Daffodil International University

Faculty of Science and Information Technology => Science and Information => Topic started by: provakar_2109 on March 31, 2019, 05:13:46 PM

Title: বিতর্কিত অপারেশন ব্লু-স্টার ও ইন্দিরা গান্ধী হত্যার ইতিবৃত্ত
Post by: provakar_2109 on March 31, 2019, 05:13:46 PM
ভারতের ইতিহাসে একটি করুণ, অনাকাঙ্ক্ষিত ও মর্মবিদারক ঘটনা প্রধানমন্ত্রী ইন্দিরা গান্ধীর হত্যাকাণ্ড। বাংলাদেশের স্বাধীনতা সংগ্রামে গোড়া থেকেই সমর্থন ও সহযোগিতা দিয়েছিলেন শ্রীমতী ইন্দিরা গান্ধী। মুক্তিযুদ্ধ চলাকালীন এক কোটি বাঙালি শরণার্থীকে আশ্রয় দেয়া থেকে শুরু করে বিশ্বমহলে বাংলাদেশের পক্ষে সমর্থন আদায়ের সার্বিক প্রচেষ্টাসহ নব্য উত্থিত রাষ্ট্রটির জন্য প্রয়োজনীয় আন্তর্জাতিক কূটনৈতিক লড়াইয়ে সদর্পে অগ্রসর হয়েছিলেন তিনি। ২০১১ সালের ২৫ জুলাই বাংলাদেশ সরকার কর্তৃক মরণোত্তর ‘বাংলাদেশ স্বাধীনতা সম্মাননা’য় ভূষিত হন বাংলাদেশের এই অকৃত্রিম বন্ধু।

স্বাধীন ভারতের প্রথম প্রধানমন্ত্রী জওয়াহরলাল নেহরুর একমাত্র সন্তান ইন্দিরা প্রিয়দর্শিনী নেহরু। ১৯৪২ সালে ইন্দিরা বিয়ে করেন ফিরোজ গান্ধীকে। ফিরোজ জাহাঙ্গীর গান্ধী ছিলেন পার্সী বংশোদ্ভূত প্রখ্যাত ভারতীয় রাজনীতিবিদ ও সাংবাদিক। তিনি ভারতীয় পার্লামেন্টের সদস্যও ছিলেন।

তার নামের পদবী ছিল মূলত ‘Ghandy’। ১৯৩০ সালে ভারতের স্বাধীনতা আন্দোলনে জড়িয়ে পড়েন ফিরোজ গান্ধী। মহাত্মা গান্ধীর দ্বারা চরমভাবে অনুপ্রাণিত ফিরোজ তার নামের বানান ‘Ghandy’ থেকে ‘Gandhi’-তে পরিবর্তন করেন। স্বাধীনতা আন্দোলনে জড়িত থাকার সুবাদেই নেহরু পরিবারের সাথে সখ্য বাড়ে ফিরোজের। ১৯৪২ সালের ২৬ মার্চ ফিরোজকে বিয়ের পর ইন্দিরা ‘নেহরু’ থেকে ‘ইন্দিরা গান্ধী’ হয়ে যান।

ইন্দিরা গান্ধী ভারতের প্রথম মহিলা প্রধানমন্ত্রী। তিনি ৪ দফা ভারতের প্রধানমন্ত্রী ছিলেন। আশির দশকে ৪র্থ দফায় ইন্দিরা প্রধানমন্ত্রী থাকাবস্থায় ভারতের রাষ্ট্রীয় অখণ্ডতা হুমকির মুখে পড়ে। বেশ কিছু রাজ্য কেন্দ্রীয় সরকার থেকে স্বাধীনতা দাবি করতে শুরু করে এ সময়। এর মধ্যে পাঞ্জাবও ছিল। সন্ত জার্নাইল সিং ভিন্দ্রানওয়ালের নেতৃত্বে শিখ বিচ্ছিন্নতাবাদীরা স্বতন্ত্র ভূখন্ড ‘খালিস্তান’ এর দাবিতে সহিংস আন্দোলন শুরু করে। ১৯৮২ সালের জুলাই মাসে জার্নাইল সিং অমৃতসরের স্বর্ণমন্দিরে অবস্থান নেন এবং শিখদের ভেতরে বিদ্রোহ উস্কে দিতে থাকেন

১৯৮৪ সালের জুন মাসে প্রধানমন্ত্রী ইন্দিরা গান্ধীর নির্দেশে ভারতীয় সেনাবাহিনী স্বর্ণমন্দিরে অপারেশন ব্লু-স্টার পরিচালনা করে। বিদ্রোহী দমনের এই অভিযানে ভিন্দ্রানওয়ালেসহ ভারতীয় সেনাদের হিসাবমতে প্রায় ৪৯৩ জন শিখ বিদ্রোহী নিহত হয়। কিন্তু অন্যান্য নথি অনুযায়ী বেসামরিক মানুষসহ মৃতের সংখ্যা আরও অনেক বেশি ছিল। সেনাবাহিনীর ৪ অফিসারসহ ৮৩ জন নিহত হন। স্বর্ণমন্দিরের অনেক ভবনও ক্ষতিগ্রস্ত হয় এই অভিযানে।

অপারেশন ব্লু-স্টারের জন্য বেছে নেয়া হয়েছিল একটি বিশেষ দিন, ৬ জুন। এই দিনটি স্বর্ণমন্দিরের প্রতিষ্ঠাতা অর্জন দেবের মৃত্যুবার্ষিকী। এই দিনে প্রচুর শিখ তীর্থযাত্রীর আগমন ঘটে স্বর্ণমন্দিরে। অনেকেই মনে করেন, যত বেশি সম্ভব শিখ হত্যা করে বিদ্রোহ দমন করাই ছিল এই দিনটি নির্ধারণের লক্ষ্য। তবে এই অভিযানে নেতৃত্বদানকারী লেফটেন্যান্ট জেনারেল ব্রারের ভাষ্যমতে, ব্যাপারটি ছিল নিছক কাকতালীয়। ২০০৪ সালে দেয়া এক সাক্ষাৎকারে তিনি বলেন,

    “আপনাকে বুঝতে হবে, সরকারের কাছে অপারেশন সম্পন্ন করার জন্য মাত্র ৩-৪ দিন সময় ছিল। আমাদের কাছে তথ্য ছিল খালিস্তান যেকোনো মুহূর্তে স্বাধীনতা ঘোষণা করতে পারে। বুঝার চেষ্টা করুন। ধরুন, এক সুন্দর দিনে ভিন্দ্রানওয়ালে স্বাধীন খালিস্তান ঘোষণা করে খালিস্তানের পতাকা উড়িয়ে দিল...। খালিস্তানি মুদ্রা পর্যন্ত বন্টন করা হয়ে গিয়েছিল; পাকিস্তানও এদের পেছনে টাকা ঢালছিল। তারা চাচ্ছিলো যে পাঞ্জাব, ভারতের শক্তিশালী একটা অংশ, ভারত থেকে বিচ্ছিন্ন হয়ে যাক।”

স্বর্ণমন্দিরে সেনা আক্রমণের আগে থেকেই পাঞ্জাবকে বাইরের পৃথিবী থেকে আলাদা করে ফেলা হয়। পাঞ্জাবের প্রধান শহরগুলোতে কারফিউ জারি করা হয়। দেশি ও বিদেশি সংবাদকর্মীদের শহরের বাইরে রেখে আসা হয়। বিদ্রোহীদের বিরুদ্ধে সরকারের অবস্থান আর ব্লু-স্টার অভিযান নিয়ে বিতর্ক কম হয়নি। কিন্তু বিতর্কের চেয়ে বেশি সাঙ্ঘাতিক ব্যাপার ছিল অভিযান পরবর্তী দীর্ঘমেয়াদী ক্ষয়ক্ষতি।

পবিত্র স্বর্ণমন্দিরের অবমাননা আর খালিস্তানের স্বপ্ন ধূলিস্মাৎ করে দেবার প্রতিশোধস্বরুপ ৩১ অক্টোবর ১৯৮৪, সাৎওয়ান্ত সিং ও বেয়ান্ত সিং নামে নিজের দুই শিখ দেহরক্ষীর গুলিতে নিহত হন ইন্দিরা গান্ধী। ইন্দিরা ব্রিটিশ অভিনেতা ও পরিচালক পিটার আস্তিনভের আইরিশ টেলিভিশনের জন্য করা একটি ডকুমেন্টারির জন্য সাক্ষাৎকার দিতে যাচ্ছিলেন। নয়া দিল্লির ১ নং সফদরজং রোডের প্রধানমন্ত্রীর বাসভবন থেকে হেঁটে পার্শ্ববর্তী আকবর রোডের অফিসে যাচ্ছিলেন তিনি। স্বর্ণমন্দিরে অভিযানের পরের মাসে ‘র’ এর ডিরেক্টর মিসেস গান্ধীকে পরামর্শ দিয়েছিলেন তার নিরাপত্তা কর্মীদের মধ্যে থেকে শিখদের অপসারণ করতে। তিনি একবাক্যে না করে দিয়ে বলেন, “তাহলে কী করে আমরা নিজেদের সেক্যুলার বলবো?”

বেয়ান্ত সিংকে মিসেস গান্ধী দশ বছর ধরে চিনতেন। এই দশ বছরের পরিচিত বেয়ান্ত সিং মাত্র ৭ ফুট দূর থেকে তার পয়েন্ট থার্টি এইট রিভলভার দিয়ে মিসেস গান্ধীর তলপেটে তিনটি গুলি চালায়। তিনি মাটিতে পড়ে যেতেই সাৎওয়ান্ত সিং তার অটোমেটিক স্টেনগানের ত্রিশ রাউন্ড খালি করে দেয় তার উপর। অন্তত ৭টি গুলি মিসেস গান্ধীর পেটে লাগে, ৩টি তার বুকে আর ১টি হৃৎপিণ্ডে। প্রধানমন্ত্রী মৃত্যুর কোলে ঢলে পড়তেই দুই ঘাতক দেহরক্ষী শান্তভাবে তাদের অস্ত্র ফেলে দেয়। অন্য নিরাপত্তাকর্মীরা তৎক্ষণাৎ তাদের ধরে ফেললে বেয়ান্ত সিং নির্লিপ্তভাবে বলে, “আমার যা করার দরকার ছিল আমি করেছি, এখন তোমরা যা করতে চাও কর।”

তাদের দুজনকে একটি গার্ডহাউসে নিয়ে যাওয়া হয়। সেখানে অকস্মাৎ বেয়ান্ত সিং লাফ দিয়ে এক নিরাপত্তারক্ষীর বন্দুক ছিনিয়ে নেবার চেষ্টা করে। একইসাথে সাৎওয়ান্ত সিং তার পাগড়ির ভেতর থেকে একটি ছোরা বের করে। রক্ষীরা তৎক্ষণাৎ দুজনকেই গুলি করতে বাধ্য হয়। বেয়ান্ত সিং সাথে সাথেই মারা যায়। সাৎওয়ান্ত সিংকে গুরুতর আহত অবস্থায় হাসপাতালে নেয়া হয়। হাসপাতালে সে স্বীকারোক্তি দেয় যে, সে একটি বড়সড় ষড়যন্ত্রের অংশ ছিল। এই ষড়যন্ত্রে একজন উচ্চপদস্থ সেনা অফিসারও জড়িত ছিল এবং তাদের পরবর্তী লক্ষ্য ছিল রাজীব গান্ধী।

মিসেস গান্ধীর নিথর দেহটি অল-ইন্ডিয়া ইনস্টিটিউট অব মেডিকেল সায়েন্সেস হসপিটালে নেয়া হয়। গাড়িতে তার মাথাটি কোলে করে বসে অঝোরে কেঁদে চলেছিলেন পুত্রবধূ সোনিয়া গান্ধী। হাসপাতালে পৌঁছার পর তার দেহে জীবনের কোনো লক্ষণ না থাকলেও ১২ জন ডাক্তারের একটি দল অসম্ভবকে সম্ভব করার বৃথা চেষ্টা চালিয়ে যান। ইন্দিরার দেহ থেকে ৭টি বুলেট বের করা হয়, একটি কৃত্রিম ফুসফুস সংস্থাপন করা হয়, ৮৮ বোতল ও-নেগেটিভ রক্ত দেয়া হয়। দুপুর ১টা ৪৫ মিনিটে একটি ভারতীয় সংবাদ সংস্থা প্রচার করে, ‘মিসেস গান্ধী মৃত।’

ইন্দিরা গান্ধী কখনো বুলেট প্রুফ ভেস্ট পরতেন না। মৃত্যুর আগেরদিন রাতে ওড়িষ্যার রাজধানী ভুবনেশ্বরে এক বিশাল জনসভায় তিনি বলেছিলেন,

    “আমার দীর্ঘ জীবনের আকাঙ্ক্ষা নেই। আমি এসব জিনিসে ভয় পাই না। এই জাতির সেবায় আমার জীবন চলে গেলেও আমি কিছু মনে করবো না। আজ যদি আমার মৃত্যু হয়, আমার প্রতিটি রক্তবিন্দু এই জাতিতে শক্তি সঞ্চার করবে।”

ক্ষমতায় থাকাবস্থায় জওহরলাল নেহেরু থাকতেন তিন মূর্তি ভবনে। সেখানেই মিসেস গান্ধীর মৃতদেহ দু’দিন রাখা হয়। হাজারো ভারতবাসী তাদের সম্মান জানাতে আর প্রধানমন্ত্রীকে শেষ দেখা দেখতে আসেন সেখানে। দু’দিন পর ৭ মাইল দূরে যমুনার তীরে তার শবদাহ করা হয়। এখানেই দাহ করা হয়েছিল তার পিতা জওহরলাল নেহরুকে, ছেলে সঞ্জয় গান্ধীকে, আর ভারতের স্বাধীনতার স্বপ্নদ্রষ্টা মহাত্মা গান্ধীকে।

ইন্দিরার ব্লু-স্টার অভিযানের সিদ্ধান্ত হয়তো সময়ের বিচারে খুব কঠিন একটি সিদ্ধান্ত ছিল। কিন্তু একজন আদর্শ রাষ্ট্রপ্রধানের সবচেয়ে বড় দায়িত্ব রাষ্ট্রীয় অখন্ডতা ও সার্বভৌমত্ব রক্ষা করা, বিশেষ করে ভারতের মতো নানা জাতি আর সংস্কৃতিতে বিভক্ত জনগোষ্ঠীর ভূখন্ডে এটিই সবচেয়ে বড় চ্যালেঞ্জ বলা যায়। সেই সাথে এত অভিযানের ক্ষয়ক্ষতি, এত বেসামরিক মানুষের মৃত্যুর দায়ভারও সরকারের উপরেই আসে। একটি খারাপ সময়ে শক্ত হাতে রাষ্ট্রীয় অখন্ডতা রক্ষার গুরুদায়িত্ব পালন করতে গিয়ে বিষাদময় পরিণতি বরণ করতে হয় ইন্দিরা গান্ধীকে। বাংলাদেশ তার আপদকালীন এই বন্ধুটির প্রতি চিরকৃতজ্ঞ থাকবে।