নাটোরের কিশোর আবদুল্লাহ হাসান কখনো মাজিদ মাজিদির নামই শোনেনি। ইরানি চিত্রপরিচালকের চিলড্রেন অব হ্যাভেন সিনেমাটা দেখার সৌভাগ্যও হয়নি তার। বিদেশি ভাষায় অস্কারের জন্য মনোনীত সিনেমায় দুই ভাইবোনের জুতা পাওয়ার গল্পটাকেও যেন হার মানিয়ে দিল আবদুল্লাহ।
জাতীয় জুনিয়র অ্যাথলেটিকসের কিশোর বিভাগের দ্রুততম মানব আবদুল্লাহর কোনো রানিং শু নেই! আদৌ ট্র্যাকে নামতে পারবেন কি না, তা নিয়েই বেশ সংশয়ে ছিল। সকালে হিটে নামার আগে খুলনার অ্যাথলেট বাহারের কাছ থেকে জুতা চেয়ে নামে ট্র্যাকে। সেখানে প্রথম হলেও বিকেলে ফাইনালে নামার আগে আর খুঁজে পায়নি ওই বন্ধুকে। পরে যখন তার খোঁজ পাওয়া গেল, বাহার ততক্ষণে খুলনার গাড়িতে উঠে গেছে। তার পরও রানিং শুর জন্য এর-ওর কাছে ধরনা দিতে থাকে। একপর্যায়ে ট্রিপল জাম্পার আবুল কাশেমের ‘দয়া’ হয়। ইভেন্ট পরে হওয়ায় কাশেম শু জোড়া দেয় আবদুল্লাহকে। ওই শু পরেই সবাইকে অবাক করে ১১.১০ সেকেন্ড সময় নিয়ে সোনা জেতে শহীদ শামসুজ্জোহা কলেজের ছাত্র। দৌড় শেষে গণমাধ্যমকর্মীরা যখন তাকে নিয়ে ব্যস্ত, কাশেম তাড়া দিতে থাকল, ‘আমার জুতা দাও!’ সঙ্গে সঙ্গে মালিককে জুতা ফেরত দিল আবদুল্লাহ।
বাবা মুন্নাফ মুন্সি অন্যের খেতে মজুর খাটেন। অভাবের সংসারে একজোড়া জুতা পাওয়ার স্বপ্ন পূরণ হওয়া সম্ভব ছিল না আবদুল্লাহর। রাজধানীতে এসে ক্রীড়াসামগ্রীর কাচঘেরা শোরুমের দিকে ব্যাকুল চোখে তাকিয়ে দেখত বিখ্যাত কোম্পানির বাহারি জুতাগুলো। সাহসেই কুলায়নি দরদাম করার। চার বছর আগে একবার দৌড়েছিল খালি পায়ে। কিন্তু গরম সিনথেটিক ট্র্যাকের ওপর পড়ে গিয়ে রক্ত ঝরেছিল পা থেকে। তার পর থেকে চলছে জুতা ধার করে দৌড়ানো। এভাবেই জাতীয় ও আন্তর্জাতিক প্রতিযোগিতায় ১টি সোনা, ১টি রুপা ও ২টি ব্রোঞ্জ জিতেছে আবদুল্লাহ।
গত বছর ঝাড়খন্ডে সাফ জুনিয়র অ্যাথলেটিকস চ্যাম্পিয়নশিপে গিয়েও রুক্ষ বাস্তবতার মুখোমুখি হতে হয়েছিল আবদুল্লাহকে। ফেডারেশন থেকে তাকে বলা হয়েছিল ৪–১০০ মিটারে দৌড়ানোর সুযোগ দেওয়া হবে। কিন্তু সেখানেও বাধা ছিল খালি পা। বিকেএসপির বন্ধু আরিফুল ইসলাম কথা দিয়েছিল জুতা ধার দেবে। কিন্তু পরে বিকেএসপির শিক্ষকেরাই নাকি বারণ করেছিলেন জুতা দিতে! আবদুল্লাহ জুতা পেলে রিলেতে দৌড়ানোর সুযোগ হারাত বিকেএসপির ছাত্র আরিফুলই! অথচ ওই রিলেতে বিকেএসপির ছেলেরা কোনো পদকই পায়নি। পরে ৪–৪০০ মিটারে জোর করেই নামানো হয় আবদুল্লাহকে। আরিফুলের জুতা পরে শেষ পর্যন্ত আবদুল্লাহই জুনিয়রদের ব্রোঞ্জ এনে দিয়েছিল বাংলাদেশকে!
দারিদ্র্যের সঙ্গে আবদুল্লাহর লড়াই চলে নিয়তই। এখনো জানে না কবে একজোড়া ভালো রানিং শু কিনতে পারবে সে। তবে এটুকু জেনে গেছে, তাকে দৌড়াতে হবে। দৌড়াতে দৌড়াতেই একদিন জয় হবে সব প্রতিকূলতা।