Show Posts

This section allows you to view all posts made by this member. Note that you can only see posts made in areas you currently have access to.


Topics - alsafayat

Pages: 1 [2]
16
বাংলাদেশের অর্থনৈতিক কর্মকাণ্ডের ইতিহাসে কৃষিবহির্ভূত সর্বাধিক উল্লেখযোগ্য ক্ষেত্রটি নিঃসন্দেহে তাঁত শিল্প, যে শিল্পে উৎপাদিত পণ্যের একটি আদি নিদর্শন হচ্ছে মসলিন। ইতিহাসের তথ্য পর্যালোচনায় ধারণা করা হয়, খ্রিস্টীয় পনেরো শতকের গোড়ায় বাংলাদেশের বিশেষ পেশাজীবীশ্রেণীর উদ্ভাবিত নিজস্ব তাঁত ব্যবহার করেই ঢাকার অদূরবর্তী ডেমরা-তারাবো অঞ্চলে মসলিনের গোড়াপত্তন। পরবর্তীতে এ মসলিনের প্রভাব এবং এতে ব্যবহূত কারিগরি নৈপুণ্যের স্থানান্তর ও সম্প্রসারণের পথ ধরেই দেশের অন্যান্য অঞ্চলে তাঁত শিল্পের বিকাশ ঘটে। তবে নানা কারণে এবং খুব স্বাভাবিকভাবেই মসলিনের অবিকল স্থানান্তর ঘটেনি, ঘটেছে তাঁতভিত্তিক অন্য বিভিন্ন বস্ত্রের, যার মধ্যে আজকের শাড়ি, লুঙ্গি, গামছা, তোয়ালে ইত্যাদি অন্যতম। আর যেসব এলাকায় এসবের স্থানান্তর ও বিকাশ ঘটে, তার মধ্যে উত্তরবঙ্গ (বর্তমানে রাজশাহী ও রংপুর বিভাগ) অন্যতম। তবে এ দুই বিভাগের সর্বত্রই যে এ তাঁত শিল্প স্থানান্তর হয় বা উৎপাদনের জন্য স্থান খোঁজে, তা কিন্তু নয়; বরং উত্তরবঙ্গের ওই বিস্তৃত অঞ্চলের গুটিকতক এলাকাই কেবল ক্রমান্বয়ে তাঁতঘন উৎপাদন এলাকায় পরিণত হয় এবং এর পেছনে বেশকিছু ভৌগোলিক ও সামাজিক কারণও রয়েছে, যার খানিকটা এ প্রবন্ধের পরের অংশের আলোচনায় অন্তর্ভুক্ত থাকছে। সেই সঙ্গে উত্তরবঙ্গে তাঁত শিল্পের বর্তমান অবস্থা, সমস্যা ও ভবিষ্যৎ সম্ভাবনা সম্পর্কেও এখানে আলোকপাত করা হলো।

উত্তরবঙ্গে মোট জেলা হচ্ছে ১৬টি এবং উপজেলা ১২৮টি। এর মধ্যে তাঁত শিল্পের বিকাশ হয়েছে মাত্র সাতটি জেলার (সিরাজগঞ্জ, পাবনা, রংপুর, বগুড়া, চাঁপাইনবাবগঞ্জ ও রাজশাহী) ১১টি উপজেলায় (শাহজাদপুর, বেলকুচি, উল্লাপাড়া, কামারখন্দ, ঈশ্বরদী, পাবনা সদর, গঙ্গাচড়া, বগুড়া সদর, শিবগঞ্জ, চাঁপাইনবাবগঞ্জ সদর ও রাজশাহী সদর)। তার মধ্যে শিবগঞ্জ, চাঁপাইনবাবগঞ্জ সদর ও রাজশাহী সদর বস্তুত রেশমজাত তাঁতবস্ত্র ও বাকি উপজেলাগুলো সুতিবস্ত্রের উৎপাদন এলাকা। আর উল্লিখিত এলাকায় উৎপাদিত পণ্যাদির মধ্যে রয়েছে শাড়ি, লুঙ্গি, গামছা, তোয়ালে ইত্যাদি এবং এগুলোর উপজাত অন্য সামগ্রী।

এখন স্বভাবতই কৌতূহল জাগে, নারায়ণগঞ্জের রূপগঞ্জে শীতলক্ষ্যা নদীর পাড়ঘেঁষে গড়ে ওঠা মসলিন বা বিবর্তনের প্রক্রিয়ায় এর অপভ্রংশ হিসেবে জামদানি তাঁতবস্ত্রের বিস্তার সন্নিহিত অনেক জেলাকে পাশ কেটে সিরাজগঞ্জ ও তৎসন্নিহিত অন্যান্য জেলায় বিস্তার লাভ করল কেন ও কীভাবে? অন্যদিকে উত্তরবঙ্গের এত উপজেলার (১২৮টি) মধ্যে মাত্র ১১টি উপজেলাতেই বা কেন তাঁত শিল্প গড়ে উঠল? জবাবে প্রথমে এর প্রাকৃতিক কারণটির দিকে তাকাই। মসলিন বা জামদানি তাঁত পল্লীগুলো গড়ে উঠেছিল শীতলক্ষ্যা নদীর পানির আর্দ্রতামিশ্রিত বিশেষ জলবায়ুগত আবহের মধ্যে (যমুনার বিপরীত পাড়ের টাঙ্গাইলে তাঁত পল্লী গড়ে ওঠাও সে ধারারই অংশ)। অন্যদিকে শিবগঞ্জ ও চাঁপাইনবাবগঞ্জের রেশম পল্লীও মহানন্দা ও পদ্মা নদীর বিশেষ গুণগত বৈশিষ্ট্যসম্পন্ন পানিরই অবদান। রংপুরের গঙ্গাচড়া ও বগুড়া সদরের তাঁত শিল্পগুলোর উৎপত্তির উৎস ১৯৪৭-এর দেশভাগের প্রক্রিয়ায় বেনারস থেকে দেশান্তরিত জনগোষ্ঠীর তাঁতিরা, যাদের এক বড় অংশের বসবাস সৈয়দপুরে এবং এদের অন্য একটি অংশের হাতে গড়ে ওঠে গঙ্গাচড়া ও বগুড়া সদরের তাঁত শিল্প।

দেশে বর্তমানে প্রায় ১ দশমিক ৮৩ লাখ তাঁত শিল্প ইউনিট রয়েছে, যেগুলোর আওতাধীন তাঁতের সংখ্যা প্রায় ৫ দশমিক শূন্য ৬ লাখ। এর মধ্যে সচল তাঁতের সংখ্যা ৩ দশমিক ১৪ লাখ এবং অচল তাঁতের সংখ্যা ১ দশমিক ৯২ লাখ। অর্থাৎ প্রতিটি ইউনিটের আওতায় গড়ে তাঁত রয়েছে প্রায় তিনটি। উল্লিখিত শিল্প ইউনিট থেকে বছরে প্রায় ৬৮ দশমিক ৭০ কোটি মিটার বস্ত্র উৎপাদন হয়। তাঁত শিল্প খাতে সরাসরি নিয়োজিত জনবল রয়েছে প্রায় ১০ লাখ এবং পরোক্ষভাবে জড়িত আরো প্রায় ছয় লাখ মানুষ। আর প্রত্যক্ষ ও পরোক্ষভাবে জড়িত এ জনবলের অর্ধেকই নারী। উল্লিখিত জাতীয়ভিত্তিক পরিসংখ্যানের বিপরীতে উত্তরবঙ্গের চিত্র কিছুটা ফ্যাকাসে, তবে অসঙ্গতিপূর্ণ নয়। উত্তরবঙ্গে অবস্থিত মোট তাঁত শিল্প ইউনিটের সংখ্যা, মোট তাঁতের সংখ্যা এবং বার্ষিক উৎপাদন, কর্মরত জনবল— সব ক্ষেত্রেই জাতীয়ভিত্তিক পরিসংখ্যানের তুলনায় এটি ৪০ শতাংশের নিচে।

বাংলাদেশের তাঁত শিল্পের ক্ষেত্রে বিরাজমান সবচেয়ে বড় সমস্যাগুলোর মধ্যে রয়েছে— উচ্চতর প্রযুক্তিভিত্তিক যন্ত্রপাতিসংবলিত কারখানায় উৎপাদিত বস্ত্রের সঙ্গে প্রতিযোগিতা করতে না পারা, মানসম্পন্ন কাঁচামালের সহজ সরবরাহ ব্যবস্থার অনুপস্থিতি, তাঁতঘন অঞ্চলে (বস্তুত যা গ্রামাঞ্চল) প্রাতিষ্ঠানিক ঋণের ঘাটতি এবং সে ঘাটতির কারণে দাদন প্রথা চালু থাকা, পণ্য বিপণন ব্যবস্থায় একাধিক মধ্যস্বত্বভাগী স্তরের উপস্থিতি, সক্ষমতা থাকা সত্ত্বেও সেখানে উৎপাদিত পণ্য (তাঁতবস্ত্র) রফতানি না হওয়া, প্রাতিষ্ঠানিক ঋণের ঘাটতি, পণ্যের নকশা ও মানোন্নয়নে উদ্যোগের অপর্যাপ্ততা ইত্যাদি। এসব সমস্যা বাংলাদেশের তাঁত শিল্পের ক্ষেত্রে সামগ্রিকভাবে যেমন সত্য, তেমনি সমান সত্য উত্তরবঙ্গের ক্ষেত্রেও। আর ভৌগোলিকভাবে তুলনামূলক বিচারে কিছুটা পশ্চাৎপদ এলাকা বিধায় এ সমস্যাগুলো সেখানকার ক্ষেত্রে আরো বেশি করে প্রকট এবং কোনো কোনো ক্ষেত্রে এটি শুধু উত্তরবঙ্গের তাঁত শিল্পেরই সমস্যা।

তাঁত শিল্প খাতের উল্লিখিত সমস্যাগুলোকে উত্তরবঙ্গের পরিপ্রেক্ষিত থেকে দেখতে গেলে প্রথমেই বলতে হয় যে, আধুনিক যন্ত্রচালিত কারখানায় উৎপাদিত বস্ত্রের সঙ্গে তাঁতবস্ত্রের বিশ্বব্যাপী যে প্রতিযোগিতা, সেটি উত্তরবঙ্গের ক্ষেত্রে আরো বেশি সংকটাপূর্ণ। কারণ বুনন নৈপুণ্যে কর্মকুশলতা থাকলেও উত্তরবঙ্গের স্বল্পশিক্ষিত বা নিরক্ষর তাঁতিদের অধিকাংশই জানেন না যে হস্তচালিত তাঁতে উৎপাদিত বস্ত্রের কদর ও আকর্ষণ পৃথিবীর বহু দেশেই এখন দিন দিন বাড়ছে। এ অবস্থায় তাদেরকে যদি বিশ্ববাজারের এ সম্ভাবনাকে কাজে লাগানোর ব্যাপারে কোনো না কোনোভাবে সহযোগিতা করা যেত, তাহলে সেটি হতে পারত উত্তরবঙ্গের তাঁত শিল্পের বিকাশ ও উন্নয়নের জন্য সর্বোত্তম টেকসই কৌশল। কিন্তু এজন্য দরকার বিশ্ববাজারের ক্রেতার রুচি ও চাহিদা সম্পর্কে সুস্পষ্ট জ্ঞান, যাতে এ তাঁতিরা সে অনুযায়ী নিজেদের পণ্যের নকশা ও মানকে ঢেলে সাজাতে পারেন। কিন্তু এরূপ সহযোগিতাদানের তেমন কোনো সুযোগই বাংলাদেশের বিদ্যমান ব্যবস্থায় চালু নেই। অন্যদিকে রফতানি বাজারে প্রবেশের কলাকৌশল ও নিয়মকানুন সম্পর্কেও এ তাঁতিরা অবগত নন। ফলে বিশ্ববাজারের ওই বিপুল সম্ভাবনাকে কাজে লাগানো তো পরের কথা, আধুনিক যন্ত্রচালিত তাঁতবস্ত্রের সঙ্গে প্রতিযোগিতায় কোনো রকমে টিকে থাকার জন্যই তাদেরকে অহর্নিশ প্রাণান্তকর পরিশ্রম করতে হচ্ছে।

উত্তরবঙ্গের মোট তাঁতের প্রায় ৪০ শতাংশই এখন বন্ধ, যেখানে জাতীয়ভিত্তিক হিসাবে বন্ধ তাঁতের সংখ্যা হচ্ছে ৩৮ শতাংশ। এ বিপুলসংখ্যক তাঁত বন্ধ থাকার পেছনে যে কারণগুলো দায়ী, তার মধ্যে রয়েছে অন্যায্য বাজার ব্যবস্থায় নানা হাত ঘুরে তাঁতির কাছে আসা কাঁচামালের উচ্চমূল্য, চলতি মূলধনের অভাব, অন্য পেশার তুলনায় এক্ষেত্রে মুনাফার হার কম হওয়া, সামাজিকভাবে তাঁত শিল্পে কাজ করাকে সম্মানজনক পেশা হিসেবে গণ্য না করায় তরুণ তাঁতিদের পেশা ত্যাগ ইত্যাদি। এ অবস্থায় উল্লিখিত সমস্যাগুলো দূরীভূত করতে পারলে তাঁত শিল্প খাতে নতুন মূলধন বিনিয়োগ ও নতুন উৎপাদনক্ষমতা স্থাপন ব্যতিরেকেই সেখানকার উৎপাদনকে অন্তত ৬০ থেকে ৭০ শতাংশ বৃদ্ধি করা সম্ভব বলে সংশ্লিষ্টরা মনে করেন।

উত্তরবঙ্গের তাঁত শিল্পের ক্ষেত্রে একটি ব্যতিক্রমী নেতিবাচক অনুষঙ্গ হচ্ছে, সেখানে দাদন প্রথার মতো শোষণমূলক ঋণ ব্যবস্থা এখনো চালু থাকা; যা দেশের অন্যান্য অঞ্চলের তাঁত শিল্পে চালু থাকলেও উত্তরবঙ্গের মতো অতটা প্রকট নয়। বাংলাদেশে প্রাতিষ্ঠানিক অর্থায়ন ব্যবস্থা তথা ব্যাংক কার্যক্রম যথেষ্ট শক্তিশালী ও গ্রামাঞ্চলে সম্প্রসারিত হওয়া সত্ত্বেও একটি অমানবিক ঋণ ব্যবস্থা কেন ও কীভাবে এখনো দুর্দান্ত দাপটের সঙ্গে টিকে থাকল, তা সংশ্লিষ্ট সবাইকে গভীরভাবে ভেবে দেখা প্রয়োজন। আমাদের ব্যাংকগুলো বিশেষত বেসরকারি খাতের ব্যাংকগুলো বর্ধিতসংখ্যক ঋণগ্রহীতা খুঁজে পাওয়ার জন্য যেখানে হন্যে হয়ে ঘুরছে, সেখানে তারা কেন এখনো দাদনভিত্তিক ঋণ ব্যবস্থার বিকল্প হয়ে উঠতে পারছে না? আর এর প্রতিবিধান হিসেবে রাষ্ট্রের দিক থেকেও তেমন কোনো উদ্যোগ এখন পর্যন্ত দৃষ্টিগোচর হয়নি এবং সেটি না হওয়া পর্যন্ত দাদনের মতো অমানবিক প্রথা যে উত্তরবঙ্গের তাঁতিদেরকে শুধু মানসিকভাবেই পীড়িত করবে তা নয়, সেখানকার তাঁত শিল্পের উৎপাদন ও উৎপাদনশীলতা দুই-ই হ্রাস পাবে এবং একই সঙ্গে ঘটতে থাকবে তাঁতিদের পেশাত্যাগের হারও।

এটা সর্বজনবিদিত, বাংলাদেশের পণ্য বিপণন ব্যবস্থায় নানা মধ্যস্বত্বভোগী স্তরের উপস্থিতির কারণে উৎপাদক ও ভোক্তা দুই-ই ব্যাপকভাবে ক্ষতিগ্রস্ত হচ্ছেন। একই ঘটনা খুব স্বাভাবিকভাবেই তাঁত শিল্পের ক্ষেত্রেও সত্য। তবে এটি অধিক সত্য উত্তরবঙ্গের তাঁত শিল্পের ক্ষেত্রে। নানা হাত ঘুরে রাজধানী বা দেশের বড় শহরে উত্তরবঙ্গের তাঁতবস্ত্র যে মূল্যে বিক্রি হয়, এর প্রকৃত উৎপাদকরা পান তার সর্বোচ্চ মাত্র ৫৫ শতাংশ। এর একটি কারণ ভৌগোলিক। তবে বড় কারণটি দীর্ঘদিন ধরে মধ্যস্বত্বভোগীদের দ্বারা নিয়ন্ত্রিত বাজার ব্যবস্থা। এ বিপণন ব্যবস্থাটিকে কীভাবে আরো সংক্ষিপ্ত করা যায় এবং উত্তরবঙ্গের তাঁতবস্ত্রকে কীভাবে আন্তর্জাতিক বাজারের সঙ্গে যুক্ত করা যায়, সে বিষয়টি গভীরভাবে ভেবে দেখা যেতে পারে। এক্ষেত্রে বাংলাদেশ তাঁত বোর্ড (বিএইচবি) ও রফতানি উন্নয়ন ব্যুরোর (ইপিবি) ভূমিকাকে আরো কার্যকর ও সম্প্রসারণের বিষয়টি গুরুত্বের সঙ্গে বিবেচনা করা যেতে পারে। অন্যদিকে শ্রমিক-তাঁতি ও মালিক-তাঁতির মধ্যকার ব্যবধান যত দ্রুত কমিয়ে আনা যাবে, তাঁত শিল্প খাতের উৎপাদন ততই বৃদ্ধি পাবে। এ প্রক্রিয়ায় প্রকৃত দক্ষতার সদ্ব্যবহারও বাড়বে; যা এ খাতে উৎপাদনশীলতা বৃদ্ধির অন্যতম নিয়ামক হিসেবে গণ্য হতে পারে। উদ্যোক্তা উন্নয়ন প্রক্রিয়ার অংশ হিসেবে শ্রমিক-তাঁতিদের উদ্যোক্তা হিসেবে গড়ে তোলার বিষয়ে বিএইচবি বা বিসিক (বাংলাদেশ ক্ষুদ্র ও কুটির শিল্প করপোরেশন) প্রয়োজনীয় উদ্যোগ গ্রহণ করতে পারে।

নিবন্ধের শুরুতে বাংলাদেশ তথা উত্তরবঙ্গের তাঁত শিল্পের উৎপত্তি ও ক্রমবিকাশের সঙ্গে নদী অববাহিকার একটি সম্পর্ক খুঁজে পাওয়ার চেষ্টা করা হয়েছে। বস্তুত যা গবেষণাভিত্তিক প্রমাণিত সত্য। শুধু বাংলাদেশেই নয়, পুরো পৃথিবীর বস্ত্র শিল্পের প্রতিষ্ঠা ও বিকাশের সঙ্গেই জড়িয়ে আছে নদীভিত্তিক  জলবায়ু ও যোগাযোগ ব্যবস্থার অবদান। বৈশ্বিক প্রেক্ষাপটেও উত্তরবঙ্গের তাঁত শিল্প খাতের যে বিপুল অন্তর্গত সম্ভাবনা রয়েছে, সেটিকে যথাযথভাবে ব্যবহার করতে পারলে আর নতুন কোনো উৎপাদনক্ষমতার সংযোজন ছাড়াই বিদ্যমান উৎপাদনক্ষমতায়ই এ শিল্পকে আরো বহুদূর এগিয়ে নিয়ে যাওয়া সম্ভব। প্রয়োজন সংশ্লিষ্টদের মধ্যে একটি সামগ্রিক বৈশ্বিক দৃষ্টিভঙ্গি এবং স্থানীয় পরিবেশ ও কাঠামোর সঙ্গে সঙ্গতিপূর্ণ দীর্ঘমেয়াদি অংশগ্রহণমূলক পরিকল্পনা ও তার ত্বরিত ও সময়মাফিক বাস্তবায়ন।

লেখক : পরিচালক
আবু তাহের খান
ক্যারিয়ার ডেভেলপমেন্ট সেন্টার
ড্যাফোডিল ইন্টারন্যাশনাল ইউনিভার্সিটি
atkhan56@gmail.com

Source: http://gg.gg/bvyu0

http://bonikbarta.net/bangla/news/2018-10-01/172207/উত্তরবঙ্গে-তাঁত-শিল্পের-ক্রমবিকাশ

17
বিভিন্ন স্থানীয় ও আন্তর্জাতিক গবেষণাপত্রের তথ্য ও শিল্প খাতে জড়িত উদ্যোক্তাদের মতামত উদ্ধৃত করে পত্রিকায় প্রকাশিত প্রতিবেদন থেকে দেখা যাচ্ছে, পাঁচ লাখের মতো বিদেশী বর্তমানে বাংলাদেশে কাজ করছে। ধারণা করা হচ্ছে, সামনের দিনগুলোয় এ সংখ্যা আরো বাড়বে। অন্যদিকে বাংলাদেশ পরিসংখ্যান ব্যুরোর (বিবিএস) ২০১৫-১৬ অর্থবছরের হিসাব অনুযায়ী, দেশে বেকারের সংখ্যা প্রায় ২৬ লাখ, যার মধ্যে উল্লেখযোগ্য সংখ্যায় রয়েছে শিক্ষিত বেকার। তদুপরি আরো প্রায় সাড়ে তিন লাখ তরুণ প্রতি বছর বিশ্ববিদ্যালয় থেকে পাস করে বেরোচ্ছে, যার মধ্যে উল্লেখযোগ্য সংখ্যায় রয়েছে মাদ্রাসা থেকে বেরোনো ডিগ্রিধারীরাও।

এখন স্বভাবতই প্রশ্ন আসে, এত বিপুলসংখ্যক মানুষ বিশেষত শিক্ষিত তরুণ বেকার থাকা সত্ত্বেও পাঁচ লাখ বিদেশী কেন বাংলাদেশে কাজ পাচ্ছে, যারা প্রতি বছর প্রায় সাড়ে ১৬ হাজার কোটি টাকা নিজ নিজ দেশে নিয়ে যাচ্ছে? বিষয়টি উত্কণ্ঠার হলেও এর মধ্যে কোনো অস্বাভাবিকতা নেই। বরং অপ্রিয় হলেও সত্য, উপযুক্ত দক্ষ লোক দেশে পাওয়া যাচ্ছে না বলেই চাকরিদাতারা বাধ্য হয়ে বেশি বেতন দিয়ে বিদেশীদের নিয়োগ করছেন এবং তা করতে না হলে অর্থাৎ স্থানীয়দের দিয়ে এ কাজ চালানো গেলে সংশ্লিষ্ট প্রতিষ্ঠানের উৎপাদন ব্যয় বা ব্যবসায়ের খরচ আরো কম পড়ত। কিন্তু তা না করে তারা যে বেশি বেতন দেয়ার ঝুঁকি নিয়ে বিদেশীদের নিয়োগ করছেন, সেটি তারা নিরুপায় হয়েই করছেন— এ ব্যাপারে দ্বিমতের কোনো অবকাশ নেই। আর তাই মানতে হবে, শিক্ষার বর্তমান ব্যবস্থা ও ধারা অব্যাহত থাকলে সামনের দিনগুলোয় বিদেশীদের নিয়োগ দেয়ার এ হার আরো বাড়বে বৈ কমবে না। অন্যদিকে উৎপাদন ও ব্যবসায় খাতে উৎপাদনশীলতার উচ্চহার প্রতিষ্ঠা করতে চাইলে এ নিয়োগকে নিয়ন্ত্রণ করাটাও সমীচীন হবে না। কারণ বিশ্ববাজারের প্রতিযোগিতায় টিকে থাকতে হলে উৎপাদন ও কর্মপ্রক্রিয়ায় উচ্চতর দক্ষতা সংযুক্তির কোনো বিকল্প নেই, যে দক্ষতার সরবরাহ বাংলাদেশের শিক্ষা ব্যবস্থা কিছুতেই করতে পারছে না। তাহলে স্বভাবতই প্রশ্ন জাগে, বাংলাদেশের কর্মবাজার কি তাহলে ক্রমে বিদেশীদের হাতেই চলে যাবে?

শেষোক্ত এ প্রশ্নটিকে রাষ্ট্রের নীতিনির্ধারকরা অনেকটা তাচ্ছিল্যের সঙ্গে নিচ্ছেন বলেই মনে হচ্ছে। অন্তত এ বিষয়ে নানা উদ্বেগজনক খবরাখবর পত্রিকায় প্রকাশিত হওয়ার পরও এ ব্যাপারে তাদের কোনো প্রতিক্রিয়া না দেখে আপাতত তা-ই মনে হচ্ছে। জাতীয় সংসদে কত গুরুত্বহীন মামুলি বিষয় নিয়ে কথা বলে কত মূল্যবান সময় ব্যয় হয়। অথচ পাঁচ লাখ বিদেশী বাংলাদেশে কাজ করে (যাদের চার-পঞ্চমাংশই আবার বৈধ কর্মানুমতি ছাড়া) বছরে সাড়ে ১৬ হাজার কোটি টাকা বাইরে নিয়ে যাওয়ার মতো পরিস্থিতি কীভাবে মোকাবেলা করা হবে, সে বিষয়ে জাতীয় সংসদে একটি টুঁ শব্দও উচ্চারিত হয়নি। বরং প্রাসঙ্গিক নানা তত্পরতা দেখে এটাই মনে হচ্ছে, রাষ্ট্র বরং এক্ষেত্রে উল্টো পথে হাঁটছে। কয়েকটি উদাহরণ দিয়ে বিষয়টি খোলাসা করা যাক।

একটু পুরনো হিসাবে দেশে এখন বেসরকারি বিশ্ববিদ্যালয়ের সংখ্যা ৯৭ (সর্বশেষ হিসাবে আরো বেশি হতে পারে)। এর মধ্যে গোটা দশেকের কথা বাদ দিলে বাদবাকিগুলোয় যে মানের পড়াশোনা করানো হয়, তাকে আর যা-ই বলা যাক, বিশ্ববিদ্যালয় পর্যায়ের শিক্ষা বলা যাবে না কিছুতেই। এখানে শিক্ষার আন্তর্জাতিক মান তো দূরের কথা, বাংলাদেশ মানের সাধারণ স্নাতক পর্যায়ের শিক্ষার স্তরও রক্ষিত হয় না। এখানকার অধিকাংশ বেসরকারি শিক্ষার মান নিয়ে যেমন প্রশ্ন রয়েছে, তেমনি প্রশ্ন রয়েছে এখানে ছাত্র ভর্তির যোগ্যতা নিয়েও। এসএসসি ও এইচএসসি পরীক্ষায় নামমাত্র জিপিএ নিয়ে পাস করতে পারলেই এসব বিশ্ববিদ্যালয়ে অনায়াসে ভর্তি হওয়া যায়, যাদের অধিকাংশেরই বিশ্ববিদ্যালয় পর্যায়ের পাঠ্যক্রমের সঙ্গে নিজেদের আত্মস্থ করার সামর্থ্য নেই। অথচ বাণিজ্যিক স্বার্থে এসব বিশ্ববিদ্যালয়ে এ ধরনের ছাত্র ভর্তি দেদার চলছে। শিক্ষক নিয়োগের ক্ষেত্রেও একই অবস্থা। যাদের উচ্চ মাধ্যমিক পর্যায়ে শিক্ষাদানের যোগ্যতাও নেই, তারাই পড়াচ্ছেন স্নাতক ও স্নাতকোত্তর পর্যায়ে। ফলে এরূপ দ্বিবিধ (মানহীন শিক্ষক ও ছাত্র) মানহীন ব্যবস্থার মধ্য দিয়ে বের হওয়া স্নাতকরা কর্মক্ষেত্রে গিয়ে চাকরি পেয়ে যাবেন বা চাকরিদাতারা অবলীলায় তাদের নিয়োগ দেবেন— এরূপ আশা করাটা একেবারেই অবান্তর। এবং অত্যন্ত যুক্তিসঙ্গত কারণেই তা ঘটছেও না এবং তা ঘটছে না বলেই তথাকথিত শিক্ষিত বেকারের সংখ্যা দিন দিন বাড়ছে।

একটি বহুল প্রচলিত ধারণা, দেশে কাঙ্ক্ষিত মাত্রায় কারিগরি শিক্ষার প্রসার না ঘটে সাধারণ শিক্ষার বিস্তার ঘটার কারণেই শিক্ষিত বেকারের সংখ্যা বাড়ছে। ধারণাটি পুরোপুরি সত্য নয়— আংশিক সত্য মাত্র। কারিগরি শিক্ষার বিস্তারে অবশ্যই ব্যাপক ঘাটতি রয়েছে এবং তা অবশ্যই সর্বোচ্চ গুরুত্ব ও দ্রুততার সঙ্গে পূরণ করা প্রয়োজন। কিন্তু অব্যক্ত বাকি সত্যটি হচ্ছে, কর্মবাজারে সাধারণ শিক্ষিত স্নাতকদের যে চাহিদা রয়েছে, মানসম্পন্ন স্নাতকের অভাবে চাকরিদাতারা সে জায়গাগুলোও প্রত্যাশা অনুযায়ী পূরণ করতে না পেরে ওইসব পদে হয় বিদেশী নিয়োগ করছেন অথবা নিরুপায় হয়ে নিম্নমানের স্থানীয়দেরকেই নিয়োগ দিতে বাধ্য হচ্ছেন। আর সাধারণ শিক্ষায় শিক্ষিত মানসম্পন্ন স্নাতক না পাওয়ারই একটি ফলাফল হচ্ছে সাম্প্রতিক সময়ে সরকারি বিশ্ববিদ্যালয়গুলোয় ‘নির্বাহী এমবিএ’ কোর্স খোলার ধুম পড়ে যাওয়া। বেসরকারি বিশ্ববিদ্যালয়গুলো থেকে পাস করা মানহীন বা নিম্নমধ্যম পর্যায়ের স্নাতকদের ঘষেমেজে ন্যূনতম পর্যায়ের কার্যোপযোগী করে তোলাই হচ্ছে এসব নির্বাহী এমবিএ কোর্সের মূল উদ্দেশ্য।

অন্যদিকে কারিগরি শিক্ষার মানও যে এখানে যথেষ্ট উন্নত— এমনটি বলা যাবে না। কারিগরি শিক্ষার ব্যাপক চাহিদার কারণে সাম্প্রতিক সময়ে বেসরকারি খাতে রাতারাতি বহুসংখ্যক পলিটেকনিক ও অনুরূপ কারিগরি শিক্ষাপ্রতিষ্ঠান গড়ে উঠলেও সেগুলোর মান নিয়ে সাধারণ শিক্ষার মানের মতোই গুরুতর প্রশ্ন রয়েছে। ফলে কারিগরি শিক্ষার অভাবেই শুধু দেশে বেকারত্ব বাড়ছে— এমনটি বলা যাবে না। বরং কারিগরি ও অকারিগরি উভয় ক্ষেত্রেই শিক্ষার মানের ক্ষেত্রে যে ব্যাপক ঘাটতি রয়েছে, সেটাই শিক্ষিত তরুণদের বেকারত্বের মূল কারণ। তবে হ্যাঁ, সাধারণ শিক্ষার তুলনায় কারিগরি শিক্ষাকে আমাদের অবশ্যই অধিকতর গুরুত্বের সঙ্গে নিতে হবে। সেসঙ্গে আরো একটি বিষয়ের প্রতি এখানে দৃষ্টি দেয়া প্রয়োজন, তথাকথিত এসব মানহীন বিশ্ববিদ্যালয় থেকে সনদ অর্জনের পর একজন ডিগ্রিধারী স্বভাবতই ভাবতে শুরু করে, যোগ্যতা থাকা সত্ত্বেও সে চাকরি পাচ্ছে না। অথচ চাকরি পাওয়ার জন্য প্রয়োজনীয় দক্ষতা যে তার নেই, অধিকাংশ তরুণই তা বুঝতে না পেরে এক ধরনের হতাশায় ভোগে এবং এ ধারণার ভিত্তিতেই সামাজিকভাবেও তা প্রতিষ্ঠিত হয়ে গেছে যে, কর্মের অভাবেই মূলত দেশে শিক্ষিত বেকারের সংখ্যা ক্রমে বাড়ছে। কিন্তু প্রকৃত তথ্য হচ্ছে, শিক্ষা ও ব্যবসায় খাতের দ্রুত প্রসারের ফলে দেশে প্রতিনিয়তই নতুন নতুন কর্মের সুযোগ তৈরি হচ্ছে। কিন্তু প্রয়োজনীয় দক্ষতা ও যোগ্যতার অভাবে আমাদের তরুণরা এসব পদে নিয়োগ লাভে সক্ষম হচ্ছে না এবং সে পদগুলোতেই পরে এসে নিয়োগ পাচ্ছে বিদেশীরা।

অতএব দেশ থেকে শিক্ষিত বেকারের সংখ্যা কমাতে হলে বিশ্ববাজারের সর্বশেষ প্রবণতার সঙ্গে সঙ্গতি রেখে দক্ষ ও আধুনিক প্রযুক্তির চাহিদা পূরণে সক্ষম জনবল গড়ে তুলতে হবে, যা গড়ে তোলার সামর্থ্য দেশের অধিকাংশ শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানের নেই। অথচ সত্য এই যে, অর্থনৈতিক কর্মকাণ্ডের বহুমাত্রিক ও ব্যাপক বিস্তারের ফলে দেশে নতুন নতুন কর্মের সুযোগ দিন দিন বাড়ছে এবং ক্রমে তা বাড়তেই থাকবে। কিন্তু প্রয়োজনীয় যোগ্যতার অভাবে, যদি না সে যোগ্যতা তৈরির আশু উদ্যোগ গ্রহণ করা হয়, তাহলে সেসব সুযোগ আমাদের তরুণদের ধরাছোঁয়ার বাইরেই থেকে যাবে। প্রসঙ্গত বলা প্রয়োজন, এ ধরনের কর্মের সুযোগ বিশ্ববাজারেও দিন দিন বাড়ছে, যা বাংলাদেশের শিক্ষিত তরুণদের জন্যও সমানভাবে উন্মুক্ত। ইউরোপ ও আমেরিকার উদ্যোক্তারা এসব পদে লোক নিয়োগের ক্ষেত্রে এশীয় তরুণ-তরুণীকে বিশেষভাবে অগ্রাধিকার দিচ্ছে তুলনামূলকভাবে কম বেতনে নিয়োগদানের সুবিধা বিবেচনা করে। ভারত, শ্রীলংকা, থাইল্যান্ড, ফিলিপাইন, ভিয়েতনাম প্রভৃতি দেশের তরুণরা এ সুযোগ ব্যাপক হারে গ্রহণ করছে বা প্রয়োজনীয় যোগ্যতা থাকার কারণে তারা তা গ্রহণ করতে পারছে।

কিন্তু দুর্ভাগ্য, প্রয়োজনীয় শিক্ষাগত জ্ঞান ও ইংরেজি ভাষা না জানার কারণে বাংলাদেশের তরুণরা এ সুযোগের অতি সামান্য অংশও ভোগ করতে পরছে না। আর তা করতে না পেরে দোষ দিচ্ছে রাষ্ট্র ও সরকারকে। অবশ্য ত্রুটিপূর্ণ নীতিমালার দায় রাষ্ট্রেরও রয়েছে বৈকি! শখানেক মানহীন বিশ্ববিদ্যালয় প্রতিষ্ঠার অনুমোদন, শত শত মানহীন বেসরকারি কলেজের রাতারাতি সরকারীকরণ, ১৯৭০ সালের ২ হাজার ৭২১টি মাদ্রাসাকে ১৪ হাজার ১৫২টিতে উন্নীতকরণ— এসব তো রাষ্ট্রীয় নীতিমালা ও সিদ্ধান্তেরই প্রতিফলন বৈকি! শোনা যাচ্ছে, শিগগিরই প্রতি জেলায় ন্যূনতম একটি করে মডেল মাদ্রাসা স্থাপন করা হবে, যা স্পষ্টতই সরকার কর্তৃক গৃহীত সর্বশেষ শিক্ষানীতির পরিপন্থী ও অন্যদিকে বর্ধিত কর্মসংস্থান নীতিমালার সঙ্গেও অসঙ্গতিপূর্ণ। অতএব, দেশে একটি প্রকৃত কর্মোপযোগী শিক্ষিত তরুণ শ্রেণী গড়ে তুলতে হলে অবিলম্বে চলতি ধারার শিক্ষা ব্যবস্থা থেকে বেরিয়ে এসে চোখ-কান খুলে বিশ্ববাজারের চাহিদা ও প্রয়োজনের দিকে তাকিয়ে নতুন ধারার জনবল তৈরির প্রতি মনোযোগী হতে হবে। নইলে বাংলাদেশে কর্মরত পাঁচ লাখ বিদেশীর সংখ্যা যদি আগামী ১০ বছরে বেড়ে ১৫ লাখে উন্নীত হয়, তাতে মোটেও অবাক হওয়ার কিছু থাকবে না। কথাগুলো শুনে মন খারাপ হলেও এটাই বাস্তবতা।

লেখক : পরিচালক
আবু তাহের খান
ক্যারিয়ার ডেভেলপমেন্ট সেন্টার
ড্যাফোডিল ইন্টারন্যাশনাল ইউনিভার্সিটি
atkhan56@gmail.com

Source: http://gg.gg/bq5sh

http://bonikbarta.net/bangla/news/2018-09-17

18
বাংলাদেশের প্রায় ৬৪ দশমিক ৯৪ শতাংশ মানুষ এখনো গ্রামে বাস করে, যাদের মধ্যে ৯১ দশমিক ৫ শতাংশই বাস করে কাঁচা ঘরে। আধা কাঁচা বা আধা পাকা ঘরে বাস করে গ্রামীণ জনগোষ্ঠীর ৬ দশমিক ৩ শতাংশ। আর পাকা ঘরে থাকে গ্রামীণ মানুষের মাত্র ২ দশমিক ২ শতাংশ। অন্যদিকে শহরে বসবাসকারী মানুষের মধ্যে পাকা ঘরে থাকে ২১ দশমিক ৭ শতাংশ, আধা পাকা ঘরে থাকে ২৩ দশমিক ১ শতাংশ এবং বাদবাকি ৫৫ দশমিক ৩ শতাংশ মানুষ থাকে ঝুপড়ি অথবা কাঁচা ঘরে। (তথ্যসূত্র: বাংলাপিডিয়া)

উল্লিখিত তথ্যাবলির সারাংশ করলে যে বিষয়টি দাঁড়ায় তা হলো, দেশের মোট ১৬ দশমিক ৩০ কোটি মানুষের মধ্যে ১ কোটি ৪৭ লাখ মানুষ পাকা ঘরে বাস করে। বাংলাপিডিয়ার দেয়া এ হিসাব খানিকটা পুরনো। যদি ধরেও নিই, এরই মধ্যে এ সংখ্যা বেড়েছে এবং প্রায় দুই কোটি মানুষ দালানে বসবাসের সুযোগ করে নিতে পেরেছে, তাহলেও আরো প্রায় ১৪ দশমিক ৩০ কোটি মানুষ আধা পাকা বা কাঁচা ঘর কিংবা ঝুপড়িতে বাস করছে, যারা সুযোগ পেলে পাকা দালানে থাকতে চায়। বস্তুত এখানেই নিহিত রয়েছে বাংলাদশের আবাসন শিল্পের ভবিষ্যৎ।

উল্লিখিত তথ্য অনুযায়ী ধারণাগতভাবে ১৪ দশমিক ৩০ কোটি মানুষের বসবাস ও অন্যবিধ ব্যবহারের জন্য নতুন দালানকোঠা প্রয়োজন। এখন প্রশ্ন হচ্ছে, এ চাহিদার সবটাই বাস্তব কিনা। জবাবে প্রথমেই যে বিষয়গুলোর প্রতি দৃষ্টিপাত করা যেতে পারে তা হচ্ছে: ১. বাংলাদেশের মানুষের মাথাপিছু আয় ক্রমেই দ্রুত হারে বাড়ছে। ফলে গ্রাম বা শহর সর্বত্রই দালানকোঠায় বসবাস বা তা নির্মাণের ক্ষেত্রে মানুষের সামর্থ্য ও আগ্রহ দুই-ই বৃদ্ধি পাচ্ছে। অর্থাৎ আবাসন খাতে বাস্তব চাহিদা বাড়ছে; ২. বাংলাদেশের জনগণের মধ্যে শহরমুখী প্রবণতা অতীতের যেকোনো সময়ের বা বিশ্বের যেকোনো দেশের তুলনায় অধিকতর দ্রুত হারে বাড়ছে। আর শহরভিত্তিক আবাসনের মূল বৈশিষ্ট্যই যেহেতু বাড়তি দালানকোঠা, সেহেতু ক্রমবর্ধমান বাড়তি শহুরে জনগোষ্ঠীর জন্য বর্ধিতসংখ্যক দালানকোঠা নির্মাণের কোনো বিকল্প নেই; ৩. এক কোটিরও বেশি বাংলাদেশী এখন বিদেশে বসবাস করে, যারা বিভিন্ন উন্নত দেশের আবাসন ব্যবস্থার সঙ্গে পরিচিত হয়ে ওঠার ফলে এবং তাদের হাতে উল্লেখযোগ্য পরিমাণ নগদ অর্থ থাকার কারণে ও তা সহসা অন্যত্র বিনিয়োগের সুযোগ না থাকায় এদের একটি বড় অংশ নিজস্ব আবাসনের প্রয়োজনে কিংবা নিরাপদ বিনিয়োগ হিসেবে গৃহনির্মাণ খাতকেই বেছে নিচ্ছে; ৪. বাংলাদেশে যৌথ পরিবার প্রথা ভেঙে গিয়ে ক্রমেই তা ছোট পরিবারে রূপ নিচ্ছে এবং এ ধারায় পরিবারের সংখ্যাও খুবই দ্রুত বাড়ছে, যা নতুনতর আবাসনের প্রয়োজনীয়তাকে অনিবার্য করে তুলেছে; ৫. দেশে ব্যবসা-বাণিজ্য দ্রুত সম্প্রসারণের ফলে আবাসিক প্রয়োজনের বাইরেও নানা ধরনের ঘরবাড়ির দরকার হচ্ছে এবং এটিও বাংলাদেশে আবাসন খাতে চাহিদা বৃদ্ধির অন্যতম অনুষঙ্গ হিসেবে কাজ করছে।

উল্লিখিত কারণগুলোর বাইরেও আরো বহু কারণ রয়েছে, যেগুলো গৃহনির্মাণ খাতের সার্বিক সম্ভাবনাকেই তুলে ধরে। তদুপরি দেশের সব মানুষের জন্য উন্নত আবাসন ব্যবস্থা নিশ্চিতের সাংবিধানিক বাধ্যবাধকতার আলোকে এক্ষেত্রে রাষ্ট্রীয় নীতিমালার যে সমর্থন রয়েছে, সেটিও দেশের আবাসন খাতের বিকাশ ও সম্প্রসারণের পক্ষে গুরুত্বপূর্ণ নিয়ামক হিসেবে কাজ করছে। কিন্তু বাস্তবতা হলো, এত কিছুর পরও এ খাতে প্রবৃদ্ধির হার কাঙ্ক্ষিত লক্ষ্যমাত্রা অনুযায়ী এগোতে পারছে না। বাংলাদেশ অর্থনৈতিক সমীক্ষা ২০১৭-এর তথ্য থেকে দেখা যাচ্ছে, ২০১৬-১৭ অর্থবছরে জাতীয় অর্থনীতির গড় প্রবৃদ্ধির হার যেখানে ছিল ৭ দশমিক ২৪ শতাংশ, সেখানে গৃহনির্মাণ খাতে প্রবৃদ্ধির হার ছিল মাত্র ৪ দশমিক ৭৮ শতাংশ। এবং লক্ষণীয়, সাম্প্রতিক বছরগুলোয় এ হার জাতীয় প্রবৃদ্ধির গড় হারের তুলনায় বরাবরই পিছিয়ে থেকেছে।

অন্যদিকে জিডিপিতেও এ খাতের অবদানের হার বাড়ছে না। ২০১১-১২ অর্থবছরে জিডিপিতে এ খাতের অবদান ছিল ৭ দশমিক ২২ শতাংশ। পাঁচ বছর পর ২০১৬-১৭ অর্থবছরে এ হার কমে দাঁড়িয়েছে ৬ দশমিক ৪৮ শতাংশ। অথচ গৃহনির্মাণ প্রতিষ্ঠানগুলোর শীর্ষ সংগঠন রিয়েল এস্টেট অ্যান্ড হাউজিং অ্যাসোসিয়েশন অব বাংলাদেশের (রিহ্যাব) প্রত্যাশা ছিল, ২০১৪ সাল নাগাদ তা ১২ শতাংশে উন্নীত হবে। তাহলে স্বভাবতই প্রশ্ন জাগে, গৃহনির্মাণ খাতের নানা সম্ভাবনা থাকা সত্ত্বেও এমনটি ঘটছে কেন?

এর বিভিন্ন কারণ রয়েছে। তবে একেবারে প্রথম কারণ হচ্ছে: দেশে যতটা না চাহিদা বৃদ্ধির পরিপ্রেক্ষিতে, তার চেয়ে বেশি দুর্নীতির কারণে জমির দাম মাত্রাতিরিক্ত হারে বেড়ে যাওয়া; যার শুরুটা সরকার কর্তৃক জমি অধিগ্রহণের ক্ষেত্রে ভূমি বিভাগের দুর্নীতিবাজ কর্মকর্তা-কর্মচারী কর্তৃক স্বার্থান্বেষী মহলের সঙ্গে যোগসাজশে জমির দাম মাত্রাতিরিক্ত হারে বাড়িয়ে দেখানো। এটি করার ফলে সরকারি প্রকল্পের ব্যয়ই শুধু বাড়ে না, পার্শ্ববর্তী অন্যান্য জমির দামও হু-হু করে বেড়ে যায়। আর দুর্নীতিগ্রস্ত এ কৃত্রিম দামবৃদ্ধির প্রক্রিয়ায় অন্যদের পাশাপাশি দেশের গৃহনির্মাণ খাতও ব্যাপকভাবে ক্ষতিগ্রস্ত হয়। তবে সবচেয়ে বেশি ক্ষতিগ্রস্ত হয় সংখ্যাগরিষ্ঠ সাধারণ জনগণ, যারা জমির এ দামবৃদ্ধির কারণে নিজেদের জন্য কাঙ্ক্ষিত আবাসন সুবিধার সংস্থান করতে পারছে না। পরিস্থিতি বোঝার জন্য জমির মূল্যের একটি তুলনামূলক তথ্য দিই। ঢাকা শহরে বর্তমানে এক বর্গমিটার জমির গড় দাম হচ্ছে ২৯ হাজার ৯০০ টাকা (সূত্র: ইসরাত ইসলাম ও অন্যান্য) এবং ঢাকার চেয়েও পুরনো শহর কলকাতায় সমপরিমাণ জমির দাম হচ্ছে ২০ হাজার ৩৮৭ টাকা (সূত্র: উইকিপিডিয়া)। ফলে জমির দাম নির্ধারণের ক্ষেত্রে ভূমি বিভাগের দুর্নীতি বন্ধ করতে না পারলে বাংলাদেশের গৃহনির্মাণ খাতের পক্ষে সহসা ভালো অবস্থায় পৌঁছানো খুবই কষ্টকর হয়ে পড়বে।

গৃহনির্মাণ খাত কাঙ্ক্ষিত হারে বিকশিত হতে না পারার পেছনে এ খাতের সঙ্গে যুক্ত একশ্রেণীর অসাধু ব্যবসায়ীর (সবাই অসাধু নন) ভূমিকাও নেহাত কম নয়। নানা অনৈতিক ও অবৈধ পন্থায় ব্যক্তি ও খাসজমি করায়ত্তকরণ, প্লট বা  ফ্ল্যাট বিক্রির ক্ষেত্রে ক্রেতার সঙ্গে প্রতারণামূলক আচরণ (টাকা হাতিয়ে নেয়া, প্লট বা ফ্ল্যাট সময়মতো বুঝিয়ে বা সঠিক মাপে ও অবস্থানে না দেয়া, নিম্নমানের নির্মাণসামগ্রী ব্যবহার করা ইত্যাদি), দূরদৃষ্টিসম্পন্ন দীর্ঘমেয়াদি পরিকল্পনার অনুপস্থিতি, অপেশাদার লোকজনের আধিক্য প্রভৃতি কারণে বাংলাদেশের গৃহনির্মাণ খাত বর্তমানে নানা সমস্যায় ভুগছে। আর এসব কারণেই অত্যন্ত যৌক্তিক সম্ভাবনা থাকা সত্ত্বেও দেশে এ খাতের একটি পরিচ্ছন্ন ও মর্যাদাপূর্ণ ভাবমূর্তি গড়ে উঠতে পারছে না। দুর্ভাগ্যের বিষয় হচ্ছে, যেসব উচ্চশিক্ষিত পেশাধারী উদ্যোক্তা বর্তমানে গৃহনির্মাণ খাতে নিয়োজিত রয়েছেন, উল্লিখিত অসাধু ব্যবসায়ীদের কারণে তাদেরও ঢালাওভাবে সমালোচনার ভাগীদার হতে হচ্ছে। অথচ এক্ষেত্রে তাদের কোনোই দায় বা ত্রুটি নেই।

গৃহনির্মাণ খাতের ক্রেতা ও বিক্রেতা উভয়ের জন্যই ব্যাংকঋণ একটি গুরুত্বপূর্ণ অনুষঙ্গ এবং এ ব্যাপারে সরকারের দৃষ্টিভঙ্গিও যথেষ্ট ইতিবাচক। সরকার যথেষ্ট নমনীয় সুদে ব্যাংক ও আর্থিক প্রতিষ্ঠানগুলোকে গৃহনির্মাণ ঋণের জন্য তহবিল সরবরাহ করে যাচ্ছে এবং প্রতিষ্ঠানগুলোও এ খাতে ঋণ দিয়ে ভালোই ব্যবসা করছে। কিন্তু এক্ষেত্রে সরকারের কিছু নীতিগত ত্রুটি তথা গ্রাম-শহর নির্বিশেষে সবার জন্য একই সুদহার নির্ধারণের কারণে এ ঋণের আওতায় গ্রামাঞ্চলে বাণিজ্যিক ভিত্তিতে গৃহনির্মাণ শিল্পের কাঙ্ক্ষিত বিকাশ ঘটছে না। অথচ এক্ষেত্রে গ্রামাঞ্চলের জন্য নিম্নহারে সুদ নির্ধারণ করা হলে বহু উদ্যোক্তাই হয়তো প্রত্যন্ত গ্রামে না হোক, অন্তত উপশহরগুলোয় আবাসন প্রকল্প গ্রহণে উৎসাহী হতেন এবং বহু মানুষ সেখানে ঋণ নিয়ে প্লট বা ফ্ল্যাট ক্রয়ের ব্যাপারে আগ্রহ দেখাত। এটি প্রকারান্তরে মানুষের বর্তমান নৈরাজ্যকর শহরমুখী প্রবণতাকে কিছুটা হলেও রোধ করতে সহায়ক হতো।

এ অবস্থায় সব মিলিয়ে গৃহনির্মাণ খাতের সুস্থ, গতিশীল, পরিবেশবান্ধব ও গ্রামমুখী বিকাশের স্বার্থে যে কয়টি আশু করণীয় পদক্ষেপের কথা বিবেচনা করা যায়, তা হলো: ১. জমি অধিগ্রহণ ও ক্রয়-বিক্রয়ের ক্ষেত্রে সংশ্লিষ্ট সরকারি দপ্তরের দুর্নীতি রোধ; ২. মানুষের শহরমুখী প্রবণতা রোধকল্পে গ্রামাঞ্চলে গৃহনির্মাণ ঋণের সুদের হার নিম্নতর হারে নির্ধারণ; ৩. গৃহনির্মাণ খাতে বিনিয়োগের ব্যাপারে প্রবাসী বাংলাদেশীদের বিশেষভাবে উৎসাহিতকরণ; ৪. গৃহনির্মাণের ক্ষেত্রে পরিবেশকে বিশেষ বিবেচনায় রাখা এবং সেক্ষেত্রে প্রাকৃতিক জলাধার ও অন্যান্য নিসর্গকে বিনষ্ট না করা; ৫. গৃহনির্মাণ খাতের উদ্যোক্তাদের ভাবমূর্তি উন্নয়নের জন্য ক্রেতাদের সঙ্গে অধিকতর স্বচ্ছ, বিশ্বাসযোগ্য, দায়িত্বশীল ও পেশাদারিত্বমূলক আচরণ ও সম্পর্ক গড়ে তোলা; ৬. গৃহনির্মাণ ব্যয় কমিয়ে আনতে অন্যান্য সংযোগ শিল্পের সঙ্গে প্রাতিষ্ঠানিক সুসম্পর্ক ও সমন্বয় গড়ে তোলা এবং এক্ষেত্রে প্রয়োজনে সরকারের সহায়তা গ্রহণ। ৭. উদ্যোক্তা কর্তৃক যেকোনো নতুন আবাসন প্রকল্প গ্রহণের ক্ষেত্রে আধুনিক নগর পরিকল্পনা ও বৈশ্বিক ধারার সঙ্গে মিল রেখে তা করা ইত্যাদি।

অর্থনৈতিক উন্নয়নের ক্ষেত্রে বাংলাদেশ বর্তমানে যেভাবে দ্রুতগতিতে এগোচ্ছে এবং সে ধারায় মানুষের সামর্থ্য ও আকাঙ্ক্ষা যেভাবে সম্প্রসারণ হচ্ছে, তাতে এ দেশে গৃহনির্মাণ শিল্পের বিকাশ ও ভবিষ্যৎ উজ্জ্বল হতে বাধ্য। আর দেশের প্রতিটি মানুষের আশ্রয় সংস্থানের ব্যাপারে সাংবিধানে স্পষ্টতই উল্লেখ রয়েছে, ‘রাষ্ট্রের অন্যতম মৌলিক দায়িত্ব হইবে...অন্ন, বস্ত্র, আশ্রয়, শিক্ষা ও চিকিৎসাসহ জীবনধারণের মৌলিক উপকরণের ব্যবস্থা নিশ্চিত করা’ (সংবিধানের অনুচ্ছেদ ১৫)। ফলে বাস্তব অর্থনৈতিক সম্ভাবনা, জনগণের জীবনমানের অগ্রসরমাণ ধারা এবং রাষ্ট্রের সাংবিধানিক অঙ্গীকার— এসব একসঙ্গে মিলিয়ে অগ্রসর হলে বাংলাদেশের নিকট ভবিষ্যতের গৃহনির্মাণ খাত শুধু গতিশীল নয়, অনন্য হয়ে উঠবে বলেও আশা করা যায়। তবে সেক্ষেত্রে সংশ্লিষ্ট সব পক্ষের চিন্তা ও পরিকল্পনায় অবশ্যই স্বচ্ছতা ও দায়িত্বশীল পেশাদারিত্বের ছাপ থাকতে হবে এবং সেটা থাকবে বলেই আশা করি।

লেখক : পরিচালক
আবু তাহের খান
ক্যারিয়ার ডেভেলপমেন্ট সেন্টার
ড্যাফোডিল ইন্টারন্যাশনাল ইউনিভার্সিটি
atkhan56@gmail.com


Link: http://bonikbarta.net/bangla/news/2018-07-19/164748/%E0%A6%AC%E0%A6%BE%E0%A6%82%E0%A6%B2%E0%A6%BE%E0%A6%A6%E0%A7%87%E0%A6%B6%E0%A7%87-%E0%A6%97%E0%A7%83%E0%A6%B9%E0%A6%A8%E0%A6%BF%E0%A6%B0%E0%A7%8D%E0%A6%AE%E0%A6%BE%E0%A6%A3-%E0%A6%B6%E0%A6%BF%E0%A6%B2%E0%A7%8D%E0%A6%AA%E0%A7%87%E0%A6%B0-%E0%A6%AD%E0%A6%AC%E0%A6%BF%E0%A6%B7%E0%A7%8D%E0%A6%AF%E0%A7%8E/

19
সাম্প্রতিক বছরগুলোতে ধারাবাহিকভাবে উচ্চতর অর্থনৈতিক প্রবৃদ্ধি অর্জনের সুবাদে বাংলাদেশের উন্নয়নশীল দেশে (জনপ্রিয় আলোচনায় যা নিম্নমধ্যম আয়ের দেশ) রূপান্তরিত হওয়ার বিষয়টি বহুল আলোচিত একটি প্রসঙ্গ। এ দেশের মানুষের মাথাপিছু আয় এখন এক হাজার ৬১০ মার্কিন ডলার, টাকার অঙ্কে যার পরিমাণ দাঁড়ায় এক লাখ ৩৬ হাজার ৮৫০, মাসপ্রতি ১১ হাজার ৪০৪ টাকা। অবশ্য এসবই গড় হিসাব, যার মধ্যে অন্তর্ভুক্ত দেশের শীর্ষ উপার্জনকারীদের মাথাপিছু আয়। আর আয়কর বিভাগের কাছে পেশকৃত রিটার্নে উল্লিখিত আয়ের পরিমাণই তাদের প্রকৃত আয় কি না সেটাও আমরা নিশ্চিত নই। তবে নিম্নবিত্ত শ্রেণির বহু মানুষের আয় সম্পর্কেই আমাদের সুস্পষ্ট ধারণা রয়েছে। ঘোষণা অনুযায়ী কৃষির পরে দেশের বৃহত্তম শ্রম খাত তৈরি পোশাকশিল্পে কর্মরত শ্রমিকদের ন্যূনতম মাসিক মজুরি হচ্ছে পাঁচ হাজার ৩০০ টাকা, যদিও বহু শ্রমিক বাস্তবে এর চেয়েও অনেক কম পান। চা শ্রমিকদের ন্যূনতম মজুরি এক হাজার ৬৫৬ টাকা; আর এই শ্রমিকদের মধ্যকার ‘বি’ ও ‘সি’ শ্রেণির অস্থায়ী শ্রমিকদের মজুরি আরো কম এবং তাদের সংখ্যাই বেশি। প্রায় একই অবস্থা মোটামুটি অন্যান্য খাতেও। পোশাক কর্মী বা চা শ্রমিকের কথা পরিস্থিতি বোঝানোর জন্য এখানে উদাহরণ হিসেবে আনা হলো মাত্র।

উপরোক্ত তথ্য থেকে দেখা যাচ্ছে যে বাংলাদেশে নিম্নবিত্ত শ্রেণির মাথাপিছু আয়ের পরিমাণ মাথাপিছু গড় জাতীয় আয়ের চেয়ে অনেক কম। আর এ ক্ষেত্রে পরিবর্তনের যে ধারা, সেটিও জাতীয় আয়ের পরিবর্তনের ধারার সঙ্গে সংগতিপূর্ণ নয়। ২০০৭ সালে বাংলাদেশের জনগণের মাথাপিছু গড় আয় ছিল ৫৮৫ মার্কিন ডলার এবং একই সময়ে পোশাক খাতের শ্রমিকদের মাসিক ন্যূনতম মজুরি ছিল ৩৮ মার্কিন ডলার। এক দশকের ব্যবধানে জনগণের মাথাপিছু গড় আয় প্রায় তিন গুণ বৃদ্ধি পেলেও পোশাক শ্রমিকদের মজুরি বেড়েছে দ্বিগুণেরও কম। অন্যান্য খাতে শ্রমিক মজুরি বৃদ্ধির হার আরো কম। শ্রমিক ছাড়া অন্যান্য নিম্ন আয়ের মানুষের ক্ষেত্রেও বিষয়টি মোটামুটি একই রূপ।

মাথাপিছু আয় বৃদ্ধির এ শ্রুতিতৃপ্ত অঙ্ক তাহলে কী অর্থ বহন করছে? স্পষ্টতই তা এ বাস্তবতাকেই নির্দেশ করছে যে আয় বৃদ্ধির এ ঘটনাটি ঘটেছে মূলত উচ্চ আয়ের মানুষের ক্ষেত্রে, যারা সংখ্যায় খুবই সীমিত। কিন্তু সংখ্যায় সীমিত হওয়া সত্ত্বেও তাদের আয়ের স্ফীতি এতটাই বিশাল যে এই সীমিতসংখ্যকের আয়ের সঙ্গে সংখ্যাগরিষ্ঠ নিম্ন আয়ের মানুষের আয় গড় করার পরও তা মধ্যম আয়ের দেশের স্তরে পৌঁছে গেছে। অন্যদিকে এ তথ্য সম্পদের দুই বিপরীতমুখী মেরুকরণকেও নির্দেশ করছে বৈকি, যার আওতায় নিম্ন ও মধ্য আয়ের মানুষের আয় বৃদ্ধির মন্থরগতির বিপরীতে বিত্তবান শ্রেণির সম্পদের দ্রুত প্রসার ঘটছে। আর এ প্রবণতা অব্যাহত থাকলে সমাজে সম্পদবৈষম্য দিনে দিনে আরো বাড়তেই থাকবে। প্রসঙ্গত উল্লেখ্য যে সম্পদের উপরোক্ত মেরুকরণের পেছনে মূলত কাজ করছে একধরনের শ্রম শোষণ।

শ্রম শোষণের প্রসঙ্গ উঠতেই সহজ উদাহরণ হিসেবে আমরা পোশাক খাত নিয়ে আলোচনা করি। অর্থনীতির বৃহত্তম শ্রমঘন খাত হিসেবে পোশাক খাতের মজুরি নিয়ে সর্বাগ্রে আলোচনা হওয়াটাই স্বাভাবিক। কিন্তু ঘটনা হচ্ছে, শ্রম শোষণ শুধু পোশাক খাতের নয়, অন্যান্য খাতেও রয়েছে এবং এসবের বেশির ভাগ ক্ষেত্রে পরিস্থিতি এর চেয়েও খারাপ। আর এসবের মধ্যে সর্বাধিক মানবেতর পরিস্থিতি বিরাজ করছে চা বাগান ও চা প্রক্রিয়াজাতকরণ শিল্প, চালকল, রাবারশিল্প, প্লাস্টিক শিল্প ও জাহাজভাঙা শিল্পে। অবাক হওয়ার মতো তথ্য এই যে এসব ক্ষেত্রে শ্রমিকদের গড় মাসিক মজুরি দুই হাজার টাকারও কম—মাথাপিছু মাসিক জাতীয় গড় আয়ের এক-পঞ্চমাংশেরও নিচে। তাহলে স্বভাবতই প্রশ্ন জাগে আয় বৃদ্ধির এ বৈষম্যমূলক ধারা দেশকে কোথায় নিয়ে যাচ্ছে?

শেষোক্ত প্রশ্নের জবাব খুঁজতে প্রথমেই সমাজ, রাষ্ট্র ও অর্থনীতির ওপর উল্লিখিত বৈষম্যমূলক আয় বৃদ্ধির প্রতিক্রিয়াগুলোর প্রতি দৃষ্টিপাত করা যেতে পারে। লক্ষ করলে দেখা যাবে, এর ফলে : ১) অস্বচ্ছ পন্থায় রাতারাতি অর্থ উপার্জনকারীদের মধ্যে যুক্তিহীন, অর্থনৈতিক ও লোকদেখানো ভোগের পরিমাণ বেড়ে যাচ্ছে এবং এর পারিপার্শ্বিক প্রভাবে মধ্য বা নিম্নবিত্তের মানুষের মধ্যেও এরূপ ভোগের প্রবণতা দৃষ্টিকটুভাবে জেঁকে বসেছে, সে ভোগের জন্য তাদের পর্যাপ্ত আর্থিক সামর্থ্য না থাকা সত্ত্বেও। আর এর ফলে সংখ্যাগরিষ্ঠ মধ্য ও নিম্নবিত্তের মধ্যে ক্ষোভ ও হতাশা বৃদ্ধি পাচ্ছে এবং তাদের বিশেষত তরুণদের মধ্যেও পরিশ্রম না করে সংক্ষিপ্ত পন্থায় রাতারাতি বিত্তবান হওয়ার মানসিকতা প্রবল হয়ে উঠছে। ব্যাপকসংখ্যক মানুষের মাদক কারবারে জড়িয়ে পড়ার বিষয়টিও অনেকাংশে রাতারাতি বিত্তবান হয়ে ওঠার আকাঙ্ক্ষা থেকে উৎসারিত বৈকি!

এটা এখন সর্বজনবিদিত তথ্য যে পুঁজির একচ্ছত্র শাসনে বেশির ভাগ বিশ্বসম্পদের মালিকানা যেমন মুষ্টিমেয় মানুষের হাতে, তেমনি এই বাংলাদেশেও অতি স্বল্পসংখ্যক মানুষ রাষ্ট্রের বেশির ভাগ সম্পদকে কুক্ষিগত করে নিয়েছেন। অভিযোগ রয়েছে, কুক্ষিগত এই বিশাল সম্পদের একটি বড় অংশই অনৈতিক পন্থায় উপার্জিত। আর অনৈতিক পন্থায় যাঁরা উপার্জন করেন অর্থাৎ ব্যয় ও বিনিয়োগের ক্ষেত্রে তাঁরা নৈতিক পথ ধরে এগোবেন—এমনটি আশা করা অবান্তর। বাস্তবে তা ঘটছেও না। ফলে নীতি-নৈতিকতাবিবর্জিত পন্থায় সম্পদ আহরণকারীরা সমাজে নতুন করে নানা রকম অনৈতিক অনুষঙ্গের জন্ম দিচ্ছেন এবং এর ফলে সমাজের সামগ্রিক গুণগত মানও দ্রুত নিচে নেমে যাচ্ছে। সমাজ থেকে সাধারণ মানবিক মূল্যবোধ, প্রতিবাদী সত্তা, নিরাপসকামিতা, ধৈর্য, সহিষ্ণুতা, পরোপকারিতা ইত্যাদি হারিয়ে যাওয়ার পেছনে এই নৈতিকতাবর্জিত সম্পদশালীদের যথেচ্ছ জীবনাচরণ বহুলাংশে দায়ী বৈকি!

একসময় সমাজ ও রাষ্ট্রের নেতৃত্ব দিতেন শিক্ষিত, মেধাবী ও সজ্জনরা। আয় বৃদ্ধির সুবাদে (আয় বৃদ্ধিকে দোষ দেওয়া হচ্ছে না) সে নেতৃত্ব এখন যথেচ্ছ পন্থায় সম্পদ আহরণকারীদের হাতে। জাতীয় সংসদ, স্থানীয় সরকার পরিষদ, বিভিন্ন সামাজিক গোষ্ঠী ও গোত্র সর্বত্রই নেতৃত্ব এখন বিত্তবানদের হাতে, তা সে বিত্ত বৈধ বা অবৈধ যেকোনো পন্থায়ই আসুক না কেন। রাজনৈতিক দলগুলোও এখন বৈধ-অবৈধ নির্বিশেষে সম্পদশালীদের কাছে জিম্মি। জাতীয় বা অন্য যেকোনো নির্বাচনে দলের মনোনয়ন পাওয়ার অন্যতম পূর্বশর্ত হচ্ছে সম্পদশালী হওয়া। ১৯৫৪ সালে তৎকালীন আইন পরিষদে ব্যবসায়ী সদস্যের সংখ্যা ছিল ৪ শতাংশ। এখন তা ৬৩ শতাংশ ছাড়িয়ে গেছে। ফলে এই ৬৩ শতাংশের অধিকসংখ্যক সদস্য মিলে যখন সংসদে কোনো আইন করেন বা কোনো সিদ্ধান্ত নেন, তখন তা বিত্তহীনদের বা নিম্নবিত্তের পক্ষে যাবে—এমনটি ভাবা সত্যি কঠিন।

সমাজ থেকে আয়বৈষম্য রোধের সবচেয়ে কার্যকর উপায় হচ্ছে রাষ্ট্রের আর্থিক ও অর্থনৈতিক নীতিমালাকে এমনভাবে সাজানো, যাতে তার ফলে নিম্ন আয়ের মানুষ বাড়তি সুবিধা পায় এবং বিত্তবান তার আয়ের একাংশ রাষ্ট্রকে রাজস্ব বা অন্যবিধ পন্থায় পরিশোধে বাধ্য হয়। কিন্তু বাস্তবে তার উল্টোটাই কি ঘটছে না? সমাজের বিভিন্ন বিত্তশালীগোষ্ঠী বাজেটের আগে রাষ্ট্রীয় প্রতিনিধিদের সঙ্গে বৈঠক করে নিজেদের সব আর্থিক সুবিধা অগ্রিম আদায় করে নেয়, জাতীয় সংসদের বাজেট বক্তৃতা যার আলংকারিক ঘোষণা মাত্র। কিন্তু অসংগঠিত কৃষক, দুর্বল শ্রমিক শ্রেণি, নিম্ন আয়ের সাধারণ মানুষ—বাজেটে এদের স্বার্থ তুলে ধরার কেউ নেই। ফলে যা হওয়ার তাই হচ্ছে। বাজার অর্থনীতির কথা বলে কৃষি খাতের ভর্তুকি ক্রমাগত উঠে গেলেও বিত্তবান শ্রেণির স্বার্থের পাহারাদার রাষ্ট্র নানা খাতে নগদ ভর্তুকি দিয়েই চলেছে এবং কোনো কোনো খাতে ফিবছর আবার তা বাড়ছেও।

আয়বৈষম্য বৃদ্ধির দুর্ভাগ্যজনক যে অর্থনৈতিক প্রবণতা বর্তমান রাষ্ট্র ও সমাজকে চারদিক থেকে ঘিরে রেখেছে, তা থেকে বেরোনো সত্যিই কঠিন। কিন্তু পাশাপাশি এটাও সত্য, তা থেকে বেরোতে না পারলে সামাজিক ক্লেদ ও অনাচার দিন দিন আরো বাড়বে বৈ কমবে না। আয় বৃদ্ধির সঙ্গে সঙ্গে সমাজে কষ্ট, ক্লেদ, দুর্ভোগ, অনাচারই যদি বাড়ে, তাহলে বর্তমানের নিম্নমধ্যম বা ২০২১ সালের মধ্যম আয়ের দেশে রূপান্তরিত হওয়ার মধ্য দিয়ে সাধারণ মানুষের জীবন কী অর্থ খুঁজে পাবে?

লেখক : পরিচালক
আবু তাহের খান
ক্যারিয়ার ডেভেলপমেন্ট সেন্টার
ড্যাফোডিল ইন্টারন্যাশনাল ইউনিভার্সিটি
atkhan56@gmail.com

Source: http://www.kalerkantho.com/print-edition/sub-editorial/2018/07/07/654983

20
মার্কিন পরিসংখ্যান প্রতিষ্ঠান স্ট্যাটিস্টার দেয়া হিসাব অনুযায়ী, ২০১৬ সালে যুক্তরাষ্ট্র থেকে চীনে পণ্য রফতানির পরিমাণ ছিল ১৬৯ দশমিক ৮ বিলিয়ন মার্কিন ডলার এবং এর বিপরীতে একই সময় চীন থেকে যুক্তরাষ্ট্রের আমদানির পরিমাণ ছিল ৪৭৮ দশমিক ৮ বিলিয়ন মার্কিন ডলার। অর্থাৎ এক্ষেত্রে চীনের সঙ্গে মার্কিন বাণিজ্য ঘাটতির পরিমাণ ছিল প্রায় ৩০৯ বিলিয়ন ডলার। বিশ্ববাণিজ্যের সর্বশেষ প্রবণতা আভাস দিচ্ছে, নিকট ভবিষ্যতে যুক্তরাষ্ট্রে চীনা পণ্যের আমদানি আরো বাড়বে এবং সেই সুবাদে চীনের সঙ্গে তাদের বাণিজ্য ঘাটতির পরিমাণ ক্রমে বাড়বে। উল্লেখ্য, ২০০১ সালে ডব্লিউটিওতে যোগদানের আগ পর্যন্ত মার্কিন পণ্যের ওপর চীনের আমদানি শুল্কহার আরো বেশি ছিল। কিন্তু ডব্লিউটিওতে যোগদানের পর এ হার অনেক নিচে নেমে এসেছে, যা এখন সর্বোচ্চ ২৫ শতাংশ এবং মাঝারি শিল্পজাত পণ্য ও উচ্চপ্রযুক্তি-সংশ্লিষ্ট শিল্পপণ্যের ক্ষেত্রে যথাক্রমে ২০ ও ১৫ শতাংশ। এর বিপরীতে বহু চীনা পণ্যের ওপরই মার্কিন আমদানি শুল্কের হার ২৫ শতাংশের উপরে। কিন্তু তার পরও চীনা পণ্যের আমদানি যুক্তরাষ্ট্রে ক্রমাগত বেড়েই চলেছে।

এরূপ পরিস্থিতিতে সম্প্রতি মার্কিন প্রেসিডেন্ট চীনা পণ্যের ওপর প্রথমে ২৫ শতাংশ ও পরে আরো ১০ শতাংশ অতিরিক্ত শুল্ক আরোপের যে ঘোষণা দিয়েছেন, সাধারণ পরিস্থিতিতে তাতে মোটেও অবাক হওয়ার কিছু থাকত না। কিন্তু এমন এক সময়ে এবং এমনসব ঘটনার সঙ্গে মিলিয়ে তিনি এ ঘোষণা দিয়েছেন যে, তাতে এর পেছনে অন্যবিধ কারণ খোঁজার যথেষ্ট অবকাশ রয়েছে। আর সে কারণ যথেষ্টই বস্তুনিষ্ঠ। তথ্য বিশ্লেষণ শেষে দেখা যাচ্ছে, একযুগ ধরেই যুক্তরাষ্ট্রে চীনা পণ্যের আমদানির পরিমাণ বছরে প্রায় ১০ শতাংশ হারে বাড়ছে। এ অবস্থায় চীনা পণ্যের আমদানি ঠেকানোই যদি ট্রাম্পের মূল উদ্দেশ্য হতো, তাহলে তাঁর মতো একজন উগ্রপন্থী মানুষের পক্ষে এটি ২০১৭-এর জানুয়ারিতে ক্ষমতায় আসার পর পরই করার কথা ছিল। কিন্তু একজন পটু ব্যবসায়ী হওয়ার কারণে তিনি জানতেন যে, যুক্তরাষ্ট্রের নিজের স্বার্থেই চীনের সঙ্গে এরূপ কোনো বাণিজ্যবিরোধে যাওয়াটা সমীচীন হবে না। কিন্তু দায়িত্ব গ্রহণের প্রায় দেড় বছর পর হঠাৎ করে কেন তিনি চীনা পণ্যের ওপর বাড়তি শুল্ক আরোপের ঘোষণা দিলেন। সংক্ষেপে এখন সে জবাবটিই খোঁজার চেষ্টা করা যাক।

উত্তর কোরিয়ার প্রেসিডেন্ট কিম জং-উনের সঙ্গে ডোনাল্ড ট্রাম্প সিঙ্গাপুরে বৈঠকে বসেন ২১ জুন। তার অব্যবহিত পূর্বে ৩ জুন হঠাৎ করেই তিনি চীনা পণ্যের ওপর ২৫ শতাংশ হারে বাড়তি শুল্ক আরোপের ঘোষণা দেন এবং মার্কিন সরকারের পক্ষ থেকে অতিরিক্ত শুল্কযোগ্য ১ হাজার ৩০০ চীনা পণ্যের একটি তালিকা প্রকাশ করা হয়। আন্তর্জাতিক রাজনীতি সম্পর্কে মোটামুটি খোঁজখবর রাখেন, এরূপ ব্যক্তিমাত্রই জানেন, ট্রাম্প ক্ষমতায় আসার পর থেকেই কিমের সঙ্গে তাঁর বাদানুবাদ চলছিল। ট্রাম্প বলছিলেন, তিনি উত্তর কোরিয়াকে পুরোপুরি ধ্বংস করে দেবেন। আর কিম ট্রাম্পকে আখ্যায়িত করেন মানসিক বিকারগ্রস্ত বুড়ো বলে। পরস্পরের প্রতি তাদের হুমকি এমন পর্যায়ে পৌঁছেছিল যে, অনেকে ভাবতে শুরু করেছিলেন, এই বুঝি একে অন্যকে আক্রমণ করে বসে!

তবে এরূপ একটি চরম পরিস্থিতির পরও যে দুই পক্ষের মধ্যে বৈঠকে বসা সম্ভব হয়েছিল, তার অন্যতম কারণ ছিল উত্তর কোরিয়ার ওপর আন্তর্জাতিক বাণিজ্য নিষেধাজ্ঞা-সংক্রান্ত ভূরাজনীতি। ওই নিষেধাজ্ঞার কবলে পড়ে উত্তর কোরিয়ার অভ্যন্তরীণ সংকট এমনই চরমে পৌঁছেছে যে, এ থেকে বাঁচার উপায় হিসেবে তাদের পক্ষে ট্রাম্পের সঙ্গে বৈঠকে না বসে অন্য কোনো উপায় ছিল না। কিন্তু সাম্প্রতিক সময়ে চীন মানবিক, বাণিজ্যিক ও কৌশলগত কারণে তার নিকটতম প্রতিবেশী ও অন্যতম বাণিজ্যিক অংশীদার দেশটির ওপর থেকে নিষেধাজ্ঞা প্রত্যাহারের ইঙ্গিত দিচ্ছিল। আর এরূপ পরিস্থিতিতে চীন যাতে সত্যি সত্যি সে নিষেধাজ্ঞা প্রত্যাহার করে না বসে এবং সেই সুযোগে উত্তর কোরিয়া ট্রাম্পের সঙ্গে বৈঠকে বসা থেকে পিছিয়ে না যায়, সেজন্যই চীনকে চাপে রাখতে ৩ এপ্রিল হোয়াইট হাউজ থেকে চীনা পণ্যের ওপর ২৫ শতাংশ বাড়তি শুল্ক আরোপের ঘোষণা দেয়া হয়।

এদিকে প্রেসিডেন্ট কিম ১৯ জুন দুদিনের সফরে চীন যান। সেখানে তিনি শীর্ষ নেতাদের সঙ্গে বৈঠক করেন। যে বৈঠকের অন্যতম উদ্দেশ্য ছিল উত্তর কোরিয়ার ওপর থেকে বাণিজ্য নিষেধাজ্ঞা প্রত্যাহারে চীনকে রাজি করানো। কূটনৈতিক মহল থেকে আভাস পাওয়া যাচ্ছে যে, চীন এ প্রস্তাবটি গুরুত্বের সঙ্গে বিবেচনার কথা ভাবছে এবং শেষ পর্যন্ত চীন যদি সত্যি সত্যি এ নিষেধাজ্ঞা প্রত্যাহার করে বসে, তাহলে ট্রাম্প-কিম বৈঠকের ফলাফল আখেরে কোথায় গিয়ে দাঁড়াবে, তা নিশ্চিত করে বলা মুশকিল। আর এরূপ পরিস্থিতিতেই চীনা পণ্যের ওপর বাড়তি ১০ শতাংশ শুল্ক আরোপ-সংক্রান্ত হোয়াইট হাউজের ১৮ জুনের এ ঘোষণা।

এটি এখন খুবই স্পষ্ট, মার্কিন বাজারে চীনা পণ্যের প্রবেশ ঠেকানো নয়, বরং ট্রাম্প-কিমের মধ্যকার সাম্প্রতিক সিঙ্গাপুর চুক্তির শর্ত ভেঙে উত্তর কোরিয়া যাতে তার পারমাণবিক অস্ত্রের পরিপূর্ণ ধ্বংস করা থেকে পিছিয়ে যেতে না পারে এবং চীন যাতে উত্তর কোরিয়ার ওপর থেকে বাণিজ্য নিষেধাজ্ঞা প্রত্যাহার থেকে বিরত থাকতে বাধ্য হয়, সেজন্যই চীনা পণ্যের ওপর যুক্তরাষ্ট্র কর্তৃক বাড়তি শুল্ক আরোপের সর্বশেষ এ ঘোষণা। এসবের ফলাফল শেষ পর্যন্ত কী দাঁড়াবে, তা এখনো নিশ্চিত নয়। তবে বিশ্বের শান্তিকামী মানুষ উত্তর কোরিয়াসহ সব রাষ্ট্রেরই পারমাণবিক নিরস্ত্রীকরণ যেমন চায়, তেমনি মানবিক কারণে উত্তর কোরিয়ার ওপর থেকে আন্তর্জাতিক বাণিজ্যিক নিষেধাজ্ঞাও প্রত্যাহারের প্রত্যাশা করে। সেক্ষেত্রে যুক্তরাষ্ট্র যদি চীনা পণ্যের ওপর বাড়তি শুল্ক আরোপের ঘোষণা বাস্তবে কার্যকর করে বসে, তাহলে চীনও নিশ্চয় চুপ করে বসে থাকবে না। পাল্টা ব্যবস্থা হিসেবে তারাও হয়তো মার্কিন পণ্যের ওপর অনুরূপ শুল্ক আরোপের সিদ্ধান্ত নেবে, যেরূপ ঘোষণা এরই মধ্যে তারা দিয়ে রেখেছে। পরিস্থিতি সে পথ ধরে এগোলে এশিয়ার এ অঞ্চলে, বিশেষ করে কোরীয় উপদ্বীপ সন্নিহিত এলাকায় শান্তির সম্ভাবনা অনেকটাই তিরোহিত হয়ে পড়বে নাকি? আর তাতে ট্রাম্প-কিমের মধ্যকার সিঙ্গাপুর বৈঠকের ফলাফলও কি অনিশ্চিত হয়ে পড়বে না?

লেখক : পরিচালক
আবু তাহের খান
ক্যারিয়ার ডেভেলপমেন্ট সেন্টার
ড্যাফোডিল ইন্টারন্যাশনাল ইউনিভার্সিটি
atkhan56@gmail.com

Source: bonikbarta.net/bangla/news/2018-07-01/162737/চীনা-পণ্যের-ওপর-বাড়তি-মার্কিন-শুল্ক-আরোপের-নেপথ্যে--/

21
সিটি ক্ষুদ্র উদ্যোক্তা পুরস্কার পেলেন ১২ জন
[/b]

ব্যবসা-বাণিজ্যে অবদানের পাশাপাশি সামাজিক উন্নয়নে অবদান রাখায় ১২তম সিটি ক্ষুদ্র উদ্যোক্তা পুরস্কার পেলেন ১২ জন। পুরস্কৃত করা হয়েছে দুটি প্রতিষ্ঠানকে।


অনুষ্ঠানে প্রধান অতিথি হিসেবে উপস্থিত ছিলেন পরিকল্পনামন্ত্রী আ হ ম মুস্তফা কামাল, বিশেষ অতিথি হিসেবে ছিলেন অর্থ প্রতিমন্ত্রী এম এ মান্নান, সম্মানিত অতিথি হিসেবে ছিলেন বাংলাদেশ ব্যাংকের ডেপুটি গভর্নর এস কে সুর চৌধুরী। অনুষ্ঠানে আরও উপস্থিত ছিলেন অর্থনীতিবিদ ওয়াহিদউদ্দিন মাহমুদ, সিটি বাংলাদেশের সাব-ক্লাস্টার প্রধান জেমস মোরো, সিটি বাংলাদেশের কান্ট্রি অফিসার রাশেদ মাকসুদ, সাজেদা ফাউন্ডেশনের নির্বাহী পরিচালক জাহিদা ফিজ্জা কবির, ক্রেডিট অ্যান্ড ডেভেলপমেন্ট ফোরামের নির্বাহী পরিচালক মো. আব্দুল আউয়াল প্রমুখ।

সিটি ফাউন্ডেশনের পক্ষ থেকে এবার শ্রেষ্ঠ ক্ষুদ্র উদ্যোক্তা, শ্রেষ্ঠ নারী ক্ষুদ্র উদ্যোক্তা, শ্রেষ্ঠ তরুণ ক্ষুদ্র উদ্যোক্তা, শ্রেষ্ঠ কৃষি ক্ষুদ্র উদ্যোক্তা বিভাগে মোট ১২ জন উদ্যোক্তাকে পুরস্কার প্রদান করা হয়।

শ্রেষ্ঠ ক্ষুদ্র উদ্যোক্তা বিভাগে বিজয়ী হয়েছেন নওগাঁর জিল্লুর রহমান, তাঁর হাতে সাড়ে চার লাখ টাকার পুরস্কার তুলে দেওয়া হয়। এই বিভাগে প্রথম রানারআপ বগুড়ার সাইদুজ্জামান সরকার দেড় লাখ টাকা ও দ্বিতীয় রানারআপ বরগুনার মো. আজিজুল হক সিকদার পেয়েছেন এক লাখ টাকা পুরস্কার।

শ্রেষ্ঠ নারী উদ্যোক্তা বিভাগে বিজয়ী হয়েছেন মুন্সিগঞ্জের রুমা আক্তার। তাঁর হাতে সাড়ে তিন লাখ টাকা পুরস্কার তুলে দেওয়া হয়। এই বিভাগে প্রথম রানারআপ ঢাকার ফজিলাতুন নেসা পুরস্কার হিসেবে পেয়েছেন দেড় লাখ টাকা ও দ্বিতীয় রানারআপ চট্টগ্রামের রুবামা শারমিন পেয়েছেন এক লাখ টাকা।

শ্রেষ্ঠ তরুণ ক্ষুদ্র উদ্যোক্তা বিভাগে বিজয়ী হিসেবে সাড়ে তিন লাখ টাকা পুরস্কার পেয়েছেন আশুলিয়ার উদ্যোক্তা রুবেল দেওয়ান। এই বিভাগে প্রথম রানারআপ হিসেবে গাইবান্ধার নারী উদ্যোক্তা মোছা. রহিমা খাতুন দেড় লাখ টাকা পুরস্কার গ্রহণ করেন। দ্বিতীয় রানারআপ হিসেবে এক লাখ টাকা পুরস্কার গ্রহণ করেন পাবনার বেড়া উপজেলার মো. তাইফুর রহমান।

শ্রেষ্ঠ কৃষি ক্ষুদ্র উদ্যোক্তা বিভাগে বিজয়ী সাতক্ষীরার সায়মা খাতুন সাড়ে তিন লাখ টাকা পুরস্কার লাভ করেন। প্রথম রানারআপ দিনাজপুরের মো. আলতাফ হোসেন এবং দ্বিতীয় রানারআপ হিসেবে পুরস্কার গ্রহণ করেন শরীয়তপুরের মো. নুরুল আমিন সরদার।

এ ছাড়া শ্রেষ্ঠ ক্ষুদ্র ঋণ প্রদানকারী প্রতিষ্ঠান হিসেবে পুরস্কার লাভ করেছে পিপলস ওরিয়েন্টেড প্রোগ্রাম ইমপ্লিমেন্টেশন (পপি) এবং শ্রেষ্ঠ সৃজনশীল ক্ষুদ্রঋণ প্রদানকারী প্রতিষ্ঠান হিসেবে পুরস্কার পেয়েছে ভিলেজ এডুকেশন রিসোর্স সেন্টার (ভার্ক)।

Source link: Prothom Alo Daily Newspaper (April 16 2017)

22
ফেসবুকের সহপ্রতিষ্ঠাতা ও প্রধান নির্বাহী মার্ক জাকারবার্গ। সম্প্রতি যুক্তরাষ্ট্রের নর্থ ক্যারোলিনা এ অ্যান্ড টি স্টেট ইউনিভার্সিটির শিক্ষার্থীদের সঙ্গে কথা বলেছেন তিনি। বলেছেন, এ বছর তাঁর লক্ষ্যের কথা।

প্রতিবছর আমি আমার জন্য নতুন নতুন চ্যালেঞ্জ ঠিক করি। এ বছর আমার লক্ষ হলো, সান ফ্রান্সিসকোর ছোট্ট গণ্ডি থেকে বের হওয়া। যুক্তরাষ্ট্রের অনেক স্টেটে আমি গিয়েছি। কিন্তু এখনো অনেক স্টেটে পা রাখা বাকি। ঠিক করেছি, বছর শেষ হওয়ার আগেই আমি সব কটি স্টেটে যাব। মানুষের সঙ্গে কথা বলব। তাঁরা কী ভাবছেন, কী করছেন, কী স্বপ্ন দেখছেন—সব শুনব।

"আমি ঘুরে ঘুরে দেখেছি, মানুষের বিচিত্র সব দল বা সংগঠন আছে। দল গঠন করার এই ভাবনাটা দারুণ। স্কুলের শিক্ষার্থীদের দল, এলাকাভিত্তিক দল, এমনকি ভিন্ন ভিন্ন দেশের মানুষ মিলেও দল হতে পারে। ফেসবুকের মাধ্যমে আমরা মানুষের সঙ্গে মানুষের যোগাযোগ স্থাপনে সহায়তা করি। এটা যেমন বন্ধুর সঙ্গে বন্ধুর যোগাযোগ, তেমনি দেশের সঙ্গে দেশের যোগাযোগও। নানা দেশের মানুষের সঙ্গে যুক্ত হওয়ার দারুণ সুযোগ এখানে আছে। যেন সবাই মিলে একটা সুন্দর পৃথিবী গড়ার দিকে আরও মনোযোগী হতে পারে। নর্থ ক্যারোলিনা এ অ্যান্ড টিতে আসার আগে যতটুকু পড়াশোনা করেছি, তাতে জেনেছি, আপনাদের এখানে দারুণ সব দল আছে। দলগুলো প্রকৌশল ও বিজ্ঞান নিয়ে কাজ করছে। আপনারা নিশ্চয়ই এই সংগঠনগুলোর কার্যক্রম নিয়ে গর্বিত।

কয়েক সপ্তাহ আগে আমি আন্তর্জাতিক সম্প্রদায় গড়ে তোলার ব্যাপারে একটা চিঠি লিখেছিলাম। আমরা এমন একটা সময়ে বাস করছি, যখন মানুষে মানুষে অনেক বিভেদ। অনেকেই ঠিক দিশা খুঁজে পাচ্ছেন না, কোন পথে যাবেন। শুধু এ দেশেই নয়, ইউরোপ, এশিয়া, সারা বিশ্বেই এক অবস্থাটা। এ অবস্থায় একটা প্রতিষ্ঠান হিসেবে আমরা কী দায়িত্ব পালন করতে পারি? আমি অনেকের সঙ্গে কথা বললাম। কিছু বই পড়লাম। জানলাম, মানব ইতিহাসে দলগঠন খুব গুরুত্বপূর্ণ। হাজার বছর ধরে মানুষ একটা বড় দল হতে চেষ্টা করেছে। পরিবার থেকে গোত্র, গোত্র থকে গ্রাম, গ্রাম থেকে শহর, শহর থেকে দেশ, দেশ থেকে জাতি...এভাবে আস্তে আস্তে মানুষ নিজের দলটা বড় করতে শিখেছে। একা যে সমস্যার সমাধান করা যায় না, মানুষ দল বেঁধে সেই সমস্যার সমাধান করেছে। আমার মনে হয় এখন আমরা এমন একটা অবস্থায় পৌঁছেছি, যখন সমস্যাগুলো শুধু ব্যক্তিগত পর্যায়ে বা একটা জাতি হিসেবে সমাধান করা সম্ভব নয়। বরং পৃথিবীর নানা প্রান্তের মানুষের এক হওয়া প্রয়োজন। যেমন বৈশ্বিক উষ্ণতার কথাই ধরুন। কিংবা কোনো রোগ, যেটা এক দেশ থেকে নানা দেশে ছড়িয়ে পড়ে। অথবা সিরিয়ার শরণার্থী পরিস্থিতির কথা ভাবুন। এই সমস্যা কোনো দেশের নয়, কোনো গোত্রের নয়, এই সমস্যা সারা পৃথিবীর। ফেসবুকে আমাদের সেই অবকাঠামোটা তৈরি করে দিয়েছে, যেন পৃথিবীর নানা প্রান্তের মানুষ এক হতে পারে।

আজকের সময়ে আরেকটা বড় ইস্যু হলো তথ্যবিভ্রাট। ভুল তথ্যের কারণে শুধু ফেসবুকই নয়, অনেক সংবাদমাধ্যমও ক্ষতিগ্রস্ত হচ্ছে। ফেসবুকে ‘থার্ড পার্টি ফ্যাক্ট চেকার’-এর মাধ্যমে আমরা এই সমস্যার সমাধান করতে চেষ্টা করছি। অনেকেই স্রেফ কিছু টাকার জন্য ভুল তথ্য পরিবেশন করে। যেমন ধরুন কেউ লিখল, ‘হার্ট অ্যাটাকে জনি ডেপ মারা গেছেন!’ এ রকম অদ্ভুত কিছু লিখে তারা ‘ক্লিক’ পেতে চেষ্টা করে। আপনি সেখানে ক্লিক করলেই একটা ওয়েবপেজে পৌঁছে যাবেন, যেখানে নানা ধরনের বিজ্ঞাপন আছে। এই বিজ্ঞাপন থেকে তারা আয় করে। একটা ব্যাপার আমি পরিষ্কার করে বলতে চাই, আমরা মিথ্যা খবর ও ভুল তথ্যের বিপক্ষে লড়ছি। ফেসবুকের বিরুদ্ধে এমন অভিযোগ আছে, আমরা এসব খবরকে উৎসাহিত করি। কিন্তু সেটা সত্যি নয়। আমরা চাই না কেউ ভুল তথ্য পাক। কোন তথ্যটা ঠিক, আর কোনটা ভুল, সেটা যাচাই করা একটা বড় চ্যালেঞ্জ। আরেকটা ব্যাপার হলো, একটা তথ্যের সঙ্গে একমত নই বলে আমি তথ্যটা ভুল বলে দাবি করতে পারি না। গণতন্ত্রের একটা গুরুত্বপূর্ণ দিক হলো, আমার মতের সঙ্গে আরেকজনের মত না মিললেও আমি অন্তত সেটা প্রকাশ করতে পারব। কম্পিউটার প্রকৌশল নিয়ে যারা পড়ালেখা করছ, অনেকেই হয়তো আমার কথার সঙ্গে একমত হবে। আমি ক্লাসে যতটা শিখেছি, তার চেয়ে অনেক বেশি শিখেছি ক্লাসের বাইরে। নিজের আগ্রহে কোডিং করেছি। ফেসবুকে কাউকে নেওয়ার ক্ষেত্রে আমরা এই বিষয়টা মাথায় রাখি। ইন্টারভিউতে জিজ্ঞাসা করি, পড়ালেখার বাইরে, কাজের বাইরে তুমি কী করেছ? অবসরে একজন মানুষ কী করে, সেটা খুব গুরুত্বপূর্ণ। এ থেকে বোঝা যায় কার আগ্রহের জায়গা কোনটা, নেতৃত্ব দেওয়ার যোগ্যতা আছে কি না। আমি যা শিখেছি, তার বেশির ভাগই বিশ্ববিদ্যালয়ের কোর্স বা অফিশিয়াল কাজের বাইরে পাওয়া। আগেই বলেছি, প্রতিবছর আমি আমার জন্য একটা লক্ষ ঠিক করি। গত বছর যেমন আমার লক্ষ্য ছিল, আমার বাসার জন্য একটা কৃত্রিম বুদ্ধিমত্তাসম্পন্ন ‘সিস্টেম’ তৈরি করব। দারুণ মজা পেয়েছি কাজটা করে। অনেক কিছু শিখেছি। এবার স্টেটগুলোতে ঘুরেও অনেক কিছু শিখছি।

কেউ যখন আমাকে প্রশ্ন করে, জীবনের কোন অর্জনটা আপনাকে সব চেয়ে আনন্দ দেয়? আমি বলি, আমার পরিবার। অপূর্ব স্ত্রী আর আদরের মেয়েকে নিয়ে আমার পরিবার। কদিন আগেই জানিয়েছি, আমাদের ঘরে আরও একটা কণ্যা সন্তান আসছে। এটাও একটা ভীষণ আনন্দের খবর। আমার মেয়ের বয়স এক বছর। সে পানি খুব পছন্দ করে, গোসল করতে খুব ভালোবাসে। যখন মেয়েকে আমি গোসল করাই, সেই মুহূর্তটা আমার কাছে সবচেয়ে সেরা মনে হয়। সপ্তাহে অন্তত তিন দিন আমি সময় বের করতে চেষ্টা করি যেন বাড়ি ফিরে মেয়েকে গোসল করাতে পারি। এটা একটা অদ্ভুত ব্যাপার। মা-বাবা হওয়ার পর পৃথিবীর প্রতি মানুষের দৃষ্টিভঙ্গি আচমকা বদলে যায়! এই পরিবর্তন আমি উপভোগ করছি। (সংক্ষেপিত)--মার্ক জাকারবার্গ--


ইংরেজি থেকে অনুবাদ: মো. সাইফুল্লাহ
সূত্র: নর্থ ক্যারোলিনা এ অ্যান্ড টি স্টেট ইউনিভার্সিটির অফিশিয়াল ভিডিও
Newpaper: Prothom Alo, 16 April 2017

Pages: 1 [2]