Daffodil International University
Help & Support => Common Forum/Request/Suggestions => Topic started by: Shah Alam Kabir Pramanik on June 04, 2015, 05:55:59 PM
-
বানরের পিঠা ভাগ ও নতুন বেতন স্কেল
০৩ জুন ২০১৫, ১২:২৭
বিপ্লব কুমার হালদার
ড. মোহাম্মদ ফরাসউদ্দিন কমিশনের সুপারিশকৃত নতুন বেতন স্কেল এবং পরবর্তীকালে সচিব কমিটির পর্যালোচনা প্রতিবেদন সম্পর্কে পত্রপত্রিকায় বিস্তর লেখালেখি হয়েছে। প্রস্তাবিত এই বেতন স্কেলে বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষকদের অবমূল্যায়নের পেছনে ঐতিহাসিক কারণ যেমন বিদ্যমান, তেমনি এর পেছনে রয়েছে কিছু মনস্তাত্ত্বিক ও দার্শনিক কারণ। দর্শনের শিক্ষক হিসেবে নতুন বেতন স্কেলে শিক্ষকদের অবমূল্যায়নের পেছনের মনস্তাত্ত্বিক ও দার্শনিক কারণগুলো অনুসন্ধানের তাগিদ অনুভব করছি।
১.
আমার বিশ্ববিদ্যালয়ের একজন বয়োজ্যেষ্ঠ শিক্ষক নতুন বেতন স্কেল প্রসঙ্গে সচিব কমিটির পর্যালোচনা প্রতিবেদনকে বানরের পিঠা ভাগের সঙ্গে তুলনা করেছেন। গল্পটি নিশ্চয়ই আপনাদের মনে আছে। দাঁড়িপাল্লার দুই পাশে পিঠার দুই অংশ সমান করার অজুহাতে একেকবার একেক অংশ থেকে এক কামড় বসাতে লাগল বানর। খেতে খেতে শেষ পর্যন্ত ইঁদুরের ভাগে আর কিছুই অবশিষ্ট থাকে না। বানরের কাছ থেকে ন্যায়পরায়ণতা আশা করাটাও বিরাট অন্যায়। সেই প্রাচীনকাল থেকেই ন্যায়পরায়ণতা সম্পর্কে প্রচুর চিন্তাভাবনা করা হয়েছে। প্লেটোর রিপাবলিকের কথাই ধরুন, পলিমারকাস ন্যায়পরায়ণতার সংজ্ঞা দিয়েছেন ‘বন্ধুর প্রতি বন্ধুত্ব, শত্রুর প্রতি শত্রুতা’ বলে। আবার থ্র্যাসিমেকাস নামের একজন সোফিস্ট ন্যায়পরায়ণতা বলতে বুঝিয়েছেন ‘শক্তিমানের স্বার্থ সংরক্ষণ’। ন্যায়পরায়ণতার এই ধারণা যদি মেনে নিই, তাহলে বলতেই হবে যে সচিব কমিটির প্রতিবেদনটি যথার্থ অর্থেই ন্যায়পরায়ণতার উদাহরণ। কিন্তু মহামতি সক্রেটিস ন্যায়পরায়ণতার উপরোক্ত সংজ্ঞাকে খণ্ডন করে ন্যায়পরায়ণতা বলতে সামাজিক সংগতিকে বুঝিয়েছিলেন। অবশ্য, সম্মানিত আমলাগণ সক্রেটিসের যুক্তিটি কীভাবে খণ্ডন করবেন, তা আমার বোধগম্য নয়।
আধুনিক যুগে জন রল্স-এর ‘এ থিওরি অব জাস্টিস’ গ্রন্থে বিধৃত ন্যায়পরায়ণতার মতবাদটি আমেরিকাসহ বহু ওয়েলফেয়ার স্টেটসের নীতিনির্ধারণের ভিত্তিমূল হিসেবে কাজ করে। এ মতবাদ অনুসারে, ন্যায়পরায়ণতার নীতি প্রণয়নের আগে আপনাকে এমন একটি অবস্থানে যেতে হবে, যেখানে আপনি থাকবেন সম্পূর্ণ নিরপেক্ষ। আপনি একজন বুদ্ধিবৃত্তিসম্পন্ন মানুষ—এ ছাড়া ন্যায়সংশ্লিষ্ট নয় এমন সবকিছুকেই ভুলে যেতে হবে, এমনকি আপনার জাতি, ধর্ম, বর্ণ, শিক্ষা, সামাজিক অবস্থান, পূর্ব অভিজ্ঞতা, সংস্কার—সবকিছু। এই ভুলে যাওয়াকে তিনি বলেছেন, Veil of ignorance। আমি নিশ্চিত, সচিব মহোদয়গণ কোনো অজ্ঞানতার আড়ালে ছিলেন না। হয়তো তাঁরা শিক্ষক-সমাজকে বিচার করেছেন ব্যক্তিগত অভিজ্ঞতার আলোকে, গুটিকয়েক বিপথগামী শিক্ষকের দ্বারা। কিংবা নিতান্তই ক্ষমতা কাঠামোর হায়ারার্কি ঠিক রাখার জন্য।
প্রস্তাবিত বেতন স্কেলে সামরিক বাহিনীর উচ্চপদস্থ কর্মকর্তাদের প্রথম তিনটি ধাপে রাখা হয়েছে, যার পরে চতুর্থ ধাপে বিশ্ববিদ্যালয়ের জ্যেষ্ঠতম একজন শিক্ষকের অবস্থান, যা স্পষ্টতই শিক্ষকদের জন্য অবমাননাকর। এ প্রসঙ্গে একটি চলচ্চিত্রের কথা মনে পড়ছে। ১৯৯৩ সালে বসনিয়া ও হার্জেগোভিনিয়ার যুদ্ধক্ষেত্রের একটি ঘটনা নিয়ে নির্মিত “No Man’s Land” নামের একটি চলচ্চিত্র। নিনো ও চিকি নামের দুই পক্ষের দুই সৈন্য মুমূর্ষু অন্য একজন সৈন্যসহ নো ম্যানস ল্যান্ডে উদ্ধারের অপেক্ষা করতে থাকে। প্রথম দিকে নিনোর ইচ্ছামতোই অন্য দুজন সৈন্য চলছিল। পরবর্তী সময়ে ঘটনাক্রমে একমাত্র রাইফেলটি চিকির হাতে চলে যায় এবং সে নিয়ন্ত্রকের ভূমিকায় অবতীর্ণ হয়। নিনো প্রশ্ন করে, ‘আমরা তোমার কথা শুনব কেন?’ চিকি ভাবলেশহীনভাবে উত্তর দেয়, ‘শুনবে, কারণ বন্দুক এখন আমার হাতে।’ অর্থাৎ, অন্য দুজন সৈন্যের চেয়ে বন্দুকওয়ালা সৈন্য কিছু বেশি সুবিধা ভোগ করে। যেটাকে বলা যায় বন্দুকের ভাগ। নতুন বেতন স্কেলে জ্যেষ্ঠ শিক্ষকদের রাখা হয়েছে চতুর্থ স্তরে। শিক্ষকদের তো বন্দুকের ভাগ নেই! তাহলে ছোটবেলা থেকে যা শিখলাম, তা কি ভুল? বাচ্চাদের কি এখন থেকে ‘অসির চেয়ে মসি বড়’-এর জায়গায় ‘মসির চেয়ে অসি বড়’ শেখাব?
২.
নতুন বেতন স্কেলে বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষকদের অবমূল্যায়নে সরকারের ভূমিকা প্রশ্নবিদ্ধ। এর সঙ্গে সামাজিক মনস্তত্ত্বের বিষয়টিও জরুরি। বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষকদের সম্পর্কে নেতিবাচক ধারণার জন্য সর্বাগ্রে বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষকরা নিজেরাই দায়ী। কিন্তু বাংলাদেশের সূচনালগ্নেও বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষকদের সম্পর্কে একটা অ্যাঞ্জেলিক ধারণা পোষণ করা হতো। চারটি পাবলিক বিশ্ববিদ্যালয়ের জন্য প্রণীত ‘তিয়াত্তরের অধ্যাদেশ’ এর প্রকৃষ্ট উদাহরণ। নৈতিক বাধ্যবাধকতা ছাড়া অন্য কোনো জবাবদিহির ব্যবস্থা রাখা হয়নি এ অধ্যাদেশে, যার অপব্যবহারও করেছেন বিশ্ববিদ্যালয়ের গুটিকয়েক শিক্ষক। এ ছাড়া অযোগ্য শিক্ষক নিয়োগ, প্রাইভেট বিশ্ববিদ্যালয় কিংবা কনসালট্যান্সিতে মনোযোগ, যৌন হয়রানি, এবং কলুষিত শিক্ষক রাজনীতির জন্য বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষকদের ভাবমূর্তি ক্ষুণ্ন হয়েছে বারবার। তাই বলে শিক্ষকতার মতো মহান এই পেশাকে প্রাতিষ্ঠানিকভাবে অবমূল্যায়নের কোনো যুক্তি আমার জানা নেই।
বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষকদের প্রতি নেতিবাচক এই দৃষ্টিভঙ্গি আমাদের সমাজ মনস্তত্ত্বেরই অংশ। ক্ষমতাবানদের তোয়াজ করা আর শক্তিহীনদের শোষণ করার মনস্তত্ত্ব থেকে আমাদের বেরিয়ে আসতে হবে। আমার এক সহকর্মী পাসপোর্টের জন্য ওয়েবসাইটে বর্ণিত ম্যানুয়াল দেখে আবেদন করে এবং যথারীতি তার পাসপোর্টটি তৈরি হয়েছে বলে তাকে জানানো হয়। পাসপোর্ট নিতে গেলে ‘পাবলিক বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষক অফিশিয়াল পাসপোর্ট পেতে পারেন না’ বলে তাকে পুনরায় ফি জমা দিয়ে আবেদন করতে বলা হয়। অর্থাৎ, থানা থেকে শিক্ষকের অফিসে বা বাসায় পুলিশ যাবেন তার বিরুদ্ধে কোনো অভিযোগ আছে কি না, তা খতিয়ে দেখতে, অতঃপর পাসপোর্ট। অথচ, অন্যান্য সরকারি কর্মকর্তার ক্ষেত্রে এসবের কোনো বালাই নেই! তার মানে, শিক্ষকদের ইমেজ অ্যাঞ্জেলিক অবস্থান থেকে একেবারে স্যাটানিক! কয়েক দিন আগে একজন পুলিশ সার্জেন্ট কর্তৃক জাহাঙ্গীরনগর বিশ্ববিদ্যালয়ের একজন শিক্ষককে লাঞ্ছিত করার ঘটনা আমাদের এ অবস্থার কথাই মনে করিয়ে দেয়।
৩.
গ্রামে গিয়ে দেখি, আমাদের বাংলা স্যার, যিনি নজরুলের ‘বিদ্রোহী’ কবিতাটি বেশ আবৃত্তি করতেন, জীবনের সঙ্গে সংগ্রাম করে করে কোনোমতে বেঁচে আছেন। পাশের গ্রামের রেজিস্ট্রার প্রাথমিক বিদ্যালয়ের একজন স্যার ঢাকায় আসার প্রথম অভিজ্ঞতা বলতে গিয়ে কেঁদেই ফেলেছিলেন লাঠিচার্জ আর পিপার স্প্রের কথা মনে করে। আমার কাছে সবকিছু অর্থহীন মনে হতে থাকে। অর্থহীন মনে হয় স্বাধীনতা। অর্থহীন মনে হয় সমস্ত প্রাপ্তি। আমার এক শিক্ষক আক্ষেপ করে বলেছিলেন, পাকিস্তানের শিক্ষকরা যা বেতন পায় তার থেকে এক টাকা হলেও বেশি পাওয়ার অধিকার ও সামর্থ্য আমাদের রয়েছে। ভালো থাকব বলে আমাদের পূর্বপুরুষরা আমাদের জন্য এই সোনার বাংলাদেশটা উপহার দিয়েছিলেন; জাতি গড়ার কারিগরদের কাছ থেকে দীর্ঘশ্বাস পাওয়ার জন্য নয়। আপনারা সচিব কমিটির সবাই বসে শিক্ষকদের জন্য এমন একটি বেতন স্কেলের সুপারিশ করলেন, যার ভিত্তিতে বিশ্ববিদ্যালয়ের জ্যেষ্ঠ অধ্যাপকরাও ওয়ারেন্ট অব প্রিসিডেন্স-এ স্থান পাবেন না। অথচ, আপনাদের নিজেদের জায়গাটা কিন্তু ঠিকই করে নিয়েছেন। এ প্রশ্ন অর্থের নয়, এ প্রশ্ন মর্যাদার। সৈয়দ মুজতবা আলীর ‘পাদটীকা’ গল্পের পণ্ডিত মশাই খুব প্রাসঙ্গিক মনে হয়। পণ্ডিত মশাইয়ের বেতন ও বড় সাহেবের তিন ঠ্যাংওয়ালা কুকুরের এক পায়ের খরচের অঙ্কটাকে খুব বাস্তব মনে হয়। একজন আমলার গাড়ির তেল-ভাতা থেকে শুরু করে বিদেশ ভ্রমণ আর হরেক রকম ভাতার পরিমাণ একজন বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষকের মূল বেতনের চেয়ে নেহাত কম হবে না। সরকারের প্রতি অনুরোধ, বেতন স্কেলটি পুনর্বিবেচনা করুন। এই ন্যায়বিচারের ভার তাঁদের হাতে অর্পণ করুন, যাঁদের দূরদৃষ্টি ‘Cost benefit analysis’-এর গণ্ডি অতিক্রম করে মর্যাদা, মূল্যবোধ এবং সর্বোপরি সামাজিক সংগতি পর্যন্ত বিস্তৃত।
বিপ্লব কুমার হালদার : সহকারী অধ্যাপক, দর্শন বিভাগ, জাহাঙ্গীরনগর বিশ্ববিদ্যালয়
-
Yes it is.