Daffodil International University

Faculties and Departments => Faculty Sections => Topic started by: provakar_2109 on July 17, 2018, 12:13:39 PM

Title: এনিগমা কোডের পাঠোদ্ধারের নেপথ্যে থাকা ৪ নারীর গল্প
Post by: provakar_2109 on July 17, 2018, 12:13:39 PM
১৯৩৯ সালে সংঘটিত হওয়া দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধ শুধু গোলাবারুদের যুদ্ধ ছিল না।তার চাইতে আরো বেশি কিছু ছিলো। বিজ্ঞান আর প্রযুক্তির চরম বিকাশ সাধন হয়েছিল। অক্ষশক্তি আর মিত্রপক্ষ একে অপরের বিজ্ঞান আর প্রযুক্তির দ্বারা যুদ্ধকে জটিলতর করে তুলছিল। দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধে ব্যবহৃত তেমন একটি প্রযুক্তি ছিল এনিগমার ব্যবহার। নিজেদের মধ্যে যোগাযোগের জন্য হিটলারের নাৎসি বাহিনী দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধের সময় রেডিও বার্তা ও মোর্স কোডের ব্যবহার করতো। এ বার্তাগুলো একস্থান হতে অন্য স্থানে পাঠানো হতো। স্বভাবতই সেসবে থাকতো স্পর্শকাতর ও গুরুত্বপূর্ণ নানা তথ্য।

কিন্তু ধীরে ধীরে রেডিওর মাধ্যমে যোগাযোগ খুবই দুর্বল হয়ে পড়ে। শত্রুপক্ষ সহজেই ট্রান্সমিশন হ্যাক করে ফেলতো। যার ফলে জার্মান বিজ্ঞানী আর্থার শ্যাবিয়াসের তৈরি করা এনিগমা নামক ডিভাইসটি তারা ব্যবহার করেন। এই এনিগমা ডিভাইসের সাহায্যে বার্তাকে কোডে রুপান্তর করে নাৎসি বাহিনীর সদস্যরা নিজেদের মধ্যে যোগাযোগ করতো। আর মিত্রপক্ষের কাজ ছিলো এনিগমা কোডের পাঠোদ্ধার করা এবং শত্রুদের পরিকল্পনা জেনে তা নসাৎ করা। এই কাজে অনবদ্য ভূমিকা রাখেন এমন ব্যক্তিত্বদের মধ্যে প্রথমেই যাদের নাম আসে তাদের মধ্যে অ্যালান টিউরিং ছিলেন অন্যতম। এরপর আসে টমি ফ্লাওয়ারের নাম।

কিন্তু এনিগমা কোডের পাঠোদ্ধারের এই যাত্রাতে নারীদের ভূমিকা ছিল উল্লেখযোগ্য। যাদের কথা ইতিহাসে তেমনভাবে উল্লেখ নেই। অথচ অ্যালেন টিউরিং এর এই মিশনে নারীদের ভূমিকা ছিল চোখে পড়ার মতো।

এনিগমা কোড পাঠোদ্ধারের কাজটা মোটেও সহজ ছিল না। খুব গোপনে বড় একটি প্রজেক্ট নেওয়া হয় এ অসাধ্য সাধন করতে। সেখানে অন্তত দশ হাজার মানুষ তাদের মেধা ও শ্রম দিয়েছিল। তাদের এই কাজ ব্লেচলি পার্কের একটি ভবনে সম্পন্ন হতো। এই দশ হাজার মানুষের মধ্যে দুই-তৃতীয়াংশই ছিল অল্পবয়সী নারী। তারাই নিজেদের জীবনের সবচেয়ে গুরুত্বপূর্ণ সময়টুকু ব্যয় করেছে এই প্রজেক্টে। নানা স্বার্থে ব্রিটিশ সরকার এই প্রজেক্টের কথা গোপন রাখে। তাই এই নারীরা কখনো এই কাজের জন্য কোনো স্বীকৃতি পাননি।

সেসকল নারীর কথা ও তাদের অবদান জানার আগে এনিগমা কোড নিয়ে কিছুটা ধারণা নেয়া যাক।

এনিগমা কোড কী? এনিগমা যন্ত্রের সাহায্যে সাংকেতিক ভাষায় যা লিখতে পারা যেত সেই সাংকেতিক ভাষাই হলো এনিগমা কোড। এনিগমা যন্ত্র দিয়ে যা লেখা হত তা এর ভেতরের কৌশল দ্বারা এলোমেলোভাবে সাজিয়ে দেয়া হত। এনিগমাতে একধরনের চাকতি ছিল, যা রোটর নামে পরিচিত। এই রোটর ছিল যন্ত্রের প্রধান অংশ। এনিগমার কীবোর্ডে যে অক্ষর টাইপ করা হত, এনিগমার এই রোটর সেই অক্ষরগুলোকে অন্য অক্ষর দ্বারা উল্টে পাল্টে দিত। ১৯৩০ সালে এতে নতুন করে প্লাগবোর্ড যুক্ত করে আরো উন্নত করা হয়। এ প্লাগবোর্ডে যে অক্ষর টাইপ করা হতো তা ভেতরে সে অক্ষর হিসেবে না গিয়ে অন্য আরেকটি অক্ষর হিসেবে যাতে রোটরে যায়, সেই ব্যবস্থা করতো। ধরুন, আপনি যে লেখাটা পাঠাতে চাইবেন সেটি আপনাকে কীবোর্ডে লিখতে হবে। প্রত্যেকটা অক্ষর লেখার পর রোটর ঘুরতে থাকবে। জটিলতা আনার জন্য রোটর প্রত্যেকটা অক্ষরকে একটা মেসেজ হিসেবে নিত, যার ফলে পুরো লেখাটা আলাদা আলাদাভাবে এনক্রিপ্ট (লিপিবদ্ধ) করতে হতো।

ধরে নেয়া যাক, কেউ APPLE শব্দটি এনিগমায় এনক্রিপ্ট করতে চাইলো। সেক্ষেত্রে এনিগমায় 'APPLE' লিখলে রোটর সাথে সাথে ঘুরে গিয়ে আউটপুট আসতে পারে ‘BQQMF’ । এখানে A=B, P=Q, L=M, E=F ব্যবহার করা হয়েছে, অর্থাৎ ইংরেজি বর্ণমালা একঘর করে পিছিয়ে দেয়া হয়েছে।

এ তো উদাহরণ ছিল মাত্র। জার্মানরা এনিগমাতে অতিরিক্ত দুটি রোটর যুক্ত করে এনিগমা কোডকে আরো জটিল করে তোলে এবং এই সংকেতের সাহায্যে তারা সব নির্দেশনা আদান-প্রদান করতো। তারা ভাবতো তাদের এ মেশিনের বার্তা কেউ কখনো ভাঙতে পারবে না।

কিন্তু সেসময় মিত্রপক্ষের ব্রিটিশ ও ফরাসি ক্রিপ্টোলজিস্টের (যারা গোপনীয় সংকেত ভিত্তিক বিষয়ের চর্চা করতেন) দল এসব বার্তা উদ্ধার করতে পেরেছিলেন। কিন্তু দিনকে দিন সংকেতগুলো জটিল করা হচ্ছিল। যেমন- অনেক মাথা খাটিয়ে কেউ নাৎসি বাহিনীর কোড পেয়ে তার কোন অক্ষরের জন্য ঠিক কোন অক্ষর বসানো হয়েছে সেই প্যাটার্ন ধরে ফেললো। ধরা যাক, কোডের প্রথম অক্ষর রোমান হরফ 'ডি’ এর জন্য ‘জেড’ বসানো হয়েছে। এটি ধরতে পেরে খুশিমনে কোডের বাকি অংশের যেখানেই ’ডি’ পাওয়া গেল সেখানেই 'জেড' বসিয়ে দিল। পরে দেখা গেল কোনো অর্থ পাওয়া গেলো না! কেন? কারণ পরের 'ডি’ এর জন্য অন্য কোনো অক্ষর হয়তো বসানো হয়েছে। তার মানে মাথা খাটিয়ে পুরো বার্তার অর্থ উদ্ধার করা একজন মানুষের পক্ষে একদম অসম্ভব। তার উপর প্রতিদিন নতুন উপায়ে বার্তা প্রেরণ করতো নাৎসিরা। তার মানে সারাদিন ব্যয় করে পূর্ণাঙ্গ কোড ব্রেক করার ফর্মুলা পেয়ে গেল মিত্রপক্ষ, এই আনন্দে ধেই ধেই করে নাচতে গেলেই বিপত্তি। কারণ পরদিনেই ওই ফর্মুলা আর কাজে আসবে না।

মূলত বিখ্যাত গণিতবিদ অ্যালান টিউরিং এ অসাধ্য সাধনের জন্য ‘বম্ব’ নামের যে যন্ত্র তৈরি করেন, সেটাই এনিগমার কোড ভাঙতে সক্ষম ছিল। তার যন্ত্রে অনেকগুলো ঘূ্র্ণায়মান ড্রাম ছিল, যেগুলো অনেক উচ্চগতিতে এনিগমার সংকেতের অর্থ খুঁজতো। ‘বম্ব’ এর চালকদের এনিগমার কোড দেওয়া হত এবং তারা ‘বম্ব’ এর সাহায্যে অর্থ উদ্ধার করতো। আর এই কাজে অগিত নারী যুক্ত ছিলো।

এবার গুরুত্বপূর্ণ এসব কাজে নিয়োজিত নারীদের মধ্যে চারজন নারীর অভিজ্ঞতার কথা জানা যাক। যারা এনিগমা কোড পাঠোদ্ধারে অসামান্য ভূমিকা রেখেছিলেন।

প্যাট্রিসিয়া ডেভিস
নিগমা কোড পাঠোদ্ধারের প্রথম গুরুত্বপূ্র্ণ ধাপ ছিল কোডগুলোকে সঠিকভাবে লিপিবদ্ধ করা। রেডিও সিগন্যালের মাধ্যমে নাৎসিরা সেগুলো নিজেদের মধ্যে আদানপ্রদান করতেন। সেসব কোড শুনতে মিত্রপক্ষকে সংকেত ধরার স্টেশন স্থাপন করত হতো যুদ্ধক্ষেত্রের কাছাকাছি, যাতে সিগন্যালগুলো ভালোভাবে পাওয়া যায়।

এমন স্টেশনে কাজ করার অভিজ্ঞতা ছিল ১৯ বছর বয়সী প্যাট্রিসিয়া ডেভিসের। তার সঙ্গে আরো শত শত নারী শ্রোতা হিসেবে কাজ করতো। ইংলিশ চ্যানেলের ডোভার বন্দরের উপকূলের সেই স্টেশনে তারা পালা করে জার্মান যুদ্ধজাহাজ থকে পাঠানো কোড শুনতেন ও তা লিপিবদ্ধ করে রাখতেন। তারপর সেগুলো ইংল্যান্ডের ব্লেচলি পার্কের ডিসাইফার স্টেশনে পাঠাতেন। প্যাট্রিসিয়া তার এক সাক্ষাৎকারে বলেন, “সবচেয়ে কঠিন সময়টা ছিল তখন, যখন আপনি জানছন যে জাহাজটি থেকে বার্তা পাঠানো হচ্ছে কিন্তু আপনি চেষ্টা করেও সেটা শুনতে পারছেন না, কারণ দ্যুর্ভাগ্যবশত সেটি অস্পষ্ট আর ম্লান হয়ে যাচ্ছিল। বিষয়টা ছিল ভীষণ হতাশাজনক।’’

রুথ বর্ন
ইংল্যান্ডের দক্ষিণ-পূর্বের ব্লেচলি পার্কে গণিতবিদ অ্যালান টিউরিং এনিগমা কোড উদ্ধারের জন্য একটি ব্রেকিং কেন্দ্র পরিচালনা করেছিলেন। দুই থেকে ছয় হাজার গুপ্ত সংকেত পরিচালনার জন্য তখন সময় পাওয়া যেত মাত্র একদিন। বৃহৎ এ কর্মযজ্ঞে সেজন্য যুক্ত হয়েছিল আট হাজার কোড ব্রেকার। কর্মী ছিল আরো চার হাজার মানুষ। অ্যালান টিউরিংয়ের তৈরিকৃত ‘বম্ব’ ডিভাইসগুলো পরিচালনার জন্য হাজার হাজার কর্মীর প্রয়োজন ছিল।

অষ্টাদশী রুথ বর্ন তাদেরই মধ্যে একজন। তার কাজ ছিল বম্বগুলো চালু রাখা এবং প্রয়োজন মতো সেটিংয়ে পরিবর্তন আনা। কলেজ থেকে সদ্য বের হওয়া রুথ ছিলেন উইমেন্স রয়্যাল নেভাল সার্ভিসের একজন সদস্য। প্রতিদিন আট ঘন্টার শিফটে তিনি মেশিনগুলোর রোটর পরিবর্তন, শর্টসাকির্ট প্রতিরোধে ব্যবস্থা নেওয়া প্রভৃতি কাজ বিরামহীনভাবে করে যেতেন। এখানকার সবচেয়ে গুরুত্বপূর্ণ ব্যাপার ছিল গোপনীয়তা। এক ইউনিটের কথা অন্য ইউনিট জানতে পারতো না। এমনকি রুথের মা-বাবা মৃত্যুর আগেও জেনে যেতে পারেননি যে তাদের মেয়ে লাখো মানুষের প্রাণ বাঁচানোর মতো মহতী কাজ করে গেছেন।

আইরিন ডিক্সন
জার্মানরা এনিগমা কোডকে দিন দিন আরো কঠিন করে তোলে। সেটার সঙ্গে তাল মিলিয়ে কোড ব্রেকিংয়ের এই অপারেশনকেও আরো উন্নত করতে হয়। তারই ধারাবাহিকতায় ব্লেচলি পার্কে অ্যালানের সহকর্মী টম ফ্লাওয়ার নির্মাণ করেন প্রথম প্রোগামযোগ্য কম্পিউার ‘কলোসাস’। ১৯৪৪ সালে পূর্ব লন্ডনের তরুণী আইরিন ডিক্সন ‘কলোসাস’ এর একজন অপারেটর হিসেবে কাজ শুরু করেন। কলোসাস জার্মানিদের যেকোনো কোড ভাঙার জন্য অবিশ্বাস্য দ্রুতগতিতে কাজ করতো।

প্রাথমিক অবস্থায় কলোসাস প্রতি সেকেন্ডে ৫,০০০ ক্যারেক্টার পড়তে পারতো। যুদ্ধ শেষে ‘কলোসাস’কে গোপন রাখতে এর ডিজাইন ধ্বংস করে দেয়া হয়। আইরিন অপারেটর হওয়ার সুবাদে সেসময়কার বিখ্যাত কয়েকজন গণিতবিদের সঙ্গে কাজ করার সুযোগ পান। তাদের নির্দেশমতো তথ্য ইনপুট করতেন, যা সফলভাবে অসংখ্য সিক্রেট কোড উদ্ধার করতো। আইরিন এখানে প্রায় আট ঘন্টা কাজ করতেন। অত্যন্ত নিষ্ঠার সাথে তিনি এ কাজটি করতেন।

তিনি বলেন, “কলোসাসের যুক্ত অটোমেটিক টাইপরাইটারের ঠং ঠং আওয়াজটা আমি বেশ উপভোগ করতাম। কোড ভাঙার পর যখন অটোমেটিক টাইপরাইটার থেকে অর্থ উদঘাটিত হয়ে বের হয়ে আসতো, তখন ঠং ঠং আওয়াজ করে উঠতো। এর চেয়ে মধুর শব্দ আর কী হতে পারে!” কলোসাসকে পৃথিবীর প্রথম প্রোগামযোগ্য কম্পিউটার বলা হয়। আইরিন ডিক্সন ছিলেন কলোসাসের প্রথম অপারেটর। পৃথিবীর প্রথম প্রোগামযোগ্য কম্পিউটারের অপারেটর হওয়া সত্ত্বেও তার নাম তেমনভাবে উঠে আসেনি।

জোয়ান ক্লার্ক
পুরো নাম জোয়ান এলিজাবেথ লুথা মু’রে। জোয়ান ক্লার্ক নামেই  তিনি বেশি পরিচিত। তিনি ১৯১৭ সালে ইংল্যান্ডে জন্মগ্রহণ করেন। তিনি একজন ক্রিপ্টঅ্যানালিস্ট বা সংকেতবিদ্যায় পারদর্শী ছিলেন। এনিগমা কোড উদঘাটনের এই প্রজেক্টে তিনিও বড় ভূমিকা রেখেছিলেন। অ্যালান টিউরিংয়ের এই মিশনে জোয়ান ক্লার্ক ব্লেচলি পার্কের Hut8 সেকশনের দায়িত্বে ছিলেন। জোয়ান ব্লেচলির বিজ্ঞানীদের সাথে যুক্ত হয়ে কোডের কিছু সূত্র বের করে ফেলেন। তারা খেয়াল করে দেখলেন, প্রতিদিন ঠিক ছয়টায় জার্মানরা আবহাওয়ার রিপোর্ট পাঠায়, ব্যাপারটি ধরতে পেরে তারা সম্ভাব্য কিছু কীওয়ার্ড বের করে ফেলে, যেমন- weather, 6.00, heil hitler। এগুলো তারা প্রবেশ করায় ফলে কাজ আরো সহজ হয়ে যায়। জোয়ান ক্লার্ক বেশিরভাগ সময় অ্যালান টিউরিংয়ের সাথে কাজ করতেন। অথচ দুঃখজনক ব্যাপার হচ্ছে, পুরুষ সহকর্মীদের মতো কাঁধে কাঁধ মিলিয়ে কাজ করলেও নারী হওয়ার কারণে পুরুষ সহকর্মীদের তুলনায় অপেক্ষাকৃত কম পারিশ্রমিক পেতেন তিনি।

বলা হয়ে থাকে, এনিগমা কোড উদঘাটনের এই মিশনে সাফল্য লাভ করার ফলে দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধ চার বছর আগে শেষ হয়েছে এবং দুই কোটি মানুষের প্রাণ রক্ষা পেয়েছে। আর এই মিশনে নারীদের অবদান ছিল অসামান্য। কিন্তু আফসোসের ব্যাপার হলো তারা তেমনভাবে স্বীকৃতি পাননি।