আবাসন শিল্প স্থবির, বেকার হতে পারে ১৫ লাখ শ্রমিক (http://dailykalerkantho.com/?view=details&archiev=yes&arch_date=18-08-2010&type=gold&data=Software&pub_no=258&cat_id=1&menu_id=13&news_type_id=1&index=0)
আবাসন শিল্পে চলমান স্থবিরতা কাটাতে কার্যকর উদ্যোগ নেওয়া না হলে অল্প সময়ের মধ্যে অন্তত ১৫ লাখ শ্রমিক বেকার হয়ে যাবে। পাশাপাশি আবাসন ব্যবসার সঙ্গে সম্পৃক্ত ২৬৯টি উপখাতে জড়িত সারা দেশের অন্তত তিন কোটি মানুষ ক্ষতিগ্রস্ত হবে। দেশের অর্থনীতিতেও এর নেতিবাচক প্রভাব পড়বে। আবাসন শিল্পের সঙ্গে সংশ্লিষ্ট ব্যক্তিরা এসব আশঙ্কা ব্যক্ত করে বলেছেন, এ শিল্পে চলমান এই অস্থিরতার জন্য ত্রুটিপূর্ণ বিধিমালা, রাজউকের নকশা অনুমোদনে জটিলতা ও গেজেট আকারে প্রকাশিত ডিটেইল্ড এরিয়া প্ল্যান (ড্যাপ)-এর অবাস্তব নকশা প্রণয়নই দায়ী।
আবাসন শিল্প ব্যবসায়ী, এ শিল্পের উপখাতের সঙ্গে জড়িত ব্যবসায়ী ও শ্রমিক সংগঠনের প্রতিনিধি, ড্যাপের আওতাধীন এলাকার সংসদ সদস্যসহ সংশ্লিষ্ট ব্যক্তিদের সঙ্গে কথা বলে এসব আশঙ্কা ও অভিযোগের বিষয় জানা গেছে। কালের কণ্ঠের সঙ্গে আলাপচারিতার সময় তাঁরা দেশের অন্যতম বড় এ শিল্পকে বাঁচাতে কার্যকর উদ্যোগ নেওয়ার জন্য সরকারের প্রতি আহ্বান জানিয়েছেন।
সংশ্লিষ্ট ব্যক্তিদের মতে, প্রথমত 'বেসরকারি আবাসিক উন্নয়ন বিধিমালা ২০০৪'-এর কারণে আবাসন শিল্প খাতে বিপর্যয়ের সূচনা হয়। কারণ ওই বিধিমালার কারণে বছরের পর বছর প্রকল্পগুলো অনুমোদনের মুখ দেখেনি। বর্তমান মহাজোট সরকার ক্ষমতায় এসে এ বিধিমালাটি সংশোধন করার উদ্যোগ নেয়। তবে এখন পর্যন্ত এটি সংসদে উত্থাপিত হয়নি। এটি গৃহায়ণ ও গণপূর্ত মন্ত্রণালয় সম্পর্কিত সংসদীয় স্থায়ী কমিটির পর্যালোচনায় রয়েছে। তাঁদের মতে, বেসরকারি আবাসিক উন্নয়ন বিধিমালা ২০০৪ ও ড্যাপ_কোনোটিই বাস্তবমুখী হয়নি। অর্থাৎ জনকল্যাণের জন্য এগুলো করা হয়নি বলেই প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা দুটি বিষয়ই পর্যালোচনার জন্য কমিটি গঠন করে দিয়েছেন।
ত্রুটিপূর্ণ বিধিমালা : পূর্ত মন্ত্রণালয় সূত্রে জানা গেছে, গত বিএনপি সরকারের সময় ২০০৪ সালে বেসরকারি আবাসিক উন্নয়ন বিধিমালা প্রণয়ন করা হয়। এর পর থেকে ঢাকা ও ঢাকার বাইরে একটি আবাসন প্রকল্পও অনুমোদন দেয়নি রাজউক। এর আগে যে প্রকল্পগুলোর কাজ চলছিল, রাজউক সেগুলোর অনুমোদনও বন্ধ করে দেয়। এতে এমন কিছু বিধি-বিধান সংযোজন করা হয়েছে, যাতে কোনো প্রকল্প অনুমোদন দেওয়া সম্ভব হচ্ছে না। বিধিমালায় বলা হয়েছে, আবাসন প্রকল্পের জন্য শতভাগ জমি না কেনা পর্যন্ত ওই প্রকল্পের জন্য বিজ্ঞাপন প্রচার করা যাবে না।
আবাসন ব্যবসায়ীদের ভাষ্য, এটা বেসরকারি খাতে কোনোভাবেই সম্ভব নয়। কারণ সরকার বা রাজউক শতভাগ জমি অধিগ্রহণ করে প্রকল্প শুরু করে, বেসরকারি ব্যবসায়ীদের পক্ষে যা একেবারেই অসম্ভব। শতভাগ জমি একসঙ্গে কেনা ব্যবসায়ীদের পক্ষে সম্ভব নয়। কারণ একসঙ্গে জমি পাওয়া যায় না। ফলে অল্প অল্প করে জমি কেনাবেচা করে প্রকল্প এগিয়ে নিতে হয়।
বিধিমালা জারির আগে এভাবেই প্রকল্প চলছিল। কিন্তু বিধিমালা জারির পর ওই সব প্রকল্পের অনুমোদন বন্ধ হয়ে যায়। ফলে এ খাতে বিশাল অঙ্কের টাকা আটকে গেছে।
আবাসন ব্যবসায়ীরা বলছেন, যে পরিমাণ জমি কেনা হয়েছে, তার ওপর গৃহীত প্রকল্প অনুমোদন দিলে সমস্যা কিছু লাঘব হতে পারে। ২০০৪ সালের আগে থেকে যেসব আবাসন ব্যবসায়ী কাজ করছেন, তাঁদের জন্য কিছুটা ছাড় দিয়ে বিধিমালা কার্যকর করার সুযোগ দেওয়ার সুপারিশ করেছেন তাঁরা।
বিধিমালার অন্য একটি ত্রুটি হলো, আবাসন প্রকল্পে ওয়াটার ট্রিটমেন্ট প্লান্ট স্থাপনের বিষয় অন্তর্ভুক্ত করা। সংশ্লিষ্ট ব্যবসায়ীরা মনে করেন, প্রতিটি প্রকল্পে এ ধরনের প্লান্ট বসানো হলে কোনো দিক থেকেই তা আর্থিকভাবে উপযোগী হবে না। দেখা গেছে, এ ধরনের প্রকল্প করতে গিয়ে সরকারই হিমশিম খাচ্ছে। এ বিষয়ে সংশ্লিষ্ট ব্যক্তিদের সুপারিশ, আবাসন প্রকল্পের উদ্যোক্তা জমি দেবে আর ওয়াটার ট্রিটমেন্ট প্লান্ট করবে সরকার বা অন্য কেউ। বিধিমালায় এই সুবিধা সংযোজন করা হলে এ ক্ষেত্রের সমস্যাও মিটে যেতে পারে বলে অনেক ব্যবসায়ী মনে করেন।
বিধিমালার সিডিউল-৩-এ বলা হয়েছে, প্রকল্পের ৩০ শতাংশ জায়গা ফাঁকা রাখতে হবে। এ ফাঁকা জায়গায় রাস্তাঘাট, খেলার মাঠসহ প্রয়োজনীয় অন্যান্য বিষয় স্থাপন করা হবে। বাকি ৭০ শতাংশ জমি বিক্রি করা যাবে। সংশ্লিষ্ট ব্যক্তিরা বলছেন, বিধিমালা অনুসারে ফাঁকা জায়গায় এসব করতে হলে প্রকল্পের ৪০ থেকে ৪৫ শতাংশ কিংবা কোথাও আরো বেশি জমি ছেড়ে দিতে হবে। ব্যবসায়ীরা বলছেন, বর্তমান সরকার এ বাস্তবতা বুঝেই বিধিমালা সংশোধনের উদ্যোগ নিয়েছে।
বেসরকারি আবাসিক উন্নয়ন বিধিমালা ২০০৪ গৃহায়ণ ও গণপূর্ত মন্ত্রণালয়-সংক্রান্ত সংসদীয় স্থায়ী কমিটির কাছে পর্যালোচনা করতে পাঠানো হয়েছে। সংসদীয় কমিটি ও মন্ত্রণালয়ের মধ্যে দূরত্বের কারণে বিধিমালাটি এখন পর্যন্ত চূড়ান্ত হয়নি। ফলে বর্তমান সরকারের কাঁধেও পুরনো বিধিমালার দায় বর্তাচ্ছে। দেখা যাচ্ছে, সরকার এটি পরিবর্তন না করে উল্টো জোট সরকারের বিধিমালার ফাঁদেই পা দিয়েছে। ফলে আবাসন খাতের উন্নয়ন স্থবির হয়ে আছে।
ড্যাপের অবাস্তব নকশা : এ খাতের স্থবিরতার সঙ্গে নতুন মাত্রা যোগ করেছে ড্যাপ। অপরিকল্পিতভাবে তড়িঘড়ি করে ড্যাপের গেজেট প্রকাশ করায় আবাসন খাতের ক্রেতা ও ব্যবসায়ীদের মধ্যে নতুন করে আতঙ্কের সৃষ্টি হয়েছে। আবাসন ব্যবসায়ী ও সংশ্লিষ্ট ব্যক্তিদের সঙ্গে কথা বলে জানা গেছে, ড্যাপ কিভাবে বাস্তবায়ন করা হবে, সে বিষয়ে জনগণ ও আবাসন ব্যবসায়ীরা কিছুই অনুমান করতে পারছেন না। ড্যাপে ঢাকা ও আশপাশের বিশাল এলাকাকে বন্যাপ্রবণ এলাকা হিসেবে দেখানো হয়েছে। ড্যাপ নিয়ে একাধিক নকশা প্রকাশ করেছে রাজউক। নকশায় অন্তর্ভুক্ত জমিতে বহুতল ভবন বা আবাসিক এলাকা করার বিপক্ষে মত দেওয়া হয়েছে। অথচ এ ধরনের অনেক এলাকায় সাধারণ মানুষ সারা জীবনের সঞ্চয় দিয়ে এক টুকরো জমি কিনেছে। সরকার কোনো দিক বিবেচনা না করে হঠাৎ ওই সব এলাকাকে ড্যাপের আওতাভুক্ত করে গেজেট প্রকাশ করেছে। এসব কারণে আগ্রহী সাধারণ মানুষ জমি কেনার বিষয়ে এগিয়ে আসতে ভয় পাচ্ছে। একইভাবে ব্যবসায়ীরা এ খাতে নতুন করে বিনিয়োগ করতে পারছেন না।
সংশ্লিষ্ট ব্যক্তিরা বলছেন, ব্যবসায়ীরা স্থানীয় জনগণের কাছ থেকে জমি কিনে প্রকল্প করে রাস্তা, খেলার মাঠ, মসজিদ বানিয়ে খোলা জায়গা রেখে যে বাকি জমি আবাসিক এলাকা হিসেবে উন্নয়ন করেছেন, রাজউক সেই জমিকে ড্যাপের আওতাভুক্ত করে নিয়েছে। ফলে শহরমুখী মানুষ ওই এলাকার জমি আর কিনতে চাইছে না। এতে ব্যবসায়ীদের কোটি কোটি টাকা আটকে গেছে। বিনিয়োগকৃত অর্থ তুলে আনার বিষয়েও সৃষ্টি হয়েছে অনিশ্চয়তা। যাঁরা প্লট কিনেছেন, তাঁদের ক্ষুদ্র বিনিয়োগ নিয়েও আশঙ্কা তৈরি হয়েছে। বিশেষ করে প্রবাসীদের পাঠানো বৈদেশিক মুদ্রার ১৩ শতাংশ এ খাতে বিনিয়োগ করা হয়েছে। ফলে তাঁদের মধ্যেও আতঙ্ক কাজ করছে।
যদিও এসব বিবেচনা করে সরকার পরিস্থিতি সামাল দেওয়ার জন্য ড্যাপ পর্যালোচনার লক্ষ্যে মন্ত্রিসভা কমিটি গঠন করে দিয়েছে, কিন্তু গত দুই মাসে এ কমিটি মাত্র একটি বৈঠক করেছে। বৈঠক শেষে কমিটির সদস্য গৃহায়ণ ও গণপূর্ত প্রতিমন্ত্রী আব্দুল মান্নান খান সাংবাদিকদের বলেছেন, সংশ্লিষ্ট সবাইকে নিয়েই ড্যাপ বাস্তবায়ন করা হবে।
রিয়েল এস্টেট অ্যান্ড হাউজিং অ্যাসোসিয়েশন অব বাংলাদেশ (রিহ্যাব) সভাপতি নসরুল হামিদ বিপু এমপি কালের কণ্ঠকে এ প্রসঙ্গে বলেন, ইতিমধ্যে এ খাতে স্থবিরতা শুরু হয়ে গেছে। এখনই তো অবস্থা খুব খারাপ। এ রকম চলতে থাকলে কেবল শ্রমিকরাই নয়, স্থপতি ও প্রকৌশলীসহ অনেকেই বেকার হয়ে পড়বেন। কারণ ৫৬টি আবাসন ব্যবসাপ্রতিষ্ঠানের কাজ এখন বন্ধ। ভবিষ্যতে যাদের কাজ করার কথা ছিল, তারাও কাজ বন্ধ করে বসে আছে। এসব কারণে ফ্ল্যাট ব্যবসায়ও স্থবিরতা দেখা দিয়েছে। এখন প্রতি বর্গফুটের রেজিস্ট্রেশন ফি আগের চেয়ে বাড়িয়ে দেওয়া হয়েছে। ফলে কেউ আর ফ্ল্যাট কিনতে চাইছেন না। অনেকে বুকিং দিলেও সেটা রেজিস্ট্রি করছেন না। সরকার বলেছিল, সুশীল সমাজ, জনপ্রতিনিধি ও আবাসন ব্যবসায়ীদের সঙ্গে নিয়ে তারা এসব সমস্যার সমাধানে পেঁৗছাবে। কিন্তু সরকার সেটা না করে সমস্যাটা ঝুলিয়ে রেখেছে। তিনি বলেন, এ সমস্যার দ্রুত সমাধান হওয়া জরুরি। অন্যথায় ১০-১৫ লাখ লোক বেকার হওয়া অস্বাভাবিক কোনো ব্যাপার নয়।
বাংলাদেশ ল্যান্ড ডেভেলপারস অ্যাসোসিয়েশনের (বিএলডিএ) মহাসচিব মোস্তফা কামাল মহীউদ্দীন কালের কণ্ঠকে বলেন, দেশের ভূমি উন্নয়ন ও আবাসন খাতে বিএলডিএ ও রিহ্যাবের বড় ভূমিকা রয়েছে। তিনি বলেন, '২০০৮ সালে গণশুনানির মাধ্যমে পাওয়া তথ্য-উপাত্তের ভিত্তিতে যে ড্যাপ প্রণয়ন করা হয়েছিল, সেটিও যদি বাস্তবায়ন করা হয়, তাতে আমাদের কোনো আপত্তি নেই। বর্তমানে যে ড্যাপ রয়েছে তা বাস্তবায়ন করা হলে দেশের সামগ্রিক অর্থনীতির ওপর ভয়াবহ নেতিবাচক প্রভাব পড়বে। ক্ষতিগ্রস্ত হবে কয়েক লাখ সাধারণ ক্রেতা। কারণ ভূমি উন্নয়ন ও আবাসন খাতে এরই মধ্যে প্রায় ৭০ হাজার কোটি টাকা বিনিয়োগ করা হয়েছে। পাশাপাশি এ খাতের ওপর নির্ভরশীল আরো ২৬৯টি উপশিল্প খাত রয়েছে। প্রবাসীদের পাঠানো বৈদেশিক মুদ্রার ১৩ শতাংশও এ খাতে বিনিয়োগ হয়ে থাকে।'
আবাসন ব্যবসায়ীরা বলেছেন, ভূমি উন্নয়ন ও আবাসন খাত জিডিপিতে গুরুত্বপূর্ণ অবদান রাখছে। জিডিপির ১৮ দশমিক ৫ শতাংশ আসে এ খাত থেকে। ইতিমধ্যে ল্যান্ড ডেভেলপাররা যে ৭০ হাজার কোটি টাকা বিনিয়োগ করেছেন, তা চলতি অর্থবছরের (২০১০-১১) বাজেটের অর্ধেকেরও বেশি