ছড়া আমার খুব প্রিয় । অংকের কাঠিন্য যখন পীড়া দেয় তখন ছড়াতে ক্লান্তি দূর করি । কিছু প্রিয় ছড়া তুলে দিলাম । আশা করি আনন্দ পাবেন ।
আবু সালেহ (জুলাই ২২, ১৯৪৮) বাংলা সাহিত্যে প্রতিষ্ঠিত ছড়াকার। ষাট দশক থেকে তার ছড়া বাংলাদেশের নানা আন্দোলন সংগ্রামে অবদান রাখে। তার প্রকাশিত গ্রন্থ সংখ্যা প্রায় একশত।১৯৬২, ১৯৬৬, ৬৭, ৬৮, ৬৯,৭০ ও ৭১ এর অসহযোগ আন্দোলনে সক্রিয়ভাবে অংশগ্রহণ করেন। ৬২, ৬৭, ৬৮, ৬৯,৭০ এর আন্দোলনে পুলিশের লাঠিচার্জ ও টিয়ার গ্যাসে আহত হন। মুক্তিযুদ্ধে সরাসরি অংশগ্রহণ করেন এবং এদেশীয় পাকিস্তানের চাটুকার বুদ্ধিজীবীদের বিরুদ্ধে অবস্থান গ্রহণ করেন। পাকিস্তানের পক্ষে অবস্থান নেয়াতে কবীর চৌধুরীসহ এইরকম আরও পাকিস্তানের মতলব হাসিল কারিদের বিরুদ্ধে এক ধরণের জনমত তৈরিতে তখন কাজ করেন।
তিনি ১৯৬৭ সাল থেকে সাংবাদিকতার সাথে যুক্ত আছেন। ইত্তেহাদ, দৈনিক দেশ, হক কথা, দৈনিক খবর, জনতা, বাংলাদেশ সংবাদ সংস্থাসহ আরো অনেক সংবাদপত্রে তিনি কাজ করেছেন। তিনি ঢাকা সাংবাদিক ইউনিয়নের সাধারণ সম্পাদক এবং সভাপতির দায়িত্ব পালন করেছেন। সাংবাদিকতার দায়িত্ব পালনকালে তিনি বহুবার পুলিশি এবং রাজনৈতিক হামলার শিকার হয়েছেন। ১৯৮৭ সালে এরশাদ বিরোধী আন্দোলনে বাংলা মোটরে স্বৈরাচারী এরশাদের পেটোয়া বাহিনী তার হাতের কব্জি এবং পাঁজরের হাড় ভেঙ্গে দেয়। বাংলা একাডেমী (২০০২) ও একুশে পদক (২০০৫) ছাড়াও ১৫ টির বেশী পুরষ্কারের অধিকারী ׀
আবু সালেহ-এর ছড়া
আমার পতাকা
আমার পতাকা নিরাপদ নয় কেন
আমার পতাকা ওদের শত্রু যেন
আমার পতাকা সীমান্তে খায় গুলি
আমার পতাকা দেখছে মাথার খুলি,
আমার পতাকা টেনে ছিঁড়ছে কারা
আমার পতাকা কেড়ে নিতে চায় তারা
আমার পতাকা সাগরসীমাতে নেই
আমার পতাকা বেরুবাড়ীকেও দেই!
আমার পতাকা কেন উড্ডীন নয়
আমার পতাকা ফেলানীর লাশ হয়
আমার পতাকা ছিটমহলে কাঁদে
আমার পতাকা কেন রয় না কাঁধে
আমার পতাকা তালপট্টিতে লুট
আমার পতাকা পিষছে ওদের বুট
আমার পতাকা নেই পদ্মার বুকে
আমার পতাকা হেলছে টিপাইমুখে !
আমার পতাকা প্রফুল্ল কেন নয়
আমার পতাকা ভয় ও ভীতিতে রয়
আমার পতাকা সংসদে থাবা খায়
আমার পতাকা লাঞ্ছনা শুধু পায়।
আমার পতাকা শান্তি পায় না ওরে
আমার পতাকা ব্যথার আগুনে পোড়ে
আমার পতাকা জাতির কাছে বোবা
আমার পতাকা হারিয়েছে তার শোভা।
আমার পতাকা কেন হয় ছারখার
আমার পতাকা কবিতা লেখে না আর
আমার পতাকা বিনা বিচারে মরে
আমার পতাকা শত্রুপক্ষের ঘরে
আমার পতাকা কোমরে দেখছে দড়ি
আমার পতাকা দেখছে স্বৈর ছড়ি
আমার পতাকা অশ্রু মাহমুদের
আমার পতাকা দেখছে কোথায় জের!
আমার পতাকা প্রতিবাদী কেন নয়
আমার পতাকা ‘মুখ্যমন্ত্রী’ হয়
আমার পতাকা বন্দরে কালিমাখা
আমার পতাকা ওদের চাদরে ঢাকা
আমার পতাকা দস্যুর ট্রানজিট
আমার পতাকা দেয়ালে ঠেকায় পিঠ
আমার পতাকা আমারই হওয়ার কথা
আমার পতাকা পেলো না স্বাধীনতা!
আমার পতাকা একুশে ফেব্রুয়ারি
আমার পতাকা চুয়ান্নর জয়ভারি
আমার পতাকা ভাসানীর সেই সালাম
আমার পতাকা বাষট্টির সংগ্রাম
আমার পতাকা আসাদের লাল জামা
আমার পতাকা এক দফা দাবিনামা
আমার পতাকা ঊনসত্তর ধরে রাখে
আমার পতাকা কেন রে দুর্বিপাকে!
আমার পতাকা সত্তরের জলোচ্ছ্বাস
আমার পতাকা লক্ষ লোকের লাশ
আমার পতাকা একাত্তরের ছবি
আমার পতাকা বিদ্রোহী সেই কবি
আমার পতাকা কালুর ঘাটের জিয়া
আমার পতাকা টেকনাফ তেঁতুলিয়া
আমার পতাকা দিল্লির দাস নয়
আমার পতাকা আমারই পরিচয়।
আমার পতাকা পলাশীর কথা বলে
আমার পতাকা তিতুমীর হয়ে জ্বলে
আমার পতাকা মুক্তিযুদ্ধের ঘর
আমার পতাকা ষোলোই ডিসেম্বর
আমার পতাকা বাংলাদেশীর প্রাণ
আমার পতাকা ধান কাউনের ঘ্রাণ
আমার পতাকা নকশিকাঁথার মাঠ
আমার পতাকা সোজন বেদের ঘাট।
আমার পতাকা মুটে ও মজুর চাষীর
আমার পতাকা ভাটিয়ালি বারোমাসির
আমার পতাকা লাল-সবুজের মুখ
আমার পতাকা চাঁদ জোছনার সুখ
আমার পতাকা জীবনের চেয়ে বড়
আমার পতাকা কেন হচ্ছে জড়
আমার পতাকা আমাকে শক্তি দেয়
আমার পতাকা কে সে কেড়ে নেয়?
সেই বাহাত্তর / আবু সালেহ
সেই বাহাত্তর সেই পচাত্তর সেই হত্যা গুম
সেই ভয়ঙ্কর দমন পীড়ন লুট লোপাটের ধুম
সেই দাউ দাউ অগ্নিকান্ড আজো দেখি চলে
সেই প্রশাসন বাকশালিদের পায়ে পিষে ঐ দলে
সেই কুটনীতি দিল্লি তোষন প্রতিরক্ষা কাড়ে
সেই ফ্যাসিবাদ চেপে বসেছে এই জনতার ঘাড়ে।
ছড়া/ আবু সালেহ
আবার কেনো রক্ত ঝরে আবার কেনো হত্যা
আবার কেনো বিঘ্নিত হয় জাতির নিরাপত্তা
আবার কেনো স্বৈরাচারের পাগলা ঘোড়া ছোঁটে
আবার কেনো জনগনের জীবন ওঠে ঠোঁটে
আবার কেনো আধিপত্যের শিকল পড়াও পায়
আবার কেনো স্বাধীনতার সূর্য ডুবে যায়!
কোথায় গেলো ভাটিয়ালি জারি সারি
কোথায় গেলো সেই পুরাতন কালিবাড়ি
কোথায় গেলো আলোভরা ভোরের ডাক
কোথায় গেলো কোথায় গেলো পাখির ঝাঁক
কোথায় গেলো মায়ের আদর স্নেহরাশি
কোথায় গেলো বাশ বাগানের চাঁদের হাসি
কোথায় গেলো সেই আমাদের পুতুল বউ
কোথায় গেলো কোথায় গেলো ফুলের মৌ
কোথায় গেলো কাজল চোখের স্বপ্ননীড়
কোথায় গেলো সেই সাহসী যোদ্ধাবীর
কোথায় গেলো অগ্রগামী ছেলের দল
কোথায় গেলো কোথায় গেলো আমায় বল
কোথায় গেলো রাতের জোনাক আলোর দূত
কোথায় গেলো শেওড়া গাছের পেত্নীভূত
কোথায় গেলো টেংরা,পুটিঁ, শোল , বোয়াল
কোথায় গেলো কোথায় গেলো হাল জোয়াল
কোথায় গেলো টুন্টুনিদের ঝোঁপের বাঁশ
কোথায় গেলো শিশির ভেঁজা দুর্বাঘাস
কোথায় এলো সেই দিগন্তের বিন্দু রেখা
কোথায় গেলো কোথায় গেলো যায় কি দেখা
আবু সালেহর সবচে বিখ্যাত ছড়াটি
ধরা যাবে না ছোঁয়া যাবে না বলা যাবে না কথা
রক্ত দিয়ে পেলাম শালার এমন স্বাধীনতা!
যার পিছনে জানটা দিলাম যার পিছনে রক্ত
সেই রক্তের বদল দেখো বাঁচাই কেমন শক্ত,
ধরা যাবে না ছোঁয়া যাবে না বলা যাবে না কথা
রক্ত দিয়ে পেলাম শালার মরার স্বাধীনতা!
বাঁচতে চেয়ে খুন হয়েছি বুলেট শুধু খেলাম
উঠতে এবং বসতে ঠুঁকি দাদার পায়ে সেলাম,
ধরা যাবে না ছোঁয়া যাবে না বলা যাবে না কথা
রক্ত দিয়ে পেলাম শালার আজব স্বাধীনতা!