Daffodil International University
Career Development Centre (CDC) => Education => Bangladesh Civil Service-BCS => Topic started by: Md. Anwar Hossain on May 29, 2016, 12:28:12 AM
-
নূরজাহান। আর বেগম। এই শব্দ দু’টি ধারণ করে দীর্ঘ দিন বাংলা সাহিত্য ও সংবাদপত্রে বিচরণ করেছেন যে মানুষটি, নারীর চিন্তা-প্রকাশ আর সামাজিক-রাষ্ট্রীয় মর্যাদা প্রতিষ্ঠার দিকে যার নজর ছিল প্রসারিত, তাঁর চলে যাওয়া অন্য সব বিদায়ের মতো নয়। তাঁর অন্তর্ধান মানেই একটি চলমান সমাজের গতিধারায় একটি আলোকিত অধ্যায়ের পরিসমাপ্তি। পারিবারিক ঐতিহ্য, পরিজনদের সান্নিধ্য আর ব্যক্তিগত ভাবনা-বলয় সব মিলিয়ে তিনি যে সময়-পরিসর যাপন করেছেন, তার সঙ্গে তুলনা করা চলে এমন উদাহরণ আমাদের সামনে খুব একটা নেই। বেগম রোকেয়া, কবি সুফিয়া কামাল, সামসুন্নাহারেরা যে সমাজ-রূপান্তরের চেষ্টায় জীবনের স্বর্ণালি সময় পার করেছেন, তারই উত্তরাধিকার ছিলেন নূরজাহান বেগম। পিছিয়ে-পড়া বাঙালি নারী-সমাজকে জ্ঞান-সাধনা আর অংশগ্রহণের শিক্ষা প্রদানের দায়িত্ব গ্রহণ করেছিলেন তিনি। নারীর অধিকার ও মর্যাদার বিষয়াদিকে বিবেচনার অগ্রভাগে নিয়ে আসাই ছিল তাঁর কর্ম-প্রয়াসের মূল লক্ষ্য।
ব্রিটিশ শাসনকালে ভারতবর্ষে শিক্ষায় নারীরা পিছিয়ে ছিল। সরকারি কাজে, সাংবাদিকতায় নারীর অংশগ্রহণ ছিল না বললেই চলে। বেগম রোকেয়া যে সাহিত্যিক আন্দোলন গড়ে তুলেছিলেন, সমকালে তা ছিল অকল্পনীয়। তিনি ভারতের নারীসমাজের চেতনায় প্রবলভাবে নাড়া দিয়েছেন। ঘুম ভাঙিয়েছেন তাদের। পরবর্তীকালে সুফিয়া কামাল কবিতা চর্চায়, সামাজিক সংগঠনে নারীদের পরিবর্তনের জন্য কাজ করেছেন। তাঁদেরই উত্তরাধিকার নূরজাহান বেগম। নারী হিসেবে নিজের অবস্থান পাকাপোক্ত করার পাশাপাশি অন্যান্য নারীকেও জাগিয়ে তুলতে তাঁদের চিন্তা ও কর্ম-পরিকল্পনা সত্যিই অবাক করার মতো। নূরজাহান বিরল বাঙালি রমণীদের প্রতিনিধি।
ভারত-উপমহাদেশে নারী-বিষয়ক প্রথম বাংলা সাপ্তাহিক পত্রিকা বেগম সম্পাদনার জন্য তিনি সাংবাদিক-সাহিত্যিক মহলে সুপরিচিত নাম। বলা চলে, বাংলাদেশে এবং বিশেষত তৎকালীন পূর্ব-পাকিস্তানে নারী সাংবাদিকতার পথিকৃৎ তিনি। যখন নারীরা সাংবাদিকতাকে পেশা হিসেবে গ্রহণ করার মতো সাহস কিংবা সুযোগ পায়নি, তখন পিতা- সওগাত পত্রিকার সম্পাদক মোহাম্মদ নাসিরউদ্দিনের সান্নিধ্যে এবং সুফিয়া কামালের সহযোগিতায় নূরজাহান বেগম সাংবাদিকতাকে পেশা ও নেশা হিসেবে বরণ করেন। পশ্চিমবঙ্গে সাখাওয়াৎ মেমোরিয়াল গার্লস স্কুলে লেখাপড়ার সময় তিনি নিশ্চয় বেগম রোকেয়ার চিন্তা ও দর্শন দ্বারা প্রভাবিত হয়েছেন। নারীর ইস্যু মিডিয়ায় প্রচারের প্রথম সুযোগ সৃষ্টি করেন কিংবদন্তি সাংবাদিক নাসিরউদ্দিন তাঁর সওগাত পত্রিকায়। প্রথম দিকে তাঁর প্রতিষ্ঠিত বেগম পত্রিকার সম্পাদক ছিলেন সুফিয়া কামাল। আর ভারপ্রাপ্ত সম্পাদক হিসেবে কাজ করেছেন শিক্ষানবিস নূরজাহান। চার মাস পর দায়িত্ব নেন নাসিরের সুযোগ্য উত্তরাধিকারী নূরজাহান। বেগম পত্রিকা ১৯৪৭ সালে কলকাতা থেকে প্রকাশ শুরু হলেও দেশ বিভাগের পর ১৯৫০ সালে এটি ঢাকা থেকে প্রকাশিত হতে থাকে। প্রতিষ্ঠাকাল থেকে বেগম বাংলাদেশের নারী সাহিত্যিকদের লেখা প্রকাশ ও চিন্তার বিচরণের ক্ষেত্র হিসেবে দীর্ঘ দিন ধরে ভূমিকা রাখছে। অনেক নারী এখান থেকে লেখার হাতেখড়িও করেছেন। সম্প্রতি দেয়া এক সাক্ষাৎকারে নূরজাহান বেগম বলেছেন : ‘আমি বেগম-এর বাইরে আর কিছুই করার চেষ্টা করিনি। আমার জীবন বেগম-এর জন্য নিবেদিত।’ তাঁর এ কাজে বরাবর অকুণ্ঠ সহযোগিতা করেছেন স্বামী কচিকাঁচার আসরের কেন্দ্রীয় সভাপতি রোকনুজ্জামান খান দাদাভাই। পুরুষশাসিত এই সমাজে পিতা ও স্বামীর মতো দুই বরেণ্য পুরুষের সহযোগিতা পেয়েছিলেন নূরজাহান। এদিক থেকে তাঁর পারিবারিক আবহ সম্পূর্ণ ভিন্ন বলা চলে। এই অনুকূলতা অবশ্যই তাঁর জন্য বাড়তি পাওনা ছিল। বেগমই ছিল তাঁর ধ্যান-জ্ঞান। আর সম্পাদক ও সংগঠক নূরজাহান ছিলেন বাংলাদেশের এক বাতিঘর।
সমকালে নারীর শিক্ষা ও সামাজিক-আর্থিক উন্নয়নে সাংবাদিক নূরজাহান সব সময় ইতিবাচক চিন্তা করেছেন। তাঁর সম্পাদিত বেগম পত্রিকার মাধ্যমে তিনি চিন্তার সাফল্য ও সম্ভাবনার নানা পথও তৈরি করে গেছেন। বাংলাদেশের সামাজিক-অগ্রগতি-পরিকল্পনার সাথে তাঁর নাম জড়িয়ে গেছে স্বাভাবিক কারণেই। চল্লিশের দশকে পারিবারিক বেষ্টনিতে থাকা নারীদের কাছে পত্রিকার মাধ্যমে বিশ্বের খবর পৌঁছে দিয়েছেন তিনি। প্রথম থেকে শেষ পর্যন্ত তিনি সাংবাদিকতা ও সম্পাদনার নীতি ও আদর্শের ক্ষেত্রে সমতা বজায় রেখেছেন। সওগাত পত্রিকার পারিবারিক আবহে তিনি যে আলোয় স্নাত হয়েছেন, সব বাঙালি নারীকে তিনি সেই আলোর পথে আনতে চেষ্টা করে গেছেন। নারী-জাগরণে তাঁর সাংগঠনিক সামর্থ্যও পরবর্তী প্রজন্মের কাছে অনুকরণীয় হয়ে থাকবে।
নূরজাহান বেগম শৈশবে কাজী নজরুল ইসলাম ও আবুল মনসুর আহমদের মতো সাহসী ও সৃজনশীল সাংবাদিকের এবং কাজী মোতাহার হোসেন, প্রিন্সিপাল ইব্রাহিম খাঁর মতো মনীষীদের সান্নিধ্য পেয়েছেন। তাঁদের চিন্তা ও কর্ম-পরিসর থেকে কিছুটা অনুপ্রেরণাও পেয়েছেন নিশ্চয়। সাংবাদিকতার পাশাপাশি সাহিত্য-সাধনা এবং পৃষ্ঠপোষকতাকে তিনি গুরুত্ব দিয়েছেন। সাহিত্য ক্ষেত্রে নারীদের বিচরণের বিষয়ে তাঁর আগ্রহ ছিল অফুরন্ত। ছবি আঁকতেও নারীদের বিশেষভাবে উৎসাহ দিতেন তিনি। ঘরের ভেতরের মেয়েলি আড্ডাও যে সাহিত্য-সংস্কৃতির বিচরণ ও বিকাশকে প্রসারিত করতে পারে, তা তিনি প্রতিষ্ঠা করে গেছেন। নারীর ব্যক্তিগত আবেগকে তিনি প্রশ্রয় দিয়েছেন- প্রসারিত করেছেন নারীর মনোজগতের পরিভ্রমণের ভুবন। সমকালীন সংস্কারাচ্ছন্ন ও পিছিয়ে থাকা নারীসমাজের কাছে তিনি এক আলোকবর্তিকা।
নূরজাহান সমকালে এবং উত্তরকালে সাহসী উদ্যোগ ও প্রেরণার এক উজ্জ্বল উদাহরণ। ক্রমে ক্রমে কাজের মধ্য দিয়ে ব্যক্তি থেকে প্রতিষ্ঠানে পরিণত হয়েছিলেন এই কর্মী নারী। যুগে যুগে, কালে কালে কোনো কোনে সমাজে এমন নারীর আগমন ঘটে। নূরজাহান সত্যিই এক ক্ষণজন্মা মানুষ।
কলকাতার লেডি ব্রেবোর্ন কলেজে আইএ ক্লাসে দর্শন, ইতিহাস ও ভূগোল পড়তে গিয়ে সম্ভবত তাঁর চিন্তাভুবনে পরিবর্তন আসে। শৈশবে নূরী (নূরজাহানের ডাকনাম) সওগাত অফিসের নিয়মিত সাহিত্য মজলিশেও যোগ দিয়েছেন। সেখান থেকেও পেয়েছেন সাহিত্য-শিল্পের প্রেরণা। তাঁর সম্পাদিত বেগম পত্রিকার মূল লক্ষ্য ছিল নারী জাগরণ, নতুন লেখক সৃষ্টি, সাহিত্য ও সৃজনশীলতায় নারীকে উৎসাহী করা। বিগত ষাট বছরে বাংলাদেশে নারীর অবস্থা ও অবস্থানে যে বৈপ্লবিক পরিবর্তন ঘটেছে, তাতে ব্যক্তি নূরজাহান এবং সাপ্তাহিক কাগজ বেগম-এর অবদান অনস্বীকার্য। সাংবাদিক হিসেবে অভিযাত্রার শুরু থেকে আজীবন সংগ্রামী ছিলেন এই নারী সংগঠক। বিশেষ করে বাঙালি মুসলিম নারীর সামাজিক-ধর্মীয় মর্যাদা এবং সামাজিক কাঠামো পুনর্গঠনে তিনি অনন্য নারী।
নূরজাহানের চলে যাওয়া সত্য। তাঁকে ফিরে পাওয়ার বাসনা বা কল্পনা অবাস্তব। তবে তাঁর কাজের মধ্য দিয়ে তাঁকে নিশ্চয়ই আমরা খুঁজে ফিরতে পারি। কী ক্ষতি হয়েছে আমাদের, তিনি এখন মারা না গেলে আর কী কী কাজ করতে পারতেন- এসব চিন্তা না করে যদি তাঁর কর্মজ্ঞান ও কর্ম-পরিসরকে চিহ্নিত করে সেই পথে গতি সঞ্চার করতে পারি, তবেই নূরজাহানের সাধনার সাফল্য ও সম্ভাবনার ক্ষেত্র সৃষ্টি হবে। নূরজাহান বেঁচে থাকবেন তাঁর কাজের মধ্যে। আর আমরা- তাঁর উত্তর-প্রজন্ম নূরজাহানদের স্মরণ করার পাশাপাশি নির্মাণ করার চেষ্টা করব নতুন নতুন পথ ও মত।