শীর্ষ কর্মকর্তাদের দুর্নীতি আর কর্মকর্তা নিয়োগে তদবির এ দুয়েই ব্যাংকিং খাত শেষ হচ্ছে। হলমার্ক, বিসমিল্লাহ, বেসিকসহ ব্যাংকিং খাতে বড় আর্থিক কেলেঙ্কারির ঘটনায় জড়িত কর্মকর্তাদের বিরুদ্ধে শাস্তিমূলক ব্যবস্থা নেওয়ার ইচ্ছা থাকলেও ব্যাংকের মানব সম্পদ বিভাগ তা করতে পারেনি। শীর্ষ মহলের যোগসাজশে এমনটি হয়েছে বলে মনে করেন ব্যাংক খাত সংশ্লিষ্ট ব্যক্তিরা। এছাড়া তদবিরের চাপে রয়েছে দেশের অর্থনীতির বড় এ খাত। খাতটিতে তদবির ছাড়া এখন আর কোনো নিয়োগ হয় না। অনেক ক্ষেত্রে ব্যাংকের ভেতরে লবিস্টদের জন্য পদও সৃষ্টি করতে হচ্ছে। আর ব্যাংকিং খাতে নৈতিকতা কাগজে-কলমে আছে, বাস্তবে নেই।
গতকাল বৃহস্পতিবার রাজধানীর মিরপুরে বাংলাদেশ ইনস্টিটিউট অব ব্যাংক ম্যানেজমেন্ট (বিআইবিএম) আয়োজিত এক কর্মশালায় বক্তারা এসব কথা বলেন। কর্মশালার প্রথম পর্বে বাংলাদেশ ব্যাংকের ডেপুটি গভর্নর আবু হেনা মোহা. রাজী হাসান ও শেষ পর্বে সাবেক ডেপুটি গভর্নর খোন্দকার ইব্রাহিম খালেদ প্রধান অতিথি হিসেবে বক্তৃতা করেন।
বিআইবিএমের মহাপরিচালক ড. তৌফিক আহমদ চৌধুরীর সভাপতিত্বে কর্মশালায় অন্যান্যের মধ্যে মার্কেন্টাইল ব্যাংকের সাবেক ব্যবস্থাপনা পরিচালক (এমডি) এম. এহসানুল হক, পূবালী ব্যাংকের সাবেক এমডি ও বিআইবিএমের সুপারনিউমারারি অধ্যাপক হেলাল আহমেদ চৌধুরী, সুপারনিউমারারি অধ্যাপক ইয়াছিন আলী ও ওয়ান ব্যাংকের অতিরিক্ত উপ-ব্যবস্থাপনা পরিচালক (এএমডি) জন সরকার বক্তব্য রাখেন। মূল প্রবন্ধ উপস্থাপন করেন বিআইবিএমের সহযোগী অধ্যাপক মোহাম্মদ তাজুল ইসলামের নেতৃত্বাধীন পাঁচ সদস্যের দল।
কর্মশালায় খোন্দকার ইব্রাহিম খালেদ বলেন, ব্যাংকিং খাতের শ্রেষ্ঠ ব্যাংক ছিল রাষ্ট্রায়ত্ত বেসিক ব্যাংক। কিন্তু দুর্নীতিবাজ শীর্ষ কর্মকর্তাদের কারণে মাত্র ৩ বছরেই ব্যাংকটি শেষ হয়ে গেছে। সোনালী এবং বেসিক ব্যাংকের উদাহরণ টেনে তিনি বলেন, এসব ব্যাংকের সাবেক দুর্নীতিপরায়ণ কর্মকর্তাদের মতো বর্তমানে কাউকে নিয়োগ দিলে সে ভালো ব্যাংককেও শেষ করে দেবে। তিনি বলেন, কর্মকর্তাদের প্রশিক্ষণের ব্যবস্থা করা হয় না। তিনি বলেন, আগে ৬ মাসব্যাপাী বুনিয়াদি প্রশিক্ষণ দেওয়া হতো। এখন সেটা ১৫ দিনে নামিয়ে আনা হয়েছে। তার মতে, ১৫ দিনে কোনো বুনিয়াদি প্রশিক্ষণ হতে পারে না। ব্যাংকিং খাতে কাগজে-কলমে নৈতিকতা থাকলেও বাস্তবে এর কোনো চর্চা নেই।
আবু হেনা মোহা. রাজী হাসান বলেন, অনভিজ্ঞতার ভিড়ে দক্ষ কর্মকর্তার সংকট সৃষ্টি হয়েছে। এতে করে নতুন নতুন ঝুঁকি তৈরি হচ্ছে। ব্যাংকিং খাতের পরিসর ও আকার বেড়েছে। কিন্তু দক্ষ কর্মকর্তার সংকট কাটেনি। প্রতিবছরই অনেক কর্মকর্তার বিরুদ্ধে শৃঙ্খলা ভঙ্গের অভিযোগ উঠছে।
অধ্যাপক হেলাল আহমেদ চৌধুরী বলেন, ব্যাংকে অনেক লবিস্ট রয়েছে। এদের কারণে অনেক নতুন পদ সৃষ্টি করতে হয়। যা পুরোপুরি ইচ্ছার বিরুদ্ধে। মূলত সব ব্যাংকেই লবিস্ট গোষ্ঠী থাকে। তারা লবিং করে নিয়োগ পেতে এবং দিতে চায়। বিভিন্ন পরিচালকের বরাত দিয়ে তারা আসেন।
অধ্যাপক ইয়াছিন আলী বলেন, ব্যাংকে নিয়োগের ক্ষেত্রে সতর্ক থাকতে হবে। অসত্ কর্মকর্তা নিয়োগ পেলে সর্বনাশ হয়ে যাবে। এক্ষেত্রে সবাইকে নৈতিকতা মেনে চলার আহ্বান জানান তিনি।
এম এহসানুল হক বলেন, ব্যাংকিং খাত তদবিরের চাপে রয়েছে। এতো তদবির আসে যে, অনেক সময় সঠিক নিয়োগ দেওয়া কঠিন হয়ে যায়। তিনি বলেন, মানব সম্পদের সঠিক নীতিমালা কোনো ব্যাংকে নেই। যদি কারও থেকে থাকে, তারও সঠিক চর্চা হয় না। দীর্ঘ ব্যাংকিংয়ের অভিজ্ঞতার কথা উল্লেখ করে তিনি বলেন, গ্রাম পর্যায়ের শাখা ব্যবস্থাপকদের ব্যাপক সেচ্ছাচারিতা লক্ষ্য করা যায়। একদিকে গ্রাহক, অন্যদিকে নিম্নপর্যায়ের কর্মকর্তা; সবার সঙ্গে বিরূপ আচরণ করেন শাখা ব্যবস্থাপক। কেউ কেউ নিজেকে রাজা মনে করেন। এগুলো বন্ধ করতে হবে।