ক্রোধ নিয়ন্ত্রণ করবেন কিভাবে
ক্রোধ আসলে একটি সাধারণ সুস্থ মানবিক আবেগ। তবে অনিয়মিত ক্রোধ ক্ষতিকারক যা প্রায়ই দৈনন্দিন জীবনধারা, সাংসারিক সম্পর্ক ও জীবনের স্বাভাবিক গুণগতমান নষ্টসহ বিভিন্ন ধরনের সমস্যা তৈরি করে এবং আপনাকে ভাবতে বাধ্য করে যে, আপনি উন্মাত্ত আবেগ ও উত্তেজনা দ্বারা নিয়ন্ত্রিত একজন মানুষ..
ক্রোধ দ্বারা নিয়ন্ত্রিত হবার পূর্বে এর নিয়ন্ত্রণ
ক্রোধ কি? আমরা সবাই তা জানি এবং সাময়িক বিরক্তিবোধ বা উন্মাদ উত্তেজনায় আমরা তা অনুভবও করি।
ক্রোধ আসলে একটি সাধারণ সুস্থ মানবিক আবেগ। তবে অনিয়মিত ক্রোধ ক্ষতিকারক যা প্রায়ই দৈনন্দিন জীবনধারা, সাংসারিক সম্পর্ক ও জীবনের স্বাভাবিক গুণগতমান নষ্টসহ বিভিন্ন ধরনের সমস্যা তৈরি করে এবং আপনাকে ভাবতে বাধ্য করে যে, আপনি উন্মাত্ত আবেগ ও উত্তেজনা দ্বারা নিয়ন্ত্রিত একজন মানুষ।
ক্রোধ কি
ক্রোধের প্রকৃতিঃ ক্রোধ বিশেষজ্ঞ বিখ্যাত মনোবিজ্ঞানী ডাঃ চার্লস পিলবার্গার এর মতে ক্রোধ হলো এমন এক ধরনের আবেগ যা বিরক্তিবোধ থেকে গভীর আক্রোশে ও উন্মুক্ত উত্তেজনা পর্যন্ত বিস্তৃত। অন্যান্য আবেগ-এর মত ক্রোধও মানসিক ও জৈবিক পরিবর্তনের সাথে সম্পৃক্ত। ক্রোধান্ব্বিত হলে হৃদকম্পনও রক্তচাপ বৃদ্ধির সাথে সাথে বলদায়ক হরমোন এড্রেনালিন হরমোন ও নর এড্রেনালিক হরমোনের মাত্রাও বৃদ্ধি পায়।
আভ্যন্তরীণ ও বাহ্যিক উভয় বিষয়ই ক্রোধের কারণ হতে পারে। আপনি যেমন একজন বিশেষ ব্যক্তির উপর ক্রোধান্ব্বিত হতে পারেন (যেমন সহকর্মী বা তত্ত্বাবধায়ক) আবার তেমনি কোনো ঘটনাও আপনাকে ক্রোধান্ব্বিত করতে পারে (যেমন ট্রাফিক জ্যাম বা যাত্রা বিরতি) আপনার ব্যক্তিগত সমস্যার ভীতি ও বিষণ্নতাও অনেক সময় ক্রোধের কারণ হয়। তাছাড়া কোনো দুঃখজনক ঘটনা বা ক্ষোভের স্মৃতিও ক্রোধানুভূতিকে ত্বরান্ব্বিত করতে পারে।
ক্রোধের বহিঃপ্রকাশ
ক্রোধের সহজাত স্বাভাবিক বহিঃপ্রকাশ আক্রমণাত্মক। ক্রোধ কোনো হুমকি মোকাবেলায় একটি স্বাভাবিক প্রক্রিয়া যা অনেক সময় শক্তিশালী আক্রমণাত্মক ব্যবহারের মাধ্যমে আমাদেরকে বহিঃআক্রমণ থেকে রক্ষা করে। এই অর্থে ক্রোধের একটি নির্দিষ্ট মাত্রা আমাদের অস্তিত্ব রক্ষায় স্বাভাবিকভাবেই প্রয়োজনীয়। তবে একথা মনে রাখা দরকার যে, বিরক্তি উদ্বেগকারী যে কোনো ব্যক্তি বা বস্তুকে আমরা শারীরিকভাবে আক্রমণ করতে পারি না। আইন, সামাজিক রীতি, নীতি সাধারণ মানবিক বোধ আমাদের ক্রোধের মাত্রাকে নির্ধারণ করে দিয়েছে।
নিয়ন্ত্রিতভাবে ক্রোধ প্রকাশে মানুষ চেতন ও অচেতন বিভিন্ন পদ্ধতি অনুসরণ করে থাকে। এর মধ্যে ৩টি প্রধান কৌশল হলো প্রকাশ, অবসান ও শান্তকরণ।
প্রকাশঃ ক্রোধ প্রকাশের সাবলীর এবং গ্রহণযোগ্য ভঙ্গি হলো অনাক্রমণাত্মক দৃঢ় প্রত্যয়ন। এটা করতে গেলে আমাদের জানা উচিত কিভাবে অন্যের ক্ষতি না করে নিজের প্রয়োজন ও তা মেটানোর পদ্ধতির প্রচ্ছন্ন প্রকাশ করা যায়। তবে বিবেচ্য বিষয় হলো এ ধরনের প্রকাশ একতরফা নিজের প্রয়োজনকে অন্যের ওপর চাপিয়ে দেয়ার কোনো প্রায়াস নয় বরং নিজের অধিকারবোধ এবং অন্যের প্রতি কর্তব্যবোধেরই বহিঃপ্রকাশ।
অবসান
অনেক সময় ক্রোধ দমনও করা যায় এবং তা ভিন্ন খাতে প্রকাশিত করা যায়। কোনো ব্যক্তি বা বিষয় যদি ক্রোধের কারণ হয়; তবে তার সম্পর্কে চিন্তা না করে বরং কিছু গঠনমূলক বিষয়ে চিত্ত নিবিষ্ট করে ক্রোধ দমন করা সম্ভব তবে এই অবদমনমূলক পদ্ধতির কিছু নেতিবাচক দিক রয়েছে যেমন-অবদমিত ক্রোধ আভ্যন্তরীণ ক্রিয়া প্রতিক্রিয়ার মাধ্যমে হাইপার টেনশন, উচ্চ রক্তচাপ ও বিষণ্নতা সৃষ্টি করতে পারে। এছাড়াও অবদমিত ক্রোধ অনেক সময় মানসিক ব্যাধিতে রূপ লাভ করে। যেমন অযৌক্তিক পরোক্ষ বিরোধ প্রবণতা, অনর্থক শত্রুতা ও নৈরাশ্যতা ইত্যাদি। ক্রোধের গঠনমূলক বহিঃপ্রকাশে অপারগ ব্যক্তিরা অযথাই সমালোচনামূলক হয় এবং নৈরাশ্যতায় আচ্ছন্ন থাকে। তাদের পর্যাপ্ত সামাজিক সম্পর্কও থাকে না।
সুপ্তকরণঃ ক্রোধের সুপ্তকরণ বা আভ্যন্তরীণ প্রশান্তকরণের মাধ্যমে ক্রোধ নিয়ন্ত্রণ করা যায়। ক্রোধের শুধু বাহ্যিক প্রকাশ নিয়ন্ত্রণ না করে হৃদকম্পন নিয়ন্ত্রণ ও আবেগ প্রশমনের মাধ্যমে আভ্যন্তরীণ প্রতিক্রিয়া নিয়ন্ত্রণ করা যায়।
ডাঃ সিপলবার্গারের মতে-যখনই এই তিনটার কোনোটিই কার্যক্ষম না থাকে কেবল তখনই কোনো ব্যক্তি বা বস্তুর আঘাতপ্রাপ্ত হওয়ার সম্ভাবনা তৈরি হয়।
ক্রোধ ব্যবস্থাপনাঃ ক্রোধ ব্যবস্থাপনার উদ্দেশ্যে হলো ক্রোধ উদ্বেগকারী আবেগানুভূতি ও মানসিক উত্তেজনার প্রশাসন। আসলে বিরক্তিকর উদ্রেগকারী ব্যক্তি বা বস্তু থেকে আমরা সবসময় মুক্ত নই বা পরিহারও করতে পারি না আবার তা পরিবর্তনও করতে পারি না, সুতরাং এক্ষেত্রে যা করা যায় তা হলো আত্মনিয়ন্ত্রণ।
আপনি কি প্রচন্ড ক্রদ্ধ?
ক্রোধের মাত্রা ও তাড়না নির্ধারণ এবং এর নিয়ন্ত্রণ কৌশল উদ্ভাবনে মনোবৈজ্ঞানিক অনেক পরীক্ষা রয়েছে। আসলে ক্রোধজনিত সমস্যা সম্পর্কে আমাদের সকলেরই কমবেশি ধারণা রয়েছে। তবে ক্রোধ নিয়ন্ত্রণের বাইরে চলে গেলে বা ভয়াবহ রূপ লাভ করলে তা নিয়ন্ত্রণে সহজতর কৌশলগত সহযোগিতা লাভে মনোবৈজ্ঞানিক সহযোগিতা নেয়া যায়।
আপেক্ষিকভাবে কিছু লোক কেন ক্রোধপ্রবণ?
ক্রোধ ব্যবস্থাপনা বিশেষজ্ঞ মনোবিজ্ঞানী ডঃ ডেফেনবেকার-এর মতানুসারে কিছু লোক সত্যিকার অর্থেই অপেক্ষাকৃত ক্ষেপাটে প্রকৃতির; তারা সহজেই কোনো কারণে প্রচন্ড উত্তেজিত হয়ে পড়ে। আবার এমন অনেকেই আছেন যারা দৃষ্টকটুভাবে ক্রোধের বহিঃপ্রকাশ না ঘটালেও স্বাভাবিকভাবে বদমেজাজি ক্রোধপ্রবণ লোক সবসময়ই বেপরোয়া আচরণ করে না। অনেক সময়ই তারা নিজেদেরকে সামাজিকভাবে অন্তঃমুখী করে রাখে, গোমরামুখো হয় এবং শারীরিকভাবে অসুস্থ থাকে।
কোনো কোনো মনোবিজ্ঞানীর মতে সহজে ক্রোধপ্রবণ লোক প্রায়ইশ হতাশ থাকে এবং তাদের ধৈর্যের মাত্রাও নিম্ন। হতাশা, বিড়ম্বনা ও বিরক্তি সহসাই তাদেরকে বিচলিত করে, কোনো কিছুই তারা সহজভাবে নিতে পারে না। যে কোনো ধরনের অসঙ্গতেই দারুণ ভীত হয়ে পড়ে অর্থাৎ ছোটখাট ভুলেই তারা খেই হারিয়ে ফেলে। আসলে এর কারণও বহুবিধ একটি কারণ হতে পারে, বংশগত জৈবিক অনেক প্রমাণও মিলে। কিছু শিশু জন্মলগ্ন থেকেই খিটখিটে স্বভাবের হয় এবং আবেগ ও ক্রোধপ্রবণ হয়। অন্য আরেকটা কারণ হতে পারে সামাজিক। সাংস্কৃতিক ক্রোধকে প্রায়শই নেতিবাচক দৃষ্টিকোণ থেকে বিচার করা হয় এবং আমরা বলে থাকি যে, বিষণ্নতা, শঙ্কা, উদ্বেগ ও অন্যান্য আবেগ প্রকাশ স্বাভাবিক হলেও ক্রোধ অযৌক্তিক। ফলেও আমরা একদিকে যেমন ক্রোধ নিয়ন্ত্রণে ব্যর্থ হই অন্যদিকে সঠিক মাত্রায় এর প্রকাশ কৌশলও শিখতে পারি না।
ক্রোধ প্রকাশ হতে দেয়া কতটা যৌক্তিক
কোনো কোনো মনোবিজ্ঞানী ক্রোধ প্রকাশ হতে দেয়াকে ভয়াবহ যুক্তি বলে মনে করেন, অনেকেই এই তত্ত্বকে আক্রমণের বৈধ লাইসেন্স মনে করেন এবং গবেষকগণ দেখেছেন যে, ক্রোধকে সহজাত ভঙ্গিতে প্রকাশ হতে দিলে কোনো সমস্যাই সমাধান হয় না বরং ক্রোধ প্রবণতা বেড়ে যায়। ক্রোধের কারণ অনুসন্ধান করে এর নিয়ন্ত্রণ কৌশল উদ্ভাবনই এবং এর চর্চাই উত্তম।
ক্রোধ নিয়ন্ত্রণে বিভিন্ন কৌশল
শিথিলায়নঃ শিথিলায়নের সহজ পদ্ধতি যেমন গভীর শ্বাস-প্রশ্বাস ও শিথিল চিত্র কল্পনা ক্রোধানুভূতি কমাতে সহায়তা করে। শিথিলায়নের ওপর বিভিন্ন বই ও প্রশিক্ষণ পদ্ধতি রয়েছে যা শিথিলায়নের কৌশল শিখাতে সহায়তা করে। যে কোনো উত্তজনার মুহর্তে এসব কৌশলের প্রয়োগ করে ক্রোধ নিয়ন্ত্রণ করা যায়, বিশেষ করে পারসপরিক সম্পর্কের ক্ষেত্রে কৌশলগুলোর প্রয়োগ বেশ সাফল্যজনক।
শিথিলকরণের সহজ কিছু স্তর
মধ্যচ্ছদা থেকে গভীর শ্বাস-প্রশ্বাস নেয়া। এক্ষেত্রে মনে রাখা প্রয়োজন যে, শুধু বক্ষদেশ থেকে নয় বরং অন্ত থেকে শ্বাস-প্রশ্বাস নেয়া প্রয়োজন।
মনে মনে শিথিল বা সহজবোধ করা এবং বারংবার এর চর্চা করা।
সহজ পদ্ধতির যোগ ব্যায়াম চর্চা করা যা পেশিকে শিথিল ও অনুভূতি শান্ত করে। কৌশলগুলোর প্রাত্যহিক চর্চা উত্তেজনা প্রশমনে স্বংক্রিয়ভাবে সহায়তা করে।
চিন্তা চেতনার পরিবর্তন
চিন্তা চেতনার পরিবর্তন করতে হবে। রাগী ব্যক্তিরা সাধারণত উচ্চস্বরে কথা বলে অযথা চিৎকার করে, অভিমান করে অহেতুক প্রতিজ্ঞা করে। ক্রোধান্ব্বিত হয়ে সবকিছুতেই বাড়াবাড়ি ও নাটকীয় ভঙ্গি করে থাকে এবং ভাবনা চিন্তায়ও নাটকীয় পরিবর্তন আসে। যৌক্তিক চিন্তা ক্রোধ দমনে বিশেষ সহায়তা করে। ভাব প্রকাশে দুঃখজনক, ভয়ানক, ধ্বংসাত্মক এসকল উত্তেজক শব্দ পরিহার করে যথাসম্ভব কোমল শব্দের ব্যবহার করে সবকিছুই সহজভাবে গ্রহণ করা ক্রোধ দমনে সহায়ক।
কখনোই না ‘সবসময়ই’ এসব শব্দের ব্যবহারে সতর্ক হওয়া উচিত। এসকল শব্দের যথেচ্ছা ব্যবহার আপনার একজন ভালো হিতৈষীও নষ্ট করতে পারে। ধরা যাক, আপনার কোনো বন্ধু সব সময় দেরি করার কারণে আপনি যদি তাকে বকেন ‘তুমি কোনো সময়ই কথা দিয়ে কথা রাখ না, তুমি একজন কান্ডজ্ঞানহীন/কর্তব্য জ্ঞানহীন’ তাহলে এসব অপমানকর শব্দ সমস্যার সমাধান না করে বরং ক্ষতির কারণ হতে পারে। বরং উদ্দেশ্য সাধনে আপনার কুশলী হওয়া উচিত। মনে রাখতে হবে ক্রোধানুভূতি কখনোই মানসিক স্বস্তি আনে না।
যুক্তির কাছে ক্রোধ সবসময়ই পরাভূত হয়। সুতরাং চিন্তায় সবসময় যৌক্তিক হওয়া উচিত। আপনি সবসময়ই সংসারের কোনো না কোনো বৈরী পরিবেশের সম্মুখীন। সুতরাং এই বৈরী পরিবেশ থেকে ক্রুদ্ধ না হয়ে বরং যুক্তিসহকারে বা গঠনমূলকভাবে মোকাবিলা করলে জীবন ধারণে স্থিতিশীলতা আসবে।
আমরা স্বাভাবিকভাবে যা কিছু ভালো, সুন্দর এবং অনুকূল তাই প্রত্যাশা করি। ক্রোধ প্রবণ লোকেরা এর ব্যাত্যয় ঘটলে সহজেই উত্তেজিত হয়ে পড়ে। এই জন্য তাদেরকে তাদের আকাক্ষা সম্পর্কে সচেতন হওয়া উচিত। যা চাই তা পেতেই হবে এ ধরনের মনোভাব পরিহার করে চাওয়া-পাওয়ার ক্ষেত্রে মেনে নেয়ার মানসিক প্রবণতা তৈরি করতে হবে।
কোনো কিছু না পেলে হতাশ হওয়া বা দুঃখ পাওয়া স্বাভাবিক, কিন্তু্তু ক্রোধান্ধ হওয়া অযৌক্তিক।
অনেকেই ক্রোধকে আত্মতুষ্টির মাধ্যম হিসেবে ব্যবহার করলেও আসলে প্রকৃতার্থে ক্রোধ দ্বারা আত্মতুষ্টি অসম্ভব।
(চলমান)