লেস্টারের রূপকথা, রূপকথার লেস্টার
(http://paimages.prothom-alo.com/contents/cache/images/643x0x1/uploads/media/2016/05/04/42ad0725bf019609238738263aa9f047-Untitled-1.0.gif)
এই মুহূর্তের অপেক্ষায় ছিলেন তাঁরা। চেলসি-টটেনহাম ম্যাচে রেফারি শেষ বাঁশি বাজাতেই উল্লাসে ফেটে পড়লেন ভার্ডির বাসায় জড়ো হওয়া লেস্টারের খেলোয়াড়েরা (বাঁয়ে)। সমর্থকদের উল্লাস অবশ্য ছড়িয়ে পড়ল পুরো লেস্টার শহরেই l মেইল অনলাইন
ম্যানচেস্টার ইউনাইটেডের মাঠে ড্রটাকে মনে হচ্ছিল ছোট্ট একটা ধাক্কা। লেস্টার সিটির হয়তো একটু শঙ্কা ছিল, যদি পরের দুই ম্যাচেও হোঁচট খেতে হয়ে? যদি টটেনহাম হটস্পার শেষ দিকে এসে সব ভন্ডুল করে দেয়? শঙ্কাটা ২৪ ঘণ্টার বেশি টিকল না। চেলসির মাঠে পরশু প্রথমার্ধে দুই গোলে এগিয়ে গিয়েও শেষ পর্যন্ত ২-২ গোলের ড্র নিয়ে ফিরল টটেনহাম। ওদিকে উল্লাসে ফেটে পড়ল লেস্টার শহরের পাবে-বারে, বাসায় টিভির সামনে বসে প্রার্থনা করতে থাকা হাজারো সমর্থক। সব অনিশ্চয়তা দূর হয়ে গেছে। মৌসুমজুড়ে এক পাতা-দু পাতা করে লিখতে থাকা রূপকথায় সুন্দর সমাপ্তিও এসে গেছে। ইংলিশ প্রিমিয়ার লিগের নতুন চ্যাম্পিয়ন লেস্টার!
(http://paimages.prothom-alo.com/contents/cache/images/300x0x1/uploads/media/2016/05/04/c94a756e71fef77d07977fddf78b92ed-Claudio-Ranieri-arrives-at-Leicester-s-training-ground-on-Tuesday-after-winning-the-Premier-League-title.gif)
ক্লদিও রানিয়েরি, যাঁর হাত ধরে এসেছে লেস্টারের শিরোপা l এএফপি
শুধু ফুটবল নয়, খেলাধুলার ইতিহাসেই সুন্দরতম রূপকথায় নিশ্চিত ঠাঁই পাবে লেস্টারের এই অবিশ্বাস্য অর্জন। ক্লাবের ১৩২ বছরের ইতিহাসে এই প্রথম ইংলিশ ফুটবলের সর্বোচ্চ পর্যায়ে সবার ওপরে নিজেদের নামটি লিখিয়ে নিল লেস্টার। কিন্তু মৌসুম শুরুর আগে কে ভেবেছিল এমন অবিশ্বাস্য কিছু হবে? লেস্টারের ঘরের ছেলে, সাবেক ইংলিশ স্ট্রাইকার গ্যারি লিনেকারই তো এই অর্জনকে ব্যাখ্যা করতে গিয়ে ভাষাহীন হয়ে পড়লেন, ‘খেলার ইতিহাসেই একে ছাপিয়ে যায় এমন কোনো অর্জন খুঁজে পাচ্ছি না। আমি আবেগে আত্মহারা হয়ে যাচ্ছি। সাত বছর বয়স থেকেই লেস্টারের মৌসুম টিকিটধারী আমি। এটা স্রেফ অবিশ্বাস্য!’
অদৃষ্টবাদী হলে এই অবিশ্বাস্য গল্পটাতে প্রকৃতির খেয়াল টের পাওয়ার কথা। তবে তাতে লেস্টারের প্রতি হয়তো একটু অপমানই হবে। মৌসুমজুড়ে অবিশ্বাস্য খেলে বর্ষসেরা খেলোয়াড় (খেলোয়াড়দের ভোটে) হওয়া রিয়াদ মাহরেজ দলকে টেনে নিয়ে গেছেন, প্রিমিয়ার লিগে রেকর্ড টানা ১১ ম্যাচে গোল করার রেকর্ড গড়া স্ট্রাইকার জেমি ভার্ডি গোলমুখে ছিলেন ভরসার প্রতীক। আর ডাগআউটে ছিলেন একজন জাদুকর—ক্লদিও রানিয়েরি। লেস্টারে এসেছিলেন অবনমন এড়ানোর লক্ষ্য নিয়ে, এসেই দলটাকে এক আশ্চর্য জাদুমন্ত্রে জাগিয়ে তুললেন ইতালিয়ান কোচ। নামও আছে এই মন্ত্রের—‘ডিলি ডিং, ডিলি ডং!’ মৌসুমের শুরুতে অনুশীলন সেশনগুলোতে খেলোয়াড়দের ফোকাস ধরে রাখতে এই অদ্ভুত মন্ত্র বলতেন ৬৪ বছর বয়সী কোচ। হাস্যকর হলেও বিশ্বাস করতেই হচ্ছে, জাদুমন্ত্রের হাত ধরেই যে এল শিরোপা।
শিরোপা নিশ্চিত হওয়ার সময়টা একসঙ্গে মিলে উদ্যাপন করেছেন লেস্টারের খেলোয়াড়েরা, জেমি ভার্ডির বাসায় বসেই সবাই দেখেছেন চেলসি-টটেনহাম ম্যাচটা। চাইলে একে মৌসুমজুড়ে প্রতিটি ম্যাচে একসঙ্গে লড়ে যাওয়ার প্রতীকও ধরে নিতে পারেন। অধিনায়ক ওয়েস মরগানও তা মনে করিয়ে দিলেন, ‘সবাই এই মুহূর্তটির জন্য কঠোর পরিশ্রম করেছে। আমরা এমন কিছু করতে পারব, সেটি কেউই বিশ্বাস করেনি। কিন্তু এই যে আমরা এখানে, প্রিমিয়ার লিগের চ্যাম্পিয়ন এবং সেটা যোগ্য হিসেবেই।’ আর ক্যারিয়ারের শুরু থেকেই লেস্টারে খেলা মিডফিল্ডার অ্যান্ডি কিংয়ের চোখে অবিশ্বাসের ঘোর, ‘ভেবেছিলাম এই ক্লাবের হয়ে যা কিছু দেখা সম্ভব সব দেখে ফেলেছি। কিন্তু এমন কিছু দেখব, এটা কখনো ভাবিনি।’
সব অনিশ্চয়তা কাটিয়ে এমন অর্জনে ভেসে যাওয়ার সময়ে অবশ্য চেলসিকেও একটা ধন্যবাদ দিয়েছেন লেস্টার কোচ রানিয়েরি। পরশু স্টামফোর্ড ব্রিজে ম্যাচ শেষে চেলসি কোচ গাস হিডিঙ্কই রসিকতা করে বললেন, ‘তিনি (রানিয়েরি) আমাকে ফোন করে ধন্যবাদ জানালেন, আমিও তাঁকে অভিনন্দন জানিয়েছি। মুখোমুখি কথা হয়নি বলে তিনি কাঁদছিলেন কি না, সেটা তো বলতে পারছি না। তবে গলা কাঁপছিল তাঁর। বেশি কিছু বলেননি তিনি, শুধু ধন্যবাদ জানিয়েছেন—পাঁচবার!’
ধন্যবাদ পাবে লেস্টারও, ফুটবল অনুরাগীদের কাছ থেকে। এই পেট্রোডলারের ঝনঝনানির যুগেও শুধু চোয়ালবদ্ধ প্রতিজ্ঞা দিয়েই যে শিরোপা জিতে নিল তারা। বুঝিয়ে দিল, অর্থের চোখ রাঙানির সামনে সবুজ মাঠে চাইলে এভাবেও রূপকথা লেখা যায়। সূত্র: রয়টার্স।
একজন জাদুকর
(http://i.telegraph.co.uk/multimedia/archive/03530/ranieri_3530868b.jpg)
ক্লদিও রানিয়েরি
অলক্ষ্যে বসে কেউ একজন নিশ্চয়ই লিখছিল পুরো স্ক্রিপ্ট। ক্লদিও রানিয়েরির জীবনে যা ঘটল, এ যেন সত্যিকারের পৃথিবীতে ঘটে যাওয়া কোনো ঘটনা নয়। যেন চরম ফ্যান্টাসি, মেলো ড্রামায় বিশ্বাসী কোনো খেয়ালি লেখক কল্পনার খ্যাপা ঘোড়াটাকে ইচ্ছেমতো ছুটিয়েছেন। যা ঘটল, সেটা রানিয়েরির নিজেরই বিশ্বাস হচ্ছে তো!
পরশুর ব্যাপারটিই খেয়াল করে দেখুন। চেলসির মাঠে নিশ্চিত হলো রানিয়েরির রূপকথা। সেই চেলসি, ২০০৪ সালে যারা এই রানিয়েরিকে ফেলে দিয়েছিল বাতিলের খাতায়!
সেদিন নীরবে ইংল্যান্ড ছাড়া রানিয়েরি গত বছর আরও নীরবে ফিরে এসেছিলেন ইংল্যান্ডে, লেস্টার সিটির দায়িত্ব নিয়ে। তবে রানিয়েরির জীবনের গল্পটা আরও রোমাঞ্চকর হয়ে উঠবে ১৫ মে। যখন চেলসির মাঠে ঢোকার সময় পুরো স্টেডিয়াম, সব খেলোয়াড় মিলে তাঁকে আর তাঁর দলকে দেবে গার্ড অব অনার। এবারের লিগে চেলসির মাঠেই লেস্টারের শেষ ম্যাচ। ফুটবলের কেতা অনুযায়ী চ্যাম্পিয়নদের গার্ড অব অনার প্রাপ্য। কিন্তু সেদিনের গার্ড অব অনার শুধু নিয়মরক্ষার হবে না, হবে ‘বাতিল’ হয়ে যাওয়া রানিয়েরির ঠিক এক যুগ পর চেলসিতে মাথা উঁচু করে ফেরা!
১৯৮৬ সাল থেকে কোচ হিসেবে কাজ করছেন। ঠিক ৩০টা বছর। চেলসি তো বটেই; ভ্যালেন্সিয়া, রোমা, অ্যাটলেটিকো মাদ্রিদ, জুভেন্টাস, ইন্টার মিলানের মতো দলের দায়িত্ব সামলেছেন। অথচ কী আশ্চর্য জানেন, এর আগে কখনোই কোনো দেশের শীর্ষ লিগ জেতা হয়নি। অবশেষে এই ৬৪ বছর বয়সে এসে ইতালিয়ান কোচ জিতলেন প্রথম শীর্ষ লিগ!
‘আমার বয়স এখন ৬৪ চলছে, কত দিন ধরে লড়াই করে যাচ্ছি। কিন্তু কখনোই আশা হারাইনি। আমি জানতাম, একসময় না একসময়, কোথাও না কোথাও আমি লিগ জিতবই’—গতকাল বলেছেন রোমের নতুন সম্রাট। রানিয়েরি জিতলেন এবং সেটা বিশ্বের সেরা লিগটাই, সেটিও এমন একটা দলকে নিয়ে, আগের মৌসুমে যারা আরেকটু হলে বাদই পড়ে যেত প্রিমিয়ার লিগ থেকে; এই মৌসুমে যাদের ট্রফি জয়ের বাজির দর ছিল ৫০০০-১!
১৫ মে ২০১৬ স্টামফোর্ড ব্রিজের গার্ড অব অনারে শামিল থাকবে আসলে পুরো ফুটবল-বিশ্বই!