1
Miscellaneous / ফিল্ড ওয়ার্ক এবং চলতি পথের অভিজ্ঞতা
« on: December 06, 2022, 01:41:25 PM »
কম্পিউটার ইঞ্জিনিয়ার এক ভদ্রলোক অপর সিভিল ইঞ্জিনিয়ারিং পড়া সহপাঠীকে বলেছিলেন। ‘যেখানেই আমাদের চাকরি হোক, কম্পিউটারের স্বার্থে হলেও একটা এসি রুম দিবে, আর তোদের মাঠেঘাটে ঘুরতে হবে’। কথা হাড়েহাড়ে সত্যি। পাশ করার আগে এবং পরে শুধু ধূলার রাজ্যে চলাফেরা করতে হয়। এমনকি শতভাগ ডিজাইনের কাজ করেন, এমন সিভিল ইঞ্জিনিয়ারকেও কাজ দেখতে যেতে হয় নিজের প্রয়োজনেই। ডিজাইন তারটাই বেশি বাস্তবসম্মত, যিনি ফিল্ডের অবস্থা বেশি জানেন। এজন্য সিভিল ইঞ্জিনিয়ারিং একসময় গিয়ে দাঁড়ায় 'লেস ইঞ্জিনিয়ারিং, মোর ম্যানেজমেন্ট'। অর্থাৎ মেশিনপত্র খুটুরখাটুর করার চেয়ে কাজ বুঝে লোক চালানোই মুখ্য হয়ে যায়।
পড়াশোনার সময়টাতে এ ব্যপারটা অনুশীলনের জন্য নানারকম কোর্স আছে। স্টুডেন্ট থাকা অবস্থায় মাঝেমাঝে বিরক্ত হয়ে যেতাম, কী কাজে লাগবে এইসব নাটবল্টু, লেদ মেশিন আর কাঠের কাজের ইতিবৃত্ত জেনে? পরে সাইট বা নিজের ঘরে কাজ করাতে গিয়ে দেখি, কাজ করাতে হলেও একটা পর্যায়ের জ্ঞান লাগে। নইলে 'পনর বিশ বচ্ছর ধইরা এই কাম করি, এক মাসের আগে পারুমই না' টাইপের আপত্তির কাছে একদম হেরে যেতে হয়। এক বছরের প্রজেক্ট টাইম অনিচ্ছাসত্ত্বেও বেড়ে যায়, হয়ত আঠারো মাসে বছর হয়ে যায়।
পড়াশোনার কাজে একটু গভীর মনযোগ দিতে হবে। তার ওপর আছে কিছু ব্যক্তিগত ব্যস্ততা। বাইশের শেষ ছয়মাস মাত্র তিনটা ক্লাসের সাথে দুইটা কোর্স দেওয়া হল। Workshop Lab এবং Details of Construction Lab. দুইটারই সাবজেক্ট এরিয়া বিশাল, ক্লাসরুমে করার কিচ্ছু নাই। সুতরাং সেভাবেই সাজিয়ে ফেললাম পুরো সেমিস্টারের কাজ৷ ক্লাসরুমকে শুধু রাখলাম রিপোর্টিং এর জায়গা হিসেবে।
Details of Construction Lab কোর্সে ছোট ছোট সাতজনের গ্রুপ করা হল, চারটা৷ এক সপ্তাহে কাজ দেখতে যাবে, পরের সপ্তাহে সেটার ওপর প্রতি গ্রুপের যে কোন দুইজন সদস্য প্রেজেন্টেশন দেবে। পরের সপ্তাহে অন্য দুইজন। প্রতিবার এই কোর্সে আমি ইঁট-বালি-সিমেন্ট-খোয়া, গ্লাস-এলুমিনিয়াম সহ মোটামুটি সমস্ত কনস্ট্রাকশন মেটেরিয়ালের বাজারদর, নতুন ব্র্যান্ড এবং কোথায় কি পাওয়া যায়, জেনে যাই। শুধু তাই না, মাটি খোঁড়া থেকে শুরু করে বেসমেন্ট, বীম-কলাম-স্ল্যাব ঢালাই, সিঁড়ি, ফাউন্ডেশন, ছাদের ট্যাংক, লিফট, ফায়ার এসকেপ কনস্ট্রাকশনের আদ্যোপান্ত জেনে এসে, নিজেদের তোলা ছবি দিয়ে ক্লাসে বুঝাতে হয়েছে ওদের। কাজটা শুধু আনন্দের তাই না, পুরো সেমিস্টার একবারও আমাকে ‘এই চুপ করে আমার কথা শোনো’ কিংবা ‘কেউ ফোন হাতে নিও না’ ধরণের সাবধানবাণী দিতে হয় নি। কারণ ক্লাসে ওদের কাজই ছিলো কথা বলা এবং ফোন থেকে ছবি ঘেঁটে বের করে প্রেজেন্টেশন বানানো।
Workshop Lab এর কাজটা এত সহজ ছিলো না। কারণ কাঠ এবং লোহার কাটাকুটির কাজগুলো শুধু দেখলেই হবে না, অভিজ্ঞ কেউ না বুঝিয়ে দিলে কাজ বোঝা যাবে না। এ জায়গায় ছাত্রদের একা পাঠিয়ে দিলে কাজের কাজ হবে না। সুতরাং বের হলাম। ইউনিভার্সিটির আশেপাশে বেশ কয়েকটা ওয়ার্কশপে গিয়ে রীতিমতো অবাক হলাম। একে জায়গা সংকট, তার ওপর কেনই যেন ওরা অজানা অচেনা ছাত্রদের ক্লাস নেয়াতে বেশ অনীহা দেখালো। এদিকে আমাদের বাজেট পাশ হয়ে গেছে, হাতে টাকাও এসে গেছে। শেষ চেষ্টা হিসেবে ক্লাসে ছাত্রদের বললাম। একজনের বাবার বিশাল কাঠের আড়ত এবং ফার্নিচার ওয়ার্কশপ পাওয়া গেলো মিরপুরে। কিন্তু ওয়েল্ডিং আর লেদ মেশিনের কাজ দেখাবো কোথায়? হঠাত মনে পড়লো, আব্বু একজনের কথা বলতেন। আমার আব্বু রিটায়ারের আগে শেষ পনেরো বছর একটা ফার্মাসিউটিক্যালসের ইঞ্জিনিয়ারিং ডিভিশনের হেড ছিলেন। বিভিন্ন পার্টস এর কাজ করাতেন একটা ওয়ার্কশপে। সেই আতাউর রহমান আংকেল আবার বেশ ইনোভেটিভ ছিলেন, দারুণ কিছু মজার মজার জিনিস বানিয়ে দিতেন। বই আটকে রাখার একটা স্ট্যান্ড বানিয়ে দিয়েছিলেন স্টেইনলেস স্টীল দিয়ে, দেখাদেখি আমি আবদার করায় আমাকেও দিয়েছিলেন। যা হোক, আব্বুর মাধ্যমে উনার সাথেও যোগাযোগ হল। ঠিক হল, একই দিনে মিরপুর কাঠের কাজ দেখে দিনের পরের অর্ধেকে গাজীপুর কালিয়াকৈর গিয়ে স্টীল ওয়ার্কশপের কাজ দেখাবো। বাজেট এবং গাড়ির অনুমতি নেওয়াই আছে, এগারোই নভেম্বর বেরিয়ে পড়ার প্ল্যান করে ফেলা হল।
কখন কোথায় যাওয়া, থামা কিংবা খাবারের বিরতি, এর একটা বিস্তারিত শিডিউল ট্রান্সপোর্ট ডিভিশনের কাছে ইমেইল করেছিলাম। সকাল সাতটায় আশুলিয়া থেকে যাত্রা করে ধানমণ্ডির ছাত্রদের নিয়ে ওখানেই ড্রাইভারদের সাথে ছোট্ট একটা মিটিং করে সে শিডিউল বুঝিয়ে দিলাম। পরের স্টপেজ মিরপুরের কার্পেন্ট্রি শপ। সেখানে যাবার পর ছাত্রদের সাথে ছোট করে ব্রিফিং হল। কিভাবে এই ফিল্ড ওয়ার্কের মার্কিং হবে, কি কি প্রশ্ন করা যাবে, কোন গ্রুপ কতটা প্রশ্ন করবে, ইত্যাদি বুঝিয়ে দিয়েছি। দুইজনকে দেওয়া হল ছবি তোলা আর ভিডিও করার কাজ। আর, একজন পরে বিস্তারিত লিখবে সেটাও বলে দিলাম। গাছ কাটা, সংরক্ষণ, সীজনিং, সেখান থেকে স'মিলে তক্তা বা খুঁটি বানানো, পালিশিং, কিনারের গ্রুভ কাটা, নকশা করা, নানা ধরণের জয়েন্ট করা, এক এক করে সব দেখানো হল। মজার ব্যপার হচ্ছে, আমরা ক্লাসে চার মাসে যা পড়িয়েছি, তার অনেক কাজ এবং যন্ত্রপাতি এখন আর ব্যবহারই হয় না। অটোমেটিক মেশিন এসে গেছে।
এখান থেকে বেরিয়ে নামাজ আর খাওয়ার বিরতি। আবার ছোট্ট তিন মিনিটের মিটিং করলাম। ড্রাইভার এবং সাথের স্টাফদের সাথে৷ ঠিক হলো, ভালো একটা খাবার জায়গা বাছাই করতে হবে যেটা গাজীপুরের পথে পড়বে এবং পাশে মসজিদও থাকবে। এখানে একটা বিষয় বলে রাখি। একজন স্টাফ ছিলো একটা বাসে, সে আসলে আমাদেরই ছাত্র, কম্পিউটার ইঞ্জিনিয়ারিং ডিপার্টমেন্টের। এটা ওর পার্টটাইম কাজ। ওর বাড়িও গাজীপুর হওয়ায় পুরো কাজে চমৎকার সমন্বয় করা গেছে, ড্রাইভারদের সাথে যোগাযোগও সাবলীল হয়েছে।
গাজীপুর, আব্বুর প্রাক্তন কর্মক্ষেত্রের ঠিক পাশেই ওয়ার্কশপ। আগেও পিকনিকে এসেছি কয়েকবার। গিয়ে দেখি আতাউর সাহেব বিরাট আয়োজন করেছেন। পাশের ফাঁকা জায়গায় শামিয়ানা টাঙিয়ে ডেকোরেটর থেকে চেয়ার আনিয়েছেন। দোকানের ভেতরে তিনজন বসে আবার প্যাকেট করছে। কলা, আপেল, বিস্কুট আরও কি কি। আপত্তি করলাম। বললেন, আপনার আব্বুর সম্মানে। পাশের টঙ থেকে সবাই চা খেয়েছি, বিল দিতে গিয়ে শুনি কড়া নিষেধ করা আছে। আমাদের থেকে যেন পয়সা নেওয়া না হয়। ছাত্রদেরকে লেদ মেশিন, ওয়েল্ডিং মেশিন নিয়ে বলার সময়ও গলা কেঁপে যাচ্ছিলো আংকেলের। বলছিলেন, 'ইগো থাকা যাবে না, শেখার মানসিকতা না থাকলে টেকনিক্যাল ফিল্ডে টিকতে পারবেন না। এই যে আপনাদের ম্যাডামের আব্বা, আগে কাগজে এঁকে ড্রইং দিতেন, আবার কাঠি দিয়ে থ্রিডি মডেল বানিয়ে দেখাতেন। কত পরামর্শ দিয়েছেন। এত বড় মানুষ এসে আমার দোকানে চা খেতেন আর কাজ দেখায় দিতেন। নিখুঁত না হলে যেতেন না'।
ফেরার পথে ওখানে দেওয়া নাশতা দিয়েই বেশ বিকেলের খাবার হয়ে গেলো। শুক্রবার দেখেই হয়তো, নির্ধারিত সময়ের এক ঘন্টা আগেই আমরা পৌঁছে গেলাম ক্যম্পাসে। সেখান থেকে একটা বাস আবার আমাদের বাকিদের নামিয়ে দিয়ে আসলো ধানমণ্ডি।
ইচ্ছে করেই কিছু প্ল্যানিং বিস্তারিত লিখেছি। কারণ, কাজ যখন ক্লাসের বাইরে, সেখানে দরকার হয় শক্তিশালী এবং বাস্তবানুগ প্ল্যান, আর তার সাথে বাস্তবায়নের ইচ্ছা এবং চেষ্টা। এক্ষেত্রে ছাত্রদের সহযোগিতা যেমন লাগে, তেমন দরকার হয় ট্রান্সপোর্ট ডিপার্টমেন্ট সহ বেশ কয়েকটা অফিসের সমন্বয়। কাজের এক সপ্তাহ পরে ভাইভাতে বসে যখন জিগেস করছিলাম, কি কি ব্যপার ভালো লেগেছে। একজন বলেছে, ম্যাডাম সবচেয়ে ভালো লেগেছে এই যে আতাউর আংকেলকে, উনি এতো চমৎকার একটা মানুষ। আরেকজন বলেছে, করোনায় ক্লাস শুরু হওয়ায় ওরা আর এরকম আউটডোর ট্যুর পায় নি। অনেকটা পথ একসাথে থেকে তিন বছরের চেনা ক্লাসমেটের এমন কিছু গুণ দেখেছে যা আগে জানতোই না।
অর্জন হিসেবে, মেশিনপাতির বৃত্তান্ত জানার পাশাপাশি এসবও কম না। কি বলেন?
পড়াশোনার সময়টাতে এ ব্যপারটা অনুশীলনের জন্য নানারকম কোর্স আছে। স্টুডেন্ট থাকা অবস্থায় মাঝেমাঝে বিরক্ত হয়ে যেতাম, কী কাজে লাগবে এইসব নাটবল্টু, লেদ মেশিন আর কাঠের কাজের ইতিবৃত্ত জেনে? পরে সাইট বা নিজের ঘরে কাজ করাতে গিয়ে দেখি, কাজ করাতে হলেও একটা পর্যায়ের জ্ঞান লাগে। নইলে 'পনর বিশ বচ্ছর ধইরা এই কাম করি, এক মাসের আগে পারুমই না' টাইপের আপত্তির কাছে একদম হেরে যেতে হয়। এক বছরের প্রজেক্ট টাইম অনিচ্ছাসত্ত্বেও বেড়ে যায়, হয়ত আঠারো মাসে বছর হয়ে যায়।
পড়াশোনার কাজে একটু গভীর মনযোগ দিতে হবে। তার ওপর আছে কিছু ব্যক্তিগত ব্যস্ততা। বাইশের শেষ ছয়মাস মাত্র তিনটা ক্লাসের সাথে দুইটা কোর্স দেওয়া হল। Workshop Lab এবং Details of Construction Lab. দুইটারই সাবজেক্ট এরিয়া বিশাল, ক্লাসরুমে করার কিচ্ছু নাই। সুতরাং সেভাবেই সাজিয়ে ফেললাম পুরো সেমিস্টারের কাজ৷ ক্লাসরুমকে শুধু রাখলাম রিপোর্টিং এর জায়গা হিসেবে।
Details of Construction Lab কোর্সে ছোট ছোট সাতজনের গ্রুপ করা হল, চারটা৷ এক সপ্তাহে কাজ দেখতে যাবে, পরের সপ্তাহে সেটার ওপর প্রতি গ্রুপের যে কোন দুইজন সদস্য প্রেজেন্টেশন দেবে। পরের সপ্তাহে অন্য দুইজন। প্রতিবার এই কোর্সে আমি ইঁট-বালি-সিমেন্ট-খোয়া, গ্লাস-এলুমিনিয়াম সহ মোটামুটি সমস্ত কনস্ট্রাকশন মেটেরিয়ালের বাজারদর, নতুন ব্র্যান্ড এবং কোথায় কি পাওয়া যায়, জেনে যাই। শুধু তাই না, মাটি খোঁড়া থেকে শুরু করে বেসমেন্ট, বীম-কলাম-স্ল্যাব ঢালাই, সিঁড়ি, ফাউন্ডেশন, ছাদের ট্যাংক, লিফট, ফায়ার এসকেপ কনস্ট্রাকশনের আদ্যোপান্ত জেনে এসে, নিজেদের তোলা ছবি দিয়ে ক্লাসে বুঝাতে হয়েছে ওদের। কাজটা শুধু আনন্দের তাই না, পুরো সেমিস্টার একবারও আমাকে ‘এই চুপ করে আমার কথা শোনো’ কিংবা ‘কেউ ফোন হাতে নিও না’ ধরণের সাবধানবাণী দিতে হয় নি। কারণ ক্লাসে ওদের কাজই ছিলো কথা বলা এবং ফোন থেকে ছবি ঘেঁটে বের করে প্রেজেন্টেশন বানানো।
Workshop Lab এর কাজটা এত সহজ ছিলো না। কারণ কাঠ এবং লোহার কাটাকুটির কাজগুলো শুধু দেখলেই হবে না, অভিজ্ঞ কেউ না বুঝিয়ে দিলে কাজ বোঝা যাবে না। এ জায়গায় ছাত্রদের একা পাঠিয়ে দিলে কাজের কাজ হবে না। সুতরাং বের হলাম। ইউনিভার্সিটির আশেপাশে বেশ কয়েকটা ওয়ার্কশপে গিয়ে রীতিমতো অবাক হলাম। একে জায়গা সংকট, তার ওপর কেনই যেন ওরা অজানা অচেনা ছাত্রদের ক্লাস নেয়াতে বেশ অনীহা দেখালো। এদিকে আমাদের বাজেট পাশ হয়ে গেছে, হাতে টাকাও এসে গেছে। শেষ চেষ্টা হিসেবে ক্লাসে ছাত্রদের বললাম। একজনের বাবার বিশাল কাঠের আড়ত এবং ফার্নিচার ওয়ার্কশপ পাওয়া গেলো মিরপুরে। কিন্তু ওয়েল্ডিং আর লেদ মেশিনের কাজ দেখাবো কোথায়? হঠাত মনে পড়লো, আব্বু একজনের কথা বলতেন। আমার আব্বু রিটায়ারের আগে শেষ পনেরো বছর একটা ফার্মাসিউটিক্যালসের ইঞ্জিনিয়ারিং ডিভিশনের হেড ছিলেন। বিভিন্ন পার্টস এর কাজ করাতেন একটা ওয়ার্কশপে। সেই আতাউর রহমান আংকেল আবার বেশ ইনোভেটিভ ছিলেন, দারুণ কিছু মজার মজার জিনিস বানিয়ে দিতেন। বই আটকে রাখার একটা স্ট্যান্ড বানিয়ে দিয়েছিলেন স্টেইনলেস স্টীল দিয়ে, দেখাদেখি আমি আবদার করায় আমাকেও দিয়েছিলেন। যা হোক, আব্বুর মাধ্যমে উনার সাথেও যোগাযোগ হল। ঠিক হল, একই দিনে মিরপুর কাঠের কাজ দেখে দিনের পরের অর্ধেকে গাজীপুর কালিয়াকৈর গিয়ে স্টীল ওয়ার্কশপের কাজ দেখাবো। বাজেট এবং গাড়ির অনুমতি নেওয়াই আছে, এগারোই নভেম্বর বেরিয়ে পড়ার প্ল্যান করে ফেলা হল।
কখন কোথায় যাওয়া, থামা কিংবা খাবারের বিরতি, এর একটা বিস্তারিত শিডিউল ট্রান্সপোর্ট ডিভিশনের কাছে ইমেইল করেছিলাম। সকাল সাতটায় আশুলিয়া থেকে যাত্রা করে ধানমণ্ডির ছাত্রদের নিয়ে ওখানেই ড্রাইভারদের সাথে ছোট্ট একটা মিটিং করে সে শিডিউল বুঝিয়ে দিলাম। পরের স্টপেজ মিরপুরের কার্পেন্ট্রি শপ। সেখানে যাবার পর ছাত্রদের সাথে ছোট করে ব্রিফিং হল। কিভাবে এই ফিল্ড ওয়ার্কের মার্কিং হবে, কি কি প্রশ্ন করা যাবে, কোন গ্রুপ কতটা প্রশ্ন করবে, ইত্যাদি বুঝিয়ে দিয়েছি। দুইজনকে দেওয়া হল ছবি তোলা আর ভিডিও করার কাজ। আর, একজন পরে বিস্তারিত লিখবে সেটাও বলে দিলাম। গাছ কাটা, সংরক্ষণ, সীজনিং, সেখান থেকে স'মিলে তক্তা বা খুঁটি বানানো, পালিশিং, কিনারের গ্রুভ কাটা, নকশা করা, নানা ধরণের জয়েন্ট করা, এক এক করে সব দেখানো হল। মজার ব্যপার হচ্ছে, আমরা ক্লাসে চার মাসে যা পড়িয়েছি, তার অনেক কাজ এবং যন্ত্রপাতি এখন আর ব্যবহারই হয় না। অটোমেটিক মেশিন এসে গেছে।
এখান থেকে বেরিয়ে নামাজ আর খাওয়ার বিরতি। আবার ছোট্ট তিন মিনিটের মিটিং করলাম। ড্রাইভার এবং সাথের স্টাফদের সাথে৷ ঠিক হলো, ভালো একটা খাবার জায়গা বাছাই করতে হবে যেটা গাজীপুরের পথে পড়বে এবং পাশে মসজিদও থাকবে। এখানে একটা বিষয় বলে রাখি। একজন স্টাফ ছিলো একটা বাসে, সে আসলে আমাদেরই ছাত্র, কম্পিউটার ইঞ্জিনিয়ারিং ডিপার্টমেন্টের। এটা ওর পার্টটাইম কাজ। ওর বাড়িও গাজীপুর হওয়ায় পুরো কাজে চমৎকার সমন্বয় করা গেছে, ড্রাইভারদের সাথে যোগাযোগও সাবলীল হয়েছে।
গাজীপুর, আব্বুর প্রাক্তন কর্মক্ষেত্রের ঠিক পাশেই ওয়ার্কশপ। আগেও পিকনিকে এসেছি কয়েকবার। গিয়ে দেখি আতাউর সাহেব বিরাট আয়োজন করেছেন। পাশের ফাঁকা জায়গায় শামিয়ানা টাঙিয়ে ডেকোরেটর থেকে চেয়ার আনিয়েছেন। দোকানের ভেতরে তিনজন বসে আবার প্যাকেট করছে। কলা, আপেল, বিস্কুট আরও কি কি। আপত্তি করলাম। বললেন, আপনার আব্বুর সম্মানে। পাশের টঙ থেকে সবাই চা খেয়েছি, বিল দিতে গিয়ে শুনি কড়া নিষেধ করা আছে। আমাদের থেকে যেন পয়সা নেওয়া না হয়। ছাত্রদেরকে লেদ মেশিন, ওয়েল্ডিং মেশিন নিয়ে বলার সময়ও গলা কেঁপে যাচ্ছিলো আংকেলের। বলছিলেন, 'ইগো থাকা যাবে না, শেখার মানসিকতা না থাকলে টেকনিক্যাল ফিল্ডে টিকতে পারবেন না। এই যে আপনাদের ম্যাডামের আব্বা, আগে কাগজে এঁকে ড্রইং দিতেন, আবার কাঠি দিয়ে থ্রিডি মডেল বানিয়ে দেখাতেন। কত পরামর্শ দিয়েছেন। এত বড় মানুষ এসে আমার দোকানে চা খেতেন আর কাজ দেখায় দিতেন। নিখুঁত না হলে যেতেন না'।
ফেরার পথে ওখানে দেওয়া নাশতা দিয়েই বেশ বিকেলের খাবার হয়ে গেলো। শুক্রবার দেখেই হয়তো, নির্ধারিত সময়ের এক ঘন্টা আগেই আমরা পৌঁছে গেলাম ক্যম্পাসে। সেখান থেকে একটা বাস আবার আমাদের বাকিদের নামিয়ে দিয়ে আসলো ধানমণ্ডি।
ইচ্ছে করেই কিছু প্ল্যানিং বিস্তারিত লিখেছি। কারণ, কাজ যখন ক্লাসের বাইরে, সেখানে দরকার হয় শক্তিশালী এবং বাস্তবানুগ প্ল্যান, আর তার সাথে বাস্তবায়নের ইচ্ছা এবং চেষ্টা। এক্ষেত্রে ছাত্রদের সহযোগিতা যেমন লাগে, তেমন দরকার হয় ট্রান্সপোর্ট ডিপার্টমেন্ট সহ বেশ কয়েকটা অফিসের সমন্বয়। কাজের এক সপ্তাহ পরে ভাইভাতে বসে যখন জিগেস করছিলাম, কি কি ব্যপার ভালো লেগেছে। একজন বলেছে, ম্যাডাম সবচেয়ে ভালো লেগেছে এই যে আতাউর আংকেলকে, উনি এতো চমৎকার একটা মানুষ। আরেকজন বলেছে, করোনায় ক্লাস শুরু হওয়ায় ওরা আর এরকম আউটডোর ট্যুর পায় নি। অনেকটা পথ একসাথে থেকে তিন বছরের চেনা ক্লাসমেটের এমন কিছু গুণ দেখেছে যা আগে জানতোই না।
অর্জন হিসেবে, মেশিনপাতির বৃত্তান্ত জানার পাশাপাশি এসবও কম না। কি বলেন?