Show Posts

This section allows you to view all posts made by this member. Note that you can only see posts made in areas you currently have access to.


Topics - najim

Pages: 1 ... 5 6 [7]
91
শাওয়াল মাসের ৬ রোজা রাখার ফযীলত :

প্রিয় নবী মুহাম্মাদ (সা.) বলেছন, "যে ব্যক্তি রমযানের রোযা রাখার পরে-পরেই শাওয়াল মাসে ৬টি রোযা রাখে, সে যেনো পূর্ণ এক বছর (৩৬৫ দিন) রোযা রাখার সমান সওয়াব লাভ করে।"
(মুসলিম ১১৬৪, আবু দাউদ, তিরমিযী, নাসায়ী ও ইবনে মাজাহ)

সুবাহানাল্লাহ !! আলহামদুলিল্লাহ !! এই সওয়াব এই জন্য যে, কেউ একটি ভালো কাজ করলে আল্লাহর অনুগ্রহে সে তার ১০ গুণ সওয়াব পাবে। দয়াময় আল্লাহ বলেন ,
, "কেউ কোনো ভালো কাজ করলে সে তার ১০ গুণ প্রতিদান পাবে। " সুরা আল-আন'আম, আয়াত ১৬০।
অতএব, এই ভিত্তিতে ৩০+৬ = ৩৬টি রোযা রাখলে ৩৬×১০ = ৩৬০ অর্থাত চন্দ্র মাস অনুআয়ী সারা বছর রোযা রাখার সমান সওয়াব পাওয়া যাবে। শাওয়াল মাসের ৬ রোযা ঈদ-উল-ফিতরের পর দিন থেকে মাসের শেষ দিন পর্যন্ত কোনো বিরতি না দিয়ে অথবা ভেঙ্গে ভেঙ্গে রাখা যায়। দুইটাই সমান ও জায়েজ। আমাদের দেশে শাওয়াল মাসের ৬ রোযাকে সাক্ষি রোযা বলা হয়, এটা ভুল। কারণ কোরান হাদীসের কোথাও একে সাক্ষী রোযা বলা হয় নি। আল্লাহ আমাদের সকলকে শাওয়াল মাসের ৬ রোযা রেখে সারা বছর রোযা রাখার সমান সওয়াব পাওয়ার তোওফিক দান করুন, আমীন

92

ছাদাক্বাতুল ফিতরের বিধান


লেখকঃ মুহাম্মাদ লিলবর আল-বারাদী



আল্লাহ তা‘আলা মানুষকে উদ্দেশ্যবিহীন সৃষ্টি করেননি। তিনি বলেন,

 وَمَا خَلَقْتُ الْجِنَّ وَالْإِنْسَ إِلاَّ لِيَعْبُدُوْنِ

‘আমি জিন ও মানবজাতিকে কেবল আমার ইবাদতের জন্যই সৃষ্টি করেছি’ (যারিয়াত ৫১/৫৬)

ইবাদত এমন একটি ব্যাপক শব্দ যা প্রকাশ্যে ও অপ্রকাশ্যে পালনকৃত এমন সব কথা ও কাজের সমষ্টি, যা আল্লাহ পসন্দ করেন ও ভালবাসেন। আল্লাহর ইবাদত গ্রহণীয় হওয়ার জন্য দু’টি শর্ত রয়েছে। এক. একমাত্র আল্লাহর উদ্দেশ্যে সমস্ত ইবাদত হ’তে হবে। দুই. রাসূলুল্লাহ (ছাঃ)-এর সুন্নাতী পন্থা অনুযায়ী তা পালন করতে হবে।

ইবাদত পালনে ত্রুটি-বিচ্যুতি হ’লে আল্লাহ ক্ষতি পুষিয়ে নেয়ারও ব্যবস্থা রেখেছেন। ছিয়াম হ’ল মহান আল্লাহর ইবাদতের মধ্যে অন্যতম। আর এই ছিয়াম পালনে যে সকল ত্রুটি-বিচ্যুতি হয়ে থাকে, তার ক্ষতি পুষিয়ে নেয়ার জন্য ছাদাক্বাতুল ফিতর আদায়ের বিধান রেখেছেন। এ বিধান আমাদের সুবিধার্থে পরিবর্তন ও পরিমার্জন করা সমীচীন নয়। কেননা ইসলাম হ’ল একমাত্র অভ্রান্ত, ত্রুটিমুক্ত ও পূর্ণাঙ্গ জীবন ব্যবস্থা।

দ্বীন ইসলাম যখন পূর্ণতা পেয়েছে, তখন অপূর্ণতার সংশয় মনে ঠাঁই দেয়া নিতান্তই মূর্খতা। সুতরাং দ্বীনকে অপূর্ণাঙ্গ মনে করার অর্থই হ’ল কুরআন-হাদীছের অপূর্ণতা (নাঊযুবিল্লাহ)। আর এটা অসম্ভব, অযৌক্তিক ও ভ্রান্ত ধারণা মাত্র। পূর্ববর্তী নবী-রাসূলগণের প্রতি অবতীর্ণ আসমানী গ্রন্থ বিকৃত হয়েছে। কিন্তু শেষ নবী মুহাম্মাদ (ছাঃ)-এর প্রতি অবতীর্ণ কুরআন অবিকৃত অবস্থায় বিদ্যমান। তবে রাসূল (ছাঃ)-এর হাদীছ বিকৃত করার অপপ্রয়াস চলেছে নানাভাবে। কিন্তু বিভিন্ন মুহাদ্দিছগণের অক্লান্ত পরিশ্রমে তা আজও অম্লান রয়েছে। তথাপিও কিছু লোক ক্বিয়াস দ্বারা ছহীহ হাদীছ বিকৃত করে চলেছে। যেমন ছাদাক্বাতুল ফিতর খাদ্যদ্রব্যের পরিবর্তে তার সমমূল্য দিয়ে আদায় করা। আলোচ্য নিবন্ধে ছাদাক্বাতুল ফিতরের বিধান সম্পর্কে আলোকপাত করা হ’ল।-

ছাদাক্বাতুল ফিতর কার উপর ফরয :
ছাদাক্বাতুল ফিতর মুসলমান নারী-পুরুষ, ছোট-বড়, সকলের জন্য আদায় করা ফরয। এ মর্মে হাদীছে এসেছে,

عَنِ ابْنِ عُمَرَ قَالَ فَرَضَ رَسُوْلُ اللهِ صلى الله عليه وسلم زَكَاةَ الْفِطْرِ صَاعًا مِنْ تَمَرٍ أَوْ صَاعًا مِنْ شَعِيْرٍ عَلَى الْحُرِّ وَالْعَبْدِ وَالذَّكَرِ وَالأُنْثَى وَالصَّغِيْرِ وَالْكَبِيْرِ مِنَ الْمُسْلِمِيْنَ وَأَمَرَ بِهَا أَنْ تُؤَدَّى قَبْلَ خُرُوْجِ النَّاسِ إِلَى الصَّلاَةِ.
ইবনে ওমর (রাঃ) বলেন, রাসূলুল্লাহ (ছাঃ) স্বীয় উম্মতের ক্রীতদাস ও স্বাধীন, নারী ও পুরুষ, ছোট ও বড় সকলের উপর মাথা পিছু এক ছা‘ পরিমাণ খেজুর বা যব যাকাতুল ফিৎর হিসাবে ফরয করেছেন এবং তা ঈদগাহের উদ্দেশ্যে বের হওয়ার পূর্বেই আদায় করার নির্দেশ দিয়েছেন’। [1]

 ঈদের দিন সকালেও যদি কেউ মৃত্যুবরণ করেন, তার জন্য ফিৎরা আদায় করা ফরয নয়। আবার ঈদের দিন সকালে কোন বাচ্চা ভূমিষ্ঠ হ’লে তার পক্ষ থেকে ফিৎরা আদায় করা ফরয। [2] ছাদাক্বাতুল ফিতর হ’ল জানের ছাদাক্বা, মালের নয়। বিধায় জীবিত সকল মুসলিমের জানের ছাদাক্বা আদায় করা ওয়াজিব। কোন ব্যক্তি ছিয়াম পালনে সক্ষম না হ’লেও তার জন্য ফিৎরা ফরয।

ছাদাক্বাতুল ফিতরের পরিমাণ :
প্রত্যেকের জন্য মাথাপিছু এক ছা‘ খাদ্যশস্য যাকাতুল ফিৎর হিসাবে বের করতে হবে। ‘ছা’ হচ্ছে তৎকালীন সময়ের এক ধরনের ওযন করার পাত্র। নবী করীম (ছাঃ)-এর যুগের ছা‘ হিসাবে এক ছা‘-তে সবচেয়ে ভাল গম ২ কেজি ৪০ গ্রাম হয়। বিভিন্ন ফসলের ছা‘ ওযন হিসাবে বিভিন্ন হয়। এক ছা‘ চাউল প্রায় ২ কেজি ৫০০ গ্রাম হয়। তবে ওযন হিসাবে এক ছা‘ গম, যব, ভুট্টা, খেজুর ইত্যাদি ২ কেজি ২২৫ গ্রামের বেশী হয়। ইরাকী এক ছা‘ হিসাবে ২ কেজি ৪০০ গ্রাম অথবা প্রমাণ সাইজ হাতের পূর্ণ চার অঞ্জলী চাউল। বর্তমানে আমাদের দেশে এক ছা‘তে আড়াই কেজি চাউল হয়।

অর্ধ ছা‘ ফিতরা আদায় করা সুন্নাত বিরোধী কাজ। মু‘আবিয়া (রাঃ)-এর যুগে মদীনায় গম ছিল না। সিরিয়া হ’তে গম আমদানী করা হ’ত। তাই উচ্চ মূল্যের বিবেচনায় তিনি অর্ধ ছা‘ গম দ্বারা ফিৎরা দিতে বলেন। কিন্তু বিশিষ্ট ছাহাবী আবু সাঈদ খুদরী (রাঃ) সহ অন্যান্য ছাহাবীগণ মু‘আবিয়া (রাঃ)-এর এই ইজতিহাদী সিদ্ধান্তের বিরোধিতা করেন এবং রাসূলুল্লাহ (ছাঃ)-এর নির্দেশ ও প্রথম যুগের আমলের উপরেই কায়েম থাকেন। যারা অর্ধ ছা‘ গম দ্বারা ফিৎরা আদায় করেন, তারা মু‘আবিয়া (রাঃ)-এর রায়ের অনুসরণ করেন মাত্র। ইমাম নবভী (রহঃ) বলেন, সুতরাং অর্ধ ছা‘ ফিৎরা আদায় করা সুন্নাহর খেলাপ। রাসূল (ছাঃ) যাকাতের ও ফিতরার যে হার নির্ধারণ করে দিয়েছেন তা রদবদল করার অধিকার কারো নেই। [3]

এ ব্যাপারে ওমর (রাঃ) একটি ফরমান লিখে আমর ইবনে হাযম (রাঃ)-এর নিকটে পাঠান যে, যাকাতের নিছাব ও প্রত্যেক নিছাবে যাকাতের যে, হার তা চির দিনের জন্য আল্লাহ তাঁর রাসূলের মাধ্যমে নির্দিষ্ট করে দিয়েছেন। এতে কোন যুগে, কোন দেশে কমবেশী অথবা রদবদল করার অধিকার কারো নেই। [4]

ছাদাক্বাতুল ফিতর আদায় ও বণ্টনের সময়কাল :
ছাদাক্বাতুল ফিতর ঈদের দু’এক দিন পূর্বে আদায় ও পরে বণ্টন করা ওয়াজিব। ঈদুল ফিতরের পূর্বে ছাহাবায়ে কেরাম বায়তুল মাল জমাকারীর নিকটে ফিৎরা জমা করতেন। ফিৎরা আদায়ের এটাই সুন্নাতী পন্থা, যা ঈদের ছালাতের পর হক্বদারগণের মধ্যে বণ্টন করতে হবে। [5]

ইবনে ওমর (রাঃ) বলেন,

রাসূলুল্লাহ (ছাঃ) ঈদগাহে যাওয়ার পূর্বে ছাদাক্বাতুল ফিতর আদায় করার নির্দেশ দিয়েছেন। [6]

অন্যত্র রয়েছে, ঈদের ছালাতের পূর্বে দায়িত্বশীলের কাছে ফিৎরা জমা করা ওয়াজিব। [7]

ইবনে ওমর (রাঃ) ঈদের দু’এক দিন পূর্বে জমাকারীর কাছে ফিৎরা পাঠাতেন। [8]

ইবনে আববাস (রাঃ) বলেন,

রাসূলুল্লাহ (ছাঃ) ছিয়াম পালনকারীর জন্য ছাদাক্বাতুল ফিতর আদায় অপরিহার্য করে দিয়েছেন। যে ব্যক্তি ঈদের ছালাতের পূর্বে আদায় করবে তা ছাদাক্বাতুল ফিতর হিসাবে গণ্য হবে। আর যে ব্যক্তি ঈদের ছালাতের পর আদায় করবে তা সাধারণ ছাদাক্বা হিসাবে গণ্য হবে। [9]

ঈদের ছালাতের পূর্বে ফিৎরা বণ্টন করার কোন প্রমাণ পাওয়া যায় না। বরং পরে বণ্টনের প্রমাণ পাওয়া যায়। [10] ইবনে ওমর (রাঃ) অনুরূপভাবে জমা করতঃ ঈদের ছালাতের পরে হক্বদারগণের মধ্যে বণ্টন করতেন। [11] অনেকে মনে করেন, ঈদের ছালাতের পূর্বে বণ্টন করা হ’লে গরীবদের সুবিধা হবে। কিন্তু এ মর্মে যে কয়টি বর্ণনা এসেছে, তা গ্রহণযোগ্য নয়। [12] সুতরাং মহান আল্লাহ তাঁর রাসূলের মাধ্যমে ফিৎরা বণ্টনের জন্য যে সময় নির্ধারণ করে দিয়েছেন তা পালন করা আবশ্যক।

ফিতরা পাওয়ার হক্বদারগণ :
ছাদাক্বাতুল ফিতর এলাকার অভাবী ও দরিদ্র মানুষের মাঝে বণ্টন করবে। কেননা ধনীদের সম্পদে গরীবের হক্ব আছে। মহান আল্লাহ বলেন,

‘ধনীদের সম্পদে রয়েছে, ফকীর, বঞ্চিতদের অধিকার’ (যারিয়াত ৫১/১৯)

এতদ্ব্যতীত যাকাত আদায়ের নিম্নোক্ত আটটি খাতেও ফিতরা বণ্টন করা যাবে। মহান আল্লাহ বলেন,

 إِنَّمَا الصَّدَقَاتُ لِلْفُقَرَاءِ وَالْمَسَاكِيْنَ وَالْعَامِلِيْنَ عَلَيْهَا وَالْمُؤَلَّفَةِ قُلُوْبُهُمْ وَفِي الرِّقَابِ وَالْغَارِمِيْنَ وَفِيْ سَبِيْلِ اللهِ وَابْنِ السَّبِيْلِ فَرِيْضَةً مِّنَ اللهِ وَاللهُ عَلِيْمٌ حَكِيْمٌ

‘যাকাত হ’ল কেবল ফকীর, মিসকীন, যাকাত আদায়কারী ও যাদের চিত্ত আকর্ষণ প্রয়োজন তাদের হক্ব এবং তা দাস মুক্তির জন্য, ঋণগ্রস্তদের জন্য, আল্লাহর পথে জিহাদকারীদের জন্য ও মুসাফিরদের জন্য। এই হ’ল আল্লাহর নির্ধারিত বিধান’ (তওবা ৯/৬০)

উপরোক্ত আয়াতে আল্লাহ যাদের কথা বলেছেন তারা প্রত্যেকেই যাকাত পাওয়ার হক্বদার।

ছাদাক্বাতুল ফিতর কোন বস্ত্ত দ্বারা আদায় ওয়াজিব :
প্রত্যেক দেশের প্রধান খাদ্য দিয়ে ফিৎরা আদায় করবে। এ মর্মে হাদীছে এসেছে,

عَنْ أَبِى رَجَاءٍ قَالَ سَمِعْتُ ابْنَ عَبَّاسٍ يَخْطُبُ عَلَى مِنْبَرِكُمْ يَعْنِى مِنْبَرَ الْبَصْرَةِ، يَقُولُ صَدَقَةُ الْفِطْرِ صَاعٌ مِنْ طَعَامٍ.

আবু রাজা‘ (রহঃ) বলেন, আমি ইবনু আববাস (রাঃ)-কে তোমাদের মিম্বরে অর্থাৎ বছরার মিম্বরে দাঁড়িয়ে খুৎবা দানরত অবস্থায় বলতে শুনেছি, ছাদাক্বাতুল ফিতরের পরিমাণ হ’ল মাথাপিছু এক ছা‘ খাদ্যদ্রব্য। [13]

عَنْ أَبِيْ سَعِيْدٍ الْخُدْرِىَّ رضى الله عنه يَقُوْلُ كُنَّا نُخْرِجُ زَكَاةَ الْفِطْرِ صَاعًا مِنْ طَعَامٍ، أَوْ صَاعًا مِنْ شَعِيْرٍ، أَوْ صَاعًا مِنْ تَمَرٍ، أَوْ صَاعًا مِنْ أَقِطٍ، أَوْ صَاعًا مِنْ زَبِيْبٍ.

আবু সাঈদ খুদরী (রাঃ) হ’তে বর্ণিত তিনি বলেন, আমরা যাক্বাতুল ফিতর আদায় করতাম এক ছা‘ খাদ্য (طعام) অথবা এক ছা‘ যব বা এক ছা‘ খেজুর অথবা এক ছা‘ পনীর অথবা এক ছা‘ কিশমিশ দিয়ে। [14]

আমাদের এই কৃষি প্রধান দেশে প্রধান খাদ্য (طعام) চাউল। সেকারণ চাউল দিয়ে ছাদাক্বাতুল ফিতর আদায় করাই উত্তম। খাদ্যশস্যের মূল্য দিয়ে ছাদাক্বাতুল ফিতর প্রদানের স্বপক্ষে কুরআন-হাদীছে স্পষ্ট কোন দলীল নেই। সুতরাং মুদ্রা দিয়ে ফিৎরা আদায় করা কোন বিশিষ্ট জনের তাক্বলীদ (অন্ধ অনুসরণ) বৈ কিছুই নয়।

আল্লাহর রাস্তায় দান-খয়রাত করতে হ’লে নবী করীম (ছাঃ) প্রদর্শিত পন্থায়ই তা করা অপরিহার্য। তাছাড়া চার খলীফা, ছাহাবীগণ, তাবেঈ, তাবে-তাবেঈগণ সকলেই খাদ্যদ্রব্য দিয়ে ফিৎরা আদায় করেছেন। খাদ্যশস্যের মূল্যে ফিৎরা আদায়ের স্বপক্ষে একটি দুর্বল, মওযূ হাদীছও প্রমাণ হিসাবে পাওয়া যায় না। সুতরাং খাদ্যশস্য দিয়েই ফিৎরা আদায় করতে হবে।

খাদ্যশস্যের মূল্য দ্বারা ফিৎরা আদায় :
খাদ্যশস্য ব্যতীত অর্থ কিংবা দীনার-দিরহাম দিয়ে ফিৎরা আদায় করেছেন মর্মে রাসূলুল্লাহ (ছাঃ), ছাহাবায়ে কেরাম, তাবেঈ ও তাবে-তাবেঈদের কোন আমল পাওয়া যায় না। খাদ্যশস্যের স্বপক্ষেই হাদীছে এসেছে। আবু সাঈদ খুদরী (রাঃ) বলেন, আমরা খাদ্যশস্য(طعام) যব, খেজুর, পনীর, কিশমিশ দিয়ে যাকাতুল ফিতর আদায় করতাম। [15]

طعام শব্দটির অর্থ হ’ল খাদ্য। পরিভাষায় যা দিয়ে ক্ষুধা নিবারণ করা যায়, তাই طعام।  طعام দ্বারা টাকা-পয়সা বুঝায় না। তাছাড়াও রাসূলুল্লাহ (ছাঃ)-এর পূর্ব যুগ হ’তেই মক্কা-মদীনায় দিরহাম-দীনার প্রভৃতি মুদ্রার প্রচলন ছিল। কিন্তু তিনি এক ছা‘ খাদ্যশস্যের মূল্য হিসাবে দিরহাম প্রদানের নির্দেশ দেননি। বরং খাদ্যশস্য দিয়ে ছাদাক্বাতুল ফিতর আদায় ওয়াজিব করেছেন।

খাদ্যশস্য ব্যতীত মূল্য দিয়ে ফিৎরা প্রদানে অনেক বৈষম্যের সৃষ্টি হয়। যেমন-

নং

ব্যক্তির নাম

চাউলের নাম

প্রতি কেজি

২১/২  কেজির মূল্য

মূল্য পার্থক্য

১   আব্দুল করীম   মিনিকেট   ৭০/=   ১৭৫/=   ১০০/=
২   আব্দুর রহীম   দাউদকানী   ৬০/=   ১৫০/=   ৭৫/=
৩   আব্দুস সালাম   জিরাশাল   ৫০/=   ১২৫/=   ৫০/=
৪   আব্দুল জববার   ব্রি ২৮   ৪০/=   ১০০/=   ২৫/=
৫   আব্দুস সাত্তার   গুটি স্বর্ণা   ৩০/=   ৭৫/=   ০০/=
এখানে আব্দুল করীম সবচেয়ে দামী ও আব্দুস সাত্তার কম দামী চাউলের ভাত খায়। এদের দু’জনে ছাদাক্বাতুল ফিতর হিসাবে খাদ্যশস্যের পরিবর্তে যদি মূল্য প্রদান করা হয়, তাহ’লে আড়াই কেজি চাউলের মূল্যের পার্থক্য হবে ১০০/= টাকা। কিন্তু তারা উভয়েই যদি খাদ্যশস্য দিয়ে ফিৎরা আদায় করে, তবে তাদের পরিমাণ আড়াই কেজি বা একই সমান হবে। তাছাড়া বণ্টনের সময় হতদরিদ্র ব্যক্তি সবচেয়ে দামী চাউলের ছাদাক্বা পেয়েও খুশী হবে।

খাদ্যশস্যের মূল্য দিয়ে ফিৎরা আদায় করা, ছাদাক্বা ক্রয় করার নামান্তর। যা ইসলামে নিষিদ্ধ। আব্দুল্লাহ ইবনে ওমর (রাঃ) বলেন, ওমর (রাঃ) তাঁর একটি ঘোড়া এক ব্যক্তিকে সওয়ার হওয়ার জন্য আল্লাহর রাস্তায় ছাদাক্বা করে দিলেন, যে ঘোড়াটি রাসূল (ছাঃ) তাকে দান করেছিলেন। তারপর তিনি (ওমর) খবর পেলেন, লোকটি ঘোড়াটি বাজারে বিক্রি করছে। এ খবর শুনে ওমর (রাঃ) রাসূলুল্লাহ (ছাঃ)-কে জিজ্ঞেস করলেন, ‘আমি কি ঘোড়াটি ক্রয় করতে পারি? রাসূল (ছাঃ) জবাবে বললেন, তা ক্রয় কর না এবং তোমার ছাদাক্বা ফেরৎ নিও না। [16] আলোচ্য হাদীছ হ’তে প্রমাণিত হয় যে, যে কোন প্রকারের ছাদাক্বা ক্রয় করা হারাম। যদি ক্রয় করা হালাল হ’ত তবে রাসূলুল্লাহ (ছাঃ) ওমর (রাঃ)-কে ক্রয় করার অনুমতি দিতেন এবং ফিৎরা খাদ্যশস্যের পরিবর্তে দিরহাম-দীনার প্রদানের অনুমতিও দিতেন। কিন্তু তিনি তা করেননি। চার খলীফা, ছাহাবী, তাবেঈ, তাবে-তাবেঈ কেউই অনুরূপভাবে ছাদাক্বা ক্রয় করার পক্ষে ছিলেন না।

যারা ফিৎরা দ্রব্যমূল্যে (টাকায়) প্রদানের স্বপক্ষে তাদের উদ্দেশ্য কি তা আদৌ বোধগম্য নয়। কেননা ফিৎরা হ’ল ফরয এবং কুরবানী হ’ল সুন্নাত। ফরযকে যদি পরিবর্তন অথবা পরিমার্জন করা জায়েয হয়, তাহ’লে কুরবানীর পরিবর্তে তার মূল্য প্রদানে বাধা কোথায়? নিয়ত তো বেশ ছহীহ। যেহেতু কুরবানীর সমমূল্য জায়েয নয়। সুতরাং ফিতরার মূল্য প্রদানও জায়েয নয়। এ সম্পর্কে ইবনে তায়মিয়াহ (রহঃ) বলেন, ‘যদি কেউ কুরবানীর বদলে তার মূল্য ছাদাক্বা করতে চান, তবে তিনি মুহাম্মাদী শরী‘আতের প্রকাশ্য বিরোধিতা করবেন’। [17]

অতএব পরকালে পরিত্রাণের নিমিত্তে পবিত্র কুরআন ও ছহীহ হাদীছ অনুযায়ী আমল করা আমাদের সকলের জন্য অপরিহার্য। অন্যথা ইহকাল ও পরকালে ক্ষতিগ্রস্ত হ’তে হবে। আল্লাহ আমাদেরক হেফাযত করুন - আমীন!!

93

কুর’আনের দিকে প্রত্যাবর্তন


লেখকঃ মনসূর আহমেদ | অনুবাদকঃ মোহাম্মদ সলিমুল্লাহ



নিঃসন্দেহে কুর’আনের সাথে আমাদের সম্পর্ক অনেক গুরুত্বপূর্ণ; কিন্তু আশ্চর্যের কথা হল আমারা বলতে গেলে তা ভুলে যাই।

আমাদের কুর’আনকে গুরুত্ব না দেয়ার বিষয়টি আমার কাছে একটি তত্ত্বীয় ব্যাপার বলে মনে হয়। আর এক্ষেত্রে তত্ত্বটি হলঃ মানুষ স্বভাবতই বিতর্ক প্রিয়। পক্ষান্তরে, কুর’আনের জ্ঞান সমস্ত বিতর্কের ঊর্ধ্বে। ফলে যা হয় তা হল মানুষ বিতর্কহীন কুর’আনের প্রতি বেশী সময় ধরে আগ্রহ ধরে রাখতে পারেনা। কারণ, আগেই বলেছি, স্বভাবগতভাবেই মানুষ বিতর্ক করতে ভালবাসে।

ঈদের চাঁদ দেখা কিংবা কুরবানীর জবেহকৃত পশুর গোশত বণ্টন ইত্যাদি বিষয়গুলোর পক্ষে-বিপক্ষে আমরা বিতর্কে লিপ্ত হয়ে থাকি। কারণ এ বিষয়গুলো নিয়ে কথা বলতে গেলে কিছুটা হলেও পুঁথিগত বিদ্যার প্রয়োজন যে বিদ্যা জাহির করে প্রতিপক্ষকে কুপোকাত করার একটা সুবর্ণ সুযোগ থাকে। আর প্রতিপক্ষের কুপোকাত হওয়াটা আমাদেরকে এক সস্তা মানসিক আত্মপ্রসাদ দান করে যা নিয়েই আমরা তৃপ্তির ঢেকুর তুলতে থাকি। কুর’আনে কিন্তু এমন বিতর্ক নেই, কারণ বাস্তবে কি কেউ তাজবীদ (কুরআন তেলাওয়াতের নিয়ম-কানুন) বা কিরা’আত (কুর’আন তেলাওয়াতের শিল্প) এমন অতি ক্ষুদ্র বিষয়ে তর্ক করে?

আল্লাহ্‌ রাব্বুল ‘আলামীন কুর’আন আল-কারীমে বলছেন যে নাবী মুহাম্মাদ (সা) তাঁর উম্মাহ্‌ তথা আমাদের বিরুদ্ধে একটি অভিযোগ করবেন। তিনি (সা) এই অভিযোগ করবেন না যে তাঁর (সা) উম্মাহ্‌ ৮ রাকা’আতের স্থলে ২০ রাকা’আত বা ১০ রাকা’আতের স্থলে ৮ রাকা’আত সলাত আদায় করেছে, বরং তাঁর (সা) অভিযোগ হবে এই যে তারা (আমরা) প্রতি ক্ষেত্রেই কুর’আনকে পরিত্যাগ করে আমাদের কাজকর্ম সম্পাদন করেছি।

“রাসূল (সা) বললেনঃ ‘হে আমার প্রতিপালক! আমার সম্প্রদায় এই কুর’আনকে পরিত্যাজ্য মনে করে।” [সূরা আল-ফুরকান; ২৫:৩০]

আসুন, বিষয়টি নিয়ে আরেকটু ভাবা যাক। কুর’আনের সাথে আমাদের সম্পর্ক কিসের? হৃদয়ের সর্বোচ্চ স্থানে না রেখে কুর’আনকে কি আমরা গৃহের দামী বুক শেলফের সর্বোচ্চ তাকে সাজিয়ে রেখেছি? তাকে কি আমরা সারাবছর তুলে রাখি শুধু রমজানে না বুঝে তেলাওয়াত করার জন্য? শুদ্ধ উচ্চারনে এবং তাজবীদ সহকারে কি কুর’আন পড়তে পারি আমরা? কখনো কি কুর’আন পড়ে বোঝার চেষ্টা করি এই অভ্রান্ত সত্যের কিতাব আমাদের কি করতে বলে? কেন আমাদের আত্মিক বা দৈনন্দিন জীবনে কুর’আনের কোনো প্রভাব পরিলক্ষিত হয় না?

প্রথমে যা বলছিলাম-আমরা বিতর্ক পছন্দ করি। কিন্তু প্রশ্ন হল, কেন বিতর্ক শুধু তুচ্ছাতিতুচ্ছ বিষয় নিয়ে যেখানে মাথা ঘামানোর মত আরো অনেক জটিল বিষয় পড়ে আছে? আর বিতর্ক যদি হয় ধর্মের কোন মৌলিক বিষয় নিয়ে তাহলে কেন আমরা কুর’আন থেকে সে বিষয়ের সমাধান পাওয়ার চেষ্টা করিনা? আল্লাহ্‌ রাব্বুল ‘আলামীন বলেনঃ

“এবং আল্লাহ্‌র রজ্জুকে মজবুতভাবে আঁকড়ে থাক আর কখনো বিচ্ছিন্ন হয়ো না।” [সূরা আল-ইমরান; ৩:১০৩]

প্রসিদ্ধ তাফসীরসমূহ অনুসারে এ আয়াতে “আল্লাহ্‌র রজ্জু” হল কুর’আন আল-কারীম। কুর’আন আমাদেরকে সবসময়ই একটি বড় বিষয় মনে করিয়ে দেয়; আর তা হল “কিয়ামত”। কিন্তু কেন?

কেননা, তারাবীতে কত রাকা’আত সলাত আদায় করেছেন তার চেয়ে কিভাবে আদায় করেছেন সেটাই মুখ্য বিষয়। মসজিদে বৃহষ্পতি নাকি শুক্রবার ঈদ পালন করা হল সেটার চাইতে আগের একমাসে কেমন ইবাদত করেছেন সেটাই মুখ্য বিষয়। বিষয়টা আসলে আল্লাহ্‌, তাঁর কিতাব কুর’আন আল-কারীম এবং তাঁর প্রিয় নাবীর (সা) সাথে আমাদের হৃদয়ের টান, হৃদয়ের সম্পর্কের সাথে সংশ্লিষ্ট।

তবে এমনটি মনে করা মোটেই ঠিক হবেনা যে, কুর’আনের নির্ধারিত হুকুম-আহকামের তোয়াক্কা না করেই আল্লাহ্‌ রাব্বুল আলামীনের সাথে আত্মিক সম্পর্ক উন্নয়নের কাজে লেগে যাব। আর বাস্তবেও সেটা কখনই সম্ভব নয়। আমাদের উচিৎ হল সঠিক উপলব্ধির উপর ভিত্তি করে এক ভারসাম্যপূর্ণ অবস্থান ধরে থাকা। একবার এ ভারসাম্যে পৌছে গেলে তার স্বাভাবিক ফল হচ্ছে তখন কোন বিতর্কিত বিষয়গুলো মুসলিম উম্মাহ্‌র মাঝে কোন বিভেদ সৃষ্টিকারী প্রভাব ফেলতে পারবেনা।

লক্ষ্য করলে দেখা যায়, ইসলামের মৌলিক বিষয়গুলো নিয়ে কখনই কোন বিতর্ক হয়না আর সেগুলো নিয়ে বিতর্ক করাও আমাদের কাজ নয়। তবে যে বিষয়গুলো নিয়ে বিতর্ক বা মতানৈক্য হয়ে থাকে সেগুলো যদি কোনভাবেও গুরুত্বপূর্ণ হয় তারপরও গৌণ বিষয়গুলোকে টেনে হিঁচড়ে এতোদূর নিয়ে যাওয়া মোটেই উচিৎ নয় যাতে করে মুসলিম উম্মাহ্‌র ঐক্য এবং ভ্রাতৃত্বের মতো মৌলিক বিষয়গুলো ঝুঁকির মধ্যে পড়ে।

আত্মিক উন্নয়নে কুর’আনের ভুমিকা

“সত্যিকার অর্থে পরিশুদ্ধ হৃদয়ের অধিকারী হলে আমাদের প্রতিপালকের সিদ্ধান্তকে মেনে নেয়ার ব্যাপারে আমরা কখনই বাড়াবাড়ি করতাম না; কুর’আন না পড়ে একটি দিনও কাটুক এমনটি ভাবতেই আমার ঘৃণা হয়।”

 তুচ্ছাতিতুচ্ছ বিষয় নিয়ে তর্ক-বিতর্ক বর্তমান সময়ে একটি অনেক বড় সমস্যা যা মুসলিম উম্মাহ্‌কে চরমভাবে ভুগাচ্ছে। অথচ বিষয়গুলো নিয়ে কোন সমস্যা হবার কথা ছিলনা। এহেন পরিস্থিতি ভবিষ্যতে আরো জটিল পরিস্থিতিরই এক পূর্বাভাস দেয়। আর এসব অনর্থের মুলে হল আমাদের আত্মিক পরিশুদ্ধতার দেউলিয়ত্ব। বিশেষ করে ঈমান সংশ্লিষ্ট বিষয়ে কেউ বিতর্কে লিপ্ত হলে বুঝতে হবে এটা  তার একটা আত্মিক ব্যাধি যা তাকে খামাখা বিতর্কে লিপ্ত করে রাখে। এতে করে ব্যক্তি তার প্রতিপক্ষকে ভুল প্রমাণের মাধ্যমে এক অকৃত্রিম আত্মতৃপ্তি লাভ করে; প্রতিপক্ষকে যুক্তির বাণে ঘায়েল করে নিজের পাশবিক আকাঙ্ক্ষাকে চরিতার্থ করে। এমন ধরনের তর্ক-বিতর্ককে শয়তান মানুষের সম্মুখে আরো সৌন্দর্যমন্ডিত করে তোলে ফলে একজন মনে করে অন্যজন ভুল পথে আছে আর সে তাকে সঠিক পথে নিয়ে আসার চেষ্টায় ব্যস্ত হয়ে অনেক মহান একটি কাজ করছে।

এহেন আচরণ পারস্পারিক অবজ্ঞা আর মানসিক বিতৃষ্ণা সৃষ্টি করে। ফলে মানুষে মানুষে মতানৈক্য সৃষ্টি হয়। অথচ কুর’আনের শিক্ষা হল এমন আচরণের সম্পূর্ণ বিপরীত। আসল কথা হল কুর’আনের সাথে আমাদের সম্পর্কের অবনতির কারনেই এমন পরিস্থিতির উদ্ভব হয়েছে; আর কুর’আনও ঠিক একই কথা বলে। কুর’আন আল-কারীমে আল্লাহ্‌ রাব্বুল ‘আলামীন বলেনঃ

“হে মানব জাতি! তোমাদের কাছে তোমাদের প্রতিপালকের তরফ হতে সমাগত হয়েছে এক নসিহত এবং অন্তরসমূহের সকল রোগের আরোগ্যকারী, আর মু’মিনদের জন্যে পথ প্রদর্শক ও রহমত।” [সূরা ইউনুস; ১০:৫৭]

আমাদের আধ্যাত্মিক উন্নতির জন্য কুর’আন না মেনে কোন উপায় নেই; কুর’আনই আমাদেরকে বারবার মনে করিয়ে দেয় এই বিশ্বজাহানের প্রতিপালক আল্লাহ্‌ রাব্বুল ‘আলামীন; কুর’আনের মাধ্যমেই আমরা এই পার্থিব জীবনের নশ্বরতা, আমাদের শেষ পরিণতি তথা মৃত্যু তারপর পুনরুত্থান, বিচার দিবস, জান্নাত ও জাহান্নামের ইত্যাদির কথা  স্মরণ করে থাকি। এই কুর’আন আমাদের জীবনের প্রতিটি বিষয়কে করে রেখেছে সুসংহত এবং সুসমন্বিত। যা একজন মু’মিনের জন্য আল্লাহ্‌র পক্ষ থেকে আসা অনুগ্রহ শুধুই অনুগ্রহ। অনুগ্রহ মু’মিনের জন্য কখনো অভিশাপ হয়ে আসতে পারে না। এজন্য খলীফা উসমান ইবনে আফফান (রা) বলেনঃ

“সত্যিকার অর্থে পরিশুদ্ধ হৃদয়ের অধিকারী হলে আমাদের প্রতিপালকের সিদ্ধান্তকে মেনে নেয়ার ব্যাপারে আমরা কখনই বাড়াবাড়ি করতাম না; কুর’আন না পড়ে একটি দিনও কাটুক এমনটি ভাবতেই আমার ঘৃণা হয়।”

কাজেই দেখা যাচ্ছে, আমাদের উচিৎ জীবনের প্রতিটি পরতেই কুর’আনকে আঁকড়ে ধারণ করা এবং এমনসব কুতর্ক এড়িয়ে চলা যা কোনভাবেই আমাদের জন্যে কোন প্রকারের কল্যাণ বয়ে আনেনা। প্রকৃতঅর্থেই, কুর’আন হল আমাদের “আত্মার খোরাক”-এটা আমাদের আত্মার পুষ্টি সাধন করে থাকে; আমাদের আত্মাকে বাঁচিয়ে রাখে এবং সর্বোপরি, এটা আমাদের পারলৌকিক জীবনের সাথে সেতু বন্ধন তৈরি করে। পৃথিবীর মাটি থেকেই আমাদের দেহ সৃষ্ট আর এ পৃথিবীতেই আল্লাহ্‌ আমাদের বেঁচে থাকার উপাদান মজুত রেখেছেন। যা কিছুই আমরা খাই তা কোনো না কোনোভাবে মাটি থেকেই উৎপন্ন। আমাদের আত্মা এসেছে আল্লাহ্‌র নিকট থেকে, তাই এর বেঁচে থাকার উপাদান আল্লাহ্‌ পাঠিয়েছেন রূহের জগত থেকে। এজন্য কুর’আনের সংস্পর্শে হৃদয় প্রশান্তি লাভ করে। পক্ষান্তরে, কুর’আন থেকে দূরে সরে গেলে আমাদের হৃদয় তথা আত্মার অপমৃত্যু ঘটে।

আল্লামা হাফিজ ইবনুল কায়্যিম (রহিমাহুল্লাহ্‌) বলেনঃ

“কুর’আন মেনে চলা, আল্লাহ্‌র প্রতি নিভৃতেও বিনয়ী হওয়া ও পাপ পরিত্যাগ করার উপর নির্ভর করে হৃদয়ের বেঁচে থাকা।”

 খাদ্যের অভাবে শরীর যেমন উপোস থাকে ঠিক তেমনি করে কুর’আন থেকে দূরে সরে গেলে মানুষের আত্মাও অভুক্ত থাকে; ফলে জীবন হয়ে ওঠে এক দুঃসহ যন্ত্রণার আঁধার। আর এভাবেই আত্মা তখন তর্ক-বিতর্কের মাঝে তার খোরাক খুঁজে পেতে চেষ্টা করে।

কুর’আনের নির্দেশনাকে গুরুত্ব না দেয়া, কুর’আনের হুকুম মেনে না চলা, কুর’আনকে হেদায়াতের উৎস হিসেবে বিবেচনা না করা, আত্মিক উন্নতি এবং হৃদয়ের অসুখ সারানোর জন্যে কুর’আনকে নিরাময় হিসেবে গ্রহণ না করা ইত্যাদি সবই হল কুর’আন পরিত্যাগ করার সমতুল্য। আল্লামা হাফিজ ইবনুল কায়্যুম (রহিমাহুল্লাহ্‌) এর মতে, উল্লেখিত বিষয়গুলোর সবকটিই নিম্নোক্ত আয়াত দ্বারা স্পষ্ট যেখানে আল্লাহ্‌ রাব্বুল আলামীন বলেনঃ

“রাসূল (সা) বললেনঃ ‘হে আমার প্রতিপালক! আমার সম্প্রদায় এই কুর’আনকে পরিত্যাজ্য মনে করে।” [সূরা আল-ফুরকান; ২৫:৩০]

আমরা লক্ষ্য করলে দেখি যে, কুর’আনের যেখানেই কোন কিছু করার জন্যে নির্দেশ দেয়া হয়েছে সেখানেই উল্লেখ করা হয়েছে আল্লাহ্‌ভীতির কথা না হয় জান্নাত-জাহান্নামের কথা। তবে যা করতে বলা হয়েছে তা করাটাই যথেষ্ট নয়। বিধিনিষেধ মেনে চলার বিষয়গুলো আসলে আধ্যাত্মিকতা এবং আন্তরিকতার সাথে সংশ্লিষ্ট। আন্তরিকতা বিবর্জিত সৎকর্মের ফলাফল শূন্য। আন্তরিকতার সাথে সৎকর্ম সম্পাদন করার মাধ্যমেই নিজের ভেতর কুর’আনের শিক্ষা বিকশিত হতে থাকে। কুর’আনের বিধিনিষেধ মেনে চলার মাধ্যমেই তৈরি হয় স্রষ্টার সাথে সৃষ্টির সম্পর্ক। স্রষ্টার সাথে সম্পর্কের উন্নয়নের মাধ্যমেই মানুষ উপলব্ধি করতে সক্ষম হয় ইবাদতের তাৎপর্য তথা আল্লাহ্‌ রাব্বুল ‘আলামীনের হুকুম মেনে চলার নিহিতার্থ এবং ভ্রাতৃত্বপূর্ণ সমাজ বিনির্মাণের গুরুত্ব।  তাই ব্যক্তির তর্কে লিপ্ত হওয়া এটাই প্রমান করে যে, সে তার স্রষ্টার ইবাদতের ব্যপারে কতটা উদাসীন এবং আন্তরিকতা বিবর্জিত। অথচ স্রষ্টার ইবাদতের অন্যতম উদ্দেশ্য ছিল মানুষকে কুর’আনের শিক্ষায় উদ্বুদ্ধ করে বিতর্ক করা থেকে দূরে রাখা।

কুর’আন প্রতিনিয়তই আমাদেরকে মানব জীবনের সবচেয়ে গুরুত্বপূর্ণ বিষয়টি মনে করিয়ে দিতে থাকে এবং সকলের এক ও অভিন্ন লক্ষ্যের সাথে আমাদের কর্মকাণ্ডকে জুড়ে দেয়। আর সেই এক ও অভিন্ন লক্ষ্য হল চিরস্থায়ী সুখের আবাস জান্নাত অর্জন এবং অনন্ত শাস্তির আবাস জাহান্নাম থেকে পরিত্রাণ। আকীদাহ্‌গত এবং ফক্‌হী কিছু বিষয় আছে যেগুলো অবশ্যই গুরুত্বপূর্ণ তবে সেগুলো কখনই আমাদের পারস্পারিক সম্পর্ককে যাতে বিনষ্ট করে না দেয় সেজন্য আমাদের যত্নবান হওয়া উচিৎ।

 কিভাবে কুর’আনের শিক্ষাকে বাস্তব জীবনে প্রয়োগ করা সম্ভবঃ


জ্ঞান অর্জনের ক্ষেত্রে আমাদের সর্বাগ্রে স্থান পাবে কুর’আন। কুর’আন শিক্ষার বিষয়টিও হতে হবে আমাদের কাছে সর্বাধিক গুরুত্বের।

লক্ষ্য করলে দেখা যাবে যে, জ্ঞানার্জনের ক্ষেত্রে পদ্ধতিগত গলদ আমাদের ভেতরের সাম্প্রদায়িক সমস্যাগুলোর মূল কারণ। এক্ষেত্রে যা মনে রাখতে হবে তা হল প্রতিটি কর্ম সম্পাদনের মত জ্ঞান অর্জনের ক্ষেত্রেও একজন শিক্ষার্থীকে কিছু নির্ধারিত নিয়ম মেনে অগ্রসর হতে হবে।

জ্ঞান অন্বেষণকারী রাতারাতি বিদ্বান হয়ে উঠতে পারেনা। তাকে অনেক কাঠ-খড় পুড়িয়ে ধাপে ধাপে অগ্রসর হতে হয়। জ্ঞান অন্বেষণের প্রথম ধাপ হওয়া চাই কুর’আন। আমরা দেখতে পাই যে, কেউ হৃদরোগ বিশেষজ্ঞ হতে চাইলে তাকে প্রথমে মানবদেহ সম্পর্কে প্রাথমিক জ্ঞানার্জন করে তারপর কোন মেডিকেল বিশ্ববিদ্যালয়ে পড়াশোনা করে উচ্চতর ডিগ্রি অর্জন করতে হয়। সে কখনো প্রথমেই সার্জারি বিষয়ক মোটা মোটা বই পড়া শুরু করেনা। ধর্মীয় জ্ঞান চর্চার ক্ষেত্রেও আমাদেরকে একই মান প্রয়োগ করতে হবে ও মৌলিক বিষয়ের উন্নতিতে গুরুত্বারোপ করতে হবে। শিক্ষার্থীর জ্ঞানার্জন বিষয়ে ইমাম নববী (রাহিমাহুল্লাহ্‌) বলেনঃ

“কাজেই শুরুই করতে হবে কুর’আন হিফয্‌ করার মাধ্যমে কারণ কুর’আন-ই হল জ্ঞানের সর্বশ্রেষ্ঠ এবং সবচেয়ে গুরুত্বপূর্ণ শাখা। সালাফগণ কুর’আনের হাফেজ ছাড়া অন্য কাউকে হাদীস বা ফিক্‌হী শিক্ষা দিতেন না। কুর’আন হিফয্‌ হয়ে গেলে ছাত্রের হাদীস, ফিকহ্‌ বিষয়ক শিক্ষা আরাম্ভ করতে হবে এবং এ বিষয়ে ছাত্রকে সজাগ করে দিতে হবে যাতে হাদীস এবং ফিকহ্‌ পড়তে গিয়ে কুর’আনের কোন অংশ ভুলে না যায়।” (Introduction toal-majomoo’ Sharh ul- Muhadhhab (১/৩৮)

এটাই হল সে পথ যা শ্রেষ্ঠ মনীষী ও বিদ্যার্থীগণ অনুসরণ করেছেন- তারা হাদীস বা ফিক্‌হী শিক্ষায় নিজেদের ব্যাপৃত করার পূর্বে কুর’আনকে অগ্রাধিকার দিয়েছেন; আকীদার বিষয়গুলোকে অনেক কমগুরুত্ব দিয়েছেন যেখানে আমরা এর বিপরীতটাই করে থাকি। আমরা যে জ্ঞানান্বেষণ একেবারেই বাদ দিয়েছি আসল বিষয় তা নয়; বরং আমাদের উচিৎ ধর্মের বিভিন্ন জ্ঞানের ভুমিকাকে প্রকৃত গুরুত্বারোপ করা, যাতে করে  আগ্রহ নিয়ে আমরা যা শিখতে চাই তা এবং ধর্মের মূল হিসেবে আমাদের যা শিখতে হয় তার মাঝে আমরা ভারসাম্য আনতে পারি; অর্থাৎ, জ্ঞানার্জনের ক্ষেত্রে আমরা কুর’আনকে অগ্রাধিকার দেয় ও শিক্ষার ক্ষেত্রে প্রথম স্থানে রাখি। নাবী কারীম (সা) বলেনঃ

“জ্ঞানীর সাথে প্রতিযোগিতা করা বা মূর্খের সাথে তর্ক করা কিংবা মজলিসে জ্ঞান জাহির করার জন্য জ্ঞানার্জন করো না, য&

94

মুসলমানদের ১৫ টি প্রশংসনীয় চারিত্রিক গুণাবলী




লেখক : আদেল বিন আলী আশ-শিদ্দী / আহমদ আল-মাযইয়াদ     

অনুবাদ : সাইফুল্লাহ আহমাদ  |



ইসলামী শরীয়ত হচ্ছে একটি পরিপূর্ণ জীবন পদ্ধতি যা সকল দিক থেকে সার্বিকভাবে মুসলমানের ব্যক্তিগত জীবনকে গঠন করার ব্যাপারে অত্যন্ত গুরুত্বারোপ করেছে এসব দিকের মধ্যে গুনাবলি শিষ্টাচার ও চরিত্রের দিকটি অন্যতম। ইসলাম এদিকে অত্যন্ত গুরুত্বারোপ করেছে। তাইতো আকীদা ও আখলাকের মাঝে সম্পর্ক স্থাপন করে দিয়েছে, যেমন নবী কারীম সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম এরশাদ করেছেন,

“মুমিনদের মধ্যে পরিপূর্ণ ঈমানদার হচ্ছে সে ব্যক্তি, যে তাদের মধ্যে সর্বোত্তম চরিত্রের অধিকারী।” [আহমাদ, আবু দাউদ, তিরমিযি ]

 

সুতরাং উত্তম চরিত্র হচ্ছে ঈমানের প্রমাণবাহী ও প্রতিফলন। চরিত্র ব্যতীত ঈমান প্রতিফলিত হয় না বরং নবী কারীম সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম সংবাদ দিয়েছেন যে, তাঁকে প্রেরণের অন্যতম মহান উদ্দেশ্য হচ্ছে চরিত্রের উত্তম দিকসমূহ পরিপূর্ণ করে দেয়া। রাসূল সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম এরশাদ করেছেন,

“আমি তো কেবল চরিত্রের উত্তম দিকসমূহ পরিপূর্ণ করে দিতে প্রেরিত হয়েছি।”  ইমাম আহমাদ ও ইমাম বুখারী আদাবুল মুফরাদে বর্ণনা করেছেন।

 

এ কারণেই আল্লাহ তাআলা উত্তম ও সুন্দরতম চরিত্রের মাধ্যমে তাঁর নবী সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম এর প্রশংসা করেছেন। আল্লাহ তাআলা বলেন,

 â€œনিশ্চয়ই আপনি মহান চরিত্রে অধিষ্ঠিত।” [সূরা আল, কালাম : ৪]

 

কোথায় এ চরিত্র বর্তমান বস্তুবাদী মতবাদ ও মানবতাবাদী মানুষের মনগড়া চিন্তা চেতনায় ?
যেখানে চরিত্রের দিককে সম্পূর্ণরূপে উপেক্ষা করা হয়েছে, তা শুধু সুবিদাবাদী নীতিমালা ও বস্তুবাদী স্বার্থের উপর প্রতিষ্ঠিত। যদিও তা অন্যদের উপর জুলুম বা নির্যাতনের মাধ্যমে হয়। অন্য সব জাতির সম্পদ লুন্ঠন ও মানুষের সম্মান হানীর মাধ্যমে অর্জিত হয়।

 

একজন মুসলমানের উপর তার আচার-আচরণে আল্লাহর সাথে, নবী সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম এর সাথে, অন্য মানুষের সাথে, এমনকি নিজের সাথে কি ধরনের আচরণ করা উচিত ইসলাম তার এক অভিনব চকমপ্রদ চিত্র অংকন করে দিয়েছে। যখনই একজন মুসলমান বাস্তবে ও তার লেনদেনে ইসলামী চরিত্রের অনুসরণ করে তখনই সে অভিষ্ট পরিপূর্ণতার অতি নিকটে পৌঁছে যায়, যা তাকে আরো বেশি আল্লাহর নৈকট্য লাভ ও উচ্চ মর্যাদার সোপানে উন্নীত হতে সহযোগিতা করে। পক্ষান্তরে, যখনই একজন মুসলমান ইসলামের চরিত্র ও শিষ্টাচার হতে দূরে সরে যায় সে বাস্তবে ইসলামের প্রকৃত প্রাণ চাঞ্চল্য, নিয়ম-নীতির ভিত্তি হতে দূরে সরে যায়। সে যান্ত্রিক মানুষের মত হয়ে যায়, যার কোন অনুভূতি এবং আত্মা নেই।

 

নামায : ইসলামে ইবাদতসমূহ চরিত্রের সাথে কঠোরভাবে সংযুক্ত। যে কোন ইবাদত একটি উত্তম চরিত্রের প্রতিফলন ঘটায় না তার কোন মূল্য নেই। আল্লাহর সামনে নামায আদায়ের ক্ষেত্রে দেখা যায় নামায একজন মানুষকে অশ্লীল অপছন্দ কাজসমূহ হতে রক্ষা করে, আত্মশুদ্ধি ও আত্মার উন্নতি সাধনে এর প্রভাব রয়েছে। আল্লাহ তাআলা বলেন,

“নিশ্চয়ই নামায অশ্লীল, অপছন্দনীয় কাজ হতে নিষেধ করে।” [ সূরা আল-আনকাবুত :৪৫ ]

 

অনুরূপভাবে রোযা তাক্কওয়ার দিকে নিয়ে যায়। আর তাক্বওয়া হচ্ছে মহান চরিত্রের অন্যতম, যেমন- আল্লাহ তাআলা বলেন,

“হে ঈমানদারগণ! তোমাদের উপর রোযা ফরয করা হয়েছে যেমনি ফরয করা হয়েছিল তোমাদের পূর্ববর্তীদের উপর যাতে তোমরা তাক্বওয়া লাভ করতে পার।” [ সূরা আল বাকারা : ১৮৩ ]

 

রোযাঃ  অনুরূপভাবে শিষ্টাচার, ধীরস্থিরতা, প্রশান্তি, ক্ষমা, মুর্খদের থেকে বিমুখতা ইত্যাদির প্রতিফলন ঘটায়। নবী সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম এরশাদ করেছেন, “তোমাদের কারো রোযার দিন যদি হয়, তাহলে সে যেন অশ্লীল কথাবার্তা না বলে, হৈ চৈ না করে অস্থিরতা না দেখায়। যদি কেউ তাকে গালি দেয় অথবা তার সাথে লড়াই করে সে যেন বলে দেয় আমি রোযাদার। বুখারী ও মুসলিম
 

যাকাতঃ  অনুরূপভাবে অন্তরকে পবিত্র করে, আত্মাকে পরিমার্জিত করে এবং তাকে কৃপণতা, লোভ ও অহংকারের ব্যধি হতে মুক্ত করে। আল্লাহ তাআলা বলেন,“তাদের সম্পদ হতে আপনি সাদকাহ গ্রহণ করুন যার মাধ্যমে আপনি তাদেরকে পবিত্র ও পরিমার্জিত করবেন।” [সূরা তাওবাহ ১০৩ আয়াত ]
 

হজ্জঃ আর হজ্জ হচ্ছে একটি বাস্তবমুখী প্রশিক্ষণশালা আত্মশুদ্ধি এবং হিংসা বিদ্ধেষ ও পঙ্কিলতা থেকে আত্মাকে পরিশুদ্ধি ও পরিমার্জনের জন্য। আল্লাহ তাআলা বলেন, “যে এ মাস গুলোতে নিজের উপর হজ্জ ফরয করে নিল সে যেন অশ্লীলতা, পাপাচার ও ঝগড়া বিবাদ হজ্জের মধ্যে না করে।” [সূরা আল বাকারাহ : ১৯৭ ]
রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম এরশাদ করেছেন,

“যে ব্যক্তি অশ্লীল কথা-বার্তা ও পাপ কর্ম না করে হজ্জ পালন করল, সে তার পাপ রাশি হতে তার মা যেদিন জন্ম দিয়েছে সে দিনের মত নিষ্পাপ হয়ে ফিরে এল।” [বুখারী ও মুসলিম]

 

ইসলামী চরিত্রের মৌলিক বিষয়সমূহ

সত্যবাদিতা:

আল্লাহ তাআলা এবং তাঁর রাসূল সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম আমাদের যে সকল ইসলামী চরিত্রের নির্দেশ দিয়েছেন, তার অন্যতম হচ্ছে সত্যবাদিতার চরিত্র। আল্লাহ তাআলা বলেন,

“হে ঈমানদারগণ আল্লাহকে ভয় কর এবং তোমরা সত্যবাদীদের সাথী হও।” সূরা আত-তাওবাহ : ১১

 

রাসুলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম এরশাদ করেছেন,

“তোমরা সততা অবলম্বন গ্রহণ কর, কেননা সত্যবাদিতা পুণ্যের পথ দেখায় আর পূণ্য জান্নাতের পথ দেখায়, একজন লোক সর্বদা সত্য বলতে থাকে এবং সত্যবাদিতার প্রতি অনুরাগী হয়, ফলে আল্লাহর নিকট সে সত্যবাদী হিসাবে লিপিবদ্ধ হয়ে যায়।” মুসলিম

 

আমানতদারিতা :

মুসলমানদের সে সব ইসলামী চরিত্র অবলম্বনের নির্দেশ দেয়া হয়েছে তার একটি হচ্ছে আমানতসমূহ তার অধিকারীদের নিকট আদায় করে দেয়া। আল্লাহ তাআলা বলেনঃ

“নিশ্চয়ই আল্লাহ তোমাদের নির্দেশ দিচ্ছেন আমানতসমূহ তার হকদারদের নিকট আদায় করে দিতে।” সূরা আন নিসা : ৫

 

রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম তাঁর সম্প্রদায়ের নিকট আল আমীন উপাধি লাভ করেছিলেন, তারা তাঁর নিকট তাদের সম্পদ আমানত রাখত। রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম এবং তার অনুসারীদের মুশরিকরা কঠোর ভাবে নির্যাতন শুরু করার পর যখন আল্লাহ তাকে মক্কা হতে মদীনা হিজরত করার অনুমতি দিলেন তিনি আমানতের মালসমূহ তার অধিকারীদের নিকট ফিরিয়ে দেয়ার ব্যবস্থা না করে হিজরত করেননি। অথচ যারা আমানত রেখেছিল তারা সকলেই ছিল কাফের। কিন্তু ইসলাম তো আমানত তার অধিকারীদের নিকট ফিরিয়ে দিতে নির্দেশ দিয়েছে যদিও তার অধিকারীরা কাফের হয়।

 

অঙ্গীকার পূর্ণ করা:

ইসলামী মহান চরিত্রের অন্যতম হচ্ছে অঙ্গীকার পূর্ণ করা। আল্লাহ তাআলা বলেন :

“আর অঙ্গীকার পূর্ণ কর, কেননা অঙ্গীকার সম্বন্ধে জিজ্ঞাসিত হবে।” সূরা ইসরা : ৩৪

 

আর রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম প্রতিশ্রতি ভঙ্গকরা মুনাফিকের বৈশিষ্ট্যের মধ্যে গণ্য করেছেন।

 

বিনয় :

ইসলামী চরিত্রের আরেকটি হচ্ছে একজন মুসলমান তার অপর মুসলিম ভাইদের সাথে বিনয়ী আচরণ করবে। সে ধনী হোক বা গরীব। আল্লাহ তাআলা বলেনঃ

“তুমি তোমার পার্শ্বদেশ মুমিনদের জন্য অবনত করে দাও।” সূরা আল হিজর : ৮৮

 

রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম এরশাদ করেছেন,

“আল্লাহ তাআলা আমার নিকট ওহী করেছেন যে, ‘তোমরা বিনয়ী হও যাতে একজন অপরজনের উপর অহংকার না করে। একজন অপর জনের উপর সীমালংঘন না করে।” -মুসলিম।

 

মাতা-পিতার প্রতি সদ্ব্যবহার:

মাতা-পিতার প্রতি সদ্ব্যবহার উত্তম চরিত্রের অন্যতম। আর এটা তাদের অধিকার মহান হওয়ার কারণে, যে অধিকার স্থান হল আল্লাহর হকের পরে।আল্লাহ তাআলা বলেনঃ

‘আর আল্লাহর ইবাদত কর, তাঁর সাথে কোন কিছুকে শরীক করো না, এবং মাতা-পিতার প্রতি সদ্ব্যবহার কর।” [সূরা আন-নিসা : ৩৫ আয়াত]

 

আল্লাহ তাআলা তাদের আনুগত্য, তাদের প্রতি দয়া ও বিনয় এবং তাদের জন্য দু’আ করতে নির্দেশ দিয়েছেন। আল্লাহ তাআলা বলেন :

“তাদের উভয়ের জন্য দয়ার সাথে বিনয়ের ডানা নত করে দাও এবং বল, হে আমার রব! তাদের প্রতি দয়া কর যেভাবে শৈশবে আমাকে তারা লালন-পালন করেছেন।” [ সূরা আল ইসরা : ২৪ ]

 

এক ব্যক্তি রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম এর নিকট এসে জিজ্ঞেস করল,

‘হে আল্লাহর রাসূল! আমার উত্তম আচরণ পাওয়ার সবচেয়ে বেশী অধিকারী ব্যক্তি কে ? তিনি বললেন, ‘তোমার মা।’ অত:পর জিজ্ঞেস করল তারপর কে? তিনি উত্তর দিলেন, ‘তোমার মা।’ অতঃপর জিজ্ঞেস করল তার পর কে? তিনি উত্তর দিলেন, ‘তোমার মা।’ অতঃপর জিজ্ঞেস করল তার পর কে? উত্তর দিলেন, ‘তোমার পিতা।’ [বুখারী ও মুসলিম]


 

মাতা-পিতার প্রতি এ সদ্ব্যবহার ও দয়া অনুগ্রহ অতিরিক্ত বা পূর্ণতা দানকারী বিষয় নয় বরং তা হচ্ছে সকল মানুষের ঐক্যমতের ভিত্তিতে ফরযে আইন।

 

আত্মীয়তার সর্ম্পক বজায় রাখা :

আত্মীয়তার সম্পর্ক বজায় রাখা ইসলামী চরিত্রের অন্যতম। আর তারা হচ্ছে নিকটাত্মীয়গণ যেমন, চাচা, মামা, ফুফা, খালা, ভাই, বোন প্রমূখ।

আত্মীয়তার সম্পর্ক বজায় রাখা ওয়াজিব, আর তা ছিন্ন করা জান্নাত হতে বঞ্চিত ও অভিশাপের কারণ। আল্লাহ তাআলা বলেনঃ

“ যদি তোমরা ক্ষমতা পাও, তাহলে কি তোমরা পৃথিবীতে বিপর্যয় সৃষ্টি করবে এবং আত্মীয়তার সম্পর্ক ছিন্ন করবে? তারা তো ঐ সব লোক যাদের প্রতি আল্লাহ অভিশাপ করেছেন। এতে তিনি তাদেরকে বধির করে দিয়েছেন এবং তাদের দৃষ্টি অন্ধ করে দিয়েছেন।” [সূরা মুহাম্মাদ : ২২-২৩]

 

রাসুলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম এরশাদ করেছেন,

“আত্মীয়তার বন্ধন ছিন্নকারী বেহেশ্তে প্রবেশ করবে না।” [বুখারী ও মুসলিম]

 

প্রতিবেশীর প্রতি সুন্দরতম ব্যবহার:

প্রতিবেশীর প্রতি সুন্দরতম ব্যবহার হচ্ছে ইসলামী চরিত্রের অন্যতম। প্রতিবেশী হচ্ছে সে সব লোক যারা আপনার বাড়ীর আশে পাশে বসবাস করে। যে আপনার সবচেয়ে নিকটবর্তী সে সুন্দর ব্যবহার ও অনুগ্রহের সবচেয়ে বেশী হকদার। আল্লাহ তাআলা বলেন,

“আর মাতা-পিতার প্রতি সদ্ব্যবহার কর, নিকটাত্মীয়, এতিম, মিসকীন নিকটতম প্রতিবেশী ও দূরবর্তী প্রতিবেশীর প্রতিও।” [সূরা আন-নিসা : ৩৬]

 

এতে আল্লাহ নিকটতম ও দূরবর্তী প্রতিবেশীর প্রতি সদ্ব্যবহার করতে ওসিয়ত করেছেন। রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম এরশাদ করেনঃ

‘জিবরীল আমাকে প্রতিবেশীর ব্যাপারে ওসিয়ত করতেছিল এমনকি আমি ধারণা করেনিলাম যে, প্রতিবেশীকে উত্তরাধিকার বানিয়ে দেয়া হবে।’ [বুখারী ও মুসলিম]

 

অর্থাৎ আমি মনে করেছিলাম যে ওয়ারিশদের সাথে প্রতিবেশীর জন্য মিরাসের একটি অংশ নির্ধারিত করে দেবে। রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম আবু যর রা. কে লক্ষ্য করে বলেন,

‘হে আবু যর! যখন তুমি তরকারী পাক কর তখন পানি বেশি করে দাও, আর তোমার প্রতিবেশীদের অঙ্গীকার পূরণ কর।” [ মুসলিম]

 

প্রতিবেশীর পার্শ্বাবস্থানের হক রয়েছে যদিও সে আল্লাহ এবং তাঁর রাসূলের প্রতি অবিশ্বাসী বা কাফের হয়।

 

মেহমানের আতিথেয়তা:

ইসলামী চরিত্রের আরেকটি হচ্ছে মেহমানের আতিথেয়তা। রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম এর বাণী,

“যে ব্যক্তি আল্লাহ এবং পরকালের প্রতি বিশ্বাস করে সে যেন তার মেহমানকে সম্মান করে।” [বুখারী ও মুসলিম]

 

সাধারণভাবে দান ও বদান্যতা:

ইসলামী চরিত্রের অন্যতম দিক হচ্ছে দান ও বদান্যতা। আল্লাহ তাআলা ইনসাফ, বদান্যতা ও দান কারীদের প্রশংসা করেছেন। আল্লাহ তাআলা বলেনঃ

“যারা আল্লাহর রাস্তায় নিজেদের সম্পদ ব্যয় করে অতঃপর যা খরচ করেছে তা থেকে কারো প্রতি অনুগ্রহ ও কষ্ট দেয়ার উদ্দেশ্য করে না, তাদের জন্য তাদের প্রতিপালকের নিকট প্রতিদান রয়েছে। তাদের কোন ভয় নেই এবং তারা দুশ্চিন্তাও করবে না।”   [সূরা আল বাকারাহ : ২৬২]

 

রাসুলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম এরশাদ করেছেন,

‘যার নিকট অতিরিক্ত বাহন থাকে সে যেন যার বাহন নেই তাকে তা ব্যবহার করতে দেয়। যার নিকট অতিরিক্ত পাথেয় বা রসদ রয়েছে সে যেন যার রসদ নেই তাকে তা দিয়ে সাহায্য করে।”  [মুসলিম]

 

১০ ধৈর্য্য ও সহিষ্ণুতা:

ধৈর্য্য ও সহিষ্ণুতা হচ্ছে ইসলামী চরিত্রের অন্যতম বিষয়। অনুরূপভাবে মানুষদের ক্ষমা করা, দুর্ব্যবহারকারীকে ছেড়ে দেয়া ওজর পেশকারীর ওজর গ্রহণ করা বা মেনে নেয়াও অন্যতম। আল্লাহ তাআলা বলেন :

“আর যে ধৈর্য্য ধারণ করল এবং ক্ষমা করল, নিশ্চয়ই এটা কাজের দৃঢ়তার অন্তর্ভূক্ত।”   [সূরা আশ শুরা : ৪৩]

 

রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম বলেন,

‘তারা যেন ক্ষমা করে দেয় এবং উদারতা দেখায়, আল্লাহ তোমাদের ক্ষমা করে দেয়া কি তোমরা পছন্দ কর না?’ রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম বলেন, “দান খয়রাতে সম্পদ কমে যায় না। আল্লাহ পাক ক্ষমার দ্বারা বান্দার মার্যাদাই বৃদ্ধি করে দেন। যে আল্লাহর জন্য বিনয় প্রকাশ করে আল্লাহ তার সম্মানই বৃদ্ধি করে দেন।” [মুসলিম ] তিনি আরো বলেন, “দয়া কর, তোমাদের প্রতি দয়া করা হবে। ক্ষমা করে দাও তোমাদেরও ক্ষমা করে দেয়া হবে।”   [আহমাদ]

 

 

১। ১  মানুষের মাঝে সমঝোতা ও সংশোধন:

ইসলামী চরিত্রের আরেকটি হচ্ছে মানুষের মাঝে সমঝোতা ও সংশোধন করে দেয়া, এটা একটি মহান চরিত্র যা ভালবাসা সৌহার্দ প্রসার ও মানুষের পারষ্পারিক সহযোগিতার প্রাণের দিকে নিয়ে যায়।আল্লাহ তাআলা বলেন:

“তাদের অধিকাংশ শলাপরামর্শের মধ্যে কল্যাণ নেই। কেবল মাত্র স&#

95
Quran / দৈনন্দিন জীবনে কুরআন
« on: August 11, 2012, 03:40:38 PM »

দৈনন্দিন জীবনে কুরআন


অনুবাদ: আবদ্‌ আল-আহাদ | সম্পাদনাঃ হামযা আবদুল্লাহ এবং শাবাব শাহরিয়ার খান 


বিসমিল্লাহির রাহমানির রাহীম



আমাদের আজকের আয়োজন মহাগ্রন্থ কুরআন আল–কারীম থেকে নেয়া কিছু অমিয় উপদেশবাণী। এই উপদেশবাণীগুলো আমাদের প্রতিদিনের জীবনের সাথে সংশ্লিষ্ট। আসুন, আমরা আমাদের প্রতিপালক, আল্লাহ্‌ সুবহানাহু ওয়া তা’আলার দেয়া উপদেশ গ্রহণ করে তাঁর অনুগ্রহপ্রাপ্ত বান্দাহ্‌দের দলভুক্ত হই -

রেফারেন্স সাজানো  হয়েছে [সূরা  নাম্বার/ আয়াত নাম্বার] অনুযায়ী

 

১. জাতি, ধর্ম, বর্ণ, লিঙ্গ, ভাষা, সামাজিক অবস্থান, ধনসম্পত্তি, বংশ পরিচয়, পেশা ইত্যাদি সকল কিছু নির্বিশেষে সকল মানুষকে শ্রদ্ধা এবং সম্মান করুন। [১৭/৭০]

 

২. মানুষের সাথে কথা বলার সময় ছলচাতুরি বা অস্পষ্টতা পরিহার করুন। যা বলতে চান স্পষ্ট করে সরাসরি বলুন। [৩৩/৭০]

 

৩. সর্বোত্তম কথা বলুন এবং সর্বোত্তম পন্থায় বলুন। [১৭/৫৩, ২/৮৩]

 

৪. নরম গলায় নম্রভাবে কথা বলুন। উচ্চঃস্বরে কথা বলবেন না। [৩১/১৯]

 

৫. সর্বদায় সত্য কথা বলুন। অতিরঞ্জিত এবং কপট কথা বলা থেকে বিরত থাকুন। [২২/৩০]

 

৬. সত্যকে মিথ্যার সাথে মিশ্রিত করবেন না। [২/৪২]

 

৭. মুখে তা-ই বলুন যা আপানার মনের কথা। [৩/১৬৭]

 

৮. সমাজে প্রচলিত এবং সমাজের মানুষ বোঝে এমন ভাষায় সদ্ভাবে কথা বলুন। [৪/৫]

 

৯. মতামত প্রকাশের ক্ষেত্রে যা ন্যায়সঙ্গত তা-ই বলুন যদিও তা আপনজনের বিরুদ্ধে যায় । [৬/১৫২]

 

১০. দাম্ভিকতা (মানে গর্ব) এবং ঔদ্ধত্যপূর্ণ আচরণ পরিহার করুন। [৩১/১৮]

 

১১. অসার ক্রিয়া-কলাপ থেকে এবং অসার কথাবার্তা বলা ও শোনা থেকে বিরত থাকুন। [২৩/৩, ২৮/৫৫]

 

১২. নিজেকে সকল প্রকার তুচ্ছ বিষয়ে জড়ানো থেকে বেঁচে থাকুন। অসার ক্রিয়া-কলাপে লিপ্ত লোকদের পাশ দিয়ে যাওয়ার সময় আত্মসম্মান বজায় রেখে সেখান থেকে চলে আসুন। [২৫/৭২]

 

১৩. হোক প্রকাশ্য কিংবা অপ্রকাশ্য, কোন প্রকার অশ্লীল ও বেহায়া কাজ এবং কথার ধারেকাছেও যাবেন না। [৬/১৫১]

 

১৪. যদি অনিচ্ছাকৃতভাবে আপনার দ্বারা কোন মন্দকাজ সংঘটিত হয়েই যায় তাহলে সাথে সাথে নিজেকে সংশোধন করে নিন। [৩/১৩৫]

 

১৫. মানুষের সাথে ঔদ্ধত্যপূর্ণ আচরণ করা থেকে বিরত থাকুন। [৩১/১৮]

 

১৬. ঔদ্ধত্যপূর্ণ পদক্ষেপে দম্ভভরে পৃথিবীতে চলাফেরা করবেন না। [১৭/৩৭, ৩১/১৮]

 

১৭. পৃথিবীর বুকে হাঁটাচলা করার সময় মধ্যম গতির পদক্ষেপে চলুন। [৩১/১৯]

 

১৮. শান্তভাবে এবং ধীরস্থির পদক্ষেপে নম্রভাবে চলাফেরা করুন। [২৫/৬৩]

 

১৯. কামুক, অশ্লীল আড়চাহনি কিংবা কামপ্রবৃত্তিপূর্ণ দৃষ্টিপাত থেকে বেঁচে থাকার জন্য দৃষ্টিকে নিম্নগামী রাখুন। [২৪/৩০, ৪০/১৯]

 

২০. যে বিষয়ে পুরোপুরি জ্ঞান নেই সে বিষয়ে কথা না বলে চুপ থাকুন। কোন বিষয়ে না জেনে সে সম্পর্কে কথা বলাটা আপনার কাছে মামুলী মনে হতে পারে। কিন্তু এর পরিণতি যে কি ভয়াবহ, তা হয়ত আপনি কল্পনাও করতে পারেন না। [২৪/১৫-১৬]

 

২১. কারোর সম্পর্কে খারাপ কিছু শুনে থাকলেও তার বিষয়ে ততক্ষণ পর্যন্ত সুধারনা পোষণ করতে থাকুন যতক্ষণ না সে বিষয়ে আপনি পুরোপুরি অবহিত হয়েছেন। সুস্পষ্ট এবং অকাট্য প্রমান ছাড়া কোন মানুষকে দোষী সাব্যস্ত করবেন না। [২৪/১২-১৩]

 

২৪. কখনই ভাববেন না আপনি সবই জানেন এবং আপনার চেয়ে আর ভাল কেউ জানেনা। মনে রাখবেন, জ্ঞানীর উপরে জ্ঞানী আছেন আর সকল জ্ঞানীর শ্রেষ্ঠ জ্ঞানী আল্লাহ্‌ রাব্বুল ‘আলামীন। [১২/৭৬]

এমনকি প্রিয় নবী (সা) কেও তাঁর জ্ঞান বাড়িয়ে দেয়ার জন্য আল্লাহ্‌ রাব্বুল ‘আলামীন তাকে দোয়া’ করতে বলেছেন, “হে আমার প্রতিপালক! আমার জ্ঞান বাড়িয়ে দিন।” [২০/১১৪]

 

২৫. মু’মিনগণ সকলেই ভ্রাতৃত্বের বন্ধনে আবদ্ধ। যেন তারা একই পরিবারভুক্ত সদস্য। নারী-পুরুষ সকলেই একে অপরের ভাইবোন। [৪৯/১০]

 

২৬. মানুষকে নিয়ে কখনই ঠাট্টা তামাশা করবেন না। [৪৯/১১]

 

২৭. অন্যের সম্মান বা মর্যাদাহানি হয় এমন কিছু করা যাবে না। [৪৯/১১]

 

২৮. বিকৃত নামে ডেকে কাউকে অপমান করা যাবে না। [৪৯/১১]

 

২৯. কল্পনা বা সন্দেহপ্রসূত ধারনা করা থেকে বেঁচে থাকুন। সন্দেহপ্রবতা সমাজের মানুষে মানুষে হৃদ্যতার বন্ধনকে মুছে ফেলে। [৪৯/১২]

 

৩০. একে অপরের গোপনীয় বিষয় অনুসন্ধান করা থেকে বেঁচে থাকুন। [৪৯/১২]

 

৩১. একে অপরের পশ্চাতে নিন্দা করা থেকে বিরত থাকুন। [৪৯/১২]

 

৩২. মানুষের সাথে সাক্ষাতের সময় তাদের কুশলাদি জিজ্ঞেস করুন এবং তাদের কল্যাণ ও সমৃদ্ধি কামনা করুন। কেউ আপনাকে অভিবাদন অর্থাৎ সালাম দিলে আপনি তারচেয়েও উত্তমরূপে উত্তর দিন, আর তা না পারলে অন্তত ততটুকু বলুন যতটুকু তিনি বলেছেন। [৪/৮৬]

 

৩৩. নিজের বাড়ী কিংবা অন্যের বাড়ীতে প্রবেশ করার সময় বাড়ীতে অবস্থানকারী লোকজনদের সালাম দিন। [২৪/৬১]

 

৩৪. অনুমতি না নিয়ে অন্যের বাড়ীতে প্রবেশ করবেন না। বাড়ীতে প্রবেশের সময় বাড়ীর লোকজনকে সালাম দিন এবং তাদের সুখ সমৃদ্ধির জন্য দোয়া’ করুন। [২৪/২৭]

 

৩৫. সদয় এবং সৌজন্যমূলক আচরণ করুনঃ

*পিতামাতার সাথে;

*আত্মীয়-স্বজনদের সাথে;

*সহায় সম্বলহীন এবং সমাজে যাদের কেউ নেই তাদের সাথে। [৪/৩৬]

 

৩৬. যত্নবান হউনঃ

*অভাবী ও হতদরিদ্র মানুষদের প্রতি;

*শারীরিক প্রতিবন্ধীদের প্রতি;

*সে সব অসচ্ছলদের প্রতি যাদের অপর্যাপ্ত উপার্জন দিয়ে অভাব কাটে না;

*তাদের প্রতি যাদের ব্যবসা বন্ধ হয়ে গেছে;

*তাদের প্রতি যারা চাকুরী হারিয়ে বেকার হয়ে পড়েছে। [৪/৩৬]

 

৩৭. আত্মীয় হোক অথবা অনাত্মীয় হোক, প্রতিবেশীর সাথে সদ্ব্যবহার করুন। সভা-সমাবেশে কিংবা যানবাহনে আপনার আশপাশের মানুষদের সাথেও সদয় ও সৌজন্যমূলক আচরণ করুন। [৪/৩৬]

 

৩৮. অভাবী মুসাফির, পথের আশ্রয়হীন বালক অথবা দারিদ্র পীড়িত অসহায় হয়ে যে আপনার দারস্থ হয়েছে- এদের প্রতি সাহায্যের হাত বাড়িয়ে দিন। [৪/৩৬]

 

৩৯. আপনার অধীনস্থ কর্মচারীদের সাথে ভাল ব্যবহার করুন। [৪/৩৬]

 

৪০. মানুষকে কোন কিছু দেওয়ার পর নিজের উদারতাকে জাহির করার জন্য বারবার সে বিষয়ে খোঁটা দিয়ে তাদের মনে কষ্ট দেবেন না। [২/২৬২]

 

৪১. মানুষের সাথে ভাল ব্যবহার করে কোন প্রতিদান আশা করবেন না, এমনকি ধন্যবাদটাও নয়। [৭৬/৯]

 

৪২. সৎ কাজে একে অপরকে সহযোগিতা করুন। মন্দ কাজে কখনই কাউকে সহায়তা করা যাবে না। [৫/২]

 

৪৩. অন্যায়ভাবে অপরের ধনসম্পত্তি কুক্ষিগত করা যাবে না। উচ্চপদস্থ কর্তাব্যক্তি অথবা বিচারকদের ঘুষ প্রদানের মাধ্যমে মানুষকে তাদের ন্যায্য অধিকার থেকে বঞ্চিত করা থেকে বিরত থাকুন। [২/১৮৮, ৫৩/৩২]

 

৪৪. অন্যদের ভাল কাজের উপদেশ দিন। তবে নিজের সংশোধনের বিষয়টি সবার আগে। অন্যকে করতে না বলে নিজে করে দেখান। আগে নিজে চর্চা করুন, পরে প্রচার করুন। [২/৪৪]

 

৪৫. অন্যদের সংশোধন করার পূর্বেই নিজেকে এবং নিজের পরিবার-পরিজনকে সংশোধন করার চেষ্টা করুন। [৬৬/৬]

 

৪৬. নিজেদের মধ্যে কেউ অজ্ঞানতাবশত কোন খারাপ কাজ করে বসলে তা ক্ষমা সুন্দর দৃষ্টিতে দেখুন, তার জন্য আল্লাহ্‌ রাব্বুল ‘আলামীনের কাছে ক্ষমা চান তারপর তাকে সংশোধন করুন। [৬/৫৪, ৩/১৩৪]

 

৪৭. আপনার ক্রোধ এবং অন্যান্য সব রকমের উগ্র আবেগকে সৃজনশীল শক্তিতে পরিণত করুন। এমন ব্যক্তিত্ব গড়ে তুলুন যাতে মানুষ আপনার সাহচর্য কামনা করে। তাদের কাছে হয়ে উঠুন মানসিক প্রশান্তির প্রতীক। [৩/১৩৪]

 

৪৮. মানুষকে প্রজ্ঞার সাথে ইসলামের দিকে ডাকুন এবং এক্ষেত্রে সর্বোত্তম পন্থা অবলম্বন করুন। তাদের সাথে ভদ্রতা বজায় রেখে তর্ক করুন। [১৬/১২৫]

 

৪৯. যারা আল্লাহ্‌ রাব্বুল ‘আল্লামীনের বিধানকে পাত্তা  দিতে চায় না, যাদের কাছে স্রষ্টার বিধান হাসি তামাশার বিষয়, তাদেরকে তাদের মতোই চলতে দিন। [৬/৭০]

 

৫০. আল্লাহ্‌ রাব্বুল ‘আলামীনের বিধানকে নিয়ে যারা ঠাট্টা-বিদ্রুপ করে তাদের সাথে কোন আলোচনায় বসবেন না। তবে অন্য প্রসঙ্গে কথা হলে তাদের সাথে বসা যেতে পারে। [৪/১৪০]

 

৫১. আল্লাহ্‌ যাদেরকে অনুগ্রহ করেন তাদের ব্যাপারে হিংসা করবেন না বা তাদের প্রতি পরশ্রীকাতর হবেন না। [৪/৫৪]

 

৫২. জীবনের যে সকল ক্ষেত্রগুলোতে সম্মিলিত প্রচেষ্টার প্রয়োজন পড়ে সেই ক্ষেত্রগুলোতে অন্যদেরও সামিল হওয়ার সুযোগ দিন। [৫৮/১১]

 

৫৩. কোন ভোজ অনুষ্ঠানে আমন্ত্রিত হলে সেখানে যথাসময়েই উপস্থিত হউন। আগেভাগে গিয়ে খাবার তৈরির অপেক্ষায় বসে থাকবেন না। আবার খাওয়া শেষ হওয়ার পর খোশগল্পে মশগুল হয়ে উঠবেন না। এমন আচরণ আয়োজনকারীর জন্য অসুবিধার কারণ হতে পারে। [৩৩/৫৩]

 

৫৪. পরিমিত পরিমাণে আহার করুন যা আমাদের সৃষ্টিকর্তা আমাদের জন্য হালাল করেছেন। [৭/৩১]

 

৫৫. বেহিসেবির মতো ধনসম্পদ খরচ করে সবকিছুকে উড়িয়ে দেবেন না। [১৭/২৬]

 

৫৬. কারো সাথে কোন বিষয়ে চুক্তিবদ্ধ হলে বা কাউকে কোন বিষয়ে প্রতিশ্রুতি দিলে তা রক্ষা করুন। [১৭/৩৪]

 

৫৭. নিজেকে পাকপবিত্র রাখুন। [৯/১০৮, ৪/৪৩, ৫/৬]

 

৫৮. শোভনীয় এবং রুচিশীল পোশাক পরুন। অমায়িক চারিত্রিক মাধুর্য দিয়ে ভরে তুলুন জীবনের প্রতিটি ক্ষেত্র। [৭/২৬]

 

৫৯. কেবলমাত্র হালাল পন্থা অবলম্বনের মাধ্যমে জীবিকা উপার্জন করুন। [২৯/১৭, ২/১৮৮]

 

আল্লাহ্‌ সুব্‌হানাহু ওয়া তা’আলা আমাদের কবুল করুন আমরা যেন সেই সব লোকদের দলভুক্ত হতে পারি যারা তাঁর উপদেশ গ্রহণ করেন এবং বাস্তবে তা মেনে চলেন! আমীন।

জাযাকাল্লাহু খাইরান

 

96


রমযান মাসে যদি সব শয়তান শৃঙ্খলাবদ্ধ থাকে তাহলে এ মাসে মানুষ নিয়মিতভাবে পাপ করতে থাকে কীভাবে?



প্রশ্ন: এটি খুব সাধারণ এবং সকলের মনে উদয় হওয়া একটি প্রশ্ন তাহলো, রমযান মাসে যদি সব শয়তান শৃঙ্খলাবদ্ধ থাকে তাহলে এ মাসেমানুষ নিয়মিতভাবে পাপ করতে থাকে কীভাবে?



উত্তর: ডা. জাকির নায়েক: হ্যাঁ, আমি এই সাধারণ প্রশ্নের সাথে একমত এবং এখন আমার বিভিন্ন আয়াত, হাদীস ইত্যাদির কথা মনে হচ্ছে যেখানে উল্লেখ আছে যে, রমযান মাসে শয়তানকে শৃঙ্খলাবদ্ধ করে দেওয়া হয়। সঙ্গে সঙ্গে আমাদের মনে এই প্রশ্ন উত্থিত হয়।

শুধু আমাদেরই নয়, বিভিন্ন মুসলিম এবং অমুসলিমদের ভেতরেও এই প্রশ্ন ওঠে যে যদি শয়তান শৃঙ্খলাবদ্ধ হয় তাহলে মানবজাতি এরকম পাপ কাজ চালিয়ে যেতে পারে কীভাবে? এই ধরনের প্রশ্ন উত্থাপিত হয় মূলত মুহাম্মদ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম এর হাদীসদ্বয়ের উপর ভিত্তি করে।

মুহাম্মদ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম বলেন,

“হে মানবজাতি তোমাদের মাঝে পবিত্র রমযান মাস সমাগত এবং আল্লাহ তোমাদেরকে এই মাসে রোযা রাখতে নির্দেশ দিয়েছেন আর এই মাসে বেহেশেতের দরজাগুলো খুলে দেয়া হয় এবং দোজখের দরজাগুলো বন্ধ করে দেওয়া হয় এবং শয়তানকে শৃঙ্খলাবদ্ধ করে দেওয়া হয় আর এই মাসেই আছে কদরের রাত যেটি হাজার মাস থেকে উত্তম এবং যে ব্যক্তি এই মাসের অনুগ্রহ হতে বঞ্চিত হলো সে ব্যক্তি সত্যিকার অর্থেই বঞ্চিত, দুর্ভাগা।” (মুসনাদ-ই আহমদ, পৃষ্ঠা-২৩০, হাদীস নং ৭১৪৮ এবং সুনানে নাসাঈ, অধ্যায়-৫, রোযা-৫, রোযা, হাদীন নং ২১০৬)

তিনি এই হাদীসে অত্যন্ত পরিষ্কারভাবেই উল্লেখ করেছেন যে, পবিত্র রমযান মাসে শয়তানকে আল্লাহ তায়ালা শৃঙ্খলাবদ্ধ করে দেন। সুতরাং খুব সহজভাবেই এই প্রশ্ন উত্থিত হয় যে, শয়তান শৃঙ্খলাবদ্ধ থাকার পরেও মানবজাতি পাপ কাজে লিপ্ত থাকে কীভাবে?

এখন এই লোকগুলোকে বোঝাতে আমাদেরকে এটি অনুধাবন করতে হবে যে, শয়তান যদিও শৃঙ্খলাবদ্ধ কিন্তু তার মানে এই নয় যে, শয়তান একেবারে শেষ বা মরে গেছে বরং শয়তান জীবিত তারা মরে যায় না। তাদের ক্ষমতা রোধ হয়ে যায়। ব্যাপারটি ভালোভাবে বোঝার জন্য একটি উদাহরণ দেওয়া যাক। বাঘের কথাই ধরুন। যে বাঘটি মুক্ত তার পক্ষে মানুষ হত্যা করার সম্ভাবনা খুবই বেশি এমনকি বাঘে পেলে হত্যা করে বৈকি! আপনার জীবন তখন বিপদাপন্ন কিন্তু যখন ওই বাঘটি খাঁচাবন্দি বা শৃঙ্খলাবদ্ধ থাকবে তখন কিন্তু আপনি ওই বাঘ হতে নিরাপদ। তবে আপনার ওই নিরাপত্তা নির্ভর করে যতটুকু দূরত্ব আপনি বাঘের সাথে রেখেছেন তার ওপর। বাঘকে শৃঙ্খলাবদ্ধ করার পরেও আপনি যদি ওই বাঘের খুব কাছাকাছি চলে যান তাহলে আপনাকে হত্যা করার একটা সুযোগ কিন্তু ওই বাঘের জন্য থেকে যায়।
সুতরাং যতটা সম্ভব, ওই বাঘের কাছ থেকে বেশি দূরত্ব বজায় রাখতে হবে তাহলেই আপনি নিরাপদ থাকবেন। একইভাবে আপনি যদি রমযান মাসে শয়তান হতে নিরাপদ দূরত্ব বজায় রাখেন তাহলে আপনিও নিরাপদ থাকতে পারবেন। এ প্রসঙ্গে আল্লাহ বলেন,

يَا أَيُّهَا النَّاسُ كُلُوا مِمَّا فِي الْأَرْضِ حَلَالًا طَيِّبًا وَلَا تَتَّبِعُوا خُطُوَاتِ الشَّيْطَانِ ۚ إِنَّهُ لَكُمْ عَدُوٌّ مُّبِينٌ

অর্থ: হে মানবজাতি! পৃথিবীতে যা কিছু বৈধ ও পবিত্র খাদ্যবস্তু রয়েছে তা হতে তোমরা আহর করো এবং শয়তানের পদাঙ্ক অনুসরণ করিও না, নিশ্চয় সে তোমাদের প্রকাশ্য শত্রু। (সূরা বাকারা, অধ্যায়-২, আয়াত-১৬৮)

এখানে বলা হয়েছে- “শয়তানের পদাঙ্ক অনুসরণ এবং তার কুমন্ত্রণা থেকে নিজেকে বাঁচানোর জন্য সতর্ক হও” কুরআনের অনেক জায়গায় আল্লাহ তায়ালা এই শয়তানের পদাঙ্ক হতে বাঁচার জন্য তাগিদ দিয়েছেন। আল্লাহ এই কথা বলেন নি যে তোমরা শুধু শয়তানের কাছ থেকে সতর্ক হও, কারণ অনেক সাধারণ এবং ঈমানদার মুসলমান আছেন যারা তাদের সামনেই শয়তানকে দেখতে পান এবং এতে করে তারা নিজেরাই সতর্ক হতে পারে বা সুযোগ পায়। উদাহরণস্বরূপ বলা যায়, একটি যুবতী মেয়ে একজন ঈমানদার যুবকের কাছে এসে বলল, চলো আজ আমরা দু’জনে একসাথে রাত কাটাই। তখন ওই যুবক বলবে, দু’জনে একসাথে রাত কাটাব! একটা মেয়ের সাথে রাত কাটাব! এটা হারাম, এটা যিনা, ব্যভিচার। সে তাৎক্ষণিকভাবে এটার প্রতিবাদ করবে। কিন্তু ওই একই যুবতী যদি ওই যুবকের সাথে ফোনে কথা বলে তাহলে এটা তেমন কোন ব্যাপার নয়, পরবর্তীতে মেয়েটি ছেলেটিকে বলল, চলো আমরা স্ন্যাকস, ম্যাকডোনাল্ড, ফ্রাইড চিকেন ইত্যাদি খাই।

এটার জন্য তাদের আধা ঘণ্টা ব্যয় হলো এবং এটিও তেমন কোন ব্যাপার নয়। এরপর মেয়েটি বলল আচ্ছা আমরা রাতের খাবার কেন খাচ্ছি না, চলো রেস্টুরেন্টে যাই। তারা গেল কিন্তু এটাও তেমন কোন সমস্যা নয়। এরপর মেয়েটি বলল, তাহলে রাতটা তুমি আমার সাথে কাটাচ্ছো না কেন? তখন ছেলেটি বলল, একটি মেয়ের সাথে রাত কাটাব চমৎকার, কোন সমস্যা নয়। আর এটাই হলো শয়তানের পদাঙ্ক অনুসরণ। আর শয়তানের এই পদাঙ্ক অনুসরণ একজন মুমিন বান্দাকে ক্ষতিগ্রস্ত করতে পারে। এই কারণে আল্লাহ আমাদেরকে শয়তানের পদাঙ্ক অনুসরণ করা থেকে সতর্ক হতে বলেছেন। যদি শয়তান সরাসরিভাবে কোনো ঈমানদার ব্যক্তির সামনে উপস্থিত হয় তাহলে ওই মুমিন ব্যক্তি তাকে ভয় করে এবং তার থেকে বাঁচতে পারে। শয়তানের পদাঙ্ক হলো এমন একটি জিনিস যেটি খুবই বিপদজনক।

সুতরাং আমরা এটাই বুঝতে পারি যে, যখন শয়তান শৃঙ্খলাবদ্ধ থাকে তখন পদচারণাও বন্ধ থাকে। যে কারণে অনেক পাপ কাজও বিরত থাকে। এখন যদি কেউ আগ বাড়িয়ে শয়তানের কাছে যায় তাহলে শয়তানের কাছে তার মাথানত এবং বিভিন্ন পাপ কাজ করার বা পাপে জড়িয়ে যাওয়ার সম্ভাবনা চরমে পৌছে। তাই পবিত্র রমযান মাসে আমরা যতই শয়তানের কাছ থেকে দূরে থাকার চেষ্টা করবো ততই আমাদের পাপ কাজে জড়িত হওয়ার সম্ভাবনা হ্রাস পাবে। আপনি যদি শৃংখলাবদ্ধ বাঘের কাছে যান যদিও সে আবদ্ধ, তবুও সে কিন্তু অল্প জায়গার ভেতরে ঘোরাফেরা করতে পারে একইভাবে শয়তানও একই কাজ করতে পারে। মুহাম্মদ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম বলেছেন, “শয়তানরা শৃঙ্খলাবদ্ধ হয়ে যায়।” তারা স্বল্প জায়গায় ঘোরাফেরা করতে পারে। সুতরাং কেউ যদি শয়তানের ঘোরাফেরার আওতায় বাইরে থাকে তাহলে সে শয়তান থেকে নিরাপদ থাকতে পারবে।

আমি এ প্রসঙ্গে দ্বিতীয় যে কারণটি অনুভব করি সেটা হলো- আমরা একটি ব্যাপার অনুধাবন করতে ব্যর্থ হই তাহলো যদিও শয়তান রমযান মাসে শৃঙ্খলাবদ্ধ থাকে কিন্তু বাকি আরো ১১ মাস সে কিন্তু মুক্তই থাকে। ওই ১১ মাসে শয়তান মানুষের ওপর যে সব কুমন্ত্রণা এবং পাপে জড়াতে পেরেছে তার প্রভাব মানুষকে পবিত্র রমযান মাসেও প্রভাবিত করে। আমি আপনাদেরকে সহজভাবে বোঝানোর জন্য একটি উদাহরণ দিচ্ছি- একজন মাদক বিক্রেতা যে বিভিন্ন প্রকার চেষ্টা করে কলেজ, ভার্সিটির তরুণ ছাত্রছাত্রীদেরকে মাদকাসক্ত করে ফেলে। এটিতে সফল হওয়ার জন্য প্রথমে তারা কি করে? প্রথমে তারা ছাত্রদেরকে বিনামূল্যে মাদক দেয়। তাদেরকে মাদক গ্রহণের জন্য উৎসাহিত করে।
পরবর্তীতে তারা ছাত্রদের উপর মাঝে মাঝে অল্প পরিমাণে মূল্য আদায় করতে শুরু করে এবং দিনে দিনে টাকার পরিমাণ বাড়িয়ে দেয়।’ কিন্তু ততদিনে ওই ছেলেমেয়েরা যথেষ্ট পরিমাণে মাদকের উপর নির্ভরশীল হয়ে পড়ে। এমতাবস্থায় যদি ওই দমাদক বিক্রেতারা ওই ছাত্রছাত্রীদের কাছে না যায় তাহলে ওই ছাত্রছাত্রীরাই নিজেরা ওই মাদক বিক্রেতাকে খুঁজে বের করে। ওই মাদক বিক্রেতারা তাদের কৌশল অনুযায়ী অন্য কোনো লোকের কাছে গিয়ে একই ধরনের কৌশল প্রয়োগ করে। সুতরাং যে লোকেরা মাদকের প্রতি আসক্ত হয়েছে তারা নিজেরাই মাদকের দোকানে গিয়ে সেটি গ্রহণ করে। একইভাবে যারা শয়তানের প্রতি আসক্ত হয়েছে তারা শয়তান অনুপস্থিত থাকলেও তাদের মাঝে শয়তানকে খোঁজা বা শয়তানের আসক্তি তাদের ভেতর প্রবলভাবে কাজ করে। কিন্তু ‍মুমিন মুসলিম যারা শয়তানের প্রতি আসক্ত হয় নি তাদের পক্ষে শয়তানের কাছে থেকে দূরে থাকা বা কুমন্ত্রণা থেকে বিরত খুবই সহজ।

এ প্রসঙ্গে তৃতীয় কারণ হিসাবে বলবো, অনেক ইসলামি চিন্তাবিদ আছেন যারা বলেন যে, পবিত্র রমযান মাসে বড় বড় শয়তানরা অনুপস্থিত থাকে কিন্তু ছোট এবং শয়তানের দোসররা মুক্ত থাকে এবং তারাই মানুষের ভিতরে কুমন্ত্রণা ঢুকিয়ে দেয়। এই শ্রেণীতে আরেকটি যুক্তি আছে তাহলো, যদিও আল্লাহ রমযান মাসে শয়তানকে শৃঙ্খলাবদ্ধ করে দেন তথাপি তারা মানুষের অন্তরে তাদের কুমন্ত্রণা দিতে থাকে এবং এরই মাধ্যমে তারা মানুষকে তাদের কাছাকাছি নিয়ে যায়।
আল্লাহ বলেন,

الَّذِي يُوَسْوِسُ فِي صُدُورِ النَّاسِ مِنَ الْجِنَّةِ وَالنَّاسِ

“তারা মানুষের অন্তরে কুমন্ত্রণা দেয় এবং তারা আসে হয়তো মানুষ কিংবা জ্বিনের ভেতর থেকে।” (সূরা নাস, আয়াত ৫,৬)

এখানে শয়তানের কথা বলা হয়েছে। শয়তান এমনই সত্তা যে মানুষের হৃদয়কে কলুষিত করে এবং পলায়ন করে এবং সে হতে পারে মানুষ কিংবা জ্বিন জাতি হতে। সুতরাং এমনও হতে পারে যে, আল্লাহ তায়ালা যে শয়তানকে বন্দি করেন সে হয়ত জ্বিন জাতির সদস্য কিন্তু মানবজাতির ভেতরের শয়তান তখনো মুক্ত থাকে। সুতরাং এক শ্রেণীর শয়তান যারা জ্বিন জাতি হতে আসে তারা অনুপস্থিত থাকে। কিন্তু মানবজাতীয় শয়তান উপস্থিত থাকে। তাই আমাদেরকে সতর্ক থাকতে হবে শয়তানের কুমন্ত্রণা হতে। এই কুমন্ত্রণাই হলো আসল জিনিস যেটি মানুষকে শয়তানের দিকে টেনে নিয়ে যায়। এই ব্যাপারটি হাদীসে পরিষ্কার করা হয়েছে। মুহাম্মদ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম বলেন, আল্লাহ তোমাদের জন্য রমযানকে উপস্থিত করেছেন। তোমাদের উচিত রোযা রাখা এবং এই রোযার উদ্দেশ্য হবে একমাত্র আল্লাহর সন্তুষ্টি অর্জন করা।

শয়তান কি শৃঙ্খলাবদ্ধ হবে? আল্লাহ আমাদেরকে রোযা রাখার জন্য নির্দেশ দিয়েছেন এবং বলেছেন যে, রোযার মাসে শয়তান শৃঙ্খলাবদ্ধ হবে। সুতরাং যদি তুমি রোযা রাখ তাহলে তোমার পেছনে যে শয়তান লেগে আছে আল্লাহ তাকে শৃঙ্খলাবদ্ধ করে দেবেন। এখানে শয়তান হতে বাঁচার জন্য শর্ত হলো আমাদেরকে অবশ্যই রোযা রাখতে হবে। যদি তুমি যথাযথ নিয়তের সাথে রোযা রাখো তাহলে নিশ্চিতভাবে শয়তান তোমার ভেতরে প্রবেশ করতে পারবে না।

এটা প্রমাণ করার সবচেয়ে যৌক্তিক উপায় হলো, যদি আমরা রমযান মাসে বিভিন্ন মুসলিম দেশের অপরাধ প্রতিবেদন দেখি তাহলে দেখা যাবে যে, অন্য মাসের তুলনায় এটি অনেক কম। কিন্তু যদি রমযান মাসে একটি অমুসলিম দেশের অপরাধ প্রতিবেদন দেখি তাহলে দেখা যাবে এটি অন্যান্য মাসের মতই রয়েছে। এর প্রধান কারণ হলো তারা রোযা পালন করে না, তারা মুসলিম নয় এবং শয়তান তাদের উপর তখনও প্রভাবশীল থাকে। যদিও সব মুসলমান রোযা থাকে না কিন্তু বেশির ভাগই রোযা থাকে এবং এই কারণে পবিত্র রমযান মাসে অন্যান্য অমুসলিম দেশের তুলনায় মুসলিম দেশগুলোতে অপরাধের পরিমাণ কম থাকে।

97



রমজানের শেষ দশকের ফজিলত ও তাৎপর্য



রমজান মাসের শেষ দশকের বিশেষ ফজিলত রয়েছে এবং আছে বেশ কিছু বৈশিষ্ট্য।


এগুলো হল :


(১) এ দশ দিনের মাঝে রয়েছে লাইলাতুল কদর নামের একটি রাত। যা হাজার মাস থেকেও শ্রেষ্ঠ। যে এ রাতে ঈমান ও ইহতিসাবের সাথে ইবাদত-বন্দেগি করবে তার অতীতের পাপগুলো ক্ষমা করে দেয়া হবে।


(২) নবী করিম (সাঃ) এ রাতে ইবাদত-বন্দেগিতে বেশি সময় ও শ্রম দিতেন, যা অন্য কোন রাতে দেখা যেত না। যেমন মুসলিম শরীফে আয়েশা (রাঃ) বর্ণিত হাদিসে এসেছে যে, তিনি এ রাতে কোরআন তিলাওয়াত, জিকির, সালাত ও দোয়ার মাধ্যমে জাগ্রত থাকতেন এরপর সেহরি গ্রহণ করতেন।


রমজানের শেষ দশকের ফজিলত ও তাৎপর্য রমজান মাসের শেষ দশকের বিশেষ ফজিলত রয়েছে এবং আছে বেশ কিছু বৈশিষ্ট্য। এগুলো হল :


(১) এ দশ দিনের মাঝে রয়েছে লাইলাতুল কদর নামের একটি রাত। যা হাজার মাস থেকেও শ্রেষ্ঠ। যে এ রাতে ঈমান ও ইহতিসাবের সাথে ইবাদত-বন্দেগি করবে তার অতীতের পাপগুলো ক্ষমা করে দেয়া হবে।


(২) নবী করিম (সাঃ) এ রাতে ইবাদত-বন্দেগিতে বেশি সময় ও শ্রম দিতেন, যা অন্য কোন রাতে দেখা যেত না। যেমন মুসলিম শরীফে আয়েশা (রাঃ) বর্ণিত হাদিসে এসেছে যে, তিনি এ রাতে কোরআন তিলাওয়াত, জিকির, সালাত ও দোয়ার মাধ্যমে জাগ্রত থাকতেন এরপর সেহরি গ্রহণ করতেন।


(৩) রমজানের শেষ দশক আসলে রাসুলুল্লাহ (সাঃ) পরনের লুঙ্গি শক্ত করে নিতেন। রাত্রি জাগরণ করতেন এবং পরিবারের সকলকে জাগিয়ে দিতেন। যেমন বোখারি ও মুসলিমে আয়েশা (রাঃ) বর্ণিত হাদিসে এসেছে। তিনি এ দশদিনের রাতে মোটেই নিদ্রা যেতেন না। পরিবারের সকলকে তিনি এ রাতে ইবাদত-বন্দেগি করার জন্য জাগিয়ে দিতেন। রাসুলুল্লাহ (সাঃ) লুঙ্গি শক্ত করে নিতেন’ কথাটির অর্থ হল তিনি এ দিনগুলোতে স্ত্রীদের থেকে আলাদা হয়ে যেতেন।

(৪) এ দশদিনের একটি বৈশিষ্ট্য হল, রাসুলুল্লাহ (সাঃ) এ শেষ দশদিনে মসজিদে এতেকাফ করতেন। প্রয়োজন ব্যতীত তিনি মসজিদ থেকে বের হতেন না। লাইলাতুল কদরের গুরুত্ব আল্লাহ রাব্বুল আলামিন এ রাতকে সকল রাতের চেয়ে শ্রেষ্ঠত্বের মর্যাদা দিয়েছেন। তিনি তার কালামে এ রাতকে প্রশংসার সাথে উল্লেখ করেছেন। তিনি তাঁর কালাম সম্পর্কে বলতে যেয়ে এরশাদ করেন :—

إِنَّا أَنْزَلْنَاهُ فِي لَيْلَةٍ مُبَارَكَةٍ إِنَّا كُنَّا مُنْذِرِينَ ﴿৩﴾ فِيهَا يُفْرَقُ كُلُّ أَمْرٍ حَكِيمٍ ﴿৪﴾. (الدخان)
‘আমি তো ইহা অবতীর্ণ করেছি এক বরকতময় রজনিতে। আমি তো সতর্ককারী। এ রজনিতে প্রত্যেক প্রজ্ঞাপূর্ণ বিষয় স্থিরকৃত হয়।’ সূরা আদ-দুখান : ৩-৪

বরকতময় রজনি হল লাইলাতুল কদর। আল্লাহ তাআলা একে বরকতময় বলে অভিহিত করেছেন। কারণ এ রাতে রয়েছে যেমন বরকত তেমনি কল্যাণ ও তাৎপর্য। বরকতের প্রধান কারণ হল এ রাতে আল-কোরআন নাজিল হয়েছে। এ রাতে প্রত্যেক গুরুত্বপূর্ণ বিষয়-সিদ্ধান্ত লওহে মাহফুজ থেকে ফেরেশতাদের হাতে অর্পণ করা হয় বাস্তবায়নের জন্য। এ রাতের অপর একটি বৈশিষ্ট্য হল আল্লাহ তাআলা এ রাত সম্পর্কে একটি পূর্ণ সূরা অবতীর্ণ করেছেন। যা কিয়ামত পর্যন্ত পঠিত হতে থাকবে।

إِنَّا أَنْزَلْنَاهُ فِي لَيْلَةِ الْقَدْرِ ﴿১﴾ وَمَا أَدْرَاكَ مَا لَيْلَةُ الْقَدْرِ ﴿২﴾ لَيْلَةُ الْقَدْرِ خَيْرٌ مِنْ أَلْفِ شَهْرٍ ﴿৩﴾ تَنَزَّلُ الْمَلَائِكَةُ وَالرُّوحُ فِيهَا بِإِذْنِ رَبِّهِمْ مِنْ كُلِّ أَمْرٍ ﴿৪﴾ سَلَامٌ هِيَ حَتَّى مَطْلَعِ الْفَجْرِ ﴿৫﴾ القدر
‘নিশ্চয় আমি কোরআন অবতীর্ণ করেছি এক মহিমান্বিত রজনিতে। আর মহিমান্বিত রজনি সম্পর্কে তুমি কী জান ? মহিমান্বিত রজনি সহস্র মাস অপেক্ষা শ্রেষ্ঠ। সে রাতেই ফেরেশতাগণ ও রুহ অবতীর্ণ হয় প্রত্যেক কাজে তাদের প্রতিপালকের অনুমতিক্রমে। শান্তিই শান্তি, সে রজনি উষার আবির্ভাব পর্যন্ত।

সূরা আল-কদর এ সুরাতে যে সকল বিষয় জানা গেল তা হল:

(১) এ রাত এমন এক রজনি যাতে মানবজাতির হেদায়াতের আলোকবর্তিকা মহা গ্রন্থ আল-কোরআন অবতীর্ণ হয়েছে।

(২) এ রজনি হাজার মাস অপেক্ষা শ্রেষ্ঠ। অর্থাৎ তিরাশি বছরের চেয়েও এর মূল্য বেশি।

(৩) এ রাতে ফেরেশতাগণ রহমত, বরকত ও কল্যাণ নিয়ে পৃথিবীতে অবতরণ করে থাকে।

(৪) এ রজনি শান্তির রজনি। আল্লাহর বান্দারা এ রাতে জাহান্নামের শাস্তি থেকে মুক্তি পেয়ে শান্তি অর্জন করে থাকে।

(৫) সময়ের প্রতি গুরুত্ব দেয়া। এ আয়াতগুলোতে অল্প সময়ে বেশি কাজ করার জন্য উৎসাহ প্রদান করা হল। যত সময় বেশি তত বেশি কাজ করতে হবে। সময় নষ্ট করা চলবে না।

(৬) গুনাহ ও পাপ থেকে ক্ষমা লাভ। এ রাতের এই ফজিলত সম্পর্কে বোখারি ও মুসলিম বর্ণিত হাদিসে এসেছে—

إن النبي صلى الله عليه وسلم قال : من قام ليلة القدر إيمانا واحتسابا غفر له ما تقدم من ذنبه. رواه البخاري ومسلم
নবী করিম (সাঃ) বলেছেন : যে লাইলাতুল কদরে ঈমান ও ইহতিসাবের সাথে সালাত আদায় ও ইবাদত-বন্দেগি করবে তার অতীতের পাপসমূহ ক্ষমা করে দেয়া হবে। বর্ণনায় : বোখারি ও মুসলিম

লাইলাতুল কদর কখন ?

আল-কোরআনে নির্দিষ্ট করে বলা হয়নি লাইলাতুল কদর কোন রাত। তবে কুরআনের ভাষ্য হল লাইলাতুল কদর রমজান মাসে। কিয়ামত পর্যন্ত রমজান মাসে লাইলাতুল কদর অব্যাহত থাকবে। এবং এ রজনি রমজানের শেষ দশকে হবে বলে সহি হাদিসে এসেছে। এবং তা রমজানের শেষ দশকের বেজোড় রাতগুলোতে হওয়ার সম্ভাবনা বেশি বলে হাদিসে এসেছে।

تحروا ليلة القدر في العشر الأواخر من رمضان. رواه البخاري
‘তোমরা রমজানের শেষ দশকে লাইলাতুল কদর অন্বেষণ কর।’ বর্ণনায়: বোখারি

এবং রমজানের শেষ সাত দিনে লাইলাতুল কদর থাকার সম্ভাবনা অধিকতর। যেমন হাদিসে এসেছে

. . . فمن كان متحر بها فليتحرها في السبع الأواخر. متفق عليه
‘যে লাইলাতুল কদর অন্বেষণ করতে চায় সে যেন শেষ সাত দিনে অন্বেষণ করে।’ বর্ণনায় : বোখারি ও মুসলিম

অধিকতর সম্ভাবনার দিক দিয়ে প্রথম হল রমজান মাসের সাতাশ তারিখ। দ্বিতীয় হল পঁচিশ তারিখ। তৃতীয় হল ঊন ত্রিশ তারিখ। চতুর্থ হল একুশ তারিখ। পঞ্চম হল তেইশ তারিখ। আল্লাহ রাব্বুল আলামিন এ রাতকে গোপন রেখেছেন আমাদের উপর রহম করে। তিনি দেখতে চান এর বরকত ও ফজিলত লাভের জন্য কে কত প্রচেষ্টা চালাতে পারে। লাইলাতুল কদরে আমাদের করণীয় হল বেশি করে দোয়া করা। আয়েশা (রাঃ) নবী করিম (সাঃ) কে জিজ্ঞেস করলেন, লাইলাতুল কদরে আমি কি দোয়া করতে পারি? তিনি বললেন, বলবে—

اَللّهُم إِنَّكَ عَفُوٌّ تٌحِبُّ العَفْوَ فَاعْفُ عَنِّيْ . رواه الترمذي
‘হে আল¬াহ ! আপনি ক্ষমাশীল, ক্ষমাকে ভালোবাসেন, অতএব আমাকে ক্ষমা করুন।’ বর্ণনায় : তিরমিজি

এতেকাফ : এতেকাফ হল সকল কাজ থেকে মুক্ত হয়ে আল্লাহর ইবাদতের জন্য মসজিদে অবস্থান করা। এটা হল সুন্নত। আয়েশা (রাঃ) বলেন :—

كان النبي صلى الله عليه وسلم يعتكف في العشر الأواخر من رمضان حتى توفاه الله عز وجل، ثم اعتكف أزوجه من بعده. رواه البخاري ومسلم
‘রাসুলুল্লাহ (সাঃ) রমজান মাসের শেষ দশকে মসজিদে এতেকাফ করতেন। যতদিন না আল্লাহ তাকে মৃত্যু দান করেছেন ততদিন তিনি এ আমল অব্যাহত রেখেছেন। তার ইন্তেকালের পর তার স্ত্রী-গণ এতেকাফ করেছেন।’ বর্ণনায় : বোখারি ও মুসলিম

এতেকাফের উদ্দেশ্য: মানুষের ঝামেলা থেকে দূরে থেকে আল্লাহ তাআলার ইবাদতে একাগ্রচিত্তে নিয়োজিত হওয়া। এ লক্ষ্যে কোন মসজিদে অবস্থান করে আল্লাহর তরফ থেকে সওয়াব ও লাইলাতুল কদর লাভ করার আশা করা। এতেকাফকারীর কর্তব্য হল অনর্থক কথা ও কাজ পরিহার করে সালাত, কোরআন তিলাওয়াত, জিকির-আজকার, ইস্তিগফার, দোয়া ইত্যাদি ইবাদত-বন্দেগিতে লিপ্ত থাকা। তবে পরিবার পরিজন বা অন্য কারো সাথে অতিপ্রয়োজনীয় কথা বলতে দোষ নেই। এতেকাফকারী নিজ অন্তরকে সর্বদা আল্লাহর সাথে সম্পৃক্ত রাখতে চেষ্টা করবে। নিজের অবস্থার দিকে খেয়াল করবে। আল্লাহর আদেশ-নিষেধ পালনের ব্যাপারে নিজের অলসতা ও অবহেলা করার কথা মনে করবে। নিজের পাপাচার সত্ত্বেও আল্লাহ যে কত নেয়ামত দিয়েছেন তা স্মরণ করে তার প্রতি কৃতজ্ঞ হবে। গভীরভাবে আল্লাহর কালাম অধ্যয়ন করবে। খাওয়া-দাওয়া, নিদ্রা ও গল্প গুজব কমিয়ে দেবে। কেননা এ সকল কাজ-কর্ম আল্লাহর স্মরণ থেকে অন্তরকে ফিরিয়ে রাখে। অনেকে এতেকাফকে অত্যধিক খাওয়া-দাওয়া ও সাথিদের সাথে গল্প-গুজব করে সময় কাটানোর সুযোগ হিসেবে গ্রহণ করে থাকেন। এতে এতেকাফের ক্ষতি হয় না বটে তবে আল্লাহর রাসূলের এতেকাফ ছিল অন্য রকম। এতেকাফ অবস্থায় স্ত্রী সহবাস, চুম্বন, স্পর্শ নিষেধ। যেমন আল্লাহ রাব্বুল আলামিন বলেন :

وَلَا تُبَاشِرُوهُنَّ وَأَنْتُمْ عَاكِفُونَ فِي الْمَسَاجِد .(البقرة : ১৮৭)
‘তোমরা মসজিদে এতেকাফরত অবস্থায় স্ত্রীদের সাথে মিলিত হবে না।’ সূরা আল-বাকারা : ১৮৭

শরীরের কিছু অংশ যদি মসজিদ থেকে বের করা হয় তাতে দোষ নেই। নবী করিম (সাঃ) এতেকাফ অবস্থায় নিজ মাথা মসজিদ থেকে বের করতেন। তখন আম্মাজান আয়েশা (রাঃ) তাঁর মাথার চুল বিন্যস্ত করে দিতেন।

এতেকাফ অবস্থায় মসজিদ থেকে বের হওয়া ও তার বিধান : এতেকাফ অবস্থায় মসজিদ থেকে বের হওয়া তিন ধরনের হতে পারে:—

এক. মানবীয় প্রয়োজনে বের হওয়ার অনুমতি আছে। যেমন পায়খানা, প্রস্রাবের জন্য, খাওয়া-দাওয়ার জন্য, পবিত্রতা অর্জনের জন্য। তবে শর্ত হল এ সকল বিষয় যদি মসজিদের গণ্ডির মাঝে সেরে নেয়া যায় তবে মসজিদ থেকে বের হওয়া যাবে না।

দুই. এমন সকল নেক আমল বা ইবাদত-বন্দেগির জন্য বের হওয়া যাবে না যা তার জন্য অপরিহার্য নয়। যেমন রোগীর সেবা করা, জানাজাতে অংশ নেয়া ইত্যাদি। তিন. এমন সকল কাজের জন্য মসজিদ থেকে বের হওয়া যাবে না যা এতেকাফের বিরোধী। যেমন ক্রয়-বিক্রয়, চাষাবাদ ইত্যাদি। এতেকাফ অবস্থায় এ সকল কাজের জন্য মসজিদ থেকে বের হলে এতেকাফ বাতিল হয়ে যায়।

98
Islam / রমজান ও ডায়াবেটিস
« on: August 02, 2012, 11:17:18 AM »
রমজান ও ডায়াবেটিস


বিসমিল্লাহির রাহমানির রাহিম




সুপরিকল্পিত ও সঠিক নির্দেশিত উপায় অবলম্বন করলে রমজান মাসে একজন ডায়াবেটিসের রোগীর কোনো রকমের সমস্যা বা অসুস্থ হওয়ার কথা নয়, কিন্তু এর বিপরীতটি ঘটলে অনেক সময় বড় ধরনের বিপর্যয় ঘটে যেতে পারে।”

 

চলছে রমজান মাস। যাঁরা ডায়াবেটিসে ভুগছেন, তাঁদের স্বাস্থ রক্ষা ও রোজা রাখা না-রাখা নিয়ে যে প্রশ্নগুলো রয়েছে, তার জবাব নিয়ে এই বিশেষ আয়োজন।

 

বিশ্বের প্রায় ১৫৭ কোটি মুসলিমের মধ্যে প্রতিবছর প্রায় ৫ কোটি ডায়াবেটিসের রোগী রমজান মাসে রোজা পালন করেন। ১৩টি মুসলিমপ্রধান দেশে জরিপ চালিয়ে দেখা গেছে, প্রায় ৮০ শতাংশ টাইপ ২ ডায়াবেটিসের রোগী নিয়মিত রোজা পালন করে থাকেন। আপাতদৃষ্টিতে একজন সুস্থ ও সুনিয়ন্ত্রিত ডায়াবেটিসের রোগীর রোজা পালন করতে কোনো বাধা নেই। কিন্তু রমজান মাসে পরিবর্তিত খাদ্যাভ্যাস, ব্যায়ামের ধরন ও ডায়াবেটিসের ওষুধ বা ইনসুলিনের পরিবর্তিত মাত্রা ও সময় সঠিকভাবে জেনে নিয়ে একজন ডায়াবেটিস রোগী রোজা পালনের জন্য সঠিকভাবে তৈরি হয়ে নেবেন। সুপরিকল্পিত ও সঠিক নির্দেশিত উপায় অবলম্বন করলে রমজান মাসে একজন ডায়াবেটিসের রোগীর কোনো রকমের সমস্যা বা অসুস্থ হওয়ার কথা নয়, কিন্তু এর বিপরীতটি ঘটলে অনেক সময় বড় ধরনের বিপর্যয় ঘটে যেতে পারে।

 

রোজা পালনে ঝুঁকি আছে কাদের?

রমজান মাস শুরু হওয়ার অন্তত দুই থেকে তিন মাস আগেই পরিকল্পনা ও প্রস্তুতি নিতে শুরু করেন এবং আপনার চিকিৎসকের সঙ্গে যোগাযোগ রক্ষা করে দিন। প্রথমেই জেনে নিন আপনার রোজা পালনে কোনো বাধা আছে কি না। গত তিন মাসের মধ্যে হাইপোগ্লাইসেমিয়া (রক্তে গ্লুকোজ কমে যাওয়া) এবং ডায়াবেটিস কোমায় আক্রান্ত হওয়া ব্যক্তিদের ঝুঁকি থেকেই যায়। যাঁদের বারবার হাইপোগ্লাইসেমিয়া হওয়ার ইতিহাস আছে, যাঁরা হাইপোগ্লাইসেমিয়া-অসচেতন রোগী, যাঁদের রক্তে সুগার একেবারেই অনিয়ন্ত্রিত, যাঁরা যকৃত, কিডনি, হূদ্যন্ত্র ও অন্যান্য রোগে আক্রান্ত, ডায়ালাইসিস করছেন, এমন রোগী, অত্যধিক বয়স্ক রোগী এবং গর্ভবতী ডায়াবেটিসের রোগীরা রোজা থেকে বিরত থাকলেই ভালো। নিজের সম্পর্কে সঠিক ধারণা পেতে রমজানের দুই থেকে তিন মাস আগে একটি সম্পূর্ণ চেকআপ করিয়ে নিন। এ সময় রক্তের সুগার, সুগারের গড় মাত্রা বা এইচবিএওয়ানসি, কিডনি ও লিভার পরীক্ষা করিয়ে নেওয়া উচিত। এসব পরীক্ষার রিপোর্টের ওপর ভিত্তি করে আসন্ন রোজা পালনের পরিকল্পনা নিন।

 

কী কী বিপদ হতে পারে?

রমজানের আগে ও সময় সঠিকভাবে প্রস্তুতি ও শিক্ষা না নিলে অন্ততপক্ষে চার রকমের বিপদ ঘটতে পারে এ সময়।

[এক] হঠাৎ করে রক্তে সুগার অনেক কমে গিয়ে অজ্ঞান হয়ে যেতে পারেন অর্থাৎ হাইপোগ্লাইসেমিকে আক্রান্ত হতে পারেন।

[দুই] রক্তে সুগার অনিয়ন্ত্রিত হয়ে যেতে পারে।

[তিন] ডায়াবেটিস কিটোএসিডোসিস বা কোমা হয়ে যেতে পারেন।

[চার] পানিশূন্যতা ও থ্রম্বোসিসে আক্রান্ত হতে পারেন।

 

 

রমজানের খাদ্যাভ্যাস ও ব্যায়াম

একজন ডায়াবেটিসের রোগী রমজানের আগে যে পরিমাণ ক্যালরি গ্রহণ করতেন, রমজান মাসেও তার হেরফের হবে না, কেবল এর সময়সূচি ও উপাদান পরিবর্তিত হতে পারে। ইফতারির সময় ও পরে হঠাৎ করে বেশি পরিমাণে খাদ্য গ্রহণ না করা, চিনি, মিষ্টি ও ভাজাপোড়া খাবার থেকে বিরত থাকা এবং পুষ্টিকর খাদ্য গ্রহণের অভ্যাসের মাধ্যমে এ সময় অনেকটাই সুস্থ থাকা যায়। রক্তে দ্রুত সুগার বাড়ায় না, এমন খাবারকে লো গ্লাইসেমিক ফুড বলা হয়ে থাকে। এর মধ্যে পড়ে লাল আটা, লাল চালের ভাত, গোটা শস্য, শস্যবীজ ইত্যাদি। রোজার মাসে এসব খাবারের পরিমিত গ্রহণ রক্তে সুগারের মাত্রা দীর্ঘক্ষণ ধরে সুষম রাখতে সাহায্য করবে। হাই ক্যালরি ও হাই গ্লাইসেমিক ফুড যত সুস্বাদু ও মুখরোচকই হোক না কেন, যেমন জিলাপি, লাড্ডু, শরবত, হালুয়া, কেক, আলুনি, সফট ড্রিংক ইত্যাদি থেকে বিরত থাকুন। বেশি পরিমাণে তেল আছে এমন খাবার, যেমন—কাবাব, বেগুনি, পেঁয়াজু বা ভাজাপোড়ায় কেবল ওজনই বাড়াবে না, রক্তে চর্বি বাড়িয়ে দেবে, পেটে বদহজম ও গ্যাস সৃষ্টি করবে। রোজা রাখলে সূর্যাস্তের পর অন্তত তিনবার খাদ্য গ্রহণ করুন। ইফতারির সময় সুষম ও পুষ্টিকর পরিমিত আহার, রাত ১০টার দিকে রুটি বা হালকা ডিনার এবং অবশ্যই শেষ রাতে ভাত বা রুটিসহযোগে যথেষ্ট পরিমাণে আমিষ ও তরল খাদ্য গ্রহণ করুন। সেহির না খেয়ে কোনো অবস্থাতেই রোজা রাখা উচিত নয়। রোজা রেখে দিনের বেলা অতিরিক্ত পরিশ্রম ও ব্যায়াম না করাই ভালো। এতে রক্তে সুগার হঠাৎ কমে যেতে পারে এবং অতিরিক্ত ঘাম হওয়ার কারণে পানিশূন্যতা দেখা দিতে পারে। সন্ধ্যার পর হালকা ব্যায়াম বা আধা ঘণ্টা হাঁটা যেতে পারে। যাঁরা নিয়মিত দীর্ঘ ২০ রাকাত তারাবির নামাজ পড়ে থাকেন, তাঁদের ক্ষেত্রে এটিই ব্যায়ামের বিকল্প, আলাদা করে ব্যায়ামের প্রয়োজন নেই।

 

নিয়মিত সুগার মাপুন

বিশ্বের বড় বড় ইসলামি চিন্তাবিদ ও আলেমগণ আগেই রায় দিয়েছেন যে রোজা রেখে রক্তে সুগার পরীক্ষা করালে তাতে রোজা ভেঙে যায় না। রমজান মাসে বাড়িতে গ্লুকোমিটারে মাঝেমধ্যে নিজের রক্তের সুগার নিজে মেপে দেখুন। অন্তত সপ্তাহে এক বা দুই দিন সেহিরর দুই ঘণ্টা পর এবং ইফতারির অন্তত আধা ঘণ্টা আগে সুগার মাপুন। সেহিরর পর সুগার আট মিলিমোল বা এর কম এবং ইফতারির আগে ছয় মিলিমোল বা এর কম থাকা বাঞ্ছনীয়। এর মধ্যে দিনের যেকোনো সময় খারাপ লাগলে বা শরীর কাঁঁপলে, ঘেমে উঠলে, মাথা ফাঁকা লাগলে অবশ্যই সুগার মাপুন। দিনের যেকোনো সময়ে সুগার ৩ দশমিক ৩ মিলিমোল বা তার কম এবং দিনের পূর্বাহ্নেই ৩ দশমিক ৯ মিলিমোল বা তার কম হয়ে গেলে সেদিন রোজা ভেঙে ফেলতে হবে। দিনের যেকোনো সময় রক্তে সুগার ১৬ মিলিমোলের বেশি হয়ে গেলেও রোজা ভাঙতে হবে।

 

ওষুধ ও ইনসুলিনের মাত্রা ও সময় জেনে নিন

রমজান মাসে ডায়াবেটিসের ওষুধ ও ইনসুলিনের মাত্রা ও সময়সূচি পরিবর্তন করা হয়। সোজা নিয়মে সকালের ডোজটি দেওয়া হয় ইফতারির সময় এবং রাতের ডোজটি অর্ধেক করে শেষ রাতে দেওয়া হয়। কিন্তু চিকিৎসকের পরামর্শ ছাড়া এ ধরনের পরিবর্তন করা উচিত নয়। কোন ওষুধ এবং কোন ধরনের ইনসুলিনের জন্য কোন ধরনের পরিবর্তন ঠিক কোন রোগীর জন্য প্রযোজ্য হবে, তা চিকিৎসকই বলতে পারবেন। কাজেই রমজানে নিজের ওষুধের মাত্রা ও সময় জেনে নেওয়ার জন্য আগে থেকেই চিকিৎসকের সঙ্গে পরামর্শ করে নিন।

ডায়াবেটিসে আক্রান্ত রোগীর ইফতারি হওয়া চাই সুষম ও পুষ্টিকর।

 

সূত্র: তানজিনা হোসেন, দৈনিক প্রথম আলো, জুলাই ১৮, ২০১২

উল্লেখ্য যে, অসুস্থতা জনিত কারণে রামাযানের রোযা ভাঙ্গার প্রয়োজন দেখা দিলে সে রোযাগুলো রামাযানের পর বাকি ১১ মাসের মধ্যে যে কোন সময় সাধারণ নিয়মে কাজা করে নিতে হবে। (দেখুন সূরা বাকারা: ১৮৩ নং আয়াত)

 

আল্লাহ তায়ালা আমাদেরকে সুস্থতা সহকারে সঠিক পদ্ধতিতে রামাযানের সম্পূর্ণ রোযা পালনের তাওফীক দান করুন। আমীন।

99

এতেকাফ তাৎপর্য, উদ্দেশ্য ও বিধান


সংকলন : মুহাম্মদ আকতারুজ্জাম

সম্পাদনা : মুহাম্মদ শামছুল হক সিদ্দিক



এতেকাফের সংজ্ঞা
বিশেষ নিয়তে বিশেষ অবস্থায় আল্লাহ তা-আলার আনুগত্যের উদ্দেশ্যে মসজিদে অবস্থান করাকে এতেকাফ বলে।

এতেকাফের ফজিলত
এতেকাফ একটি মহান ইবাদত, মদিনায় অবস্থানকালীন সময়ে রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম প্রতি বছরই এতেকাফ  পালন করেছেন। দাওয়াত, তরবিয়ত, শিক্ষা এবং জিহাদে ব্যস্ত থাকা সত্ত্বেও রমজানে তিনি এতেকাফ ছাড়েননি। এতেকাফ ঈমানি তরবিয়তের একটি পাঠশালা, এবং রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লামের হিদায়েতি আলোর একটি প্রতীক। এতেকাফরত অবস্থায় বান্দা নিজেকে আল্লাহর ইবাদতের জন্য দুনিয়ার অন্যান্য সকল বিষয়  থেকে আলাদা করে নেয়।  ঐকান্তিকভাবে মশগুল হয়ে পড়ে আল্লাহর নৈকট্য অর্জনের নিরন্তর সাধনায়। এতেকাফ  ঈমান বৃদ্ধির একটি মূখ্য সুযোগ। সকলের উচিত এ সুযোগ কাজে লাগিয়ে নিজের ইমানি চেতনাকে প্রাণিত করে তোলা ও উন্নততর পর্যায়ে পৌছেঁ দেয়ার চেষ্টা করা।

আল-কুরআনুল কারিমে বিভিন্নভাবে এতেকাফ সম্পর্কে বর্ণনা এসেছে, ইবরাহিম আ. ও ইসমাইল আ.  এর কথা উল্লেখ করে এরশাদ হয়েছে :

وَعَهِدْنَا إِلَى إِبْرَاهِيمَ وَإِسْمَاعِيلَ أَنْ طَهِّرَا بَيْتِيَ لِلطَّائِفِينَ وَالْعَاكِفِينَ وَالرُّكَّعِ السُّجُودِ) ﴿১২৫﴾ سورة البقرة
“এবং আমি ইবরাহিম ও ইসমাইলকে আদেশ করলাম, তোমরা আমার গৃহকে তাওয়াফকারী, এতেকাফকারী ও রুকু-সেজদাকারীদের জন্য পবিত্র করো।” ( সূরা বাকারা : ১২৫)

এতেকাফ অবস্থায় স্ত্রীদের সাথে কি আচরণ হবে তা বলতে গিয়ে আল্লাহ তা-আলা বলেন :

وَلَا تُبَاشِرُوهُنَّ وَأَنْتُمْ عَاكِفُونَ فِي الْمَسَاجِدِ.  سورة البقرة ১৮৭
“আর তোমরা মসজিদে এতেকাফ কালে স্ত্রীদের সাথে মেলামেশা করো না।” ( সূরা বাকারা : ১৮৭)

ইবরাহিম আ.  তাঁর পিতা এবং জাতিকে লক্ষ্য করে মূর্তির ভর্ৎসনা করতে যেয়ে যা বলেছিলেন, আল্লাহ তা-আলা তা উল্লেখ করে বলেন:

إِذْ قَالَ لِأَبِيهِ وَقَوْمِهِ مَا هَذِهِ التَّمَاثِيلُ الَّتِي أَنْتُمْ لَهَا عَاكِفُونَ ﴿৫২﴾ سورة الأنبياء
“যখন তিনি তাঁর পিতা ও তাঁর সম্প্রদায়কে বললেন: “এই মূর্তিগুলো কি, যাদের পূজারি (এতেকাফকারী) হয়ে) তোমরা বসে আছ” ?  (সূরা আম্বিয়া : ৫২)

রসুলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লামের অসংখ্য হাদিস এতেকাফ সম্পর্কে বর্ণিত হয়েছে, তার মধ্য হতে ফজিলত সম্পর্কিত কিছু হাদিস নিচে উল্লেখ করা হল।

عن عائشة رضي الله عنها قالت: كان رسول الله صلي الله عليه وسلم يعتكف العشر الأواخر حتي توفاه الله، ثم أزواجه من بعده.     رواه البخاري و مسلم
আয়েশা রাদি-আল্লাহু আনহা থেকে বর্ণিত, তিনি বলেন: রসুলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম রমজানের শেষের দশকে এতেকাফ করেছেন, ইন্তেকাল পর্যন্ত। এরপর তাঁর স্ত্রীগণ এতেকাফ করেছেন। [ বুখারি ও মুসলিম]

عن عائشة رضي الله عنها قالت: كان رسول الله صلي الله عليه وسلم يعتكف في كل رمضان . ( البخاري  رقم الحديث :  ২০৪১)
অর্থাৎ: আয়েশা রাদি-আল্লাহু আনহা থেকে বর্ণিত, তিনি বলেন: রসুলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি  ওয়াসাল্লাম প্রত্যেক রমজানে এতেকাফ করতেন। (বুখারি ২০৪১)

অন্য এক হাদিসে এসেছে—

إني اعتكفت العشر الأول ألتمس هذه الليلة، ثم اعتكفت العشر الأوسط، ثم أُتيت فقيل لي إنها في العشر الأواخر فمن أحب منكم أن يعتكف فليعتكف، فاعتكف الناس معه، قال: وإني أُريتها ليلة وتر وأني أسجد صبيحتها في طين وماء، فأصبح من ليلة إحدى وعشرين وقد قام إلى الصبح، فمطرت السماء فوكف المسجد، فأبصرت الطين والماء، فخرج حين فرغ من صلاة الصبح وجبينه وروثة أنفه فيهما الطين والماء، وإذا هي ليلة إحدى وعشرين
আমি (প্রথমে) এ রাতের সন্ধানে প্রথম দশে এতেকাফ পালন করি। অত:পর এতেকাফ পালন করি মাঝের দশে। পরবর্তীতে ওহির মাধ্যমে আমাকে জানানো হয় যে, এ রাত শেষ দশে রয়েছে। সুতরাং তোমাদের মাঝে যে (এ দশে) এতেকাফ পালনে আগ্রহী, সে যেন তা পালন করে। লোকেরা তার সাথে এতেকাফ পালন করল। রাসূল বলেন—আমাকে তা এক বেজোড় রাতে দেখানো হয়েছে এবং দেখানো হয়েছে যে, আমি সে ভোরে কাদা ও মাটিতে সেজদা দিচ্ছি। অত:পর রাসূল একুশের রাতের ভোর যাপন করলেন, ফজর পর্যন্ত তিনি কিয়ামুল্লাইল করেছিলেন। তিনি ফজর আদায়ের জন্য দণ্ডায়মান হয়েছিলেন। তখন আকাশ ছেপে বৃষ্টি নেমে এল, এবং মসজিদে চুঁইয়ে চুঁইয়ে পানি পড়ল। আমি কাদা ও পানি দেখতে পেলাম। ফজর সালাত শেষে যখন তিনি বের হলেন, তখন তার কপাল ও নাকের পাশে ছিল পানি ও কাদা। সেটি ছিল একুশের রাত।

আবু হুরাইরা রা. হতে বর্ণিত, তিনি বলেন :

كان النبي صلي الله عليه و سلم يعتكف في كل رمضان عشرة أيام، فلما كان العام الذي قبض فيه اعتكف عشرين يوماً
রাসূল সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম প্রতি রমজানে দশ দিন এতেকাফ  করতেন, তবে যে বছর তিনি পরলোকগত হন, সে বছর তিনি বিশ দিন এতেকাফে কাটান।

আবু হুরাইরা  রা. হতে বর্ণিত হাদিসে উভয়টির উল্লেখ পাওয়া যায়।  তিনি বলেন —

عن أبي هريرة رضي الله عنه قال: كان النبي صلي الله عليه وسلم يعتكف في كل رمضان عشرة أيام فلما كان العام الذي قبض فيه اعتكف عشرين يوما. رواه البخاري
আবু হুরাইরা রা. হতে বর্ণিত, তিনি বলেন : রাসূলুল্লাহ  সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম প্রতি রমজানের শেষ দশদিন এতেকাফ করতেন। তবে যে বছর পরলোকগত হন তিনি বিশ দিন এতেকাফ করেছেন। ( বুখারি)

عن عائشة رضي الله عنها أن النبي صلي  الله عليه وسلم اعتكف معه بعض نسائه وهي مستحاضة تري الدم فربما وضعت الطست تحتها من الدم) رواه البخاري
আয়শা রাদিয়াল্লাহু  আনহা বলেন, রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লামের সাথে তাঁর জনৈকা স্ত্রীও এতেকাফ করলেন। তখন তিনি ছিলেন এস্তেহাজা  অবস্থায়, রক্ত দেখছেন। রক্তের কারণে হয়তো তাঁর নীচে গামলা রাখা হচ্ছে। ( বুখারি)

রাসূল বলেন—

إني اعتكفت العشر الأُوَل ألتمس هذه الليلة، ثم اعتكفت العشر الأوسط، ثم أُتيت فقيل لي: إنها في العشر الأواخر؛ فمن أحب منكم أن يعتكف فليعتكف؛ فاعتكف الناس معه
আমি কদরের রাত্রির সন্ধানে প্রথম দশ দিন এতেকাফ করলাম। এরপর এতেকাফ করলাম মধ্যবর্তী দশদিন। অত:পর ওহি প্রেরণ করে আমাকে জানানো হল যে তা শেষ দশদিনে। সুতরাং তোমাদের যে এতেকাফ পছন্দ করবে, সে যেন এতেকাফ করে। ফলে, মানুষ তার সাথে এতেকাফ যাপন করল।

এতেকাফের উপকারিতা
১- এতেকাফকারী এক নামাজের পর আর এক নামাজের জন্য অপেক্ষা করে থাকে, আর এ অপেক্ষার অনেক ফজিলত রয়েছে। আবু হুরাইরা রাদি-আল্লাহু আনহু থেকে বর্ণিত, তিনি বলেন, রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম বলেছেন:

إن الملائكة تصلي على أحدكم ما دام في مصلاه ما لم يحدث: اللهم اغفر له، اللهم ارحمه لا يزال أحدكم في مصلاه ما دامت الصلاة تحبسه، لا يمنعه أن ينقلب إلي أهله إلا الصلاة.   رواه البخاري
অর্থাৎ: নিশ্চয় ফেরেশতারা তোমাদের একজনের জন্য দোয়া করতে থাকেন যতক্ষণ সে কথা না বলে, নামাজের স্থানে অবস্থান করে। তারা বলতে থাকে আল্লাহ তাকে ক্ষমা করে দিন, আল্লাহ তার প্রতি দয়া করুন, যতক্ষণ তোমাদের কেউ নামাজের স্থানে থাকবে, ও নামাজ তাকে আটকিয়ে  রাখবে, তার পরিবারের নিকট যেতে নামাজ ছাড়া আর কিছু বিরত রাখবে না, ফেরেশতারা তার জন্য এভাবে দোয়া করতে থাকবে।

২- এতেকাফকারী কদরের রাতের তালাশে থাকে, যে রাত অনির্দিষ্টভাবে রমজানের যে কোন রাত হতে পারে। এই রহস্যের  কারণে আল্লাহ তা-আলা সেটিকে বান্দাদের থেকে গোপন রেখেছেন, যেন তারা মাস জুড়ে তাকে তালাশ করতে থাকে।

৩- এতেকাফের ফলে আল্লাহ তা’আলার সাথে সম্পর্ক দৃঢ় হয়,এবং আল্লাহ তা’আলার জন্য মস্তক অবনত করার প্রকৃত চিত্র ফুটে উঠে। কেননা আল্লাহ তা’আলা বলেন:

وَمَا خَلَقْتُ الْجِنَّ وَالْإِنْسَ إِلَّا لِيَعْبُدُونِ) ﴿৫৬﴾الذاريات
অর্থাৎ: আমি মানুষ এবং জিন জাতিকে একমাত্র আমারই ইবাদতের জন্য সৃষ্টি করেছি। [সুরা আজ-জারিয়াত: ৫৬]

আর এ ইবাদতের বিবিধ  প্রতিফলন ঘটে এতেকাফ অবস্থায়। কেননা এতেকাফ অবস্থায় একজন মানুষ নিজেকে পুরোপুরি আল্লাহর ইবাদতের সীমানায় বেঁধে নেয় এবং আল্লাহর সন্তুষ্টির কামনায় ব্যকুল হয়ে পড়ে।  আল্লাহ তা-আলাও তাঁর বান্দাদেরকে নিরাশ করেন না, বরং তিনি বান্দাদেরকে নিরাশ হতে নিষেধ করে দিয়ে বলেছেন:

قُلْ يَا عِبَادِيَ الَّذِينَ أَسْرَفُوا عَلَى أَنْفُسِهِمْ لَا تَقْنَطُوا مِنْ رَحْمَةِ اللَّهِ إِنَّ اللَّهَ يَغْفِرُ الذُّنُوبَ جَمِيعًا إِنَّهُ هُوَ الْغَفُورُ الرَّحِيمُ ﴿৫৩﴾الزمر
অর্থাৎ: বলুন, হে আমার বান্দাগণ! যারা নিজেদের উপর জুলুম করেছ তোমরা আল্লাহর রহমত থেকে নিরাশ হয়ও না। নিশ্চয় আল্লাহ সমস্ত গুনাহ মাফ করে দেন। তিনি ক্ষমাশীল, পরম দয়ালু। [সুরা ঝুমার : ৫৩]

(وَإِذَا سَأَلَكَ عِبَادِي عَنِّي فَإِنِّي قَرِيبٌ أُجِيبُ دَعْوَةَ الدَّاعِ إِذَا دَعَانِ فَلْيَسْتَجِيبُوا لِي وَلْيُؤْمِنُوا بِي لَعَلَّهُمْ يَرْشُدُونَ ﴿১৮৬ سورة البقرة)
অর্থাৎ: আর আমার বান্দারা যখন তোমার কাছে জিজ্ঞেস করে আমার ব্যাপারে- বস্তুত আমি রয়েছি সন্নিকটে। প্রার্থনাকারীর প্রার্থনা কবুল করি যখন সে  প্রার্থনা করে। কাজেই তারা যেন আমার হুকুম মান্য করে এবং আমার প্রতি বিশ্বাস স্থাপন করে। সম্ভবত তারা পথ প্রাপ্ত হবে। (আল-বাকারা : ১৮৬)

৪- যখন কেউ মসজিদে অবস্থান করা পছন্দ করতে লাগে— যা সম্ভব প্রবৃত্তিকে অভ্যস্ত করানোর  মাধ্যমে,  কেননা প্রবৃত্তিকে যে বিষয়ে  অভ্যস্ত করানো  হবে  সে বিষয়েই সে অভ্যস্ত হয়ে পড়বে— মসজিদে অবস্থান করা পছন্দ হতে শুরু করলে মসজিদকে সে  ভালোবাসবে,  সেখানে নামাজ আদায়কে ভালোবাসবে। আর এ প্রক্রিয়ায় আল্লাহর সাথে তার সম্পর্ক মজবুত হবে। হৃদয়ে সৃষ্টি হবে নামাজের ভালোবাসা, এবং নামাজ আদায়ের মাধ্যমেই অনুভব করতে শুরু করবে হৃদয়ের প্রশান্তি। যে প্রশান্তির কথা  রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম এভাবে বলেছিলেন:

(أرحنا بها يا بلال، أرحنا بها يا بلال)
অর্থাৎ: নামাজের মাধ্যমে আমাদেরকে শান্ত করো হে বেলাল, নামাজের মাধ্যমে আমাদেরকে শান্ত করো হে বেলাল।

৫- মসজিদে এতেকাফের মাধ্যমে একমাত্র আল্লাহ তা’আলার উদ্দেশে নিজেকে আবদ্ধ করে নেওয়ার কারণে মুসলমানের  অন্তরের কঠোরতা দূরীভূত হয়, কেননা কঠোরতা সৃষ্টি হয়  দুনিয়ার প্রতি ভালোবাসা ও পার্থিবতায় নিজেকে আরোপিত করে রাখার কারণে। মসজিদে নিজেকে আবদ্ধ করে  রাখার কারণে দুনিয়ার প্রতি ভালোবাসায় ছেদ পড়ে এবং আত্মিক উন্নতির অভিজ্ঞতা অনুভূত হয়। মসজিদে এতেকাফ করার কারণে ফেরেশতারা দোয়া করতে থাকে, ফলে এতেকাফকারী ব্যক্তির আত্মা নিম্নাবস্থার নাগপাশ কাটিয়ে  ফেরেশতাদের স্তরের দিকে ধাবিত হয়। ফেরেশতাদের পর্যায় থেকেও বরং ঊর্ধ্বে ওঠার প্রয়াস পায়।  কেননা ফেরেশতাদের প্রবৃত্তি নেই বিধায় প্রবৃত্তির ফাঁদে তারা পড়ে না।  আর মানুষের  প্রবৃত্তি থাকা সত্ত্বেও সব কিছু থেকে মুক্ত হয়ে আল্লাহর জন্য একাগ্রচিত্ত হয়ে যায়।

৬- এতেকাফের মাধ্যমে অন্তরে প্রশান্তি আসে।

৭- বেশি বেশি  কুরআন তিলাওয়াতের সুযোগ সৃষ্টি হয়।

৮- ঐকান্তিকভাবে তওবা করার সুযোগ লাভ হয়।

৯- তাহাজ্জুদে অভ্যস্ত হওয়া যায়।

১০-সময়কে সুন্দরভাবে কাজে লাগানো যায়।

এতেকাফের আহকাম
ইসলামি শরিয়াতে এতেকাফের অবস্থান
এতেকাফ করা সুন্নাত। এতেকাফের  সবচেয়ে উপযোগী সময় রমজানের শেষ দশক, এতেকাফ কুরআন, হাদিস ও এজমা দ্বারা  প্রমাণিত।

ইমাম আহমদ রহ. বলেন: কোন মুসলমান এতেকাফকে সুন্নাত বলে স্বীকার করেনি এমনটি আমার জানা নেই।

এতেকাফের উদ্দেশ্য
১- আল্লাহর সাথে সম্পর্ক দৃঢ় করা

আল্লাহর দিকে আকৃষ্ট হওয়া ও আল্লাহ কেন্দ্রিক ব্যতিব্যস্ততা  যখন অন্তর সংশোধিত ও ঈমানি দৃঢ়তা অর্জনের  পথ,  কেয়ামতের দিন তার মুক্তিও বরং এ পথেই, তাহলে  এতেকাফ হল এমন একটি ইবাদত যার মাধ্যমে বান্দা সমস্ত সৃষ্টি-জীব থেকে আলাদা হয়ে যথাসম্ভব প্রভুর সান্নিধ্যে চলে আসে। বান্দার কাজ হল  তাঁকে স্মরণ করা, তাঁকে ভালোবাসা  ও তাঁর ইবাদত করা। সর্বদা তার সন্তুষ্টি ও নৈকট্য লাভের চেষ্টা করা, এরই মাধ্যমে আল্লাহর সাথে বান্দার সম্পর্ক দৃঢ় ও মজবুত হয়।

২- পাশবিক প্রবণতা  এবং অহেতুক কাজ থেকে দুরে থাকা

রোজার মাধ্যমে আল্লাহ তা-আলা তাঁর  বান্দাদেরকে বাঁচিয়ে রাখেন অতিরিক্ত পানাহার ও যৌনাচারসহ পশু প্রবৃত্তির বিবিধ প্রয়োগ  থেকে, অনুরূপভাবে তিনি   এতেকাফের বিধানের মাধ্যমে  তাদেরকে বাঁচিয়ে রাখেন অহেতুক কথা-বার্তা, মন্দ সংস্পর্শ,  ও অধিক ঘুম হতে ।

এতেকাফের মাধ্যমে একজন ব্যক্তি সম্পূর্ণ অর্থে  আল্লাহর জন্য নিবেদিত হয়ে যায়। নামাজ, কুরআন তিলাওয়াত, জিকির ও দোয়া ইত্যাদির নির্বাধ চর্চার মাধ্যমে  আল্লাহর নৈকট্য লাভের অফুরান সুযোগের আবহে সে নিজেকে পেয়ে যায়।

৩- শবে কদর তালাশ করা

এতেকাফের মাধ্যমে শবে কদর খোঁজ করা রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লামের মূল উদ্দেশ্য ছিল, আবু সায়ীদ খুদরি রা. থেকে  বর্ণিত হাদিস সে কথারই প্রমাণ বহন করে, তিনি বলেন, রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম বলেছেন:

إني اعتكفت العشر الأول ألتمس هذه الليلة ثم اعتكفت العشر الأوسط ثم أتيت فقيل لي إنها في العشر الأواخر فمن أحب منكم أن يعتكف فليعتكف فاعتكف الناس معه.  مسلم : رقم الحديث ১১৬৭
আমি প্রথম দশকে এতেকাফ করেছি এই (কদর) রজনী  খোঁজ করার উদ্দেশে, অতঃপর এতেকাফ করেছি মাঝের দশকে, অত:পর মাঝ-দশক পেরিয়ে এলাম , তারপর আমাকে বলা হল, (কদর) তো শেষ দশকে। তোমাদের মধ্য

100
Islam / ওযুর ফজিলত---
« on: July 26, 2012, 11:20:26 AM »

ওযুর ফজিলত---

আমর ইবনু আবাসা (রা) হ’তে বর্ণিত, আমি বললাম, হে আল্লাহর নবী (ছাঃ)! ওযূ সম্পর্কে বলুন। তিনি বলেন, তোমাদের কেউ যখন পানি সংগ্রহ করে কুলি করে এবং নাকে পানি দেয় অতঃপর নাক ঝাড়ে, নিশ্চয়ই তখন তার মুখমন্ডল, মুখের ভিতরের ও নাকের ভিতরের গোনাহ সমূহ ঝরে যায়। অতঃপর সে যখন চেহারা ধৌত করে যেরূপ আল্লাহ নির্দেশ দান করেছেন, তখন তার মুখমন্ডলের পানির সাথে পাপগুলো দাড়ির কিনারা দিয়ে ঝরে পড়ে।

অতঃপর যখন সে দুই হাত কনুই পর্যন্ত ধৌত করে তখন তার দুই হাতের পাপ সমূহ আঙ্গুলের ধার দিয়ে পানির সাথে ঝরে যায়। অতঃপর যখন সে মাথা মাসাহ করে তখন তার মাথার পাপসমূহ চুলের পাশ দিয়ে ঝরে পড়ে। অবশেষে যখন সে দুই পা ধৌত করে দুই গিরা পর্যন্ত তখন তার গোনাহ সমূহ তার আঙ্গুল সমূহের কিনারা দিয়ে ঝরে পড়ে। অতঃপর সে যখন ছালাতের জন্য দাঁড়ায় এবং আল্লাহর প্রশংসা ও গুণগান করে এবং তাঁর মর্যাদা বর্ণনা করে তিনি যেমন মর্যাদার অধিকারী। সেই সাথে নিজের অন্তরকে আল্লাহর জন্য নিবিষ্ট করে, তখন সে তার পাপ হ’তে অনুরূপ মুক্ত হয়ে যায় যেন তার মা তাকে সেদিন জন্ম দিয়েছে।"
(ছহীহ মুসলিম হা/১৯৬৭, ১/২৭৬, ‘মুসাফিরের ছালাত’ অধ্যায়, ‘আমর ইবনু আবাসার ইসলাম গ্রহণ’ অনুচ্ছেদ-৫২; মিশকাত হা/১০৪২; বঙ্গানুবাদ মিশকাত হা/৯৭৫, ৩/৩৮ পৃঃ)
-- সুবহান আল্লাহ --

101

লেখক : আব্দুল্লাহ শহীদ আব্দুর রহমান


সিয়ামের হিকমত, লক্ষ্য-উদ্দেশ্য ও উপকারিতা

ইসলাম অর্থ আল্লাহর কাছে আত্মসমর্পণ। সৃষ্টিকর্তা মহান আল্লাহর নির্দেশের কাছে নিজেকে সন্তুষ্ট চিত্ত সঁপে দেয়া। তার প্রতি ঈমান রাখা, তার কাছে প্রতিদানের আশা করা এবং বিশ্বাস করা যে আল্লাহর বিধান অনুযায়ী জীবন যাপনের মধ্যে রয়েছে কল্যাণ ও সফলতা। এটাও বিশ্বাস করতে হবে যে আল্লাহ তাআলা হলেন হাকিম বা মহাজ্ঞানী। তার বিধানই পূর্ণাঙ্গ ও সবচেয়ে শ্রেষ্ঠ এবং সুন্দর। তার প্রতিটি বিধানে রয়েছে হেকমত বা কল্যাণকর মহা উদ্দেশ্য। অনেক সময় মানুষ তার বিধানের কল্যাণকর দিক ও হেকমত যথার্থ ভাবে অনুধাবন করতে পারে না। এটা মানুষের জ্ঞানের সীমাবদ্ধতা। আল্লাহ তাআলা বলেন :—

وَمَا أُوتِيتُمْ مِنَ الْعِلْمِ إِلَّا قَلِيلًا ﴿85﴾ سورة الإسراء.

তোমাদের খুব অল্পই জ্ঞান দেয়া হয়েছে। মানুষের কর্তব্য হল সর্বদা আল্লাহ তাআলার আদেশ-নির্দেশ পালন করা। এ আদেশ-নির্দেশসমূহের হেকমত তথা বৈজ্ঞানিক লক্ষ্য উদ্দেশ্য ও উপকারিতা অনুধাবন করতে পারা যাক বা না যাক। যদি এমন হয় যে আল্লাহর যে সকল বিধানের উপকারিতা আমাদের কাছে স্পষ্ট সেগুলো আমরা বাস্তবায়ন করব আর অন্যগুলো গুরুত্ব দেব না তাহলে তো আল্লাহর দাসত্ব করা হলো না। বরং নিজের মনের দাসত্ব করা হলো। এরূপ কেউ করলে এটা তার ঈমান ও বিশ্বাসের দুর্বলতার পরিচয় দিল। আবার এর অর্থ এটাও নয় যে আমরা আল্লাহ তাআলার বিধি-বিধানের বৈজ্ঞানিক লাভ-ক্ষতি, উপকারিতা সম্পর্কে আলোচনা করতে পারব না। অবশ্যই পারব, কারণ এটা আমাদের ঈমানকে আরো শক্তিশালী করবে, তাঁর প্রতি বিশ্বাসকে মজবুত করবে। তাই আমরা এখন সিয়ামের লক্ষ্য-উদ্দেশ্য তার কল্যাণ ও উপকারিতার দিকগুলো তুলে ধরার চেষ্টা করব।

(১) তাকওয়া বা আল্লাহ-ভীতি :

এটা আল্লাহ রাব্বুল আলামিন নিজেই স্পষ্ট করে বলে দিয়েছেন। সিয়ামের একটা লক্ষ্য হল মানুষ তাকওয়া বা আল্লাহ-ভীতি অর্জন করবে। তিনি বলেন:

يَا أَيُّهَا الَّذِينَ آَمَنُوا كُتِبَ عَلَيْكُمُ الصِّيَامُ كَمَا كُتِبَ عَلَى الَّذِينَ مِنْ قَبْلِكُمْ لَعَلَّكُمْ تَتَّقُونَ.البقرة : 183

হে বিশ্বাসীগণ ! তোমাদের জন্য সিয়ামের বিধান দেয়া হল, যেমন বিধান তোমাদের পর্ববর্তীদের দেয়া হয়েছিল, যাতে তোমরা তাকওয়া অর্জন করতে পার। সূরা আল-বাকারা : ১৮৩

তাকওয়া কী ? যা অর্জন করা যাবে সিয়াম পালন করলে।

তাকওয়া হল : আল্লাহ যা আদেশ করেছেন তা পালন করা আর যা নিষেধ করেছেন তা থেকে বিরত থাকা। এটা করা হবে আল্লাহর পক্ষ থেকে প্রতিদান লাভ ও তাঁর শাস্তি থেকে মুক্তি পাওয়ার আশায়। সিয়াম পালনকারী আল্লাহর নির্দেশের সামনে আত্মসমর্পণ করে যখন বৈধ পানাহার ও যৌনাচার বর্জন করতে পারে তখন সে অবশ্যই অবৈধ আচার-আচরণ, কথা ও কাজ এবং ভোগ-বিলাস থেকে বেঁচে থাকতে পারবে।

(২) শয়তান ও কু-প্রবৃত্তির ক্ষমতা দুর্বল করা :

শয়তান মানুষের শিরা-উপশিরায় চলাচল করতে পারে। এবং কু-প্রবৃত্তি যদি যখন যা ইচ্ছা তা করতে থাকে তখন সে উদ্ধত ও অপ্রতিরোধ্য হয়ে থাকে। এবং সে তার আরো চাহিদা মিটানোর জন্য চাপ অব্যাহত রাখে। এমতাবস্থায় শয়তান ক্ষুধা ও পিপাসা দিয়ে এর সাথে যুদ্ধ করে। এ যুদ্ধে সিয়াম পালনকারী আল্লাহর সাহায্যে শয়তান ও কু-প্রবৃত্তিকে পরাজিত করে। এ কারণে কু-প্রবৃত্তিকে দমন করার জন্য নবী করিম সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম সিয়াম নামক চিকিৎসা দিয়েছিলেন। কেননা নফ্‌সে আম্মারা বা কু-প্রবৃত্তির তাড়নায় মানুষ সকল প্রকারের পাপাচারে লিপ্ত হয়। যেমন রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম বলেছেন -

يا معشر الشباب: من استطاع منكم الباءة فليتزوج، فإنه أغض للبصر، وأحصن للفرج، ومن لم يستطع فعليه بالصوم، فإنه له وجاء .متفق عليه

হে যুবকেরা ! তোমাদের মধ্যে যে সামর্থ্য রাখে সে যেন বিবাহ করে। কেননা বিবাহ দৃষ্টি ও লজ্জাস্থানের সুরক্ষা দেয়। আর যে বিবাহের সামর্থ্য রাখে না সে যেন সিয়াম পালন করে। কারণ এটা তার রক্ষা কবচ। বর্ণনায় : বোখারি ও মুসলিম। সিয়ামের বিধানের এটা একটা হিকমত। এভাবেই সিয়াম মানুষকে তাকওয়ার পথে নিয়ে যায়। মোটকথা সিয়াম যাবতীয় জৈবিক চাহিদা নিয়ন্ত্রণ ও তা বৈধ পথে পরিচালিত করার প্রশিক্ষণ দেয়।

(৩) সিয়াম আল্লাহর কাছে আত্মসমর্পণ ও তার দাসত্ব প্রতিষ্ঠার প্রশিক্ষণ :

মানুষ যখন তার প্রবৃত্তির গোলামি ও শয়তানের আগ্রাসন থেকে মুক্তি লাভ করবে তখনই সে আল্লাহ রাব্বুল আলামিনের বান্দা বা দাস হওয়ার যোগ্যতা অর্জন করবে। আল্লাহর সন্তুষ্টি অর্জন ব্যতীত তার সামনে আর কোন উদ্দেশ্য থাকে না। তাই সে আল্লাহ রাব্বুল আলামিনের আদেশ-নিষেধকে নিজের প্রবৃত্তির দাবির উপর অগ্রাধিকার দেয়। এতে যত কষ্ট হোক, যত ধৈর্যের প্রয়োজন হোক, যত ত্যাগের দরকার হোক সব কিছু করতে সে প্রস্তুত হয়ে যায়। তাই সিয়াম পালনকারীকে দেখবেন সে দিনের বেলা খাচ্ছে না, খাচ্ছে রাতে, রাতে নিদ্রা যাচ্ছে না, রাত জেগে সে সালাত আদায় করছে। মিথ্যা কথা ও কাজ এবং সব ধরনের অসদাচরণ সে পরিহার করে চলছে । অথচ তার মন ও প্রবৃত্তি নির্দেশ দিচ্ছে দিনের বেলায় খাওয়া-দাওয়া করতে, রাতের বেলা বিশ্রাম নিতে, মিথ্যা কথা বলতে ইত্যাদি। এমনিভাবে সিয়াম ও এ সম্পর্কিত কাজগুলো আদায় করার মাধ্যমে সিয়াম পালনকারী প্রবৃত্তিসহ সকল মানুষের দাসত্ব অস্বীকার করে আল্লাহর দাসত্বে প্রবেশ করার যোগ্যতা অর্জন করে।

(৪) ঈমানকে দৃঢ় করা, মোরাকাবা ও আল্লাহর ভয় সৃষ্টি করা :—

আল্লাহ রাব্বুল আলা-মীনের নির্ধারণ করা সময়ে তারই সন্তুষ্টি লাভের জন্য সকল প্রকার পানাহার পরিহার করা, আল্লাহকে ভয় করা ও তার মোরাকাবার একটি বলিষ্ঠ প্রমাণ বহন করে। এটাই প্রকৃত ঈমান। সিয়াম পালনকারী যদি লোক চক্ষুর আড়ালে পানাহার করে আর মানুষের কাছে প্রকাশ করল সে সিয়াম অবস্থায় আছে তাহলে সে সিয়াম পালনকারী বলে গণ্য হবে না। এমনিভাবে সে দিনের বেলা ও পানাহার ও যৌনাচার ত্যাগ করল বটে কিন্তু সিয়ামের নিয়ত ছিল না তাহলে সে সিয়াম আদায় করেছে বলে ধরা হবে না। সিয়াম পালনকারীর এ অনুভূতি আল্লাহকে ভয় করা ও তার মোরাকাবার প্রমাণ দিতে শিখায়। (মোরাকাবা হল : সর্বদা আল্লাহ আমাকে ও আমি যা করছি তা দেখছেন এ ধরনের দৃঢ় অনুভূতি ধারণ করা) তাই সিয়াম মুসলিমকে ঈমানের সত্যতার প্রমাণ দিতে প্রশিক্ষণ দেয়। তাকে স্মরণ করিয়ে দেয় যে,মোমিন হিসেবে তার কর্তব্য হল সর্বদা আল্লাহর মোরাকাবা করা অর্থাৎ এ দৃঢ় বিশ্বাস পোষণ করা যে আমার প্রতিটি মুহূর্তের প্রতিটি কাজ আল্লাহ রাব্বুল আলামিন পর্যবেক্ষণ করছেন তাই আমাকে কোন কাজে তার অবাধ্য হওয়া চলবে না। তিনি যাতে সন্তুষ্ট হন শুধু তা-ই আমাকে করতে হবে। যদি এ রকম মোরাকাবার সাথে সিয়াম আদায় করা যায় তাহলে তার জন্য রয়েছে যা আল্লাহর রাসূল সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম বলেছেন :—

كل عمل ابن آدم يضاعف الحسنة بعشر أمثالـها إلى سبع مئة ضعف. قال الله عز وجل: ( إلا الصوم فإنه لي وأنا أجزى به، يدع شهوته وطعامه من أجلي . ..) رواه البخاري ومسلم

মানব সন্তানের প্রতিটি নেক আমলের প্রতিদান দশ থেকে সাত শত গুণ পর্যন্ত বৃদ্ধি করা হয়। আল্লাহ তাআলা বলেন, কিন্তু সিয়ামের বিষয়টা ভিন্ন। কেননা সিয়াম শুধু আমার জন্য আমিই তার প্রতিদান দেব। আমার জন্যই সে পানাহার ত্যাগ করে থাকে। বর্ণনায় : বোখারি ও মুসলিম

আর এ বিষয়টা সকল প্রকার ইবাদত-বন্দেগিতে থাকতে হয়। যখন মানুষ বিশ্বাস করবে আল্লাহ আমাকে সর্বদা দেখছেন তখন সে বিনা ওজুতে সালাত আদায় করে না। ঠিক তেমনি কোন কাজে ফাঁকি দিতে চেষ্টা করবে না। সকল প্রকার কাজ-কর্ম যথাযথ ও সুন্দরভাবে সম্পাদন করবে।

(৫) ধৈর্য, সবর ও দৃঢ় সংকল্পের প্রশিক্ষণ :

সিয়ামের মাস মূলত ধৈর্য ও সবরের মাস। সিয়াম মনের চাহিদা পূরণে বাধা দেয়ার মাধ্যমে সংকল্পের দৃঢ়তার প্রশিক্ষণ দেয়। আল্লাহ রাব্বুল আলামিন কর্তৃক নির্ধারিত সীমারেখা লঙ্ঘন না করে তা মেনে চলার অভ্যাস গড়তে প্রশিক্ষিত করে গড়ে তোলে। কখনো তাঁর সীমা লঙ্ঘনের কথা চিন্তা করে না। আল্লাহ তাআলা সিয়ামের বিধান বর্ণনা করার পর বলেছেন :

تِلْكَ حُدُودُ اللَّهِ فَلَا تَقْرَبُوهَا (البقرة : 187)

এগুলো আল্লাহর সীমারেখা। সুতরাং এগুলোর নিকটবর্তী হয়ও না। সূরা বাকারা :১৮৭

এর মাধ্যমে মানুষ নিজের মন ও বিবেককে নিয়ন্ত্রণ করার ক্ষমতা লাভ করে। উদাহরণ হিসাবে বলা যায়, ধরুন কোন ব্যক্তি একটি খারাপ অভ্যাসে লিপ্ত। ইচ্ছা থাকা সত্ত্বেও সে এর থেকে বিরত থাকতে পারছে না। রমজান মাসের সিয়াম তার তার বদ অভ্যাস উৎপাটন করতে একটা বিরল সুযোগ সৃষ্টি করে দিয়েছে। এরপর সে যেন আর বলতে না পারে যে আমি পারি না।

(৬) আখেরাতমুখী করার প্রশিক্ষণ :

সিয়াম পালনকারী পার্থিব সকল ভোগ-বিলাস ত্যাগ করে দুনিয়ার প্রতি বিমুখ হয়ে আখেরাতমুখী হওয়ার দীক্ষা নিয়ে থাকে। তার এ ত্যাগ শুধুমাত্র আল্লাহর সন্তুষ্টি অর্জনের মাধ্যমে আখেরাতে জান্নাত লাভের উদ্দেশ্য ব্যতীত অন্য কিছুর জন্যে নয়। এ আধ্যাত্মিক শিক্ষার মাধ্যমে দুনিয়ার সাথে সম্পর্ক কমিয়ে আখেরাতের সম্পর্ককে প্রাধান্য দেয়ায় সবক নিয়ে থাকে। আর এ লক্ষ্য অর্জনে সে শারীরিক ও আর্থিক ইবাদত-বন্দেগি ও সৎকর্ম সম্পাদন ক্ষেত্র প্রশস্ত করতে চেষ্টা করে।

(৭) আল্লাহর অনুগ্রহের প্রতি শুকরিয়া ও সৃষ্টি জীবের সেবা করার দায়িত্ব স্মরণ করিয়ে দেয়া :

অনুগ্রহের কথা ভুলে যাওয়া মানুষের একটি স্বভাব। অনুগ্রহ মূল্যায়ন করতে শেখে তখন, যখন সে তা হারিয়ে ফেলে। সিয়াম আদায়ের মাধ্যমে বঞ্চিত ও অভাবী মানুষদের দুরবস্থা অনুধাবন করতে শেখে। তখন সে যেমন তার প্রতি আল্লাহ রাব্বুল আলা-মীনের অনুগ্রহের কথা স্মরণ করে আল্লাহর শোকর আদায়ে যত্নবান হয় তেমনি বঞ্চিত, অভাবী, অনাহার ক্লিষ্ট মানুষের অধিকার আদায়ের জন্য দায়িত্ব পালনে অগ্রসর হয় ও তাদের সেবা করতে উৎসাহ পায়।

(৮) সিয়াম সমাজ সংস্কারের একটি বিদ্যাপীঠ :

সিয়ামের যে সকল হিকমত রয়েছে যা ব্যক্তিকে পরিশুদ্ধ করে, এসকল হিকমত সমাজকেও পরিশুদ্ধ ও সংস্কারে ভূমিকা রাখে। কেননা ব্যক্তির পরিশুদ্ধতা হল সমাজ শুদ্ধির পথ। ব্যক্তি সংশোধন হয়ে গেলে সমাজ সংশোধন হয়ে যায়। তাইতো আমরা দেখি, সিয়ামকে সামাজিক ভাবে আদায় করতে হয়। অর্থাৎ একই সাথে একই সময়ে। কিন্তু নফল সিয়াম সকলকে এক সময়ে এক সাথে আদায় করতে হবে বলে কোন বাধ্য-বাধকতা নেই। রমজান আমাদেরকে সমাজ সংস্কারের পথে উদ্বুদ্ধ করে, সমাজ যতই কলুষিত হয়ে যাক না কেন। রমজান ইসলামি শরিয়া বাস্তবায়নের আন্দোলনের এক অনুকুল সময়। এ সময় যেমন শয়তানের সৃষ্ট প্রতিকূলতা দুর্বল হয়ে পড়ে, তেমনিভাবে মানুষের মধ্যে ইসলামের প্রতি আগ্রহ অন্যান্য সময়ের তুলনায় বেশি দেখা যায়। তাই সমাজ সংস্কারের উদ্যোগের এটাই উপযুক্ত সময়। মানুষকে বুঝানোর এটা উত্তম সময় যে, ইসলামি শরিয়া হর বাস্তবায়ন সমাজে শান্তি প্রতিষ্ঠার একমাত্র পথ।

(৯) শারীরিক শক্তি ও সুস্থতা অর্জন :

এক নম্বর থেকে আট পর্যন্ত সিয়ামের যে সকল কল্যাণকর দিক আলোচিত হল তা ছাড়াও সিয়ামের একটি কল্যাণকর দিক হল স্বাস্থ্যের উন্নতি। নিয়ম তান্ত্রিক ভাবে খাবার গ্রহণ, পরিমিত আহার, ঠিক একই সময় পানাহার আবার ঠিক একই সময় বিরতি দেয়া ইত্যাদি পাকস্থলীকে নির্দিষ্ট সময়ের জন্য বিশ্রাম দেয় ফলে পাকস্থলী শক্তিশালী হয়। এমনিভাবে ইসলাম প্রবর্তিত প্রত্যেকটি ইবাদত-বন্দেগিতে রয়েছে হিকমত ও মানুষের জন্য অসংখ্য পার্থিব কল্যাণ।

102


রমজান কি?


রামাদ্বান/রমযান ...এটি ‘আরাবী’ বার মাসগুলোর একটি, আর এটি দ্বীন ইসলামে একটি সম্মানিত মাস।  এটি অন্যান্য মাস থেকে বেশ কয়েকটি বৈশিষ্ট্য ও ফাযিলাহ (ফযীলত) সমূহের কারণে বিশেষভাবে উল্লেখযোগ্য। যেমনঃ

১. আল্লাহ -‘আযযা ওয়া জাল্ল- সাওমকে (রোযাকে) ইসলামের আরকানের মধ্যে চতুর্থ রুকন হিসেবে স্থান দিয়েছেন, যেমনটি আল্লাহ তা’আলা বলেছেনঃ

“রামাদ্বান মাস যে মাসে তিনি আল কুরআন নাযিল  করেছেন, তা মানবজাতির জন্য হিদায়াতের উৎস, হিদায়াত ও সত্য মিথ্যার মাঝে পার্থক্যকারী সুস্পষ্ট নিদর্শন সুতরাং তোমাদের মাঝে যে এই মাস পায় সে যেন সাওম রাখে।“ [সূরা বাক্বারাহঃ ১৮৫]

আর  সাহীহুল বুখারী ইমান অধ্যায়  ও  সাহীহ মুসলিম এ ইবনু উমার এর হাদীস থেকে প্রমাণিত হয়েছে যে নাবী (আল্লাহ তাঁর উপর সালাত ও সালাম বর্ষণ করুন) বলেছেনঃ

“ইসলাম পাঁচটি স্তম্ভের উপর প্রতিষ্ঠিত এই সাক্ষ্য দেওয়া যে আল্লাহ ছাড়া আর কোন সত্য উপাস্য নেই, এবং মুহাম্মাদ (সাঃ) আল্লাহর বান্দা ও তাঁর রাসূল সালাত কায়েম (প্রতিষ্ঠা) করা, যাকাত প্রদান করা, রমযান মাসে সাওম পালন করা এবং বাইতুল্লাহ (কা’বাহ)এর উদ্দেশ্যে হজ্জ করা”।

২. আল্লাহ আযযা ওয়া জাল্ল এই মাসে আল কুরআন  নাযিল করেছেন, যেমনটি তিনি-তা‘আলা-পূর্বের আয়াতে উল্লেখ করেছেনঃ

"রামাদ্বান মাস যে মাসে তিনি আল কুরআন নাযিল করেছেন, তা মানবজাতির জন্য হিদায়াতের উৎস, হিদায়াত ও সত্য মিথ্যার মাঝে পার্থক্যকারী সুস্পষ্ট নিদর্শন; সুতরাং তোমাদের মাঝে যে এই মাস পায় সে যেন সাওম রাখে”। [সূরা বাক্বারাহঃ ১৮৫]

তিনি –সুবহানাহূ ওয়া তা‘আলা- আরো বলেছেনঃ

“নিশ্চয়ই আমি একে (আল কুরআন) লাইলাতুল ক্বাদরে নাযিল করেছি”। [সূরা ক্বাদরঃ১]

৩. আল্লাহ এ মাসে লাইলাতুল ক্বাদর রেখেছেন যে মাস হাজার মাস থেকে উত্তম যেমনটি তিনি-তা’আলা বলেছেনঃ

"নিশ্চয়ই আমি একে লাইলাতুল ক্বাদরে (আল কুরআন ) নাযিল করেছি। এবং আপনি কি জানেন লাইলাতুল ক্বাদর কি ? লাইলাতুল ক্বাদর হাজার মাস অপেক্ষা অধিক উত্তম। এতে ফেরেশতাগণ এবং রূহ (জিবরাইল আলাইহিস সালাম) তাদের রবের (প্রতিপালকের) অনুমতিক্রমে অবতরণ করেন সকল সিদ্ধান্ত নিয়ে। শান্তিময় (বা নিরাপত্তাপূর্ণ ) সেই রাত ফাজরের সূচনা পর্যন্ত”। [সূরা ক্বাদরঃ১-৫]

তিনি আরো বলেছেনঃ

“নিশ্চয়ই আমি একে (আল কুরআন) এক বারাকাতপূর্ণ (বরকতময়) রাতে নাযিল করেছি, নিশ্চয়ই আমি সর্তককারী”। [সূরা আদ দুখানঃ৩]

আল্লাহ তা’আলা রমযান মাসকে লাইলাতুল ক্বাদর  দিয়ে সম্মানিত করেছেন আর এই বারাকাতপূর্ণ (বরকতময়) রাতে মর্যাদার বর্ণনায় সূরাতুল ক্বাদর নাযিল করেছেন।

আর এ ব্যাপারে বর্ণিত হয়েছে অনেক আহাদীস (হাদীসসমূহ, হাদীসের বহুবচন)। আবূ হুরাইরাহ থেকে বর্ণিত হয়েছে যে, রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম  বলেছেনঃ

“তোমাদের কাছে উপস্থিত হয়েহে রামাদ্বান, এক বারাকাতপূর্ণ (বরকতময়) মাস। এ মাসে স্বাওম পালন করা আল্লাহ-‘আযযা ওয়া জাল্ল-তোমাদের উপর ফারদ্ব (ফরজ) করেছেন। এ মাসে আসমানের দরজাসমূহ খুলে দেয়া হয়, এ মাসে জাহীমের দরজাসসমূহ বন্ধ করে দেয়া হয়, এ মাসে অবাধ্য শাইত্বানদের শেকলবদ্ধ করা হয় আর এ মাসে রয়েছে আল্লাহর এক রাত যা হাজার মাস থেকে উত্তম, যে এ রাত থেকে বঞ্চিত হল, সে প্রকৃত পক্ষেই বঞ্চিত হল”। [বর্ণনা করেছেন আন-নাসা’ঈ (২১০৬), আহমাদ (৮৭৬৯) এবং আল-আলবানী একে সাহীহ হিসেবে বর্ণনা করেছেন ‘সাহীহুত তারঘীব’ (৯৯৯) - এ]

আর আবূ হুরাইরাহ-রাদ্বিয়াল্লাহু ‘আনহ- থেকে বর্ণিত  যে তিনি বলেছেন, রাসূলুল্লাহ -সাল্লাল্লাহু ‘আলাইহি ওয়া সাল্লাম- বলেছেনঃ

“যে ঈমান সহকারে প্রতিদানের আশায় লাইলাতুল ক্বাদর (ক্বাদরের রাত্রিতে) ‘ইবাদাত  করবে তার অতীতের সমস্ত গুনাহ  মাফ করে দেয়া হবে।” [বর্ণনা করেছেন আল-বুখারী (১৯০১) ও মুসলিম (৭৬০)]

৪. আল্লাহ -‘আযযা ওয়া জাল্ল - এই মাসে স্বাওম পালন ও ক্বিয়াম করাকে গুনাহ মাফের কারণ করেছেন, যেমনটি দুই সাহীহ গ্রন্থ বুখারী (২০১৪) ও মুসলিম (৭৬০) - এ বর্ণিত হয়েছে আবূ হুরাইরাহ-রাদ্বিয়াল্লাহু ‘আনহ-এর হাদীস থেকে যে নাবী-সাল্লাল্লাহু ‘আলাইহি ওয়া সাল্লাম-বলেছেনঃ

“যে রামাদ্বান মাসে ঈমান সহকারে ও সাওয়াবের আশায় স্বাওম পালন করবে তার অতীতের সমস্ত গুনাহ  মাফ করে দেয়া হবে।”

এবং বুখারী (২০০৮) ও মুসলিম (১৭৪)-এ তাঁর (আবূ হুরাইরাহ-রাদ্বিয়াল্লাহু ‘আনহ-) থেকে আরো বর্ণিত হয়েছে যে তিনি বলেছেনঃ

“যে রামাদ্বান মাসে ঈমান সহকারে ও সাওয়াবের আশায় ক্বিয়াম করবে তার অতীতের সমস্ত গুনাহ  মাফ করে দেয়া হবে।”

মুসলিমদের মাঝে রামাদ্বানের রাতে ক্বিয়াম করা সুন্নাহ হওয়ার ব্যাপারে ইজমা‘ (ঐক্যমত) রয়েছে। ইমাম আন-নাওয়াউয়ী উল্লেখ করেছেনঃ

“রামাদ্বানে  ক্বিয়াম করার অর্থ হল তারাউয়ীহের (তারাবীহের) স্বালাত আদায় করা অর্থাৎ তারাউয়ীহের (তারাবীহের) স্বালাত আদায়ের মাধ্যমে যাতে ক্বিয়াম করার উদ্দেশ্য সাধিত হয়।”

৫. আল্লাহ-‘আযযা ওয়া জাল্ল- এই মাসে জান্নাতসমূহের দরজা সমূহ খুলে দেন, এ মাসে জাহান্নামের দরজা সমূহ বন্ধ করে দেন এবং শাইত্বানদের শেকলবদ্ধ করেন।

৬. এ মাসের প্রতি রাতে আল্লাহ জাহান্নাম থেকে (তাঁর বান্দাদের) মুক্ত করেন। ইমাম আহমাদ (৫/২৫৬) আবূ উমামাহ’র হাদীস থেকে বর্ণনা করেছেন যে নাবী-সাল্লাল্লাহু ‘আলাইহি ওয়া সাল্লাম-বলেছেনঃ

“আল্লাহর রয়েছে প্রতি ফিত্বরে (ইফত্বারের সময় জাহান্নাম থেকে) মুক্তিপ্রাপ্ত বান্দা।”

আল-মুনযিরী বলেছেন এর ইসনাদে কোন সমস্যা নেই। আর আল-আলবানী এটিকে ‘সাহীহুত তারঘীব’ (৯৮৭) - এ সাহীহ বলে আখ্যায়িত করেছেন।

আল-বাযযার (কাশফ ৯৬২) আবূ সা‘ঈদের হাদীস থেকে বর্ণনা করেছেন যে তিনি বলেছেনঃ

“নিশ্চয়ই আল্লাহ – তাবারাকা ওয়া তা‘আলা - র রয়েছে (রামাদ্বান মাসে) প্রতি দিনে ও রাতে (জাহান্নাম থেকে) মুক্তিপ্রাপ্ত বান্দাগণ আর নিশ্চয়ই একজন মুসলিমের রয়েছে প্রতি দিনে ও রাতে কবুল হওয়া দু‘আ’।”

৭. রামাদ্বান মাসে স্বাওম পালন করা পূর্ববর্তী রামাদ্বান থেকে কৃত গুনাহসমূহের কাফফারাহ লাভের কারণ যদি বড় গুনাহ সমূহ (কাবীরাহ গুনাহ সমূহ) থেকে বিরত থাকা হয়, যেমনটি প্রমাণিত হয়েছে ‘সাহীহ মুসলিম (২৩৩)-এ যে নাবী-সাল্লাল্লাহু ‘আলাইহি ওয়া সাল্লাম-বলেছেনঃ

“পাঁচ ওয়াক্বতের পাঁচবার স্বালাত, এক  জুমু‘আহ থেকে অপর  জুমু‘আহ, এক রামাদ্বান থেকে অপর রামাদ্বান এর মাঝে কৃত গুনাহসমূহের কাফফারাহ  করে যদি বড় গুনাহ সমূহ (কাবীরাহ গুনাহ সমূহ) থেকে বিরত থাকা হয়।”

৮. এই মাসে স্বাওম পালন করা দশ মাসে স্বিয়াম পালন করার সমতূল্য যা ‘সাহীহ মুসলিম’ (১১৬৪)-এ প্রমাণিত আবূ আইয়ূব আল-আনসারীর হাদীস থেকে নির্দেশনা পাওয়া যায় যে তিনি বলেছেনঃ

“যে রামাদ্বান মাসে স্বিয়াম পালন করল, এর পর শাউওয়ালের ছয়দিন স্বাওম পালন করল, তবে তা সারা জীবন স্বাওম রাখার সমতূল্য”।

আর ইমাম আহমাদ (২১৭/০৬)বর্ণনা করেছেন যে, নাবী-সাল্লাল্লাহু ‘আলাইহি ওয়া সাল্লাম-বলেছেনঃ

“যে রামাদ্বান মাসে স্বাওম পালন করল, তা দশ মাসের (স্বাওম পালনের) সমতূল্য আর ‘ঈদুল ফিত্বরের পর (শাউওয়ালের মাসের) ছয় দিন স্বাওম পালন করা গোটা বছরের (স্বাওম পালনের) সমতূল্য।”


[বিঃদ্রঃ সূরা (৬) আল-আন‘আমের ১৬০ নং আয়াত অনুসারে কোন মু’মিন কোন ভাল কাজ করলে আল্লাহ-তা‘আলা-তাকে দশ গুণ সাওয়াব দেন। সুবহানাল্লাহ ! তাই রামাদ্বান মাসে ৩০ দিন স্বাওম পালনের অর্থ এই দাঁড়ায় (৩০×১০)=৩০০ দিন অর্থাৎ   দশ মাস স্বিয়াম পালন করা; আর (শাউওয়ালের মাসের) ছয় দিন স্বাওম পালন করার অর্থ দাঁড়ায় (৬×১০)=৬০ দিন অর্থাৎ  দুই মাস স্বিয়াম পালন করা। সুতরাং রামাদ্বান ও এর পরবর্তী শাউওয়ালের ছয় দিন স্বাওম পালন করা (১০ মাস+২ মাস) = ১২ মাস অর্থাৎ  গোটা বছরের সমতূল্য!]

“আর আল্লাহ যাকে ইচ্ছা বেহিসাব রিযক্ব দান করেন”। [সূরা আন-নূরঃ ৩৮]

৯. এই মাসে যে ইমামের সাথে তিনি (ইমাম)(স্বালাত) শেষ করে চলে যাওয়া পর্যন্ত ক্বিয়াম করে, সে সারা রাত ক্বিয়াম করেছে বলে হিসাব করা হবে যা ইমাম আবূ দাঊদ (১৩৭০) ও অন্য সূত্রে আবূ যার -রাদ্বিয়াল্লাহু ‘আনহ- এর হাদীস থেকে প্রমাণিত হয়েছে যে তিনি বলেছেন যে রাসূলুল্লাহ - সাল্লাল্লাহু ‘আলাইহি ওয়া সাল্লাম- বলেছেনঃ

“যে ইমাম চলে যাওয়া পর্যন্ত তাঁর (ইমামের) সাথে ক্বিয়াম করল, সে সারা রাত ক্বিয়াম করেছে বলে ধরে নেয়া হবে।”

আল-আলবানী ‘স্বালাহ আত-তারাউয়ীহ’ বইতে (পৃঃ১৫) একে সাহীহ বলে চিহ্নিত করেছেন।

১০. এই মাসে ‘উমরাহ করা হাজ্জ করার সমতূল্য। ইমাম আল-বুখারী (১৭৮২) ও মুসলিম (১২৫৬) ইবনু ‘আব্বাস থেকে বর্ণনা করেছেন  যে তিনি বলেছেনঃ

রাসূলুল্লাহ -সাল্লাল্লাহু ‘আলাইহি ওয়া সাল্লাম- আনসারদের এক মহিলাকে প্রশ্ন করলেনঃ

“কিসে আপনাকে আমাদের সাথে হাজ্জ করতে বাঁধা দিল?”

তিনি (আনসারী মহিলা)বললেনঃ

“আমাদের শুধু পানি বহনকারী দুটি উটই ছিল।”

তাঁর স্বামী ও পুত্র একটি পানি বহনকারী উটে করে হাজ্জে গিয়েছিলেন।

তিনি বললেনঃ

“আর আমাদের পানি বহনের জন্য  একটি পানি বহনকারী উট রেখে গেছেন।”

তিনি (রাসূলুল্লাহ) বললেনঃ

“তাহলে রামাদ্বান এলে  আপনি ‘উমরাহ করেন কারণ, এ মাসে ‘উমরাহ করা হাজ্জ করার সমতূল্য।”

মুসলিমের রিওয়াইয়াতে আছেঃ

“......কারণ এ মাসে ‘উমরাহ করা আমার সাথে হাজ্জ করার সমতূল্য।”

১১. এ মাসে ই‘তিকাফ করা সুন্নাহ কারণ নাবী-সাল্লাল্লাহু ‘আলাইহি ওয়া সাল্লাম-তা নিয়মিতভাবে করতেন যেমনটি বর্ণিত হয়েছে ‘আ’ইশাহ-রাদ্বিয়াল্লাহু‘আনহা-থেকে –

“আল্লাহ তাঁকে (রাসূলুল্লাহকে) ক্বাবদ্ব (কবজ, মৃত্যু দান) না দেওয়া পর্যন্ত রামাদ্বানের শেষ দশ দিনে ই‘তিকাফ করতেন। তাঁর পরে তাঁর স্ত্রীগণও ই‘তিকাফ করেছেন।”

[বর্ণনা করেছেন আল বুখারী (১৯২২) ও মুসলিম (১১৭২)]

১২. রামাদ্বান মাসে ক্বুর’আন অধ্যয়ন ও তা বেশি বেশি তিলাওয়াত করা খুবই তা’কীদের (তাগিদের)  সাথে করণীয় এক মুস্তাহাব্ব (পছন্দনীয়) কাজ। আর ক্বুর’আন অধ্যয়ন হল একজন অপরজনকে ক্বুর’আন পড়ে শুনাবে এবং অপরজনও তাকে তা পড়ে শুনাবে। আর তা মুস্তাহাব্ব  হওয়ার দালীলঃ

“যে জিবরীল রামাদ্বান মাসে প্রতি রাতে নাবী-সাল্লাল্লাহু ‘আলাইহি ওয়া সাল্লাম-এর সাথে সাক্ষাৎ করতেন এবং ক্বুর’আন অধ্যয়ন করতেন।”

[বর্ণনা করেছেন আল বুখারী (৬) ও মুসলিম (২৩০৮)]

কুরআন ক্বিরা‘আত সাধারণভাবে মুস্তাহাব্ব, তবে রামাদ্বানে বেশি তা’কীদ যোগ্য।

১৩. রামাদ্বানে স্বাওম পালনকারীকে ইফত্বার করানো মুস্তাহাব্ব যার দালীল যাইদ ইবনু খালিদ আল-জুহানী হতে বর্ণিত হাদীস যাতে তিনি বলেছেন যে, রাসূলুল্লাহ -সাল্লাল্লাহু ‘আলাইহি ওয়া সাল্লাম- বলেছেনঃ

“যে কোন স্বা’ইমকে (স্বাওম পালনকারীকে) ইফত্বার করায়, তার (যে ইফত্বার করালো) তাঁর (স্বাওম পালনকারীর) সমান সাওয়াব হবে, অথচ সেই স্বাওম পালনকারীর সাওয়াব কোন অংশে কমে না”।

103
রামাদানে আমাদের করনীয় (গুরুত্বপূর্ণ)

আমরা যখন এ মাসের গুরুত্ব অনুভব করলাম তখন আমাদের কর্তব্য হয়ে দাঁড়াল কীভাবে এ মাসের প্রতিটি মুহূর্তকে কাজে লাগানো যায় সে প্রচেষ্টা চালানো। এ মাসে হেদায়াতের আলোকবর্তিকা আল-কোরআন নাজিল হয়েছে। এ মাসে জান্নাতের দরজাগুলো খুলে দেয়া হয়। এ মাসে জাহান্নামের দরজাগুলো বন্ধ করে দেয়া হয়। শয়তানকে শৃঙ্খলে আবদ্ধ করা হয়। একজন ঘোষণাকারী ভাল কাজের আহ্বান জানাতে থাকে ও খারাপ কাজ থেকে বিরত থাকতে বলে। সাথে সাথে এটা হল মাগফিরাতের মাস, জাহান্নাম থেকে মুক্তির মাস। এ মাসে রয়েছে লাইলাতুল কদর যা হাজার মাস থেকে শ্রেষ্ঠ। আমাদের অনেকের ধারণা রমজান মাস সিয়াম পালন ও তারাবীহ আদায়ের মাস। ব্যাস ! আর কীসের আমল ? দিনের বেলা পানাহার থেকে বিরত থাকছি এটা কম কি? না, ব্যাপারটা শুধু এ টুকুতে সীমিত নয়। রমজান একটি বিশাল বিদ্যাপীঠ।
এ রমজানে আমরা কি কি নেক আমল করতে পারি তা নিম্নে আলোচনা করা হল :—
(১) কিয়ামুল লাইল
কিয়ামুল লাইল শব্দের অর্থ রাতের সালাত। অর্থাৎ সালাতে তারাবীহ। রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম বলেন :—
من قام رمضان إيمانا واحتسابا غفر له ما تقدم من ذنبه. رواه مسلم
যে রমজান মাসে ঈমান ও ইহতিসাবের সাথে রাতে সালাত আদায় করবে তার অতীতের পাপসমূহ ক্ষমা করে দেয়া হবে। বর্ণনায় : মুসলিম
সালাতে তারাবীহ যেমন কিয়ামুল লাইলের মধ্যে পড়ে তেমনি শেষ রাতে তাহাজ্জুদও সালাতুল লাইল এর অন্তর্ভুক্ত। ইমাম সাহেবের সাথে শুরু থেকে শেষ পর্যন্ত জামাতে সালাত আদায় করলে রমজানের পূর্ণ রাত সালাত আদায়ের সওয়াব অর্জিত হবে। রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম বলেছেন :—
من قام مع الإمام حتى ينصرف كتب له قيام ليلة (رواه أبو داود)
ইমাম সাহেব সালাত শেষ করা পর্যন্ত তার সাথে যে সালাত আদায় করবে সে পূর্ণ এক রাত সালাত আদায়ের সওয়াব পাবে। বর্ণনায় : আবু দাউদ
যে সামর্থ্য রাখে সে ইমামের সাথে সালাত শেষ করে একা একা যত ইচ্ছা তত সালাত আদায় করবে। এ ক্ষেত্রে অনেকের মধ্যে যে অমনোযোগিতা দেখা যায় তা হল রমজানের প্রথম রাতে তারা সালাতে অংশ নিতে পারে না। আবার অনেককে রমজানের শেষ দিকে অলসতায় পেয়ে বসে। ফলে তারা পূর্ণ রমজানের কিয়ামুল লাইলের সওয়াব থেকে বঞ্চিত হয়ে থাকেন।
(২) আল-কোরআন খতম ও তিলাওয়াত :
নবী করিম সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম বলেছেন :—
الصيام والقرآن يشفعان للعبد يوم القيامة . . .
সিয়াম ও কোরআন কেয়ামতের দিন মানুষের জন্য সুপারিশ করবে...।
হাদিসে এসেছে, রমজানে জিবরাইল রাসূলে করিম সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম-কে কোরআন পাঠ করে শোনাতেন। আর রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম পূর্ণ কোরআন তিলাওয়াতের মাধ্যমে জিবরাইলের কাছে তুলে ধরতেন। আল-কোরআন তিলাওয়াত হল সর্বশ্রেষ্ঠ জিকির। সিয়াম পালনকারী এ জিকির থেকে বঞ্চিত থাকতে পারেন না। আল-কোরআন তিলাওয়াতের একটি সঠিক দিক-নির্দেশনামুলক প্রবন্ধ এ বইয়ের শেষ দিকে যুক্ত করে দেয়া হয়েছে। পাঠক এ থেকে উপকৃত হতে পারবেন। যদি কেউ কোরআন তিলাওয়াত করতে অপারগ হন তাহলে বিভিন্ন তাসবীহ, তাহলীল, তাহমীদ আদায়ের মাধ্যমে মুখে আল্লাহর জিকির অব্যাহত রাখবেন।
(৩) সদকা বা দান :
প্রখ্যাত সাহাবি আব্দুল্লাহ ইবনে আব্বাস বলেন :—
كان رسول الله صلى الله عليه وسلم أجود الناس بالخير، وكان أجود ما يكون في شهر رمضان. رواه مسلم
নবী করিম সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম ছিলেন মানুষের মধ্যে সবচেয়ে বেশি দানশীল। আর রমজানে তার বদান্যতা আরো বেড়ে যেত। বর্ণনায় : মুসলিম
ইমাম শাফেয়ি (র.) বলেন, রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম-এর অনুসরণ করে তার উম্মতের জন্য উত্তম কাজ হল রমজান মাসে তারা বেশি করে দান-সদকা করবে। কারণ এ মাসে মানুষের প্রয়োজন বেশি থাকে। অপরদিকে রমজান হল জিহাদের মাস। তাই প্রত্যেকের উচিত অর্থ-সম্পদ দান করার মাধ্যমে জিহাদে অংশ নেয়া।
(৪) এতেকাফ :—
ইবনে উমার রা. থেকে বর্ণিত, তিনি বলেন :—
كان رسول الله صلى الله عليه وسلم يعتكف العشر الأواخر من رمضان . رواه مسلم
রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম রমজানের শেষ দশকে এতেকাফ করতেন। বর্ণনায় ; মুসলিম। এতেকাফ প্রসঙ্গে ইমাম যুহরি বলেন, আশ্চর্যজনক হল মুসলমানরা এতেকাফ পরিত্যাগ করে অথচ রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম মদিনায় আসার পর থেকে ইন্তেকাল পর্যন্ত কখনো এতেকাফ পরিত্যাগ করেননি।
(৫) ওমরাহ আদায় :—
যেমনটি হাদিসে এসেছে নবী করিম সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম বলেছেন :—
عمرة في رمضان كحجة معي
রমজান মাসে ওমরাহ আদায় আমার সাথে হজ আদায়ের সমতুল্য।
(৬) রোজাদারদের ইফতার করানো :
রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম বলেছেন :—
من فطر صائما كان له مثل أجره ، غير أنه لا ينقص من أجر الصائم شيئا. رواه أحمد
 
যে ব্যক্তি কোন সিয়াম পালনকারীকে (রোজাদারকে) ইফতার করাবে সে সিয়াম পালনকারীর অনুরূপ সওয়াব লাভ করবে, তবে তাতে সিয়াম পালনকারীর সওয়াব বিন্দুমাত্র কমে যাবে না। বর্ণনায় : আহমদ
(৭) দোয়া-প্রার্থনা করা :
আল্লাহ রাব্বুল সিয়ামের বিধান বর্ণনা করার পর বলেছেন -
وَإِذَا سَأَلَكَ عِبَادِي عَنِّي فَإِنِّي قَرِيبٌ أُجِيبُ دَعْوَةَ الدَّاعِ إِذَا دَعَانِ (البقرة : 186)
আমার বান্দাগণ যখন আমার সম্পর্কে তোমাকে প্রশ্ন করে, আমি তো নিকটেই। প্রার্থনাকারী যখন আমার কাছে প্রার্থনা করে আমি তার প্রার্থনায় সাড়া দেই। সূরা আল-বাকারা : ১৮৬। তাই সিয়াম পালনকারী আল্লাহর কাছে অধিক পরিমাণে দোয়া-প্রার্থনা করবে। রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম বলেছেন :—
ثلاث دعوات مستجابة : دعوة الصائم، دعوة المظلوم، دعوة المسافر. رواه البيهقي في شعب الإيمانوصححه الألباني في الجامع
তিনজনের দোয়া কবুল করা হয় ; সিয়াম পালনকারীর দোয়া, অত্যাচারিত ব্যক্তির দোয়া এবং মুসাফিরের দোয়া। সহি আল-জামে
(৮) তওবা করা :
সর্বদা তওবা করা ওয়াজিব। বিশেষ করে এ মাসে তো বটেই। এ মাসে তওবার অনুকূল অবস্থা বিরাজ করে। শয়তানকে শৃঙ্খলাবদ্ধ করা হয়, জাহান্নাম থেকে মানুষকে মুক্তি দেয়া হয়। এ ছাড়া রমজান মাসের সকল ইবাদত বন্দেগি তওবার অনুকুল পরিবেশ সৃষ্টি করে। এ কারণেই রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম বলেছেন :—
رغم أنف رجل دخل عليه رمضان، ثم انسلخ قبل أن يغفر له (رواه الترمذي)
যে ব্যক্তি রমজান মাস পেয়েও তার পাপ ক্ষমা করাতে পারেনি তার নাক ধুলায় ধূসরিত হোক। বর্ণনায় : তিরমিজি
তাই রমজান মাসটাকে তওবা ও ক্ষমা পাওয়ার মাস হিসেবে গ্রহণ করে সে অনুযায়ী আমল করা উচিত।
(৯) নেক আমল করতে অধিক হারে চেষ্টা অব্যাহত রাখা:
বিশেষ করে রমজানের শেষ দশকে -
عن عائشة رضي الله عنها قالت : كان رسول الله صلى الله عليه وسلم إذا دخل العشر أحيى الليل، وأيقظأهله، وجد وشد المئزر. رواه مسلم
আয়েশা রা. থেকে বর্ণিত, তিনি বলেন : যখন রমজানের শেষ দশক এসে যেত রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম তখন রাত্রি জাগরণ করতেন, পরিবারবর্গকে নিদ্রা থেকে জাগিয়ে দিতেন, লুঙ্গি শক্ত ও ভাল করে বেঁধে (প্রস্তুতি গ্রহণ) নিতেন। বর্ণনায় : মুসলিম
তিনি আরো বলেন :—
كان رسول الله صلى الله عليه وسلم يجتهد في العشر الأواخر ما لا يجتهده في غيره. رواه مسلم
রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম রমজানের শেষ দশকে ইবাদত-বন্দেগিতে যে পরিশ্রম করতেন অন্য সময় এ রকম করতেন না। বর্ণনায় : মুসলিম
(১০) ইসলামি শিক্ষা অর্জনের প্রতি গুরুত্ব প্রদান :
ইসলামি শিক্ষা হল সকল প্রকার শিক্ষার মূল। তা ছাড়া দুটি বিষয় লক্ষ্য করা খুব জরুরি
এক. ইসলামের সকল ইবাদত-বন্দেগি সঠিকভাবে আদায় করতে হলে ইসলামি শিক্ষা অর্জন করতে হয়। এ ব্যাপারে কোন ওজর-আপত্তি গ্রহণযোগ্য নয়। সালাতের নিয়মকানুন, সিয়ামের বিধান, জাকাতের নিয়ম-নীতি, হজের আহকাম না শিখে এগুলো আদায় করা যায় না।
দুই. আল-কুরআনের তফসির শেখা ও অধ্যয়ন অত্যন্ত জরুরি। বিশেষ করে আমরা যে সকল সূরা-কেরাত সালাতের মাঝে পড়ে থাকি সেগুলোর মর্ম অনুধাবন করে তিলাওয়াত করা দরকার। কাজেই রমজান মাসকে আমরা ইসলামি শিক্ষা অর্জন ও শিক্ষা প্রসারের একটি সুযোগ হিসেবে নিতে পারি। মূর্খতার অবসান ঘটানো সিয়ামের একটা গুরুত্বপূর্ণ দাবি।
যেমন রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম বলেছেন :—
من لم يدع قول الزور والعمل به والجهل، فليس لله حاجة أن يدع طعامه وشرابه . رواه البخاري
যে মিথ্যা কথা ও কাজ এবং মূর্খতা পরিত্যাগ করতে পারল না তার পানাহার বর্জনে আল্লাহর কোন প্রয়োজন নেই। বর্ণনায় : বোখারি
হাদিসটি দ্বারা স্পষ্ট বুঝে আসে যদি মূর্খতা পরিহার না করা হয় তবে সিয়াম আল্লাহর কাছে গুরুত্বহীন হয়ে পড়ে। আর মূর্খতা ত্যাগ করা যাবে শুধু শিক্ষা অর্জনের মাধ্যমে।
আল্লাহ আমাদের রামাদানের গুরুত্ত বুঝে আমল করার তওফিক দান করুন । আমীন

Pages: 1 ... 5 6 [7]