জীবন হাসে চেষ্টা ও সংগ্রামে
চেষ্টা ও সাধনা ছাড়া মানুষ বেঁচে থাকতে পারে না। সুন্দরভাবে জীবন যাপন করতে পারে না। ভালো কিছু উপহার দিতে পারে না পৃথিবী ও পৃথিবীর সন্তানদের। মানুষের পৃথিবীতে রেখে যেতে পারে না সৃষ্টিশীল, সৃজনশীল ও প্রশংসনীয় কর্ম।
মৃত্যুর পরে অমর থাকা, মানুষের হৃদয় মিনারে বেঁচে থাকা, সমাদৃত ও বরণীয় হয়ে অন্তরে অন্তরে ধ্বনি তোলার জন্য প্রয়োজন চেষ্টা, সাধনা ও সংগ্রাম। এর সঙ্গে সঙ্গে মনের জমিনে ফলাতে হবে দুর্দম দুরন্ত স্পৃহার ফসল।
চেষ্টা-সাধনার অপর নাম সফলতা। চেষ্টা-সাধনা ছাড়া সফলতা কল্পনা করা নিছক মূর্খতা। পৃথিবীর ইতিহাসে যাঁদের নাম সমাদৃত, মানুষের মুখে মুখে প্রশংসায় উচ্চারিত, স্বপ্নবাজদের হৃদয় টেবিলের আলোচনার প্রতিপাদ্য বিষয়, যাঁরা উপমা হয়ে জ্বলছেন আলোর আকাশে তাঁরা সবাই চেষ্টা-সাধনায় ব্রত নিয়েছিলেন। স্বপ্ন নির্মাণে চেষ্টা-সাধনাকে চূড়ান্ত করে নিয়েছিলেন জীবনের জন্য।
আমেরিকার গণতন্ত্রের প্রেসিডেন্ট ‘জন আব্রাহাম লিংকন’ নির্বাচনে বারবার হেরে গিয়েও থেমে যাননি। তাঁর চূড়ান্ত চেষ্টা তাঁকে অবশেষে প্রেসিডেন্ট বানিয়েছিল। প্রেসিডেন্ট হওয়ার আগে নির্বাচনে ১২ দফা পরাজয় তাঁকে দমাতে পারেনি। তাঁর স্বপ্ন বিকল করতে পারেনি। ইচ্ছা, সাধনা এবং বিশ্বাসের অদম্য শক্তি তাঁকে মনজিলে পৌঁছে দিয়েছিল।
একজন মুমিনের জীবনে সবচেয়ে বড় স্বপ্ন হলো, নিজের রব আল্লাহকে খুশি করা। আর আল্লাহকে পেতে হলে, তাঁকে খুশি করতে হলে দীর্ঘ পথ পাড়ি দিতে হবে। এর জন্য পরিশ্রম করতে হবে। অব্যাহত প্রচেষ্টা চালিয়ে যেতে হবে। ইরশাদ হয়েছে, ‘যারা আমার উদ্দেশ্যে চেষ্টা-সংগ্রাম করবে, তাদের আমি আমার পথ দেখাব। আর আল্লাহ অবশ্যই সৎকর্মশীল লোকদের সঙ্গে রয়েছেন। ’ ( সুরা : আনকাবুত, আয়াত : ৬৯)
ভারতের পরমাণু বিজ্ঞানী এ পি জে আবদুল কালাম বলেছেন, ‘সূর্যের মতো দীপ্তিমান হতে হলে প্রথমে তোমাকে সূর্যের মতোই পুড়তে হবে। ’ যে স্বপ্ন দেখে উজ্জ্বলতার, ভব্যতার, মরে গিয়ে বেঁচে থাকার, তাকে জলাঞ্জলি দিতে হবে জীবনের কাছে জীবনকে।
মহান আল্লাহ বান্দাকে শিক্ষা দিয়েছেন তাঁকে পাওয়ার পথ ও পদ্ধতি। আল্লাহকে পেতে হলে, তাঁর সঙ্গে হৃদ্যতা গাঢ় করতে হলে তাঁর হুকুম পালনে ব্রত হতে হবে। তাঁর স্মরণে উৎসর্গ করতে হবে জীবন এবং জীবনের সব কিছু। আল্লাহ বলেন, ‘তুমি তোমার রবের নাম স্মরণ করতে থাকো এবং একমাত্র তাঁর দিকে মনোনিবেশ করো। ’ (সুরা : মুজ্জাম্মিল, আয়াত : ০৮)
বিশ্বসাহিত্য কেন্দ্রের প্রতিষ্ঠাতা অধ্যাপক আবদুল্লাহ আবু সায়ীদ বলেন, ‘মানুষ তার স্বপ্নের সমান বড়। ’ আমাদের স্বপ্ন যত বড় আমরাও তত বড়। স্বপ্ন যদি আমাকে ঘুমাতে না দেয়, আমাকে জড় পদার্থের মতো বসিয়ে না রাখে, তাহলে আমাদের স্বপ্নরা বাস্তবতার নিশান উড়াতে পারবে বলে বিশ্বাস করতে পারি।
‘কষ্ট ছাড়া কেষ্ট মেলে না’ কথাটা অনেক প্রাচীন। কিন্তু কথাটা জিইয়ে আছে আজও। কথাটা সুগন্ধ ছড়াচ্ছে মানুষের জীবনের অলিগলিতে। সুতরাং কষ্টের পূর্ণ প্রস্তুতি নিয়ে আমাদের ছুটে যেতে হবে উদ্দেশ্যর নগরে। জুলভার্নের ‘৮০ দিনে বিশ্বভ্রমণ’ (Around the world in 80 days) বইয়ের নায়ক ‘ফিলিয়াস ফগ’ বহু চড়াই-উতরাই পেরিয়ে ৮০ দিনে বিশ্বভ্রমণ করেছে। এই অল্পদিনে পুরো বিশ্বভ্রমণ এমনিতে হয়ে যায়নি। এ জন্য তাকে নানা বিপদাপদ, বাধা পাড়ি দিতে হয়েছে। পৃথিবীর সব সফলতার পেছনে আছে যাতনার দীর্ঘ কাহিনি। জীবন বিপন্নতার নানা ‘মনভাঙা’ গল্প।
মানবতার ধর্ম ইসলামও বলেছে, চেষ্টা ও কষ্টে রয়েছে সফলতা। মুসলমানের প্রধান স্বপ্ন হলো জান্নাত। আর জান্নাতকে দুঃখ-কষ্টের দ্বারা আড়াল করে রাখা হয়েছে। সুতরাং জান্নাতে যেতে চাইলে চেষ্টা-সাধনায় নিজেকে উৎসর্গ করতে হবে। রাত-দিন পরিশ্রম করে যেতে হবে জান্নাতের উপকরণ সংগ্রহে। ইসলামের নবী মুহাম্মদ (সা.) বলেন, ‘দোজখকে লোভনীয় জিনিস দিয়ে আড়াল করে রাখা হয়েছে। আর জান্নাতকে দুঃখ-কষ্টের দ্বারা আড়ালে রাখা হয়েছে। ’ (সহিহ বুখারি ও সহিহ মুসলিম সূত্রে রিয়াজুস সালেহিন : ১০১)
মুহাম্মদ (সা.)-এর জীবনের পূর্বাপর সব গুনাহ মাফ হওয়া সত্ত্বেও তিনি দিবানিশি ইবাদত করতেন। প্রিয় প্রেমিক আল্লাহর সোহবতে ধন্য হতে নিজেকে উৎসর্গ করেছেন কষ্টের কাছে। হাদিসে এসেছে, আয়েশা (রা.) বর্ণনা করেন, নবী (সা.) রাতে এত বেশি ইবাদত করতেন যে তাতে এমনকি তাঁর পা মোবারক ফুলে ফেটে যেত। আমি তাকে বললাম, হে আল্লাহর রাসুল! আপনি এরূপ কেন? আপনার অতীত ও ভবিষ্যতের সব ত্রুটিবিচ্যুতি তো আল্লাহ ক্ষমা করে দিয়েছেন। তিনি বলেন, ‘আমি কি আল্লাহর শুকরগুজার বান্দা হওয়া পছন্দ করব না। ’ (সহিহ বুখারি ও সহিহ মুসলিম সূত্রে রিয়াজুস সালেহিন : ৯৮)
আমাদের জীবনকে সুন্দর ও সাফল্যমণ্ডিত করতে হলে সময়কে কাজে লাগাতে হবে। জীবনকে উপলব্ধি করে তার কাছে থেকে সফলতার পাঠ নিতে হবে। সময় ও স্বাস্থ্যকে একসঙ্গে করে জীবনকে পৌঁছে দিতে হবে সফলতার স্বর্ণ শিখরে। সময় ও স্বাস্থ্য আমাদের অনুকূলে থাকার পরও যদি জীবন সুন্দর না হয়, স্বপ্ন পূরণ না হয়, তাহলে আমাদের বেঁচে থাকা নিরর্থক। সময় ও স্বাস্থ্য মানুষের বড় নিয়ামত। মুহাম্মদ (সা.) বলেন, ‘দুটি নিয়ামত (আল্লাহর দান) যার ব্যাপারে বহু লোক ক্ষতিগ্রস্ত—স্বাস্থ্য ও অবসর। ’ (সহিহ বুখারি, হাদিস : ৬৪১২, সুনানে তিরমিজি, হাদিস : ২৩০৪)
বেঁচে থেকে যারা জীবনকে উজ্জ্বল আলোয় প্রদীপ্ত করেছে, তারাই সর্বোত্তম মানুষ। হাদিস শরিফে এসেছে, ‘সেই ব্যক্তি উত্তম, যার বয়স দীর্ঘ ও কাজ সুন্দর। ’ (সুনানে তিরমিজি সূত্রে রিয়াজুস সালেহিন : ১০৮)
আসুন, স্বপ্ন দেখি এবং সেই স্বপ্ন বিনির্মাণে সর্বাত্মক চেষ্টা করি। মহান আল্লাহ আমাদের তাওফিক দান করুন।
Source: https://www.kalerkantho.com/print-edition/islamic-life/2020/02/24/878197