Daffodil International University

Bangladesh => Heritage/Culture => Topic started by: mustafiz on November 10, 2014, 04:25:13 PM

Title: আমাদের বুড়িগঙ্গা নদী এবং...
Post by: mustafiz on November 10, 2014, 04:25:13 PM
একসময় এই ঢাকা নগরের প্রাণ ছিল বুড়িগঙ্গা। বুড়িগঙ্গা নিয়ে অনেক স্মৃতি। সেইসব স্মৃতি আমাকে প্রবলভাবে তাড়িত করে! জন্মসূত্রে আমি পুরান ঢাকার বাসিন্দা। নিজেকে বলি আদি ঢাকাইয়া। একটু বোঝার পর থেকেই বুড়িগঙ্গায় যাতায়াত। আমার নানিবাড়ি মুন্সিগঞ্জের কাঠপট্টি। সেসময় হেনা এক্সপ্রেস লঞ্চে চড়ে কিংবা রকেট স্টিমারে চেপে প্রায়ই নানিবাড়ি যেতাম। তখনকার বুড়িগঙ্গা আর তার জল জুড়িয়ে দিতো প্রাণ। লঞ্চের পেছনে বসতাম। গাঙচিলেরা আমাদের লঞ্চের পেছন পেছন ছুটতো। মাঝে মাঝে একটা দুটো বা একসঙ্গে অনেকগুলো শুশুক মাথা উঁচিয়ে সঙ্গে সঙ্গে টুপ করে ডুব মারতো। পালতোলা বড় বড় নৌকা সেসময় চোখে পড়ত অহরহ। আর বুড়িগঙ্গায় চলতে চলতে এসব আমাকে আচ্ছন্ন করত। আজকের দিনে বুড়িগঙ্গায় এসব একবারেই দুর্লভ।


আমার ছেলেবেলার বুড়িগঙ্গা নিয়ে সবচেয়ে মধুর স্মৃতি হচ্ছে, সময়-অসময় বা যখন-তখন চলে যেতাম বুড়িগঙ্গার জলে গোসল করতে। দিনভর দাপিয়ে তবেই বাড়ি ফিরতাম। তখন এপার-ওপার মিলে  বুড়িগঙ্গা ছিল বিশাল। বাজি ধরে বন্ধুরা এপার-ওপার হতাম। সামাদ লঞ্চ থেকে লাফিয়ে পড়তাম বুড়িগঙ্গার জলে। কুরবানির ঈদে আরেক মজা। এলাকার সবাই ঈদের দিন ভোরবেলা প্রত্যেকে প্রত্যেকের গরু নিয়ে চলে যেতাম বুড়িগঙ্গায়। গোসল করাতাম, নিজেও গোসল সেরে তবেই বাড়ি ফিরতাম। সে এক অদ্ভুত সময় ছিল। সেই বুড়িগঙ্গার এখন করুণ অবস্থা। দুষণযুক্ত কালো ময়লা বা দুর্গন্ধময় পানির জন্য বুড়িগঙ্গার কত বদনাম, অবহেলা। কালের নিয়মে পরিবর্তন সব কিছুরই হবে। কিন্তু এত নোংরাভাবে হবে তা কখনো ভাবতেও পারিনি।
কতদিন লঞ্চে নানিবাড়ি যাই না, বুড়িগঙ্গার জলে গোসল হয় না। তবে বুড়িগঙ্গায় যাই অন্যভাবে। ক্যামেরা নিয়ে বছিলা থেকে পোস্তগোলা ঘুরে বেড়াই।

(http://s26.postimg.org/lkatgrjux/buriganga_river_in_dhaka_bangladesh_3.jpg)

                                                                          বুড়িগঙ্গার বুকে জেলেদের নৌকা

বর্ষার রূপ যেমন আলাদা, তেমনি বর্ষায় বুড়িগঙ্গার নিজস্ব একটা রূপ থেকেই যায়। আর সে রূপে চোখ জুড়াতে বর্ষার শুরু থেকেই প্রায় প্রতি শুক্রবার বুড়িগঙ্গায় যাওয়াটা নিয়ম হয়ে গিয়েছিল। তারই ধারাবাহিকতায় শেষ শরতের বৃষ্টিভেজা একদিন শিকদার মেডিক্যাল কলেজ ও হাসপাতাল সংলগ্ন ঘাট থেকে ফেরার পথে রাজারঘাট, সেয়ারিঘাট হয়ে চলে গেলাম শ্যামবাজার ঘাট। সেখান আগে থেকেই ছিল নাসির সরদার। একজন মাঝি, দীর্ঘদিন বুড়িগঙ্গায় নৌকা বেয়ে জীবন-যাপন করছেন। শ্যামবাজার ঘাটে গেলেই আমি এই নাসির সরদারের খোঁজ করি। তারপর তাঁর নৌকায় বুড়িগঙ্গায় ঘুরে বেড়াই। আজও তাঁকে পেয়ে চড়ে বসলাম তাঁর নৌকায়। নৌকা তরতর করে এগিয়ে চলল।

সেদিন ঝিরিঝিরি বৃষ্টির সকাল। মেঘলা আবহাওয়ায় বুড়িগঙ্গা আমায় সেই ফেলে আসা দিনে ফিরিয়ে নিয়ে গেল। বর্ষায় দুপারের দূরত্ব বেড়েছে। বুড়িগঙ্গার পানি এখন স্বচ্ছ, দুর্গন্ধমুক্ত। অনেকদিনের চেনা আগের সেই সুন্দর প্রবাহিত নদী বুড়িগঙ্গাকে আবার আপন মনে হলো। যাত্রী নিয়ে এপার ওপার হচ্ছে লালরঙা পাল তোলা অনেকগুলো নৌকা। একদল জেলে দেখলাম জাল ফেলে মাছ ধরছে। জানতে চাইলাম, ভাই মাছ পাওয়া যায়?

জেলেরা জানালেন, ‘পামু না ক্যান! পুটি, খইলসা, আর নলা, মইদ্যে মইদ্যে রুই মাছ ও পায়া যাই। অহন বুড়িগঙ্গায় নাও বেশি। নাইলে মাছ ঠিকই পাইতাম!’
ঠিকই বলেছেন জেলে, বুড়িগঙ্গায় নৌকা এখন অনেক বেশি। এত নৌকা যে নৌকায় না আবার জট লেগে পত্রিকার খবর হয়ে যায়- নৌকাজট! ভাবতে ভাবতে ক্যামেরা বের করে ছবি তোলায় মনোযোগী হই। ইতোমধ্যে আমাদের নৌকা বুড়িগঙ্গা প্রথম সেতুর কাছে চলে এসেছে। নৌকা ঘুরিয়ে এবার নদীর ওপার দিয়ে চলি। এখানে পুরো এলাকা জুড়ে ডকইয়ার্ড। আর বরিশাল, বরগুনা, ঝালকাঠিসহ দেশের বিভিন্ন অঞ্চলে চলাচল করা সব লঞ্চ দাঁড়িয়ে আছে। এরা সময় হলে ঘাটে চলে যাবে। তারপর যাত্রী নিয়ে গন্তব্যে। আমি এমভি টিপু নামের একটি লঞ্চ আসতে দেখে নাসির সরদারকে প্রশ্ন করি- লঞ্চে যাত্রী কত হবে? মাঝির তড়িৎ জবাব সাত’শর মতো। তারপর নিজে নিজেই বলে যায়, মাঝি, এই লঞ্চেই ঈদের সময় চাইর-পাঁচ হাজার মানুষ উঠছিল। সে যে কতটা ভয়ঙ্কর তা আমরা প্রতি বছর ঈদের সময় প্রত্যক্ষ করে থাক

এর মধ্যে আমাদের নৌকা বাবুবাজার ঘাটের কাছে চলে এসেছে। এখানে নৌকা-লঞ্চ অনেক বেশি। জট লাগার যে কথা বলেছিলাম। ঠিক জট না হলেও, এখানকার অবস্থা অনেকটা সে রকমই। এখানে তিনটি স্টিমার দাঁড়ানো- রকেট, লেপচা আর এমভি মাসহুদ। এসব প্যাডেল স্টিমার সবকটি প্রতিদিন গন্তব্যে যাতায়াত করে না। প্রায় সময়ই একটা দুইটা নষ্ট থাকে। বাবুবাজার ঘাটে প্যাডেল স্টিমারগুলি দঁড়ানো। এখানে প্রচুর লোক-জন নদী পারাপর হচ্ছে। নদীর দুই পারেই ময়লা-বর্জ পড়ার দৃশ্য মনটাকে বিষণ্ন করে তুলল। বিষণ্ন মন নিয়ে ভাবতে বসি। বুড়িগঙ্গার অবৈধ দখলমুক্ত করা আসলে কতটা সম্ভব। আসলে এখন আর বুড়িগঙ্গাকে সম্পূর্ণ দখলমুক্ত করে নদীকে তার সেই আগের অবস্থায় ফিরিয়ে দেওয়া সম্ভব নয়। সম্ভব; নতুন দখলদারিত্বের হাত থেকে বুড়িগঙ্গাকে রক্ষা করা আর দূষণমুক্ত করা। নদীর বর্তমান অবস্থা রেখেই এর পার ধরে সৌন্দর্য বর্ধন করা যেতে পারে। যেহেতু প্রত্নতত্ত্ব অধিদপ্তরের আওতাধীন আহসান মঞ্জিল আর রূপলাল হাউসের মতো প্রাসাদসম বাড়ি দুটিও বুড়িগঙ্গার এই পরিকল্পনার অংশীদার করা যায়। পরিকল্পনায় করা যায় লেপচা, অস্ট্রিচ, শেলা, টার্ন ও এম.ভি মাসহুদকে নিয়ে। শতবর্ষের ঐতিহ্য নিয়ে এসব স্টিমার আমাদের সেবা দিয়ে চলেছে। এবার কিছুটা বিশ্রাম তাদের প্রাপ্য। ঢাকা-খুলনা তারা অনেক চলেছে। এবার শুধু বড়িগঙ্গায় চলাচল করবে। কোনো কোনো স্টিমার শুধু যাদুঘর হয়ে বুড়িগঙ্গায় বসে থাকবে। লোকজন বেড়াতে আসবে। বিনোদন আর ঘোরাঘুরির জায়গার খুব অভাব আমাদের। বুড়িগঙ্গা আর এসব ঐতিহ্যবাহী স্টিমারগুলো আমাদের বেড়ানো আর বিনোদনের অংশীদার হতে পারে। নীতিনির্ধারকগণ ভেবে দেখুন। বুড়িগঙ্গা আমাদের রাজধানী ঢাকা মহানগরের ঐতিহাসিক নদী। স্টিমারগুলো বুড়িগঙ্গার ইতিহাসের সাক্ষী।


আমরা প্রায় সবাই একটু নদীর ছোঁয়ায় দূরদূরান্তে ছুটে যাই। এই নগরের ধানমণ্ডি লেকে প্রতিদিন প্রচুর লোকের যাতায়াত আছে। সেখানে ছোট্ট প্যাডেল নৌকায় চড়ার জন্য আমাদের কত আকুতি। ২৫০ টাকা ঘণ্টায় আমরা অনেকেই প্রতিদিন ধানমণ্ডি লেকে নৌকাভ্রমণ করে থাকি। এবার বুড়িগঙ্গা দূষণমুক্তির আন্দোলন জোরদার করে একে বাস্তব রূপ দিয়ে এসব স্টিমারকে বুড়িগঙ্গার পরিকল্পনায় নিয়ে এসে প্রতিদিন না হলেও অন্তত ছুটির দিনগুলোতে সদরঘাট থেকে মুন্সিগঞ্জ পর্যন্ত স্টিমার ভ্রমণের ব্যবস্তা করা যেতে পারে। তাতে করে বুড়িগঙ্গা ফিরে পাবে তার অতীত জৌলুস। সঙ্গে আমাদের নদীভ্রমণের সাধ অনেকটাই বাস্তবায়িত হবে। একবার ভাবুন প্রতিটি স্টিমার একটি যাদুঘর। ভ্রমণ-পিপাসুদের নিয়ে সেসব যাদুঘর বুড়িগঙ্গায় দাঁড়িয়ে আছে কিংবা ঘুড়ে বেড়াচ্ছে। ভ্রমণ-পিপাসুরা দু’চোখ ভরে দেখে নিচ্ছে নদীমাতৃক বাংলাদেশের রূপ। বুড়িগঙ্গার দু’পাশে গালিচা বিছানো। নদীতে রঙিন পালতোলা নৌকা। অনেকে সেসব নৌকায় ঘুরতে বেড়িয়েছে। বুড়িগঙ্গা আর বুড়িগঙ্গাপারসহ দেশের মানুষের মধ্যে প্রাণচাঞ্চল্য ফিরে এসেছে।

‘নদীকে তার রূপ ফিরিয়ে দিতেই হবে’ মুখ থেকে বের হয়ে আসে বাক্যটি। তারপর হাতের দিকে চেয়ে দেখি মুষ্টিবদ্ধ হাতে কী এক দৃঢ়তা। সেই দৃঢ়তাকে সঙ্গী করে মাঝি নাসির সরদারের সব হিসাব চুকিয়ে নৌকা থেকে নেমেই সামনে পড়ি যানজটের। এই শহরে আসলে আমাদের স্বস্তির জায়গা কোথায়? ভাবতে ভাবতে গন্তব্যে চলি...

ফারুখ আহমেদ
পরিবেশ ও প্রকৃতি-বিষয়ক লেখক এবং
সমন্বয়কারী, 'কেম্প অন বুড়িগঙ্গা'
Title: Re: আমাদের বুড়িগঙ্গা নদী এবং...
Post by: fahad.faisal on January 29, 2018, 06:26:42 PM
Thanks a lot for the informative post.