Daffodil International University
Entertainment & Discussions => Story, Article & Poetry => Topic started by: Shakil Ahmad on June 20, 2017, 11:16:52 PM
-
আমাদের পাহাড় তার বুকের চাপ চাপ মাটি ধসিয়ে চাপা দিয়ে মানুষ হত্যা করেছে, সে দুঃখে মানুষ কাঁদে। কিন্তু পাহাড়ের দুঃখে কাঁদবার কেউ নেই। পাহাড়ের দুঃখে শুধু পাহাড় একাই কাঁদে। তবে সে কাঁদে নিঃশব্দে। সে কান্নার আওয়াজ কারও কানে যায় না। অথবা দেশের মানুষের কান নেই বলে তার কান্না শোনে না, চোখ নেই বলে পাহাড়ের দুঃখের চেহারাটি দেখতে পায় না।
মানুষ পাহাড়ের ক্ষতি করে বলে পাহাড়ও মানুষের ক্ষতি করে। তাহলে পাহাড়ও কি প্রতিহিংসাপরায়ণ মানুষের মতো? রাজনৈতিক নেতাদের মতো?
মানুষ প্রতিদিন পাহাড়ের ক্ষতি করে, পাহাড় করে বছরে এক দিন। যখন সে আঘাত ও অত্যাচার সইতে সইতে আর তিষ্ঠতে পারে না, তখন পাহাড় মানুষের ওপর তার রাগ ঝাড়ে। পাহাড়ের নির্মমতা মানুষের চোখে পড়ে, কিন্তু পাহাড়ের প্রতি মানুষের নির্মমতা মানুষের চোখে পড়ে না। এবার পাহাড়ে যে ভূমিধস হয়েছে, তার সঙ্গে শুধু রানা প্লাজা ধসেরই তুলনা চলে। রানা প্লাজা নিজে ধসে পড়েনি। মানুষ তাকে ধসে পড়তে বাধ্য করেছিল স্তম্ভ নাড়াচাড়া না করলেও। পাহাড়ও নিজে ধসতে চায়নি। মানুষ তাকে বাধ্য করেছে ধসে পড়তে।
বাংলার মাটিতে যা ঘটে, পৃথিবীর অন্য কোনো দেশে তা ঘটে না। বাংলাদেশেই সব কটি জেলায় সিরিজ বোমা একসঙ্গে বিস্ফোরিত হয়। এবার একক নয়, এবার সিরিজ পাহাড়ধস হলো। পাহাড় দেখিয়ে দিল—আমরাও ঐক্যবদ্ধ হয়ে মানুষের ওপর আঘাত হানতে পারি এবং সে আঘাত খুবই নির্মম। পাহাড় জানিয়ে দিল, মানুষের মতো আমরাও নিষ্ঠুর এবং আমরাও নরঘাতক।
পাঁচটি জেলায় একযোগে পাহাড়ধসে দেড় শতাধিক মানুষের প্রাণহানির ঘটনা বিরল। বর্ষা মৌসুমে টানা বর্ষণ এই নতুন নয়। কমবেশি প্রতিবছরই হয় এবং তা হচ্ছে হাজার হাজার বছর ধরে। দুর্গম অঞ্চলের পাহাড় ধসে না, পাহাড় ধসে লোকালয়ের।
গত দশ বছরে চট্টগ্রাম, রাঙামাটি, বান্দরবান, কক্সবাজার প্রভৃতি জেলায় পাহাড়ধসে হাজারখানেক মানুষের প্রাণহানি ঘটেছে। সবচেয়ে ভয়াবহ পাহাড়ধস ঘটে ২০০৭ সালে। মাটিচাপায় ১২৭ জন মানুষ নিহত হন। পরিবেশকর্মীদের পরামর্শে গুরুত্ব না দিলেও সেবারের পাহাড়ধসের পর সেনাসমর্থিত সরকার কিঞ্চিৎ সচেতন হয়। তারপর পাহাড় সম্পর্কে কিছু পরিকল্পনা গ্রহণ করে বলে শোনা যায়। পাহাড়ধস প্রতিরোধে সার্বক্ষণিক নজরদারির জন্য টিম গঠনের কথাও শোনা গিয়েছিল। পরবর্তীকালে সেই টিমের দেখা কেউ পেয়েছে, এমন কথা পাহাড়ে বসবাসকারীরা হলফ করে বলতে পারবেন না।
যদি বলা হয় লোকচক্ষুর আড়ালে অতি গোপনে সেই টিমের লোকেরা কাজ করেন, তা করতে পারেন এবং তা অবিশ্বাস্য নয়। পর্যবেক্ষণ টিমের সদস্যরা বলতে পারেন, আমরা লোক মাত্র কয়েকজন, আমাদের সাধ্য নেই হাত দিয়ে ঠেলা দিয়ে প্রবল পাহাড়ধস ঠেকাই। সে কথাও বিশ্বাসযোগ্য। কিন্তু পাহাড়ের ঢালুর বিপজ্জনক জায়গায় গাছপালা কেটে বসতি গড়ে উঠছে—সেই দৃশ্য কি তাঁদের চোখে পড়েনি? পড়ে থাকলে সে ব্যাপারে তাঁরা কাকে রিপোর্ট দিয়েছিলেন? রিপোর্ট দিয়ে থাকলে সে বিষয়ে কর্তৃপক্ষ কী ব্যবস্থা নিয়েছিল? বেতন-ভাতা দিয়ে রাষ্ট্র যখন লোক নিয়োগ দেয়, তখন তা দেয় তাঁদের দিয়ে কাজ করানোর জন্য। ঘুরে বেড়ানোর জন্য নয়।
ভূবিজ্ঞানীরা বলবেন, বাংলাদেশের পাহাড় কঠিন শিলায় গঠিত নয়। তা হতেই পারে। আমাদের পাহাড়গুলো কঠিন শিলারই হওয়া উচিত ছিল, যেখানে কোদালের কোপ বসানো সম্ভব নয়। তাহলে রাতের অন্ধকারে পাহাড়ে মাটি চুরি সম্ভব হতো না।
পাহাড়কে মানুষ আগে আঘাত হেনেছে, তারপর প্রতিশোধ নিতে পাহাড় আঘাত করছে মানুষকে। বেআইনিভাবে যথেচ্ছ পাহাড়ের মাটি কাটা রোধ করা যায় না, তা বিশ্বাসযোগ্য নয়। পাহাড়ের গাছপালা কেটে সাবাড় করছে যারা, তাদের শায়েস্তা করার ক্ষমতা ও দক্ষতা আইন প্রয়োগকারী সংস্থার নেই, তা অবিশ্বাস্য; বিশেষ করে সেই আইন প্রয়োগকারী সংস্থা, যা হাজার হাজার বিরোধীদলীয় নেতা-কর্মীর কোমরে দড়ি বেঁধে শ্রীঘরে ঢোকাতে সক্ষম।
২০০৭ সালে চট্টগ্রাম অঞ্চলে পাহাড়ধসে ১২৭ জন নিহত হওয়ার পর সরকার গঠন করে ‘পাহাড় ব্যবস্থাপনা কমিটি’। পরিবেশবাদীদের পরামর্শ সরকার শুনতে বাধ্য নয়, কিন্তু উচ্চ আদালতের রায় বাস্তবায়ন সরকারের নৈতিক দায়িত্ব। পরিবেশবাদীদের আরজির পরিপ্রেক্ষিতে হাইকোর্ট পাহাড় কাটার ওপর নিষেধাজ্ঞা জারি করেন। কিন্তু তা কার্যকর করতে পারেনি প্রশাসন। মনে হয় আমাদের উচ্চ আদালতের চেয়ে প্রভাবশালীরা বেশি ক্ষমতাবান। আইন-আদালত অগ্রাহ্য করার ক্ষমতা তাঁরা রাখেন। বেআইনি কাজকর্ম করতে তাঁদের লাজলজ্জার লেশমাত্র নেই। পাহাড় নাকি এখন অনেকের ব্যক্তিগত সম্পত্তি।
পাহাড় রক্ষায় পরিবেশকর্মীরা শীতাতপনিয়ন্ত্রিত কক্ষে আলোচনা করেছেন, প্রখর রৌদ্রে ও প্রবল বর্ষণের মধ্যে রাস্তায় মানববন্ধন করেছেন, প্রশাসনের পায়ে ধরেছেন, কোনো কাজ হয়নি। তা যদি হতো তাহলে এক দশকে এক হাজার মানুষ বেঘোরে প্রাণ দিত না।
পরিবেশবাদীরা সরকার থেকে জামাই-আদর আশা করেন না। তাঁরা চান তাঁদের পরামর্শের যথাযথ মূল্যায়ন করুক সরকার। কিন্তু দুঃখজনক ব্যাপার হলো, পরিবেশকর্মীরা প্রশাসন থেকে যে আচরণ পান, তা বাংলার কোনো সতিনের ছেলেও তার সৎমার কাছ থেকে পায় না। পরিবেশবাদীরা যে সরকারের শত্রু নন, সরকারকে সহায়তাকারী কর্মী মাত্র, তা বোঝার মতো বোধ নীতিনির্ধারকদের আছে বলে মনে করার কারণ নেই। তা যে নেই, তার প্রমাণ রামপাল কয়লাভিত্তিক তাপবিদ্যুৎকেন্দ্র প্রকল্প। লাখো বছরের বিশ্ব ঐতিহ্য সুন্দরবনের নিয়তি যা-ই হোক, আমরা বিদ্যুৎ চাই।
পাহাড় ও বনভূমি সব শ্রেণির মানুষের কাছে নিরাপদ নয়। পাহাড়-বনভূমি রক্ষা করতে পারে তারাই, যারা পাহাড় ও বনভূমির মর্ম বোঝে। তারাই বোঝে হাজার বছর ধরে যাদের জীবন পাহাড়ের প্রাকৃতিক জীবনধারার সঙ্গে যুক্ত। যারা পাহাড় চেনে, পাহাড় যাদের চেনে। সমতলের অচেনা মানুষ পাহাড়ে গিয়ে অনাচার শুরু করলে পাহাড়ের পক্ষে প্রতিহিংসাপরায়ণ হয়ে ওঠা অস্বাভাবিক নয়। এবার পাহাড়গুলোতে যা ঘটেছে, তাকে স্রেফ প্রাকৃতিক দুর্যোগ বললে অসত্য বলা হয়। পাহাড়কে নিরপরাধ বলব না, কিন্তু তার অপরাধের পরিমাণ যা, আমাদের অপরাধ তার চেয়ে কম নয়।
পাহাড়ি এলাকায় অবকাঠামো উন্নয়নে পরিকল্পনাবিদদের যে দূরদর্শিতা থাকা দরকার, তা লক্ষ করা যায়নি গত চার দশকে। আশির দশক থেকে পাহাড়ি এলাকায় রাস্তাঘাট নির্মাণে ভূপ্রকৃতির বৈশিষ্ট্য বিবেচনা করা হয়নি। রাস্তাঘাট বানাতে গিয়ে পাহাড়ের কার্নিশ কাটা হয়। তাতে পাহাড়ের মাটি আলগা হয়ে যায়। সরেজমিনে দেখে আমাদের মতো অনভিজ্ঞ লোকেরও ধারণা হয়, সড়ক নির্মাণে পাহাড়ের মারাত্মক ক্ষতি হয়েছে।
সাধারণত সড়কের পাশেই মানুষ গৃহ নির্মাণ করে বসতি স্থাপন করে। বসতি স্থাপন করতে গিয়ে যথেচ্ছ অনাচার হয় পাহাড়ের প্রতি। দরিদ্র সহায়-সম্বলহীন মানুষদের থেকে সচেতনতা আশা করা যায় না। পাহাড়ে গর্ত করে মাটি চুরি করা হয়। মাটি চোরদের ঠেকানোর কোনো কর্তৃপক্ষ নেই। স্থানীয় প্রশাসন তো কিছুই করে না, স্থানীয় সরকারের প্রতিনিধিদেরও ওসব ব্যাপারে মাথাব্যথা নেই। তাঁরা ব্যস্ত প্রকল্পের বরাদ্দ প্রভৃতি নিয়ে।
রিলিফ চোর আগেও ছিল, এখনো আছে। বরং সংখ্যায় বেড়েছে। তাদের সঙ্গে যোগ হয়েছে বনের কাঠ চোর, নদীর বালু চোর, পাহাড়ের মাটি চোর প্রভৃতি। প্রশাসনের ঘুষখোর আর বিভিন্ন ঘরানার চোর যখন হাত মেলায়, তখন প্রাকৃতিক দুর্যোগের প্রয়োজন হয় না। মানবসৃষ্ট দুর্যোগ তখন মানুষের ক্ষতি করবেই।
বাংলাদেশ ধনী দেশ হতে যাচ্ছে। সেই লক্ষে্য সে ধাবিত ঊর্ধ্বশ্বাসে। বাংলায় এখন আর ছিঁচকে চোর নেই বললেই চলে। সিঁধেল চোরের প্রজাতিটিও বিলুপ্তপ্রায়। কিন্তু জাতীয় সম্পদ চোরের বিভিন্ন প্রজাতির প্রাদুর্ভাব ঘটেছে ব্যাপকভাবে।
ভেনেজুয়েলা, মরক্কো বা গুয়াতেমালার পাহাড়ধস আর বঙ্গীয় পাহাড়ধসের পার্থক্য পর্বতসমান। ভূমিকম্পেও পাহাড়-পর্বতধস হয়। তাতে মানুষের দোষ নেই। কিন্তু যে দেশে পাহাড়ে গাছপালা ও মাটি কেটে সাবাড় করা হয়, সেখানকার পাহাড়ধসের জন্য দায়ী বিধাতাও নন, পাহাড়ও নয়। জনমানবহীন দুর্গম এলাকায় কেন পাহাড়ধস হয় না। লোকালয়ের নিকটবর্তী পাহাড়ই কেন ভেঙে পড়ে ঘুমন্ত মানুষের ওপর?
ঘূর্ণিঝড়, জলোচ্ছ্বাস প্রভৃতি যে প্রাকৃতিক দুর্যোগ, তার ব্যবস্থাপনায় আমরা অনেকটা সক্ষমতা অর্জন করেছি। সেনাবাহিনীর সদস্যরা জীবন দিয়ে ওই সব প্রাকৃতিক দুর্যোগে ত্রাণকাজ চালান। ঘূর্ণিঝড়, জলোচ্ছ্বাস ঠেকানোর ক্ষমতা মানুষের নেই, তা থেকে আত্মরক্ষার চেষ্টা মানুষের সাধ্যের মধ্যে। আমাদের পাহাড়ধসকে ষোলো আনা প্রাকৃতিক দুর্যোগ বলা যায় না। এটা আমাদের পাপের শাস্তি। এবারের পাহাড়ধসে উদ্ধার অভিযান চালাতে গিয়ে সেনাবাহিনীর কর্মকর্তা ও সদস্যদের যে প্রাণহানি ঘটেছে,
তা নতুন বিপদ। সুতরাং বড় বিপর্যয় রোধ করতে হলে পাহাড়ে মানবিক অনাচার বন্ধে ব্যবস্থা গ্রহণ অত্যন্ত জরুরি।
সৈয়দ আবুল মকসুদ: লেখক ও গবেষক।