Show Posts

This section allows you to view all posts made by this member. Note that you can only see posts made in areas you currently have access to.


Messages - kekbabu

Pages: 1 [2] 3 4 ... 6
16
স্বাস্থ্য খাতের অনিয়ম-দুর্নীতি এবং জনগণের সুচিকিৎসা
ড. কুদরাত-ই-খুদা
১৩ জুলাই, ২০২০ ০০:০০

একটি রাষ্ট্রের কাছে ওই রাষ্ট্রের জনগণের যত চাহিদা থাকে, স্বাস্থ্যসেবা হচ্ছে তার অন্যতম। স্বাস্থ্য মানবসম্পদ উন্নয়নের গুরুত্বপূর্ণ সূচক হিসেবে সর্বজনীনভাবে স্বীকৃত। সংবিধানের অনুচ্ছেদ ১৫(ক) ও ১৮(১)-এ চিকিৎসাসেবা ও জনগণের পুষ্টির স্তর উন্নয়ন এবং জনস্বাস্থ্যের উন্নতিসাধনকে রাষ্ট্রের অন্যতম মৌলিক দায়িত্ব হিসেবে স্বীকৃতি দেওয়া হয়েছে। চিকিৎসা নামক এই মৌলিক চাহিদাটি পূরণ করতে গিয়ে দেশের জনগণকে কম হয়রানির শিকার হতে হয় না, বিশেষ করে জনগণ যদি যায় কোনো সরকারি হাসপাতালে। এ দেশে চিকিৎসাক্ষেত্রে অনিয়ম, বিশৃঙ্খলা, দুর্নীতি নতুন কোনো বিষয় নয়। বরং পত্রিকার পাতা খুললেই চোখে পড়ে এসংক্রান্ত খবরাখবর।

স্বাস্থ্য মন্ত্রণালয়ের প্রাথমিক তদন্তে অনেক ঠিকাদারি প্রতিষ্ঠান এবং সংশ্লিষ্ট একটি অসাধুচক্র যন্ত্রপাতি সরবরাহ না করেই ওই অর্থ আত্মসাৎ করেছে। এ ধরনের দুর্নীতিগুলোকে বাংলা ব্যাকরণ অনুযায়ী ‘পুকুরচুরি’ না বলে ‘সাগরচুরি’ বলাই ভালো। ভালোভাবে খোঁজ নিলে দেখা যাবে, স্বাস্থ্য অধিদপ্তরের বিভিন্ন কার্যালয়ে কিছুসংখ্যক অসাধু কর্মকর্তা-কর্মচারীর যোগসাজশে দুর্নীতির শক্তিশালী বলয় তৈরি হয়েছে। ‘শক্তিশালী’ এই সিন্ডিকেটের মাধ্যমে সরকারি মেডিক্যাল কলেজ ও হাসপাতালে ওষুধ, সরঞ্জাম ও যন্ত্রপাতি ক্রয়ে ঠিকাদারি প্রতিষ্ঠানের সমন্বয়ে ‘সিন্ডিকেট’ গঠন করে স্বাস্থ্য খাতে জনসাধারণের জন্য বরাদ্দ সরকারি বাজেটের একটি বড় অংশ হাতিয়ে নেওয়া হচ্ছে। এর ফলে জনগণ তাদের প্রত্যাশিত স্বাস্থ্যসেবা থেকে নিয়মিত বঞ্চিত হচ্ছে। গত বছর দুর্নীতি দমন কমিশনের প্রকাশিত এক প্রতিবেদনে উল্লেখ করা হয়, স্বাস্থ্য খাতে কেনাকাটা, নিয়োগ, পদোন্নতি, বদলি, পদায়ন, চিকিৎসাসেবা, চিকিৎসাসেবায় ব্যবহৃত যন্ত্রপাতি, ওষুধ সরবরাহসহ ১১টি খাতে দুর্নীতি বেশি হয়। এসব দুর্নীতি প্রতিরোধে ২৫ দফা সুপারিশও করে ওই সংস্থা। তখন স্বাস্থ্য খাতের দুর্নীতি-অনিয়ম নিয়ে সংসদেও প্রশ্ন উঠেছিল। কিন্তু এখন পর্যন্ত স্বাস্থ্য খাতে অনিয়ম-দুর্নীতি থেমে নেই। বরং তা পাগলা ঘোড়ার মতো দ্রুত বেগে চলমান। মাননীয় প্রধানমন্ত্রী একাধিকবার দুর্নীতির বিরুদ্ধে জিরো টলারেন্সের ঘোষণা দিয়েছেন। দেশ-জাতির বৃহত্তর স্বার্থেই স্বাস্থ্য খাতের কেনাকাটা, ঋণ ব্যবহারসহ যেসব বিষয়ে অভিযোগ উঠেছে এবং দুর্নীতি হচ্ছে, তা দ্রুত ভালোভাবে খতিয়ে দেখে প্রয়োজনীয় ব্যবস্থা নেওয়া অত্যাবশ্যক।

তবে করোনাভাইরাসের প্রাদুর্ভাবের এই ক্রান্তিলগ্ন দেশের চিকিৎসকদের  জন্য অনেক বেশি সংকটপূর্ণ সময় বলে মনে করা হচ্ছে। কারণ করোনার এই মহামারির সময়ে তাঁরা সম্মুখযোদ্ধা বা ভ্যানগার্ড হিসেবে কাজ করছেন। করোনায় আক্রান্ত রোগীদের চিকিৎসাসেবা দিচ্ছেন। দুঃখজনক হলেও সত্য, এরই মধ্যে দেশে অনেক চিকিৎসক এই ভাইরাসে আক্রান্ত হয়ে মারাও গেছেন। আবার অনেক চিকিৎসকই রোগীদের সেবা দিতে গিয়ে করোনায় আক্রান্ত হয়ে বর্তমানে চিকিৎসা নিচ্ছেন। কেউ কেউ চিকিৎসা নিয়ে এরই মধ্যে সুস্থ হয়েছেন। বলা বাহুল্য, রোগীদের খুব কাছাকাছি গিয়ে চিকিৎসাসেবা দিতে হয় চিকিৎসকদের। এই পরিস্থিতিতে চিকিৎসকদের নিরাপত্তা নিশ্চিত করা অত্যাবশ্যক। অন্যথায় তাঁরা চিকিৎসা দেওয়ার ক্ষেত্রে নিরাপদ বোধ করবেন না। বলার অপেক্ষা রাখে না, করোনার বিরুদ্ধে জিততে হলে অবশ্যই চিকিৎসক আর নার্সদের অগ্রণী ভূমিকা পালন করতে হবে। দেশের এই সংকটময় মুহূর্তে চিকিৎসক, নার্স, মেডিক্যাল স্টাফসহ সংশ্লিষ্টদের প্রতি আমাদের সবারই সুনজর দেওয়া উচিত। যেসব চিকিৎসক বর্তমান সময়ে খেয়ে-না খেয়ে, না ঘুমিয়ে করোনা মোকাবেলায় আন্তরিকভাবে নিরলস কাজ করে যাচ্ছেন, রোগীদের সেবা দিয়ে যাচ্ছেন, যাঁরা দিনের পর দিন করোনার বিরুদ্ধে নিজেদের জীবন বাজি রেখে লড়াই করে চলেছেন, চিকিৎসক নামক সেই মহৎ মানুষগুলোর প্রতি আমাদের সবারই শ্রদ্ধা নিবেদন করা নৈতিক দায়িত্ব। তাঁদের যেকোনো সমস্যা বা চাহিদা অবশ্যই অগ্রাধিকার ভিত্তিতে সমাধান করতে হবে। মাননীয় প্রধানমন্ত্রী অবশ্য এরই মধ্যে করোনাভাইরাস মহামারি মোকাবেলায় যেসব চিকিৎসক, নার্স ও স্বাস্থ্যকর্মী প্রত্যক্ষভাবে কাজ করছেন, তাঁদের পুরস্কৃত করার ঘোষণা দিয়েছেন, যা নিঃসন্দেহে প্রশংসার দাবিদার। চিকিৎসকদের কাছে জনগণের এখন একটি বিশেষ প্রত্যাশা রয়েছে, আর তা হচ্ছে করোনাকালীন এই সংকটময় মুহূর্তে যেন কোনো রোগীকে বিনা চিকিৎসায় ফিরে যেতে না হয়। কারণ চিকিৎসকদের কাছ থেকে একটু ভালো সেবা আর যত্ন পেলে করোনা আক্রান্ত অনেক মানূষ সুস্থ হয়ে হাসিমুখে বাড়ি ফিরতে পারবে। করোনা মোকাবেলায় চিকিৎসক, নার্স আর মেডিক্যাল স্টাফদের আন্তরিক নিরলস লড়াই এবং সরকার, আইন-শৃঙ্খলা রক্ষাকারী বাহিনীসহ সবার দায়িত্বশীল কর্তব্য পালন এবং সর্বোপরি জনগণ কর্তৃক সঠিকভাবে স্বাস্থ্যবিধি মানা হলে করোনার বিরুদ্ধে চলমান লড়াইয়ে আমাদের জয় সুনিশ্চিত।

বর্তমান সরকার সবার জন্য মানসম্মত স্বাস্থ্যসেবা নিশ্চিত করার লক্ষ্যে নিরলসভাবে কাজ করে যাচ্ছে। এ বিষয়টি নিশ্চিত করতে চিকিৎসকদের ভূমিকা অপরিসীম। কারণ চিকিৎসকদের সার্বিক সহযোগিতা ছাড়া সবার জন্য মানসম্মত স্বাস্থ্যসেবা নিশ্চিত করা সম্ভব নয়। জনগণের চিকিৎসাসেবা নিশ্চিত করার লক্ষ্যে চিকিৎসকদের প্রতি মাননীয় প্রধানমন্ত্রী এর আগেও অনেকবার নির্দেশ দিয়েছেন, সতর্ক করেছেন। সার্বিক দিক বিবেচনায় এ ক্ষেত্রে এমন একটি সুনির্দিষ্ট পদ্ধতি গড়ে তোলা প্রয়োজন, যেন একটি নির্দিষ্ট সময় পর্যন্ত চিকিৎসকরা গ্রামীণ এলাকায় থেকে কাজ করতে বাধ্য হন। আর বাস্তব অবস্থা বিবেচনায় এবং জনগণের চিকিৎসাসেবা নিশ্চিত করতে কার্যকর আইন প্রণয়নসহ তার যথাযথ বাস্তবায়ন জরুরি বিষয় হিসেবে দেখা দিয়েছে। বিজ্ঞজনেরা বলে থাকেন, একটা খারাপ সময়ও অনেক ভালো ভবিষ্যৎ প্রস্তুতির সুযোগ করে দেয়। করোনাকালের সমাপ্তি শেষে এ দেশ একদিন নিশ্চয়ই আলোকিত হবে। সরকার, স্বাস্থ্য মন্ত্রণালয়সহ সংশ্লিষ্ট কর্তৃপক্ষের যথাযথ ও কার্যকর উদ্যোগ গ্রহণের ফলে সেই আলোকিত বাংলাদেশের স্বাস্থ্য খাতে আর কোনো অনিয়ম-দুর্নীতি ঘটবে না এবং চিকিৎসকরাও দায়িত্বে অবহেলা না করে জনগণের সুচিকিৎসা নিশ্চিত করতে আন্তরিক হবেন—এমনটাই সবার প্রত্যাশা।
লেখক : সহযোগী অধ্যাপক, আইন বিভাগ, ড্যাফোডিল ইন্টারন্যাশনাল ইউনিভার্সিটি; আন্তর্জাতিক মানবাধিকার সংগঠন অ্যামনেস্টি ইন্টারন্যাশনালের আন্তর্জাতিক সদস্য
kekbabu@yahoo.com

Link: https://www.kalerkantho.com/print-edition/sub-editorial/2020/07/13/934037?fbclid=IwAR2fDk90N9mSm0Mt9_8pQcCF_Eww-U_V9IB4Ter3Qw4xG5h_x1z3R5Q1T7U
 

17
ধর্ষণ বন্ধ হচ্ছে না কেন
প্রকাশিতঃ অক্টোবর ০৪, ২০২০

ড. কুদরাত-ই-খুদা বাবু
সম্প্রতি সিলেটের এমসি কলেজ ছাত্রাবাসে এক তরুণীকে তুলে নিয়ে গণধর্ষণের ঘটনায় ক্ষোভে ফুঁসে উঠেছে মানবাধিকারকর্মী থেকে শুরু করে দেশের সচেতন জনগণ এবং ফেসবুক থেকে শুরু করে সামাজিক যোগাযোগের বিভিন্ন মাধ্যমগুলো। এ ঘটনার আগে ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের এক ছাত্রী ধর্ষণের ঘটনায় ক্ষোভে ফুঁসে উঠেছিল দেশের বিভিন্ন বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষক-শিক্ষার্থীসহ নানা শ্রেণী পেশার মানুষ। সিলেটের ওই ঘটনায় ধর্ষকদের গ্রেফতার ও বিচারের দাবিতে বিক্ষোভ সমাবেশ, মানববন্ধনসহ বিভিন্ন কর্মসূচী অব্যাহত রয়েছে। ইতোমধ্যে দুজন অভিযুক্তকে গ্রেফতার করেছে আইনশৃঙ্খলা রক্ষাকারী বাহিনীর সদস্যরা। শুধু দেশেই আশঙ্কাজনকহারে বেড়ে চলছে ধর্ষণ, ধর্ষণ পরবর্তী হত্যা ও নির্যাতন। এ দেশে ধর্ষণের হাত থেকে প্রাপ্ত বয়স্ক মেয়ে, গৃহবধূ, স্কুল-কলেজ-মাদ্রাসা-বিশ্ববিদ্যালয় পড়ুয়া ছাত্রী থেকে শুরু করে দুই-তিন বছরের কোমলমতি শিশু পর্যন্ত কেউ-ই রেহাই পাচ্ছে না। অনেক সময় অনেক হুজুর দ্বারাও মাদ্রাসা শিক্ষার্থী ধর্ষণ বা বলাৎকারের ঘটনা ঘটে। আর এ সমাজে বিয়ের প্রলোভন দেখিয়েও ধর্ষণ করার ঘটনাতো অহরহই ঘটে চলেছে। আবার অনেক সময় দেখা যায়, কোন মেয়ে ধর্ষণের শিকার হলে সমাজ ও মান-সম্মানের ভয়ে ধর্ষণের বিষয় কাউকে জানান না। তখন বিষয়টি লোকচক্ষুর অন্তরালেই থেকে যায়। অনেক সময় এ-ও দেখা যায়, ধর্ষণ করার ঘটনা ধর্ষক বা তার সহযোগী কর্তৃক ভিডিও আকারে ধারণ করে ইন্টারনেটে ছেড়ে দেয়া হচ্ছে কিংবা ইন্টারনেটে ছেড়ে দেয়ার ভয়-ভীতি দেখিয়ে ওই মেয়েকে ধর্ষণ করা হচ্ছে, তার কাছ থেকে অবৈধ সুবিধা নেয়া হচ্ছে। একজন মেয়ে যখন ধর্ষণের শিকার হন, তখন তার মানসিক অবস্থা কেমন হতে পারে, তা কি আমাদের ভেবে দেখা উচিত নয়? পাশাপাশি ওই মেয়েটিকে বা ওই মেয়েটির পরিবারকে আমাদের ’সমাজ’-ই বা কোন চোখে দেখে থাকে, তা কি আমরা ভেবে দেখি? আমরা কি ভেবে দেখেছি যে, একজন মেয়ে যখন ধর্ষণের শিকার হন, তখন তার সারা জীবনের লালিত স্বপ্ন ভেঙ্গে চুরমার হয়ে যায়। ধর্ষণের ওই ঘটনা তাকে সারাক্ষণ তাড়া করে বেড়ানোর ফলে তার মানসিক শান্তি থাকে না। থাকে না ভালোভাবে বাঁচার স্বপ্ন এবং শেষ পর্যন্ত তার আত্মবিশ্বাসটুকুও দিনে দিনে লোপ পেতে থাকে। সর্বোপরি, ধর্ষণের শিকার মেয়েটি মানসিকভাবে এমন অশান্তি এবং যন্ত্রণাময় জীবন অতিবাহিত করেন যে, তিনি যেন জীবিত থেকেও মৃত। আবার অনেক সময় অনেক মেয়ে ধর্ষণের শিকার হয়ে অপমান সইতে না পেরে আত্মহত্যা পর্যন্ত করে থাকেন। তবে আশ্চর্যের বিষয়, ধর্ষণের মতো ফৌজদারী অপরাধ, ন্যক্কারজনক ও জঘন্য ঘটনা ঘটলেও ধর্ষিতা কিংবা তার পরিবার অনেক সময় ন্যায়বিচারটুকু পর্যন্ত পান না। একটি স্বাধীন, সভ্য ও গণতান্ত্রিক দেশে এর চেয়ে বড় লজ্জার, দুঃখের ও আশ্চর্যের বিষয় আর কি হতে পারে?

মানবাধিকার সংস্থা আইন ও সালিশ কেন্দ্র (আসক)-এর হিসাব অনুযায়ী, সদ্য বিদায়ী ২০১৯ সালে দেশে এক হাজার ৪১৩ জন নারী ধর্ষণের শিকার হয়েছেন। ২০১৮ সালে এই সংখ্যা ছিল ৭৩২জন। অর্থাৎ, ২০১৮ সালের তুলনায় ২০১৯ সালে ধর্ষণের ঘটনা বেড়েছে দ্বিগুণ, যা প্রকৃত পক্ষেই ভয়াবহ একটি বিষয়। ওই সংস্থার হিসাব মতে, ২০১৭ সালে দেশে ধর্ষণের শিকার হয়েছেন ৮১৮ জন নারী। অপর এক হিসেবে দেখা যায়, ২০১৯ সালে ধর্ষণের পর হত্যা করা হয়েছে ৭৬ জনকে। আর আত্মহত্যা করতে বাধ্য হয়েছেন ১০জন নারী। নারীর প্রতি সহিংসতার অন্য চিত্রগুলোও ভয়াবহ। ২০১৯ সালে যৌন হয়ানারীর শিকার হয়েছেন ২৫৮ জন নারী। ২০১৮ সালে এই সংখ্যা ছিল ১৭০ জন। ২০১৯ সালে যৌন হয়রানির শিকার ১৮ জন নারী আত্মহত্যা করেছেন। প্রতিবাদ করতে গিয়ে চারজন নারীসহ ১৭ জন হত্যার শিকার হয়েছেন। আর যৌন হয়রানির প্রতিবাদ করতে গিয়ে ৪৪জন পুরুষ নির্যাতনের শিকার হয়েছেন। দেশব্যাপী ধর্ষণ, হত্যা এবং নির্যাতন বেড়ে যাওয়ায় সচেতন দেশবাসী ও অভিভাবক মহল আজ রীতিমতো উদ্বিগ্ন হয়ে পড়েছেন। এ অবস্থা নিঃসন্দেহে একটি জাতির জন্য অত্যন্ত লজ্জাজনক এবং অশনিসংকেতই বটে। আমাদের দেশে আশঙ্কাজনক হারে ধর্ষণ, নির্যাতন ও হত্যার ঘটনাসমূহ বিশ্ব দরবারে বাংলাদেশের ভাবমূর্তি ক্ষুণ্ণ করছে। বলাবাহুল্য, কোন সমাজে ধর্ষণ বিস্তৃত হলে এবং ধর্ষকদের কঠোর সাজার ব্যবস্থা করা না হলে সেই সমাজে নীতি-নৈতিকতা ও মূল্যবোধ বলে কিছুই থাকে না। এ ধরনের ঘটনা পুরো সমাজ, দেশ ও জাতিকে বিশৃঙ্খলা ও পাপাচারের দিকে ধাবিত করে, যা কখনোই শুভ কোন বিষয় নয়। এমতাবস্থায় সমাজ থেকে ধর্ষণ, নির্যাতন ও হত্যা বন্ধে দ্রুত কার্যকর পদক্ষেপ গ্রহণ না করলে ভবিষ্যতে এ অবস্থা আরও ভয়ানক পর্যায়ে গিয়ে ঠেকবে।

ধর্ষণের কারণগুলো বিশ্লেষণ করলে দেখা যায় : ১. ধর্ষণকারীদের মধ্যে বিন্দুমাত্র অপরাধবোধ না থাকার কারণে নির্দ্বিধায় ধর্ষণ করতে উদ্যোগী হচ্ছে। ২. যে সমাজে আইনের শাসন নেই কিংবা থাকলেও তা দুর্বল বা ভঙ্গুর, সেই সমাজের লোকেরা ধর্ষণ উপযোগী পরিবেশ পায় এবং ধর্ষণ করে। সুতরাং, সামাজিক প্রতিরোধ ও আইনের শাসনের অভাব ধর্ষণের জন্য দায়ী। ৩. পর্নোগ্রাফি, সেসব দেখে অনেক পুরুষ ধর্ষণে উৎসাহিত বোধ করে। ৪. মেয়েদের ওপর আধিপত্য বিস্তার ও ভয়ভীতি দেখিয়ে নিয়ন্ত্রণ করার মানসিকতাও ধর্ষণের অন্যতম কারণ। ৫. ক্ষমতাশালী ব্যক্তি সুযোগ পেয়ে কোন দুর্বল মেয়ে, শিশু বা ছেলের ওপর ক্ষমতার প্রয়োগ ঘটায় ধর্ষণের মাধ্যমে। ৬. অনেক সময় বন্ধুবান্ধব একসঙ্গে হয়ে আকস্মিকভাবে কোন অসহায় মেয়েকে একা পেয়ে আনন্দ-ফুর্তি করার জন্যও ধর্ষণ করে। এ ছাড়া বর্তমানে ইন্টারনেটসহ নানা ধরনের তথ্যপ্রযুক্তির অবাধ ব্যবহার বৃদ্ধি পাওয়াসহ পারিপার্শ্বিক আরও অনেক কারণে ধর্ষণ বৃদ্ধি পেতে পারে। তবে যেভাবেই ধর্ষণ, হত্যা ও নির্যাতন হোক না কেন, তা গুরুতর ফৌজদারী অপরাধ। বাংলাদেশ দ-বিধির ৩৭৫ ধারা মোতাবেক, যদি কোন ব্যক্তি অপর কোন ব্যক্তির ইচ্ছার বিরুদ্ধে, সম্মতি ব্যতিরেকে, সম্মতিক্রমে-যে ক্ষেত্রে তাকে মৃত্যু বা আঘাতের ভয় প্রদর্শন করে তার সম্মতি আদায় করা হয়, তার সম্মতিক্রমে-যে ক্ষেত্রে লোকটি জানে যে সে তার স্বামী নয় এবং নারীটি এ বিশ্বাসে সম্মতিদান করে যে পুরুষটির সঙ্গে সে আইনানুগভাবে বিবাহিত অথবা সে নিজেকে আইনানুগভাবে বিবাহিত বলে বিশ্বাস করে এবং পঞ্চমত: তার সম্মতিক্রমে বা ব্যতিরেকে-যেক্ষেত্রে সে ১৪ বছরের কম বয়স্ক হয়। নারী ও শিশু নির্যাতন দমন আইন ২০০০ (সংশোধিত ২০০৩)-এর ৯ ধারা মোতাবেক ধর্ষণের অপরাধের যেসব শাস্তির বিধান রয়েছে তা হচ্ছে, ধর্ষণের ফলে কোন নারী বা শিশুর মৃত্যু হলে ধর্ষণকারীর জন্য রয়েছে মৃত্যুদ- বা যাবজ্জীবন সশ্রম কারাদ- এবং এর অতিরিক্ত কমপক্ষে এক লাখ টাকা অর্থদণ্ড। একাধিক ব্যক্তি দলবদ্ধভাবে কোন নারী বা শিশুকে ধর্ষণ করলে ধর্ষণকালে বা ধর্ষণের পর যদি তার মৃত্যু ঘটে, তবে ওই দলের সবার জন্যই এই শাস্তি প্রযোজ্য হবে। ধর্ষণের চেষ্টা করলে ধর্ষণকারীর সর্বোচ্চ ১০ বছর ও সর্বনিম্ন পাঁচ বছরের সশ্রম কারাদ- এবং এর অতিরিক্ত অর্থদণ্ডেরও বিধান রয়েছে। কোন নারী বা শিশুকে ধর্ষণ করে মৃত্যু ঘটানো বা আহত করার চেষ্টা করলে ধর্ষণকারী যাবজ্জীবন সশ্রম কারাদণ্ডে দণ্ডিত হবে এবং এর অতিরিক্ত অর্থদণ্ডেও দণ্ডিত হবে। তবে শিশু ধর্ষণ বা নির্যাতন বা হত্যা বিষয়ে মামলা করে বিচার পাওয়ার চেয়ে সমাজে যেন এ ধরনের ঘটনা কোনভাবেই না ঘটে সে ব্যবস্থা করা অধিকতর মঙ্গলজনক। কারণ চৎবাবহঃরড়হ রং নবঃঃবৎ ঃযধহ পঁৎবৎ. ধর্ষণের হাত থেকে পরিত্রাণ পেতে হলে আমাদের দর্শন ও নৈতিকতার উন্নয়ন করতে হবে, আমাদের মনের অশুভ চিন্তা বা দৃষ্টিভঙ্গির পরিবর্তন করতে হবে। বর্তমান বাস্তবতায় সমাজে ধর্ষণের বিরুদ্ধে সম্মিলিত কণ্ঠে প্রতিবাদ হওয়াটা খুবই জরুরী। ধর্ষকরা অনেক সময় উপযুক্ত শাস্তি পায় না বলেই পরবর্তীকালে তারা আবারও বীরদর্পে ধর্ষণ করে। আর তাদেরকে দেখে অন্যরাও ধর্ষণ করতে উৎসাহিত হয়। এভাবে চলতে থাকলে এ সমাজ, দেশ ও জাতি কলুষিত হবে। দেশ পরিণত হবে মগের মুল্লুকে। তাই ধর্ষণ রোধে প্রতিটি পরিবার থেকে প্রতিটি শিশুকে ছোটবেলা থেকেই নৈতিক শিক্ষা প্রদান করা প্রয়োজন, যেন বড় হয়ে সে কোনভাবেই এ পথে পা না বাড়ায়। পরিবারই শিশুর আচরণ, মূল্যবোধ, নৈতিকতা ইত্যাদির ভিত্তি তৈরি করে দেয়। সর্বোপরি, ধর্ষণ প্রতিরোধে সরকারসহ বিভিন্ন সরকারী-বেসরকারী প্রতিষ্ঠান, গণমাধ্যম, সুধীসমাজসহ সকলের একযোগে এগিয়ে আসা প্রয়োজন। প্রয়োজন ধর্ষণকে যে কোন মূল্যে প্রতিহত করা। এ দেশ ও জাতির সামগ্রিক উন্নয়ন, অগ্রগতি ঘটানোসহ সমাজের শান্তিশৃঙ্খলা বজায় রাখার স্বার্থেই ধর্ষণকে কঠোর হস্তে প্রতিহত করা এখন সময়ের দাবি এবং তা অপরিহার্য একটি বিষয় হিসেবে দেখা দিয়েছে।
লেখক : সহযোগী অধ্যাপক, আইন বিভাগ, ড্যাফোডিল ইন্টারন্যাশনাল ইউনিভার্সিটি
kekbabu@yahoo.com

Link: https://www.dailyjanakantha.com/details/article/527895/%E0%A6%A7%E0%A6%B0%E0%A7%8D%E0%A6%B7%E0%A6%A3-%E0%A6%AC%E0%A6%A8%E0%A7%8D%E0%A6%A7-%E0%A6%B9%E0%A6%9A%E0%A7%8D%E0%A6%9B%E0%A7%87-%E0%A6%A8%E0%A6%BE-%E0%A6%95%E0%A7%87%E0%A6%A8/

18
জীবনকে ভালোবাসতে শিখতে হবে
ড. কুদরাত-ই-খুদা বাবু
১০ সেপ্টেম্বর ২০২০, ০০:০০:০০ | প্রিন্ট সংস্করণ

আজ ১০ সেপ্টেম্বর। বিশ্ব আত্মহত্যা প্রতিরোধ দিবস। বিশ্ব স্বাস্থ্য সংস্থার (ডব্লিউএইচও) উদ্যোগে ২০০৩ সাল থেকে প্রতি বছর এ দিবসটি বাংলাদেশসহ সারা বিশ্বে পালিত হয়ে আসছে। ধর্মীয় বিধানের আলোকে ছোটবেলা থেকেই আমরা ‘আত্মহত্যা মহাপাপ’- এ কথা শোনার পাশাপাশি বিশ্বাস করে আসছি এবং আইন অনুযায়ী আত্মহত্যার চেষ্টা করা দণ্ডনীয় অপরাধও বটে। তা সত্ত্বেও সমাজে আত্মহত্যার ঘটনা ঘটেই চলেছে। সম্প্রতি বলিউড তারকা সুশান্ত সিং রাজপুতের আত্মহত্যার খবর ছড়িয়ে পড়লে অনেকেই ফেসবুকে আবেগঘন স্ট্যাটাস দেন। আবার অনেকেই হয়েছেন বিমোহিত। কারণ প্রিয় নায়কের অস্বাভাবিক মৃত্যু মন থেকে মেনে নেয়া যায় না। সুশান্তের বাসা থেকে তার লাশসহ অ্যান্টি-ডিপ্রেশন ওষুধ ও প্রেসক্রিপশন উদ্ধারের মাধ্যমে ধরে নেয়া যায়, এটি একটি আত্মহত্যা। শুধু বলিউড তারকা সুশান্ত-ই নয় বরং পত্রিকার পাতা খুললে প্রায়ই চোখে পড়ে আত্মহত্যাসংক্রান্ত নানা খবর। আমাদের দেশও এর ব্যতিক্রম নয়। এ দেশের বিভিন্ন শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানের শিক্ষার্থীসহ দেশের বিভিন্ন জায়গায় আত্মহত্যাসংক্রান্ত নানা খবর প্রায়ই চোখে পড়ে। বলাবাহুল্য, আত্মহত্যা হচ্ছে মানবজীবনের এক চরম অসহায়ত্ব। ক্ষণিক আবেগে একটি মহামূল্যবান জীবনের চির অবসান ঘটানো, যা কোনো কিছুর বিনিময়েই ফিরে পাওয়া সম্ভব নয়। আত্মহত্যার মাধ্যমে নিজের মূল্যবান জীবনকে যেমন একদিকে শেষ করে দেয়া হয়, তেমনি অপরদিকে একটি সম্ভাবনারও চির অবসান ঘটে।

ইতিহাস পর্যালোচনা করলে দেখা যায়, অতি প্রাচীনকাল থেকেই বিভিন্ন দেশে আত্মহত্যা নামক এ মহাপাপ সংঘটিত হয়ে আসছে। যদিও এটিকে কোনো সমাজই কখনও ভালো চোখে দেখেনি এবং আগামীতেও দেখবে বলে মনে হয় না। একজন ব্যক্তির আত্মহত্যা করার পেছনে সাধারণত যে কারণগুলো থাকে তা হচ্ছে- বিষণ্নতা বা ডিপ্রেশন, আর্থিক, সামাজিক, পারিবারিক বিভিন্ন সমস্যা কিংবা নিতান্ত ব্যক্তিগত মনোকষ্ট, বাইপোলার ডিসঅর্ডার, সিজোফ্রেনিয়া (দীর্ঘদিন ধরে ব্যর্থতা, গ্লানি বা হতাশা এবং নিজের প্রতি আত্মবিশ্বাসের ঘাটতি, অনাগত ভবিষ্যৎ সম্পর্কে উদ্বেগ, নিঃসঙ্গতা, কর্মব্যস্তহীন দিনযাপন ইত্যাদি মানব মস্তিষ্ককে সিজোফ্রেনিয়ায় আক্রান্ত করে), পার্সোনালিটি ডিসঅর্ডার, এনজাইটি ডিসঅর্ডার, অ্যালকোহল ব্যবহারজনিত ডিসঅর্ডার ইত্যাদি।

বিশ্ব স্বাস্থ্য সংস্থার পরিসংখ্যান মতে, বিশ্বে প্রায় ১২১ মিলিয়ন মানুষ মাত্রাতিরিক্ত বিষণ্নতার শিকার। বিশ্ব স্বাস্থ্য সংস্থার বিশেষজ্ঞরা আশঙ্কা প্রকাশ করছেন, ২০২০ সালের মধ্যেই হৃদরোগের পরেই বিষণ্নতা মানবসমাজের বিপন্নতার দ্বিতীয় কারণ হিসেবে প্রতীয়মান হবে। বিশ্ব স্বাস্থ্য সংস্থার জরিপ অনুযায়ী, বর্তমানে বিশ্বে প্রতি এক লাখ মানুষের মধ্যে বার্ষিক আত্মহত্যার হার ১১ দশমিক ৪ শতাংশ। জরিপে দেখা যায়, শুধু ২০১২ সালে সারা বিশ্বে আত্মহত্যার ঘটনা ঘটেছে ৮ লাখ ৪ হাজারটি।
প্রতি ৪০ সেকেন্ডে একটি করে আত্মহত্যা সংঘটিত হচ্ছে। তবে এর মধ্যে ১৫-২৯ বছর বয়সীদের মধ্যে আত্মহত্যার প্রবণতা সবচেয়ে বেশি। আর বাংলাদেশে বার্ষিক আত্মহত্যার সংখ্যা গড়ে ১০ হাজার ২২০টি, যার মধ্যে ৫৮-৭৩ শতাংশ আত্মহত্যাকারীই নারী। খোঁজ নিলে দেখা যাবে, দেশের বিভিন্ন শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানের অনেক শিক্ষার্থীই হতাশা, মানসিক অশান্তি ও মানসিক অস্থিরতায় ভুগছেন। তথ্যপ্রযুক্তির বহুমাত্রিক অপব্যবহারসহ নানা কারণে আগের তুলনায় সাম্প্রতিক সময়ে শিক্ষার্থীদের মাঝে এ অবস্থা অধিকমাত্রায় বৃদ্ধি পেয়েছে। প্রেমে ব্যর্থতাসহ বিভিন্ন কারণে হতাশা, মানসিক অশান্তি ও মানসিক অস্থিরতার ফলে শিক্ষার্থীদের মাঝে এ ধরনের প্রবণতা বেড়েই চলছে। শিক্ষার্থীদের মাঝে আত্মহত্যার প্রবণতাসহ আত্মহত্যাচেষ্টার প্রবণতা বেড়ে চলা এবং অনেক শিক্ষার্থী মানসিক অশান্তি ও অস্থিরতায় ভুগলেও অধিকাংশ শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানেই নেই কোনো পেশাদার পরামর্শক বা কাউন্সেলর। কোনো শিক্ষার্থী যদি আত্মহত্যা করে বা আত্মহত্যার চেষ্টা করে, তবে তা হবে সমাজ-দেশ ও জাতির জন্য অত্যন্ত লজ্জার বিষয়। কারণ শিক্ষার্থীদের কাছ থেকে তাদের পরিবারসহ সমাজ, দেশ ও জাতি ভালো অনেক কিছু আশা করেন। একজন শিক্ষার্থীকে স্কুল-কলেজ কিংবা বিশ্ববিদ্যালয় পর্যায়ে আসতে তার অভিভাবকসহ ওই শিক্ষার্থীকে অনেক ত্যাগ-তিতিক্ষা ও সংগ্রাম করতে হয়। পাড়ি দিতে হয় অনেক দুর্গম ও বন্ধুর পথ। এ বিষয়গুলো প্রতিটি শিক্ষার্থীরই উপলব্ধি করা প্রয়োজন। শিক্ষার্থীদের স্মরণ রাখা উচিত, অনেক আশা-ভরসা নিয়ে তাদের বাবা-মা, অভিভাবকরা তাদের শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানে লেখাপড়া শেখাতে পাঠান।

মানুষের জীবনেই সমস্যা আছে এবং সমস্যা আসবে- এটিই স্বাভাবিক। তার মানে এই নয় যে, জীবনে সমস্যা এলে বা সমস্যায় পড়লে আত্মহত্যা করে জীবনকে শেষ করে দিতে হবে। বরং জীবনে সমস্যা এলে আবেগনির্ভর না হয়ে সুস্থ মস্তিষ্কে ও বাস্তবতার আলোকে সেই সমস্যার সমাধান খোঁজা দরকার। প্রয়োজনে কোনো মনোরোগ বিশেষজ্ঞের শরণাপন্ন হওয়া যেতে পারে। যখন কেউ আত্মহত্যা করে বা আত্মহত্যার চেষ্টা করে, তখন ধরে নেয়া হয় এটি তার মানসিক অস্থিরতা বা আবেগ দ্বারা তাড়িত হওয়ার ফলাফল। বাংলাদেশের প্রেক্ষাপটে আত্মহত্যার পেছনের কারণগুলোর মধ্যে রয়েছে- পারিবারিক বা ব্যক্তিগত সম্পর্কের মধ্যে ভুল বোঝাবুঝির সৃষ্টি হওয়া, সম্পর্কের বিচ্ছেদ ঘটা, পরীক্ষায় আশানুরূপ ফলাফল লাভ করতে না পারা, অপরিসীম অর্থকষ্ট, ধর্ষণ, যৌন, শারীরিক বা মানসিক নির্যাতন-নিপীড়ন, মাদকাসক্তিসংক্রান্ত সমস্যা, নানা ধরনের মানসিক অসুস্থতা ইত্যাদি। এসবের পাশাপাশি রয়েছে প্রিয় কোনো নেতা, অভিনেতা, শিল্পী, খেলোয়াড়ের আকস্মিক মৃত্যুর খবর; কর্মস্থল বা শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানে সহকর্মী বা সহপাঠীদের সঙ্গে ভুল বোঝাবুঝির সৃষ্টি হওয়া, দীর্ঘদিনের বেকারত্ব বা হঠাৎ চাকরিচ্যুতি বা চাকরিতে পদাবনতি ঘটা, ‘এ পৃথিবীতে কেউ আমাকে চায় না’; ‘এ পৃথিবীতে বেঁচে থেকে আমার কোনো লাভ নেই’- এ জাতীয় বদ্ধমূল চিন্তাভাবনা ইত্যাদি। এসব চিন্তার ফলে মনের মধ্যে সৃষ্টি হওয়া প্রচণ্ড রকমের হতাশা ও ক্ষোভের কারণে মানুষ তার নিজের প্রতি আস্থা ও সম্মানবোধ হারিয়ে ফেলে। আর তখনই সে সবার কাছ থেকে নিজেকে গুটিয়ে নিতে শুরু করে এবং একসময় আত্মহত্যার পথ বেছে নেয়। আবার কিছু ব্যর্থতাও মানুষকে আত্মহত্যার পথে ঠেলে দেয়। পরিবারের সব সদস্যের মৌলিক চাহিদা পূরণ করতে না পারা এবং দীর্ঘদিনেও ঋণমুক্তির উপায় খুঁজে না পাওয়া ইত্যাদিও রয়েছে আত্মহত্যার কারণের মধ্যে। এছাড়াও প্রেমে ব্যর্থতাসহ প্রেমিক-প্রেমিকার ইচ্ছাপূরণের জন্য জেদের বশবর্তী হয়েও অনেক তরুণ-তরুণীকে আত্মহত্যার পথ বেছে নিতে দেখা যায়।

দুঃখজনক হলেও সত্য, আমাদের দেশের বিভিন্ন বিশ্ববিদ্যালয়, স্কুল-কলেজের শিক্ষার্থীরা আত্মহত্যার ক্ষেত্রে এগিয়ে রয়েছে। বলা বাহুল্য, আত্মহত্যাজনিত মৃত্যুর অধিকাংশই প্রতিরোধযোগ্য। অধিকাংশ ব্যক্তিই আত্মহত্যার সময় কোনো না কোনো গুরুতর মানসিক রোগে আক্রান্ত হয়ে থাকেন। স্বাস্থ্যকর জীবনযাপন, শারীরিক ও মানসিক যে কোনো অসুস্থতায় যথাযথ স্বাস্থ্যসেবা লাভের সুযোগ আত্মহত্যার প্রবণতা কমায়। পাশাপাশি আত্মহত্যা প্রতিরোধে কিছু বিষয় রয়েছে যেগুলোকে প্রোটেকটিভ ফ্যাক্টর বা রক্ষাকারী বিষয় বলা হয়। যেমন- জীবনের খারাপ সময়গুলোতে খাপ খাইয়ে নেয়ার ক্ষমতা জন্মানো, নিজের প্রতি শ্রদ্ধা ও আত্মবিশ্বাস জন্মানো, সমস্যা সমাধানের কার্যকর দক্ষতা বাড়ানো এবং প্রয়োজনে অন্যের কাছ থেকে ইতিবাচক সহায়তা লাভের চেষ্টা করা ইত্যাদি। তাছাড়া সামাজিক ও ধর্মীয় রীতি-নীতি, অনুশাসন, ভালো বন্ধু, প্রতিবেশী ও সহকর্মীর সঙ্গে সামাজিক সুসম্পর্ক প্রভৃতি আত্মহত্যা প্রবণতা হ্রাসে সহায়তা করে। এছাড়া সুষম খাদ্য গ্রহণ, পর্যাপ্ত নিদ্রা, নিয়মিত শরীরচর্চা, ধূমপান ও মাদকাসক্তি থেকে দূরে থাকা তথা স্বাস্থ্যকর জীবনযাপন এবং শারীরিক ও মানসিক যে কোনো অসুস্থতায় যথাযথ স্বাস্থ্যসেবা লাভের সুযোগ আত্মহত্যা প্রবণতা কমায়। সুতরাং শিক্ষার্থীদের হতাশা ও মানসিক অশান্তি থেকে উত্তরণের জন্য দেশের সব শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানে দ্রুত পেশাদার কাউন্সেলর নিয়োগ করা প্রয়োজন। আর তা সম্ভব হলে শিক্ষার্থীদের আত্মহত্যার চেষ্টা চালানো কিংবা আত্মহত্যা করার প্রবণতা অনেকটাই কমে আসবে বলে আশা করা যায়। সর্বোপরি, আত্মহত্যার বিভিন্ন নেতিবাচক দিক তুলে ধরে নিয়মিতভাবে তা প্রচার-প্রচারণারও ব্যবস্থা করা আবশ্যক। শিক্ষার্থীসহ সবাইকে জীবনের গুরুত্ব ও মূল্য সম্পর্কে বুঝতে হবে। সবাইকে বুঝতে হবে, জীবন একটিই এবং তা মহামূল্যবান। জীবন একবার হারালে তা আর কোনো কিছুর বিনিময়েই ফিরে পাওয়া সম্ভব নয়। জীবনটিকে যদি সুন্দরভাবে সাজানো যায় তাহলে জীবনকে সুন্দরভাবে উপভোগও করা যায়। তাই আসুন, আত্মহত্যার চিন্তা ও আত্মহত্যার পথ পরিহার করে এখন থেকেই আমরা আমাদের জীবনকে ভালোভাবে ভালোবাসতে শিখি।

ড. কুদরাত-ই-খুদা বাবু: ড্যাফোডিল ইন্টারন্যাশনাল ইউনিভার্সিটির আইন বিভাগের সহযোগী অধ্যাপক এবং ক্যামব্রিজ ইউনিভার্সিটির (যুক্তরাজ্য) সেন্টার ফর দ্য স্টাডি অব গ্লোবাল হিউম্যান মুভমেন্টের সহযোগী সদস্য
kekbabu@yahoo.com

Link: https://www.jugantor.com/todays-paper/sub-editorial/343158/%E0%A6%9C%E0%A7%80%E0%A6%AC%E0%A6%A8%E0%A6%95%E0%A7%87-%E0%A6%AD%E0%A6%BE%E0%A6%B2%E0%A7%8B%E0%A6%AC%E0%A6%BE%E0%A6%B8%E0%A6%A4%E0%A7%87-%E0%A6%B6%E0%A6%BF%E0%A6%96%E0%A6%A4%E0%A7%87-%E0%A6%B9%E0%A6%AC%E0%A7%87

19
সড়ক দুর্ঘটনা রোধে যথাযথ বাস্তবায়ন জরুরি

ড. কুদরাত-ই-খুদা বাবু
 
এ দেশে সড়ক দুর্ঘটনা নতুন কোনো বিষয় নয়। পত্রিকার পাতা খুললে কিংবা টিভি চ্যানেলের সংবাদের দিকে চোখ রাখলে প্রায় প্রতিদিনই চোখে পড়ে সড়ক দুর্ঘটনায় আহত ও নিহত হওয়ার খবরাখবর। দেশে প্রতিনিয়ত মর্মান্তিক সড়ক দুর্ঘটনা ঘটে চললেও তা রোধে কার্যকর তেমন কোনো পদক্ষেপ গ্রহণ করা হয় না এবং সেই সঙ্গে জনগণও ট্রাফিক আইন ভালোভাবে মানে না। তাই প্রায় প্রতিনিয়তই ঘটে চলেছে সড়ক দুর্ঘটনা। পরিসংখ্যান মোতাবেক, দেশে যেভাবে সড়ক দুর্ঘটনা ঘটে চলেছে, তাতে মনে হয় দেশের সড়ক-মহাসড়কগুলো নিরাপদে চলার পথ না হয়ে তা দিনে দিনে মৃত্যুফাঁদে পরিণত হচ্ছে। প্রশ্ন হচ্ছে, দেশের সড়ক-মহাসড়কগুলোতে নিয়মিতভাবে ঘটে চলা দুর্ঘটনাগুলো কি এ দেশের জনগণের কপালের লিখন? দেশের সড়ক-মহাসড়কে প্রতিনিয়ত সড়ক দুর্ঘটনাগুলোকে যদি এ দেশের পরিপ্রেক্ষিতে না দেখে উন্নত দেশের পরিপ্রেক্ষিতে দেখা যায়, তাহলে দেখা যাবে উন্নত দেশে সড়ক দুর্ঘটনার হার এ দেশের তুলনায় অনেক কম। সুতরাং, এ দেশের সড়ক-মহাসড়কগুলোতে নিয়মিতভাবে ঘটে চলা দুর্ঘটনা জনগণের কপালের লিখন নয়, কিংবা ভাগ্যদেবীর নির্মম পরিহাসও নয়। এ ক্ষেত্রে যে বিষয়গুলো এ পার্থক্যের সৃষ্টি করছে তা হচ্ছে; সার্বিক যোগাযোগব্যবস্থার ধরন, চালকদের দক্ষতা, বেপরোয়া গতিতে গাড়ি চালানো, চালকদের ওভারট্রেকিং করার মানসিকতা প্রবল মাত্রায় বিদ্যমান থাকা, ড্রাইভিং লাইসেন্স প্রাপ্তিতে স্বচ্ছতা ও জবাবদিহির অভাব, জনগণের সচেতনতার অভাব, জনগণ কর্তৃক ট্রাফিক আইন কিংবা রাস্তায় চলাচলের নিয়ম না মানা প্রভৃতি। সরকারি তথ্য বিশ্লেষণ করে বাংলাদেশ প্রকৌশল বিশ্ববিদ্যালয় বলছে, সড়ক দুর্ঘটনার ৯০ শতাংশেরই কারণ হলো চালকের বেপরোয়া মনোভাব ও গতি। এদেশে লাইসেন্সবিহীন ও ট্রাফিক আইন না জানা চালকের সংখ্যাই বেশি। সড়ক দুর্ঘটনার অনেক কারণের মধ্যে এটি একটি উল্লেখযোগ্য কারণ।

এক হিসাবে দেখা গেছে, সড়ক দুর্ঘটনার দিক থেকে বাংলাদেশের অবস্থান সমগ্র বিশ্বে দ্বিতীয়। বেসরকারি সূত্রগুলো বলছে, প্রতি বছর দেশের সড়কপথে অন্তত ৫ হাজার দুর্ঘটনা ঘটছে আর এক বছরেই দেশে মৃতের সংখ্যা ২০ হাজার ছাড়িয়ে যায় এবং পঙ্গুত্ব বরণ করছে এর দ্বিগুণ। দেশের সড়ক-মহাসড়কগুলোয় যেভাবে দুর্ঘটনা ঘটছে এবং দুর্ঘটনার সংখ্যা দিনে দিনে যে হারে বাড়ছে, তা যদি অতি দ্রুত রোধ করার ব্যাপারে যথাযথ পদক্ষেপ গ্রহণ না করা হয়, তাহলে যে ভবিষ্যতেও ভয়াবহ ও মর্মান্তিক সড়ক দুর্ঘটনা ঘটার পাশাপাশি জনগণ আহত-নিহত হতেই থাকবে। সুতরাং, সড়ক দুর্ঘটনা রোধকল্পে মাননীয় প্রধানমন্ত্রী যে ছয় দফা নির্দেশনা দিয়েছিলেন, তা এখন অক্ষরে অক্ষরে বাস্তবায়ন করা প্রয়োজন। পাশাপাশি সড়ক দুর্ঘটনার অন্যান্য কারণও নিবিড়ভাবে চিহ্নিত করা প্রয়োজন। সড়ক দুর্ঘটনার অন্যান্য কারণের মধ্যে রয়েছে সঠিক পরিকল্পনাহীন দেশে অনেক অনুপযুক্ত সড়ক-মহাসড়ক নির্মাণ, নির্দিষ্ট লেন ধরে গাড়ি না চালিয়ে সড়কের মাঝ দিয়ে চালকদের গাড়ি চালানো, রাস্তায় বিপজ্জনক বাঁক বিদ্যমান থাকা, রাস্তার ত্রুটিপূর্ণ নকশা থাকা, ফিটনেসবিহীন গাড়ি রাস্তায় চালানো, মাদক সেবন করে গাড়ি চালানো, চালকদের বেপরোয়া গতিসহ ভুল পথে বেপরোয়া গাড়ি চালানো, বেশি গতির বড় গাড়িগুলোর অপেক্ষাকৃত কম গতির ছোট গাড়িগুলোকে ওভারটেকিং করার টেনডেন্সি থাকা, রাস্তা দিয়ে চলাচলকারী যাত্রী বা পথচারীদের ট্রাফিক আইন না মানার প্রবণতা, রাস্তার ফুটপাত ব্যবহার না করে রাস্তার মাঝখান দিয়ে জনগণের চলাচল করা, রাস্তা পারাপারের জন্য অনেক সময় ওভারব্রিজ থাকলেও তা ব্যবহার না করে ঝুঁকি নিয়ে রাস্তা পার হওয়া, রাস্তার ওপর ও ফুটপাতে দোকানপাট সাজিয়ে ব্যবসা-বাণিজ্য করা, যত্রতত্র গাড়ি পার্কিং করা, দুর্বল ও দুর্নীতিগ্রস্ত ট্রাফিকব্যবস্থা এবং সর্বোপরি রাস্তায় চলাচলের জন্য যেসব নিয়মকানুন রয়েছে, তা না মানা।

সড়ক দুর্ঘটনা অপ্রতিরোধ্য কোনো কঠিন বিষয় নয়। এজন্য দরকার সরকার ও জনগণের ইতিবাচক চিন্তা এবং সমন্বিত পদক্ষেপ গ্রহণ ও বাস্তবায়ন। রাস্তার ওপর ফুটপাতে দোকানপাট স্থাপনসহ ফুটপাতে নির্বিঘ্নে হকারদের ব্যবসা করার ‘সুযোগ’ করে দেওয়া, অপরিকল্পিত ও দুর্বল ট্রাফিকব্যবস্থা, চাঁদাবাজি, খেয়ালখুশি মতো যেখানে-সেখানে গাড়ি পার্কিং করা, সড়ক-মহাসড়কের ওপর রিকশা, ভ্যান, টেম্পো, ট্যাক্সিস্ট্যান্ড স্থাপন করা, সড়ক-মহাসড়কের উন্নয়নের কাজ যথাযথভাবে সম্পন্ন না করা এবং একই রাস্তা বছরে বারবার খনন করা, জনগণ কর্তৃক রাস্তা পারাপারের নিয়মকানুন সঠিকভাবে না মানার কারণে এ দেশের সড়ক-মহাসড়কগুলোতে প্রতিনিয়ত দুর্ঘটনা ঘটেই চলেছে। সড়ক দুর্ঘটনা রোধে সর্বাগ্রে চালকদের হতে হবে বেশি দক্ষ, হতে হবে সতর্ক। আর জনগণকেও ট্রাফিক আইন ও রাস্তায় চলাচলের আইনকানুন যথারীতি মেনে চলতে হবে। তাছাড়া সড়ক দুর্ঘটনা রোধে দেশের সার্বিক সড়কব্যবস্থার উন্নয়ন ঘটানোসহ চালকদের দক্ষতা বিচার করে দুর্নীতিমুক্তভাবে ড্রাইভিং লাইসেন্স দেওয়ার বিষয়টিও নিশ্চিত করা জরুরি। সড়ক দুর্ঘটনা রোধে বিভিন্ন গণমাধ্যম, সুশীলসমাজ, সরকারসহ আপামর জনগণকে একযোগে এগিয়ে আসতে হবে। সেই সঙ্গে সড়ক দুর্ঘটনা রোধকল্পে মাননীয় প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা যে ছয় দফা নির্দেশনা দিয়েছেন, তা এখন যথাযথভাবে বাস্তবায়ন করা আবশ্যক। সর্বোপরি, সড়ক দুর্ঘটনা রোধে সবাই সচেতন হলে সড়ক দুর্ঘটনা নিশ্চয় অনেকাংশে কমে আসবে।

লেখক :সহযোগী অধ্যাপক, আইন বিভাগ, ড্যাফোডিল ইন্টারন্যাশনাল ইউনিভার্সিটি

Link: https://www.ittefaq.com.bd/print-edition/opinion/180395/%E0%A6%B8%E0%A7%9C%E0%A6%95-%E0%A6%A6%E0%A7%81%E0%A6%B0%E0%A7%8D%E0%A6%98%E0%A6%9F%E0%A6%A8%E0%A6%BE-%E0%A6%B0%E0%A7%8B%E0%A6%A7%E0%A7%87-%E0%A6%AF%E0%A6%A5%E0%A6%BE%E0%A6%AF%E0%A6%A5-%E0%A6%AC%E0%A6%BE%E0%A6%B8%E0%A7%8D%E0%A6%A4%E0%A6%AC%E0%A6%BE%E0%A7%9F%E0%A6%A8-%E0%A6%9C%E0%A6%B0%E0%A7%81%E0%A6%B0%E0%A6%BF

20
এ সময়ে ভেজাল খাদ্য (দৈনিক জনকন্ঠ, ১২ জুলাই ২০২০, পৃ. ৫)

ড. কুদরাত-ই-খুদা বাবু

মানুষের জীবন ধারণ ও জীবন যাপনের জন্য যতগুলো চাহিদা রয়েছে, তার মধ্যে খাদ্য হচ্ছে প্রথম ও প্রধান মৌলিক চাহিদা। কিন্তু এ দেশের জনগণ প্রতিদিন যেসব খাবার খান, তা কি সম্পূর্ণরূপে নিরাপদ বা ভেজালমুক্ত? নিশ্চয় না। তার মানে, জনগণ প্রতিনিয়তই ভেজাল খাবার খাচ্ছেন। ভেজালযুক্ত খাদ্য থেকে জনগণ মুক্তি চাইলেও যেন কিছুতেই মুক্তি পাচ্ছেন না। তবে একদিনে এ অবস্থার সৃষ্টি হয়নি। দীর্ঘদিন ধরে সংশ্লিষ্ট কর্তৃপক্ষের গাফিলতি, অসাধু ও অতি মুনাফালোভী ব্যক্তিদের ফলে মূলত এ অবস্থার সৃষ্টি হয়েছে। ভেজালমুক্ত খাদ্য যেমন দেহের ক্ষয় পূরণ, বৃদ্ধি সাধন এবং রোগ প্রতিরোধ করে, তেমনি ভেজালযুক্ত খাদ্য গ্রহণের ফলে নানা রোগ-ব্যাধিতে আক্রান্ত হয়ে জীবন বিপন্ন পর্যন্ত হতে পারে। তাই ‘সকল সুখের মূল’ নামক স্বাস্থ্যকে সুস্থ ও সুন্দর রাখতে ভেজালমুক্ত খাবার গ্রহণের কোন বিকল্প নেই। কিন্তু আমাদের দেশে শাক-সবজি, ফল-মূল, মাছ-মাংস, দুধ, গুড়, মসলা থেকে শুরু করে নিত্যপ্রয়োজনীয় প্রায় সব খাদ্যই ভেজালে পরিপূর্ণ। এমনকি এ দেশে শিশুখাদ্যসহ জীবন রক্ষাকারী ওষুধেও ভেজাল মেশানো হয়েছে এবং ভেজালযুক্ত ওষুধ খেয়ে অনেক শিশুর মৃত্যু পর্যন্ত হয়েছে। আবার এসব অপরাধের সঙ্গে জড়িত ব্যক্তিরা শেষ পর্যন্ত ছাড়ও পেয়েছেন, যা গোটা জাতির জন্য অত্যন্ত লজ্জাজনক বিষয়। বলাবাহুল্য, নিরাপদ খাদ্যের বিষয়টি জনস্বাস্থ্য সংক্রান্ত এমনই এক বিষয় যে, এ ক্ষেত্রে কাউকে ন্যূনতম ছাড় পর্যন্ত দেয়ার কোন সুযোগ নেই। অথচ আমাদের দেশে বাস্তবে ঘটছে উল্টো ঘটনা। করোনাভাইরাসের প্রাদুর্ভাবের এই কঠিন সময়েও এ দেশে থেমে নেই খাদ্যে ভেজাল দেয়ার প্রবণতা। উদাহরণ হিসেবে বলা যায়, গত ১০ মে রাজধানীর বাদামতলীতে র‌্যাব ও কৃষি সম্প্রসারণ অধিদফতর অভিযান চালায়। র‌্যাবের ভাষ্য মতে, আরও সপ্তাহখানেক আগে থেকেই সেখানে রঙিন কাঁচা আম আড়তগুলোতে বিক্রি হচ্ছিল। অথচ তখন পর্যন্ত আম পাকার বা আম গাছ থেকে নামানোর সময় হয়নি। করোনার হাত থেকে যখন মানুষ নিজেদের রক্ষা করতে হিমশিম খাচ্ছে; কোয়ারেন্টাইন ও সোশ্যাল ডিসটেন্সিংসহ নানা রকম প্রতিরোধমূলক ব্যবস্থা নিচ্ছে; সরকার যখন মানুষকে নানা বিষয়ে সতর্ক করছে; বিজ্ঞানীরাও যখন মানুষকে শরীরের রোগ প্রতিরোধ ব্যবস্থা বা ইমিউনিটি কিভাবে বাড়ানো যায় সে বিষয়ে বিভিন্ন পরামর্শ দিচ্ছেন, ঠিক তখনই এ দেশে চলছে বিভিন্ন খাদ্য-দ্রব্যে ভেজাল মেশানোর চির পরিচিত খেলা। চিকিৎসা বিজ্ঞানীদের মতে, শরীরে ইমিউনিটি ভাল থাকলে ও স্বাস্থ্যবিধি যথাযথভাবে মেনে চললে করোনা সহজে কাউকে সংক্রমিত করতে পারবে না। পৃথিবীতে এখন পর্যন্ত যখন করোনার কোন টিকা বা ওষুধ আবিষ্কৃত হয়নি, তখন যার যার শরীরের ইমিউনিটিকে রক্ষা করার জন্য সবাই কত চেষ্টাই না করছে। কারণ, এটাই এখন আত্মরক্ষার জন্য অন্যতম প্রধান বর্ম। সুতরাং, একে কিছুতেই নষ্ট করা যাবে না, বরং শরীরে এই ইমিউনিটি কিভাবে বাড়ানো যায় সেই চেষ্টা করতে হবে। আমাদের দেশে এখন চলছে আম-কাঁঠালসহ বিভিন্ন ফলের মৌসুম। এ কথা সর্বজনস্বীকৃত যে, প্রাকৃতিকভাবে পরিপক্ব বা পাকানো ফল ও শাকসবজির মধ্যে ইমিউনিটি বাড়ানোর অসীম ক্ষমতা থাকে। তাই করোনার বিরুদ্ধে লড়াই করতে গেলে অবশ্যই আমাদের প্রত্যেকের শরীরে ইমিউনিটি বাড়ানো অত্যন্ত জরুরী বিষয়। কিন্তু ফরমালিন মেশানো আমসহ বিভিন্ন ফল, শাক-সবজি এবং ভেজাল মেশানো বিভিন্ন খাদ্য-দ্রব্য খেয়ে সেই ইমিউনিটি বাড়ানোর বদলে নিজের অজান্তেই কমে যাচ্ছে, যা অত্যন্ত দুঃখজনক এবং তা আমাদের সকলের জন্যই এক অশনিসংকেত বটে।

অনেক সময় দেখা যায়, ফল পাকানোর ক্ষেত্রে বিষাক্ত কেমিক্যাল ব্যবহার করা হয়। ফল পাকানোয় ব্যবহৃত বিষাক্ত রাসায়নিকের কিছু অংশ ফলের খোসার সূক্ষè ছিদ্র দিয়ে ফলের ভেতরে প্রবেশ করে। আর এ ধরনের ফল খাবার ফলে ক্ষতিকর রাসায়নিক পদার্থের অংশ বিশেষ শরীরে ঢুকে পড়ে লিভার, কিডনিসহ মানবদেহের বিভিন্ন অঙ্গ-প্রত্যঙ্গের ক্ষতি করে থাকে। বিকল্প উপায় না থাকায় জনগণকে এক প্রকার বাধ্য হয়েই এসব ভেজাল খাদ্য খেতে হচ্ছে। ফলে প্রতি বছর অসংখ্য মানুষ নানা রোগে আক্রান্ত হয়ে অকালেই মারা যাচ্ছেন। খাদ্য-দ্রব্যে ভেজাল (যেমন ফরমালিন, ক্যালসিয়াম কার্বাইড, প্রোফাইল প্যারা টিটিনিয়াম পাউডার বা পিপিটি, ইথেফেন ইত্যাদি) মেশানোর বিষয়টি দেশে দীর্ঘদিন ধরেই আলোচিত ও নিন্দিত হয়ে আসলেও জনগণ যেন এ থেকে পরিত্রাণ পাচ্ছেন না। পত্রিকায় প্রকাশিত প্রতিবেদন থেকে জানা যায়, দেশে শিল্প খাতে ফরমালিনের প্রয়োজন ৪০-৫০ টন। কিন্তু প্রতি বছর ফরমালিন আমদানি করা হয় প্রায় ২০৫ টন। তার মানে বাড়তি ১৫০ টনের বেশি ফরমালিন বিভিন্ন খাদ্য-দ্রব্যের সঙ্গে দেশবাসীর পেটে গেছে। অনেক সময় বিভিন্ন বাজারকে ফরমালিন মুক্ত ঘোষণা করতে দেখা যায়। অথচ খোঁজ নিলে দেখা যাবে, আগে যা ছিল কয়েকদিন পরে আবার তা-ই হয়েছে। ভেজালযুক্ত খাবার গ্রহণের ফলে দেশের জনগণ স্বাভাবিকভাবেই দীর্ঘমেয়াদী স্বাস্থ্য ঝুঁকিতে রয়েছেন, বিশেষ করে এই করোনার সময়ে। তবে সবচেয়ে বেশি স্বাস্থ্য ঝুঁকিতে রয়েছে অগণিত শিশু, যাদেরকে বলা হচ্ছে আগামীর ভবিষ্যত। এ ধরনের পরিস্থিতি নিঃসন্দেহে সকলের জন্যই উদ্বেগজনক। আমাদের পুরো খাদ্যচক্রের মধ্যে প্রতিনিয়ত যেভাবে বিষ ঢুকিয়ে দেয়া হচ্ছে, তাতে করে মনে হয় জাতি হিসেবে আমরা বেশ দ্রুত গতিতেই ধ্বংসের দিকে এগিয়ে যাচ্ছি। তাই, এসব বন্ধে স্বাস্থ্য মন্ত্রণালয়, খাদ্য মন্ত্রণালয়সহ সংশ্লিষ্ট কর্তৃপক্ষের পক্ষ থেকে দ্রুত বাস্তবমুখী পদক্ষেপ গ্রহণ করা অত্যাবশ্যক। আমাদের দেশে এখন পর্যন্ত গড়ে তোলা হয়নি ‘ফুড এ্যান্ড ড্রাগ প্রশাসন’ ধরনের কোন শক্তিশালী প্রতিষ্ঠান। পাশাপাশি উচ্চ আদালতের নির্দেশ জারির দীর্ঘদিনেও খাদ্যে ভেজাল রোধে সারাদেশে স্বতন্ত্রভাবে খাদ্য আদালত গঠন করা হয়নি। অবস্থা এমন যে, খাদ্যে ভেজাল রোধে কয়েকটি ভ্রাম্যমাণ আদালত পরিচালনার মধ্যেই যেন কার্যক্রম সীমাবদ্ধ। প্রতি বছর ১৫ মার্চ এলে ভোক্তা অধিকার দিবস পালন করা হয়। সারাদেশ যখন ভেজালযুক্ত খাদ্যে ভরে গেছে, তখন এমনি পরিস্থিতিতে কনজ্যুমার রাইটস সোসাইটি ও কনজ্যুমারস এ্যাসোসিয়েশন অব বাংলাদেশ (ক্যাব) একসঙ্গে আন্দোলন করার পর ২০১০ সালে ভোক্তা অধিকার সংরক্ষণ অধিদফতর গঠন করা হয়।

জনগণের সচেতনার অভাবসহ কর্তৃপক্ষের গাফিলতি ও দীর্ঘদিন ধরে দায়িত্বহীনতার কারণে কোনভাবেই খাদ্যে ভেজাল রোধ করা সম্ভব হচ্ছে না। আর এভাবেই চলছে মানুষের মূল্যবান জীবন নিয়ে ছিনিমিনি খেলা। এক পরিসংখ্যানে দেখা গেছে, প্রতি বছর ভেজাল খাদ্য খেয়ে তিন লাখের বেশি মানুষ আক্রান্ত হচ্ছেন মরণব্যাধি ক্যান্সারে। আর প্রায় দেড় লাখ মানুষ ডায়াবেটিস এবং প্রায় দুই লাখ মানুষ কিডনি রোগে আক্রান্ত হচ্ছেন। তবে ভেজাল খাদ্য গ্রহণের ফলে শিশু ও গর্ভবতী মহিলারা সবচেয়ে বেশি আক্রান্ত হচ্ছেন। ভেজাল খাদ্যের ফলে গর্ভবতী মায়ের শারীরিক বিভিন্ন জটিলতা দেখা দেয় এবং গর্ভজাত অনেক শিশু বিকলাঙ্গ হয়ে পড়ে। ভেজাল খাদ্যের কারণে শিশু বিকলাঙ্গ হওয়া এবং শিশুখাদ্যে ভেজাল মেশানো আগামী প্রজন্মের জন্য নিঃসন্দেহে এক অশনিসংকেতই বটে। নিত্যপ্রয়োজনীয় খাদ্য সামগ্রীতে বিষাক্ত কেমিক্যাল ব্যবহারে সরকার কর্তৃক নিষেধাজ্ঞা থাকলেও এক শ্রেণীর অসাধু ব্যবসায়ী জনস্বাস্থ্যের কথা চিন্তা না করে অধিক মুনাফার লোভে খাদ্য-দ্রব্যে বিষাক্ত কেমিক্যাল মেশাচ্ছে। এ ধরনের অসাধু ব্যবসায়ীরা সমাজের শত্রু, জনগণের শত্রু এবং এরা করোনার চেয়ে কোন অংশেই কম ক্ষতিকর নয়। অনেক সময় এদের কাউকে হাতেনাতে ধরা হলেও তারা ঘুষ, পেশী শক্তিসহ রাজনৈতিক ছত্রছায়ায় পার পেয়ে যায়। নিরাপদ খাদ্য আইন সঠিকভাবে বাস্তবায়িত না হওয়ার পাশাপাশি সংশ্লিষ্ট কর্তৃপক্ষের দায়িত্বহীনতা, উদাসীনতা এবং জনগণ সচেতন ও সোচ্চার না হওয়ায় খাদ্যে ভেজাল রোধ করা সম্ভব হচ্ছে না বলে আপাতদৃষ্টিতে প্রতীয়মান হয়। অতি দ্রুত যদি এ অবস্থার যদি ইতিবাচকভাবে পরিবর্তন ঘটানো না হয়, তাহলে আগামীতে এর কুফল যে কী ভয়ানক ও বিপজ্জনক হবে, তা সময়মতোই হাড়ে হাড়ে টের পাওয়া যাবে। তাই খাদ্য-দ্রব্যে ভেজাল ও ক্ষতিকর রাসায়নিক পদার্থ মেশানো রোধে খাদ্য মন্ত্রণালয়, স্বাস্থ্য মন্ত্রণালয়, বিভিন্ন গণমাধ্যমসহ সচেতন সকলের সম্মিলিতভাবে এগিয়ে আশা প্রয়োজন। প্রয়োজন এ ব্যাপারে জনসচেতনতা বৃদ্ধি করা। তবে খাদ্যে ভেজালরোধে সর্বাগ্রে প্রয়োজন নৈতিকতাবোধকে জাগ্রত করা, নিজের বিবেককে জাগ্রত করা।
লেখক : সহযোগী অধ্যাপক, আইন বিভাগ, ড্যাফোডিল ইন্টারন্যাশনাল ইউনিভার্সিটি

Link: https://www.dailyjanakantha.com/details/article/510584/%E0%A6%8F-%E0%A6%B8%E0%A6%AE%E0%A7%9F%E0%A7%87-%E0%A6%AD%E0%A7%87%E0%A6%9C%E0%A6%BE%E0%A6%B2-%E0%A6%96%E0%A6%BE%E0%A6%A6%E0%A7%8D%E0%A6%AF/

21
আত্মহত্যা নয়, জীবনকে ভালোবাসতে হবে
ড. কুদরাত-ই-খুদা বাবু

(দৈনিক ইত্তেফাক, ২৫ জুন ২০২০)

বলিউড তারকা সুশান্ত সিং রাজপুতের আত্মহত্যাসংক্রান্ত খবর ১৪ জুন বিভিন্ন সামাজিক যোগাযোগমাধ্যমে ছড়িয়ে পড়ে। তাছাড়া বিভিন্ন গণমাধ্যমেও তা ফলাও করে প্রকাশিত হয়। ঐদিন সুশান্তের বাড়ি থেকে ঝুলন্ত অবস্থায় তার মরদেহ উদ্ধার করার পাশাপাশি অ্যান্টি ডিপ্রেশন ওষুধ ও প্রেসক্রিপশন উদ্ধার করা হয়। নায়ক সুশান্তর আত্মহত্যার খবর ছড়িয়ে পড়লে অনেকেই ফেইসবুকে আবেগঘন স্ট্যাটাস দিয়েছেন। আবার অনেকেই হয়েছেন বিমোহিত। কারণ প্রিয় নায়কের অস্বাভাবিক মৃত্যু, মন থেকে যা মেনে নেওয়া যায় না। সুশান্তের বাসা থেকে তার লাশসহ অ্যান্টি ডিপ্রেশন ওষুধ ও প্রেসক্রিপশন উদ্ধারের মাধ্যমে ধরে নেওয়া যায় যে এটি একটি আত্মহত্যা। শুধু বলিউড তারকা সুশান্তই নন, বরং পত্রিকার পাতা খুললে প্রায়ই চোখে পড়ে আত্মহত্যাসংক্রান্ত খবরাখবর। আমাদের দেশও এর ব্যতিক্রম নয়। এ দেশের বিভিন্ন শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানের শিক্ষার্থীসহ দেশের বিভিন্ন জায়গায় বিভিন্ন জনগণের আত্মহত্যাসংক্রান্ত খবরাখবর প্রায়ই চোখে পড়ে। বলা বাহুল্য, আত্মহত্যা হচ্ছে মানবজীবনের এক চরম অসহায়ত্ব, ক্ষণিকের আবেগে একটি মহামূল্যবান জীবনের চির অবসান ঘটানো, যা কোনো কিছুর বিনিময়েই ফিরে পাওয়া সম্ভব নয়। আত্মহত্যার মাধ্যমে নিজের মূল্যবান জীবনকে যেমন একদিকে শেষ করে দেওয়া হয়, তেমনি অন্যদিকে একটি সম্ভাবনারও চির অবসান ঘটে। ইতিহাস পর্যালোচনা করলে দেখা যায়, অতি প্রাচীনকাল থেকেই বিভিন্ন দেশে ‘আত্মহত্যা’ নামক এই মহাপাপ সংঘটিত হয়ে আসছে। যদিও এটিকে কোনো সমাজই কখনো ভালো চোখে দেখেনি এবং দেখবেও না। এক ব্যক্তির আত্মহত্যা করার পেছনে সাধারণত বিষণ্নতা বা Depression, আর্থিক, সামাজিক, পারিবারিক সমস্যা কিংবা নিতান্ত ব্যক্তিগত মনোকষ্ট, বাইপোলার ডিসঅর্ডার, সিজোফ্রেনিয়া (দীর্ঘদিন ধরে ব্যর্থতা, গ্লানি বা হতাশা এবং নিজের প্রতি আত্মবিশ্বাসের ঘাটতি, অনাগত ভবিষ্যত্ সম্পর্কে উদ্বেগ, নিঃসঙ্গতা, কর্মব্যস্ততাহীন দিন যাপন ইত্যাদি মানব মস্তিষ্ককে সিজোফ্রেনিয়ায় আক্রান্ত করে), পারসোন্যালিটি ডিসঅর্ডার, এনজাইটি ডিসঅর্ডার, অ্যালকোহল ব্যবহারজনিত ডিসঅর্ডার ইত্যাদি।

বিশ্ব স্বাস্থ্য সংস্থার (WHO) পরিসংখ্যানমতে, বিশ্বে প্রায় ১২১ মিলিয়ন মানুষ মাত্রাতিরিক্ত বিষণ্নতার শিকার। WHO-র বিশেষজ্ঞরা আশঙ্কা প্রকাশ করছেন, ২০২০ সালের মধ্যে হূদেরাগের পরেই বিষণ্নতা মানব সমাজের বিপন্নতার দ্বিতীয় কারণ হিসেবে প্রতীয়মান হবে। WHO-র জরিপ অনুযায়ী, বর্তমানে বিশ্বে প্রতি ১ লাখ মানুষের মধ্যে বার্ষিক আত্মহত্যার হার ১১ দশমিক ৪ শতাংশ। জরিপে দেখা যায়, শুধু ২০১২ সালে সারা বিশ্বে আত্মহত্যার ঘটনা ঘটেছে ৮ লক্ষ ৪ হাজার। প্রতি ৪০ সেকেন্ডে একটি করে আত্মহত্যা সংঘটিত হচ্ছে। তবে ১৫-২৯ বছর বয়সিদের মধ্যে আত্মহত্যার প্রবণতা সবচেয়ে বেশি। আর বাংলাদেশে বার্ষিক আত্মহত্যার সংখ্যা গড়ে ১০ হাজার ২২০টি, যার মধ্যে ৫৮ থেকে ৭৩ শতাংশ আত্মহত্যাকারীই নারী। খোঁজ নিলে দেখা যাবে, দেশের বিভিন্ন শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানের অনেক শিক্ষার্থীই হতাশা, মানসিক অশান্তি ও মানসিক অস্থিরতায় ভুগছে। তথ্যপ্রযুক্তির অপব্যবহারসহ সংগত নানা কারণে পূর্বের তুলনায় সাম্প্রতিক সময়ে শিক্ষার্থীদের মধ্যে এ অবস্থা যেন অধিক মাত্রায় বৃদ্ধি পেয়েছে। প্রেমে ব্যর্থতাসহ বিভিন্ন কারণে হতাশা, মানসিক অশান্তি ও মানসিক অস্থিরতার কারণে শিক্ষার্থীদের মধ্যে এ ধরনের প্রবণতা বেড়েই চলেছে। শিক্ষার্থীদের মধ্যে আত্মহত্যার প্রবণতা, আত্মহত্যা চেষ্টার প্রবণতা বেড়ে চলাসহ অনেক শিক্ষার্থী মানসিক অশান্তি ও অস্থিরতায় ভুগলেও অধিকাংশ শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানেই নেই কোনো পেশাদার পরামর্শক বা কাউন্সিলর। কোনো শিক্ষার্থী যদি আত্মহত্যা করে বা আত্মহত্যা করার চেষ্টা করে, তবে তা হবে সমাজ, দেশ ও জাতির জন্য অত্যন্ত লজ্জার একটি বিষয়। কারণ শিক্ষার্থীদের কাছ থেকে তাদের পরিবারসহ সমাজ, দেশ ও জাতি ভালো অনেক কিছু আশা করে। একজন শিক্ষার্থীকে স্কুল-কলেজ কিংবা বিশ্ববিদ্যালয় পর্যায়ে আসতে তার অভিভাবকসহ ঐ শিক্ষার্থীকে অনেক ত্যাগ-তিতিক্ষা ও সংগ্রাম করতে হয়। পাড়ি দিতে হয় অনেক দুর্গম ও বন্ধুর পথ। এ বিষয়গুলো প্রত্যেক শিক্ষার্থীরই উপলব্ধি করা প্রয়োজন। তাদের স্মরণ রাখা উচিত, অনেক আশা-ভরসা নিয়ে তাদের বাবা-মা বা অভিভাবকেরা তাদের শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানে লেখাপড়া শেখাতে পাঠান।

মানুষের জীবনে সমস্যা আসে এবং সমস্যা আসবেই—এটিই স্বাভাবিক। তার মানে এই নয় যে জীবনে সমস্যা এলে বা সমস্যায় পড়লে আত্মহত্যা করে জীবনকে শেষ করে দিতে হবে। বরং জীবনে সমস্যা এলে সবাইকে আবেগনির্ভর না হয়ে সুস্থ মস্তিষ্কে ও বাস্তবতার আলোকে সেই সমস্যার সমাধান করা প্রয়োজন। প্রয়োজনে কোনো মনোরোগ বিশেষজ্ঞের শরণাপন্ন হওয়া। যখন কেউ আত্মহত্যা করে বা আত্মহত্যার চেষ্টা করে, তখন ধরে নেওয়া হয় যে এটি তার মানসিক অস্থিরতা বা আবেগ দ্বারা তাড়িত হওয়ার ফলাফল। বাংলাদেশের প্রেক্ষাপটে আত্মহত্যার পেছনের কারণগুলোর মধ্যে রয়েছে পারিবারিক বা ব্যক্তিগত সম্পর্কের মধ্যে ভুল বোঝাবুঝির সৃষ্টি হওয়া, সম্পর্কের বিচ্ছেদ ঘটা, পরীক্ষায় আশানুরূপ ফলাফল লাভ করতে না পারা, অপরিসীম অর্থকষ্ট, ধর্ষণ, যৌন, শারীরিক বা মানসিক নির্যাতন-নিপীড়ন, মাদকাসক্তিসংক্রান্ত সমস্যা, নানা ধরনের মানসিক অসুস্থতা ইত্যাদি। এসবের পাশাপাশি রয়েছে প্রিয় কোনো নেতা, অভিনেতা, শিল্পী, খেলোয়াড়ের আকস্মিক মৃত্যুর খবর; কর্মস্থল বা শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানে সহকর্মী বা সহপাঠীদের সঙ্গে ভুল বোঝাবুঝির সৃষ্টি হওয়া, দীর্ঘদিনের বেকারত্ব বা হঠাত্ চাকরিচ্যুতি বা চাকরিতে পদাবনতি ঘটা; ‘এ পৃথিবীতে কেউ আমাকে চায় না’, ‘এ পৃথিবীতে বেঁচে থেকে আমার কোনো লাভ নেই’—এজাতীয় বদ্ধমূল চিন্তাভাবনা ইত্যাদি। এসব চিন্তার কারণে মনের মধ্যে সৃষ্টি হওয়া প্রচণ্ড রকমের হতাশা ও ক্ষোভের কারণে মানুষ তার নিজের প্রতি আস্থা ও সম্মানবোধ হারিয়ে ফেলে। আর তখন থেকেই সে সবার কাছ থেকে নিজেকে গুটিয়ে নিতে শুরু করে এবং একসময় আত্মহত্যার পথ বেছে নেয়। আবার কিছু ব্যর্থতাও মানুষকে আত্মহত্যার পথে ঠেলে দেয়। পরিবারের সব সদস্যের মৌলিক চাহিদা পূরণ করতে না পারা, দীর্ঘদিনেও ঋণমুক্তির উপায় খুঁজে না পাওয়া ইত্যাদি। এছাড়া প্রেমে ব্যর্থতাসহ প্রেমিক-প্রেমিকার ইচ্ছাপূরণের জন্য জেদের বশবর্তী হয়েও অনেক তরুণ-তরুণীকে আত্মহত্যার পথ বেছে নিতে দেখা যায়। দুঃখজনক হলেও সত্য, আমাদের দেশের বিভিন্ন বিশ্ববিদ্যালয়, স্কুল-কলেজের শিক্ষার্থীরা এক্ষেত্রে এগিয়ে রয়েছে। বলা বাহুল্য, আত্মহত্যাজনিত মৃত্যুর অধিকাংশই প্রতিরোধযোগ্য। অধিকাংশ ব্যক্তিই আত্মহত্যার সময় কোনো-না-কোনো গুরুতর মানসিক রোগে আক্রান্ত হয়ে থাকে। স্বাস্থ্যকর জীবনযাপন, শারীরিক ও মানসিক যেকোনো অসুস্থতায় যথাযথ স্বাস্থ্যসেবা লাভের সুযোগ আত্মহত্যার প্রবণতা কমায়। পাশাপাশি আত্মহত্যা প্রতিরোধে কিছু বিষয় রয়েছে, যেগুলোকে প্রোটেকটিভ ফ্যাক্টর বা রক্ষাকারী বিষয় বলা হয়। যেমন জীবনের খারাপ সময়গুলোতে খাপ খাইয়ে নেওয়ার ক্ষমতা জন্মানো, নিজের প্রতি শ্রদ্ধা ও আত্মবিশ্বাস জন্মানো, সমস্যা সমাধানের কার্যকর দক্ষতা বাড়ানো, প্রয়োজনে অন্যের কাছ থেকে ইতিবাচক সহায়তা লাভের চেষ্টা করা ইত্যাদি। তাছাড়া সামাজিক ও ধর্মীয় রীতিনীতি, অনুশাসন, ভালো বন্ধু, প্রতিবেশী ও সহকর্মীর সঙ্গে সামাজিক সুসম্পর্ক প্রভৃতি আত্মহত্যার প্রবণতা হ্রাসে সহায়তা করে। এছাড়া সুষম খাদ্য গ্রহণ, পর্যাপ্ত নিদ্রা, নিয়মিত শরীরচর্চা, ধূমপান ও মাদকাসক্তি থেকে দূরে থাকা তথা স্বাস্থ্যকর জীবনযাপন এবং শারীরিক ও মানসিক যেকোনো অসুস্থতায় যথাযথ স্বাস্থ্যসেবা লাভের সুযোগ আত্মহত্যার প্রবণতা কমায়। সুতরাং, শিক্ষার্থীদের হতাশা ও মানসিক অশান্তি থেকে উত্তরণের জন্য দেশের সব শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানে দ্রুত পেশাদার কাউন্সিলর নিয়োগ করা প্রয়োজন। আর তা সম্ভব হলে শিক্ষার্থীদের আত্মহত্যার চেষ্টা চালানো কিংবা আত্মহত্যা করার প্রবণতা অনেকটাই কমে আসবে বলে আশা করা যায়। সর্বোপরি, আত্মহত্যার বিভিন্ন নেতিবাচক দিক তুলে ধরে নিয়মিতভাবে তা প্রচার-প্রচারণারও ব্যবস্থা করা আবশ্যক। শিক্ষার্থীসহ সবাইকে জীবনের গুরুত্ব ও মূল্য সম্পর্কে বুঝতে হবে। সবাইকে বুঝতে হবে যে জীবন একটাই এবং তা মহামূল্যবান। জীবন একবার হারালে তা আর কোনো কিছুর বিনিময়েই ফিরে পাওয়া সম্ভব নয়। এবং জীবনটাকে যদি সুন্দরভাবে সাজানো যায়, তাহলে জীবনকে সুন্দরভাবে উপভোগও করা যায়। তাই আসুন, আমরা সবাই আত্মহত্যার চিন্তা ও আত্মহত্যার পথ পরিহার করে এখন থেকেই আমাদের জীবনটাকে ভালোভাবে ভালোবাসতে শিখি।
লেখক :সহযোগী অধ্যাপক, আইন বিভাগ, ড্যাফোডিল ইন্টারন্যাশনাল ইউনিভার্সিটি

Link: https://www.ittefaq.com.bd/print-edition/opinion/161085/%E0%A6%86%E0%A6%A4%E0%A7%8D%E0%A6%AE%E0%A6%B9%E0%A6%A4%E0%A7%8D%E0%A6%AF%E0%A6%BE-%E0%A6%A8%E0%A7%9F-%E0%A6%9C%E0%A7%80%E0%A6%AC%E0%A6%A8%E0%A6%95%E0%A7%87-%E0%A6%AD%E0%A6%BE%E0%A6%B2%E0%A7%8B%E0%A6%AC%E0%A6%BE%E0%A6%B8%E0%A6%A4%E0%A7%87-%E0%A6%B9%E0%A6%AC%E0%A7%87?fbclid=IwAR3wq9_OZy_2z26duUWPplBzcibiXmOptZ7jFjUECM-E4b6XMr-te3N7lZw



 

22
মানব পাচার রোধে আইনের সঠিক প্রয়োগ জরুরি
  ড. কুদরাত-ই-খুদা বাবু
 ১৯ জুন ২০২০, ০০:০০:০০ | প্রিন্ট সংস্করণ

মানব পাচার রোধে আইনের সঠিক প্রয়োগ জরুরি
আন্তর্জাতিক শ্রম সংস্থার (আইএলও) মতে, শিশু শ্রমিক, সংখ্যালঘু এবং বেআইনি অভিবাসীরা প্রচণ্ডভাবে শোষিত হওয়ার সর্বোচ্চ ঝুঁকিতে আছে। আর আন্তর্জাতিক কনভেনশন অনুযায়ী, মানব পাচার হচ্ছে মানুষের অধিকারের লঙ্ঘন। দুঃখজনক হলেও সত্য, দেশ থেকে মানব পাচারের ঘটনা দিন দিন বেড়ে চলেছে, যা উদ্বেগজনক। অভাবের তাড়নায় বা অর্থনৈতিক সংকট দূর করতে বা উন্নত জীবনের আশায় বাংলাদেশ থেকে নারী-পুরুষ ও শিশু মালয়েশিয়াসহ বিভিন্ন দেশে পাচারের শিকার হচ্ছে। উন্নত জীবন আর ভালো চাকরি দেয়ার প্রলোভন দেখিয়ে নারীদের পাচার করার পর শেষ পর্যন্ত তাদের পতিতাবৃত্তিতে বাধ্য করা হচ্ছে। অর্থলোভী, অসৎ লোক এবং দালালদের খপ্পরে পড়ে এভাবে অনেক মানুষের জীবন নিঃশেষ হয়ে যাচ্ছে।

২৭ মে লিবিয়ায় ৩০ জন অভিবাসীকে গুলি করে হত্যা করা হয়, যার মধ্যে ২৬ জনই বাংলাদেশের নাগরিক। লিবিয়ার মানব পাচারকারী এক ব্যক্তির পরিবারের সদস্যরা ওই ৩০ অভিবাসীকে নির্বিচারে গুলি চালিয়ে হত্যা করে। ওই মানব পাচারকারী আগেই মারা যায়। সেই মৃত্যুর দায় তার আত্মীয়স্বজন এসব অভিবাসীর ওপর চাপায়। আর প্রতিশোধ নিতেই এ নির্মম হত্যাকাণ্ড ঘটানো হয়। লিবিয়ায় ২৬ বাংলাদেশিকে নির্মমভাবে গুলি করে হত্যা করার পর মানব পাচারের বিষয়টি এখন আলোচনায় এসেছে। এ ধরনের ঘটনা এই প্রথম নয়, এর আগে ২০১৫ সালের ১ মে থাইল্যান্ডের গহিন অরণ্যে পাওয়া গিয়েছিল গণকবর। এরপর মালয়েশিয়াতেও পাওয়া যায় গণকবর। আর ওইসব গণকবরে পাওয়া গিয়েছিল অনেক বাংলাদেশির লাশ; যাদের অধিকাংশই মানব পাচারের শিকার। খবরে প্রকাশ, ২০১২ থেকে ২০১৯ সাল পর্যন্ত সময়ে শুধু কক্সবাজার জেলা থেকেই পাচার হয়েছে এক লাখের বেশি মানুষ। এমনও দেখা গেছে, ইউরোপে যেতে ভূমধ্যসাগর পাড়ি দিতে গিয়ে অনেকে নির্যাতনের কারণে আর খাদ্যের অভাবে সাগরেই মর্মান্তিকভাবে মারা গেছে। আর এভাবেই উন্নত জীবনের আশায় অনেকের বিদেশে পাড়ি জমানোর স্বপ্ন ভেসে গেছে সাগরে, আবার কখনো বা সেই স্বপ্নের কবর রচিত হয়েছে গহিন বনে, গণকবরে আর পতিতা পল্লীতে।

বাস্তবতা হচ্ছে, মানব পাচার সংক্রান্ত ঘটনায় অনেক মামলা হলেও শেষ পর্যন্ত এসব মামলার তদন্ত ও বিচার এগোয় না। পত্রিকায় প্রকাশিত এক প্রতিবেদনে জানা যায়, ২০১২ সালে দেশে মানব পাচার প্রতিরোধ ও দমন আইন হওয়ার পর থেকে গত বছরের ডিসেম্বর পর্যন্ত মানব পাচার সংক্রান্ত প্রায় ৬ হাজার মামলা করা হয়। এসব মামলায় গ্রেফতার করা হয় ৯ হাজার ৬৯২ জনকে। ২০১৪ সাল থেকে এখন পর্যন্ত এসব মামলায় সাজা হয়েছে মাত্র ৫৪ জনের। আর মানব পাচার সংক্রান্ত মামলা নিষ্পত্তির হারই খুব কম, যা দুঃখজনক। মূলত পাচারের শিকার অধিকাংশ পরিবারই ভোগান্তি ও সমস্যার মধ্যে দিন যাপন করে এবং মানব পাচারকারী ও দালালরা অধিকাংশ ক্ষেত্রেই পর্দার আড়ালে বা ধরাছোঁয়ার বাইরে থাকে। ফলে মানব পাচার বন্ধ হয় না। আবার মানব পাচার সংক্রান্ত মামলার তদন্তে ঘাটতি থাকায় অনেক আসামি খালাস পেয়ে যায়। মানবাধিকারকর্মীরা প্রায়ই অভিযোগ করে বলেন, দেশে আইনের শাসন থাকলে এত মানুষ পাচারের শিকার হতো না। মানব পাচারকারীরা অনেককেই টাকার ভাগ দেন। তাই এটি বন্ধ করতে হলে সংশ্লিষ্ট কর্তৃপক্ষের সদিচ্ছার প্রয়োজন। বর্তমান সময়ে দেশে মানব পাচারের সবচেয়ে বড় রুট হিসেবে বিবেচিত হচ্ছে কক্সবাজার জেলা। এ জেলায় এ পর্যন্ত মানব পাচারের ৬৩৭টি মামলা হয়েছে; কিন্তু এখন পর্যন্ত একটি মামলারও নিষ্পত্তি হয়নি। অর্ধেক মামলা তদন্তাধীন রয়েছে আর খারিজ হয়ে গেছে ১৬টি মামলা। আগে দেশে মানব পাচারবিষয়ক কোনো সুনির্দিষ্ট আইন ছিল না। দীর্ঘদিন ধরে দণ্ডবিধি, ফৌজদারি কার্যবিধি এবং নারী ও শিশু নির্যাতন দমন আইনে মানব পাচার সংক্রান্ত অপরাধের বিচার করা হতো। ২০১২ সালে দেশে ‘মানব পাচার প্রতিরোধ ও দমন আইন, ২০১২’ নামক আইন প্রণয়ন করা হয়। এ আইনের ৬ ধারায় মানব পাচার নিষিদ্ধ করে এর জন্য অনধিক যাবজ্জীবন কারাদণ্ড ও কমপক্ষে পাঁচ বছর সশ্রম কারাদণ্ড এবং কমপক্ষে ৫০ হাজার টাকা অর্থদণ্ডের বিধান রাখা হয়। আইনটির ৭ ধারায় সংঘবদ্ধ মানব পাচার অপরাধের দণ্ড মৃত্যুদণ্ড বা যাবজ্জীবন কারাদণ্ড বা কমপক্ষে সাত বছরের সশ্রম কারাদণ্ড এবং কমপক্ষে পাঁচ লাখ টাকা অর্থদণ্ডের বিধান রাখা হয়। এ আইনের অধীনে কৃত অপরাধগুলো কগনিজেবল বা আমলযোগ্য অপরাধ, আপস ও জামিনের অযোগ্য অপরাধ হিসেবে বিবেচিত হয়। মানব পাচার প্রতিরোধ ও দমন আইন হওয়ার পর গত আট বছরে এ সংক্রান্ত মামলার সংখ্যা ৫ হাজার ৭১৬। এখন পর্যন্ত মাত্র ২৪৭টি মামলার নিষ্পত্তি হয়েছে। অর্থাৎ মামলা নিষ্পত্তির হার মাত্র ৪ শতাংশ। মানব পাচার প্রতিরোধ ও দমন আইনে মানব পাচার সংক্রান্ত বিচারের জন্য আলাদা করে বিশেষ আদালত বা ট্রাইব্যুনাল গঠনের বিধান ছিল। অথচ আইন পাসের ৮ বছর পর সাত বিভাগে সাতটি ট্রাইব্যুনাল গঠনের আদেশ হয়েছে। অনেক বিচার এখনও নারী ও শিশু নির্যাতন দমন ট্রাইব্যুনালেই হচ্ছে। মানব পাচার সংক্রান্ত মামলা দীর্ঘদিন ধরে ঝুলে থাকার পেছনে এটি একটি অন্যতম কারণ। তবে এর চেয়েও বড় কারণ হচ্ছে, মানব পাচার মামলায় আদালতে পুলিশ কর্তৃক সাক্ষী হাজির করতে ব্যর্থ হওয়া। মানব পাচার মামলায় সাধারণত নিয়মিতভাবে সাক্ষী পাওয়া যায় না। ভুক্তভোগীরা সহায়তা না করলে এ ধরনের মামলা প্রমাণ করা শেষ পর্যন্ত কঠিন হয়ে পড়ে। মানব পাচার আইন ২০১২-এর সঠিক প্রয়োগসহ সরকারিভাবে দেশে বিভিন্ন কর্মসংস্থানের ব্যবস্থা করা হলে এবং জনগণ দালালের মাধ্যমে অবৈধভাবে বিদেশে যাওয়ার মনমানসিকতা পরিহার করলে মানব পাচারের সংখ্যা নিঃসন্দেহে কমে আসবে। যেহেতু দেশে মানব পাচারের সংখ্যা উদ্বেগজনক হারে বেড়েই চলেছে, তাই মানব পাচার রোধে এ আইনের সঠিক প্রয়োগের বিকল্প নেই। পাশাপাশি আইনশৃঙ্খলা বাহিনীকেও এ বিষয়ে প্রকৃত অর্থেই তৎপর হয়ে প্রয়োজনীয় ব্যবস্থা নিতে হবে। অন্যথায় মানব পাচার বন্ধ হবে না এবং মানব পাচারকারীরাও শাস্তি পাবে না।
ড. কুদরাত-ই-খুদা বাবু: সহযোগী অধ্যাপক, আইন বিভাগ, ড্যাফোডিল ইন্টারন্যাশনাল ইউনিভার্সিটি
kekbabu@yahoo.com

Link: https://www.jugantor.com/todays-paper/sub-editorial/317300/%E0%A6%AE%E0%A6%BE%E0%A6%A8%E0%A6%AC-%E0%A6%AA%E0%A6%BE%E0%A6%9A%E0%A6%BE%E0%A6%B0-%E0%A6%B0%E0%A7%8B%E0%A6%A7%E0%A7%87-%E0%A6%86%E0%A6%87%E0%A6%A8%E0%A7%87%E0%A6%B0-%E0%A6%B8%E0%A6%A0%E0%A6%BF%E0%A6%95-%E0%A6%AA%E0%A7%8D%E0%A6%B0%E0%A7%9F%E0%A7%8B%E0%A6%97-%E0%A6%9C%E0%A6%B0%E0%A7%81%E0%A6%B0%E0%A6%BF

23
কর্মহীন শ্রমজীবী মানুষের পাশে দাঁড়ান
  ড. কুদরাত-ই-খুদা বাবু
 ০১ মে ২০২০, ০০:০০ | প্রিন্ট সংস্করণ

বর্তমান সময়ে বিশ্বে সবচেয়ে আতঙ্কের নাম করোনাভাইরাস বা কোভিড-১৯। গোটা বিশ্ব আজ মুখ থুবড়ে স্থবির হয়ে পড়েছে প্রাণঘাতী এই ভাইরাসের কারণে।
সর্বশেষ তথ্য অনুযায়ী, ২৯ এপ্রিল পর্যন্ত বিশ্বের ২১০টি দেশ ও অঞ্চলে প্রায় ৩২ লাখ ২০ হাজার ৯৭০ জন করোনাভাইরাসে আক্রান্ত হয়েছেন। আর এ সময় পর্যন্ত করোনাভাইরাসে আক্রান্ত হয়ে মারা গেছেন ২ লাখ ২৮ হাজার ২৫১ জন। বাংলাদেশ করোনাভাইরাসে ২৯ এপ্রিল পর্যন্ত আক্রান্ত হয়েছেন ৭ হাজার ১০৩ জন আর মৃত্যুবরণ করেছেন ১৬৩ জন (সূত্র : আইইডিসিআর)। সুতরাং দেখা যাচ্ছে, দেশে করোনাভাইরাসে আক্রান্তের ও মৃতের সংখ্যা দিন দিন বাড়ছে, যা আমাদের সবার জন্যই উদ্বেগের বিষয়। সরকারের সামাজিক বিচ্ছিন্নতার নীতি এবং করোনা আক্রান্ত মানুষকে শনাক্ত ও তাদের সংস্পর্শে যারা এসেছেন, তাদের পুরোপুরি বিচ্ছিন্ন করাসহ দেশের বিভিন্ন এলাকা লকডাউন করার কর্মসূচি এক্ষেত্রে গুরুত্বপূর্ণ বিষয় হিসেবে বিবেচিত হচ্ছে। কিন্তু করোনা সংকট দেশের দরিদ্র জনগোষ্ঠীর মধ্যে যেভাবে প্রভাব ফেলতে শুরু করেছে এবং দেশের অর্থনীতির ওপর দীর্ঘ মেয়াদে যে নেতিবাচক প্রভাব ফেলবে, তা-ই এখন সবার জন্য বড় চিন্তার বিষয়।

বেশ আগে থেকেই জনস্বার্থের বিষয়টি মাথায় রেখে সরকার দেশে করোনাভাইরাসের সংক্রমণ ঠেকাতে সামাজিক বিচ্ছিন্নতা বা পুরোপুরি লকডাউন কর্মসূচি বাস্তবায়ন করে যাচ্ছে। কিন্তু এতে করে সবচেয়ে বেশি ক্ষতির মুখোমুখি হচ্ছেন দেশের অসংখ্য খেটে খাওয়া মানুষ। পরিসংখ্যান মতে, দেশে এ ধরনের মানুষের সংখ্যা দুই কোটির বেশি। করোনার ফলে এসব লোকের আয়-রোজগার এখন প্রায় বন্ধ হয়ে গেছে বললেই চলে। এ অবস্থায় মধ্যবিত্ত বা নিম্ন-মধ্যবিত্তরা বোধকরি সবচেয়ে বিপদের মধ্যে রয়েছেন। কারণ তারা চক্ষুলজ্জা ও লোকলজ্জার কারণে ত্রাণ নিতেও পারছেন না; আবার এ অস্বস্তিকর পরিস্থিতি থেকে পরিত্রাণও পাবেন না। এ যেন ‘না পারি কইতে, না পারি সইতে’ অবস্থার মতো। দেশের ৬৪ জেলায় ২ হাজার ৬৭৫ জন নিম্নআয়ের মানুষের মধ্যে সম্প্রতি ব্র্যাক কর্তৃক পরিচালিত এক জরিপে দেখা গেছে, মানুষের উপার্জন ও খাদ্য নিরাপত্তায় প্রভাব ফেলেছে করোনাভাইরাস। জরিপে দেখা যায়, দারিদ্র্যরেখার নিম্নসীমার নিচে নেমে গেছেন ৮৯ শতাংশ মানুষ।
আর ১৪ ভাগ মানুষের ঘরে কোনো খাবারই নেই। জরিপে বলা হয়, নিম্নআয়ের মানুষের জীবিকায় করোনাভাইরাস প্রতিরোধের পদক্ষেপের মারাত্মক প্রভাব পড়েছে। জরিপে অংশগ্রহণকারীদের ৮৯ শতাংশ দারিদ্র্যরেখার নিম্নসীমার নিচে নেমে গেছেন।

এখন বাস্তবতা হচ্ছে, সামাজিক বিচ্ছিন্নতা বা সবকিছু বন্ধ করে দেয়ার পর থেকেই দেশের দরিদ্র ও কর্মহীন মানুষের মধ্যে এক ধরনের হাহাকার শুরু হয়েছে। আয়ের অভাবে তাদের জীবনধারণ কঠিন হয়ে পড়েছে।

সরকার সামাজিক সুরক্ষা কর্মসূচির আওতায় দরিদ্র মানুষের ঘরে ঘরে খাবার পৌঁছে দেয়ার কথা বলেছে ও ইতোমধ্যে অনেক লোকের কাছে তা পৌঁছেও দেয়া হয়েছে- যা নিঃসন্দেহে প্রশংসনীয়। তবে দেশের বিপুলসংখ্যক হতদরিদ্র ও নিম্নবিত্ত মানুষের ঘরে খাদ্যসংকট সংক্রান্ত যেসব খবর বিভিন্ন গণমাধ্যমে আসছে, তা উদ্বেগজনক।
কোনো কোনো স্থান থেকে ‘অবরুদ্ধ মানুষ’ টেলিফোন করে জানিয়েছেন, তারা খাবারের সংকটে রয়েছেন। এরপর প্রশাসন খবর পেয়ে তাদের কাছে খাবার পৌঁছে দিয়েছে। এ ধরনের বিক্ষিপ্ত ও বিচ্ছিন্ন কার্যক্রমের মধ্য দিয়ে দেশের বিপুলসংখ্যক দরিদ্র মানুষের সবার ঘরে ঘরে খাবার পৌঁছানো আপাতদৃষ্টিতে সম্ভব নয়।
সরকার সামাজিক সুরক্ষা কর্মসূচির আওতায় হতদরিদ্র মানুষের কাছে খাবার পৌঁছে দেয়ার যে মহতি পরিকল্পনা নিয়েছে, তা সঠিকভাবে বাস্তবায়িত হবে না; যদি দেশের বিভিন্ন স্থানে সরকারের খাদ্যবান্ধব কর্মসূচির চাল আত্মসাতের ঘটনা ঘটে। অথচ করোনার কারণে দেশের এ সংকটময় মুহূর্তে হতদরিদ্র ও অভাবী মানুষের কাছে খাবারসহ নিত্যপ্রয়োজনীয় পণ্য পৌঁছানো এখন জরুরি বিষয়। সরকারি গুদামে মজুদকৃত খাদ্য যেন হতদরিদ্র মানুষের কাছে সঠিকভাবে পৌঁছে, সে ব্যবস্থা নিশ্চিত করা আবশ্যক। অন্যথায় মানবিক বিপর্যয়ের ভয় থেকেই যাবে। করোনা সংকট উত্তরণে সরকার সামাজিক সুরক্ষা কর্মসূচিগুলো জোরদার করার সিদ্ধান্ত নিয়েছে; যাতে বেশি সংখ্যক দরিদ্র মানুষ উপকার পায়।

কিন্তু প্রশ্ন হচ্ছে, খাদ্যবান্ধব কর্মসূচির চাল রাজনৈতিক পরিচয়ধারীরা আত্মসাৎ করলে দরিদ্র জনগোষ্ঠী উপকারভোগী হবে কীভাবে? অতীতে দেখা গেছে, রাজনৈতিক ছত্রছায়ায় থাকা এ ধরনের অপরাধীরা খুব কম ক্ষেত্রেই শাস্তি পেয়েছে। তবে এবারে খাদ্যবান্ধব কর্মসূচির আত্মসাৎ করা চাল উদ্ধার এবং চালচোরদের গ্রেফতারের ঘটনায় স্থানীয় প্রশাসন অবশ্যই সাধুবাদ পাওয়ার যোগ্য। প্রশাসন যদি সর্বদা এভাবে সক্রিয় থাকে, তবে এ ধরনের দুর্নীতিবাজ, অসাধু, ও দুর্বৃত্তরা অনেকটাই নিরস্ত হবে আর তখনই সরকারের পক্ষে দরিদ্র ও কর্মহীনদের খাবার নিশ্চিত করা সম্ভব হবে। তবে সব সময়ই যে তা সরকারের পক্ষ থেকে নিশ্চিত করা সম্ভব হবে, তা নয়। কারণ, সরকারেরও সীমাবদ্ধতা রয়েছে। এজন্য সমাজের প্রতিষ্ঠিত ব্যবসায়ী, শিল্পপতি, উদ্যোক্তা, বিত্তবান, বিভিন্ন এনজিও, দাতা সংস্থা, গণমাধ্যম, সুশীল সমাজসহ নিজ নিজ অবস্থান থেকে সবারই এগিয়ে আসা প্রয়োজন। প্রয়োজন সবার সার্বিক সহযোগিতা ও সম্মিলিত প্রয়াস। সবাই মিলে আন্তরিকভাবে এগিয়ে এলে নিশ্চয় করোনা সংকটকালীন দেশের দরিদ্র ও কর্মহীনদের খাবার নিশ্চিত করা সম্ভব হবে। তাই আসুন, দরিদ্র ও কর্মহীন শ্রমজীবী মানুষের খাদ্য-চাহিদা পূরণে আমরা সবাই আন্তরিকভাবে কাজ করি।
ড. কুদরাত-ই-খুদা বাবু : সহযোগী অধ্যাপক, আইন বিভাগ, ড্যাফোডিল ইন্টারন্যাশনাল ইউনিভার্সিটি; অ্যামনেস্টি ইন্টারন্যাশনালের সদস্য
kekbabu@yahoo.com

Link: https://www.jugantor.com/todays-paper/editorial/303238/%E0%A6%95%E0%A6%B0%E0%A7%8D%E0%A6%AE%E0%A6%B9%E0%A7%80%E0%A6%A8-%E0%A6%B6%E0%A7%8D%E0%A6%B0%E0%A6%AE%E0%A6%9C%E0%A7%80%E0%A6%AC%E0%A7%80-%E0%A6%AE%E0%A6%BE%E0%A6%A8%E0%A7%81%E0%A6%B7%E0%A7%87%E0%A6%B0-%E0%A6%AA%E0%A6%BE%E0%A6%B6%E0%A7%87-%E0%A6%A6%E0%A6%BE%E0%A6%81%E0%A7%9C%E0%A6%BE%E0%A6%A8?__cf_chl_jschl_tk__=13049bbdba4c07d27253562af529fc1933a26264-1588332326-0-AaIaHzCZsnDRCTigtmEHJNUj3wW6nqyOM78YeR9URljRb3MgCBmj5c364vAmevtrvaBd96ySr7OvqmZeqfRhkniN6yrylnSv-xiLaauPrGpp97pgEJEyKDoaDkalNz7xh4-vrijDsVKa513BtodWIhpwPkQQX0ZFPCIG197U8c4dSKF8Vpt-l-mX34MFwVqY4Jt7gBIjmR5hTPk-BbNjs4YkF3J0mc99SGhw3H9YDT-I3OW0HeAe3h3rPrzfFYEl1F-urAbB3YFf3NVZxPeSCxEP0RYEuF1L5KBruP_fC3IdS6K07XCUSSgJ0rvChBodWyB8gx-oplEswX_axHosoDqmEFRiYPwn4XADJlvOW5s86JTPh8AdZZ0gotNzXKtChClAWtY_PRTiSZpGZQAlIcn5Bzv9ygJQqugbnlAwMi_TcqNYzkygkutbVtC04P1AJH8E00BLdTU_16uXFYMBnP84NaNn4BFZZTQwiparsj6V2oCvh8mn3jsngxHlOZOumcSTJa3RBk2NZW53MFaKxXWgVyir3zQxtFfSMhKVKlhwMoXidEfaL8iUND5vVBWemRBdL15CZhcNn1AUhVlbik3KW2UrK5Q4amqoLDkyz2gwKlzFTyo7I4tJD8pAd8qWwE7kNsHws34oML7Ig5QQUGhk1Ac21nivhfZXnRAuhWF4CCwLYYwVG-cd_wlN2yZ5CQ

24
চালচোরদের বিরুদ্ধে কঠোর ও দৃষ্টান্তমূলক শাস্তি নিশ্চিত করা জরুরি [The daily Kalerkantho on 27.04.2020 (p.5)
ড. কুদরাত-ই-খুদা বাবু
২৭ এপ্রিল, ২০২০

নভেল করোনাভাইরাসের কারণে গোটা বিশ্ব আজ যেন স্থবির হয়ে গেছে। জনস হপকিন্স ইউনিভার্সিটির তথ্য অনুযায়ী, ১৩ এপ্রিল পর্যন্ত বিশ্বের ১৮৫টি দেশে প্রায় ১৮ লাখ ৮৫ হাজার ৫০৩ জন করোনাভাইরাসে আক্রান্ত হয়েছে। আর ১৩ এপ্রিল পর্যন্ত এই ভাইরাসে আক্রান্ত হয়ে মারা গেছে এক লাখ ১৪ হাজার ১৮৫ জন। বিশ্বের অন্যান্য দেশের মতো বাংলাদেশও করোনাভাইরাসের কবলে পড়েছে। সরকারের রোগতত্ত্ব, রোগ নিয়ন্ত্রণ ও গবেষণা প্রতিষ্ঠানের (আইইডিসিআর) হিসাব অনুযায়ী, ১৩ এপ্রিল পর্যন্ত দেশে ৮০৩ জনের করোনা শনাক্ত হয় আর ওই সময় পর্যন্ত করোনায় আক্রান্ত হয়ে মারা গেছে ৩৯ জন। সুতরাং দেখা যাচ্ছে, দেশে করোনাভাইরাসে আক্রান্ত ও মৃতের সংখ্যা দিন দিন বাড়ছে, যা সরকারসহ দেশবাসী সবার জন্যই রীতমতো ভীতিকর ও উদ্বেগের বিষয়। যদিও সরকারের সামাজিক বিচ্ছিন্নতার (সোশ্যাল ডিস্ট্যান্স) নীতি এবং করোনায় আক্রান্ত মানুষকে শনাক্ত ও তাদের সংস্পর্শে যারা এসেছে, তাদের পুরোপুরি বিচ্ছিন্ন করাসহ দেশের বিভিন্ন এলাকা লকডাউন কর্মসূচি এ ক্ষেত্রে বিশেষ গুরুত্বপূর্ণ বিষয় হিসেবে বিবেচিত হচ্ছে। কিন্তু করোনা সংকট এ দেশের দরিদ্র জনগোষ্ঠীর মাঝে এরই মধ্যে যেভাবে ও যে হারে প্রভাব ফেলতে শুরু করেছে এবং দেশের অর্থনীতির ওপর দীর্ঘ মেয়াদে যে ধরনের নেতিবাচক প্রভাব ফেলবে, তা কিভাবে সামাল দেওয়া হবে, তা-ই এখন সবার কাছে চিন্তার বিষয় হিসেবে দেখা দিচ্ছে। যদিও বেশ আগে থেকেই জনস্বার্থের বিষয়টি মাথায় রেখে সরকার দেশে করোনাভাইরাসের সংক্রমণ ঠেকাতে সামাজিক বিচ্ছিন্নতা বা পুরোপুরি লকডাউন কর্মসূচি বাস্তবায়ন করে যাচ্ছে রীতিমতো; কিন্তু এতে সবচেয়ে বেশি ক্ষতির মুখোমুখি হচ্ছে দেশের অসংখ্য খেটে খাওয়া মানুষ তথা দিনমজুর, রিকশাচালক, ভ্যানচালক, ক্ষুদ্র ব্যবসায়ী, পরিবহন শ্রমিক, রেস্তোরাঁর শ্রমিক, গৃহকর্মী, হকার, ভিক্ষুকসহ নানা শ্রেণির মানুষ। পরিসংখ্যান অনুযায়ী, বাংলাদেশে এ ধরনের মানুষের সংখ্যা দুই কোটির বেশি। আর করোনার ফলে এসব মানুষের আয়-রোজগার এখন প্রায় বন্ধ হয়ে গেছে। গত ৩১ মার্চ থেকে ৫ এপ্রিল পর্যন্ত দেশের ৬৪ জেলায় দুই হাজার ৬৭৫ জন নিম্ন আয়ের মানুষের মধ্যে উন্নয়ন সংস্থা ব্র্যাক পরিচালিত এক জরিপে দেখা গেছে, দেশের মানুষের উপার্জন ও খাদ্য নিরাপত্তায় প্রভাব ফেলেছে করোনাভাইরাস। জরিপে দেখা যায়, দারিদ্র্যরেখার নিম্নসীমার নিচে নেমে গেছে ৮৯ শতাংশ মানুষ। আর ১৪ শতাংশ মানুষের ঘরে কোনো খাবারই নেই। মানবিক ও জনগুরুত্বপূর্ণ এ বিষয়টি মাথায় রেখে সরকার করোনার অর্থনৈতিক সংকট মোকাবেলায় ৭২ হাজার ৭৫০ কোটি টাকার প্যাকেজ ঘোষণা করে। পাশাপাশি চলছে ত্রাণ বিতরণ কার্যক্রম। বিভিন্ন রাজনৈতিক নেতাকর্মী ও জনপ্রতিনিধিরাও অংশ নিচ্ছেন ত্রাণ তৎপরতায়। ত্রাণ দিচ্ছেন বিভিন্ন সংস্থা, সংগঠন, মানবদরদি ব্যক্তিসহ বিত্তবানরা। সামাজিক সুরক্ষা কর্মসূচির আওতায় সরকার দরিদ্র মানুষের ঘরে ঘরে খাবার পৌঁছে দেওয়ার অংশ হিসেবে এরই মধ্যে অনেকের কাছে তা পৌঁছে দিয়েছে এবং দিচ্ছে, যা নিঃসন্দেহে প্রশংসাযোগ্য। কিন্তু সরকারের এই মহতী কাজ কতটা কার্যকরভাবে বাস্তবায়িত হচ্ছে, তা ভেবে দেখা দরকার। কারণ মাননীয় প্রধানমন্ত্রীর কঠোর হুঁশিয়ারি উচ্চারণের পরও থেমে নেই ত্রাণের চালচোরদের কারবার। রাজনীতিকে পুঁজি করে এ ধরনের অসৎ ও লোভী লোকের কারণে সরকারের গৃহীত এ ধরনের কর্মসূচির সুফল অনেক সময় ভুক্তভোগীরা পায় না। ফলে সরকারের ওই সব পদক্ষেপ পরিপূর্ণভাবে সফলতা পায় না আবার অনেক ক্ষেত্রে তা প্রশ্নবিদ্ধও হয়ে পড়ে। উদাহরণ হিসেবে বলা যায়, ৩১ মার্চ পটুয়াখালীতে জেলেদের জন্য বরাদ্দকৃত চাল বিক্রির অভিযোগে কমলাপুর ইউনিয়নের স্থানীয় জনতা জাকির হোসেন ও মো. সোহাগ নামের দুজনকে আটক করে পুলিশে সোপর্দ করে। আটককৃতদের জবানবন্দি অনুযায়ী কমলাপুর ইউনিয়ন পরিষদের (ইউপি) চেয়ারম্যান মনির রহমান মৃধাকে আটক করেছে পুলিশ। আবার ২ এপ্রিল রাতে নওগাঁর রাণীনগরে আওয়ামী লীগ নেতা আয়াত আলীর বাড়ি থেকে ১৩৮ বস্তা ত্রাণের চাল ও ২০০ খালি বস্তা উদ্ধার করেছে উপজেলা প্রশাসন। আর ৭ এপ্রিল নাটোরের সিংড়ায় ত্রাণের চাল বিক্রির দায়ে উপজেলা প্রশাসনের হাতে আটক হন ইউপি সদস্য মো. শাহিন শাহসহ আরো দুজন। শুধু তা-ই নয়, ৮ এপ্রিল টাঙ্গাইলের ঘাটাইল ইউনিয়নের টিলাবাজার এলাকায় ওএমএসের ৯০ কেজি চালসহ এক ভ্যানচালককে আটক করা হয়। আবার ৮ ও ৯ এপ্রিল হতদরিদ্রদের জন্য বরাদ্দের ৩৫৬ বস্তা চাল আটক করেছে পুলিশ। বগুড়া, জামালপুর, ফরিদপুর, কুমিল্লা, রংপুর, কিশোরগঞ্জ ও ফেনীর বিভিন্ন স্থান থেকে ওই চাল উদ্ধার করা হয়। এসব ঘটনার পাশাপাশি গণমাধ্যমে প্রকাশিত সংবাদে প্রায়ই দেখা যাচ্ছে, অনেক জনপ্রতিনিধি ত্রাণের চাল কম দিচ্ছেন। উপরোক্ত ঘটনাগুলোর মাধ্যমে প্রমাণিত হয় যে মাননীয় প্রধানমন্ত্রীর হুঁশিয়ারি সত্ত্বেও থেমে নেই ত্রাণ চুরির কাণ্ড। এই অসৎ ব্যক্তিরা দেশ পরিচালনার দায়িত্ব পেলে দেশকে নিলামে তুলে বিক্রি করে দেওয়াটাও তাঁদের পক্ষে অসম্ভব কিছু নয়। অতীতে দেখা গেছে, ত্রাণের চাল চুরির ঘটনায় যাঁরা ধরা পড়েন বা আটক হন তাঁরা কিছুদিন পর জামিন নিয়ে বের হয়ে আবারও শুরু করেন অপকর্ম। এ যেন ‘ব্যাক টু দ্য প্যাভিলিয়ন’। আবার যাঁদের শাস্তি হয়, তাঁরাও আইনের ফাঁক দিয়ে বেরিয়ে আবার স্বরূপে চলে আসেন। বর্তমানে দেশের এই সংকটময় মুহূর্তে সরকার সামাজিক সুরক্ষা কর্মসূচির আওতায় হতদরিদ্র মানুষের কাছে খাবার পৌঁছে দেওয়ার যে মহতী পরিকল্পনা এরই মধ্যে নিয়েছে, তা সঠিকভাবে বাস্তবায়িত হবে না যদি খাদ্যবান্ধব কর্মসূচির চাল আত্মসাতের ঘটনা ঘটে। রাজনৈতিক প্রভাব-প্রতিপত্তির জোরে এই চাল বিতরণের দায়িত্ব যাঁরা পান, তাঁদের বেশির ভাগই আত্মস্বার্থ উদ্ধারে ব্যস্ত থাকে, যা দুঃখজনক। অতীতে এও দেখা গেছে যে সরকারের এ ধরনের কর্মসূচি সফল না হলে জনপ্রতিনিধিরা প্রশাসনকে আর প্রশাসন জনপ্রতিনিধিদের দোষারোপ করে থাকে। তবে বর্তমান পরিস্থিতি সম্পূর্ণ ভিন্ন। এখন মোটেও দোষারোপের সময় নয়। করোনার কারণে দেশের এই সংকটময় মুহূর্তে হতদরিদ্র ও অভাবী মানুষের কাছে খাবারসহ নিত্যপ্রয়োজনীয় পণ্য পৌঁছানো জরুরি। কারণ খাদ্য মানুষের প্রথম ও প্রধান মৌলিক চাহিদা। করোনা সংকট উত্তরণে সরকার সামাজিক সুরক্ষা কর্মসূচিগুলো জোরদার করার সিদ্ধান্ত নিয়েছে, যাতে বেশিসংখ্যক দরিদ্র মানুষ উপকার পায়। কিন্তু প্রশ্ন হচ্ছে, খাদ্যবান্ধব কর্মসূচির চাল রাজনৈতিক নেতা নামধারীরা আত্মসাৎ করলে দরিদ্র জনগোষ্ঠী উপকারভোগী হবে কিভাবে? ভিজিডি, ভিজিএফের চাল-গম আত্মসাৎ করা কিংবা খাদ্যবান্ধব কর্মসূচির চাল কালোবাজারে বিক্রি করার খবর হরহামেশাই গণমাধ্যমে আসে। কিন্তু রাজনৈতিক ছত্রচ্ছায়ায় অপরাধীরা খুব কম ক্ষেত্রেই শাস্তি পায়। তবে এবার খাদ্যবান্ধব কর্মসূচির আত্মসাৎ করা চাল উদ্ধার এবং আত্মসাৎকারীকে গ্রেপ্তার করার ঘটনায় স্থানীয় প্রশাসন ও জনগণ অবশ্যই সাধুবাদ পাওয়ার যোগ্য। দেশের অন্যান্য স্থানেও প্রশাসন ও জনগণ সক্রিয়তা দেখিয়ে কাজ করলে রাজনীতির ছত্রচ্ছায়ায় থাকা দুর্নীতিবাজ, অসাধু, লোভী ও দুর্বৃত্তরা অনেকটাই নিরস্ত হবে। আর তখনই সরকারের পক্ষে সম্ভব হবে দরিদ্র ও কর্মহীনদের খাবার নিশ্চিত করা। মাননীয় প্রধানমন্ত্রীর পাশাপাশি স্থানীয় সরকার, পল্লী উন্নয়ন ও সমবায় মন্ত্রী মো. তাজুল ইসলামও হুঁশিয়ারি উচ্চারণ করে বলেছেন, ‘করোনা পরিস্থিতিতে ত্রাণ বিতরণে কোনো অনিয়ম বা দুর্নীতির অভিযোগ পেলে সঙ্গে সঙ্গেই ব্যবস্থা নেওয়া হবে, এ ক্ষেত্রে আগে শাস্তি পরে তদন্ত করা হবে।’ বলা বাহুল্য, যাঁরা গরিবের জন্য বরাদ্দকৃত সাহায্য আত্মসাৎ করেন, তাঁদের বিরুদ্ধে অবশ্যই কঠোর ও দৃষ্টান্তমূলক শাস্তির ব্যবস্থা গ্রহণ করা জরুরি। চুরির অভিযোগ প্রমাণিত হলে অভিযুক্তের যে আর জনপ্রতিনিধিত্ব করার নৈতিক অধিকার থাকে না, তা বলা বাহুল্য। তাই এ ধরনের অসৎ লোক যেন ভবিষ্যতে কোনো ধরনের রাজনৈতিক পদ-পদবি না পান বা দলে যেন কোনোভাবেই থাকতে না পারেন, তা অবশ্যই নিশ্চিত করা প্রয়োজন। কারণ তাঁরা দলের জন্য করোনাভাইরাসের চেয়ে কোনো অংশেই কম ক্ষতিকর নয়। তাঁদের সামাজিকভাবেও বয়কট করা প্রয়োজন। সর্বোপরি ত্রাণচোরদের বিরুদ্ধে গণমাধ্যমসহ সবাইকে সজাগ থাকতে হবে, যেন তাঁরা ভবিষ্যতে কোনোভাবেই অসহায়, দুস্থ আর গরিবের জন্য বরাদ্দকৃত চাল বা ত্রাণ চুরি করতে না পারেন।
লেখক : সহযোগী অধ্যাপক, আইন বিভাগ, ড্যাফোডিল ইন্টারন্যাশনাল ইউনিভার্সিটি; আন্তর্জাতিক মানবাধিকার সংগঠন অ্যামনেস্টি ইন্টারন্যাশনালের আন্তর্জাতিক সদস্য
kekbabu@yahoo.com

Link: https://www.kalerkantho.com/print-edition/sub-editorial/2020/04/27/904191

25
দুর্নীতি প্রতিরোধে প্রয়োজন সম্মিলিত প্রয়াস
ড. কুদরাত-ই-খুদা বাবু
৬ ফেব্রুয়ারি, ২০২০

ট্রান্সপারেন্সি ইন্টারন্যাশনালের (টিআই) দুর্নীতির ধারণা সূচকে বাংলাদেশের এক ধাপ অগ্রগতি হয়েছে। বিষয়টি ‘নাই মামার চেয়ে কানা মামা ভালো’র মতো হলে এটি অবশ্যই একটি শুভ দিক। ১৮০টি দেশের মধ্যে ২০১৯ সালে অধঃক্রম অনুযায়ী (খারাপ থেকে ভালো) বাংলাদেশের অবস্থান ১৪তম, যা আগের বছর ছিল ১৩তম। আবার সূচকের ঊর্ধ্বক্রম অনুযায়ী (ভালো থেকে খারাপ) বাংলাদেশের অবস্থান তিন ধাপ এগিয়ে ১৪৯ থেকে ১৪৬তম অবস্থানে এসেছে। তবে দুর্নীতি পরিস্থিতি উন্নয়নসংক্রান্ত স্কোরে বাংলাদেশের কোনো পরিবর্তন নেই। ১০০ নম্বরের মধ্যে এবারও বাংলাদেশ পেয়েছে ২৬। এর মানে, সূচকের উন্নতি হলেও দুর্নীতি কমেনি। সামনে এগিয়ে থাকা কোনো দেশ আরো খারাপ করায় বাংলাদেশের অবস্থান এগিয়ে গেছে। বাংলাদেশের এই অবস্থান এশিয়া-প্রশান্ত মহাসাগরীয় অঞ্চলে চতুর্থ এবং দক্ষিণ এশিয়ায় দ্বিতীয়। জার্মানভিত্তিক দুর্নীতিবিরোধী সংস্থা ট্রান্সপারেন্সি ইন্টারন্যাশনালের (টিআই) দুর্নীতির ধারণাসূচক (করাপশন পারসেপশন ইনডেক্স)-২০১৯ সালের প্রতিবেদনে এসব তথ্য উঠে এসেছে।

এ কথা অনস্বীকার্য যে আমাদের দেশে অর্থনৈতিক উন্নতি হচ্ছে এবং দিন দিন প্রবৃদ্ধি বাড়ছে। কিন্তু এই প্রবৃদ্ধির ব্যবহার কোথায় হচ্ছে এবং কারা ভোগ করছে, সেটা সঠিকভাবে বণ্টন হচ্ছে কি না ইত্যাদি বিষয় সরকারসহ সংশ্লিষ্ট সবারই ভালোভাবে খতিয়ে দেখা প্রয়োজন। অর্থনৈতিক ক্ষেত্রে বাংলাদেশ অনেক উন্নতি করলেও সমাজে দুর্নীতি থাকায় এর সুফল ঠিকমতো পাচ্ছে না দেশের জনগণ। তবে দুর্নীতি না থাকলে আমাদের দেশের যে আরো অনেক অনেক উন্নতি হতো, সে কথা বলা যায় নিঃসন্দেহে। বলার অপেক্ষা রাখে না, বিশ্বের বিভিন্ন দেশের মতো বাংলাদেশও এখন পর্যন্ত দুর্নীতির আওতামুক্ত হতে পারেনি। বরং আমাদের সবার প্রিয় এ বাংলাদেশে যত সমস্যা জাতীয় উন্নয়ন-অগ্রগতি, ন্যায়বিচার ও সুশাসনের ক্ষেত্রে বাধা হয়ে দাঁড়িয়েছে এবং দাঁড়াচ্ছে; দুর্নীতি তাদের মধ্যে অন্যতম। মূলত রাজনীতিবিদদের প্রতিশ্রুতির ঘাটতি, রাষ্ট্রীয় প্রতিষ্ঠানগুলোর জবাবহিদির অভাব, রাজনৈতিক দলগুলোর জন্য অবস্থান সংকুচিত করে দেওয়া এবং গণমাধ্যম ও সুধীসমাজের প্রতিনিধিদের কথা বলার সুযোগ সীমিত করার বিষয়গুলোকে দুর্নীতি না কমার কারণ হিসেবে চিহ্নিত করেছে টিআইবি। জনসংখ্যাধিক্য ও ক্ষুদ্র আয়তনের এ দেশটির একদিকে যেমন এখনো বিরাজ করছে দারিদ্র্য, অপুষ্টি ও সম্পদের অভাব, তেমনি অন্যদিকে সমাজের বিভিন্ন স্তরে বিরাজ করছে দুর্নীতির কালো ছায়া। দুর্নীতি নামক সমাজের সর্বগ্রাসী এই কালোব্যাধিটি যে তার কালো থাবা বিস্তার করে সমাজকে দিন দিন রাঘব বোয়ালের মতো গ্রাস করেই চলেছে তা সহজেই অনুমেয়। টিআই ২০০১ সাল থেকে ২০০৫ সাল পর্যন্ত বিশ্বের বিভিন্ন দেশে দুর্নীতির ওপর জরিপ চালিয়ে যে ফলাফল প্রকাশ করেছিল, তাতে পর পর টানা পাঁচ বছরেই বাংলাদেশ সবচেয়ে বেশি দুর্নীতিগ্রস্ত দেশ হিসেবে বিবেচিত হয়েছিল। তবে আশার কথা এই যে এর পরবর্তী বছরগুলোতে টিআইয়ের জরিপে দুর্নীতিতে বাংলাদেশের অবস্থান অনেকাংশে নিচের দিকে অর্থাৎ অপেক্ষাকৃত ভালো পর্যায়ে রয়েছে। এর আগে বারবার দুর্নীতিগ্রস্ত দেশ হিসেবে বাংলাদেশের অবস্থান শীর্ষ পর্যায়ে অবস্থান করায় আন্তর্জাতিক অঙ্গনে এ দেশের ভাবমূর্তি মারাত্মকভাবে ক্ষুণ্ন্ন হয়েছে। আবার তখন দেশে সীমাহীন দুর্নীতির কারণে বিদেশি বিনিয়োগকারীরাও বাংলাদেশকে ‘আস্থাহীন দেশ’ হিসেবে চিহ্নিত করেছিল। শুধু তাই নয়, দুর্নীতি নামক এই কালোব্যাধির কারণে একদিকে যেমন জিডিপি তার কাঙ্ক্ষিত লক্ষ্যে পৌঁছতে পারেনি, দারিদ্র্য বিমোচন কর্মসূচি সফলতা পায়নি; তেমনি অন্যদিকে জীবনযাত্রার মানও হয়েছিল নিম্নগামী।

দুর্নীতি প্রতিরোধে বিগত সরকারগুলোর আমলসহ বর্তমান সরকারের আমলে গৃহীত ব্যবস্থা যে একেবারেই অপ্রতুল তা অস্বীকার করার উপায় নেই। আইডিবি, এডিবিসহ বিভিন্ন দাতা সংস্থা ও নীতিনির্ধারকরা দীর্ঘদিন ধরেই বিভিন্ন সরকারকে দুর্নীতি হ্রাস করার উপায় হিসেবে অনেক পরামর্শ দিয়েছেন। টিআইবিও বিভিন্ন সময়ে সভা, সেমিনার ও রিপোর্টের মাধ্যমে দুর্নীতি প্রতিরোধে নানাভাবে সরকারের দৃষ্টি আকর্ষণ করেছে। এবারও দুর্নীতি প্রতিরোধে বেশ কিছু সুপারিশ করেছে টিআই। তার মধ্যে রয়েছে; দুর্নীতি নিয়ন্ত্রণে রাজনৈতিক সদিচ্ছা দেখানো; দুদককে আরো স্বাধীনভাবে কাজ করতে দেওয়া এবং অবাধ গণমাধ্যম ও সক্রিয় নাগরিক সমাজ বিকাশে উপযুক্ত পরিবেশ নিশ্চিত করা। দুর্নীতি প্রতিরোধ করতে সব কাজের স্বচ্ছতা ও জবাবদিহির যথাযথ ব্যবস্থা করা, দারিদ্র্য বিমোচন ও আয়বৈষম্য কমানোর উদ্যোগ গ্রহণ ও তার বাস্তবায়ন, দুর্নীতি দমন কমিশনকে প্রকৃত অর্থেই স্বাধীনভাবে কাজ করতে দেওয়া এবং দুর্নীতিবিষয়ক মামলা দ্রুত নিষ্পত্তি করা জরুরি। পাশাপাশি দুর্নীতিবাজদের রাজনৈতিক পরিচয় বাদ দিয়ে তাদের শুধু ‘দুর্নীতিবাজ’ হিসেবে চিহ্নিত করে তাদের বিরুদ্ধে উপযুক্ত ও দৃষ্টান্তমূলক শাস্তি প্রদান করাসহ তাদের সামাজিকভাবে বর্জন করার ব্যবস্থা করা দরকার। দুর্নীতি রোধের ক্ষেত্রে প্রশাসনিক সংস্কার, সুধীসমাজ গঠন, ব্যাপক গবেষণার মাধ্যমে দুর্নীতির প্রকৃত কারণ উদ্ঘাটন ও তা দূর করতে বাস্তবমুখী পদক্ষেপ গ্রহণ করাও আবশ্যক। এ ছাড়া গণমাধ্যমকে প্রকৃত অর্থেই স্বাধীনভাবে কাজ করার সুযোগ দিয়ে দুর্নীতির বিরুদ্ধে জনমত সৃষ্টির সুযোগ করে দেওয়া, সরকারি কর্মকর্তা-কর্মচারীদের দলীয় সম্পৃক্ততা বিচ্ছিন্ন করা এবং সব ক্ষেত্রে রাজনৈতিক হস্তক্ষেপ ও দলীয় দৃষ্টিভঙ্গির পরিবর্তন ঘটানো অতি জরুরি। সর্বোপরি দুর্নীতি থেকে দেশ ও জাতিকে রক্ষা করার জন্য দেশের সর্বত্র প্রয়োজন ‘সততা’র একটি আবহ। দরকার স্বচ্ছতা ও জবাবদিহির একটি সুষ্ঠু, সুন্দর পরিমণ্ডল। এ কথা সবারই স্মরণ রাখা দরকার, এ দেশটি আমার, আপনার, সবার। আসুন, আমরা সবাই মিলে সম্মিলিত কণ্ঠে দুর্নীতিকে ‘না’ বলি। দুনীতি প্রতিরোধে সরকারসহ আমাদের সবার সম্মিলিত অংশগ্রহণ ও তার যথাযথ বাস্তবায়ন সম্ভব হলে দ্রুততম সময়ের মধ্যে অবশ্যই বাংলাদেশকে একটি দুর্নীতিমুক্ত দেশ হিসেবে গড়ে তোলা সম্ভব।

লেখক : সহযোগী অধ্যাপক, আইন বিভাগ ড্যাফোডিল ইন্টারন্যাশনাল ইউনিভার্সিটি; আন্তর্জাতিক মানবাধিকার সংগঠন অ্যামনেস্টি ইন্টারন্যাশনালের আন্তর্জাতিক সদস্য
kekbabu@yahoo.com

Link: https://www.kalerkantho.com/print-edition/muktadhara/2020/02/06/871297?fbclid=IwAR0AX5cbJyHCHqao1lxsbAJPDXJyFlpdoRBrERte6_qCMA2uTNDi6SCwZF4

26
বায়ুদূষণ রোধে হাইকোর্টের নির্দেশনার বাস্তবায়ন কতদূর?
ড. কুদরাত-ই-খুদা বাবু
২১ জানুয়ারি ২০২০
চিকিৎসা বিজ্ঞানী ইবনে সিনা তার গবেষণালব্ধ ফলাফল থেকে বলেছিলেন, মানুষের ভেতরে শ্বাস-প্রশ্বাসের মাধ্যমে বা অন্য কোনোভাবে যদি ধুলাবালি কণা না ঢুকত, তবে মানুষ লাখ লাখ বছর বাঁচতেন। সুতরাং দেখা যাচ্ছে, দীর্ঘায়ু লাভের ক্ষেত্রে ধুলাবালি কণামুক্ত নির্মল ও বিশুদ্ধ বায়ু বা বাতাসের এক গুরুত্বপূর্ণ অবদান রয়েছে।
ঠিক একইভাবে উল্টোদিক থেকে বিষয়টি নিয়ে পর্যবেক্ষণ করলে দেখা যাবে, দূষিত বাতাস বা দূষিত পরিবেশ দীর্ঘায়ু কমানোর ক্ষেত্রে নেতিবাচকভাবে গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা পালন করে।বিশ্ব স্বাস্থ্য সংস্থার (WHO) এক পরিসংখ্যানে দেখা গেছে, পৃথিবীতে প্রতিবছর সড়ক দুর্ঘটনা, ধূমপান এবং ডায়াবেটিস- এ তিনটি কারণে যে পরিমাণ মানুষ মারা যায়, তারচেয়ে বেশি মানুষ মারা যায় বায়ুদূষণের কারণে।

পরিবেশ ও চিকিৎসাবিদ্যা মতে, বায়ুদূষণ থেকে ক্রনিক অবস্ট্রাকটিভ পালমোনারি ডিজিস (সিওপিডি) নামে শ্বাসতন্ত্রের যে রোগ হয়, তা বিশ্বজুড়ে মানুষের মৃত্যুর তৃতীয় প্রধান কারণ। আর ২০১২ সালে শুধু এ রোগেই পৃথিবীতে যে পাঁচটি দেশে সবচেয়ে বেশিসংখ্যক মানুষের মৃত্যু ঘটেছে, বাংলাদেশ তার মধ্যে অন্যতম।

বাংলাদেশের রাজধানী ঢাকাসহ দেশের বড় শহরগুলোয় বায়ুদূষণের মাত্রা অত্যন্ত বেশি। এয়ার ভিজুয়ালের প্রতিবেদন অনুযায়ী, চলতি বছরের ১২ জানুয়ারি বিশ্বের দূষিত বায়ুর শহরগুলোর তালিকায় শীর্ষে ছিল ঢাকা। এর আগে গত বছরের ২৬ ও ২৭ নভেম্বর, ১৭ ডিসেম্বর এবং চলতি বছরের ৭ জানুয়ারি বায়ুদূষণে ঢাকার অবস্থান ছিল শীর্ষে।

শুধু ঢাকা নয়, সারা দেশেই হচ্ছে পরিবেশ দূষণ। বিশ্বের প্রভাবশালী স্বাস্থ্য সাময়িকী দ্য ল্যানসেট ২০১৭ সালে এক প্রতিবেদনে জানায়, পরিবেশ দূষণের ফলে মৃত্যুর দিক থেকে বাংলাদেশ শীর্ষে। আর রাজধানী ঢাকা তো অনেক বছর ধরেই বসবাসের অযোগ্য ও নিকৃষ্টতম শহরগুলোর একটি, যার অন্যতম কারণ পরিবেশ দূষণ।

অনিয়ন্ত্রিত যানবাহন, বাড়ি ও কলকারখানার দূষিত ও রাসায়নিক পদার্থ নির্গমন, বর্জ্য ব্যবস্থাপনার দুর্বলতা, নাগরিক অসচেতনতা ইত্যাদি পরিবেশ দূষণের কারণ। ২০১৯ সালে WHO ১০টি স্বাস্থ্যঝুঁকি চিহ্নিত করেছে।

এর মধ্যে এক নম্বর ঝুঁকি হল বায়ুদূষণ ও জলবায়ু পরিবর্তন। আর ২০১৮ সালে সংস্থাটির হিসাবে বিশ্বের সবচেয়ে দূষিত শহরগুলোর মধ্যে ঢাকা ছিল তৃতীয়।

ঢাকার বায়ুদূষণের এ চিত্র সরকারি সংস্থা পরিবেশ অধিদফতরের পর্যবেক্ষণেও উঠে এসেছে। সংস্থাটির পর্যবেক্ষণে ঢাকার বায়ুমান মারাত্মক অস্বাস্থ্যকর। ঢাকা শহরের বায়ুতে যেসব ক্ষতিকর উপাদান আছে, তার মধ্যে মানবদেহের জন্য সবচেয়ে মারাত্মক উপাদান হচ্ছে পিএম ২.৫।

WHO-এর তথ্যানুসারে, পিএম ২.৫ শ্বাস-প্রশ্বাসের মাধ্যমে সহজেই শরীরে প্রবেশ করে তা শ্বাসতন্ত্রের নানা রোগসহ হৃদরোগের পরিমাণ বাড়ায় এবং পিএম ২.৫-এর কারণে অ্যাজমা ও ফুসফুসের ক্যান্সারও হতে পারে। উল্লেখ্য, বায়ুদূষণের কারণে বাংলাদেশে প্রতিবছর প্রায় ১ লাখ ২২ হাজার ৪০০ মানুষের মৃত্যু ঘটে।

ঢাকার বাতাস দূষিত হওয়ার কারণ কী এবং তা রোধে পরিবেশ অধিদফতর কী পদক্ষেপ নিয়েছে, তা জানাতে ১৩ জানুয়ারি মহামান্য হাইকোর্ট কর্তৃক নির্দেশ দেয়া হয়েছে। একই সঙ্গে যেসব পরিবহন নির্ধারিত মাত্রার চেয়ে বেশি কালো ধোঁয়া ছড়াচ্ছে, সেসব যানবাহন জব্দ করতেও নির্দেশ দেয়া হয়েছে।

ঢাকার বায়ুদূষণ রোধে সুপারিশ সংবলিত বিশেষজ্ঞ কমিটির প্রতিবেদন হাইকোর্টে উপস্থাপনের পর আদালত ঢাকার বায়ুদূষণ রোধে মোট ৯ দফা নির্দেশনা দিয়েছেন।

মানবাধিকার ও পরিবেশবাদী সংগঠন হিউম্যান রাইটস অ্যান্ড পিস ফর বাংলাদেশের (এইচআরপিবি) করা এক রিট আবেদনের ধারাবাহিকতায় বিচারপতি এফআরএম নাজমুল আহাসান ও বিচারপতি কেএম কামরুল কাদেরের হাইকোর্ট বেঞ্চ এ নির্দেশনা দিয়েছেন।

নির্মল বায়ু ও পরিবেশ রক্ষায় বিশ্বব্যাংকের ৩০০ কোটি টাকার প্রকল্প গ্রহণ করা হয়েছিল। এ টাকা পরিবেশ অধিদফতর কীভাবে ব্যয় করেছে, পরিবেশ উন্নয়নে কী ধরনের ভূমিকা রেখেছে, এতে জনগণ কী ধরনের সুফল পাচ্ছে অর্থাৎ পুরো প্রকল্পের টাকা কীভাবে ব্যয় হয়েছে, তার ব্যাখ্যা তলব করা হয়েছে।

মহামান্য হাইকোর্টের দেয়া ৯ দফা নির্দেশনায় সড়ক পরিবহন আইনের বিধান অনুযায়ী পরিবহনের ‘ইকোনমিক লাইফ’ নির্ধারণ করতে বলা হয়েছে। যেসব পরিবহনের ইকোনমিক লাইফের মেয়াদ শেষ হয়েছে, সেসব পরিবহন চলাচলে নিষিদ্ধ করতে প্রয়োজনীয় ব্যবস্থা নিতে নির্দেশ দেয়া হয়েছে।

পরিবেশ অধিদফতরের অনুমোদন ছাড়া চলমান টায়ার পোড়ানো ও ব্যাটারি রিসাইকেলিং বন্ধ করতে ব্যবস্থা নিতে নির্দেশ দেয়া হয়েছে। এ আদেশ বাস্তবায়ন করে পরিবেশ অধিদফতরকে এক মাসের মধ্যে প্রতিবেদন দিতে বলা হয়েছে।

পাশাপাশি ঢাকার পাশের চার জেলা গাজীপুর, মুন্সীগঞ্জ, নারায়ণগঞ্জ ও মানিকগঞ্জে যেসব অবৈধ ইটভাটা এখনও বন্ধ করা হয়নি, সেগুলো বন্ধ করে দুই মাসের মধ্যে প্রতিবেদন দিতে বলা হয়েছে।

এ ছাড়া ঢাকায় বালু, ময়লা, বর্জ্য বহনের সময় বহনকারী ট্রাকসহ সংশ্লিষ্ট যানবাহনগুলো ঢেকে চলাচল করার ব্যবস্থা নিশ্চিত করতে হবে। দোকান বা মার্কেটের ময়লা যাতে সিটি কর্পোরেশনের নির্ধারিত স্থানে ফেলা হয়, তা নিশ্চিত করতে প্রয়োজনীয় পদক্ষেপ নিতে সিটি কর্পোরেশনকে নির্দেশ দেয়া হয়েছে।

পাশাপাশি যে কোনো স্থাপনা নির্মাণ এলাকায় বালু, সিমেন্ট, মাটিসহ নির্মাণসামগ্রী ঢেকে রাখা নিশ্চিত করতে ব্যবস্থা নিতে নির্দেশ দেয়া হয়েছে। উন্নয়ন ও নির্মাণকাজ যাতে আইন ও দরপত্রের শর্তানুযায়ী নিশ্চিত করা হয়, তারও নির্দেশ দেয়া হয়েছে।

সিটি কর্পোরেশনের যেসব ধুলাবালিপ্রবণ এলাকায় এখনও পানি ছিটানো হয়নি, সেসব এলাকায় নিয়মিত পানি ছিটাতেও বলা হয়েছে।

ঢাকার বাতাসের এই যখন অবস্থা, তখন বাতাসে ভাসমান মানবস্বাস্থ্যের জন্য ক্ষতিকর মিহি ধূলিকণার মাত্রা কমিয়ে আনার ক্ষেত্রে রাজশাহী শহর বিশ্বের মধ্যে সর্বাধিক সাফল্য অর্জন করেছে। সারা বিশ্বের শহরগুলোয় বায়ুদূষণ কমানোর ক্ষেত্রে রাজশাহীর এ গৌরবোজ্জ্বল দৃষ্টান্ত থেকে একটা বিষয় সবার কাছে অত্যন্ত সুস্পষ্ট হয়ে উঠেছে।

আর তা হচ্ছে, সংশ্লিষ্ট কর্তৃপক্ষের সত্যিকার অর্থে আন্তরিক প্রয়াস এবং সবার সহযোগিতা থাকলে অবশ্যই একটি শহরে শুধু বায়ুদূষণ কমানোই নয়, বরং ওই শহরকে সবচেয়ে ভালোভাবে বসবাস উপযোগী করে তোলাও সম্ভব। এমনকি সারা বিশ্বের মধ্যে ওই শহরকে সবচেয়ে সুখী শহরেও পরিণত করা সম্ভব।

আবার এ ক্ষেত্রে যদি ঘটনা উল্টোভাবে ঘটে, তাহলে এ ক্ষেত্রে রাজশাহীকে দেখতে না পেয়ে প্রথমেই দেখা যাবে ঢাকা এবং এরপর গাজীপুর, নারায়ণগঞ্জ, চট্টগ্রাম, খুলনার মতো অন্যান্য শহরকে; যা মাত্রাতিরিক্ত দূষণে পরিপূর্ণ।

এ যেন ইতিবাচক মনোভাবাপন্ন কতিপয় ব্যক্তিকে নরকে পাঠিয়ে দেয়ার পর কয়েকদিন পর নরকটি স্বর্গে পরিণত হওয়া এবং নেতিবাচক মনোভাবাপন্ন কতিপয় ব্যক্তিকে স্বর্গে পাঠিয়ে দেয়ার পর স্বর্গটি নরকে পরিণত হওয়ার গল্পের মতো।

এখন প্রশ্ন হচ্ছে, বায়ুদূষণ কমানোর ক্ষেত্রে যদি রাজশাহী শহর সারা বিশ্বের মধ্যে প্রথম স্থান অর্জন করতে সক্ষম হয়; তাহলে কেন ঢাকা, গাজীপুর, নারায়ণগঞ্জ, চট্টগ্রাম, খুলনা কিংবা দেশের অন্য শহরগুলোয় বায়ুদূষণ কমানো যাচ্ছে না?

নাকি ওই শহরগুলোয় বসবাসরত লোকজন দূষণ পছন্দ করেন? নিশ্চয়ই পছন্দ হওয়ার কথা নয়। দেশের অন্যান্য শহরে বায়ুদূষণ বা অন্যান্য দূষণ কমানোর ক্ষেত্রে কোনো জাদুর কাঠির প্রয়োজন নেই।

ঢাকার বায়দূষণ রোধে মহামান্য হাইকোর্টের ৯ দফা নির্দেশনা দ্রুত বাস্তবায়নের পাশাপাশি প্রত্যেক ব্যক্তিকে নিজ নিজ অবস্থান থেকে সচেতন হয়ে পরিবেশ রক্ষায় এগিয়ে এসে সঠিক পরিকল্পনা অনুযায়ী নগরায়ণ করা প্রয়োজন।

এক কথায়, বাস্তবমুখী জোরালো কার্যকর পদক্ষেপ গ্রহণ করা আবশ্যক। আর তা সম্ভব হলেই রাজশাহী শহরের মতো ঢাকা শহরসহ দেশের অন্য শহরগুলোয়ও বায়ুদূষণ কমিয়ে আনা সম্ভব হবে। সম্ভব হবে ওই শহরগুলোকে সত্যিকার অর্থেই সুখে ও শান্তিতে বসবাসের উপযোগী করে গড়ে তোলা।

সুতরাং, এ লক্ষ্যে এখন থেকেই ঢাকা উত্তর ও দক্ষিণ সিটি কর্পোরেশনসহ সরকার, গণমাধ্যম, সরকারি-বেসরকারি বিভিন্ন প্রতিষ্ঠানসহ সবাইকে নিজ নিজ অবস্থান থেকে কাজ শুরু করা আবশ্যক।

ড. কুদরাত-ই-খুদা বাবু : সহযোগী অধ্যাপক, আইন বিভাগ, ড্যাফোডিল ইন্টারন্যাশনাল ইউনিভার্সিটি; অ্যামনেস্টি ইন্টারন্যাশনালের সদস্য
kekbabu@yahoo.com

Link: https://www.jugantor.com/todays-paper/window/269364/%E0%A6%AC%E0%A6%BE%E0%A7%9F%E0%A7%81%E0%A6%A6%E0%A7%82%E0%A6%B7%E0%A6%A3-%E0%A6%B0%E0%A7%8B%E0%A6%A7%E0%A7%87-%E0%A6%B9%E0%A6%BE%E0%A6%87%E0%A6%95%E0%A7%8B%E0%A6%B0%E0%A7%8D%E0%A6%9F%E0%A7%87%E0%A6%B0-%E0%A6%A8%E0%A6%BF%E0%A6%B0%E0%A7%8D%E0%A6%A6%E0%A7%87%E0%A6%B6%E0%A6%A8%E0%A6%BE%E0%A6%B0-%E0%A6%AC%E0%A6%BE%E0%A6%B8%E0%A7%8D%E0%A6%A4%E0%A6%AC%E0%A6%BE%E0%A7%9F%E0%A6%A8-%E0%A6%95%E0%A6%A4%E0%A6%A6%E0%A7%82%E0%A6%B0

27
আগামী দিনের মেয়রদের কাছে প্রত্যাশা
ড. কুদরাত-ই-খুদা বাবু
১৬ জানুয়ারি, ২০২০

২০১৯ সালে বিশ্ব স্বাস্থ্য সংস্থা (WHO) ১০টি স্বাস্থ্যঝুঁকি চিহ্নিত করে। এর মধ্যে এক নম্বর ঝুঁকি হলো বায়ুদূষণ ও জলবায়ু পরিবর্তন। আর ২০১৮ সালে সংস্থাটির হিসাবে বিশ্বের সবচেয়ে দূষিত শহরগুলোর মধ্যে ঢাকা ছিল তৃতীয়। ঢাকার বায়ুদূষণের এই চিত্র সরকারি সংস্থা পরিবেশ অধিদপ্তরের পর্যবেক্ষণেও উঠে এসেছে। সংস্থাটির পর্যবেক্ষণে ঢাকার বায়ুমান মারাত্মক অস্বাস্থ্যকর। যুক্তরাজ্যভিত্তিক ইকোনমিক ইন্টেলিজেন্স ইউনিট (ইআইইউ) প্রতিবছর বিশ্বের বিভিন্ন শহরের বাসযোগ্যতার একটি তালিকা প্রকাশ করে। প্রতিবছরই স্বাস্থ্য, সংস্কৃতি ও পরিবেশ, শিক্ষা, ভৌত অবকাঠামো এবং স্থিতিশীলতা বা শৃঙ্খলা—এই পাঁচটি বিষয়ের ওপর ভিত্তি করে এ তালিকা করা হয়। তালিকায় প্রতিবছরই বসবাসের অযোগ্য শহরের তালিকায় প্রথম বা দ্বিতীয় বা তৃতীয় অবস্থানে থাকে ঢাকা শহর। অথচ একটু সচেতন হলে বায়ুদূষণ রোধ করা, জলাশয় ভরাট করে বহুতল ভবন নির্মাণ, অপরিকল্পিত ফ্যাক্টরি-কারখানা নির্মাণ করে একটি শহরের ওপর অত্যধিক চাপ সৃষ্টি করা, একটি শহরকে জ্বলন্ত চুল্লিতে পরিণত করা, এক ঘণ্টার টানা বৃষ্টিতে পুরো একটি শহরকে পানির নিচে তলিয়ে দেওয়া, একই রাস্তা অসৎ উদ্দেশে বারবার খোঁড়াখুঁড়ি করে জনগণকে ভোগান্তিতে ফেলা, যত্রতত্র ময়লা-আবর্জনা ফেলে দুর্গন্ধময় পরিবেশ সৃষ্টি করা, যানজট, ধুলাবালি, ধোঁয়া আর মশার উপদ্রবকে জনগণের নিত্যসঙ্গী বানানো, পানি-বিদ্যুৎ-গ্যাস সংকটে শহরবাসীকে ভোগান্তির হাত থেকে অন্ততপক্ষে রক্ষা করা যেতে পারে। ঢাকা সিটি করপোরেশনের আগামী দিনের মেয়র ও কাউন্সিলররা এ ব্যাপারে যথাযথ পদক্ষেপ গ্রহণ করবেন বলে নগরবাসীর প্রত্যাশা।

ঢাকাকে আতঙ্কিত ও অপ্রস্তুত শহর হিসেবে প্রায়ই উল্লেখ করা হয়। বিভিন্ন গণমাধ্যমেও এ বিষয়ে প্রায়ই রিপোর্ট প্রকাশিত ও প্রচারিত হয়। কিন্তু ঢাকাকে বাসযোগ্য করে তোলা সম্ভব হয়ে ওঠে না। ঢাকার বিকেন্দ্রীকরণ ও যানজটমুক্ত করতে নানা পরিকল্পনার কথা শোনা যায়। ঢাকাকে বাসযোগ্য করতে সরকারি-বেসরকারি উদ্যোগে নিত্যনতুন পরিকল্পনাও তৈরি হয়, সিটি করপোরেশনের মেয়র-কাউন্সিলররাও ভোটের আগে-পরে ঢাকাকে বাসযোগ্য করে তোলার দৃঢ় প্রত্যয় ব্যক্ত করেন। আবার এসব নিয়ে প্রায়ই সভা-সেমিনার অনুষ্ঠিত হয়। কিন্তু সেসব পরিকল্পনাকে বাস্তবে রূপ দেওয়ার কোনো উদ্যোগ তেমন একটা দেখা যায় না। ইআইইউর বিগত বছরের জরিপ থেকে একটা বিষয় স্পষ্ট যে ঢাকাকেন্দ্রিক নগরায়ণ টেকসই নয়—যা প্রত্যেক নগরবাসীই উপলব্ধি করতে পারে। এখন প্রশ্ন হচ্ছে, আমরা কেন এত পিছিয়ে? পাবলিক পরিবহনব্যবস্থা বলতে যা বোঝায়, তা ঢাকায় নেই। প্রয়োজনের তুলনায় রাস্তার স্বল্পতা, ব্যক্তিগত গাড়ির সংখ্যা বৃদ্ধি, অপরিকল্পিত ট্রাফিক ব্যবস্থা, জনগণ কর্তৃক ট্রাফিক আইন না মানার পাশাপাশি সুষ্ঠু গণপরিবহন ব্যবস্থার অভাবে ঢাকার রাস্তাঘাটে সৃষ্টি হচ্ছে যানজট। আর যানজটের কারণে মানুষের মূল্যবান সময় নষ্ট হচ্ছে। নষ্ট হচ্ছে কার্যক্ষমতা ও মনোযোগ। ঢাকা এমন একটি শহর, যেখানে পথচারীদের চলাচলের জন্য সামান্যতম যেসব সুযোগ-সুবিধা থাকা প্রয়োজন সেটুকুও নেই। যতটুকু আছে, সেখানেও হকাররা পুলিশ ও ক্ষমতাসীনদের ‘ম্যানেজ’ করে বসায় দোকানপাট। এক শ্রেণির মানুষের সীমাহীন অর্থলিপ্সা রাজধানী ঢাকাকে ভয়াবহ ইট-কাঠের বস্তিতে পরিণত করছে। অত্যন্ত ঘনবসতিপূর্ণ হওয়ায় ঢাকায় বড় আকারের অঘটন ঘটলে যে পরিমাণ ক্ষতি হবে, তা হবে অকল্পনীয়। শরীরের কোনো অংশে অস্বাভাবিক কোষ বৃদ্ধির কারণে ওই অংশে টিউমার, গোদ রোগ বা মরণব্যাধি ক্যান্সারের সৃষ্টি হয় এবং এর ফলে মানুষ যেমন তার স্বাভাবিক কার্যক্ষমতা হারায়; ঠিক তেমনিভাবে বাংলাদেশের রাজধানী ঢাকার ওপর নানা দিক থেকে অস্বাভাবিক চাপ সৃষ্টি করা হচ্ছে। রিস্ক অ্যাসেসমেন্ট টুলস ফর ডায়াগনসিস অব আরবান এরিয়াস-এর জরিপে ভূতাত্ত্বিক ঝুঁকিপূর্ণ বিশ্বের ২০টি শহরের মধ্যে অন্যতম ঢাকা। ঢাকা মহানগরীর প্রায় তিন লাখ ২৬ হাজার পাকা ভবনের মধ্যে ৭২ হাজার ভূমিকম্প ঝুঁকির মধ্যে আছে। রাজধানী ঢাকায় প্রায় আড়াই কোটি মানুষের বসবাস এবং দেশের বিপুলসংখ্যক জনগণ কর্মসংস্থানের লক্ষ্যে রাজধানীমুখী হওয়ায় এ সংখ্যা প্রতিদিনই অস্বাভাবিক হারে বাড়ছে। ঢাকার ওপর বর্তমানে জনসংখ্যার চাপ যে হারে বাড়ছে, তাতে ভূমিকম্পের উৎপত্তিস্থল ঢাকা এবং তা রিখটার স্কেলে ৭ কিংবা তার একটু ওপরের মাত্রার হলেই ঢাকা ধূলিসাৎ হয়ে যেতে পারে।

ঢাকা শহরের ওপর চাপ কমানোর জন্য ঢাকার বিকেন্দ্রীকরণ এখন অত্যন্ত জরুরি বিষয় হয়ে পড়েছে। দেশের বড় একটি সেক্টর হচ্ছে রপ্তানিমুখী গার্মেন্টশিল্প, যা দেশের সর্ববৃহৎ ও সর্বাধিক বৈদেশিক মুদ্রা অর্জনকারী শিল্প। বাংলাদেশ তৈরি পোশাক রপ্তানি করে প্রধানত যুক্তরাষ্ট্র ও ইউরোপে। বিজিএমইএর তত্ত্বাবধানে পরিচালিত ঢাকা রিজিয়নে রয়েছে প্রায় দুই হাজার ৮৩৩টি গার্মেন্ট ফ্যাক্টরি। এসব গ্যার্মেন্ট ফ্যাক্টরিতে লাখ লাখ শ্রমিক কাজ করে। আর গার্মেন্ট ফ্যাক্টরির কাঁচামাল ও উৎপাদিত পণ্য উভয়ের চলাচল হয় চট্টগ্রাম পোর্ট ও মোংলা পোর্ট দিয়ে। অর্থনীতির পরিভাষায় উৎপাদনের উপকরণ ও উৎপাদিত পণ্য নির্বিবাদে স্থানান্তরের সুযোগ থাকলে যেকোনো স্থানের বিনিয়োগ থেকে প্রাপ্ত সুফল সংযুক্ত অন্যান্য এলাকায় পৌঁছানো যায়। তুলনামূলকভাবে পণ্য চলাচল সহজ ও সাশ্রয়ী হলে আঞ্চলিক বৈষম্য হ্রাস পেতে পারে। এ ক্ষেত্রে গার্মেন্ট ফ্যাক্টরিগুলোরও বিকেন্দ্রীকরণ অত্যন্ত জরুরি। এ ব্যাপারে বুয়েটসহ সরকারি ও বেসরকারি প্রকৌশল সেক্টরের বিশেষজ্ঞদের সঙ্গে আলোচনাপূর্বক সুপরামর্শ নেওয়া যেতে পারে।

ঢাকা শহরকে পরিষ্কার রাখতে ঢাকা সিটি করপোরেশনের পক্ষ থেকে ২০১৬ সালকে পরিচ্ছন্ন বছর হিসেবে ঘোষণা করা হয়েছিল। কিন্তু বাস্তবে তা কতটুকু কার্যকর হয়েছে? আবার দুই সিটি করপোরেশনের আসন্ন নির্বাচনে মেয়র ও কাউন্সিলর প্রার্থীরাও ঢাকাকে বাসযোগ্য নগরী গড়ে তোলার প্রত্যয় ব্যক্ত করছেন। কিন্তু ঢাকাকে পরিষ্কার রাখতে, বাসযোগ্য নগরী করতে তাঁদের একার পক্ষে সম্ভব নয়। এ ক্ষেত্রে সিটি করপোরেশনের আন্তরিকতাসহ সরকারের সদিচ্ছার পাশাপাশি বিভিন্ন গণমাধ্যম, বিভিন্ন রাজনৈতিক দল, সামাজিক, সাংস্কৃতিক ও স্বেচ্ছাসেবী সংগঠনের অংশগ্রহণ আবশ্যক। পাশাপাশি আমাদের সবাইকে এ ব্যাপারে সচেতন হয়ে প্রত্যেককে মেয়র-কাউন্সিলরের ভূমিকায় অবতীর্ণ হয়ে কাজ শুরু করতে হবে এখন থেকেই, যেন ঢাকা শহর আগামীতে সত্যিকার অর্থেই একটি বাসযোগ্য শহর হিসেবে গড়ে ওঠে।
লেখক : সহযোগী অধ্যাপক, আইন বিভাগ ড্যাফোডিল ইন্টারন্যাশনাল ইউনিভার্সিটি
আন্তর্জাতিক মানবাধিকার সংগঠন অ্যামনেস্টি ইন্টারন্যাশনালের আন্তর্জাতিক সদস্য
kekbabu@yahoo.com

Link: https://www.kalerkantho.com/print-edition/muktadhara/2020/01/16/862988


28
নারী নির্যাতন কমছে না কেন
ড. কুদরাত-ই-খুদা বাবু
যুগান্তর (১১ জানুয়ারি ২০২০)

সম্প্রতি ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের এক ছাত্রী ধর্ষণের ঘটনায় ক্ষোভে ফুঁসে উঠেছিলেন দেশের বিভিন্ন বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষক-শিক্ষার্থীসহ নানা শ্রেণি-পেশার মানুষ। বস্তুত সারা দেশে আশঙ্কাজনক হারে বেড়েছে ধর্ষণ, ধর্ষণ-পরবর্তী হত্যা ও নির্যাতন।
দেশে প্রাপ্তবয়স্ক মেয়ে, গৃহবধূ, স্কুল-কলেজ-মাদ্রাসা-বিশ্ববিদ্যালয় পড়ুয়া ছাত্রী থেকে শুরু করে দুই-তিন বছরের কোমলমতি শিশু- কেউই রেহাই পাচ্ছে না। এছাড়া মাদ্রাসা শিক্ষার্থীরাও এ নারী নির্যাতনের শিকার হচ্ছে। আর বিয়ের প্রলোভন দেখিয়ে এমন ঘটনা তো অহরহই ঘটানো হচ্ছে।

অনেক সময় দেখা যায়, কোনো মেয়ে ধর্ষণের শিকার হলে সমাজ ও মানসম্মানের ভয়ে বিষয়টি কাউকে জানান না। তখন বিষয়টি লোকচক্ষুর অন্তরালেই থেকে যায়। অনেক সময় এও দেখা যায়, ধর্ষণের ঘটনা ধর্ষক বা তার সহযোগী কর্তৃক ভিডিও আকারে ধারণ করে ইন্টারনেটে ছেড়ে দেয়া হচ্ছে কিংবা ইন্টারনেটে ছেড়ে দেয়ার ভয়ভীতি দেখিয়ে ওই মেয়েকে পুনরায় ধর্ষণ করা হচ্ছে কিংবা তার কাছ থেকে অবৈধ সুবিধা নেয়া হচ্ছে।

একজন মেয়ে যখন ধর্ষণের শিকার হন, তখন তার মানসিক অবস্থা কেমন হতে পারে, তা কি আমাদের ভেবে দেখা উচিত নয়? পাশাপাশি ওই মেয়েটিকে বা ওই মেয়েটির পরিবারকে আমাদের ‘সমাজ’ই বা কোন চোখে দেখে থাকে, তা কি আমরা ভেবে দেখি? আমরা কি ভেবে দেখেছি, একজন মেয়ে ধর্ষণের শিকার হওয়ার পর ওই ঘটনা তাকে সারাক্ষণ তাড়া করে বেড়ানোর ফলে তার মানসিক শান্তি থাকে না। থাকে না ভালোভাবে বাঁচার স্বপ্ন এবং শেষ পর্যন্ত তার আত্মবিশ্বাসটুকুও দিনে দিনে লোপ পেতে থাকে।

আবার অনেক সময় অনেক মেয়ে ধর্ষণের শিকার হয়ে অপমান সইতে না পেরে আত্মহত্যা পর্যন্ত করে থাকেন। তবে আশ্চর্যের বিষয়, ধর্ষণের মতো ফৌজদারি অপরাধ, ন্যক্কারজনক ও জঘন্য ঘটনা ঘটলেও ধর্ষিতা কিংবা তার পরিবার ন্যায়বিচারটুকু পর্যন্ত পান না। একটি স্বাধীন, সভ্য ও গণতান্ত্রিক দেশে এর চেয়ে বড় লজ্জার, দুঃখের ও আশ্চর্যের বিষয় আর কী হতে পারে?

মানবাধিকার সংস্থা আইন ও সালিশ কেন্দ্রের (আসক) হিসাব অনুযায়ী, সদ্য বিদায়ী ২০১৯ সালে দেশে ১ হাজার ৪১৩ নারী ধর্ষণের শিকার হয়েছেন। ২০১৮ সালে এ সংখ্যা ছিল ৭৩২। অর্থাৎ ২০১৮ সালের তুলনায় ২০১৯ সালে ধর্ষণের ঘটনা বেড়েছে দ্বিগুণ; যা প্রকৃতই উদ্বেগের বিষয়। শুধু তাই নয়, এটি বিশ্ব দরবারে বাংলাদেশের ভাবমূর্তি ক্ষুণ্ন করছে। বলা বাহুল্য, কোনো সমাজে ধর্ষণ বিস্তৃত হলে এবং ধর্ষকদের কঠোর সাজার ব্যবস্থা করা না হলে সেই সমাজে নীতি-নৈতিকতা ও মূল্যবোধ বলে কিছুই থাকে না।

ধর্ষণের কারণগুলো বিশ্লেষণ করলে সাধারণত দেখা যায়- ১. ধর্ষণকারীদের মধ্যে বিন্দুমাত্র অপরাধবোধ থাকে না। ২. যে সমাজে আইনের শাসন নেই কিংবা থাকলেও তা দুর্বল বা ভঙ্গুর, সেই সমাজের লোকরা ধর্ষণ উপযোগী পরিবেশ পায়। সুতরাং সামাজিক প্রতিরোধ ও আইনের শাসনের অভাব ধর্ষণের জন্য দায়ী। ৩. পর্নোগ্রাফি দেখে অনেক পুরুষ ধর্ষণে উৎসাহিত বোধ করে। ৪. মেয়েদের ওপর আধিপত্য বিস্তার ও ভয়ভীতি দেখিয়ে নিয়ন্ত্রণ করার মানসিকতাও ধর্ষণের অন্যতম কারণ।

৫. ক্ষমতাশালী ব্যক্তি সুযোগ পেয়ে কোনো দুর্বল মেয়ে, শিশু বা ছেলের ওপর ক্ষমতার প্রয়োগ ঘটায় ধর্ষণের মাধ্যমে। ৬. অনেক সময় বন্ধুবান্ধব একসঙ্গে হয়ে আকস্মিকভাবে কোনো অসহায় মেয়েকে একা পেয়ে আনন্দ-ফুর্তি করার জন্যও ধর্ষণ করে। এ ছাড়া বর্তমানে ইন্টারনেটসহ নানা ধরনের তথ্যপ্রযুক্তির অবাধ ব্যবহার বৃদ্ধি পাওয়াসহ পারিপার্শ্বিক আরও অনেক কারণে ধর্ষণ হতে পারে।

তবে যেভাবেই ধর্ষণ, হত্যা ও নির্যাতন হোক না কেন, তা গুরুতর ফৌজদারি অপরাধ। নারী ও শিশু নির্যাতন দমন আইন ২০০০ (সংশোধিত ২০০৩)-এর ৯ ধারা মোতাবেক ধর্ষণের অপরাধের যেসব শাস্তির বিধান রয়েছে, তা হল- ধর্ষণের ফলে কোনো নারী বা শিশুর মৃত্যু হলে ধর্ষণকারীর জন্য রয়েছে মৃত্যুদণ্ড বা যাবজ্জীবন সশ্রম কারাদণ্ড এবং এর অতিরিক্ত কমপক্ষে এক লাখ টাকা অর্থদণ্ড।

একাধিক ব্যক্তি দলবদ্ধভাবে কোনো নারী বা শিশুকে ধর্ষণ করলে ধর্ষণকালে বা ধর্ষণের পর যদি তার মৃত্যু ঘটে, তবে ওই দলের সবার জন্যই এ শাস্তি প্রযোজ্য হবে। ধর্ষণের চেষ্টা করলে ধর্ষণকারীর সর্বোচ্চ ১০ বছর ও সর্বনিু পাঁচ বছরের সশ্রম কারাদণ্ড এবং এর অতিরিক্ত অর্থদণ্ডেরও বিধান রয়েছে। কোনো নারী বা শিশুকে ধর্ষণ করে মৃত্যু ঘটানো বা আহত করার চেষ্টা করলে ধর্ষণকারী যাবজ্জীবন সশ্রম কারাদণ্ডে দণ্ডিত হবে এবং এর অতিরিক্ত অর্থদণ্ডেও দণ্ডিত হবে।

তবে শিশু ধর্ষণ বা নির্যাতন বা হত্যা বিষয়ে মামলা করে বিচার পাওয়ার চেয়ে সমাজে যেন এ ধরনের ঘটনা কোনোভাবেই না ঘটে সে ব্যবস্থা করা অধিকতর মঙ্গলজনক। ধর্ষণ থেকে পরিত্রাণ পেতে হলে আমাদের দর্শন ও নৈতিকতার উন্নয়ন ঘটাতে হবে, আমাদের মনের অশুভ চিন্তা বা দৃষ্টিভঙ্গির পরিবর্তন করতে হবে। বর্তমান বাস্তবতায় সমাজে ধর্ষণের বিরুদ্ধে সম্মিলিত কণ্ঠে প্রতিবাদ হওয়াটা খুবই জরুরি।

ধর্ষকরা অনেক সময় উপযুক্ত শাস্তি পায় না বলেই পরবর্তী সময়ে তারা আবারও বীরদর্পে ধর্ষণ করে। আর তাদের দেখে অন্যরাও উৎসাহিত হয়। এভাবে চলতে থাকলে এ সমাজ, দেশ ও জাতি কলুষিত হবে। তাই ধর্ষণ রোধে প্রতিটি পরিবারে প্রতিটি শিশুকে ছোটবেলা থেকেই নৈতিক শিক্ষা দেয়া প্রয়োজন, যেন বড় হয়ে সে কোনোভাবেই এ পথে পা না বাড়ায়। পরিবারই শিশুর আচরণ, মূল্যবোধ, নৈতিকতা ইত্যাদির ভিত্তি তৈরি করে দেয়।

সর্বোপরি, ধর্ষণ প্রতিরোধে সরকারসহ বিভিন্ন সরকারি-বেসরকারি প্রতিষ্ঠান, গণমাধ্যম, সুধীসমাজসহ সবার একযোগে এগিয়ে আসা প্রয়োজন। এ দেশ ও জাতির সামগ্রিক উন্নয়ন, অগ্রগতির পাশাপাশি সমাজের শান্তি-শৃঙ্খলা বজায় রাখার স্বার্থেই ধর্ষণকে কঠোর হস্তে প্রতিহত করা এখন সময়ের দাবি এবং তা অপরিহার্য।

ড. কুদরাত-ই-খুদা বাবু : সহযোগী অধ্যাপক, আইন বিভাগ, ড্যাফোডিল ইন্টারন্যাশনাল ইউনিভার্সিটি; অ্যামনেস্টি ইন্টারন্যাশনালের সদস্য
kekbabu@yahoo.com

Link: https://www.jugantor.com/todays-paper/sub-editorial/265539/%E0%A6%A8%E0%A6%BE%E0%A6%B0%E0%A7%80-%E0%A6%A8%E0%A6%BF%E0%A6%B0%E0%A7%8D%E0%A6%AF%E0%A6%BE%E0%A6%A4%E0%A6%A8-%E0%A6%95%E0%A6%AE%E0%A6%9B%E0%A7%87-%E0%A6%A8%E0%A6%BE-%E0%A6%95%E0%A7%87%E0%A6%A8

29
চারদিকে উৎপাত : প্রতিকারের উপায় কী
ড. কুদরাত-ই-খুদা বাবু
৭ জানুয়ারি, ২০২০ (The daily Kalerkantho)

আমাদের দেশে উৎপাতের অন্ত নেই। চারদিকে উৎপাত। নানা ধরনের উৎপাত। পথে-ঘাটে-মাঠে সর্বত্র উৎপাত আর উৎপাত। অনেক সময় ঘরের দরজা-জানালা বন্ধ করেও উৎপাত থেকে রেহাই মেলে না। সব কিছু দেখে মনে হয়, আমরা যেন উৎপাতের রাজ্যে বাস করছি। উৎপাত যেন জীবনেরই অনুষঙ্গ; তাই উৎপাতে এখন আমরা আর বিরক্ত হই না। আবার অনেকেই মনে করতে পারেন, দেশে বুঝি উৎপাত নিরোধক কোনো আইন নেই। আবার অনেকেই হয়তো জানি না, উৎপাত কী? আভিধানিক অর্থে, উৎপাত শব্দের অর্থ হচ্ছে উপদ্রব, দৌরাত্ম্য, অত্যাচার। উন্নত দেশগুলোতে উৎপাত করা একটি মারাত্মক অপরাধ; ভয়ানক দেওয়ানি অপরাধ ও শাস্তিযোগ্য। সেখানে শান্তি ভঙ্গ করা বা উৎপাত করা ফৌজদারি অপরাধের মতোই দণ্ডযোগ্য একটি অপরাধ। সাধারণ অর্থে, অন্যের ভোগে বা স্বাচ্ছন্দ্যে ব্যাঘাত ঘটানোর নামই উৎপাত। এটি এমন এক ধরনের অপরাধমূলক কাজ, যা জনগণের অধিকারে হস্তক্ষেপ করে। একজন আইন মেনে আরেকজনকে বিরক্ত না করে যদি তার ন্যায়সংগত অধিকার ভোগ করে, তাতে কারো ব্যাঘাত ঘটানোর অধিকার নেই। এই ব্যাঘাত ঘটানোই হলো উৎপাত। উৎপাতের দায়-দায়িত্ব সৃষ্টি হয়, এমন কোনো অবস্থার সৃষ্টি করলে যার ফলে অন্যের ভোগে বা স্বাচ্ছন্দ্যে ব্যাঘাত সৃষ্টি হয়। গণ-উৎপাত সম্পর্কে বাংলাদেশ দণ্ডবিধির (১৮৬০) ২৬৮ ধারায় বলা হয়েছে, ‘কোনো ব্যক্তি কর্তৃক জনসম্মুখে এমন কোনো কাজ করা, যার দ্বারা জনগণের বিরক্তি সৃষ্টি হয় এমন কার্য করাকে গণউৎপাত বলে’। আর দণ্ডবিধির ২৯০ ধারায় এর শাস্তি সম্পর্কে ২০০ টাকা পর্যন্ত জরিমানা করার কথা বলা হয়েছে। ১৮৬০ সালে প্রণীত দণ্ডবিধির শাস্তি হিসেবে ২০০ টাকা যদিও বর্তমান বাস্তবতায় খুবই সামান্য, তবু শাস্তি শাস্তি হিসেবেই গণ্য হয়। দণ্ডবিধির সংজ্ঞা অনুযায়ী, যেকোনো ব্যক্তি তার অবৈধ কাজ যা জনসাধারণের উপদ্রব সৃষ্টির জন্য দায়ী, যা জনসাধারণের শারীরিক বা মানসিক আঘাত, বিপদ বা বিরক্তি সৃষ্টি করে। অতএব, কোনো ব্যক্তির উচ্চ শব্দের সংগীতের বিরুদ্ধে প্রতিবাদ করা বৈধ অধিকার, যা শব্দের তীব্রতার কারণে একটি অপরাধকে গঠন করে। এ প্রসঙ্গে বছর কয়েক আগে ঢাকার ওয়ারি রামকৃষ্ণ মিশন রোডের মর্মান্তিক ঘটনাটি প্রাসঙ্গিক। সেখানে একটি ভবনের ছাদে একদল লোক অনুষ্ঠান উপলক্ষে উচ্চশব্দে সংগীত বাজাচ্ছিল। ৬৫ বছর বয়সী নাজমুল হক নামক এক ব্যক্তি ওই একই ভবনের একজন বাসিন্দা ছিলেন। তিনি ওই উচ্চশব্দের সংগীতের কারণে অসুস্থ বোধ করেছিলেন। তিনি সংশ্লিষ্টদের অনুরোধ করলেন সংগীতে শব্দের তীব্রতা কমাতে। কিন্তু তারা তা না করলে শেষ পর্যন্ত পরিস্থিতি মর্মান্তিক ঘটনায় রূপ নেয়। এ ঘটনাকে কেন্দ্র করে হত্যার সঙ্গে জড়িত থাকার জন্য পুলিশ চারজনকে গ্র্রেপ্তার করে আদালতে প্রেরণ করে। আমাদের দেশে মশা-মাছির উৎপাত থেকে শুরু করে ভিক্ষুকের উৎপাত, হিজড়াদের উৎপাত, মাদকসেবীদের উৎপাত, যানবাহনে উচ্চমাত্রার হর্ন ব্যবহার করে শব্দদূষণের উৎপাত, বায়ুদূষণের উৎপাতসহ পরিবেশ দূষণজনিত উৎপাত, ভাসমান পতিতাদের উৎপাত, ময়লা-আবর্জনা-ধোঁয়া-দুর্গন্ধজনিত উৎপাত, হৈ-হুল্লোড়জনিত উৎপাত, চলাচলজনিত উৎপাত, উচ্চৈঃস্বরে মাইকে বা ঢাকঢোল বাজিয়ে বা সাউন্ডবক্সে গান-বাজনা বাজিয়ে বা রাতের বেলায় বিভিন্ন অনুষ্ঠানে মাইক ব্যবহার করে উৎপাত সৃষ্টি করাপূর্বক লেখাপড়া ও ঘুমে বিঘ্ন ঘটানোর উৎপাত, স্কুল-কলেজ আর রাস্তার মোড়সহ যেখানে-সেখানে বখাটেদের উৎপাত, আড্ডাবাজদের উৎপাত, হকারদের উৎপাত, পথে-ঘাটে চলাচলের সময় উৎপাতসহ নানা ধরনের উৎপাত আমাদের দেশে পরিলক্ষিত হয়। আবার অনেক সময় বখাটের উৎপাত সহ্য করতে না পেরে অনেক স্কুলছাত্রী আত্মহত্যা বা আত্মহত্যার চেষ্টা পর্যন্ত করে, যা সত্যিকার অর্থেই দুঃখজনক।

আমরা অনেক সময় উৎপাত আর দায়িত্বে অবহেলাকে এক বিষয় হিসেবে মনে করি বা মনে হতে পারে। কিন্তু উৎপাত আর দায়িত্বে অবহেলা এক বিষয় নয়। অবহেলার ক্ষেত্রে প্রধান প্রশ্ন হচ্ছে বিবাদীর সাবধানতা অবলম্বন করা দায়িত্ব ছিল কি না এবং বিবাদী সে দায়িত্ব যথাযথভাবে পালন করেছে কি না। আর উৎপাতের ক্ষেত্রে সাবধানতা অবলম্বনের প্রশ্ন উঠে না। বিবাদীর আচরণই মুখ্য বিষয়। যথাযথ সাবধানতা অবলম্বন করার পরও যদি উৎপাতের সৃষ্টি হয় তার পরও বিবাদী দায়ী। কিন্তু কারো জমিতে কোনো আগন্তুক যদি উৎপাতের কারণ সৃষ্টি করে তবে জমির মালিক অসতর্কতার জন্য অবহেলার দায়ে দায়ী। কারণ তার জমিতে এসে কেউ উৎপাত সৃষ্টি করলে তার দায়-দায়িত্ব মালিককেও নিতে হবে। অবহেলার ক্ষেত্রে বাদীর অবদান বিবাদীর দায়-দায়িত্ব আনুপাতিক হারে হ্রাস করে। উৎপাতের স্থলে বাদী নিজেই এসেছিল—এ রকম আপত্তি গ্রহণযোগ্য নয়। পরিস্থিতি, স্থান, পদ্ধতি, ফলাফল, সংবেদনশীলতা ইত্যাদির আলোকে বিচার করতে হবে সেখানে উৎপাতের প্রতিকার পাওয়া যাবে কি না। আইনে ক্ষমতাপ্রাপ্ত হলে উৎপাত বৈধ হয়ে যায়, কিন্তু অবহেলার জন্য আইন ক্ষমতা প্রদান করে না। কেউ ক্রমাগত উৎপাত করলেও বিষয়টিকে আমরা অবহেলা বা অজ্ঞতা বলে ক্ষমার চোখে দেখি। ফলে উৎপাতের পরিমাণ বাড়ে বৈ কমে না। সম্ভাব্য ও অনুমেয় ক্ষতির জন্য সাবধানতা অবলম্বনে কেউ ব্যর্থ হলে বিষয়টিকে আমরা অবহেলা বলে গণ্য করতে পারি। কিন্তু উৎপাত নয়। কেউ তার এ কাজের জন্য ক্ষতিগ্রস্ত হলে তাকে আমরা অবহেলার দায়ে দায়ী করতে পারি। যদিও কোনো কোনো ক্ষেত্রে একই কাজের জন্য অবহেলা অথবা উৎপাতের প্রতিকার পাওয়া যায়, কিন্তু এ দুটি বিষয় এক নয়। যদিও আইনের ভাষায় দুটি বিষয়ই টর্ট আইনের অন্তর্গত। বর্তমানে অবহেলা স্বতন্ত্র টর্ট হিসেবে আত্মপ্রকাশের আগে অনেক ক্ষেত্রে উপাতের সঙ্গে জড়িত ছিল। আমাদের দেশে টর্টের যে দুই-চারটি মামলা হয়ে থাকে, তা মূলত মানহানিকেন্দ্রিক। টর্টের অন্যান্য বিষয় যেমন : উৎপাত, গণ-উৎপাত, দায়িত্ব-কর্তব্যে অবহেলা, ভয়ভীতি প্রদর্শন, অনধিকার প্রবেশ ইত্যাদি বিষয়ক মামলা আদালতে যেন অজ্ঞাত কারণে দায়ের হতে দেখা যায় না। ফলে আইনের এই গুরুত্বপূর্ণ শাখাটি দেশের আইন অঙ্গনে উপেক্ষিত থাকায় এর প্রয়োগ ও প্রতিকার সম্পর্কে অনেকেরই অজানা। অথচ টর্ট আইনে মামলা করে সহজেই উৎপাত বা গণউৎপাতের প্রতিকার পাওয়া সম্ভব।

উৎপাত বা উপদ্রবের মতো ক্ষুদ্র অপরাধ হত্যাকাণ্ডে পর্যন্ত রূপান্তরিত হতে পারে বা হয়ে থাকে। এ ধরনের অবাঞ্ছিত পরিস্থিতির পেছনে অন্যতম কারণ হচ্ছে আমাদের আইনি শিক্ষার অভাব, সচেতনতার অভাব।

লেখক : সহযোগী অধ্যাপক, আইন বিভাগ, ড্যাফোডিল ইন্টারন্যাশনাল ইউনিভার্সিটি, আন্তর্জাতিক মানবাধিকার সংগঠন অ্যামনেস্টি ইন্টারন্যাশনালের আন্তর্জাতিক সদস্য
kekbabu@yahoo.com

Link: https://www.kalerkantho.com/print-edition/muktadhara/2020/01/07/859703

 



30
গুরুত্বপূর্ণ ও প্রয়োজনীয় টর্ট আইনটি এ দেশে উপেক্ষিত
ড. কুদরাত-ই-খুদা বাবু
১২ ডিসেম্বর, ২০১৯ ০০:০০

আমাদের দেশে টর্ট আইনের যথেষ্ট ব্যবহার ও এর তেমন একটা প্রয়োগ না থাকায় অনেকেই টর্ট এবং টর্ট আইনের সঙ্গে পরিচিত নন। অথচ আমাদের দেশের মতো একটি দেশে এমন একটি গুরুত্বপূর্ণ আইনের প্রয়োজনীয়তা অপরিসীম এবং এর প্রয়োজনীয়তা কোনোভাবেই উপেক্ষা করা যায় না। লাতিন শব্দ Tortum থেকে Tort শব্দটি এসেছে—যার অর্থ বাঁকা বা সোজা পথে না চলে বাঁকা পথে চলা। যদিও বাংলা ভাষায় Tort-এর কোনো উপযুক্ত আইনি প্রতিশব্দ ব্যবহার হতে দেখা যায় না। সাধারণত Tort-কে দেওয়ানি ক্ষতি বা নিমচুক্তি কিংবা কখনো ব্যক্তিগত অপকার হিসেবে গণ্য করা হয়ে থাকে। সাধারণ অর্থে টর্ট বলতে বোঝায়, কোনো ক্ষতিগ্রস্ত ব্যক্তিকে ক্ষতিপূরণ প্রদান। টর্টের কোনো বিধিবদ্ধ আইন নেই। তথাপি পৃথিবীর উন্নত দেশগুলোতে এ আইনের প্রয়োগ ও বিস্তার অনেক বেশি। কিন্তু দুঃখজনক হলেও সত্য, আমাদের দেশে Tort আইনের প্রয়োগ নেই বললেই চলে। অথচ গুরুত্বপূর্ণ ও প্রয়োজনীয় এ আইনটির যথাযথ ও সুষ্ঠু প্রয়োগ ঘটালে একদিকে যেমন দেশ থেকে অনেক অপরাধ কমিয়ে আনা সম্ভব, তেমনি অন্যদিকে এই আইনের মাধ্যমে ক্ষতিগ্রস্ত ব্যক্তিকে সত্যিকারের আইনি প্রতিকার দেওয়াও সম্ভব। তবে এই ক্ষতিপূরণের কোনো নির্দিষ্টতা নেই। বাংলাদেশে অন্যান্য বিধিবদ্ধ আইনের মতো টর্ট আইন বিধিবদ্ধ আইন নয়। এখানে প্রযোজ্য টর্ট আইন ইংল্যান্ডের সাধারণ আইন অনুসারে গঠিত। টর্টের মামলা বিচারের ক্ষেত্রে পারিপার্শ্বিক পরিস্থিতি ও যুক্তিসংগত কারণকে প্রাধান্য দেওয়া হয়ে থাকে। এ দেশে টর্টের যে দু-চারটি মামলা হয়ে থাকে, তা মূলত Defamation বা মানহানিকেন্দ্রিক। টর্টের অন্যান্য বিষয় যেমন—দায়িত্ব-কর্তব্যে অবহেলা, ভয়ভীতি প্রদর্শন, উৎপাত, গণ-উৎপাত বা Public nuisance, অনধিকার প্রবেশ ইত্যাদি বিষয়ক মামলা আদালতে যেন অজ্ঞাত কারণে দায়ের হতে দেখা যায় না। ফলে আইনের এই গুরুত্বপূর্ণ শাখাটি এ দেশের আইন অঙ্গনে উপেক্ষিত থাকায় এর প্রয়োগ ও প্রতিকার সম্পর্কে অনেকেরই অজানা। এ দেশের বেশির ভাগ মানুষই জানে না যে শারীরিক আঘাতের জন্য দোষী ব্যক্তি কারাবরণের পাশাপাশি বাদীর (ক্ষতিগ্রস্ত ব্যক্তি) চিকিৎসার খরচসহ অন্যান্য ক্ষতির দায়স্বরূপ ক্ষতিপূরণ দিতে বাধ্য। দোষী ব্যক্তিকে জেল বা অর্থদণ্ড দিয়ে থাকেন আদালত তথা রাষ্ট্র। কিন্তু এ ক্ষেত্রে বাদী কোনো সুবিধা পান না। তবে টর্ট আইনের মাধ্যমে দোষী ব্যক্তির কাজের জন্য বাদী ব্যক্তিগতভাবে যে ক্ষতির সম্মুখীন হন, তা পুষিয়ে দেওয়া হয়ে থাকে। এতে বাদী নিজের জন্য সুনির্দিষ্টভাবে আইনি প্রতিকার পেয়ে থাকেন। একটি উদাহরণ দিয়ে বিষয়টি পরিষ্কার করা যেতে পারে। মনে করা যাক, কোনো এক ব্যক্তি অন্য এক ব্যক্তির হাত বা পা কেটে ফেলল বা ভেঙে দিল। এ ক্ষেত্রে যদি দোষী ব্যক্তিকে আদালত কর্তৃক অপরাধের ধরন ও প্রকৃতি অনুযায়ী আইন মোতাবেক নির্দিষ্ট মেয়াদে কারাদণ্ড দেওয়া হয়ে থাকে, তাহলে এতে বাদীর বা ক্ষতিগ্রস্ত ব্যক্তির তেমন কিছু আসে-যায় না। তাঁর চিকিৎসা খরচ ও হাত-পা কাটা বা ভেঙে ফেলার কারণে তিনি যে কয়দিন কাজ করতে পারলেন না এবং তাঁর আনুষঙ্গিক ক্ষতির জন্য শুধু টর্টে মামলা করার মাধ্যমেই ক্ষতিপূরণ আদায় করা সম্ভব। টর্টে বিভিন্ন ধরনের প্রতিকারের বিধান রয়েছে। তবে এগুলোর মধ্যে আর্থিক জরিমানাই বেশি দেওয়া হয়ে থাকে। আর কিছু কিছু ক্ষেত্রে নিষেধাজ্ঞা (Injunction) জারি বা সুনির্দিষ্ট প্রতিকারের আদেশ দেওয়া হয়ে থাকে। আধুনিক বিশ্বে টর্ট আইনের মাধ্যমে মানসিক ক্ষতিপূরণের ব্যবস্থাও চালু আছে।

আমাদের দেশে টর্ট আইন প্রয়োজনীয় কেন? এ প্রশ্নের জবাবে বলা যায়, এ দেশে প্রতিনিয়তই আইনের লঙ্ঘন হচ্ছে। টর্ট আইনের ব্যাপক প্রয়োগ থাকলে ওই আইনের মাধ্যমে এসব ঘটনা-দুর্ঘটনা ও অন্যায়-অপরাধের বিরুদ্ধে সুনির্দিষ্ট প্রতিকার পাওয়া সম্ভব। যেমন : খাদ্যে ভেজালবিরোধী অভিযানে টর্টের মাধ্যমে সফলতা আনা সম্ভব। খাদ্য মানুষের প্রথম ও প্রধান মৌলিক চাহিদা। তাই খাদ্যের ব্যাপারে মানুষ সর্বদাই সতর্ক ও সচেষ্ট থাকে। কিন্তু আমাদের দেশে জনগণের তথা ক্রেতার বিশ্বাসকে ও অসহায়ত্বকে পুঁজি করে কিছু অসাধু ব্যবসায়ী বা বিক্রেতা বেশি মুনাফার লোভে প্রতিনিয়ত খাদ্যে ভেজাল মেশাচ্ছে। শুধু খাদ্যে ভেজাল নয়, প্রায় সময়ই আমরা পত্রিকায় চিকিৎসকের অবহেলা বা ভুল চিকিৎসার কারণে রোগী মারা যাওয়া বা রোগীর জীবন বিপন্ন হওয়ার খবর পড়ে থাকি। কিন্তু এ ক্ষেত্রে ক্ষতিগ্রস্ত ব্যক্তি বা তার পক্ষে কেউ আগে থেকে চিকিৎসক বা হাসপাতালের সঙ্গে করে রাখা একটি চুক্তির জন্য কোনো আইনি পদক্ষেপ নিতে পারেন না। কিংবা নেওয়ার সাহস করেন কিংবা এ ব্যাপারে তেমন একটা আগ্রহ দেখান না। অথচ এ ক্ষেত্রে যদি ওই চিকিৎসকের বিরুদ্ধে অবহেলার বিষয়টি প্রমাণ করা যায়, তাহলে সহজেই ভুক্তভোগী রোগী বা রোগীর পরিবার কিছুটা হলেও সহায়তা পেতে পারে। পৃথিবীর অন্যান্য দেশের মতো আমাদের দেশেও যদি টর্ট আইনে মামলা (অসাবধানতার জন্য ক্ষতি হলে) হতো, তাহলে দোষী ব্যক্তিদের বড় অঙ্কের ক্ষতিপূরণ দিতে হতো। তাই জনগণের উচিত হবে, এ ধরনের ঘটনার ক্ষেত্রে আদালতে গিয়ে টর্ট আইনের অধীনে মামলা করা। আর এজাতীয় মামলা সরকারের পক্ষ থেকে নয় বরং ক্ষতিগ্রস্ত ব্যক্তিদের পক্ষ থেকেই করতে হবে। তাহলে ক্ষতিগ্রস্ত ব্যক্তি আইনের উপযুক্ত ও যথাযথ প্রয়োগের মাধ্যমে প্রতিকার ও সুফল পেতে পারেন। আর সবচেয়ে বড় কথা হচ্ছে, একবার কেউ ফৌজদারি অপরাধের জন্য জেল খাটলে, জরিমানা দিলে এবং এসবের পাশাপাশি ক্ষতিগ্রস্ত ব্যক্তিকে মোটা অঙ্কের ক্ষতিপূরণ দিলে সে আর দ্বিতীয়বার ওই ধরনের অন্যায়-অপরাধ করতে চাইবে না। আমাদের দেশে এ ধরনের ঘটনার পরিপ্রেক্ষিতে মামলাগুলোর বেলায় আদালত কর্তৃক দায়ী ব্যক্তির কৃত অপরাধের জন্য ক্ষতিগ্রস্ত ব্যক্তিকে পূর্ণ ক্ষতিপূরণ দেওয়ার নির্দেশ দেওয়ার রেওয়াজ প্রবল মাত্রায় বাড়ালে এবং অপরাধের সঙ্গে জড়িত কাউকে কোনোভাবেই ছাড় না দিলে দেশ থেকে এ ধরনের অপরাধ সহজেই হ্রাস পাবে বলে আশা করা যায়। আমাদের দেশে যেখানে প্রতিনিয়ত-প্রতি মুহূর্তে-প্রতিদিন আইন লঙ্ঘিত হচ্ছে নানাভাবে; যেখানে সাধারণ মানুষ নিত্য হেনস্তা ও হয়রানির শিকার হচ্ছে; যেখানে প্রতারণা প্রবলমাত্রায় বিরাজমান, সেখানে টর্টের মতো কার্যকর একটি আইন কেন উপেক্ষিত রয়েছে, তা বোধগম্য নয়। বলার অপেক্ষা রাখে না, টর্ট আইনের সুষ্ঠু প্রয়োগ হলে তা আমাদের সমাজব্যবস্থার ধরন পাল্টে দিতে পারে। টর্টের মাধ্যমে প্রতিষ্ঠিত হতে পারে সাধারণ মানুষের আইনি অধিকার। পাশাপাশি এই আইনের যথাযথ প্রয়োগ ঘটলে সমাজ থেকে অপরাধপ্রবণতা উল্লেখযোগ্য হারে কমে যাবে। সর্বোপরি, দেশের সব মানুষকে আইনের প্রতি শ্রদ্ধাশীল করতে টর্ট আইন এক অনন্য ভূমিকা পালন করতে পারে। সুতরাং, টর্ট আইনের প্রয়োজনীয়তা ও গুরুত্বের দিকে লক্ষ রেখেই এই আইনটির ব্যাপক প্রচার ঘটানোসহ এর সুষ্ঠু প্রয়োগ ও ব্যবহারের লক্ষ্যে সাধারণ জনগণ, গণমাধ্যম, সরকার ও আইন-আদালত সংশ্লিষ্টসহ সবাইকে একযোগে এগিয়ে এসে প্রয়োজনীয় পদক্ষেপ গ্রহণ করতে হবে।
লেখক : সহযোগী অধ্যাপক, আইন বিভাগ, ড্যাফোডিল ইন্টারন্যাশনাল ইউনিভার্সিটি; অ্যামনেস্টি ইন্টারন্যাশনালের আন্তর্জাতিক সদস্য
kekbabu@yahoo.com

Link: https://www.kalerkantho.com/print-edition/sub-editorial/2019/12/12/849913

Pages: 1 [2] 3 4 ... 6