Daffodil International University

Entrepreneurship => Business Information => Topic started by: Md. Rashadul Islam on November 16, 2016, 11:26:49 AM

Title: আনিসুল হক চৌধুরী: ব্যবস্থাপনা পরিচালক, মারমেইড ইকো-টুরিজম লিমিটেড
Post by: Md. Rashadul Islam on November 16, 2016, 11:26:49 AM
মারমেইডের পথচলা শুরু হয়েছিল কক্সবাজারে সমুদ্রসৈকতে ছোট্ট একটি রেস্তোরাঁ দিয়ে। সময়টা ২০০৪ সাল। কর্মী ছিল তখন মাত্র পাঁচজন। এখন সেই কর্মীবাহিনী ৪০০ সদস্যের। রেস্তোরাঁর পাশাপাশি এখন আমরা গড়ে তুলেছি রিসোর্ট, যা দিনে দিনে হয়ে উঠেছে আন্তর্জাতিক ব্র্যান্ড। এখানে বেড়াতে এসে নিজস্ব সৈকত, দ্বীপ, বিচ রাইড থেকে শুরু করে আন্তর্জাতিক মানের সেবা পাচ্ছেন দেশি-বিদেশি পর্যটকেরা।
তবে এই অবস্থানে আসতে পোড়াতে হয়েছে অনেক কাঠখড়। হোঁচট খেয়েছি। আবার উঠে দাঁড়িয়েছি। ছোট ছোট জায়গায় দক্ষতা অর্জনের চেষ্টা করেছি। সেই দক্ষতাই বড় কাজের প্রেরণা দিয়েছে।
সেই কাহিনি শোনাতে একটু পেছনে যেতে হবে। বয়স তখন ১৭ কি ১৮। তারুণ্যের উন্মাদনা তুঙ্গে। যা ভালো লাগছে, তা-ই হাসিল করা চাই। কখনো ট্রাভেলার, কখনো সার্ফার, কত্ত কী! তবে সবকিছুই পরিপাটিভাবে করার চেষ্টা থাকত।
একসময় যোগ দিলাম থিয়েটারে। বিস্ময় জাগাত তাদের কাজ। সবকিছুর পেছনে গল্প। কাজ করতে থাকলাম মোস্তফা সরওয়ার ফারুকীর সঙ্গে। নাটকে অভিনয়, সিনেমায় পার্ট। সবই চলতে থাকল সমানতালে। তারপরও কোথায় যেন ঘাটতি। ভাবলাম, এ জন্য চাই আরও দক্ষতা, পড়াশোনা। ব্যস, পাড়ি জমালাম ভারতের মুম্বাই। সেখানকার একটি থিয়েটার স্কুলের সঙ্গে যুক্ত হলাম। এর ফাঁকে ঘুরে বেড়িয়েছি ভারতের বিভিন্ন স্থানে। একবার গেলাম গোয়া। সমুদ্রশহরটি দেখে মুগ্ধ না হয়ে উপায় ছিল না। সৈকত ঘিরে সেখানকার মানুষের জীবনধারা বেশ উপভোগ্য। সৈকতে সংগীত, রেস্তোরাঁ, সার্ফিং, বিচ বাইক—মজার এক জীবন।
গোয়া আমাকে টানল। পরের মাসে আবার গেলাম। কিন্তু শুধু গেলে তো হবে না। এ জন্য খরচ লাগে। খরচের সংস্থান করতে সৈকতে একটি রেস্তোরাঁয় ওয়েটারের কাজ নিলাম। এই দিনগুলো আমার জীবনে নতুন বাঁক এনে দিল। গোয়ায় নানা ভাষার পর্যটক আসেন। রেস্তোরাঁয় খাবার পরিবেশন করতে গিয়ে তাঁদের সঙ্গে কথা বলা। নানান অভিজ্ঞতার গল্প শোনা। তা ছাড়া একসঙ্গে অনেক মানুষকে খাবার দেওয়া, ঠিকভাবে ব্যবস্থাপনা করা। সবকিছু সামলাতে গিয়ে অন্য এক অভিজ্ঞতা হলো। এভাবে টানা চার মাস গোয়া গিয়ে ১৫ দিন করে কাটিয়েছি। এরপর দেশে এলাম। এদিকে অভিনয়ে কেটে গেল তিন বছর। কিন্তু এবার আর কাজে মন বসছে না। মনে হচ্ছে অভিনয়টা আমার জন্য নয়। আমার পথ হয়তো ভিন্ন। ইস্তফা দিলাম অভিনয়জীবনে। ঘুরপাক খেতে থাকল অন্য স্বপ্ন—এমন একটা ক্যারিয়ার হবে, যার প্রাতিষ্ঠানিক রূপ থাকবে।
এর মধ্যে মাথায় ঢুকল সার্ফিংয়ের পোকা। এলাম কক্সবাজার। এখানেও গোয়ার সেই সমস্যা। খরচ। হোটেলের ভাড়া বেশি। তবে দমে যাইনি। কাজে লাগল গোয়ার অভিজ্ঞতা। লক্ষ করলাম সমুদ্রের পাড়ে কোনো রেস্তোরাঁ নেই, সংগীত নেই। ভালো মানের রেস্তোরাঁ হলে পর্যটকেরা আসবেনই। কিন্তু রেস্তোরাঁ হবে কীভাবে? না আছে জমি-জিরাত, না আছে যথেষ্ট টাকা। সম্বল বলতে নিজের জমানো ৮০ থেকে ৯০ হাজার টাকা। তারপরও চেষ্টা করতে থাকলাম। সাগরপাড়ে জমির মালিকদের কাছে ধরনা দিলাম। একজন ভাড়ায় জায়গা দিলেন।

শুরু হলো সৈকতজীবন। কলাতলীতে জায়গা পেয়ে তাঁবু খাঁটিয়ে শুরু হলো থাকা। রেস্তোরাঁ গড়ার স্বপ্ন বাস্তবায়নের জন্য মাটি কামড়ে পড়ে রইলাম। এই সময়ে সাহস জোগালেন আমার বড় ভাই, বন্ধু নগর পরিকল্পনাবিদ ও স্থপতি জিয়াউদ্দিন খান। তাঁর সহযোগিতায় দাঁড়িয়ে গেল ২০ থেকে ২৫ আসনের রেস্তোরাঁ। নাম ‘মারমেইড ক্যাফে’।

হোঁচট খেয়েছি। আবার উঠে দাঁড়িয়েছি। ছোট ছোট জায়গায় দক্ষতা অর্জনের চেষ্টা করেছি। সেই দক্ষতাই বড় কাজের প্রেরণা দিয়েছে
শুরু থেকে একটি ব্যাপারে কোনো আপস ছিল না। তা হচ্ছে, মানসম্মত খাবার ও পরিবেশবান্ধব স্থাপনা। এ জন্য দরকার ভালো একজন শেফ। ঢাকায় এক বন্ধুর মাধ্যমে এমন একজনকে পেলাম, যিনি যুক্তরাষ্ট্রে শেফ হিসেবে কাজ করেছেন দীর্ঘদিন। তাঁকে বললাম, ‘আসুন, দেশের জন্য কিছু করি।’ তিনি আমাকে একটা শর্ত দিলেন রান্নাঘর থাকতে হবে ‘পবিত্র’। আমি আশ্বাস দিলাম, তিনি আস্থা রাখলেন। চলে এলেন কক্সবাজার।
এবার রেস্তোরাঁর বিপণন। নিজেরাই প্রতিদিন সৈকতে হেঁটে হেঁটে কিংবা বাসস্টেশনে দেশি-বিদেশি পর্যটকদের কাছে পৌঁছে দিতে লাগলাম মারমেইড রেস্তোরাঁর খবর। পর্যটকেরা রেস্তোরাঁয় এসে দেখল পবিত্র রান্নাঘর। এই আমাদের পুঁজি। দিনে দিনে পর্যটকেরা মারমেইড ক্যাফেমুখী হলো। একটা সময় তো রীতিমতো লাইন পড়ল খাবারের জন্য।
একদিন হঠাৎ মাথার ওপর বাজ পড়ল। জমির মালিক এসে বললেন, জায়গা ছেড়ে দিতে হবে। বেকায়দায় পড়ে গেলাম। শেষে পাশেই আরেকটি জায়গায় স্থানান্তরিত হলো মারমেইড ক্যাফে। এত দিনের রেস্তোরাঁর আয় পুরোটা বিনিয়োগ করলাম। পর্যটকদের জন্য চালু করলাম মন্তব্য খাতা। এসব মন্তব্যে তাঁরা আমাদের রিসোর্ট করার কথা বলত। বিষয়টা আমাকে ভাবাতে লাগল। আবার বড় ভাই জিয়াউদ্দিন খানের শরণাপন্ন হতে হলো। তিনি বললেন, ‘হুট করে কোনো কিছু নয়। এগোতে হবে ধীরে ধীরে।’
রেস্তোরাঁ চালানোর ফাঁকে জমি খোঁজা শুরু হলো। তবে কক্সবাজার শহরের আশপাশে হবে না। এখানে জমির অনেক দাম। চলে এলাম ২০ কিলোমিটার দূরের রেজুখালের পাশে প্যাঁচার দ্বীপ সমুদ্রসৈকতে। সামান্য জমি কিনলাম। প্রথম দিকে কেনা আধা কানি জমিতে একটি মাটির ঘর তৈরি করলাম। পর্যটকদের জন্য প্যাকেজ বানালাম। সারা দিন নির্জন সৈকতে ঘোরাঘুরি আর দুপুরের খাবার। অনেকেই লুফে নিলেন। এর মধ্যে আমার জীবনে যুক্ত হলো সামিহা আলম চৌধুরী, আমার স্ত্রী। দুজন মিলে ঝাঁপিয়ে পড়লাম।
স্বপ্ন পূরণের পথে এগোনোর প্রাথমিক ভিত্তি গাড়া হলো। জিয়াউদ্দিন খান, সামিহা আর আমি মিলে গঠন করলাম ‘মারমেইড ইকো টুরিজম লিমিটেড’। প্রথম প্রকল্প ‘মারমেইড ইকো রিসোর্ট’। ১৫টি কক্ষ দিয়ে ২০০৯ সালে যাত্রা শুরু। বছর খানেক যাওয়ার পর আবার বিপত্তি। প্রশাসন ভুল বুঝে ভেঙে দিল ইকো রিসোর্টের অর্ধেকটা। মন ভেঙে গেল। ঢাকায় ফিরে গেলাম। তবে বসে থাকলাম না। হাত দিলাম রেস্তোরাঁ গড়ার কাজে। মাথায় ছিল ভালো সেবা ও মানসম্মত খাবার দিলে সব জায়গায় গ্রাহক পাওয়া যাবে। শেষমেশ ঢাকায় চালু হলো ‘মারমেইড গ্যালারি ক্যাফে’। খাবেন তো বটেই, একই সঙ্গে চিত্রকর্মও উপভোগ করুন। ঢাকার মানুষও আমাদের আপন করে নিল।
এর মধ্যে কক্সবাজারের ভাঙা ইকো রিসোর্টও আবার চালু হলো। কর্মীরা কেউ আমাকে ছেড়ে যায়নি। নতুন উদ্যমে ফেরা। এবার অনেক বেশি পরিণত, বাস্তবমুখী। বাড়তে থাকল আয়, সঙ্গে কাজের পরিধিও। এরপর আরও এক ধাপ এগোলাম। আর্ট রেসিডেন্সের আদলে প্যাঁচার দ্বীপে গড়ে তুললাম ‘মারমেইড আশ্রম বিচ ভিলাস’।
এবার স্বপ্ন আরও বিস্তৃত। গড়ে তোলা হলো ‘মারমেইড বিচ রিসোর্ট’। সেটি চালু হয়েছে ২০১২ সালে। এখন তিনটি রিসোর্ট মিলে ৫৩টি কক্ষ।
মারমেইড এখন সারা বিশ্বে বাংলাদেশের প্রতিনিধিত্ব করে। পর্যটন-বিষয়ক অন্যতম গুরুত্বপূর্ণ ওয়েবসাইট ‘ট্রিপ অ্যাডভাইজার’ থেকে এক্সেলেন্স সনদ পেয়েছে। আরেক বিশ্ববিদিত ওয়েবসাইট ‘লোনলি প্ল্যানেট’-এরও সেরা তালিকায় আছে মারমেইড। শুধু তা-ই নয়, চীনের হাইনান প্রদেশের সানায়া সমুদ্রসৈকত এলাকায় যৌথ ব্যবসায় চালু হয়েছে ‘মারমেইড-লা পা মিয়ার’।
আমাদের মূল ভাবনা অর্গানিক খাবার। সেটি দিয়েই এত দূর এসেছি। আমি ইতালীয় দার্শনিক কার্লো প্যাতরিনির ভক্ত। তাঁর ‘স্লো ফুড’ আন্দোলন আমাকে নাড়া দিয়েছে। তিনি বলেছেন, নিজের খাদ্য নিজেই উৎপাদন করতে।
আমাদের এখানেও গ্রামের মানুষের নিজস্ব পদ্ধতিতে জৈব সারে ফলানো ফল-সবজি পর্যটকদের পরিবেশন করা হয়। সেসব সংগ্রহ করা হয় রিসোর্টের ১০ কিলোমিটার এলাকা থেকে। তাজা মাছ দেওয়া হয় সাগর থেকে তুলে এনে। এর ফলে আশপাশের মানুষ ভালো দামে সবজি ও মাছ বিক্রি করতে পারেন। তাঁদের আর্থসামাজিক অবস্থায়ও মারমেইড ভূমিকা রাখতে পারছে।
একদিন পাঁচজনের দল দিয়ে শুরু করা মারমেইড ক্যাফে রেস্তোরাঁর সংখ্যা এখন এসে দাঁড়িয়েছে পাঁচটিতে। রিসোর্ট ও রেস্তোরাঁর পাশাপাশি অন্য ক্ষেত্রেও প্রসারিত হয়েছে মারমেইড। গড়ে তোলা হয়েছে পোশাকের ব্র্যান্ড ‘মারমেইড মারম্যান’ ও শিল্পকলা-বিষয়ক প্রতিষ্ঠান ‘মারমেইড আর্ট ফাউন্ডেশন’।
আমি মনে করি, কর্মীরা সবাই এই প্রতিষ্ঠানের মালিক। তাঁরা শ্রম দিচ্ছেন, আমরা বিনিয়োগ ও পরিচালনা করছি। তাঁরা মনে করেন, এটি তাঁদের সম্পদ। তাঁদের সেই পরিবেশে গড়ে তোলা হয়েছে।
আমার অভিজ্ঞতা হলো, শুরু করতে হবে ছোট কিছু দিয়ে। তাহলে বড় কিছু কীভাবে পরিচালিত হয়, তার অভিজ্ঞতা অর্জন করা সম্ভব। বড় কিছু দিয়ে শুরু করলে সেটার ভগ্নাংশ হয়ে থাকতে হয়।
আসলে ভালোবাসা আর একাগ্রতা থাকলে যেকোনো বাধার পাহাড় ডিঙানো সম্ভব। বাধার পেছনেই থাকে সাফল্যের মন্ত্রগাথা। বাধা পেলে তাই পথ ছেড়ে সরে যেতে হয় না।

Source: Prothom-Alo