Show Posts

This section allows you to view all posts made by this member. Note that you can only see posts made in areas you currently have access to.


Messages - mrchawdhury

Pages: [1] 2 3 ... 5
1
দস্তরখানের সবচেয়ে বড় ফায়দা হল, তাতে খাদ্য পড়লে তা থেকে তুলে খাওয়া হয়। কিন্তু অনেক সময় এমন হয় যে, আমরা গুরুত্বের সাথে দস্তরখান  বিছিয়ে খাচ্ছি ঠিকই কিন্তু খাদ্য পড়ে গেলে তুলে খাওয়ার প্রতি গুরুত্ব দিচ্ছি না। অথচ খাদ্য পড়ে গেলে তার ময়লা পরিষ্কার করে হলেও তুলে খাওয়ার প্রতি নবীজী সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম আমাদেরকে উদ্বুদ্ধ করেছেন। তিনি ইরশাদ করেন-

إِذَا سَقَطَتْ لُقْمَةُ أَحَدِكُمْ فَلْيُمِطْ عَنْهَا الْأَذَى وَلْيَأْكُلْهَا، وَلَا يَدَعْهَا لِلشَّيْطَانِ.

যদি তোমাদের কারো খাদ্য-কণা পড়ে যায় তাহলে সে যেন এর ময়লা দূর করে খেয়ে নেয় এবং শয়তানের জন্য রেখে না দেয়। -সহীহ মুসলিম, হাদীস ২০৩৪

তেমনি অনেক সময় আমরা দস্তরখান পরিষ্কার রাখি না, ফলে তাতে খাদ্য পড়লে তুলে খেতে রুচি হয় না।  এটি কাম্য নয়; দস্তরখান সবসময় এমন পরিষ্কার রাখা চাই যে, তাতে খাদ্য পড়লে তুলে খেতে বা তা বিছিয়ে খানা খেতে রুচিতে না বাধে।
তেমনি অনেক সময় আমরা দস্তরখানকে কাটা,হাড্ডি ইত্যাদি রাখার পাত্র বানিয়ে ফেলি। ফলে একসময় তা এমন অপরিষ্কার হয়ে যায় যে, তাতে খাবার পড়ে গেলে তুলে খেতে আর রুচি হয় না। কাটা, হাড্ডি ইত্যাদি রাখার জন্য ভিন্ন পাত্র ব্যবহার করা চাই। দস্তরখানকে কাটা-হাড্ডির পাত্র বানানো ঠিক নয়।

2
ওয়ায়েস করনীর বিষয়ে আমাদের সমাজে একটি ঘটনা প্রসিদ্ধ আছে যে, রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম ওমর ও আলী রা.-এর কাছে তাঁর একটি জুব্বা রেখে যান এবং তাদেরকে ওসীয়ত করে যান, তারা যেন এ জুব্বা ওয়ায়েস করনীকে দেন। পরবর্তীতে তাঁরা ওয়ায়েস করনীকে সেই জুব্বাটি  দেন।

এটি একটি ভিত্তিহীন বর্ণনা। কোনো নির্ভরযোগ্য সূত্রে এটি পাওয়া যায় না। আল্লামা আলী কারী আলহারাবী রাহ. বলেন-

وَكَذَا مَا اشْتهرَ بَيْنَهُمْ مِنْ أَنَّ النَّبِيَّ صَلَّى اللَّهُ عَلَيْهِ وَسَلَّمَ أَوْصَى عُمَرَ وَعَلِيًّا بِخِرْقَتِه لأُوَيْسٍ وَأَنَّهُمَا سَلَّمَاهَا إِلَيْهِ...، فَلا أَصْلَ لَهُ.

‘মানুষের মাঝে যে কথা প্রসিদ্ধ আছে যে, রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম ওয়ায়েস করনীকে তাঁর জুব্বা মুবারক দেওয়ার জন্য ওমর ও আলী রা.-কে ওসীয়ত করে যান এবং তাঁরা সেটি তার হাতে পৌঁছান...- এ বর্ণনার কোনো ভিত্তি নেই। (দ্র. আলমাছনূ ফী মারিফাতিল হাদীসিল মাওযূ, বর্ণনা ৪৭৫; কাশফুল খাফা, বর্ণনা ২০৩৫; আলআসরারুল মারফ‚আ, বর্ণনা ৩৫৬)
সহীহ মুসলিমের বর্ণনায় ওমর রা.-এর সাথে ওয়ায়েস করনীর সাক্ষাতের ঘটনা এসেছে। কিন্তু উপরোক্ত কাহিনীর কথা নির্ভরযোগ্য কোনো সূত্রে পাওয়া যায় না।

3
Namaj/Salat / কবরে ফুল দেওয়া
« on: August 20, 2015, 04:41:23 PM »
শরীয়তের পরিভাষায় ‘সুন্নত’ হচ্ছে ঐ পথ, যা ধর্মে শুরু থেকে আছে। সুতরাং যা নবী সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লামের আমল ছিল তা সুন্নত। তেমনি খোলাফায়ে রাশেদীন ও সাহাবা-তাবেয়ীন (রিদওয়ানুল্লাহি আলাইহিম) যে আমল করেছেন তা-ও সুন্নতের মাঝে শামিল।

কোনো কাজ সুন্নত কি না তা নির্ধারণের উপায় হচ্ছে, এ কাজ খাইরুল কুরূনে প্রচলিত ছিল কি না দেখা। প্রথম যুগে (অর্থাৎ নবী সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম, খোলাফায়ে রাশেদীন ও সাহাবা-তাবেয়ীনের মোবারক যুগে) যা প্রচলিত ছিল তা নিঃসন্দেহে সুন্নত। আর এর অনুসরণকারীরা ‘আহলে সুন্নত’ বা সুন্নী নামে অভিহিত হওয়ার উপযুক্ত। পক্ষান্তরে যা ঐ বরকতপূর্ণ যুগের পরে উদ্ভাবিত হয়েছে, যার পক্ষে কুরআন-সুন্নাহর কোনো দলীল নেই, একে ছওয়াবের কাজ মনে করে পালন করা বিদআত। আর এতে লিপ্ত লোকেরা ‘আহলে বিদআত’ বা ‘বিদআতী’ নামের উপযুক্ত।

নবী সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম নিজের শত শত প্রিয় সাহাবীকে দাফন করেছেন। মা-শাআল্লাহ মদীনা তাইয়েবায় ফুলেরও অভাব ছিল না। তিনি কি কারো কবরে ফুল দিয়েছেন? তাঁর ওফাতের পর খোলাফায়ে রাশেদীন কি তাঁর পবিত্র কবরে ফুল দিয়েছেন? এরপর অন্য সাহাবীগণ কি দিয়েছেন খোলাফায়ে রাশেদীনের কবরে বা তাবেয়ীগণ কোনো একজন সাহাবীর কবরে? এই সবগুলো প্রশ্নের উত্তর ‘না’। আর গোটা হাদীস-সমগ্রে একটি হাদীসও এই মর্মে পাওয়া যায় না যে, নবী সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম, কোনো খলীফায়ে রাশেদ, কোনো সাহাবী বা কোনো তাবেয়ী কারো কবরে ফুল দিয়েছেন। তাহলে যে কাজ নবী সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম থেকে শুরু করে কোনো একজন সাধারণ তাবেয়ী থেকেও প্রমাণিত নয় একে সুন্নত কে বলতে পারে? কীভাবে বলতে পারে? তবে হ্যাঁ, কেউ যদি এমন কোনো কাজকেও ‘সুন্নত’ মনে করে, যা নবী সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লামের রীতি ও সাহাবা-তাবেয়ীগণের রীতির পরিপন্থী তাহলে এই অধম স্বীকার করছে যে, সুন্নতের এই নতুন পরিভাষা তার জানা নেই।

একটি ছুরত এই হতে পারে যে, কোনো একটি বিষয় নবী সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম ও সাহাবা-তাবেয়ীনের যুগে ছিল না, পরে এর অস্তিত্ব হয়েছে। আর কোনো মুজতাহিদ শরীয়তের কোনো মূলনীতির আলোকে ইজতিহাদ করে একে ‘জায়েয’ বা ‘মুস্তাহসান’ বলেছেন, এমন কিছুকে (সরাসরি) ‘সুন্নাতুন নাবী’ বলা যায় না। আবার খেলাফে শরীয়তও বলা যায় না। কারণ, মুজতাহিদ ইমামগণের কিয়াস ও ইজতিহাদও শরয়ী দলীল; বরং একেও ‘ছাবিত বিস সুন্নাহ’ (সুন্নাহ দ্বারা প্রমাণিত) মনে করা হবে।

আমাদের আলোচ্য বিষয়টি এ শ্রেণিরও অন্তর্ভুক্ত নয়। কারণ, প্রথমত ফুল ও কবর এমন কিছু নয় যা খাইরুল কুরূনের পরে এসেছে। নবী সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লামের যুগে কবরও ছিল, ফুলও ছিল। আর সেই ফুল কবরে দেওয়া সম্ভবও ছিল। এ যদি কোনো মুস্তাহসান (পছন্দনীয়) ব্যাপার হত তাহলে নবী সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম কথা ও কাজের দ্বারা তা জারি করতে পারতেন।

এরপর ফিকহে হানাফীর সংকলন আমাদের ইমামে আযমের যমানা থেকে শুরু হয়েছে এবং দ্বিতীয় শতাব্দী থেকে দশম শতাব্দী পর্যন্ত, কোনো রকমের অতিশয়তা ছাড়াই বলা যায়, হাজার হাজার ফিকহ-গ্রন্থ রচিত হয়েছে। আমাদের ফকীহগণ কাফন-দাফন ও কবর সংক্রান্ত ছোট ছোট সুন্নত-মুস্তাহাব ও আদবও বিশদভাবে লিখেছেন। এই প্রায় হাজার বছরের ফিকহ-রচনাবলীতে কোথাও নেই যে, কবরে ফুল দেওয়া সুন্নত। এ যদি সুন্নতই হত, তাহলে হাজার বর্ষব্যাপী হানাফী ইমাম ও ফকীহগণ এ ‘সুন্নত’ থেকে উদাসীন কীভাবে রইলেন? এ কেমন সুন্নত, যার খোঁজ না খাইরুল কুরূনে পাওয়া যায়, না বিস্তৃত হাদীস-সমগ্রে, না হাজার বছরের ফিকহ রচনাবলীতে! না আল্লাহর নবী সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম এর উপর আমল করেছেন, না খোলাফায়ে রাশেদীন, না সাহাবা-তাবেয়ীন, না আইম্মায়ে মুজতাহিদীন আর না হাজার বছরের আলিমগণ!

এখানে একথাও আরয করে দেওয়া জরুরি যে, পরের যুগের কারো ‘ইস্তিহসান’ (ভালো মনে করার) দ্বারা সুন্নত তো দূরের কথা, (অনেক ক্ষেত্রে) জাওয়ায বা বৈধতাও প্রমাণ হয় না।

ইমাম রাব্বানী মুজাদ্দিদে আলফে ছানী রাহ. ‘ফাতওয়া গিয়াছিয়্যাহ’ থেকে নকল করেন-

অর্থ: শায়খ ইমাম শহীদ রাহ. বলেছেন, আমরা বলখের মাশাইখের ‘ইস্তিহসান’কেও কবুল করি না। আমরা শুধু কবুল করি আমাদের মুতাকাদ্দিমীন আসহাব-এর কওল। কারণ কোনো এলাকায় কোনো বিষয়ের প্রচলন হয়ে যাওয়া তার বৈধতার দলীল নয়। বৈধতার প্রমাণ তো ঐ ‘তাআমুল’ বা কর্ম-ধারা, যা প্রথম যুগ থেকে চলে আসছে। যার দ্বারা প্রমাণ হতে পারে যে, নবী সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম সাহাবায়ে কেরামকে এই ধারার উপর প্রতিষ্ঠিত করেছেন। তাহলে বোঝা যাবে, এ নবী সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লামের পক্ষ হতে ‘তাশরী’ শরীয়তের ধারা প্রবর্তন। অন্যথায় লোকের সাধারণ কর্ম-ধারা দলীল নয়। তবে হাঁ, সব দেশের সব লোক (উলামা-ফুকাহাগণ একমত হয়ে) যদি তা করে তাহলে এ হবে ইজমা। আর ইজমা শরীয়তের দলীল। দেখুন লোকেরা যদি মাদক-দ্রব্যের বেচাকেনা ও সুদের লেনদেন করতে থাকে তাহলে (তাদের কর্মধারার কারণে) তা হালাল হওয়ার ফতোয়া দেয়া হবে না। (কারণ তা হারাম ও দ্বীনের আলিমগণ একে হারামই জানেন।) -মাকতুবাতে ইমাম রাব্বানী, দফতরে দুঅম, মাকতূব ৫৪

 খেজুর-গাছের শাখা পোঁতার হাদীস

এ প্রসঙ্গে শাহ ছাহেব যে হাদীসটি পেশ করেছেন, অর্থাৎ নবী সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম খেজুর গাছের একটি ডাল দুই ভাগ করে দুই কবরে পুঁতে দিয়েছিলেন, যে কবর দুটিতে আযাব হচ্ছিল এবং বলেছিলেন, ‘আশা করা যায়, এই শাখা শুকানো পর্যন্ত কবর দুটির আযাব লঘু হবে’। এখানে কয়েকটি বিষয় লক্ষণীয়।

এক. এ ঘটনা একাধিক সাহাবীর সূত্রে বর্ণিত হয়েছে। ইমাম নববী রাহ. ও কুরতুবী রাহ.-এর মতে, তা একই ঘটনার বিভিন্ন বর্ণনা। তবে হাফেয ইবনে হাজার রাহ. ও আল্লামা আইনী রাহ.-এর মতে তা আলাদা তিনটি ঘটনা। এ বিতর্কের অবসান কঠিন হলেও সকল বর্ণনার অভিন্ন বক্তব্য এই যে, কবরে খেজুর গাছের শাখা পোঁতা নবী সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লামের সাধারণ নিয়ম ছিল না। আযাবের শিকার কোনো কোনো কবরে শাখা পোঁতার দুটি একটি ঘটনা অবশ্য ঘটেছে।

দুই. এ নিয়েও কথা আছে যে, এ কবরগুলো কাদের ছিল- কাফিরের না মুসলমানের? আবু মুসা মাদীনী রাহ. বলেন, এ কাফেরদের কবর ছিল। পক্ষান্তরে কেউ কেউ বলেছেন, এ মুসলমানদের কবর ছিল। হাফেয ইবনে হাজার আসকালানী রাহ. বলেন, জাবির রা.-এর হাদীসে যে ঘটনা বর্ণিত হয়েছে, তা মুসলমানদের কবরের ঘটনা। -ফাতহুল বারী খÐ ১ পৃষ্ঠা ২৫৬

কবরগুলো কাফিরদের হোক বা মুসলমানদের, এটুকু তো স্পষ্ট এবং হাদীসেও উল্লেখিত যে, ঐ সব কবরেই শাখা পোঁতা হয়েছিল যেগুলো আযাবের শিকার হওয়া নবী সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম অকাট্য ওহী বা সহীহ কাশফের দ্বারা অবগত হয়েছিলেন। সাধারণ মুসলমানের কবরে না নবী সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম শাখা পুঁতেছেন আর না নবী-যুগে ও সাহাবা-তাবেয়ীনের যামানায় এর সাধারণ প্রচলন ছিল। এ থেকে স্পষ্ট যে, কবরে শাখা পোঁতা নবী সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লামের সাধারণ সুন্নত বা সুন্নতে মাকসূদাহ ছিল না।

তিন. নবী সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লামের এই বাণী- ‘আশা করা যায়, এ ডাল শুকানো পর্যন্ত কবরগুলোর আযাব লঘু হবে’। হাদীসের ভাষ্যকারগণ এ কথার মর্ম ও তাৎপর্য নিয়ে লম্বা আলোচনা করেছেন।

হযরত শায়খ আব্দুল হক মুহাদ্দিসে দেহলভী মিশকাতের আরবী শরাহ ‘লামাআতুত তানকীহ’তে মশহুর হানাফী ফকীহ, মুহাদ্দিস ও আরিফ ইমাম ফযলুল্লাহ তূরাপিশতী রাহ. থেকে বর্ণনা করেন: তূরাপিশতী বলেন, এ সময়সীমার কারণ, নবী সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম এই শাখাগুলো সজীব থাকা পর্যন্ত এই কবরগুলোর আযাব-লঘুতার সুপারিশ করেছিলেন।

যারা বলেন, সজীব শাখা সজীব থাকা পর্যন্ত আল্লাহ তাআলার তাসবীহ করে। আর একারণে তা কবরের আযাব থেকে রক্ষা করে- তাদের একথা সম্পূর্ণ অসার, অর্থহীন। আহলে ইলমের কাছে এর কোনো মূল্য নেই। -লামআত খ. ২ পৃ. ৪৪

চার. তাদের এ ‘ব্যাখ্যা’, যা আহলে ইলমের কাছে অসার ও ভিত্তিহীন যদি যথার্থও ধরে নেওয়া হয় তাহলেও এর দ্বারা কবরে শাখা পোঁতা সুন্নত সাব্যস্ত হয়, ফুল ছড়ানো বা পুষ্পাঞ্জলি অর্পণ নয়। একারণে আল্লামা আইনী রাহ., যিনি এ ব্যাখ্যা কবুল করেন, তিনিও বলেছেন,

 وكذلك ما يفعله أكثر الناس من وضع ما فيه رطوبة من الرياحين والبقول ونحوهما على القبور ليس بشيء، وإنما السنة الغرز

তেমনি আকসার লোক যা করে থাকে অর্থাৎ কবরে ফুল-পাতা দেওয়া, এ সম্পূর্ণ ভিত্তিহীন। সুন্নত হচ্ছে শুধু শাখা পোঁতা। -উমদাতুল কারী ৩/১২১

পাঁচ. এ ছাড়া তাদের ঐ কারণ-ব্যাখ্যা যদি মেনেও নেওয়া হয় তাহলেও এর দ্বারা কাফের ও ফাসিকের কবরে শাখা পোঁতার বৈধতা প্রমাণ হয়, আল্লাহর অলীগণের কবরে নয়। ইতিপূর্বে বিস্তারিত আলোচনা করা হয়েছে যে, নবী সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম আযাবের শিকার এক-দুটি কবর ছাড়া অন্য কোনো কবরে শাখা পোঁতেননি এবং এর নির্দেশনাও দেননি। আর সাহাবা-তাবেয়ীনও এর উপর আমল করেননি। সুতরাং ঐ ঘটনার অজুহাতে ছালেহীন ও আল্লাহর মকবুল বান্দাদের কবরে ফুল দেওয়ার বৈধতাও প্রমাণ হয় না। সুন্নত-মুস্তাহাবের তো প্রশ্নই আসে না।

কী আশ্চর্যের কথা, নবী সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম যা কাফের ও গোনাহগারের কবরে  করেছেন তা ওরা বৈধ মনে করছেন আল্লাহর ওলীগণের কবরে!

নবী সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম যে সাধারণ মুসলমানের কবরে শাখা পোঁতার সুন্নত জারী করেননি, সম্ভবত এতে এ হিকমতও নিহিত আছে যে, শাখা পোঁতা ঐ কবরটির আযাবগ্রস্ততার লক্ষণ বহন করে। অথচ শরীয়ত এমন কোনো কিছু পছন্দ করে না, যা কোনো মুসলমান সম্পর্কে নেতিবাচক ধারণা দান করে বা যাতে কুলক্ষণ থাকে। একারণে এই হাদীসের ভিত্তিতে অলী-আল্লাহর কবরে ফুল দেওয়া নিতান্তই বে-আদবী।

আসল কথা

বস্তুত আজ মাযারগুলোতে যে ফুলের চাদর বিছানো হয় তা এ হাদীসের বিধান তামিলের জন্য নয়; বরং কবরের তাজিম ও কবরবাসীর নৈকট্য অর্জনের জন্য। অথচ রাসূল সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম কবরের তাজিম ও কবরবাসীর নৈকট্য-অন্বেষণার্থে ফুল দেওয়ার মোটেও ইজাযত দেননি। এ হাদীসেও এ ইজাযতের কোনো সূত্র পাওয়া যায় না। বস্তুত পুষ্প-অর্পণের যে রীতি আমাদের এ যমানায় চালু হয়েছে আগের পরের কেউ এর বৈধতার ফতোয়া দেননি। এ কারণে তা বিদআতে সাইয়িআহ হওয়ায় কোনো সন্দেহ নেই। এটা ইয়াহুদ-নাসারা ও হিন্দুদের রসম, যা মুসলিমসমাজে অনুপ্রবেশ করেছে। বিদআতের বৈশিষ্ট্যই এই যে, যখন এর বিস্তার ঘটে তখন ধীরে ধীরে (তাকওয়া এবং ইলমের পরিপক্কতা থেকে বঞ্চিত) আলিমদের মন-মস্তিষ্কও এর দ্বারা প্রভাবিত হয়ে পড়ে এবং বিদআতের মন্দত্ব ও ভয়াবহতা তাদের চিন্তা থেকে অন্তর্হিত হয়ে যায়।

এ কারণে কোনো কোনো আলিম কোনো না কোনোভাবে এর বৈধতা ও ইস্তিহসানের কোনো না কোনো উপায় বের করার চেষ্টা করেন। এভাবে তারা সুন্নত যিন্দা করার পরিবর্তে বিদআতের বিস্তারে সহযোগী হয়ে যান। আল্লাহ তাদের ফেতনা থেকে উম্মতকে হেফাযত করেন। আমীন।

(সংক্ষেপিত ‘ইখতিলাফে উম্মত আওর সিরাতে মুস্তাকীম’ থেকে। অনুবাদে : আব্দুল্লাহ আবু মুহাম্মাদ)

4
কোথাও কোথাও এই কথাটি হাদীস হিসেবে প্রচলিত আছে-

‘যে ব্যক্তি মসজিদ থেকে একটি চুল ফেলে দিল সে যেন একটি মৃত গাধা ফেলে দিল বা সে একটি মরা গাধা সরানোর সওয়াব লাভ করল।’

মসজিদে কোনো ময়লা দেখলে তা পরিষ্কার করা অনেক সওয়াব ও ফযীলতের কাজ। নবীজী সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম মসজিদে কোনো ময়লা দেখলে নিজ হাতে তা পরিষ্কার করতেন। আবু হুরায়রা রা. থেকে বর্ণিত, একবার রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম মসজিদের দেয়ালে ময়লা দেখতে পেলেন। তখন তিনি একটি পাথরের টুকরা নিলেন এবং নিজ হাতে তা পরিষ্কার করলেন। -সহীহ বুখারী, হাদীস ৪০৮

আরেক হাদীসে এসেছে, রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম বলেন, আমার সামনে আমার উম্মতের নেক আমলের প্রতিদান পেশ করা হল, এর মধ্যে ‘মসজিদ থেকে ময়লা দূর করার নেক আমলের প্রতিদানও দেখতে পেলাম...। -সুনানে আবু দাউদ, হাদীস ৪৬১; জামে তিরমিযী, হাদীস ১৯১৬

সুতরাং মসজিদে কোনো ময়লা দেখলে তা পরিষ্কার করা অনেক সওয়াবের কাজ। কিন্তু মসজিদ থেকে একটি চুল ফেলে দিলে মরা গাধা ফেলার সওয়াব সম্বলিত কথাটি লোকমুখে হাদীস হিসেবে প্রসিদ্ধ হলেও এটি হাদীস নয়। কোনো নির্ভরযোগ্য কিতাবে তা পাওয়া যায় না। আমাদের জানামতে এর কোনো নির্ভরযোগ্য সনদ নেই।

5
কিছু কিছু মানুষকে বলতে শোনা যায়, খাওয়ার মাঝে মাঝে পানি পান করা সুন্নত।

এটি মনগড়া কথা, যার সাথে নবীজীর সুন্নতের কোনো সম্পর্ক নেই।

কোনো কাজকে -তা যত ভাল কাজই হোক নির্ভরযোগ্য সূত্র থেকে জানা ছাড়া রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লামের সাথে সম্পৃক্ত করা বা সুন্নত বলা জায়েয নেই।

সুতরাং নিশ্চিতভাবে জানা ছাড়া কোনো কাজ বা পদ্ধতিকে সুন্নত বলা যাবে না। তাহলে এটা রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম যা বলেননি তা রাসূলের সাথে সম্পৃক্ত করা হবে। যা বড় ধরনের গুনাহের কাজ। আমরা এটা থেকে বিরত থাকব।
খানার মাঝে মাঝে পানি পান করা সুন্নত হওয়ার জন্য রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম অথবা সাহাবায়ে কেরামের ‘কওল’ বা ‘ফে‘ল’ (বক্তব্য বা কাজ) দ্বারা তা মাতলূব হওয়ার দলীল প্রয়োজন। আমাদের জানামতে এমন কোনো দলীল নেই।

6
আপনার কথা বললে মজলিসে লোক কম হয় কেন?...

কিছু কিছু মানুষকে দ্বীনী মজলিসে বসতে পারার ফযীলত হিসেবে নীচের কাহিনীটি বলতে শোনা যায়-

‘মূসা আ. একবার আল্লাহকে জিজ্ঞেস করলেন, আপনার আলোচনা করলে মানুষ কম হয় কেন?

আল্লাহ বললেন, এক তোড়া ফুল আনো। মূসা আ. বেছে বেছে সুন্দর সুন্দর ফুল দিয়ে একটি তোড়া বানিয়ে আনলেন।

আল্লাহ বললেন, এত ফুল থাকতে বেছে বেছে আনলে কেন?

মূসা আ. বললেন, বেছে বেছে সুন্দর দেখে পছন্দ করে এনেছি।

তখন আল্লাহ বললেন, আমিও আমার মজলিসে আমার বান্দাদের থেকে বেছে বেছে পছন্দনীয় বান্দাদের আনি।’
যে উদ্দেশ্যেই বলা হোক এটি একটি ভিত্তিহীন কাহিনী। কোনো নির্ভরযোগ্য বর্ণনার মাধ্যমে তা প্রমাণিতও নয়। সুতরাং এটি বর্ণনা না করা চাই। দ্বীনী মাহফিল বিষয়ে যে সহীহ হাদীস রয়েছে সেগুলোই বর্ণনা করা উচিত।

7
আলহামদু লিল্লাহ। আল্লাহ তা‘আলার শোকর আদায় করছি যে, তিনি আমাদেরকে দ্বীনের কিছু আলোচনার জন্য এভাবে একত্রিত হওয়ার তাওফীক দিয়েছেন। আমি একজন ইংরেজি শিক্ষিত মানুষ। প্রাতিষ্ঠানিকভাবে ইলমে দ্বীন হাসিল করার আমার সৌভাগ্য হয়নি। এখন যেখানে দ্বীনের সব স্কলারদের কেন্দ্র, সেখানে কিছু বলার মত বিষয় আমি খুঁজে পাই না।

হারদুই হযরত মাওলানা আবরারুল হক ছাহেব রাহমাতুল্লাহি আলাইহি বার বার একটি আয়াতের দিকে ইশারা করতেন,

وَذَكِّرْ فَإِنَّ الذِّكْرَىٰ تَنْفَعُ الْمُؤْمِنِيْنَ

‘মনে করিয়ে দাও। নিশ্চয়ই মনে করিয়ে দেয়া আমার ঈমানদার বান্দাদেরকে উপকৃত করবে।’ -... এখন আপনাদের আমি কী মনে করিয়ে দেব? আমাদের প্রিয় নবী হযরত মুহাম্মাদ মুস্তফা সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম উলামায়ে কেরাম সম্পর্কে কত কথা বলে গেছেন। বিশেষ করে তিনি বলেছেন যে, ‘উলামায়ে কেরাম সকল নবীদের ওয়ারিস।’ ‘আমার ওয়ারিস’ বলেননি। সকল নবীদের ওয়ারিস। ইসলাম আপনাদের উপর এক বিরাট দায়িত্ব দিয়েছে। আমরা আলেম না হয়ে একদিক  থেকে বেঁচে গেছি। কিন্তু অন্যদিকে আসল সৌভাগ্য থেকে বঞ্চিত হয়েছি।

আমার এক ছাত্র পিএইচডি করেছে অস্ট্রেলিয়ায়। আমার সঙ্গে হজ্বও করেছে। বছর দুয়েক আগে ঢাকায় এসে আমার সাথে দেখা করেছে। দেখা করে বলে, ‘স্যার, আপনাকে ইঞ্জিনিয়ারিং ইউনিভার্সিটিতে দেখেছি। একসাথে হজ্বও করেছি। তারপরেও মনের মধ্যে বার বার ওয়াসওয়াসা আসে, আসলে আখেরাত বলে কি আদৌ কিছু আছে?’ আমি তাকে ইলমি জবাব কী দেব? আমি সেদিকে গেলামই না। আমি তাকে বললাম, ‘ইবরাহীম (বাইবেলে আব্রাহাম), ইয়াকুব (বাইবেলে জ্যাকব), ইসহাক (বাইবেলে আইজ্যাক) সবাই ঐতিহাসিক চরিত্র। তাদের সবার কথা বাইবেলে আছে। বাইবেলের দুটো ভাগ। নিউ টেস্টামেন্ট এবং ওল্ড টেস্টামেন্ট। নিউ টেস্টামেন্টকে বলে ইঞ্জিল। আর ওল্ড টেস্টামেন্টকে বলে তাওরাত। (কিন্তু এগুলো আসল ইঞ্জিলও নয় তাওরাতও নয়। একথা সবারই জানা আছে। তা সত্ত্বেও কথাটি এজন্য বললাম যে, তাহরীফ ও বিকৃতির পরও এগুলোতে তাঁদের নাম রয়েছে। এবং আসমানী দ্বীনপ্রাপ্ত সকলেই তাঁদেরকে সত্যবাদী ও বিশ্বস্ত মনে করে)। তো নবীগণ এবং খাতামুন নাবিয়্যীন হযরত মুহাম্মাদ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম সকলেই যখন আখেরাতের বিষয়ে সংবাদ দিচ্ছেন, তাহলে ঈমান আনার জন্য এর চেয়ে বেশি আর কী দলীলের প্রয়োজন! পৃথিবীর ইতিহাসে এরকম সত্য আর কোথায় পাবে?’

আমি ২০১২ সালে আমেরিকায় গিয়েছিলাম। সেখানে ফ্লোরিডায় রাস্তার পাশে একটা সাইনবোর্ড দেখলাম। তাতে বিরাট করে লেখা, Islam : The Religion of Abraham, Moses, Jesus and Muhammad (ইসলাম ইবরাহীমের ধর্ম, মূসার ধর্ম, ঈসার ধর্ম এবং মুহাম্মাদ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম -এর ধর্ম)। সাইনবোর্ডে Islam এর ও অক্ষরটা প্রায় আমার সমান। এটা তো আমেরিকায় দেখেছি। আর আমার সেই ছাত্র থাকে অস্ট্রেলিয়ায়। আমি তাকে বললাম, ‘এই মানুষগুলো সবাই কি মিথ্যুক? তুমি তো পিএইচডি করেছ অস্ট্রেলিয়ায়। তোমার কি মনে হয় ইবরাহীম আলাইহিস সালাম মিথ্যা বলেছেন? মূসা আলাইহিস সালাম মিথ্যা বলেছেন? ঈসা আলাইহিস সালাম মিথ্যা বলেছেন? মুহাম্মাদ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম মিথ্যা বলেছেন?’ আমার কথা শুনে সে চুপ হয়ে গেল।

এসকল নবী সারা দুনিয়ায় সম্মানিত। তবে ইসলাম তাদেরকে যে সম্মান দিয়েছে, সেটাই আসল সম্মান। কুরআন মাজীদে আছে,

 قُلِ الْحَمْدُ لِلّٰهِ وَسَلَامٌ عَلٰى عِبَادِهِ الَّذِينَ اصْطَفَىٰ

‘আপনি বলুন, আল্হামদু লিল্লাহ, সালাম বর্ষিত হোক আল্লাহর নির্বাচিত সকল দাসদের উপর।’ - ... সারা দুনিয়ার মুসলমানরা এর উপর আমল করে কি করে না? চৌদ্দশ বছর পরও আমরা মূসার নাম নিলে বলি, মূসা আলাইহিস সালাম (তাদের উপর সালাম বর্ষিত হোক)। অন্য ধর্মাবলম্বীরা এর ধারে কাছেও নেই। আমাদের দেশে মুসলমানদের মধ্যেও এখন এ অবস্থা এসে গেছে। যেহেতু মানুষ দ্বীন শেখার সুযোগ পায় না, অজ্ঞতা দানা বাধেই।

আল্লাহ তা‘আলা পরিবেশের ওসিলায় অনেক সময় দ্বীনি বুঝ নসীব করেন। আমার এক বন্ধু এখন আমেরিকায় থাকেন। আমরা একসাথে আহসানউল্লাহ ইঞ্জিনিয়ারিং কলেজে পড়েছি। খুবই মেধাবী ছাত্র ছিলেন। আচার ব্যবহারে খুব ভদ্র। তবে তাকে আমি কোনোদিন নামায পড়তে দেখিনি। ধর্ম-কর্মের সাথে সম্পর্ক নেই। সবচেয়ে আধুনিক শিক্ষায় শিক্ষিত হয়েছেন। আমেরিকার পশ্চিম প্রান্তে প্রশান্ত মহাসাগরের পাড়ে লস এঞ্জেলস শহর। ২০১২ সালে আমেরিকা সফরে আমি এ শহরে গিয়েছিলাম। একদিন লস এঞ্জেলসের লেকউড এলাকার এক মসজিদে প্রোগ্রাম ছিল। সেখানে দেখি আমার এই বন্ধু হাজির। আমি তাকে বললাম, ‘তুমি এখানে?’ সে বলল, ‘হ্যা। তোমার নাম দেখে আসলাম। প্রফেসর হামীদুর রহমান আর কে হবে, তুমি ছাড়া?’

আমার বন্ধু আমাদের সাথে অনেকক্ষণ থেকেছে। মাগরিব এশা একসাথে পড়েছে। পুরো বয়ান শুনেছে। বয়ান শেষে প্রশ্নোত্তর পর্ব ছিল। সেখানে প্রশ্নও করেছে। তার এই পরিবর্তনের বিষয়টা আমাকে অবাক করল। আমেরিকায় এটা খুব হচ্ছে। যারা বাংলাদেশে কেবল মুসলমান হিসেবে পরিচিত ছিলেন, ধর্ম-কর্ম করতেন না, তারা আমেরিকায় এসে ধার্মিক হয়ে গেছেন। বিপরীত পরিবেশে আল্লাহর অনুগ্রহে তারা দ্বীনের দিকে খুব অগ্রসর হন। দ্বীনের খেদমতে লাগার জন্য খুব কামনা করেন। এটা আল্লাহপাকের কুদরতী বিধান।

ইংরেজিতে বলে জেনারেশন (Generation, প্রজন্ম)। আমরা এক জেনারেশন। আমাদের ছেলেরা আরেক জেনারেশন। প্রথম জেনারেশনের যারা আমেরিকায় গিয়েছে, তারা ভিন্ন পরিবেশে এসে দ্বীনের প্রতি খুব আগ্রহী হয়ে ওঠে। মসজিদ-মাদরাসা প্রতিষ্ঠা এবং তাবলীগের কাজে খুব এগিয়ে যায়। সমস্যা হল তাদের পরবর্তী জেনারেশন নিয়ে। তাদের ছেলে-মেয়ে যারা আমেরিকায় জন্মেছে, তারা নতুন প্রজন্ম। এ প্রজন্মের ছেলে-মেয়েরা পুরোনোদের মত দ্বীনী খেয়াল নিয়ে বেড়ে ওঠে না। প্রথম প্রজন্ম মুসলমান হওয়ার দিকে আগায়। আর তার পরবর্তী প্রজন্ম আমেরিকান হওয়ার দিকে আগায়। আমেরিকান হওয়া মানে কী? যেখানে আল্লাহর কোন জায়গা নেই। God has nothing to do (খোদার করার মত কিছুই নেই)। ভালো চলছে সব। ভালো খানা-দানা, আমোদ-ফূর্তি। পবিত্র কালামে রয়েছে,

 كَلَّا إِنَّ الْإِنْسَانَ لَيَطْغَىٰ أَنْ رَآهُ اسْتَغْنَىٰ إِنَّ إِلَىٰ رَبِّكَ الرُّجْعَىٰ

‘না না মানুষ তো আমার আদেশের বিরুদ্ধাচরণ করে, ঔদ্ধত্যের সাথে ঘাড় ফেরায়। সে নিজেকে অভাবহীন মনে করে। আপনার প্রতিপালকের কাছে ফিরতে হবে একদিন।’ -... আল্লাহপাকের মন্তব্য ছোট্ট, ‘আপনার প্রতিপালকের কাছে তাকে ফিরে যেতে হবে।’  তখন দেখা যাবে, কার দেয়া নেয়ামত ভোগ করে এসেছ। পুরো আমেরিকায় এজন্য মুসলমানদের মধ্যে এ অনুভূতিই সবচেয়ে তীব্র যে, আলহামদুলিল্লাহ, আমি তো এখন নামায পড়া শুরু করেছি। রোযা রাখা শুরু করেছি। আমার ছেলে-মেয়েদের কী হবে?

আমেরিকায় আমরা অনেকগুলো স্টেটে গিয়েছি। আটলান্টা শহরে সফরের সময় একজন মহিলা নিউইয়র্ক থেকে ফোন করল। আমি প্রথমে তাকে বললাম, আপনি আমার নম্বর কোথায় পেলেন? ‘আপনার ছোট ভাই ইঞ্জিনিয়ার মুহাম্মাদ মাসহুদুর রহমান সাহেবের মেয়ে নিউইয়র্কে থাকে। তার কাছ থেকে আপনার মোবাইল নম্বর পেয়েছি।’

‘কি ব্যাপার?’

এ কথা বলতেই মহিলা কান্না শুরু করে দিল,

‘আমার ছেলেটা পাচ ওয়াক্ত নামায মসজিদে জামাতে পড়ত। কুরআন শরীফ সুন্দর পড়ে। পরশু তার বয়স আঠার হয়েছে। সে তার খ্রিস্টান বান্ধবীকে বিয়ে করে ঘর ছেড়ে চলে গেছে। আমরা জানতামই না যে, তার বান্ধবী আছে।

ছেলে খুব ভালো। কিন্তু ভেতরে ভেতরে সে যে পুরোপুরি আমেরিকান হয়ে যাচ্ছে, এটা তো মায়ের খবর নেই। মা এখন কাঁদে। আমি বললাম, ‘এ তো আমাদের অবহেলা, উদাসীনতার ফল। এখন কেঁদে কী হবে? আপনি মা। তার জন্য আল্লাহর কাছে দুআ করেন।’

আরো কিছু কথা বলে মাকে সান্ত¡না দিলাম। এরকম ঘটনা কম নয়। আমেরিকার মত পরিবেশে ছেলে পাঁচ ওয়াক্ত নামায পড়ছে। কুরআন পড়ছে। এর মধ্যে খ্রিস্টান মেয়েকে বিয়ে করে ফেলছে। খ্রিস্টান মেয়েকে বিয়ে করা ঐদেশে কোনো বিষয়ই না!

বিদেশের পরিবেশে বেশিরভাগই চেইঞ্জ হয়। আমেরিকায় যাওয়ার আগে যারা মুসলমান ছিল, তাদের ঈমান সাধারণত বাড়ে। কিন্তু যাদের ঐদেশেই জন্ম, শুরু থেকেই তারা এক ভিন্ন পরিবেশে বেড়ে ওঠে। এটা অনেকেই বলেন যে, আমরা আলহামদুলিল্লাহ, নামায-রোযা করছি। দাড়ি রাখছি। কিন্তু আমাদের ছেলে-মেয়েরা আমেরিকান হয়ে যাচ্ছে! তাদের চাল-চলন সব আমেরিকানদের মত।

১৯৮৫ সালে আমি হাফেজ্জী হুযুরের সাথে লন্ডন গিয়েছিলাম। সেখানে আমরা এমন অনেক মসজিদে গিয়েছি যেগুলো আগে চার্চ ছিল। মুসলমানরা আমাদেরকে দেখিয়ে বলেছে, এ মসজিদটা আগে খ্রিস্টানদের চার্চ ছিল। এটা ইহুদীদের উপসনালয় সিনাগগ (Synagogue) ছিল। আর আমরা আমেরিকা গিয়ে দেখলাম মুসলমানরা অনেক চার্চকেই মসজিদ বানিয়ে ফেলেছে। তারা আমাদের দেশে টাকা-পয়সা খরচ করে লোক কিনে কিনে খ্রিস্টান বানাচ্ছে। নীলফামারী, লালমনিরহাটসহ অনেক জায়গায় আমাদেরকে ডেকে বলে, এই বাড়িতে সাতজন খ্রিস্টান হয়ে গেছে। প্রতি মাসে সবাইকে ৩৫০ টাকা করে দেয়। কেউ যদি খ্রিস্টান হয়ে যায়, তাহলে তাকে মাসে মাসে তারা টাকা দেয়। তাদের নিজেদের দেশেই চার্চ বিক্রি হয়ে যাচ্ছে আর আমাদের দেশে টাকা-পয়সা বিলিয়ে বাঙ্গালীদের ঈমান হরণ করে! অকল্পনীয় জঘণ্য কাজ করে তারা। এখন তো আল্লাহপাকের কালামের সব নামগুলো ব্যবহার শুরু করেছে। ঈসা আলাইহিস সালাম-এর সঙ্গীদের নাম দিয়েছে সাহাবী। যাদের শুরুই ধোঁকা, তারা মানুষকে কী দিবে? মানুষকে ঠকানো, ধোঁকা দিয়ে স্বধর্মী বানানো - এগুলো হচ্ছে তাদের জন্মগত আদর্শ।

মুসলমানরা দ্বীনের উপর টিকে থাকার জন্য অনেক পরিশ্রম করে। এমন কোনো মসজিদ নেই যেখানে রোববার সাপ্তাহিক ক্লাস হয় না। রোববার সাপ্তাহিক ছুটির দিন। এদিন শিশুদেরকে দ্বীনি তালীম দেয়া হয়। খুব যত্নের সাথে এ কাজটা প্রায় সব মসজিদই করে। কিন্তু সারা সপ্তাহে আর সময় হয় না। একদিনে আর কতটুকু পারা যায়! তবু কিছু হয়। দ্বীনের কাজ করার অপূর্ব এক জায়গা।

মুসলমানদের কথা হল, আমরা এখন আল্লাহ চাইলে অভ্যন্তরীণভাবে দখল করব। ইসলাম দ্বারা, আখলাক দ্বারা তাদের অন্তর দখল করব। মুসলমানদের জন্য এটা খুব সৌভাগ্যের জিনিস। কিন্তু সমস্যা হচ্ছে বাচ্চাদের নিয়ে। টিভি, কম্পিউটারের মত জিনিস যেগুলো ঈমান বিধ্বংসী, সেগুলোকে তারা কোনো অপরাধই মনে করে না। বাবা-মা কত চেষ্টা করছে। কিন্তু খুব কমই লাইনে আসে। বাবা-মায়ের চেষ্টায় দেখা যায় ছোটবেলায় শিশুদের মধ্যে হেফজ করার খুব আগ্রহ তৈরি হয়। অনেকে হাফেজও হয়। হাফেজ হয়ে কলেজ-ইউনিভার্সিটিতে পড়াশোনা করছে। আমেরিকায় থাকছে। কুরআন পড়ছে। আলহামদুলিল্লাহ, এ চেষ্টা অনেক পরিবারে চলছে। বিশেষ করে নিউইয়র্কে এটা বেশি হচ্ছে। সেখানে বাংলাদেশী উলামায়ে কেরাম বেশি যান।

এ বছর আমি গিয়েছিলাম নিউজিল্যান্ডে। সেখানে একটা অদ্ভূত দৃশ্য দেখলাম। নিউজিল্যান্ডের একটা বড় শহর অকল্যান্ড। আর রাজধানী হচ্ছে ওয়েলিংটন। অকল্যান্ডে যত মসজিদে আমরা নামায পড়েছি, প্রায় সবগুলো মসজিদের ইমাম সাহেবই ডাভেলের।

অকল্যান্ডে তাবলীগের কাজ খুব ভালো হচ্ছে। তাবলীগী ভাইদের সাথে সেখানকার উলামায়ে কেরামের খুবই ভালো সম্পর্ক। আমি অকল্যান্ডের একটা বড় মসজিদের পাশেই ছিলাম। মসজিদের নাম মসজিদে উমর। সেখানে আমাকে বলে, ‘আমরা প্রতিদিন ফজরের পর দশ মিনিট আপনার বয়ান শুনব?’ আমি বললাম, ‘এখানে ফজরের নামাযের পর তাবলীগের মাশওয়ারা হয় না?’ তারা বলল, ‘হয়। তাবলীগী ভাইদের সাথে কথা  হয়েছে, যে কয়দিন আপনি আছেন, সে কয়েকটা দিন বয়ানের পর তাবলীগের মাশওয়ারা হবে।’ আমি সেখানে আট-নয় দিন ছিলাম। প্রতিদিন আমি দশ মিনিট কথা বলতাম। ইংরেজিতে। তারপর তাবলীগের মাশওয়ারা-তালীম হত। এ এক অপূর্ব সম্মিলন।

আমাদের এই পদ্ধতির তাবলীগের কাজ চালু হয়েছে মাওলানা ইলিয়াস ছাহেব রহমাতুল্লাহি আলাইহির মাধ্যমে। তিনি আলেম ছিলেন কি ছিলেন না? আগে তিনি দাঈ হয়েছেন না আলেম হয়েছেন?

আমরা নিউজিল্যান্ডে কয়েকটা শহরে গিয়েছি। সবখানেই ইমাম সাহেবদেরকে পেশাক-আশাক থেকে শুরু করে সবকিছুই পুরো সুন্নাত তরিকায় করতে দেখেছি। তাবলীগের ভাইদের সাথে উলামায়ে কেরামের সম্প্রীতি দেখে বেশি অবাক হয়েছি। তাবলীগের ভাইদেরকে একসঙ্গে মহব্বতের সাথে জড়িয়ে রাখা এবং একই সাথে বিভিন্ন ইলমে দ্বীনের মাহফিলগুলোতে অংশগ্রহণ করা, যা আমাদের দেশে কম।

আমি বলছিলাম ১৪৯২ ঈ.  সালের ঘটনা। সালটা মনে রাখবেন। তখন ভারতবর্ষে মোঘল শাসন শুরু হবে হবে ভাব। পুরো ভারতবর্ষ আবাদ করা শেষ। অথচ এসময় আমেরিকা আবাদবিহীন দেশ। লোক-জন নেই। হাজার হাজার মাইল জায়গা খালি পড়ে আছে। ১৪৯২ থেকে ২০১৪ সাল, এই গত পাঁচশত বছরে সেখানে অনেক আবাদ হয়েছে।

প্রথম প্রেসিডেন্ট ছিলেন জর্জ ওয়াশিংটন। তার জীবনীতে দেখা যায় যে, তিনি খুব যোগ্য যোদ্ধা ছিলেন। বৃটিশদের বিরুদ্ধে আমেরিকার স্বাধীনতা যুদ্ধে তিনি নেতৃস্থানীয় ছিলেন। চৌকস যোদ্ধা হিসেবে তিনি স্বীকৃত। তারপর তাকে প্রেসিডেন্ট বানানো হল। চার বছর প্রেসিডেন্ট থাকলেন। আবার তাকে চার বছরের জন্য নির্বাচন করা হল। তিনি আরো চার বছর প্রেসিডেন্ট থাকলেন।

প্রথম প্রেসিডেন্ট সম্পর্কে বলা হয়, তিনি একজন ডিস্ট (Deist1) ছিলেন। মানে তিনি একজন মহা করুণাময় প্রভুতে বিশ্বাস করতেন। এটা কী রকম? আমেরিকার ডলারের উপরে লেখা আছে, In God We Trust (আমরা প্রভুর উপর নির্ভর করি)। ডযরপয এড়ফ (কোন্ প্রভু তারা বিশ্বাস করে)? দেখা যায় যে, তারা এমন এক স্রষ্টায় বিশ্বাস করে যার কাছে আখেরাত বলে কিছু আছে বলে তিনি বলেন না।  নবী-রাসূল কিছু পাঠান না। আসমানী কিতাব বলে কিছু নেই। ফেরেশতা বলে কিছু বানাননি। তবে তিনি খুব করুণাময়। সেটা ঠিক আছে। আমেরিকার প্রথম তিনজন প্রেসিডেন্ট এমন ছিলেন। কিন্তু এখন শুধু আমেরিকা নয়, পুরো পাশ্চাত্যে তাদের নতুন কালেমা, God the Father, God the Son, God the holy Ghost (পিতা খোদা, পূত্র খোদা, পবিত্র আত্মা খোদা)। কুরআন মাজীদে পরিষ্কার কথা,

 وَلَا تَقُوْلُوْا ثَلَاثَةٌ اِنْتَهُوْا خَيْرًا لَّكُمْ

‘তিন বলো না। থাম। এটা তোমাদের জন্য ভালো হবে।’ -... কত শক্ত কুরআন শরীফের শব্দ! তাদের কাছে সত্য না হলেও পালানোর পথ নেই।

আমার কাছে ‘ইসলাম’ নামে দুটো বই আছে। একজন অস্ট্রেলিয়ান মানুষ। তিনি মুসলমান হয়েছেন। নাম রেখেছেন মুহাম্মাদ থম্পসন। তিনি তার কাহিনী বর্ণনা করেছেন। খ্রীস্টবাদে খোদা তিনজন। তিনজনে একজন। যদি বলা হয়, আসল খোদা হল আল্লাহ, মাঝারি খোদা হল পূত্র, তৃতীয় খোদা হল পবিত্র আত্মা তাহলে কিছুটা হলেও ফিলোসফিটা দাঁড় করানো যেত। কিন্তু তারা বলে যে, না। একই খোদা। তখন যদি বলেন যে, মরিয়মের পেটে যে খোদা ছিল, সেটা কোন খোদা? যদি আসল খোদা সেটা হয়, তাহলে তখন বাইরে কে ছিল? তারা তখন বলবে, এত প্যাঁচানো কথা বলবেন না। প্যাঁচানো কথা কি আপনি বলেন, না তারা বলে? আল্লাহ বলেন,

 الْحَمْدُ لِلّٰهِ الَّذِي أَنْزَلَ عَلٰى عَبْدِهِ الْكِتَابَ وَلَمْ يَجْعَلْ لَّه‘ عِوَجًا

‘সব প্রশংসা আল্লাহর, যিনি নিজ বান্দার প্রতি কিতাব নাযিল করেছেন এবং তাতে কোনো রকমের কত্রুটি রাখেননি।’ -...কুরআন মাজীদের বৈশিষ্ট্য হচ্ছে, এর মধ্যে কোনো প্যাঁচানো কথা নেই।

ত্রিত্ববাদের এ কথাটা বিশ্বাস করতে যে কোনো শান্ত ভদ্র মানুষের কষ্ট হয়। একই খোদা তিনটা।

তারা আবার বলে, সব শিশু গোনাহের মধ্যে জন্মগ্রহণ করে। ইসলাম বলে, তারা পবিত্র হয়ে জন্মগ্রহণ করে। ঈসা আলাইহিস সালাম পৃথিবীতে এসেছেন রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম-এর জন্মের ৫৭০ বছর আগে। এখন তার আগে যারা দুনিয়ায় ছিল, তাদের মুক্তির কী উপায় হবে? হাজার হাজার খ্রীস্টান এই দুঃখে মরে। তারা তাদের ধর্মের মৌলিক কথাগুলোকে মানতে পারে না। আমাদের উলামায়ে কেরাম বলেন যে, আসলে বর্তমান খ্রীস্টান ধর্ম আর ঈসা আলাইহিস  সালাম-এর ধর্মের মধ্যে কোনো মিল নেই। পল এটাকে বিকৃত করেছে।

আলহামদুলিল্লাহ, ইসলামের সৌন্দর্য, সরলতা, সাদাসিধেভাব অকল্পনীয়ভাবে তাদেরকে আকৃষ্ট করেছে। খ্রীস্টান ধর্মের বিকৃত অবস্থা তাদের সমাজের ভদ্র কেউ মানতে পারে না। খোদা ক’জন? বলে, একজন। এটা একত্ববাদী ধর্ম। কীভাবে? তিন খোদায় এক খোদা। হিন্দুরা বলে, তারাও এক খোদায় বিশ্বাস করে। তবে তিনি তিন মূর্তিতে প্রকাশিত। ব্রহ্মা, বিষ্ণু, শিব - এই তিন মূর্তি এক। সব ভেজালে ভরা!

নিউজিল্যান্ডের যে কিতাবের কথা আমি বলছিলাম, তার একটা বই২ লিখেছেন থমপসন। তিনি খ্রীস্টান থেকে মুসলমান হয়েছেন। আগে নাম ছিল পিটার থমপসন। মুসলমান হওয়ার পর নাম রেখেছেন মুহাম্মাদ ফারহান থমপসন। তিনি খুব সুন্দর লিখেছেন। ভূমিকায় তিনি বলেছেন, ‘আমি একটা শ্রমিক পরিবারের সন্তান। আমার পরিবারের সবাই নিয়মিত চার্চে যেত। সপ্তাহে একদিন। পরবর্তীতে তারা আমাকেও নিয়মিত চার্চে নিয়ে যেত। আমি যখন বড় হলাম, চার্চের নানরা আমার প্রশ্নের জবাব দিতে পারত না। তখন তারা আমাকে মারধর করত। এই যে তাদের ধর্মের এই প্যাঁচানো কথা, তিন খোদায় এক খোদা, এটা আমার ভালো লাগত না।’

আমরা খোঁজ নিয়ে জানলাম যে, মুহাম্মাদ থমপসন এখন নিউজিল্যান্ডে থাকেন। আমরা তাকে টেলিফোন করলাম। তিনি ধরলেন। কথা হল। আমরা তার সাথে দেখা করতে চাইলাম। সময় ছিল না। পরদিনই আমরা ঢাকা ফিরে এসেছি। দেখা করা সম্ভব হয়নি। তিনি তার বইয়ে লিখেছেন, ‘আমার নাম ছিল গ্রাহাম পিটার থম্পসন। আমি জন্মেছি মেলবোর্ণ শহরে। ১৯৫৮ সালে। আমি আমার আব্বা-আম্মার আট সন্তানের মধ্যে দ্বিতীয়। আমরা সবাই ক্যাথলিক স্কুলে পড়াশোনা করেছি। পরবর্তীকালে আমাকে অল্টার বয় (Alter Boy) বানানো হল। অল্টার শব্দের অর্থ যেখানে পূজার অর্ঘ্য থাকে। এর মানে চার্চে আমার অবস্থান আরো উচ্চ পর্যায়ে উন্নীত হল। আমার ছোটবেলা ভালোই কাটল। কিন্তু যখন বড় হতে লাগলাম, তখন দেখলাম খ্রীস্টান ধর্মের অনেক কিছুই আমার কাছে বোধগম্য হচ্ছে না। আমি জানার চেষ্টা করলাম। প্রশ্নের জবাব পেলাম না। আমার মন সন্তুষ্ট হল না।’ এই যে কথাগুলো, এটা যারা চিন্তা করে, তাদের শতকরা আশি ভাগের মধ্যেই কাজ করে।

একই জায়গায় একই মহল্লায় আরেকটি বই পেলাম। এ বইয়ের লেখক ফ্রেডেরিক ম্যাথিওসন ড্যানি। তিনি মুসলমান হয়েছেন কিনা জানি না। কিন্তু তার বইয়ের লেখা পড়ে অকল্পনীয় একটা মহব্বত হয়ে গেল। তিনি ইন্দোনেশিয়ার কথা লিখেছেন। সেখানে কুরআন শরীফ সম্পর্কে বিভিন্ন ঘটনা উল্লেখ করেছেন। তিনি লিখেছেন যে, বিষয়টা তার কাছে

অদ্ভূত লেগেছে। শুধু কুরআন শরীফের উপর পঁচিশ-তিরিশ পৃষ্ঠা লিখেছেন। কী পরিমাণ স্টাডি করেছেন এই প্রফেসর! নিউইয়র্কের এক বিশ্ববিদ্যালয়ের প্রফেসর। দেখার জিনিস হল, কত বড় বড় কাজ   হচ্ছে, আমাদের খবর নেই। আমাদের ধর্মের গুণাগুণ বিধর্মীরা প্রকাশ করছে।

আরেকজন নতুন মুসলমান। তার নাম মুরাদ হফম্যান (Murad Hofmann)। আসল নাম কি জানি না। মুসলমান হওয়ার পর নাম রেখেছেন মুরাদ। পারিবারিক টাইটেল হফম্যান। খুব সুন্দর বই লিখেছেন। তিনি একজন জার্মান। মুসলমান হওয়ার পরও সে দেশের সরকার তাকে আলজেরিয়া, লিবিয়ায় রাষ্ট্রীয় দূত বানিয়েছে। তিনি আল্লাহর কুদরত সম্পর্কে লিখেছেন। সারা দুনিয়ায় কম্পিউটারের বাদশা বলা হয় বিল গেটসকে। তিনি বলেন, আল্লাহ পাকের কুদরত আর কী তালাশ করবে? একটা বুয়া রাস্তার পাশে ঝুপরির মধ্যে সন্তান প্রসব করল। এই শিশুটা বড় হয়ে হয়ত রিক্সাওয়ালা হবে। এখন এই রিক্সাওয়ালা যখন রিক্সা চালায়, তখন সে দেখে সামনে থেকে একটা গাড়ি আসছে। গাড়িটা আসার আগে সে ডান দিকে যেতে পারবে কি পারবে না - এ হিসেব নিকেশগুলো সে খাতা-কলম নিয়ে লিখে লিখে করে, নাকি ব্রেনের মধ্যে করে? তাতে এটাই প্রমাণ হয় যে, কম্পিউটার জগতের বাদশাহ বিল গেটসের সবচেয়ে বড় আবিষ্কারও ব্রেনের কাছে কিছু না। এই শিশুর মস্তিস্ক পাওয়ারফুল বেশি নাকি বিলগেটসের কম্পিউটার? ইসলামের পক্ষে কত কথা, আমাদের খবর নেই।

আল্লাহ তাআলার কুদরত বিষয়ে এই আয়াতটা নিয়ে খুব আলোচনা হয়,

 وَالسَّمَاءَ بَنَيْنَاهَا بِأَيْدٍ وَإِنَّا لَمُوسِعُوْنَ ৫১

‘আকাশকে আমি বানিয়েছি আমার হাতে। আমি এর সম্প্রসারণকারী।’ -...  এখানে مُوْسِعُوْنَ মানে সম্প্রসারণকারী। সৌদি আরব থেকে প্রকাশিত কুরআনের ইংরেজি তরজমা দেখলে এ আয়াতের অর্থ পাওয়া যায়, And the sï, I created it with my Hands and certainly I am the expander thereof. বলার ভঙ্গিটা কি! এ আয়াতের ব্যাপারে মুসলমান বিজ্ঞানীরা বলেন, স্পেস (Space) আমাদের থেকে কতটুকু দূরে? তোমার আমার ফাঁকা জায়গাটা স্পেস। আমরা পুরো স্পেসের মধ্যে আছি। এখন এই স্পেস উপরে কত দূর পর্যন্ত আছে? চাঁদ হল পৃথিবীর নিকটতম প্রতিবেশী। দূরত্ব ২৩৮০০০ মাইল। ব্যাস কত? ২১৬০ মাইল। পৃথিবীর ব্যাস প্রায় ৮০০০ মাইল। সূর্যের ব্যাস ৮৬৫০০০ মাইল। সুবহানাল্লাহ। কুরআন শরীফে কত জায়গায় আছে, সূরা নাবার মধ্যে আল্লাহ বলছেন,

 وَجَعَلْنَا سِرَاجًا وَهَّاجًا

‘আমি তোমাদেরকে একটা গনগনে সূর্য দিয়েছি।’ কেমন গনগনে? পৃথিবীর ব্যাস প্রায় ৮০০০ মাইল। সূর্যের ব্যাস ৮৬৫০০০ মাইল। ভেতরে জায়গা বেশি কার? পৃথিবীর তুলনায় সূর্যের ভেতরের জায়গা তের লক্ষ গুণ বেশি। কী অবস্থা হয় তাতে? সারা দুনিয়ার আলো ও তাপের প্রয়োজন আল্লাহ তাআলা এক সূর্য দিয়ে পূরণ করেন। সূর্যকে যদি আমরা একটা ফুটবল মনে করি, তাহলে এই মসজিদের এক কোণায় সূর্য, আরেক কোণায় একটা সর্ষে দানার মত পৃথিবী। সূর্যের আলো চারিদিকে ছড়াচ্ছে। পৃথিবী এ আলোর কতটুকু পায়? বৈজ্ঞানিকভাবে এটারও হিসেব করা হয়েছে। সূর্যের আলোর দু’শ কোটি ভাগের এক ভাগ পায় সারা পৃথিবী। পৃথিবীর মধ্যে সবচেয়ে ছোট একটা দেশ হচ্ছে বাংলাদেশ। এখানে ভরদুপুরে যদি কাউকে খালি গায়ে দাঁড় করিয়ে রাখা হয়, তাহলে তার কেমন লাগবে? কি বানিয়েছেন আল্লাহ তা’আলা! সুবহানাল্লাহ! এরপরের কথা আরো অদ্ভুত। স্পেসে কী আছে?

দূরবীক্ষণ যন্ত্র দিয়ে দেখা যায়, লক্ষ লক্ষ তারার মধ্যে নয়টা এমন আছে যারা তারা না। জমিন থেকেই বোঝা যায়। আজকাল পশ্চিম আকাশে দেখা যায়। কয়েকদিন পর সেটাকে আবার পূর্ব আকাশে দেখা যাবে। এখন মাগরিবের পর দেখা যায়। কুরআন শরীফে আছে, النجم الثاقب ঐটার আলোকশক্তি বিদীর্ণকারী। সূর্য হল বিদীর্ণকারী তারকা। সূর্য ডোবার পর পশ্চিমাকাশে যেটাকে দেখা যায়, সেটা হল একটা গ্রহ। ইংরেজিতে সেটার নাম হল ভেনাস (Venus)। বাংলায় বলে শুক্র গ্রহ। সেটার অবস্থানের কারণে পৃথিবী থেকে কয়েকমাস পূর্বাকাশে দেখা যায়। সূর্য উঠে যাওয়ার পরও অনেকক্ষণ থাকে। তখন সেটাকে বলে মর্নিং স্টার (Morning Star, প্রভাতি তারা)। আবার কয়েকমাস পশ্চিমাকাশে থাকে। তখন সেটাকে বলে ইভিনিং স্টার (Evening Star, সন্ধ্যা তারা)। পৃথিবী থেকে তার দূরত্ব কয়েক কোটি মাইল। এভাবে পৃথিবীর নিকটতম তারার দূরত্ব কত? সূর্য একটা তারা। এর দূরত্ব নয় কোটি তিরিশ লক্ষ মাইল। আলোর গতি হচ্ছে প্রতি সেকেণ্ডে ১৮৬০০০ মাইল। আর শব্দের গতি হল প্রতি ঘণ্টায় ৮০০ মাইল। সেকেণ্ডে ১১৫০ ফুট।

আমরা এখন মোবাইলে আমেরিকায় কথা বলি। এখানে কিন্তু শব্দকে শব্দের গতিতে পাঠানো হয় না। শব্দটাকে প্রথমে মাইক্রোফোনের মধ্যে বিজলীর গতিতে রূপান্তরিত করা হয়। বিজলীর গতিতে শব্দটা আমেরিকায় যায়। সেখানে বিজলীর গতি থেকে শব্দটা আবার শব্দের গতিতে ফিরে আসে। শব্দের গতিতে গেলে তো ৮০০ মাইল যেতে এক ঘণ্টা লাগবে। আমেরিকা ১২০০০ মাইল দূরে। কয় ঘণ্টা লাগবে শব্দ কানে পৌঁছতে? আপনি এ প্রান্ত থেকে বললেন, ‘হ্যালো কেমন আছেন?’ এই হ্যালো শব্দের গতিতে গেলে অপর প্রান্তে পৌছবে কয়েকদিন পর। এটা আল্লাহ পাকের একটা কুদরত!

শব্দের গতি অনেক কম। শব্দকে আমরা মাইক্রোফোনের মাধ্যমে বিজলী বানাই। এরপর ১৮৬০০০ মাইল গতিতে পাঠাই। কত নেয়ামতের ছড়াছড়ি! এ গতিতে চললেও সূর্যের আলো পৃথিবীতে আসতে সময় লাগে সাড়ে আট মিনিট। সূর্যের পরের যে নক্ষত্র, সেটার নাম প্রক্সিমা সেঞ্চুরি (Proxima Centauri)। সেখান থেকে আলো আসতে সাড়ে চার বছর লাগে। কত সুবহানাল্লাহ বলবেন!

অনেকগুলো তারকা নিয়ে আমাদের তারকাজগত। এ জগতের একজন সদস্য সূর্য। আরেকজন সদস্য হচ্ছে প্রক্সিমা সেঞ্চুরিই। এরকম সদস্য আরো কতজন আছে? দশ হাজার কোটি। সুবহানাল্লাহ। এখন যদি কেউ এই মসজিদের সামনে খোলা আকাশে উপরের দিকে যেতে পারে, তাহলে কত দূর পর্যন্ত সে যেতে পারবে? একশ কোটি বছর আলোর গতিতে চললেও এমন কোনো জায়গা পাওয়া যাবে না, যেখানে লেখা আছে, এটা আকাশের সীমানা। কত সুবহানাল্লাহ বলবেন!

কতদূর অগ্রগতি হয়েছে? আগে মহাকাশ সম্পর্কে কোন ধারণাই ছিল না। এখন ধারণা হয়েছে। আলোর গতিতে একশ কোটি বছর চললেও তুমি আকাশের কোন সীমানা পাবে না। মহাকাশ সম্পর্কে শুনে আমরা কতবার সুবহানাল্লাহ বলব। রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওযসাল্লাম হযরত জুয়াইরিয়া রা.-এর মাধ্যমে আমাদেরকে শিখিয়ে রেখেছেন,

 سُبْحَانَ اللهِ وَبِحَمْدِهِ عَدَدَ خَلْقِهِ

কত বার সুবহানাল্লাহ বলব, এটা আল্লাহর উপর ছেড়ে দিলাম। সুবহানাল্লাহ কত বার?   عَدَدَ خَلْقِهِ তার সৃষ্টি সংখ্যা বরাবর। আল্লাহু আকবার!

বর্তমান যুগের একজন বিখ্যাত বিজ্ঞানী হচ্ছেন স্টিফেন হকিং (Stephen Hawking)। A Brief History of Time বইটা তার লেখা। এখনো জীবিত আছেন। পুরোপুরি অচল। হাত-পা বাঁকা। কথাও বলতে পারে না। হুইল চেয়ারে চলাফেরা করানো হয়। চরম পর্যায়ের লুলা, বোবা। কিন্তু আল্লাহ পাক তাকে এ অবস্থায় রাখার পরও তাকে দিয়ে অনেক কাজ নিচ্ছেন। বিজ্ঞানের জগতে তিনি একজন মহাপুরুষ। মহাকাশ সম্পর্কে অনেক তথ্য তিনি এ বইয়ে জমা করেছেন। আল্লাহপাক নিজে বলেছেন,

أَفَلَمْ يَنْظُرُوا إِلَى السَّمَاءِ فَوْقَهُمْ كَيْفَ بَنَيْنَاهَا وَزَيَّنَّاهَا  وَمَا لَهَا مِنْ فُرُوْجٍ ৫

‘তারা কি তাদের মাথার উপরে আকাশের দিকে তাকিয়ে দেখে না কীভাবে আমি সেটিকে বানিয়েছি এবং কীভাবে সেটিকে সাজিয়েছি? তাতে কোনো ছিদ্র নেই।’ -... يَنْظُرُوا তো আমরা করিই। চিন্তাও করি। কিন্তু চিন্তার সামগ্রী কোথায়?

যাক, বিজ্ঞানের এসব আবিষ্কার কারা করেছে? বিজ্ঞানীরা। তারা কুরআন শরীফের এসব আয়াত নিয়ে গবেষণা ঠিকই করছে। কিন্তু বেশিরভাগেরই আল্লাহর নেক বান্দাদের সাথে মেলামেশা নেই। তাদের কাছে প্রশ্ন করলে তারা বোকা বনে যায়। আমি যে আয়াত আলোচনা করলাম,

 وَالسَّمَاءَ بَنَيْنَاهَا بِأَيْدٍ وَإِنَّا لَمُوسِعُوْنَ

‘আকাশকে আমি বানিয়েছি আমার হাতে। আমি এর সম্প্রসারণকারী।’-... তারপরের আয়াত হচ্ছে,

وَمِنْ كُلِّ شَيْءٍ خَلَقْنَا زَوْجَيْنِ لَعَلَّكُمْ تَذَكَّرُوْنَ فَفِرُّوْا إِلَى اللهِ ۖ إِنِّي لَكُمْ مِنْهُ نَذِيرٌ مُبِيْنٌ

‘প্রতিটি বস্তুকে আমি করেছি জোড়া জোড়া, যেন তোমরা চিন্তা কর। আল্লাহর দিকে পালাও। আমি তোমাদের জন্য তার কাছ থেকে আসা একজন প্রকাশ্য সতর্ককারী।’ -... আল্লাহর দিকে পলায়ন কর। Flee towards Allah| ঋষু মানে ওড়া। আর  ঋষবব মানে পলায়ন করা।

 فَفِرُّوْا إِلَى اللهِ

‘আল্লাহর দিকে পলায়ন কর’। কোথা থেকে কোথায় চলে গেলেন! আল্লাহপাকের আসল উদ্দেশ্য কী? কুরআন শরীফে আরেক জায়গায় আছে,

الَّذِينَ يَذْكُرُوْنَ اللهَ قِيَامًا وَقُعُوْدًا وَ عَلٰى جُنُوْبِهِمْ وَيَتَفَكَّرُوْنَ فِي خَلْقِ السَّمَاوَاتِ وَالْأَرْضِ رَبَّنَا مَا خَلَقْتَ هَذَا بَاطِلًا سُبْحَانَكَ فَقِنَا عَذَابَ النَّارِ

‘যারা দাঁড়িয়ে, বসে ও শুয়ে আল্লাহর স্মরণ করে এবং আকাশ ও পৃথিবীর সৃষ্টি সম্বন্ধে চিন্তা করে ও বলে, হে আমাদের প্রতিপালক! তুমি এসব নিরর্থক সৃষ্টি করনি। সকল পবিত্রতা তোমারই। তুমি আমাদের জাহান্নামের আগুন থেকে রক্ষা কর।’ -... এখানেও একই কথা। প্রথমে বলেছেন, ‘তুমি এসব নিরর্থক সৃষ্টি করনি। সকল পবিত্রতা তোমারই।’ তারপর, ‘তুমি আমাদের জাহান্নামের আগুন থেকে রক্ষা কর।’ কোত্থেকে কোথায় চলে গেলেন! একজায়গায় বলেছেন, فَفِرُّوْا إِلَى اللهِ - ‘আল্লাহর দিকে পলায়ন কর।’ আরেক জায়গায় বলেছেন, فَقِنَا عَذَابَ النَّارِ - ‘তুমি আমাদের জাহান্নামের আগুন থেকে রক্ষা কর।’- ... আল্লাহ পাকের আসল উদ্দেশ্য কী। আল্লাহর যিকির। আল্লাহ তা’আলা আমাদেরকে উত্তম নেক আমলের তাওফীক নসীব করুন। 

[মারকাযুদ দাওয়াহ আলইসলামিয়া  মসজিদ, হযরতপুর, কেরাণীগঞ্জ]

১৮.১১.১৪৩৫ হিজরী ১৪.০৯.২০১৪ ঈসায়ী

টীকা

1 A person who believes that God created the universe and then abandoned it, assuming no control over life, exerting no influence on natural phenomena and giving no supernatural revelation.

২ বইটার নাম বেসিক প্রিন্সিপ্যাল্স অব ইসলাম (Basic Principles of Islam, ইসলামের মৌলিক নীতিসমূহ)। ইসলামিক ইনফরমেশন সার্ভিস, অকল্যান্ড থেকে প্রকাশিত।

8
 বর্তমানে আমাদের দেশে গায়রে মুকাল্লেদগণ ফাতওয়া দিয়ে বেড়াচ্ছে যে, ‘‘সহীহ বুখারীর মাঝে আছে ফিতরা দিতে হবে গম, খেজুর, কিসমিস, পনীর ইত্যাদি খাদ্য দ্রব্য দিয়ে। টাকা দিয়ে আদায় করলে আদায় হবে না!!’’
তাদের এই দাবি সম্পূর্ণ ভিত্তিহীন।
❏ তাছাড়াও ইমাম বুখারী (রহ.), ইবনে আবী শায়বা (রহ.) ও বায়হাকি (রহ.) বলেন, টাকা দিয়ে ফিতরা দিলে আদায় হয়ে যাবে। নিম্মে দেখুন বিস্তারিত....

❀❖ (০১) যদি গম, কিসমিস, পনীর ইত্যাদি খাদ্য দ্রব্য দিয়ে ফিতরা আদায় করে, তাহলে হয়ে যাবে। তার দলীল বুখারী থেকে-
صحيح البخاري (2/ 130)
1503 - حَدَّثَنَا يَحْيَى بْنُ مُحَمَّدِ بْنِ السَّكَنِ، حَدَّثَنَا مُحَمَّدُ بْنُ جَهْضَمٍ، حَدَّثَنَا إِسْمَاعِيلُ بْنُ جَعْفَرٍ، عَنْ عُمَرَ بْنِ نَافِعٍ، عَنْ أَبِيهِ، عَنِ ابْنِ عُمَرَ رَضِيَ اللَّهُ عَنْهُمَا، قَالَ: «فَرَضَ رَسُولُ اللَّهِ صَلَّى اللهُ عَلَيْهِ وَسَلَّمَ زَكَاةَ الفِطْرِ صَاعًا مِنْ تَمْرٍ، أَوْ صَاعًا مِنْ شَعِيرٍ عَلَى العَبْدِ وَالحُرِّ، وَالذَّكَرِ وَالأُنْثَى، وَالصَّغِيرِ وَالكَبِيرِ مِنَ المُسْلِمِينَ، وَأَمَرَ بِهَا أَنْ تُؤَدَّى قَبْلَ خُرُوجِ النَّاسِ إِلَى الصَّلاَةِ»
__________
[تعليق مصطفى البغا]
(فرض) أوجب أو قدر.
❐ অর্থ : হযরত ইবনে উমর (রা.) থেকে বর্ণিত, তিনি বলেন, প্রত্যেক গোলাম, আযাদ, পুরুষ, নারী, প্রাপ্ত বয়স্ক, অপ্রাপ্ত বয়স্ক মুসলিমের উপর রাসূলুল্লাহ (সা.) زَكَاةَ الفِطْرِ সাদকাতুল ফিতর হিসাবে খেজুর হোক অথবা যব হোক এক সা’ পরিমাণ আদায় করা আবশ্যক করেছেন এবং লোকজনের ঈদের সালাতে বের হওয়ার পূর্বেই তা আদায় করার নির্দেশ দিয়েছেন। বুখারী-২/১৩১, হাদীস-১৫০৬।
صحيح البخاري (2/ 131)
1506 - حَدَّثَنَا عَبْدُ اللَّهِ بْنُ يُوسُفَ، أَخْبَرَنَا مَالِكٌ، عَنْ زَيْدِ بْنِ أَسْلَمَ، عَنْ عِيَاضِ بْنِ عَبْدِ اللَّهِ بْنِ سَعْدِ بْنِ أَبِي سَرْحٍ العَامِرِيِّ، أَنَّهُ سَمِعَ أَبَا سَعِيدٍ الخُدْرِيَّ رَضِيَ اللَّهُ عَنْهُ، يَقُولُ: «كُنَّا نُخْرِجُ زَكَاةَ الفِطْرِ صَاعًا مِنْ طَعَامٍ، أَوْ صَاعًا مِنْ شَعِيرٍ، أَوْ صَاعًا مِنْ تَمْرٍ، أَوْ صَاعًا مِنْ أَقِطٍ، أَوْ صَاعًا مِنْ زَبِيبٍ»
❐ অর্থ : হযরত আবূ সাঈদ খুদরী(রা.) থেকে বর্ণিত, তিনি বলেন, আমরা এক সা’ পরিমাণ খাদ্য অথবা এক সা’ পরিমাণ যব অথবা এক সা’ পরিমাণ খেজুর অথবা এক সা’ পরিমাণ পনির অথবা এক সা’ পরিমাণ কিসমিস দিয়ে زَكَاةَ الفِطْرِ সাদাকাতুল ফিতর আদায় করতাম। বুখারী-২/১৩১, হাদীস-১৫০৬।

✏ উল্লেখ্য যে, উক্ত দুটি হাদীস দ্বারা একথা স্পষ্ট যে, কোন ব্যক্তি চাইলে মাল দ্বারা সাদাকাতুল ফিতর আদায় করতে পারবে। কিন্তু টাকা দ্বারা আদায় করা ভুল এধরনের কোন আলোচনা নেই।

❖ আর زَكَاةَ الفِطْرِ সাদাকায়ে ফিতর হলো ওয়াজিব। এখন প্রশ্ন জাগে তাহলে ইমাম বুখারী অনুচ্ছেদের মাঝে ফরয শব্দ ব্যবহার করেছেন আর হাদীসের মাঝেও ফরয শব্দ এসেছে, তাহলে ওয়াজিব কোথা থেকে আসলো?

❖ তার উত্তরে বলা হবে, ইমাম বুখারী (রহ.) এর নিকট ওয়াজিব আর ফরয দুটি এক। তার একটি জ্বলন্ত প্রমাণ হলো ইমাম বুখারী তার সহীহ বুখারীর মাঝে এক অনুচ্ছেদ এভাবে বলেন- باب وجوب الحج অর্থাৎ এ অনুচ্ছেদ হজ্ব ওয়াজিব হওয়া সম্পর্কে! (অথচ আমরা সকলেই জানি হজ্ব ফরয। তাহলে ইমাম বুখারী ওয়াজিব বললেন কেন? তার জবাব হলো ইমাম বুখারীর নিকট ফরয ও ওয়াজিব একই) ।
আর হাদীসের মাঝে ফরয শব্দ ব্যবহার হলেই সর্ব স্থালে তার দ্বারা ফরয উর্দ্দেশ্য নয়। কেননা হাদীসের পরিভাষা দেখলে দেখা যায় ফরয শব্দটি কখনো أوجب قدر عين بين অথাৎ ওয়াজিব, নির্ধারণ, বর্ণনা, ব্যাখ্যা ইত্যাদি অর্থেও প্রয়োগ হয়। (অতএব ফরযের দাবী করে উত্তাল হয়ে যাওয়ার সুযোগ কোথায়?) দেখুন নিম্মে তার কিছু দৃষ্টান্ত-
صحيح البخاري (5/ 63)
3912 - حَدَّثَنَا إِبْرَاهِيمُ بْنُ مُوسَى، أَخْبَرَنَا هِشَامٌ، عَنِ ابْنِ جُرَيْجٍ، قَالَ: أَخْبَرَنِي عُبَيْدُ اللَّهِ بْنُ عُمَرَ، عَنْ نَافِعٍ، عَنْ عُمَرَ بْنِ الخَطَّابِ رَضِيَ اللَّهُ عَنْهُ قَالَ: كَانَ فَرَضَ لِلْمُهَاجِرِينَ الْأَوَّلِينَ أَرْبَعَةَ آلَافٍ فِي أَرْبَعَةٍ، وَفَرَضَ لِابْنِ عُمَرَ ثَلَاثَةَ آلَافٍ وَخَمْسَ مِائَةٍ، فَقِيلَ لَهُ هُوَ مِنَ المُهَاجِرِينَ فَلِمَ نَقَصْتَهُ مِنْ أَرْبَعَةِ آلاَفٍ، فَقَالَ: " إِنَّمَا هَاجَرَ بِهِ أَبَوَاهُ يَقُولُ: لَيْسَ هُوَ كَمَنْ هَاجَرَ بِنَفْسِهِ "
__________
[تعليق مصطفى البغا]
[ ش (فرض) عين من مال بيت المال.
صحيح البخاري (6/ 156)
{قَدْ فَرَضَ اللَّهُ لَكُمْ تَحِلَّةَ أَيْمَانِكُمْ، وَاللَّهُ مَوْلاَكُمْ وَهُوَ العَلِيمُ الحَكِيمُ} [التحريم: 2]
__________
[تعليق مصطفى البغا]
[ ش (فرض) بين.
সহীহ বুখারী-৫/৬৩, হাদীস-৩৯১২, সহীহ বুখারী-৬/১৫৬।

❀❖ (০২) ‘‘ফিতরা’’ টাকা দ্বারা আদায় করলেও আদায় হয়ে যাবে। তার দলীল-
مصنف ابن أبي شيبة (2/ 398)
فِي إِعْطَاءِ الدَّرَاهِمِ فِي زَكَاةِ الْفِطْرِ
10371 - حَدَّثَنَا أَبُو أُسَامَةَ، عَنْ زُهَيْرٍ، قَالَ: سَمِعْتُ أَبَا إِسْحَاقَ، يَقُولُ: «أَدْرَكْتُهُمْ وَهُمْ يُعْطُونَ فِي صَدَقَةِ رَمَضَانَ الدَّرَاهِمَ بِقِيمَةِ الطَّعَامِ»
অর্থ : হযরত যুহাইর (রহ.) থেকে বর্ণিত। তিনি বলেন, আমি আবূ ইসহাক (রহ.) থেকে শুনেছি যে, তিনি বলেছেন, আমি সাহাবায়ে কেরাম (রা.) কে এই অবস্থায় পেয়েছি যে, তারা রমজানে সাদাকায়ে ফিতর খাবারের বিনিময়ে টাকা দ্বারা আদায় করতেন। ইবনে আবি শায়বা-২/৩৯৮, হাদীস-১০৩৭১। এটির সনদ সম্পূর্ণ সহীহ তথা প্রমাণযোগ্য।

✏ তেমনি ভাবে ইবনে আবী শায়বার মাঝে টাকা দ্বারা সাদাকায়ে ফিতর আদায় করার ব্যাপারে রয়েছে হযরত হাসান বসরী (রহ.) এর আসার-
مصنف ابن أبي شيبة (2/ 398)
10370 - حَدَّثَنَا وَكِيعٌ، عَنْ سُفْيَانَ، عَنْ هِشَامٍ، عَنِ الْحَسَنِ، قَالَ: «لَا بَأْسَ أَنْ تُعْطِيَ الدَّرَاهِمَ فِي صَدَقَةِ الْفِطْرِ»
অর্থ : হযরত হাসান বসরী (রহ.) বলেন, টাকা দ্বারা সাদাকায়ে ফিতর আদায় করার দ্বারা কোন সমস্যা নেই। ইবনে আবি শায়বা-২/৩৯৮, হাদীস-১০৩৭০।

✏ অনুরুপ ভাবে রয়েছে এ বিষয়ে হযরত ওমর (রা.) এর পক্ষ থেকে হযরত ওমর বিন আব্দুল আযীয (রহ.) এর প্রতি চিঠি-
مصنف ابن أبي شيبة (2/ 398)
10369 - حَدَّثَنَا وَكِيعٌ، عَنْ قُرَّةَ، قَالَ: جَاءَنَا كِتَابُ عُمَرَ بْنِ عَبْدِ الْعَزِيزِ فِي صَدَقَةِ الْفِطْرِ «نِصْفُ صَاعٍ عَنْ كُلِّ إِنْسَانٍ أَوْ قِيمَتُهُ نِصْفُ دِرْهَمٍ»
ইবনে আবি শায়বা-২/৩৯৮, হাদীস-১০৩৬৯।

✏ এছাড়াও বিখ্যাত ইমাম, ইমাম ইবনে আবী শায়বা তার রচিত কিতাব ইবনে আবি শায়বা-২/৩৯৮ এর মাঝে এই ভাবে অনুচ্ছেদ স্থাপন করেন যে- فِي إِعْطَاءِ الدَّرَاهِمِ فِي زَكَاةِ الْفِطْرِ অর্থাৎ সাদাকায়ে ফিতর টাকা দ্বারা আদায় করার (বৈধতা) সম্পর্কে।

✏ আর ইমাম বায়হাকী (রহ.) তার রচিত কিতাব সুনানুল কুবরা-৪/১৮৯ এর মাঝে এই ভাবে অনুচ্ছেদ স্থাপন করেন যে--بَابُ مَنْ أَجَازَ أَخْذَ الْقِيَمِ فِي الزَّكَوَاتِ. অথাৎ এই অনুচ্ছেদ হলো টাকা দ্বারা যাকাত আদায় করা অনুমোদিত।

✏ তাছাড়াও রাসূল (সা.) এর যুগেও زَكَاةَ الفِطْرِ ও زكوة ইত্যাদি টাকা দ্বারা আদায় করা হতো। তার কিছু প্রমাণ নিম্মে পেশ করা হলো-
صحيح البخاري (2/ 116)
وَقَالَ طَاوُسٌ: قَالَ مُعَاذٌ رَضِيَ اللَّهُ عَنْهُ لِأَهْلِ اليَمَنِ: «ائْتُونِي بِعَرْضٍ ثِيَابٍ خَمِيصٍ - أَوْ لَبِيسٍ - فِي الصَّدَقَةِ مَكَانَ الشَّعِيرِ وَالذُّرَةِ أَهْوَنُ عَلَيْكُمْ وَخَيْرٌ لِأَصْحَابِ النَّبِيِّ صَلَّى اللهُ عَلَيْهِ وَسَلَّمَ بِالْمَدِينَةِ» وَقَالَ النَّبِيُّ صَلَّى اللهُ عَلَيْهِ وَسَلَّمَ: وَأَمَّا خَالِدٌ فَقَدِ احْتَبَسَ أَدْرَاعَهُ وَأَعْتُدَهُ فِي سَبِيلِ اللَّهِ " وَقَالَ النَّبِيُّ صَلَّى اللهُ عَلَيْهِ وَسَلَّمَ: «تَصَدَّقْنَ وَلَوْ مِنْ حُلِيِّكُنَّ» فَلَمْ يَسْتَثْنِ صَدَقَةَ الفَرْضِ مِنْ غَيْرِهَا، فَجَعَلَتِ المَرْأَةُ تُلْقِي خُرْصَهَا وَسِخَابَهَا، وَلَمْ يَخُصَّ الذَّهَبَ وَالفِضَّةَ مِنَ العُرُوضِ "
সহীহ বুখারী-২/১১৬।

✏ উল্লেখ্য যে, সাদাকায়ে ফিতর টাকা দ্বারা আদায় করা যাবে এটি ইমাম বুখারী (রহ.) এরও উক্তি-
فتح الباري لابن حجر (3/ 312)
(قَوْلُهُ بَابُ الْعَرْضِ فِي الزَّكَاةِ)
أَيْ جَوَازُ أَخْذِ الْعَرْضِ وَهُوَ بِفَتْحِ الْمُهْمَلَةِ وَسُكُونِ الرَّاءِ بَعْدَهَا مُعْجَمَةٌ وَالْمُرَادُ بِهِ مَا عَدَا النَّقْدَيْنِ قَالَ بن رَشِيدٍ وَافَقَ الْبُخَارِيُّ فِي هَذِهِ الْمَسْأَلَةِ الْحَنَفِيَّةَ مَعَ كَثْرَةِ مُخَالَفَتِهِ لَهُمْ لَكِنْ قَادَهُ إِلَى ذَلِكَ الدَّلِيلُ ......الخ
.....আল্লামা ইবনু রাশীদ (রহ.) বলেন, উক্ত মাসয়ালাটির মাঝে ইমাম বুখারী (রহ.) হানাফীদের সহমত পোষন করেছেন....। ফাতহুল বারী লি ইবনে হাজার-৩/৩১২।

✏ এ বিষয়ে আহমদ আল গুমারী (রহ.) এর আরবী ভাষায় ১৫০ পৃষ্ঠায় ‘‘تحقيق الامال فى فى اخراج زكوة الفطر بالمال’’ নামে একটি গুরুত্বপূর্ণ পুস্তিকা রচনা করেছেন। যা সকলকে পড়ে রাখা আবশ্যক। (আমার কাছে পুস্তিকাটি রয়েছে কারো প্রয়োজন হলে বলবেন)।
এ বিষয়ে আরো দেখুন- বাদায়েউস সানায়ে-২/৯৬৯, আল মাবসুত লিসসারাখসী-৩/১১৩ ইত্যাদি।

✔মহান আল্লাহ তায়ালা আমাদেরকে ফেৎনা সৃষ্টি না করে সঠিক দ্বীন বুঝে আমল করার তাওফীক দান করুন। আমীন

✍ ইতি মুফতী মো. ছানা উল্লাহ

9
অজ্ঞ লোকেরা কবরে সিজদা করে,কবরের তাওয়াফ করে,এর চৌকাঠে চুমু খায়-এই সকল কর্মকাণ্ড শরীয়তে না-জায়েয। আমাদের আহলুস সুন্নাহ ওয়াল জামাআর ইমামগণ এসব কাজকে স্পষ্ট ভাষায় হারাম ও না-জায়েয বলেছেন। কারণ তাওয়াফ,সিজদা,রুকু,হাত বেঁধে দাঁড়ানো-এইগুলো ইবাদত-উপাসনার বিভিন্ন রূপ। আমাদের শরীয়ত কবরের এরূপ সম্মানের অনুমতি দেয়নি,যা পূজা ও উপাসনার পর্যায়ে পৌঁছয়।

নবী সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম জানতেন,আগের উম্মতের পথভ্রষ্টতার কারণ ছিল অতিশয়তা। তাই তিনি আপন উম্মতকে এসকল কার্যকলাপ থেকে বেঁচে থাকার তাকীদ করে গেছেন।

উম্মুল মুমিনীন আয়েশা সিদ্দীকা রা. বলেন,নবী সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম তাঁর অন্তিম দিনগুলোতে বলেছেন-

لعن الله اليهود والنصارى، اتخذوا قبور أنبياءهم مساجد

ইয়াহুদ ও নাসারার উপর আল্লাহ অভিশাপ। ওরা ওদের নবীগণের কবরসমূহকে সিজদাগাহ বানিয়েছে। -সহীহ বুখারী, হাদীস ১৩৯০; সহীহ মুসলিম, হাদীস ৫২৯

অন্য হাদীসে ইরশাদ হয়েছে,

ألا وإن من كان قبلكم كانوا يتخذون قبور أنبياءهم وصالحيهم مساجد. ألا فلا تتخذوا القبور مساجد، إني أنهاكم عن ذلك .

 তোমাদের আগের লোকেরা নিজেদের নবী-ওলীগণের কবরকে সিজদাগাহ বানাতো। সাবধান! তোমরা যেন কবরকে সিজদার জায়গা বানাবে না। আমি তোমাদের নিষেধ করে যাচ্ছি। -সহীহ মুসলিম, হাদীস ৫৩২/২৩; মিশকাত পৃ. ৬৯

আরেক হাদীসে আছে-

اللهم لا تجعل قبري وثنا يعبد، اشتد غضب الله على قوم اتخذوا قبور أنبياءهم مساجد.

ইয়া আল্লাহ! আমার কবরকে ‘মূর্তি’তে পরিণত কোরেন না, যার পূজা অর্চনা হবে! ঐ জাতির উপর আল্লাহ চরম ক্রুদ্ধ, যারা নিজেদের নবীর কবরকে সিজদাগাহ বানায়। -মুয়াত্তা মালেক, হাদীস ৮৫

সাহাবী কায়স ইবনে সা‘দ রা. বলেন, আমি ‘হীরা’ গিয়েছিলাম। ওখানে দেখলাম, লোকেরা তাদের সর্দারকে সিজদা করে। আমি মনে মনে বললাম, আল্লাহর রাসূল সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লামই তো সিজদা পাওয়ার বেশি উপযুক্ত! আমি যখন তাঁর কাছে এলাম আমার ধারণা তাঁকে জানালাম। তিনি বললেন-

أ رأيت لو مررت بقبري أ كنت تسجد له

বল তো তুমি যদি আমার কবরের কাছ দিয়ে গমন করতে তাকে কি সিজদা করতে?

আমি বললাম, لا

‘জি না’

তিনি বললেন -

لا تفعلوا لو كنت آمرا أحدا أن يسجد لأحد لأمرت النساء أن يسجدن لأزواجهن لما جعل الله لهم عليهن من حق

(জীবিত অবস্থায়ও সিজদা) করো না। আমি যদি কাউকে আদেশ করতাম কোনো মাখলুককে সিজদা করার তাহলে নারীদের আদেশ করতাম যেন নিজের স্বামীদের সিজদা করে। স্বামীর ঐ হকের কারণে, যা আল্লাহ স্ত্রীর উপর আরোপ করেছেন। -সুনানে আবু দাউদ, হাদীস ২১৪০; মুসতাদরাকে হাকেম, হাদীস ২৭৬৩; সুনানে কুবরা, বায়হাকী, হাদীস ১৪৭০৫

চিন্তা করে দেখুন, নবী সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম নিজ উম্মতের ব্যাপারেও কবর-পূজার আশঙ্কা কত গভীরভাবে করেছেন! ফলে কত স্পষ্টভাষায় তা নিষেধ করেছেন! কবরে সিজদাকারীকে অভিশাপ করেছেন এবং ঐ কবরকে وثنا ‘মূর্তি’ বলে আখ্যায়িত করেছেন! এ গর্হিত কর্মকে আল্লাহর ক্রোধ প্রজ্বলিত হওয়ার কারণ সাব্যস্ত করেছেন!

এই সকল হাদীসের কারণে আহলুস সুন্নাহ ওয়াল জামাআর আলিমগণের সিদ্ধান্ত, কবরে সিজদা করা ‘শিরকে জলী’ (প্রকাশ্য শিরক)।

 মোল্লা আলী ক্বারী রাহ.  لعن الله اليهود والنصارى (ইয়াহুদ-নাসারার উপর আল্লাহর অভিশাপ)-এর ব্যাখ্যায় বলেছেন, ‘ইয়াহুদ ও নাসারার উপর অভিশাপ হওয়ার কারণ হয়ত এই যে, নবীগণের ভক্তি-সম্মানার্থে ওরা তাঁদের কবরে সিজদা করত। এটা শিরকে জলী। কিংবা এই যে, ওরা নবীগণের সমাধিতে আল্লাহ তাআলার জন্যই নামায পড়ত। তবে নামাযে কবরের দিকে মুখ করত ও তার উপর সিজদা করত। ওদের ধারণা ছিল, ওরা একসাথে দু’টি পুণ্যের কাজ করছে- আল্লাহর ইবাদত এবং নবীগণের চ‚ড়ান্ত সম্মান। এটা শিরকে খফী। প্রচ্ছন্ন র্শিক। কারণ এতে মাখলুকের এমন তাজিম আছে, যার অনুমতি নেই। সুতরাং নবী সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম নিজ উম্মতকে এ কাজ করতে নিষেধ করেছেন হয়ত এ কারণে যে, এটা ইহুদীদের সাথে সামঞ্জস্যপূর্ণ কাজ কিংবা একারণে যে, এতে ‘শিরকে খফী’ (প্রচ্ছন্ন শিরক) রয়েছে। -মিশকাতুল মাসাবীহ, টীকা পৃ. ৬৯

হযরত শাহ ওলিউল্লাহ মুহাদ্দিসে দেহলভী রাহ. ‘আলফাউযুল কাবীর’ কিতাবে বলেন, তোমরা যদি মুশরিকদের আকীদা-আমলের পূর্ণ ছবি দেখতে চাও তাহলে এ যুগের আওয়াম ও জাহিলদের দেখ, ওরা মাযারে-মাযারে এবং নিদর্শনের স্থানসমূহে কত ধরনের শিরকে কীভাবে লিপ্ত হয়! অতীতের এমন কোনো বিপদ নেই যাতে এ যুগের কোনো না কোনো গোষ্ঠী অনুরূপ বিশ্বাস নিয়ে লিপ্ত হয়নি। এহেন আমল-আকীদা থেকে খোদা তাআলা আমাদের রক্ষা করুন।

হযরত কাযী ছানাউল্লাহ পানিপথী রাহ. বলেন-

  سجدہ کردن سوۓ قبور اولياء وطواف گرد قبور کردن ودعا از آنہا خواستن و نذر براۓ آنہا قبول کردن  حرامست، بلکہ چيزہا  ازاں بکفر میر ساند۔ پیغمبر صلی اللہ علیہ وسلم برآنہا لعنت گفتہ، وازاں منع فرمودند، وگفتہ قبر مرا بت نہ کنند

অর্থ, ওলীদের কবরে সিজদা করা, কবরের তাওয়াফ করা, তাদের কাছে প্রার্থনা করা, তাদের জন্য মান্নত গ্রহণ করা হারাম। এসবের অনেক কিছুই কুফর পর্যন্ত পৌঁছে দিয়ে থাকে। আল্লাহর রাসূল সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়সাল্লাম এসবের উপর অভিশাপ দিয়েছেন এবং এসব কাজে লিপ্ত হতে নিষেধ করেছেন। তিনি ইরশাদ করেছেন, আমার কবরকে মূর্তি বানিও না। (মা-লাবুদ্দা মিনহু পৃ. ৮৮)

ইরশাদুত তালিবীন, কিতাবে তিনি বলেন-

 وگرد قبور گردیدن جائز نیست کہ طواف بیت اللہ حکم نماز دارد، قال رسول اللہ صلی اللہ علیہ و سلم: طواف البیت صلوۃ ،طواف بیت اللہ حکم نماز دار .

অর্থ, ‘কবরের চারপাশে প্রদক্ষিণ করা জায়েয নয়। কারণ বাইতুল্লাহর তওয়াফ নামাযের হুকুম রাখে। নবী সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম বলেছেন, বাইতুল্লাহর তওয়াফ নামায।’

ফাতাওয়া আলমগীরীতে আছে-

 قال برهان الترجماني : لا نعرف وضع اليد على المقابر سنة ولا مستحسنا، ولا نرى به بأسا، وقال عين الأئمة الكرابيسي: هكذا وجدناه من غير نكير من السلف. وقال شمس الأئمة المكي: بدعة. كذا في القنية، ولا يمسح القبر ولا يقبله فإن ذلك من عا دة النصارى

বুরহান তুরজুমানী বলেন, আমরা কবরে হাত রাখাকে সুন্নতও মনে করি না, ভালো কাজও না। তবে কেউ হাত লাগালে গুনাহও মনে করি না। আইনুল আইম্মা কারাবীছি বলেন, ‘আমরা সালাফ থেকে এভাবেই কোনো আপত্তি ছাড়া পেয়েছি।’ শামসুল আইম্মা মক্কী বলেন, এ বিদআত। (কিনয়া) কবরে হাত বুলাবে না, চুমু খাবে না। কারণ এ খ্রিস্টানদের রীতি। (খ. ৫ পৃ. ৩৫১)

এ ফতোয়ার সারকথা এই যে,সুন্নত বা ভালো কাজ মনে না করলে কবরে হাত দিয়ে স্পর্শ করায় দোষ নেই। তবে হাত বুলানোকে বরকতের কারণ মনে করা, চুমু দেওয়া বিদআত। এটা সালাফে সালেহীনের তরীকা না, খ্রিস্টানদের রীতি।

হযরত মাওলানা ইউসুফ লুধিয়ানবী
(‘ইখতিলাফে উম্মত আওর সিরাতে মুস্তাকীম’ থেকে অনুবাদে : আবু মুহাম্মাদ)

10
একবার এক ওয়াজের মাহফিলে জনৈক বক্তার বয়ান শুনছিলাম। তিনি ইলমে দ্বীন ও ওলামায়ে কিরামের ফযীলত সম্পর্কে আলোচনা করছিলেন। কথায় বলে تتبين الأشياء بأضدادها  ‘যে কোনও বিষয় তার বিপরীতের দ্বারাই বেশি পরিষ্কার হয়’। আলো বোঝা যায় অন্ধকার দ্বারা এবং সাদা কালোর দ্বারা। সুতরাং ইলমে দ্বীন ও উলামায়ে কিরামের মাহাত্ম্য পরিষ্কার করার জন্য বক্তা একপর্যায়ে তার শ্রোতাদেরকে দুনিয়ার বিদ্যা ও আধুনিক বিদ্বানদের কাছে নিয়ে গেলেন এবং সেই পরিমণ্ডল যে কতটা কদর্য তা তাদেরকে চাক্ষুষ দেখিয়ে দেওয়ার চেষ্টা করলেন। শ্রোতামণ্ডলীও যেন তা দেখতে পেরে বেশ তৃপ্তি বোধ করলেন এবং বিভিন্ন ধ্বনি সহযোগে চোখ-মুখের ভঙ্গী দ্বারা সেই বোধের অভিব্যক্তি ঘটালেন।

বলাবাহুল্য, ওয়াজ মাহফিলেরও শ্রেণীভেদ আছে। কোন ঘরানার মাহফিল এবং বক্তা কে, অধিকাংশ শ্রোতার কাছে তা বিবেচ্য হয়ে থাকে। যে কোনও বক্তার ওয়াজ সাধারণত তার চিন্তা-চেতনা ও আকীদা-বিশ্বাসের সাথে যাদের মিল আছে তারাই শুনতে বেশি আগ্রহী হয়। স্বাভাবিকভাবেই তার বক্তব্যের সাড়াও তাদের মধ্যে বেশি পড়ে। কাজেই তাদের হর্ষধ্বনি দ্বারা এই সিদ্ধান্তে পৌঁছার অবকাশ নেই যে, মাহফিলের বাইরের আপামর সকলেও সেই বক্তব্যে আহ্লাদ বোধ করবে। তা নাই করুক- বক্তার তাতে কিছু যায় আসে না। উপস্থিত শ্রোতাদের বাহবা ধ্বনির ভেতরেই যেন তিনি সমস্ত গণমানুষের ঐকতান শুনতে পান। ফলে ক্রমবর্ধমান উৎসাহে সব সীমারেখা অতিক্রম করে চলে যান বহুদূর। যে বক্তার কথা বলেছি এমনটাই হয়েছিল তার বেলায়। বলা যায় তিনি তার বয়ানে শ্রোতামানসে এই অনুভ‚তি জন্মাতে সক্ষম হয়েছিলেন যে, আধুনিক শিক্ষা কিছু শিক্ষা নামেরই উপযুক্ত নয়। কিছুদিন আগে সদ্য কলম বাগানো এক তরুণের লেখায়ও এই ভাবনার ছাপ দেখতে পেলাম। তা পড়লে ধারণা জন্মায় মুসলিম সমাজে আধুনিক শিক্ষার কোনও প্রয়োজন নেই। এই শিক্ষায় শিক্ষিতদের দ্বারা সমাজের বিশেষ কল্যাণ হয় না।

তো দেখা যাচ্ছে ‘আলেম-উলামার একাংশ আধুনিক জ্ঞান-বিদ্যাকে ঘৃণার চোখে দেখে। তারা তাদের বয়ান ও লেখার মাধ্যমে সেই ঘৃণা প্রকাশও করে। তারা নিজেরা যেমন বিশ্বাস করে তেমনি অন্যদেরও বোঝানোর চেষ্টা করে এ জ্ঞান-বিদ্যা সম্পূর্ণ অপ্রয়োজনীয়;  বরং অত্যন্ত ক্ষতিকর।

আমার একথা উলামায়ে কিরামের একাংশ সম্পর্কে। সকলেই যে এরূপ মনোভাব পোষণ করেন তা নয়।[1]

আবার অন্যদিকে যারা আধুনিক শিক্ষা গ্রহণ করেন তাদের একটা বিরাট অংশ ইলমে দ্বীন ও উলামায়ে কিরাম সম্পর্কে নেতিবাচক মানসিকতার ধারক। তাদের বক্তৃতা-বিবৃতি ও লেখা-জোখায় এ ব্যাপারে কোনও রাখঢাক নেই। সব রকম প্রচার মাধ্যমে অত্যন্ত উৎকটভাবে তারা এ সম্পর্কে বিষোদ্গার করে থাকে। দেশের আপামর জনগণকে কিভাবে এ শিক্ষার প্রতি বীতশ্রদ্ধ করা যায়, কিভাবে সমাজ চোখে উলামায়ে কিরামকে হেয় প্রতিপন্ন করা যায় সে লক্ষ্যে তাদের চেষ্টা-কসরতের কোনও শেষ নেই। তারা নিরবচ্ছিন্নভাবে এই মেহনত করে যাচ্ছে এবং উত্তরোত্তর তাতে সফলতাও লাভ করছে। তাদের দিক থেকে এ তৎপরতা এমনই খোলামেলা বহুবিচিত্র ও নিত্যনবতর যা বিশদ বলার অবকাশ রাখে না। বলা যায় বর্তমানে এটা তাদের সর্বাপেক্ষা সুখকর বিনোদনক্রিয়া।

এ উভয় মনোভাবই সম্পূর্ণ বিপরীতমুখী দুই প্রান্তিকতা ও চরম একদেশদর্শিতা। অন্যসব বাড়াবাড়ির মতই এ বাড়াবাড়িও ব্যক্তি ও সমাজের জন্য অপূরণীয় ক্ষতির কারণ হয়েছে। এর ফলে দ্বীনী ইলমের উলামা ও আধুনিক বিদ্বৎসমাজের মধ্যে এক অদৃশ্য দেওয়াল গড়ে উঠেছে। দৃশ্যমান দেওয়াল তো সহজেই টপকানো যায়, কিন্তু অদৃশ্য দেওয়াল দুর্লঙ্ঘ্য। সাধারণত তা টপকানোর চিন্তাই করা হয় না। অগত্যা প্রত্যেক মহল আপন-আপন পরিমণ্ডলেই বিচরণ করছে। কেবল নিজেদেরই লাভ-লোকসান চিন্তা করছে। অপর মহলের কল্যাণ চিন্তা করলেও নিজেদের অবস্থান থেকেই করছে। চিন্তার বিনিময় হচ্ছে না। একে অন্যকে বোঝার চেষ্টা করা হচ্ছে না। একের কল্যাণ অন্যতে বিস্তার লাভ করতে পারছে না। মাঝখানে অদৃশ্য দেওয়াল প্রতিবন্ধক হয়ে আছে। সামগ্রিক কল্যাণার্থে এ দেওয়ালের অপসারণ জরুরি। তার জন্য প্রথমে দরকার মনোভাবের পরিবর্তন ও চিন্তার ভারসাম্য আনয়ন। প্রান্তিক দৃষ্টিভঙ্গী পরিহার করে উদার মানসিকতার সাথে যদি প্রত্যেকে অপরকে পর্যবেক্ষণ ও মূল্যায়ন করে তবে এ প্রাচীর আপনিই অপসৃত হতে পারে।

উলামায়ে কিরামের দিকটাকেই প্রথমে ধরা যাক। সন্দেহ নেই কুরআন-হাদীসে তাদের অতি উঁচু মর্যাদা বর্ণিত হয়েছে। যেমন ইরশাদ,

 اَمَّنْ هُوَ قَانِتٌ اٰنَآءَ الَّیْلِ سَاجِدًا وَّ قَآىِٕمًا یَّحْذَرُ الْاٰخِرَةَ وَ یَرْجُوْا رَحْمَةَ رَبِّهٖ ؕ قُلْ هَلْ یَسْتَوِی الَّذِیْنَ یَعْلَمُوْنَ وَ الَّذِیْنَ لَا یَعْلَمُوْنَ ؕ اِنَّمَا یَتَذَكَّرُ اُولُوا الْاَلْبَابِ۠

‘যে ব্যক্তি রাতের বিভিন্ন সময়ে সিজদাবনত হয়ে ও দাঁড়িয়ে আনুগত্য প্রকাশ করে আখিরাতকে ভয় করে এবং তার প্রতিপালকের অনুগ্রহ প্রত্যাশা করে সে কি তার সমান যে তা করে না? বল, যারা জানে এবং যারা জানে না তারা কি সমান? কেবল বোধসম্পন্ন লোকেরাই উপদেশ গ্রহণ করে -সুরা যুমার : ৯

এ আয়াত সুনির্দিষ্ট শর্তপূরণ ও দায়-দায়িত্ব পালন সাপেক্ষে উলামায়ে কিরামের শ্রেষ্ঠত্ব প্রতিপন্ন করে। এক হাদীসে আছে, ‘তোমাদের মধ্যে সেই শ্রেষ্ঠ যে কুরআন নিজে শেখে ও অন্যকে শেখায়’। ইশারাস্বরূপ একখানি আয়াত ও একটি হাদীস উল্লেখ করা হল, না হয় উলামায়ে কিরামের মর্যাদা সম্পর্কিত আয়াত ও হাদীসের সংখ্যা প্রচুর। কিন্তু প্রশ্ন হচ্ছে, এই মর্যাদা ও শ্রেষ্ঠত্বের দাবি কি এই যে, তাদের ছাড়া বাকি সব লোক উপেক্ষিত হবে? অন্যদের কোনও গুণ ও অবদানকে স্বীকার করা হবে না? নিশ্চয়ই তা নয় এবং সেরূপ ভাবনা শ্রেষ্ঠত্বের মহিমাকেই প্রশ্নবিদ্ধ করে।

উলামায়ে কিরাম একটা সমাজের সব নয়; বরং ক্ষুদ্র একটা অংশ মাত্র। একটা সুন্দর, সুষ্ঠু ও পূর্ণাঙ্গ সমাজের জন্য তাদের প্রয়োজন যেমন অনঃস্বীকার্য তেমনি একথাও সত্য যে, কেবল তাদের পক্ষে সমাজের সকল প্রয়োজন মেটানো সম্ভব নয়। যত রকম পেশাজীবি আছে তাদের প্রত্যেকের ভ‚মিকাই অত্যন্ত মূল্যবান এবং বাকি সকলের জন্য তা অপরিহার্য। সন্দেহ নেই প্রতিটি পেশার উৎকর্ষ ও উপযোগিতায় আধুনিক শিক্ষার ভূমিকা বিশাল। এ শিক্ষার কল্যাণে আজ জীবন ও জীবিকার প্রতিটি বৃত্তি অভাবিতপূর্ব উপযোগিতা অর্জন করেছে। ক্রমবর্ধিষ্ণু মানবগোষ্ঠীর হরেক রকম চাহিদা পূরণে কৃষক-শ্রমিকের মেহনত পর্যন্ত যে বিস্ময়কর সরবরাহ সৃষ্টি করছে, তা আধুনিক জ্ঞান-বিদ্যার অবদান নয় কি? আজকের সহজ, নিরাপদ ও দ্রুত যোগাযোগ, যাতায়াত ও পরিবহন ব্যবস্থা, কঠিন-কঠিন রোগ-ব্যাধির উন্নত চিকিৎসাব্যবস্থা এবং নিরাপদ ও মনোরম আবাসনের স্থাপত্যকলা এবংবিধ জীবন-সংশ্লিষ্ট আরও যত ক্ষেত্র আছে, কোনটিতে না অধুনা জ্ঞান-বিজ্ঞান যুগান্তকারী বিপ্লব সাধন করেছে? এদিকে লক্ষ করলে স্বীকার করতেই হবে যে, এ শিক্ষাও আল্লাহ তাআলার এক বিরাট নিআমত। সে দৃষ্টিতে এ শিক্ষা ও এর শিক্ষিতজনদেরকে অবজ্ঞার সাথে নয়; বরং কৃতজ্ঞতার সাথেই নেওয়া উচিত।

বিশেষত এ কারণে যে, এর সাথে সংশ্লিষ্ট কাজকর্ম, যা ছাড়া জীবন ও সমাজের গাড়ি চলতে পারে না, কেবল তারাই আঞ্জাম দিচ্ছে। উলামায়ে কিরামের পক্ষে তা সম্ভব নয়। কেননা উলামায়ে কিরাম যে শিক্ষা লাভ করেন তা আদৌ এজন্য নয়। কুরআন-হাদীস এ জন্য নয় যে, তা পড়ে মানুষ প্রকৌশলী, চিকিৎসক, নাবিক-পাইলট, কৃষিবিদ ইত্যাদি হবে। এসব তাদের কাজ নয়। তবে তাদের কাজ কী? কুরআন মাজীদ বলছে,

 وَ مَا كَانَ الْمُؤْمِنُوْنَ لِیَنْفِرُوْا كَآفَّةً ؕ فَلَوْ لَا نَفَرَ مِنْ كُلِّ فِرْقَةٍ مِّنْهُمْ طَآىِٕفَةٌ لِّیَتَفَقَّهُوْا فِی الدِّیْنِ وَ لِیُنْذِرُوْا قَوْمَهُمْ اِذَا رَجَعُوْۤا اِلَیْهِمْ لَعَلَّهُمْ یَحْذَرُوْنَ۠

প্রত্যেক দলের একটি অংশ কেন বের হয় না, যাতে তারা দ্বীন সম্পর্কে জ্ঞানানুশীলন করতে পারে এবং তাদের সম্প্রদায়কে সতর্ক করতে পারে যখন তারা তাদের কাছে ফিরে আসবে, যাতে তারা সতর্ক হয়’ -সুরা তাওবা :১২২

কুরআন-সুন্নাহর জ্ঞানার্জনকারীগণ কী কাজ করবে তা এ আয়াতে পরিষ্কারভাবেই বলে দেওয়া হয়েছে। বলা হয়েছে, যারা সরাসরি কুরআন-হাদীসের জ্ঞানার্জন করেনি, যারা জীবন-জীবিকা সংক্রান্ত বিভিন্ন কাজে নিয়োজিত তারা সেই কাজের ভেতর দিয়েও কিভাবে আল্লাহ তাআলার সন্তুষ্টি অর্জন করবে। তারা তাদের সেইসব জাগতিক কাজকে কিভাবে পারলৌকিক সফলতার মাধ্যম বানাবে। কিভাবে তারা তাদের দুনিয়াকে দ্বীনে পরিণত করবে। ‘আলেমগণ তাদেরকে সেই পথ দেখাবে। তারা যাতে কুরআনের ভাষায় এমন না হয়ে যায় যে, তারা পার্থিব জীবনের বাহ্যিক দিক সম্পর্কে অবগত আর আখিরাত সম্বন্ধে তারা গাফিল। (সূরা রূম:৭) সেই লক্ষ্যে তাদেরকে সতর্ক-সচেতন করবে। অনাচার করলে, দুর্নীতিতে লিপ্ত হলে এবং আপন দায়িত্ব যথাযথভাবে আঞ্জাম না দিলে আখিরাতে কী কঠিন শাস্তির সম্মুখীন হতে হবে সেই ভয় দেখাবে। যাতে প্রত্যেক পেশাজীবি আপন পেশায় বিশ্বস্ত থাকে, চিন্তা-চেতনায় আখিরাতের জবাবদিহিতাকে জাগ্রত রাখে আর এভাবে দুনিয়ার কাজের ভেতর দিয়েও আল্লাহ তাআলার সন্তুষ্টি অর্জনে সক্ষম হয়।

এভাবে এ আয়াত উলামায়ে কিরামকে গণমানুষের সাথে যুক্ত করে দিয়েছে। আম জনগণই তাদের কাজের ক্ষেত্র। একজন আলেমেদ্বীন ডাক্তার, ইঞ্জিনিয়ার বা জাগতিক অন্য কোন কর্মজীবি নয়, কিন্তু তাদের থেকে সে বিচ্ছিন্নও নয়। সে তাদের কাজে প্রাণরস জোগাবে। তাদের নীতি-নৈতিকতা রচনা করবে। উভয়ের পারস্পরিক সম্পর্ক ঠিক দেহ ও আত্মার মত। একটা সুষ্ঠু সমাজের জন্য আলেমগণ আত্মাস্বরূপ, জাগতিক পেশার লোকজন সেই সমাজের শরীর। তাদের মেহনত শরীরকেন্দ্রিক। আলেমদের কাজ আত্মাকেন্দ্রিক। উভয় মেহনত একটি আরেকটির সম্পূরক। শরীর ছাড়া যেমন আত্মার অবস্থিতি কল্পনা করা যায় না তেমনি ইহজাগতিক কাজের সাথে সম্পৃক্ত লোকদের ছাড়া উলামায়ে কিরামের অবস্থান অকল্পনীয়। কাজেই আলেমদের পক্ষে তারা ‘পর’ নয়; বরং তাদের অস্তিত্বের অংশ। সুতরাং আলেমদের কর্তব্য তাদের সাথে অবিচ্ছেদ্য হয়ে থাকা।

এর জন্য প্রথম কাজ, যে কথা আগেই বলা হয়েছে, মানসিকতার পরিবর্তন। অর্থাৎ আধুনিক শিক্ষিতদেরকে ‘পর’ না ভেবে ‘আপন’ ভাবা। তাদেরকে সমাজের জন্য প্রয়োজনীয় ও উপকারী গণ্য করা এবং তাদের কাজকর্মের মূল্যায়ন করা। সেইসঙ্গে তাদের কাজকর্মকে কেবলই ইহজাগতিক দৌড়ঝাঁপ মনে না করে তার পারলৌকিক মহিমা উপলব্ধি করা। যেমন হাদীসে রোগী দেখতে যাওয়া ও রোগীর সেবা-যত্ন করাকে অতি বড় পুণ্যের কাজ হিসেবে উল্লেখ করা হয়েছে। বলা বাহুল্য এ কাজে একজন চিকিৎসকের চেয়ে অগ্রণী আর কেউ হতে পারে না। অপর এক হাদীসে কারও পার্থিব কষ্টলাঘব করলে তার বিনিময়ে দুনিয়া ও আখিরাতের কষ্টলাঘবের সুসংবাদ দেওয়া হয়েছে। জাগতিক যে কোনও পেশার লোকই এর আওতায় পড়ে যায়। এক হাদীসে পরোপকারী মানুষকে শ্রেষ্ঠ মানুষ বলা হয়েছে। এটাও সমাজ ও রাষ্ট্রের সর্বস্তরের লোকদের জন্যই প্রযোজ্য। এভাবে যে যেই বৈধ পেশাই গ্রহণ করুক না কেন তা সর্বশ ইহজাগতিক হওয়া অনিবার্য নয়। দৃষ্টিকোণের বদল দ্বারা তা পারলৌকিকও হয়ে উঠতে পারে। বস্তুত ইসলাম মানুষকে সেই নির্দেশনাই দান করে। সমাজের সর্বস্তরে সেই বোধ করিয়ে দেওয়ার দায়িত্ব তো উলামায়ে কিরামেরই, আর তারই প্রথম ধাপ নিজ মন-মস্তিষ্কে সেই চেতনাকে প্রতিষ্ঠিত করা।

প্রকাশ থাকে যে, আখিরাতের বিচারে উলামায়ে কিরামের শ্রেষ্ঠত্ব তো নিঃশর্ত নয়, বরং ইখলাস, আমল ও দায়িত্বপালনের শর্তসাপেক্ষ। সমষ্টিগতভাবে সে শর্তপূরণের নিশ্চয়তা থাকলেও যে কোনও ‘ব্যক্তি আলেমের’ ক্ষেত্রে তাতে ঘাটতি থাকার যথেষ্ট অবকাশ আছে। ফলে এ মহলের কোনও ব্যক্তি নিজেকে অন্য কারও অপেক্ষা শ্রেষ্ঠ ভাবতে পারে না। তাতে সেই অন্য ব্যক্তিটি যে পেশারই হোক না কেন। হাকীমুল উম্মত হযরত থানভী রাহ. তো বলতেন দুনিয়ার যে কোনও মুসলিমকে তার বর্তমান অবস্থার ভিত্তিতে এবং যে কোনও অমুসলিমকে তার ভবিষ্যত সম্ভাবনার ভিত্তিতে আমি নিজের চেয়ে উত্তম মনে করি। দ্বীনী খেদমতে বিস্ময়কর ভ‚মিকা রাখা সত্তে¡ও যখন তাঁর এই অনুভূতি তখন নিজেকে আর কার কি ভাবার অবকাশ আছে? এ দৃষ্টিকোণ থেকে ব্যক্তিগতভাবে যে কোনও আলেমই আধুনিক শিক্ষিত যে কোনও লোককে নিজের থেকে উত্তম ভাবতেই পারে।

যা হোক প্রথম কাজ হল মানসিকতার বদল। এই বদলে দেওয়া মানসিকতাই উলামায়ে কিরামকে আধুনিক শিক্ষিত সমাজের কাছে নিয়ে যেতে পারে। এটাই হতে পারে বাধার প্রাচীর উৎপাটনে তাদের পক্ষ থেকে প্রথম আঘাত। এর পরবর্তী কাজ হল তাদের সাথে মেলামেশা ও মতবিনিময় করা, তাদেরকে বোঝার চেষ্টা করা, তাদেরকেও বোঝার সুযোগ দান করা। সেই লক্ষ্যে নিজেদের অনুষ্ঠানাদিতে তাদেরকে শামিল রাখা এবং আরও যত যোগাযোগ-মাধ্যম আছে সেগুলোকেও কাজে লাগানো। ইত্যাদি উপায়ে সম্পর্ককে আরো ঘনিষ্ঠতায় নিয়ে যাওয়া। বিভেদ-বিভক্তি দূর করে পারস্পরিক সম্প্রীতি গড়ে তোলার জন্য উলামায়ে কিরামের পক্ষ থেকে এ জাতীয় পদক্ষেপ গ্রহণ করতেই হবে। কারণ তারা উলামায়ে কিরামের মাদ্উ-দাওয়াতের ক্ষেত্র ও পাত্র। মাদ্উ স্ব-উদ্যোগে এগিয়ে আসবে তা আশা করা যায় না। উদ্যোগটা দাওয়াতদাতাকেই নিতে হয়। এটাই স্বাভাবিক নিয়ম।

এতো গেল উলামায়ে কিরামের দিক। তাদের সম্পর্কে আধুনিক শিক্ষিত সমাজের যে নেতিবাচক ধারণা এবং তাদের একটা বিরাট অংশের চরম একদেশদর্শী দৃষ্টিভঙ্গী সে সম্পর্কে আলকাউসারের পাতায় কিছু লেখার বিশেষ ফায়দা নেই। তবে এ সম্পর্কে উলামায়ে কিরামকে লক্ষ্য করে সংক্ষেপে বলা যায় যে, ব্যক্তি ও সমাজ নির্মাণ এবং মানুষের ইহ ও পরলৌকিক কল্যাণ সাধনে উলামায়ে কিরামের ভ‚মিকা ও প্রয়োজনীয়তা সম্পর্কে যাতে তারা যথার্থ উপলব্ধি লাভ করতে পারে সেজন্য উলামায়ে কিরামকেই সাহায্যের হাত বাড়িয়ে দিতে হবে। তাদেরকে বুঝতে দিতে হবে আলেমদের কাজই তাদের সর্বপ্রকার মেহনতের প্রাণবস্তু। সেই প্রাণবস্তুর অভাবেই তাদেরকে আজ যান্ত্রিক জীবনের ঘানি টানতে হচ্ছে। পারিবারিক জীবন বিপর্যস্ত। সমাজ থেকে শান্তি-শৃংখলা উধাও। অফিস-আদালত দুর্নীতিকবলিত। এর থেকে মুক্তির কোনও পথ কেউ খুঁজে পাচ্ছে না। অন্ধকারের ভেতর থেকে এ লক্ষ্যে যা কিছু পদক্ষেপ গ্রহণ করা হচ্ছে সঙ্গত কারণেই তা ব্যর্থতায় পর্যবসিত হচ্ছে। তা হতে বাধ্য। কেননা গলত রয়ে গেছে গোড়াতেই। মূল রোগ আত্মায়- অর্থাৎ আকীদা-বিশ্বাস ও নীতি-নৈতিকতায়। কর্মের সুচারু পরিচালনা, বিশ্বাস ও আখলাকের শুদ্ধতা দ্বারাই সম্ভব। ইসলাম যে বিশ্বাস ও আখলাকের শিক্ষা দান করে মানব জীবনের যাবতীয় কাজের সাথেই রয়েছে তার গভীর সম্পর্ক। জীবনদৃষ্টিতে সেই বিশ্বাস ও আখলাকের আধিপত্য থাকলে কর্মের শুদ্ধতা অবশ্যম্ভাবী। কিন্তু এই মহাসত্যের সবক তারা কোথায় পাবে? যে শিক্ষা তারা লাভ করছে কেবল বস্তুর সাথেই তার সম্পর্ক। তা দ্বারা তারা

 يعلمون ظاهرا من الحياة الدنيا

পার্থিব জীবনের বাহ্যিক দিকটাই জানতে পারে। আত্মাকে তা স্পর্শ করে না। আত্মার খোরাক পেতে হলে তাদেরকে উলামায়ে কিরামেরই দ্বারস্থ হতে হবে। কেননা সে খোরাক কেবল কুরআন-হাদীসেই আছে আর তা নিয়েই আলেমদের কারবার। সুতরাং উলামা সমাজ তাদের ব্যক্তিজীবন তো বটেই বৃহত্তর সমাজের জন্যও অত্যন্ত প্রয়োজনীয়, অতি প্রাসংগিক।

মোটকথা উলামা সমাজ ও আধুনিক শিক্ষিত মহল উভয়েরই চিন্তায় ভারসাম্য আনতে হবে। প্রত্যেককেই নিজ সীমারেখা সম্পর্কে সজাগ হতে হবে এবং নিজের জন্য অপরের প্রয়োজনীয়তাকে উপলব্ধি করতে হবে। এভাবে উভয় পক্ষ যদি পরস্পরের দিকে এগিয়ে আসতে পারে এবং বিভক্তির প্রাচীর উৎপাটিত করে একে অন্যের সম্পূরক হিসেবে হাতে হাত ধরে চলতে পারে তবেই সাধিত হতে পারে ব্যক্তি ও সমষ্টির সত্যিকারের মঙ্গল। আল্লাহ তাআলা তাওফীক দান করুন। আমীন।

 মাওলানা আবুল বাশার মুহাম্মাদ সাইফুল ইসলাম

[1]   বরং তারা জাগতিক বিদ্যা ও উপকারী আধুনিক জ্ঞান-বিজ্ঞান এবং বিভিন্ন বৈধ পেশার প্রয়োজনীয়তা ও উপকারিতার প্রবক্তা। এগুলোর সাথে সম্পৃক্ত ব্যক্তিদের যথাযথ মূল্যায়নও করেন তারা। জাগতিক বিদ্যা ও উপকারী আধুনিক জ্ঞান-বিজ্ঞানের উপর তাদের কোনো আপত্তি নেই। তাদের আপত্তি শুধু শরীয়ত বিরূদ্ধ পন্থায় শিক্ষাদান ও লব্ধ শিক্ষা ও বিদ্যার শরীয়ত বিরূদ্ধ প্রয়োগের উপর। নতুবা তাঁদের দৃষ্টিতে যারা এই লব্ধ বিদ্যা আল্লাহর মাখলুকের সেবায় ব্যয় করে তারা শত মোবারকবাদ পাওয়ার যোগ্য।- আব্দুল মালেক

11
কিছু দিন আগে আমার এক প্রিয় তালিবে ইলম দেখা করতে এসে বললো, হুযূর, আগামী পরশু আমার বিবাহ। চমকে উঠে তাকালাম। বড় ‘বে-চারা’ মনে হলো। কারণ আমিও একদিন বড় অপ্রস্ত্তত অবস্থায় জেনেছিলাম, আগামীকাল আমার বিবাহ! ভিতর থেকে হামদরদি উথলে উঠলো। ইচ্ছে হলো তাকে কিছু বলি, যিন্দেগির এই নতুন রাস্তায় চলার  জন্য প্রয়োজনীয় কিছু পাথেয়, আল্লাহর তাওফীকে তাকে দান করি। আল্লাহর তাওফীক ছাড়া আমরা কেই বা কী করতে পারি!

তো তাকে জিজ্ঞাসা করলাম, বিবাহের জন্য কী প্রস্ত্ততি নিয়েছো? বড় ভোলাভালা নও জোয়ান! সরলভাবে বললো, আমার কিছু করতে হয়নি, সব প্রস্ত্ততি আববা -আম্মাই নিয়েছেন। কেনা-কাটা প্রায় হয়ে গেছে, শুধু বিয়ের শাড়ীটা বাকি।

অবাক হলাম না, তবে দুঃখিত হলাম, আমার এই প্রিয় তালিবে ইলম এখন একজন যিম্মাদার আলিমে দ্বীন। দীর্ঘ কয়েক বছর আমাদের ছোহবতে ছিলো, তার কাছে বিবাহের প্রস্ত্ততি মানে হলো জিনিসপত্র এবং বিয়ের শাড়ী! তাহলে অন্যদের অবস্থা কী?!

বড় মায়া লাগলো; বললাম, দেখো, মানুষ যে কোন কাজ করতে চায়, প্রথমে সে ঐ বিষয়ে প্রয়োজনীয় শিক্ষা গ্রহণ করে। কাজটির হাকীকত ও উদ্দেশ্য কী? কাজটি আঞ্জাম দেয়ার সঠিক পন্থা কী? শুরু থেকে শেষ পর্যন্ত কী কী সমস্যা হতে পারে, সেগুলোর সমাধান কী? এগুলো জেনে নেয়। এজন্য দস্ত্তর মত আমাদের শিক্ষা ব্যবস্থায় শিক্ষার আয়োজন আছে, এমনকি বাস্তব প্রশিক্ষণেরও ব্যবস্থা আছে।

অথচ জীবনের সবচে’ কাঠিন ও জটিল অধ্যায়ে মানুষ প্রবেশ করে, বরং বলতে পারো ঝাঁপ দেয়, কিছু না শিখে, না জেনে এবং না বুঝে একেবারে অপ্রস্ত্তত অবস্থায়। ফল কী হতে পারে?! কী হয়?! অন্যদের কথা থাক, চোখের সামনে আমার ক’জন ছাত্রের ঘর ভেঙ্গে গেলো! একজনের তো এমনকি দু’জন সন্তানসহ। কিংবা ঘর হয়ত টিকে আছে, কিন্তু শান্তি নেই। স্বাভাবিক শান্তি হয়ত বজায় আছে, কিন্তু বিবাহ যে দুনিয়ার বুকে মানবের জন্য আল্লাহর দেয়া এক জান্নাতি নেয়ামত, সুকূন ও সাকীনাহ, সে খবর তারা পায়নি, শুধু অজ্ঞতার কারণে, শুধু শিক্ষার অভাবে।

আশ্চর্য, মা-বাবা সন্তানকে কত বিষয়ে কত উপদেশ দান করেন; উস্তাদ কত কিছু শিক্ষা দেন, নছীহত করেন, কিন্তু জীবনের সবচে’ কঠিন ও জটিল বিষয়টি কেন যেন তারা সযত্নে এড়িয়ে যান!

তাকে বললাম, যদিও তুমি এ উদ্দেশ্যে আসোনি তবু তোমাকে কিছু কথা বলতে চাই, যা ইনশাআল্লাহ আগামী জীবনে তোমার কাজে আসবে।

খুব জযবা ছিলো, অবেগের তোড় ছিলো, ‘দিল কো নিচোড় ক্যর’, বাংলায় যদি বলি তাহলে বলবো, হৃদয় নিংড়ে, কিন্তু দিল কো নিচোড়না-এর ভাব হৃদয় নিংড়ানোতে আসবে কোত্থেকে! যাক, বলছিলাম, হৃদয়টাকে নিংড়ে কিছু কথা তাকে বলেছিলাম। পরে আফসোস হলো যে, কথাগুলো তো সব হাওয়ায় উড়ে গেলো, যদি বাণীবদ্ধ করে রাখা যেতো কত ভালো হতো! হয়ত আল্লাহর বহু বান্দার উপকারে আসতো। শেষে বললাম, এককাজ করো, এ কথাগগুলোর খোলাছা কাগজে লিখে আমাকে দেখিও।

আগামী পরশুর বিয়ের খবর দিয়ে ছেলেটা সেই যে গেলো, তিন বছরে আর দেখা নেই! দাম্পত্য জীবনের বিভিন্ন দিক নিয়ে বিভিন্ন সময় দরসেও আমি অনেক কথা বলেছি। ‘সবচে’ বেশী বলেছি আমার নূরিয়ার জীবনের প্রিয় ছাত্র (বর্তমানের হাতিয়ার হুযূর) মাওলানা আশরাফ হালীমীকে, আশা করি তিনি সাক্ষ্য দেবেন, অনেকবার বলেছেন, আমার কথাগুলো তার জীবনে বে-হদ উপকারে এসেছে। আরো অনেকে বলেছে, কিন্তু কথাগুলো কেউ ‘কলমবন্দ’ করেনি।

তো এখন এই উপলক্ষকে কেন্দ্র করে তোমাদের মজলিসে ঐ কথাগুলো আবার বলতে ইচ্ছে করছে। কিন্তু আফসোস, সেই আবেগ ও জযবা তো এখন নেই যা ঐ প্রিয় তালিবে ইলমকে বলার সময় ছিলো। আবেগভরা দিলের কথা তো রসভরা ইক্ষু, আর শুধু চিন্তা থেকে বলা কথা হলো রস নিংড়ে নেয়া ইক্ষুর ছোবা! তবু কিছু না কিছু ফায়দা তো ইনশাআল্লাহ হবে।

আমি আমার প্রিয় ছাত্রটিকে বলেছিলাম, এখন তোমার জীবনের এই যে নতুন অধ্যায় শুরু হচ্ছে উর্দূতে এটাকে বলে ইযদিওয়াজী যিন্দেগী, বাংলায় বলে দাম্পত্য জীবন, অর্থাৎ এটা জীবন ও যিন্দেগির খুবই এবং খুবই গুরুত্বপূর্ণ অংশ, শুধু গুরুত্বপূর্ণ নয়, বরং অত্যন্ত জটিল ও ঝুঁকিপূর্ণ। এটা তোমাকে ঘাবড়ে দেয়ার জন্য বলছি না; প্রয়োজনীয় প্রস্ত্ততি গ্রহণ ও পাথেয় সংগ্রহ করার জন্য বলছি, যাতে পূর্ণ আস্থা ও সাহসের সঙ্গে তুমি তোমার এই নতুন জীবন শুরু করতে পারো। আল্লাহ যদি সাহায্য করেন তাহলে সবই সহজ।

এটা যে শুধু তোমার ক্ষেত্রে হচ্ছে তা নয়! আমার জীবনেও হয়েছে, আমার মা-বাবার জীবনেও হয়েছে! তোমার মা-বাবাও একদিন এ জীবন শুরু করেছিলেন। যদি সহজ ও অন্তরঙ্গ সম্পর্ক থাকে তাহলে তোমার মাকে, বাবাকে জিজ্ঞাসা করতে পারো, কীভাবে তারা এ দীর্ঘ পথ পাড়ি দিয়ে এসেছেন? জীবনের শুরুতে তারা কী ভেবেছিলেন, কী চেয়েছিলেন, কী পেয়েছেন?

কখন কী সমস্যা হয়েছে, সেগুলো কীভাবে সমাধান করেছেন। এই জীবনের শুরুতে তোমার প্রতি তাদের কী উপদেশ? এধরনের সহজ আন্তরিক আলোচনায় সংসার জীবনের পথচলা অনেক সহজ হয়ে যায়। অবশ্য সব মা-বাবার সঙ্গে সব সন্তানের এমন সহজ সম্পর্ক থাকে না, তবে থাকা উচিত। জীবনের যে কোন সমস্যার সমাধানের জন্য সন্তান মা-বাবার কাছেই আসবে, মা-বাবাকেই নিরাপদ আশ্রয় মনে করবে, বন্ধুবান্ধবকে নয়। কঠিন সমস্যার মুখে একজন অপরিপক্ব বন্ধু কীভাবে সঠিক পথ দেখাতে পারে! কিন্তু অধিকাংশ ক্ষেত্রে এটাই ঘটে। সন্তান মা-বাবাকে ভয় করে, হয়ত কোন জটিলতায় পড়েছে; তখন তাদের প্রথম চেষ্টা হয় যে, মা-বাবা যেন জানতে না পারে, কারণ তাদের কানে গেলে সর্বনাশ!  ছেলে তার বন্ধুর শরণাপন্ন হয়, মেয়ে তার বান্ধবীর কাছে বলে, তারা তাদের মত করে পরামর্শ দেয়। ফলে অবস্থা আরো গুরুতর হয়।

অতীতে যাই ছিলো, এখন তো অপরিহার্য হয়ে পড়েছে, মা-বাবার জন্য সন্তানের বন্ধু হওয়া। বিপদে সমস্যায় সন্তানকে তিরস্কার পরে করা, আগে তার পাশে দাঁড়ানো। তাহলে সন্তান আরো বড় অন্যায় করা থেকে এবং আরো গুরুতর অবস্থায় পড়া থেকে বেঁচে যায়। কিন্তু এখন অবস্থা হলো, সন্তান মা-বাবাকে ভয় করে, বন্ধুকে নিরাপদ আশ্রয়স্থল মনে করে। আমার ছেলেকে আমি এটা বোঝাতে চেয়েছি এবং আশা করি, কিছুটা বোঝাতে পেরেছি। অনেক সমস্যা থেকে সে রক্ষা পেয়েছে, কারণ সবার আগে সে আমার কাছে এসেছে, আর আমি বলেছি, ভয় নেই, আমি তোমার পাশে আছি। আগে তাকে সাহায্য করেছি, তারপর প্রয়োজনে দরদের সঙ্গে তিরস্কার করেছি, বা শিক্ষা দিয়েছি। বন্ধুর কাছে আগে পাওয়া যায় সাহায্য, মা-বাবার কাছ থেকে আগে আসে তিরস্কার। তাই সন্তান সমস্যায় পড়ে মা-বাবার কাছে আসে না, বন্ধুর কাছে আসে। এভাবে নিজের কারণেই সবচে’ কাছের হয়েও মা-বাবা হয়ে যায় দূরের, আর দূরের হয়েও বন্ধু হয়ে যায় কাছের। সন্তানের সমস্যা বন্ধু জানে সবার আগে। মা-বাবা জানে সবার পরে, পানি যখন মাথার উপর দিয়ে চলে যায় তখন।

তো আমি আশা করছি, জীবনের অন্যসকল ক্ষেত্রে যেমন তেমনি, আল্লাহ না করুন দাম্পত্যজীবনে যদি কোন রকম সমস্যার সম্মুখীন হয় তাহলে সন্তান সবার আগে আমার কাছে আসবে, তার মায়ের কাছে আসবে, আমাদের উপদেশ, পরামর্শ নেবে।

আলহামদু লিল্লাহ, সেই রকমের সহজ অন্তরঙ্গ সম্পর্কই সন্তানের সঙ্গে আমার, আমাদের।

আমার প্রিয় ছাত্রটিকে বললাম, কথা অন্য দিকে চলে গেছে, তো এই প্রসঙ্গে তোমাকে একটি আগাম নছীহত করি; আজ তোমরা স্বামী-স্ত্রী, দু’দিন পরেই হয়ে যাবে, মা এবং বাবা। সেটা তো জীবনের আরো কঠিন, আরো জটিল অধ্যায়। আমি প্রায় বলে থাকি, প্রাকৃতিক নিয়মে মা-বাবা হয়ে যাওয়া খুব সহজ। কিন্তু আদর্শ মা-বাবা হওয়ার জন্য প্রয়োজন দীর্ঘ শিক্ষা ও দীক্ষা। তো তোমরা দু’জন জীবনের শুরু থেকেই শিক্ষা গ্রহণ করতে শুরু করো যে, একটি মেয়ে কীভাবে একজন আদর্শ মা হতে পারে এবং একটি ছেলে কীভাবে একজন আদর্শ বাবা হতে পারে! আগে বলেছিলাম একটি নছীহত, এখন বলছি দু’টি নছীহত।

সন্তানের সামনে কখনো তার মাকে অসম্মান করো না। তোমাকে মনে রাখতে হবে, সে তোমার স্ত্রী, কিন্তু তোমার সন্তানের মা, তোমার চেয়েও অধিক শ্রদ্ধার পাত্রী। সন্তান যেন কখনো, কখনোই মা-বাবাকে ঝগড়া-বিবাদ করতে না দেখে। এ নছীহত আমি তোমাকে করছি, আল্লাহর শোকর নিজে আমল করে। আমার বড় সন্তানের বয়স ত্রিশ বছর, এর মধ্যে কখনো সে আমাদের বিবাদ করতে এমনকি তর্ক করতেও দেখেনি। দ্বিতীয়ত  তোমরা উভয়ে সন্তানের বন্ধু হওয়ার চেষ্টা করো, এমন বন্ধু যাকে নিজের মনের কথা, সব কথা নিঃসঙ্কোচে জানাতে পারে।

আগের কথায় ফিরে আসি; আগামীপরশু তোমার বিবাহ। তার মানে, আজ তুমি নিছক একটি যুবক ছেলে, অথচ আগামী পরশু হয়ে যাচ্ছো, একজন দায়িত্ববান স্বামী। কত বিরাট পার্থক্য তোমার আজকের এবং আগামী পরশুর জীবনের মধ্যে। বিষয়টি তোমাকে বুঝতে হবে। কেন তুমি বিবাহ করছো? বিবাহের উদ্দেশ্য কী? দেখো, আমাদের দেশে পারিবারিক পর্যায়ে একটা নিন্দনীয় মানসিকতা হলো, সংসারের প্রয়োজনে, আরো খোলামেলা যদি বলি, কাজের মানুষের প্রয়োজনে ছেলেকে বিয়ে করানো। সবাই যে এমন করে তা নয়, তবে এটা প্রবলভাবে ছিলো, এখনো কিছু আছে। আমি নিজে সাক্ষী, আমার একজন মুহতারাম তাঁর মেয়েকে বিয়ে দিলেন, বিয়ে হওয়ামাত্র ছেলের বাবা স্বমূর্তি ধারণ করে বলতে লাগলেন, আর দেরী করা যাবে না, তাড়াতাড়ি মেয়ে বিদায় করেন। মেয়ের মা ও বাবা তো হতবাক!

মেয়ে বিদায় হলো। শশুরবাড়ীতে রাত পোহালো, আর পুত্রবধুর সামনে কাপড়ের স্ত্তপ নিক্ষেপ করে শাশুড়ী আদেশ করলেন, কাপড়ে সাবান লাগাও, দেখি, মায়ের বাড়ী থেকে কেমন কাজ শিখে এসেছো!

আমার এক ছাত্রের কথা, বিয়ের প্রয়োজন। কেন? কারণ মা-বাবার খেদমত করার কেউ নেই।

এটা কিন্তু বিবাহের উদ্দেশ্য বা মাকছাদ হতে পারে না। মা-বাবার খেদমত মূলত তোমার দায়িত্ব। এখন সে যদি স্বতঃস্ফূর্তভাবে তোমার সাথে এতে শরীক হয়, তবে সেটা তোমাদের উভয়ের জন্য সৌভাগ্যের কারণ হতে পারে। দেখো, আল্লাহ চাহে তো অচিরেই আমাদেরও ঘরে পুত্রবধু আসবে। আমরা আমাদের না দেখা সেই ছোট্ট মেয়েটির প্রতীক্ষায় আছি। কিন্তু আমি আমার পুত্রকে অবশ্যই বলবো, বিবাহের উদ্দেশ্য মা-বাবার খেদমত করা হতে পারে  না।

আমি দু’আ করি, তোমার মা-বাবা তোমার যেমন, তেমনি তোমার স্ত্রীরও যেন মেহেরবান মা-বাবা হতে পারেন। আমার দুই মেয়ের শশুর, দু’জনই এখন জান্নাতবাসী (ইনশাআল্লাহ)। আল্লাহর কাছে আমার সাক্ষ্য এই যে, সত্যি সত্যি তারা আমার মেয়েদু’টির ‘বাবা’ ছিলেন। আমার ছোট মেয়ের শশুর বড় আলিম ছিলেন, তাঁকে আমার একটি বই হাদিয়া দিয়েছিলাম এভাবে, ‘সাফফানার আববুর পক্ষ হতে সাফফানার আববাকে’। তিনি খুশী হয়ে অনেক দু’আ করেছিলেন, আর বলেছিলেন, ‘আপনি তো এই ছোট্ট একটি বাক্যে সম্পর্কের মহামূল্যবান এক দর্শন তুলে ধরেছেন!

আমার বড় মেয়ের অবস্থা হলো, মায়ের বাড়ী থেকে যাওয়ার সময় সে কাঁদে না, কাঁদে ‘আম্মার’ বাড়ী থেকে আসার সময়।

দুআ’ করি, আমার দেশের প্রতিটি মেয়ে যেন মা-বাবার ঘর থেকে এমন মা-বাবার ঘরে প্রবেশ করতে পারে। আর তুমি দু’আ করো, আমরা দু’জন যেন আমাদের অনাগত মেয়েটির জন্য তেমন মা-বাবাই হতে পারি।

তো বলছিলাম বিবাহের উদ্দেশ্যের কথা। বৈধ উপায়ে স্ত্রীপরিচয়ে কাউকে ভোগ করা, এটাও বিবাহের উদ্দেশ্য বা মাকছাদ হতে পারে না।

স্বামী-স্ত্রী পরস্পরকে বলা হয় শরীকে হায়াত, জীবনসঙ্গী এবং জীবনসঙ্গিনী। বস্ত্তত এই শব্দটির মধ্যেই দাম্পত্য জীবনের সুমহান  উদ্দেশ্যটি নিহিত রয়েছে। আর যদি কোরআনের ভাষায় বলি তাহলে বিবাহের উদ্দেশ্য হল,

هن لباس لكم وانتم لباس لهن

তুমি তো কোরআন বোঝো। ভেবে দেখো, দাম্পত্য-সম্পর্কের কী গভীর তাৎপর্য এখানে নিহিত!

পেয়ারা হাবীব ছাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম বলেছেন, বিবাহ হচ্ছে আমার সুন্নত। আর বলেছেন, যে আমার সুন্নতের প্রতি বিমুখ হবে সে আমার উম্মতভুক্ত নয়।

বিবাহ নবীর সুন্নত! সুতরাং সহজেই বোঝা যায়, বিরাট ও মহান কোন মাকছাদ রয়েছে এর পিছনে।

বিবাহের আসল মাকছাদ বা উদ্দেশ্য  হলো স্বামী ও স্ত্রী- এই পরিচয়ে একটি নতুন পরিবার গঠন করা এবং মা ও বাবা- এই পরিচয়ে সন্তান লাভ করা। তারপর উত্তম লালন-পালন এবং আদর্শ শিক্ষা-দীক্ষা ও তারবিয়াতের মাধ্যমে নেক সন্তানরূপে গড়ে তুলে দুনিয়া থেকে বিদায় গ্রহণ করা, যাতে নস্লে ইনসানি বা মানববংশ কেয়ামত পর্যন্ত আল্লাহর পছন্দমত আগে বাড়তে থাকে।

এটাই হলো বিবাহের আসল উদ্দেশ্য; অন্য যা কিছু আছে তা সব পার্শ্ব-উদ্দেশ্য। তো এখনই তুমি নিয়ত ঠিক করে নাও যে, কেন কী উদ্দেশ্যে বিবাহ করবে। উদ্দেশ্য যদি ঠিক হয়ে যায় তাহলে দেখতে পাবে, আল্লাহ চাহে তো এখনই তোমার ভিতরে কত সুন্দর পরিবর্তন আসছে! কী আশ্চর্য এক পরিপূর্ণতা নিজের মধ্যে অনুভূত হচ্ছে! আগামী জীবনের সকল দায়দায়িত্ব পালন করার জন্য গায়ব থেকে তুমি আত্মিক শক্তি লাভ করছো। আল্লাহ তাওফীক দান করেন।

এবার আসো জীবনের

বাস্তবতার কথা বলি, এতদিন তোমার জীবনে ছিলেন শুধু তোমার মা, যিনি তোমাকে গর্ভে ধারণ করেছেন, প্রসববেদনা ভোগ করেছেন। নিজেকে তিলে তিলে ক্ষয় করে তোমাকে প্রতিপালন করেছেন। এতদিন তোমার উপর ছিলো তাঁর অখন্ড অধিকার। হঠাৎ তিনি দেখছেন, তাঁর আদরের ধন, তাঁর অাঁচলের রত্ন পুত্রের জীবনে স্ত্রীপরিচয়ে অন্য এক নারীর প্রবেশ (অনুপ্রবেশ?) ঘটেছে! এভাবে পুত্রের উপর তার অখন্ড অধিকার খন্ডিত হতে চলেছে। যে পুত্র ছিলো এতদিন তাঁর একক অবলম্বন, এখন সে হতে চলেছে অন্য এক নারীর অবলম্বন। এ বাস্তবতা না তিনি অস্বীকার করতে পারছেন, না মেনে নিতে পারছেন। সংসারে প্রত্যেক মায়ের জীবনে এ কঠিন সময়টি আসে। এমন এক অর্ন্তজ্বালা শুরু হয় যা শুধু তিনি নিজেই ভোগ করেন, কাউকে বোঝাতে পারেন না, এমনকি এতদিনের আদরের ধন পুত্রকেও না। ফলে সামান্য সামান্য কারণে, এমনকি অকারণেও তিনি খুব সংবেদনশীল হয়ে পড়েন; তাঁর অনুভূতি আহত হয়। এমন সময় ছেলে (এবং তার স্ত্রী অজ্ঞতা, অনভিজ্ঞতা ও অপিরপক্বতার কারণে) যদি অসঙ্গত কিছু বলে বা করে বসে তাহলে তো মায়ের মনে কষ্টের শেষ থাকে না। প্রসববেদনা থেকে শুরু করে প্রতিপালনের সব কষ্ট একসঙ্গে মনে পড়ে যায়।

আম্মার কাছে শুনেছি, গ্রামের এক মা তার পুত্রবধুকে বলেছিলেন, ‘ততা ফানি আমি খাইছিলাম, না তুই খাইছিলি?’

তখনকার যুগে প্রসবপরবর্তী বেশ কিছু দিন মা ও শিশুর স্বাস্থ্যগত কল্যাণ চিন্তা করে মাকে গরম পানি খেতে দেয়া হতো, ঠান্ডা পানি দেয়া হতো না।

তো কথাটা কিন্তু নির্মম। আমার জন্য ‘তাতানো পানি’ আমার মা খেয়েছেন, আমার সব আবর্জনা আমার মা পরিস্কার করেছেন। নিজের জীবন তিলে তিলে ক্ষয় করে তিনি আমাকে বড় করেছেন, উপযুক্ত করেছেন। সেই সব কষ্টের সুফল হঠাৎ করে অন্য একটি মেয়ে এসে অধিকার করে বসেছে। তখন সব হারানোর একটা বেদনা তাকে কুরে কুরে খায়। তো তোমার মায়ের অন্তরেও এরকম অনুভূতি হওয়া স্বাভাবিক। মায়ের মনের এই কষ্টের উপশম, এই বেদনার সান্ত্বনা তোমাকেই চিন্তা করতে হবে।

মায়ের পর দ্বিতীয় পর্যায়ে আসে বাবার কথা, তারপর ভাই-বোনদের কথা। (এসম্পর্কেও ছাত্রটিকে বিশদভাবে বলেছিলাম।)

তৃতীয়ত তোমার স্ত্রী। যদিও তৃতীয় বলছি, কিন্তু বাস্তবে এটাই হলো সবচে’ গুরুত্বপূর্ণ এবং সবচে’ নাযুক। তবে এটা থাকবে তোমার দিলে, তোমার অন্তরে। মা-বাবার সামনে মুখের কথায় বা আচরণে এটা প্রকাশ করা প্রজ্ঞার পরিচায়ক হবে না।

কেন বলছি স্ত্রীর বিষয়টি সবচে’ নাযুক? তার আগে আমার একটি প্রশ্নের উত্তর দাও; কোন বিবাহে কোন ছেলেকে কাঁদতে দেখেছো?! কোন ছেলের মা-বাবাকে বিষণ্ণ দেখেছো?! দেখোনি; (হয়তো ব্যতিক্রম এক দুইটি ঘটনা থাকতে পারে। কিন্তু সাধারণ অবস্থা এটিই, এদের কেউ কাঁদে না।) কেন? কারণ বিবাহের মাধ্যমে ছেলে কিছু হারায় না, ছেলের মা-বাবা কিছু হারায় না, বরং অর্জন করে। তাই তাদের মুখে থাকে অর্জনের হাসি এবং প্রাপ্তির তৃপ্তি।

বিবাহের আসরে কাঁদে শুধু মেয়ে, আর মেয়ের মা-বাবা। কেন কাঁদে একটি মেয়ে? কারণ তাকে সবকিছু হারাতে হয়, সবকিছু ত্যাগ করতে হয়। মা-বাবাকে ছেড়ে আসতে হয়, শৈশবের সব স্মৃতি তাকে মুছে ফেলতে হয়। একটি ছোট্ট মেয়ের জীবনে এটি অনেক বড় আঘাত। এ যেন একটি ছোট্ট গাছের চারাকে শিকড়শুদ্ধ উপড়ে ফেলে বহু দূরে ভিন্ন পরিবেশে নতুন মাটিতে এনে রোপণ করা। বাকি জীবন তাকে এই মাটি থেকেই রস আহরণ করে বেঁচে থাকতে হবে।

হিন্দিতে বলে, ‘আওর‌্যত কী ডোলী যাহা উত্যরতী হ্যয়, উসকী আর্থী ওহীঁ সে উঠতি হ্যয়।’ অর্থাৎ মেয়েদের পালকি যেখানে গিয়ে নামে, সেখান থেকেই তার জানাযা ওঠে।

কত বড় নির্মম সত্য! তো তোমার স্ত্রীরূপে তোমার ঘরে আসা এই ছোট্ট মেয়েটির যখমি দিলে তাসাল্লির  মরহম তোমাকেই রাখতে হবে। একমাটি থেকে উপড়ে এনে আরেক মাটিতে রোপণ করা একটি চারাগাছ থেকে দু’দিন পরেই ফল দাবী করা কতটা নিষ্ঠুরতা! ফল পেতে হলে তোমাকে ধৈর্য ধরতে হবে। চারা গাছটির পরিচর্যা করতে হবে, সকাল-সন্ধ্যা তার গোড়ায় পানি দিতে হবে। ধীরে ধীরে শিকড় যখন মাটিতে বসবে এবং মাটি থেকে রস সংগ্রহ করার উপযুক্ত হবে, তখন তোমাকে ফল চাইতে হবে না; সজীব বৃক্ষ নিজে থেকেই ফল দিতে শুরু করবে।

কত আফসোসের বিষয়, দাম্পত্য জীবনের শুরুতে যত আদেশ-উপদেশ সব ঐ ছোট্ট মেয়েটিকে উদ্দেশ্য করে বর্ষিত হয়। প্রথম দিনেই তাকে শুনতে হয়, এখন থেকে তাকে স্বামীর মন জয় করতে হবে, শশুর-শাশুড়ি সন্তুষ্টি অর্জন করতে হবে, শশুর বাড়ীর সবার মন যুগিয়ে চলতে হবে। তার নিজের যেন কোন ‘মন’ নেই। সুতরাং সেটা জয় করারও কারো গরজ নেই।

তো মায়ের মন তোমাকেই রক্ষা করতে হবে, আবার স্ত্রীর মনোরঞ্জনও তোমাকেই করতে হবে। সবদিক তোমাকেই শামাল দিয়ে চলতে হবে। কত কঠিন দায়িত্ব! অথচ না শিক্ষাঙ্গনে, না গৃহপ্রাঙ্গণে, কোথাও এ সম্পর্কে শিক্ষার নূন্যতম কোন ব্যবস্থা নেই। সম্পূর্ণ অপ্রস্ত্তত অবস্থায় দু’টি অপরিপক্ব তরুণ-তরুণীকে যেন সংসার সমুদ্রে ভাসিয়ে দেয়া! মেয়েটিও জানে না, আজ থেকে সে আর ছোট্ট মেয়েটি নেই। সে এখন স্ত্রী হয়ে একটি অপরিচিত মানুষের জীবনে প্রবেশ করছে, যার মা আছে, বাবা আছে, ভাইবোন আছে এবং তাদের প্রতি তার স্বামীর অনেক দায়-দায়িত্ব আছে। সহানুভূতির সঙ্গে কোমলাতার সঙ্গে এই দায়িত্ববোধ কেউ তার মধ্যে জাগ্রত করে দেয়নি। এ দোষ কার!

তো আমার প্রিয় ছাত্রটিকে বলেছিলাম, কথা দ্বারা আচরণ দ্বারা তোমার মাকে তুমি বোঝাবে, মা, আমি আপনারই ছিলাম, আছি এবং থাকবো। স্ত্রী হলো আমার জীবনের নতুন প্রয়োজন; আপনি আমার প্রাণ, আপনার সঙ্গে আমার নাড়ির টান।

অন্যদিকে স্ত্রীকে বোঝাতে হবে, এই সংসার সমুদ্রে তুমি একা নও; আমি তোমার পাশে আছি। নতুন জীবনে চলার পথে আমারও অনেক কষ্ট হবে, তোমারও অনেক কষ্ট হবে। তবে সান্ত্বনা এই যে, তুমিও একা নও, আমিও একা নই। আমার পাশে তুমি আছো, তোমার পাশে আমি আছি। আমার কষ্টের সান্ত্বনা তুমি, তোমার কষ্টের সান্ত্বনা আমি। আমরা পরস্পরের কষ্ট হয়ত দূর করতে পারবো না, তবে অনুভব করতে পারবো এবং হয়ত কিছুটা লাঘব করতে পারবো।

আল্লাহর কসম, এমন কোন নারিহৃদয় নেই যা এমন কোমল সান্ত্বনায় বিগলিত হবে না।

তোমার স্ত্রীকে তুমি এভাবে বলবে, আমাদের জীবন তো আলাদা ছিলো। আমরা তো একে অপরকে চিনতামও না। আল্লাহ আমাদের কেন একত্র করেছেন জানো?! একা একা জান্নাতে যাওয়া কঠিন। আল্লাহ আমাদের একত্র করেছেন একসঙ্গে জান্নাতের পথে চলার জন্য। আমি যদি পিছিয়ে পড়ি, তুমি আমাকে টেনে নিয়ে যাবে; তুমি যদি পিছিয়ে পড়ো, আমি তোমাকে টেনে নিয়ে যাবো। তুমি সতর্ক থাকবে, আমার দ্বারা যেন কারো হক নষ্ট না হয়; আমিও সতর্ক থাকবো, তোমার দ্বারা যেন কারো প্রতি যুলুম না হয়।

প্রিয় ছাত্রটিকে আমি আরো বললাম, স্ত্রীকে বোঝানোর জন্য তার সন্তানকে সামনে আনতে হবে। অর্থাৎ তুমি তাকে বলবে, দেখো, জীবন কত গতিশীল! সবকিছু কত দ্রুত শেষ হয়ে যাচ্ছে! দু’দিন আগে আমরা শুধু যুবক-যুবতী ছিলাম, আজ হয়ে গেছি স্বামী-স্ত্রী। দু’দিন পরেই হয়ে যাবো মা-বাবা। আমি বাবা, তুমি মা! আল্লাহর কাছে একজন মায়ের মর্যাদা কত! তোমার কদমের নীচে হবে তোমার সন্তানের জান্নাত! যেমন আমার মায়ের কদমের নীচে আমার জান্নাত। তো তোমার সন্তান কেমন হলে তুমি খুশী হবে? আমাকেও আমার মায়ের ঐরকম সন্তান হতে তুমি সাহায্য করো। আমি যদি ভুল করি, মায়ের কোন হক নষ্ট করি, মায়ের সামনে ‘উফ’ করি, তুমি আমাকে সাবধান করো, আমাকে সংশোধন করো। তাহলে ইনশাআল্লাহ তোমার সন্তানও তুমি যেমন চাও তেমন হবে।

প্রয়োজন হলে স্ত্রীকে মা-বাবার সামনে তিরস্কার করবে, তবে ঘরে এসে একটু আদর, একটু সোহাগ করে বোঝাতে হবে, কেন তুমি এটা করেছো?! বোঝানোর এই তরযগুলো শিখতে হবে, আর এটা দু’একদিনের বিষয় নয়, সারা জীবনের বিষয়। কিন্তু আমরা ক’জন এভাবে ভারসাম্যপূর্ণ জীবন যাপন করি?! হয় মাতৃভক্তিতে স্ত্রীর প্রতি অবিচার করি, না হয়, স্ত্রীর ভালোবাসায় অন্ধ হয়ে মা-বাবার দিলে আঘাত দেই, আর দুনিয়া-আখেরাত বরবাদ হয়। আমার একটা কথা মনে রেখো, মায়ের পক্ষ নিয়ে স্ত্রীর প্রতি অবিচার করা মূলত মায়ের প্রতি যুলুম, তদ্রূপ স্ত্রীর পক্ষ নিয়ে মায়ের হক নষ্ট করা আসলে স্ত্রীর প্রতি যুলুম। আমার একথার উৎস হলো,

أنصر أخاك ظالما أو مظلوما

অবশ্য সবকিছু হতে হবে হিকমত ও প্রজ্ঞার সঙ্গে।

একটি ঘটনা তোমাকে বলি, তোমার মত আলিমে দ্বীন নয়, সাধারণ শিক্ষায় শিক্ষিত একজন মানুষ আমাকে বলেছেন, একবার তার মা তাকে বললেন, তোর বউ আজ তোর এত আপন হয়ে গেলো কীভাবে!

আমি বললাম, দেখো মা, তোমাকে আমি মা বলি; এই ‘মা’ ডাকটুকু পাওয়ার জন্য তোমাকে কত কষ্ট করতে হয়েছে! অথচ ‘পরের বাড়ীর মেয়েটি’র মুখ থেকে তুমি বিনা কষ্টে ‘মা’ ডাক শুনতে পাও! তোমাকে যে মা বলে ডাকে সে আমার আপন হবে না কেন মা?

আরেকটা ঘটনা, এক মা তার মেয়ের শাশুড়ী সম্পর্কে বললেন, মানুষ না, মেয়েটাকে আনতে পাঠালাম, দু’টো পিঠে বানিয়ে খাওয়াবো, দিলো না, ফেরত পাঠিয়ে দিলো!

দু’দিন আগে তিনিও একই কাজ করেছিলেন, ছেলের বউকে নিতে এসেছিলো মায়ের বাড়ী থেকে। তিনি বললেন, দু’দিন পরে আমার মেয়েরা আসবে এখন তুমি গেলে কীভাবে চলবে!

ভদ্রমহিলাকে বললাম, আপনার কাজটা কি ঠিক হয়েছিলো? আপনাকে কষ্ট দেয়া আমার উদ্দেশ্য নয়, সতর্ক করা উদ্দেশ্য। আল্লাহর কাছে যদি আটকা পড়েন তখন তো আপনিই বলবেন, তুমি তো হাদীছ-কোরআন পড়েছো, আমাকে সতর্ক করোনি কেন?

মোটকথা, মেয়েদেরকে তারবিয়াত করতে হবে যাতে তারা আদর্শ স্ত্রী, আদর্শ মা এবং আদর্শ শাশুড়ীরূপে আদর্শ জীবন যাপন করতে পারে। পুরুষ হচ্ছে কাওয়াম ও পরিচালক। সুতরাং তারবিয়াত ও পরিচালনা করা পুরুষেরই দায়িত্ব। স্ত্রী, মা ও শাশুড়ী, জীবনের এই তিনটি গুরুত্বপূর্ণ ও কঠিন ধাপের জন্য ঘরে ঘরে আমরা যদি আমাদের মেয়েদের গড়ে তুলতে পারি, আদেশ দ্বারা, উপদেশ, সর্বোপরি নিজেদের আচরণ দ্বারা তাহলেই সংসার হতে পারে সুখের, শান্তির।

প্রিয় ছাত্রটিকে আরেকটি কথা বললাম, তোমার স্ত্রীর কোন আচরণ তোমার অপছন্দ হতে পারে। সেক্ষেত্রে প্রথমে তোমাকে ভাবতে হবে, তোমার সব আচরণ কি সুন্দর, তোমার স্ত্রীর পছন্দের? তাছাড়া তোমার স্ত্রীর ভালো দিক কি কিছু নেই। সেই ভালো দিকগুলোর জন্য শোকর করো, আর যা তোমার কাছে মন্দ লাগে তার উপর ছবর করো। আর যদি সংশোধন করতে চাও তাহলে ভালো দিকগুলোর প্রশংসা করো, তারপর কোমল ভাষায় বলো, তোমার এই বিষয়টা যদি না থাকতো তাহলে তুমি আরো অনেক ভালো হতে। তবে আল্লাহর পেয়ারা হাবীব ছাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লামের সেই প্রজ্ঞাপূর্ণ উপদেশ মনে রাখতে হবে, একটু বাঁকা থাকবেই, এই বক্রতা, সাহিত্যের ভাষায় যাকে বলে নায, আন্দায, মান, অভিমান, লাস্যতা, এই বক্রতা নারীর সৌন্দর্য, নারীর শক্তি। এটাকে সেভাবেই গ্রহণ করে তার সঙ্গে জীবন যাপন করতে হবে, পূর্ণ সোজা করতে চাইলে ভেঙ্গে যাবে, আর সৌন্দর্য নষ্ট হয়ে যাবে।

সত্যি সত্যি যদি তোমার স্ত্রীর গুরুতর কোন ত্রুটি থাকে তবে সেটা সংশোধনের দায়িত্ব ও কর্তব্য অবশ্যই তোমার। তবে সেক্ষেত্রেও সংশোধনের জন্য অত্যন্ত ধৈর্যের সঙ্গে দিনের পর দিন চেষ্টা করে যেতে হবে। ধমক দিয়ে, জোর খাটিয়ে সংশোধন করা যায় না, ঘরে অশান্তি আনা যায়, ঘর ভাঙ্গা যায়, আর সন্তানদের জীবনে বিপর্যয় আনা যায়।

ইসলামপুরে আমার আববার দোকানের অপর দিকে এক ভদ্রলোকের দোকান ছিলো। অবস্থা ছিলো এই যে, দোকানে বসেই মদ খেতো। আববা তাকে দাওয়াত দিলেন, আর সে খুব দুর্ব্যবহার করলো, কিন্তু আববা ধৈর্যের সঙ্গে দাওয়াত চালিয়ে গেলেন। দু’বছর পর তিনি মসজিদমুখী হলেন এবং এমন মুবাল্লিগ হলেন যে, বউকে তালাক  দেবেন। কারণ সে দ্বীনের উপর আসছে না।

আববা তাকে এভাবে বুঝালেন, ‘আমার সঙ্গে আপনার আচরণ কি মনে আছে? আমি যদি ধৈর্যহারা হয়ে আপনাকে ত্যাগ করতাম! এই পুরো কথাটা যেহেনে রেখে স্ত্রীকে তালিম করতে থাকেন। ছবর করেন, ছবর করলে আমার প্রতি আপনার যুলুম আল্লাহ মাফ করবেন। আল্লাহ যদি প্রশ্ন করেন আমার বান্দা তোমাকে আমার ঘরের দিকে ডেকেছে, তুমি তার প্রতি যুলুম করেছো কেন? তখন আপনি বলতে পারবেন, হে আল্লাহ, আমিও আপনার বান্দীর পিছনে ছবরের সঙ্গে মেহনত করেছি।’

সেই লোকের স্ত্রী কিন্তু পরবর্তী সময়ে পরদানশীন হয়েছিলো। অথচ জোশের তোড়ে লোকটা তো ঘরই ভেঙ্গে ফেলছিলো।

আসলে দোষ আমাদের। আমরা তারবিয়াত করার তরীকা শিখিনি। বোঝানোর তরয আয়ত্ত্ব করিনি।

প্রিয় ছাত্রটিকে আরো অনেক কথা বলেছিলাম, প্রায় দু’ঘণ্টা সময় তার জন্য ব্যয় করেছিলাম। সবকথা এখন মনেও নেই।

তবে একটা কথা তাকে বলা হয়নি, এখন তোমাদের মজলিসে বলি, স্ত্রীর সঙ্গে আচরণ কেমন হবে, এ সম্পর্কে একজনকে যা বলতে শুনেছিলাম, তা ছিল খুবই মর্মান্তিক। তিনি বলেছিলেন, ‘মেয়েলোক যেন তোমার মাথায় চড়ে না বসে, তাই প্রথম দিন থেকেই তাকে শাসনের মধ্যে রাখবা। পূর্ণ ইতা‘আত ও আনুগত্য আদায় করে নিবা, গোরবা কুশতান দর শবে আওয়াল।’

এ প্রবাদ এমনই বিশ্ববিশ্রুত যে, আমাদের নিরীহ বাংলাভাষায়ও বলে, ‘বাসর রাতেই বেড়াল মারতে হবে’। কিন্তু জীবনের সর্বক্ষেত্রের মত এক্ষেত্রেও আমাদের অনুসরণীয় হলো সুন্নাতে রাসুল, আর তিনি ইরশাদ করেছেন,

خيركم خيركم لأهله وأنا خيركم لأهلي

তো জীবনের শুরু থেকে শেষ পর্যন্ত শরীয়তের সীমারেখায় থেকে স্ত্রীর সঙ্গে এমন আচরণই আমাকে করতে হবে, যাতে সে মনে করে, আমি সর্বোত্তম স্বামী, আমার মতো উত্তম স্বামী হয় না, হতে পারে না।

স্ত্রীগণের সঙ্গে নবী ছাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লামের আচরণ কী ছিলো তা জানতে হবে এবং অনুসরণ করতে হবে। স্বামীর খেদমত করার মাধ্যমে স্ত্রী অনেক আজর ও ছাওয়াবের অধিকারিণী হতে পারে, এটা আলাদা কথা। তবে আমাকে মনে রাখতে হবে যে, এটা স্ত্রীর মহত্ত্ব, স্বামীর অধিকার নয়। তারা যদি কখনো মায়ের বাড়ী যেতে চায়, আমরা প্রশ্ন করি, ‘আমার খাওয়া-দাওয়ার কী হবে?’ অথচ এটা তার বিবেচনার বিষয় হতে পারে, আমার প্রশ্ন করার বিষয় নয়।

আরেকটি গুরুত্বপূর্ণ বিষয়ে সামান্য কথা বলেই মজলিস শেষ করছি। সহবাস দাম্পত্য জীবনের একটি অপরিহার্য সত্য। এ বিষয়ে আলোচনাকে হায়া-শরমের খেলাফ মনে করা হয়। ফলে বিষয়টি অজ্ঞতার মধ্যে থেকে যায়। একারণে এমনকি অনেক সময় দাম্পত্য জীবন বিষাক্ত হয়ে পড়ে।

স্ত্রী তোমার সারা জীবনের সম্পদ এবং সেরা সম্পদ।

متاع   মানে সম্পত্তি নয়, ভোগের বস্ত্ত নয়  متاع  মানে সম্পদ, ঐশ্বর্য। বিষয়টি বুঝতে না পেরে আধুনিক বুদ্ধিজীবীরা হাদীছের সমালোচনা করেন। আমরা হাদীছটির তরজমা ও ব্যাখ্যা এমন খন্ডিতভাবে করি যে, তারাও সুযোগ পেয়ে যায়।

তো স্ত্রী তোমার সম্পত্তি নয়, স্ত্রী হলো তোমার জীবনের সর্বোত্তম সম্পদ, যা যথাযোগ্য মর্যাদার সঙ্গে  তোমাকে রাখতে হবে এবং ব্যবহার করতে হবে।

প্রথমেই বর্বর ও পাশবিকরূপে নিজেকে স্ত্রীর সামনে তুলে ধরা বিরাট মুর্খতা ছাড়া আর কিছু নয়। স্ত্রী স্বামীর ভোগের পাত্রী নয়, বরং স্বামী-স্ত্রী হলো পরস্পরকে উপভোগ করার জন্য। যত দিন লাগে, দীর্ঘ সাধনা করে প্রথমে হৃদয় জয় করো, মনের দুয়ার খোলো, অন্তরের গভীরে প্রবেশ করো।

যিন্দেগীর এই কঠিন মারহালা সম্পর্কে কত কিছু যে বলার আছে, কত কিছু যে শেখার আছে! দেখি, যদি আবার কখনো সুযোগ হয়।
মাওলানা আবু তাহের মেসবাহ
(১৪৩৩ হি. শা‘বান মাসে এক খাছ মজলিসে এক বিশেষ উপলক্ষে আদীব হুজুরের একটি গুরুত্বপূর্ণ আলোচনা। মুসাজ্জিলা থেকে তা পত্রস্থ করা হল)
[দাম্পত্যজীবন সুখময় হওয়ার জন্য শুধু পুরুষের প্রচেষ্টা ও সচেতনতাই যথেষ্ট নয়, নারীরও সদিচ্ছা ও সচেতনতা অতি প্রয়োজন।

এ বিষয়ে তারও আছে অনেক দায়িত্ব। কিন্তু নারীর তালীম-তরবিয়তের ভারও তো পুরুষেরই উপর। বিয়ের আগে পিতামাতা তার তরবিয়ত করবেন, বিয়ের পর স্বামী। দাম্পত্যজীবনে নারীর দায়িত্ব কী কী, সেই সকল দায়িত্ব সম্পর্কে তাকে সচেতন করার পদ্ধতি কী এবং তার তালীম-তরবিয়ত কীভাবে করতে হবে-এটি আলাদা একটি বিষয়।

আল্লাহ করুন, কোনো মজলিসে আমরা যেন হুজুরের কাছ থেকে এ বিষয়েও বিস্তারিত দিক-নির্দেশনা লাভ করি।-তত্ত্বাবধায়ক]

12
আমার ধারণা ছিল না যে, এত বড় উপস্থিতি এখানে হবে এবং এখানেও কোনো কথা বলার প্রয়োজন পড়বে। এবার বাংলাদেশের সফর খুবই সংক্ষিপ্ত সময়ের জন্য। আবার এর মধ্যে চট্টগ্রামও সফর করতে হল। কিছক্ষুণ পর আবার রওনা হয়ে যেতে হবে। এই মুহূর্তে কোনো বয়ান করার খেয়াল আমার ছিল না। ইচ্ছা ছিল শুধু আপনাদের সাথে সাক্ষাতের। আলহামদুলিল্লাহ আপনাদের পরম আন্তরিকতা ও মুহাববতের কারণে আপনাদের সাথে আবারো সাক্ষাতের সৌভাগ্য হল। উলামায়ে কেরামের এক বিশাল জামাত এখানে একত্র হয়ে গেছেন। কিছু বলার জন্য আমাকে বলাও হচ্ছে। তাই অনিচ্ছা সত্ত্বেও কিছু কথা বলতেই হচ্ছে।

বাস্তব কথা হল আমি বয়ান করার কোনো যোগ্যতাই রাখি না। এবং বক্তা ও ওয়ায়েজদের মতো আমি কোনো বক্তব্য বা ওয়াজও করতে পারি না। তবে দ্বীনী কথাবার্তা কোনো বক্তৃতা, ওয়াজ বা বয়ানের মুখাপেক্ষী নয়। ইখলাসের সাথে সাধারণ কথাবার্তাও অনেক উপকারী হয়। কিন্তু (আল্লাহ না করুন) যদি ইখলাস না থাকে তাহলে লম্বা লম্বা ওয়াজও নিরর্থক হয়ে যায়।

এই মুহূর্তে যে কথাটা দিলে এসেছে সেটি হচ্ছে, আমরা যত কাজ করছি, আল্লাহ তাআলার ফযল ও করমে আমাদের দ্বারা যত ইলমী ও দ্বীনী কাজ হচ্ছে-চাই তা শিক্ষা-দীক্ষা হোক, লেখালেখি হোক, ফতোয়া বা ইমামতি, যাই হোক-এসবের সম্পর্ক সরাসরি দ্বীনের সাথে। এবং এটা আল্লাহ পাকের পক্ষ থেকে অনেক বড় রহমত যে, তিনি আমাদেরকে এই মহান কাজের সাথে সম্পৃক্ত করেছেন। অন্যথায় আমরা অন্য যে কোনো ব্যস্ততায় আবদ্ধ হয়ে যেতে পারতাম। নিজের পেট চালানোর জন্য মানুষ কত উপায়ই না গ্রহণ করছে। আমরাও হয়তো কোনো একটা বেছে নিতাম। কিন্তু আল্লাহ তাআলা তার অশেষ রহমতে আমাদেরকে কোনো না কোনো এমন কাজের সাথে সম্পৃক্ত রেখেছেন যার সম্পর্ক সরাসরি দ্বীনের সাথে। এর শোকর আদায় করে আমরা শেষ করতে পারব না। কেননা এটা একমাত্র আল্লাহ তাআলার তাওফীক ও দয়া। তিনি যাকে ইচ্ছা দয়া করে তার দ্বীনের কাজে লাগিয়ে দেন।

অনেক সময় বিভিন্ন পারিপার্শ্বিক অবস্থা এবং এমন উপায়-উপকরণ সামনে চলে আসে যে, মানুষ ইচ্ছায়-অনিচ্ছায় এ জাতীয় দ্বীনী কাজের সাথে লেগে থাকে। আমি আমার নিজের অবস্থাই বর্ণনা করি। ছোটকালে আমার কবিতা বা শে’র-এর প্রতি খুব আগ্রহ ছিল। আমার বয়স যখন ৪/৫ বছর তখন আমি যেকোনো বিষয়ে কবিতা বলতে পারতাম। এমনকি আমাদের বোনেরা, যারা কখনো স্কুলের ধারেকাছেও যায়নি-তারাও কবিতা বলতে পারত। আমার মামা খুব ভালো কবি ছিলেন। ওই বয়সে যখন কোনো কবিতা শুনতাম তখন তা নিয়েই ব্যস্ত থাকতাম এবং মুখে মুখে আবৃত্তি করতাম। একটু বড় হওয়ার পর বড় বড় কবিদের বই পড়তে আরম্ভ করলাম এবং নিজেই সুন্দর সুন্দর কবিতা বলতে লাগলাম। ১২ বছর বয়সে গজল বলা আরম্ভ করলাম। এভাবে সাহিত্য-কবিতা ইত্যাদির প্রতি ওই বয়সে একটা ঝোঁক তৈরি হয়ে গিয়েছিল।

এর কারণ ছিল, আমি যখন দারুল উলূমে পড়ি তখন যে শিক্ষকের কাছে আমরা নাহবেমির থেকে শরহে জামী পর্যন্ত পড়েছি মাওলানা সাহবান মাহমুদ ছাহেব, তিনি খুব ভালো কবি ছিলেন। এমনকি দরসের মধ্যেও তিনি কবিতা বিষয়ে আলোচনা করতেন। এতে কবিতার দিকে আমাদের আগ্রহ হয়।

আবার কখনো আরবী সাহিত্যের দিকে এগিয়ে যাওয়ার আগ্রহ জেগে উঠত। কিন্তু সে পথে বেশি দূর যাওয়া হয়নি। যদি নিজের আগ্রহ মোতাবেক চলতাম তাহলে আল্লাহ জানেন আজ কোথায় কি হত। আমার আববাজান রাহ. এই কাজে (ফতোয়া) লাগিয়ে দিয়েছেন। মানুষের ঝোঁক থাকে একদিকে, কিন্তু আল্লাহ তাআলা তার ফযল ও করমে সে ঝোঁকের গতি পরিবর্তন করে দেন অন্যদিকে।

এজন্য এটা আল্লাহ তাআলার অনেক বড় দয়া ও মেহেরবানি যে, তিনি আমাদেরকে দ্বীনী কাজের সাথে সম্পৃক্ত করেছেন। আমরা এর শোকর আদায় করে কখনো শেষ করতে পারব না। কিন্তু এই কাজকে উপকারী বানানোর জন্য, দুনিয়া ও আখিরাতে এর দ্বারা ফায়দা হাসিলের জন্য এ কাজের রূহ বা প্রাণটাকে আগে চিনতে হবে ও অবলম্বন করতে হবে। প্রতিটি দ্বীনী কাজের একটি রূহ রয়েছে। যতণ পর্যন্ত ওই রূহ অর্জিত না হয় ততক্ষণ পর্যন্ত ওই দ্বীনী কাজ দ্বারা ফায়দা হাসিল করা সম্ভব হয় না; বরং অনেক সময় তা অনেক বড় ফেতনার কারণ হয়ে দাঁড়ায়। এজন্যই দুআ করা হয়-

اللهم إني أعوذ بك من علم لا ينفع

ইলম তো চাই, কিন্তু এমন ইলম নয়, যার কোনো ফায়দা নেই।

তো এ ইলম উপকারী হওয়ার জন্য এবং এই ইলমকে উপকারী বানানোর জন্য তাতে রূহ থাকতে হবে। ইলমের মধ্যে যখন ওই রূহ এসে যাবে তখন এটা উপকারী হয়ে যাবে। মানুষ এর দ্বারা উপকৃত হবে। এর সৌরভ চারদিকে ছড়িয়ে পড়বে। গোটা জগত এর দ্বারা উপকৃত হতে থাকবে। ওই ব্যক্তির জন্য তা সদকায়ে জারিয়া হয়ে যাবে। আল্লাহর কাছে পৌঁছার পর আল্লাহর সন্তুষ্টি তার নসীব হবে। আর যদি ওই ইলম (আল্লাহ না করুন) উপকারী না হয়, এতে রূহ না থাকে তাহলে তা একটি প্রাণহীন শরীর হিসেবে গণ্য হবে। যার কোনো রূহ নেই। দেখতে সবকিছুই ঠিকঠাক। হাত, পা, কান, সব ঠিক। কিন্তু তার মধ্যে রূহ নেই। তখন তো সেটা আর মানুষ থাকেনি; বরং তা প্রাণহীন জড় বস্তর মধ্যে গণ্য হয়। (আল্লাহ না করুন) ওই ইলমের মধ্যেও যদি রূহ না থাকে তখন তাও এ রকম মৃত লাশের মতো;  বরং মৃত লাশের তো কোনো উপকার করার শক্তি নেই, আবার অপকার করারও শক্তি নেই। কিন্তু ইলম যদি উপকারী না হয়, এতে রূহ না থাকে তাহলে তা শুধু এমন নয় যে, কোনো উপকার করে না; বরং তা ক্ষতির কারণ হয়ে দাঁড়ায়। এর দ্বারা ফেতনা সৃষ্টি হয়। এজন্যই আমাদের ইলমের মধ্যে যেন রূহ সৃষ্টি হয়-এর ফিকির করতে হবে।

ওই রূহটা কী? যদি একশব্দে তা বলতে চাই তাহলে সেটা হল, ইখলাস। ইলম যদি ইখলাসের সাথে শেখা ও শেখানো হয় অর্থাৎ এই ইলম আমি এজন্য শিখছি এবং অন্যের কাছে পৌঁছে দিচ্ছি যেন আমার আল্লাহ আমার ওপর রাজি হয়ে যান তাহলে তার রূহ বা প্রাণটা ঠিক থাকবে। এটাই হল সমস্ত আমলের রূহ।

আর যদি (আল্লাহ না করুন) ইখলাস না থাকে তাহলে এই ইলমের কারণে আমার দ্বারা ফেতনা স"ষ্টি হবে। যখন এই ইলম ইখলাসের সাথে না হয়, একমাত্র আল্লাহর সন্তুষ্টির উদ্দেশ্যে না হয়ে মাখলুকের সন্তুষ্টির উদ্দেশ্যে হয় মানুষের প্রশংসা অর্জনের উদ্দেশ্যে হয়, মানুষের মাঝে নিজের প্রসিদ্ধি অর্জনের উদ্দেশ্যে হয়, মানুষ থেকে দুনিয়াবী ফায়েদা হাসিলের উদ্দেশ্যে হয়-তখন ওই ইলম থেকে ফেতনা জন্ম নেয়।

পারস্পরিক হিংসা-বিদ্বেষ সৃষ্টি হয়। ভাবনা আসে, অমুকের প্রসিদ্ধি বেশি হয়ে গেছে আমারও ওই রকম প্রসিদ্ধি অর্জন করতে হবে। মানুষের মাঝে অমুকের গ্রহণযোগ্যতা বেশি হয়ে গেছে এখন সে এই চেষ্টায় লেগে গেছে যে, আমি তার থেকেও এগিয়ে যাই। অথবা সে আমার থেকে পেছনে পড়ে যাক। আমার প্রসিদ্ধি বেশি হোক। মানুষ আমাকে বেশি মানুক ইত্যাদি। যখন এসব এসে যায় তখন ইখলাস শেষ হয়ে যায়। এর পরিণতিতে পারস্পরিক দ্বন্দ্ব শুরু হয়। বিভিন্ন গ্রুপিং সৃষ্টি হয়। মানুষ বিভিন্ন দল-উপদলে বিভক্ত হয়ে পড়ে এবং একে অন্যের প্রতি হিংসা-দলাদলির ধারাবাহিকতা শুরু হয়ে যায়। এত কিছু কেন হয়? এজন্য যে, ইখলাস-যা ইলমের রূহ, তা উপস্থিত নেই।

আর যদি ইখলাস থাকত (আল্লাহ তাআলা দয়া ও মেহেরবানি করে আমাদের সকলকে ইখলাসের দৌলত নসীব করুন) তাহলে এর ফলাফল এই হতো যে, যে ব্যক্তি দ্বীনের কাজ করছে, যার দ্বারা কোনো না কোনোভাবে দ্বীনের উপকার হচ্ছে তার সম্পর্কে সে ভাবত, এটা তো আমারই কাজ ছিল। সে এই কাজটা করছে। এতে সে আমারই উপকার করছে। এটা তো মেহনত করে আমারই করতে হত। ওই আল্লাহর বান্দা আমার প থেকে কাজটা করে দিয়েছেন। অন্তরে এই অনুভূতি বসে গেলে পারস্পরিক মুহাববত সৃষ্টি হবে। ভাবনাটাই হবে এমন যে, ওই কাজ তো আমার করার দরকার ছিল। এটা তো আমার জন্য আনন্দের ব্যাপার, খুশির ব্যাপার যে, সে আমার কাজ করে দিচ্ছে। আমি তার সাথে লড়তে যাব কেন? সে কেন এটা অর্জন করে ফেলল-এজন্য হিংসা করতে যাব কেন। এটাই হল ইখলাস ও ইখলাসশূন্যতার মধ্যে পার্থক্য।

হযরত মাওলানা ইদ্রিস কান্ধলভী রাহ.। অনেক বড় বুযুর্গ এবং অত্যন্ত সরল-সাদাসিধা মানুষ ছিলেন। আমার আববাজান রাহ.কে খুব মুহাববত করতেন। একবার আমি তাঁর খেদমতে গিয়েছি। তিনি তখন পায়চারি করছিলেন। আমাকে বললেন, মৌলভী শফীকে আমার সালাম বলবে। সবসময় বলতেন, মৌলভী শফী। তাঁর নামের আগে-পরে এত লম্বা-চওড়া লকব-উপাধি লাগানোকে পছন্দ করতেন না। এরপর বললেন, আচ্ছা মৌলভী সাহেব, আরেকটা কথা শোনো। আমি বললাম, জ্বী। তিনি বললেন, মৌলভী শফী সাহেবের সাথে আমার ৫২ বছরের সম্পর্ক। (সাহেব বলেছেন কি না আমার মনে নেই) এবং মুহাববতের সম্পর্ক। এই মুহাববতের সম্পর্ক দিন দিন বেড়েই চলেছে। এই লম্বা সময়েও ওই

মুহাববতের সম্পর্কের মধ্যে কোনো কমতি আসেনি। আচ্ছা মৌলভী সাহেব! তুমি কি জান, কেন এত লম্বা সময়েও সম্পর্কে কোনো কমতি আসেনি? একথা বলে তিনি একটি সূক্ষ্ম ইলমী বিষয় টেনে আনলেন। বললেন, মৌলভী সাহেব! তুমি কাফিয়া পড়েছ? আমি বললাম, জ্বী, পড়েছি। বললেন, কাফিয়ার মধ্যে মাতবুআত-এর একটি অধ্যায় আছে। আমি বললাম, জ্বী আছে।

তাতে পূর্বের তাওয়াবে’-এর একটি ছিফত হয়। ঐ ছিফত দুই প্রকার। একটা ছিফত হয় মাতবু-এর। আরেকটা ছিফত হয় মুতাআল্লিকে মাতবু’-এর। যেমন-زيد عالم বললে যায়েদ-এর ছিফত হয় আলিম। আবার মুতাআল্লিকে মাতবু-এর ছিফত হয়। অর্থাৎ زيد العالم أبوه এখানে ‘আলআলিমু’ বাস্তব ছিফত হল ‘আবূহু’-এর। কিন্তু তারকীবের সময় ‘আলআলিমু’ শব্দটি ‘যায়েদ’-এর ছিফত হবে।

زيد العالم أبوه ـ أخوه  এখানে ‘যায়েদ’ মওসুফ আর ‘আলআলিমু আবূহু’ হল তার ছিফত। কিন্তু আলিম মূলত ‘আবূহু’-এর ছিফত। এরপর তিনি বলেন, মৌলভী সাহেব। যখন মৌলভী শফীর কোনো ইলমী কাজ আমার সামনে আসে তখন আমি নিজেকে زيد العالم أبوه এর মতো মনে করি। অর্থাৎ আমার ভাই যে দ্বীনী কাজ করছে এটা তো আমারই কাজ। যখন তার কোনো তাসনীফ বা রচনা আমার সামনে আসে তখন আমি মনে করি যে, এটা আমারই কাজ ও কৃতিত্ব। তার সাথে আমার ৫২ বছরের সম্পর্ক। এই মনোভাব নিয়েই আমি চলছি। এতে কখনো সামান্য ফাটল সৃষ্টি হয়নি। এখন যদি কোনো আলিম কোনো দ্বীনী কাজ করে তখন অন্যজন সেটাকে নিজের জন্য অসম্মানের মনে করে। তাই মৌলভী সাহেব! এগুলো থেকে বেঁচে থাকবে।

দেখুন, মাত্র  দুই শব্দে তিনি কত বড় হাকীকত বর্ণনা করে দিয়েছেন। যদি আমার মধ্যে এই চেতনা এসে যায় যে, যে-ই দ্বীনের কোনো উপকারী কাজ করছে সে আমারই কাজ করছে, তখন এই অনুভূতি তার ইলমের মধ্যে ইখলাস সৃষ্টি করবে। এবং এতে নূর পয়দা হবে। আন্তরিকতা সৃষ্টি হবে। পরস্পরের প্রতি ঘৃণা, দুশমনি দূর হয়ে যাবে। হিংসা-বিদ্বেষ থাকবে না।

কিন্তু কোথাও যদি এই পরিস্থিতি সৃষ্টি হয়ে যায় যে, আমার নাম হোক, আমার কর্তৃত্ব অর্জিত হোক, আমার গলায় মালা পরানো হোক, আমার প্রসিদ্ধি-পরিচিতি ছড়িয়ে পড়ুক তখন সেখান থেকেই ওই দোষগুলি আসা শুরু হয়ে যাবে। পরস্পরের প্রতি ঘৃণা-বিদ্বেষ সৃষ্টি হবে। এবং ইখলাস, যা দ্বীনের রূহ সেটা শেষ হয়ে যাবে। ইখলাসের সাথে যদি কোনো সংক্ষিপ্ত বাক্যও বলা হয় তাহলে তাও খুব ফায়েদা দেয়। শ্রোতার অন্তরে তার প্রভাব পড়ে। জীবনের গতি পরিবর্তন করে দেয়। আর ইখলাস ব্যতীত জ্বালাময়ী বক্তব্য দিয়ে দাও, অগ্নিঝরা বক্তা বনে যাও, বড় নামকরা ওয়ায়েজ হয়ে যাও, সে বক্তার কথা শ্রোতার এক কানে ঢুকবে অন্য কান দিয়ে বের হয়ে যাবে। অন্তরে কোনো প্রভাবই পরিলক্ষিত হবে না।

আমার আববাজান রাহ.কে বলতে শুনেছি যে, হযরত আবদুল কাদের জিলানী রাহ.-এর একজন ছেলে ছিল। নতুন আলিম হয়েছে। দেশ-বিদেশ থেকে অনেক ইলম অর্জন করে এসেছে। ফিরে এসে আববাজানের খেদমতে উপস্থিত হল। হযরত শায়খ জিলানী রাহ. তার দরবারে উপস্থিত লোকদের সামনে মাঝে মাঝে বয়ান করতেন। এখন ছেলে যেহেতু নতুন নতুন ইলম শিখে এসেছে তাই তাকে বললেন, আজকে অনেক মানুষ উপস্থিত হয়েছে। আজ তুমিই বয়ান কর। তখন ছেলে তো নতুন নতুন ইলম অর্জন করে এসেছে। তাজা ইলম ছিল, আগ্রহ-উদ্দীপনাও ছিল প্রচুর। এক জ্বালাময়ী বক্তব্য দিয়ে দিলেন। ইলমের দরিয়া প্রবাহিত করে দিলেন। উপস্থিত লোকজন চুপচাপ শুনলেন। তাদের অবস্থা হল, আমাদের শায়খের ছেলে বয়ান করছে। শুনতে হচ্ছে, শুনছি। ব্যস, এতটুকুই। কারো মাঝে কোনো পরিবর্তন বা প্রভাব পরিলক্ষিত হয়নি। যখন তার বয়ান শেষ হল তখন শায়খ রাহ. বসলেন। বললেন, ভাই! আমি গত রাতে রোযা রাখার নিয়ত করেছিলাম। এজন্য এক পেয়ালা দুধ সাহরীর সময় পান করার জন্য তুলে রেখেছিলাম। এর মধ্যে রাতে বিড়াল এসে সব দুধ খেয়ে ফেলল। যার কারণে আমি আজ রোযা রাখতে পারিনি।’ একথা বলার সাথে সাথেই পুরা মজলিস  হু হু করে কেঁদে উঠল।

তিনি কোনো সূক্ষ্ম ইলমী বিষয়ও বললেন না, কোনো ফাসাহাত-বালাগাতও বর্ণনা করলেন না। সাদাসিধাভাবে একটা ঘটনা শুনিয়ে দিলেন আর পুরা মজলিস গড়াগড়ি খেতে লাগল। পরে শায়খ রাহ. ছেলেকে বললেন, বেটা! তুমি যে ইলম অর্জন করে এসেছ। মাশাআল্লাহ, আল্লাহ তোমার ইলমে আরো উন্নতি দান করুন। এটা শুধু মানুষের কান পর্যন্ত পৌঁছেছে। এখন ঐ ইলম অর্জন করার চেষ্টা কর, যা দিলে প্রভাব ফেলে, অন্তরে নাড়া দেয়।

কখন অন্তরে নাড়া দিবে? যখন তা ইখলাসের সাথে হবে। যে কথা ইখলাসের সাথে দিল থেকে বের হয় তা মানুষের অন্তরে প্রভাব ফেলে। তুমি যখন ওই ইখলাস অর্জন করবে তখন যা বলবে তা মানুষের অন্তরে পৌঁছে যাবে। তাদের যিন্দেগী পরিবর্তন হয়ে যাবে। এতে তোমার ইলম সদকায়ে জারিয়া হবে। আখিরাতে কাজে আসবে।

সারকথা হল আমাদের ইলমের রূহ  হল ইখলাস। এখন আমাদের কাজ হল, আমরা যে কাজই করব, শুধু আল্লাহর জন্যই করব। মাখলুক থেকে পরিপূর্ণভাবে দৃষ্টি সরিয়ে নেব। আমি যে কাজ করছি, মানুষ আমাকে এ ব্যাপারে ভালো বলছে কি খারাপ বলছে, প্রশংসা করছে কি নিন্দা করছে-এসব কিছু থেকে দৃষ্টি সরিয়ে নিজের দিলকে আল্লাহমুখী করে নিতে হবে যে, আমার আল্লাহ আমার এই কাজকে পছন্দ করছেন।

আববাজান রাহ. বলতেন, হিন্দিতে একটি প্রবাদ আছে, যার একটি অংশ হল-

پيا جسكو چاہے سهاگت وہی ہے.

পিয়া বলা হয় প্রেমিকাকে। আর কোনো মেয়ে যখন বলে তখন তার অর্থ হবে, স্বামী। কেননা মেয়েদের জন্য তার বাস্তব প্রেমিক একমাত্র স্বামীই হয়ে থাকে। আর সোহাগত বলা হয় যে মেয়ের স্বামী আছে এবং জীবিত আছে। তো এই প্রবাদবাক্যের একটা পটভূমি আছে। তা হল, একটা মেয়ের নতুন বিবাহ হয়েছে। বিবাহের পর যখন স্বামীর সাথে তার শ্বশুরালয়ে যাওয়ার সময় হল তখন তার বান্ধবিরা তাকে সাজগোজ করতে লেগে গেল। তারা তাকে স্বামীর বাড়িতে পাঠানোর জন্য তৈরি করতে লাগল এবং তার সৌন্দর্যের প্রশংসা করতে লাগল। একজন এসে বলে, তোমাকে খুব সুন্দর দেখাচ্ছে। আরেকজন এসে বলে, তোমাকে আজ খুব সুন্দর লাগছে। আরেকজন এসেও একই কথা বলে। মোটকথা, যে-ই আসে সেই তার রূপ-সৌন্দর্যের প্রশংসা করে। আর ওই মেয়ে চুপচাপ শুধু তাদের কথা শুনে যায়। তখন তার এক বান্ধবী বলল, (এই মেয়ে!) তোমার কী হয়েছে? তোমার বান্ধবীরা তোমার এত প্রশংসা করছে কেউ এটা বলছে। কেউ ওটা বলছে। কিন্তু তুমি না তাদের ধন্যবাদ দিচ্ছ, না তাদের কথায় কোনো আনন্দ প্রকাশ করছ। তোমার কী হয়েছে?’ তখন সে মুখ খুলল। বলল, হ্যাঁ, এটা তো আমার জন্য আনন্দের এবং আমি তাদের ধন্যবাদও দিচ্ছি। কিন্তু তাদের প্রশংসায় আমার কি ফায়েদা হবে? আমি যার কাছে যাচ্ছি (একমাত্র তার প্রশংসাই আমার কাজে আসবে)। সে যদি বলে, তুমি সুন্দর তাহলে আমি খুশি। অপরদিকে এরা সবাই আমার প্রশংসা করল। কিন্তু আমি যার কাছে যাচ্ছি সে যদি বলে, তুমি অসুন্দর। তাহলে তো আমার পুরা যিন্দেগী বরবাদ। এদের প্রশংসায় আমার কী আসে যায়।

আমার আববাজান রাহ. বলতেন, এক অবলা মেয়ে, সেও জানে যে, কার প্রশংসা তার কাজের, আর কার প্রশংসা বেকার। তদ্রূপ আমাদেরও এটা বুঝতে হবে যে, কার প্রশংসা আমার প্রয়োজন। সারা দুনিয়া যদি আমার প্রশংসা করতে থাকে, আমার নামে বিভিন্ন লকব-উপাধি লাগাতে থাকে, আরো কত কী বলতে থাকে তাদের সেসব প্রশংসা তো হাওয়ায় উড়ে গেছে। প্রশংসা করেছে তো তা হাওয়ায় মিলিয়ে গেছে। তাতে আমার কি ফায়েদা। আমার তো ওখানের প্রশংসা দরকার, যেখানে আমি যাচ্ছি। সেখানে যদি বলে, (তরজমা) হে প্রশান্ত মন! তুমি তোমার পালনকর্তার নিকট ফিরে যাও সন্তুষ্ট ও সন্তোষভাজন হয়ে। অতপর আমার বান্দাদের অন্তর্ভুক্ত হয়ে যাও এবং আমার জান্নাতে প্রবেশ কর।

তখন তার প্রশংসা আমার কাজে আসবে। চির জীবনের নেয়ামত আর সুখ-শান্তি আমার অর্জিত হবে।

 তো আমাদের জন্য এটা অনেক বড় ফেতনা যে, মাখলুকের রেযামন্দি, মাখলুকের পছন্দ-অপছন্দ আমাদের কাজের মাপকাঠি হয়ে দাঁড়িয়েছে, যার ফলে অনেক সময় আমাদের কাজে ইখলাস আর থাকে না। এ ব্যাপারেই তো হাদীস শরীফে এসেছে-

তুমি যে উদ্দেশ্যে দুনিয়ায় ইলম শিখেছ-শিখিয়েছ তা বলা হয়ে গেছে।

               যা চেয়েছ ওখানে পেয়ে গেছ। এখানে তোমার জন্য আর কিছুই  নেই।

আল্লাহ তাআলা তার ফযল ও করমে আমাদের সকলকে ইখলাসের দৌলত দান করুন। যেদিন আমাদের এই ইখলাস অর্জন হয়ে যাবে আমার দৃঢ় বিশ্বাস ওইদিন আমাদের মধ্যকার সকল হিংসা-বিদ্বেষ, ঝগড়া-বিবাদ, গ্রুপিং-দলাদলি সব শেষ হয়ে যাবে। মনের ভেতরে জাগবে, যে দ্বীনের কাজ করছে সে আমারই কাজ করছে। তার যে উন্নতি হচ্ছে সেটা আমারই উন্নতি। যেদিন এই খেয়াল আমাদের অন্তরে বসে যাবে সেদিন ইনশাআল্লাহ আমাদের কাজে নূরও হবে, বরকতও হবে।

 

কিন্তু কখনো কখনো শয়তান আমাদেরকে বিভিন্নভাবে পথভ্রষ্ট করার চেষ্টা করে। আমার আববাজান রাহ. বলতেন যে, মৌলভীর শয়তানও মৌলভী হয়। সে কি কোন মৌলভীকে পথভ্রষ্ট করলে গুনাহকে সওয়াব বলে, খারাপকে ভালো আখ্যা দিয়ে পথভ্রষ্ট করবে? কখনো নয়, তার জানা আছে যে, এ মৌলভী। এ জানে কোনটা হালাল, কোনটা হারাম। কোনটা জায়েয আর কোনটা না-জায়েয। সে তো পথভ্রষ্ট করার ভিন্ন পন্থা অবলম্বন করে। বলে যে, আমি যে আরেকজনের সাথে মতবিরোধ বা ইখতিলাফ রাখি সেই ইখতিলাফটাও দ্বীনের জন্যই রাখি। দ্বীনের চাহিদাই হল এটা যে, আমি তার সাথে ইখতিলাফ রাখি। তার থেকে আলাদা থাকি এবং নিজস্ব পরিচিতি গড়ে তুলি। কেননা সে দ্বীনের সঠিক ব্যাখ্যা, সঠিক মর্ম বর্ণনা করছে না। এজন্য নিজস্ব ক্ষেত্র তৈরি করব যাতে আমি দ্বীনের সঠিক ব্যাখ্যা, সঠিক মর্ম মানুষের সামনে উপস্থাপন করতে পারি। আমার আববাজান রাহ. বলতেন, শয়তান মৌলভীদেরকে এভাবেই ধোঁকা দেয়।

এজন্য একথা আমাদের খুব ভালোভাবে স্মরণ রাখতে হবে যে, অনেক সময় গন্তব্য এক হয়, কিন্তু

গন্তব্যে পৌঁছার রাস্তা বিভিন্ন হয়। আর রাস্তা কখনো মূল উদ্দেশ্য বা মাকসাদ হয় না। বরং তা গন্তব্যে পৌঁছার একটা মাধ্যমমাত্র। আমাদের মাঝে একটা বড় খারাবি এটাও ঘটে যে, কেউ একজন গন্তব্যে পৌঁছার জন্য একটা মাধ্যম গ্রহণ করল। আর ঐ মাধ্যমকেই নিজের মাকসাদ বানিয়ে নিল। আর এটাকে মাকসাদ বানানোর ফল এই দাঁড়াল যে, এই রাস্তা ব্যতীত অন্যগুলোর ব্যাপারে তার ধারণা গড়ে উঠল, এগুলি দ্বীনের সঠিক পথ নয়। তখন শয়তান আসে এবং রাস্তাকে মাকসাদ বানিয়ে দেয়। আঞ্চলিকতা, গোত্রপ্রীতি ইত্যাদি সৃষ্টি করে।

আমাদের সকলের গন্তব্য এক অর্থাৎ দ্বীন। আমরাও ওই গন্তব্যে পৌঁছব এবং অন্যদেরও পৌঁছানোর চেষ্টা করে যাব। এই গন্তব্যে পৌঁছার এক রাস্তা তাবলীগ, এক রাস্তা ওয়াজ ও বয়ান, এক রাস্তা লেখালেখি। গন্তব্যে পৌঁছার বিভিন্ন

রাস্তা রয়েছে। এখন যারা ওই গন্তব্যে পৌঁছার একটা রাস্তা বেছে নিল তারা মনে করে এটাই দ্বীন। বাকি যারা আরো অন্যান্য রাস্তায় চলছে তা দ্বীনই নয়। যেমন একজন তাবলীগের রাস্তা অবলম্বন করল। আমাদের তাবলীগী জামাত, মাশাআল্লাহ, সারা দুনিয়াব্যাপী আল্লাহ তাআলা তাদেরকে ব্যাপক গ্রহণযোগ্যতা দান করেছেন এবং তাদের দ্বারা সারা দুনিয়ায় দ্বীনের যে উপকার হচ্ছে এরকম এককভাবে আর কোনো জামাত দ্বারা এত বেশি উপকার হচ্ছে না। কিন্তু কখনো কখনো তাদের অন্তরে এমন ধারণা সৃষ্টি হয় যে, আমরা যা করছি এটাই একমাত্র দ্বীনের কাজ। অন্য যারা আরো বিভিন্ন পন্থায় দ্বীনের কাজ করছে সেটা দ্বীনই নয়।

এক জায়গায় আমার জুমআর দিন আসরের পর বয়ানের প্রোগ্রাম ছিল। নামাযের পর সবাইকে উপস্থিত থাকার জন্য এলান করা হল। তখন আমাদের ওখানে মসজিদে যেসব তাবলীগী ভাইয়েরা আছেন তারা এসে আমাকে বলতে লাগল, আপনি বয়ানের জন্য ভুল সময় নির্ধারণ করেছেন। আমি বললাম, কেন? তারা বললেন, আজকের গাশতে মানুষ আসবে না। আমি বললাম, বয়ান কখন হয়? বললেন, মাগরিবের পর। আমি বললাম, আমাদের কথাবার্তা তো আসরের পর হবে। বললেন, না। আসরের পর যখন সবাই আপনার মজলিসে অংশগ্রহণ করবে তখন মাগরিবের পর আবার সময় দেওয়া তাদের জন্য কষ্টকর হয়ে যাবে এবং আমাদের গাশতের সমস্যা হয়ে যাবে। আমি বললাম, এটা তো কোনো সমস্যাই নয়। আমি নিজেই বলে দেব যে, মাগরিবের পর সবাই যেন শরিক থাকে। তারা বললেন, না। মানুষের জন্য কষ্টকর হয়ে যাবে। তারা বসবে না। বললাম, তাহলে আমার কি করার আছে? তখন তারা আমাকে বললেন, আপনি দ্বীনের কাজে বাধা সৃষ্টি করছেন। দ্বীনের তাবলীগের কাজে বাধা দিচ্ছেন।

তো কখনো কেউ কেউ এটা মনে করে যে, আমি যে পথ গ্রহণ করেছি এটাই দ্বীন। বাকি যারা আরো অন্যান্য পথে দ্বীনের কাজ করছে তা দ্বীনই নয়। এভাবে সে রাস্তাকেই মাকসাদ বানিয়ে নেয়।

এর দ্বারা আবার কেউ এটা মনে করবেন না যে, আমি তাবলীগের বিরোধিতা করছি। তাদের দ্বারা মাশাআল্লাহ দ্বীনের অনেক বড় কাজ হচ্ছে। কিন্তু অনেক সময়  তাদের মধ্যে নিচের দিকে এমন লোকও আসে, যারা নিজেদেরকেও নিন্দিত করে এবং পুরা জামাতকে নিন্দার মুখোমুখি করে।

অতএব রাস্তা বা মাধ্যমকেই মাকসাদ বানিয়ে নেওয়া এটা শয়তানের এক বড় ধোঁকা। কেউ কোনো দ্বীনের কাজ করছে তো প্রথমে দেখতে হবে তার দ্বারা সামগ্রিকভাবে মানুষের উপকার হচ্ছে কি না? যদি তার দ্বারা কোনোভাবে মানুষের উপকার হচ্ছে-দেখা যায় তাহলে সে অনুমোদিত যে রাস্তাই গ্রহণ করুক ওই রাস্তা থেকে দৃষ্টি সরিয়ে ঐটাকে নিজের কাজ মনে করতে হবে। যখন আমাদের এই কাজের মধ্যে রূহ এসে যাবে তখন সেটা যে প্রকারের কাজই হোক না কেন চাই ওয়াজ-বক্তৃতা হোক, চাই মাদরাসায় পড়া-পড়ানো হোক, লেখালেখি হোক, ফতোয়া হোক, সবই নেক কাজ হবে। দ্বীনের কাজ হিসেবে গণ্য হবে। আল্লাহ তাআলা আমাদের সকলের অন্তরে এই কথাগুলো বসিয়ে দিন এবং এর উপর আমল করার তাওফীক দান করুন।

 

[গত ২১/১২/২০১১ ইং তারিখে শায়খুল ইসলাম মুফতী মুহাম্মাদ তাকী উসমানী দামাত বারাকাতুহুম ঢাকার শায়খ যাকারিয়া ইসলামিক রিসার্চ সেন্টারে বয়ানটি করেছেন। মুসাজ্জিলে ধারণকৃত মূল উর্দু থেকে বয়ানটি বাংলায় অনূদিত।

অনুবাদ : মুহাম্মাদ ইউসুফ]

13
Allah: My belief / কুরআন কীভাবে বুঝব
« on: July 12, 2015, 02:35:27 PM »
 খুতবায়ে মাসনুনার পর : মুহতারাম দোস্ত ও বুযুর্গ! এটা আমার জন্য কতই না সৌভাগ্যের বিষয় যে, আল্লাহ পাক এমন একটি শহরে আসার তাওফীক দিয়েছেন, যে শহর কুতবুল ইরশাদ মাওলানা গাঙ্গুহী রাহ.-এর খলীফাগণ ও শায়খুল হিন্দ মাওলানা মাহমুদ হাসান রাহ.সহ অন্য বুযুর্গদের ফায়েযে ধন্য। আল্লাহর দয়া ও অনুগ্রহ যে, এ কারণে শহরে দ্বীনি পরিবেশ দেখা যাচ্ছে। আমাকে বলা হয়েছে, ‘কুরআন বুঝার আদব’ সম্পর্কে আলোচনা করার জন্য; তাই আমি ঐ আয়াত তেলাওয়াত করেছি, যে আয়াতে আল্লাহ পাক নবী কারীম সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লামকে পৃথিবীতে প্রেরণের লক্ষ্য ও উদ্দেশ্য বর্ণনা করেছেন। নবী সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লামকে প্রেরণের উদ্দেশ্য আল্লাহ তাআলা বলেন- لقد من الله على المؤمنين اذ بعث فيهم رسولا من انفسهم، يتلو عليهم آياته ويزكيهم ويعلمهم الكتاب والحكمة، وان كانوا من قبل لفى ضلال مبين ‘আল্লাহ মুমিনদের ওপর বড়ই দয়া ও অনুগ্রহ করেছেন যে, তিনি তাদের থেকেই একজন রাসূল প্রেরণ করেছেন।’ যিনি তাদের নিকট তাঁর আয়াতসমূহ তিলাওয়াত করেন, তাদেরকে পরিশুদ্ধ করেন এবং কিতাব ও হিকমত শিক্ষা দেন। যদিও তারা পূর্বে স্পষ্ট বিভ্রান্তিতেই ছিল।-আলে ইমরান : ১৬৪ আল্লাহর প্রথম অনুগ্রহ হল -রাসূল প্রেরণ। দ্বিতীয় অনুগ্রহ, মানুষের মধ্য থেকে প্রেরণ। অর্থাৎ এমন রাসূল প্রেরণ করেছেন, যিনি মানবিক চাহিদাগুলো বোঝেন। তিনি বোঝেন কোন্ জিনিস মানুষের প্রয়োজন, মানুষের কী দরকার। কোনো ফেরেশতা পাঠাননি, যিনি পানাহার করেন না। এরপর আল্লাহ পাক নবী প্রেরণের চারটি উদ্দেশ্য বর্ণনা করেছেন- ১. يتلو عليهم آياته ‘তাদেরকে কিতাব ও আয়াতসমূহ পড়ে শোনান।’ ২. ويزكيهم ‘তাদেরকে পবিত্র করেন।’ অর্থাৎ তাদের চরিত্রকে পূতপবিত্র ও সুন্দর করেন, উত্তম ও শ্রেষ্ঠ বানান। ৩-৪. ويعلمهم الكتاب والحكمة ‘তাদেরকে কিতাব ও হিকমতের তালীম দেন।’ কুরআন তিলাওয়াত একটি পৃথক উদ্দেশ্য এ চারটি উদ্দেশ্য আল্লাহ পাক চার স্থানে উল্লেখ করেছেন। এতে এগুলোর গুরুত্ব বুঝা যায়। আমি এ চারটির মধ্যে দুইটির আলোচনা করতে চাই। কিতাবের তিলাওয়াত এবং কিতাবের তালীম। আল্লাহ পাক কুরআন শরীফের আয়াতের তেলাওয়াতকে নবী প্রেরণের পৃথক একটি উদ্দেশ্য বলে ঘোষণা দিয়েছেন। আর কুরআন বোঝাও আলাদা আরেকটি উদ্দেশ্য। এ দ্বারা অনেকের ভুল বুঝাবুঝির অবসান হবে বলে আশা করি, যারা বলেন, মক্তবে বাচ্চাদেরকে তোতা পাখির মতো কুরআন মুখস্থ করানো হয়। তারা অর্থ ও ব্যাখ্যা না বুঝলে তাদের কী ফায়দা হবে? কুরআনের এ আয়াত ওইসব লোকদের ভুল বোঝাবুঝির অবসান করে ঘোষণা দিচ্ছে যে, কুরআনের তেলাওয়াত স্বয়ংসম্পূর্ণ পৃথক একটি উদ্দেশ্য। ইলমে তাজবীদের সৌন্দর্য কুরআন মজীদ হচ্ছে হেদায়াতের ব্যবস্থাপত্র, যা সাধারণ ডাক্তার বা হেকিমদের ব্যবস্থাপত্রের মতো নয়। কারণ তাদের ব্যবস্থাপত্র বুঝতে না পারলে কোনো উপকারে আসে না। আর কুরআন শরীফ হচ্ছে হেদায়াতের এমন ব্যবস্থাপত্র যার এক-একটি অক্ষর পাঠ করলে দশ দশটি নেকী পাওয়া যায়। এটি এমন এক গ্রন্থ, যা থেকে এমন জ্ঞান উৎসারিত হয়েছে, যার উপমা দুনিয়ার কোনো জাতির মধ্যে পাওয়া যাবে না। এগুলোর মধ্য থেকে একটি হল ‘ইলমুত তাজবীদ’। অর্থাৎ কুরআন শরীফের অক্ষরসমূহ উচ্চারণের সঠিক পদ্ধতি। যেমন أ অক্ষরটি কোথা থেকে উচ্চারিত হয়। এর মাখরাজ কী? ب কোথা থেকে উচ্চারিত হয়। ض ও ظ এর মাঝে কী পার্থক্য? এসব বিষয় ইলমে তাজবীদ থেকেই জানা যায়। অন্যান্য ভাষায় এমন বিষয় নেই। যেমন ইংরেজী ভাষায় একথা পাওয়া যায় না যে, D কোথা থেকে বের হয়, C ও H কোথা থেকে উচ্চারিত হয়। এ কারণে দেখা যায়, স্থানভেদে এগুলোর উচ্চারণেরও পার্থক্য হয়। আমেরিকায় এগুলো একভাবে উচ্চারণ করা হয় তো ইউরোপে অন্যভাবে। সবাই নিজ নিজ পদ্ধতিতে উচ্চারণ করে। তেলাওয়াত হচ্ছে কুরআন বুঝার প্রথম ধাপ কুরআন কারীম এমন একটি কিতাব, যা নিয়ে আসতেন হযরত জিবরীল আ.। তিনি কুরআন পড়ে শোনাতেন। যেমন আল্লাহ তাআলা বলেন- فاذا قرأناه فاتبع قرآنه ‘যখন ফেরেশতা কুরআন পড়তে আরম্ভ করবেন তখন আপনি তাঁর অনুসরণ করুন।’ নবী কারীম সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম সাহাবীদেরকে কুরআন শরীফ এভাবেই পড়ে শোনাতেন যেভাবে কুরআন অবতীর্ণ করা হয়েছে। আর সাহাবায়ে কেরাম তা শিখতেন। আলহামদুলিল্লাহ, আজ আমরা উচ্চকণ্ঠে বলতে পারি যে, রাসূল সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম যেভাবে কুরআন তেলাওয়াত করতেন আমরা হুবহু সেভাবেই তেলাওয়াত করছি। এতে কোনো পরিবর্তন আসেনি। আল্লাহ পাক এ উম্মতকে এই মর্যাদা দিয়েছেন যে, ইলমে তাজবীদের ন্যায় একটি শাস্ত্র দিয়েছেন। কুরআনের অর্থ বুঝার জন্য কুরআনের আয়াতসমূহ সঠিকভাবে উচ্চারণ করা ও পড়া প্রথম শর্ত। কেউ সহীহ-শুদ্ধভাবে কুরআন তেলাওয়াত করতে না পারলে সে কী করে কুরআন বুঝবে? তাছাড়া কুরআনের তেলাওয়াত হচ্ছে পৃথক একটি উদ্দেশ্য। তাই কেউ একথা মনে করবেন না, মক্তবে কুরআন পাঠ শেখা ও শেখানো বেকার। নাউযুবিল্লাহ। আরবীভাষীদের কিতাবুল্লাহর শিক্ষাদান রাসূল সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লামকে প্রেরণের উদ্দেশ্যাবলির মধ্য থেকে গুরুত্বপূর্ণ একটি হচ্ছে কিতাবুল্লাহ শিক্ষাদান। এ উদ্দেশ্যের বর্ণনা দিয়ে আল্লাহ তাআলা বলেন, ويعلمهم الكتاب ‘রাসূল সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম মুমিনদেরকে কিতাবের তালীম বা শিক্ষা দেন।’ কিতাবের তালীম দ্বারা কী উদ্দেশ্য? শুধু আয়াতের অনুবাদ বলে দিবেন? তিনি তো শিক্ষা দিবেন আবু বকর, উমর, উসমান, আলী রা.কে। তারা কি আরবী ভাষা জানেন না? এঁদের প্রত্যেকেই তো আরবী ভাষায় দক্ষ ছিলেন। হযরত উমর ফারুক রাযিআল্লাহু আনহু আরবী ভাষায় এত দক্ষ ছিলেন যে, বড় বড় সাহিত্যিক পর্যন্ত তাঁর সামনে নিজেদের ‘কালাম’ পেশ করলে তা সংশোধন করতেন। আরবের মহিলারাও তো ছিলেন স্বভাবকবি। অপরদিকে কুরআনের ঘোষণা بلسان عربى مبين ‘কুরআন স্পষ্ট আরবী ভাষায় অবতীর্ণ করা হয়েছে।’ তাহলে তো আরবী ভাষা শিক্ষা করার জন্য বা কুরআনের অর্থ বুঝার জন্য তাঁদের কোনো শিক্ষকের প্রয়োজন ছিল না। কিন্তু দেখা যায়, এরপরও আল্লাহ পাক আরবী ভাষীদের কুরআন শিক্ষা দেওয়ার জন্য নবী প্রেরণ করেছেন। এ থেকে বুঝা গেল যে, কেবল অনুবাদ পড়ে নিলে অথবা শুধু আরবী ভাষা জেনে নিলে কিতাবুল্লাহর বুঝ ও কুরআনের ইলম অর্জন হয় না; বরং কুরআনকে সঠিকভাবে বুঝতে হলে কোনো শিক্ষক বা মুরবিবর অবশ্যই প্রয়োজন। মানুষ ও অন্যান্য প্রাণীর স্বভাবগত পার্থক্য আল্লাহ মানুষের প্রকৃতিই এমন বানিয়েছেন যে, তারা শুধু গ্রন্থ পাঠের দ্বারা কোনো বিষয়ে দক্ষতা অর্জন করতে পারে না; দক্ষতা অর্জনের জন্য শিক্ষক বা মুরবিবর অবশ্যই প্রয়োজন পড়ে। আল্লাহ পাক কিছু কিছু বিষয়ে মানুষ ও অন্যান্য প্রাণীর মধ্যে পার্থক্য রেখেছেন। যেমন মুরগী ডিম পাড়ে, ডিম থেকে বাচ্চা বের হয়। বাচ্চা বের হয়ে সে প্রথম দিনেই চলতে শুরু করে। মাছের পোনা পানিতে জন্ম নিয়েই সাঁতার কাটতে আরম্ভ করে। এ দেখে কেউ যদি নিজের বাচ্চাকে পানিতে ছেড়ে দেয় এই ভেবে যে, সে সাঁতার কাটতে আরম্ভ করবে তাহলে কী অবস্থা হবে। বস্ত্তত সাঁতার শিখতে হলেও তার কোনো শিক্ষকের প্রয়োজন। শিক্ষক ছাড়া কোনো বিষয়ে পূর্ণতা অর্জন হয় না কেউ যদি মেডিকেল সাইন্সের গ্রন্থাদি কিনে এনে সেগুলো পড়ে, এরপর চিকিৎসা দিতে আরম্ভ করে, তাহলে গোরস্থানের অধিবাসী বাড়ানো ছাড়া আর কী সেবা হবে? তেমনি কেউ প্রকৌশল বিদ্যার বইপত্র পড়ে নিলেই তাকে লোকেরা ইঞ্জিনিয়ার হিসেবে মেনে নেবে না। বাজারে রন্ধনের বিষয়ে অনেক বই পাওয়া যায়, যেগুলোতে নিয়ম কানুন লিখিত। বিরিয়ানী কিভাবে হয়, কাবাব কিভাবে বানাতে হয়, কোরমা কিভাবে তৈরি করা যায়-এসব নিয়ম দেখে দেখে কোরমা, কাবাব তৈরি করলে জানি না তা কি আজব ধরনের খানা হবে; এর জন্যও অভিজ্ঞ ব্যাক্তির কাছে প্রশিক্ষণ নিতে হয়। দুনিয়ার কোনো বিষয়ই অভিভাবকের তত্ত্বাবধান ছাড়া হাসিল করা যায় না। নবী ছাড়া শুধু কিতাব কখনো অবতীর্ণ হয়নি আল্লাহ তাআলা যে কিতাবই অবতীর্ণ করেছেন, ইঞ্জিল, যাবুর, তাওরাত বা কুরআন প্রত্যেকটির সাথে নবী পাঠিয়েছেন। এমনও ঘটেছে যে, নবী এসেছেন, নতুন কিতাব আসেনি। তবে এমন উদাহরণ খুঁজে পাওয়া যাবে না যে, শুধু কিতাব এসেছে, নবী আসেননি। কেন? কারণ মানুষকে তো আল্লাহ পাকই সৃষ্টি করেছেন, তাই মানুষের প্রকৃতি ও স্বভাব তাঁরই ভালো জানা আছে যে, কিতাবের সাথে মানুষের জন্য শিক্ষক ও অভিভাবকেরও প্রয়োজন। আলো ছাড়া কিতাবের দ্বারা কোনো ফায়দা হয় না কুরআন শরীফের এক স্থানে আল্লাহ পাক খুবই সূক্ষ্মভাবে উল্লেখ করেন- قد جاءكم من الله نور وكتاب مبين ‘তোমাদের কাছে আল্লাহর পক্ষ থেকে এসেছে নূর ও খোলা কিতাব।’ -মায়েদা : ১৫ এখানে নূর দ্বারা উদ্দেশ্য, নবী করীম সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লামের শিক্ষার আলো। এ থেকে বুঝা গেল যে, কিতাব যতই শ্রেষ্ঠ হোক না কেন, এর সাথে নবী কারীম সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লামের শিক্ষার আলো না থাকলে তা দ্বারা সুফল পাওয়া যাবে না। এর দৃষ্টান্ত হল চোখের জ্যোতি। চোখের জ্যোতি না থাকলে শুধু গ্রন্থ কী সুফল দিবে? তেমন নবী কারীম সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লামের শিক্ষার জ্যোতি ছাড়া কুরআন শরীফ থেকেও ফায়দা হাসিল করা যাবে না। কিতাব শিক্ষা দেওয়া নবীর দায়িত্ব মক্কার মুশরিকদের দাবি ছিল ‘কুরআন কেন একবারে নাযিল হয় না।’ -ফুরকান : ৩২ আল্লাহ চাইলে তো এমন হত যে, লোকেরা রাতে ঘুমাতে যেত আর সকালে উঠে দেখত যে, বালিশের নিচে উন্নত বাঁধাই করা কুরআনের কপি। আর তাদেরকে বলে দেওয়া হত, নাও, কিতাব এসে গেছে। পড়, বুঝ এবং আমল কর। এমন হলে তা তো অলৌকিক বিষয় হত। ফলে ঈমান আনারও আশা বেশি করা যেত। কিন্তু এমন হয়নি; বরং কুরআন এল, সাথে নূর নিয়ে এল। যেন এমন না হয় যে, তোমরা নিজেদের মনমতো অর্থ বুঝতে আরম্ভ কর এবং নিজের বুঝমতো আমল শুরু কর। এ কারণেই আল্লাহ পাক শিক্ষক পাঠিয়েছেন এবং তাকে কিতাব শিক্ষা দেয়ার দায়িত্ব দিয়েছেন। অন্যত্র আল্লাহ বলেন, وانزلنا اليك الذكر لتبين للناس ما نزل اليهم ‘হে নবী! আমি তোমার উপর কুরআন এজন্য অবতীর্ণ করেছি যাতে তুমি লোকদের সামনে এসব বিষয় স্পষ্ট করে দাও, যা তাদের জন্য অবতীর্ণ হয়েছে।’ -নাহল : ৪৪ প্রথম ইসলামী মাদরাসার শিক্ষাদান পদ্ধতি রাসূল সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম এ কিতাব কিভাবে শিক্ষা দিয়েছেন? হযরত সাদ বিন আবী ওয়াক্কাস রা. বলেন, আমি আট বছরে সূরায়ে বাকারা শিক্ষা করি। এভাবে যে-‘একই সাথে ইলম, আমল ও কুরআন তেলাওয়াত শিক্ষা করতাম।’ এভাবে শিখতে আমার আট বছর লেগে ছিল। আল্লামা সুয়ূতি রাহ. ‘আল ইতকান’ গ্রন্থে এ বর্ণনা উল্লেখ করেছেন, আশা করি আসহাবে সুফফাহ সম্পর্কে আপনারা জানেন। এরা ওইসব সাহাবী ছিলেন, যারা সুফফা নামক স্থানে পড়ে থাকতেন। তাদের একমাত্র কাজ ছিল রাসূল সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম যা বলেন তা হাসিল করা। ইসলামের ইতিহাসে সর্ব প্রথম মাদরাসা ও প্রথম ভার্সিটি হচ্ছে এই সুফফা। এখানে কী হত? সাহাবায়ে কেরাম রা., রাসূল সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লামের খেদমতে হাজির হতেন। রাসূল সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম যা বলতেন, যা করতেন তাঁরা তা শিখতেন, বুঝতেন। তাঁর চলাফেরা নিকট থেকে প্রত্যক্ষ করতেন। এগুলো দ্বারা কুরআন শরীফের তাফসীর বুঝতেন। এটাই ছিল সাহাবায়ে কেরামের ইলম হাসিলের পদ্ধতি। অর্থাৎ কুরআনের ইলম ও এর উপর আমল একই সাথে তাঁরা হাসিল করতেন। শুধু অনুবাদের উপর নির্ভর করে কুরআনের ব্যাখ্যা করা মূর্খতা সাহাবী রাসূল সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম-এর সান্নিধ্য লাভ করেছেন। তাঁরই সান্নিধ্যে থেকে ইলম হাসিল করেছেন। এরপর সাহাবায়ে কেরাম তাবেয়ীদেরকে শিক্ষা দেন। তাবেয়ীরা তাবে তাবেয়ীদেরকে। এভাবে আলহামদুলিল্লাহ নবী-শিক্ষার এ ধারাবাহিকতা আজ আমাদের পর্যন্ত চলে এসেছে। এখন যদি কেউ বলে, আমার কোনো শিক্ষকের প্রয়োজন নেই, আমি অনুবাদ পড়ে পড়ে যা বুঝে আসে বুঝে নিব-তাহলে আপনি নিজের বিবেককে জিজ্ঞাসা করুন, যে কুরআনের তাফসীর বুঝানোর জন্য আল্লাহ পাক নবী প্রেরণ করেছেন, রাসূল সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম তেইশ বছর পর্যন্ত তা শিক্ষা দিয়ে গেছেন, সাহাবায়ে কেরাম যার পিছনে জীবন ব্যয় করেছেন, তাবেয়ীন যা সংরক্ষণ করে আমাদের পর্যন্ত পৌঁছে দিয়েছেন-এসব কিছু না মেনে যদি কেউ বলে আমার কোনো শিক্ষকের প্রয়োজন নেই; বরং আমি যা বুঝব তাই সঠিক, তাহলে এর থেকে বড় নির্বুদ্ধিতা আর কী হতে পারে? ‘কুরআন সহজ’-এর অর্থ কী? কুরআন শরীফের একটি আয়াতের অর্থ বোঝার ক্ষেত্রে কারো কারো ভুল হয়। এখানে তা দূর করা জরুরি। কুরআন বলে, ولقد يسرنا القرآن للذكر فهل من مدكر ‘আমি কুরআনকে উপদেশ গ্রহণের জন্য সহজ করে দিয়েছি।’ অতএব কেউ আছে কি যে উপদেশ গ্রহণ করবে? কেউ কেউ বলে, আমরা কুরআন থেকেই কুরআনের অনুবাদ নিজে বুঝব এবং এর উপর আমল করব। যারা এমন কথা বলে, তারা এ আয়াতের মর্মই বুঝেনি। খুব ভাল করে মনে রাখতে হবে যে, কুরআনের বিষয়বস্ত্তসমূহ দুই প্রকার : প্রথম প্রকার : কিছু আয়াত এমন রয়েছে যেগুলোতে আল্লাহপাক মানুষকে উপদেশ দিয়েছেন যে, আল্লাহ এক, আখিরাত সম্পর্কে বলেছেন যে, একদিন তোমাদের সকলকে প্রত্যাবর্তন করতে হবে। এ উপদেশ একজন সাধারণ মানুষ শুধু অনুবাদ পড়ে গ্রহণ করতে পারবে। এ কারণেই তো কুরআন স্পষ্ট বলেছে, উপদেশ গ্রহণের ক্ষেত্রে সহজ। দ্বিতীয় প্রকার : দ্বিতীয় প্রকারের বিষয়বস্ত্ত, যেগুলোতে আল্লাহ পাক আহকাম ও আমছাল বা উপমা পেশ করেছেন। এসব হুকুমের ব্যাপারে আল্লাহ নিজে বলেন- وتلك الامثال نضربها للناس وما يعقلها الا العالمون ‘আমি এসব উপমা মানুষের উপকারার্থে প্রদান করে থাকি তবে তা কেবল ইলমওয়ালারাই বুঝবে।’ আর ইলম তা-ই যা সাহাবায়ে কেরাম অর্জন করেছিলেন। যদি চৌদ্দশ বছর পর এখন কেউ বলে, আমি নিজে গবেষণা করে কুরআনের ব্যাখ্যা বলব, এ পর্যন্ত যা তাফসীর করা হয়েছে তা আমার বুঝে আসছে না, এগুলো আমি মানি না, বরং আমি আমার বুদ্ধি দিয়েই বুঝব, তাহলে ওই ব্যক্তি পদে পদে ভুল করবে? নিছক বুদ্ধির অনুসারী ‘মুফাসসির’ উপমহাদেশে সর্বপ্রথম এমন তাফসীর করেছেন স্যার সায়্যিদ আহমদ। তার তাফসীর থেকে মনে হয়, পূর্ণ কুরআন যেন রূপক। এতে হাকিকত বা বাস্তব বলতে কোনো কিছু নেই। কুরআনের এক আয়াতে এসেছে যে, যখন হযরত মূসা আ.-এর কাছে তার কওম পানি চাইল তখন মুসা আ. আল্লাহর দরবারে দুআ করলে আল্লাহ পাক হুকুম দিলেন, اضرب بعصاك الحجر ‘তুমি তোমার লাঠি দ্বারা পাথরে আঘাত কর।’ স্যার স্যায়িদ আহমদ এ আয়াতের ব্যাখ্যা এভাবে করেন- اضرب এর অর্থ হল চলা। আর ‘হাজার’ অর্থ পাহাড়। তো আয়াতের অর্থ পাহাড়ে চড়লে ওখানে ঝর্ণা দেখতে পারবে।’ মূসা আ. পাহাড়ে চড়ে ঝর্ণা দেখতে পেলেন। তো এটা কোনো মুজিযা নয়, এটা ছিল বাস্তবতা। এটা এমন এক তাফসীর যা পূর্ববর্তী সকল তাফসীর থেকে ভিন্ন। কুরআনের অন্য এক স্থানে যেখানে জান্নাতের আলোচনা করতে গিয়ে আল্লাহ বলেন, ‘জান্নাতে ফলমূল থাকবে, হুর থাকবে, বাগান ও মহল থাকবে।’ স্যার সায়্যিদ বলেন, ‘এগুলো আল্লাহ পাক এজন্য বলেছেন, যাতে অশিক্ষিত বেদুঈনদের একটু লোভ হয়। বাস্তবে জান্নাত ও হুর বলতে কোনো কিছুই নেই; বরং জান্নাত হল এক বিশেষ ধরনের প্রশান্তি, যা নেককার লোকদের অর্জিত হবে।’ মূলত শিক্ষক না থাকায় এ অবস্থা হয়েছে। শিক্ষক ও মুরবিব ছাড়া নিজের চিন্তা-বুদ্ধি দিয়ে কুরআন বুঝতে আরম্ভ করলে অবশ্যই গোমরাহী ও ভ্রষ্টতার দ্বার উন্মুক্ত হবে। এ কারণেই আল্লাহ পাক কুরআনের সাথে রাসূলও প্রেরণ করেন। শুধু নিজের বুদ্ধি দিয়ে কুরআন বুঝনেওয়ালা গোমরাহ কুরআনে এসেছে- والسارق والسارقة فاقطعوا ايديهما ‘পুরুষ চোর এবং নারী চোরের হাত কেটে দাও।’ এখন এক নতুন ‘মুফাসসির’ বলেন, হাত কেটে দাও অর্থ অকর্মণ্য করে দাও এবং তাকে এমন শাস্তি দাও যাতে সে আর কখনো চুরি না করে বা চুরি করার সাহস না পায়। তিনি এমন তাফসীর কেন করলেন? কারণ পশ্চিমারা বলে, ইসলামে হাত কাটার শাস্তি একটি পাশবিক কাজ। তাই তাদের ভয়ে, তাদের সামনে হাত জোড় করে বলতে লাগলেন, আয়াতের অর্থ হাত কাটা নয়; বরং এমন শাস্তি দেওয়া, যাতে আর কখনো চুরি করতে না পারে। তো কোনো শিক্ষক ও মুরবিব না থাকলে এমন সব ‘তাফসীরে’র পথ উন্মোচিত হবে। নবী সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম-এর দিকনির্দেশনা ও সাহাবায়ে কেরাম রা. থেকে বর্ণিত তাফসীর ছাড়া নিজের বুদ্ধি দিয়ে শুধু অনুবাদের সাহায্যে কুরআনের তাফসীর আরম্ভ করলে ভ্রষ্টতা ও গোমরাহীর কোনো সীমা থাকবে না। কুরআন বুঝতে আত্মশুদ্ধির প্রয়োজন এ কারণেই কুরআনের কোনো কোনো স্থানে ويعلمهم الكتاب এর পূর্বে ويزكيهم এসেছে। অর্থাৎ প্রথমে তাদের পরিশুদ্ধ কর, পাক-পবিত্র কর, তাদের চরিত্র গঠন কর, ইখলাস ও লিল্লাহিয়্যাত পয়দা কর। এরপর অর্থ শিক্ষা দিলে ফায়দা হবে। এ কারণেই কুরআন শরীফের আয়াত-ولا يمسهم الا المطهرون-এর এক তাফসীর এও করা হয় যে, কুরআনকে পাক পবিত্র না হয়ে স্পর্শ করো না। অর্থাৎ যারা খারাপ আখলাক থেকে পাক সাফ হয়, তাদের মধ্যে ইখলাস ও তলব পয়দা হবে তখন তারা কুরআন শিক্ষায় মনোযোগী হবে। প্রথমে আল্লাহর কাছে দুআ করুন, তিনি যেন পাক-পবিত্র করে দেন এবং ইখলাস ও হকের তলব পয়দা করে দেন। এরপর শিক্ষক ও মুরবিবর নিকট থেকে তা শিক্ষা করুন। তাহলে কুরআনের নূর হাসিল করা সম্ভব হবে। নতুবা গোমরাহীর দ্বার উন্মুক্ত হবে। আল্লাহ আমাদের হেফাযত করুন।
হযরত মাওলানা মুফতি তকী উছমানী
[২০১০ সালের ১৬ জুলাই বৃহস্পতিবার ভারতের তামিলনাড়ু রাজ্যের ওয়ানিমবাড়ি এলাকার ‘মসজিদে কাদিম’-এ উলামা ও সাধারণ মানুষের এক বিরাট সমাবেশে প্রদত্ত ভাষণ]
অনুবাদ : হাফেয মাওলানা ফখরুযযামান

14
হামদ ছানার পর

তাকওয়া অর্জনের সবচেয়ে মজবুত হাতিয়ার কী? তাকওয়া অর্জনের সবচেয়ে বড় হাতিয়ার দুআ, মুত্তাকীদের নেগরানীওয়ালা সোহবত, হিম্মত ও আল্লাহর মুহাববত । এ চারটা বিষয়। আমরা ধোঁকায় থাকি, গাফলতে থাকি, এজন্য আমাদের কাছে সবই কঠিন মনে হয় । কিন্তু যদি চিন্তা করা হয় তাহলে দেখা যাবে, এ চারটার মধ্যে সবচেয়ে কঠিন হল, হিম্মত। আবার হিম্মতের চেয়ে কঠিন চেষ্টা করা। আপনার মধ্যে ন্যূনতম যে হিম্মত আছে সেটাকে কাজে লাগান এবং আরেকটু আগে বাড়ুন। ওটাকে কাজে লাগিয়ে আরেকটু আগে বাড়ার চেষ্টা করুন। তো হিম্মত অনেক শক্তিশালী নিআমত। শুধু একটু তাওয়াজ্জুহ দরকার।

বিভিন্ন দোষত্রুটি ত্যাগ করার ইচ্ছা মানুষ এই ভেবে বাদ দেয় যে, অভ্যাস হয়ে গেছে। অভ্যাস ত্যাগ করা খুব কঠিন। সব কঠিনের পেছনে কারণ হল, আমরা এই চার হাতিয়ার কাজে লাগাই না। শুধু একটাকে লাগাই। শুধু দুআ করি। শুধু দুআ এমন হাতিয়ার যা একা কখনো যথেষ্ট নয়।  শুধু দুআর হাতিয়ার কাজে লাগানো মানে দুআর নাশোকরি করা।

আসল দুআ তো হল, দিল হাযির রেখে আল্লাহর কাছ থেকে চেয়ে নেওয়া।

أَمَّنْ يُجِيبُ الْمُضْطَرَّ إِذَا دَعَاهُ

‘বল তো কে নিরুপায় মানুষের ডাকে সাড়া দেন ‘যখন সে ডাকে’ (সূরা নামল ২৭ : ৬২) ইযতিরারী হালত বা নিরুপায় অবস্থা যখন মানুষের পয়দা হবে, দিল হাযির রেখে যখন মানুষ দুআ করবে তখন যত বড় নাস্তিক হোক  আল্লাহ সাথে সাথে দুআ কবুল করে নিবেন। আর এই ইযতিরারী হালত তখন পয়দা হবে, যখন আপনি অন্য সকল হাতিয়ারকে কাজে লাগাবেন। এসকল হাতিয়ার ব্যবহার করা ছাড়া ইযতিরারী হালত বা নিরুপায় ভাব পয়দা হওয়া কখনো সম্ভব না। সেজন্য শুধু এক হাতিয়ার ব্যবহার করা যেন কোনো হাতিয়ারই ব্যবহার না করা।

মুত্তাকীদের সোহবত দ্বারা কোন ধরনের সোহবত উদ্দেশ্য? সোহবত দ্বারা উদ্দেশ্য, মুত্তাকীদের সাথে এমন সম্পক যে সম্পর্কের কারণে আমার মাঝে নাড়াচাড়া পড়বে। কিন্তু আজকাল মানুষের অভ্যাস হল -অবশ্য থানবী রাহ.-এর তাহরীকের কল্যাণে এ অভ্যাস কিছুটা কমেছে- কোনো আল্লাহওয়ালা বুজুর্গকে দেখল তো তার হাতে বাইআত হয়ে গেল। বাইআত হয়েই নিজের সম্পর্কে একেবারে খুশী । কিছু অযীফা নিয়ে এল। তারপর ওটার উপর আমল করল বা করল না। তো এটা হল মুত্তাকীদের সোহবতের একেবারে নিমণ পর্যায়। আসলে মুত্তাকীদের সোহবত হল, তাঁর মজলিসে নিয়মিত বসার সৌভাগ্য যদি নাও হয়। কিন্তু আমি যেহেতু তাঁর নেগরানী গ্রহণ করেছি। তাঁর তত্ত্বাবধান গ্রহণ করেছি। আমার হালত তাঁকে জানাব। কোনো কিছু লুকাব না। তারপর যে হেদায়েত তিনি আমাকে দেন সেই হেদায়েতের উপর আমল করব। আমল করার মধ্যে ত্রুটি হয়ে  গেলে ওটা আবার জানাব। এটা হল সোহবত। এটা যদি কাছে থেকে হয় তাহলে নূরুন আলা নূর। বাংলায় সোনায় সোহাগা। খুব ভালো। আর যদি কাছে থেকে না হয়; বরং দূরে থেকে হয় তাহলেও এটা অনেক গুরুত্বপূর্ণ জিনিস।

(উপস্থিতিদের একজন প্রশ্ন করলেন, সত্যিকারের যারা মুত্তাকী, যাদের  সোহবত আসলেই গ্রহণ করা যায়, তাদের তো কারো সাথে দেখা করারও সুযোগ নেই। কথা বলারও সুযোগ নেই। কারো প্রশ্নের জবাব দেয়ারও সুযোগ তাদের নেই। তো তাদের  সোহবত লাভের জন্য কী করণীয়? তার জবাবে হুযুর বললেন,) আপনাদের কথা ঠিক আছে। কিন্তু  চেষ্টা করলে যে সময় পাওয়া যাবে না এরকম নয়। দুনিয়াতে এমন লোক অনেক আছেন, শত ব্যসত্ম হলেও তাদেরকে যদি আমরা আমাদের আগ্রহ দেখাতে পারি তাহলে তাদের কাছ থেকে সময় নেওয়া যাবে। আরেকটা গুরুত্বপূর্ণ উপায় চিঠি লেখা। আমাকে বলা হয়েছে, মাসে একটি চিঠি লিখতে। আমি লিখতেই থাকব। উত্তর আসুক বা না আসুক, আমাকে চিঠি লিখতে বলা হয়েছে। আমি চিঠি লিখেই যাব।

তো তাকওয়া অর্জনের চারটি হাতিয়ারের কথা বলছিলাম। এক. দুআ করা, দুই. মুত্তাকীদের নেগরানীওয়ালা সোহবত, তিন. হিম্মত, চার. আল্লাহর মুহাববত।

দিলে আল্লাহর মুহাববত বাড়াতে হবে। তকী ছাহেব হুযুরের ‘এসলাহী মাজালিসে’ এ বিষয়ে অনেক বয়ান আছে। সেখানে শুধু আল্লাহর মুহাববতের আলোচনা । আল্লাহর মুহাববত কীভাবে বাড়ানো যায়?

আল্লাহর মুহাববত বাড়ানোর অনেকগুলো নোসখা, অনেকগুলো ব্যবস্থা সেখানে তিনি দিয়েছেন। সেখান থেকে যে নোসখা আমার জন্য সহজ হয় সে নোসখা মোতাবেক আমল করি।

দুনিয়াতে স্বভাবগতভাবেই মানুষের কারো না কারো প্রতি টান থাকে, দুর্বলতা থাকে। সেটার উপর কেয়াস করে আপনি আল্লাহর মুহাববতটাকে বুঝতে পারেন।  কারো প্রতি আপনার দুর্বলতা থাকলে আপনি তার সাথে কেমন আচরণ করেন? অথচ সে মাখলুক। আপনার উপর তার যদি কোনো ইহসান থাকেও  তাহলে তা আল্লাহর তাওফীকে হয়েছে এবং ঘুরেফিরে তার সকল ইহসান আল্লাহর দিকেই যাবে। এরপরও তার প্রতি আপনার এত রেয়ায়েত, এত দুর্বলতা ! আল্লাহ রাববুল আলামীনের নিআমতে তো সেও ডুবে আছে, আপনিও ডুবে আছেন। তার প্রতি যদি  আপনার এত মুহাববত হয় তাহলে আল্লাহর  সাথে আপনার মুহাববত কেমন হবে? কেমন হওয়া উচিত?

স্বভাবগতভাবেই মানুষের মধ্যে আল্লাহর মুহাববত সবচেয়ে বেশী থাকে। কিন্তু আল্লাহর নিআমতের কথা স্মরণ না করার কারণে সেই মুহাববত চাপা পড়ে থাকে। তো ‘ইসলাহী মাজালিসে’ আল্লাহর মুহাববত বাড়ানোর  কিছু উপায়  বলা হয়েছে। যেমন, আল্লাহর  নিআমতের কথা স্মরণ করা। বেশী বেশী যিকির করা। কুরআন তিলাওয়াত করা। যাদের ভেতর আল্লাহর মুহাববত আছে তাদের কাছে বেশী বেশী যাওয়া। এরকম সাত আটটা উপায় সেখানে লেখা হয়েছে। এগুলোর মধ্যে যেটা আমার কাছে সহজ লাগে সেটা দিয়ে আমি আল্লাহর মুহাববত বাড়ানোর চেষ্টা করতে পারি।

আল্লাহর মুহাববত বাড়ানোর চেষ্টা করতে গেলেই মানুষ একটা ধাক্কা খায়। হয়ত কখনো গোনাহ হয়ে গেলে ধাক্কা যাবে। অথবা কখনো নেক আমল ছুটে গেলে ধাক্কা যাবে। এভাবে ধাক্কা খাবে একবার, দুইবার, তিনবার, চারবার। তারপর আসেত্ম আসেত্ম ঠিক হয়ে যাবে। এটা অনেক বড়  একটা কৌশল। আল্লাহর মুহাববত বাড়াতে হবে এবং মুহাববতটাকে হাযির করতে হবে। অনুশীলন করতে করতে মুহাববতটাকে হাযির করতে হবে। আমার আল্লাহ নারায হবেন- এই ভেবে গোনাহের কাজ  থেকে বিরত থাকতে হবে। আমার মুরুববী যদি আমাকে এই কাজটা করতে দেখেন, তাহলে তিনি কী ভাবতেন? আমি কি এই কাজটা তার সামনে করতে পারতাম? অথচ মুরুববী আমার চোখের আড়ালে আর আমিও তার চোখের আড়ালে।  তো একজন মুরুববীর বেলায় যখন এ কথা ভাবতে পারি তাহলে আমার আল্লাহ সম্পর্কে কি এ কথা ভাবতে পারি না? আমার আল্লাহ তো আমাকে সব সময় দেখেন। তিনি আমার চোখের আড়ালে  হলেও আমি তো আল্লাহর চোখের আড়ালে না। فان لم تكن تراه فإنه يراك

‘তুমি যদিও তাকে দেখ না, তিনি তো তোমাকে দেখেন’।

আরেক হাতিয়ার, হিম্মত। যতটুকু হিম্মত আল্লাহ আপনাকে দিয়েছেন তা কাজে লাগান এবং এভাবে আগে বাড়তে থাক। হিম্মত এমন এক শক্তি যার মোকাবেলা করার মত অন্য কোনো শক্তি দুনিয়াতে নেই। এই যে সিগারেটের অভ্যাস। কত মানুষ সিগারেটের অভ্যাস  ছেড়ে দিয়েছে। নিয়ত করে, খাবে না, আবার শুরু করে । আবার নিয়ত করে, খাবে না, আবার শুরু করে। এভাবে শেষবার যখন বলে- নাহ্, আর খাব না। তখন আর খায় না। তো এই হিম্মতটা আল্লাহর কাছে অনেক দামী। হিম্মতের সাথে আল্লাহর রহমতের খুব বেশী সম্পর্ক। হিম্মত হলে আল্লাহর রহমত আসে। গোনাহ থেকে বাঁচার, তাকওয়া হাসিল করার যত উপায় আছে এর মধ্যে সবচেয়ে কার্যকর হল হিম্মত করা। আল্লাহ দেখছেন, বান্দা আমার জন্যে চেষ্টা করছে।

وَمَنْ أَرَادَ الْآَخِرَةَ وَسَعَى لَهَا سَعْيَهَا وَهُوَ مُؤْمِنٌ فَأُولَئِكَ كَانَ سَعْيُهُمْ مَشْكُورًا

এ আয়াতের ‘সা‘আ লাহা’-এর দ্বারা হিম্মত বোঝানো হয়েছে। আল্লাহ তাআলা এই হিম্মতের কদর করবেন- এই ওয়াদা আল্লাহ তাআলা আগেই দিয়েছেন। বান্দা হিম্মতকে কাজে লাগালে আল্লাহ বলেন, আমি হিম্মতের শোকর করব। এজন্যে দেখা যায়, বান্দা যখন তার সর্বোচ্চ হিম্মতকে কাজে লাগায়, তখন সে সফল হবেই। হিম্মতের সাথে আল্লাহর ওয়াদা ।

وَالَّذِينَ جَاهَدُوا فِينَا لَنَهْدِيَنَّهُمْ سُبُلَنَا وَإِنَّ اللَّهَ لَمَعَ الْمُحْسِنِينَ

‘যে মুজাহাদা করবে আমি তাকে আমার পথে পরিচালিত করব’। (সূরা আনকাবূত ২৯ : ৬৯) এখানে ‘রাসত্মা দেখাব’ দ্বারা তরজমা করার চেয়ে ‘পরিচালিত করব’ দ্বারা তরজমা করা সুন্দর । কারণ রাসত্মা তো আল্লাহ কুরআন সুন্নাহর মাধ্যমে দেখিয়েছেন।

এখানে অর্থ হল, আল্লাহ তাআলা তার পথে পরিচালিত করবেন। আমাদের শাইখুল হাদীস ছাহেব এই তরজমা করতেন। এখানে বলা হয়েছে মোজাহাদা করার কথা। আর আসল মোজাহাদা হল হিম্মত ব্যবহার করা। বান্দা তার হিম্মত ব্যবহার করলে আল্লাহর নুসরত আসবেই।

তো কেউ যদি তাকওয়া হাসিল করতে চায় তাহলে এ চার পদ্ধতি তাকে অবলম্বন করতে হবে। জিগার মুরাদাবাদীর ঘটনা দেখ- একবার খাজা আযীযুল হাসান মাজযুব রাহ.-এর সাথে তার দেখা। তিনি বললেন, খাজা ছাহেব, থানবী রাহ.-এর কাছে যেতে ইচ্ছা হয়। কিন্তু অবস্থা তো দেখতেই পাচ্ছেন। এ চেহারা সুরত নিয়ে এমন একজন আলিমের কাছে কীভাবে যাই! খাজা ছাহেবও বললেন, হাঁ, এই হালতে কীভাবে যাবেন। সৌভাগ্যক্রমে খাজা ছাহেব হযরত থানবী রাহ.-কে কথাগুলো বললেন- জিগার মুরাদাবাদীর সাথে দেখা হয়েছিল।  সে এই এই বলেছিল,  আমি এই এই বলেছিলাম। হযরত থানবী রাহ. বললেন, আহ! খাজা ছাহেব, আমি তো মনে করেছিলাম, তাসাউফের সাথে আপনার মোনাসাবাত হয়ে গেছে। এখন তো দেখছি,  এর হাওয়া বাতাসও আপনার গায়ে লাগেনি। আপনার তো বলা উচিত ছিল- না, এই অবস্থায়ই আস।

এই বুজুর্গরা তো আল্লাহর খলিফা। তাদের দরজা সবার জন্য খোলা।

ايں درگاہ ما در کاہ نا اميدی نيست

এই দরবার তো সকলের জন্য উম্মুক্ত’। যারা আল্লাহর রাসূলের নায়েব তাদের দরজাও তো সবার জন্যে খোলা। যে হালতে আছ এসে যাও।

জিগার মুরাদাবাদীর সাথে খাজা ছাহেবের আবার যখন দেখা হল, তখন খাজা সাহেব জিগার মুরাদাবাদীকে হযরতের কথাগুলো বললেন। হযরতের কথা শুনে জিগার মুরাদাবাদীর কিছুটা হিম্মত হল।

তিনি শরাবপানে অভ্যস্ত ছিলেন। হযরতের কাছে যখন আসা-যাওয়া শুরু করলেন, তখন তওবা করলেন, আর শরাব পান করবেন না। শরাব পান করার পুরানো অভ্যাস তার ছাড়তে  অনেক কষ্ট হল। শরাব ছেড়ে দেয়ার  কারণে যখন তার জান যায় যায় অবস্থা তখন একজন বলেছিল, এমন হালতে তো হারাম খাওয়াও জায়েয। তিনি বললেন, না। জান বের হয়ে গেলেও আমি শরাব পান করব না।

তো হিম্মত এটা কোনো ওয়াজের বিষয় না। এটা কাজ করার বিষয়। সুতরাং হিম্মত কর। গোনাহ থেকে বেঁচে থাক।

নেক আমল কর।

(আরেকজন প্রশ্ন করলেন, যারা ঈমান ও তাকওয়ার অধিকারী দুনিয়াতে তাদের উপরও কি বিভিন্ন বিপদ-আপদ আসতে পারে? দুনিয়াতে তারাও বিপদ-আপদের সম্মুখীন হতে পারে? তার প্রশ্নের জবাবে হুযুর বললেন,)  ঈমান ও তাকওয়া যার ভেতরে থাকবে, দুনিয়াবী বিপদ-আপদে কখনো কখনো তাকেও কষ্ট করতে হবে; তবে  সে কখনো বেচাইন ও পেরেশান হবে না। দুনিয়ার বিভিন্ন হালতে তার কষ্ট হবে; তবে হায়-হুতাশের যে পেরেশানী এমন পেরেশানী তার মধ্যে কখনো হবে না। এবিষয়টাকে হাকীম আখতার ছাহেব রাহ. একটি কবিতায় বলেছেন একভাবে। যদি বেআদবি না হয় তাহলে বলি, আমার আম্মা ঐ কবিতাটিকে বলেছেন আরেকটু পরিবর্তন করে। হযরতের কবিতাটি ছিল এরকম-

زندگی پر کیف پاۓ گرچہ دل پر غم رہا تيرے غم کے فيض سے میں غم میں بھی بے غم رہا

হাকীম ছাহেবের শেরের মধ্যে একটি প্রশ্ন আসে। তা হল, সেখানে জীবনকে বানিয়ে দেয়া হয়েছে আনন্দময় আর দিলকে বানানো হয়েছে  অস্থির ও  পেরেশান। অথচ মুমিনের অবস্থা হয়ে থাকে এর  থেকে ব্যতিক্রম। কারণ জীবনে অস্থিরতা ও পেরেশানী থাকলে তার অন্তর থাকে নিশ্চিন্ত এবং সর্ব প্রকার পেরেশানীমুক্ত। এটি আম্মার খাতায় আমি লেখা দেখেছি এভাবে-

زندگی پر کیف پاۓ گرچہ غم پر غم رہا  ان کے غم کے فيض سے میں غم میں بھی بے غم رہا

 ‘আমার যিন্দেগীটা বড় মজার যিন্দেগী, যদিও সেখানে ছিল অনেক পেরেশানী। কিন্তু আমি ছিলাম আল্লাহর মুহাববতের ব্যথায় ব্যথিত। এজন্যে অন্য কোনো ব্যথা আমাকে স্পর্শ করতে পারেনি।’ এভাবে হলে আর আগের প্রশ্নটি আসে না। হাকীম ছাহেবের দ্বিতীয় লাইন শুরু হয়েছিল ‘তেরে’ দিয়ে। কিন্তু আম্মার খাতায় লেখা ছিল ‘উনকে’ দিয়ে। এই ‘উনকে’ শব্দটি ইসহাক ওবায়দী ছাহেবের সম্পাদনা।

(গত রমযানের শেষ দশকে মারকাযুদ দাওয়াহ’র হযরতপুর প্রাঙ্গণের মসজিদে প্রদত্ত হযরত মাওলানা আবদুল মালেক ছাহেব দা. বা.-এর একটি বয়ান)

15
রান্তিকতা বাংলায় একটি সুন্দর শব্দ যা দুই প্রান্তকেই বোঝায়। বাড়াবাড়ি-ছাড়াছাড়ি, ইফরাত-তাফরীত দুটোকেই বোঝায়। সব বিষয়ের মতো তাওহীদ-বিষয়েও প্রান্তিকতা আছে। এক ‘ইফরাত ফিত তাওহীদ’, অর্থাৎ আপনি তাওহীদের বিষয়ে এমন প্রান্তে গিয়ে পৌঁছলেন যে, তাওহীদ পরিপন্থী নয় এমন অনেক কিছুকে তাওহীদ পরিপন্থী বলা শুরু করলেন। আর ‘তাফরীত ফিত তাওহীদ’ হল, তাওহীদের ক্ষেত্রে শৈথিল্য প্রদর্শন করতে করতে এমন প্রান্তে গিয়ে পৌঁছলেন যে, এখন তাওহীদ পরিপন্থী জিনিসকেও বলেন তাওহীদ পরিপন্থী নয়। নাউযুবিল্লাহ।

তাওহীদের ক্ষেত্রে উভয় প্রান্তিকতাই আমাদের বর্জন করতে হবে। প্রান্তিকতা যে দিকেরই হোক এর অর্থ হল, তাওহীদের ক্ষেত্রে মাঝামাঝি রাস্তা থেকে সরে যাওয়া। একটি কাজ তাওহীদ পরিপন্থী কিন্তু আমি মনে করলাম তাওহীদ পরিপন্থী নয়। আবার তাওহীদ পরিপন্থী নয় কিন্তু আমি মনে করলাম তাওহীদ পরিপন্থী দুটোই নিন্দনীয় এবং দুটোই বর্জনীয়। বিষয়টি উদাহরণের মাধ্যমে আরো স্পষ্ট হয়ে যাবে।

তাওহীদ পরিপন্থী কিন্তু মনে করা হচ্ছে তাওহীদ পরিপন্থী নয়-এর উদাহরণ হল, বেরলবীগণ। কিছু কাজ যা তাওহীদের জন্যে একেবারে প্রাণঘাতী, তাওহীদের সাথে পুরোপুরি সাংঘর্র্র্ষিক কিন্তু বেরলবীগণ বলেন, না, এটা তাওহীদ পরিপন্থী না।

আগে বেরলবীদের পরিচয়টা সংক্ষেপে বলি। আহমাদ রেযা খানের অনুসারী যারা তাদেরকে বলা হয় বেরলবী।  আহমাদ রেযা খান যেহেতু বেরেলীর অধিবাসী ছিল, তাই তার অনুসারীদেরকে বলা হয় বেরলবী। আবার তার নামের একটা অংশ যেহেতু রেযাখান তাই তার দলের এক নাম রেযাখানী। রেযাখানীকে সংক্ষেপে বলা হয় রেজভী।

 হিন্দুস্তানে বেরেলী নামে দু’টি জায়গা আছে। একটি জায়গার নাম রায়বেরেলী, আরেকটার নাম শুধু বেরেলী। রায়বেরেলী ভালো জায়গা। আবুল হাসান আলী নদভী রাহ.-এর বাড়ি। তার পূর্বপুরুষরাও অনেক বড় বড় বুযুর্গ ছিলেন। তাদের কবর সেখানে আছে। নদভী রাহ.-এর খান্দানের একজন বুযুর্গের নাম শাহ আলামুল্লাহ রাহ.। তার কবরও রায়বেরেলীতে। সাইয়েদ আহমাদ শহীদ রাহ.ও রায়বেরেলীর অধিবাসী। সাইয়েদ আহমাদ শহীদকে যে বেরেলবী বলা হয় তা কিন্তু আহমাদ রেযাখানের বেরেলীর কারণে নয়। বরং এই রায়বেরেলীর কারণে। লখনৌ  থেকে রায়বেরেলী যেতে লাগে দুই ঘন্টা আর বেরেলী যেতে লাগে ছয় ঘন্টা। বেরেলী তো  আসলে আহমাদ রেযাখানের না। বেরেলীতে আহমাদ রেযাখানের আগে ও পরে আকাবিরে  দেওবন্দ, আহলে সুন্নাত ওয়াল জামাতের  অনেক আলিম ছিলেন।

তো আমি তাদের তিনটি নাম বললাম- রেজভী, রেযাখানী, বেরলভী। কিন্তু তারা তাদের নাম দিয়েছে সুন্নী। আর আহলে  হকের নাম দিয়েছে, ওয়াহাবী। তাদের মতে, সুন্নী হল তাদের সংক্ষিপ্ত নাম। পুরো নাম, আহলুসসুন্নাহ ওয়াল জামাআহ। এবং আহমাদ রেযাখানের লকব হল, ইমামে আহলুস সুন্নাহ ওয়াল জামাআহ। আহলুস সুন্নাহ ওয়াল জামাআর ইমাম! নাউযুবিল্লাহ! পাকিস্তান ভারত বাংলাদেশ এই এলাকায় তারা ‘আহলুস সুন্নাহ ওয়াল জামাআহ’ নামটি দখল করে নিয়েছে। আমরা কেন যেন এ দিকে খুব একটা গুরুত্ব দেই না। এ বিষয়টি আমাদের খুব গুরুত্ব দিয়ে ভাবা উচিত।

এই বেরলবীদের নিকট বুযুর্গদের কবর তাওয়াফ করা জায়েয! এটা কোনো শিরকি কাজ নয়! এমনকি তারা একথাও বলে, বুযুর্গদের কবরে সিজদা করা জায়েয। কারণ কবরে যে সিজদা করা হয় সেটা সম্মানের সিজদা, ইবাদতের সিজদা নয়। কিন্তু আল্লাহর কী কুদরত! আহমাদ রেযাখানের কলমে বের হয়ে গেছে সম্মানের জন্যে কারো কবরে সিজদা করা নাজায়েয। কট্টর বেদআতী হওয়া সত্তে¡ও সে লিখেছে, কারো কবরে সম্মানসূচক সিজদা নাজায়েয। অবশ্য তার পক্ষের লোকেরা বাস্তবে এটার উপর নেই।

ছেলে হারিয়ে গেছে বা কঠিন কোনো রোগে আক্রান্ত হয়েছে,তো ছুটে যাচ্ছে আটরশী,সুরেশ্বর, দেওয়ানবাগ,মাইজভাণ্ডারে। আহ! কত বড় আফসোসের কথা। মক্কার মুশরিকরা সাধারণ কোনো বিপদে পড়লে তাদের দেবদেবীর কথা স্মরণ করত। তাদের জন্যে মানত করত। কিন্তু বড় কোনো বিপদে পড়লে আল্লাহকে ডাকত,আল্লাহর কথা স্মরণ করত। অথচ মুসলিম নামধারণ করেও আজ তাদের খাসলত হল, যেকোনো বিপদেই তারা স্মরণ করে মাযারকে।  শরণাপন্ন হয় বাবার দরবারে। এ সকল কর্মকাণ্ড যে শিরক এতে কোনো সন্দেহ নেই। কিন্তু বেরলবীগণ বলছেন, এখানে দেখতে হবে, তারা যে বাবার কাছে চাচ্ছে কী নিয়তে চাচ্ছে?  যদি এই নিয়তে চায় যে, বাবা আল্লাহর কাছ থেকে নিয়ে দেবেন তাহলে এটা শিরক হবে না। যদিও সে মুখে বলে, বাবা দেন! বাবা দেন! এটা তাওহীদের ক্ষেত্রে এক প্রান্তিকতা। এটা হল, তাফরীতের উদাহরণ।

আরেক প্রান্তিকতা হল, তাওহীদ পরিপন্থী নয় কিন্তু বলা হচ্ছে তাওহীদ পরিপন্থী। এই গোমরাহী নতুন কিছু নয়। এর সিলসিলা অনেক আগের । যেমন- গোমরা ফেরকাগুলোর মধ্যে এক ফেরকা হল মুতাযিলা।  তারা নিজেদের নাম দিয়েছে ‘আসহাবুল আদলি ওয়াত তাওহীদ’। অর্থাৎ ইনসাফ ও তাওহীদওয়ালা জামাত। তাদের নামটিই কিন্তু তীর্যক নাম। নামের মধ্যেই এই খোঁচা আছে যে, অন্যরা  কেউ তাওহীদওয়ালা নয়।

ইতিযাল মানে পৃথক হওয়া। মুতাযিলা মানে পৃথক, আলাদা। প্রথম যিনি আলাদা  হয়েছেন তিনি হযরত হাসান বসরী রাহ.-এর সাথে তাকদীরের মাসআলা নিয়ে এখতেলাফ করে তার মজলিস থেকে আলাদা হয়েছিলেন। সেখান থেকে উৎপত্তি হয় মুতাযিলার। মানে আহলুস সুন্নাহ ওয়াল জামাআহর ইমামদের থেকে আলাদা পৃথক সম্প্রদায়। তাদের কথা হল,  হাসান বসরী এবং আহলুসসুন্নাহ ওয়াল জামাআহর তাওহীদের আকীদা বিশুদ্ধ নয়। কারণ তারা তাকদীরের উপর ঈমান রাখেন। আর তাকদীরের বিশ্বাস তাওহীদের পরিপন্থী!

তাওহীদের শিক্ষা আমরা পেয়েছি রাসূলে কারীম সল্লাল্লাহু আলাইহিওয়া সাল্লামের কাছ থেকে। রাসূলুল্লাহ সল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লামকে তাওহীদের কথা ঈমানের কথা জিজ্ঞাসা করা হল। তিনি তাওহীদের সংজ্ঞা দিতে গিয়ে বললেন,

أن تؤمن  باالله وملائكته و كتبه و رسله و اليوم الآخر و القدر خيره و شره من الله تعالى و البعث بعد الموت  .....

তো রাসূল সল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম ঈমানের সংজ্ঞার মধ্যে বললেন, তাকদীরের উপর আকীদা রাখার কথা । আর মুতাযিলাগণ বলছে, তাকদীরে ঈমান রাখা তাওহীদ পরিপন্থী। এ হল আরেক প্রান্তিকতা।

বেরলবীগণ তো তাওহীদ পরিপন্থী বিশ্বাস ও কর্মকাণ্ডকে তাওহীদ পরিপন্থী বলছেন না। স্পষ্ট শিরকও তাদের কাছে তাওহীদ পরিপন্থী নয়। আর মুতাযিলীগণ কুরআন-সুন্নাহয় অকাট্যভাবে বর্ণিত আকিদাকে বলছেন তাওহীদ পরিপন্থী। সুতরাং তাওহীদের ক্ষেত্রে  দু’ দলই ভয়াবহ প্রান্তিকতার স্বীকার।

তাওহীদ পরিপন্থী নয় এমন জিনিসকে তাওহীদ পরিপন্থী বলার ধারাবাহিকতায় এখন কিছু সংখ্যক সালাফি বন্ধুও কিছু কিছু ক্ষেত্রে বাড়াবাড়ি করেন। সবার কথা বলছি না। যেমন ধরুন একটা জিনিস এভাবে হলে বেদআত হবে, এভাবে হলে শিরক হবে, এভাবে হলে সুন্নত হবে, এভাবে হলে মোবাহ হবে এভাবে একটা জিনিসের বিভিন্ন আঙ্গিক ও পর্যায় রয়েছে। কিন্তু কিছু সংখ্যক সালাফী ভাই আজ সবগুলোকে ঢালাওভাবে বলে দেন  শিরক। যারা পেশাদার ‘আহলে হাদীস’ তারা আজ চোখ বন্ধ করে তাকলীদকে শিরক বলে দিচ্ছেন!

এভাবে আরো অনেক উদাহরণ আছে,যা প্রান্তিকতার মারাত্মক উদাহরণ এজন্যে আমাদেরকে সীরাতে মুস্তাকীম ধরতে হবে। প্রান্তিকতামুক্ত সরলপথে কোনটি তা বুঝতে হবে। আল্লাহ তাওফীক দান করুন। আমীন!
মাওলানা মুহাম্মাদ আব্দুল মালেক
[রমযান ১৪৩৫হি. - এর ইতিকাফে মারকাযুদ দাওয়াহ-এর মসজিদে কৃত বয়ান থেকে গৃহীত]

Pages: [1] 2 3 ... 5