Daffodil International University
Faculties and Departments => Faculty Sections => Faculty Forum => Topic started by: SabrinaRahman on April 24, 2017, 03:15:53 PM
-
মা যাবেন ভ্রমণে?
কথা হচ্ছিল বয়স নিয়ে। ত্রিশের পরে নারীদের জীবন শেষ হয়ে যায় কি না। তার মাঝেই যুক্ত হলো অ্যাডভেঞ্চার। একে তো বয়স ত্রিশের বেশি, তার ওপর পাহাড়ি পথে ট্রেকিং! আবার প্রায় সবাই নতুন মা। মানে শিশুদের বয়স দুই থেকে চার বছরের মধ্যে। কারও হয়তো দুটো সন্তান।
এমনই এক আড্ডায় এক মা বলে বসলেন, ‘বাচ্চা নিয়ে আবার ট্রেকিং! শখ কত!’ আলোচনা ঘুরে যায়। বয়স বিষয়টাকে পাশে রেখে মুখ্য হয়ে উঠল মায়েদের ‘উচিত-অনুচিত’ এবং ‘ভালো মা-মন্দ মায়ের সংজ্ঞা’। এমন সময় একজন বললেন, তিনি নিজেই ট্রেকিং করে এসেছেন কিছুদিন আগে। সঙ্গে সঙ্গে আরেকজনের চোয়াল ঝুলে পড়ে! ‘তোমার বাচ্চা কোথায় ছিল?’ সেই মা একটু হেসে উত্তর দিলেন, ‘আমাদের বাচ্চা তার বাবার কাছে ছিল।’
মায়েদের কোথাও ঘুরতে যাওয়া কি আসলেই অষ্টমাশ্চর্য! যা আজকালকার আধুনিক মায়েরা মেনে নিতেই পারেন না। নাকি আসলেই সবাই বিশ্বাস করেন যে সন্তান জন্ম দেওয়ার পর থেকে শিশু প্রতিপালনের বিষয়টা শুধু মায়েরই কর্তব্য। এ জন্য মায়েদের প্রায়ই শুনতে হয়, ‘তোমার বাচ্চা কোথায়?’, ‘বাচ্চাকে রেখে কোথায় গিয়েছিলে?’ বা ‘তুমি তোমার বাচ্চাকে রেখে বাইরে যাও?’—এ ধরনের প্রশ্ন বেশির ভাগই কিন্তু আসে অন্য নারীদের কাছ থেকে!
সন্তান জন্মের পর থেকে মায়ের ওপরেই নির্ভরশীল থাকে। বুকের দুধ আর নির্ভরতার সেই অধিকার শিশুর জন্মসূত্রে পাওয়া অধিকার। কিন্তু সময়ের সঙ্গে সঙ্গে শিশুর বাবার দায়িত্ব সঠিকভাবে পালন করা এখন সময়ের দাবি। বিশেষ করে যাঁরা একক পরিবারে থাকেন। কারণ, একক পরিবারে শুধু মা যদি নিজের চাকরি, সংসারের এবং শিশুপালনের দায়িত্ব একা পালন করেন, তাহলে সেই নারীর মানসিক হতাশা আসবে। সামাজিক যোগাযোগ মাধ্যমের কারণে আজকাল অনেক কিছুই খোলা বইয়ের মতো সবার সামনে চলে আসছে। আর এ কারণেই দেখা যায়, মাঝে মাঝে যেন নতুন মায়েদের অনেকেই বিষাদগ্রস্ত হয়ে পড়ছেন। যাঁদের বেশির ভাগই মনে করেন, তাঁরা কখনোই আরাম করে ঘুমাতে পারবেন না, ঘুরতে পারবেন না বা বেড়াতে পারবেন না। ওদিকে আরেক দল মনে করে, মা হওয়ার পর শিশুপালন ছাড়া আর কোনো কাজই করতে পারবেন না মায়েরা। তাঁরা মনে করেন, সংসার বা সন্তান সামলানোর জন্য তাঁদের কোনো সাহায্যকারী নেই। এখানেই প্রশ্নবিদ্ধ বাবাদের ভূমিকা।
এ সমাজে বাবাদের ক্ষেত্রে ধরেই নেওয়া হয় যে তাঁরা সন্তান সামলাতে পারবেন না। বাবারাও আত্মবিশ্বাসের অভাবে ভোগেন। মায়েরা যদি শিশু জন্মের পর থেকে রাতজাগা, ঘণ্টায় ঘণ্টায় শিশুকে খাওয়ানো পর্যন্ত বাবাকে সঙ্গে রাখেন বা এখন থেকে রাখা শুরু করেন, সেই বাবাদের মনে কর্তব্যবোধ নিজে থেকেই আসতে বাধ্য। কারণ, এই সন্তানের পেছনে তাঁরও আছে সমান দায়িত্ব। আর স্ত্রীর প্রতি ভালোবাসা, যে ভালোবাসা থেকে সন্তান দেখেছে পৃথিবীর মুখ। কেবল জন্ম দিয়েই হাত-পা ঝাড়া হওয়া আদৌ দায়িত্বের শেষ নয়—এটা বোঝাতে হবে বাবাদের।
আবার অনেক মা আছেন, যাঁরা নিজেরাই বাবাদের কাছে সন্তানকে রাখতে ভরসা পান না। এতে করে মায়েরা সন্তানকে কেবলই মাকেন্দ্রিক করে ফেলছেন। ফলে মায়েদের নিজস্ব ভুবন বলে কিছুই থাকছে না। মা হওয়া কি শিকল? মা হওয়া কি নিজের জীবনকে ভুলে যাওয়া? নাকি মা হওয়া মানে শুধু সন্তান পালনেই সুখ খুঁজে নেওয়া?
বিষয়টা জটিল কিন্তু এখনকার দিনে আলোচ্যই বটে। মা হওয়ার চেয়ে আনন্দের বিষয় নারীর জীবনে হয়তো থাকে না—কিন্তু সেই আনন্দকে ঘটনাবহুল রাখার জন্য চাই বৈচিত্র্য। তাতে করে মায়েরা যে আত্মবিশ্বাস পাবেন, তা শিশুর মাঝেই প্রতিফলিত হবে। একদিন শিশুই বড় হয়ে বলবে—তার মা কত ‘কুল’! শিশুকে অন্তত বাবার কাছে রেখে নিজেকে একটু একটু করে আবার ডানপিটে করে তুলতে পারলে জীবনটা বোকাবাক্সের নিত্যদিনের নাটক হবে না শেষ পর্যন্ত। শিশুর চোখে শুধু বাবাই সুপারহিরো হবে না, মা-ও হবে ওয়ান্ডারওম্যান। আর এই বিশ্বাসটা আসতে হবে নারীদের মাঝ থেকেই। একজন নারী যখন আরেকজন নারীকে কটাক্ষ না করে কাঁধে কাঁধ মেলাবে, তখনই নারীর জীবনের জটগুলো খুলে যাবে একে একে। একজন মা অবশ্যই অ্যাডভেঞ্চার করতে পারেন, একজন মা অবশ্যই বাচ্চাকে ভালোবাসার পাশাপাশি নিজের জীবনকে উপভোগ করতে পারেন, একজন মা অবশ্যই পারেন কর্তব্যপালনের পর নিজের জন্য সময় কাটাতে। আর এ জন্য চাই মায়েদের আত্মবিশ্বাস। আর বাবাদের দায়িত্ব পালনে আগ্রহ।
এবার আসি মোদ্দা কথায়। আমি সেই ব্যক্তি যে অতি সম্প্রতি বান্দরবানের নাফাখুম ঘুরে এসেছি। একে তো বয়স ত্রিশের বেশি, তার ওপর দুই বছরের বাচ্চাকে বাবার কাছে রেখে গিয়েছিলাম বাংলাদেশের এই অপরূপ ঝরনাটি দেখতে। আমার মনে হয়, প্রত্যেক নারীকে জীবনের বিভিন্ন সময়ে এভাবে নিজেকে ট্রিট দেওয়া অবশ্যই জরুরি। কারণ, ঘড়ির পেন্ডুলামের মতো চলতে থাকা এই জীবন কখনো না কখনো একঘেয়ে মনে হবেই। তাহলে প্রশ্ন উঠতে পারে যে সন্তানকে রেখে ট্রিপ করা কেন! এর পেছনে দুটো কারণ—এক. সন্তানের বাবা আত্মবিশ্বাসী হোক সন্তান পালনে। দুই. মায়েরও যে বিরতি প্রয়োজন, তা প্রতিষ্ঠা করা।
মায়েদের জীবনে বিরতি বিষয়টা এখনো অনেকে মেনে নিতে পারে না। অথচ এই ‘অনেকেই’ কিন্তু একদিন ঘটা করে মায়ের কাজ করে দেওয়ার প্রচারণা চালান। তাহলে মা কেন বেড়াতে পারবেন না? কেউ কেউ বলেই ফেলেন, তোমার মতো আমি তো সন্তান রেখে যেতে পারি না। তাঁদের সবাইকে হাসিমুখে বলেছি, সবাই সবকিছু পারে না। আমি আমার সন্তানকে এটাই বোঝাতে চাই যে নারী মানেই ঘরের হাঁড়ি ঠেলার হিসাব নয়। কোনো একদিন যেন আমার সন্তানও তার সন্তানকে নিয়ে সময় কাটায়। আর তার স্ত্রী যেন জয় করে পাহাড় চূড়া—এটাই আমি চাই।
এবার নাফাখুম বেড়ানোর পর অ্যাডভেঞ্চারের এবং আত্মবিশ্বাসের যে অভিজ্ঞতা, তা অতুলনীয়। একজন মা যখন বিশেষ করে এমন ভ্রমণে যান, তখন তিনি বুঝে যান, তাঁর কাছে কোনো কিছুই অসম্ভব নয়।