Daffodil International University
Faculty of Science and Information Technology => Science and Information => Topic started by: Md. Alamgir Hossan on April 26, 2017, 01:57:15 PM
-
রিনির মন সকাল থেকেই খারাপ। ঘুম ভেঙে মুঠোফোনে ফেসবুক খুলতেই দেখতে পেল তার বন্ধুদের উচ্ছ্বসিত মুখগুলো। কাল বিশ্ববিদ্যালয়ে ভর্তি পরীক্ষার রেজাল্ট দিয়েছে। কাছের বন্ধুরা প্রায় সবাই কোনো না কোনো বিভাগে সুযোগ পেয়েছে, কিন্তু রিনির রোল নম্বর কোথাও নেই! একে তো এ জন্য মন খারাপ নিয়ে ঘুমাতে যাওয়া, তার ওপর সকালে উঠেই ফেসবুকে বন্ধুদের ‘ফিলিং হ্যাপি’, ‘ফিলিং এক্সাইটেড’-জাতীয় পোস্ট দেখে মনটা আরও খারাপ হয়ে গেল। সে ভাবতে লাগল, জগতের সবাই সফল, সুখী একমাত্র আমি ছাড়া।
সুজন কাজ করে একটা ছোট বেসরকারি প্রতিষ্ঠানে। ইদানীং ফেসবুক খুললেই তার মেজাজটা খারাপ হয়ে যায়। সেখানে সে দেখতে পায় তার বন্ধুরা একটার পর একটা বহুজাতিক প্রতিষ্ঠানে চাকরি বদলাচ্ছে। কিছুদিন পরপরই দেশ-বিদেশে ঘুরতে যাওয়ার ছবি দিচ্ছে, নিত্যনতুন রেস্তোরাঁ বন্ধুদের নিয়ে খেতে যাচ্ছে। এমনকি তার সবচেয়ে পছন্দের মানুষের সঙ্গে তারই বন্ধুরা আড্ডায় মেতে উঠছে। কখনো সুজন দেখে তারা অনেকে তারকাদের সঙ্গে হাস্যোজ্জ্বল ছবি তুলে পোস্ট করছে। ফেসবুকে এসব দেখতে দেখতে তার মনে হয় পৃথিবীতে সে-ই একমাত্র ব্যর্থ মানুষ, অন্যরা কত সফল। বিষাদগ্রস্ত হয়ে পড়ে সে।
ফেসবুকের এই সুখের ঝড়ে অনেকের মনেই বিষণ্নতা বাসা বাঁধে। আরেকজনের সফলতা আর সুখের কাহিনি দেখতে দেখতে নিজেকে মনে হয় ব্যর্থ আর অসুখী। নিজের সম্পর্কে একধরনের নেতিবাচক ধারণা জন্ম নেয়। নিজেকে ছোট আর হীন মনে হতে থাকে।
কেন এমনটা হয়
ফেসবুক বা অন্যান্য সামাজিক যোগাযোগমাধ্যম হচ্ছে ব্যবহারকারীর ইচ্ছাধীন। প্রত্যেক ব্যবহারকারী নিজের ইচ্ছেমতো সেটিকে সাজিয়ে তোলেন। এগুলোর মাধ্যমে নিজেকে অন্যের কাছে তুলে ধরে। ফলে ‘প্রকৃত আমি’র চেয়ে ‘সাজানো আমি’ বা ‘ডেকোরেটেড সেলফ’ ফেসবুককে ভরিয়ে তোলে। এসব দেখে অন্যরা কিন্তু একজন ব্যক্তি সম্পর্কে খণ্ডিত ধারণা পায়—এই খণ্ডিত ধারণা কেবল অন্যের সুখ আর সাফল্যের বয়ানমাত্র। কারও ব্যর্থতা বা পরাজয়ের চিত্র সাধারণত ফেসবুকে ঠাঁই পায় না। এদিকে যারা সেগুলো দেখছে, তারা নিজেদের সফলতা-ব্যর্থতা সবকিছুর সঙ্গে সেই আপাতসুখী আর সফল বন্ধুদের তুলনা করে বিষণ্ন হতে থাকে। ভাবে, ‘জগতে সবাই ভালো আছে, আমি ছাড়া’ কারণ বন্ধুদের খারাপ থাকার অংশ, পরাজয়ের তিক্ততা আর অপমানগুলো তার কাছে অজানা থাকে, নিজের ব্যর্থতা আর হতাশা তাকে পীড়া দেয় প্রতিনিয়ত।
কারেন্ট অপিনিয়ন অন সাইকোলজি, জুন ২০১৬-তে প্রকাশিত এক গবেষণা ফলাফলে দেখা যায়, অন্যের সঙ্গে ‘সামাজিক তুলনা’র কারণে ফেসবুক ব্যবহারকারীদের একটা বড় অংশ বিষণ্নতায় ভোগে। একজনের ‘পজিটিভ সেলফ পোট্রে৴ট’ আরেকজনের মধ্যে ঈর্ষার জন্ম দেয়, বিষাদগ্রস্ত করে তোলে—কারণ সেই ‘পজিটিভ সেলফ পোট্রে৴ট’-এর মধ্যে পরাজয়ের গল্পটাকে লুকিয়ে রাখা হয়। ২০১৬ সালে ডেনমার্কের কোপেনহেগেনে ১ হাজার ৯৫ জন ফেসবুক ব্যবহারকারীর মধ্যে গবেষণা চালিয়ে দেখা গেছে, যারা গবেষণাকালীন ফেসবুক ব্যবহার বন্ধ রেখেছিল, তাদের মধ্যে বিষণ্নতার হার কম।
যুক্তরাষ্ট্রে পরিচালিত আরেক গবেষণায় দেখা যায়, ফেসবুক ব্যবহারকারীদের মধ্যে ২৫ শতাংশ বিষণ্নতায় ভুগছে,¦যার মূল কারণ হিসেবে চিহ্নিত হয়েছে ঈর্ষাকাতরতা থেকে সৃষ্ট হতাশা। আমেরিকান একাডেমি অব পেডিয়াট্রিকস কিশোর-কিশোরীদের মধ্যে এই ধরনের বিষণ্নতাকে ‘ফেসবুক ডিপ্রেশন’ হিসেবে চিহ্নিত করেছে। কাছের মানুষের সাফল্যে প্রায় সবাই খুশি হয়, কিন্তু যারা একাকিত্বে ভুগছে, হতাশায় নিমজ্জিত আছে, তারা কিন্তু বিষণ্নতায় আক্রাত্ম হতে পারে।
অন্যের সফলতার চিত্র, যা আসলে খণ্ডিত, সেগুলো দেখে বিষণ্ন হওয়াটা বৈজ্ঞানিকভাবে প্রমাণিত সত্য। আরেকজনের এই টুকরো সফলতার চিত্র দেখে ‘সোশ্যাল কমপারিজন’ বা সামাজিক তুলনা করতে করতে নিজের সম্পর্কে নেতিবাচক মনোভাব তৈরি হয়, হতাশা বোধ হতে থাকে—একপর্যায়ে বিষণ্নতা জন্ম নেয়। এমনকি ফেসবুকের কোনো কোনো পোস্ট আরেকজনকে আত্মহত্যার জন্যও প্ররোচিত করতে পারে।
সমাধান কী
অন্যের সুখ দেখে ঈর্ষাকাতর হয়ে, হতাশ হয়ে, নিজেকে ছোট মনে করে বিষণ্নতা হওয়া থেকে বাঁচতে হলে নিজের মধ্যে কিছু বিষয়ের চর্চা করা প্রয়োজন।
‘মাইন্ডসেট’ পাল্টান
ফেসবুক মানেই জীবন নয়। এর বাইরে আরেকটা বড় বাস্তব জীবন রয়েছে। তাই ফেসবুককে পৃথিবী ভাবা চলবে না। প্রকৃত পৃথিবীর চিত্র কিন্তু ফেসবুক থেকে আলাদা।
আত্মবিশ্বাস বাড়ান
নিজেকে আত্মবিশ্বাসী করতে সামাজিক দক্ষতা বাড়াতে থাকুন। সফলতার পাশাপাশি ব্যর্থতাকে মেনে নিতে শিখুন। হতাশ না হয়ে পরবর্তী লক্ষ্য স্থির করুন।
যা দেখছেন, তা-ই সব নয়
একজনের জীবনের যে চিত্র আপনি ফেসবুকে দেখছেন, সেটা দিয়ে তাকে মূল্যায়ন করবেন না। প্রকৃত সে কিন্তু ফেসবুকে প্রকাশিত অংশের চেয়ে অনেক আলাদা। মনে রাখবেন, মস্তিষ্কের ‘রিওয়ার্ড সেন্টার’কে তৃপ্ত করতে ‘লাইক’ আর ‘কমেন্টস’-এর জন্য সে যা প্রকাশ করছেন, তা অনেকটাই সাজানো, তা হয়তো সর্বাঙ্গীণ সত্য; কিন্তু সেটি আরও অনেক সত্যকে আড়াল করে আপনার সামনে উপস্থাপিত হয়েছে।
বিকল্প পথে চারপাশকে জানুন
বই পড়ুন, আড্ডা দিন, বেড়াতে যান। বন্ধু-স্বজনদের সঙ্গে মুখোমুখি আলাপ করুন। এতে চারপাশকে অনেক বিস্মৃতভাবে জানতে পারবেন। জানতে পারবেন প্রত্যেকের সফলতা আর ব্যর্থতাগুলোকে।
সময় ব্যবস্থাপনা
ফেসবুকে বেশি সময় কাটালে আপনার পেশাগত জীবন বা পড়ালেখার সময় কমে যাবে। পারিবারিক সম্পর্কগুলো হালকা হতে থাকবে। তখন দেখা যাবে, আপনি একাকিত্বে ভুগছেন—সঙ্গী কেবল ফেসবুক। এই সময়টা দারুণ ঝুঁকিপূর্ণ। নিজের কোনো ব্যর্থতা বা হতাশার মাঝে বন্ধুদের কোনো সফলতা দেখলে আপনি তখন সহজেই বিষণ্নতায় আক্রান্ত হবেন।
দায়িত্ব আছে সবারই
নিজের সফলতা আর বাঁধভাঙা উচ্ছ্বাস, আনন্দের ছবি বা স্ট্যাটাস পোস্ট করার সময় সচেতন থাকবেন যে কাছের কাউকে আপনি আঘাত দিয়ে ফেলছেন কি না। আপনার এই পোস্টে কেউ ঈর্ষাকাতর হতে পারে কি না, কারও মধ্যে তীব্র হতাশা বা বিষণ্নতা হতে পারে কি না। এসব বিবেচনায় এনে পরিশীলিতভাবে ফেসবুক ব্যবহার করুন।
মনে রাখবেন, যাপিত জীবনের সবটাই স্বপ্নে ভরা নয়
‘আছে দুঃখ, আছে মৃত্যু, বিরহ দহন লাগে’। তা যেমন আপনার জীবনে সত্য, তেমনি অন্যের জীবনেও সত্য। তাই ফেসবুকে আরেকজনের আপাতসফল আর সুখের টুকরো চিত্র দেখে মন খারাপ করবেন না। আপনার জীবনেও সফলতা আছে—সফলতা আসবে। তাই ধৈর্য ধরুন, স্থির থাকুন। এমনভাবে আত্মবিশ্বাসী হন, যাতে ফেসবুকে আরেকজনের খণ্ডিত সুখের ঝড় আপনাকে উড়িয়ে নিতে না পারে।