করোনা
আমি করোনা; আসল নাম নভেল করোনাভাইরাস। আমি অণুজীব, সাধারণ অণুবীক্ষণ যন্ত্রেও আমাকে দেখা যায় না। ২০১৯ সালের ডিসেম্বরে চীনের উহান নগরে আমার জন্ম। এরপর ক্রমান্বয়ে আমি দেশ থেকে দেশান্তরে ছড়িয়ে পড়ি। এখন গোটা দুনিয়া আমার কবজায়।
কিন্তু জন্মের পর মনে হচ্ছে, জন্মই আমার আজন্ম পাপ। সারা বিশ্বের মানুষের কাছে আমি আতঙ্কের প্রতিশব্দ। আমার নাম শুনলে মানুষের অন্তরাত্মা কেঁপে ওঠে।
কারণ, আমার জন্মের মধ্যেই ধ্বংসের বীজ নিহিত। আকারে অতি ক্ষুদ্র হলেও আমাকে স্রষ্টা অপার শক্তির অধিকারী করে পাঠিয়েছেন। আমার মতো অদৃশ্য শক্তির মাজেজা খুঁজতে সারা পৃথিবীর বিজ্ঞানীরা হিমশিম খাচ্ছেন। কোনো কূল-কিনারা পাচ্ছেন না। আমি বহুরূপী, রহস্যময়ী, প্রয়োজন অনুযায়ী রূপ ও শক্তির হ্রাস/বৃদ্ধিতে আমার সমকক্ষ এখনও পয়দা হয়নি। আর অতি ক্ষুদ্রাকৃতি হওয়ার সুবিধা হল, আমি মানুষের নাক-মুখের ফাঁক-ফোকর দিয়ে ঢুকে পড়ি যা কেউ টের পায় না।
একবার ঢুকতে পারলেই হল, এরপরই শুরু হয় আমার মরণখেলা। আমার থাকার জায়গার অভাব নেই। তবে মনুষ্য দেহই আমার নিরাপদ আশ্রয়স্থল। পৃথিবীর অগণিত মানুষকে আমি এরই মধ্যে কুপোকাত করেছি। আমাকে ঠেকানোর জন্য মানুষ মুখোশ পরছে। আমাকে আটকানোর আরও কত ব্যবস্থা! আমার ভয়ে লকডাউন করে মানুষকে ঘরবন্দি করে রাখা হয়েছিল।
বাজার, ঘাট, অফিস-আদালত, শিল্প-বাণিজ্য, গাড়ি, উড়োজাহাজ সব বন্ধ ছিল। এ তো গেল আমাকে ঠেকিয়ে রাখার আয়োজন-উদ্যোগ। এখন আমাকে চিরতরে নির্মূল করার জন্যে পৃথিবীর তাবৎ পণ্ডিত, জ্ঞানী-গুণী ব্যক্তির চোখের ঘুম হারাম হয়ে গেছে। বিলাত, আমেরিকা, রাশিয়া, চীন, ভারত ইত্যাদি দেশের বিজ্ঞানীরা আমাকে নির্মূল করতে উঠেপড়ে লেগেছে টিকা বানাতে। কিন্তু স্রষ্টা আমাকে কম বুদ্ধি দেননি। যখন দেখি আমাকে মারার চিন্তা করে কেউ টিকা বানিয়ে টেস্ট করছে, অমনি আমি চেহারা পাল্টে ফেলি। কূলে এসে পণ্ডিতদের তরী ডুবে যায়। তাদের মাথায় হাত দেখে আমি মনে মনে হাসি।
কিন্তু একটা বিষয় আমি বুঝি না, আপনারা এত বুদ্ধিমান প্রাণী হয়েও কেন আমার মুণ্ডুপাত করছেন? আপনাদের তো জ্ঞানের সীমা নেই। একটু ঠাণ্ডা মাথায় চিন্তা করে দেখেন এত বিবেক-বুদ্ধি নিয়ে আপনারা স্বজাতির মধ্যে মারামারি-কাটাকাটি, যুদ্ধ-বিগ্রহ করে, খাদ্যে বিষ মিশিয়ে, ঈশ্বরের সৃষ্টি আকাশ-বাতাসকে দূষিত করে, পাহাড়-জঙ্গল, নদী-নালাকে তছনছ করে নিত্যদিন অসংখ্য মানুষের জীবন ধ্বংস করে যাচ্ছেন। বিকলাঙ্গ করছেন। অপুষ্টিতে মেরে ফেলছেন কত শিশুকে।
হিসাব করে দেখেন, দুনিয়া সৃষ্টির শুরু থেকে আজ পর্যন্ত আমি এবং আমার জ্ঞাতিগোষ্ঠীরা কত মানুষ মেরেছে। আর আপনারা নিজেদের দখলদারি বজায় রাখতে কোটি কোটি মানুষের প্রাণ নিয়েছেন। এখনও স্বজাতিকে মারতে দিন-রাত কূটচালে মত্ত হয়ে আছেন। মারণাস্ত্রের গুদাম উপচে পড়ছে, অস্ত্রের খেলায় সারা দুনিয়াকে অস্থির করে তুলছেন।
সৃষ্টির সেরা জীব আপনারা, বিবেক-বুদ্ধি, জ্ঞান ইত্যাদিতে আপনাদের তুলনা নেই। প্রাণীকূলসহ এই সুন্দর পৃথিবীকে লালন পালন ও হেফাজত করা মানুষ জাতির স্রষ্টা প্রদত্ত মহান দায়িত্ব। স্বজাতির মধ্যে রেষারেষি ভুলে একে অন্যের সেবায় জীবন উৎসর্গ করুন। প্রাণীকূলকে রক্ষা করুন, প্রকৃতিকে বাঁচান, সৃষ্টির সবকিছুকে আপন নিয়মে বাঁচিয়ে রাখুন।
ঈশ্বর দয়ার সাগর, দেখবেন পৃথিবী স্বর্গরাজ্যে পরিণত হবে। সত্য, সুন্দর ও ন্যায়ের পথে চলবে ধরিত্রী। আমি প্রতিজ্ঞা করছি, আমরাও আর কোনোদিন আপনাদের বিরক্ত করব না। আমরা বাতাসের সঙ্গে মিশে খুশবু ছড়াব, অক্সিজেন দিয়ে ভরিয়ে দেব আপনাদের প্রাণ-মন।
Source:https://www.jugantor.com/todays-paper