(http://sphotos-g.ak.fbcdn.net/hphotos-ak-snc6/p206x206/429061_496943690350820_1321440516_n.jpg)
বাংলা সাহিত্যের প্রথম মহিলা কবি চন্দ্রাবতী। মধ্যযুগে বাংলা সাহিত্যের বিকাশের সময়কালে যাঁরা সাহিত্যচর্চা করে খ্যাতি অর্জন করেছেন কবি চন্দ্রাবতী তাঁদের মধ্যে অন্যতম। বাংলাদেশের কিশোরগঞ্জ জেলার পাতুয়ারী গ্রামে তিনি জন্মগ্রহণ করেন। তাঁর জন্ম সাল ১৫৫০ খিস্টাব্দ বলে মনে করা হয়। বাংলায় তখন মুসলিম সুলতানগণ রাজত্ব করতেন।
কবি চন্দ্রাবতী অনেক কারনে পাঠকের মনোযোগ আকর্ষণ করেন। প্রথমত: তিনি বিখ্যাত মধ্যযুগীয় কবি দ্বিজ বংশীদাসের মেয়ে। বংশীদাস ১৫৭৫/৭৬ খ্রিস্টাব্দে মনসামঙ্গল কাব্যচর্চায় নিয়োজিত ছিলেন। যিনি মনসামঙ্গল, রামগীতা, চণ্ডী ইত্যাদি কাব্যগ্রন্থ রচনা করেছিলেন। বংশীদাস একজন সঙ্গীতশিল্পীও ছিলেন। পরিবারের সমর্থনের কারনেই চন্দ্রাবতী শিক্ষিত ও কাব্যচর্চা করতে হতে পেরেছিলেন এবং বাবা বংশীদাসই তাঁকে কাব্যচর্চায় উৎসাহ দিতেন বলে জানা যায়।
(http://sphotos-e.ak.fbcdn.net/hphotos-ak-prn1/p206x206/58602_496943670350822_878584390_n.jpg)
দ্বিতীয়ত: মধ্যযুগে বাংলা সাহিত্য ও সংগীতে চন্দ্রাবতী বিখ্যাত হয়েছিলেন তাঁর অসামান্য কাব্য প্রতিভার কারনেই। তিনি লিখেছেন ‘রামায়ন কথা’, ‘দস্যু কেনারামের গাঁথা’, পদ্মপুরাণ, মলুয়া ইত্যাদি বিখ্যাত সব কাব্য যা মধ্যযুগে বাংলা সাহিত্যের সূচনাকালে বাংলা সাহিত্যকে সমৃদ্ধ করেছিল। তিনি অনেক লোকগানও রচনা করেছিলেন। তাঁর বাবা কবি দ্বিজ বংসীদাশ ও দাদা যাদবানন্দও গান রচনা ও পরিবেশন করতেন। ঐতিহ্যগত ভাবেই তাঁর পরিবার সংস্কৃতিমনা ছিল।
তৃতীয়ত: কবি চন্দ্রাবতী কাব্যচর্চার পাশাপাশি নিজেই সমকালীন কবি ও লেখকদের কাছে বিরহী জীবনের একটি ‘আইকন’ বনে গিয়েছিলেন। কেননা তিনি নিজে ‘জয় চন্দ্রাবতী’ নামক উপখ্যানের নায়িকা। এটি অন্যতম একটি মৈমনসিংহ গীতিকা। কবির ব্যক্তিগত জীবনের ট্রাজেডি নিয়ে কাব্যচচা হয়েছিল। তাঁর জীবনের সেই মর্মান্তিক আখ্যানটি সংক্ষেপে এমন: ‘কবি ছিলেন রূপসী এবং তিনি ভালবেসেছিলেন জয়চন্দ্রকে। তাঁর বাবা বংশীদাস মেয়ের পছন্দের পাত্রের সাথে কবির বিয়েতে মতও দিয়েছিলেন। কিন্তু জয়চন্দ্র ওদিকে অন্য নারী ‘কমলা’কে বিয়ে করেছিলেন। নিজের ভালবাসার এই অপমানে তিনি ব্যাথিত হয়ে পড়েন। কিছুদিন পর জয়চন্দ্র ফিরে এসেছিলেন বটে কিন্তু চন্দ্রাবতী তাকে আর মেনে নিতে পারেননি। জয়চন্দ্র শেষ পর্যন্ত ফুলেশ্বরী নদীতে আত্মহত্যা করেছিলেন। জয়চন্দ্রের জীবন বিষর্জণের ঘটনায় কবি চন্দ্রাবতী আরও মর্মাহত হন। তিনি ফুলেশ্বরী নদীর তীরে নির্মিত মন্দীরে শিবের পুজা অর্চণা ও কাব্যচর্চার মাধ্যমে কুমারী বেশে বাকী জীবন কাটিয়ে দেন’। কবির ব্যক্তিজীবনের এই বেদনাবিধুর কাহিনী নাড়া দিয়েছিল সমকালীন গীতিকার ও কাব্যজনদের । তাঁরা তাই কবির জীবনী নিয়ে রচনা করেছেন বেশ কয়েকটি কাব্য ও পালা।
পাতুয়ারী গ্রামে বর্তমানে নিশ্চিহ্ন ফুলেশ্বরী নদীর তীরে কবি চন্দ্রাবতীর স্মৃতিবিজড়িত বাসভবন, শিবমন্দির ও বিলুপ্ত নদী ফুলেশ্বরী পরিদর্শন করি বিগত ০৩ জানুয়ারী ২০১২ তারিখে। আমার সাথে ছিল ডেফোডিল ইন্টারন্যাশনাল ইউনিভার্সিটির একদল শিক্ষার্থী, যারা বিবিএ প্রগ্রামের অধীনে ‘বাংলাদেশ স্টাডিজ’ নামে একটি কোর্স পড়ে থাকে। বাংলাদেশের ইতিহাস, ঐতিহ্য ও আর্থ-সামাজিক বিষয়াবলীর সাথে পরিচিত করানোই এই কোর্সের উদ্দেশ্য।
(http://sphotos-c.ak.fbcdn.net/hphotos-ak-ash3/553228_496943717017484_2051191367_n.jpg)
কবির বাড়ীটি প্রায় ভগ্নাবস্থায় রয়েছে। বাড়ীর এক অংশে একটি মুসলমান পরিবার ও অন্য অংশে একটি হিন্দু পরিবার বাস করছে। জরাজীর্ণ এই বাড়ী ও শিবমন্দির রক্ষণাবেক্ষণে কোন সরকারী বা বেসরকারী উদ্যোগ নেই। ফলে দেয়াল ছাড়া বাড়ীর আর কোন মূল্যবান কিছু অবশিষ্ট নেই। দেয়ালের টেরাকোটা কারুকাজ পর্যন্ত তুলে নেয়া হয়েছে। ভুমি অফিসের একজন কর্মকর্তার সহযোগিতায় আমরা বাড়ীটি পরিদর্শন করতে পারি। ঐ কর্মকর্তা জানান, যেহেতু বাড়ীটি উক্ত পরিবারদ্বয় নিজ নামে রেজিস্ট্রিসূত্রে মালিক হয়ে গেছেন এবং সরকার এটিকে অধিগ্রহণ করেনি, তাই এটি সংরক্ষণের কোন উদ্যোগ নেয়া হয়নি।
কবির বাড়ীতে যাতায়াতের ব্যবস্থাও ভালো নয়, একমাত্র রাস্তাটিও মাটির। কিশোরগঞ্জ শহরের খুব কাছে হলেও পাকা রাস্তার অভাবে দর্শনার্থীরা যেতে পারেননা। বাড়ীর পাশেই একটি প্রাইমারী স্কুল হয়েছে কবির নামে, ‘কবি চন্দ্রাবতী প্রাথমিক বিদ্যালয়’।
কবি চন্দ্রাবতী বাংলা সাহিত্যের সম্পদ, তিনি বাঙ্গালী নারীর অগ্রযাত্রার ইতিহাসেও একজন অন্যতম পথিকৃত। তাঁর অবদান ও স্মৃতির প্রতি শ্রদ্ধা জানিয়ে সরকারের সংশ্লিষ্ট বিভাগ বাড়ীটি সংরক্ষণ ও তত্বাবধানে দ্রুত ব্যবস্থা নেবেন বলে আশা করছি।