মাছ-মুরগিরতে ঢুকছে ক্রোমিয়ামসহ ২০ ধরনের বিষাক্ত পদার্থ। মূলত মাছ ও মুরগির খাবার এই পদার্থ ব্যবহার করা হয়। এর মাধ্যমেই মুরগি ও মাছের শরীরে বিষাক্ত পদার্থ প্রবেশ করছে। আর মুরগি বা মাছ ক্রোমিয়াম হজম করতে না পারায় এই বিষাক্ত রাসায়নিক সরাসরি চলে যাচ্ছে মানুষের শরীরে। এতে বাড়ছে ক্যান্সার, কিডনি নষ্ট হওয়া থেকে শুরু করে নানা ধরনের রোগ-ব্যাধি।
চিকিৎসকরা বলছেন, বিষাক্ত এসব মাছ বা মুরগি খেলে গর্ভবতী মা ও তার গর্ভের সন্তান ক্যান্সারে আক্রান্ত হতে পারেন। এমনকি ডায়াবেটিস নিয়ে জন্ম নিতে পারে শিশু। আবার জন্মের সময়ই নবজাতকের একটি কিডনি নষ্ট হতে পারে। আর এসব এখন অহরহই হচ্ছে। তাই সামাজিক আন্দোলন ছাড়া এসব ক্ষতিকর রাসায়নিকের ব্যবহার প্রতিরোধ করা কোনভাবেই সম্ভব নয়।
শুক্রবার রাজধানীর হাজারীবাগে হাইপো ফিড কারখানায় র্যাব-২ এর সহযোগিতায় অভিযান চালায় ভ্রাম্যমাণ আদালত। মোবাইল কোর্ট পরিচালনা করেন র্যাবের নির্বাহী ম্যাজিস্ট্রেট এ এইচ এম আনোয়ার পাশা। কারখানা পরিচালনাকারী সাইফুল ইসলাম জানান, কারখানার মালিক খলিল ক্যান্সারে আক্রান্ত এবং গত ছয় মাস যাবৎ কারখানায় আসেন না। তার অবর্তমানে সাইফুলই সব কিছু পরিচালনা করছেন। মালিক তাকে ট্যানারির বিষাক্ত বর্জ্য দিয়ে ফিড তৈরি করতে নিষেধ করলেও তিনি তাকে না জানিয়ে সহযোগী জামালকে নিয়ে এ ব্যবসা চালিয়ে যাচ্ছেন। আদালত সাইফুলকে ২ লাখ টাকা জরিমানা ও ২ বছরের জেল ও জামালকে ২ লাখ টাকা জরিমানা করেছে।
আদালত সূত্রে জানা গেছে, গত ৪ বছর ধরে এখানে এভাবে ফিড তৈরি হচ্ছে। মুরগি বা মাছের খাবারে ৩০ পিপিএম মাত্রার বেশি ক্রোমিয়াম থাকা ঝুঁকিপূর্ণ হলেও এই কারখানায় উৎপাদিত ফিডে প্রায় পাঁচ হাজার পিপিএম মাত্রার ক্রোমিয়াম পাওয়া গেছে। সাইফুল জানান, ট্যানারি থেকে চামড়ার বর্জ্য এনে কারখানায় সিদ্ধ করে ছাদে শুকিয়ে শুঁটকি বানানো হয়। এ শুঁটকি ১৭ টাকা কেজি হিসেবে পাইকারি বিক্রি করেন এবং নিজেই গুঁড়া করে ফিড তৈরি করেন। তার কাছ থেকে শুঁটকি কিনে বিভিন্ন স্থানে নিয়ে বিভিন্ন ব্যক্তি ক্ষতিকর ফিড তৈরি করছে বলে তিনি জানান।
সংশ্লিষ্ট সূত্রে জানা গেছে, সাধারণত দু’টি কারণে ক্ষতিকর ট্যানারি বর্জ্য মাছ ও মুরগির খাবারে ব্যবহূত হয়। প্রথমত, এটি খাওয়ালে মুরগি বা মাছের দ্রুত বৃদ্ধি ঘটে এবং ডিমের আকার বড় হয়। দ্বিতীয়ত, এটি দামে সস্তা। শুটকি মাছের গুঁড়া এবং আমদানি করা ‘মিটবন্ড’ ব্যবহার করে সাধারনত ফিড তৈরি করা হয়। কিন্তু এগুলোর দাম বেশি হওয়ায় বিকল্প হিসেবে চামড়ার বর্জ্য ব্যবহার করা হয়।
অথচ মারাত্মক ক্ষতিকর ক্রোমিয়াম এসব ফিডের মাধ্যমে মানবদেহে প্রবেশ করছে। এ ফিড মাছ বা মুরগি খেলে মলমূত্রের মাধ্যমে খানিকটা বের হয়ে গেলেও একটা বড় অংশ তাদের শরীরে জমা হতে থাকে। এমনকি ডিমেও জমা হয়। এই মাছ, মুরগি বা ডিম খেলে মানুষের শরীরে ক্রোমিয়াম প্রবেশ করে এবং মলমূত্রের মাধ্যমে সবটা বের হতে না পেরে শরীরে জমা হতে থাকে এবং নানা রোগ সৃষ্টি করে।
চিকিত্সকরা জানান, মানবদেহে অতিরিক্ত ক্রোমিয়াম প্রবেশ করলে নানা রোগব্যাধি হতে পারে। এর মধ্যে রয়েছে, ক্যান্সার (বিশেষত ফুসফুসে ক্যান্সার), টিউমার, পাকস্থলি ও ক্ষুদ্রান্ত্র আলসার, পুরুষত্বহীনতা, অকাল প্রসব, বিকলাঙ্গ শিশুর জন্ম, অ্যাজমা, শ্বাসকষ্ট ও চর্মরোগ। এছাড়া এর প্রভাবে শিশু ও সংশ্লিষ্ট শ্রমিকদের স্বাস্থ্যঝুঁকি অত্যন্ত বেশি।
এ প্রসঙ্গে প্রখ্যাত কিডনি বিশেষজ্ঞ, কিডনি ফাউন্ডেশনের চেয়ারম্যান অধ্যাপক ডা. হারুন অর রশীদ বলেন, ক্রোমিয়াম হেভি মেটাল। এতে দ্রুত কিডনি নষ্ট হয়ে যেতে পারে। তিনি বলেন, এগুলো যারা করছে তাদের কঠোর শাস্তি দরকার। কারণ এটা জঘন্যতম অপরাধ। এসব কারণে দেশে রোগী মৃত্যুর হারও বাড়ছে বলে তিনি জানান।
ক্যান্সার বিশেষজ্ঞ প্রফেসর ডা. আকরাম হোসেন বলেন, এসব কেমিক্যালের কারণেই ক্যান্সার সৃষ্টি হচ্ছে। আগে কিন্তু এত ক্যান্সারের রোগী ছিল না। তিনি বলেন, এসিড নিক্ষেপের শাস্তি মৃত্যুদন্ড ঘোষণার পর থেকে এসিড নিক্ষেপ অনেক কমে গেছে। এসব ক্ষতিকর কেমিক্যাল ব্যবহারের শাস্তিও মৃত্যুদন্ড করলে এর ব্যবহার কমবে।
ঢাকা শিশু হাসপাতালের পরিচালক ও শিশু বিশেষজ্ঞ অধ্যাপক ডা. মঞ্জুর হোসেন বলেন, কেমিক্যাল শিশুদের ব্রেন ধ্বংস করে দেয়। ফলে শিশু মোটা হয়ে যায়, বিকলাঙ্গ হয়। তাই এসব ক্ষতিকর কেমিক্যাল যারা ব্যবহার করে তাদের সর্বোচ্চ শাস্তি হওয়া উচিত্। বিষাক্ত খাবারের কারণে গর্ভবতী মা ও সন্তানের ক্যান্সার হতে পারে বলে জানিয়েছেন গাইনি বিশেষজ্ঞ অধ্যাপক ডা. রাশিদা বেগম।