ইন্টারনেটে মত প্রকাশের স্বাধীনতা

Author Topic: ইন্টারনেটে মত প্রকাশের স্বাধীনতা  (Read 991 times)

Offline Ferdousi Begum

  • Hero Member
  • *****
  • Posts: 823
  • Don't give up.
    • View Profile
আজকাল আমাদের দেশের সচেতন ব্যক্তিদের বড় একটা অংশ ইন্টারনেট ব্যবহার করে। পিছিয়ে নেই শিশু ও নারীরাও। তাঁরা তাঁদের মনের ভেতর লুকিয়ে থাকা নানান কথা প্রকাশ করেন ফেসবুক, টুইটার, ইউটিউব, বিভিন্ন ব্লগ ও অনলাইন পত্রিকায়। কখনো তাঁরা জাতীয় ও আন্তর্জাতিক ইস্যু নিয়েও নানা রকম আলোচনার পাশাপাশি সমালোচনাও করে থাকেন। আর সমালোচনার মাধ্যমেই যে কোন বিষয় খুব সুন্দরভাবে ফুটে উঠে। কিন্তু কেউ যদি কারণে অকারণে ঐ সব মতামত, লিখা বা চিত্র তাঁর অনুভূতিতে আঘাত করেছে বা তাঁর মানসম্মান নষ্ট করেছে বলে আইনি পদক্ষেপ নেই তাহলে সংশ্লিষ্ট প্রকাশকারীর কিংবা প্রচারকারীর অপরাধ বিচারে প্রমাণিত হোক বা না হোক তাঁকে বিচারের পূর্ব পর্যন্ত মাসের পর মাস, বছরের পর বছর হাজতে বন্দী হয়ে থাকতে হবে। যদিও এর জন্য তাঁর অপরাধ লঘু প্রকৃতির হয়ে থাকে তাও তাঁকে গুরুদণ্ড ভোগ করতে হবে যা অমানবিক ও ন্যাচরাল জাস্টিস সমর্থন করে না।

উদাহরণস্বরূপ বলা যায় চুরি, ডাকাতি, ছিনতাই, ধর্ষণ, নারী নির্যাতন, প্রতারণা ইত্যাদি গুরুতর অপরাধ হিসেবে সমাজে স্বীকৃত। কিন্তু তুলনামূলকভাবে এই সব অপরাধের জন্য না যতটুকু অপরাধীর সাজার বিধান আছে তথ্য ও যোগাযোগ প্রযুক্তি আইনে বর্তমানে তার চেয়ে বেশি শাস্তির বিধান করা হয়েছে যা কখনো গ্রহণযোগ্য হতে পারে না। আর চুরি, ডাকাতি, ছিনতাই, নারী নির্যাতন, প্রতারণা ইত্যাদি সমাজের সবাই করে না কিন্তু সকলে তাঁদের মত প্রকাশ করতে চায় নিজের মত করে নিজের ধ্যান ধারণা অনুযায়ী। হোক না তা ভাল অথবা মন্দ।

যে কোন আইন প্রণয়ন করা হয়ে থাকে সমাজ ও রাষ্ট্রের কল্যাণে। জনসাধারণকে সংশ্লিষ্ট অপরাধের আক্রমণের হাত থেকে মুক্তি দিতে। কিন্তু প্রণীত আইনে যদি জনগনের মঙ্গলের চেয়ে অমঙ্গলই বেশি হয় কিংবা শুধু মাত্র ঐ আইন রাষ্ট্রের অনুকূলে আর জনগণের প্রতিকূলে প্রণীত হয়ে থাকে তবে তাকে কাল আইনই বলা যায়।

তথ্য ও যোগাযোগ প্রযুক্তি আইন ২০০৬(সংশোধিত ২০১৩) আইনটিকে এমনই একটি কাল আইন বলে মনে করা হচ্ছে যেখানে নাগরিকরা ইন্টারনেটে কোন বিষয়ে স্বাধীনভাবে তাঁদের মত প্রকাশের ক্ষেত্রে চরম বাধাগ্রস্থ হবে। কোন বিষয়ে কোনটি সঠিক আর কোনটি সঠিক নয় সে বিষয়ে কারো মত প্রকাশকে চ্যালেঞ্জ করা হলে তাঁকে আজ আইনের কাঠগড়ায় দাঁড়াতে হবে যা সাংবাদিকসহ তথ্য অধিকার কর্মীদের জন্যও হুমকিস্বরূপ।

২০০৬ সালে প্রণীত হওয়া এই আইনটির ব্যাপারে পূর্ব থেকেই অনেকের আপত্তি ছিল যে, এই আইনে লঘু অপরাধের জন্য গুরু দণ্ডের বিধান করা হয়েছে। কিন্তু ২০১৩ সালের সংশোধনীতে এই আইনে সংঘটিত অপরাধের জন্য আরও বেশি দণ্ডের বিধান করে সংসদে আইনটি পাস করা হয়। এটা ঠিক যে বর্তমানে তথ্যপ্রযুক্তি ব্যবহারের মাধ্যমে পূর্বের চেয়ে অপরাধ করার প্রবণতা অনেক বেড়েছে। অসৎ উদ্দেশ্যে এই মাধ্যমকে ব্যবহার করা হচ্ছে ও উসকানি দেওয়া হচ্ছে। আঘাত দেওয়া হচ্ছে ধর্মীয় অনুভূতিতেও। যার কারণে এসব রোধেই এই আইনে সংশোধনী দরকার বলে সরকার উল্লেখ করেছে। কিন্তু আমাদের দেশের প্রখ্যাত ব্যক্তি ও আইনজীবীরা মনে করেন এই কঠোর আইনের ফলে মানুষের মত প্রকাশের স্বাধীনতা খর্ব হবে। এ আইনের মাধ্যমে সংবিধান প্রদত্ত বাক স্বাধীনতার অধিকার হরণ করা হবে। শুধুমাত্র লিখালিখির মাধ্যমে মত প্রকাশের জন্য হয়রানির শিকার হতে হবে অনেককে।

২০০৬ সালে এই আইন মূলত যে সব কারণে প্রণয়ন করা হয়েছিল তা হল কম্পিউটার বা কম্পিউটার সিস্টেম ইত্যাদির অনিষ্ট সাধন(৫৪ ধারা), কম্পিউটার সিস্টেমের হ্যাকিং সংক্রান্ত অপরাধ(৫৬ ধারা), ইলেক্ট্রনিক ফরমে মিথ্যা, অশ্লীল অথবা মানহানিকর তথ্য প্রকাশ সংক্রান্ত অপরাধ(৫৭ ধারা) ও সংরক্ষিত সিস্টেমে প্রবেশ সংক্রান্ত অপরাধ(৬১ ধারা) ইত্যাদি। উল্লেখিত অপরাধগুলোকে গুরুতর অপরাধ হিসেবে বিবেচনা করে গুরুদণ্ডের ব্যবস্থা করা হয়েছে। পূর্বে এই অপরাধগুলোর দণ্ড ছিল অনধিক দশ বছর। আর সংশোধিত আইনে এই দন্ড পরিবর্তন করে অনধিক চৌদ্দ বছর কারাদন্ড করা হয়েছে।

এই আইনে উল্লিখিত অপরাধগুলো আমলযোগ্য(কগনিজেবল) করা হয়েছে যার ফলে অপরাধ সংঘটনের খবর পেলে পুলিশ ওয়ারেন্ট ছাড়াই যে কাউকে গ্রেফতার করতে পারবে। অর্থাৎ এই আইন লঙ্ঘনকারীর বিরুদ্ধে পুলিশ সন্দেহের বশবর্তী হয়েও সরাসরি ব্যবস্থা নিতে পারবে। এক্ষেত্রে আদালত হতে কোন প্রকার ওয়ারেন্ট বা অনুমতি লাগবে না পুলিশের। অজামিনযোগ্যও করার ফলে এই অপরাধের দায়ে আটককৃত ব্যক্তি কোন জামিন পাবেন না। তবে আইনটিতে তদন্তের কোন সংজ্ঞা দেওয়া হয়নি এবং যে ট্রাইব্যুনালে বিচার হবে সে ট্রাইব্যুনাল সম্পর্কে কোন সুস্পষ্ট ধারণা দেয়া হয়নি। জানা যায় সংশোধিত আইনটি কোন মহলের মতামত ছাড়ায় বেশ তাড়াহুড়া করে পাস করা হয়েছে।

এই আইনে পুলিশকে অসীম ক্ষমতা দেওয়ার কারণে তাদের জবাবদিহিতার বিষয়টি কী হবে সে বিষয়েও কোন দিকনির্দেশনা নেই। এর ফলে সাধারণ নাগরিকের হয়রানি বৃদ্ধি পাবে। এই ধারায় অপরাধ জামিন অযোগ্য হওয়ার কারণে আইনের অপব্যবহার হতে পারে। তাই জামিন অযোগ্য না করে তা আদালতের সন্তুষ্টির উপর ছেড়ে দেওয়া উচিত ছিল। কারণ পুলিশ খেয়াল খুশি মত মামলার ভয় দেখিয়ে দুর্নীতির আশ্রয় নিতে পারে। ওয়ারেন্ট ছাড়া যে কাউকে গ্রেফতার করে আদালতে চালান করে দিতে পারবে। নিরপরাধী ব্যক্তি তাঁর জীবন থেকে হারিয়ে ফেলবে গুরুত্বপূর্ণ সময়গুলো। আবার এই আইনের আলোকে সংঘটিত অপরাধ যদি কোন খবরের কাগজে প্রকাশ করা হয় তবে প্রচলিত আইনে সাজা হতে পারে তিন বছর।

এই আইনের ৫৪, ৫৬, ৫৭ ও ৬১ ধারার যেকোনো একটি ধারায় আপরাধ করলে সর্বনিম্ন সাজা হবে সাত বছর এবং সর্বোচ্চ সাজা হবে ১৪ বছর। তার মধ্যে ৫৭ ধারা হল সব চেয়ে ভয়ংকর। স্বাধীন মত প্রকাশের ক্ষেত্রে বাঁধা হয়ে দাঁড়িয়েছে এই ধারা। এমনকি মানুষ তাঁর মত প্রকাশ করতে গেলে ভীত হবে এই ধারার কারণে। লিখা, চিত্র বা মতামত প্রকাশ করার পূর্বে তাঁকে বারবার ভাবতে হবে, সে কি প্রকাশ করবে আর কি প্রকাশ করবে না। জনগণ তাদের সংবিধানে প্রদত্ত মৌলিক অধিকার- মত ও ভাব প্রকাশের অধিকারও দ্বিধাহীনভাবে প্রয়োগ করতে পারবে না।

যা হোক ৫৭ ধারায় উল্লেখ করা হয়েছে, কোন ব্যক্তি যদি ইচ্ছাকৃতভাবে ওয়েব সাইটে বা অন্য কোন ইলেক্ট্রনিক বিন্যাসে এমন কিছু প্রকাশ বা সম্প্রচার করেন, যা মিথ্যা ও অশ্লীল বা সংশ্লিষ্ট অবস্থা বিবেচনায় কেউ পড়লে, দেখলে বা শুনলে নীতিভ্রষ্ট বা অসৎ হতে উদ্বুদ্ধ হতে পারেন অথবা যার দ্বারা মানহানি ঘটে, আইন শৃঙ্খলার অবনতি ঘটে বা ঘটার সম্ভাবনা সৃষ্টি হয়, রাষ্ট্র ও ব্যক্তির ভাবমূর্তি ক্ষুণ্ন হয় বা ধর্মীয় অনুভূতিতে আঘাত করে বা করতে পারে বা এ ধরনের তথ্যাদির মাধ্যমে কোন ব্যক্তি বা সংগঠনের বিরুদ্ধে উস্কানী প্রদান করা হয়, তা হলে তার এই কাজ হবে একটি অপরাধ। কোন ব্যক্তি এমন অপরাধ করলে তিনি কম পক্ষে সাত বছর ও অনধিক চৌদ্দ বছর কারাদণ্ডে এবং অনধিক এক কোটি টাকা অর্থদণ্ডে দণ্ডিত হবেন।

এখানে উপরোক্ত ধারায় স্পষ্ট করে বলা হয়নি কি কি কারণে, কোন কোন সময়, কার বা কাদের বিরুদ্ধে, কোন ধরণের কর্মকাণ্ড তথ্য ও যোগাযোগ প্রযুক্তি আইনে অপরাধ বলে গণ্য হবে। যার কারণে আইনটিতে অস্পষ্টতা রয়ে গেছে। এখানে দণ্ডবিধির মত সংঘটিত অপরাধের কোন উধাহরণও দেওয়া হয়নি। কেউ কিভাবে কি দেখলে বা শুনলে নীতিভ্রষ্ট বা অসৎ হতে উদ্বুদ্ধ হবে তার কোন উল্লেখ নেই। যেহেতু প্রকাশের দ্বারা কার মানহানি হয়েছে, কার অনুভূতিতে আঘাত লেগেছে কিংবা অন্য কোন ক্ষতি কিভাবে কতটুকু হয়েছে তা পূর্ব থেকে বুঝা সম্ভব নয় তাই প্রকাশকারী নিজের অজান্তেই এমন কোন লিখা বা চিত্র সরল বিশ্বাসে ইন্টারনেটে প্রকাশ করতে পারে যার কারণে সে এই আইনে ফেঁসে যেতে পারে। কেউ ব্যক্তিগত বিদ্বেষ থেকে ইন্টারনেটে কারো সাধারণ প্রকাশনাকে তাঁর জন্য মানহানিকর বা ক্ষতিকর বলে মামলা করতে পারে। আর প্রমাণ হলে সংশ্লিষ্ট ব্যক্তিকে কম পক্ষে সাত বছর জেলে থাকতে হবে।

সবশেষে বলা প্রয়োজন, সরকারের নীতিনির্ধারণী বিষয়ে নাগরিকদের সমালোচনা করার অধিকার রয়েছে। তাই রাষ্ট্রের নাগরিকদের মত প্রকাশের ক্ষমতা কোন কিছুতেই সীমাবদ্ধ থাকা উচিত নয়। হোক না সেটা রাজনৈতিক, সামাজিক, ধর্মীয়, অর্থনৈতিক কিংবা সাংস্কৃতিক বিষয়ে। সরকার অনলাইনে ক্ষতিকর মত প্রকাশে নিয়ন্ত্রণ আরোপ করতেই পারে কিন্তু তার জন্য এতটা কঠোর আইন প্রণয়ন করার কারণে সমাজে এর বিরূপ প্রভাব পড়বে। তাই সকল দিক বিবেচনা করে এবং সংবিধান প্রদত্ত নাগরিকের মত প্রকাশের অধিকারের উপর গুরুত্ব আরোপ করে সরকার এই আইনটি যথাযথভাবে সংশোধন করবে এমনটি সকলে প্রত্যাশা করেন।

লেখকঃ মোঃ জাহিদ হোসেন, প্রতিষ্ঠাতা পরিচালক, রিসার্চ অর্গানাইজেশন ফর লিগাল এওয়ারনেস বাংলাদেশ (রোলা বাংলাদেশ)