স্মার্টফোন ও ট্যাবলেটেও মারাত্মক ভাইরাস! কম্পিউটারের ভাইরাস এখন ট্যাবলেট আর কম্পিউটারের ক্ষেত্রেও ঝুঁকি তৈরি করছে। ভাইরাস আক্রমণের ঝুঁকি বিবেচনা করলে মুঠোফোনের নিরাপত্তা নিয়ে চিন্তায় পড়ে যাওয়ারই কথা।
যুক্তরাষ্ট্রের প্রযুক্তি গবেষকেরা জানিয়েছেন, ট্যাবলেট আর মুঠোফোনের জনপ্রিয়তার সঙ্গে সঙ্গে বাড়ছে ভাইরাসের আক্রান্ত হওয়ার ঝুঁকিও। ইন্টারনেট নিরাপত্তা প্রতিষ্ঠান ব্লু কোট সিস্টেমসের প্রকাশিত সাম্প্রতিক এক প্রতিবেদনে বলা হয়েছে, ডেস্কটপ কম্পিউটারের মতই মুঠোফোন ও ট্যাবলেটে ভাইরাস আক্রমণের ঝুঁকি বেড়ে গেছে।
চলতি বছরের ফেব্রুয়ারি মাসে কম্পিউটার নিরাপত্তা প্রতিষ্ঠান ম্যাকাফিও তাদের প্রতিবেদনে একই ভাইরাস ঝুঁকির কথা জানিয়েছিল। ম্যাকাফি সেসময় জানিয়েছিল, অ্যান্ড্রয়েড অপারেটিং সিস্টেমেই ভাইরাস আক্রমণের ঝুঁকি বেশি।
গবেষকেরা জানিয়েছেন অ্যান্ড্রয়েডের পাশাপাশি অন্যান্য অপারেটিং সিস্টেমনির্ভর মুঠোফোন ব্যবহারকারীদেরও ভাইরাস আক্রমণের কারণ ও প্রতিরোধের বিষয়গুলো মাথায় রাখা উচিত। যদি মুঠোফোন বা ট্যাবলেটে ভাইরাস ঢুকে পড়ে তবে তা ব্যবহারকারীর অগোচরেই অ্যাডওয়্যার ইনস্টল করে ফেলতে পারে এবং এসএমএস ট্রোজান সক্রিয় করে ফেলতে পারে। এরপর মোবাইল ফোন থেকে অগোচরে বিভিন্ন কন্টাক্ট নম্বরে বার্তা পাঠাতে থাকে এবং অর্থ হাতিয়ে নিতে থাকে। এ ছাড়াও মোবাইল ফোনে আসা ইমেইল, বার্তা ও ব্রাউজিং তথ্য চুরি করে।
টাইম অনলাইনে প্রকাশিত সাম্প্রতিক এক প্রতিবেদনে মুঠোফোনে ভাইরাস আক্রমণের ঝুঁকি ও সে ঝুঁকি নিরাপত্তায় করণীয় তথ্য উঠে এসেছে।
কীভাবে মুঠোফোন বা ট্যাবলেটে ভাইরাস প্রবেশ করে?
অ্যাপ্লিকেশন ডাউনলোডের সময় মুঠোফোন বা ট্যাবলেটে ভাইরাস প্রবেশ করে। অ্যাপ ডাউনলোডের সময় সচেতন না থাকার ফলে ভাইরাস ভোগান্তির শিকার হতে হয়। মুঠোফোন নিরাপত্তা বিশ্লেষকেরা জানিয়েছেন, জনপ্রিয় ও প্রয়োজনীয় অনেক অ্যাপ্লিকেশনের ছদ্মবেশে মুঠোফোনে ম্যালওয়্যার ডাউনলোড হয়ে যায়। অনেক সময় সচেতন থাকার পরও ম্যালওয়্যারের ধোঁকায় পড়ে যান অ্যাপ্লিকেশন ডাউনলোডকারী। ২০১২ সালে জনপ্রিয় গেম ‘অ্যাংরি বার্ডস’ ও ‘অ্যাসাসিন ক্রিড’ অ্যাপ্লিকেশনের ছদ্মবেশে গুগল প্লে স্টোর থেকে ম্যালওয়্যার ডাউনলোডের হার ছিল বেশি। এতে অনেক অ্যাপ্লিকেশন ডাউনলোডকারী তাদের প্রচুর অর্থ খুইয়েছেন।
অ্যাপ্লিকেশন ছাড়াও ওয়েবপেজ থেকেও ট্যাবলেট ও মুঠোফোনে ভাইরাসের আক্রমণ ঘটতে পারে। চলতি বছরের ফেব্রুয়ারি মাসে যুক্তরাষ্ট্রের স্যানফ্রান্সিসকোতে অনুষ্ঠিত আরএসএ সিকিউরিটি কনফারেন্সে নিরাপত্তা গবেষক ক্রিস অ্যাসটাসিও জানিয়েছিলেন, অ্যাপ্লিকেশনের পাশাপাশি ওয়েবপেজ থেকেও মুঠোফোন ও ট্যাবলেটে ভাইরাস আক্রমণের ঝুঁকি বাড়ছে। অ্যান্ড্রয়েড-নির্ভর মুঠোফোন ও ট্যাবলেটের পাশাপাশি কম্পিউটারের জন্য তৈরি ট্রোজান ভাইরাসগুলো আইফোন, আইপ্যাডের জন্যও ঝুঁকির কারণ হয়ে উঠতে পারে। এখন আক্রমণের ঝুঁকি কম থাকলেও ভবিষ্যতে ওয়েবপেজের মাধ্যমে মুঠোফোন ও ট্যাবলেট ভাইরাস আক্রান্ত হওয়া সম্ভব বলেই জানান ক্রিস।
অ্যান্ড্রয়েডে ম্যালওয়্যারের রাজত্ব
কম্পিউটার নিরাপত্তা প্রতিষ্ঠান ম্যাকাফি জানিয়েছে, ২০১৩ সালের ফেব্রুয়ারি নাগাদ তারা ৩৬ হাজারেরও বেশি অ্যান্ড্রয়েড ম্যালওয়্যার শনাক্ত করেছিল। ম্যাকাফির পাশাপাশি আরেকটি ইন্টারনেট নিরাপত্তা প্রতিষ্ঠান ক্যাসপারস্কি ল্যাবের ২০১২ সালে প্রকাশিত প্রতিবেদনে বলা হয়েছিল, হ্যাকারদের কাছে ভাইরাস ছড়ানোর সবচেয়ে জনপ্রিয় প্ল্যাটফর্ম হচ্ছে অ্যান্ড্রয়েড। ২০১২ সালে ৯৪ শতাংশ ম্যালওয়্যার অ্যান্ড্রয়েড অপারেটিং সিস্টেম লক্ষ্য করে তৈরি করা হয়েছিল। এর মধ্যে বেশি ঝুঁকিতে ছিল জিঞ্জারব্রেড ও আইসক্রিম স্যান্ডউইচ। ক্যাসপারস্কির শনাক্ত করা বেশির ভাগ ভাইরাসই ছিল ট্রোজান এসএমএস। তাই মুঠোফোনে কোনো অস্বাভাবিক মেসেজ আদান-প্রদান বিষয়টির খোঁজ পেলে, আপনার মুঠোফোনে ভাইরাসের আক্রমণ হয়েছে কী না তা যাচাই করে দেখতে হবে এবং দ্রুত প্রতিরোধের কথা ভাবতে হবে। প্রতিরোধের জন্য আপনাকে অ্যান্ড্রয়েড অপারেটিং সিস্টেমের সর্বশেষ সংস্করণটি ব্যবহার করতে হবে বলেই পরামর্শ গবেষকেদের।
গবেষকেরা জানিয়েছেন, অ্যান্ড্রয়েডের জন্য বেশির ভাগ ভাইরাস তৈরি হচ্ছে; এর অর্থ এই নয় যে, অন্যান্য অপারেটিং সিস্টেমগুলো সম্পূর্ণ নিরাপদ। মুঠোফোন বিশ্লেষক প্রতিষ্ঠান অ্যাপঅথরিটি প্রকাশিত সাম্প্রতিক এক প্রতিবেদনে বলা হয়েছে, অ্যান্ড্রয়েডের চেয়েও আইওএস অ্যাপ্লিকেশনগুলো বেশি ঝুঁকি তৈরি করতে পারে। গবেষকেরা ২০১২ সালে প্রথম আইওএস ম্যালওয়্যারের খোঁজ পেয়েছিলেন যে অ্যাপ্লিকেশনটি আইফোনের তথ্য চুরি করে হ্যাকারকে জানিয়ে দিতে সক্ষম ছিল এবং এ ম্যালওয়্যারটি আইফোনের কন্টাক্ট তালিকার সবার কাছে স্প্যাম বার্তা পাঠাতে সক্ষম ছিল।
২০১২ সালে বাজারে আসা উইন্ডোজ ফোন ৮ অপারেটিং সিস্টেম প্ল্যাটফর্মটি এখনও নতুন। কিন্তু এ প্ল্যাটফর্মটিও সম্পূর্ণ নিরাপদ নয়। সম্প্রতি ভারতীয় এক কিশোর উইন্ডোজের জন্য ম্যালওয়্যার তৈরি করে দেখিয়েছেন। তাই গবেষকেরা এই প্ল্যাটফর্মটি ব্যবহারকারীদের সতর্ক করে দিয়েছেন।
কীভাবে মুঠোফোন ও ট্যাবলেট নিরাপদ রাখবেন
আপনি যখন কোনো পরিচিত অ্যাপ্লিকেশন ডাউনলোড করবেন তখনও আপনাকে সতর্ক থাকতে হবে। কারণ পরিচিত অনেক অ্যাপ্লিকেশনের ছদ্মবেশে আপনার প্রিয় পণ্যটিতে মারাত্মক ভাইরাস প্রবেশ করে অ্যাপ্লিকেশন ব্যবহারে সমস্যা তৈরি করতে পারে। আর এ সমস্যা এড়াতে, অ্যাপ্লিকেশন ডাউনলোডের আগে নির্মাতার তথ্য যাচাই করে নিতে হবে। পরিচিত ও মূল উত্স থেকে প্রকাশিত না হওয়া অ্যাপ্লিকেশন ডাউনলোড করার সময়ই সতর্ক থাকতে হবে। উদাহরণ হিসেবে বলা যায়, অ্যাংরি বার্ড অ্যাপ্লিকেশনটির প্রকাশক রোভিও। এই প্রকাশকের বাইরে আর কারও প্রকাশিত অ্যাংরি বার্ড ডাউনলোড করবেন না। যদি এরকম ম্যালওয়্যারের সন্ধান পান তবে তা গুগলের কাছে অভিযোগ দিন। যদি কোনো অজানা বা অপরিচিত প্রকাশকের প্রকাশিত কোনো অ্যাপ্লিকেশন আপনার পছন্দ হয় সেক্ষেত্রে ডাউনলোডের আগে অ্যাপ্লিকেশনটির রেটিং ও ব্যবহারকারীদের মন্তব্যগুলো দেখে দিন। অ্যাপ্লিকেশনটিতে কোনো ব্যবহারকারী লাল পতাকা দেখিয়েছেন কী না তা খেয়াল করুন।
অ্যাপ্লিকেশন ডাউনলোডের আগে যদি মন্তব্য কম থাকে এবং এতে যদি কেউ ভুয়া অ্যাপ্লিকেশন বলে মন্তব্য করেন তবে তা যাচাই করে নিতে হবে। এর জন্য অনলাইনে ওই অ্যাপ্লিকেশনের রিভিউ বা পর্যালোচনা পড়ে নিয়ে তারপর ডাউনলোড করতে হবে। অনেক বেশি নেতিবাচক মন্তব্যযুক্ত অ্যাপ্লিকেশন ডাউনলোডের ক্ষেত্রে সচেতন থাকতে হবে।
মুঠোফোন ও ট্যাবলেটের জন্য অ্যান্টি-ম্যালওয়্যার অ্যাপ্লিকেশন
মুঠোফোন ও ট্যাবলেটের নিরাপত্তার জন্য বেশ কয়েকটি অ্যান্টি-ম্যালওয়্যার সফটওয়্যার বাজারে রয়েছে। বিনামূল্যে অ্যাপ্লিকেশন স্টোরগুলোতেও অনেক অ্যাপ্লিকেশন ডাউনলোডের জন্য পাওয়া যায়। বাজারে থাকা কয়েকটি জনপ্রিয় মুঠোফোন নিরাপত্তা অ্যাপ্লিকেশনের মধ্যে অ্যান্ড্রয়েড নির্ভর পণ্যের জন্য নর্টন সিকিউরিটি অ্যান্টিভাইরাস, লুকআউট সিকিউরিটি অ্যান্ড অ্যান্টিভাইরাস, ম্যাকাফি মোবাইল সিকিউরিটি, এভিজি অ্যান্টিভাইরাস উল্লেখযোগ্য। আইফোন ও আইপ্যাডের জন্য রয়েছে ওয়েবরুট সিকিউরওয়েব নামের নিরাপত্তা পণ্য আর উইন্ডোজ ফোনের জন্য রয়েছে ট্রাস্টগো অ্যান্টিভাইরাস। ব্ল্যাকবেরি ও অ্যান্ড্রয়েডের উপযোগী হতে পারে কুইকহিল।
কম্পিউটার, মুঠোফোন, ট্যাবলেটের জন্য যাঁরা আলাদা আলাদা নিরাপত্তা সফটওয়্যার ব্যবহার করতে নারাজ তাঁরা অল-ইন-ওয়ান নিরাপত্তা ব্যবস্থা বেছে নিতে পারেন। এরকম সফটওয়্যারের মধ্যে রয়েছে ম্যাকাফি অল অ্যাকসেস, ক্যাসপারস্কি ওয়ান, ট্রেন্ড মাইক্রো টাইটানিয়াম ম্যাক্সিমাস সিকিউরিটি। এ ধরনের সফটওয়্যার বান্ডেল কেনার জন্য বেশি অর্থ খরচ হতে পারে। এর জন্য ৩০ মার্কিন ডলার থেকে ১০০ মার্কিন ডলার পর্যন্ত খরচ হতে পারে। তবে নিরাপত্তা বিশ্লেষকেদের পরামর্শ হচ্ছে শুধু একটি মুঠোফোন বা ট্যাবলেটের জন্য নিরাপত্তা পণ্য হিসেবে অ্যাপ্লিকেশন স্টোর থেকে সাশ্রয়ী কোনো অ্যাপ্লিকেশন বেছে নেওয়া।
মুঠোফোন ও ট্যাবলেটের পাসওয়ার্ড নিরাপদ করুন
মুঠোফোন নিরাপত্তা বিশ্লেষকেরা নিয়মিত মুঠোফোন ও ট্যাবলেট স্ক্যান করার পরামর্শ দিয়েছেন এবং পাসওয়ার্ডের নিরাপত্তাব্যবস্থা জোরদার করার পরামর্শ দিয়েছেন। মুঠোফোনের পাসওয়ার্ড ব্যবস্থা জোরদার করতে পাসওয়ার্ড প্রটেকশন অ্যাপ্লিকেশন ইনস্টল করার পরামর্শ দিয়েছেন প্রযুক্তিবিদরা। যাঁরা অনলাইন ব্যাংকিং করেন বা মুঠোফোনের মাধ্যমে আর্থিক তথ্য লেনদেন করেন তাঁদের পাসওয়ার্ড নিরাপত্তায় একাধিক স্তর যুক্ত করার পরামর্শ গবেষকেদের। আইওএস ও অ্যান্ড্রয়েডের জন্য ‘ওয়ানপাসওয়ার্ড’, নর্টন আইডেনটিটি সেফ, আইওএস ও অ্যান্ড্রয়েড ও উইন্ডোজ ফোন ৭-এর জন্য ‘লাস্ট পাস’ অ্যাপ্লিকেশনগুলো কাজে লাগতে পারে। নিরাপত্তা গবেষকেরা জানিয়েছেন, দ্বিস্তর পাসওয়ার্ড ব্যবস্থা থাকলে ম্যালিসাস সফটওয়্যারগুলো পাসওয়ার্ড তথ্য চুরি করতে পারে না।
গবেষকেরা জানিয়েছেন, অ্যান্টি ম্যালওয়্যার অ্যাপ্লিকেশন ডাউনলোড ও ইনস্টল করার পর নিয়মিত ট্যাবলেট ও মুঠোফোন স্ক্যান করতে হবে। প্রতি সপ্তাহে অন্তত একবার স্ক্যান করার মাধ্যমে আপনার প্রিয় পণ্যটিকে ভাইরাসমুক্ত রাখতে পারেন।
(http://paimages.prothom-alo.com/resize/maxDim/340x1000/img/uploads/media/2013/05/13/2013-05-13-04-34-40-51906d60a018b-tab1.jpg)
Ref:- http://www.prothom-alo.com/detail/date/2013-05-13/news/351918