ব্যক্তি সচেতনতাই যথেষ্ট নয়
‘একটি মৃত্যু ট্র্যাজেডি, কিন্তু অসংখ্য মৃত্যু পরিসংখ্যান।’
জার্মান কথাসাহিত্যিক এরিখ মারিও রেমার্ক ১৯৫৬ সালে যুদ্ধকালীন অসংখ্য মানুষের মৃত্যুর বাস্তবতা বোঝাতে কথাটি বলেছিলেন তার বিখ্যাত উপন্যাস দ্য ‘ব্ল্যাক ওবেলিস্ক’তে। কিন্তু কোনো যুদ্ধবিগ্রহ ছাড়াই সাম্প্রতিককালে হিমালয়কন্যা নেপাল দেখল কয়েক সেকেন্ডে সব ট্র্যাজেডি ছাপিয়ে কীভাবে মানুষের মৃত্যু নির্মম পরিসংখ্যান হয়ে ওঠে।
গত ২৫ এপ্রিল নেপালে সৃষ্ট ভয়াবহ ভূমিকম্পে মৃতের সংখ্যা ৭ হাজার ছাড়িয়েছে এরই মধ্যে। ২ কোটি ৭০ লাখ মানুষের দেশ নেপালে গত ৮০ বছরের মধ্যে ৭ দশমিক ৯ মাত্রার এ ভূমিকম্পই সবচেয়ে ভয়াবহ। রাজধানী কাঠমান্ডু পরিণত হয়েছে ঘরহারা মানুষের তাঁবুর শহরে। রাজধানীর বাইরের প্রত্যন্ত অঞ্চলের অবস্থা কতটা ভয়াবহ, সে চিত্র এখনো স্পষ্ট নয়। হাসপাতালগুলোয় স্থান সংকুলান না হওয়ায় মেডিকেল কলেজের সামনের খোলা মাঠে তাঁবু খাটিয়ে তাতে চলছে চিকিত্সা কার্যক্রম। সারা পৃথিবী থেকে সাহায্য আসতে শুরু করেছে, উদ্ধারকাজে অংশ নিচ্ছে বিশ্বের বিভিন্ন দেশের সেনাবাহিনী এবং নেপালের জনগণ।
১৯৩৪ সালের পর নেপালে এমন ভূমিকম্প প্রথম হলেও বিশ্ববাসীর জন্য তা নয়। ইউএস জিওলজিক্যাল সার্ভে এবং টাইমস অব ইন্ডিয়ার পর্যবেক্ষণ অনুযায়ী, গত বিংশ এবং একবিংশ শতকে বিশ্বের ভয়াবহতম ভূমিকম্পগুলো হলো (তারিখ, স্থান, রিখটার স্কেলে মাত্রা এবং প্রাণহানী):
৩১ জানুয়ারি ১৯০৬: ইকুয়েডর উপকূলে ৮ দশমিক ৮, তাতে প্রাণহানি অন্তত ৫০০। ১১ নভেম্বর ১৯২২: আর্জেন্টিনা ও চিলি সীমান্তে ৮ দশমিক ৫। ৩ ফেব্রুয়ারি ১৯২৩: রাশিয়ার কামচাটকায় ৮ দশমিক ৫। ১ ফেব্রুয়ারি ১৯৩৮: ইন্দোনেশিয়ার বান্দা সাগরের কাছে ৮ দশমিক ৫। ১৫ আগস্ট ১৯৫০: তিব্বতে ৮ দশমিক ৬, এতে প্রাণহানি অন্তত ৮০০। ৪ নভেম্বর ১৯৫২: রাশিয়ার কামচাটকায় ৯ দশমিক শূন্য, তাতে হাওয়াই দ্বীপে প্রায় ৩০ ফুট উঁচু ঢেউয়ের সুনামি। ৯ মার্চ ১৯৫৭: আলাস্কার দ্বীপে ৮ দশমিক ৬, ফলাফল ৫২ ফুট উঁচু ঢেউসহ সুনামি। ২২ মে ১৯৬০: চিলির দক্ষিণাঞ্চলে ৯ দশমিক ৫, ফলে সৃষ্ট সুনামিতে প্রাণহানি ১ হাজার ৭১৬। ১৩ অক্টোবর ১৯৬৩: রাশিয়ার কুড়িল দ্বীপে ৮ দশমিক ৫। ২৮ মার্চ ১৯৬৪: আলাস্কার প্রিন্স ইউলিয়াম সাউন্ডে ৯ দশমিক ২, তাতে প্রাণহানি কমপক্ষে ২৫০। ৪ ফেব্রুয়ারি ১৯৬৫: আলাস্কার র্যাট দ্বীপে ৮ দশমিক ৭, ফলাফল ৩৫ ফুট উঁচু ঢেউসহ সুনামি। ২৬ ডিসেম্বর ২০০৪: ইন্দোনেশিয়ায় ৯ দশমিক ১, ফলাফল ভারত মহাসাগরে সুনামি, সর্বকালের সর্বোচ্চ প্রাণহানি, ২ লাখ ৩০ হাজার। ২৮ মার্চ ২০০৫: ইন্দোনেশিয়ার দ্বীপ সুমাত্রায় ৮ দশমিক ৬, ফলে প্রাণহানি ১ হাজার ৩০০। ১২ সেপ্টেম্বর ২০০৭: ইন্দোনেশিয়ার সুমাত্রায় ৮ দশমিক ৫। ২৭ ফেব্রুয়ারি ২০১০: চিলিতে ৮ দশমিক ৮, প্রাণহানি ৮২৪। ১১ মার্চ ২০১১: জাপানের উত্তর-পূর্বাঞ্চলীয় উপকূলে ৯ দশমিক শূন্য, এতে সৃষ্ট সুনামিতে প্রাণহানি ১৮ হাজারের অধিক। ১১ এপ্রিল ২০১২: ইন্দোনেশিয়ার সুমাত্রায় ৮ দশমিক ৬ মাত্রার ভূমিকম্প আঘাত হানে।
১৯৩৮ থেকে ২০১৫ সাল পর্যন্ত সর্বনিম্ন ৮ দশমিক ৫-এর অধিক মাত্রা নিয়ে পাঁচটি ভয়াবহ ভূমিকম্প আঘাত হানে ইন্দোনেশিয়ায়, যার তিনটিই ছিল দ্বীপ সুমাত্রায়। ১৯০৬ থেকে বর্তমান পর্যন্ত রিখটার স্কেলে ৮-এর অধিক মাত্রায় চিলিতে তিনটি, রাশিয়ায় তিনটি, আলাস্কায় তিনটি বড় ভূমিকম্প আঘাত হানে।
যেসব এলাকায় বারবার এমন শক্তিশালী ভূমিকম্প হয়েছে, তার সবক’টি অবস্থিত টেকটনিক প্লেট বরাবর। বস্তুত ভূগর্ভস্থ এ গতিশীল টেকটনিক প্লেটের নড়াচড়াই ভূমিকম্পের মূল কারণ। ভূকেন্দ্রের উত্তপ্ত ম্যাগমা এবং প্রাকৃতিকভাবে ম্যানহলে মিথেন গ্যাস সৃষ্টির মতো সৃষ্টি হওয়া ভূগর্ভের তেল, গ্যাসসহ নানা খনিজ পদার্থের চাপে টেকটনিক প্লেটগুলো পরস্পরকে আঘাত করে, যার ফলে ঘর্ষণের সৃষ্টি হয়। তাছাড়া দুটি প্লেটের সংযোগস্থলে ফল্ট লাইন (শূন্য স্থান) থাকে। সংঘর্ষের সময় এ ফল্ট লাইন বরাবর শূন্য অবস্থার সৃষ্টি হয়। কখনো কখনো সংঘর্ষের ফলে দুটি টেকটনিক প্লেটের মিলনস্থলে খাতের সৃষ্টি হয়, যাতে আঘাত আরো তীব্রতর হলে খাত বরাবর সমুদ্রের তলদেশ স্থানান্তরিত হয়। টেকটনিক প্লেটের এ নড়াচড়াকেই আমরা দেখি ভূমিকম্প হিসেবে।
৮১ বছর আগে ভূবিজ্ঞানীরা এ অঞ্চলে ভূমিকম্পের পুনরাবৃত্তির যে আশঙ্কা করেছিলেন, নেপালেরটি নিঃসন্দেহে সেটি; কিন্তু একমাত্র এবং সর্বশেষ নয়। কোনো অঞ্চলে বড় ধরনের ভূমিকম্প হলে সাম্প্রতিককালে আর হবে না, এমনটা বলা যায় না। উপরে উল্লিখিত বিশ শতকের বড় ভূমিকম্পের পরিসংখ্যান থেকে তা অনুমেয়।
বাংলাদেশে ভূমিকম্পের ইতিহাস পর্যালোচনা করলে জানা যায়, ১৭৬২ সালে চট্টগ্রাম-আরাকান সীমান্তে, ১৮৮৫ সালে মানিকগঞ্জে ‘বেঙ্গল আর্থকোয়েক’ নামে, ১৮৯৭ এবং ১৯৫০ সালে সিলেট সীমান্তের কাছে আসামে এবং ১৯৯৭ সালে চট্টগ্রামে শক্তিশালী ভূমিকম্প অনুভূত হয়।
ভূতাত্ত্বিকদের মতে, বাংলাদেশের উত্তর-পূর্ব অর্থাত্ সিলেট সীমান্তের খুব কাছে ইন্দো-বাংলা এবং ইউরোশিয়া-ইন্ডিয়ান প্লেট এবং তার ডাউকি ফল্ট লাইন অবস্থিত। উল্লেখ্য, একই প্লেটে ভারত-নেপালও অবস্থিত। এছাড়া কেবল সিলেট অঞ্চলের ভূমিকম্পের ইতিহাসে যদি চোখ বোলায় তো দেখতে পাব, বিশেষভাবে ১৫৪৮ সালে সিলেটে সংঘটিত ভূমিকম্প এবং তত্পরবর্তী ১৬৪২, ১৬৬৩, ১৮১২, ১৮৬৯ সালের ভূমিকম্প সিলেটকে সম্পূর্ণ বদলে দেয়। তার পর ১৮৯৭ সালের ১২ জুন ‘গ্রেট ইন্ডিয়ান আর্থকোয়াক’ নামে পরিচিত ভয়াবহ ৭ দশমিক ৮ মাত্রার ভূমিকম্প সিলেটের মানচিত্র পুরোপুরি পাল্টে দেয়।
যদিও এ অঞ্চলের ইতিহাস পর্যালোচনা করলে দেখা যায়, প্রায় ১০০ বছর পর পর বড় ধরনের ভূমিকম্প হয়েছে, কিন্তু এখন আর তা বলার সুযোগ নেই। কেননা পৃথিবীর অন্যান্য টেকটনিক প্লেটে স্বল্প সময়ের ব্যবধানে একাধিকবার ভূমিকম্প সংঘটিত হয়েছে, তাতে সেসব প্লেট সংযোগস্থলের তুলনায় আমাদের এ অঞ্চলে ফল্ট রয়েছে বেশি।
মার্কিন কলোরাডো বিশ্ববিদ্যালয়ের ভূমিকম্প বিশেষজ্ঞ দলের গবেষণাও বলছে, নেপালের পর এবার সিকিম, ভুটান, আসাম, নাগাল্যান্ড ও সিলেট হচ্ছে ভূমিকম্পের উত্পত্তিস্থল। এ ফল্ট লাইনের যে কোনো স্থান ভূমিকম্পের কেন্দ্র হলে বাংলাদেশে নেপালের মতো ভূকম্পন অনুভূত হবে। এছাড়া ঢাকা থেকে মাত্র ৯০ কিলোমিটার দূরে অবস্থিত ১৫ কিলোমিটার বিস্তৃত মধুপুর ফল্ট লাইন ঢাকায় ভূমিকম্পের অন্যতম কারণ হবে। আবার সাম্প্রতিক সময়ে ভারতীয় টেকটনিক প্লেটেও ভূমিকম্পের উত্পত্তিস্থল সৃষ্টি হবে। সুতরাং নেপালের পর নিঃসন্দেহে পৃথিবীর সবচেয়ে ভূমিকম্প ঝুঁকিপূর্ণ দেশ বাংলাদেশ।
বিশ্বব্যাংক ও আর্থকোয়েকস অ্যান্ড মেগাসিটিজ ইনিশিয়েটিভের (ইএমআই) যৌথ উদ্যোগে ২০১৪ সালে প্রকাশিত ‘ঢাকা প্রোফাইল অ্যান্ড আর্থকোয়েক রিক্স অ্যাটলাস’ শীর্ষক প্রতিবেদনে ঢাকার ভূমিকম্প ঝুঁকি এবং তাতে সৃষ্ট ক্ষয়ক্ষতির সম্ভাব্যতা উঠে আসে। প্রতিবেদন মতে, মধুপুরে রিখটার স্কেলে ৭ দশমিক ৫ মাত্রার ভূমিকম্প হলে ঢাকার ২৭ শতাংশ ভবন ক্ষতিগ্রস্ত হবে। আশঙ্কা রয়েছে ৫০ হাজার মানুষ নিহত এবং দুই লাখ আহত হওয়ার, যাতে আর্থিক ক্ষতির পরিমাণ দাঁড়াবে প্রায় ৫৭০ কোটি ডলার বা ৪৬ হাজার কোটি টাকা।
এখন প্রশ্ন হলো, আমাদের প্রস্তুতি কতটুকু? আমাদের উদ্ধার, ত্রাণ, চিকিত্সার প্রস্তুতি এতটাই অপ্রতুল যে, রানা প্লাজার মতো মাত্র একটি ভবন ধসে পড়লে উদ্ধার করতে বহুদিন লেগে গেছে। তার পরও পচে যাওয়ার আগে অন্তত সব লাশ উদ্ধার করা সম্ভব হয় না। সে দেশে ভূমিকম্পের মতো বড় বিপর্যয়ে কী প্রস্তুতি থাকতে পারে, তা সহজেই অনুমেয়।
বড় ধরনের বিপদ আসার আগেই সচেতন হতে হবে। যতটা সম্ভব ঝুঁকিপূর্ণ ভবন ভেঙে ফেলতে হবে। পর্যাপ্ত আশ্রয়কেন্দ্র নির্মাণ করতে হবে। ফায়ার সার্ভিসে হেলিকপ্টার যুক্ত করাসহ আধুনিকায়ন করতে হবে। সরকারি হাসপাতালসহ সব চিকিত্সাকেন্দ্রে ভূমিকম্প ঝুঁকিমুক্ত উন্নত কাঠামো নিশ্চিত করতে হবে এবং সবকিছুর সঙ্গে সমন্বয় রেখে জনসচেতনতা বাড়াতে হবে। তবেই ভূমিকম্পের ক্ষয়ক্ষতির পরিমাণ কমানো সম্ভব হবে। মোটকথা, ভূমিকম্পে কেবল ব্যক্তি সচেতনতা নয়, প্রয়োজন যথাযথ রাষ্ট্রীয় প্রস্তুতি।
Source: http://www.bonikbarta.com/2015-05-04/news/details/35629.html