জালাল উদ্দিন রুমি : মানবাত্মার রহস্যের কবি

Author Topic: জালাল উদ্দিন রুমি : মানবাত্মার রহস্যের কবি  (Read 2104 times)

Offline Ishtiaque Ahmad

  • Full Member
  • ***
  • Posts: 136
  • Test
    • View Profile
বর্তমানে পশ্চিমা বিশ্বে মাওলানা জালালউদ্দিন রুমি কবিদের মধ্যে সর্বাধিক পরিচিত ও পঠিত। ফারসি ভাষাভাষীদের গবেষকেরা জালালউদ্দিন রুমিকে তাদের সবচেয়ে বড় কবি হিসেবে দেখেন। পশ্চিমা বিশ্বে তার জনপ্রিয়তার কারণ তিনি তার কবিতার মাধ্যমে যে বার্তা তুলে ধরেছেন তা তার ভাষার সীমাবদ্ধতা অতিক্রম করতে সক্ষম হয়েছে। তিনি তার কাব্যে অনেক গুরুত্বপূর্ণ দর্শন দিয়েছেন যা নিছক ফারসি ভাষা বা সংস্কৃতির বিষয় নয়, বরং মানবজাতির আত্মার রহস্যের বিষয়। কাব্য-সাহিত্যের পাশাপাশি তিনি গদ্যও রচনা করেছেন। তার গদ্য সাহিত্যের মধ্যে রয়েছে কিছু সংলাপ, যেগুলোর মানসম্পন্ন অনুবাদ করেছেন এ জে আরবেরি। মাওলানা জালালউদ্দিন রুমি যে বিশ্বের একজন সর্বশ্রেষ্ঠ সুফি তা বোঝার জন্য কাউকে তার কাব্যের সমঝদার হতে হবে এমনটি নয়।
সাহিত্যের সামগ্রিক বিচারে রুমির মাহাত্ম্য নিহিত এখানে, তিনি ইসলাম ধর্মের একেবারে নির্যাসটুকু হাজির করতে পেরেছিলেন। যা মানুষকে পবিত্র ও সৌন্দর্য দান করে। আর স্বভাবতই একটি সার্বজনীন ধর্ম হিসেবে ইসলামের মর্মবাণী সব দেশের সব কালের প্রতিনিধিত্ব করে। মানব সন্তান সীমাহীন স্বাধীনতা ও অফুরন্ত স্বর্গীয় মহিমা নিয়ে জন্মলাভ করেছে। এ দু’টি পাওয়া তাদের জন্মগত অধিকার। তবে এ মহামূল্যবান দু’টি জিনিস পেতে হলে তাদের অবশ্যই ভালোবাসার কাছে আত্মসমর্পণ করতে হবে। কেউ হয়তো বা প্রশ্ন করতে পারেন এর মধ্যে নতুন কী আছে? দুনিয়ার তাবত মহাপুরুষই তো এ কথা বলে গেছেন। রুমির মাহাত্ম্য এখানেই নিহিত যে, তিনি অত্যন্ত সরাসরি দৈনন্দিন জীবনাচরণ থেকে উদাহরণ টেনে মহাসত্যকে জীবন্তভাবে উপস্খাপন করতে পেরেছেন। উন্মোচন করেছেন মানবাত্মার রহস্য।
জালালউদ্দিন রুমি ১২০৪ খ্রিষ্টাব্দে বর্তমান আফগানিস্তানের বালাখে জন্মগ্রহণ করেন। তার পিতা বাহা ওয়ালাদ ছিলেন সর্বজনবিদিত পণ্ডিত ও সুফি। বিশ্বস্রষ্টা আল্লাহর ভালোবাসা কিভাবে হাসিল করা যায় তার ওপর অনেক চিত্তাকর্ষক লেখা তিনি লিখেছেন। মোঙ্গলদের আসন্ন আক্রমণের সময় ইরানের পূর্বাঞ্চলীয় এলাকায় থাকাকে নিরাপদ মনে না করায় তিনি ১২২০ সালের দিকে তার পরিবারকে আনাতলিয়ায় সরিয়ে নেন। বর্তমান তুরস্কের কনিয়ায় তিনি স্খায়ীভাবে বসতি স্খাপন করেন। এবং সেখানেই তিনি তৎকালীন শ্রেষ্ঠ আলেম হিসেবে পেশাজীবন শুরু করেন। ১২৩১ সালে মৃত্যুর পর তার পুত্র জালালউদ্দিন পিতার স্খলাভিষিক্ত হন। এর অনেক আগেই জালালউদ্দিন স্বনামধন্য অধ্যাপক ও ধর্মপ্রচারক হিসেবে খ্যাতি অর্জন করেন। তিনি আইন ও ধর্মতাত্ত্বিক বিজ্ঞানকে এক সূত্রে গ্রোথিত করেছিলেন এবং সুফিবাদকে আরো বেশি আধ্যাত্মিক মাত্রা দিয়েছিলেন। তবে তখনো তিনি কবিতা রচনা করেননি বা সুফি বিজ্ঞানের অথরিটি হিসেবে স্বীকৃতি পাননি। রুমির জীবনের সবচেয়ে বড় পরিবর্তন ঘটতে শুরু করে ১২৪৪ সালে, অর্থাৎ তার বয়স যখন ৪০ বছর। এ বছর তিনি কনিয়ায় একজন অতি আশ্চর্যজনক ব্যক্তিত্বের সংস্পর্শে আসেন। তার নাম শামস আল-দীন তাবরিজ বা শামস-ই তাবরিজ। তারা দু’জন নিষ্কাম প্রেমের বìধনে আবদ্ধ হয়ে পড়েন। শামস রুমিকে আধ্যাত্মিক প্রেমের ব্যাপারে এমন উৎকৃষ্ট সবক দিলেন যা তিনি ইত:পূর্বে কল্পনাও করতে পারেননি। এ অবস্খায় রুমির কাছে শামস যেন সৌন্দর্য ও মহত্বের মূর্ত প্রতিক হয়ে ওঠেন। পাশাপাশি তিনি উপলব্ধি করতে থাকেন, তিনি যেন আল্লাহর রহমতের ছায়াতলে আশ্রয় পাচ্ছেন। এমতাবস্খায় এক দিন শামস নিরুদ্দেশ হয়ে যান। শামস নিহত হয়েছেন বলে গুজব শোনা গেলেও রুমি নিজে তা বিশ্বাস করতেন বলে মনে হয় না। তবে এ থেকে একটা জিনিস পরিষ্কার, শামসের নিরুদ্দেশ হয়ে যাওয়ার পরই রুমির কলম দিয়ে ঝরনা ধারার মতো কবিতা বেরোতে থাকে। রুমি অবশ্য তার অনেক লেখার মাধ্যমে এ কথা পরিষ্কার করে দিয়েছেন।

রুমি ৩ হাজার গজল (প্রেমের গান) রচনা করেছেন। আর এসব গজলের অনেকগুলোর সাথেই শামসের নাম বিজড়িত। শামসের জন্য উৎসর্গীকৃত তার দিওয়ান-ই শামস-ই তাবরিজ হচ্ছে গজল ও বিভিন্ন শ্লোকের সমাহার, যার মধ্যে রয়েছে ৪০ হাজার পংক্তি। ২৫ হাজার শ্লোক নিয়ে রচিত তার সঙ্কলনের নাম মসনবি। মসনবি হচ্ছে শিক্ষামূলক নীতিবাক্যের সমাহার। এবং মানুষকে নীতিবোধে উজ্জীবিত করাই এর একমাত্র লক্ষ্য।  Literary History of the Arabs গ্রন্থের বিখ্যাত লেখক R A Nicholson (1868-1945) মসনবির পুরোটাই ইংরেজিতে অনুবাদ করে ইংরেজি ভাষাভাষীদের কাছে মাওলানা জালালউদ্দিন রুমিকে একজন শ্রেষ্ঠ সাহিত্যিক ও আধ্যাত্মিক সাধক হিসেবে তুলে ধরেছেন। রুমি বিশারদ নাদের খলিল তার ‘সুফি পাথ টু লাভ’ গ্রন্থে ৭৫টি গজল ও বিক্ষিপ্তভাবে ১ হাজার শ্লোক অনুবাদ করেছেন।
অতি সম্প্রতি কয়েকজন কবি দিওয়ান থেকে কিছু গজল তাদের কাব্য সৌন্দর্য অক্ষুণí রেখে অনুবাদকর্ম প্রকাশ করেছেন। এবং এর ভিত্তি হিসেবে তারা ইত:পূর্বে অন্যদের দ্বারা আক্ষরিকভাবে অনুবাদগুলোকে ভিত্তি হিসেবে গ্রহণ করেছেন। তবে যারা ফারসি ভাষাভাষী তারা উপলব্ধি করতে পারবেন, অনুবাদগুলো সাদামাটা এবং অনেক ক্ষেত্রেই দুর্বল। এতদসত্ত্বেও তারা এ জন্য ধন্যবাদ পাওয়ার যোগ্য। তারা এটা মনে করেছেন যে রুমির মতো একজন উঁচুদরের কবি শুধু পারস্যের গণ্ডীর মধ্যে আটকে থাকতে পারেন না। তিনি আন্তর্জাতিক স্বীকৃতি পাওয়ার যোগ্য।
তবে এখনো পর্যন্ত দেওয়ানের ওপর যতগুলো ইংরেজি অনুবাদ বেরিয়েছে তন্মধ্যে নাদের খলিলের অনুবাদই মানসম্পন্ন হয়েছে। অনুবাদের ক্ষেত্রে তিনি অন্যদের তুলনায় সুবিধাজনক অবস্খানে আছেন। কেননা তার মাতৃভাষা ফারসি এবং ইংরেজিতেও তিনি তুখোড়। এ ছাড়া তার মধ্যে অসাধারণ কাব্য প্রতিভা লুকায়িত আছে। কবি ছাড়া আর কেই-বা কবিতার মাহাত্ম্য সর্বাধিক উপলব্ধি করতে পারে? এ জন্যই তিনি রুমির কর্মকে তার অন্তর্নিহিত ভাবধারাকে অক্ষুণí রেখে হৃদয়গ্রাহী করে উপস্খাপন করতে পেরেছেন। আজকের দিনে যারা রুমির প্রতি আকৃষ্ট হচ্ছেন তাদের সম্পূর্ণ বিপরীতে নাদের খলিলি রুমির বাণীর যে বাস্তব প্রাসঙ্গিকতা আমাদের দৈনন্দিন জগতে রয়েছে সেটা নিংড়িয়ে আনতে সক্ষম হয়েছেন। রুমি বিশ্বাস করেন, সৌন্দর্য মানব মনের চিরন্তন কাম্য। কেননা আল্লাহ নিজেই সুন্দর এবং তিনি সব সৌন্দর্যের উৎস। আর মানবাত্মার প্রকৃত চাহিদা হচ্ছে খোদ আল্লাহ পাক। নাদের এই সৌন্দর্যকে অসাধারণ পাণ্ডিত্যের মাধ্যমে ভাষাগত রূপায়নের পাশাপাশি স্খাপত্য কর্মের মাধ্যমেও তুলে ধরে মানব সভ্যতাকে উপকৃত করেছেন। নাদেরের সিরামিকের বাড়ি ও মৃত স্খাপত্যের দিকে তাকালেই এই সত্য মূর্ত হয়ে ধরা দেবে।
R A Nicholson, Arther John Arbery, William C Chittick, Ancara University’s History of Religions-এর Professor Annemarie Schimmel এবং আমেরিকার শৌখিন রুমি গবেষক ইব্রাহিম গামার্দ (Ibrahim Gamard)-এর ঐকান্তিক প্রচেষ্টা ও অনুবাদ কর্মের দ্বারা আজকের ইউরোপের শিক্ষার্থীরা ব্যাপকহারে রুমির সাহিত্য কর্মের রস আস্বাদন করতে পারছেন। ইতোমধ্যে তারা যে রুমির সাহিত্যকর্মের রস নিংড়ে পরিতৃপ্তির সাথে পান করছেন তা-ও জোরালোভাবে প্রকাশ পাচ্ছে। গবেষকরা এখন বিশ্ব সাহিত্যের বদ্ধমূল ধারণায় অন্তত কিছুটা হলেও চিড় ধরাতে সক্ষম হয়েছেন। তাদের মধ্যে সাহিত্যের তুলনামূলক বিশ্লেষণের ক্ষেত্রে নতুন করে বোধদয় ঘটতে শুরু করেছে। রুমির সাহিত্যকর্ম অধ্যয়নের পর এতকাল দোর্দণ্ড প্রতাপশালী ইংরেজ সাহিত্যিকদের সাহিত্যকর্মকে রীতিমতো পানসে বলে মনে হচ্ছে। তারা এখন রীতিমতো নিক্তি দিয়ে ওজন করছেন কার সাহিত্যকর্মের গভীরতা কতটা। হার্ভার্ড বিশ্ববিদ্যালয়ের সাবেক রিসার্স স্কলার এবং লন্ডন স্কুল অব ইকোনমিকস ও অক্সফোর্ড বিশ্ববিদ্যালয় থেকে উচ্চতর ডিগ্রিপ্রাপ্ত সামির আসাফ The Poet of the Poets– শীর্ষক এক নিবìেধ লিখেছেন, গভীরতার মানদণ্ডে রুমির তুলনায় শেক্সপিয়রের মান হচ্ছে মাত্র ১০ ভাগের এক ভাগ। পশ্চিমা সাহিত্যিকদের মান প্রসেঙ্গ তিনি আরো লিখেছেন, ‘পাশ্চাত্যের গ্যাটে, চসার ও ইমারসন পর্যন্ত রুমির প্রভাব প্রতিপত্তি উপলব্ধি করতে পেরেছেন। এ কথা বলতে দ্বিধা নেই, রুমির সমকক্ষ­ যেমন গাজ্জালি, গালিব, জামি, সাদি, জিবরান, এমনকি কাজমি, দেহলভি বা জাউকের (Zauk) সাহিত্যকর্মের তুলনায় পশ্চিমা সাহিত্য বলতে গেলে হাস্যকর পর্যায়ের অগভীর।
ভাষাবিদরা পশ্চিমা সাহিত্য, বিশেষ করে ইংরেজি সাহিত্যের এই অগভীরতার পেছনে অন্যতম তিনটি কারণ উল্লেখ করেছেন। এগুলো হচ্ছে­ উর্দু বা ফারসির তুলনায় এসব ভাষার প্রকাশভঙ্গির অন্তর্নিহিত সীমাবদ্ধতা, পাশ্চাত্যে মরমিবাদের সহজাত ঘাটতি এবং সামগ্রিকভাবে পশ্চিমা সমাজ ও সংস্কৃতি তুলনামূলকভাবে অস্খিতিশীল। পক্ষান্তরে রুমি এ জগতের মানুষ হয়েও সম্পূর্ণ ভিন্ন জগতের বাসিন্দা তথা আধ্যাত্মিক চেতনার মানুষ ছিলেন। তার কবিতা তাই যেন আকাশ থেকে বারিধারার মতো নেমে আসত।
রুমির সাহিত্যকর্ম স্খান-কাল-পাত্রের সীমা অতিক্রম করে অমরত্ব লাভ করেছে। আজ বিশ্বখ্যাত সঙ্গীত শিল্পী ম্যাডোনা ও তার মতো আরো অনেকে রুমির কবিতাকে গানে রূপ দিয়ে গেয়ে বিশ্বের দরবারে তাকে শ্রেষ্ঠত্বের আসনে সমাসীন করার প্রয়াস পাচ্ছেন।