পৃথিবীতে মোট মৃত্যুর শতকরা ২৯ ভাগ হয়ে থাকে হূদরোগ জনিত কারণে, এজন্য একে বিশ্বের এক নম্বর ঘাতক ব্যাধি বলা হয়ে থাকে। বিশ্বে প্রতি বছর ১ কোটি ৭১ লাখ লোক এই রোগে মারা যায়। যার মধ্যে শতকরা ৮২ ভাগ মৃত্যু হয় নিম্ন ও মধ্য আয়ের দেশগুলোর জনগণের। এই মৃতূ খুবই হতাশাজনক। কারণ হূদরোগ এবং স্ট্রোকসহ বিভিন্ন ক্রনিক রোগে যারা মারা যায় তাদের অর্ধেকেরই বয়স হয় জীবনের সবচেয়ে সুন্দরতম সময় এবং কর্ম জীবন ১৫-৬৯ বছরের মধ্যে। কিছু নিয়ম যেমন- স্বাস্থ্যকর খাবার খাওয়া, শারীরিক পরিশ্রম করা এবং তামাকমুক্ত জীবন-যাপনের মাধ্যমে এই অকাল মৃত্যু অনেকাংশে এড়ানো সম্ভবপর হয়।সুস্থ হার্ট গঠনের জন্য ব্যক্তিগতভাবে এবং পারিবারিকভাবে সচেতন হওয়া প্রয়োজন। পরিবারের মধ্যে মেনে চলার জন্য চারটি বিষয়কে চিহ্নিত করা হয়েছে, যা পরিবারের সদস্যদের সুস্থ হার্ট গঠনে সহায়ক হিসাবে কাজ করবে।
১. বাড়িতে সিগারেট, বিড়ি, জর্দ্দা, সাদা পাতা সহ সকল প্রকার তামাকের ব্যবহার সম্পূর্ণ নিষিদ্ধ করুন
তামাক এবং তামাকজাত দ্রব্যের ব্যবহার বিশ্বে হূদরোগ, ক্যান্সার, বক্ষব্যাধি এবং অন্যান্য অনেক প্রতিরোধযোগ্য রোগের এবং মৃত্যুর কারণ। গবেষণায় দেখা গেছে, তামাক সেবনের ফলে প্রতি বছর বিশ্বে ৪ মিলিয়ন লোক মৃতুবরণ করছে। প্রতি ১০ সেকেন্ডে তামাকজনিত রোগে ভুগে কেউ না কেউ মারা যাচ্ছেন। তামাক সেবনের ফলে আমাদের শরীরের প্রায় প্রতিটি অঙ্গই ক্ষতিগ্রস্ত হয়। যেমন- করোনারী হূদরোগ, স্ট্রোক এবং হার্ট ফেইলিয়র এর ঝুঁকি বেড়ে যায়। তামাক ব্যবহারে ফুসফুস, ঠোঁট, মুখ গহ্বর, খাদ্যনালী, শ্বাসনালী, মূত্রথলি, কিডনি, জরায়ু, বৃহদন্ত্র ও ক্ষুদ্রান্ত্র এবং স্তন এর ক্যান্সার হওয়ার ঝুঁকি বহুগুণে বেড়ে যায়।
বাড়িতে তামাকমুক্ত পরিবেশ বজায় থাকলে তা আপনার এবং আপনার সন্তানের হার্টকে সুস্থ রাখতে সহায়তা করবে। কারণ এটা প্রমাণিত যে, ধূমপান করোনারী হূদরোগের অন্যতম রিস্ক ফ্যাক্টর। সুতরাং কঠোরভাবে ধূমপানসহ সকল ধরণের তামাক গ্রহণ থেকে পরিবারের সবাইকে মুক্ত রাখার চেষ্টা করুন। পরিবারের কোন সদস্য যদি ধূমপান এবঙ তামাজাতীয় দ্রব্যে আসক্ত থাকে, তাহলে তাকে ধূমপান ছেড়ে দেওয়ার ব্যাপারে সর্বাত্মক সহযোগিতা করতে হবে। কারণ ধূমপান ছেড়ে দেওয়ার পর হূদরোগের ঝুঁকি এক বছরে অর্ধেকে নেমে আসে এবং ১৫ বছর পর এই ঝুঁকির মাত্রা একেবারে যে কখনও ধূমপান করেনি তার কাছাকাছি যায়।
২. পরিবারের সকলের প্রতিদিন শাক সবজি ও ফলমূলসহ স্বাস্থ্যসম্মত খাদ্যাভ্যাস গড়ে তুলুন।
++ বাড়িতে স্বাস্থ্যকর খাবার তৈরী করুন এবং এই সব খাবার খেতে সকলকে উত্সাহিত করুন। স্কুল বা অফিসে বাসার তৈরি খাবার দিয়ে দিন। সবাই ফল এবং সবজি খাওয়ার অভ্যাস করুন।
++ প্রতিদিনের শুরুতে একটি করে ফল খাওয়ার অভ্যাস করুন। দৈনিক প্রত্যেকের কমপক্ষে ২ থেকে ৩ পরিবেশন শাক সবজি খাওয়া নিশ্চিত করুন।
++ লবণ ও চিনি কম খান
++ তৈলাক্ত ও চর্বিযুক্ত খাবার এড়িয়ে চলুন।
৩. পরিবারের সবাইকে খেলাধূলাসহ অন্যান্য শারীরিক পরিশ্রম করতে উদ্ধুদ্ধ করুন।
নিয়মিত ব্যায়াম এবং শারীরিক পরিশ্রম সুস্বাস্থ্যের জন্য অপরিহার্য। শারীরিকভাবে সক্রিয় হলে স্বাস্থ্যের সার্বিক উন্নতি ঘটবে। ব্যঅয়াম হূদরোগের রিস্ক ফ্যাক্টরগুলো নিয়ন্ত্রণের ক্ষেত্রে বিশেষ ভূমিকা রাখে। হূদরোগ, স্ট্রোক এবং অস্টিওপোরোসিস প্রতিরোধে ব্যায়াম কার্যকর ভূমিকা রাখে। অধিক কর্মক্ষম হতে মানসিক চাপ কমাতে, হাড় ও মাংসপেশী সুদৃঢ় করতে এবং গতিময়তা ও শক্তির সামঞ্জস্য রক্ষার ক্ষেত্রে উন্নতি ঘটাতে ব্যায়াম সাহায্য করে। ছোট বড় সকলের নিয়মিত ব্যায়াম এবং প্রতিদিন হাঁটার অভ্যাস করতে হবে।
++ নিজের কাজ নিজে করার চেষ্টা করুন।
++ পরিবারের সদস্যদের টেলিভিশন দেখার সময়কাল সীমিত করে ফেলা উচিত। প্রতিদিন দুই ঘণ্টার বেশি সময় টেলিভিশন দেখা উচিত নয়।
++ পরিবারের সদস্যদের নিয়ে ঘরের বাইরে বিভিন্ন কার্যক্রম গ্রহণ করুন। যেমন- সাইক্লিং, হাঁটা, দড়ি খেলা কিংবা বাগনে বা ছাদে বিভিন্ন ধরণের খেলাধূলা করুন।
++ সম্ভব হলে গাড়ির পরিবর্তে হেঁটে কিংবা সাইকেলে করে আপনার বাড়ি থেকে গন্তব্যে পৌছান।
++ বাড়িতে লিফট থাকলে সেটা পরিহার করে সিঁড়ি ব্যবহার করুন।
++ প্রাপ্তবয়স্কদের দিনে কমপক্ষে ৩০ মিনিট হাঁটা এবং বাচ্চাদের ৬০ মিনিট হাঁটা হূদরোগের ঝুঁকি কমাতে সাহায্য করে। সুতরাং পরিবারের ছোট-বড় সকলের নিয়মিত ব্যায়াম এবং প্রতিদিন হাঁটার অভ্যাস করতে হবে।
++ বাগানের কাজ যেমন- ঘাস কাটা, ঝরা পাতা কুড়ানো, আবর্জনা পরিষ্কার করা, মাটি খনন করা, গাছের ডাল-পাতা ছাঁটাই করার মাধ্যমে কায়িক পরিশ্রম করা সম্ভব।
৪. হূদরোগের ঝুঁকির মাত্রা জেনে প্রয়োজনীয় ব্যবস্থা গ্রহণ করুন
++ একজন স্বাস্থ্যকর্মী বা ডাক্তারের নিকট থেকে আপনার রক্তচাপ, কোলেস্টেরল এবং গ্লুকোজের মাত্রা, কোমর ও নিতন্বের আনুপাতিক পরিমাপ এবং বডি মাস ইনডেক্স (বিএমআই) জানুন। সবগুলো ঝুঁকির মাত্রা জেনে সে অনুযায়ী প্রয়োজনীয় ব্যবস্থা গ্রহণ করুন। স্বাভাবিক বডি মাস ইনডেক্স হওয়টা খুব জরুরী। কারণ অধিক ওজন হলে শরীরে রক্ত সরবরাহ করতে হূদপিন্ডের অধিক কাজ করতে হয়। যার ফলে হূদরোগ ও স্ট্রোকের ঝুঁকি বাড়ে। অতিরিক্ত ওজনের বাচ্চাদের বয়স বাড়ার সাথে সাথে নানা ধরণের অসুবিধা হয়। যেমন- ৬৫ বছর বয়সে পৌছানোর পূর্বে তাদের ৩-৫ বার হার্ট অ্যাটাক এবং স্ট্রোক হতে পারে। সুতরাং ওজন নিয়ন্ত্রণ করে স্বাভাবিক ওজন রাখার চেষ্টা প্রতিটি মানুষের জন্য খুবই দরকার।
++ একবার আপনি আপনার হূদরোগের ঝুঁকির মাত্রা জানলে সে অনুযায়ী হার্টকে সুস্থ রাখার এবং হার্টের অবস্থার উন্নতির জন্য প্রয়োজনীয় পদক্ষেপ গ্রহণ করতে পারবেন। বাড়িতে এই পরিকল্পনা এমনভাবে লিপিবদ্ধ করে রাখুন যেন তা মেনে চলার জন্য বারে বারে মনে পড়ে। পরিবেশে বলা যায়, হূদরোগ প্রতিরোধকল্পে সকলকে এগিয়ে আসতে হবে। স্বাস্থ্যসম্মত জীবন যাপনের জন্য সকলকে সচেষ্ট হতে হবে। পরিবারের প্রতিটি সদস্যকে উপরোক্ত অভ্যাসগুলো মেনে চলার চেষ্টা করতে হবে। তাহলেই আগামী প্রজন্মকে আমরা সুস্থ এবং সুন্দর জীবন উপহার দিতে পারবো।
লেখক:
জাতীয় অধ্যাপক ব্রিগেডিয়ার (অব.) আব্দুল মালিক
প্রখ্যাত হূদরোগ বিশেষজ্ঞ ও
মহাসচিব, ন্যাশনাল হার্ট
ফাউন্ডেশন অব বাংলাদেশ
Source:
http://new.ittefaq.com.bd/news/view/148111/2012-11-01/24