39
« on: October 15, 2015, 08:12:59 PM »
খাদ্য সম্পর্কে ভ্রান্ত ধারনা বা কুসংস্কার
সুস্থ্যভাবে বেঁচে থাকার জন্য প্রতিদিন আমাদের বিভিন্ন ধরণের পুষ্টিকর খাবার খাওয়া জরুরী। কিন্তু আমাদের মাঝে খাবার সম্পর্কে অজ্ঞতাবশত মনগড়া কিছু ধারনা/বিশ্বাস প্রাচীন কাল থেকেই প্রচলন দেখা যায়; যেগুলোর বেশীরভাগই মহিলা ও শিশুদের উপলক্ষ করেই সৃষ্ট। শুধু গ্রামে নয় শহরের শিক্ষিত মানুষের মাঝেও অপ্রয়োজনীয় এসব প্রথার প্রচলন আছে। কখনও কখনও তারা নিজেরাও জানেন যে; এসব হয়ত সত্যি না, তারপরও তারা ঐসব গোঁড়ামি থেকে বেরিয়ে আসতে পারেন না। ফলে তারা নিজেরা যেমন বঞ্চিত হন তেমনি তাদের আত্মিয়-স্বজন, পাড়া প্রতিবেশীরাও ক্ষতিগ্রস্ত হন। খাবার নিয়ে এসব ধ্যান-ধারণা বা কুসংস্কার এতটাই প্রবল আর প্রকট আকার ধারণ করে যে, তা মানুষের অপুষ্টির কারণ তো বটেই, কখনও কখনও মৃত্যু ঝুঁকিও সৃষ্টি করতে পারে। যেমন:-
• পাকা কলা খেলে ঠাণ্ডা লাগবে; সর্দি হবে- তাই শীতকালে অনেকেই কলা খেতে চাননা। এটি নিতান্তই ভুল ধারণা। ব্যাক্তি বিশেষে কলায় কারও কারও এলার্জি থাকতে পারে। তবে কলায় এমন কোনও উপাদান নেই যার কারণে সর্দি হতে পারে। বরং এতে রয়েছে শর্করা, আয়রন, ক্যলসিয়াম, ফসফরাস, ভিটামিন-সি, বি কমপ্লেক্স প্রভৃতি পুষ্টিকর উপাদান। আমাদের দেশে অনেকেই জোড় কলা খান না; এর কারণ তাদের ধারণা জোড় কলা খেলে যমজ সন্তান হবে। এটি নিতান্তই হাস্যকর এবং যুক্তিহীন একটি ধারণা। সন্তান একটি হবে নাকি যমজ হবে তা সম্পুর্নই একটি দৈব ঘটনা। এর সাথে জোড় কলা খাওয়ার কোনও সম্পর্ক নেই।
• আরও একটি ব্যাপক প্রচলিত কুসংস্কার হলো, কোনও ব্যাক্তির শরীরের কোনো অংশ কেটে গেলে কিংবা অপারেশন করার পর টক জাতীয় ফল খাওয়া যাবেনা। অথচ প্রকৃত ঘটনা সম্পুর্ন বিপরীত। শরীরের কোনো অংশ কেটে গেলে কিংবা অপারেশন করার পর টক জাতীয় ফল খেলে ক্ষতস্থান দ্রুত সেরে উঠে। কারণ ওইসব ফলে রয়েছে, ভিটামিন-সি যা ঘা শুকাতে সাহায্য করে। এ কারণে এমন অবস্থায় ভিটামিন-সি জাতীয় ফল যেমন- লেবু, কমলা, আনারস, জাম্বুরা, আমড়া, মাল্টা ইত্যাদি খাওয়া উচিত।
• আমাদের দেশে গর্ভবতী মহিলাদের বিভিন্ন কুসংস্কারে আবদ্ধ করে রাখা হয় ফলশ্রুতিতে তারা মাতৃত্বকালীন অপুষ্টিতে ভোগেন। যেমন- গর্ভাবস্থায় আনারস খেলে গর্ভপাত হয়। একারনে অনেক গর্ভবতী মহিলা আনারস খাওয়া থেকে বিরত থাকেন। কিন্তু প্রকৃত সত্য হলো আনারসে এমন কোনও উপাদান নেই যা গর্ভপাত ঘটাতে পারে। আনারস ভিটামিন-সি এর খুব ভালো উৎস। গর্ভাবস্থায় আনারস খুবই উপকারি একটি ফল।
• অত্যন্ত হাস্যকর আরও একটি কুসংস্কার হলো কেউ কেউ মনে করেন গর্ভাবস্থায় বোয়াল মাছ খেলে শিশুর ঠোঁট বোয়াল মাছের মত হবে। প্রকৃত সত্য হলো এই; সৃষ্টিকর্তা যেভাবে চাইবেন সন্তান সেভাবেই জন্ম গ্রহণ করবে। মাছ খাওয়ার সাথে মাছের মত অঙ্গপ্রত্যঙ্গ হওয়ার কোনও সম্পর্ক নেই। একই ভাবে মৃগেল মাছ নিয়েও রয়েছে ভুল ধারণা। এ মাছ খেলে নাকি মৃগী রোগ হয়! এক্ষেত্রেও একই কথা; এই মাছ খেলে মৃগী রোগ হওয়ার কোনও সম্ভাবনা নেই। এসব প্রাচীন কুপ্রথার কারণে আমাদের দেশের গর্ভবতী মায়েরা পরিবারের সামর্থ্য অনুযায়ী খাবার কিনে খেতে পারেন না, ফলে প্রোটিনের অভাবে ভোগেন, সেই সাথে অনাগত শিশুটিও অপুষ্টি নিয়ে জন্মগ্রহণ করে।
• তেমনি ভাবে মাংস নিয়েও রয়েছে অবান্তর ধারণা। গরুর মাংসে এলার্জি থাকায় কেউ কেউ খাসীর মাংসের উপর নির্ভর করে থাকে। কারও কারও ধারণা গর্ভবতী মা খাসীর মাংস খেলে নাকি শিশুর শরীরে ঘন লোম গজাবে। এটিও কুসংস্কার ছাড়া আর কিছুই নয়। ফলে দেখা যায় গর্ভবতী মা যেকোন ধরণের মাংস খাওয়া থেকেই বিরত থাকেন; তিনি নিজে তো বটেই শিশুটিও অপুষ্টির শিকার হয়। আবার কেউ কেউ বলে মাংস অপেক্ষা ঝোল ভালো। কিন্তু ঝোলে থাকে শুধু তেল, চর্বি, মসলা আর পানি। কাজেই ঝোল থেকে প্রোটিন পাওয়ার কোনও সম্ভাবনা নেই।
• আরও প্রচলিত আছে গর্ভবতী মা বেশী খেলে নাকি শিশু আকারে বড় হবে আর জন্মদানের সময় মায়ের ও সন্তানের ক্ষতি হবে। বাস্তবে গর্ভাবস্থায় পুষ্টি চাহিদা একজন সাধারন মহিলার চেয়ে বেড়ে যায়। আর সেই বাড়তি চাহিদা পূরণের জন্য তাকে পুষ্টিকর খাবার সরবরাহ করতে হবে। তানাহলে মা ও শিশু উভয়েরই ক্ষতি হওয়ার সম্ভাবনা থাকে। কখনও কখনও মৃত্যুও হতে পারে। একই ভাবে সন্তান প্রসবের পরও মায়ের উপর নানা রকমের নিষেধাজ্ঞা জারী করা হয়। যেমন- সদ্যপ্রসুতি মাকে স্বাভাবিক খাবার কিংবা রসালো খাবার দেয়া যাবেনা, তাকে শুকনো খাবার যেমন- মুড়ি, ভর্তা দিয়ে ভাত ইত্যাদি দিতে হবে তাহলে ক্ষতস্থান তাড়াতাড়ি শুকাবে। এসব ভুলের কারনে তখনও মা সঠিক পুষ্টি থেকে বঞ্চিত হন আর নানা রকম রোগে আক্রান্ত হন। ফলে সন্তানের দেখা-শোনাও ঠিকমত করতে পারেন না। এসব ভ্রান্ত ধারণা যদি দূর করা না যায় তবে মা ও শিশুর অপুষ্টি দূর করা যাবেনা।
• তাই গর্ভবতী ও প্রসূতি মাকে তার চাহিদা, সামর্থ্য এবং রুচি অনুযায়ী খাবার খেতে দিতে হবে। খাবার সম্পর্কে ভ্রান্ত ধারণা নিয়ে বিভ্রান্ত না হয়ে খাদ্য ও পুষ্টি বিশেষজ্ঞের পরামর্শ নিতে হবে। আমাদের দেশে প্রচুর পুষ্টিকর, সুস্বাদু এবং সস্তা খাদ্যদ্রব্য রয়েছে; যা খেয়ে ধনী-দরিদ্র, অসহায় এবং বঞ্চিত জনগোষ্ঠীও তাদের পুষ্টি অবস্থার উন্নয়ন ঘটাতে সক্ষম হবে। তাই আসুন দৃষ্টিভঙ্গি বদলে, কুসংস্কার ভুলে, পুষ্টিকর খাবার গ্রহণ করি, সুস্থ জাতি গঠনে সহায়তা করি।
মুনমুন হক