প্রবল বর্ষণ ও ভয়াবহ বন্যায় বাংলাদেশের প্রত্যন্ত অঞ্চল প্লাবিত। দেশের বিভিন্ন এলাকার সাধারণ মানুষ মানবেতর জীবন যাপন করছে। ঘরবাড়ি হারিয়ে অনাহারে-অর্ধাহারে দিন কাটাচ্ছে। বন্যাপীড়িত অসহায় মানুষের আর্তনাদে পরিবেশ ভারী হয়ে উঠছে। এহেন দুর্যোগপূর্ণ পরিস্থিতিতে দুর্গত মানুষের পাশে দাঁড়ানো সব সামর্থ্যবান ও বৃত্তবানের মানবিক, নৈতিক ও ঈমানি দায়িত্ব।
আল্লাহ তাআলা আমাদের এ পৃথিবীতে পাঠিয়েছেন তাঁর ইবাদতের জন্য। নামাজ, রোজা, হজ পালন ও জাকাত আদায় শুধু ইবাদত নয়; বরং মানুষের সেবা করা, অসহায় ও বিপদগ্রস্তদের পাশে দাঁড়ানোটাও একটি গুরুত্বপূর্ণ ইবাদত। মানুষের দুর্যোগপূর্ণ মুহূর্তে আমরা যদি তাদের পাশে দাঁড়াতে না পারি, আমাদের অবহেলায় যদি কোনো মানুষ না খেয়ে ও বিনা চিকিৎসায় পানিবন্দি হয়ে মৃত্যুবরণ করে, তাহলে আল্লাহর সামনে কোন মুখ নিয়ে আমরা দাঁড়াব? হাদিসে কুদসিতে এসেছে, ‘কিয়ামতের দিন মহান আল্লাহ বলবেন, হে বনি আদম! আমি রোগাক্রান্ত হয়েছিলাম, তুমি আমাকে দেখতে যাওনি! বান্দা বলবে, হে আমার প্রভু! আমি কেমন করে আপনার রোগের খবর নেব? আপনি যে বিশ্বজাহানের প্রভু! তিনি বলবেন, তুমি কি জানতে না যে আমার অমুক বান্দা রোগাক্রান্ত ছিল, তুমি কি তাকে দেখতে গিয়েছ? তুমি যদি তাকে দেখতে যেতে, তাহলে তুমি আমাকে অবশ্যই তার কাছে পেতে। হে বনি আদম! আমি তোমার কাছে খাবার চেয়েছিলাম, কিন্তু তুমি আমাকে খাবার দাওনি। বান্দা বলবে, হে আমার প্রভু! আমি কেমন করে আপনাকে খাওয়াব? আপনি যে সমগ্র বিশ্বজাহানের মালিক ও প্রতিপালক! মহান আল্লাহ বলবেন, আমার অমুক বান্দা তোমার কাছে খাবার চেয়েছিল, কিন্তু তুমি তাকে খাওয়াওনি? তুমি কি জানতে না যে তুমি যদি তাকে খাবার খাওয়াতে, তাহলে আমার কাছে তা পেতে। হে বনি আদম! আমি তোমার কাছে পানি চেয়েছিলাম, কিন্তু তুমি আমাকে পানি পান করাওনি।
বান্দা বলবে, হে আমার প্রভু! আমি কেমন করে আপনাকে পানি পান করাব? আপনি যে সমগ্র বিশ্বজাহানের প্রভু। মহান আল্লাহ বলবেন, আমার অমুক বান্দা তোমার কাছে পানি চেয়েছিল, তুমি তাকে পানি পান করাওনি! তুমি যদি তখন তাকে পানি পান করাতে, তাহলে আজ আমার কাছে তুমি তা পেতে। ’ (মুসলিম, হাদিস : ৬৭২১)
মানবসেবায় মহানবী (সা.)-এর ভূমিকা
আল্লাহ তাআলা রাসুল (সা.)-কে ‘রাহমাতুল্লিল আলামিন’ তথা গোটা বিশ্বের জন্য দয়া ও করুণার মূর্তপ্রতীক হিসেবে ঘোষণা করেছেন। ইরশাদ হয়েছে, ‘আমি আপনাকে বিশ্ববাসীর জন্য রহমতস্বরূপই প্রেরণ করেছি। ’ (সুরা : আম্বিয়া, আয়াত : ১০৭)
এ দয়া ও কল্যাণকামিতায় শামিল হতে সব মুসলমানের প্রতিও তিনি আহ্বান জানিয়ে বলেছেন, ‘তোমরা দুনিয়াবাসীদের ওপর দয়া করো, আসমানের বাসিন্দা তোমাদের ওপর দয়া করবেন। ’ (তিরমিজি, হাদিস : ১৯২৪) রাসুল (সা.) আরো বলেন, ‘যে ব্যক্তি মানুষের প্রতি দয়া করে না, আল্লাহ তার প্রতি দয়া করেন না। ’ (কানজুল উম্মাল, হাদিস : ৫৯৭১)
রাসুল (সা.) আরো বলেছেন, ‘কোনো বান্দা যতক্ষণ তার ভাইয়ের সাহায্যরত থাকে, ততক্ষণ আল্লাহ তাকে সাহায্য করতে থাকেন। ’ (তিরমিজি, হাদিস : ১৯৩০)
এ হাদিসগুলোতে আল্লাহর রহমত, দয়া ও সাহায্যপ্রাপ্তির জন্য মানুষের প্রতি ব্যাপক সাহায্য-সহযোগিতার শর্ত জুড়ে দেওয়া হয়েছে।
মানুষ মানুষের জন্য
মানুষের জন্য মানুষ—এর সার্থক বাস্তবায়ন রয়েছে ইসলামী অনুশাসনের মধ্যে। প্রতিবেশীকে অভুক্ত রেখে পূর্ণ আহারকারীর ঈমানকে বলা হয়েছে ত্রুটিপূর্ণ ও অসম্পূর্ণ। মহানবী (সা.) ইরশাদ করেন, ‘ওই ব্যক্তি পরিপূর্ণ মুমিন নয়, যে তৃপ্তি সহকারে আহার করে অথচ তার প্রতিবেশী থাকে ক্ষুধার্ত। (শুয়াবুল ঈমান, হাদিস : ৫৬৬০) রাসুল (সা.) একদিন আবু যর (রা.)-কে বললেন, ‘হে আবু যর! তুমি যখন তরকারি পাকাও, তখন তাতে একটু বেশি পানি দিয়ে ঝোলটা বাড়িয়ে নিয়ো এবং তোমার প্রতিবেশীকে তা পৌঁছে দিয়ো। ’ (মুসলিম, হাদিস : ৬৮৫৫)
ইসলাম নিঃস্ব, অসহায়, অভাবী ও দুর্দশাগ্রস্ত মানুষের বিপন্ন অবস্থা থেকে উদ্ধার করার জন্য প্রয়োজনীয় ব্যবস্থা গ্রহণ করতে এবং তাদের ক্ষুধা, তৃষ্ণা, কষ্ট দূর করতে নির্দেশ দিয়েছে। ব্যাপকভাবে সাহায্য করার ক্ষমতা না থাকলে তরকারির কিছু ঝোল দিয়ে হলেও মানুষের পাশে দাঁড়াতে বলা হয়েছে। এ জন্য কোরবানির বাজেট কমিয়ে হলেও বন্যাপীড়িত অসহায় মানুষগুলোর কষ্ট ভাগাভাগি করে নেওয়া উচিত। পৃথিবীর কোথাও কোনো মানুষ বিপদগ্রস্ত হলে মানুষ হিসেবে তার বিপদে এগিয়ে যাওয়া আমাদের দায়িত্ব। রাসুল (সা.) সব মুসলমানকে একটা দেহের সঙ্গে তুলনা করে বলেছেন, ‘পারস্পরিক ভালোবাসা, দয়া-মায়া ও স্নেহ-মমতার দিক থেকে গোটা মুসলিম সমাজ একটি দেহের সমতুল্য। যদি দেহের কোনো বিশেষ অঙ্গ অসুস্থ হয়ে পড়ে, তাহলে অন্যান্য অঙ্গ-প্রত্যঙ্গেও তা অনুভূত হয়; সেটা জাগ্রত অবস্থায়ই হোক কিংবা জ্বরাক্রান্ত অবস্থায়। ’ (মুসলিম, হাদিস : ৬৭৫১)
অনুদান হতে হবে নিঃস্বার্থ
ইসলামে বিপন্ন মানবতার সেবায় এগিয়ে আসার জোর তাকিদ দেওয়া হয়েছে। দুর্গত ও বিপন্ন মানুষকে সাহায্য-সহযোগিতা করা, খাদ্য, আবাসন, বস্ত্র, চিকিৎসাসামগ্রী দিয়ে সহায়তা করে মানবসেবায় নিয়োজিত থাকাও আল্লাহর ইবাদত বলে স্বীকৃত। এ ব্যাপারে রাসুল (সা.) বলেছেন, ‘কবুল হজ হলো খাদ্য খাওয়ানো এবং সুন্দর কথা বা ভালো আচরণ করা। ’ (কানজুল উম্মাল, হাদিস : ১১৮৮১)
তাই অসহায় মানুষকে সাহায্য করার দ্বারা দানশীলতা ফলাও করা বা রাজনৈতিক প্রচারণা যেন উদ্দেশ্য না হয়। এমনভাবে অনুদানের ব্যবস্থা করা যাবে না, যাতে গ্রহীতাকে মানসিক কষ্টের সম্মুখীন হতে হয়। আবার গ্রহীতা যেন কোনোভাবেই হেয়প্রতিপন্ন না হয়, সেদিকেও লক্ষ রাখতে বলা হয়েছে, ‘যারা আল্লাহর রাস্তায় ধনৈশ্বর্য ব্যয় করে কথা বলে বেড়ায় না এবং ক্লেশও দেয় না, তাদের পুরস্কার তাদের রবের কাছে আছে। তাদের কোনো ভয় নেই এবং তারা দুঃখিতও হবে না। ’ (সুরা : বাকারা, আয়াত : ২৬২)
এখানে দল-মত-নির্বিশেষে সব বিপন্ন মানবতার সেবায় এগিয়ে আসার জন্য আহ্বান জানানো হয়েছে। শুধু নাম-যশের মানসিকতা নিয়ে দান করলে তাতে আল্লাহর সন্তুষ্টি পাওয়া যাবে না। দান করতে হবে দুর্দশাগ্রস্ত মানুষের দুর্গতি ও তাদের অসহায়ত্ব লাঘব করার পরিকল্পিত লক্ষ্য নিয়ে।
Source: লেখক : পশ্চিম আফ্রিকার মালি প্রবাসী আলেম