প্রতিবছরই এসএসসি এবং এইচএসসির রেজাল্ট প্রকাশের পর দেখা যায় সারাদেশে বিপুল পরিমাণ ছাত্রছাত্রী এ প্লাস পাচ্ছে, পাশের হার দিনের পর দিন বেড়েই চলেছে। অথচ পাশাপাশি প্রতিবছর বিভিন্ন বিশ্ববিদ্যালয়ের ভর্তি পরীক্ষায় এসব এ প্লাসদের একটা বিশাল অংশ পাশই করছে না। ২০১২ সালের ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের ভর্তি পরীক্ষায় ৫৫ শতাংশ ছাত্র ছাত্রী পাশ করেনি।
এর পিছনে কারণ খুঁজে অভিপ্রায়ে কিছু কলেজ শিক্ষকের কাছে জানতে চাওয়া হয়েছিল কিভাবে এতো এতো ছাত্র এ + পায়? তাদের বক্তব্য ছিল জেলা বা থানা পর্যায়ে স্কুল কলেজগুলোতে চাপ দেয়া হয় ১০০ ভাগ পাশের জন্য, বলা হয় খাতায় কিছু লেখা থাকলেই পাশ করিয়ে দিতে। তাই মোটামুটি কিছু ভাল লেখা থাকলেই তার পক্ষে এ+ পাওয়া সহজ হয়ে যায় যেহেতু খুবই নিম্নমানের সবাই পাশ করে যাচ্ছে। পাশের হার কমে গেলে অনেক বেসরকারী স্কুল কলেজের এমপিও বাতিল হয়ে যাবার ভয় থাকে। শিক্ষকেরা নিজেদের বেতন ভাতা না পাবার ভয়েও অনেক নিম্নমানের ছাত্রদের পাশ করিয়ে দিচ্ছেন। এভাবে পর্যাপ্ত শিক্ষায় শিক্ষিত না হয়েও একজন ছাত্রের পক্ষে এ+ পাওয়া সহজ হয়ে যাচ্ছে, তখন স্বাভাবিকভাবেই তার মনে সর্বোচ্চ বিদ্যাপিঠগুলোতে পড়ার একটা বাসনা তৈরী হয়। কিন্তু সেসব বিশ্ববিদ্যালয়গুলো এখনো পর্যন্ত ভাল মানের প্রশ্ন করায় ভর্তি পরীক্ষায় বিপুল সংখ্যক ছাত্র ফেল করছে। পাশ করে অপেক্ষমান তালিকাতেও সে থাকতে পারছে না।
এদিকে ঢাকাসহ শহরাঞ্চলগুলো বিগত বছরগুলোতে আরেকটি বিষয় বেশ প্রকট আকার ধারণ করছে। অনেক নামী দামী স্কুলগুলোতেও আজকাল ক্লাসে শিক্ষকরা পড়ান না, হোম ওয়ার্ক দেখতে দেখতেই সময় পার করে দেন। এরপর ছাত্রছাত্রীদের বাধ্য করানো হয় শিক্ষকের বাড়িতে বা কোচিং সেন্টারে গিয়ে প্রাইভেট পড়তে। যারা প্রাইভেট পড়ে না, তাদের পক্ষে এই তীব্র প্রতিযোগিতার যুগে টিকে থাকা বা ভাল রেজাল্ট করা কঠিন হয়ে পড়ে, কারণ সে কেবলমাত্র নিয়মিত ক্লাস করে কিছুই শিখতে পারে না।
টারশিয়ারী শিক্ষার বাস্তবতা এবং চ্যালেঞ্জসমূহ নিয়ে আয়োজিত এক কনফারেন্সের উদ্বোধনী অনুষ্ঠানে মাননীয় শিক্ষামন্ত্রী বলেন বেতন ভাতা কম হবার কারণে প্রাইমারী এবং সেকেন্ডারী স্কুল লেভেলে মেধাবী ছাত্রছাত্রীরা শিক্ষকতা পেশায় যেতে চায় না। যার ফলে শিক্ষার মানও ভাল হয় না। এই কমমানের শিক্ষায় শিক্ষিত হয়ে পরবর্তীতে ছাত্ররা পাশ করে বেরিয়ে আসে, তাদেরই কিছু সংখ্যক শিক্ষকতায় নিয়োজিত হয়... এভাবে দিনে দিনে শিক্ষার মান আরো কমতে থাকে।
এই কনফারেন্সে বিভিন্ন বক্তৃতায় যে মূল কথাটি উঠে আসে সেটা হলো শিক্ষাকে মানুষের দ্বারগোড়ায় পৌঁছে দিতে হবে, দূরত্বের কারণে, ভৌগলিক সীমারেখার কারণে যেন কেউ শিক্ষা অর্জনে পিছিয়ে না পড়ে। এজন্যে ইদানীংকালে ডিসটেন্স লার্নিং বা ই-লার্নিং নামের প্রযুক্তিনির্ভর শিক্ষা ব্যবস্থা বেশ জনপ্রিয় হয়ে উঠছে। এছাড়াও ক্লাসে নানারকম শিক্ষাপ্রযুক্তি উপকরণ যেমন অফিস ডকুমেন্ট, মোবাইল ফোন, ল্যাপটপ, ইন্টারনেট, বিভিন্ন রকম অনলাইন সোশাল মিডিয়া যেমন ফেইসবুক, টুইটার ইতয়াদি ব্যবহার করে শ্রেণীকক্ষে পাঠদানকে আরো আকর্ষণীয় করে তোলার প্রতি গুরুত্ব আরোপ করা হচ্ছে।কোন পুরোনো স্থায়ী তত্ত্বও বিভিন্ন এনিমেশন দিয়ে উপস্থাপন করে সেটাকে আরো অর্থপূর্ণ এবং আকর্ষণীয় করে তোলা যায় ছাত্রদের কাছে। এর জন্য শিক্ষকদেরও প্রয়োজনীয় প্রস্ততি নেবার দরকার আছে।
শিক্ষাদান পদ্ধতিকে মোটাদাগে দুইভাগে ভাগ করা যায়ঃ শিক্ষক নির্ভর শিক্ষা, শিক্ষার্থী নির্ভর শিক্ষা। শিক্ষক নির্ভর শিক্ষাব্যবস্থায় শিক্ষকের উপরই মূল দায়িত্ব থাকে ছাত্রদের সবকিছু শেখানোর। এ ব্যবস্থায় শিক্ষক ক্লাসে লেকচার দেন, আর ছাত্ররা নোট টুকে নিতে থাকে। এরপর বাড়িতে গিয়ে আর পুনরায় মনোযোগ দিয়ে সেটা নাও পড়তে পারে বা একেবারে পরীক্ষার আগে পড়তে পারে। তাই পুরোনো এই শিক্ষাদান পদ্ধতি বদলে ফেলে যদি ছাত্রদেরকে ক্লাসে আরো বিভিন্নভাবে মনোযোগি করে তোলা যায়, সেটা আরো ভাল ফল দিতে পারে। আজকের ক্লাসে কি পড়ানো হবে সেটা যদি ছাত্রদের আগেই বাড়ি থেকে পড়ে আসতে বলা হয় এবং সে যাই-ই পড়ে বুঝলো সেটার একটা সারাংশ ক্লাসে লিখে নিয়ে আসতে বলা হয়, এরপর ক্লাসে ২-৩জনের গ্রুপ করে আলোচনা করতে দেয়া হয়, নানারকম টিউটোরিয়াল ক্লাস নেয়া হয় সে টপিকের উপর তাহলে ছাত্ররা ক্লাসে আরো বেশি মনোযোগি হবে আশা করা যায়।
ক্লাস নেবার সময়ে আরো দুটো বিষয়ের দিকে নজর দেয়া আবশ্যক, লেকচার কি কন্টেন্টনির্ভর হবে নাকি পদ্ধতিনির্ভর হবে নাকি উভয়েই হবে। একজন ভাল শিক্ষক দুটোর দিকেই নজর দিবেন। কিছু মুখস্থ করা চেয়ে সেগুলো ধারণাগুলো কিভাবে স্বচ্ছভাবে দেয়া যায় এবং কিভাবে টেক্সটবুকের পড়া বাস্তবে কাজে লাগানো যায়, ছোট ছোট প্রজেক্ট করানোর মধ্য দিয়ে যেখানে শিক্ষকেরা কেবল দিকনির্দেশনা দিবেন, ছাত্ররা বাকীটা নিজেরা করতে অভ্যস্ত হবে, এভাবেই শিক্ষাকে ছাত্রদের মাঝে আরো বেশি করে আকর্ষণীয় করে তোলা যেতে পারে।
কায়কোবাদ স্যার অবশ্য মতামত দিয়েছেন ছাত্রদের শেখানোর দরকার নেই, তাদেরকে চ্যালেঞ্জের মুখোমুখি দাঁড় করিয়ে দিলে তারাই উত্তরণের পথ খুঁজে নিবে। এ প্রসংগে তিনি বিভিন্ন আন্তর্জাতিক অলিম্পিয়াড, গণিত এবং প্রোগ্রামিং প্রতিযোগিতার উদাহরণ টেনেছেন যেখানে বাংলাদেশী কিছু ছেলেমেয়ে চমতকার সফলতা দেখাচ্ছে। কিন্তু এখানে আরেকটা ব্যাপার হলো সেসব প্রতিযোগিতায় ছেলেমেয়েরা অংশগ্রহণ করে শখ করে, নিজের প্রচন্ড আগ্রহ থেকে। কিন্তু স্কুল কলেজে পড়া হলো নিয়মতান্ত্রিক গতানুগতিক পড়াশোনা। তাই এখানে কেবল ছাত্রদের উপর সব শেখার দায়িত্ব ছেড়ে দেয়া যায় না। ছাত্রদের কেবল চ্যালেঞ্জের মুখে ছেড়ে দিলে তারাই একসময়ে প্রশ্ন করবে শিক্ষকেরা তবে আছেন কেন? অভিভাবকেরাই প্রশ্ন করবেন তবে মাসে মাসে এতো বেতন দিয়ে একজন ছাত্র নিয়মিত ক্লাসে যাবে কেন? ছাত্রদের মাথা খাটিয়ে নিজবুদ্ধিতে কিছু করতে দেয়া অবশ্যই পাঠদানের বা শিক্ষা কার্যক্রমের একটা অংশ। কিন্তু এর জন্য ছোটবেলা থেকে বই পড়া বা জ্ঞানের বিভিন্ন উতস থেকে কিভাবে জ্ঞান আহরণ করতে হয় সেটা একটি শিশুকে শেখানোর প্রয়োজন আছে। একজন কলেজ বা বিশ্ববিদ্যালয় পর্যায়ের ছাত্র ছাত্রীরা এ ব্যাপারে দরকারী পরিপক্কতা অর্জন করে কিন্তু স্কুল থেকেই। প্রাইমারী স্কুলের একজন বাচ্চার পক্ষে একা একাই চ্যালেঞ্জ মোকাবিলা করা সম্ভব নয়। তাকে ন্যুনতম শিক্ষাটুকু আগে পর্যাপ্তভাবে দিতে হবে, হাতে কলমে শেখাতে হবে চ্যালেঞ্জ কি, তা মোকাবিলা করার উপয়াগুলো কি কি?
কিছুদিন আগে প্রায় ২৬ হাজার প্রাইমারী বিদ্যালয় সরকারী করা হলো। সরকারী করা হলে শিক্ষকদের বেতন ভাতা নিয়ে চিন্তা অনেকটাই দূর হয়ে যায়। প্রায় কিছুদিন পরপরই বেসরকারী স্কুলের শিক্ষকেরা আন্দোলন করেন এমপিওভুক্ত হবার জন্য, এর জনইয় তারা দিনের পর দিন রাস্তায় পড়ে থেকে আন্দোলন করেন, পুলিশের মারও খান। কিন্তু এসময়টায় তাদের স্কুলগুলোর পাঠদান অবস্থার কি করুণ চিত্র হয় সেটা বলাই বাহুল্য। শেষ পর্যন্ত এর প্রভাব ছাত্রছাত্রীদের উপর গিয়ে পড়ে। স্কুল কলেজগুলোতে পর্যাপ্ত ক্লাস না হবার ফলে তারা কিছুই শিখতে পারে না, কিন্তু পরীক্ষার খাতায় ভাল ভাল নাম্বার দিয়ে, গ্রেড দিয়ে তাদের পাশ করিয়ে দেয়া হয়, ১০০ ভাগ পাশ করে…… এভাবে দিনে দিনে একটা ভিতরে ফাঁপা ভবিষ্যত প্রজন্ম তৈরী হচ্ছে, যার কুফল জাতি অচিরেই পাবে। যতই এ+ মেধাবীমুখ বের হোক না কেন, শেষ পর্যন্ত এদের মাঝে খুব কমজনই ভাল কিছু করতে পারবে। ঘুরে ফিরে কিছু সীমিত সংখ্যক প্রকৃত মেধাবীদের উপরই দেশকে নির্ভর করতে হবে, তাই এতো এতো এ+ বা এতো বেশি পাশের হার না বাড়িয়ে শিক্ষার মান বাড়ানোর দিকে আরো বেশি মনোযোগী হতে হবে। শিক্ষকদের যেন রাস্তায় রাস্তায় বেতন ভাতার জন্য আন্দোলন করতে না হয়, ক্লাসে বেশি সময় দিতে পারেন, তাদের মাঝে শ্রেণীকক্ষে পাঠদানে যেন কোন রকম অবহেলার মানসিকতা তৈরী না হয়, ছাত্র ছাত্রিদের খাতা যথাযথভাবে মূল্যায়ন করার জন্য তাদের যেন কোন হেনস্থা না হতে হয় সেদিকে নজর দিতে হবে। স্কুল কলেজে ছাত্র ছাত্রীদের কিভাবে আরো আকর্ষণীয়ভাবে পাঠদান করা যেতে পারে সে ব্যাপারে শিক্ষকদের পর্যাপ্ত ট্রেনিং এবং সুযোগ সুবিধা প্রদান করতে হবে। ছাত্র ছাত্রীরা বাড়িতে গিয়ে নিজে কিছু সময় দিচ্ছে কিন পড়াশোনার জন্য, কেবলি যেন প্রাইভেট টিউটরের উপর নির্ভর না করতে হয় এ ব্যাপারে শিক্ষকদের যেমন সচেতনতা দরকার, অভিভাবকদেরও সচেতনতা দরকার। তারাই তাদের ছেলেমেয়েদের তখন প্রাইভেট পড়তে নিরুতসাহিত করবেন। একজন ছাত্র তার মেধা কাজে লাগিয়ে নিজে পড়ে কতটা বুঝতে পারছে, সেটা পরীক্ষা করার পর্যাপ্ত ব্যবস্থা বাড়িতে এবং স্কুল কলেজগুলোতেও থাকা দরকার। এভাবেই হয়তো আমাদের প্রিয় সন্তানদের, ছোট ভাই বোনদের আরো বেশি আত্মবিশ্বাসী, আত্মপ্রত্যয়ী করে গড়ে তুলতে পারবো।
তথ্যসূত্রঃ
http://www.prothom-alo.com/detail/date/2012-12-29/news/316969http://www.prothom-alo.com/detail/date/2013-01-03/news/318235