পানি বিশুদ্ধকরণে নতুন পদ্ধতি উদ্ভাবন!
(http://www.banglanews24.com/images/imgAll/2013May/water20130706041810.jpg)
পানির অপর নাম জীবন। কিন্তু তা যদি জীবাণুমুক্ত না হয় তবে সেই পানিই হতে পারে জীবন হরণকারী। কলেরা, আমাশয়, টাইফয়েড ইত্যাদি ডায়রিয়া জাতীয় রোগ কাজের সময় ও সুযোগও নষ্ট করে এবং অনেক সময় মৃত্যুর দিকেও ঠেলে দেয়। শিশুদের শরীরে রোগ প্রতিরোধ ক্ষমতা এবং পুষ্টি সঞ্চয় কম থাকে বলে এসব অসুখে তাদের মৃত্যু ঝুকি বেশি থাকে। অথচ পানিতে ডায়রিয়ার জীবাণু ধ্বংস করা খুবই সহজ একটি কাজ। সাধারণত পানি ফুটিয়ে নিলেই সব ডায়রিয়া জীবাণু মরে যায়। কিন্তু অনেক সময় জ্বালানীর অভাবে পানি ফোটানো কঠিন হয়ে দাঁড়ায়। বিশেষ করে বন্যার সময় পানি ফোটানোর ব্যবস্থা করা প্রায় অসম্ভব। তাই কম খরচে আশেপাশের জিনিসপত্র দিয়েই সূর্যের বিকিরণ ব্যবহার করে পানি জীবাণুমক্ত করার বিশেষ প্রযুক্তি পদ্ধতি উদ্ভাবন করেছে ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের বায়োমেডিকেল ফিজিক্স অ্যান্ড টেকনোলজি বিভাগ বিশেষ প্রযুক্তি উদ্ভাবন করে সাফল্য দেখিয়েছে। এ প্রযুক্তি উদ্ভাবন করেছেন বায়োমেডিকেল ফিজিক্স অ্যান্ড টেকনোলজি বিভাগের প্রধান অধ্যাপক খোন্দকার সিদ্দিক-ই-রব্বানী ও তার বিভাগের শিক্ষার্থীরা। তাদের উদ্ভাবিত প্রযুক্তিগত এ পদ্ধতিটিই স্বপ্নযাত্রায় তুলে দেওয়া হলো।
পানির বোতল ব্যবহার:-
বাজারে যে বোতলে পানি বিক্রি হয় সে বোতল ব্যবহার করেও পানি গরম করা যায়। প্রথমে স্বচ্ছ ১ লিটার বা দেড় লিটার বোতল নিতে হবে। খেয়ার রাখতে হবে যেন বোতল রঙিন না হয়। পুরানো বোতল বা কোথাও ফাটা দাগ থাকলেও ব্যবহার করা যাবে না। বোতলগুলোকে লোহার মোটা তার দিয়ে একটি খোলা শক্ত ফ্রেম তৈরি করে নিতে হবে, যেন তার উপর কয়েকটি পানিভরা বোতল শুইয়ে রাখা যায়। কিন্তু নিচে বাতাস চলতে পারে। প্রথমে তাপ নিরোধক বিছানার উপর কালো কাপড় বিছিয়ে দিতে হবে। মাঝখানে ফ্রেমটি রেখে একটি স্বচ্ছ পলিথিন শীট ফ্রেমের উপর ছড়িয়ে দিতে হবে। পানি ভরা বোতলগুলো সম্পূর্ণ ভরে মুখ আটকিয়ে পলিথিন শীট দিয়ে ঢাকা ফ্রেমের উপর শুইয়ে দিতে হবে। বোতলগুলোর উপর আড়াআড়ি করে কয়েকটি খড়ের নাড়া ছড়িয়ে দিয়ে তার উপর আর একটি স্বচ্ছ পলিথিন শীট দিয়ে পুরো বিছানা ঢেকে দিতে হবে।
বোতলে পানি গরম হবার ব্যাখ্যা:-
এ ব্যবস্থায় বাতাসকে গরম করে তার মাধ্যমে বোতলের পানিকে পরোক্ষভাবে গরম করা হচ্ছে। তবে পলিথিন শীট দিয়ে দুটি আবদ্ধ বাতাসের স্তর কিছুটা ভিন্নভাবে কাজ করবে। নীচের কালো কাপড় সূর্যের বিকিরণ গরম হয়ে প্রথমত: নীচের আবদ্ধ বাতাসের স্তরকে গরম করবে। হাল্কা গরম বাতাস নীচের আবদ্ধ বাতাসের স্তরের উপরে রাখা পানির বোতলের নীচ দিয়ে প্রবাহিত হবে এবং বোতলের পানির নীচের স্তরকে গরম করবে।এ কাজ করতে গিয়ে এ বাতাস ঠাণ্ডা হয়ে মাঝখানে নেমে আসবে। কালো কাপড়ের সংস্পর্শে এসে গরম হয়ে পাশের থেকে আবার উপরে উঠে বোতলের নীচে যাবে। এভাবে নীচের আবদ্ধ বাতাসের স্তরের পরিচলন প্রক্রিয়ায় বোতলের পানির নিচের স্তর গরম হবে। আবার বোতলের মধ্যে পানির পরিচলন প্রক্রিয়ার মাধ্যমে গরম পানি উপরে উঠে, ও ঠাণ্ডা পানি নিচে নেমে পুরো পানিকেই গরম করে ফেলবে। উপরের আবদ্ধ বাতাসের স্তরের গরম বাতাস বোতলের উপরের পানিকে আগে গরম করবে, কিন্তু সে গরম পানি আর নীচে নামবে না। তবে পরিবহন প্রক্রিয়ায় উপরে পানির সংস্পর্শে নিচের পানি ধীরে ধীরে গরম হবে। উদ্ভাবিত দুটি বায়ু-স্তরবিশিষ্ট এ ব্যবস্থায় সূর্যের শক্তির সবচেয়ে বেশি ব্যবহার হবে, এবং পুরো বোতলের পানিই ধীরে ধীরে গরম হয়ে যাবে। আর স্বচ্ছ বোতল ব্যবহার করলে সূর্যের আল্ট্রাভায়োলেট রশ্মিও ভিতরে ঢুকে জীবাণু ধ্বংস করে দিতে সাহায্য করবে।
চূলো জ্বালাবার অবস্থা না থাকলে সূর্যের কিরণে পানি গরম করে জীবাণু ধ্বংস করা যাবে:-
(http://www.banglanews24.com/images/PhotoGallery/2013May/inter20130706041636.jpg)
চার ইঞ্চি পুরু খড়ের বিছানা তৈরি করে তার উপর কালো রং করা ডালা রাখতে হবে। খড় নিচের দিকে তাপ বেরিয়ে যেতে বাধা দেবে। একটি পরিস্কার স্বচ্ছ পলিথিন শিট ডালার উপর বিছিয়ে দিতে হবে। তার উপর ছেঁকে নেওয়া পানি ঢালতে হবে। পানির গভীরতা ২ সেন্টিমিটার বা আঙ্গুলের ১ কড়ের কম হতে হবে।আর একটি স্বচ্ছ পলিথিন শীট পানির উপর বিছিয়ে দিতে হবে। বাতাসের বুদবুদ থাকলে সরিয়ে দেওয়া ভালো। কয়েকটি খড়ের নাড়া ছড়িয়ে দিয়ে তৃতীয় একটি স্বচ্ছ পলিথিন শীট বিছিয়ে দিয়ে মাঝে একটি বাতাসের স্তর তৈরি করতে হবে। যা উপরের দিকে তাপ বেরোতে দেবে না, কিন্তু সূর্যের আলো ঢুকতে দেবে। কয়েকটি খড়ের নাড়া ছড়িয়ে দিয়ে চতুর্থ একটি স্বচ্ছ পলিথিন শীট সবার উপর বিছিয়ে দিয়ে আর একটি তাপরোধক স্তর তৈরি করতে হবে।চারিদিকে ওজন চাপা দিয়ে শীটগুলো টানটান করে রাখতে হবে। পরিস্কার রোদে দু’ঘণ্টায় পানি জীবাণুমুক্ত হবে। উপরের তিনটি পলিথিন শীট সরিয়ে নিতে হবে। নিচেরটি গুটিয়ে নিয়ে জীবাণুমুক্ত পানি পরিস্কার পাত্রে ঢেলে পান করা যাবে।
নিচে তাপরোধক বিছানার বিকল্প:-
খড়ের অভাবে অন্য একটি ডালাকে উল্টিয়ে তার উপর একটি পলিথিন শীট বিছিয়ে আবদ্ধ বাতাসের স্তর তৈরি করে নিতে হবে।প্যাকিংয়ের কর্ক-শীট, পাটকাঠি, শুকনো পাতা বিকল্প হতে পারে। ছোট ছোট পলিথিন ব্যাগে বাতাস ভরে নিয়ে সবগুলোর মুখ আটকে একটি বড় ব্যাগে একসঙ্গে করে বিকল্প বিছানা হতে পারে। যে ব্যবস্থায় পানি গরম করা হচ্ছে তার মূল ভিত্তি হলো- ‘গ্রীন হাউজ এফেক্ট’। উদ্ভাবিত ব্যবস্থাটি মূলত: একটি সোলার ফ্ল্যাট প্লেট কালেক্টর। তবে কম খরচে এবং দেশে সহজলভ্য জিনিসপত্র দিয়ে তৈরি করে পানিকে উচ্চ তাপমাত্রায় উঠানোটিই ছিল এ গবেষণার বড় চ্যালেঞ্জ। এ পদ্ধতিগুলো সম্পন্ন করতে প্রয়োজন ১৫০-২০০ টাকা।
পান করার জন্য নিরাপদ পানি সুস্থ জীবনের জন্য কত জরুরী সে কথা বলার অপেক্ষা রাখে না। একসময় নদী-কুয়া-পুকুরের পানি পান করা হতো। এতে রোগ জীবাণু থাকায় রোগ ছড়িয়ে পড়ে। কিন্তু এ জায়গাগুলোর পানি ফুটিয়ে খেলেই হয়। কিন্তু এ ব্যবস্থার তেমন প্রচারণাও দেখা যায়। অন্যদিকে আমরা ব্যাপকভাবে টিউবয়েলের পানি খাওয়ার প্রচারণা করতে দেখেছি। কিন্তু এখন সে পানিতেও আর্সেনিক পাওয়া যাচ্ছে। কোটি কোটি টাকা দিয়ে টিউবওয়েল স্থাপন করা হয়েছিল। এখন সেসব অকেজো। আবার বিভিন্ন পদ্ধতি উদ্ভাবনে কোটি কোটি টাকা বরাদ্দ দেওয়া হচ্ছে। সবাই জটিল সমাধানের পেছনে অর্থ খরচ করেন। অথচ সহজ সমাধানের পেছনে কেউই তেমন আগ্রহ দেখান না। ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের বায়োমেডিকেল ফিজিক্স অ্যান্ড টেকনোলজি বিভাগের শিক্ষার্থীরা ও শিক্ষকরা মিলে সাধারাণ মানুষের নিজের ক্ষমতার মধ্যে সমাধান দিতে পারে এমন দীর্ঘস্থায়ী পদ্ধতি আবিষ্কারের চেষ্টা করে যাচ্ছেন। তাদের আবিষ্কার শুধু বাংলাদেশ নয়, ছড়িয়ে পড়বে সারা বিশ্বে। এমনই স্বপ্ন বুকে নিয়ে অবিরাম কাজ করে যাচ্ছে এ বিভাগের প্রতিটি মানুষ। এ সংক্রান্ত বিস্তারিত তথ্য জানতে হলে কিংবা এ পদ্ধতিতে নিজের এলাকায় পানি বিশুদ্ধ করার কৌশল স্থাপন করতে চাইলে যোগাযোগ করতে পারেন bmpt@unidhaka.edu ঠিকানায়।