উদ্যোক্তা উন্নয়নে ইসলামী অর্থনীতির ভূমিকা
ড. এম. কবীর হাসান | 2014-05-08
প্রতিটি দেশই তার উন্নয়নমুখী কর্মকাণ্ডে কিছু অবশ্যম্ভাবী বাধার সম্মুখীন হয়। যার মধ্যে বাণিজ্যিক খাতের ক্ষতির শঙ্কা অনেক বেশি থাকে। প্রতিটি উদ্যোক্তা নিজের ব্যবসায়িক সাফল্য অর্জনে সাধারণত ভিন্ন ভিন্ন সমস্যার সম্মুখীন হয়। তবে একটা বড় অংশের ব্যবসায়ীরা নিজেদের বাণিজ্য ব্যবস্থায় প্রায় একই ধরনের বাধার মুখে পড়েন। ব্যবসার শুরুতেই একজন উদ্যোক্তার জন্য সবচেয়ে বড় সমস্যা হয়ে দাঁড়ায় ব্যবসার পুঁজি সংগ্রহ, সরকারি নীতিমালা এবং ওই ব্যবসার সামাজিক অবস্থান। এসব কারণে অনেকেই ব্যবসায় ঝুঁকি নিতে অনিচ্ছুক হয়ে পড়েন। এর মধ্যে নতুন উদ্যোক্তাদের জন্য ব্যবসার পুঁজি জোগান দেয়া বিশ্বব্যাপী সবচেয়ে বড় সমস্যা। নির্দিষ্ট কোনো দেশ, সীমার জন্য এ কথা সত্য না হলেও উন্নয়নশীল দেশে এ সমস্যা প্রকট আকার ধারণ করে।
সম্ভাব্য উদ্যোক্তা ও আর্থিক প্রতিষ্ঠানগুলোর মধ্যকার সম্পর্কের অবনতির পেছনে ইসলামী দেশগুলোয় বেশ কয়েকটি বিষয় কাজ করে। প্রথমত. আর্থিকভাবে সচ্ছল প্রতিষ্ঠানগুলো নতুন উদ্যোক্তাদের আর্থিকভাবে সাহায্যের ক্ষেত্রে বেশ খানিকটা অনীহা প্রকাশ করে। এ অনীহার গুরুতর প্রভাব পড়ে ক্ষুদ্র ব্যবসায়ীদের ওপর। প্রায় সময় ঋণের পরিমাণ তাদের ব্যবসার আকারের তুলনায় খুবই সামান্য হয়ে যায়। ফলে ঝুঁকি ও দাফতরিক খরচের বোঝা হয়ে যায় অনেক বেশি। এটা হয় মূলত এসএমই এবং পারস্পরিক বোঝাপড়ার মধ্যে সম্পর্ক ভালো না হওয়ার দরুন।
আর্থিক প্রতিষ্ঠানগুলো ঋণদানের সময় কিছু শর্তারোপ করে। যেগুলোর মধ্যে পূর্ববর্তী ব্যবসায়িক অভিজ্ঞতা ও মুনাফা অর্জনের হারের অভিজ্ঞতা সবচেয়ে জরুরি। কেননা এর ওপর ঋণ পরিশোধের সম্ভাবনা নির্ভর করে বহুলাংশে। এক্ষেত্রে যেসব উদ্যোক্তাদের আগে ব্যবসায়িক অভিজ্ঞতা নেই, তাদের জন্য ঋণ পাওয়া কষ্টসাধ্য হয়ে দাঁড়ায়। বাণিজ্যিক ব্যাংকগুলোও নবীন উদ্যোক্তাদের ক্ষেত্রে ঋণ-ঝুঁকি নিতে অনাগ্রহী। ব্যাংকগুলো নতুন পণ্য ও উদ্যোক্তার ভবিষ্যৎ সম্ভাবনা, বাজারে তাদের গ্রহণযোগ্যতা ও স্থায়িত্বের কথা অনেক বেশি ভাবে। তারা ঋণ ও মুনাফার নিশ্চয়তায় অনেক সময় এত বেশি পরিমাণ জামানত দাবি করে, যা উদ্যোক্তার মূল ঋণের চেয়ে অনেক বেশি। বাণিজ্যিক ব্যাংকের এ কঠিন শর্ত পূরণে অধিকাংশ উদ্যোক্তাই অসমর্থ হন। ফলে উদ্যোক্তা প্রচলিত ব্যাংকিং বিধিবিধানকে কখনই তার মূলধনি পুঁজির সহায়ক মনে করতে পারেন না। এ ব্যবস্থা উদ্যোক্তাকে এক কঠিন পরীক্ষার মুখোমুখী করে তোলে। বিকল্প হিসেবে তাকে চড়া সুদে ঋণ নিতে হয় অথবা ব্যবসার স্বপ্ন ত্যাগ করতে হয়।
উদ্যোক্তা ঋণগ্রহণে নিজের যোগ্যতা প্রমাণ করতে পারলেও রয়েছে পূর্বনির্ধারিত চড়া সুদ পরিশোধের তাগিদ। মূলধন জোগানের উচ্চমূল্য উদ্যোক্তার জন্য বড় বোঝা হয়ে যায়, যা কিনা শুরু থেকেই তাকে ন্যায়সম্মত উপায়ে সাফল্য অর্জনের চেয়ে একটি ক্ষতিকর মনোভাবের দিকে নিয়ে যায়। উপরন্তু সুদসহ ঋণ শোধের তাড়নার পাশাপাশি ব্যবসার ভবিষ্যৎ উন্নয়নের চাপ রয়েছে। পূর্বনির্ধারিত সুদ ও ব্যবসায়িক উন্নতির চাপ উদ্যোক্তার জন্য সহায়ক ভূমিকা পালন করে না। অন্যদিকে কোনো কারণে ব্যবসায় ধস নামলে ব্যাংক তাদের ঋণ পরিশোধের জন্য অমানবিক পর্যায়ের ব্যবহার করে। যাতে উদ্যোক্তা পুরোপুরি নিঃস্ব হয়ে পড়েন। ইসলাম ধর্মে এ ধরনের শোষণ পুরোপুরি নিষিদ্ধ হলেও অন্যায়ভাবে এ চর্চা চালু রয়েছে।
দ্বিতীয়ত. অধিকাংশ মুসলিম উদ্যোক্তারাই ধর্মীয় কারণে প্রচলিত ব্যাংকিং প্রথায় অর্থায়ন পছন্দ করেন না। তাদের মতে, বাণিজ্যিক ব্যাংক হলো অনৈতিক আর্থিক প্রতিষ্ঠান। কারণ তারা সুদ পদ্ধতি ‘রিবা’র মাধ্যমে ধনী ও দরিদ্রের মধ্যে বিস্তর ফারাক সৃষ্টি করে। এর গুরুত্ব ও সংখ্যাধিক্য বিচার করে বিশেষজ্ঞরা গবেষণায় বিষয়টিকে উপেক্ষা করে গেছেন।
তৃতীয়ত. উল্লেখযোগ্য সংখ্যক মুসলিম ব্যবসায়ী নতুন ব্যবসার ঝুঁকির চেয়ে শেয়ারিংকে অধিক অগ্রাধিকার দেন।
প্রিসলি ও সেশন (১৯৯৪, পৃষ্ঠা ৫৮৫) জোরালোভাবে দেখিয়েছেন, অতি সম্প্রতি ইসলামী অর্থনীতির প্রতি সবাই আগ্রহী হলেও, ইসলামে অর্থনীতির ইতিহাস বহু প্রাচীন। প্রকৃতপক্ষে প্রায় ১৪ শতকের আগে কোরআন নাজিলের সময় থেকেই ইসলামী অর্থনীতির মূল পাওয়া যায়।
ইসলামী বাণিজ্যিক খাতের উন্নয়নের সক্ষমতা নির্ণয়ে ইসলামী অর্থনৈতিক ব্যবস্থার গুরুত্ব ও গভীরতা অপরিসীম। ইসলামী শরিয়াহ হলো ইসলামী সমাজ ব্যবস্থা, রাজনীতি, অর্থনীতি ও সাংস্কৃতিক কাজ পরিচালনার জন্য শুদ্ধ নিয়ম-আদর্শ। কোরআন ও সুন্নাহ হলো শরিয়াহর মূল উত্স। ইসলামী অর্থনৈতিক ব্যবস্থার মূলেই রয়েছে সংখ্যাগরিষ্ঠ দরিদ্র জনগোষ্ঠী এবং সংখ্যালঘু ধনীদের মধ্যে পক্ষপাতহীনভাবে সম্পদ সংগ্রহ ও তার সুষ্ঠু বণ্টনের দর্শন। যার মূল লক্ষ্য, ইসলামী ব্যবস্থাপনার মাধ্যমে মুসলিমদের মধ্যে আর্থসামাজিক ন্যায়নীতি প্রতিষ্ঠা। ইকবাল (১৯৯৭) দেখিয়েছেন, ইসলামী ব্যাংকিং পদ্ধতি ইসলামী অর্থনীতির প্রাণ হলেও এর সম্পর্কে ভ্রান্ত অনেক ধারণা প্রচলন রয়েছে। যার অন্যতম হচ্ছে, সামগ্রিকভাবে ইসলামী অর্থনীতিকে ‘সুদমুক্ত’ বলে সংজ্ঞায়িত করা।
ইসলামী অর্থনীতিতে সুদের (রিবা) শর্তায়নে বিশেষ গুরুত্বারোপ করা হয়েছে। অনেক পাশ্চাত্য দার্শনিক ইসলামী অর্থনীতির এ শর্তায়নে পুঁজিবাদ-বিরোধী এবং বর্তমান অর্থনীতিতে এটি অপ্রচলিত বলে আখ্যায়িত করেছেন। যদি এটি কোনোক্রমে প্রচলিত হয়ে যায়, তাহলে অর্থনৈতিক উন্নয়ন সংকুচিত করে ফেলবে। অন্যদিকে অন্যরা বলছেন, সুদ নির্ধারণ ও আদায়ের ক্ষেত্রে কোনো নৈতিক বা আর্থিক অজুহাতের দরকার নেই। তাদের মতে, এ সুদের কারণে অনেক উদ্যোক্তাই ব্যবসায়ে অনাগ্রহী হন। তাই অনেক ক্ষেত্রেই ‘সুদ’ অগ্রগতির পথে বাধা। তাছাড়া সুদনির্ভর অর্থনীতি কখনই সামাজিক ন্যায্যতা প্রদানে সক্ষম হতে পারে না।
আহমদ (১৯৯৬) সুদের শর্তারোপ এবং অর্থনৈতিক উন্নয়নের মধ্যে সম্পর্ক স্থাপন করেছেন। এর মাধ্যমে তিনি সিদ্ধান্ত নেন যে: এক. সুদের ‘রেন্ট সিকিং এক্টিভিটি’র মাধ্যমে অর্থায়নের ফলে নতুন; কিন্তু কৃত্রিম মূলধন তৈরি হয়, যা বাজারের প্রাণ সঞ্চালনে কোনো ভূমিকা রাখে না। ‘বাজারের মূল প্রাণ হলো উদ্যোক্তা।’
দুই. ঋণদাতা ও উদ্যোক্তার মধ্যকার সুসম্পর্ক ‘সুদ’ বন্ধের নেতিবাচক দিকগুলো মোচনে সমর্থ হবে। ইসলামী অর্থনীতির দুই ধরনের চালিকাশক্তি মুদারাবাহ এবং মুসারাকাহকে প্রচলিত ধারার সুদনির্ভর অর্থনীতির বিকল্প ধরা হয়। ‘রেট অব রিটার্ন’-এর ভিত্তিতে মুদারাবাহ এবং মুসারাকাহ পরিচালিত হয়। এখানে ঋণদাতা ও উদ্যোক্তা উভয়ই নির্দিষ্ট অনুপাতের ভিত্তিতে ব্যবসায়ী ঝুঁকি ও মুনাফা ভাগ করে নেন। এক্ষেত্রে পূর্বনির্ধারিত স্থিতিশীল সুদের ক্ষেত্রে উদ্যোক্তার লাভ-ক্ষতি বিবেচিত হয় না। তাই মুদারাবাদ এবং মুসারাকাহ পদ্ধতি পূর্বনির্ধারিত স্থিতিশীল সুদের সম্পূর্ণ বিপরীত ধারা।
তৃতীয়ত. ইসলামে ঋণের ওপর পূর্বনির্ধারিত স্থিতিশীল সুদে নিষেধাজ্ঞা আরোপ করে। সুদ (রিবা) একদিকে দরিদ্রদের আরো নিঃস্ব করে। অন্যদিকে কোনো কাজ ছাড়াই ধনীকে আরো বিত্তবান করে। রিবা এমন সম্পদের সৃষ্টি করে, যা সৃষ্টিশীল অর্থনীতিকে সচল কিংবা আরো উন্নত করতে সাহায্য করে না। এ কারণেই ইসলাম সব সুদনির্ভর অর্থনীতিকে অনৈতিক, অন্যায্য ও পক্ষপাতমূলক বলে আখ্যায়িত করেছে। ফলে বিনিময় হওয়া ও আয়কৃত অর্থ অর্থাৎ রিবাকে বেআইনি ঘোষণা করেছে। মজার বিষয় হলো, প্রতিটি বড় ধর্ম (ইহুদি, খ্রিস্ট ও ইসলাম) এবং বৌদ্ধ ও হিন্দুইজমের মতো অন্যান্য নৈতিক ব্যবস্থা ‘সুদ’কে অনৈতিক অনুশীলন বলে নিন্দা করে।
লেখক: অধ্যাপক
ইউনিভার্সিটি অব নিউ অরলিন্স, যুক্তরাষ্ট্র
Source:
http://www.bonikbarta.com/2014-05-08/news/details/539.html