Daffodil International University

General Category => Common Forum => Topic started by: shawket on December 06, 2016, 03:01:14 PM

Title: আইনিভাবে রোহিঙ্গাদের রাষ্ট্র নেই, নাগরিকতা
Post by: shawket on December 06, 2016, 03:01:14 PM
আধুনিক বিশ্বে সবচেয়ে নিপীড়িত এবং নির্যাতিত ক্ষুদ্র জাতিগোষ্ঠী রোহিঙ্গা (আন্তর্জাতিকভাবে বহুল ব্যবহৃত নাম) বা রাখাইনের মুসলিমরা। মিয়ানমারের এই ক্ষুদ্রগোষ্ঠী প্রতিনিয়ত শিকার হচ্ছে রাষ্ট্রীয় সন্ত্রাসের। দেশটির সেনাবাহিনী আর আইন-শৃঙ্খলা বাহিনী প্রতিদিন পুড়িয়ে দিচ্ছে রোহিঙ্গাদের ঘর-বাড়ি। হত্যা করা হচ্ছে নিরীহ এইসব মানুষদের। যা প্রতিনিয়ত বিভিন্ন আন্তর্জাতিক গণমাধ্যমে প্রচারিত ও প্রকাশিত হচ্ছে। যদিও মিয়ানমার সরকার এসব নির্যাতন ও হত্যাকাণ্ডের কথা বরাবরের মতোই অস্বীকার করে আসছে। দেশটির কাউন্সিলর অফ স্টেট এই এসব অভিযোগ হেসেই উড়িয়ে দিয়েছেন।

এই সমস্যার মূল কারণ তাদের অস্তিত্ব স্বীকার করে না মিয়ানমার সরকার। দেশটির সরকারের দাবি, রোহিঙ্গারা মিয়ানমারের নাগরিক নয়। দেশটির অভিযোগ রোহিঙ্গা বা রাখাইনের মুসলিমরা অনুপ্রবেশকারী অভিবাসী। ফলে দীর্ঘদিন ধরে রাষ্ট্রহীন হয়ে আছেন লক্ষাধিক রোহিঙ্গা। জীবন ধারণের জন্য যেসব মৌলিক চাহিদার দরকার তার সবকিছু থেকেই বঞ্চিত তারা। আসলেই কি রোহিঙ্গারা মিয়ানমারের ক্ষুদ্র জাতিগোষ্ঠী? এই প্রশ্নের সঠিক কোন উত্তর নেই। তবে মুসলমানরা যে কয়েক হাজার বছর আগ থেকেই দেশটিতে বসবাস করছে এটা ঐতিহাসিকভাবেই প্রমাণিত।

মিয়ানমারের রাখাইন (সাবেক আরাকান) রাজ্যের রোহিঙ্গারা মুসলিম, ইন্দো-আর্য জাতিগোষ্ঠীর। বিশেষজ্ঞদের মতে, রোহিঙ্গারা হলো মায়ানমারের (সাবেক বার্মা) আদিবাসী। তবে, কিছু ইতিহাসবিদ দাবি করেন, বার্মায় ব্রিটিশ শাসন চলাকালে সে মসয়ে বাংলা থেকে মিয়ানমারে আসে রোহিঙ্গারা।

বলা হয়ে থাকে, রোহিঙ্গা শব্দের প্রচলন হয় ১৯৫০ সালে। যখন স্বাধীন বার্মার প্রথম প্রধানমন্ত্রী ইউ ন্যু ১৯৫০ সালের ১০ মার্চ মংডু ভ্রমণ করেন। সেসময় রোহিঙ্গা এল্ডার্স অব নর্থ আরাকান নামে একটি গোষ্ঠী তাদের আনুষ্ঠানিকভাবে নিজেদের রোহিঙ্গা নামে পরিচয় দেয়। পরবর্তীতে ইউ ন্যু মংডু এবং আকিয়াব এলাকা ভ্রমণ করেন। সেময় রোহিঙ্গারা তাকে স্বাগত জানায়। এছাড়া সেসময় রোহিঙ্গা বা রাখাইন রাজ্যের মুসলিমদের রাষ্ট্রীয়ভাবে দেয়া হয় পরচিয়পত্র।

তবে, বৃটিশ ইস্ট-ইন্ডিয়া কোম্পানিতে কাজ করা সার্জন ফ্রান্সিস বুচনান ১৭৯৯ সালে মিয়ানমারের রাখাইন (আরাকান) রাজ্য ভ্রমণ করেন এবং কিছু মুসলিম ক্ষুদ্রগোষ্ঠীর সাথে কথা বলেন। নজিরে, অ্যা কম্প্যরেটিভ ভোকাবুলারি অফ সাম অফ দ্যা ল্যাঙ্গুয়েজ স্পোকেন ইন বার্মা বইয়ে বলনে, আরাকানরেস্থানীয়রা নিজেদের রোহিনগা বা আরাকানের মুসলিম বলে পরিচয় দিয়েছিল।

১৯৯৯ সালে প্রকাশিত এএফকে জিলানি দ্যা রোহিঙ্গাস অফ আরাকান: দেয়ার কোয়েস্ট অফ জাস্টিস বইতে লেখেন রোহিঙ্গা শব্দটি এসেছে, রোহান, রোহাম বা রোসাম থেকে।

আব্দুল গাফফার যিনি নিজে রোহিঙ্গা ও সাবেক সংসদ সদস্য। নির্বাচিত হয়েছিলেন উত্তর আকিয়াব সংসদীয় এলাকা থেকে। ১৯৫১ সালের ২০ আগস্ট দৈনিক গার্ডিয়ান ডেইলি পত্রিকায় প্রকাশিত একটি লেখায় তিনি রোহিঙ্গা শব্দটি ব্যবহার করেন।

২০১৩ সালে সেনাবাহিনী সমর্থিত ইউনিয়ন সোলিডারিটি অ্যান্ড ডেভেলপমেন্ট পার্টির সংসদ সদস্য সিউই মাউং যিনি নিজে একজন রোহিঙ্গা, দাবি করেন, ১৮২৪ সালের আগ থেকেই আরাকানে ৩০ হাজার রোহিঙ্গা বসবাস করছিল। যেটি আনুষ্ঠানিকভাবে স্বীকার করে নেয়া হয়েছে।

ইতিহাস বলছে, চতুর্দশ থেকেই আরাকান রাজ্যে মুসলিমরা বসবাস করতো। এই রাজ্যের প্রভাবশালী রাজা ছিলেন মিন সুয়া মুন। সেসময়ের বাংলার রাজার সহায়তায় আরাকানের রাজত্ব ফিরে পান তিনি। কৃতজ্ঞতাস্বরূপ নিজের নাম পরিবর্তন করে রাখেন সুলাইমান শাহ। এছাড়া ওই রাজ্যের প্রায় সব রাজাই নিজের বৌদ্ধ নামের পাশাপাশি রাখেন মুসলিম নাম। অনেক মুসলিম ব্যক্তি এই রাজ্যের রাজসভার সদস্য ছিলেন। বলা হয়ে থাকে, এরাই বর্তমান রোহিঙ্গাদের পূর্বপুরুষ।

এছাড়া ১৯৪৮ সালে বৃটিশদের কাছ থেকে  স্বাধীনতা পাবার পর ষাটের দশকের আগ পর্যন্ত মিয়ানমার সরকার রোহিঙ্গাদের নৃ-তাত্ত্বিক গোষ্ঠী হিসেবে স্বীকার করে নেয়। তবে অবস্থার পরিবর্তন হয় সামরিক সরকার নে উইনের সময়। তার সরকারই প্রথম ঘোষণা করে রোহিঙ্গারা মিয়ানমারে অনুপ্রবেশকারী। ১৯৮২ সালে আইনের মাধ্যমে নাগরিকত্ব কেড়ে নিয়ে রাষ্ট্রহীন করা হয় রোহিঙ্গাদের। আইন অনুযায়ী ১৮২৩ সালের আগ থেকে যেসব নৃগোষ্ঠী মিয়ানমারে বসবাস করছে তারাই হবে মিয়ানমারের নাগরিক। কিন্তু রোহিঙ্গা বা রাখাইন মুসলিমরা যে এর আগ থেকেই দেশটিতে বসবাস করছে তা ঐতিহাসিকভাবে প্রমাণিত। কিন্তু মিথ্যা অজুহাতে ১৩৫টি ক্ষুদ্র নৃগোষ্ঠীকে নাগরিকত্ব দেয়া হলেও রোহিঙ্গা বা মুসলিমদের নাগরিকত্ব দেয়নি, দেশটির কাউন্সিলর অফ স্টেট।

২০১২ সালে রাখাইন রাজ্যে বিদ্যমান সমস্যা ও সমাধানের উপায় খুঁজতে সরকারের পক্ষ থেকে গঠন করা হয় রাখাইন তদন্ত কমিশন। এই কমিশন রাখাইন মুসলিমদের নাগরিকত্ব সমস্যার সমাধানের জন্য সুপারিশ করে। এই কমিশনের প্রতিবেদনে বলা হয়, রাখাইন রাজ্য মুসলিমদের জন্য রোহিঙ্গা নামটি গ্রহণ করেনি। ঐতিহাসিক কোন প্রমাণ নেই এই নাম ব্যবহারের। বৃটিশ শাসনামলে চট্টগ্রাম থেকে কৃষিকাজ করার জন্য বাঙালি শ্রমিকরা রাখাইন রাজ্যের বুটেনতাগ ও মংডু এলাকায় যেত। সেময় রাখাইন এলাকাকে বাঙালিরা রোহিন মালুক নামে ডাকত।

প্রতিবেদনে বলা হয়, রোহিন মানে রাখাইন আর মালুক মানে দেশ বোঝানো হতো তখন। তাদের নিজস্ব ভাষায় গায়া মানে যাওয়া বোঝাতো। অর্থাৎ রোহিঙ্গা মানে রাখাইন রাজ্যে যাওয়া। সুতরাং রোহিঙ্গা কোন গোষ্ঠী বা জনগণের নাম নয়। এছাড়া বৃটিশ আমলে বার্মায় যে আদমশুমারি হয় তখন রোহিঙ্গা নামে কোন গোষ্ঠীর অস্তিত্ব পাওয়া যায়নি বলেও প্রতিবেদনে বলা হয়। এই প্রতিবেদনের প্রেক্ষিতে সেসময়ের প্রেসিডেন্ট থেন সেইন বলেন, এই রাজ্যের মুসলিমদের প্রত্যাশা এবং প্রয়োজন অনুযায়ী মৌলিক মানবাধিকার রক্ষায় প্রয়োজনীয় পদক্ষেপ নেয়া হবে।

অর্থাৎ মিয়ানমার সরকার স্বীকার করে নিয়েছে যে, রাখাইন রাজ্যে মুসলমান আছে এবং তাদের নির্যাতন করা হচ্ছে। তবে, রোহিঙ্গা নামটি ব্যবহার করেনি দেশটির সরকার।

এখন প্রশ্ন কেন তাদের নাগরিকত্ব থেকে বঞ্চিত করা হলো। রাখাইন কমিশনে উল্লেখ করা হয়, রাখাইন রাজ্যে রাঙালি জনগোষ্ঠীর মধ্যে জন্মহার বেড়ে যাওয়ার ফলে রাখাইন জনগণের মধ্যে আতঙ্ক তৈরি হয়। শুধু জন্মহার বৃদ্ধি নয়, অভিযোগ করা হয় বাংলাদেশ থেকে অনুপ্রেবেশ এই সঙ্কটকে আরও বাড়িয়ে দেয়। রাখাইন জনগণ বিশ্বাস করে স্বাধীনতার পর কোন সরকার এই সমস্যা সমাধানে কোন পদক্ষেপ নেয়নি। এ কারণে ১৯৭৮ সালে ড্রাগন কিং নামে এক অভিযানে পালিয়ে বাংলাদেশে আসে মুসলিমরা। সেই থেকে শুরু তাদের উপর নির্যাতন।

এটা প্রমাণিত যে, রাখাইন রাজ্যে মুসলমানরা কয়েক হাজার বছর থেকেই বসবাস করছে। তারা যে নির্যাতনের শিকার হচ্ছে তা রাষ্ট্রের পক্ষ থেকে স্বীকার করে নেয়া হয়েছে। মিথ্যা অজুহাতে দেশটির সামরিক সরকার তাদের নাগরিকত্ব কেড়ে নিয়েছে, করেছে রাষ্ট্রহীন।

আইনিভাবে তাদের কোন রাষ্ট্র নেই, কিন্তু তারা এই বিশ্বের নাগরিক। তাই সবারই উচিত এইসব নির্যাতিত মানুষের পাশে দাঁড়ানো। সমস্যা সমাধানে মিয়ানমার সরকারের উপর চাপ প্রয়োগ করা।