Daffodil International University
Entertainment & Discussions => Story, Article & Poetry => Topic started by: Saujanna Jafreen on November 07, 2016, 01:47:41 PM
-
১৯৫২ সালের ২১ ফেব্রুয়ারি সকালে পাকিস্তানি শাসকগোষ্ঠী গুলি করে হত্যা করেছিল মাতৃভাষার অধিকার প্রতিষ্ঠার দাবিতে মিছিলরত তরুণদের ওপর। সেই খবর ছড়িয়ে পড়ে সারা দেশে। মাহবুব উল আলম চৌধুরী তখন রোগশয্যায় শায়িত; তাঁর সারা শরীরে জলবসন্তের চিহ্ন। রাত জেগে তিনি লিখলেন আগুনঝরা কবিতা: ‘কাঁদতে আসিনি, ফাঁসির দাবি নিয়ে এসেছি’। ২৩ ফেব্রুয়ারি চট্টগ্রামের লালদীঘি ময়দানে আয়োজিত প্রতিবাদ সভায় সে কবিতা পড়লেন তাঁরই সতীর্থ চৌধুরী হারুণ-উর-রশীদ। পাকিস্তান সরকার সে কবিতা বাজেয়াপ্ত করল। হুলিয়া জারি হলো মাহবুব উল আলম চৌধুরীর ওপর। তিনি এবং তাঁর কবিতা হয়ে গেল ইতিহাসের অংশ। ‘কাঁদতে আসিনি ফাঁসির দাবি নিয়ে এসেছি’—একুশের প্রথম কবিতা।কবিতাটির শেষাংশে কবি যে ভবিষ্যদ্বাণী করেছিলেন, পরবর্তীকালে তা-ই বাস্তবে রূপ নিয়েছে। শহীদদের উদ্দেশ করে তিনি লিখেছিলেন: ‘খুনি জালিমদের নিপীড়নকারী কঠিন হাত/ কোনো দিনও চেপে দিতে পারবে না/ তোমাদের সেই লক্ষ্য দিনের আশাকে/ যেদিন আমরা লড়াই করে জিতে নেব/ ন্যায়নীতির দিন/ হে আমার মৃত ভাইরা/ সেই দিন নিস্তব্ধতার মধ্য থেকে/ তোমাদের কণ্ঠস্বর/ স্বাধীনতার বলিষ্ঠ চিৎকার/ ভেসে আসবে।’
মাহবুব উল আলম চৌধুরী ১৯৫২ সালেই স্বাধীনতার কণ্ঠস্বর শুনতে পেয়েছিলেন এবং তা ভাষায়ও রূপ দিয়েছেন।
মাহবুব উল আলম চৌধুরীর জন্ম ১৯২৭ সালে। সেই সময়টার কথা ভাবুন। সমগ্র ভারতবর্ষে ব্রিটিশবিরোধী আন্দোলন জোরদার হচ্ছে। কাজী নজরুল ইসলামের অগ্নিস্ফুলিঙ্গসম কবিতা বাঙালি মনে বিদ্রোহের আগুন ঝরিয়ে দিয়েছে। মেহনতি মানুষের মুক্তির লক্ষ্যে দেশবন্ধু চিত্তরঞ্জন, মতিলাল নেহরু, শরৎ বসু প্রমুখকে নিয়ে গঠন করলেন বাংলা স্বরাজ্য দল। কমরেড মুজাফ্ফর আহমদের প্রেরণায় এবং এ কে ফজলুল হকের অর্থায়নে নজরুল প্রথম প্রকাশ করেছিলেন অসাম্প্রদায়িক পত্রিকা দৈনিক ‘নবযুগ’। তারপর ‘ধূমকেতু’। ১৯২৫ সালে দেশবন্ধু চিত্তরঞ্জনের নেতৃত্বে বেঙ্গল প্যাক্ট নামে হিন্দু-মুসলমান প্যাক্ট হয়। ১৯৩০ মাস্টারদা সূর্য সেনের নেতৃত্বে একদল যুবক চট্টগ্রাম অস্ত্রাগার লুণ্ঠন করে। তাদের লক্ষ্য ছিল, সশস্ত্র উপায়ে বিদেশি শাসককে দেশ থেকে তাড়াতে হবে। ভারতবর্ষে প্রথম সশস্ত্র সংগ্রাম, যাতে হিন্দু-মুসলমান উভয় সম্প্রদায়ের লোক যুক্ত হয়েছিল।
চট্টগ্রাম বিদ্রোহ ব্যর্থ হয়েছিল; কিন্তু বিপ্লবীদের আত্মত্যাগ বিফলে যায়নি। ১৭ বছরের মাথায় ১৯৪৭ সালে ব্রিটিশ শাসকেরা দেশ থেকে পাততাড়ি গুটাতে বাধ্য হয়। সে সময়ে মাহবুব উল আলম চৌধুরীর বয়স মাত্র ২০ বছর। ইতিমধ্যে তিনি মার্ক্সীয় মতাদর্শে দীক্ষা নিয়েছেন, কাজ করেছেন গণনাট্য গণশিল্পী সংস্থার সঙ্গে। সংস্কৃতিকর্মীদের সংগঠিত করেছেন। দেশ ভাগ হয়ে গেছে; এত দিনের চেনা পরিবেশও বদলে গেছে। হিন্দু লেখক-শিল্পী, রাজনৈতিক ও সংস্কৃতিকর্মীরা দেশ ছাড়ছেন। সর্বত্র সাম্প্রদায়িক আবহ তৈরি হচ্ছে। তরুণ মাহবুব উল আলম চৌধুরী ভাবলেন, কমিউনিস্ট পার্টির বিচ্ছিন্ন চেষ্টা দিয়ে খুব একটা এগোনো যাবে না। মুসলিম লীগকে মোকাবিলা করতে হবে। তার উপায় কী? পত্রিকা প্রকাশ। সাহিত্য পত্রিকা। জনমানসে নাড়া দিতে পারে, চিন্তার জগৎকে বদলে দিতে পারে—এমন একটি পত্রিকা। আসলে মনের সীমান্ত অতিক্রম করতেই ১৯৪৭ সালে, দেশ বিভাগের অব্যবহিত পর তিনি প্রকাশ করলেন ‘সীমান্ত’ নামে একটি উন্নত মান ও অসাম্প্রদায়িক চিন্তার সাহিত্য সাময়িকী। এই পত্রিকার লেখকের তালিকায় ছিলেন আবদুল করিম সাহিত্যবিশারদ, ড. মুহাম্মদ এনামুল হক, মাহবুব-উল আলম, আবুল ফজল, অন্নদাশঙ্কর রায়, মোতাহের হোসেন চৌধুরী, সুলেখা স্যানাল, পূর্ণেন্দু পত্রী, শামসুর রাহমান, আলাউদ্দিন আল আজাদ প্রমুখ। পত্রিকা প্রকাশ করতে গিয়ে মাহবুব উল আলম চৌধুরীকে নানা হয়রানির সম্মুখীন হতে হয়েছে। এরপরও তিনি হতোদ্যম হননি। ১৯৫২ সাল পর্যন্ত ‘সীমান্ত’র প্রকাশনা অব্যাহত ছিল।
কিছু কিছু মানুষ থাকেন, যাঁরা দলমত, শ্রেণি-পেশা ও ধর্মনির্বিশেষে সবার প্রিয় হয়ে ওঠেন। তাঁদের সান্নিধ্য ও সাহচর্য অন্যদের অনুপ্রাণিত করে। মাহবুব উল আলম চৌধুরী সেই বড় মাপের মানুষ। নীতিতে তিনি ছিলেন পাহাড়ের মতো ঋজু, চরিত্রে শিশুর মতো সরল। আজীবন যোদ্ধা তিনি। তাঁর লেখা, তাঁর কর্ম ও চিন্তাভাবনায় মূর্ত হয়ে আছে দেশ ও মানবকল্যাণ।
মাহবুব উল আলম চৌধুরী নেতা হতে চাননি। বড় লেখক হওয়ার বাসনাও পোষণ করেননি তিনি। কর্মী হিসেবে সমাজকে নির্মাণ করতে চেয়েছেন, করেছেন। মানুষে মানুষে যে পর্বতপ্রমাণ বৈষম্য, তার অবসান চেয়েছেন, মানবমুক্তির লক্ষ্যে লড়াই করেছেন। সেই লড়াইয়ে বরাবরই তাঁর সঙ্গী ছিল মুক্তচিন্তা ও প্রগতিশীল রাজনৈতিক দর্শন।
প্রেম, রাজনীতি, সমাজ—সবকিছু মাহবুব উল আলম চৌধুরীর কবিতার উপজীব্য। জাতীয় ও আন্তর্জাতিক প্রেক্ষাপটে নানা ঘটনা তাঁকে আলোড়িত করত। তাঁর কবিতায় মানবজীবনের প্রতিটি মুহূর্ত ধারণ করার চেষ্টা আছে। ব্যক্তিগত দুঃখ-বেদনা থেকে জাতীয় ঘটনাবলি তাঁকে দিয়ে কিছু উজ্জ্বল পঙ্ক্তি লিখিয়ে নিয়েছে। তাঁর প্রেমের কবিতা সরল ও চাতুর্যহীন।
মাহবুব উল আলম চৌধুরী কবিতা লিখেছেন, প্রবন্ধ লিখেছেন, গান লিখেছেন। লিখেছেন রাজনৈতিক কলামও। ২০০৭ সালে মৃত্যুর আগে তাঁর শেষ কাব্যগ্রন্থ ‘সূর্যাস্তের রক্তরাগ’ উৎসর্গ করেছিলেন স্ত্রী জওশন আরা রহমানকে। উৎসর্গপত্রটি লিখেছেন রবীন্দ্রনাথকে ধার করে, ‘যে আমারে দেখিবারে পায়/ অসীম ক্ষমায়/ ভালোমন্দ মিলায়ে সকলি।’
কবি মাহবুব উল আলম চৌধুরী আজ নেই। কিন্তু তাঁর লেখা ও চিন্তা আমাদের নিয়ত অনুপ্রাণিত করবে।
-
thanks mam for sharing the post.
-
Great post!