ইসলামে নারীর অধিকার
১• আল্লাহর সৃষ্টির মধ্যে মানুষ তথা নারী ও পুরুষ সবচেয়ে সুন্দর। সূরা আত তীনের ৪নং আয়াতে আল্লাহ নিজেই বলেছেন, আমি মানুষকে সবচেয়ে সুন্দর কাঠামোতে বানিয়েছি।†মানুষকে নারী ও পুরুষ এই দুই রকমে সৃষ্টি করার কারণ বুঝা কঠিন কিছু নয়। দুইভাবে সৃষ্টি না করলে তো মানব বংশই বিস্তার হতো না; প্রথম মানুষ আদম (আঃ) পর্যন্তই তা থেমে যেত। সূরা আন নিসার প্রথম আয়াতে বলা হয়েছে, “হে মানব জাতি! তোমাদের রবকে ভয় কর, যিনি তোমাদেরকে একজন মানুষ থেকে সৃষ্টি করেছেন, তার থেকে তার জোড়া সৃষ্টি করেছেন এবং এ দু’জন থেকে বহু পুরুষ ও নারী দুনিয়ায় ছড়িয়ে দিয়েছেন।â€
মানুষকে এমন গুণ বৈশিষ্ট্যে সৃষ্টি করা হয়েছে যে, সে সঙ্গী ছাড়া থাকতে পারে না নারীর প্রতি পুরুষের এবং পুরুষের প্রতি নারীর রয়েছে দারুণ আকর্ষণ । এ আকর্ষণ স্থায়ী হওয়ার জন্য দেয়া হয়েছে ভালোবাসা। আর এ আকর্ষণের প্রয়োজনেই নারী ও পুরুষের সৃষ্টিতে অবয়বগত ও বৈশিষ্ট্যগত কিছু পার্থক রয়েছে। র্পাথক্যের কারণে এমন হয়নি যে, পুরুষ সুন্দর আর নারী বিশ্রী হয়েছে কিংবা নারী সুন্দর আর পুরুষ বিশ্রী হয়েছে বরং উভয়ই সুন্দর। এমন কোন নারী খুঁজে পাওয়া যাবে না, যে পুরুষের ব্যক্তিত্বশীল স্বভাব পছন্দ করে না, আবার এমন কোন পুরুষও খুঁজে পাওয়া যাবে না, যে নারীর লাজুক স্বভাব পছন্দ করে না।
২• মানুষকে নারী ও পুরুষ এই দুই প্রকার সৃষ্টি করার অনস্বীকার্যতা প্রমাণিত হওয়ার পর এবার দেখা যাক তাদের মর্যাদার ক্ষেত্রে কোন তারতম্য আছে কিনা। মর্যাদার দিক দিয়ে আল্লাহর কাছে নারী বা পুরুষ বলে আলাদা কিছু নেই; পুরুষের বেশী মর্যাদা আর নারীর কম মর্যাদা, এমন নয়। সূরা আল হুজুরাতের ১৩নং আয়াতে আল্লাহতায়ালা বলেন, হে মানব সমাজ! আমি তোমাদেরকে একজন পুরুষ ও একজন নারী থেকে সৃষ্টি করেছি, তারপর তোমাদেরকে বিভিন্ন কাওম ও গোত্র বানিয়ে দিয়েছি যাতে তোমরা একে অপরকে চিনতে পারো। আল্লাহর কাছে তোমাদের মধ্যে তরাই (নারী হোক, পুরুষ হোক) বেশী সম্মানিত, যারা তাঁকে বেশী ভয় করে চলে। আল্লাহ সব কিছু জানেন, সবকিছুর খবর রাখেন।†সুতরাং আল্লাহর কাছে মর্যাদা বা সম্মানের মাপকাঠি হচ্ছে তাকওয়া বা আল্লাহ ভীতি।
যেসব মানুষ আল্লাহর কথা বা দীন মেনে চলে, তারা তাঁর কাছে শুধু সম্মানিতই নয় বরং তাদের জন্য রয়েছে ক্ষমা ও পুরস্কার। নিশ্চয়ই যেসব নারী ও পুরষ মুসলিম, মুমিন, আল্লাহর অনুগত, সত্য পথের পথিক, সবরকারী, আল্লাহর সামনে অবনত, দানশীল, রোযাদার , লজ্জাস্থানের হিফাজতকারী এবং আল্লাহকে বেশী বেশী স্মরণকারী, আল্লাহ তাদের জন্য মাগফিরাত ও বিরাট পুরস্কারের ব্যবস্থা করে রেখেছেন।†সূরা আল আহযাবঃ৩৫
মানুষ হিসেবে নারী-পুরুষ উভয়ই সমান, উভয়ের জাত একই, মানুষ জাত। সূরা আলে ইমরানের ১৯৫ নং আয়াতে বলা হয়েছে, “তোমরা পুরুষ হও বা নারী হও, আমি তোমাদের কারো আমল নষ্ট করবো না। তোমরা সবাই সমাজাতের লোক।â€
৩• দুনিয়ার সকল কাজ-কারবার পুরুষ করবে, আর নারী শুধু ঘবে বসে রানাÃ-বান্না করবে, এ রকম যাদের ধারণা তারা ভুল ধারণা পোষণ করেন। ইসলাম কখনো নারীকে চার দেয়ালে আবদ্ধ করেনি। মুসলিম সমাজ যদি তার কর্ম পরিসর সংকীর্ণ করে দেয়, সে জন্য ইসলাম দায়ী নয়। মুসলিম সমাজের অনেকে তো মদ খায়, ঘুষ খায়, কিন্তু ইসলাম কি তাদেরকে মদ, ঘুষ খেতে বলেছে? ঘরের বাইরেও যে নারীর কর্মক্ষেত্র প্রসারিত, তার প্রমাণ হিজাব বা পর্দা। ঘরের ভিতরে হিজাব পরার কোন প্রয়োজন আছে কি? নারীকে ঘরের বাইরে যেতে হবে বলেই ইসলাম তার সম্মান ও নিরাপত্তর জন্য পর্দার ব্যবস্থা করেছে। সূরা আত তওবার ৭১নং আয়াতে আল্লাহ বলেন, “মুমিন পুরুষ ও মুমিন নারীরা একে অপরের বন্ধু। তারা ভালো কাজের আদেশ দেয়, মন্দ কাজে বাধা দেয়, নামায কয়েম করে, যাকাত দেয় এবং আল্লাহ ও তাঁর রাসূলকে মেনে চলে। এরা এমন লোক যাদের উপর অবশ্যই আল্লাহর রহমত নাযিল হবে। নিশ্চয়ই আল্লাহ সর্বজয়ী ও সুবিজ্ঞ।†এ আয়াত থেকে বুঝা যায়, নারী ও পুরুষ উভয়ে নিজ নিজ বলয়ে একে অপরের বন্ধু ও সঙ্গী হয়ে সংসারে, সমাজে কাজ করবে।
নারীর প্রধান কর্মক্ষেত্র ঘর। ঘর কি শুধু রান্না-রান্নার কাজ? রান্না-বান্না তো পুরুষ বাবুর্চি রেখেও করানো যায়। ঘরের আসল কাজ হচ্ছে স্বামীকে নিয়ে ভালোবাসাপূর্ণ ও কলহমুক্ত একটি আদর্শ পরিবারের সূচনা করা। ছেলে-মেয়েকে সুশিক্ষা ও নৈতিক শিক্ষায় শিক্ষিত করে গড়ে তোলার জন্য আপ্রাণ চেষ্টা করা। বাবা যেহেতু বাইরে চাকুরী বা ব্যবসায় ব্যস্ত সেহেতু ঘরে সন্তানদেরকে সঠিক শিক্ষা দেয়া ও চরিত্র গঠন করার মতো বিরাট দায়িত্ব মাকেই পালন করতে হয়। বোকারাই এ মহান কাজকে ছোট করে দেখে। কোন ঘরে যদি নারীর বুদ্ধিমত্তা ও প্রচেষ্টায় শান্ত, ভদ্র ও পবিত্র পরিবেশ সৃষ্টি হয় এবং ছেলে-মেয়ে শিক্ষিত ও চরিত্রবান হয়, তবে তা একটি আদর্শ ঘর, আদর্শ পরিবার। আদর্শ পরিবারের সমম্বয়েই আদর্শ সমাজ গড়া সম্ভব। সমাজ আদর্শ হলেই কেবল আদর্শ রাষ্ট্র কায়েম করা যায়। ঘরের এই আসল দায়িত্বকে উপেক্ষা না করে কোন নারী যদি সময়- সুযোগ, মেধা ও যোগ্যতা অনুযায়ী সুইটেবল কোন চাকুরী বা ব্যবসা করে, তবে তা অতি উত্তম।
ইসলাম নারীকে ঘরের বাইরের কাজ করতে নিষেধ করেনি; নিষেধ করলে হিজাব ফরয হলো কেন? হিজাব তো ঘরের বাইরে প্রয়োজন, ঘরের ভিতরে নয়। ঘরের বাইরেও নারীর অনেক ভূমিকা রয়েছে বলেই পর্দার বিধান দেয়া হয়েছে। পর্দার প্রয়োজন আছে কিনা, তা মনে হয় আজকের এই সময়ে ব্যাখ্যা করার প্রয়োজন নেই। বৃটেনের এক খৃস্টান ছাত্রী হিজাব পরে কলেজে আসা-যাওয়া করলে তাকে তার কারণ জিজ্ঞেস করা হয়। জবাবে সে বলেছে, “পর্দা করলে নিরাপত্তা লাভ করি, রাস্তায় বখাটেরা আর বিরক্ত করে না।â€
৪• নারীর কল্যাণ বেশী কিসে, তা বেশী জানেন আল্লাহ তায়ালা, নারী নিজে নয়, পুরুষ তো নয়ই। নারী ও পুরুষের স্রষ্টা আল্লাহ, তিনি এদের স্বভাব-প্রকৃতি সম্যক অবগত। তাই সুস্পষ্ট জ্ঞানের ভিত্তিতেই তিনি নারী ও পুরুষকে জীবন -বিধান দিয়েছেন, যা মেনে চললে তারা উভয়েই ভালো থাকতে পারবে এবং পবিত্র ও আনন্দঘন জীবন যাপন করতে পারবে। আজকের নারী-পুরুষরা যেহেতু আল্লহকে ভুলে গেছে তাই তাঁর দেয়া দীন (জীবন-বিধান) তারা মেনে চলে না। ফলে সমস্যার পর সমস্যায় জড়িয়ে পড়ছে। বিশেষভাবে নারীরা। সে জন্য নারীর উচিত পুরষের তৈরি করা নিয়মে পদাঘাত করে আল্লাহর দেয়া নিয়ম গ্রহণ করা। নারীকে আল্লাহ সৃষ্টি করেছেন, তিনিই তার বড় হিতাকাংঙ্খী। তিনি তার ভালোর জন্যই বলছেনঃ
হে নবী! মমিন পুরুষদের বলো, যেন তারা নিজেদের চোখ (পর নারী থেকে) নিচু রাখে এবং তাদের লজ্জাস্থানের হিফাজত করে। এটাই তাদের জন্য বেশী পবিত্র নিয়ম তারা যা কিছু করে আল্লাহ তার খবর রাখেন। হে নবী! মুমিন নারীদেরকে বলো, তারা যেন চোখ নিচু রাখে ও তাদের লজ্জাস্থানের হিফাজত করে এবং রূপ-যৌবন যেন দেখিয়ে না বেড়ায়, ঐটুকু ছাড়া যা আপনা-আপনিই প্রকাশ হয়ে পড়ে। আর তারা যেন তাদের বুকের উপর উড়না জড়িয়ে রাখে।ঃ• তারা যেন তাদের গোপন সৌন্দর্য প্রকাশ করার উদ্দেশ্যে মাটির উপর জোরে পা ফেলে চলাফেরা না করে। হে মুমিনগণ! তোমরা সবাই আল্লাহর নিকট তওবা কর, আশা করা যায় যে, তোমরা সফলকাম হবে।â€
সূরা আন নূরঃ ৩০-৩১
পুরুষের তুলনায় নারীর চিরসুখের জান্নাত লাভ করা এবং ভয়াবহ শাস্তির জায়গা জাহান্নাম থেকে মুক্তি পাওয়া বেশী সহজ। আয়-রোজগারের দায়িত্ব তাকে দেয়া হয়নি। কিভাবে আয় করা হল, এ ব্যাপারে আল্লাহর কাছে তার কোন জবাবদিহি নেই। তাকে জবাবদিহি করতে হবে শুধু আল্লাহকে ভয় করে চলেছে কিনা, স্বামীর অনুপস্থিতিতে তার হক সে হিফাজত করেছে কিনা এবং সন্তানদের ইসলামের আঙ্গিকে গড়ে তোলার চেষ্টা করেছে কিনা।
৫• স্বভাবগতভাবেই নারী পুরুষের তুলনায় অনেক বেশী শান্ত ও ভদ্র। জটিল বিষয় ও ঝামেলার বিষয় থেকে সে সব সময় মুক্ত থাকতে চায়। এতে বুঝা যায় নারীকে সহজ-সরল করে সৃষ্টি করা হয়েছে। মুসলিম নারীকে একটি কথা খুব ভালোভাবে বুঝতে হবে। তা হলো, আল্লাহর বিধান মেনে চললেই কেবল দুনিয়ায় তার শান্তি, নিরাপত্তা , সম্মান ও অধিকার সুনিশ্চিত হবে এবং আখিরাতেও মুক্তি পাওয়া যাবে। আল্লাহর বিধান না মানায় নবীর স্ত্রী হওয়া সত্ত্বেও দুনিয়ার তাঁর শাস্তি থেকে, আখিরাতে দোযখ থেকে রেহাই পাওয়া সম্ভব হয়নি। সূরা আত তাহরীমের ১০নং আয়াতে বলা হয়েছে, আল্লাহ কাফিরদের ব্যাপারে নূহ ও লূতের স্ত্রীদের উদাহরণ পেশ করেছেন। তারা আমার দু’জন নেকবান্দার অধীনে ছিল কিন্তু তারা তাদের স্বামীদের সঙ্গে বিশ্বাসঘাতকতা করেছিল। তাই (তাদের স্বামীগণ নবী হওয়ার পরও ) আল্লাহর আযাব থেকে বাঁচার জন্য কোন উপকারে আসেনি। তাদের দু’ জনকে বলা হলো, জাহান্নামের দিকে যারা যাচ্ছে তাদের সাথে তোমরও জাহান্নামে যাও।â€
৬• ইসলামই নারীকে সঠিক মর্যাদা দিয়েছে। আরব দুনিয়ায় নারীর যখন এক পয়সার দামও ছিল না, যখন পুরুষরা তাকে শুধুই ভোগের জন্য ব্যবহার করতো, যখন কন্যা সন্তান জন্ম নেয়াকে অপমানজনক মনে করে তাকে জীবন্ত পুঁতে ফেলা হতো, তখন বিশ্বনবী মুহাম্মাদুর রাসূলুল্লাহই(সা) কেবল নারী ও পুরুষের সমান মর্যাদার কথা বললেন। তিনি আল্লাহর পক্ষ থেকে ঘোষণা করলেন, আর যে সৎ কাজ করবে, সে পুরুষ হোক বা নারী হোক,, যদি সে মুমিন হয়, তাহলে এমন লোকেরাই জান্নাতে প্রবেশ করবে এবং তাদের বিন্দু পরিমাণ হকও নষ্ট করা হবে না।†সূরা আন নিসাঃ ১২৪। স্বামী-স্ত্রীর সম্পর্ককে আল্লাহ পোশাকের সঙ্গে তুলনা করেছেন। পোশাকের সঙ্গে শরীরের সম্পর্ক যত নিবিড়, স্বামী-স্ত্রীর সম্পর্ক ততটাই নিবিড় হওয়া চাই। তারা হচ্ছে তোমাদের জন্য পোশাকস্বরুপ এবং তোমরাও তাদের জন্য পোশাকস্বরূপ।†সূরা আল বাকারাঃ১৮৭ মেয়েদেরও তেমনি ন্যায়সঙ্গত অধিকার আছে, যেমন তাদের উপর পুরুষদের অধিকার আছে।†সূরা আল বাকারাঃ ২২৮
সম্পদে নারীদের রয়েছে নির্ধারিত অংশ।â€সূরা আন নিসাঃ৭
৭• আল্লাহর দেয়া কোন বিধান যদি কোন মানুষের কাছে অযৌক্তিক বলে মনে হয়, তাহলে ধরে নিতে হবে তিনি তাঁর বিধানটি বুঝতে ভুল করেছেন। মহাজ্ঞানী আল্লাহর কোন বিধানই অযৌক্তিক হতে পারে না। তাই কোন বিষয়ে আল্লাহর দেয়া ফয়সালাকে বিনা প্রশ্নে মেনে নেয়াই হচ্ছে একজন মুসলিমের প্রধান বৈশিষ্ট্য। সূরা আল আহযাবের ৩৬ নং আয়াতে আল্লাহ বলেন, যখন আল্লাহ ও তাঁর রাসূল কোন বিষয়ে ফায়সালা করে দেন, তখন কোন মুমিন পুরুষ ও নারীর এ অধিকার থাকে না যে, সে ঐ বিষয়ে নিজে কোন ফয়সালা করবে। আর কেউ আল্লাহ ও রাসূলের নাফরমানী করে সে সুস্পষ্ট গুমরাহ।†আল্লাহর জ্ঞান হচ্ছে অসীম, তাঁর জ্ঞানে কোন ভুল নেই। সুতরাং তাঁর মীরাস বন্টন ব্যবস্থায়ও কোন ভুল নেই। আকাশের দিকে তাকালে আমরা কি দেখি? জগতসমূহ, নক্ষত্ররাজি চাঁদ-সূর্য সমেত গোটা ইউনিভার্স কি নির্ভুল জ্ঞান দ্বারা, কি নিপুন ভাবে পরিচলিত! কোথাও কি কোন ত্রম্নটি খুঁেজ পাওয়া যায়? দৃষ্টিরা অবসাদগ্রস্ত হয়ে ফিরে আসবে, ত্রম্নটি খুঁজে পাবে না
**************************