Daffodil International University

Famous => Person => Topic started by: Golam Kibria on January 06, 2013, 08:44:46 AM

Title: Ecxeptional and intelligent person
Post by: Golam Kibria on January 06, 2013, 08:44:46 AM
শ্যামনগরের চন্দ্রিকা দিদি

সুন্দরবনসংলগ্ন প্রত্যন্ত জনপদ। মানুষজনের বেশির ভাগই অভাবী। সত্যিকার অর্থে নুন আনতে পান্তা ফুরোয় তাঁদের। নিজেরা বিদ্যালয়মুখী হননি। সন্তানদেরও পড়ালেখা করানোর ইচ্ছা বা সামর্থ্য—কোনোটাই ছিল না। এভাবেই পার হচ্ছিল বছরের পর বছর।
একদিন চন্দ্রিকা ব্যানার্জি নামের এক গৃহবধূ উদ্যোগ নিলেন এই অবস্থার পরিবর্তনে। বিদ্যালয়ে যখন পাঠদান চলছে, তখন রাস্তার পাশে খেত-খামারে ছোট ছোট শিশুকে কাজ করতে দেখে তাঁর ভালো লাগেনি। শুরু করলেন ‘ঘরের খেয়ে বনের মোষ তাড়ানোর’ কাজ। সে দুই দশক আগের কথা।
সেই থেকে তিনি সাতক্ষীরার শ্যামনগর উপজেলার বুড়িগোয়ালিনী ও মুন্সিগঞ্জ এলাকার বাসিন্দাদের কাছে ‘চন্দ্রিকা দিদি’।
নিজ ঘরের বারান্দায় হয়েছিল সূচনা। এখন চন্দ্রিকা দিদির পাঠশালার সংখ্যা ১৭। মোট শিক্ষার্থী ৫১০ জন। বলার অপেক্ষা রাখে না, দরিদ্র ও সুবিধাবঞ্চিত শিশুরাই চন্দ্রিকা দিদির পাঠশালায় আসে। এই শিশুরাই শিক্ষিত হয়ে একদিন নিজেদের অধিকার আদায়ের পাশাপাশি সমাজের নেতৃত্ব দিতে পারবে—এমনটাই বিশ্বাস চন্দ্রিকার।
চন্দ্রিকার বিশ্বাস কিছুটা ফলতেও শুরু করেছে। কারণ, পাঠশালার প্রাক্তন শিক্ষার্থীদের অনেকেই এখন সমাজ ও কর্মক্ষেত্রে প্রতিষ্ঠিত।
গল্পের মতো শুরু: উচ্চমাধ্যমিক পাস করার আগেই পরিবারের অমতে বিয়ে করেন চন্দ্রিকা। সদ্য কৈশোর পেরোনো অবস্থায় উপজেলার ঈশ্বরীপুরে শ্বশুরবাড়িতেও প্রত্যাশিত মর্যাদা না পেয়ে তিনি মুষড়ে পড়েছিলেন। স্বামী স্বল্প আয়ের চাকরি করেন। তিনি অফিসে চলে যাওয়ার পরের সময়টা প্রতিবেশীদের বাড়ি বাড়ি ঘুরে কাটাতেন চন্দ্রিকা। সুযোগের অভাবে অনেক শিশুর শিক্ষাবঞ্চিত থাকার বিষয়টি এ সময় তাঁর নজরে আসে। বিষয়টি তাঁকে ভাবিয়ে তোলে। তিনি স্বামীর সঙ্গে পরামর্শ করে ওই শিশুদের পরিবারের সঙ্গে আলোচনা করেন এবং তাদের পড়াশোনায় ফিরিয়ে আনার উদ্যোগ নেন। চন্দ্রিকা তখন থেকেই শুরু করেন বিনা পারিশ্রমিকে পাঠদান কার্যক্রম।
চন্দ্রিকা ব্যানার্জির শয়নকক্ষের বারান্দায় পাঠশালার যাত্রা শুরু হয় ১৯৯২ সালে। পাশের বাড়ির ছেলে জিল্লুর রহমান, বাপ্পী মালো, মনিরুজ্জামানসহ আরও কয়েকজন শিশু সেখানে প্রথম পড়তে এসেছিল। চন্দ্রিকার বাড়ির আঙিনায় পর্যায়ক্রমে আরও শিশু ও কয়েকজন নারী শিক্ষার্থী জড়ো হয় অক্ষরজ্ঞান লাভের আশায়। এভাবে বাড়তে থাকে শিক্ষার্থীর সংখ্যা। চন্দ্রিকার পরিবারের সদস্যদের মধ্যেও অসন্তোষ দেখা দেয়। তাঁদের কাছে চন্দ্রিকার কার্যক্রম ছিল ‘ঘরের খেয়ে বনের মোষ তাড়ানোর’ সমতুল্য। কিন্তু বঞ্চিত শিশু ও নারীদের নিয়ে চন্দ্রিকার স্বপ্ন তত দিনে অনেক দূর এগিয়ে গেছে। তাই সব বাধা-বিপত্তি উপেক্ষা করে তিনি লক্ষ্যে অবিচল থাকেন এবং ধীরে ধীরে জাবাখালী, গুচ্ছগ্রামসহ আরও কয়েকটি স্থানে তাঁর কার্যক্রম ছড়িয়ে দেন। প্রতিদিন সকালে স্বামী অফিসে রওনা হলে চন্দ্রিকাও বেরিয়ে পড়তেন নিজ হাতে গড়া পাঠশালার উদ্দেশে। প্রতিটি কেন্দ্রে দুই ঘণ্টা করে পড়িয়ে বিকেলে বাসায় ফিরতেন। এভাবে কয়েক বছরে তাঁর কার্যক্রমের পরিসর বাড়ে। স্থান সংকুলানের অভাবে তিনি একটি বেসরকারি প্রতিষ্ঠানের সম্মেলনকক্ষ ব্যবহারের অনুমতি নেন। শিক্ষার্থীর সংখ্যা আরও বাড়ার পর তিনি নতুন চার-পাঁচটি স্থানে কার্যক্রম শুরু করেন। অনেকের সহযোগিতায় তিনি অভাবী শিশুদের বইপত্র ও কাগজ-কলমেরও ব্যবস্থা করেন।
অধিকারবঞ্চিত নারীদের অধিকার ও আত্মসচেতন করে তুলতে চন্দ্রিকা ব্যানার্জির উদ্যোগে ১৯৯৩ সালে ‘নকশী কাঁথা’ নামের একটি সংগঠন প্রতিষ্ঠিত হয়। পরে ওই সংগঠনের সঙ্গে পাঠশালাভিত্তিক কার্যক্রম সংযুক্ত করেন চন্দ্রিকা। নকশী কাঁথার উদ্যোগে তিনি উপকূলবর্তী প্রত্যন্ত অঞ্চল বুড়িগোয়ালিনী, কাশিমারী, মুন্সিগঞ্জসহ কয়েকটি স্থানে মোট ১৭টি বিদ্যালয় গড়ে তোলেন।
এক দিন পাঠশালায়: সম্প্রতি এক সকালে বুড়িগোয়ালিনী গ্রামে চন্দ্রিকা দিদিকে সঙ্গে নিয়ে তাঁর পাঠশালায় গিয়ে দেখা যায়, ছোট ছোট ছেলেমেয়েরা চাটাইয়ে বসে খুব মনোযোগের সঙ্গে লেখাপড়া করছে। চন্দ্রিকাকে দেখেই ছেলেমেয়েরা দিদি বলে সালাম দিল।
একটি ঘর নিয়েই এই পাঠশালা। কাঠের বেড়া, ওপরে গোলপাতার ছাউনি। শিক্ষক জানালেন, পাঠশালায় প্রথম থেকে পঞ্চম শ্রেণী পর্যন্ত পড়ানো হয়। ছেলেমেয়ে ৪০ জনের মতো।
চন্দ্রিকার ১৭টি পাঠশালায় ১৭ জন শিক্ষক আছেন। তাঁদের মাসে কিছু ভাতা দেওয়া হয়। দরিদ্র শিশুদের দিতে হয় শিক্ষা উপকরণ। যারা পরীক্ষায় ভালো ফল করে, তাদের বৃত্তি দেওয়ার ব্যবস্থা আছে। খরচ কুলিয়ে উঠতে না পারায় ২০০৩ সাল থেকে একটি বেসরকারি প্রতিষ্ঠানের সহায়তা নিচ্ছেন তিনি।
তবে বাড়ি বাড়ি গিয়ে ছাত্র সংগ্রহ, পাঠশালার যাবতীয় দেখভাল—সবই করেন তিনি। চেষ্টা করেন সপ্তাহে একবার হলেও পাঠশালাগুলো ঘুরে দেখতে।
‘বুড়িগোয়ালিনী উপানুষ্ঠানিক বিদ্যালয়ে’র তৃতীয় শ্রেণীর ছাত্র রাসেল কিছুদিন আগেও বাবার সঙ্গে নদীতে জাল টানতে যেত। কিন্তু চন্দ্রিকা দিদির পরামর্শে সে আবার স্কুলে পড়াশোনার অনুমতি পেয়েছে। ভ্যানচালক ইব্রাহিম গাজীর মেয়ে সালমা আগে মায়ের সঙ্গে চিংড়িঘেরে শামুক কুড়াত। কিন্তু বাড়ির পাশের স্কুলে ভর্তি হয়ে পড়াশোনায় এখন সে বেশ ভালো করছে।
সাফল্য ও কৃতজ্ঞতা: চন্দ্রিকার বারান্দায় প্রথম পাঠ গ্রহণকারী সেই শিশুদের কয়েকজন এখন সমাজে প্রতিষ্ঠিত। সেই বাপ্পী মালো ও জিল্লুর রহমান এখন পৃথক বেসরকারি প্রতিষ্ঠানে কাজ করেন। দরিদ্র পরিবারের মেয়ে মিলি খাতুন পড়েন খুলনা মেডিকেল কলেজে। তিনিও চন্দ্রিকার পাঠশালার ছাত্রী ছিলেন। জিল্লুরের বাবা শেখ নূর আলী, মিলির মা নুরুন্নাহার, বাপ্পীর বাবা খোকন মালোসহ অন্য অভিভাবকেরা নিজ নিজ সন্তানের প্রতিষ্ঠার পেছনে চন্দ্রিকার অবদান কৃতজ্ঞতাভরে স্বীকার করেন।
চন্দ্রিকা নিজ জীবন থেকে অর্জিত শিক্ষাকে শক্তিতে পরিণত করে একটি দৃষ্টান্ত স্থাপন করেছেন—এ মন্তব্য করেছেন শ্যামনগর আতরজান মহিলা মহাবিদ্যালয়ের অধ্যক্ষ আশেক-ই-এলাহী। তিনি মনে করেন, চন্দ্রিকার প্রচেষ্টা সরকারি পৃষ্ঠপোষকতা পেলে আরও এগিয়ে যাবে।
সব শিশুকে বিদ্যালয়ে আনতে সরকারি উদ্যোগ সত্ত্বেও প্রতিবছর অনেক শিশু শিক্ষা কার্যক্রম থেকে ঝরে পড়ছে। আর সেই শিশুদেরই বিদ্যালয়মুখী করতে চন্দ্রিকা সরকারকে সহযোগিতা করছেন—মন্তব্য শ্যামনগর উপজেলা প্রাথমিক শিক্ষা কর্মকর্তা আবদুল হাকিমের। তাই চন্দ্রিকার উদ্যোগ প্রশংসার দাবি রাখে।
স্বপ্ন সীমাহীন: চন্দ্রিকা বলেন, তাঁর এলাকা সুন্দরবনসংলগ্ন শ্যামনগর উপজেলাসহ উপকূলজুড়ে বহু শিশু প্রতিবছর বিদ্যালয় থেকে ঝরে পড়ছে। তাঁর অভিজ্ঞতামতে, বাড়ি থেকে বিদ্যালয়ের দূরত্ব, মা-বাবার অসচেতনতা ও দারিদ্র্যই ঝরে পড়ার মূল কারণ।
চন্দ্রিকা বিশ্বাস করেন, বঞ্চিত শিশু ও নারীর অধিকার প্রতিষ্ঠায় তাঁর সংগ্রাম এখনো অসমাপ্ত রয়ে গেছে। চন্দ্রিকা তাই স্বপ্ন দেখেন নিরন্তর।