়ে যেমন ইনোভেশন অ্যান্ড এন্ট্রাপ্রেনিউরশিপ নামে একটা বিভাগ আছে। শিক্ষার্থীদের উদ্যোক্তা হিসেবে গড়ে তোলার জন্য আরও নানা রকম কার্যক্রম আছে ড্যাফোডিলের।
প্রতি সপ্তাহে আমরা ছাত্রছাত্রীদের জন্য একটা স্টার্টআপ মার্কেটের সুযোগ করে দিই। এই মার্কেটে ছাত্রছাত্রীরা বিভিন্ন পণ্য সাজিয়ে বিক্রি করে। আবার বিশ্ববিদ্যালয়ের রেস্তোরাঁ চালানো থেকে শুরু করে বিভিন্ন অনুষ্ঠানের খাবার কিংবা টি–শার্ট সরবরাহ...সবকিছুই করে শিক্ষার্থীরা। একটা দল পাস করে বের হয়ে যাচ্ছে, নিজের ব্যবসা চালু করছে। আবার নতুন একটা ব্যাচ এসে হাল ধরছে। এ ছাড়া আমরা ক্যাম্পাসে প্রচুর প্রতিযোগিতার আয়োজন করি। হাল্ট প্রাইজ, গেট ইন দ্য রিং, আর ইউ নেক্সট স্টার্টআপ, স্টার্টআপ আইডিয়া ফর ফান্ড...এই সব প্রতিযোগিতার উদ্দেশ্যই হলো শিক্ষার্থীকে ব্যবসায় উদ্বুদ্ধ করা, চর্চা করার সুযোগ করে দেওয়া। সম্প্রতি একটা তহবিল চালু করেছি। আমি ছাত্রছাত্রীদের কিছু ক্লাস নিই। বিশ্ববিদ্যালয়ের নিয়ম অনুযায়ী তার জন্য আমাকে বেতন দেওয়া হয়। আমি বললাম, আমি বেতন নিলে সেটা তো ভালো দেখা যায় না। এই টাকাটা দিয়ে বরং একটা তহবিল গঠন করা হোক। উদ্যোক্তা উন্নয়ন তহবিল। কোনো শিক্ষার্থী যদি ব্যবসা করতে চায়, তার যদি তহবিলের দরকার হয়, সে বিনা সুদে এই তহবিল থেকে ঋণ নিতে পারবে।

 তরুণ উদ্যোক্তাদের জন্য যদি সংক্ষেপে ৩টি পরামর্শ দিতে বলি...
প্রথম পরামর্শ হলো, শুরু করো। দ্বিতীয় পরামর্শ, ফান্ড নিয়ে ভেবো না। শুরু করতে পারলে ফান্ডের ব্যবস্থা হবে। তৃতীয় পরামর্শ হলো, সব লিখে রাখো। আমি অনেক বড় ব্যবসায়ীকে দেখেছি, যদি বলি আপনার ব্যবসার পরিকল্পনা আমাকে পাঠান, আমি একটু বিশ্লেষণ করে দেখি। দিতে পারে না। এটা খুব দুঃখজনক। মাথায় রাখলে হবে না। নোট রাখতে হবে। তাহলে পরিকল্পনাটা গোছানো হয়, ভুলগুলো জানা যায়।


আরও ৬ পরিচিতি

● পরিচালক, ওয়ার্ল্ড ইনফরমেশন টেকনোলজি সার্ভিসেস অ্যালায়েন্স (উইটসা)

● হাইকমিশনার, ওয়ার্ল্ড বিজনেস অ্যাঞ্জেল ইনভেস্টমেন্ট ফোরাম বাংলাদেশ

● সহসভাপতি, অ্যাসোসিয়েশন অব ইউনিভার্সিটিজ অব এশিয়া অ্যান্ড দি প্যাসিফিক

● সাবেক সভাপতি, ঢাকা চেম্বার অব কমার্স অ্যান্ড ইন্ডাস্ট্রিজ

● সাবেক সভাপতি, বাংলাদেশ কম্পিউটার সমিতি

● প্রতিষ্ঠাকালীন সভাপতি, বাংলাদেশ বিজনেস অ্যাঞ্জেল নেটওয়ার্ক (বিবিএএন)


মো. সবুর খান
১৯৬৫
জন্ম, বাবুরহাট, চাঁদপুর

১৯৮৯
জাহাঙ্গীরনগর বিশ্ববিদ্যালয় থেকে স্নাতকোত্তর

১৯৯০
ড্যাফোডিল কম্পিউটারস লিমিটেড প্রতিষ্ঠা

১৯৯৫
দেশের প্রথম কম্পিউটার সুপারস্টোর ধারণার প্রবর্তন

১৯৯৬
ড্যাফোডিল ইনস্টিটিউট অব আইটি প্রতিষ্ঠা

১৯৯৭
প্রথম দেশে ব্র্যান্ড কম্পিউটার ড্যাফোডিলপিসি বাজারজাত

২০০২
প্রথম তথ্য প্রযুক্তি প্রতিষ্ঠান হিসেবে ঢাকা স্টক এক্সচেঞ্জ ও চিটাগং স্টক এক্সচেঞ্জে ‘পাবলিক লিস্টেড প্রতিষ্ঠান’ হিসেবে তালিকাভুক্ত হয় ড্যাফোডিল কম্পিউটারস লিমিটেড

২০১৮
ভারতের কলিঙ্গ ইনস্টিটিউট অব ইন্ডাস্ট্রিয়াল টেকনোলজি থেকে সম্মানসূচক ডি লিট ডিগ্রি অর্জন

৫ প্রতিষ্ঠান

● ড্যাফোডিল ইন্টারন্যাশনাল ইউনিভার্সিটি

● বাংলাদেশ স্কিল ডেভেলপমেন্ট ইনস্টিটিউট (বিএসডিআই)

● ড্যাফোডিল ইন্টারন্যাশনাল প্রফেশনাল ট্রেনিং ইনস্টিটিউট

● ড্যাফোডিল ইনস্টিটিউট অব আইটি (ডিআইআইটি)

● ড্যাফোডিল ইন্টারন্যাশনাল একাডেমি (ডিআইএ)

৩ বই

● হ্যান্ডবুক অব এন্ট্রাপ্রেনিউরশিপ ডেভেলপমেন্ট

● উদ্যোক্তা উন্নয়ন নির্দেশিকা

● আর্ট অব ইফেক্টিভ লিভিং এবং আ জার্নি টুওয়ার্ডস এন্ট্রাপ্রেনিউরশিপ

৫ পুরস্কার

● দ্য ডেইলি স্টার আইসিটি বিজনেস পারসন অব দ্য ইয়ার ২০১৮

● লাইট অব এশিয়া অ্যাওয়ার্ড

● ওয়ার্ল্ড কংগ্রেস অব আইটি (ডব্লিউসিআইটি) ২০১৭ মেরিট অ্যাওয়ার্ড

● এশিয়া’স মোস্ট ইনস্পায়ারিং ন্যাশন বিল্ডার পুরস্কার

● উইটসা অ্যাওয়ার্ড ফর বেস্ট আইসিটি এন্ট্রাপ্রেনিউর


Source: https://www.prothomalo.com/we-are/article/1576317/%E2%80%98%E0%A6%AA%E0%A7%8D%E0%A6%B0%E0%A6%A4%E0%A6%BF%E0%A6%9F%E0%A6%BE-%E0%A6%AC%E0%A7%8D%E0%A6%AF%E0%A6%B0%E0%A7%8D%E0%A6%A5%E0%A6%A4%E0%A6%BE%E0%A6%87-%E0%A6%8F%E0%A6%95%E0%A7%87%E0%A6%95%E0%A6%9F%E0%A6%BE-%E0%A6%B6%E0%A6%BF%E0%A6%95%E0%A7%8D%E0%A6%B7%E0%A6%BE%E2%80%99

10
আওয়ামী লীগের ২০০৮ সালের নির্বাচনী ইশতেহারে প্রদত্ত ডিজিটাল বাংলাদেশ গড়ার ঘোষণা তরুণ প্রজন্মের সমর্থন কাড়তেই শুধু সক্ষম হয়নি—সরকার গঠনের পর সে ঘোষণা বাস্তবায়নের মধ্য দিয়ে রাষ্ট্রগতভাবেও বাংলাদেশকে এক ধাপ এগিয়ে যেতে সাহায্য করেছে। একইভাবে ২০১৮ সালের নির্বাচনী ইশতেহারে আওয়ামী লীগ যে গ্রামে সব নাগরিক সুবিধা সৃষ্টির মাধ্যমে গ্রামগুলোকে বসবাসের জন্য শহরের মতোই আকর্ষণীয় করে তোলার ঘোষণা দিয়েছে, যথাযথভাবে বাস্তবায়ন করা গেলে সে ঘোষণাও বাংলাদেশের আর্থ-সামাজিক উন্নয়নে ডিজিটাল খাতের ভূমিকার মতোই অনন্য সাধারণ হয়ে উঠতে পারবে বলে আশা করা যায়। এবং সেটি ঘটলে বাংলাদেশের গ্রামীণ অর্থনৈতিক কাঠামোতে প্রথম যে পরিবর্তনটি ঘটবে তা হচ্ছে, গ্রাম আর শুধু কৃষিভিত্তিক কর্মকাণ্ডের মধ্যেই সীমাবদ্ধ থাকবে না, বরং কৃষিবহির্ভূত কর্মকাণ্ড সেখানে দিন দিন মুখ্য হয়ে উঠবে। আর সে রকম একটি সম্ভাবনাকে সামনে রেখে এই মুহূর্তে দেশের অর্থনৈতিক খাতের অন্যতম অগ্রাধিকার হওয়া উচিত উদ্যোক্তা উন্নয়ন কার্যক্রমকে আরো জোরদার করা এবং ক্রমান্বয়ে সেটিকে ব্যাপক হারে গ্রামমুখী করে তোলা।

উদ্যোক্তা উন্নয়ন কার্যক্রমকে জোরদার করার ক্ষেত্রে এত দিন পর্যন্ত মনে করা হতো যে এ ক্ষেত্রে প্রধান বাধা হচ্ছে শিক্ষিত বা স্বল্পশিক্ষিত তরুণের মানসিক গঠন, যে গঠনের আওতায় ওই তরুণরা পড়াশোনা শেষের গন্তব্য হিসেবে চাকরি ভিন্ন অন্য কিছুর কথা ভাবত না। কিন্তু সাম্প্রতিক সময়ে এ ক্ষেত্রে তরুণদের মানসিকতায় ব্যাপক পরিবর্তন এসেছে। অনেক শিক্ষিত মেধাবী তরুণ এখন চাকরির কথা না ভেবে উদ্যোক্তা হওয়ার কথা ভাবছে এবং অনেকেই সরাসরি উদ্যোক্তা হিসেবে পেশাগত জীবন শুরু করে দিয়েছে এবং সে ক্ষেত্রে তারা যথেষ্ট ভালোও করছে। আর কোনো কোনো ক্ষেত্রে তারা এতটাই ভালো করছে যে তাদের কেউ কেউ দেশের সীমানা ছাড়িয়ে বিদেশের মাটিতেও ছোট-বড় বিনিয়োগ করার সাহস দেখাচ্ছে বা নিদেনপক্ষে বিদেশিদের সঙ্গে কাজকারবার ও ব্যবসা-বাণিজ্য শুরু করে দিয়েছে।

শিক্ষিত তরুণের মানসিক গঠনের ক্ষেত্রে সাধিত উপরোক্ত রূপান্তর নিঃসন্দেহে উৎসাহব্যঞ্জক ঘটনা। কিন্তু এ ক্ষেত্রে সামাজিক চিন্তা ও দৃষ্টিভঙ্গিটি এখনো প্রায় আগের মতোই রয়ে গেছে। এখনো বেশির ভাগ কৃষিজীবী বা চাকরিজীবী অভিভাবক ভাবেন যে তাঁর সন্তান যদি ভালো চাকরিই করতে না পারল, তাহলে তাঁর সামাজিক মর্যাদা ও অবস্থানের উন্নয়ন ঘটল কোথায়? আর অভিভাবকদের দিক থেকে এরূপ দৃষ্টিভঙ্গি পোষণ ও সন্তানের ওপর তা প্রয়োগের ফলে লক্ষ করা যাচ্ছে যে (একেবারে প্রত্যক্ষ অভিজ্ঞতা থেকে বলা), অনেক তরুণ-তরুণীর মধ্যেই উদ্যোক্তা হওয়ার আকাঙ্ক্ষা থাকলেও উল্লিখিত বাধার কারণে শেষ পর্যন্ত তাদের পক্ষে আর উদ্যোক্তা হয়ে ওঠা হচ্ছে না। অবশ্য প্রকৃত সম্ভাবনাময় উদ্যোক্তাকে বাধা অতিক্রম করেই এগোতে হয়—এরূপ দৃঢ়সংকল্প যাদের মধ্যে আছে, তারা অবশ্য এ বাধাকে উপেক্ষা করে এগোচ্ছে এবং তারা সফলও হচ্ছে। তবে উল্লিখিত বাধার মুখে ফিরে যাওয়া তরুণের সংখ্যাও নেহাত কম নয়। শেষোক্ত এই তরুণদের যদি তাদের আকাঙ্ক্ষা অনুযায়ী উদ্যোক্তাবৃত্তির সঙ্গে যুক্ত করা যেত, তাহলে বাংলাদেশের অর্থনৈতিক প্রবৃদ্ধির চলমান হারের ক্ষেত্রে তা অনেকটাই বাড়তি গতি যুক্ত করতে পারত বলে মনে করি।

এখন প্রশ্ন হচ্ছে, উদ্যোক্তা উন্নয়নের ক্ষেত্রে অভিভাবক ও সমাজের রক্ষণশীল ও পশ্চাত্মুখী এই দৃষ্টিভঙ্গিকে পরিবর্তন করা যাবে কিভাবে? কাজটি রাষ্ট্রকেই করতে হবে। নারীকে যেমন—শিক্ষা, স্বাস্থ্য ও গেরস্তালি অর্থনৈতিক কর্মকাণ্ডে যুক্ত হওয়ার ব্যাপারে সহায়ক প্রণোদনা দিয়ে নিজেদের অধিকার রক্ষায় এরই মধ্যে অনেকটাই উদ্যোগী করে তোলা গেছে এবং আরো উদ্যমী করে তোলাসংক্রান্ত কার্যক্রম অব্যাহত আছে, শিক্ষিত তরুণদের উদ্যোক্তা হিসেবে গড়ে তোলার লক্ষ্যেও সে ধারার কার্যক্রমই প্রবর্তন করতে হবে।

উদ্যোক্তা উন্নয়ন কার্যক্রমের সঙ্গে সংশ্লিষ্ট রাষ্ট্রীয় প্রতিষ্ঠানগুলোর ভূমিকায় জনগণ এখনো পুরোপুরি সন্তুষ্ট নয়। এসব কার্যক্রমকে আরো দক্ষ এবং সর্বশেষ বৈশ্বিক চাহিদা ও দ্রুত পরিবর্তনশীল প্রযুক্তি স্তরের সঙ্গে সংগতিপূর্ণ করে তুলতে হবে।

কয়েক বছরের মধ্যে গ্যাস, বিদ্যুৎ, রাস্তাঘাট ও আনুষঙ্গিক খাতে পল্লী অবকাঠামো পরিস্থিতির যখন ব্যাপক উন্নতি ঘটবে বলে আশা করা যায় তখন সেখানে ব্যাপকভিত্তিক কৃষিবহির্ভূত নানা অর্থনৈতিক উদ্যোগ গ্রহণ ও বাস্তবায়নের সুযোগ সৃষ্টি হবে। নিকট ভবিষ্যতের সম্ভাব্য সে অবস্থার কথা চিন্তা করে সরকারের উচিত হবে এখন থেকেই স্থাপিতব্য সে সুযোগের পূর্ণাঙ্গ সদ্ব্যবহারের লক্ষ্যে এলাকাভিত্তিক সম্ভাব্য ক্ষেত্রগুলো চিহ্নিত করা এবং চিহ্নিত সেসব ক্ষেত্রে ক্ষুদ্র ও মাঝারি বিনিয়োগ নিশ্চিত করার লক্ষ্যে সে সময়ের জন্য যথেষ্টসংখ্যক উদ্যোক্তা গড়ে তোলা। এটি করতে না পারলে একসময় দেখা যাবে যে গ্রামীণ অর্থনীতি বিকাশের যথেষ্ট সুযোগ থাকা সত্ত্বেও কাঙ্ক্ষিত গতিতে তা বিকশিত হচ্ছে না।

শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানগুলোকে গতানুগতিক বিষয়ে পাঠদানের দেখাদেখি অভ্যস্ততা থেকে বেরিয়ে এসে উদ্যোক্তা উন্নয়ন বা তদসহায়ক বিষয়গুলোতে শিক্ষাদানের রীতি চালুর বিষয়ে নতুনভাবে চিন্তাভাবনা করতে হবে। এ ক্ষেত্রে স্পষ্টীকরণের জন্য উদাহরণ হিসেবে বলি—ধরুন, কোনো বিশ্ববিদ্যালয় আগে থেকেই বিজ্ঞান বা সামাজিক বিজ্ঞানের কতিপয় মৌলিক বিষয়ে পাঠদান করে আসছে। এখন উদ্যোক্তা উন্নয়নের সঙ্গে এ পাঠদান কার্যক্রমকে যুক্ত করার লক্ষ্যে প্রচলিত বিষয়টি বাদ দিয়ে নতুন কোনো বিষয় প্রবর্তন করতে হবে—প্রস্তাবটি মোটেও এমন নয়। বরং আগে থেকে চলে আসা বিষয়ের পাঠ্যসূচিতে নতুন উদ্ভাবিত জ্ঞান ও তথ্য যুক্ত করার পাশাপাশি সেসব অধীত জ্ঞানকে কিভাবে উদ্যোক্তাবৃত্তির সঙ্গে যুক্ত করা যাবে—নতুন করে চিন্তা করতে হবে সেটি। আর পুনরাবৃত্তি করে বলা এই যে নতুন সরকারের গ্রামে শহরের সুবিধা সৃষ্টি সংক্রান্ত কার্যক্রম বাস্তবায়নের আওতায় বাংলাদেশের তরুণ শিক্ষার্থীদের জন্য বস্তুতই স্বকর্মস্থানের অর্থাৎ উদ্যোক্তাবৃত্তির এক নতুন দিগন্ত উন্মোচিত হবে বলে আশা করা যায়। আর সে সুযোগকে কাজে লাগানোর জন্য শিক্ষিত তরুণসহ দেশের সব শ্রেণির সম্ভাবনাময় উদ্যোক্তারা এখন থেকেই প্রয়োজনীয় প্রস্তুতি গ্রহণ শুরু করবেন এবং সে সুযোগকে যাঁরা কাজে লাগাতে চান, তাঁদের সহায়তাদানের জন্য সরকারি ও বেসরকারি খাতের সংশ্লিষ্ট প্রতিষ্ঠানগুলো অধিকতর দক্ষ সেবা নিয়ে এগিয়ে আসবে বলেই আশা রাখি। বাংলাদেশের আগামী দিনের গ্রামগুলো শহরের সব নাগরিক সুবিধা নিয়ে তার নিজস্ব নিসর্গ ও অনিন্দ্যতা নিয়ে টিকে থাকুক, আবার পাশাপাশি সে গ্রাম হয়ে উঠুক নতুন প্রজন্মের শিক্ষিত তরুণ উদ্যোক্তার চারণক্ষেত্র—সেটিই প্রত্যাশা।

 
লেখক : পরিচালক
আবু তাহের খান
ক্যারিয়ার ডেভেলপমেন্ট সেন্টার
ড্যাফোডিল ইন্টারন্যাশনাল ইউনিভার্সিটি
atkhan56@gmail.com


Source: http://www.kalerkantho.com/print-edition/sub-editorial/2019/01/11/724703

11
বিশ্ববাণিজ্য ও অর্থনীতির ক্ষেত্রে সদ্যসমাপ্ত ২০১৮ সালে সংঘটিত ও বহুল আলোচিত বিভিন্ন ঘটনার মধ্যে অন্যতম ছিল যুক্তরাষ্ট্র-চীন বাণিজ্য বিরোধ। অথচ বছরের গোড়ার দিকে কিন্তু চীন-যুক্তরাষ্ট্র সম্পর্কের তেমন কোনো উত্তেজনাই লক্ষ করা যায়নি; বরং সাম্প্রতিক অন্যান্য বছরের তুলনায় গত বছরের গোড়ার দিকে এ সম্পর্ক ছিল অনেকটাই স্বস্তিদায়ক। মনে হচ্ছিল, পরিস্থিতি বোধহয় কিছুটা ভালোর দিকেই যাচ্ছে। কিন্তু হঠাৎ করেই আগস্টে (২০১৮) এসে মার্কিন প্রেসিডেন্ট ডোনাল্ড ট্রাম্প যুক্তরাষ্ট্রে রফতানিকৃত চীনা পণ্যের ওপর বর্ধিত শুল্ক আরোপের ঘোষণা দিয়ে বসেন। স্বভাবতই পাল্টা ঘোষণায় চীনও তার দেশে মার্কিন পণ্য প্রবেশের ওপর বাড়তি শুল্ক আরোপ করে। পরবর্তীতে আরো দুই দফায় উভয় দেশ এ শুল্কহার বৃদ্ধি করে এবং দুই পক্ষের এ পাল্টাপাল্টি ব্যবস্থা গ্রহণ ও রেষারেষির মধ্য দিয়ে ২০১৮ সাল সমাপ্ত হয়। এরই মধ্যে ডোনাল্ড ট্রাম্প চীনের প্রেসিডেন্ট শি জিনপিংয়ের সঙ্গে অনুষ্ঠিত তার টেলিফোন আলাপের উদ্ধৃতি দিয়ে গত ২৯ ডিসেম্বর এক টুইটবার্তায় জানান, তাদের দুজনের মধ্যে ‘ভালো ও দীর্ঘ আলাপ’ হয়েছে এবং তিনি এটিকে ‘বড় ধরনের অগ্রগতি’ বলে উল্লেখ করেন। বাণিজ্য বিরোধ কমিয়ে আনার লক্ষ্যে দুই পক্ষের মধ্যে চুক্তি স্বাক্ষরের বিষয়ে অগ্রগতি হয়েছে বলেও তিনি দাবি করেন।

প্রথমত, যেকোনো নতুন বছরের শুরুতে ভালো কথা বলার রেওয়াজ পৃথিবীর সব দেশেই কমবেশি রয়েছে। ইউরোপ-আমেরিকার মতো পশ্চিম মহাদেশীয় দেশগুলোয় এ প্রচলন আরো অধিক শক্তিশালী। ফলে নতুন বছরের প্রাক্কালে ক্রিসমাসে বা ক্রিসমাসের অব্যবহিত পরের দিনগুলোয় শুভেচ্ছামূলক ভালো কথা বলে জনগণের প্রীতি অর্জনের চেষ্টার অংশ হিসেবে ডোনাল্ড ট্রাম্প এমনটি বলতেই পারেন। আবার এমনও হতে পারে যে যুক্তরাষ্ট্রের ক্রমবর্ধমান বেকারত্ব ও চাপে থাকা অর্থনীতিকে কিছুটা হলেও গতিশীল করার চেষ্টায় চীনের সঙ্গে সমঝোতামূলক উদ্যোগের অংশ হিসেবে তিনি চীনের প্রেসিডেন্টকে ফোন করেছিলেন। তবে কারণ যা-ই হোক, বিশ্ব অর্থনীতির জন্য বিষয়টি খানিকটা হলেও স্বস্তিদায়ক। আর ফোর্বস ম্যাগাজিনে প্রকাশিত ও পরে বণিক বার্তায় পুনর্মুদ্রিত (১ জানুয়ারি ২০১৯) এক নিবন্ধে নিউইয়র্কের লং আইল্যান্ড ইউনিভার্সিটির অধ্যাপক প্যানোস মুরদোকুতাস অভিমত ব্যক্ত করেন, ২০১৯ সালে যুক্তরাষ্ট্র-চীন বাণিজ্য বিরোধ আর না-ও বাড়তে পারে। তবে বিষয়টিকে এতটা সরলভাবে দেখার সুযোগ আছে বলে মনে হয় না। আর কেন এ আশঙ্কা, তা নিয়েই নিবন্ধে খানিকটা আলোকপাত করা হলো।

যুক্তরাষ্ট্র-চীন বাণিজ্য বিরোধের ঘটনাটি চরিত্রগতভাবে নিঃসন্দেহে অর্থনৈতিক ইস্যু। কিন্তু এর উৎসমূলে যতটা না রয়েছে অর্থনৈতিক ও বাণিজ্যিক কারণ, তার চেয়ে অনেক বেশি রয়েছে সামরিক আধিপত্য প্রতিষ্ঠার কৌশলগত ভূমিকা। চীনের সীমান্তসংলগ্ন দেশ উত্তর কোরিয়ার সঙ্গে মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রের দীর্ঘকালীন যে বিরোধ, যা একবার যুদ্ধেও রূপান্তর হয়েছিল এবং যে ধারায় কোরীয় উপদ্বীপ অঞ্চল এখনো মাঝে মাঝেই উত্তেজনায় উত্তপ্ত হয়ে ওঠে, সাম্প্রতিক সময়ে সেটিই আসলে মার্কিন-চীন বাণিজ্য বিরোধের মূল অনুঘটক। অবশ্য বৈশ্বিক কূটনীতির অন্যান্য হিসাবনিকাশও রয়েছে! উত্তর কোরিয়াকে পারমাণবিক অস্ত্রমুক্তকরণে বাধ্য করার লক্ষ্যে দেশটির ওপর যুক্তরাষ্ট্র ও তার মিত্রদের দ্বারা আরোপিত অর্থনৈতিক নিষেধাজ্ঞায় চীন যাতে তাদের পক্ষে থাকে বা নিদেনপক্ষে বিপক্ষে যেতে না পারে, সেটাই এ মুহূর্তে চীনকে ঘিরে মার্কিন কূটনীতির অন্যতম অগ্রাধিকার বলে মনে হচ্ছে।

আর এ রকম অবস্থাকে সামনে রেখেই মার্কিন প্রেসিডেন্ট ডোনাল্ড ট্রাম্প উত্তর কোরিয়ার প্রেসিডেন্ট কিম জং উনকে গত জুনে (২০১৮) সিঙ্গাপুরে তার সঙ্গে বৈঠকে বসতে বাধ্য করেছিলেন। আর সে বৈঠক আয়োজনের নেপথ্যে চীনেরও পরোক্ষ সহযোগিতা ছিল অনেকখানি। ওই বৈঠকে সিদ্ধান্ত হয়েছিল, উত্তর কোরিয়া কর্তৃক সমুদয় পারমাণবিক অস্ত্র ও সরঞ্জাম ধ্বংস করার বিনিময়ে দেশটিতে বিরাজমান মানবিক বিপর্যয় রোধকল্পে যুক্তরাষ্ট্র ও অন্যরা উত্তর কোরিয়ার ওপর থেকে ক্রমান্বয়ে সমুদয় বাণিজ্যিক নিষেধাজ্ঞা এবং কোরীয় উপদ্বীপ থেকে সমুদয় মার্কিন সামরিক স্থাপনা ও বাহিনী প্রত্যাহার করে নেবে। কিন্তু বাস্তব ঘটনা হচ্ছে, পারমাণবিক অস্ত্র না থাকা সত্ত্বেও তা ধ্বংসের নাম করে যেমন বুশ কর্তৃক ইরাক আক্রমণ করা হয়েছিল, তেমনি এখন আর গুরুতর তেমন কোনো পারমাণবিক অস্ত্র ও সরঞ্জাম উভয় কোরিয়ার কাছে না থাকা সত্ত্বেও মার্কিন যুক্তরাষ্ট্র ও তার মিত্ররা উভয় কোরিয়ার ওপর অর্থনৈতিক নিষেধাজ্ঞাসহ নানা পীড়ন, নিগ্রহ চালিয়ে যাচ্ছে। এবং সে নিষেধাজ্ঞা ও নিপীড়নের পরিপ্রেক্ষিতে উত্তর কোরিয়ায় সাম্প্রতিক সময়ে খাদ্য, ওষুধ ও অন্যান্য নিত্যপ্রয়োজনীয় দ্রব্যের অভাবে যে মানবিক বিপর্যয় দেখা দিয়েছে, তারই পরিপ্রেক্ষিতে দেশটির প্রেসিডেন্ট তার অসহায় সম্মতিতে গত জুনে ট্রাম্পের সঙ্গে বৈঠকে বসতে বাধ্য হয়েছিলেন এবং বৈঠকের সিদ্ধান্তগুলোও বস্তুত হোয়াইট হাউজ থেকে প্রণয়ন করা হয়েছিল বলেই ব্যাপকভাবে মনে করা হয়। কিন্তু তার পরও ওই চুক্তি অনুযায়ী অর্থনৈতিক নিষেধাজ্ঞার আংশিক প্রত্যাহার এবং ক্রমান্বয়ে কোরিয়া সন্নিহিত সমুদ্রাঞ্চল থেকে মার্কিন সামরিক স্থাপনা ও সৈন্য সরিয়ে নেয়ার কথা থাকলেও ট্রাম্প প্রশাসন তার ধার-কাছ দিয়েও হাঁটেনি। আর এ অবস্থায় চীন যাতে কোনোরূপ প্রতিবাদ করতে উদ্যোগী না হয়, সেজন্যই কি মার্কিন প্রশাসন চীনকে চাপে রাখার জন্য আগস্টে হুট করেই চীনা পণ্যের ওপর বাড়তি শুল্ক আরোপ করে বসে?

আন্তর্জাতিক গণমাধ্যম সূত্রে আভাস পাওয়া যাচ্ছে, সিঙ্গাপুর চুক্তির ব্যাপারে যুক্তরাষ্ট্রের সামগ্রিক নির্লিপ্ততার পরিপ্রেক্ষিতে উত্তর কোরিয়াও এখন অনেকটা হতাশ হয়ে ওই চুক্তি থেকে সরে আসার কথা ভাবছে (অবশ্য দীর্ঘমেয়াদি অর্থনৈতিক ও কূটনৈতিক নিষেধাজ্ঞা মোকাবেলা করে এবং যুক্তরাষ্ট্র ও তার মিত্রদের ক্রমাগত বৈরিতার পরিপ্রেক্ষিতে নিঃস্ব হতে হতে এখন আর উত্তর কোরিয়ার চুক্তি থেকে সরে আসা বা না-আসার মধ্যে তেমন কোনো পার্থক্য নেই।) এ অবস্থায় চীন যাতে উত্তর কোরিয়ার প্রতি আবার সহানুভূতিশীল না হয়ে পড়ে, বোধকরি সে কথা ভেবেই চীনের সঙ্গে বাণিজ্য বিরোধ নিয়ে যুক্তরাষ্ট্র এখন আবার কিছুটা নমনীয় হতে শুরু করেছে। বার্তা সংস্থার খবর অনুযায়ী, ট্রাম্প যেদিন (২৯ ডিসেম্বর ২০১৮) তার টুইটবার্তায় শি জিনপিংয়ের সঙ্গে ‘ভালো’ আলোচনা হয়েছে বলে জানালেন, মার্কিন প্রশাসন বস্তুত সেদিনই এক হাজারের বেশি চীনা পণ্যের ওপর থেকে শুল্ক প্রত্যাহারের ঘোষণা দেয়। আর সে ঘোষণাকে ভিত্তি ধরেই প্যানোস মুবদোকুতাস হয়তো আশাবাদ ব্যক্ত করেছেন, ২০১৯ সালে মার্কিন-চীন বাণিজ্য বিরোধ আর তীব্র আকার ধারণ করবে না। কিন্তু আসলেই কি তা-ই? গত সোয়া শতাব্দীর বিশ্বকূটনীতির ইতিহাস ও গতিপ্রকৃতি পর্যালোচনা করে কোথাও কি পাওয়া যাবে যে কোনোরূপ যুক্তি ও নৈতিকতা মেনে মার্কিন যুক্তরাষ্ট্র তার বিশ্বসম্পর্ক নির্ধারণ করেছে? ফলে ২০১৮ সালের শেষে যুক্তরাষ্ট্র আংশিক চীনা পণ্যের ওপর থেকে শুল্ক প্রত্যাহারের যে ঘোষণা দিল, ২০১৯ সালের শেষ নাগাদ তা ঘোষণার অনুরূপ আঙ্গিকে টিকে থাকবে, এমন নিশ্চয়তা কেউই দিতে পারবেন না।

আগামী বছরই (২০২০ সালে) মার্কিন প্রেসিডেন্ট নির্বাচন। প্রেসিডেন্ট নির্বাচন সামনে রেখে যুক্তরাষ্ট্রে বরাবর যা ঘটে তা হচ্ছে, প্রতিদ্বন্দ্বী প্রার্থীদের প্রত্যেকেই ভোটারদের আবেগ ও অহংকে উসকে দেয়ার লক্ষ্যে উগ্র রাষ্ট্রাভিমানকে (অর্থাৎ যুক্তরাষ্ট্রই শ্রেষ্ঠ) উপরে তুলে ধরার চেষ্টা করবেন। আর তা করার জন্য নির্বাচিত হলে বিরোধী পক্ষ উল্লিখিত রাষ্ট্রাভিমানের পক্ষে কী কী করবে, সে বিষয়ে যেমন অঙ্গীকার করবে, তেমনি ক্ষমতাসীন প্রেসিডেন্টকেও (প্রার্থী তিনি নিজে হন বা দলের অন্য কেউ হোক) প্রমাণ করতে হবে যে অন্য দেশ ও রাষ্ট্রের সঙ্গে তার আচরণ যথেষ্টই যুদ্ধংদেহী ও ঔদ্ধত্যপূর্ণ। আর তা করতে গিয়ে ২০১৯ সাল শেষ হওয়ার আগেই ডোনাল্ড ট্রাম্প যদি চীনের সঙ্গে আরো বড় বাণিজ্যযুদ্ধ বাধিয়ে বসেন, তাতে মোটেও অবাক হওয়ার কিছু থাকবে না। ফলে ট্রাম্পের সাম্প্রতিক ঘোষণায় এটি ভেবে স্বস্তি বোধ করার কোনোই কারণ নেই যে মার্কিন-চীন বাণিজ্য বিরোধ স্তিমিত হয়ে আসছে। ফোর্বস প্রতিবেদনের সঙ্গে এ সহমত অবশ্যই থাকল যে মার্কিন-চীন বাণিজ্য বিরোধের চেয়েও অন্য আরো অনেক সমস্যাই ২০১৯ সালের বিশ্ব অর্থনীতিকে ঝুঁকির মধ্যে ফেলতে পারে। আর সে ব্যাপারে সব দেশেরই বিশেষত অনুন্নত ও উন্নয়নশীল দেশগুলোকে এখন থেকেই যথেষ্ট সতর্ক হওয়া প্রয়োজন। বাংলাদেশকেও সতর্ক থাকতে হবে বৈকি!

তবে প্রাযুক্তিক ও অর্থনৈতিক ক্ষেত্রে দ্রুত বিকাশমান চীনের প্রতি আহ্বান থাকবে, ক্রমাগত স্বেচ্ছাচারিতা ও ঔদ্ধত্যপূর্ণ আচরণের কারণে যুক্তরাষ্ট্রের প্রতি বিশ্বব্যাপী সাধারণ মানুষের মধ্যে যে ক্ষোভ বিরাজমান এবং তার বিপরীতে চীনকে বিশ্ব অর্থনীতির নিকট ভবিষ্যতের অন্যতম বিকল্প হিসেবে দেখার যে প্রচ্ছন্ন আকাঙ্ক্ষা দিন দিন জোরদার হচ্ছে, তারা যেন তা উপলব্ধি করতে পারে। আর তা করতে পারলে সেটি চীনের অবস্থানকেই শুধু শক্তিশালী ও মর্যাদাবান করে তুলবে না, বিশ্ব অর্থনীতি ও কূটনীতির একটি ভারসাম্যপূর্ণ যৌক্তিক বিকল্পও তৈরি হবে। এখানে নতুন কোনো পরাশক্তি গড়ে তোলার প্রতি ইঙ্গিত করা হচ্ছে না; বরং এ উপলব্ধিকেই উপরে তুলে ধরার চেষ্টা করা হচ্ছে, বিশ্বসম্পদের মালিকানার ক্ষেত্রে বর্তমানে যে চরম বৈষম্যপূর্ণ অবস্থা ও একচ্ছত্র মেরুকরণ চলছে, তা থেকে মানবজাতিকে মুক্ত করার জন্য হলেও বিশ্বব্যাপী চীনা বাণিজ্য ও অর্থনীতির উল্লেখযোগ্য বিকাশ ও সম্প্রসারণ প্রয়োজন এবং তা প্রয়োজন বাংলাদেশের মতো দ্রুত বিকাশমান অর্থনীতির দেশগুলোর নতুন মিত্রবলয় গড়ে তোলার প্রয়োজনেও।


লেখক : পরিচালক
আবু তাহের খান
ক্যারিয়ার ডেভেলপমেন্ট সেন্টার
ড্যাফোডিল ইন্টারন্যাশনাল ইউনিভার্সিটি
atkhan56@gmail.com



 Source: http://epaper.bonikbarta.net/1970637/Bonik-Barta/Bonik-Barta#clip/35570706/2ca6dbd5-0db7-4b1d-8362-58cadd622215/1573.3333333333333:826.5585774058577

12
পর পর তিনবার নির্বাচনে জিতে রাষ্ট্র পরিচালনার দায়িত্ব পেলে ক্ষমতাসীন দলের মন্ত্রী, সংসদ সদস্য ও নেতাকর্মীদের মধ্যে অতি আস্থা ও  অহমিকা দ্বারা তাড়িত হয়ে স্বেচ্ছাচারী হয়ে ওঠার যে ঝুঁকি থাকে, আওয়ামী লীগ বস্তুত সে ঝুঁকি মাথায় নিয়েই নতুন করে যাত্রা শুরু করতে যাচ্ছে। তবে এ ঝুঁকির বিপরীতে তাদের সামনে নতুন ইতিহাস সৃষ্টির মধ্য দিয়ে দেশ ও জনগণের জন্য অভূতপূর্ব কিছু করার অসামান্য সুযোগও রয়েছে। তারা যদি আবেগপ্রবণ ও উন্নাসিক না হয়ে ধীরস্থিরভাবে সে সুযোগগুলোকে পরিপক্বতা ও দায়িত্বশীলতার সঙ্গে ব্যবহার করতে পারে, তাহলে তাদের পক্ষে বাংলাদেশকে শুধু দক্ষিণ এশিয়ার নয়—পুরো এশিয়ারই অন্যতম মর্যাদাবান রাষ্ট্রে উন্নীত করা সম্ভব। আর তা করার ক্ষেত্রে তাদের সবচেয়ে বড় সুবিধা এই যে বিগত দুই মেয়াদে ক্ষমতায় থাকার সুবাদে অধিকাংশ হোমওয়ার্ক তাদের করাই আছে, যা একটি সম্পূর্ণ নতুন সরকার হলে সম্পূর্ণ নতুনভাবে করতে হতো। এখন তাই তাদের দরকার শুধু আর এক মুহূর্তও বিলম্ব না করে প্রতিজ্ঞা ও প্রত্যয় নিয়ে কাজে নেমে পড়া। আর সে কাজের ক্ষেত্রে সহায়ক হলে হতেও পারে, এমন কিছু চিন্তাভাবনা এখানে তুলে ধরা হলো।

প্রথমেই শীর্ষ নেতৃত্বের পক্ষ থেকে এমন একটি বার্তা সরকারি দল, মন্ত্রিপরিষদ, সংসদ সদস্য, নির্বাহী বিভাগ ও জনগণের মধ্যে পৌঁছে দিতে পারলে ভালো হয় যে আগে যখন যা-ই কিছু ঘটে থাকুক না কেন, এখন থেকে রাষ্ট্রের সব পর্যায়ে যার যার অবস্থান নির্ধারিত হবে সংশ্লিষ্ট ব্যক্তির নিজস্ব দক্ষতা ও যোগ্যতা অনুযায়ী। মন্ত্রিপরিষদকে দক্ষ করে তোলার জন্য অবিলম্বে প্রশিক্ষণের ব্যবস্থা করতে হবে। মন্ত্রীদের প্রতি পূর্ণ সম্মান রেখে বলি, যাঁরা নতুন মন্ত্রী হবেন তাঁরা তো বটেই, এমনকি যাঁরা এর আগে মন্ত্রী ছিলেন তাঁরাও অনেকে দক্ষতার সঙ্গে মন্ত্রণালয় পরিচালনাসংক্রান্ত সমুদয় খুঁটিনাটি আইন-কানুন, বিধিবিধান, প্রক্রিয়া-পদ্ধতি ইত্যাদি সম্পর্কে বিস্তারিত অবহিত নন। এ ক্ষেত্রে তাই একটি পূর্ণাঙ্গ প্রশিক্ষণসূচি তৈরি করে জাতীয় সংসদ সচিবালয়ের তত্ত্বাবধানে অবিলম্বে এ প্রশিক্ষণ আয়োজনের ব্যবস্থা করা যেতে পারে। পরবর্তীকালে মন্ত্রিপরিষদবহির্ভূত অন্য সংসদ সদস্যদের জন্যও প্রযোজ্য বিষয়সূচি তৈরি করে অনুরূপ প্রশিক্ষণের ব্যবস্থা করা যেতে পারে।

অন্যদিকে নির্বাহী বিভাগের বিদ্যমান দক্ষতা উন্নয়ন ব্যবস্থা পর্যালোচনা করে এটিকে আরো আধুনিক ও বৈশ্বিক মানসম্পন্ন করে তুলতে হবে। বিশেষত দ্রুত পরিবর্তমান তথ্য ও যোগাযোগ প্রযুক্তি ব্যবস্থার আওতায় দক্ষতার সঙ্গে কাজ করার ব্যাপারে তাঁদের সামর্থ্যবান করে তুলতে হবে। আর দক্ষতা উন্নয়নসংক্রান্ত আলোচনা ও অনুচ্ছেদের আওতায় অন্য একটি প্রস্তাব এই যে দলকে সরকার থেকে আরো সুনির্দিষ্টভাবে আলাদা করতে হবে এবং মন্ত্রী, সংসদ বা নির্বাহী বিভাগের সদস্যদের মতোই দলীয় কর্মীদের জন্যও প্রশিক্ষণের ব্যবস্থা করতে হবে।

ব্যাঙের ছাতার মতো গড়ে ওঠা মানহীন নামসর্বস্ব বেসরকারি বিশ্ববিদ্যালয় (মানসম্পন্ন ১০-১২টি বাদে) থেকে প্রায় শিক্ষা লাভ ছাড়াই সনদ নিয়ে বেরোনো স্নাতকের সংখ্যা কমাতে না পারলে দেশ ও সরকার উভয়ের জন্যই তা এক বিব্রতকর পরিস্থিতি তৈরি করতে বাধ্য। এরই মধ্যে প্রচলিত অভিমত দাঁড়িয়ে গেছে যে হাজার হাজার শিক্ষিত তরুণ বেকারত্ব মাথায় নিয়ে ঘুরে বেড়াচ্ছে, সরকার তাদের জন্য কোনো কর্মসংস্থানের ব্যবস্থা করতে পারছে না। অথচ প্রকৃত ঘটনা হচ্ছে এই যে দেশে যত কর্মের সুযোগই তৈরি হোক না কেন, সেসব পদের চাহিদা পূরণের মতো দক্ষতা ও যোগ্যতা তথাকথিত এ শিক্ষিত তরুণদের নেই। আর সে কারণেই বহু বেসরকারি প্রতিষ্ঠানকে উচ্চ বেতন দিয়ে বিদেশি কর্মী নিয়োগ করতে হচ্ছে। অতএব শিক্ষার সঠিক মান রক্ষার স্বার্থে তো বটেই, অহেতুক বদনামের হাত থেকে বাঁচার জন্য হলেও সরকারের উচিত হবে বেসরকারি বিশ্ববিদ্যালয়ের মানহীন ব্যবস্থাকে নিয়ন্ত্রণ করা। আর নতুন সরকারের উচিত হবে কাজটি গোড়াতেই সেরে ফেলা।

মাননীয় প্রধানমন্ত্রী এরই মধ্যে নির্বাচনী ইশতেহার ঘোষণাকালে জানিয়েছেন, তাঁর সরকার নতুন মেয়াদে ক্ষমতায় এলে দুর্নীতির ব্যাপারে ‘শূন্য সহনীয়তা’ নীতি গ্রহণ করবে। এ ব্যাপারে উল্লেখ করাটা প্রাসঙ্গিক হবে যে বাংলাদেশ এ পর্যন্ত একটি অপরাধের ক্ষেত্রেই শুধু ‘শূন্য সহনীয়তা’ নীতি বাস্তবায়ন করে দেখাতে পেরেছে এবং সেটি হচ্ছে, বর্তমান সরকারের অধীনে জঙ্গিবাদের বিরুদ্ধে ব্যবস্থা গ্রহণ। আমরা আশা করব, এ ক্ষেত্রে দ্বিতীয় সার্থকতাটি আসবে নতুন সরকারের আওতায় দুর্নীতির ব্যাপারে ‘শূন্য সহনীয়তা’ নীতি গ্রহণের মধ্য দিয়ে। আশা করি আইন ও নির্বাহী বিভাগ উভয় ক্ষেত্রের সমুদয় দুর্নীতিই এ নীতির আওতায় স্থান পাবে। আর তা পেলে বেসরকারি খাতের দুর্নীতিও বহুলাংশে হ্রাস পাবে বলে আশা করা যায়।

অনুসন্ধানকৃত তেল-গ্যাসের পাশাপাশি বাংলাদেশের অর্থনীতির নিকট-ভবিষ্যতের একটি অত্যন্ত সম্ভাবনাময় ক্ষেত্র হচ্ছে বঙ্গোপসাগরসহ দেশের অন্যত্র তেল-গ্যাসের নতুন সম্ভাব্য ক্ষেত্রগুলো খুঁজে দেখা। এ কাজটি যথেষ্ট দক্ষতা ও উদ্যমের সঙ্গে পরিচালিত হচ্ছে কি না তা পর্যালোচনা করে দেখা প্রয়োজন বলে মনে করি। দ্বিতীয়ত, অতীতে এ ক্ষেত্রে উৎপাদন বণ্টন চুক্তি (প্রডাকশন শেয়ারিং কন্ট্রাক্ট-পিএসসি) নিয়ে সংঘটিত নানা দুর্নীতি ও অনিয়মের কথা সংশ্লিষ্টরা তো বটেই, দেশের সাধারণ মানুষেরও অনেকটা জানা হয়ে গেছে। ফলে ভবিষ্যতে যাতে আর এমনটি না ঘটে, সে ব্যাপারে সতর্ক থাকার জন্য নতুন সরকারের প্রতি এখনই আহ্বান রাখছি।

রোহিঙ্গাদের আশ্রয় দিয়ে মাননীয় প্রধানমন্ত্রী এরই মধ্যে আন্তর্জাতিক পরিসর থেকে ‘মানবতার মা’ নামে খ্যাত হয়েছেন, যা নিঃসন্দেহে দেশ ও জাতির জন্য গৌরবের। কিন্তু পাশাপাশি এটাও সত্য যে এ নিয়ে আন্তর্জাতিক কূটনৈতিক তৎপরতা পরিচালনার ক্ষেত্রে পররাষ্ট্র মন্ত্রণালয়ের আরো বেশি দক্ষতার পরিচয় দেওয়া উচিত ছিল বলে সরকার সমর্থক কূটনীতিকদের মধ্যেই অভিমত রয়েছে। ফলে এ অসম্পূর্ণতার জায়গাটি কিভাবে সমন্বয় ও সংশোধন করা হবে, সে বিষয়টির প্রতি নতুন সরকারের দৃষ্টি আকর্ষণ করছি।

ডাকসু একটিমাত্র বিশ্ববিদ্যালয়ের বিষয় হলেও ইতিহাসের পথপরিক্রমায় ডাকসু আজ বাঙালি তরুণের আদর্শ ও চেতনার এক মহত্তম তীর্থক্ষেত্র। ফলে যত তাড়াতাড়ি সম্ভব ডাকসু আয়োজনের ব্যবস্থা করতে পারলে সেটি নতুন সরকারের জন্য একটি চমৎকার নতুন যাত্রা হবে বলে মনে করি। ডাকসু নির্বাচন সুষ্ঠুভাবে আয়োজনের পর ক্রমান্বয়ে অন্য শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানগুলোয়ও অনুরূপ নির্বাচন আয়োজনের সুযোগ করে দেওয়া যেতে পারে।

ঢাকা শহরে নতুন বিদ্যুৎ লাইন স্থাপন, নিয়নবাতি জ্বালিয়ে সৌন্দর্যবৃদ্ধিকরণ ও নিরাপত্তার কথা বলে জেনারেল জিয়াউর রহমান অকাতরে রাজধানীর কয়েক হাজার বৃক্ষনিধনের উৎসব করেছিলেন। বর্তমানে নির্বাচনী ইশতেহারের উল্লিখিত ঘোষণাকে কাজে লাগিয়ে অন্য সুবিধাবাদী কেউও এটি করে বসতে পারে। অতএব সে ব্যাপারে সতর্ক থাকতে হবে।

পরিশেষে একাদশ জাতীয় সংসদ নির্বাচনে মুক্তিযুদ্ধের পক্ষশক্তির বিজয়কে স্বাগত জানিয়ে অত্যন্ত বিনীতভাবে এই মর্মে একটি প্রস্তাব করতে চাই যে নতুন সংসদের সদস্যদের চিন্তায় নিজেদের স্থানীয় সরকারের প্রতিনিধি ভাবার চেয়ে আইনপ্রণেতা ভাবার বোধটি যেন অধিকতর গুরুত্ব পায়, যা একদিকে তাঁদের সম্মানকে যেমন বৃদ্ধি করবে, অন্যদিকে তেমনি দেশের স্থানীয় সরকারব্যবস্থাটিও আরো শক্তিশালী ও স্বনির্ভর হয়ে ওঠার সুযোগ পাবে। দুর্নীতির ব্যাপারে শূন্য সহনীয়তার মতোই এটিও হয়ে উঠুক নতুন সরকারের একটি যুগান্তকারী দৃষ্টিভঙ্গি।

লেখক : পরিচালক
আবু তাহের খান
ক্যারিয়ার ডেভেলপমেন্ট সেন্টার
ড্যাফোডিল ইন্টারন্যাশনাল ইউনিভার্সিটি
atkhan56@gmail.com

Source: https://www.ekalerkantho.com/home/page/2019-01-02/14

13
২০১৯ সালের ১ জানুয়ারি, কিউবা বিপ্লবের ৬০ বছর পূর্ণ হলো। বাংলাদেশের স্বাধীনতা লাভের এক যুগ আগে সাধিত এ বিপ্লবের (২৬ জুলাই-১ জানুয়ারি ১৯৫৯) সাফল্য শুধু কিউবার জনগণকেই নতুন জীবনের আস্বাদন জোগায়নি, বিশ্বের অন্যান্য বহু দেশের সাধারণ মানুষের জীবনের দাবি ও অধিকার প্রতিষ্ঠার সংগ্রামকেও এগিয়ে নিয়ে যেতে অনেকখানি সহায়তা করেছে। আর বাংলাদেশের অর্থনীতি, সমাজ, রাজনীতিতে এ বিপ্লবের প্রভাব ও প্রাসঙ্গিকতা এতটাই নিবিড় যে, এক্ষেত্রে বিষয়টি স্বতন্ত্র গবেষণার দাবি রাখে। তাই সীমিত পরিসরের এ আলোচনায় এখানে শুধু বিপ্লবের মূল চেতনা, বৈশিষ্ট্য ও অভিজ্ঞতাগুলোকে স্মরণ করার চেষ্টা করা হলো, যেগুলোকে কেন্দ্র করে সামনের দিনগুলোয় আরো নানামাত্রিক আলোচনা বহুদূর পর্যন্ত এগিয়ে যেতে পারে।

যোজন দূরত্বের ভৌগোলিক অবস্থান ও সমাজকাঠামোর মধ্যকার নানা বৈসাদৃশ্য থাকা সত্ত্বেও বাংলাদেশের স্বাধীনতা সংগ্রাম ও কিউবা বিপ্লবের পটভূমির মধ্যে ব্যাপক মিল ও সাদৃশ্য রয়েছে। বাংলাদেশের স্বাধীনতা সংগ্রামের পটভূমিক কারণগুলোর অন্যতম ছিল শোষণ, বৈষম্য ও সে ধারায় সম্পদের চরম মেরুকরণ। কিউবা বিপ্লবের পটভূমিতেও ছিল তাই। বাংলাদেশের ক্ষেত্রে ছিল পাকিস্তানি শাসকগোষ্ঠীর শোষণ ও নিপীড়ন, পশ্চিম পাকিস্তানি উঠতি পুঁজিপতিদের দ্বারা সম্পদের একচ্ছত্র কুক্ষিগতকরণ (বহুল আলোচিত ২২ পরিবারের নাম বিশেষভাবে উল্লেখযোগ্য) এবং পাকিস্তানি সামরিক শাসকদের ছত্রচ্ছায়ায় মার্কিন সাম্রাজ্যবাদী শক্তির আগ্রাসন। অন্যদিকে কিউবার ক্ষেত্রে ছিল মার্কিন সমর্থনপুষ্ট স্বৈরাচারী বাতিস্তুতার একনায়কতন্ত্র, আখ উৎপাদনসহ (কিউবার অন্যতম অর্থকরী ফসল হচ্ছে আখ ও তদজাত চিনি) কিউবান অর্থনীতির ওপর মার্কিন কোম্পানিগুলোর একচেটিয়া নিয়ন্ত্রণ (কিউবার ৭৫ শতাংশ কৃষিজমির মালিকানা ছিল মার্কিনিদের হাতে) এবং মার্কিন অঙ্গুলি হেলনে রাষ্ট্রনীতি পরিচালনা। এর বাইরে কিউবার ক্ষেত্রে একটি অতিরিক্ত উপসর্গ ছিল অর্থনীতির ওপর মাফিয়া চক্রের প্রবল নিয়ন্ত্রণ এবং মার্কিন কোম্পানিগুলোর পাশাপাশি দেশের সম্পদের ওপর তাদেরও বড় ধরনের ভাগীদারিত্ব।

উপরোল্লিখিত প্রেক্ষাপটকে পেছনে রেখে ১৯৫৯ সালের ১ জানুয়ারিতে যাত্রা শুরু করা কিউবাকেও একেবারে প্রথম দিন থেকেই প্রচণ্ড অভ্যন্তরীণ ও আন্তর্জাতিক বৈরিতা মোকাবেলা করে যাত্রা শুরু করতে হয়, যেমনটি শুরু করতে হয়েছিল বাংলাদেশকেও। বাংলাদেশের অভ্যন্তরীণ বৈরিতা ছিল পাকিস্তানি শাসকগোষ্ঠীর এ দেশীয় সমর্থক পরাজিত শক্তির দিক থেকে, যেটি কিউবার ক্ষেত্রে ছিল মাফিয়াচক্র ও সে দেশের ধনিক শ্রেণী। অন্যদিকে বাংলাদেশের ক্ষেত্রে আন্তর্জাতিক বৈরিতা ছিল পাকিস্তান, সৌদি আরবসহ রাজপরিবারশাসিত মধ্যপ্রাচ্যের কতিপয় দেশ ও মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রের দিক থেকে। এবং এ বৈরিতার পথ ধরেই ১৯৭২-৭৩ সালে বাংলাদেশকে যুক্তরাষ্ট্রের খাদ্য সহায়তা বন্ধ করে দেয়া এবং সিআইএর প্রত্যক্ষ মদদে ১৯৭৫ সালে বঙ্গবন্ধুকে হত্যা। আর কিউবার ক্ষেত্রেও প্রায় একই ঘটনা ঘটেছিল। তবে এর মাত্রা ও ফলাফল ছিল ভিন্নতর। অর্থনৈতিক বৈরিতার ক্ষেত্রে কিউবার অবস্থা ছিল বাংলাদেশের চেয়েও ভয়াবহ। বাংলাদেশকে মার্কিন যুক্তরাষ্ট্র শুধু খাদ্য সহায়তা বন্ধ রেখেছিল। কিন্তু ১৯৬০ সালে কিউবার ওপর তারা আরোপ করেছিল স্থায়ী অর্থনৈতিক নিষেধাজ্ঞা, যা এখনো পুরোপুরি উঠে যায়নি। তাছাড়া একই সময়ে তারা যুক্তরাষ্ট্রে অবস্থিত সব কিউবান সম্পদ বাজেয়াপ্ত করে, কিউবার সঙ্গে ফেরি চলাচল বন্ধ করে দেয় এবং কূটনৈতিক সম্পর্ক ছিন্ন করে। আর এর দেখাদেখি বেশ কয়েকটি মার্কিন মিত্র দেশও প্রায় একই পথ অনুসরণ করে চলে। এতসব বৈরিতা উপেক্ষা করেও কিউবা পরম ধৈর্য, সাহস ও বিচক্ষণতার সঙ্গে এগিয়ে যায়, যার ফলে সেখানে এখন সাক্ষরতার হার শতভাগ, জনগণের আয়ুষ্কাল ৮০ বছর ও শিশুমৃত্যুর হার হাজারে ৪ দশমিক ৭৬ জন। আর এ সবক’টি ক্ষেত্রেই কিউবা যুক্তরাষ্ট্রের চেয়ে এগিয়ে আছে। বাংলাদেশ এক্ষেত্রে কিউবার মতো অতটা সাহস দেখাতে না পারলেও এসব ক্ষেত্রে দক্ষিণ এশিয়ায় শ্রীলংকার পরেই দেশটির অবস্থান, যেখানে পাকিস্তানের অবস্থান আরো অনেক পরে।

অন্যদিকে মার্কিন রোষানল থেকে নিজেদের রাষ্ট্রনায়ককে বাঁচিয়ে রাখার ক্ষেত্রেও কিউবানরা অনেক বেশি সাহসের পরিচয় দিয়েছে। বঙ্গবন্ধুর পাশাপাশি কিউবান নেতা ফিদেল কাস্ত্রোকেও সিআইএ বারবার হত্যা করতে চেয়েছে। কিন্তু তারা তা পারেনি, যা বাঙালি নামের কতিপয় কুলাঙ্গারের কারণে বাংলাদেশের ক্ষেত্রে সিআইএ পেরেছে। বলা হয়ে থাকে, ফিদেল কাস্ত্রো ছাড়া পৃথিবীর আর কাউকে হত্যার জন্য সিআইএ এত বেশিবার উদ্যোগ নেয়নি। কিন্তু কাস্ত্রো ও তার জনগণের কৌশলের কাছে তারা প্রতিবারই হেরে গেছে; যে কৌশল কাস্ত্রো আয়ত্ত করেছিলেন, তার দীর্ঘকালীন গেরিলা যুদ্ধের অভিজ্ঞতার মধ্য দিয়ে। উল্লেখ্য, কিউবান বিপ্লবের যুদ্ধকালীন পর্বের পুরোটাই ছিল বস্তুত গেরিলা যুদ্ধের ইতিহাস, যেটি বাংলাদেশের মুক্তিযুদ্ধের ইতিহাসের সঙ্গে মিলে যায়।

কিউবান বিপ্লব ও বাংলাদেশের স্বাধীনতা সংগ্রাম এবং এ দুই দেশের গঠন প্রক্রিয়ার মধ্যে ব্যাপক সাদৃশ্য ও আদর্শিক মিল থাকা সত্ত্বেও উভয়ের মধ্যে বৈসাদৃশ্যও কিন্তু যথেষ্ট রয়েছে। বাংলাদেশের স্বাধীনতার ৫০ বছর পূর্ণ হতে যাওয়ার প্রাক্কালে বিষয়গুলোর প্রতি পর্যালোচনামূলক দৃষ্টি দেয়া উচিত বলে মনে করি। বিপ্লব-পরবর্তী প্রথম সিদ্ধান্তেই ফিদেল কাস্ত্রো কিউবায় যা যা করেছিলেন, বঙ্গবন্ধুও বাংলাদেশে অনেকটা সে ধরনের সিদ্ধান্তই নিয়েছিলেন। কিন্তু কিউবায় সেগুলো বাস্তবায়িত হলেও বঙ্গবন্ধুর অবর্তমানে বাংলাদেশে সেগুলো আর বাস্তবায়িত হয়নি। কাস্ত্রোর প্রথম সিদ্ধান্তগুলোর অন্যতম ছিল সমাজ থেকে বৈষম্য নিরসন ও সমতা প্রতিষ্ঠার লক্ষ্যে ব্যাপকভিত্তিক ভূমি সংস্কার, অবৈধ পন্থায় আহরিত সম্পদ রাষ্ট্রের অনুকূলে জব্দকরণ, বেসরকারি খাতে বিদ্যালয় স্থাপন সম্পূর্ণভাবে নিষিদ্ধকরণ ইত্যাদি। ভূমি সংস্কার উদ্যোগের আওতায় যাদের বেশি পরিমাণ জমি ছিল, সে জমি রাষ্ট্রের অনুকূলে অধিগ্রহণ করা হয়, যার আওতায় ফিদেল কাস্ত্রো তার পৈতৃক সম্পত্তিও ছেড়ে দিয়েছিলেন। আর সর্বোচ্চ অগ্রাধিকারভিত্তিক অন্যান্য কর্মসূচির মধ্যে ছিল যোগাযোগ অবকাঠামো, স্বাস্থ্য, বাসস্থান, শিক্ষা ও নারীর ক্ষমতায়ন। আর এসবেরই কারণে সর্বোচ্চ পর্যায়ের মাথাপিছু আয়ের দেশ না হয়েও অধিকাংশ মানব উন্নয়ন সূচকের নিরিখে কিউবা এখন বিশ্বের সর্বোচ্চ সারির দেশগুলোর একটি। আর মাথাপিছু আয়ও নেহায়েত কম নয়— ৭ হাজার ৩৯১ ডলার, বাংলাদেশের তুলনায় প্রায় সাড়ে ৪ গুণ।

কিউবার মতো প্রায় একই আঙ্গিকের আদর্শ ও কর্মসূচি নিয়ে বাংলাদেশ তার যাত্রা শুরু করলেও ১৯৭৫ সালে রক্তক্ষয়ী সামরিক অভ্যুত্থানের মধ্য দিয়ে ক্ষমতায় আরোহণকারী সাম্রাজ্যবাদী শক্তির ক্রীড়নকেরা তার সবই প্রায় ধ্বংস করে দেয়। কিন্তু এখন যেহেতু স্বাধীনতা সংগ্রামে নেতৃত্বদানকারী দল ক্ষমতায়, তাই ১৯৭২-এর সেই গণমুখী কর্মসূচিগুলোর দিকে আবার ফিরে তাকানো যায় কিনা? বিশেষত ক্রমবর্ধমান বৈষম্য যখন ক্ষণে ক্ষণে আমাদের স্বাধীনতা সংগ্রামের মৌল চেতনাকে অনেকটাই ফ্যাকাশে করে দিচ্ছে, তখন এ তাকানোর বিষয়টি আরো জরুরি হয়ে পড়েছে বৈকি! বিশেষ করে কিউবার অনুকরণে বাংলাদেশের প্রাথমিক শিক্ষাকে পুরোপুরি সরকারি বিদ্যালয়ের অধীন করা যায় কিনা, তা ভেবে দেখা যেতে পারে।

এ প্রসঙ্গে এখানে শুধু এটুকু বলতে চাই শিল্প, কৃষি, শিক্ষা, স্বাস্থ্য, গৃহায়ণ ইত্যাদি প্রতিটি রাষ্ট্রীয় নীতিমালার আওতাতেই এমন কিছু অনুষঙ্গ রয়েছে, যেগুলো সম্পদের বৈষম্য ও মেরুকরণকেই শুধু ত্বরান্বিত করছে না, নিম্ন ও মধ্যবিত্ত মানুষের আয় উপার্জন বৃদ্ধি সত্ত্বেও একই সঙ্গে তা তাদের মধ্যে ক্ষোভ ও অসন্তুষ্টির মাত্রা বাড়িয়ে দিচ্ছে। এক্ষেত্রে কিউবা বিপ্লব থেকে আমাদের অনেক কিছু শেখার আছে বলে মনে করি। একমাত্র বারাক ওবামা ছাড়া প্রত্যেক মার্কিন প্রেসিডেন্ট (এমনকি জন এফ. কেনেডিও: ১৯৬১-৬৩) ফিদেল কাস্ত্রো ও কিউবাকে এত বেশি যন্ত্রণা ও কষ্ট দিয়েছেন, আর কোনো দেশের প্রতিই মার্কিন নিগ্রহের মাত্রা এতটা উগ্ররূপ ধারণ করেছে বলে প্রমাণ পাওয়া যায় না। তার পরও কিউবা যেভাবে নিঃশ্বাস দূরত্বে অবস্থান করে মার্কিন প্রতিকূলতা মোকাবেলা করে শুধু টিকে থাকা নয় দাপটের সঙ্গে এগিয়ে গেছে, তা আমাদের জন্য অনুপ্রেরণার উৎস হতে পারে। এ প্রসঙ্গে নিজেদের একটি সাহসের প্রশংসা অবশ্যই উল্লেখ করতে হয়, সেটি হচ্ছে শেখ হাসিনা কর্তৃক পদ্মা সেতু নির্মাণে বিশ্বব্যাংকের আর্থিক সহযোগিতা প্রত্যাখ্যান করা।

কিউবান বিপ্লবের প্রথম প্রত্যক্ষ সুবিধাভোগী নিঃসন্দেহে সে দেশের জনগণ। কিন্তু বিশ্বের অন্যান্য বহু দেশের লক্ষ-কোটি মেহনতি মানুষও কি এর সুফল কম-বেশি ভোগ করেনি? নেলসন ম্যান্ডেলা ১৯৯০-এর দশকে দক্ষিণ আফ্রিকায় কৃষ্ণাঙ্গ ও শ্বেতাঙ্গদের মধ্যে যে মেলবন্ধন গড়ে তুলেছিলেন, তার প্রায় সাড়ে তিন দশক আগে ১৯৫৯ সালেই ফিদেল কাস্ত্রো ঘোষণা করেছিলেন। তা ছিল আফ্রিকান বংশোদ্ভূত কৃষ্ণাঙ্গ কিউবানদের সঙ্গে মিলে শ্বেতাঙ্গ কিউবানদের একসঙ্গে দেশ গড়ার প্রত্যয়। এখন থেকে ৬০ বছর আগে ঘোষিত সে প্রত্যয়ের ধারাতেই যে বর্ণবৈষম্যবিরোধী চেতনা আজ বিশ্ব মানবাধিকারের অন্যতম মানদণ্ড। অন্যদিকে লাতিন আমেরিকার অধিকাংশ দেশই যে আজ মার্কিন কর্তৃত্বের বাইরে গিয়ে তাদের জনগণের জীবনমানের উন্নয়ন ও প্রগতিশীল রাজনৈতিক আদর্শকে সীমিত পরিসরে হলেও ধরে রেখেছে, সেটি কিউবান বিপ্লবেরই ফসল। অতএব, ফিদেল কাস্ত্রোর নেতৃত্বাধীন কিউবার বিপ্লব সে দেশের জনগণের মুক্তি, আকাঙ্ক্ষা ও অংশগ্রহণের প্রতীক হলেও একই সঙ্গে তা পৃথিবীর সব মুক্তিকামী মানুষেরই বিপ্লব।

১৯৭৩ সালে আলজেরিয়ার রাজধানী আলজিয়ার্সে অনুষ্ঠিত জোট নিরপেক্ষ শীর্ষ সম্মেলনে যোগ দিতে গিয়েছিলেন ফিদেল কাস্ত্রো ও বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমান। সেখানে অনুষ্ঠিত পারস্পরিক সাক্ষাতে ফিদেল কাস্ত্রো সদ্য স্বাধীনতাপ্রাপ্ত বাংলাদেশ রাষ্ট্রের প্রতিষ্ঠাতা বঙ্গবন্ধুকে উদ্দেশ করে বলেছিলেন, ‘আমি হিমালয় দেখিনি, কিন্তু শেখ মুজিবকে দেখেছি।’ ইতিহাসের এ অমোঘ উক্তি শুধু শেখ মুজিবের মহত্ত্ব ও বিরাটত্বের মহিমাকেই তুলে ধরেনি, একই সঙ্গে তা পৃথিবীর দেশে দেশে প্রগতিশীল মানুষের সংগ্রাম ও আকাঙ্ক্ষার প্রতি ফিদেল কাস্ত্রোর অঙ্গীকার ও দায়বদ্ধতার উপলব্ধিকেও তুলে ধরেছিল। এবং বস্তুত সেটিই ছিল কিউবান বিপ্লবের মূল চেতনা এবং তা বাংলাদেশের মুক্তি সংগ্রামের চেতনাও বৈকি!

লেখক : পরিচালক
আবু তাহের খান
ক্যারিয়ার ডেভেলপমেন্ট সেন্টার
ড্যাফোডিল ইন্টারন্যাশনাল ইউনিভার্সিটি
atkhan56@gmail.com


Source: http://epaper.bonikbarta.net/1960696/Bonik-Barta/Bonik-Barta#clip/35356639/1be577c2-1f06-4a65-a8a1-e9dbd1dbe6b2/1584:943.8765690376571

14
একাদশ জাতীয় সংসদ নির্বাচনের তফসিল ঘোষণা করা হয়েছে। এখন পর্যন্ত আশা করা হচ্ছে, সব নিবন্ধিত রাজনৈতিক দলই নির্বাচনে অংশ নিচ্ছে। আর সেই সূত্রে বড় রাজনৈতিক দলগুলো শিগগিরই হয়তো তাদের নির্বাচনী ইশতেহার ঘোষণা করবে। সেসব দলীয় ইশতেহারে কী কী থাকবে, তা আমরা এখনো নিশ্চিত নই। তবে ধারণা করা যায়, বিভিন্ন সময়ের বক্তৃতা-বিবৃতি ও বহুল উচ্চারিত কথোপকথনে তারা যা যা বলে, মোটামুটি সেগুলোই হবে নির্বাচনী ইশতেহারের মূল অনুষঙ্গ। এ অবস্থায় যেসব বিষয়ে তারা খুব কম বলে অথবা তা এড়িয়ে চলে কিংবা আদৌ বলে না বা বলতে চায় না, এরূপ কিছু বিষয় এখানে রাজনৈতিক দলগুলোর নির্বাচনী ইশতেহারে অন্তর্ভুক্তির জন্য প্রস্তাব আকারে তুলে ধরা হলো।

গড় মাথাপিছু আয়, অর্থনৈতিক প্রবৃদ্ধির হার ইত্যাদি সূচক দেশে উল্লেখযোগ্য হারে বাড়লেও একই সঙ্গে উদ্বেগজনক হারে বাড়ছে সম্পদবৈষ্যমও এবং এ ধারা অব্যাহত থাকলে অদূর ভবিষ্যতে তা ন্যায়ভিত্তিক সমাজ প্রতিষ্ঠার ক্ষেত্রে বড় ধরনের অন্তরায় হয়ে দাঁড়াতে পারে। এ অবস্থায় সম্পদবৈষম্যের এ প্রবণতা রোধ করতে হলে যেসব রাষ্ট্রীয় নীতিমালার কারণে এসব বৈষম্য সৃষ্টি হয়েছে, সেগুলোকে সুনির্দিষ্টভাবে চিহ্নিত করে রাষ্ট্রের নীতি-কাঠামোতে বড় ধরনের পরিবর্তন আনা জরুরি। সেটি করার জন্য রাজনৈতিক দলগুলো কতটা প্রস্তুত সে ব্যাপারে যথেষ্ট সন্দেহ রয়েছে। তা ছাড়া আদর্শিক চিন্তাভাবনা, দৃষ্টিভঙ্গি ও উপলব্ধিগত দিক থেকেও এ ক্ষেত্রে সমস্যা রয়েছে বলে মনে করি, যেসব সমস্যার সমাধানে তাদের নিজেদের পক্ষে উদ্যোগী না হওয়াটাই স্বাভাবিক। কিন্তু সে ক্ষেত্রে জনমতের চাপ যদি বাড়ানো যায়, তাহলে নিজেদের রাজনৈতিক অস্তিত্ব টিকিয়ে রাখার স্বার্থে হলেও এসব আদর্শিক চাহিদা পূরণে তারা এগিয়ে আসতে বাধ্য হবে। এই মুহূর্তে সে রকম একটি দাবি হচ্ছে, রাজনৈতিক দলগুলো যেন তাদের আসন্ন নির্বাচনী ইশতেহারে সমাজ থেকে সম্পদবৈষম্যে দূরীকরণে কী পন্থা অবলম্বন করবে সে বিষয়ে সুস্পষ্ট বক্তব্য তুলে ধরে।

দ্বিতীয়ত, প্রশাসনিক বিকেন্দ্রীকরণ ও স্বনির্ভর স্থানীয় সরকার ব্যবস্থা গড়ে তোলার ব্যাপারে কোনো রাজনৈতিক দল নির্বাচনে জিতে ক্ষমতায় গিয়ে কী ব্যবস্থা গ্রহণ করবে, জনগণ তা জানতে চায়। অতীতে এ দুটি ব্যাপারেই বড় রাজনৈতিক দলগুলো তাদের ওয়াদা রক্ষা করেনি এবং কিছু ক্ষেত্রে চাতুর্যের আশ্রয় নিয়েছে। অবশ্য ব্যাপকভাবে মনে করা হয় যে বিদ্যমান আমলাতন্ত্রই তাদের কায়েমি স্বার্থকে ধরে রাখার জন্য নেপথ্যে থেকে এ ব্যাপারে ঘুঁটি চালছে। বস্তুত তারাই প্রশাসনিক বিকেন্দ্রীকরণ ও স্বনির্ভর স্থানীয় সরকার ব্যবস্থা গড়ে তোলার ক্ষেত্রে প্রধান অন্তরায়। তবে রাজনৈতিক দলগুলোও এ ব্যাপারে তাদের দায় এড়াতে পারে না। কারণ আমলাতন্ত্রকে দক্ষতার সঙ্গে ব্যবহারের দায়িত্ব তো সর্বাগ্রে রাজনৈতিক কর্তৃপক্ষের ওপরই বর্তায়। এ অবস্থায় প্রশাসনিক বিকেন্দ্রীকরণ ও শক্তিশালী স্বনির্ভর স্থানীয় সরকার গড়ে তোলার ব্যাপারে তারা আমলাতন্ত্রের কৌশলী আচরণকে কিভাবে মোকাবেলা করবে এবং স্থানীয় সরকারের ক্ষমতায় ভাগ বসানোর প্রচলিত ধারা থেকে সংসদ সদস্যরা কিভাবে বিরত থাকবেন সে ব্যাপারে রাজনৈতিক দলগুলোর নির্বাচনী ইশতেহারে কোনো ধরনের ধূম্রজাল নয়—সুস্পষ্ট ও সুনির্দিষ্ট বক্তব্য দেখতে চাই।

নবপর্যায়ে রোহিঙ্গা সংকট বাংলাদেশের সামনে একটি অনেক বড় ইস্যু। এ ব্যাপারে বাংলাদেশের অনুকূলে আন্তর্জাতিক সম্প্রদায়ের নীতিগত সমর্থন এখনো নিরঙ্কুশ নয়। তদুপরি যারা বাংলাদেশকে সমর্থন করছে, তারাও তা করছে অনেকটাই কূটনৈতিক কলাকৌশলের আবরণ মেখে। রোহিঙ্গাদের স্বদেশে ফিরিয়ে নেওয়ার ব্যাপারে মিয়ানমারকে বাধ্য করার জন্য যে ধরনের চাপ প্রয়োগ করা প্রয়োজন, আন্তর্জাতিক সম্প্রদায়ের পক্ষ থেকে এখনো তা লক্ষ করা যায়নি। এ অবস্থায় কূটনৈতিক তৎপরতা জোরদারকরণের মাধ্যমে শিগগিরই রোহিঙ্গাদের ফিরিয়ে নেওয়ার ব্যবস্থা করতে না পারলে অদূর ভবিষ্যতে তা বাংলাদেশের সমাজ ও অর্থনীতির জন্য বড় ধরনের ঝুঁকি তৈরি করতে পারে। এ ক্ষেত্রে অর্থনৈতিক ঝুঁকির চেয়েও বড় ঝুঁকি হচ্ছে সামাজিক ও রাজনৈতিক ঝুঁকি। আশঙ্কা করা হচ্ছে, রোহিঙ্গাদের কেন্দ্র করে নিকট-ভবিষ্যতের বাংলাদেশে জঙ্গিবাদী তৎপরতা আবারও মাথাচাড়া দিয়ে উঠতে পারে। এ অবস্থায় রাজনৈতিক দলগুলো ক্ষমতায় গেলে এ ব্যাপারে কে কী করবে, নির্বাচনী ইশতেহারের মাধ্যমে তা জানা প্রয়োজন।

বঙ্গোপসাগরসহ দেশের বিভিন্ন স্থান থেকে তেল-গ্যাস আহরণে নিয়োজিত বিদেশি কম্পানিগুলোর সঙ্গে সম্পাদিত উৎপাদন বণ্টন চুক্তিসহ (পিএসসি) খনিজ সম্পদ আহরণ নীতির বিষয়টিও রাজনৈতিক দলগুলোর নির্বাচনী ইশতেহারে উঠে আসা প্রয়োজন। একইভাবে দেশের ভবিষ্যৎ জ্বালানি চাহিদা পূরণে কার কী ধরনের দীর্ঘমেয়াদি পরিকল্পনা রয়েছে, সেটিও এসংক্রান্ত অঙ্গীকারের আওতায় উঠে আসতে পারে বলে মনে করি। জ্বালানি মূল্য নির্ধারণের ক্ষেত্রে কোন খাতের জন্য কী ধরনের ভর্তুকি ব্যবস্থা চালু থাকবে এবং এ খাতে ব্যাপক অনিয়ম, দুর্নীতি ও অদক্ষতার যেসব অভিযোগ রয়েছে, সেগুলো কিভাবে মোকাবেলা করা হবে—সে বিষয়েও রাজনৈতিক দলগুলোর কাছ থেকে নির্বাচনী ইশতেহারের মাধ্যমে সুনির্দিষ্ট বক্তব্য আসা প্রয়োজন।

প্রাথমিক থেকে উচ্চশিক্ষা পর্যন্ত সর্বস্তরেই শিক্ষার মানের দ্রুত অবনতি ঘটছে। যেসব কারণে এটি ঘটছে তার মধ্যে অন্যতম হচ্ছে প্রাথমিক বিদ্যালয় পর্যায়ে শিক্ষক নিয়োগ প্রক্রিয়ার ত্রুটি ও অনিয়মের কারণে যোগ্য শিক্ষকের অভাব, শিথিল নিয়ন্ত্রণ ব্যবস্থার আওতায় ব্যাপকসংখ্যক মানহীন বিশ্ববিদ্যালয় ও অন্যান্য শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানের জন্মলাভ, কোনো প্রকার মান যাচাই ছাড়াই কওমি ও অন্যান্য মাদরাসা সনদকে বিশ্ববিদ্যালয় সনদের সমমর্যাদাদান ইত্যাদি। এ অবস্থা অব্যাহত থাকলে অচিরেই দেশের রাজনীতি, অর্থনীতি ও সমাজকে নেতৃত্বদানের মতো উপযুক্ত শিক্ষিত জনবলের ঘাটতি দেখা দেওয়ার আশঙ্কা রয়েছে। এ অবস্থায় এ বিষয়গুলোতে রাজনৈতিক দলগুলো তাদের নির্বাচনী ইশতেহারে নিজেদের বক্তব্য স্পষ্ট করবে—এটিই প্রত্যাশা।

একইভাবে উচ্চ সম্পদ সহায়ক বিদ্যমান রাজস্বব্যবস্থাকে স্বল্প সম্পদধারীদের অনুগামী করে তোলা, ব্যাংকিং খাতে অনিয়ম প্রতিরোধ ও পেশাদারি প্রতিষ্ঠা, জনগণের শহরমুখী অভিগমন প্রবণতার মাত্রাতিরিক্ততা রোধ, যানজট নিরসন, সাধারণ জনগণের নিরাপত্তা ও আইন-শৃঙ্খলা রক্ষা ব্যবস্থাকে বিশ্বাসযোগ্য ও নির্ভরশীল করে তোলা ইত্যাদি বিষয়েও সাধারণ জনগণ রাজনৈতিক দলগুলোর নির্বাচনী ইশতেহারে যথাযথ বক্তব্য দেখতে চায়। আশা করব, নির্বাচনী ইশতেহারে নিজেদের পরিকল্পনা ও অঙ্গীকারকে যথাযথভাবে তুলে ধরার মাধ্যমে  প্রতিটি দলই সংখ্যাগরিষ্ঠ জনগণের সমর্থন আদায়ে সচেষ্ট হবে। জনমতকে নিজেদের পক্ষে টানার জন্য এমন চমৎকার সুযোগ আমাদের রাজনৈতিক দলগুলো হাতছাড়া করবে না বলেই আশা করি।

লেখক : পরিচালক
আবু তাহের খান
ক্যারিয়ার ডেভেলপমেন্ট সেন্টার
ড্যাফোডিল ইন্টারন্যাশনাল ইউনিভার্সিটি
atkhan56@gmail.com


Source: http://www.kalerkantho.com/print-edition/sub-editorial/2018/11/23/706473

15
বিশ শতকের ষাটের দশকে তত্কালীন পাকিস্তানের সমগ্র সম্পদের সিংহভাগই কুক্ষিগত ছিল মাত্র ৪৩ পরিবারের হাতে, যাদের মধ্যে একজন মাত্র ছিলেন বাঙালি— এ.কে. খান (Rehman Sobhan: From Two Economies to Two Nations)। অবশ্য জনপ্রিয় আলোচনায় এটি ২২ পরিবার হিসেবেই সর্বাধিক পরিচিত। পাকিস্তানবিরোধী আন্দোলনের সময় বঙ্গবন্ধুসহ বহু নেতাই তাঁদের ভাষণে ওই ২২ পরিবারের সম্পদ কুক্ষিগতকরণের বিষয়টিকে অত্যন্ত ক্ষোভের সঙ্গে তুলে ধরেন। বস্তুত এ সম্পদ শোষণ ও তা থেকে সৃষ্ট বৈষম্যের বিরুদ্ধে সংগ্রামের ধারাবাহিকতায়ই আজকের এ স্বাধীন বাংলাদেশ রাষ্ট্রের অভ্যুদয়। আর বাংলাদেশের স্বাধীনতার অন্যতম মৌল চেতনাই হচ্ছে বৈষম্যের বিরুদ্ধে সংগ্রাম— একটি বৈষম্যমুক্ত রাষ্ট্র গড়ে তোলা।

তো একটি বৈষম্যমুক্ত শোষণহীন সমাজ প্রতিষ্ঠার আকাঙ্ক্ষা থেকে সৃষ্ট বাংলাদেশ যখন ২০২১ সালে এর ৫০ বছর পূর্ণ করতে যাচ্ছে, তখন যুক্তরাষ্ট্রভিত্তিক গবেষণা প্রতিষ্ঠান ওয়েলথএক্সের সর্বসাম্প্রতিক গবেষণা প্রতিবেদনের তথ্যের উদ্ধৃতি দিয়ে পত্রিকায় প্রকাশিত তথ্য জানাচ্ছে, গত পাঁচ বছরে বিশ্বে ধনীদের সম্পদ বৃদ্ধির হারের বিবেচনায় সর্বশীর্ষে রয়েছে বাংলাদেশ। ২০১২-১৭ সময়ে বাংলাদেশে ধনীদের সম্পদ বৃদ্ধির হার ছিল ১৭ দশমিক ৩ শতাংশ। অন্যদিকে এ সময়ে দেশে সামগ্রিক অর্থনৈতিক প্রবৃদ্ধির গড় হার ছিল ৬ দশমিক ৯৬ শতাংশ। অর্থাৎ এ সময়ে এ দেশে ধনীদের সম্পদ দেশের অর্থনৈতিক প্রবৃদ্ধির গড় হারের চেয়ে প্রায় তিন গুণ হারে বৃদ্ধি পেয়েছে। আর রাষ্ট্রের বিদ্যমান অর্থনৈতিক নীতিকাঠামো অব্যাহত থাকলে সামনের দিনগুলোয় এ বৈষম্য যে আরো বাড়তেই থাকবে, তা প্রায় নিশ্চিত করেই বলা যায়। তাহলে স্বভাবতই প্রশ্ন জাগে, ২০২১ সালে স্বাধীনতার ৫০ বছর পূর্তির ক্ষণে দারিদ্র্য বিমোচন ও আয় বৃদ্ধির নানা অগ্রগতির কথা যখন রাষ্ট্র তুলে ধরতে চাইবে, তখন এসব অর্জনের মহিমা এ ক্রমবর্ধমান সম্পদবৈষম্যের কারণে অনেকটাই ম্লান হয়ে যাবে না কি?

এখন প্রশ্ন, এ বৈষম্য কেন বাড়ছে এবং তা কমিয়ে আনা সম্ভব কিনা? একেবারে বিতর্কহীনভাবে প্রশ্নের প্রথম অংশের জবাব হচ্ছে, রাষ্ট্রের নীতিকাঠামোর মধ্যেই নিহিত রয়েছে এ বৈষম্যের বীজ এবং যে নীতিকাঠামো প্রণয়নে জনসংশ্লিষ্ট রাজনীতিকদের চেয়ে শ্রেণিস্বার্থপ্রবণ আমলাতন্ত্রের ভূমিকাই অধিকাংশ সময়ে মুখ্য হিসেবে কাজ করেছে। ফলে শোষণ ও বৈষম্য বিলোপের জনআকাঙ্ক্ষাকে ধারণ করে বাংলাদেশ তার স্বাধীনতা অর্জন করলেও আমলাতান্ত্রিক এ রাষ্ট্রে নীতিনির্ধারণী পর্যায়ের অধিকাংশ সিদ্ধান্তই শ্রমজীবী সাধারণ মানুষের স্বার্থের পক্ষে না গিয়ে বিত্তবান মানুষের স্বার্থকে পাহারা দিচ্ছে। উদাহরণ হিসেবে বিভিন্ন খাতের এরূপ কিছু নীতিনির্ধারণী সিদ্ধান্তের প্রসঙ্গ নিয়ে এখানে খানিকটা আলোকপাত করা যেতে পারে। বৈদেশিক মুদ্রা আহরণকে অন্যতম লক্ষ্য হিসেবে গণ্য করে রফতানি বৃদ্ধিকে উৎসাহদানের জন্য তৈরি পোশাক, হিমায়িত চিংড়ি, চামড়াজাত পণ্য, হস্তশিল্প, কৃষিজাত দ্রব্যাদি ইত্যাদিসহ বেশকিছু পণ্য রফতানির ক্ষেত্রে প্রতি বছরের বাজেটে নগদ ভর্তুকির ব্যবস্থা রাখা হয়। আর সহজেই বোধগম্য, বিত্তবান রফতানিকারককে প্রদত্ত এ ভর্তুকি তার সম্পদ বৃদ্ধিকেই শুধু সহায়তা করছে না; এ ভর্তুকি পরিশোধের জন্য সাধারণ মানুষের ওপর করের বোঝাও বাড়ানো হচ্ছে, প্রকারান্তরে যা সমাজের এ দুই শ্রেণীর মধ্যে সম্পদবৈষম্য বৃদ্ধিতেও ভূমিকা রাখছে।

রফতানি আয়ের ওপর নগদ ভর্তুকি প্রদানের ব্যাপারে রাষ্ট্রের নীতিনির্ধারকদের অন্যতম যুক্তি, এটি বাড়তি বৈদেশিক মুদ্রা আহরণের জন্য একটি খুবই সহায়ক কৌশল, যা বাণিজ্য ঘাটতি মেটানোর জন্য অত্যন্ত জরুরি। তো বাড়তি বৈদেশিক মুদ্রা উপার্জনকে উৎসাহিত করার জন্য নগদ ভর্তুকি যদি দিতেই হয়, তাহলে বাংলাদেশের যে শ্রমজীবী মানুষ নিজেদের ভিটামাটি বিক্রি করে বিদেশে গিয়ে সেখানে অমানবিক পরিশ্রম করে মূল্যবান বৈদেশিক মুদ্রা স্বদেশে পাঠায়, তাদের সে আয়ের ওপর নগদ ভর্তুকি প্রদান করা হচ্ছে না কেন? যুক্তি বলে, বৈদেশিক মুদ্রা উপার্জনকে উৎসাহদানের লক্ষ্যে নগদ ভর্তুকি যদি প্রদান করতেই হয়, তাহলে সর্বাগ্রে তা করতে হবে প্রবাসী আয়ের ওপর; পণ্য রফতানির ওপর নয়। আর অভিমত হচ্ছে, বাংলাদেশের অর্থনীতির বর্তমান পর্যায়ে এ ধরনের নগদ ভর্তুকির এখন আর কোথাও কোনো প্রয়োজন নেই এবং তা অব্যাহত রাখা মানেই হচ্ছে তেলে মাথায় আরো বেশি করে তেল মাখা, রাষ্ট্রীয় পৃষ্ঠপোষকতায় সম্পদবৈষম্যকে আরো বাড়িয়ে তোলা।

সরকারের রাজস্ব আয় বৃদ্ধির লক্ষ্যে কর বিভাগের একটি অন্যতম জনপ্রিয় কৌশল হচ্ছে প্রত্যক্ষ করদাতার সংখ্যা বৃদ্ধি করা (পরোক্ষ কর ধনী-দরিদ্র সবাই দিচ্ছেন)। অন্যান্য উন্নত দেশের দৃষ্টান্ত উল্লেখ করে প্রায়ই দেখানোর চেষ্টা করা হয়, মোট জনসংখ্যার তুলনায় বাংলাদেশে করদাতার সংখ্যা এখনো অনেক কম। এ ধরনের তুলনার মধ্যে বড় ধরনের বিভ্রান্তি রয়েছে। জিডিপির সঙ্গে করের অনুপাত মেলানোর চেষ্টাটি ঠিক আছে। কিন্তু করদাতার সংখ্যার ঢালাও সম্প্রসারণ কর-জিডিপির অনুপাত বৃদ্ধির সর্বোত্তম উপায় নয় কোনোভাবেই। কারণ দেশের সম্পদ তো সব মানুষের মধ্যে সমান হারে ছড়িয়ে নেই যে, সবাইকে একই মাপকাঠিতে করের আওতায় নিয়ে আসা যায়। এক্ষেত্রে শুধু করদাতার সংখ্যা বৃদ্ধি করে নয়, সম্পদের পরিমাণের ভিত্তিতে করের পরিমাণ বাড়িয়ে এবং বিদ্যমান করদাতাদের মধ্যে কর ফাঁকি কমিয়ে অতি সহজেই উল্লিখিত অনুপাতকে বহুগুণে বাড়িয়ে তোলা যেতে পারে। হিসাব করে দেখা গেছে, প্রত্যক্ষ করদাতার সংখ্যা আর একজন না বাড়িয়েও কেবল কর ফাঁকি প্রতিরোধ করে যৌক্তিক হারে কর আদায় করা গেলে বিদ্যমান করদাতাদের কাছ থেকেই প্রায় দ্বিগুণ পরিমাণ কর আদায় করা সম্ভব। কিন্তু সেটি না করে অর্থাৎ বিত্তবানের কর ফাঁকির বোঝা প্রত্যক্ষ করদাতার সংখ্যা বাড়িয়ে মধ্যবিত্তের ওপর এবং পরোক্ষ কর বাড়িয়ে নিম্নবিত্ত বা বিত্তহীনের ওপর চাপানোর যে চেষ্টা চলমান রয়েছে, তা অব্যাহত থাকলে কর-জিডিপির অনুপাত বাড়বে বটে। তবে তার চেয়েও বেশি করে বাড়বে সম্পদবৈষম্য।

বাংলাদেশের অর্থনীতির অন্যতম বড় খাত এখন সেবা খাত। বেসরকারি পর্যায়ে মোবাইল ফোন, ব্যাংকিং, ইন্স্যুরেন্স, চিকিৎসা, পরিবহন, ইজারা, জনশক্তি রফতানি, আইসিটি, কুরিয়ার ইত্যাদি সেবা খাতের প্রসার এখন এতটাই দ্রুততার সঙ্গে ঘটছে যে, বস্তুত এসব খাতের দ্রুততর বিকাশের কারণেই সাম্প্রতিক বছরগুলোয় জিডিপি প্রবৃদ্ধির ক্ষেত্রে এরূপ উচ্চতর হার বজায় রাখা সম্ভব হয়েছে। কিন্তু নেপথ্যের অনালোচিত তথ্য পর্যালোচনা করলে আরো একটি চিত্র পাওয়া যাবে এবং তা হচ্ছে, সচেতনতার অভাবে অথবা অসংগঠিত থাকার কারণে এসব খাতের ভোক্তারা সংশ্লিষ্ট বিনিয়োগকারীদের যথেচ্ছ মুনাফার দাবি প্রশ্নহীনভাবে মিটিয়ে যাচ্ছেন। আর এ প্রক্রিয়ায় সংশ্লিষ্ট বিনিয়োগকারীদের মুনাফার পাহাড়ই শুধু স্ফীত হচ্ছে না, সাধারণ মানুষ তাদের দৈনন্দিন আয়ের একটি বিরাট অংশ বাধ্য হয়ে তাদের হাতে সঁপে দিয়ে দেশে সম্পদবৈষম্যের মেরুকরণের প্রবণতাকেও ত্বরান্বিত করে তুলছেন।

সন্দেহ নেই, স্বাধীনতা-উত্তর গত ৪৭ বছরে দেশের প্রতিটি মানুষের আয়-উপার্জন ও জীবনযাপনের ক্ষেত্রে লক্ষ্যযোগ্য অগ্রগতি সাধিত হয়েছে। কিন্তু এ সময়ের মধ্যে ভূমির মালিকানার ক্ষেত্রে যে মেরুকরণ ঘটেছে, তা রীতিমতো আতঙ্কজনক ভবিষ্যতেরই ইঙ্গিত দিচ্ছে। ১৯৭২ সালের তুলনায় ২০১৮ সালে ভূমিহীন মানুষের সংখ্যা বাড়তে বাড়তে দেশের সমগ্র ভূমির একটি বড় অংশই চলে গেছে বিত্তবান উঠতি পুঁজিপতিদের হাতে। উদ্বেগের বিষয়, নিকট ভবিষ্যতের বাংলাদেশে মাথাপিছু আয়ের পরিমাণ যখন আরো বাড়বে, তখন একই সঙ্গে বাড়বে ভূমিহীন সচ্ছল স্বল্পভূমির মালিকানাধারী নগদ বিত্তের মানুষের সংখ্যাও, যারা যেকোনো মূল্যে ভূমির মালিকানা করায়ত্ত করতে গিয়ে নিম্নবিত্ত সাধারণ মানুষের জীবনযাপনকে আরো কষ্টকর করে তুলবে। আর এ পরিস্থিতিতে সম্পদবৈষম্যের মেরুকরণ এমন এক পরিস্থিতির জন্ম দিতে পারে, যা নতুন করে অনাকাঙ্ক্ষিত সামাজিক অস্থিরতার কারণ হয়ে উঠতে পারে। ফলে দেশে ভূমির অধিগ্রহণ ও মালিকানা ব্যবস্থার আশু পর্যালোচনা প্রয়োজন বলে মনে করি। শিল্পোন্নয়নকে উদ্দেশ করে নতুনভাবে ১০০টি বিশেষ অর্থনৈতিক অঞ্চল স্থাপনের লক্ষ্যে যে প্রক্রিয়ায় ভূমি অধিগ্রহণ কার্যক্রম চলছে, সীমিত ভূমির এ দেশে দূরদৃষ্টিসম্পন্ন দীর্ঘমেয়াদি টেকসই উন্নয়ন কৌশল হিসেবে সেটি যথার্থ কিনা, তা জরুরি ভিত্তিতে ভেবে দেখা প্রয়োজন। সম্পদবৈষম্য রোধে তো প্রয়োজন অবশ্যই।

২০১২-১৩ অর্থবছরে বাংলাদেশের জনগণের মাথাপিছু আয় ছিল ৯২৩ মার্কিন ডলার, যা ২০১৭-১৮ অর্থবছরে এসে দাঁড়িয়েছে ১ হাজার ৭৫১ মার্কিন ডলারে। মাত্র পাঁচ বছরের ব্যবধানে তা প্রায় দ্বিগুণ হয়ে উঠলেও এ সময়ের ব্যবধানে শিল্প শ্রমিকের বেতন বেড়েছে খুবই সামান্য। শিল্প খাতে প্রবৃদ্ধির হারও মাথাপিছু গড় আয় বৃদ্ধির হারের মতোই উৎসাহব্যঞ্জক ২০০৯-১০ অর্থবছরের পর থেকে শুধু ২০১৩-১৪ অর্থবছর ছাড়া কখনই তা ১০ শতাংশের নিচে নামেনি। অথচ শিল্প খাতে শ্রমিক মজুরির হার এখনো বহু ক্ষেত্রে রীতিমতো অমানবিক, যে ব্যাপারে সরকারের হস্তক্ষেপ শুধু বাঞ্ছনীয়ই নয় সাংবিধানিক বাধ্যবাধকতারও অন্তর্ভুক্ত। এসব খাতের উদ্যোক্তাদের উৎসাহদানের লক্ষ্যে সরকার অহর্নিশ তাদের  নানা আর্থিক ও অন্যান্য প্রণোদনা জুগিয়ে যাচ্ছে। কিন্তু এসব প্রণোদনা প্রদানের শর্তে কেন থাকছে না যে, তা পাওয়ার জন্য সংশ্লিষ্ট শ্রমিকদের যুক্তিসঙ্গত হারে মজুরি প্রদানের বিষয়টি নিশ্চিত করতে হবে? রাষ্ট্রের নীতিকাঠামোয় বিত্তবানদের প্রতি এরূপ পক্ষপাত আর বিত্তহীনের প্রতি বিরূপতা অব্যাহত থাকলে আগামী দিনের বাংলাদেশে সম্পদবৈষম্য আরো প্রকট আকার ধারণ করলে তাতে মোটেও অবাক হওয়ার কিছু থাকবে না।

রাষ্ট্রীয় নীতিমালার অন্যান্য অনেক ক্ষেত্রেই পরিস্থিতি মোটামুটি একই রকম, যা কখনো প্রত্যক্ষভাবে আবার কখনোবা পরোক্ষে সম্পদবৈষম্যকেই ক্রমাগত উৎসাহিত করে চলেছে। এ পরিস্থিতিতে মনে রাখা প্রয়োজন, ১৯৫০ ও ১৯৬০-এর দশকে এ দেশের আত্মমর্যাদাবোধসম্পন্ন প্রতিবাদী-সংগ্রামী মানুষ শুধু একটি ভূখণ্ডের জন্য আন্দোলন করেনি। তাদের সে আন্দোলনের অন্তর্মূলে প্রোথিত ছিল বৈষম্য ও শোষণের বিরুদ্ধে প্রতিবাদের চেতনা। বস্তুত সেটাই হচ্ছে এ দেশে মুক্তিযুদ্ধের মৌল চেতনা। ফলে মুক্তিযুদ্ধের চেতনায় দেশ গড়ার প্রসঙ্গ যদি আসে, তাহলে মানতেই হবে যে, বিদ্যমান আমলা নিয়ন্ত্রিত রাষ্ট্রীয় নীতিমালায় পুঁজি ও বিত্তের পক্ষে যে অকুণ্ঠ সমর্থন এবং বিপরীতে সাধারণ মানুষের স্বার্থের প্রতি যে উপেক্ষা সেটি দূরীভূত করতে না পারলে মুক্তিযুদ্ধের চেতনাপুষ্ট শোষণমুক্ত বৈষম্যহীন সমাজ এ দেশে কখনই প্রতিষ্ঠা করা সম্ভব হবে না। বিপরীতে বরং এসব নীতিমালার সমর্থন নিয়ে বিত্তবানরা আরো বিত্তবান হয়ে উঠবে, যেমনটি হয়ে উঠেছিল তত্কালীন পাকিস্তানের ২২ পরিবার। আর পুঁজির ধর্ম অনুযায়ী, সে বিত্তের শোষণে সাধারণ মানুষ হয়ে পড়বে আরো অধিক অসহায়। কিন্তু ১৯৫০ ও ১৯৬০-এর দশকের বাঙালি সে শোষণ ও অসহায়ত্বকে মেনে নেয়নি; বরং উল্টো প্রতিবাদ করেছে, যার ফল আজকের স্বাধীন বাংলাদেশ। কিন্তু দেশ স্বাধীন হয়ে গেল বলে কি সে প্রতিবাদ আজ অপ্রাসঙ্গিক? মোটেও না। তবে হ্যাঁ, সে প্রতিবাদের ধরন ও কৌশল হতে হবে ভিন্নতর। পাকিস্তান আমলে সামরিক শাসকরা নিজেদের ক্ষমতা টিকিয়ে রাখার জন্য রাষ্ট্রীয় সমর্থনেই শোষণের ওই কাঠামোকে নিয়মসিদ্ধ করে দিয়েছিল। কিন্তু স্বাধীন বাংলাদেশের গণতান্ত্রিক সরকার কেন বৈষম্যসহায়ক রাষ্ট্রীয় নীতির পক্ষ নেবে? ফলে বাংলাদেশের রাজনৈতিক সরকারকেই বরং বৈষম্যমুখী আমলাতান্ত্রিক নীতিকাঠামোর বিপরীতে দাঁড়িয়ে সমাজে ন্যায় ও সাম্য প্রতিষ্ঠার অনুগামী নীতিমালা প্রণয়ন করতে হবে, যা ২২ বা ২২০০ পরিবারের পরিবর্তে প্রতিটি সাধারণ মানুষের স্বার্থ ও স্বাধীনতাকে নিশ্চিত করবে। আর তা করা গেলেই কেবল ধনীদের সম্পদ বৃদ্ধির হারের তালিকার শীর্ষস্থান থেকে বাংলাদেশের পক্ষে বেরিয়ে আসা সম্ভব হবে এবং মুক্তিযুদ্ধের প্রকৃত চেতনায় বিশ্বাস করলে সেটি এ দেশকে করতেই হবে। নইলে এত সংগ্রাম ও ত্যাগের মূল্যটা থাকে কোথায়?


লেখক : পরিচালক
আবু তাহের খান
ক্যারিয়ার ডেভেলপমেন্ট সেন্টার
ড্যাফোডিল ইন্টারন্যাশনাল ইউনিভার্সিটি
atkhan56@gmail.com


Source: gg.gg/ccnzr

http://bonikbarta.net/bangla/news/2018-11-07/176012/%E2%80%98%E0%A6%AC%E0%A6%BE%E0%A6%87%E0%A6%B6-%E0%A6%AA%E0%A6%B0%E0%A6%BF%E0%A6%AC%E0%A6%BE%E0%A6%B0%E0%A7%87%E2%80%99%E0%A6%B0-%E0%A6%AA%E0%A7%81%E0%A6%A8%E0%A6%B0%E0%A7%81%E0%A6%A4%E0%A7%8D%E0%A6%A5%E0%A6%BE%E0%A6%A8---/

Pages: [1] 2